প্রতিহিংসার পার্সেল

প্রতিহিংসার পার্সেল

‘দুড়ম’

একটা তীব্র আওয়াজে কেঁপে উঠল পুরো এলাকা। থরথর করতে থাকল বহুতলগুলির ভিত। কাচের জানলাগুলি ভেঙে পড়ল ঝনঝন করে। সমস্বরে কা—কা রব তুলে কাকের দল উড়ে গেল অন্য এলাকায়। বোধহয় ভূমিকম্প! এমন ভাবাটাও অস্বাভাবিক কোনও বিষয় নয় এ তল্লাটে। উত্তরবঙ্গ ভূমিকম্পপ্রবণ হওয়ায় এই দোলা মাঝে মধ্যেই ঘুরে ফিরে আসে। দুলিয়ে দিয়ে যায় স্বাভাবিক চলতে থাকা সবকিছু। দার্জিলিং কিংবা মালদায় যাঁরা থাকেন, তাঁদের কাছে এই দুলে ওঠার আতঙ্ক এই তো আসে, আর এই তো যায়! সেই আশঙ্কা থেকে ভর দুপুরে যাঁরা নিজের বাড়ির ভিতরে ছিলেন, দুড়দাড় করে পালিয়ে বাইরে চলে এলেন।

আর রাস্তায় আসার পর বুঝতে পারলেন, যা ভেবেছিলেন, আসলে তা নয়। একটা বিকট শব্দের পর সবকিছু থমকে গিয়েছে। কাঁপাও পুরোপুরি বন্ধ। অনেকের মনে হল, কারও বাড়িতে সিলিন্ডার ফাটেনি তো? অত্যুৎসাহী দু-একজন এদিক ওদিক খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলেন।তখনই আচমকা চোখে পড়ল সীতাংশু দাসের বাড়ির একতলার ভাড়াটের সিঁড়িটা। সেখান দিয়ে গড়িয়ে আসছে রক্তের ধারা। কৌতুহল মেটাতে মুখটা বাড়ালেন কয়েকজন, তারপর দৌড়ে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। ভিতরটা ধোঁয়ায় অন্ধকার। কেমন পোড়া বারুদের গন্ধ। যেটুকু বোঝা যাচ্ছে তাতে ঘরের ছাদের একটা অংশ সাইক্লোনের মতো উড়ে গিয়েছে। ধসে পড়েছে একদিকের দেওয়াল। ঘরময় উড়ছে পুড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া বইয়ের পাতা। কাউকে কেটে সারা ঘরে মাংসপিণ্ড যেন ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গা গুলিয়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট। হৈ—হৈ শুরু হয়ে গেল পাড়াময়। সবাই গেলেন ঘরের দিকে। উকি মারতেই দেখা গেল, ঘরের বাসিন্দা বছর ছাব্বিশের স্কুল শিক্ষিকার ছিন্নভিন্ন দেহ পড়ে রয়েছে মেঝেতে। শরীরের একটা অংশ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন। চারদিক রক্তে মাখামাখি। চেঁচামেচি শুনে দোতলা থেকে নেমে এলেন বাড়ির মালকিন রেখা দাস এবং তাঁর মেয়ে সোনালি। মাত্র পাঁচ মিনিট আগে সোনালি একতলায় নেমে দিদিমণির হাতে তুলে দিয়েছিল একটা বড় পার্সেল।

কোথায় ঘটল এমন ঘটনা?

পার্সেল বোমা বিস্ফোরণ মামলা। ইংরেজবাজার, মালদা। ২৪ এপ্রিল, ২০১১।

ঘটনাস্থলে একঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গিয়ে বিস্ফোরণের তীব্রতা দেখে তদন্তকারীদের প্রথমেই মাথায় এল, কেএলও বা মাওবাদীদের কাজ নয় তো? নাহলে এভাবে পার্সেল বোমা তৈরিতে যে দক্ষতার প্রয়োজন জেলাতে কার থাকতে পারে? সন্দেহটা আরও উসকে দিল একটি তথ্য। তা হল, হবিবপুর বরাবর কেএলও সংগঠনের অন্যতম শক্তিশালী গড়। ওই এলাকায় একটু অনুসন্ধান করতে খুব বেশি বেগ পেতে হল না। তাতে জানা গেল, কেএলওর ভিত অনেকটাই দুর্বল হয়ে এসেছে। ফলে খামোখা বিস্ফোরণে একজন শিক্ষিকা খুন করানোর ঝুঁকি তারা নেবে কেন? ওই সম্ভবনা প্রায় নেই। বলতে গেলে একশ’র মধ্যে পাঁচ শতাংশ।

তবুও জঙ্গি সংগঠন, পুরোনো প্রেম বা সম্পর্ক, মোটামুটি এই দুটি অ্যাঙ্গেলকে সামনে রেখে শুরু হল মামলার জট খোলার কাজ। বাকি সব তদন্ত ফেলে এটা নিয়েই পড়ে থাকলেন জেলা পুলিশের তাবড় কর্তারা। আনা হল ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ এবং সিআইডির গোয়েন্দা কুকুর। এই ঘটনা চিন্তা বাড়াল মহাকরণের। কারণ, রাজ্যের মধ্যে এটাই প্রথম পার্সেল বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা।

আগের দিন তদন্ত শেষ করে, বেশ কিছু সূত্রের সন্ধান নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। সন্দেহভাজন কয়েকজনকে জেরা করার কাজটা সেরে ফেলতে হবে আজই, ভাবলেন তিনি। হয় প্রাক্তন স্বামী সঞ্জয়, নয়তো ওই প্রাক্তন প্রেমিক ছোকরা প্রিন্স, এদের মধ্যেই তদন্তের বিষয়টা ঘোরাফেরা করছে। তুলেও আনা হয়েছে দু’জনকে। একজন গাজোলে থাকেন তো অন্যজন ওল্ড মালদার বাসিন্দা। ইংরেজবাজার থানা থেকে কমবেশি ৫০ কিমি দূরত্ব। কিন্তু দুটোই অত্যন্ত ঘোড়েল মাল। জেরা করলেই এপাশ—ওপাশ দিয়ে ঠিক কথা ঘুরিয়ে দিচ্ছে। পুলিশের বিষাক্ত ইনসুইং—আউটসুইংগুলো থেকে অবলীলায় সরিয়ে নিচ্ছে ব্যাট। সঞ্জয় বলছেন, বছর তিনেক আগে ডিভোসের পর থেকে আর কোনও রকম যোগাযোগ নেই। অন্যদিকে, প্রিন্সের দাবি, ২০০৯ সালে চাকরি পাওয়ার কয়েকমাস পর থেকে তাদের সম্পর্কেও ইতি টেনে দিয়েছে অপর্ণা। আবার থানায় এসে মৃত শিক্ষিকার বাবা স্বরূপ বিশ্বাস জানিয়ে গিয়েছেন, তাঁর সন্দেহ এদের মধ্যে একজনের প্রতি। কারণ, কিছুদিন আগে রায়গঞ্জগামী একটি বাসে তাঁর মেয়ের তুমুল বচসা হয় ওই অভিযুক্তের সঙ্গে। বাসভর্তি যাত্রীর সামনে দু’জন দুজনকে চড় মারে। সেই ঘটনা থেকে পাকাপাকি ভাবে দাঁড়ি পড়ে যায় সম্পর্কে।

পুলিশ কর্তারা মন দিয়ে স্বরূপবাবুর কথা শুনেছেন। কিন্তু পুরোটা ধ্রুবসত্য হিসেবে ধরে নিতে প্রমাণের বড়ো প্রয়োজন তাঁদের।

সদ্য ব্রেকফাস্ট শেষ করে সবে খবরের কাগজগুলোতে চোখ বোলাচ্ছিলেন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। আন্দোলনে উত্তাল সিঙ্গুরে তিনি ছিলেন এসডিপিও। এছাড়াও গত কয়েকবছরে একাধিক জায়গায় ছুটতে হয়েছে তাঁকে। যেতে হয়েছে জঙ্গলমহলেও। এখানে অবশ্য অন্য রকম অভিজ্ঞতা। ভাবতে না ভাবতেই বেজে উঠল তাঁর পাশে রাখা বিএসএনএল নম্বরের মোবাইলটা। স্যর, কুরিয়ার কোম্পানি থেকে বলছি। আমাদের সংস্থার পার্সেলটা যে নিয়ে গিয়েছিল, সেই ছেলেটি এসেছে। ওর সঙ্গে কথা বলতে পারেন স্যর। আমরা বসিয়ে রেখেছি।

এতো মেঘ না চাইতেই জল! কোনওক্রমে পোশাকটা গায়ে চাপিয়ে এএসপি দ্রুত ছুটলেন। এক্ষুনি পৌছতে হবে। না হলে সব হিসেব গড়বড় হয়ে যেতে পারে। এসব কাজ ফেলে রাখার নয়। কাল সন্ধ্যার দিকে ব্রাউন রঙের ফর্দাফাই হয়ে যাওয়া পার্সেলটা ঘেঁটে বহু কষ্ট করে উদ্ধার করা গিয়েছিল কুরিয়ার সংস্থার নামটা। যোগাযোগ করতে গিয়ে রাত হয়ে যায়। আজ ওদের অফিসে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সকালবেলার ফোনটা পেয়ে পুলিশ কর্তা হন্তদন্ত হয়ে প্রথমেই সেই তথ্যটা জানিয়ে রাখলেন নিজের বস জেলার পুলিশ সুপারকে। তারপর রওনা।

একটা এঁদোগলির মধ্যে কুরিয়ারের দপ্তর। গাড়িটা একটু দূরে রেখে দিতে হল। তারপর হেঁটে। মনে মনে অস্ফুটে বলেন এএসপি, শালারা খুঁজে খুঁজে বার করেছে বটে, এমন একটা জায়গা।’

সামনে পেল্লাই সাইজের টেবিল পাতা। একদিকে বড় গদি আটা চেয়ার। উল্টোদিকে পর পর তিনটে প্ল্যাস্টিকের চেয়ার রাখা। অনেকগুলো বড় বড় ব্যাগ। মুখগুলো দড়ি দিয়ে বাঁধা। পিছনে আলমারিতে প্রচুর জাবদা খাতা। অল্প বয়সী কিছু ছেলে চিঠি এবং পার্সেল মেলানোর কাজে ব্যস্ত। পুলিশ কর্তা পৌঁছতেই মালিক বিশ্বাসবাবু নেয়াপাতি ভুড়ি নিয়ে হাত কচলাতে শুরু করলেন। স্যর, কি বলব, ঠাণ্ডা না গরম?’

মাথাটা গরম হয়ে গেল এএসপির। মশাই, আমি খেতে এসেছি নাকি, কাজটা করতে দিন। এবার বলুন তো, কে ওটা বুকিং করিয়েছিল ? গাজোলের শুভম বিশ্বাস নামে কাউকে পাওয়া যায়নি? অথচ বুকিং হয়েছিল ওই নামে। আপনারা যে যা দেয়, নিয়ে নেন? বোমাটা ওখানের বদলে এখানেও কোনও ভাবে ফাটতে পারত, তখন?’

মালিক আমতা আমতা করে শুধু বললেন, “আজ্ঞে স্যর। আজ্ঞে স্যর। তবে বলছিলাম কি স্যর, ওই ছেলেটা, মানে যে চিঠিটা দিদিমনির কাছে পৌছতে গিয়েছিল, তাকে আজ কোথাও না পাঠিয়ে আপনার জন্য রেখে দিয়েছি স্যর। অনুমতি দিলেই ডাকব।’

ফের একবার মাথাটা চড়াক করে গরম হয়ে গেল পুলিশ কর্তার। তবুও মেজাজটাকে নিয়ন্ত্রণে রেখে বললেন, এর জন্য অনুমতি লাগে নাকি? পার্সেল পাঠানোর সময় নিয়েছিলেন? ডাকুন এক্ষুনি, তখন থেকে শুধু ভূমিকা করে যাচ্ছেন।’

হাঁক পাড়লেন মালিক, ‘এই ভুতো। সুমনকে ডাক তো।’

একটা রোগা চেহারার যুবক। বয়স তিরিশের মধ্যে। পরনে ছাই রঙা থ্রি কোয়াটার প্যান্ট এবং হলুদ রঙের হাফ টিশার্ট। হাতে একটা স্টিলের বালা। ঠোঁটটা বিড়ি খেতে খেতে কালো হয়ে গিয়েছে বেশ বোঝা যাচ্ছে। সামনে এসে দাঁড়াল। এএসপি—র মাথায় খেলল, আচ্ছা, অপর্ণা বাড়িতে না থাকায় ওই পার্সেলটি সেদিন দু’টি রসিদে সই করে নিয়েছিল বাড়ির মালিকের মেয়ে সোনালি দাস। সে পুলিশের কাছে কুরিয়ার বয়ের ঠিক এই পোশাকের কথাই তো বলেছিল! যা হুবহু মিলে যাচ্ছে। অর্থাৎ, ছেলেটার মধ্যে বাজে কোনও উদ্দেশ্য আছে বলে আপতত মনে হচ্ছে না। সেয়ানা হলে পোশাকটা অন্তত পাল্টে ফেলত।

সুমনকে পুলিশের গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হল থানায়। তারপর একটা ফাঁকা ঘরে বসে শুরু হল জেরার কাজ।

প্রথম দিকে একটু হালকা কথাবার্তার পর এল আসল প্রসঙ্গ। সুমন দেখা গেল, তদন্তে সহযোগিতা করতে বেশ আগ্রহী। তার ডেলিভারি দেওয়া জিনিসে একজন দিদিমণির এই ধরনের মৃত্যুতে সে অনুতপ্তও বটে। শুরুর ভয় কাটিয়ে এক সময় গড়গড় করে বলা শুরু করল সব। স্যর, পার্সেলটা ২২ তারিখ রোগামতো একজন এসে দিয়ে যায়। ব্রাউন কালারের কাগজ দিয়ে সেটা ভালো করে মোড়া ছিল। উপরে লেখা ‘আর্জেন্ট। ঠিকানা, অপর্ণা বিশ্বাস, কেয়ার অফ সীতাংশু দাস,মালঞ্চ পল্লী, মালদা। সেন্ডার হিসেবে নাম লেখা ছিল শুভম বিশ্বাস, বিবেকানন্দ পল্লী, গাজোল। বেশ বড় পার্সেল। বলা হয়েছিল, এতে কিছু গল্পের বই রাখা আছে। তাই তাড়াতাড়ি পৌছে দিতে হবে।’ বলে চলে সুমন, ‘সেটা পরের দিন। মানে,২৩ তারিখ। অনেক চিঠি এবং পার্সেল থাকায় আর্জেন্ট সত্ত্বেও ওটা পৌঁছে দেওয়া যায়নি। কিন্তু বিকেলবেলা আমাদের অফিস এবং আমার মোবাইলে একটা নম্বর থেকে ফোন আসা শুরু করে। তাতে বেশ রাগের সঙ্গে একজন বারবার ধমকি দিয়ে জানতে চাইছিলেন, কেন আগের দিন পার্সেলটা গেল না? তাই, পরের দিন আর ঝুঁকি নিইনি। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ বড় প্যাকেটটা ব্যাগে ভরে ওই ঠিকানায় চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু যাঁর নামে পার্সেল, তিনি তখন বাড়ি না থাকায়, সোনালি নামে একজনের হাতে দিয়ে চলে আসি। পরে এসব শুনলাম। আমার কোনও দোষ নেই স্যর। ’

শিক্ষিকা অপর্ণা বিশ্বাস
শিক্ষিকা অপর্ণা বিশ্বাস

এতটা পর্যন্ত চুপচাপ শুনে পুলিশ কর্তা বুঝে গিয়েছিলেন মামলার লম্বা সুতোর লাটাই গোটানো সম্ভবত হয়ে গিয়েছে। প্রশ্ন করলেন, “তা, তুই কি আমাকে ওই নম্বরটা দিতে পারবি?

—“হ্যাঁ স্যর, কেননয়?’বলল সুমন। তারপর নিজের প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে খুটখুট করে দেখাও শুরু করল অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের সামনে। একটা একদম ছোট্ট কমদামি সেট। মিনিট দশেক দেখার পর কললিস্টের ভিড়ে আর খুঁজে পাওয়া গেল না নম্বরটা। তাতে কী, পুলিশ কর্তা এবার মোবাইলটা হাতে নিয়ে তিনদিনের সব নম্বর বার করে ফেললেন মাত্র কয়েক মিনিটে। অনুসন্ধান শুরু হল। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো হাতে এল আরও একটা সূত্র। এবং সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ এই তদন্তের ক্ষেত্রে। প্রায় পাঁচজোড়া চোখ ঘুরতে ঘুরতে আটকে গেল একটা নির্দিষ্ট নম্বরে এসে। সেই নম্বরটা থেকে যেমন কুরিয়র বয়কে ফোন করা হয়েছে,ঠিক তেমনই বহুবার ফোন গিয়েছে অপর্ণার মোবাইলেও। আগে থেকে মৃত স্কুল শিক্ষিকার মোবাইলের কল ডিটেইলস হাতে নিয়ে বসে ছিলেন তদন্তকারীরা। ফলে মিলে গেল অঙ্ক।

এই ফোনের মালিক তাহলে কে? উঠে এল আরও একটা নতুন ধাঁধা।

মাঝে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধান। সুমনকে ছেড়ে দেওয়া হল থানা থেকে।

এটা শুনিয়ে যে, যখন ডাকা হবে তখনই যেন ফের চলে আসে। এদিকে, ঠিক তার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে মোবাইলের সার্ভিস প্রোভাইডার জানিয়ে দিল, ফোনের মালিকের নাম প্রিন্স ঘোষ। বাড়ি, মালদার মঙ্গলবাড়ি এলাকায়।

পুলিশের অন্য একটি দল ততক্ষণে ডেকে পাঠিয়েছে অপণার প্রাক্তন স্বামী সঞ্জয় মজুমদারকে। তিনি থাকেন হবিবপুর। তেমন কিছু করেন না। সঞ্জয় পুলিশের জেরার জবাবে অবশ্য জানিয়ে দিলেন, বছর খানেক বিবাহিত জীবন কাটালেও ২০০৯ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় পাশ করে চাকরি পাওয়ার দু’মাসের মাথায় অর্পণা তাঁকে ডিভোর্স দিয়ে দেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, সঞ্জয় বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও অন্য একটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন।

‘সেটা কি সত্যি?’ জানতে চাইলেন গোয়েন্দারা।

‘না স্যর। তবে পরিচিত একজন অবশ্যই ছিল। যদি সত্যি হত তবে আবার বিয়ে করতাম। তা তো করিনি। একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে স্পষ্ট উত্তর এল সঞ্জয়ের কাছ থেকে।

‘তাছাড়া ওই সিদ্ধান্তের পর আর সন্দেহবাতিক অপর্ণার সঙ্গে কখনও যোগাযোগ রাখিনি। ফলে কোনও ঝামেলাও হয়নি। তাহলে এতদিন পর কেন এই কাজ করতে যাব, আপনারাই বলুন স্যর?’ সঞ্জয় পাল্টা একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন বটে, তবে তাঁকেও সন্দেহের বাইরে রাখা উচিত হবে না। ভাবলেন পুলিশ কর্তারা। এই ধরনের ঘটনায় যে কোনও মুহূর্তে তদন্তের অভিমুখ বদলে যেতে পারে। সামনে আসতে পারে নিরীহ কোনও চরিত্রের বুনে দেওয়া ষড়যন্ত্রের জাল।

দল বেঁধে পুলিশ কর্তারা চলে এলেন থানায়। ইংরেজবাজার থানা চত্বরে যেন গাড়ির মেলা। সঞ্জয়কে বলা হল, “আমাদের অনুমতি না নিয়ে জেলার বাইরে কোথাও যাবেন না। যখন ডাকা হবে থানায় চলে আসবেন। বেশি চালাকি করতে গেলে কিন্তু সমস্যা বাড়বে। এতক্ষণ একগাদা গোয়েন্দার হাইভোল্টের চোখের সামনে ঘেমে যাওয়া সঞ্জয় রুমালে মুখ মুছতে মুছতে শুধু বলতে পারলেন, যা বলবেন তাই করব। একবার ফোন করলেই চলে আসব। এবার বাড়ি যাই স্যর?’

তদন্তকারী ঘাড় নাড়তেই চোখের নিমেষে থানার বাইরে চলে গেলেন তিনি।

পুলিশ সুপার চেয়ারে বসেই জানতে চাইলেন সেদিনের তদন্তের অগ্রগতি। শুনলেন সন্দেহভাজন দু’পক্ষের বয়ান। তবে তাঁর নির্দেশ, আপাতত প্রিন্সের দিকে আমাদের ফোকাস করতে হবে। ওকে পেলে কোথা থেকে? ঠিক ভাবে একটু ঝালাই করো। জানা দরকার, ম্যাডামকে কেন এত ফোন করত?

এই মামলার তদন্তের জন্য বিভিন্ন থানা থেকে প্রায় ১৫ জন দক্ষ অফিসারকে নিয়ে একটা বিশেষ দল তৈরি করা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে একজন বলে উঠলেন, ‘স্যর। দুপুরবেলা ধরে আনা হয়েছে। ওর এক বন্ধু রাজকুমার ঋষির কালিয়াচকের ছোট সুজাপুরের বাড়ি থেকে। সেখানে গাঁজায় টান দিচ্ছিল। দুটোকে একসঙ্গে তুলেছি আমরা।’

নির্দেশ পেতেই আলাদা করে ডেকে আনা হল প্রিন্সকে। রোগা চেহারা। ছোট চুল। দাড়ি—গোঁফ কাটা। পরনে একটা স্যান্ডাে গেঞ্জি আর লুঙ্গি। তার বয়সও দেখে বোঝা যায় ওই ২৯/৩০ হবে বড় জোর। বসতে বলতেই মেঝেতে বসে পড়ল ধপ করে। মুখেচোখে অনুশোচনার লেশমাত্র নেই। গোয়েন্দারা শুরু করলেন কথাবার্তা, ‘কিরে, বেশি চালাকি না করে বল, ওই দিদিমণিকে ফোন করতি কেন? তোর সঙ্গে সম্পর্ক তো চুকে গিয়েছিল? তারপর ফোন, কোন দরকারে?’

আস্তে আস্তে গোবেচারার মতো মুখ খোলা শুরু করল প্রিন্স।‘স্যর, আপনারা জানেন আমার ক্লাস এইট পর্যন্ত বিদ্যা। অপর্ণার সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও টুকটাক কাজের জন্য আমাকে প্রায়ই ফোন করত। ধরুন, বাড়ির টিভিটা খারাপ হল কিংবা অন্য কোনও কাজ। আমিও কিছু জিনিস বুঝতে না পারলে ফোন করতাম। তবে স্যর একটা কথা বলতে পারি, ওর আগের স্বামীটা সুবিধার ছিল না। ডিভোর্স দিয়ে দিলেও বিরক্ত করত। আমাকে অনেকবার বলেছে অপর্ণা। খোঁজ নিয়ে দেখুন আপনারা। মিছিমিছি আমার পিছনে পড়ে থেকে সময় নষ্ট করছেন। একটু থামল প্রিন্স। তারপর চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল দ্রুত। পুলিশ কর্তারা বুঝলেন এ ছেলে ঘাঘু মাল।

ইশারায় কথা হয়ে গেল গোয়েন্দাদের মধ্যে। একজন উঠে গিয়ে অপর্ণার ফোনের কল ডিটেইলস রেকর্ড চেক করে সঞ্জয়ের সঙ্গে যোগাযোগের কোনও সূত্র পেলেন না। কিন্তু ছোট ছোট বিষয় প্রথম থেকে ইগনোর করলে মুশকিল। তাই সরাসরি সঞ্জয়কে ফোন ঘোরালেন। “আচ্ছা সঞ্জয়বাবু, আপনার সঙ্গে অপর্ণাদেবীর লাস্ট কবে কথা হয়েছিল একটু তাড়াতাড়ি বলুন তো।’

‘স্যর, একদম নির্দিষ্ট ডেট বা টাইম বলতে পারব না। তবে ডিভোর্সের পর আর কথা হয়নি আমাদের মধ্যে। আমি ওর নতুন নম্বরটা জানতাম না। সামনাসামনি দেখাও হয়নি বহুকাল। সঞ্জয়ের সোজাসুজি উত্তর পেতেই তদন্তকারীরা বুঝে গেলেন প্রিন্স অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রাখার খেলা খেলতে চাইছে।

জেলা পুলিশ সুপারের মাথায় তখন অন্য বুদ্ধি খেলে গেল। প্রিন্সকে ওখান থেকে সরিয়ে তিনি দুটি দলকে পৃথক দুটি কাজ দিলেন। এক, প্রিন্সের বন্ধু রাজকুমারকে আলাদা করে জেরা। দুই, প্রিন্সের ওল্ড মালদার বাড়িতে তল্লাশি চালানো। সময় নষ্ট না করে একটি দল বেরিয়ে পড়ল মঙ্গলবাড়ির দিকে। তদন্তের প্রতি মিনিট মূল্যবান।

সরু গলি দিয়ে হুটার বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি ঢুকতেই এলাকার বাসিন্দারা তাকিয়ে রইলেন। তাঁদের কানে ততক্ষণে টুকরো—টাকরা খবর পৌছে গিয়েছে পাড়ার ছেলের এহেন ভিলেনরূপী আচরণের। সবার কৌতুহল বাড়তি কিছু তথ্যের। গোয়েন্দারা অবশ্য সে সবের তোয়াক্কা না করে দরজা ঠেলে সোজা ঢুকে পড়লেন ভিতরে। ইটের গাঁথনি দেওয়া একতলা বাড়ি। কেউ নেই। ঘরের মধ্যে বেশ কিছু তার, সুইচ এবং ছড়ানো বইয়ের পাতা। হাতে নিতেই বোঝা গেল যে বইটাকে পার্সেল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল এগুলি সেখানকার কেটে নেওয়া কয়েকটি পাতা। খুব সূক্ষ্মভাবে ব্লেড দিয়ে পাতাগুলি কাটা হয়েছে। এক অফিসার গুছিয়ে তুলে নিলেন সেগুলি। যাতে ফরেনসিক পরীক্ষার পর আদালতে নথি হিসেবে জমা দেওয়া যায়। এদিক ওদিক খোঁজাখুজি করতে গিয়ে ঘরের এককোণে ব্যাগের মধ্যে দলা করে রাখা পাঁচ হাজার টাকাও মিলল।

অন্য দলটি তারও আধঘণ্টা আগে ইন্টারোগেশন রুমে নিয়ে বসিয়েছে রাজকুমারকে। ২৭/২৮ বছর বয়স। ক্ষয়াটে চেহারা। গায়ের রঙ কালো। প্রথম দিকে যতটা ডাকাবুকো মনে হচ্ছিল মাত্র কয়েকঘণ্টা আশেপাশের হালহকিকত দেখতে পেয়ে কিসমিসের মতো যেন মিইয়ে গিয়েছে। শুরু হল প্রশ্নপর্ব।

কী করিস রে তুই?

‘স্যর। সুজাপুরে একটা টিভি সারাইয়ের দোকান আছে।

প্রিন্সকে চিনলি কী করে?

‘কয়েক বছর আগে আমরা একটা টিভি কোম্পানির সার্ভিসিং সেন্টারে একসঙ্গে কাজ করতাম। সেখান থেকে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। পরে কাজ ছেড়ে দিলেও যোগাযোগটা ছিল।’

এধরনের ঘটনায় যারা অভিযুক্ত, তারা বেশ পোড়খাওয়া হয়। কিন্তু রাজকুমারকে অত হড়হড় করে কথা বলতে দেখে পুলিশ কর্তারা বেশ উৎসাহিত হলেন। তাঁদের মনে হল, এ যেন পুরোনো বাইক। এক কিক দিতেই স্টার্ট নিয়ে নিয়েছে। এখন শুধু কন্ট্রোল করতে হবে বুঝেশুনে।

এই প্ল্যানটা কী করে করলি, এবার বলে ফেল, নাহলে এই কেসে কেমন ফেঁসে যাবি জানিস? রাজকুমার যেন এই প্রশ্নটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। বলে চলল, এক নাগাড়ে। স্যর, ওদের সম্পর্কের বিষয়টা আগে জানতাম। মাসখানেক আগে প্রিন্স আমার দোকানে এল এক বৃষ্টির রাতে। মুখটা দেখলাম লাল হয়ে রয়েছে। কারণ জানতে চাইলে বলল, অপর্ণাকে ফোন করেছিল কিন্তু ওকে যাচ্ছেতাই বলে লাইন কেটে দিয়েছে। চা খেতে বললেও সেদিন খেল না। চলে গেল তাড়াতাড়ি। বুঝলাম, মুড খারাপ। তারপর কয়েকদিন খোঁজ নেই। এক সপ্তাহ বাদে আবার এল একদিন দোকানে। সেদিনও বৃষ্টি পড়ছিল। একদম ভিজে কাকের মতো দেখতে লাগছিল। আমার গেঞ্জি ওকে পরার জন্য দিলাম। তখন হাতে তেমন কোনও কাজ ছিল না। একটা টিভি সেট খুলে শুধু ঝালাই করছিলাম। জানতে চাইলাম, কি খবর দোস্ত? একটা খিস্তি দিয়ে জবাব দিল, শুধু দোস্ত বলিস, অথচ একটা মেয়ে আমাকে দিনের পর দিন অপমান করছে সেই খবর রাখিস না।’

একটু থামল রাজকুমার। দুঁদে পুলিশ কর্তা ভাবলেন এমন সাপকে দুধ—কলা না দিলেই নয়। তিনি জোরে হাঁক পাড়লেন ক্যান্টিন বয়ের দিকে, ‘বিশু এক কাপ স্পেশাল চা বানিয়ে আন তাড়াতাড়ি। চালু চা দিবি না। তাহলে তোকে ধরেই ক্যালাব। এবার রাজকুমারের দিকে তাকিয়ে পুলিশি চালে বললেন ‘তোর কোনও চিন্তা নেই। তুই ভালো ছেলে। যত নষ্টের গোড়া ওই প্রিন্স। বলে যা।’

অনেকদিন পর যেন চেপে রাখা কথা বলার সুযোগ পেয়েছে সে, কাজেই কোনও ঝামেলায় না গিয়ে রাজকুমার উগড়ে দিল সব। আমাকে অপর্ণার বিষয়ে খুলে বলল সব কিছু। ওর সঙ্গে কীভাবে গদ্দারি করেছে তাও জানাল। আমি বলেছিলাম, দোস্তের জন্য জান হাজির। একবার শুধু বল, কী করতে হবে? প্রিন্স ফিসফিস করে আমার কানের সামনে মুখটা এনে বলেছিল, একটা প্ল্যান আছে, কথা দে কাউকে বলবি না, তাহলে বলতে পারি। কসম খেলাম। এবার ও একটা নোংরা গালাগাল দিয়ে প্রস্তাব দিল, সারা জীবন শুধু মিস্ত্রি হয়ে থাকলে হবে? একটা বৈজ্ঞানিকের মতো কাজ করতে হবে, পারবি?’ কথার মধ্যে চলে এল গরম চা। অফিসার পরামর্শ দিলেন, ‘চা খেতে খেতে বল, গলায় আরাম পাবি। ভালো, স্পেশাল চা বললাম তোর জন্য, দেখলি তো।’

চা খেতে গিয়ে একটা বড় রকমের বিষম লাগল রাজকুমারের। কাশতে শুরু করল সে। চেয়ার ছেড়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন তদন্তকারী অফিসার। মাথায় হাত বুলিয়ে, পিঠে সামান্য চাপড় মেরে স্বাভাবিক করতে চাইলেন পরিস্থিতি। কেমন যেন ভ্যাবলার মতো চেয়ে রইল রাজকুমার। হয়ত ভাবল, কেসটা কী, পুলিশ এত খাতিরদারি করছে কেন? অফিসারের মনে তখন অন্য চিন্তা। বাপ, তুই সুস্থ থাক। সোনার ডিম দেওয়া হাঁসকে ঠিক রাখতে না পারলে সব চটকে যাবে। মিনিট পাঁচেক চুপচাপ থেকে ফের কথা বলা শুরু হল তার।

‘স্যর, কসম যখন খেয়েই নিয়েছি সাহস করে ওইদিন প্রিন্সকে বললাম, একবার সুযোগ দিয়ে দেখ না, পারি কি না? প্রথমে অবশ্য ও কিছু বলেনি। কিছু টাকা শুধু ধার চাইল। সেদিন হাজার বিশেক টাকার একটা বড় পেমেন্ট পেয়েছিলাম, ছ’হাজারের একটা পাওনাদার ছিল, ফলে ওর হাতে নগদ ১৪ হাজার টাকা তুলে দিতে কোনও অসুবিধা হয়নি। তাছাড়া আমাদের মধ্যে এরকম ধার—বাকি চলে। টাকাটা নিয়ে খানিকক্ষণের মধ্যে হুড়োহুড়ি করে বেরিয়ে গেলেও ফের তিনদিন বাদে এসে প্রিন্স খবরটা দিল, একটা বড় পার্টি পেয়েছে। অনেক টাকা দেবে। কাজটা একটু অন্যরকম।

মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে শুনতে অফিসার শুধু বললেন, তারপর?

‘প্রিন্স আমাকে বলে, একটা পার্সেল বোম তৈরি করতে হবে। নতুন ধরনের কাজ। মোটা বইয়ের মধ্যে সার্কিট যুক্ত করে বোম ফিট করলেই চলবে। যাতে মোবাইলের সঙ্গে কানেকশন হলে ওটা ফেটে যায়। বলেছিল, তাতে পার্টি লাখখানেক টাকা দেবে। একদিন চিন্তা করার জন্য টাইম চেয়েছিলাম আমি। তারপর ভেবে দেখলাম, এই মরা বাজারে এক থেকে কিছু টাকা ঘরে এসে গেলে ক্ষতি কী? তাই হ্যাঁ করে দিয়েছিলাম। আর বেশি কিছু জানতে চাইনি।

‘বুঝলাম, এবার কি হল?—ফের প্রশ্ন পুলিশ কর্তার। ঘরে তখন যেন পিন পড়লেও আওয়াজ পাওয়া যাবে, এতটাই নিস্তব্ধতা।

‘এবার একটু একটু করে কাজ শুরু করলাম আমি।তাতে হাত লাগাল প্রিন্সও। সপ্তাহ খানেক নিজেদের বুদ্ধি আর বইটই ঘেঁটে একটা ছোটখাট আইইডি বানিয়ে ফেললাম আমরা। আসলে প্রিন্স খুব তাড়া দিচ্ছিল। পনের দিন আগে একটা মাল তৈরি হলেও ওটা ফাটবে কিনা, তা নিয়ে চিন্তা ছিল আমাদের। ও বারবার বলছিল ফেল করলে পার্টি একটা টাকাও দেবে না। উল্টে সব লস হয়ে যাবে। কী করা যায়? এই ভাবতে ভাবতে হঠাৎ প্রিন্সই বুদ্ধিটা দেয়, এক কাজ করি চল। আমার বাড়ির কাছে একটা ফাঁকা জায়গা আছে ওখানে একবার টেস্ট করে নিই। তখন দুপুরবেলা। ওর বাড়িতে খাওয়াদাওয়ার পর মাঠের মতো জায়গায় গিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম দু’জনে। ভালো লাগল এটা ভেবে যে, আমাদের কাজটা ঠিকঠাক হয়েছে। তবে স্ প্লিন্টারগুলির আরও একটু পাওয়ার বাড়ানো প্রয়োজন। কারণ, ওগুলো বইয়ের ভিতর থাকার সময় জোরে চাপ তৈরি করতে না পারলে তীব্রতা বাড়বে না। আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হল কাজটা তাহলে হবে আমাদের দ্বারা। তখনও জানতাম না এই কাজে ব্যবহার করা হবে ওই সার্কিট লাগানো বোমটি।

এরপর? প্রশ্নটা জিভের ডগায় এলেও পুলিশ কর্তারা তা সংবরণ করে রাজকুমারকে বললেন, ঠিক আছে। তুই এবার লকআপে গিয়ে বসে থাক। দুপুরের খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে নিয়ে রেডি থাকবি। আবার ডাকব।’ ‘আচ্ছা স্যর। ঘাড় নাড়িয়ে এক কনস্টেবলের সঙ্গে হাঁটা দিল সে।

‘এই ঘোষ, ওই ব্যাটাকে আনে এবার। দেখি জামাই আদর করলে কি বলে?’ বললেন পুলিশ কর্তা। মামলা সলভ হতে আর বেশি দেরি নেই, সেই কনফিডেন্স তখন পেয়ে গিয়েছেন জেলা পুলিশের কর্মীরা।

প্রিন্স এল। আর সামনে দাঁড়াতেই সপাটে তার গালে একটা বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় লাগিয়ে দিলেন এক গোয়েন্দা অফিসার। ছিটকে দেওয়ালের দিকে দরাম করে পড়ে গেল প্রিন্স। হঠাৎ এই চড়ে খানিকটা দিশা হারিয়ে ফেলল সে। এমনিতে ঘরটা আধো অন্ধকার। সবার মুখও দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, সব গোয়েন্দা অফিসারই এক—একজন যেন মিস্টার ইন্ডিয়ার অনিল কাপুর।

পুলিশ কর্তাদের অভিজ্ঞতা বলে, যত বড় ক্রিমিনাল হোক না কেন, ভয়ঙ্কর রকমের ইগো থাকে তাদের। সেটা শুরুতে একবার ভেঙে চুরচুর করে দিতে পারলে কাজ করাটা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে প্রথম থাপ্পড়টা অবশ্য টোটকা হিসেবে কাজে দিল না। নিজেকে সামলে হাঁটু গেড়ে বসে প্রিন্স শুরু করল সেই চর্বিতচর্বন। অপর প্রাক্তন স্বামীর কথা। মিনিট তিনেক এমন কাটল।

আচমকা ঘরটা গমগম করে উঠল একটা আওয়াজে। আরে! এটা সেই রাজকুমারের গলা না? একটু আগে এই ঘরে বসে যে শুনিয়ে গিয়েছে এই মামলা সম্পর্কে নানা তথ্য। ঠিক আগের জেরার সময় তদন্তকারী এক অফিসারের মোবাইল রেকর্ডিং অপশন অন করে রেখে দেওয়া হয়েছিল টেবিলের উপর। তা বেজে উঠতেই কান পাতল প্রিন্স। দু’মিনিট শুনিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হল সেই স্বীকারোক্তি। এবার বল, তুই কী বলতে চাস? একসঙ্গে যেন একই প্রশ্ন করলেন তিনজন অফিসার।

খানিকটা থতমত খেয়ে প্রিন্স নিজেকে দ্রুত গুছিয়ে নিয়ে জবাব দিল, ‘সব মিথ্যা বলছে স্যর। ও সব জানত। পার্সেলটা পাঠানোর পরের দিন ওই তো ফোন করে আমাকে বলে, কিরে কিছুই তো হল না। ওটা ঠিক ভাবে গিয়েছে তো?’

এক অফিসারের গলা যেন তখন সপ্তমস্বর্গে। তিনি খেকিয়ে উঠলেন, ‘শোন,অনেকক্ষণ হয়েছে। রাতও বাড়ছে। সোজা কথা সোজা ভাবে বল। ঠিক কী হয়েছিল তোর সঙ্গে। কেন এই কাজ করলি?’

 ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে ঘটনাটা পাঠকদের জন্য একটু বলে দেওয়া প্রয়োজন: ২০০৯ সালের শেষের দিক। রামকৃষ্ণ বালিকা বিদ্যালয়ে চাকরি পাওয়ার পর ডিভোর্স হয়ে যায় অপর্ণার। নিজের গ্রাম হবিবপুরের জগন্নাথপুর, বলতে গেলে একেবারে ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুর। শহর থেকে অনেকটা দূরে, সে জন্য একটা হস্টেলে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। একদিন সকালে কাজের সূত্রে একটি নম্বরে ফোন করে বসে প্রিন্স। যদিও সেটা রং নাম্বার। কিন্তু ঘটনাচক্রে ওটাই ছিল শিক্ষিকা অপর্ণার ব্যবহার করা নম্বর। অচেনা—অজানা হলেও সদ্য বিবাহবিচ্ছিন্না স্কুল শিক্ষিকার ফোনের ওপ্রান্তে থাকা যুবকের কথাবার্তা বেশ ভালো লেগে যায়। এক কথা দু’কথাতে জানতে পারেন না—চেনা যুবকের নাম প্রিন্স ঘোষ। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। ওই রং নাম্বার দু’জন তাঁদের মোবাইলে সেভ করে রাখেন কিছুদিন পর। প্রথমে আপনি থেকে তারপর তুমি, শেষে ঘনিষ্ঠতা। বাড়তে থাকে মেলামেশা। এতটাই যে, তাঁরা একসঙ্গে বহু জায়গায় বেড়াতে যাওয়া শুরু করেন শহর ছেড়ে অনেক দূরে। মাত্র ছ’মাসের ভালোবাসায় সিদ্ধান্তও নিয়ে নেন একসঙ্গে ঘর বাঁধার। দিনগুলো দিব্যি কাটছিল দু’জনের। এমনকী, প্রেমিকের সঙ্গে যাতে আরও বেশি সময় কাটাতে পারেন সেজন্য হস্টেল ছেড়ে অপর্ণ আলাদা ঘর ভাড়া নিয়ে নেন সীতাংশুর বাড়ির একতলায়। কিন্তু প্রিন্সের মুখ আর মুখোশ আলাদা হয়ে যেতে সময় লাগল না। বছর খানেকের মাথায় একদিন দুপুরে বাইরে খেতে বেরিয়েছিল প্রিন্স আর অপর্ণা। একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই অপর আচমকা দেখা হয়ে যায় এক পুরনো বান্ধবীর সঙ্গে। তাও প্রায় বছর পাঁচেক পর। তাঁদের মধ্যে কথাবার্তা জমে উঠে দ্রুত। প্রিন্সের দিকে চোখ পড়ে সেই বান্ধবীর। বিষয়টা যখন এতটাই এগিয়ে গিয়েছে, তখন আর লুকিয়ে কী লাভ? এই মনে করে প্রিন্সের সঙ্গে নিজের বান্ধবীর পরিচয় করিয়ে দেন অপর্ণা। গল্প চলতে থাকে। ফোন নম্বর দেওয়া নেওয়াও হয়। ঘণ্টাখানেক পর তাঁরা যে যার মতো বেরিয়ে পড়েন সেখান থেকে। কিন্তু আসল বিষয় জট পাকাতে শুরু করে ওই সাক্ষাতের পর।

সেই রাতে অপর্ণার মোবাইলে ফোন আসে বান্ধবীর।

‘হ্যারে কী করছিস? খাওয়াদাওয়া হল। আজ এতদিন পর দেখা হয়ে এত ভালো লাগল যে আবার ফোন করে ফেললাম।’

‘না রে, খাওয়া হয়নি। একটা গল্পের বই নিয়ে বসেছি। একটু পরে রান্না বসিয়ে দেব। উত্তর দেন অপর্ণা। ‘আচ্ছা, একটা কথা বলবি, দুপুরে যাঁর সঙ্গে দেখা হল, তাঁকে না খুব চেনা চেনা লাগছিল। এখন মনে পড়ল, তাই ভাবলাম ফোন করি। তা, তোর সঙ্গে পরিচয় হল কী করে রে?’ জানতে চান সেই বান্ধবী।

‘প্রথম দিনেই আমার বয়ফ্রেন্ডকে দেখে এত উৎসাহ কেন সোনা?’ ফোনে ঠাট্টা শুরু করেন অপর্ণা।

‘আসলে, তোকে একটা কথা বলব, কিছু মনে করবি না তো? তুই বললি, ভদ্রলোক ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু উনি ঠিক কী করেন, তুই জানিস? এবার সিরিয়াস ফোনের ওপারে থাকা বান্ধবী। কঠিন কথাটা সহজ ভাবে বলার চেষ্টা করলেন তিনি।

‘বল না। কে আপত্তি করল। অপর্ণা গোপন কথা শুনতে যে আগ্রহী, তা স্পষ্ট করে দিলেন।

‘তাহলে বলেই ফেলি। দু’মাস আগে আমাদের বাড়ির টিভিটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গিয়েছিল, বাজ পড়ে। চারদিকে খোঁজ নিতে গিয়ে পাড়ার একটি দোকানের মাধ্যমে একজনের নম্বর পাই। সেখানে ফোন করি। তখন এই লোকটি এসেছিল। পরিচয় দিয়েছিল মেকানিক হিসেবে। টিভিটা খুলে অনেক চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু আর ঠিক করা যায়নি। ওর একটা বন্ধুর কথা বলেছিল সে সময়। তবে আমরা দেখলাম ঠিক যখন হবে না, আর অন্য কাউকে দেখিয়ে কী লাভ? সে দিন লোকটির নম্বর আমার বাড়ির ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলাম। আজ বাড়ি এসে খুঁজতে খুঁজতে নম্বরটা পেতেই তোকে ফোন করলাম। এক নাগাড়ে প্রায় পাঁচ মিনিট বলার পর থেমে গেলেন সেই বান্ধবী।

চোখের সামনে তখন যেন অন্ধকার দেখছেন অপর্ণা। মুডটা একদম নষ্ট হয়ে গেল। তবুও ভেঙে পড়েননি বোঝাতে পাল্টা বললেন, ‘এমনও তো হতে পারে তুই ভুল দেখেছিস। তাছাড়া একই রকম দেখতে অনেক লোক থাকে।’

বান্ধবীও ছাড়ার পাত্রী নন। তাঁর পাল্টা যুক্তি, তোকে একটা নম্বর এসএমএস করে দিচ্ছি। একবার মিলিয়ে নিতে পারিস এটাই ওর নম্বর কিনা।’

‘পাঠা তাহলে। খুব একটা আগ্রহ না দেখিয়ে দায়সারা গোছের উত্তর দিলেন অপর্ণা।

সেদিনের মতো দু’জন দু’জনকে বাই বললেন বটে। কিন্তু কেমন একটা খচখচে ভাব রয়ে গেল। তার চেয়েও বড় অস্বস্তির যেটা, ফোন কাটার পাঁচ মিনিটের মধ্যে এসে গেল মোবাইল নম্বরটা। রাতে আর ইচ্ছে করছিল না ক্রশ চেক করার। তবু মনও যেন সায় দিচ্ছিল না। গল্পের বইটা দু’পাতা পড়ার পর ধুত্তোর বলে সরিয়ে রাখতে না রাখতে অপর্ণার চোখটা নিজে থেকেই চলে গেল ফোন নম্বরের দিকে। আরে, সত্যি তো, এটা প্রিন্সের আরও একটা নম্বর! একদিন নিজেই নম্বরটা দিয়ে বলেছিল খুব দরকার পড়লে এটায় ফোন করতে। একবার ভাবলেন, এখন একটা ফোন করে দেখলে কেমন হয়? পরক্ষণে আবার ভাবনাটা বদলে গেল। থাক, কাল সকালে বরং দেখা যাবে। রাতটা আগে কাটুক।

সকাল থেকে বান্ধবীর কথাটা বার বার বাজছিল কানে। স্কুলে যাওয়ার আগে করব কি করব না, ভাবতে ভাবতে নম্বরটা ডায়াল করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল প্রিন্সের গলা। এই নম্বরে কেন? আরেকটা নম্বরে করো। বিষয়টা বুঝতে আর সময় লাগল না।

কী করা উচিত এখন? এই প্রশ্নের কোনও উত্তর আপাতত অপর্ণার কাছে নেই। আলোচনাই বা করবে কার সঙ্গে? এমনিতে প্রথমবার ডিভোর্স হওয়ায় সবার কাছে কেমন একটা করুণার পাত্রী তিনি। যেন আর কারও বিবাহবিচ্ছেদ হয় না এ সংসারে। মাঝে মাঝে এটা খুব বিরক্তির বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর গ্রাম থেকে উঠে আসার সংগ্রামটা কেউ মনে রাখতে চায় না। কথা বলতে গেলে শুধু ব্যক্তিগত আলোচনা টেনে আনে বার বার। আজ কিছুই ভাবতে ভালো লাগছিল না তাঁর। তাই প্রিন্সকে আর ফোন না করে রেডি হয়ে স্কুলের দিকে রওনা দিলেন।

স্কুলের শিক্ষিকা হলেও বেসিক্যালি ইন্ট্রোভার্ট টাইপের অপর্ণা। নিজেই নিজেকে এক এক সময় প্রশ্ন করেন তিনি, প্রিন্সের প্রেমে পড়লেন কীভাবে? কিন্তু এখন যে সন্দেহ এবং দ্বিধাদ্বন্দ্ব তাঁর মধ্যে কাজ করা শুরু করেছে।আপাতত এর থেকে রেহাই পাওয়া প্রয়োজন। যে টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে মন চলছে তা শেয়ার করবেন কার সঙ্গে?

বিস্ফোরণের পর ঘরের চেহারা

হাতে বিকল্প কিছু না থাকায়, ওই পুরনো বান্ধবীকে বিশ্বাস করতে হল এবার। তাঁর প্রতি সন্দেহ থাকার কোনও কারণ নেই। স্বামী—সন্তান সহ সে দিব্যি রয়েছে। ফলে অপর্ণার প্রতি হিংসা বা বিদ্বেষ থাকার কথা নয়। তাছাড়া সেদিন দেখেও মনে হল না এর পিছনে অন্য কোনও কারণ থাকতে পারে বলে।

প্রথম সম্পর্কটা শেষ হলেও দ্বিতীয়টা নিয়ে বেশ সিরিয়াস ছিলেন অপর্ণা। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন সন্দেহটা আপাতত ঠাণ্ডাঘরে পাঠিয়ে, নিজে পরীক্ষা করে দেখবেন পুরো বিষয়টা।

সম্পর্কটা এরপরও টিকে গেল। কিন্তু কমে এল ঘনিষ্ঠতা। আর এর মধ্যে ঘটে গেল সেই চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্স। দীর্ঘদিন পর, ছুটির দিন দেখে অপর্ণার ভাড়া বাড়িতে এল প্রিন্স। সকাল থেকে রান্নাবান্না করছেন প্রেমিকা। দু’জনে প্রাণ খুলে গল্পও করলেন অনেকদিন পর। বেলা আড়াইটে নাগাদ দুপুরে খাওয়ার আগে, প্রিন্স বাথরুমে গেল স্নান করতে। টেবিলে রাখা তার দুটি মোবাইল। সাইলেন্ট মোড অন করা। তাতে একের পর এক ফোন এসে গেলেও রিং হচ্ছিল না জোরে। রান্নাঘর থেকে মাংসটায় একটু বেশি জল দিয়ে শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে অপর্ণা হাজির হলেন বড় ঘরে। তখনই নজরে এল একটি মোবাইল বেজে যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। ধরব কি ধরব না, ভাবতে ভাবতে এক সময় হাতে তুলে নিলেন ফোনটা। স্ক্রিনটাচ। সুতরাং কলটা রিসিভ করে হ্যালো বলার আগে ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এল এক পুরুষের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, আরে ভাই, তুমি কাল টিভিটা সারাই করে যাওয়ার পরও ছবি ঠিক ভাবে আসছে না। এতগুলো পয়সা দিলাম কি এমনি এমনি। আজ বিকেলে আসবে। রাতে ভালো খেলা রয়েছে। দেখতে হবে।’

ফোনটা যেন দুমড়ে দিয়ে গেল অপর্ণার মন। প্রিন্স সত্যি তাহলে একজন পাতি টিভি মেকানিক? বান্ধবী যা বলেছিল তাই? অথচ আমাকে বেমালুম মিথ্যা কথা বলেছে?’

অস্ফুটে শুধু একবার ওপ্রান্তে জানিয়ে দিলেন, ঠিক আছে। বলে দেব।’ দুপুরে আর খেতে ভালো লাগল না। প্রিন্স খেয়ে ওঠার পর আস্তে আস্তে বললেন, তুমি আর এ বাড়িতে আসবে না। বেশি বাইরের লোক এলে বাড়িওয়ালা আপত্তি করে।

সম্পর্কটাতে পাকাপাকি ভাবে একটা ফাটল ধরে গেল। তারপর পচন। আস্তে আস্তে প্রিন্সের ফোন ধরা বন্ধ করে দিলেন অপর্ণা। মরিয়া হয়ে একদিন অন্য নম্বর থেকে ফোন করে প্রিন্স জানতে চাইল, কী এমন হল যে আমার ফোন রিসিভ করছো না?’ এপাশ থেকে বেশ রুক্ষস্বরে জবাব গেল, একটা টিভি মেকানিকের সঙ্গে কী করে সম্পর্ক রাখব। আমি কী, সেটা বোধহয় তোমার জানা রয়েছে। উত্তেজিত হয়ে পড়ল প্রিন্সও, হ্যাঁ আমি ক্লাস এইট পাস। টিভি সারাই করি। কিন্তু নিজে উপার্জন করি। তোমাকে পেতে চাই। সে দিন বেশ ক্ষুব্ধ অপর্ণাও। পাল্টা বললেন তিনি, “তোমার অওকাত আছে? আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে না। কেটে যায় ফোন। তারপর আবার আসে, আবারও। একদিক থেকে মাঝে মাঝে আসতেই থাকে।

দিন পনের পর মালদায় শুরু হল বইমেলা। বান্ধবীর সঙ্গে একদিন সন্ধ্যায় মেলাতে যেতে হল অপর্ণাকে। বেশ কয়েকটি বই কেনা দরকার। হঠাৎ করে কফিশপের পাশে নজরে পড়ল তাঁর দেওয়া হালকা হলুদ রঙের টি শার্টটা পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রিন্স। মনে হল, কথা বলতে চায়। কিন্তু এড়িয়ে গেলেন অপর্ণা। প্রায় দৌড়ে সামনে এসে মূর্তিমানের মতো দাঁড়িয়ে প্রিন্স। এবার গলায় যেন হুমকির সুর, শোনো, তুমি শুধু আমার। আর যদি না হও, তাহলে কারও নয়।তাচ্ছিল্যর সঙ্গে অপর্ণাও মন্তব্য ছুঁড়ে দিলেন, ‘যা খুশি করার করে নাও।

আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে না।’এই ঘটনার পর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ভাইকে ভাড়া বাড়িতে নিজের কাছে রাখা শুরু করলেন অপর্ণা। যুক্তি, হবিবপুরের জগন্নাথপুরে ভালো শিক্ষক পাওয়া বেশ কঠিন। কিন্তু সেটা বাস্তব নয়। আসল কথা, একাকীত্ব কাটানো।

মাঝে একটু থেমে পুলিশ কর্তাদের দাবড়ানি খেয়ে, ফের বলে চলে প্রিন্স, ‘অপর্ণা আছে জানতে পেরে একদিন রায়গঞ্জগামী একটা বাসে উঠে পড়ি কথা বলতে। সেখানে সবার সামনে আমার গালে একটা থাপ্পড় মারে। ওই অপমানটা আর নিতে পারিনি। তারপর এই প্ল্যানটা করি। জানতাম, বাড়িতে বই গেলে কিছুতেই ফেরাবে না। অনেক হয়েছে, এবার বল বিস্ফোরকটা তৈরি করলি কীভাবে?

‘মালদা আদালতের সামনে পুরোনো বই কম দামে বিক্রি হয়। আগে বই অনেকবার কিনেছি, তাই ওটা জানতাম। সেখান থেকে ৬০০ পাতার একটা মোটা বই কিনি। দরদাম করায় ২০০ টাকা নেয়। কাজটা শুরু করব কী করে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একটি নামী টিভি কোম্পানিতে কাজের সুত্রে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিল সুজাপুরের মুন্না নামে একজন। মনে পড়ে ওর কথা। ওকে গিয়ে বোঝাই, একটা বড় পার্টি পেয়েছি তাই কিছু মাল লাগবে। রাজি হতেই মুন্নার কাছ থেকে পটাসিয়াম নাইট্রেট এবং সালফার কিনে এনে রাজকুমারকে দিয়েছিলাম। প্রথম দিকে আমাদের জ্ঞান, পরে ইন্টারনেট এবং বই ঘেঁটে পার্সেল বোম তৈরি করার কাজ শুরু করি। যে বোমাটা ফেটেছে তাতে ১৫ থেকে কুড়ি গ্রাম বিস্ফোরক দেওয়া ছিল। বালবের ফিউজের তার যুক্ত করে একটা সার্কিট বানানো হয়। সেই সার্কিটের সঙ্গে মোবাইলের সুইচকে ডিটোনেটর হিসেবে ব্যবহার করি আমরা। বিষয়টা এমন যে, পার্সেলটা খুললেই মোবাইলে একটা কল আসবে। সেটা রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে ট্রিগারের কাজ করবে মোবাইলের সুইচ। অন করতেই ভয়ঙ্কর শব্দে উড়ে যাবে সামনে থাকা সবকিছু। মাঝারি মাপের সেই বোমাটা তৈরি হওয়ার পর, মাপ মতো বইয়ের মাঝে পাতা ব্লেড দিয়ে কেটে জায়গা তৈরি করে বসিয়ে দেওয়া হয়। এবার বইয়ের উপর কাগজ দিয়ে ভালো ভাবে মুড়ে পার্সেলটি কুরিয়ারের অফিসে পৌছে দেওয়ার কাজটা করে রাজকুমার।

‘সব বুঝলাম, কিন্তু ঘটনার দিন রাতে হোটেলে গিয়ে কী করছিলি? এত দ্রুত মামলা সলভ হয়ে যাওয়ার তৃপ্তি থেকে এক অফিসার জানতে চাইলেন।

ততক্ষণে অন্য একজন পিছন দিক দিয়ে রাজকুমারকেও নিয়ে এসেছেন ওই ঘরে।

প্রিন্স উত্তর দিল, ‘কাজটা শেষ হওয়ার পর রাজকুমার আনন্দের চোটে বলেছিল চল আজ একটু ফুর্তি করে আসি, কোথায় যাব এটা ভাবতে ভাবতে আমরা ওই হোটেলে যাই। ওখানে পার্টি চলছিল। আমরাও পার্টি করা শুরু করি।

আচমকা অন্ধকার থেকে একটা গলার আওয়াজ ভেসে আসে, ‘ও সব মিথ্যা কথা বলছে স্যর। নিজেই হোটেলে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, বাইরে কেউ দেখতে পেলে সমস্যা হতে পারে। ও একটা ক্রিমিনাল।’

উপস্থিত এক পুলিশ কর্তা মুচকি হেসে বললেন, ‘ঝগড়া করিস না। কোন গাধা তোদের ক্রিমিনাল বলে? তোরা তো একজোড়া বিজ্ঞানী! এবার নে, গরাদের ভিতর বিজ্ঞানচর্চা কর বাকি জীবনটা।’

দু’জনকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে ঘটনার রিকনস্ট্রাকশন করায় পুলিশ। শুরু হয় তদন্তের তৃতীয় এবং শেষ পর্যায়। ঘটনার দিন ছুটি থাকায় সকাল সাড়ে ন’টায় অপর্ণার ভাই হবিবপুরে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল বাবা—মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। ভাই বেরিয়ে যেতেই অপর্ণা বেশ কিছুক্ষণ উপরে গিয়ে গল্প করে সোনালির সঙ্গে। তারপর নিজের ক্লাস থাকায় রেডি হয়ে খানিকক্ষণ পর বেরিয়ে যায়। আর ওই সময়ে পার্সেল এসে পৌঁছোয় তাঁর নামে। সই করে সেটা রিসিভ করে সোনালি। স্কুল থেকে ফেরার পর অপর্ণা ফ্রেশ হওয়ার সময় ওটা একতলায় দিয়ে উপরে উঠে আসে ওই কিশোরী। খাটের উপর বসে খুশি খুশি মুখে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বই ভেবে টান দিয়ে প্যাকেটটা খুলতে যান অপর্ণা। তখনই মোবাইলে ফোন আসে। এবং বিকট শব্দে বিস্ফোরণ। লন্ডভন্ড হয়ে যায় চারদিক।

প্রতিহিংসার একটা পার্সেল প্রাণ কেড়ে নেয় তাঁর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *