ত্রেতা

ত্রেতা

সেই যে সুন্দরী মেয়েটি এক লফে ডেসক ডিঙিয়ে আসন নিয়েছিল তার পর ঝাড়া বিয়াল্লিশটি বছর কী করে যে হুশ করে মাথার উপর দিয়ে চলে গেল তার জমা-খরচ আমি কখনও নিইনি। এই চল্লিশ বৎসরের ইতিহাস লেখা আমার শক্তির বাইরে। তবে মনে মনে আশা পোষণ করেছিলুম ল্যানগুইজ পরীক্ষায় পাস করে আমি যে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছিলুম তার বয়স, বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মপদ্ধতি, সেখানকার ছাত্রজীবন, তার পর বন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন, এদিকে বন শহর ওদিকে সপ্তকুলাচল, মাঝখানে বিশাল প্রশস্ত রাইন নদ, গোডেসবের্গে জীবন যাপন, হিটলারের অ্যুদয়, তার একচ্ছত্রাধিপত্য, ইতোমধ্যে হাজার হাজার বৎসরের প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি মিশরে বৎসরাধিক কাল বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, (ওই সময়টায় আমি অবশ্য জর্মনিতে ছিলাম না কিন্তু হিটলারের তাবৎ বক্তৃতা এবং গ্যোবেলস-এর অনেকগুলো বেতার মারফত শুনেছিলুম) হিটলারের পতন, যুদ্ধশেষের কয়েক বৎসর পর পুনরায় একাধিকবার– জর্মন ভ্রমণ, বন্ধুমিলন এবং যারা যুদ্ধ থেকে ফেরেনি তাদের বিধবা পুত্রকন্যার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ আরও কত কী– এসবের বর্ণনা দফে দফে দেব। কিন্তু বিধাতা বোধহয় সেটা চাননি। আমি যাতে অকরুণ অকারণে নিরীহ বঙ্গপাঠকের মস্তকোপরি অষ্টাদশ ভলুম নিক্ষেপ না করি তাই তিনি এই চল্লিশ বৎসর আমাকে ননস্টপ তুর্কি নাচন নাচিয়েছেন এবং তার ড্যান্স-ফ্লোর কন্যাকুমারী থেকে সিমলে, মসৌরি, পিণ্ডিদাদনখান থেকে কামাখ্যা! আর সব বাদ দিন– অষ্টাদশপদী এ খট্টাঙ্গ পুরাণ রচনা করার জন্য নিদেন যেটুকু দেশকাল পাত্রের তথা অবকাশের প্রয়োজন তার একরত্তিও তিনি আমাকে দেননি। তাকে বার বার নমস্কার।

পাগলা রাজা মুহম্মদ তুগলুক সর্বদাই তাঁর প্রজাদের মঙ্গল কামনা করতেন। কিন্তু অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন বলে মাত্রাবোধ ছিল তাঁর কম এবং প্রায়ই লঘু অপরাধে মারাত্মক গুরুদণ্ড দিয়ে বসতেন– অনেক স্থলে মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী পিতা যে রকম পুত্রকে তস্য উপকারার্থে মাত্রাধিক লাঠৌষধি সেবন করান। তাই পরলোক গমনের কিয়দ্দিন পূর্বে তিনি আফসোস করেছিলেন, আমি প্রজাদের কল্যাণার্থে যেসব আদেশ দিতুম তারা সেগুলো অমান্য তো করতই তদুপরি আমার পুণ্য উদ্দেশ্যও তারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারল না। তাঁর মৃত্যুর পর রাজ-ঐতিহাসিক জিয়া উদ-দীন লিখলেন প্রজাসাধারণের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে মহারাজ আনন্দিত হলেন ও প্রজাসাধারণও হুজুরের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।

অষ্টাদশী খট্টাঙ্গ পুরাণ লোষ্ট্র চিরসহিষ্ণু বঙ্গীয় পাঠকের শীর্ষদেশে নিক্ষেপ না করতে পেরে আমি হর্মোদ্বেলিত কণ্ঠে শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ আমেন আমেন জপ করছি এবং আচণ্ডাল গৌড়জনও সেই বিকট মধুচক্র পান না করতে পেরে ঘন ঘন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন।

কিন্তু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আপ্তবাক্য রূপে বলেছেন, যে-লোক মুলো খেয়েছে তার ঢেকুরে মুলোর গন্ধ থাকবেই। তাই এই চল্লিশ বৎসরের অভিজ্ঞতা যে আমার লেখাতে কিছু না কিছু বেরিয়ে যাবেই যাবে এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু যে ইঙ্গিত পূর্বেই দিয়েছি তারই পূর্ণার্থ প্রকাশ করে বলি, সে সব অভিজ্ঞতা সুসংলগ্নভাবে কালানুক্রমে লিখে উঠতে পারিনি। কিন্তু আমি ভরসা রাখি যে, সুচতুর পাঠক আমার প্রকাশিত পুস্তক থেকে খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত টুকিটাকি ছিটেফোঁটা জুড়ে নিয়ে একটি জিগশো পাজল সমাধান করতে পারবেন অর্থাৎ একটি মোজাইক নির্মাণ করতে পারবেন, তদর্থ : মোটামুটি একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি পেয়ে যাবেন। যদিও তার আউটলাইনগুলো সূক্ষ্ম শার্প হবে না, বহু ডিটেল বাদ পড়ে যাবে কিন্তু তাতে করে কিছু আসে-যায় না। তদুপরি ভারতের প্রায় সর্বশেষ আলঙ্কারিক বলেছেন, সবকিছু সবিস্তর বর্ণন করো না; পাঠককে ইঙ্গিত দেবে ব্যঞ্জন দেবে মাত্র যাতে করে সে তার কল্পনাশক্তির সদ্ব্যবহার করার সুযোগ পায়। তাই কবিগুরুও আপ্তবাক্য বলে গেছেন :

একাকী গায়কের নহে তো গান
গাইতে হবে দুজনে
একজন গাবে খুলিয়া গলা
অন্য জন গাবে মনে।

 যে দেশে বার বার গিয়েছি তারই এক গুণী বলেছেন, যে সবকথা সবিস্তর বলতে চায়, তার কোনও কথাই বলা হয় না। অনেক কথা যাও যে বলি কোনও কথা না বলি। (তাই) তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি ॥

বলেছেন পুনরপি ভাষার জহুরি বিশ্বকবি।

 মোদ্দা কথা : কোনও পুস্তকের সব ছত্রই যদি আন্ডারলাইন করো তবে কোনও ছত্রই আন্ডারলাইন করা হয় না।

শ্রদ্ধেয় সুনীতি চট্টোপাধ্যায় একখানা বিরাটাকার বাংলা ব্যাকরণ লেখার পর অনুভব করলেন, হয়তো বড় বেশি বলা হয়ে গেছে। তাই রচনা করলেন একটি ক্ষুদ্র ব্যাকরণ। পথে দেখা হতে বললেন, এবারে একটা সংক্ষিপ্ত ব্যাকরণ লিখেছি; আগেরটা ছিল ক্ষিপ্ত ব্যাকরণ। আমার এ লেখাটাতে তাঁর ইরশাদ-নির্দেশ মস্তকাভরণ হয়ে রইল।

আরেক গুণী আরেকটি সরেস উপদেশ দিয়েছেন : স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে লেখাতে কিছু কিছু ভুল রেখে দিয়ে। পাঠক সেগুলো ধরতে পারলে বিমলানন্দ অপিচ আত্মপ্রসাদ অনুভব করে। মনে মনে বলে, আমিই-বা কম যাই কিসে! ব্যাটা লেখক যতই বড়-ফাট্টাই করুক না কেন আমি, হ্যাঁ, আমি তার সবকটা বমাল ধরতে পারি। হয়তো-বা কাগজে ভ্রম সংশোধন করে চিঠি লিখবে। সে শংকরের কান মলতে পারে, অবধূতের নাসিকা কর্তন কর্মে সিদ্ধহস্ত। আপনার বইয়ের আরও তিন কপি সে কিনবে। সে যে কেরামতি মেরামতি করেছে সেগুলোসহ বিয়ে-শাদিতে প্রেজেন্ট করবে। আপনার অন্যান্য তাবৎ বই গ্যাটের কড়ি খর্চা করে বাড়িতে তুলবে– ভুলের সন্ধানে, আত্মপ্রসাদ লাভের জন্য।

আমাকে অবশ্য সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় ভুলের কলঙ্ক লেখার উপর ছিটোতে হয় না। সদাপ্রভু আমার হাত দিয়ে নিত্য নিত্য তামাক খান আর আমি খাই পাঠক পণ্ডিতের কানমলা।

ঈশ্বর সদগুরু জগদগুরু মন্নাহ জগন্নাথ আচার্য ক্ষিতিমোহন সেই পরলোক গমনের দিন দুই পূর্বে তাঁরই সম্মুখে তাঁর চিকিত্সক তার সহধর্মিণীকে বলেন, আর দুধটাতে একটু জল দিয়ে সেটা পেতলে নেবেন–উনি তা হলে সহজেই হজম করতে পারবেন। ক্ষিতিমোহন জানতেন তাঁর মৃত্যু আসন্ন। কিন্তু যে লোক আজীবন রসিকতা করেছে মৃত্যুভয় তাকে স্বধর্মচ্যুত করতে অক্ষম। মৃদু কণ্ঠে বললেন, সিডা আর হাসপাতালে করন লাগবে না। গয়লাই আপন বাড়িতে কইরা লয়!

বিধাতা বলুন, নলরাজের অন্তরে প্রবিষ্ট কলিই বলুন, তিনি ওই গয়লার মতো আমার রচনাতে অনবরত জল মেশাচ্ছেন। অধম এ লেখককে আমার গুবীর মতো আর জল মেশাতে হয় না।

আগাতা ক্রিস্টি বিয়ে করেন এক আর্কিয়োলজিস্ট বা প্রত্নতাত্ত্বিককে। ক্রিস্টি যখন বার্ধক্যে উপনীত হলেন তখন এক দরদী যুবতী তাঁকে শুধোন, আপনি বুড়িয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আপনার স্বামী আপনাকে অবহেলা করছেন না তো? আফটার অল– পুরুষের মন।

মাদাম স্যানা হাসির ঝিলিক খেলিয়ে বললেন, তোমরা তো বিয়ে করার সময় অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে দুম করে ঝুলে পড়ো! আম্বো প্রথম বারে তাই করেছিলুম। দ্বিতীয় বারে নির্বাচনটি হৃদয়ের হাতে ছেড়ে না দিয়ে দিলুম হেডাপিস অর্থাৎ ধুরন্ধর ব্রেন বকসটিকে। সে ফরমান দিলে বিয়ের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করাটাই শ্রেয়তর প্রস্তাব। কিন্তু নিতান্তই যদি করতে হয়, তবে কোনও প্রত্নতাত্ত্বিককে।… খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর মাদাম শেষ তত্ত্ব, গভীরতম তত্ত্ব প্রকাশ করে বললেন, জানো তো, যে জিনিস যত বেশি প্রাচীন হয়, প্রত্নতাত্ত্বিকের কাছে তার মূল্য তত বেশি। কব্জিটো এর্গো সুমের ছকে ফেলে অতএব আমি যত বুড়োচ্ছি ততই ওর কাছে আমার মূল্য বাড়ছে।

বিধাতা গয়লা আমার লেখাতে যেমন শনৈঃ শনৈঃ ব্যাকরণের ভুল বাড়াচ্ছেন, শৈলীর শিরদাঁড়া আর ভাষার পাঁজর কটা মটমট করে ভাঙছেন, আমার বইয়ের কাটতি তেমন তেমন হুশহুশ করে বেড়ে যাচ্ছে। পূর্বে যে স্থলে আড়াই শো বইয়ের এক সংস্করণ কাটতে ঝাড়া কুড়িটি বছর কেটে যেত এখন মাত্র উনিশটি বত্সর।

হরি হে তুমিই সত্য।

এই যে হনুমানি লম্ফ দিয়ে আমি মবলগ চল্লিশটি বছর অতিক্রম করলুম নানাবিধ প্রবন্ধ গল্প মারফত এ চল্লিশ বৎসরের একটা সাদামাটা বোচাভোতা মোজায়িক গড়ে তুলেছি, যার উল্লেখ পূর্বেই করেছি, এবং এটাকে দু যুগের সেতুবন্ধস্বরূপ বিবেচনা করা যেতে পারে সে সম্বন্ধে এবং বর্তমান লিখন সম্বন্ধে একটি সাবধানবাণী চতুর্থ বা পঞ্চম বারের মতো পাঠকের দরবারে পেশ না করলে আমি গুরুহীন তথা ধর্মভ্রষ্ট হব।

সেটি এই :

১৯৪৪ সালে যখন স্বরাজ কোন শুভাশুভ লগ্নে অবতীর্ণ হবেন, কী রূপ নিয়ে অবতীর্ণ হবেন, বামন অবতার না এক আজব নয়া ক্লীব শিখণ্ডি অবতার এবং সে-ও অতিশয় ক্ষুদ্রস্য ক্ষুদ্র ধূলি পরিমাণ অংশাবতার হয়ে (আজ তো অহরহ চতুর্দিকে সেই নপুংসকাবতারই দেখতে পাচ্ছি) এই দিলীপ ভগীরথের (একদা) প্রাতঃস্মরণীয় পুণ্যভূমি ভারতবর্ষে অবতীর্ণ হবেন- সে যুগে আমাদের মনে স্বরাজ সম্বন্ধে স্পষ্টাস্পষ্ট কোনও ধারণাই ছিল না। ১৯২০/২১-এ গাঁধীজি এক বৎসরের ভিতর (ভাগ্যিস দশ মাস দশ দিন বলেননি) স্বরাজ আনবেন বলে দিলাশা দেন। কবিগুরু তখন তাকে মুখোমুখি বলেন, এক বৎসরের ভিতর যদি না আসে তবে প্রতিক্রিয়া স্বরূপ জনগণ-মনে যে নৈরাশ্যজনিত কর্মবিমুখ জড়ত্ব এনে দেবে সে কথা ভেবেছেন কি? মহাত্মাজি বলেন, আমি মরালি স্থিরনিশ্চয় যে প্রত্যেক ভারতীয় যদি আমার কর্মসূচি গ্রহণ করে তবে এক বৎসরের ভিতর আমরা স্বরাজ লাভ করবই করব। (এর মাত্র আঠারো বৎসর পর হিটলারও রণশখে ফুকার দেবার পূর্বে বলেন, প্রত্যেক জর্মন সৈন্য যদি সূচ্যগ্রন সুতীনে ভিদ্যতে যা চ মেদিনী পরিত্যাগ করে পশ্চাৎপদ না হয় অপিচ শত্রুকে নিধন করতে করতে বীরের ন্যায় যে ভূমিতে দণ্ডায়মান সেখানেই মৃত্যুবরণ করে তবে আমার জয়লাভ অনিবার্য। অতিশয় হক কথা- সাধু, সাধু। উত্তম, উত্তম। কিন্তু জিজ্ঞাস্য : আমাদের যখন অজানা নয় যে প্রত্যেক মানুষেই কর্মক্ষমতা, আত্মোৎসর্গপ্রবৃত্তি, শৌর্যবীর্য পরিচয় দানের একটা সীমা আছে তখন প্রত্যেকটি লোক শেষমুহূর্ত পর্যন্ত সংগ্রাম করে করে ধূলিশয্যা গ্রহণ করবে এহেন আশা করাটা পূৰ্বাভিজ্ঞতাসম্মত নয়– এটাকে বরঞ্চ ধর্মরাজের দূতক্রীড়ার সময় এবারে আমি জিতব, এবারে আমি জিতবই জিতব দুরাশা দুরাশায় গড়া পিরামিডের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। তদুত্তরে হিটলার অবশ্যই বলতে পারতেন, নিয়তি (হিটলার ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন না, কট্টর নাস্তিকও না, কিন্তু নিয়তির অদৃশ্য লিখনে দৃঢ় বিশ্বাস করতেন) কখনওই কোনও মানুষের স্কন্ধে সে বোঝা চাপান না যেটা বইতে পারবে না।

তা সে যাই হোক যাই থাক, কর্মক্ষেত্রে দেখা গেল গাঁধীজির প্রতিশ্রুতি এক বৎসর অতি সরেস রবারের মতো– বড্ডই ইলাস্টিক, বিলম্বিত উভয়ার্থে হওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা ধারণ করে। যতই মারিবে টান ততই যাবে বেড়ে।

এ স্থলে আমাকে বাধ্য হয়ে কিছুটা জীবনস্মৃতি মন্থন করতে হবে। পাঠক, অসংখ্যবার আমার অপরাধ মার্জনা করেছ। আরেকবার করলে হয়তো একশোতে পৌঁছে তুমি রত্নাকরের মতো মোক্ষ লাভ করে যাবে। আর কথায় বলে যাহা বাহান্ন তাহা তিরানব্বই (হায়, হায় পাঠক, দ্যাখ তো না দ্যাখ, বিধাতা গয়লা আমার হাত দিয়ে কী কৌশলে তামাক খেয়ে নিলেন, অতি সাধারণ একটি প্রবাদ গুবলেট করে দিলেন)। কিন্তু আমার জীবনস্মৃতি লিপিবদ্ধ করার মতো দুর্মতি আমার কখনও হবে না সে আমি জানি। ওদিকে আবার আমার চেয়েও পাপিষ্ঠজন ইহসংসারে আছে। তারা সর্বক্ষণ আমাকে টুইয়ে টুইয়ে অনুযোগ বিনয় করে, আমি যেন আমার আত্মজীবনী লিখি, কারণ আপনার মতো বিচিত্র অভিজ্ঞতা কজনের আছে (অর্থাৎ খুনখারাবি করে পৃথিবীতে কোন দীনতম দেশের কারাগারের শ্রীবৃদ্ধি সাধনে মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন আমি করিনি?), পৃথিবীর কোন দেশ আমি চষিনি (অর্থাৎ কোন দেশের পুলিশ আমাকে গুণ্ডা আইনে ফেলে– যে আইনানুযায়ী নগরপাল যে কোনও গুণ্ডাকে চব্বিশ ঘণ্টার ভিতর শহর ছেড়ে অন্যত্র যাবার মোক্ষম আদেশ দিতে পারেন– সেদেশ থেকে বের করে দেয়নি?)। মোদ্দা কথা আমি অকপটে সত্যবর্ণন করলে তেনারা বগল বাজিয়ে নৃত্য করতে করতে বলবেন, বলেছিলুম, তখনই বলেছিলুম। হয়তো-বা একটি ছড়াও সঙ্গে জুড়বেন :

বাইরে তোমার লম্বা কোঁচা
 ঘরেতে চড়ে না হাঁড়ি,
খেতে মাখতে তেল জোটে না,
 কেরোসিনে বাগাও তেড়ি।
 যাও হে, যাও হে, কালাচাঁদ
 আর এসো না আমার বাড়ি
এবার এলে আমার বাড়ি
দেব তোমায় খ্যাঙরার বাড়ি।

পক্ষান্তরে এবারে আমার জীবন সম্বন্ধে নির্বিকার উদাসীন পাঠক বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই, কোন দুষ্ট, পরশ্রীকাতর, বিঘ্ন-সন্তোষী জুগুপ্সা দ্বারা তাড্যমান হয়ে এনারা আমাকে জীবনস্মৃতি লিখতে বলেন।

কিন্তু ভবদীয় সেবককে তার কিছুটা, সামান্যতম অংশটা এ স্থলে নিবেদন করতেই হবে। নইলে (১) সে-পটভূমি নির্মিত হবে না যার সাহায্য বিনা পাঠক আমার তাবৎ সম্যক হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন।

অপরঞ্চ (২) পূর্বলিখিত চল্লিশ বৎসর যে মুষ্টিযোগ প্রসাদাৎ আমি ডুবসাঁতার মেরে মোজায়িক নির্মাণ করেছিলুম এ স্থলেও তদ্বৎ। সেই পদ্ধতিই অবলম্বন করব।

.

১৯৪৪-এর কাছাকাছি আমি বে-car (বে-কার) তো বটেই, এবং নির্জলা বেকার। শ্যামপেন বরগন্ডি মাথায় থাকুন জল এস্তেক জোটে না। মাথার উপরে ছাতখানাও যদি না থাকে তবে ট্যাপই-বা কোথায় কুঁজোই-বা কই? কাজেই রাস্তার কল থেকে আঁজলা আঁজলা জল খেতুম। তদাভাবে পার্কের পুকুর কিংবা মা-গঙ্গার স্তন্যরসই ছিল আমার সম্বল।

অবস্থা যখন চরমে তখন শ্রীমান কানাই (ভজু-কানাই) সরকারের সঙ্গে দেখা। তার হঠাৎ মনে পড়ে গেল, (আমি যখন শান্তিনিকেতন কলেজে পড়তুম সে তখন ইস্কুলে) যে আমি তখন ইস্কুলের সাহিত্য সভায় বেনামিতে কয়েকটি রচনা পেশ করি। সেগুলো এমনই ওঁচা যে আমি স্বয়ং পড়লে সাধু-স্ সাধু-সাধু রব ওঠার পরিবর্তে দুয়ো দুয়ো দুয়ো ধ্বনি সভাস্থলের চতুর্দিকে মুখরিত হত। ওদিকে মহারাজ শ্রীমান ভজু-কানাই সাহিত্যসভার সেক্রেটারি (আমরা আড়ালে বলতুম স্যাঁকা রুটি) তারে মারে কেডা।*

[*শ্রীমান কানাই যখন শান্তিনিকেতনে এলেন তখন অন্য এক কানাই সেখানে বর্তমান। গুবলেট এড়াবার জন্য তখন তার দাদা ভজুর সঙ্গে তার নাম জুড়ে দিয়ে ভজু-কানাই নাম রাখা হল। আরেকটি উদাহরণ চমৎকার একটি এমনি ছোটখাটো একমুঠো ছেলে এল যে সবাই তার নাম দিল সিকি। ওমা, পরের বৎসর সে তার ছোট ভাইকে নিয়ে এল–সে আরও ক্ষুদে, একদম মাটির সঙ্গে কথা কয়। তার নাম রাখা হল দুআনি।]

সেই কানাইয়ের সঙ্গে দেখা কলকাতায়। ছেলেবেলার বিস্তর কচিকাঁচারা একটুখানি সিনিয়র ছাত্রদের হিরো ওয়ারশিপ করে। আমার রচনা পরে সে যে বিস্তর সাধু-স-সাধু কুড়িয়েছিল তার থেকে তার একটা অন্ধ ধারণা হয়ে গিয়েছিল আমি কালে রীতিমতো ডাকসাইটে কেউকেডা লেখক হব। তাই দেখা হওয়া মাত্রই আমাকে পড়কে নিয়ে গেল স্বর্গত সুরেশ মজুমদার মহাশয়ের সমীপে।

আহা! এ রকম আরেকটি সংবাদপত্র কর্ণধার আমি ত্রিভুবন চষেও পাইনি। কিন্তু আজ না, মোকা পেলে আরেকদিন তাঁর দেহ, মন ও সর্বোপরি তার হৃদয়ের সবিস্তর বর্ণন দেব। তিনি আড়নয়নে আমার দিকে একবার মাত্র তাকিয়েই কানাইয়ের দিকে তাকিয়ে কী যেন একটা মুদ্রা দেখালেন। এ রকম বিনা মেহনতে আমি কোনও পরীক্ষা পাস করিনি।

সত্যপীর ছদ্মনামে সপ্তাহে দু বার দুই কলম, আফটার এডিট লিখতুম। সে কাহিনী দীর্ঘ। শুধু দুঃখের সঙ্গে বলি সে আমলে যারা সবে সাবালক হতে যাচ্ছেন সেই আমি আজ হয়ে গেলুম তাদের পেট রাইটার, অর্থাৎ আমি তাদের ফ্যান। হায় আজ তাদের দরবারে কল্কে পেতে হলে আমাকে রীতিমতো কসরৎ করতে হয়। সব সময় পাইনে। এখন যদি সেই প্রায় ত্রিশ বৎসরের পুরনো সত্যপীর নাম দিয়ে কিছু লিখি– অতিশয় সভয়ে বৃদ্ধ বরজলালের মতো ক্ষীণ কণ্ঠে অর্থাৎ শ্লথ অক্ষম হস্তে লিখিত যৎকিঞ্চিৎ পাঠাই তবে সেটা ছাপা হয় ইংরেজিতে যাকে বলে অন এ রেনি ডে। রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ বয়সে একটি কবিতা নিম্নের কটি ছত্র দিয়ে আরম্ভ করেন :

ডাক্তারেতে বলে যখন মরেছে এই লোক
 তাহার তরে বৃথায় করা শোক।
 কিন্তু যখন বলে জীবন্মৃত্রর
তখন শোনায় তিতো
আমার হল তাই—

 পরে কবি বুঝলেন, গৌড়ীয় পাঠক মাত্রই তার এ-বিনয় অট্টহাস্যসহ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে। তাই পুস্তকাকারে প্রকাশের সময় এ ছত্র কটি তিনি নাকচ করে দিলেন।

আর আমার বেলা?

 জীবন্ত না। খাবি-খেকো, গঙ্গাযাত্রার আস্ত জীবন্মৃত।

সে কথা থাক।

ওই সময় অন্যান্য যাবতীয় বিষয়বস্তুর মধ্যে আমার একটি বক্তব্যে আমি বার বার ফিরে আসতুম। বলতুম, স্বরাজ আমাদের দিগ্বলয় চক্রের মতোই নিয়ে বা ঊর্ধ্বে দৃষ্টির বাইরে থাকুন না কেন, এই বেলাই তার জন্য কিছু কিছু প্রস্তুতির প্রয়োজন। ২. স্বরাজলাভের সঙ্গে সঙ্গেই ভারত পৃথিবীর সর্বদেশেই এম্বেসি, লিগেশন, কনসুলেট, ট্রেড কমিশন নিযুক্ত করবে; ৩. সে সব দফতরের জন্য বিদেশি ভাষা জাননেওলা লোকের প্রয়োজন হবে; ৪. বাঙালি ভাষা শেখার জন্য বিশেষ বুদ্ধি ধরে অতএব, এই বেলাই সাততাড়াতাড়ি কলকাতাতেই ভিন্ন ভিন্ন ভাষা শিখবার ব্যবস্থা করা অতীব প্রয়োজনীয় জরুরি কাজ। কারণ প্রথম ধাক্কাতেই যারা ফরেন সার্ভিসে ঢুকতে পারবেন তারা দেশদেশান্তরে ঘুরে বেড়াবেন এবং ফলে তাদের ছেলে এমনকি মেয়েরাও একাধিক ভাষা ইচ্ছা-অনিচ্ছায় শিখে নেবে। তখন আমাদের কলকাতার মেধাবী ছেলেরাও এদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না। ফলে ভালো ভালো চাকরি, যারা প্রথম ধাক্কায় ঢুকেছিল বংশানুক্রমে তাদের গোষ্ঠীপরিবারের একচেটে সম্পত্তি হয়ে যাবে। এ কিছু আজগুবি নয়া হাল নয়। বিসমার্ক এমনকি তার পূর্বেও যেসব খানদানি পরিবার ফরেন অফিসে প্রথম ধাক্কাতেই প্রবেশ করেছিল তাদের বংশধরগণকে গণতান্ত্রিক ভাইমার রিপাবলিক কমিয়ে দিয়ে মেধাবী মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোককে ঢোকাতে পারেননি। এমনকি হিটলারও এদের বিশেষ কাবু করতে পারেননি। এঁরা মস্করা করে বলতেন, নাৎসিদের দিয়ে এসব কাজকর্ম করানো যায় না; আমাদের মতো স্পেস (স্পসিয়ালিসট= স্পেশালিস্ট ওয়াকিফহাল) না থাকলে তাবৎ ফরেন আপিস এবং সঙ্গে সঙ্গে ওদের নিযুক্ত ন্নি ভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলো তছনছ বানচাল হয়ে যাবে।

আমার এসব সাবধানবাণীতে খুব কম লোকই তখন কান দিয়েছিলেন। একাধিক জন। আমাকে বলেন, আরে মশাই, আগে তো স্বরাজ ফলটি পেকে মাটিতে পড়ুক।

আমার পেটেন্ট উত্তর ছিল, রাধে মেয়ে কি চুল বাঁধে না?

আজ আমাদের কানে জল গেছে। আজ ম্যাকস্যুলার ভবনে, রুশ পাঠচক্রে ভিড় এমনকি কোনও কোনও বাড়ির বউ-ঝিরা এঁদের মধ্যে আছেন। শ্ৰীযুত মনোজ বসুর ধর্মপত্নী ও পুত্রবধূ কয়েক বৎসর আগে একই রুশ ক্লাসে পড়াশুনো করতেন।

কিন্তু ইতোমধ্যে ঘোড়া পালিয়েছে। আস্তাবলে এখন চাবি মারাটা বন্ধ্যাগমনের ন্যায় নিষ্ফল। সংস্কৃত সুভাষিত কয়, প্রদীপ নির্বাপিত হয়ে যাওয়ার পর তেল দিয়ে কী লাভ, যৌবনান্তে বিবাহ করে কী ফল পাবে!

সেই ১৯৪৪ থেকে কানমলা খেয়ে খেয়ে অর্থাৎ এ সব বাবদে লেখা সাধারণ জনের কৌতূহল উদ্রেক না করাতে আমি অন্য সব বিষয় নিয়ে লিখতে আরম্ভ করলুম। যারা দেশ পত্রিকায় (এ পত্রিকাতে ১৯৪৮/৪৯-এ আমার সর্বপ্রথম পুস্তক দেশে-বিদেশে ধারাবাহিক রূপে বেরোয় এবং সে-সম্বন্ধে দেশ পত্রিকার সুযোগ্য একনিষ্ঠ সম্পাদক শ্রীমান সাগরময় ঘোষ তাঁর অনবদ্য সম্পাদকের বৈঠক পুস্তকে কীর্তন করেছেন। সে যুগ থেকে বস্তুত ১৯৪৪ থেকে আমি কয়েক মাস, কখনও-বা দু এক বৎসর বাদ দিয়ে ঢাকের বাদ্যি থেমে গেলেই ভালো শোনায় দেশ পত্রিকায় প্রধানত পঞ্চতন্ত্রই লিখে আসছি) আমার এই পঞ্চতন্ত্র মাঝে মধ্যে পড়েছেন তারাই জানেন আমি এখন প্রধানত অজগর আসছে তেড়ে।/আমটি আমি খাব পেড়ো কিংবা ঔড্র পদ্ধতিতে ক রে কমললোচন শ্রীহরি/। করেন শঙ্খচক্রধারী ধরনের নির্বিষ অজাতশত্রু রচনাতে নিজেকে সীমাবদ্ধ করে রাখি।

কিন্তু ইতোমধ্যে মেঘে মেঘে বেলা হয়ে গিয়েছে। আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে। স্বরাজ লাভের সঙ্গে (১) ভারতীয় রাষ্ট্রদূতরা মদনভস্মের মতো বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়লেন। তারা যে সব দেশে অবস্থান করছেন তাদের সমস্যা, ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় সম্বন্ধে বিবৃতি দিতে লাগলেন; কখনও স্বেচ্ছায় কখনও পার্লিমেন্টের তাড়া খেয়ে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারফত। তাঁদের দারাপুত্ৰপরিবারও এ সব দেশকে কেন্দ্র করে সাহিত্য নিম-সাহিত্য প্রকাশ করলেন। (২) দলে দলে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, জর্নালিস্ট, সাহিত্যিক, ছাত্রছাত্রী, টুরিস্ট, সরকারি কর্মচারী গয়রহ নিত্যি নিত্যি দুনিয়াটা চষে ফেলতে লাগলেন। তাদের অনেকেই গানা থেকে অল-আলেমিন সিদি অল-বররাণি, পানামা থেকে তাশকেন্দ প্লাদিভস্তক সম্বন্ধে এন্তের এন্তের প্রবন্ধ কেতাব লিখলেন। অনেক সময় অগ্রপশ্চাৎ সম্যক বিবেচনা না করে। পরে সে বইয়ের কিয়দংশ সানুষ্ঠানে ভস্মীভূত করা হল। চার্বাক বলেছেন, ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতৎ কিন্তু এস্থলে পুনরাগমন আদৌ অসম্ভব নয়। বিশাখাপট্টনমে যখন জাপানি বোমা পড়ে তখন সরকারের হুকুমে ট্রেজারি অফিসার জমায়েত কারেনসি নোট পুড়িয়ে দিল্লিতে খবর দিলেন তিনি সাকুল্যে তাবৎ নোট ভস্মীভূত করেছেন। উত্তম। দু বত্সর যেতে না যেতে তার কিয়দংশ গুঁড়ি গুঁড়ি কী করে যে হাটবাজারে মদ্যালয়ে ক্লাবে আত্মপ্রকাশ করল কেউ জানে না।… এবং সবচেয়ে মোক্ষম তত্ত্ব (৩) ইংরেজ আমলে আমাদের বৈদেশিক নীতি কী হবে সে নিয়ে আমাদের কোনও শিরঃপীড়া ছিল না। এখন ওই বিষয় কানু ভিন্ন গীত নেই। অধুনা ডিহি পোঁদালিয়া ২/১ক/ক নং থার্ড বাইলেন শালপাতা ঠোঙ্গা বিতরণীর সহ-শাখা-কমিটির রক থেকে আরম্ভ করে টাটা-বিড়লা-লিভার ব্রাদারজের গোপনতম আলোচনা কক্ষে ওই এক কানুর গীত। যেমন মনে করুন এই যে ইংরেজ কমন মার্কেটে ঢোকার জন্য বেহায়া বেশরম হ্যাংলামোর চূড়ান্তে পৌচেছে, টা-পেনি হে-পেনি লুকসুমবের্গ বেলজিয়ামের মতো দেশের পা চাটছে সর্ব ইজ্জৎ সর্ব ইমান সৰ্ব আব্রু বাকিংহাম প্রাসাদস্থ স্কেটিং করার পুকুরে গলায় পাথর বেঁধে বিস্ হাথ পানিমে ডুবিয়ে দিয়ে দ্য গলের প্রেতাত্মারূপী বর্তমান সরকার তাদের পশ্চাদ্দেশে দু-চারখানা সবুট সরেস কিক কষাবে না তো- গোষ্ঠ-সমদ যে রকম পেনালটি পেলে, কালী (মৌলা) আলী ফোকটে বেমক্কা না-হক্কো পেনালটি পেলে যে রকম কালী আলীর (কালীঘাট মৌলা আলী) কাছে পুজো শিরনি মানৎ করে।

এইসব এবং অন্যান্য নানাবিধ কারণে ট্রেনজিসটারের সুলভতা ভুলবেন না– দেশের লোক, রকের রকফেলার এস্তেক পাড়ার পদীপিসি পর্যন্ত নানা বিষয়ে এমনই ওয়াকিফহাল হয়ে গিয়েছেন যে ১৯৪৪ সালে যা ছিল কঠিন বিষয়বস্তু, স্পেশেলাইজড তত্ত্বতথ্য, আজ তার অনেক কিছু হয়ে গিয়েছে ক ম ন ন লে জ। যেমন ধরুন ১৯৪৪–চুয়াল্লিশ কেন প্রায় ১৯৫২/১৯৫৩ অর্থাৎ যত দিন না নাপাক সরকার উভয় বঙ্গের যাতায়াতের জন্য ভিসা প্রথা প্রচলন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গসন্তান চোখের জলে নাকের জলে শিখল, ভিসা কারে কয় এবং প্রথম আপন সরকার ভারতীয় হলে ভারত সরকার পাকিস্তানি হলে পাক সরকারের কাছ থেকে যে সর্বপ্রথম দশ টাকা না পনেরো টাকা খর্চা করে একখানি পাসপোর্ট যোগাড় করতে হয়। তার জন্য কিউয়ে দাঁড়াও, ফর্ম বের করো এবং বিরাটতম চার পৃষ্ঠাব্যাপী তিন দফে (ইন ট্রিপলিকেট!) সেগুলো ফিলআপ করো। পাক্কা দেড়ঘণ্টা থেকে দু ঘণ্টা লাগে, যশয়। এই ফর্ম যদি আপনি স্বয়ং ফিলআপ করেন তবে আন্তর্জাতিক প্রাথমিক আইনকানুন সম্বন্ধে আপনার বেশ খানিকটে জ্ঞান হয়ে যাবে। কিন্তু দোহাই ধর্মের, আপনার নিরাপত্তার জন্যে তথা পাসপোর্ট আপনি আখেরে যেন পান তার জন্য আপনি সে ফর্ম স্বয়ং ফিলআপনা করে করাবেন ওই আপিসের আশেপাশে যেসব প্রফেশনাল ফর্ম ফিল আপ করনেওলারা আছে। অপরাধ নেবেন না; বেহারি ভাইয়ারা যে রকম ইটালিয়ান ব্যুরোতে, অর্থাৎ ইটের উপর বসে প্রফেশনালকে দিয়ে মনিঅর্ডার ফর্ম ফিলআপ করায়। হুবহু সেই রকম। অ। আপনি বুঝি ইংরেজিতে এম.এ. ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট, পিএইচডি.লিট। তাই আপনার দেমাক। কোনখানে ব্লক ক্যাপিটাল হরফে লিখবেন আর কোনখানে সাদামাটা হরফে, যে সব জায়গা দফতর ফিল আপ করবে, করে ফেললেন আপনি, যে জায়গাটা সুন্দুমাত্র খালাসিদের (যারা একদা পাকিস্তানি ছিল কিন্তু অধুনা ইন্ডিয়ান, আবার কখন রঙ বদলাবে তার স্থিরতা নেই এবং ইতোমধ্যে বেআইনি কায়দায়– যার জন্য তিন মাসের তরে শ্রীঘর-শ্বশুরালয়– সে জোগাড় করেছে তিন-তিনখানা পাসপোর্ট : প্রথমটাতে সে ভারতীয় নাগরিক, দ্বিতীয়টাতে সে পাক্কা ব্রিটিশ, তৃতীয়টাতে সে পাকিস্তানি। পুলিশ সন্দেহ করে শুধোলে সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলবে সে ভারতীয় এবং ভারতীয় পাসপোর্ট তার ছিল কিন্তু সেটা খোয়া গেছে : তার মতলব আরেকখানা পাবার। পেলে এটা বা আগেরটা বিক্রি করে দেবে। এই কলকাতাতেই যারা নোট জাল করে তারা স্পেয়ার টাইমে করে পাসপোর্ট জাল। এরা সে পাসপোর্ট কিনে নিয়ে অত্যুকৃষ্ট কেমিক্যাল দিয়ে খালাসির ফোটোগ্রাফ সেই পাসপোর্ট থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। যে ব্যক্তি গুণ্ডা বা ফেরার বলে পাসপোর্ট যোগাড় করতে পারেনি তার ফটো ছাপা হবে– সেখানে জায়গাটায় নতুন ফোটো কেমিকাল লাগিয়ে।… এতে বেশ কাঁচা দু পয়সা আমদানি হয়। খিদিরপুর অঞ্চলে নাকি একটা (প্রাইভেট) লিমিটেড কোম্পানি হয়েছে– ভাবছি কিছু শেয়ার কিনব) সেটা ফিল আপ করে বসলেন আপনি। সে ভুলটা ধরিয়ে দেবে আপনারই এক ভাগ্নে– উনিশবার ম্যাট্রিকে সে/ঘায়েল করে থামল শেষে। তখন ছিঁড়ে ফেলুন সেই তিন প্রস্ত ফর্ম, ফের দাঁড়ান কিউয়ে– ফের, ফিনসে। আর সবচেয়ে মারাত্মক অদৃশ্য ফাঁদ যেটি সদাশয় সরকার, অবশ্য অতিশয় অনিচ্ছায় কিন্তু সরকারি পয়সার যাতে অপচয় না হয় সেই শুভ ব্রত গ্রহণ করে আপনার জন্য পেতেছেন। অদৃশ্য কেন বললুম এখখুনি বুঝতে পারবেন। আমরা তথা পাকিস্তানিরা বিলেত ফ্রান্সের তুলনায় তো সবে স্বরাজ পেয়েছি। আমাদের সরকারকে কোন কোন প্রশ্ন জিগ্যেস করতে হয় সে সম্বন্ধে খুব একটা স্পষ্ট ধারণা নেই। ইংরেজ একদা যেসব প্রশ্ন শুধোত তার বেশকিছু বিশেষ একটা উদ্দেশ্য নিয়ে মহারানির রাজত্ব যেন হিটলারের সহস্রবর্ষের রাইষ-এর মতো অজরামর হয়ে থাকে। মহারানির রাজত্বে যেন কস্মিনকালেও– মহাপ্রলয়ে তাবৎ মণ্ডলসমূহ তথা অগণিত নক্ষত্ররাজি লোপ পাওয়ার পরও সূর্য কখনও অস্তমিত না হয়। … তা সে যাক গে। এখানে পাসপোর্ট ফরম তৈরি করার সময় ভারতীয় হুজুরদেরই স্থির করতে হয় আমরা কোন কোন প্রশ্ন শুধব। পয়লা ঝটকাতেই সব প্রশ্ন হুজুরদের মনে আসে না। পরে হঠাৎ চিৎকার করে ওঠেন, ঐয্যা! অমুক প্রশ্নটা তো শুধানো হয়নি। কিন্তু হায় তখন তো আর তাবৎ ছাপা ফর্ম বাতিল করে দেওয়া যায় না। তাই বের করলে এক নয়া কৌশল। নতুন প্রশ্ন রবার স্ট্যাম্পে বানিয়ে নিয়ে চাপরাশিকে দিলেন হুকুম, প্রত্যেক ফর্মে মারো এই ইস্টাম্পো। চাপরাসি ভটভট সেই কর্ম করতে লাগল ফর্মের এক সংকীর্ণ কোণে। এখন হয়েছে কী, আপনি পেলেন ৩৭৩৮৫ নম্বরের ফর্ম। ততক্ষণের রবার স্ট্যাম্পের হরফগুলো সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে সেটি হয়ে গিয়েছে নখের মতো পালিশ। তখন ফর্মে একটা ঝাপসা ঝাপসা ফিকে বেগনি রঙের কুয়াশা কুয়াশা মাত্র দেখা যায় অবশ্য আপনি যদি সেটি সাতিশয় মনোযোগসহ নিরীক্ষণ করেন। সেটা দেখে আপনার মনে কিছুতেই সন্দেহ হবে না যে এটা খয়ে যাওয়া রবারস্ট্যাম্পের অবদান– আপনি সন্দেহ-পিচেশ হোন না কেন? অ! ভুলে গিয়েছিলাম আপনি ইংরেজিতে ডি লিট কিংবা যাই হোন না কেন, যেখানে কোনও অক্ষরের চিহ্নমাত্র নেই তার পাঠোদ্ধার করবেন কী করে? তাই আপনি নিশ্চিন্ত মনে ফর্ম পাঠিয়ে দিলেন হেড অফিসে। এক মাস পরে সেটি এল ফেরত। এবং সঙ্গে লেখা আছে আপনি অমুক নম্বর প্রশ্নের উত্তর দেননি কেন? আপনি খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে যাবেন সেই প্রফেসনালের ইটের পাজাতে। সে লেটেস্ট খবর রাখে। সে সেই বেগনি কুয়াশার মধ্যিখানে সঠিক জায়গায় উত্তরটি লিখে দেবে। শুধু কি তাই? আপনি যেসব উত্তর দিয়েছেন, আপনার জ্ঞান আপনার বিবেক অনুযায়ী সেগুলো চেক অপ করতে করতে সে বিষম খাবে, আঁতকে উঠবে আর গোঙরাতে গোঙরাতে বলবে, এসব কী উত্তর দিয়েছেন! বরঞ্চ আপনার কৃষ্ণপ্রাপ্তি হলেও হতে পারে কিন্তু এসব উত্তর শুনতে চান এবং শুধু তাই নয়, আজ কী উত্তর শুনতে চান, মত পালটে পরশু দিন ফের কোন উত্তর দিলে পাসপোর্ট প্রাপ্তি হবে না। সে জানে, হুজুররা কী উত্তর শুনতে চান। সে নতুন ফর্ম তার বাক্স থেকে বের করবে আপনাকে ফের কিউয়েতে ধন্না দেবার গব্বযন্তনা থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে এবং এমন সব আকাশকুসুম, সোনার পাথরবাটি উত্তর লিখবে যে এবারে আপনার বিষম খাবার, আঁতকে ওঠবার পালা।

কিন্তু আপনি পাসপোর্ট পেয়ে যাবেন। যদিস্যাৎ না পান তবে জানবেন অন্য কোনও ব্যাপারে আপনার জীবন নিষ্কলঙ্ক নয়। পুলিশ আপনার সম্বন্ধে অনুসন্ধান করে, কিংবা আপন ফাইল (দসিয়ে) থেকে আবিষ্কার করেছে, আপনি ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে রুশ লেখক গর্কির মাদার পড়েছিলেন, কিংবা ওয়েল নেভার মাইন্ড—কিছু একটা আছে।

এমন সময় আপনার এক উকিল বন্ধু আপনাকে বললে, সংবিধানে প্রত্যেক ভারতীয়কে জন্মগত অধিকার দিয়েছে, যত্রতত্র গমনাগমনের স্বাধীনতা। ঠোকো মোকদ্দমা। পেত্যয় যাবেন না, আপনার চেয়েও শতগুণে তালেবর এক খলিফে ব্যক্তি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত লড়ে বিদেশ যাবার পাসপোর্ট পেয়েছিলেন। তিনি বগল বাজিয়ে প্লেনের টিকিট কাটতে ধাওয়া করেছিলেন কি না জানিনে, আমরা হুঁশিয়ার করছি,

ঘুঘু দেখেই নাচতে শুরু
ফাঁদ তো বাবা দেখোনি।

কিংবা’ না আঁচিয়ে’ ভরসা কই! কিংবা সুকুমার রায়ী ভাষায়

কেই বা শোনে কাহার কথা
কই যে দফে দফে।
গাছের পরে কাঁঠাল দেখে
তেল দিয়ো না গোঁফে ॥

পাসপোর্ট পাওয়ার পর একটি

বৈষ্ণব হইতে মনে গেল বড় সাধ।
তৃণাদপি শোলোকেতে ঘটালো পরমাদ।

 সে তৃণটি এস্থলে পি ফরম। বিদেশের হোটেলে তো আপনাকে মুফতে থাকতে দেবে না, রেস্তোরাঁতে মাগনা খেতে দেবে না। অতএব আপনার বিদেশি মুদ্রার প্রয়োজন। সে মুদ্রা ক্রয় করার তরে আপনি দিশি মুদ্রা দিতে প্রস্তুত, কিন্তু পি ফর্মের পীঠস্থান রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সবিনয়ে বলবে, এদানির বিদেশি অর্থের বড়ই অনটন। সরি! কথাটা খুবই সত্য, সে কথা আমি কোনও ব্রাহ্মণ বন্ধুর কাছ থেকে পৈতে ধার করে সেইটে ছুঁয়ে কসম খেতে রাজি আছি।

সবই জানি। শুধু জানিনে, পাসপোর্ট না পেলে যে রকম মোকদ্দমা করা যায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বিদেশি কড়ি না দিলে তার বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের করা যায় কি না।

এ পর্যায়ে কিন্তু একটি শেষ কথা না বললে অন্যায় হবে। কর্তারা যে যাকে-তাকে চট করে বিদেশ যেতে দেন, তার প্রচুর কারণ আছে। কিন্তু সেকথা আরেক দিন হবে।

.

মোদ্দা কথায় ফিরে যাই।

ত্রিশ বৎসর পূর্বে এইসব বহুবিধ, যাবতীয়, হরেকরকম্বা সমস্যা সম্বন্ধে সবাই ছিল উদাসীন। মার খেয়ে খেয়ে, এবং তার চেয়েও নির্মমতর অভিজ্ঞতা পয়সাওলারা কী করে সর্ববাধা অতিক্রম করে সর্বত্র যাতায়াত করেন, বিজনেসমেন দেশের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য বিদেশ যাবার তরে সর্ব ছাড়পত্র সংগ্রহ করে ড্যাংড্যাং করে রওনা দিলেন, আপনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন, সে তো বুঝি, কিন্তু সঙ্গে তাঁর বিরাটকলেবরা ভামিনী গোটাদুত্তিন বালক পুত্র এবং কন্যা,– এনারা যাচ্ছেন দেশের কোন সম্পদ বৃদ্ধি করতে, এবং এনাদেরই একজন

উনিশটিবার ম্যাট্রিকে সে
ঘায়েল করে চললো হেসে
 বিলেতে কিংবা ওয়াশিংটন
মুদ্রা মেলা, হাজার টন।

 এ তো বিদেশের কথা। কটা লোকই-বা বিদেশ যাবার মতো রেস্ত ধরে। দেশের ভিতরকার সমস্যাই-বা কিছু ছেড়ে কথা কয় নাকি? একদা ভূমিকম্প হলে, যথেষ্ট বৃষ্টিপাত না হলে, টাইগার হিল থেকে কুয়াশার দরুন কাঞ্চনজঙ্র দর্শন না পেলে, বাজী পঠি বাচ্চা না বিয়োলে অন্যথা বউ সাত নম্বরের বাচ্চা বিয়োলে, পর্যাপ্ত পরিমাণে স্কচ চুকুস চুকুস করে না চাখতে পারলে, গণ্ডায় গণ্ডায় রামমোহন রবিঠাকুর না জন্মালে আমরা বণিকের মানদণ্ড-র উত্তরাধিকারিণী মহারানির (পাড়ার ঘোষাল বলত, ব্যাটাদের ঘিনপিতও নেই– বেনের এঁটো গব গব করে খেল রাজার বেটাবেটি) বাজার সরকার বড়লাটের খুলিতে ডবল বম ফাটাবার চেষ্টা করতুম– অবশ্য সঙ্গোপনে মনে মনে।

সুস্থাবস্থায় কিন্তু সেই মনই অতিশয় বেয়াদব প্রশ্ন শুধোত এসব বর্গিদের, খাজনা দেব কিসে?

গুরু বড় দুঃখে বলেছিলেন, শোন থেকে মশান থেকে ঝোড়ো হাওয়ায় হা হা করে উত্তর আসে আব্রু দিয়ে, ইজ্জৎ দিয়ে, ইমান দিয়ে–বুকের রক্ত দিয়ে।

একই নিশ্বাসে গুরুর সেই ভবিষ্যবাণীর সঙ্গে আমার পরবর্তী যুগের অক্ষম সাবধানবাণীর কথা তুলি কোন পাপমুখে? কিন্তু পাঠক ক্ষণতরে চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন, এটা আমার দম্ভ নয়। ঝাড়া তিনটি মাস মেসের ভাত না খেলে (কিংবা উপস্থিত আমি যে নার্সিং হোমের খুঁটে খাচ্ছি সে বস্তুর অভিজ্ঞতা না থাকলে) মায়ের রান্নার প্রকৃত মূল্য কে কখন বুঝতে পেরেছে? যুধিষ্ঠিরকে যে নরক দর্শন করানো হয়েছিল সেটা বিধাতার কোনও উটকো খামখেয়ালি নয়। নইলে স্বর্গপুরীর অপ্সরাদের সঙ্গে দু দণ্ড রসালাপ বিশ্রম্ভালাপ করার পূৰ্ণানন্দটা তিনি তারিয়ে তারিয়ে চাখতেন কী প্রকারে? গব গব করে গিলতেন, আমরা যে রকম মেসের রান্না হড় হড় করে গিলে রেকর্ড টাইমে পাপ বিদেয় করি।… এইবারে শ্যানা পাঠক নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন, আমার প্রবন্ধ সাতিশয় মনোযোগ সহকারে পঠন কেন অবশ্য কর্তব্য, একান্ত অবর্জনীয়। তার চেয়েও ইমপর্টেনট প্রবন্ধ : তার চেয়ে আরও ইমপর্টেনট কর্তব্য, আমার বই কিনুন– চাই পড়ুন, চাই না বা পড়ন।

ত্রিশ বৎসর পূর্বে আমি পুনঃপুন বলেছিলুম, আরও কঠোরতর, আরও নির্মমতর খাজনা দিতে হবে স্বরাজ লাভের পর। এইবেলাই যদি সে খাজনার সন্ধান না নাও তবে তোমার কপালে বিস্তর গদিশ আছে। এই দেখুন না আজ পুব বাংলার হাল! কাল যে পশ্চিম বাংলায় হবে না তার আশ্বাস দেবেন কোন পলিটিকাল গোঁসাই?– আমি অবশ্য এসব দুর্যোগের ভবিষ্যত্বাণী আপ্তবাক্য রূপে প্রকাশ করিনি। কিন্তু যা কিছু নিবেদন করেছিলুম সেটা কেউ কান পেতে শোনেনি। (বলতে ইচ্ছে করছে এখন তবে খাও কানমলা, কান টানলে মাথা আসে সেটা যেমন সত্যি, ঠিক তেমনি সত্যি কান না পাতলে কানমলা খেতে হয়)।

ওঁরা বলতেন বা ভাবতেন, আমার বক্তব্য স্পেশালাইজড নলেজ; এসব এখন তকলিফ বরদাস্ত করে আমরা পড়বই-বা কেন, বুঝতে যাবই-বা কেন। আগে স্বরাজ আসুক তার পর অন্য কথা। আমি সবিনয় বলেছিলুম, রাধে মেয়ে কি চুল বাধে না?

মার খেয়ে অপমান সয়ে সয়ে আমরা এখন অনেক কিছু শিখে ফেলেছি- এই যেমন খানিকক্ষণ আগে পাসপোর্ট কী প্রকারে পেতে হয়, সেটা পাওয়ার পরও আপনার কপালে আর কোন কোন গর্দিশ আছে সে সম্বন্ধে অতিশয় যৎকিঞ্চিৎ সাতিশয় সংক্ষেপে নিবেদন করেছি।

তারই ফলে একদা যেসব তথ্য নিয়ে শুধু স্পেশ লশটরা আলোচনা করতেন, যেগুলো নিছক স্পেশালাইজড নলেজ ছিল এখন সেগুলো হয়ে গিয়েছে ডালভাত, কমন নলেজ। একদা যেমন বিশেষজ্ঞরাই শুধু মাথা ঘামাতেন, পৃথিবী ঘোরে না সূর্য ঘোরে, পরবর্তী যুগে সেই সমস্যার সমাধান কমন নলেজ হয়ে দাঁড়াল!

চল্লিশ-পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে বঙ্গসন্তান আমার য়ুরোপ ভ্রমণ, লন্ডনে বঙ্গ মহিলার ঘরকন্না, নরওয়েতে প্রথম বঙ্গরমণী উৎসাহ ও কঙ্গোতে কৌতূহল সহকারে পড়ত। এখন এতশত লোক নিত্য বঙ্গো ইন উইক এন্ড কাটাতে যায়, জবল অল অলবিয়াতে হানিমুনের প্রথমার্ধ চুষে আসে যে ফ্রান্স ভ্রমণ কিংবা মন্তে কার্লো দর্শন শিরোনামা এখন সে অবজ্ঞার চোখে দেখে, লেখক পরিচিতজন হলে গেরেমভারি মুরুব্বির মতো তাকে পেট্রোনাইজ করে পিঠ চাপড়ে বলে, লেগে থাকো ছোকরা; এখনও হাদ্ৰামুৎ অঞ্চলে অমুসলমানকে ঢুকতে দেয় না বটে কিন্তু তুমিই হয়তো একদিন সেখানকার সেই বিরাট প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ যেখানে একদা শেবার রানি বাস করতেন সেইটে সক্কলের পয়লা দেখে এসে তাবৎ গৌড়জনকে তাক লাগিয়ে দেবে।

একদা আমি দেশে-বিদেশে নাম দিয়ে কাবুল সম্বন্ধে একখানা পুস্তক রচনা করি। প্রকাশকালে বইখানা কিছু লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শুনেছি, এখনও নাকি কেউ কেউ বইখানা পড়ে। আমি জানি, কেন? তার একমাত্র কারণ যদিও কাবুল পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে অবস্থিত নয়, এবং উত্তর মেরুতে অভিযান করার মতো বিপজ্জনকও নয়, তবু একাধিক কারণে প্রধানতম কারণ অবশ্য এই যে আফগান সরকার চট করে সব্বাইকে ও দেশে যাবার অনুমতিলাঞ্ছন ভিসা পারমিট মঞ্জুর করে না, এবং এই একটি কারণই পূর্বে উদ্ধৃত তৃণাদপি শোলকের মতো কাবুলগামীর সম্মুখে অলঙ্ প্রতিবন্ধন; কাবুলি প্রবাদও বলে সিংহের এক বাচ্চাই ব্যস (যথেষ্ট)। বইখানি তাই এখনও লিকলিক করে টিকে আছে।

.

গৌড়জনের কমন নলেজ এ-কালে এতই সুদূরবিস্তৃত– ভয়ে ভয়ে বলি, কুলোকে বলে শুধু বিস্তারই আছে– গভীরতা আদৌ নেই এবং সে বিস্তারও নাকি বড় পল্লগ্রাহী যে তাদের মন পাওয়া প্রতিদিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শুনতে পাই, বিকৃত যৌনজীবন, এবনরমাল সেকস, সমকাম, সাদিজম, মাসোখিজম, পিকচার পোস্টকার্ড, ব্লু ফিলম ইত্যাদি ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়বস্তু বেহদ্দ রগরগে ভাষায়, সর্ববিধ অসম্ভব ফোটোগ্রাফসহ পরিবেশন করলেও তারা যে শুধু নাসিকা কুঞ্চিত করেন তাই নয়, বা দিকে ঘাড় বেঁকিয়ে ডান রু ইঞ্চিটাক উত্তোলন করে বলেন, ছোঃ! চাঃ!! পুঃ!!! এগুলো আবার কী? ক-অ-অ-বে কোন আদ্যিকালে এ-সব তো কমন নলেজেরও নিচের স্তরে নেমে গিয়েছে। পুলিশের নাকের সামনে পেভমেন্টে বিক্রি হয়, জলের দরে। শোনননি বুঝি থাকো কোন ভবে কোন দুনিয়ায়?- যবে থেকে ডেনমার্কে এসব মালের ওপর থেকে ব্যান তুলে দেওয়া হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে তার বিক্রি দশ আনা পরিমাণ কমে গিয়েছে। তাবৎ বস্তু, সাকুল্যে বিষয় ব্যান তুলে দেওয়ার ফলে যখন তিন দিনের ভিতর কমন নলেজ হয়ে গেল, তখন আর ওসব মাল কানা কড়ি দিয়েও কিনবে কে? শুনছে, এখন নাকি দিনেমার প্রকাশক ওসব মাল তালাক দিয়ে ধর্মগ্রন্থ ছাপবে। সেটা যখন স্পিরিচুয়াল লেভেলে উঠে গিয়েছে তখন স্পিরিচুয়াল বই অর্থাৎ গ্রন্থ ছাপানোই প্রশস্ততর।

হ্যাঁ, তদুপরি আরেকটি খবর আমি কাগজে পড়েছি। তত্ত্বটি আমি বাল্যকালেই শুনেছিলুম। পরিপূর্ণ স্বাদ পেতে হলে চুম্বনটি চুরি করে নিতে হয়। এ কিস টু বি দি সুইটেসট হ্যাঁজ টু বি স্টোলেন। সম্মানিত মার্কিন কাগজে পড়লুম, নাম ছিল লেডি চ্যাটারলিজ লয়ারজ। লাভারজ নয়–অর্থাৎ কি না মার্কিন মুলুকে যখন লেডি চ্যাটারলি কেতাবখানা অশ্লীল কিংবা কাব্যরসের অত্যুকৃষ্ট উদাহরণ কি না ওই নিয়ে মোকদ্দমা উঠল তখন এক বাঘা উকিল বিচারগৃহ প্রকম্পিত করে ওজস্বিনী ভাষায় তাঁর সুদীর্ঘ বক্তৃতা শেষ করে আবেগোল কণ্ঠে বললেন, ধর্মাবতার তথা সম্মানিত জুরি মহোদয়গণ! লেডি চ্যাটারলি পুস্তকে গ্রন্থকার যে অপূর্ব কলানৈপুণ্য ও সত্য শাশ্বত সাহিত্যরস সৃষ্টি করেছেন তাই নয়, যৌনজীবনকে তিনি স্পিরিচুয়াল লেভেলে (আধ্যাত্মিক স্তরে) তুলে নিয়েছেন, তুলে ধরেছেন।

এই শেষ অভিমতটি শুনে এক পরিপক্কা সমাজে সম্মানিতা ফরাসি নাগরী মৃদু, দুই মেয়ের স্মিত হাস্য হেসে বললেন, সর্বনাশ। আমি তো এ্যাদ্দিন জানতুম যৌনসম্পর্কটা নিষিদ্ধ পাপাচার। এখন থেকে ওই আনন্দের অর্ধেকটাই মাঠে মারা গেল।

.

নিষিদ্ধ হোক, কিংবা পুলিশসিদ্ধ তথা শাস্ত্রসম্মত হোক আর নাই হোক বিদগ্ধ গৌড়ীয় পাঠক এখন চান কড়া পাকের মাল, তত্ত্ব ও তথ্য সম্বলিত– একদা যে রকম নৃত্যসম্বলিত গ্রামোফোন রেকর্ড সাদামাটা রেকর্ডের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল। অর্থাৎ পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আগে আমি যে সওগাত পরিবেশন করছিলুম তারা অধুনা সেই বস্তু চান।

কিন্তু আমি পোড়া গোরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরাই।

ইতোমধ্যে আবার অন্য দিক থেকে আরেক বিপরীত বায় বইতে আরম্ভ করেছে। জীবনসংগ্রাম কঠোরতর হয়েছে, পাপাচারের উত্তাল তরঙ্গ গিরিচূড়া লঙ্ন করে উধ্বমুখে উৎক্ষিপ্ত, দিনান্তে বলীবদের ন্যায় কর্মক্লান্ত জন স্বগৃহে পৌঁছবে না টিয়ার গ্যাসে অন্ধ হবে এবং/কিংবা গুলি খেয়ে পঞ্চভূতে লীন হবে সেই দুশ্চিন্তায় সে ম্রিয়মাণ মোহ্যমান।

ঠিক এই একই অবস্থাতে ফরাসি সাহিত্যের তদানীন্তন গ্রামেত্র (গ্রান্ড মাস্টার) কী উপদেশ দিয়েছিলেন সেটি অবহিত চিত্তে শ্রবণ করে কর্ণ সার্থক তথা পুণ্যার্জন করুন।

প্যারিসের এক অসহিষ্ণু গবি অর্থাৎ যিনি অবোধ্য মডার্নস্য মডার্ন গবিতা লেখেন আনাতোল ফ্রাসকে প্রায় শাসিয়ে হুঁশিয়ার করে তালিম দেন, কবিতা পড়াটা কিছু ছেলেখেলা নয়, যে ছ্যাবলামো এ্যাদ্দিন ধরে চলে আসছে। মডার্ন কবিতা আগাপাশতলা সম্পূর্ণ ভিন্ন বস্তু।৬

এ কবিতা-দেউলের প্রতি পাঠককে তীর্থযাত্রীর ন্যায় অবনত মস্তকে অগ্রসর হতে হয়। ভক্তিশ্রদ্ধা তথা (সূচ্যগ্রন সুতীক্ষেণ) একাগ্রতাসহ মডার্ন পোয়ট্রির দ্বারস্থ হতে হয়! (মডার্ন পোয়েট্রি শুড বি এপ্রোচ উইদ ডিভোশন অ্যান্ড কনসানট্রেশন)

এ উদ্ধৃতি দেওয়ার পর ফ্ৰাস যেন দিবাদ্বিপ্রহরে সাক্ষাৎ যমদূতের দর্শন পেয়ে সাতঙ্কে ভগবানকে স্মরণ করছেন যে স আযৌবন প্রকাশ্যে একাধিকবার তার নাস্তিকতা প্রচার করেছিলেন; এর থেকেই সর্ব আস্তিক সর্ব নাস্তিক অনায়াসে বুঝে যাবেন। সেই গবির আপ্তবাক্য শুনে তাঁর হৃদয়ে কী মারাত্মক গগনচুম্বী পাতালস্পর্শী ভীতির সৃষ্টি হয়েছিল। উচ্চকণ্ঠে সৃষ্টিকর্তাকে আহবান জানিয়ে প্রার্থনা করছেন :

হেভন ফরবিড! দেবভাষায় বলা হয় ঈশ্বর রক্ষতু, মুসলমান বলে লা হাওলা কুয়েতি ইল্লা বিল্লা। বাংলায় এ স্থলে ঠিক কী বলা হয় জানিনে। ভূত দেখলে লোকে রাম নাম স্মরণ করে অবশ্য। কিন্তু এ স্থলে প্রার্থনা রয়েছে, নাস্তিক ফ্ৰাস বলছেন, ঈশ্বরাদেশে এ হেন অপকর্মে যেন বিরত হয়।

এর পরই ফ্ৰাঁস বলছেন, আমি জানি বেচারী (সাধারণ) ফরাসিকে সমস্ত দিন সামান্য রুটি-মাখনের জন্য কী রকম মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়।

এ স্থলে এগোবার পূর্বে পাঠককে ফের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, ত্রেতা যুগটি আমি লিখছি (দ্বাপরের পরে। কেন, সেটা যারা তাপসী অহল্যার কাহিনী পড়েছেন তারাই জানেন) হাসপাতালে। (যদিও খানদানি ভাষায় এটি নার্সিং হোম বা মেডিকাল সেন্টার নামে সগৌরবে প্রচারিত, তথাপি আমার সামান্য অভিজ্ঞতা প্রতিবাদ জানিয়ে অজ্ঞজনকে হুঁশিয়ার করে বলে, এটা হোম তো নয়ই, এবং আচার-আচরণ, প্রাচীন যুগীয় সাজ-সরঞ্জাম দেখে মনে হয়, মেডিকাল সেন্টার-এর নাম পালটে এটাকে মেডিঙ্গভালো– মধ্যযুগীয় কান্তার নাম দিলেই এর প্রতি সত্য বিচার করা হয়, কিংবা মেডিঙ্গভালো হান্টারও বলতে পারেন, এবং এখানে কী শিকার হয় তার আলোচনা করে অসুস্থ শরীর নিয়ে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে চাইনে)। সবসুদ্ধ মিলিয়ে এখানকার কর্তৃপক্ষই স্মৃতিভ্রষ্ট হন, আমি যে আনাতোল ফ্রাসকে উদ্ধৃত করার সময় পর্বতপ্রমাণ ভুলভ্রান্তি করব সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং কার্সিং (প্রুফরিডার মশাই, আমি কার্সিং অভিসম্পাত অভিশপ্ত-ই লিখেছি– সজ্ঞানে; নার্সিং লিখিনি) বম বাবদে যাদের সামান্যতম অভিজ্ঞতা আছে, অর্থাৎ এ পুরী থেকে সুস্থ অস্থি নিয়ে নিতান্তই ভগবদকৃপায় বেরুতে পেরেছেন তারা যে আমাকে ক্ষমাসুন্দর চক্ষে দেখবেন সেটা ততোধিক স্বাভাবিক।

ফ্ৰাঁস বলছেন, বেচারী ফরাসি যখন ক্লান্ত দেহে শ্লথ পদে বাড়ি পৌঁছে একখানা পুস্তক হাতে তুলে নেয় (অর্থাৎ, অত্যধিক মদ্যপান করে বউকে না ঠেঙিয়ে, কিংবা ঝটপট জুয়ো খেলাতে বসে বউ-বাচ্চার জন্য দু মুঠো অন্ন কেনার রেস্ত উড়িয়ে না দিয়ে– লেখক) তখন, ঈশ্বর রক্ষতু, আমি তার কাছ থেকে সশ্রদ্ধ একাগ্রতা (ডিভোশন অ্যান্ড কনসানট্রেশন) মোটেই কামনা করিনে–  বলছেন ফ্রাঁস। তার পর তিনি যেন নিবেদন করছেন : আমি যা দিতে চাই, এবং সে-ই আমার উজাড় করে দেওয়া, (অল আই উয়োন্ট টু গিভ) তার যেন একটুখানি শ্রান্তি বিনোদন হয়, তার যেন একটুখানি ফুর্তি জাগে (রিলেকসেশন, এনটারটেনমেন্ট, এম্বুজমেন্ট হয়। এবং যেদিন ওই সবের ফাঁকে ফাঁকে ওই বেচারী ফরাসিকে কোনও প্রকারের কোনও ইনফরমেশন দিতে পারি, সেদিন আমার আর আনন্দের সীমা পরিসীমা থাকে না (মাই জএ নোজ নো বাউন্ডজ)।

দম্ভী মসিয়ো মরিসকে, আমার পাঠকদের মধ্যে দম্ভী কেউ নেই, কিন্তু যদিস্যাৎ কোনও উটকো দম্ভী মাল ছিটকে এসে গোলে হরিবোল দিয়ে থাকেন তবে তাকে বলছি, অবহিতচিত্তে প্রণিধান করো, যে ফ্রাসকে ফরাসিদের লোক ক্রাঁ মেৎর, গ্র্যান্ড মাস্টার, গুরুদেব বলে একবাক্যে স্বীকার করে সাহিত্যের ময়ূর সিংহাসনে বসিয়েছিল তিনি কতখানি বিনয় সহকারে বলছেন, তার নগণ্য অর্ঘ্য কী? এবং সেটা এমনি যৎসামান্য অকিঞ্চিত্বর যে তার জন্য কোনও পাঠকের কাছ থেকে কোনও প্রকারের ডিভোশন বা কনসানট্রেশন তিনি চান না।

এবং সর্বশেষে মসিয়ো মরিসকে একটুখানি ধূলি পরিমাণ উপদেশ দিচ্ছেন : তদুপরি সর্বোপরি, হে মসিয়ো মরিস, তুমি যদি শতাব্দীর পর শতাব্দী ভ্রমণ করতে করতে পেরিয়ে যেতে চাও তবে হাল্কা হয়ে ভ্রমণ করো। (ইফ ইউ উয়োন্ট টু ট্র্যাভেল গ্রু সেঞ্চুরিজ, ট্র্যাভেল লাইট!)

কী মহান আপ্তবাক্য! মরিস, তুমি যদি চাও যে তোমার রচনা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লোকে পড়ক তবে সে রচনার ঘাড়ে বিস্তরে বিস্তর ভারী মাল চাপিয়ো না। অর্থাৎ যে মাল কনসানট্রেশন চায়, ডিভোশন চায়।

ব্যাসদেব এ তত্ত্বটির প্রথম আবিষ্কারক। গণপতিকে যখন তিনি মহাভারতের ডিকটেশন নেবার জন্য মনোনীত করেন তখন তার মাত্র একটি শর্ত ছিল, তুমি নিজে না বুঝে কোনও বাক্য লিখতে পারবে না। গণপতি গণের অর্থাৎ সাধারণজনের, mass-এর প্রতি। অতএব তিনি লিখবেন সবকিছু নিজে প্রথমটায় বুঝে নিয়ে যাতে করে জন গণও সবকিছু বুঝতে পারে। তাই বোধহয় কাব্যতত্ত্ববিশারদ তলস্তয় মন্তব্য করেছিলেন, মহাভাররে মতো কাব্য ইহসংসারে আর নেই।

আনাতোল ফ্রাঁস হুবহু এই আদর্শটিই শ্রীমান মরিসের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।

অবনত মস্তকে, করজোড়ে, দাঁতে দাঁতে কুটো কেটে স্বীকার করছি, প্রাগুক্ত তত্ত্বটি আবিষ্কার করতে এবং সেটা হৃদয়ঙ্গম করতে আমার অনেকখানি সময় লেগেছিল। অবশ্য মসিয়ো মরিসের মতো সশ্রদ্ধ একাগ্রতার প্রত্যাশা করার মতো হিমালয় বিনিন্দিত উত্তুঙ্গ দম্ভ আমার কস্মিন কালেও ছিল না। আমি ভুল করেছিলুম অন্য ক্ষেত্রে। আমি মনে করেছিলুম দেশবিদেশ ঘুরে আমি যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, একাধিক ভিন দেশে বাধ্য হয়ে যে দু একটি ভাষা নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি, বহুবিধ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিরীক্ষণ এবং তার নির্যাস গলাধঃকরণ করেছি, নানান ধরনের নানান চিড়িয়ার সঙ্গে মোলাখাৎ-সহবাসের ফলে যে আদর-অনাদর, দাগা-মহব্বত পেয়েছি, প্রবাসের নিরানন্দ দিনে, নির্জন ত্রিযামা শর্বরীতে আকাশকুসুম চয়ন করেছি, দীর্ঘ, দীর্ঘকাল ধরে মাতৃবিরহের অসহ কাতরতা এবং তার চেয়েও নিষ্ঠুর উপলব্ধি যে পুত্রবিরহিণী আমার মা-জননী আমার চেয়েও কত লক্ষ গুণে কাতর নিরানন্দ নিরালোক দিনযামিনী যাপন করছেন আমার প্রত্যাগমন প্রত্যাশা করে এর মধ্যে অসাধারণ অলৌকিক এমন কোনও সৃষ্টিছাড়া উপাদান-উপকরণ নেই যেটা আমার মতো নিতান্ত সাধারণজনসুলভ সাধারণ ভাষায় প্রকাশ করলে গৌড়ীয় পাঠকের বোধগম্য হবে না, তার দিকচক্রবাল অতিক্রম করে মহাশূন্যে বিলীন হবে না।

আমি জানতুম, এবং এখনও দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করি যে হাড় আলসে, রকবাজিতে দিগ্বিজয়ী ফোকটে টু পাইস কামাবার তরে বাপের কামানো ফোর পাইস ঝটসে ঝেড়ে দিতে প্রস্তুত, এবং পাড়ায় একটি সর্বজনসেবী পাঠাগার নির্মাণের জন্য হোক কিংবা নির্মাণান্তে দলাদলিবশত সেটিকে বীরদর্পে ভস্মীভূত করাই হোক, উভয় মহৎ কর্মের জন্য, তদাভাবে সর্বকর্মের জন্য, তদাভাবে কর্মহীন কর্মের জন্যই হোক, চাঁদা তোলাতে যে বাঙালি অদ্বিতীয়, অপরাজেয়, যে বাঙালি গত বিশ্বযুদ্ধের সময় ওই মহৎ ব্রত উদযাপনের জন্য হিটলার-স্তালিনের চাঁদা তোলার প্রয়াস-পদ্ধতির বর্ণনা শুনে শিশু! শিশু!! বলে অট্টহাস্য দ্বারা গোরশয্যাশায়ী ওই দুই মহাপ্রভুকে লজ্জা, আত্মগুলায় ঘন ঘন ঘূর্ণায়মান করতে ভানুমতী বিশারদ, সেই বাঙালি, আবার বলছি, সেই বাঙালি– অন্য জাত যারা ভ্রমণ ব্যপদেশে কলকাতাতে এসে সভয়ে, আমাদের রঙ্গভূমি থেকে সম্মানিত ব্যবধান রক্ষা করে, আমাদের কীর্তিকলাপের খুশবাইটুকু মাত্র পেয়েছে তারা কিছুতেই প্রত্যয় যাবে না যে বাঙালি বই পড়ে।

হ্যাঁ, বই পড়ে। অধিকাংশ স্থলেই অবৈধ কিন্তু মার্জনীয় পদ্ধতিতে। কিন্তু পড়ে।

তাই আমি হরেদরে ধরে নিয়েছিলুম, আমার বক্তব্যবস্তু যতই হ য ব র ল মার্কা হোক না কেন, সেটা তার কাছে কিছুতেই সম্পূর্ণ অপরিচিত হতে পারে না– নিতান্ত দু-একটি উৎকট ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছাড়া। কারণ প্রকৃত পাঠকের কাছে কোনও বিষয়ই সম্পূর্ণ অজানা নয়, আবার কোনও বিষয়ই সম্পূর্ণ জানা নয়। তাই এক আরব গুণী বলেছেন, পুস্তক, সে যেন একটি ছোট্ট বাগান যেটি তুমি অনায়াসে পকেটে পুরে সর্বত্র নিয়ে যেতে পার। যখন খুশি তাতে ডুব মেরে ভ্রমরগুঞ্জন, কোকিলের কণ্ঠ, বসরাই গোলাপের খুশবাই, সারা দিনমান ঝরনার গান সবকিছুই পেতে পার। তেমন বই যদি বেছে নাও তবে সে বাগিচায় মিশরের পিরামিড, হিমালয়ের গিরিশ্রণি, পাভলোভা পাভলোভাই বা কেন উর্বশী-মেনকার নৃত্যও দেখতে পাবে। এমনকি এমন বই অর্থাৎ এমন বাগিচাতেও তুমি প্রবেশ করতে পার যে বাগিচা তোমাকে আরও লক্ষ লক্ষ বাগিচার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে। যেমন ধরো, প্যারিসের জাতীয় গ্রন্থাগার সম্বন্ধে একখানি প্রামাণিক পুস্তক। কত লক্ষ বাগবাগিচার সঙ্গে সে যে তোমার পরিচয় করিয়ে দেবে সেটা নির্ভর করে শুধু তোমার কৌতূহলের ওপর।

আরেক জ্ঞানী বলেছেন, একখানা পুস্তক যেন একখানা ম্যাজিক কার্পেট; তারই উপর আরামসে তাকিয়া হেলান দিয়ে বসে তুমি যত্রতত্র যেতে পার, যা ইচ্ছা তাই এমনকি তোমার সে রকম রুচি হলে যাচ্ছেতাই দেখতে পারো।

তবে হ্যাঁ, আমার মনে ধারণা ছিল, ম্যাজিক কার্পেট রাজারাজড়ার মিনার, অধুনা মার্কিন মুলুকের চন্দ্ৰস্পৰ্শী প্রাসাদাদির থেকে গা বাঁচিয়ে বহু উধ্বলোক দিয়ে উড্ডীয়মান হয় বলে পাঠক সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পায় না। আমার রচনা হবে যুগ মানানসই হেলিকপ্টার, অনেক নিচু দিয়ে যায় বলে, অনেক মন্থরে চলে বলে পাঠক হয়তো অনেক আধ-চেনা জিনিসের চৌদ্দ আনা চিনে নেবে।

কিংবা বলি, ম্যাজিক কার্পেটের সন্ধানে অতদূরে যাই কেন? এই কাছেই তো বাঙলা দেশ, নিত্য নিত্য যার ক্রন্দনধ্বনি আমাদের কানে আসছে, কিন্তু সে কথা থাক। সেই বাঙলা দেশের ঢাকার এক কুট্টি ফেরিওলা আম বেচতে এসে বাড়ির সামনে লন-এর উপর ঝুড়িটা রেখেছে। বাবু উপরের বারান্দা থেকে আমগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে ঈষৎ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, কী আম আনছে, মিয়া, বড় যে ছোড় হোড় (ছোট ছোট)। কুট্টি একগাল হেসে উপরভাগে তাকিয়ে বললে, ছোড তো লাগবই, কর্তা–উচা থনে ছোড তো লাগবই। ল্যামা আহেন মহারাজ, তখন দেখবাইন অনে, বরো বরো।

কিন্তু হায়, আমার পাঠক মহারাজা নেমে এলেন না। আমগুলোর সত্য রূপ তাঁরা নিকটে এসে দেখতে রাজি হলেন না। সেটা হয়ে যেত স্পেশালাইজড নলেজ। তখন তারা চাইতেন কমন নলেজ। এখন তারা চান স্পেশালাইজড নলেজ। কিন্তু অধম এ-খাট, ইন্দ্রলুপ্তজন আর দ্বিতীয়বার বিল্ববৃক্ষ নিয়ে গমনাগমন করিবেক না।

এখন থেকে আমি সুদুমাত্র অতিশয় সাদামাটা, সাতিশয় নির্জন কমন নলেজ পরিবেশন করব।

কিন্তু না, পুনরপি না। যদ্যপি উন্নাসিক সম্প্রদায় উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে বারবার বলছেন সে কমন নলেজ হয়ে গিয়েছে, এবং আমিও এইমাত্র যে প্রতিজ্ঞাপাঠ লিপিবদ্ধ করলুম তার কালি এখনও শুকোয়নি, এবং যার অর্থ, আমি এখন থেকে শুধু কমন নলেজ নিয়ে লিখব তার অর্থ এই নয় যে আমি ইহসংসারের তাবৎ কমন নলেজ-এর বিশ্বকোষ রচনা করতে বসে যাব। সংসারের বিস্তর পোড় খাওয়া এক ধনী বাপ মৃত্যুকালে অন্যান্য উপদেশ দিতে দিতে বলেছিল, আর হ্যাঁ, প্রতি গ্রাসে পাঁচটা করে মাছের মুড়ো খাবি। পয়সাওলা সে বাড়িতে পাকা রুই বাঘা কাৎলা গোত্রের বড় মাছের মুড়ো ভিন্ন অন্য কোনও মাছের মুড়ো কস্মিন্ কালেই প্রবেশ লাভ করেনি। ছেলে বেচারী একই গ্রাসে পাঁচটা রুই মাছের মুড়ো খেতে গিয়ে দমবন্ধ হয়ে মৃত পিতার অনুজ হওয়ার উপক্রম। বাবা বলতে চেয়েছিল চুনোর্পটি কেঁচকি পোনার মুণ্ডু খেয়ে সস্তায় আহারাদি সমাপন করো। আমি কমন নলেজের চুনোপুঁটির মুণ্ডু গিলতে রাজি আছি কিন্তু রাঘব বোয়ালের বাঘা মুণ্ডু এক গরাসে গেলবার চেষ্টা করতে রাজি নই, যদিও মুণ্ড তো দুটোই। সে কমন নলেজ আবার পুরাতন ভৃত্যও কমন নলেজ।

দ্বিতীয়ত, এ যৌবন জলতরঙ্গ রুধিবে কেরে? হরে মুরারে হরে মুরারে আর্তনাদ করেছিলেন কবি আকুল কঠে। এখন এ যৌন বটতলা প্লাবন রুধিবে কে রে? আই জি রে, পি সি রে? আমি বাস করি একতলায়। খুব বেশি দিনের কথা নয়, তেড়ে নেমেছে কলকাতার বর্ষা। গৃহিণী দুরুদুরু বুকে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে দেখছেন রাস্তা থেকে পেভমেন্টে জল। উঠেছে। এইবারে পেভমেন্ট ছাড়িয়ে ঘরের ভিতরে জল ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার আবর্জনা ময়লাও অপর্যাপ্ত পরিমাণে। (পৌর পিতারা নিশ্চয়ই উদ্ধাহু হয়ে নৃত্য করেছিলেন এবং মার্কিন টুরিস্টদের দাওয়াত করেছিলেন দেখে যেতে, আমাদের কলকাতা কী সুন্দর, কী সাফ, কী সুৎরো) এবং তার পর কেলেঙ্কারি। ডাবু সি-তে জল ঢুকে, না জানি কোন বৈজ্ঞানিক কারণে উজান বইতে আরম্ভ করল কোথা থেকে নানাবিধ স্রোত, ভেসে আসতে লাগল নানাবিধ অবদান। বীভৎস রস এ স্থলেই সমাপ্ত হোক।

হুবহু একদম সে-ই প্রক্রিয়ারই পুনরাবৃত্তি হল যৌন-সাহিত্য মারফত। প্রথম ছেয়ে গেল পেভমেন্ট, তার পর হুড়হুড় করে ঢুকল ঘরের ভিতরে। কিন্তু সত্যিকারের রগড় তো শুরু হল তার পর। যৌনজীবনের যেসব আবর্জনা আমরা ডাবু সি দিয়ে, স্যুয়ারেজ দিয়ে বাড়ি থেকে নগর থেকে বের করে দিয়েছি সেগুলোকে কোন এক পিচেশ মার্কা উচাটন মন্ত্রে আবাহন জানাল বাইরের সেই আবর্জনা, সেই বিদেশ থেকে আমদানি যৌন-বটতলীয় মাল যা ধীরে ধীরে ছেয়ে ফেলেছিল কুল্লে পেভমেন্ট, তাবৎ ফুটপাথ পুলিশের নাকের ডগায় সুড়সুড়ি দিতে দিতে (আমি পুলিশের ঘাড়ে কুল্লে বেলেল্লাপনার বালাই চাপাতে চাইনে; দেশের লোক যদি এ মাল চায় তবে পুলিশ আর কতখানি ঠেকাবে?) দেশ-বিদেশের একাধিক ডাঙর ডাঙর কর্ণধার কখনও সোল্লাসে, কখনও-বা মুচকি হেসে, কখনও-বা বক্রোক্তি করে আপ্তবাক্য ঝেড়েছেন, এ নেশন (কানট) বি রং।

এই হৈ-হুল্লোড়, জগঝম্প বাদ্যির মধ্যিখানে কে কান দেবে, মশাই, আপনার গুনগুনানি প্যানপ্যানিতে। আপনার বক্তব্য, যত অসুস্থই হোক না কেন, তাকে দেখতে হবে। কিন্তু সুস্থ মাথায়, অধ্যয়ন করতে হবে শান্তচিত্তে, অযথা উত্তেজিত না হয়ে। কিন্তু তাতে কোনও ফায়দা হবে না, এখন থেকেই বলে দিচ্ছি। এই যে সেদিন শ্যামাপুজোর সাঁঝ থেকে ভোর অবধি বেধড়ক, আচমকা, নানাবিধ কর্ণপটহ বিদারক বাজি ফাটালে কলকাত্তাইরা, সে অক্তে আপনি পাকা সুরেলা হাতে বীণাযন্ত্রে দরবারি কানাড়া বাজালে কান দিত না যেদো-মেধো কেউই। তাই কবি শাবাশ শাবাশ রব ছেড়ে বলেছেন :

ভদ্রং কৃতং কৃতং মৌনং কোকিল জলদাগমে

বর্ষাকাল এসেছে। এখন মত্ত দাদুরী পাগলা কোলাব্যাঙের পালা। কোকিল যে মৌনতা অবলম্বন করল সেটা অতিশয় ভদ্র কর্ম (বিচক্ষণেরও বটে)। জন্ম-অভিজাত জাতদ্রই এ আচরণ ভিন্ন অন্য আচরণ কল্পনা করতে পারে না।

.

তা আমি যতই কমন নলেজ নিয়ে পড়ে থাকতে চাইনে কেন, আমরা একদল হাফউন্নাসিক (হাফ-গেরস্ত তুলনীয় নয়, থুড়ি, থুড়ি, এই দেখুন, ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যতই সন্তর্পণে আপনি যৌনের প্রতি সামান্যতম ইঙ্গিত দিয়েছেন কি না, অমনি দ্যাখ-তো-না-দ্যাখ ওই খাটালের বোঁটকা গন্ধের অর্ধান্যায্য বখরাটি আপনি পেয়ে যাবেনই যাবেন)– হ্যাঁ, কী বলছিলুম, এক দল অর্ধ-উন্নাসিক পাঠক আমাকে সঙ্গ দিয়েছেন বহু বৎসর ধরে। কেন, বলতে পারব না। কখনও ভেবেছি, অনুকম্পাবশত লক্ষ করেননি এই তত্ত্বটি, পথে যেতে যেতে দেখলেন দুই অজানা টিমে ফুটবল খেলা হচ্ছে, তার একটি স্পষ্টত দুর্বল; আপন অজানতে দেখবেন, আপনার দরদখানি আস্তে আস্তে ওই দুলা টিমের পাল্লার ওপর ভর দিচ্ছে। কখনও ভেবেছি, হয়তো আমার মুসলমানি চিন্তাধারা, ভাষার যাবনিক কায়দা কেতা তার নতুন তত্ত্বের জন্যে কোনও কোনও একঘেয়েমি-ক্লান্ত পাঠককে আকৃষ্ট করেছে। আমি অবশ্য সে সম্বন্ধে অল্পই সচেতন ছিলুম; আমি জানত এমন কোনও বিষয়, এমন কোনও ভাষা ব্যবহার করিনি যা সুদ্ধমাত্র যাবনিকতা দ্বারা নিত্যনবীনের সন্ধানী জনের পাজরে কাতুকুতু দিয়েছে, জড় রসনায় চুলবুল জাগাবার চেষ্টা করেছে। যাবনিক জিনিস আমি আলিঙ্গন করেছি, পাঠকের সম্মুখে পেশ করেছি তখনই, যখন অনুভব করেছি সে যাবনিকতার মধ্যে বিশ্বজনীন ভাব সঞ্চারিত আছে, যে যাবনিকতা দেশ-কালপাত্র উত্তীর্ণ হয়ে শাশ্বত হবার অধিকার লাভ করেছে। কোণের প্রদীপ মিলায় যথা জ্যোতিঃ সমুদ্রেই। বলা বাহুল্য খ্রিস্টীয়, অখ্রিস্টীয়, জনপদসুলভ ভাবধারা, আমার আবাল্য পরিচয়ে খাসিয়া-সাঁওতাল সভ্যতার প্যাটার্ন আমি ঠিক সেইভাবেই গ্রহণ করেছি যেভাবে আমি যাবনিক চিন্তামণিকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছি।.. এই পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থা অতিক্রম করার সময় কিছু পাঠক সর্বদাই আমাকে সঙ্গ দিয়েছেন, বিশেষ করে দুর্দিনে;

দুর্দিনে বলো, কোথা সে সুজন যে তোমার সাথী হয়?
 আঁধার ঘনালে আপন ছায়াটি সেও, হায়, হয় লয় ॥

তদস্তিমে কৌন কিসকা সাথ দেতা হৈ?
কি ছায়া ভি জুদা হোতা হৈ ইনসাসে তারিকিমে ॥

এঁদের বয়স হয়েছে। এদের অনেকেই এখন গভীরে প্রবেশ করতে চান।

আমি তাই একটা মধ্যপন্থা অবলম্বন করব। দয়া করে আমার সহৃদয় পাঠকসমুদায় তাদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ এই অধম লেখককে তার মধ্যপন্থা অবলম্বনের প্রদোষে, তার ধূসর জীবনের গোধূলিতে তাকে আশীর্বাদ করবেন।

আমার অনুরোধ, আমার মূল লেখাটি পড়ার সময় যদি কৃপালু পাঠক অম্লাধিক নিরবচ্ছিন্ন আনন্দলহরীতে দোলা খেতে খেতে এগিয়ে যান, সে-রসস্রোতে (যদি আদৌ রসসৃষ্টিতে আমি কথঞ্চিৎ সক্ষম হই) ভেসে ভেসে সমুখ পানে চলতে থাকেন তবে হঠাৎ সে স্রোত থেকে সরে গিয়ে ফুটনোটের গভীরে ডুব দেবেন না।

আর যারা ফুটনোটের গভীরে গিয়ে কিছুক্ষণ সে গভীরে অবগাহন করার পর সাঁতার দিয়ে পুনরায় ভেসে উঠে স্রোতোপরি অন্যান্য পাঠকদের সঙ্গে সম্মিলিত হন তারা তখন নিশ্চয়ই আমাকে সস্নেহ আশীর্বাদ জানাবেন।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *