ব্ল্যাক ওয়ারেন্ট
সাত সকালে অসমের ধুবড়ি থেকে একটা ট্রেন এসে থামল শিলিগুড়ির টাউন স্টেশনে। আসলে এটাই শিলিগুড়ি এক্সপ্রেসের শেষ গন্তব্য। পেটভর্তি যাত্রী নিয়ে এলে যা হয়, শুরু হল হৈচৈ। কুলিদের তৎপরতা। আর খুব দ্রুত গাড়িটা ফাঁকাও হয়ে গেল। ভিড় খানিকটা থিতিয়ে যেতে নেমে এলেন এক ভদ্রলোক। হাতে একটা বড় ব্যাগ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বয়স ষাট পেরিয়েছে। মুখে—চোখে অভিজাত্যের ছোঁয়া। যদিও বয়সের রেখা স্পষ্ট। তবে তাঁর কুলির প্রয়োজন নেই। ব্যাগটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন স্টেশনের বাইরে। সামনে নজরে এল রিকশ স্ট্যান্ড।
‘আচ্ছা ভাই, এখানে কাছাকাছি ভালো কী হোটেল আছে?’ প্রশ্ন করলেন রিকশওয়ালাকে। বোঝা গেল এলাকার লোক নন। কারণ, টিপিক্যাল উত্তরবঙ্গীয় ভাষার সঙ্গে তেমন রপ্ত হতে পারেননি।
‘হ্যাঁ বাবু, আছে তো। এইখান থেকে একদম কাছে। হিলকার্ট রোডে। যাইবেন নাকি? পঞ্চাশ পয়সা ভাড়া দিয়েন।’—উত্তর দিলেন একজন।
‘চলো তাহলে।’ উঠে বসলেন ভদ্রলোক। রিকশও চলতে শুরু করল। আজকের হিলকার্ট রোডের সঙ্গে তখনকার দিনে পার্থক্য অনেক। একটা পিচঢালা নাক বরাবর রাস্তা। এত দোকানপাট নেই। গাড়ি অনেক আছে। লোকও। বোঝা যাচ্ছে, অনেকে গাড়ি নিয়ে দার্জিলিংয়ের দিকেও যাচ্ছেন। চারিদিকে হাঁকডাক। সেবক রোডের ঢোকার মুখে রিকশচালক বললেন, ‘বাবু, এই হোটেলটা দেখতেছেন। স্যাভয় হোটেল। খারাপ না। খাওয়া—দাওয়া ভালোই।
‘ঠিক আছে তাহলে।’ এদিক ওদিক সামান্য তাকিয়ে ভদ্রলোক ভাড়া মিটিয়ে ঢুকে পড়লেন ভিতরে। তখনও আজকালকার মতো এত সন্দেহ বা নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি নেই। হোটেলে থাকতে গেলে হাজারটা নথি জমা দেওয়ার হ্যাপাও ছিলনা। খাতায় নামটা সই করে তিন নম্বর রুমে সেঁধিয়ে গেলেন তিনি। ম্যানেজার শুধু জানতে চাইলেন, ‘কয়দিন থাকবেন এইখানে?’ জবাব মিলল, ‘একটা কাজে এসেছি। দেখা যাক, মিটে গেলে চলে যাব। আপাতত কয়েকদিন আছি।’
১৬ এপ্রিল ১৯৭০।
খাতায় লেখা রেকর্ড অনুযায়ী, ভদ্রলোকের নাম উপেন্দ্র নাথ রাজখোয়া। ঠিকানা, অসমের ধুবড়ি।
উপেন্দ্র পড়াশোনায় ছোটবেলা থেকে খুব ভালো ছিলেন। শেষ পর্যন্ত আইনের দিকটিকেই পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। অসমের বহু আদালতে তাঁকে বিভিন্ন ভার সামলাতে হয়। অবসরের প্রান্তে এসে বিচারক হওয়ার দায়িত্ব পান ধুবড়ির ডিস্ট্রিক্ট অ্যান্ড সেশন আদালতে। ঠিক তার আগের বছর।
গুয়াহাটিতে উপেন্দ্রর আদি বাড়ি। স্ত্রী পুতুল রাজখোয়া। তিন মেয়েকে নিয়ে সেখানে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকেন। আর বিভিন্ন জায়গায় বদলির সূত্রে যেতে হওয়ায় নিজের বাড়িটি ভাড়া দিয়েছিলেন উপেন্দ্র। যার দেখভালের দায়িত্ব ছিল শ্যালক বরদা শর্মার। বড় মেয়ে নির্মলা ওরফে নিলু, মেজ মেয়ের নাম জোনালি ওরফে লুনা এবং ছোট মেয়ের নাম রূপলেখা ওরফে রূপালী। বড় মেয়ে কলেজ পাশ করলেও বাকি দু’জন তখনও কলেজে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে।
এবারের সফরে অবশ্য তাঁর সঙ্গে কেউ নেই। একা। দিনটা শুয়ে বসে কেটে গেল। সন্ধ্যা নামার পর শিলিগুড়ি শহরের চেহারাটাই যেন পাল্টে যায়। ভোল বদলে ফেলে পাহাড়ের সানুতলে থাকা একটা গোটা জনপদ। চারিদিকে তখন আলোর রোশনাই। সারাদিন হোটেলের ঘরে কাটিয়ে বিকেলবেলা শহরটাতে একটু চক্কর কাটতে বেরলেন তিনি। এখানে একটা নিশ্চিন্তি অবশ্য রয়েছে। চেনাজানা কেউ নেই। গায়ে ফুরফুরে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো যাবে।
আর হ্যাঁ, আরও একটা তথ্য জানানো প্রয়োজন। সেই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে নিজের দীর্ঘ চাকরি জীবন থেকে অবসর নিয়েছেন তিনি। বর্তমানে, প্রাক্তন বিচারক।
হাঁটতে হাঁটতে মহানন্দা নদীর ব্রিজের দিকে (তখনও একটাই ব্রিজ) এগিয়ে গেলেন। সামনে রাস্তার ধারে ঠেলায় নানা রকম গরম খাবারদাবার বিক্রি হচ্ছে। ব্রিজ দিয়ে হুশ হুশ করে সব গাড়ি একে অন্যকে টেক্কা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে শহরের দিকে। একটু এগিয়ে যেতেই গুরুংবস্তি। উপেন্দ্র একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন চারপাশটা দেখতে দেখতে আচমকা একজনের সঙ্গে ধাক্কা লাগল। বিরক্ত হয়ে দুজন দুজনের দিকে কড়া ভাবে তাকালেন। আর তারপর? যেন কাকতালীয় ঘটনা। দ্বিতীয় ব্যক্তির মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে এল, ‘স্যর আপনি এখানে, এখন?’ চমকে গেলেন উপেন্দ্র। তিনি তো এটা চাননি। যেন এক অনাহুতকে দেখছেন এমন ভাব করে বললেন, ‘তুমি কী করছ?’
‘স্যর, আমি প্রধাননগরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে এসেছি। কিন্তু আপনি গুয়াহাটিতে চলে গিয়েছিলেন বলে জানতাম।’
উপেন্দ্র সবটা বলতে না চাইলেও একটু ইতস্তত করে মুখ খুললেন, ‘একটা জরুরি কাজে এখানে এসেছি। স্যাভয় হোটেলে উঠেছি। পারলে এসো একবার। আর হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে যে দেখা হয়েছে এটা বাইরে কাউকে আবার বলতে যেও না। আসলে আমার এক মেয়ে দার্জিলিংয়ে পড়াশুনো করছে, ওকে দেখতে মাঝে মাঝে আসতে হয়।
শিলিগুড়িতে দেখা হওয়া ভদ্রলোকের নাম জয়প্রকাশ চক্রবর্তী। উপেন্দ্রর বাংলোতে আর্দালির কাজ করতেন কয়েকমাস আগেও।
বিষয়টা মিটে গেল ওখানেই।
দিন পনের শিলিগুড়িতে থেকে ফের একবার কাজে যোগ দেওয়ার জন্য জয়প্রকাশ রওনা হলেন ধুবড়ির পথে। তাঁর মনেও ততদিনে উপেন্দ্র সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন, কিন্তু কোনওটারই উত্তর নেই।
এরপর কেটে গেল প্রায় মাস দুয়েক। ধুবড়িতে একদিন হঠাৎ করেই এসে হাজির হলেন অসম পুলিশের ডিআইজি বরদা শর্মা। সম্পর্কে যিনি আবার প্রাক্তন বিচারক উপেন্দ্র রাজখোয়ার শ্যালক। দিন তিনেক সেখানে থেকে সবার কাছ থেকে খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করলেন নিজের জামাইবাবু, বোন এবং ভাগ্নিদের সম্পর্কে। নতুন বিচারক হিসেবে ততদিনে সেখানে চলে এসেছেন এন কে চৌধুরী। এমনকী, বিচারকের বাংলোয় পরিবার নিয়ে থাকাও শুরু করেছেন তিনি। ডিআইজির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে পুরনো কর্মীরা যা বুঝলেন তার সারমর্ম: গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এই পুলিশ কর্তা নিজের বোন এবং তিন ভাগ্নির কোনও খবর পাচ্ছেন না। তাদের পড়াশোনার বিষয়ে জানতে গেলে জামাইবাবু একবার বলেন ওরা সবাই দিল্লি গিয়েছে, আবার কখনও বলেন গুয়াহাটিতে রয়েছে। অথচ তিনি খোঁজ করে কাউকে কোথাও পাননি।
এলাকার বাসিন্দাদের অনেকেই কথায় কথায় তাঁকে জানালেন, আমরাও এই বিষয়ে তেমন কিছু জানি না। কারণ, আমাদের সঙ্গে নিজের পরিবার সম্পর্কে কখনও কিছু খুলে আলোচনা করতেন না সাহেব। বরং জানতে চাইলে একেকবার একেকরকম তথ্য দিতেন।
মালি, বাড়ির কাজের লোক, আর্দালিদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বরদার দেখা হয়ে গেল জয়প্রকাশের সঙ্গেও। এ কথা সে কথার মাঝে তিনি মুখ ফসকে বলে ফেললেন কয়েকদিন আগে শিলিগুড়িতে সাহেবের সঙ্গে দেখা হওয়ার প্রসঙ্গ।
ডিআইজির পুলিশি মগজাস্ত্র মুহুর্তে সিগন্যাল পাঠিয়ে দিল যে মারাত্মক একটা কিছু অপেক্ষা করছে। না হলে, গুয়াহাটিতে যাঁর নিজের বাড়ি, এত আত্মীয়স্বজন, তিনি কেন শিলিগুড়িতে লুকিয়ে থাকবেন? আর একের পর এক লোককে এভাবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করে চলবেন। সুতরাং আর দেরি করা চলবে না।
সে রাতেই সড়কপথে রওনা হলেন তিনি। ভোর হতে না হতে পৌছে গেলেন শিলিগুড়ি। তারপর স্থানীয় থানায়। পুলিশকে নিজের পরিচয় এবং পুরো বিষয়টি জানিয়ে তাঁদের সঙ্গে নিয়ে এবার সরাসরি সেই হোটেলে। সাত সকালে চৌকাঠে পুলিশ দেখে খানিকটা ঘাবড়ে গেলেন হোটেল কর্তৃপক্ষ।
সেখানে বোঝাতে অবশ্য বেশি সময় লাগল না। রেজিস্টার চেক করতে গিয়ে দেখা গেল বেশ কয়েকদিন ধরে হোটেলের ৩ নম্বর রুমে আবাসিক হিসেবে থাকছেন উপেন্দ্র নাথ রাজখোয়া। এবং বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। যে কোনও কিছু হতে পারে এমন পরিস্থিতির আগাম আভাস করে কার্যত পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে নক করা শুরু করলেন পুলিশ কর্মীরা। প্রায় দশ মিনিট এভাবে চলার পর ঘুম চোখে উঠে এসে দরজা খুলে হতবাক হয়ে গেলেন প্রাক্তন বিচারক। একি! একদম মুখের সামনে দাঁড়িয়ে শ্যালক, খোদ ডিআইজি! উপেন্দ্রকে ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়লেন শিলিগুড়ি থানার পুলিশ কর্মীরা। শুরু হল টানা জিজ্ঞাসাবাদ। দফায় দফায় কথা বললেও প্রতিবারই উপেন্দ্রর নতুন নতুন বক্তব্যে অসঙ্গতি উঠে আসা শুরু করল। একবার তিনি বললেন, স্ত্রী—কন্যারা সবাই দিল্লিতে ঠিকঠাক রয়েছে। আবার খানিকক্ষণ পর জানালেন, তাঁরা কলকাতা গিয়েছেন। কখনও আবার তাদের গুয়াহাটিতে থাকার তথ্যও দিলেন। কিন্তু প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই বরদা শর্মার পাল্টা যুক্তির কাছে খারিজ হয়ে গেল বিচারকের সব কৌশলি জবাব। বরদা জানালেন, তিনি ওই সমস্ত জায়গায় নিজে গিয়েছেন, নয়তো খোঁজখবর নিয়ে এসেছেন, আর সেখানে ওই চারজনের কেউই নেই। অতএব পুরোটাই ডাহা মিথ্যে।
একঘণ্টার বেশি সময় ধরে ক্রমাগত ডিফেন্স করে করে এক সময় উপেন্দ্র বুঝে গেলেন এটা কোর্টরুম নয়, যেখানে তিনিই শেষ কথা বলতেন। বরং এখানে পরিস্থিতি তাঁর হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। এবার তাই আজব একটা নতুন শর্ত চাপিয়ে দিলেন। বললেন, ‘মুখে কিছু বলতে চান না। তাঁকে একটি খাতা এবং পেন এনে দিতে হবে। সেখানে সবটাই লিখে জানাবেন।’ দেখা যাক একবার চেষ্টা করে, সে কথা ভেবে সেই শর্তও মেনে নেওয়া হল। মিনিট পাঁচেক ভেবে নিয়ে অসমীয়া ভাষায় গোটা গোটা হরফে লেখা শুরু করলেন উপেন্দ্র। দু’পাতার কাগজটায় খস খস করে লিখতে থাকলেন, ‘১০ ফেব্রুয়ারি রাতে তাঁর স্ত্রী পুতুল বাংলোর মেঝেতে পা পিছলে হোঁচট খেয়ে পড়ে যান। মাথা সরাসরি আঘাত করে দেওয়ালে। রক্তাক্ত অবস্থায় সেখানেই মৃত্যু হয় তাঁর। মায়ের এই মর্মান্তিক মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি বড় মেয়ে নিলু। চোখের সামনে এমন ঘটনা দেখে সে রাতেই প্রচুর পরিমাণে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করে। সারা রাত দু’টি লাশের সঙ্গে থাকার পর ভোরবেলা কয়েকজন মজুরকে ডেকে তিনি একটি ছোট গাড়িতে দেহগুলি চাপিয়ে নিয়ে যান ব্রহ্মপুত্র নদীতে। সেখানে ভাসিয়ে দেওয়া হয় মৃত মা—মেয়েকে।’
বাকি দুই মেয়ে কোথায়? এবার উপেন্দ্র নতুন যুক্তি খাড়া করেন। তা হল, ‘মা—দিদির মৃত্যুর খবর তিনি বাকি দুই মেয়েকে প্রথমে জানাননি, তাহলে হয়ত শোকে তারাও আত্মহত্যা করত। ঘটনার বেশ কিছুদিন পর দুই মেয়ে লুনা আর রূপালীকে নিজের বাংলোতে ডেকে নেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে খাওয়াদাওয়ার পর গাড়ি নিয়ে তাঁরা সবাই চলে যান ব্রহ্মপুত্রের ধারে। সেখানে ফাঁকা জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে দুই মেয়েকে পুরো কাহিনী বিস্তারিত বর্ণনা করেন। মা এবং দিদির মর্মান্তিক সেই ঘটনা শুনে শোকে মেজো এবং ছোট মেয়ে অন্ধকারে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।’
তাহলে কি ধুবড়ি থেকে ১৫ তারিখ এসে শুধুমাত্র শিলিগুড়ির হোটেলেই ছিলেন উপেন্দ্র ?
পুলিশের তদন্তে উঠে আসে, আসলে তা নয়। ২৮ এপ্রিল থেকে ৯ মে পর্যন্ত তিনি একা একা কাটিয়েছিলেন দার্জিলিংয়ের সামার বুন হোটেলে। আবার সে বছরের জুন মাসের ৭ তারিখ থেকে ২৫ তারিখ ধরা পড়ার আগে পর্যন্ত তাঁর আস্তানা ছিল স্যাভয় হোটেল।
এরপর যা হল তা সত্যিই সিনেমার গল্পের মতো। উপেন্দ্রর শ্যালক তথা ডিআইজি তাঁকে বললেন, ‘যা লিখে দিয়েছেন তা পুলিশ এবং ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বয়ান দিতে হবে। সুতরাং আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন।’
এক কথাতে রাজি হয়ে গেলেন প্রাক্তন বিচারক। শুধু একটা অনুরোধ করলেন, আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। আমি পোশাক বদলে নিচ্ছি। সন্মতি না দেওয়ার প্রশ্ন ছিল না। ফলে উপস্থিত পুলিশ কর্মীদের সামনে বাক্স থেকে জামা কাপড় বার করে বাথরুমে ঢুকে পড়লেন তিনি। আর সেই ফাঁকে ঘরের আনাচে কানাচে তল্লাশি শুরু করলেন ডিআইজি বরদা। বলা যায় না। হয়ত সামান্য হলেও কোনও সূত্র মিলে যেতে পারে! এবং মিললও তাই। আচমকা বিছানার চাদরটা তুলতে গিয়ে নজরে এল একটা ছোট্ট চিরকুট। জুলাই মাসের ৩১ তারিখ সেখানে উল্লেখ রয়েছে। একটু আঁকাবাঁকা হাতে লেখা, ‘আমি উপেন্দ্র নাথ রাজখোয়া। আসামের অবসরপ্রাপ্ত ডিস্ট্রিক্ট জাজ। আমার স্ত্রী এবং তিন কন্যা সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। কাজেই আমারও বেঁচে থেকে কোনও লাভ নেই।’
এক মিনিট, দশ মিনিট। এই করে ততক্ষণে কেটে গিয়েছে প্রায় আধঘণ্টা। সেই যে বাথরুমে ঢুকেছেন, আর বেরিয়ে আসার নামই নিচ্ছেন না উপেন্দ্র। ধৈর্য্য যখন প্রায় শেষ প্রান্তে, সে সময় বাথরুমের ভিতর থেকে ভেসে এল একটা আর্ত চিৎকার। আর অপেক্ষা করার মানে হয় না। পুলিশের টিম দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়ল। দেখা গেল, বাথরুমের মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন তিনি। নিজের পেটে ছুরি ঢুকিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন প্রাক্তন বিচারক। গুরুতর অবস্থায় তাঁকে দ্রুত উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হল শিলিগুড়ি হাসপাতালে। ঠাঁই হল, ১৮ নম্বর বেডে। চলল দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা। সুস্থ হলেন ‘সন্দেহভাজন’ উপেন্দ্র।
৯ অগস্ট, ১৯৭০।
অনেকটা স্বাভাবিক হলেন তিনি। ততদিনে চেহারাতেও পরিবর্তন এসেছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে, যাই করে থাকুন নিজের কৃতকর্মের জন্য বেশ অনুতপ্ত। দু’দিন ধরে পর্যবেক্ষণে রাখার পর সেদিন উপেন্দ্রকে নিয়ে যাওয়া হল স্থানীয় আদালতে। ওখানে নিজের স্বীকারোক্তিতে বললেন, ‘আগেরগুলো সবই ছিল বানানো গল্প। আসলে, আমি চারজনকে খুন করেছি।’
‘কিন্তু আপনার আগের লিখিত বয়ানের ভিত্তিতে ইতিমধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদীতে তল্লাশি করে পুলিশ কিছুই পায়নি? চারটে লাশ তাহলে গেল কোথায়?’ প্রাক্তন বিচারকের প্রতি পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন শিলিগুড়ি আদালতের বিচারক।
এবার উপেন্দ্র খানিকটা হলেও মুখ খুলতে থাকেন, ‘ওই চারজনকে দু’দফায় আমার ধুবড়ির বাংলোতে বাথরুম এবং রান্নাঘরের পাশে গর্তে পুঁতে দিয়েছি।
পরদিন, ১০ তারিখ সেশন জজের অনুমতি আদায় করা হল। ১১ তারিখ মজদুরদের নিয়ে পুলিশের টিম হাজির সেই সরকারি বাংলোয়। বাথরুমের পাশে গর্ত খুঁড়তেই পাওয়া গেল দুটি কঙ্কাল। যার মধ্যে একটি পুতুলের। অন্যটি বড় মেয়ে নিলু। হাতের গয়না দেখে শনাক্ত করা গেল তাদের। রান্নাঘরের পাশে ছিল আরও একটি গর্ত। এবার সেখানে খানিকটা খোঁড়াখুঁড়ি করতেই উঠে এল দুই মেয়ে লুনা এবং রুপালির পচাগলা দেহ।
খুনের বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর ঘটনার তদন্ত শুরু করল পুলিশ। উপেন্দ্রকে ফের দফায় দফায় জেরা এবং এলাকার বাসিন্দাদের বয়ান নথিভুক্ত করতে তেমন পরিশ্রম করতে হল না। মামলায় উপেন্দ্রকে অভিযুক্ত করে চার্জশিটও জমা পড়ে গেল দ্রুত। সেখানে উল্লেখ থাকল উপেন্দ্রর বাংলোর প্রাক্তন কর্মী উমেশ বৈশ্যর নামও।
১৯৭২ সালের ১৩ নভেম্বর মামলার শুনানি শুরুর দিন। তার আগে ধুবড়ি জেলে পাঠানো হল অভিযুক্তকে। কিন্তু ১২ তারিখ রাতে ফের এক কাণ্ড বাধালেন তিনি। জেলের ভিতর আরও একবার আত্মহত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হল তাঁর। লোহার ধারালো টুকরো দিয়ে সেলের ভিতর পেটে আঘাত করতে করতে নিজেকে রক্তাক্ত করে তুললেন খুনের মামলার এই অভিযুক্ত। আগের অভিজ্ঞতা থেকেই সতর্ক করে দেওয়া ছিল সব মহলে। ফলে তাঁর উপর নজরদারি করতে গিয়ে জেলকর্মীরা বিষয়টি দেখে ফেলে ব্যবস্থাও নিলেন বেশ তাড়াতাড়ি। পিছিয়ে দিতে হল শুনানির দিন। বেশ কিছুদিন ধরে হাসপাতালে আরও একদফা চিকিৎসা করাতে হল তাঁর।
সুস্থ হওয়ার পর নিজেদের হেফাজতে নিয়ে প্রাক্তন এই বিচারককে একাধিকবার জেরা এবং তদন্ত করেও পুলিশ কর্তারা একটি বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। কেন নিজের স্ত্রী এবং কন্যাদের এভাবে খুন করলেন একজন আইনজ্ঞ ? প্রায় তিরিশ বছর আগে তাঁর বিয়ে হয়েছে, মেয়েদের প্রত্যেকেরই বয়স ১৮ ছাড়িয়ে গিয়েছে, তাহলে অবসর নেওয়ার পর হঠাৎ করে খুন করার মতো এই হঠকারী সিদ্ধান্ত কেন? মানসিক ভাবেও কারও কোনও সমস্যা নেই। তাহলে?
আস্তে আস্তে আরও সুস্থ হয়ে উঠলেন উপেন্দ্র। মালির দেওয়া বয়ান এবং পারিপার্শ্বিক তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হল। এই খুনের মামলায় প্রথম থেকেই কোনও প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। ফলে ঘটনা পরম্পরা জুড়ে বিষয়টি একত্রিত করলেন তদন্তকারীরা। অনেকটা পুনর্নির্মাণের মতো। তাতে দেখা যায়, চারজনকেই একই কায়দায় ঘুমের মধ্যে মাথায় লোহার রড জাতীয় কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে।
ঘটনার প্রায় তিন বছর পর, ১৯৭৩ সালের ২৭ জানুয়ারি। আদালত এই মামলায় রায় ঘোষণা করল। যেখানে কয়েক বছর আগে তিনি ছিলেন শেষ কথা, সেই আদালতের অন্য বিচারকের সামনে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হল প্রাক্তন একজন বিচারককে। রায় শেষে বলা হল একটি কথা, এই ঘটনা বিরলের মধ্যে বিরলতম। কাজেই ফাঁসির সাজা দেওয়া হচ্ছে একজন খুনি বিচারককে।’ সই করে পেনের নিবটি ভেঙে ফেললেন দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারক। লেখা হয়ে গেল, উপেন্দ্রর ব্ল্যাক ওয়ারেন্ট। তাঁর অপরাধের সঙ্গী উমেশকে দেওয়া হল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। বলে রাখা প্রয়োজন, প্রতিটি ফাঁসির রায়ে সই করার পর বিচারকরা সেই পেনটি ভেঙে ফেলেন, সিনেমার দৌলতে তা আমাদের জানা। কিন্তু এর নেপথ্যে যে কারণ তা হল, যাতে আর কোনও মৃত্যুদণ্ডের আদেশে সই করতে না হয় সেই কলম দিয়ে, তাই কলমটিকেই ভেঙে দেন ওখানে।
ফাঁসির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উপেন্দ্র রাজখোয়া গুয়াহাটি হাইকোর্টে আবেদন করেন। এক বছর ধরে শুনানির পর ১৯৭৪ সালের মে মাসে সেই সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন বিচারপতিরা। এভাবে বিভিন্ন আদালত এবং রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে দফায় দফায় আবেদন জানাতে থাকেন তিনি। কিন্তু তিনটি আদালতের রায় দেখে রাষ্ট্রপতি ১৯৭৬ সালে সেই আবেদন পাকাপাকি ভাবে খারিজ করে দেন।
১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬। তখন অবশ্য ভালোবাসার দিন বলে ঘোষিত কিছু ছিল না। কিন্তু নিজের সবচেয়ে ভালোবাসার এবং কাছের মানুষদের খুন করার দায়ে জোড়হাটের জেলে উপেন্দ্র রাজখোয়াকে ফাঁসি দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের দেশে মোট ৫৭ জনের ফাঁসি হলেও প্রথম কোনও বিচারককে ঝােলানো হয় খুনের অপরাধে। সম্ভবত, যা সারা বিশ্বেও প্রথম।
যে কোনও খুনের ঘটনায় একটি চূড়ান্ত ক্লুাইম্যাক্স থাকে। এটাতেও আছে, তবে খুব অদ্ভুত রকম। তাই এই ঘটনা বিশদে জানতে হলে, আমাদের একটু রিওয়াইন্ড করে নিতে হবে ঘটনাপ্রবাহ।
৬৯ সালের শেষদিকে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব নিলেও তাঁর আগে যিনি ওই পদে ছিলেন, তিনি বাসভবন না ছাড়ায় উপেন্দ্রকে কয়েকদিন স্থানীয় সার্কিট হাউজে কাটাতে হয়। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে সরকারি বাংলো পেয়ে যান তিনি। ফলে পরিবারকে সেখানেই চলে আসার জন্য বলে দেন সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারক। তবে বললেই তো আর হল না, তার জন্য সময়—সুবিধা দুটোরই প্রয়োজন। এভাবে পেরিয়ে গেল সেই বছরটা। এসে গেল ১৯৭০ সাল। ফেব্রুয়ারি মাস। ঘটনাচক্রে ২ তারিখেই আবার উপেন্দ্রর অবসর নেওয়ার কথা।
সরকারি নিয়মে ওইদিন অবসরও হয়ে যায় তাঁর। ঠিক পর দিন ৩ তারিখ, শ্যালক বরদাকে ফোন করেন জামাইবাবু। জানান নিজের ইচ্ছের কথা, গুয়াহাটিতে তাঁর বাড়িতে থাকা ভাড়াটেদের তুলে দিতে। অবসর যখন হয়েই গিয়েছে তখন যে কোনও দিন তিনি ওখানে গিয়ে পরিবার নিয়ে বাকি জীবনটা কাটাবেন। অবসর নিলেও নিজের সরকারি বাংলোটি সঙ্গে সঙ্গে খালি করে দেননি উপেন্দ্র। থেকে যান তাঁর আর্দালি সহ অন্যান্য কর্মীরাও।
এভাবে পেরিয়ে যায় আরও এক সপ্তাহ।
সে বছর ১০ তারিখ সরস্বতী পুজো। পশ্চিমবঙ্গের গা লাগোয়া আসামের ধুবড়ি বাঙালি অধ্যুষিত। ঘরে ঘরে পুজো হয়। অফিস—কাছারিও ছুটি থাকে। ফলে স্বামী যখন বলেছেন তখন আর দেরি না করে সরস্বতী পুজোর আগে বড় মেয়েকে নিয়ে পুতুল ধুবড়ি চলে এলেন। স্ত্রী এবং মেয়ে চলে আসায় উপেন্দ্র নিজের আর্দালি এবং মালিদের ডেকে বলে দিলেন, ‘তোমরা আমাদের রাতের রান্না করে দিয়ে চলে যেতে পারো। সবাইকে পুজো দেখতে যাওয়ার জন্য আজ ছুটি দিয়ে দিচ্ছি।’
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর্ব মিটে যাওয়ার পর বিকেলের দিকে স্ত্রী এবং বড় মেয়েকে নিয়ে পুজো দেখতে বাজারের দিকে গেলেন। বাঙালি বেশি থাকায় ধুবড়ি এলাকায় সরস্বতী পুজো নিয়ে বেশ মাতামাতি হয়। বহু লোক সেখানে বড় পুজোগুলি দেখতে যান। তবে শীতকাল থাকায়, ঠাণ্ডার প্রকোপে একটু রাত বাড়তে না বাড়তে রাস্তাঘাটে লোকজন কমে আসে। কাজেই আর ঘোরাঘুরি না করে সাড়ে আটটা নাগাদ উপেন্দ্র পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাংলোয় ফিরে এলেন। তারপর বাগানে আগুন জ্বালিয়ে একটু আরাম করে আড্ডা দিতে বসে গেলেন স্ত্রী—কন্যার সঙ্গে। গল্প করতে করতে বেজে গেল রাত সাড়ে দশটা। সর্বদা নিয়ম মেনে চলা বিচারক রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে, ফের বারান্দায় খানিকটা সময় কাটিয়ে ঘুমোতে চলে গেলেন সপরিবারে। ওই বাংলোর একদম কাছাকাছি সারভেন্টস কোয়াটার। ফলে তাঁরাও রাতে দেখতে এবং শুনতে পেলেন সাহেব দীর্ঘদিন পর পরিবারের সদস্যদের পেয়ে অন্য মেজাজে রয়েছেন। আগের সেই গুমোট ভাবটা আর নেই। তাছাড়া বিচারক হিসেবে থাকার সময়েও উপেন্দ্র বেশ লো—প্রোফাইলেই থাকতেন। টাকাপয়সা নিয়েও কোনও চাহিদা ছিল না তাঁর।
এর মধ্যে আরও একটি বিষয় অবশ্য আগে ঘটে গিয়েছে। সেটা পুতুলরা ধুবড়ি আসার দিন তিনেক আগে। উপেন্দ্র সকালে ফোন করে নিজের বাংলোর দুই মালিকে ডেকে পাঠান। তাঁদের বলেন, “আমার বাথরুমের গা ঘেষে একটি বড় হয়ে ওঠা গাছ শাখাপ্রশাখা মেলে অনেকটা অংশ নিয়ে প্রায় ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সেই গাছটা একদম গোড়া থেকে কেটে ফেলতে হবে। প্রাক্তন বিচারকের নির্দেশ শুনে মালিরা গাছটা কেটে দিতেই সেখানে একটি গর্ত তৈরি হল। উপেন্দ্র নির্দেশ দিলেন, “ওই গর্তটা আরও বড় করে দাও যাতে ওখানে একটি নতুন গাছ লাগানো যায়। আমি কোচবিহার থেকে পদ্ম ফুলের গাছ এনে ওখানে লাগাব। যাতে পরের বিচারক ওটা দেখে আমাকে মনে রাখেন।’
প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটে এর ঠিক তিনদিন পর। ওই বাংলোর রান্নাঘরের পিছন দিকে আরও একটি বড় গাছ ছিল। মালিদের ডেকে এনে নতুন ফুল গাছ লাগানোর নাম করে সেই গাছও কাটিয়ে আবার একটি নতুন গর্ত তৈরি করান তিনি।
বাংলোতে ঘোরাঘুরি করার সময় আচমকা পুতুলের নজরে পরে গর্তটি। সে সময় উপেন্দ্র বাড়ি ছিলেন না। ফলে পুতুল মালিকে আবার ডেকে পাঠান এবং দাঁড়িয়ে থেকে গর্তটি বুজিয়ে দেন। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কাজ সেরে বাড়িতে ফেরত এসে বিষয়টি দেখতে পান প্রাক্তন বিচারক। ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তিনি। ফের মালিকে ডেকে নতুন করে গর্ত তৈরি করিয়ে নেন।
১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭০।
সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ নিজের ঘর থেকে বাইরে আসেন উপেন্দ্র। ততক্ষণে তাঁর আর্দালি বিজেন এবং শাহিদ কাজে চলে এসেছিলেন। আগ্রহ নিয়ে তাঁরা জানতে চান, ‘ম্যাডাম আর গুড়িয়া কোথায় স্যর?’ জবাব আসে, ‘আর বোলো না। কাল অনেক বেশি রাতে স্ত্রীর এক আত্মীয় কোকড়াঝাড়ে অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেখান থেকে ফোন আসে। ফলে সাত সকালে ওদের বাসে করে রওনা করিয়ে দিয়েছি।’
প্রথম দিকে খানিকটা অদ্ভুত লাগলেও বিষয়টা নিয়ে দুজনের কেউই আর প্রশ্ন না করে নিজেদের কাজ শুরু করলেন। সব কিছু ঠিকঠাকও চলছিল। কাজ করতে করতে শাহিদের নজর যায় বাথরুমের দিকে। ওখানকার পাইপ দিয়ে যে জল আসছে তার রঙটা কেমন লালচে। তাঁর সন্দেহ হয়। কৌতুহল মেটাতে উঁকি দিয়ে দেখতে পান, বাথরুমে লাল রঙের একটা বিছানার চাদর এবং জামা কাপড় কাচছেন উপেন্দ্র নিজেই। আর কিছু বলার মতো সাহসও দেখালেন না দু’জনে। বরং তাদের মনে হল, আগে তো কোনওদিন সাহেবকে এসব করতে দেখা যায়নি। আজ হঠাৎ কেন এই কাজ করছেন? আবার ভেবে নিলেন, সম্ভবত অবসর নেওয়ার পর সাহেব এসব কাজ নিজেই করে নিতে চাইছেন।
খানিকক্ষণ পর বিজেন এবং শাহিদ আবার নতুন করে ধাক্কা খেলেন। বাড়ির এদিক—ওদিক ময়লা সাফাই করতে গিয়ে নজরে এল বাথরুমের পিছনে যে বড় গর্ত খোঁড়া হয়েছিল সেটা বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ তাতে কোনও ফুল গাছ লাগানো হয়নি! আবারও একদফা সন্দেহ হল তাদের। কিন্তু সাহস করে কে আর সে সব জিজ্ঞেস করে? অতএব সেই প্রশ্নও গর্তচাপা পড়ে রইল ওখানে।
দুপুর পেরিয়ে রাত এল, যেমন রোজ আসে। স্থানীয় এক দম্পত্তি মাঝেমধ্যেই সাহেবের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে ওই বাংলোতে আসতেন। কয়েকদিন না এলেও ওইদিন স্বামীর সঙ্গে এলেন স্থানীয় বাসিন্দা ভাবনা শর্মা। গল্প করতে করতে একবার তিনি বাথরুমে যাওয়ার ইচ্ছেও প্রকাশ করলেন। কিন্তু পত্রপাঠ তা খারিজ করে, রাজখোয়া একটু স্বভাব বিরুদ্ধভাবেই তাঁদের জানিয়ে দিলেন, “আজ বাথরুম ব্যবহার করার মতো পরিস্থিতিতে নেই। ভীষণ নোংরা হয়ে রয়েছে।’
পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টাও কেটে গেল। ১৪ ফেব্রুয়ারি উপেন্দ্র গুয়াহাটিতে তাঁর শ্যালক বরদার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তাঁর ওখানে থেকেই বাকি দুই মেয়ে তখন কলেজে পড়াশোনা করছে। ফোনে তিনি বললেন, মেয়েদের ধুবড়ি পাঠিয়ে দাও। কারণ, ওদের নিয়ে একটু দার্জিলিং বেড়াতে যাব।’
‘বউদি আর নিলু কেমন আছে? তাছাড়া মার্চ মাস থেকে তো লুনা আর রূপালীর পরীক্ষা? এখন যাওয়া কি ঠিক হবে?’—প্রশ্ন করলেন বরদা।
‘আসলে তোমার দিদি এক পরিচিতের অসুস্থতার খবর পেয়ে বড় মেয়েকে নিয়ে কোকড়াঝাড় গিয়েছে। আর তোমাকে আগে জানানো হয়নি তবে আমাদের ঘুরতে যাওয়ার বিষয়টা অনেকদিন আগে ঠিক হয়ে গিয়েছিল, তাই মেজো আর ছোটকে পাঠিয়ে দাও।’ ফোনের এ প্রান্তে স্বাভাবিক গলাতে বললেন উপেন্দ্র।
বেশ কয়েক দফা কথাবার্তার পর, শেষ পর্যন্ত তাড়াহুড়ো করে গুয়াহাটি থেকে বাসে কয়েকঘণ্টার জার্নি শেষে, বিকেলবেলা দুই মেয়ে চলে এল ধুবড়ি। বাসস্ট্যান্ড থেকে তাদের সরকারি গাড়ি করে নিজের বাংলোতে নিয়ে এলেন বাবা। খাতা কলমে অবসর নিয়ে নিলেও একজন বিচারক হিসেবে উপেন্দ্র তখন পর্যন্ত স্বাভাবিক নিয়মে গাড়ি এবং আর্দালি রাখার সুবিধা পাচ্ছিলেন।
মেয়েরা এসে ওই বাংলোতে থাকা শুরু করল। আশেপাশের বাসিন্দারাও তা দেখতে পাচ্ছিলেন। রোজ নিয়ম করে বাংলোর বারান্দায় আড্ডা দিতেন বাবা—দুই মেয়ে। কাজের লোকেরা নিজেদের মত করে এসে অন্য কাজের পাশাপাশি দু’বেলা রান্নাও করে দিতেন। একদিন বাবা এবং মেয়েরা বাইরে ঘুরতেও গেলেন। তবে কোনও কিছুর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ত না কারও। এভাবেই দিন কাটছিল। ততদিনে ঠাণ্ডা ভাবটা আরও জাঁকিয়ে বসা শুরু করেছে আসাম রাজ্যের এই প্রান্তে।
ঠিক দশদিন পর। ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল সাতটা। রাজখোয়া আরও একবার ফোন ঘোরালেন শ্যালক বরদাকে। এটা জানাতে যে, গুয়াহাটির বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি যেন ভাড়াটেকে তুলে দেওয়া হয়। কারণ, পুতুল আর ধুবড়ি থাকতে চাইছে না।
রাত ৯টা। ভাড়াটের সঙ্গে কথা বলে বরদা ফোন করলেন জামাইবাবুকে। কিন্তু ফোনটা কেউ তুলছে না। তাঁর মনে হল, হয়ত মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন তিনি, তাই বিরক্ত না করাই শ্রেয়।
রাত কেটে যায়। পরদিন সকাল। আবারও ফোন। কিন্তু উপেন্দ্রর বাংলোর ফোনটা বেজেই চলেছে। বরদার মনে হল, একটু বেশি বিরক্ত করা হয়ে যাচ্ছে বোধহয়। থাক তাহলে, উনি ফোন করলে তবে কথা বলা যাবে।
এটা আসলে এমন একটা সময়, যখন ল্যান্ড লাইনে ট্র্যাঙ্ককলের যুগ। এসটিডির চল নেই। আর মোবাইল বস্তুটির নামই শোনেননি কেউ।
২৫ তারিখ দুপুর।
বাংলোর গেটের কাছে একটা কালো রঙের অ্যাম্বাসাডর দেখা গেল। গাড়িতে বসে একজন। তাঁর সঙ্গে মুখ বাড়িয়ে কথা বলছেন প্রাক্তন বিচারক। সার্ভেন্টস কোয়ার্টার থেকে অনেকেই দেখতে পেলেন। এটা সামান্য বিষয়। জানার চেষ্টা করে কী হবে, ভাবলেন সবাই।
২৬ ফেব্রুয়ারি। সকাল সাড়ে সাতটা।
আবার অন্যান্যদিনের মতো আর্দালিরা কাজে চলে এলেন। কিন্তু সে দিন বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠলেন রাজখোয়া। ঘর পরিষ্কার করতে ঢুকে কাজের লোকেরা দেখতে পেলেন দুই মেয়ের মধ্যে কেউ নেই। এক আজব কৌতুহল হল তাঁদের। খানিকটা ইতস্তত হলেও প্রশ্ন করে বসলেন, স্যর, দুই বিটিয়া কোথায় গেল?’
হাই তুলতে তুলতে শান্তস্বরে উপেন্দ্র খানিকটা জড়িয়ে আসা স্বরে বললেন, “আরে, ওদের দুজনের কাছে রাতে একটা ফোন এসেছে। তাই ভোরে কোকড়াঝাড়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে গাড়ি ভাড়া করে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার স্ত্রী সেখানে আসছে। আপাতত ওই আত্মীয়ের কাছেই থাকবে। তারপর আমি কয়েকদিনের মধ্যে যাব এখান থেকে। অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়। সবার পারিবারিক ব্যাপারে অযথা মাথা গলানোর কোনও প্রয়োজন নেই। তাই কাজের লোকেরা কাজে মন দিলেন।
একজন সুস্থ—সবল—সাধারণ মানুষ হলে এই সময়ে মনে যে যে প্রশ্নগুলো আসতে পারে তার সবগুলো ঘুরে ফিরে আসছিল আর্দালি এবং অন্যান্য কাজের লোকেদের মনে। কিন্তু কে খুঁজবে তার উত্তর? এখানে ফেলুদা নেই, শার্লক হোমস নেই, তখনও সিনে আসেনি পুলিশ কর্তা বরদার চরিত্রও। অতএব, সব প্রশ্ন দূরে ঠেলে সবাই মন দিয়ে নিজের কাজটা করাই ঠিক সিদ্ধান্ত মনে করলেন। ঘণ্টাখানেক পর ঘরের ময়লা ফেলতে গিয়ে আর্দালি রাজেনের নজরে এল রান্নাঘরের পিছনে যে বড় গর্ত ছিল, সেটাও বুজিয়ে দেওয়ার কাজ চলছে। এবং সাহেবের সঙ্গে হাত লাগিয়েছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ আর এক আর্দালি উমেশ বৈশ্যও। অথচ, এখানে পদ্মগাছ লাগানোর কথা, অবাক লাগল তাদের, “আরে, এই গর্তটা তো কাল পর্যন্ত খোলা ছিল! তাহলে?’
এবারেও মন বলল, “কি দরকার, সাহেব ক্ষমতাবান লোক। নিজের বানানো গর্ত উনি কী করবেন সেটাও তাঁর বিষয়?
ফের কয়েকদিনের জন্য সব আবার যেমন চলছিল, সে রকম চলল। তবে ডিস্ট্রিক্ট অ্যান্ড সেশন আদালতের দায়িত্ব নিতে এন কে চৌধুরী নামে পরবর্তী বিচারক ধুবড়ি চলে এলেন। কয়েক মাসের মধ্যে তাঁর এই বাংলোতে চলে আসার কথা। তবে সাময়িক ভাবে তিনিও থাকা শুরু করলেন সার্কিট হাউজে।
মার্চ মাস পেরিয়ে গেল। বেড়ে চলল স্থানীয় বাসিন্দাদের নানা প্রশ্ন, “আপনার স্ত্রী, মেয়েরা কোথায় ? কবে ফিরবে? আপনি ওদের কাছে যাবেন না?
সবার জন্য উপেন্দ্র যেন একটাই উত্তর প্লেটে করে সাজিয়ে রেখেছিলেন, ‘আমার পুরো পরিবার দিল্লি চলে গিয়েছে। আমিও যাব। টুকটাক কিছু কাজের জন্য আর মাত্র কয়েকটা দিন আছি এখানে।
তারপর, ১৫ এপ্রিল ১৯৭০।
সত্যি সত্যি একদিন সবাইকে দিল্লি চলে যাচ্ছি, বলে পাকাপাকি বাংলো ছেড়ে চলে গেলেন প্রাক্তন বিচারক। সামান্য কিছু যা জিনিস ছিল তা রেখে গেলেন গোলক নামে এক আর্দালির কাছে।
এল জুন মাস। বাংলোটা নতুন রঙ করে খানিকটা সাজিয়ে—গুছিয়ে সপরিবারে থাকা শুরু করলেন ডিস্ট্রিক্ট অ্যান্ড সেশন জাজ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া এন কে চৌধুরী।
তদন্তকারীরা জানতে পারলেন, ধুবড়ি থেকে শিলিগুড়ি যাওয়ার পর তিনদিনের জন্য গৌরিপুরে এক পরিচিতের বাড়িতেও গিয়েছিলেন উপেন্দ্র। সেখানে তাঁকে বলেন, ‘একটা আশ্রম করতে চাই। কাছাকাছি জমি প্রয়োজন।’ সত্যপ্রকাশ নামে সেই আত্মীয়ের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন পুলিশ কর্তারা। তিনি শোনান একদিনের অভিজ্ঞতার কথা, তাঁর বাড়িতে থাকার সময় দু’জনে জমি দেখতে গাড়ি করে বেশ খানিকটা দূরে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়ান। সেই সময় সামনে দিয়ে একটা পুলিশের গাড়ি যাচ্ছিল কোথাও। বলা নেই, কওয়া নেই, প্রাক্তন বিচারক আচমকা গাড়ি থেকে নেমে হাওয়া হয়ে যান। পরে অনেক খোঁজাখুজির পর বলেন, বাথরুমে গিয়েছিলেন।
তবে এই পুলিশ দেখে গায়েব হয়ে যাওয়াটা চোখ এড়ায়নি সত্যপ্রকাশের। পরে তিনি পুলিশ কর্তাদের বলেন, সন্দেহটা আরও বাড়ে, যখন উপেন্দ্র অনুরোধ করেন তাঁর ওখানে যে এসেছেন, তা কাউকে যেন না জানানো হয়।
কেন ঘটল চারটি খুনের ঘটনা? খুনের মোটিভ কী? শিলিগুড়ির হোটেলে ধরা পড়া থেকে ফাঁসির দড়ি ইস্তক দুঁদে পুলিশ কর্তারা মূল অভিযুক্তের কাছ থেকে প্রায় ছ’বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে এ বিষয়ে একটি শব্দও বার করতে পারেননি। অনেকে মনে করেন, বিচারক বলে পুলিশের নিজস্ব আতিথেয়তা’ তাঁর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়নি। ফলে অজানা রয়ে গিয়েছে বহুমূল্য এই প্রশ্নের উত্তর। বাজারে অবশ্য খবর হিসেবে ঘোরাঘুরি করেছে অনেক গল্প। তবে কোনওটারই যুক্তির ভিত তেমন পোক্ত নয়। আর পুলিশের কাছে এটা অবশ্যই একটা ব্যর্থতার ‘মডেল কেস। কিন্তু এসব সরিয়ে রাখলে নিপাট এক ভদ্রলোক, যিনি আবার খোদ বিচারক, তিনি ঘুমিয়ে থাকা প্রিয় মানুষগুলোকে লোহার রড দিয়ে মাথায় আঘাত করে একের পর এক খুন করেছেন তা বিরলের মধ্যে বিরলতম।
আর সেটাই যেন ধ্রুব সত্য, ‘সব খুন হয় কোনও না কোনও কারণে। খোদ খুনি মনে করে, খুন করাটাই তাঁর বৈধ অধিকার।’