মুসাফির – সৈয়দ মুজতবা আলী
.
কৈফিয়ত
এ পুস্তকের একটি ক্ষুদ্র মুখবন্ধের প্রয়োজন আছে।
একাধিক খ্যাতনামা ভূপর্যটক পরিণত বয়সে নাকেখৎ দিয়ে অসঙ্কোচে স্বীকার করেছেন, উঠান-সমুদ্র পেরিয়ে বাড়ির বাইরে বেরুনোটাই মূখামির চুড়ান্ত নিদর্শন। খ্যাতনামা লেখক না হয়েও আমি এ সব প্রাতঃস্মরণীয়দের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলছেন কি, ভ্রমণকাহিনী লিখে সে মূখামির চূড়ান্ত পরিচয়টি তারা দিতে গেলেন কেন?
১৯২৭ থেকে আপনাদের বশংবদ এ-লেখক ঘরছাড়া। মাঝে-মধ্যে দু চার বছরের জন্য হেথা হোথা সে আশ্রয় পেয়েছিল বটে কিন্তু গৃহনির্মাণ করার সুযোগ সে কখনও পায়নি। ফের পথে নামতে হয়েছে। সে নিয়ে ফরিয়াদ করিনে। একদা নাবিকজনের অধিকাংশই সমুদ্রে মারা যেত। তাদের যেসব ভীতু ছেলে-ভাইপো সমুদ্রযাত্রা করত না, তারা মরত বাড়িতে। ফল তো একই। আমার বেলা আরও একটা ভয় আছে। উঠান-সমুদ্র পেরিয়ে অপকর্ম করেছি সে পাপ তো এইমাত্র স্বীকার করলুম, কিন্তু বাড়ি থেকে না বেরুলে যে আরও মেলা জব্বর জব্বর ব্রহ্মহত্যা করতুম না সে ভরসা দেবেন কোন গোসাই? অর্বাচীন জনই মন্তব্য করে, হিটলার যদি অমুক ভুলটা না করতেন তবে তিনি আখেরে বিজয়ী হতেন– ওই ভুলটা না করলে তিনি যে পরে গণ্ডা দশেক ততোধিক মহামারাত্মক ভুল করতেন না সে আশ্বাস দেবেন কোন বিধানরাজ!
তবে এ সত্য আমি বার বার বলব, আমি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছি অতিশয় অনিচ্ছায়– গত্যন্তর ছিল না বলে। প্রতি আশ্রয় লাভের পর ফের যে বেরিয়েছি সেটা আরও বেশি অনিচ্ছায়– নিতান্ত বাধ্য হয়ে।
এবং শেষ মোক্ষম পাপাচার স্বীকার করছি, যে পাপ কৃতী পর্যটককে আদৌ স্বীকার করতে হয়নি, কারণ তারা আপন আপন সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি সাধন করে পুনরায় অপাপবিদ্ধ হতে পেরেছিলেন, আমার তরে সে দুয়ার বন্ধ। আমার মোক্ষমতার গুরুপাপ– আমি ভ্রমণকাহিনী (তথা অন্যান্য সর্ববিধ রচনা) লিখেছি সর্বাধিক অনিচ্ছায়।
অসহিষ্ণু পাঠক শুধোবেন, আমরা ক্যাথলিক পাদ্রি নাকি যে বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ তুমি আপন পাপ কনফেস্ করতে আরম্ভ করলে? না, আপনারা অতি অবশ্যই পাদ্রি নন। কারণ শুধু পাদ্রি কেন, সব সম্প্রদায়ের আচার্যগণকেই ধর্মাদর্শ অক্ষত রাখবার জন্য প্রায়ই কঠোর কঠিন হতে হয়। পক্ষান্তরে, যেসব পাঠক এতদিন ধরে আমার রচনা বরদাস্ত করে এসেছেন তারা অকরুণ হবেন কী প্রকারে? আর আমি মোল্লা-পুরুত পাবই-বা কোথায়? এবং অতিশয় শ্লাঘাভরে উচ্চকণ্ঠে স্বীকার করছি আমার পাঠকই আমার মোল্লা, আমার পুরুৎ। একমাত্র তার কাছেই আমার সর্ব অক্ষমতার ভার নামানো যায়।
পূর্বেই নিবেদন করেছি, ১৯২৭-এ আমি গৃহহারা হই। প্রথম দু বৎসরের কাহিনী আমি সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় কীর্তন করিনি। সে ইচ্ছাটার পিছনে যে ছিল সে বহুকাল হল জিন্নবাসিনী। সে করুণ কাহিনী থাক।
তার পরের দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর বৎসরের প্রতিবেদন আমারই মতো ছন্নছাড়া; দেশকালপাত্র মেনে নিয়ে সেটা মিষ্ট এবং সংরক্ষিত হয়নি কারণ, চিরাচরিত আপ্তবাক্য আছে যাহা অল্প তাহাই মিষ্ট–কাজেই সংক্ষিপ্ত না হয়ে সে হয়েছে ক্ষিপ্ত।
সে সম্বন্ধে অল্পবিস্তর সবিস্তর আলোচনা করেছি। এ পুস্তকের ত্রেতাপর্বে যারা আমার নতিস্বীকার, অর্ধসিদ্ধ কনফেশন সম্বন্ধে উদাসীন তারা সে যুগটি অবহেলাভরে বর্জন করলে ধূলিপরিমাণও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। আর যারা ক্ষিপ্তের তাণ্ডবে কোনও সঙ্গতি আছে কি না (মেথড় ইন্ ম্যাডনেস) সেটা নিজের মুখে ঝাল খেয়ে রগড় দেখতে চান, কিংবা যারা অসংলগ্ন খণ্ড প্রতিবেদন সমষ্টিকে শ্রেণিবদ্ধ করার বন্ধ্যাগমনসুলভ নিষ্ফল প্রয়াস লক্ষ করে তথাকথিত রূঢ় কণ্ঠে, ন্যায়সঙ্গত কটুবাক্য শুনিয়ে পত্রাঘাত করেছেন, অপরঞ্চ যারা বার্লিনি দ্বিরদরদস্তম্ভোপরি সিংহাসন থেকে কিংবা যারা নেটিভ বিদ্যালয়ের গো-অন্বেষণ কর্মে লিপ্তাবস্থায় গলদঘর্ম কলেবরে অশেষ ক্লেশস্বীকার করে আমা হেন দীনহীনজনোপরি মহামূল্যবান উপদেশ অকৃপণভাবে বর্ষণ করেছেন, তারা এ পুস্তকের দ্বিতীয় উল্লাসে আমার অকৃপণতর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভূরিভূরি স্বর্ণোজ্জ্বল নিদর্শন পাবেন।
ভগবৎকৃপায় অব্যবহিত প্রত্যাদেশ লাভ করেছি, আমার ভবলীলা সংহরণ প্রত্যাসন্ন। ঈদৃশ মুখবন্ধের প্রতি রুদ্রের দক্ষিণ মুখ পুনর্বার প্রসন্ন হবেন সে আশা দুরাশা।
—কিমধিকমিতি
সৈয়দ মুজতবা আলী
কলকাতা, ২০ নভেম্বর,
১৯৭১ নিরানন্দ ঈদ (আনন্দ) দিবস, ১৩৭৮
Leave a Reply