অভিশপ্ত হোস্টেল

অভিশপ্ত হোস্টেল

রুবি সরকারী মহিলা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ১ম বর্ষের ছাত্রী। তার বাড়ি আগৈলঝড়া, সেখান থেকে শহরে এসে কলেজের হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করছে। তার বাবার আগৈলঝড়া বাজারে একটি মুদি দোকান রয়েছে। সেই দোকানের আয় থেকেই তাদের সংসার চলে। কলেজের হোস্টেলে না থেকে, কোন মেসে বা ঘর ভাড়া করে থাকার মত অর্থনৈতিক সামর্থ্য তার নেই। যদি থাকত তা হলে সে অনেক আগেই হোস্টেল ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেত।

তিন তলা ও দুই তলা দুইটি হোস্টেল বিল্ডিং, সুবিশাল কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যেই। দুটি বিল্ডিংয়ের একটি পুরানো বিল্ডিং, অন্যটি নতুন বিল্ডিং নামে পরিচিত। পুরানো বিল্ডিংটি উত্তর দিকে আর নতুন বিল্ডিংটি পূর্বপাশে। বড় বড় গাছপালা ঘেরা কলেজ ক্যাম্পাসের চারপাশ। শুধু কলেজের অফিস ঘর এবং পাঁচতলা মূল ভবনটির সামনে ছোট্ট করে একটা ফুলের বাগান। ছায়া ঘেরা, পাখি ডাকা, হালকা মৃদু মন্দ হাওয়া বয়ে যাওয়া কলেজ ক্যাম্পাস। ক্লাসের ফাঁকে মেয়েদের কণ্ঠের কলকাকলিতে ভরে ওঠে সারা ক্যাম্পাস। ক্লাস শেষে বিকেলের পর থেকে, পরের দিন সকাল দশটা পর্যন্ত এবং ছুটির দিনগুলোতে নীরব নিভৃতই থাকে ক্যাম্পাস। শুধু হোস্টেল দুটিতে থাকা মেয়েগুলোর হাসি ঠাট্টার শব্দ পাওয়া যায় মাঝে মাঝে।

কলেজের পরিবেশ, পরিস্থিতি, নিয়ম-কানুন সবই পছন্দ হয়েছে রুবির। কলেজটি মহিলা কলেজ বলে অফিস টাইম ছাড়া কোন পুরুষ লোক ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারে না। কোন মেয়ের কোন আত্মীয়, ভাই বা বাবা দেখা করতে আসলেও ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। গেটে দারোয়ানের কাছে স্লিপ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। পরে ওই মেয়েটি এসে দেখা করে যায়। এই নিয়মও আবার রাত আটটা পর্যন্ত। আটটার পর থেকে কোন মেয়ে গেটের বাইরে যেতে পারবে না, শুধু বিশেষ প্রয়োজনে হোস্টেল সুপার জাহানারা ম্যাডামের লিখিত অনুমতি ছাড়া।

সব কিছুই ঠিক ছিল, সবই পছন্দ হয়েছিল রুবির। শুধু পুরানো বিল্ডিংয়ের হোস্টেলে তার সিট পড়েছে বলে তার মনের মধ্যে এক ধরনের চাপা ভয় কাজ করছে। পুরানো বিল্ডিংয়ের দুই তলার ২১ নং রুমে তার সিট পড়েছে, তার রুমমেট ঝর্না নামের আর একটি মেয়ে। রুম নিয়েও সমস্যা নেই, সমস্যাটা হচ্ছে পশ্চিম দিকের একেবারে শেষ মাথার গাছ- গাছালি ঘেরা বাথরুমটা নিয়ে। আর এই বাথরুমটার একটু দূরত্বের রুমটাই হচ্ছে ২১ নং রুম। দুই তলায় থাকা সব মেয়েরাই নির্বিঘ্নে ওই বাথরুমটিই ব্যবহার করে। কিন্তু ওই বাথরুম সম্পর্কে অনেক ভীতিকর কথা শোনা যায়। বাথরুমটায় মাঝে মাঝে নাকি ভৌতিক কর্মকাণ্ড হয়। হোস্টেলের প্রাক্তন অনেক ছাত্রীর ওই বাথরুম সম্পর্কে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে এগুলো শোনা কথা, সাক্ষী-প্রমাণ নেই। কিন্তু কলেজের অধিকাংশ ছাত্রী, শিক্ষক, কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করে ওই হোস্টেলটায় কিছু একটা অপার্থিব ব্যাপার রয়েছে।

শোনা যায় হোস্টেলের আগের অনেক মেয়েই নাকি বলেছে ওই বাথরুমে কেমন যেন একটা অশরীরী অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। অনেক রাতে মেয়েরা ওই বাথরুম থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পেয়েছে। মেয়ে মানুষের কান্নার শব্দ। হঠাৎ কান্নার শব্দ ছাপিয়ে অট্টহাসির শব্দ। এমন কী দিনের বেলায়ও মেয়েরা ভয় পেয়েছে। একবার ঈদের আগে আগে, অধিকাংশ মেয়েরাই বাড়ি চলে গেছে, এমন এক ভর দুপুরে, এক মেয়ে একা একা বাথরুমে যায়। মেয়েটা বন্ধ বাথরুমের ভিতরে, হঠাৎ দেখতে পায়, বাথরুমের ভিতরটা কেমন যেন ধোঁয়া-ধোঁয়া ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে তীব্রভাবে পচা মাংস পোড়া গন্ধ। মেয়েটা ভয় পেয়ে জলদি করে বাথরুমের দরজার ছিটকিনি খুলতে চায়, কিন্তু সে দেখতে পায় ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকানো একটা অদৃশ্য হাত তার হাতটা চেপে আছে। মেয়েটা প্রাণপণে চিৎকার শুরু করে, তখন অন্য মেয়েরা এসে দরজা ধাক্কাধাক্কি শুরু করলে, মেয়েটা কোনভাবে দরজা খুলে বাইরে এসে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এর পর ওই মেয়ে আর কখনও হোস্টেলে থাকেনি 1

হোস্টেলের ওই বাথরুমটা সম্পর্কে সব ছাত্রীই কিছু না কিছু জানে। অনেকে বলে এই হোস্টেলটা এক সময় এক জমিদারের বাগান বাড়ি ছিল। সে বিভিন্ন কুমারী মেয়েদের এখানে ধরে নিয়ে এসে নির্যাতন করত অনেক মেয়ে কষ্ট সইতে না পেরে ওই বাথরুমে ঢুকে গায়ে কেরসিন মেখে, আগুনে পুড়ে আত্মহত্যা করেছে। ওই মেয়েদের অতৃপ্ত আত্মাই নাকি এখনও এই হোস্টেলে রয়ে গিয়েছে। আবার অনেক ছাত্রীরা বলে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও এই বিল্ডিংটি মেয়েদের হোস্টেলই ছিল, হিন্দু মেয়েদের হোস্টেল। এক রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এসে, হোস্টেলের মেয়েদের জিম্মি করে, একের পর এক নির্যাতন চালিয়ে যায়। অনেক মেয়ে নিজেকে বাঁচাতে ওই বাথরুমের ভিতর লুকিয়ে থাকে, শেষমেশ উপায় না দেখে, বাথরুমে থাকা ব্লেড দিয়ে হাত পায়ের শিল্প। কেটে আত্মহত্যা করে। পরে ডোমেরা যখন লাশ উদ্ধার করে তখন ওই বাথরুমের মধ্যে দেখতে পেয়েছিল পাঁচটি তরুণী কী ভাবে ভয়ে জড়সড় হয়ে, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে রক্তে রঞ্জিত হয়ে, ভীত অবাক চোখে মরে পড়ে আছে। তাই অনেকে বলে ওই পাঁচটি মেয়ের আত্মাই এখন ওই অভিশপ্ত বাথরুম ঘিরে রয়েছে।

রুবি বাথরুম সম্পর্কে এত কিছু শুনে, ভয়ে একেবারে তটস্থ হয়ে থাকে। এই হোস্টেলেই তার থাকতে ইচ্ছে করে না। তার পরও, কী করার, উপায় নেই, এখানেই থাকতে হবে। তবে তার রুমমেট ঝর্না নামের মেয়েটি খুবই সাহসী। ভূত বলে যে পৃথিবীতে কিছু আছে তা এই মেয়েটি বিশ্বাসই করে না। রুবি কখনও যদি ভূত সম্পর্কে কিছু বলে ঝর্নাকে, তবেই হলো, ‘ভূত এসে তোকে চুমু খাবে, জড়িয়ে ধরবে, আদর করবে, তারপর…হা…হা।

গভীর রাতে রুবির যখন টয়লেট পায় তখন ঝর্নার যাওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকে, একা বাথরুমে যেতে ভয় লাগে বলে। ঝর্না চটির পটর-পটর শব্দ তুলে হিন্দি গান গাইতে-গাইতে বাথরুমের দিকে এগোতে থাকে, আর তার পাশে জড়সড় রুবি কুঁজো হয়ে হাঁটতে থাকে। একজন বাথরুমের ভিতরে গেলে অন্য জন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। ঝর্না যখন বাথরুমের ভিতরে থাকে আর রুবি দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে তখনও শুনতে পায় বাথরুমের ভিতরে ঝর্না গুন-গুন করে হিন্দি গান গেয়েই চলেছে।

ঝর্নার মত সাহসী একটা মেয়ে পাশে থাকায়, রুবির হোস্টেলের দিনগুলো ভালই কাটছিল। আরও জানতে পেরেছে সে বিগত সাত-আট বছরে কোন মেয়ে ভৌতিক কিছুই দেখতে পায়নি। হোস্টেলের সাহসী মেয়েদের মন্তব্য ভূত সম্পর্কিত এসব কথা স্রেফ গুজব। রুবি আজকাল বেশ সাহসী হয়ে উঠেছে। সন্ধ্যার পর ছাড়া দিনের বেলাতে একাই সাবলীলভাবে বাথরুম ব্যবহার করে।

এমনই একদিন দুপুরে, দুটো বা আড়াইটা বাজে। রুবি এক বান্ধবীর বাসা থেকে হোস্টেলে ফিরেই গোসল করার জন্য বাথরুমে গিয়েছে। ট্যাপের নীচে বড় একটা বালতি রেখে মাথা নুইয়ে, মাথায় পানি দিচ্ছে। আর ভাবছে, আজ যে বান্ধবীর বাসায় গেল তার কথা। বান্ধবীটি কতই না সুখে আছে, এখানে স্থানীয় বাড়ি ঘর, প্রতিদিন রিকশা করে কলেজে আসে আবার বাসায় ফিরে যায়, মায়ের হাতের রান্না খেতে পারে। বাবা-মা, ভাইয়ের আদরে কতই না সুখী জীবন মেয়েটার। আর রুবির বাবা-মা রয়েছে কত দূর গ্রামে, মায়ের হাতের রান্না খাওয়া তো পরের কথা, কত দিন মাকে দেখেইনি। মা-বাবার কথা মনে করতেই রুবির চোখ জ্বালা করতে শুরু করে। বালতি থেকে আঁজলা ভরে কিছু পানি তুলে চোখে ছিটিয়ে দিয়ে আবার মাথা নুইয়ে পানি দিতে থাকে। বান্ধবীর ভাইটিকে খুবই সুপুরুষ মনে হয়েছে রুবির। গম্ভীর ভরাট কণ্ঠ, দেখেই মনে হয় খুবই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোক, অন্য ছেলেগুলোর মত হ্যাংলা টাইপের নয়। ‘এমন একটা মানুষকে যদি জীবন সাথী হিসাবে পাওয়া যেত! ছিহ্! এসব কী ভাবছি,’ রুবি মনে-মনে বলে। বান্ধবীর বাড়ি থেকে আসার সময় বান্ধবীর ভাইটি শুধু বান্ধবীর অনুরোধে রাস্তার মোড় পর্যন্ত এগিয়ে এসে রিকশায় উঠিয়ে দিয়েছে আর কথা বলতে এইটুকুই, ‘তোমার নাম কি রুবি?’ আর এতেই কী সব ভাবছি, রুবি নিজে-নিজে খুব লজ্জাবোধ করে। হঠাৎ বালতির দিকে চোখ যেতেই চমকে ওঠে। বালতির পানির রং টকটকে লাল, মনে হচ্ছে পানি নয় যেন রক্ত। আর রক্ত ভরা বালতির মধ্য থেকে শীর্ণ দুটি হাত, ছাগলের লোমের মত কালো লোমে আবৃত, তার দিকে উঠে আসছে। সে চিৎকার করে ছিটকে পড়ার আগেই তার একটি হাত ওই কালো লোমে আবৃত হাতখানা চেপে ধরে। রুবি ওই কালো হাতের মুঠো থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে-করতে আকাশ ফাটানো চিৎকার ছাড়ে। চিৎকার শুনে মেয়েরা দৌড়ে এসে বাথরুমের দরজায় ধাক্কাধাকি শুরু করার পর, রুবি কীভাবে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়েছিল তা জ্ঞান ফিরে পাবার পর নিজেও বলতে পারেনি। রুবির ওই ভয়ঙ্কর হাতের কথা শুনে, ঝর্না ও অন্যান্য মেয়েরা সবাই মিলে রুবিকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে দেখায়, কোথায় বালতি ভরা রক্ত আর কালো হাত? বালতিতে এক বালতি টলটলে পানি, তার উপরে হালকা একটু তেল, যার সাথে রুবির মাথার দুই তিনটি চুলও ভাসছে।

এই ঘটনার পর রুবি হোস্টেল ছেড়ে চলে যেত, কিন্তু অনেক ভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঝর্না তাকে জোর করে হোস্টেলে রাখে। ঝর্না রুবিকে বোঝায়, ‘দেখ, রুবি, তুই সেদিন দুপুরে যে কাণ্ডটা করলি এটা স্রেফ তোর মনের ভুল, তুই সারাদিন আজগুবি চিন্তা ভাবনা করে এই অবস্থার সৃষ্টি করেছিস। তুই যেটা দেখেছিস সেটা সম্পূর্ণ একটা হ্যালুসিনেশন। শুধু তুই না, এর আগেও যে মেয়েরা এই সব ব্যাপার দেখেছে তাদের ক্ষেত্রেও। মেয়েরা যখন এই হোস্টেলে থাকতে আসে তখনই শুনতে পায় ওই বাথরুমটায় জমিদার আমলে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় মেয়েরা আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যার এই ব্যাপারটা হোস্টেলের মেয়েদের মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে, এক সময় ভৌতিক শব্দ শুনতে পায়, ধীরে-ধীরে চোখের সামনে দেখতেও পায়। অডিটরি হ্যালুসিনেশন ভিস্যুয়েল হ্যালুসিনেশনে রূপ নেয়। তুই একটু বেশি পরিমাণে ভীতু বলে তোর ক্ষেত্রে প্রথমেই ভিস্যুয়েল হ্যালুসিনেশন হয়। ভয়টাকে জয় করতে শেখ, এভাবে ভয় পেয়ে যদি পালিয়ে যাস তবে কোন দিনও তোর ভয় কাটবে না। অন্য যেখানে যাবি সেখানের বাথরুমেও ভৌতিক কর্মকাণ্ড দেখবি। আর তুই চলে গেলে আমি একা হয়ে যাব, কিছুদিন পরে হয়তো আমিও ভূত দেখা শুরু করব। আমিও তো একটা মেয়ে, আমার মনের মধ্যেও ভয় লুকানো আছে। সব সময় সাহস নিয়ে থাকি, ভয়কে প্রশ্রয় দেই না, কারণ প্রশ্রয় পেলেই ভয় মনের মাঝে শিকড় গেড়ে বসে পড়বে।’

রুবি কোন বারণই শুনত না, হোস্টেল ছেড়ে সে চলেই যেত, কিন্তু ঝর্না শেষে যখন বলেছে, রুবি চলে গেলে ঝর্নার একা-একা ভয় লাগবে, তখন এতদিনের রুমমেটের প্রতি সহানুভূতি অনুভব করে হোস্টেলেই থেকে যায়।

এর পর প্রায় বছর খানেক কেটে গেছে, রুবি আর ভয়ঙ্কর কিছু দেখেনি। আর ওই ঘটনার পর থেকে রুবি আর কখনও একা বাথরুমে যায় না, ঝর্নাকে সাথে নিয়ে যায়। ঝর্না আগের মত গুন-গুন করে গান গাইতে থাকে।

দেখতে দেখতে পরীক্ষা এসে যায়। ঝর্না পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এতদিন মোটেই পড়াশুনা করেনি বলে পরীক্ষার আগে সিলেবাস কমপ্লিট করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। রাত দুটো-আড়াইটা পর্যন্ত সে জেগে থাকে। এদিকে রুবি বারোটা-সাড়ে বারোটা বাজলেই ঘুমিয়ে পড়ে।

এমনই একদিন নিশুতি বৃষ্টির রাত, প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। রাত প্রায় পৌনে তিনটা। রুবি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আর ঝর্না বই বন্ধ করে ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তবে টের পায় তার আগে বাথরুমে যাওয়া দরকার। হোস্টেলের টানা বারান্দা দিয়ে, বৃষ্টির শব্দের সাথে চটির পটর-পটর শব্দ তুলে হেঁটে- হেঁটে চলে যায় বাথরুমে। একটা হুতুম পেঁচার থেমে-থেমে, কুক-কুক শব্দের ডাক ভেসে আসে উত্তর দিকের বড় বাদাম গাছটা থেকে। ঝর্না ভাবে, সে কি এর আগে কখনও বৃষ্টির রাতে কোন পাখির ডাক শুনেছে? ভাবতে-ভাবতেই টয়লেটের প্যানের উপর বসে, চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। হঠাৎ তার ঘাড়ে ফোঁটা ফোঁটা তরল কিছু পড়ার শব্দ টের পায়। হাত দিয়ে ঘাড়ে পড়া তরল ফোঁটা মুছে চোখের সামনে এনে দেখতে পায়, লাল ঘোলাটে এক ধরনের কিছু। মনে হচ্ছে পচা রক্ত, বোটকা গন্ধও আসছে। তরল ফোঁটার উৎপত্তিস্থল দেখার জন্য ঝর্না ঘাড় কাত করে উপরের দিকে তাকাতেই স্তম্ভিত হয়ে যায়। একটা মেয়ের আধপচা গলিত রক্তাক্ত লাশ বাথরুমের ছাদের সাথে উল্টো ভাবে ঝুলছে। মেয়েটা উলঙ্গ, মাথা, চুল, হাত নীচের দিকে ঝুলে আছে আর তা থেকে পচা রক্ত বেয়ে- বেয়ে টপ-টপ করে পড়ছে। চোখটা উল্টে কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে আর জিভটা প্রায় এক হাত বেরিয়ে ঝুলে আছে। চোখের কোটর আর জিভ থেকেও সেই ঘন তরল ঝরছে। ঝর্না ভয় পেয়ে চিৎকার করতে চায়, কিন্তু সে তার বাক্ শক্তি হারিয়ে ফেলে। উঠে দৌড়ে পালিয়ে যাবার চিন্তা করে, তখনই দেখতে পায় উল্টো ভাবে ঝুলে থাকা পচা গলা লাশটা জীবন্ত হয়ে উঠেছে। চোখ দুটি একবার কোটরের ভিতরে যাচ্ছে, আবার বেরিয়ে শূন্যে ঝুলছে, জিভটাও দুইহাত পর্যন্ত লম্বা হয়ে ল্যাক-ল্যাক করছে আবার সাপের মত মুখের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। হাত দুটোও নাড়াবার চেষ্টা করছে, হাতের চামড়া ফেটে পচা মাংস খসে খসে পড়ছে। ঝর্না তখনও ছুটে পালাবার চিন্তা করে, কিন্তু তার আগেই পচা লাশটা ধুপ করে তার গায়ের উপর পড়ে, সঙ্গে ভয়ঙ্কর পৈশাচিক হাসির শব্দ।

ঝর্না সকাল পর্যন্ত ওই বাথরুমে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে ছিল। সকালে মেয়েরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। প্রায় একদিন পর তার জ্ঞান ফেরে। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থা ছিল না, উল্টো-পাল্টা বকতে থাকে, ভয়ে কুঁকড়ে আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে। বেশ কিছুদিন ধরে ঝর্না ভয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে অবশেষে হার মেনে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়।

ঝর্না মারা যাওয়ার পর রুবি হোস্টেল ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আর কলেজ কর্তৃপক্ষ, হোস্টেলের সেই বাথরুমটি দেয়াল করে চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছিল।

রুবির আর বেশিদূর পড়াশুনা হয়নি। সে একা হলেই ভয়ে অস্থির হয়ে পড়ে। তার মনে হয় ঘাড়ের পিছনে কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে, পরিচিত নিঃশ্বাসের শব্দ-ঝর্নার। কিন্তু পিছনে তাকালে কাউকে দেখা যায় না। ভীতু মেয়েটার বিয়ে হয়ে যায়। শহরের স্থানীয় বান্ধবীর সেই গম্ভীর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ভাই শফিকের সঙ্গেই।

মধ্যরাত। রুবি তার ঘুমন্ত স্বামীর পাশে শুয়ে আছে। একটু আগে তার ঘুম ভেঙে গিয়েছে। প্রচণ্ড টয়লেট পেয়েছে, কিন্তু একা যেতে খুব ভয় লাগছে। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা সে, শরীরটাও আজ বেশ অসুস্থ। স্বামী বেচারীর দিকে তাকিয়ে রুবির খুব মায়া লাগছে, অফিসে সারাদিন পরিশ্রম করে এসে, ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। এমন একটা ঘুমন্ত মানুষকে কী করে ডেকে তোলা যায়। রুবি একাই খালি পায়ে পা টিপে-টিপে বাথরুমে চলে যায়। বাথরুমের দরজার ছিটকিনি বন্ধ করতেই আবার সেই ঘাড়ের পিছনে নিঃশ্বাসের শব্দ পায়। এবার পিছন ফিরতে সত্যি সত্যিই সে কিছু দেখতে পায়। দেখতে পায় তার রুমমেট ঝর্না দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটি হিংস্র পশুর মত জ্বল জ্বল করছে, আর রোগা পাতলা, কালো কুচকুচে উলঙ্গ দেহটা যেন দীর্ঘদিন অনাহারে কাটিয়েছে। পাটকাঠির মত চিকন দুটি হাত বড়-বড় নখ দিয়ে মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বুড়ো মানুষের মত কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে বলছে, ‘রুবি, খুব খিদে, খুব তৃষ্ণা আমার। আমার এই খিদে শুধু তোর ওই পেটের বাচ্চাটাই মিটাতে পারে, দে বাচ্চাটা আমাকে দে,’ বলে রুবির দিকে এগোতে থাকে সাপের মত লকলকে কালো দুটি পা দিয়ে লেংচাতে-লেংচাতে। রুবি চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।

রুবি এখন শের-ই-বাংলা মেন্টাল হসপিটালের ১১ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা। সেই রাতে, বন্ধ বাথরুমের মধ্যেই রুবির গর্ভপাত হয়ে গিয়েছিল। শেষ রাতের দিকে তার স্বামী ঘুম থেকে উঠে দেখতে পায় রুবি বাথরুমের মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, আর তার কোমরের নীচের শাড়ি, হাঁটু, পা, বাথরুমের মেঝে তাজা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। জলদি করে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। সে সময় রুবির স্বামীর কেন যেন বারবারই মনে হচ্ছিল কেউ একজন শুকনো কালো পাট কাঠির মত দেখতে, দূরে দাঁড়িয়ে খিল-খিল করে হাসছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *