আড়ালে আততায়ী : ১২টি খুনের রোমহর্ষক ময়না তদন্ত
আড়ালে আততায়ী : ১২টি খুনের রোমহর্ষক ময়না তদন্ত – চিত্রদীপ চক্রবর্তী, হিমাদ্রি সরকার
প্রথম প্রকাশ : ডিসেম্বর ২০১৯
প্রচ্ছদ : উদয় দেব
.
মুখবন্ধ
চিত্রদীপ চক্রবর্তী এবং হিমাদ্রি সরকার, দু’জনেই সাংবাদিক। তাঁদের কাজের এলাকা, অপরাধ জগত। ছােট—বড় যে কোনও অপরাধের ঘটনা ঘটলে সাধারণত আমরা সাংবাদিকদের দেখি উপর উপর তথ্যগুলি দিয়ে যেতে। তারপর তদন্ত যেমন এগোতে থাকে, সেটার উপর ভিত্তি করে শুধুমাত্র দৈনন্দিন একটা বিবরণ লিখে যান তাঁরা। বিষয়টির গতিপ্রকৃতির ভিতরে ঢােকার খুব একটা প্রয়াস দেখা যায় না সংবাদমাধ্যমের।
সেদিক থেকে দু’জনের এই যৌথ প্রয়াসে, শুধু ঘটনার বিবরণ নয়, ক্রিমিনাল মনস্তত্ত্ব বুঝতে চেষ্টা করা এবং পুলিশের তদন্তের ভিতরে গিয়ে কীভাবে একটা একটা করে সূত্র চয়ন করে সেগুলিকে পরপর সাজিয়ে আদালতের কাছে গ্রহণযােগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসাবে দাখিল করা হয়, তা তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে। যা অন্যরকম ভাবনাচিন্তার ফসল।
হত্যার তদন্তে খুনির মনস্তত্ত্ব বােঝা ও প্রমাণ করা একটি সূক্ষ্ম, কিন্তু অতি প্রয়ােজনীয় ব্যাপার। কারণ, এর উপরেই বেশিরভাগ সময় সাজার পরিমাণ ঠিক হয়। রাগারাগি, ঝগড়া চলছে, হঠাৎ একজন একটা কুড়ল তুলে অন্যজনের মাথায় বসিয়ে দিল, এটা একরকম। বােঝা গেল, লোকটি রাগি এবং মেরে ফেলব বলে কুড়ল চালিয়েছে। অন্য ঘটনায় দেখা গেল, এক গৃহবধূ বসে রান্না করছে, তার স্বামী সেখানে ঢুকে মাথায় ও সারা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিল। তারপর দরজার বাইরে থেকে তুলে দিল শিকল। বধূটি ঘরের ভিতর পাগলের মতো দৌড়ােদৌড়ি করে আগুন নেভাতে চাইছে, দরজা ভেঙে বাইরে আসার চেষ্টা করছে, অথচ স্বামী নির্বিকার। এখানে খুনি স্বামীর শান্ত মস্তিষ্কে পরিকল্পনা করে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার মানসিকতা বােঝা যায়। আবার ধরা যাক, কোনও ঘটনায় একটি মেয়েকে অসহায় অবস্থায় শুধু ধর্ষণ করা নয়, অনেকক্ষণ ধরে শারীরিক অত্যাচার করে সেটা উপভোগ করা ও শেষে মেরে ফেলা, অতীব নৃশংস মনের পরিচয় দেয়। এর উপরেই নির্ভর করে বিচারক কখনও সাত বছর, কখনও দশ বছর জেল, কখনও বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, নয়ত ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ ঘােষণা করে ফাঁসির হুকুম দেন। এই মামলাগুলিতে সাক্ষ্য এবং নথি দিয়ে অপরাধ প্রমাণ করাটা তদন্তকারী অফিসারদের কৃতিত্ব। সাধারণ মানুষ খবরের কাগজে কোনও অপরাধের ছােট্ট একটা খবর হয়ত পড়েন, অমুক খুনের ঘটনার বিচার শেষে আজ সেশন কোর্ট তমুককে ফাঁসির সাজা দিয়েছে। কিন্তু এই ঘােষণাটির পিছনে যে কী কর্মকাণ্ড, রাতের পর রাত জাগা এবং পরিশ্রম লুকিয়ে থাকে, তাঁরা জানতে পারেন না। শার্লক হােমসদের কাজ যেখানে শেষ হয়ে যায়, আসল তদন্তকারী অফিসারের কাজ সেখান থেকে শুরু হয়। অনেক ক্ষেত্রে একজন খুন করেছে বুঝতে পারা সত্ত্বেও তদন্তকারী অফিসারের প্রয়ােজন হয় সাক্ষ্য ও প্রমাণের। বিচারের সময় বিচারক কিন্তু দেখেন, যে ধারায় একজনকে পুলিশ অভিযুক্ত করেছে, ভারতীয় দণ্ডবিধির সেই শাস্তির ধারাগুলির প্রত্যেকটি শর্তকে সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে সন্দেহাতীতভাবে তুলে ধরা গিয়েছে কি না? তবেই অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্ত হবে, সাজা হবে।
এই দুই সাংবাদিক যে পুলিশের তদন্তের কঠিন দিকগুলি বুঝতে চেয়েছেন এবং ১২টি ঘটনা জনসমক্ষে এনে বিষয়গুলি উপস্থাপিত করেছেন, এর জন্য আমি তাঁদের সাধুবাদ জানাই।
প্রসূন মুখোপাধ্যায়
(প্রাক্তন কমিশনার, কলকাতা পুলিশ)
০১—১১—২০১৯
Leave a Reply