দ্বাপর
০১.
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে রাতদুপুরে হোক আর দিনদুপুরেই হোক চট করে বলতে পারবেন না, আপনি যে হোটেলে শুয়ে আছেন সেটা কোন শহরে। টোকিও, ব্যাংকক, কলকাতা, কাবুল, রোম, কোপেনহাগেন যে কোনও শহর হতে পারে। আসবাবপত্র, জানালার পর্দা, টেবিলল্যাম্প যাবতীয় বস্তু এমনই এক ছাঁচে ঢালা যে স্বয়ং শার্লক হোমসকে পর্যন্ত তারা সবকটা পুরু পুরু আতসি কাঁচ মায় তার জোরদার মাইক্রোস্কোপটি বের করে ওয়াটসনকে কার্পেটের উপর ঘোড়া বানিয়ে, নিজে তার পিঠে দাঁড়িয়ে, ছাতের উপর তার স্বহস্তে নির্মিত আ লা হোমস স্প্রে ছড়িয়ে বাকিটা থাক্, ব্যোমকেশ ফেলুদার কল্যাণে আজ ইস্কুল বায় ও সেগুলো জানে– তবে বলবেন, হয় মন্তে কালোর রেজিনা হোটেল নয় মোহোনেসবের্গের অল হোয়াইট হোটেল। দূরপাল্লার অ্যারোপ্লেনের বেলাও আজকের দিনে তাই। একবার তার গর্ভে ঢুকলে ঠাহর করতে পারবেন না, এটা সুইস এ্যার, লু হানজা, অ্যার ইন্ডিয়া না কেএলএম। তিমির পেটে ঢুকে নোয়া কি আর আমেজ-আন্দেশা করতে পেরেছিলেন এটা কোন জাতের কোন মুল্লুকের তিমি?
ইন্ডিয়ান মানেই নেটিভ, আস্তে আস্তে এ ধারণা কমছে। নইলে জর্মনি এ দেশের সেলাইয়ের কল, রুশ কলকাতার জুতো কিনবে কেন?
অতএব অ্যার ইন্ডিয়া কোম্পানির অ্যারোপ্লেনকে একটা চান দিতেই বা আপত্তিটা কী? অন্য কোম্পানিগুলো তো প্রায় সব চেনা হয়ে গিয়েছে। অবশ্য আরেকটা কথা আছে। ওই কোম্পানির এক ভদ্রলোক বুদ্ধি খাঁটিয়ে তদ্বির-তদারক করে আমার সুখ সুবিধার যাবতীয় ব্যবস্থা না করে দিলে হয়তো আমার যাওয়াই হত না। তার নাম বলব না। উপরওলা খবর পেলে হয়তো কৈফিয়ৎ তলব করে বসবেন, কোনও একজন ভিআইপিকে সাহায্য না করে একটা থাচ্ছো কেলাস নেটিভ রাইটারের পিছনে তিনি আপিসের মহামূল্যবান সময় নষ্ট করলেন কেন? তবে কি না তাঁর এক ভিআইপি মিত্রও আমাকে প্রচুরতম সাহায্য করেছিলেন। তাকে না হয় শিখণ্ডিরূপে খাড়া করবেন।
ভাবছিলুম চুঙ্গী (কাসটম্সের) উৎপাত থেকে এই দুই দোস্তো কতখানি বাঁচাতে পারবেন। ইতোমধ্যে এক কাস্টমিয়া আমার কাগজপত্র পড়ে আমার দিকে মিটমিটিয়ে তাকিয়ে শুধোলে, আপনিই তো আপনার বইয়ে চুঙ্গীঘরের কর্মচারীদের এক হাত নিয়েছেন, না?
খাইছে। এ যাত্রায় আমি হাজতবাস না করে মানে মানে কলকাতা ফিরতে পারলেই নিতান্তই পঞ্চপিতার আশীর্বাদেই সম্ভবে। কে জানে, এই কাস্টমিয়াই হয়তো হালে কয়েকজন ডাঙর ভিআইপি কাম সরকারি কর্মচারীকে বেআইনিতে মাল আনার জন্য নাজেহাল করেছিলেন।… এত দিন কলকাতা করপরশনের অত্যুৎসাহ ও মাত্রাধিক কর্মতৎপরতাবশত জলের কল খুললে যে রকম জল না বেরিয়ে শব্দ বেরুত সেই রকম আমার ব্লটিং পেপারের লাইনিংওলা গলা দিয়ে কথা না বেরিয়ে বেরোল ঘসঘস খসখস চো-ও-ও-ও ধরনের কী যেন বদখৎ আওয়াজ।
নাহ্। এ লোকটির রসবোধ আছে কিংবা এঁর বাড়িতে মাসে একদিন করপরশনের কলের জল আসে। ওই ভাষা বাবদে তিনি সুনীতি চাটুয্যে মশাইকে তাক লাগিয়ে উত্তম ধ্বনিতত্ত্ববাদের কেতাব লিখতে পারবেন। বললেন, নিশ্চিন্তমনে ওই আরাম চেয়ারটায় বসুন। আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি। তার পর ডাইনে-বাঁয়ে তাকিয়ে এক অশ্রুত টরে-টক্কার সঙ্কেত করলেন আর সঙ্গে সঙ্গে জনাচারেক বাঙালি কাস্টমিয়া আমাকে ঘিরে যা আদর-আপ্যায়ন আরম্ভ করলেন যে হৃদয়ঙ্গম করলুম, দেবীর প্রসাদে মূক যে রকম বাঁচাল হয়, আমি কেন, হরবোলাও মূক হতে পারে।
প্রতিজ্ঞা করলুম, চুঙ্গীঘর লেখাটি আমি ব্যান করে দেব। কার যেন দুশো টাকা ফাইন হয়েছে। অবশ্য অন্য অকারণে, কিন্তু জরিমানা ইজ জরিমানা! আপনার কারণ ভিন্ন বলে আপনি তো আর মেকি টাকা দিয়ে শোধবোধ করতে পারবেন না।
কিন্তু এত সব বাখানিয়া বলছি কেন?
শুনুন। জীবনে ওই একদিন উপলব্ধি করলুম, সাহিত্যিক- তা সে আমার মতো আটপৌরে সাহিত্যিক হওয়ার মধ্যেও একটা মর্যাদা আছে।
***
এসব যে বাখানিয়া বলছি তার আরও একটা কারণ আছে।
আমার নিজের বিশ্বাস, প্লেনের পেটের ভিতরকার তুলনায় অ্যারপোর্টে আজব আজব তাজ্জব চিড়িয়া দেখতে পাওয়া যায় ঢের বেশি। পাসপোর্ট, কাস্টমস, হেলথ অফিসে, রেস্তোরাঁয় তাদের আচরণে কেউ-বা সঙ্কোচের বিহ্বলতায় অতীব মিয়মাণ, কারও-বা গড় ড্যাম ডোন্টো কেয়ার ভাব– ওদিকে একটি বিগতযৌবনা মার্কিন মহিলা অ্যারোপ্লেনে অর্ধন্দ্রি যামিনী কাটিয়ে আলুথালু-কেশ, হৃতপাউডাররুজ, এঞ্জিনের পিস্টন বেগে পলস্তরা পলস্তরা ক্রিম-পাউডার-রুজ মাখছেন, এদিকে তার কর্তা প্লেনে সস্তায় কেনা স্কচ স্যাট স্যাট করছেন; আর ওই সুদূরতম প্রান্তে দেখুন, দেখুন বললুম বটে, কিন্তু দেখার উপায় নেই- কালো বোরকাপরা জড়োসড়ো গণ্ডা দুই মক্কাতীর্থে হজযাত্রিনীর গোঠ। এরা নিশ্চয়ই চলতি ফ্যাশানের ধার ধারেন না। বেশিরভাগ আঁকড়ে ধরে আছেন পুঁটুলি- হ্যাঁ, বেনের পুঁটুলি। গরুর গাড়িতে, গয়নার নৌকোয় ওঠার সময় যে পটুলি নেন। ওঁরা ভাড়া বাবদ কয়েক হাজার টাকা দিয়েছেন নিশ্চয়ই। অনায়াসে হাল্কা স্যুটকেস কিনতে পারতেন। দু-একজনের ছিলও বটে। কিন্তু ওদের কাছে গরুর গাড়ি যা, হাওয়াই জাহাজও তা– এদের মক্কা পৌঁছলেই হল। হায়, এঁরা জানেন না প্লেনে ভ্রমণ– তা সে যে কোনও কোম্পানিই হোক না কেন– গরুর গাড়িতে মুসাফিরি করার তুলনায় ঢের বেশি তকলিফদায়ক। এমনকি প্লেনে এঁদের পক্ষে হায়া-শরম বাঁচিয়ে চলাও কঠিন। কলকাতার বস্তিতে কী হয় জানিনে, কিন্তু এদের গ্রামাঞ্চলে কেউ কখনও প্রাতঃকৃত্যের জন্য কিউ দেয় না। অথচ প্লেনে প্রাতঃকৃত্যের জন্য এদের কিউয়ে দাঁড়াতে হবে– মেয়েমদ্দে লাইন বেঁধে। সে কথা পরে হবে। তবে হজযাত্রীদের জন্য স্পেশাল প্লেনে যদি স্পেশাল ব্যবস্থা থাকে তার তথ্য জানিনে। কোনও কোম্পানি অপরাধ নেবেন না।
***
শুভক্ষণে দুর্গা স্মরি প্লেন দিল ছাড়ি
দাঁড়ায়ে রহিল পোর্টে সব বেরাদরুই শুষ্ক চোখে।
পূর্বেই নিবেদন করেছি প্লেনের ভিতরে দেখবার মতো কিছুটি নেই। খেয়াপারে রেলগাড়িতে যা দেখতে পাওয়া যায় তার চেয়েও কম। আর সর্বক্ষণ আপনার চোখের তিন ফুট সামনে, সম্মুখের দুটো সিটে দুটো লোকের ঘাড়। তারও সামনে সারি সারি ঘাড়। দোস্ত আমার এ প্লেনের মালিক, অতএব আমার জন্য উইন্ডো সিটের ব্যবস্থা করেছেন অর্থাৎ বাঁ দিকে তাকালে বাইরের আকাশ দেখা যায় মাত্র, বলতে গেলে পৃথিবীর কিছুই না। এক রাত্রে, তদুপরি আল্লায় মালুম, বিশ হাজার না পঁচিশ হাজার ফুট উপর দিয়ে প্লেন যাচ্ছে। কিছু-বা দেখতে পায়। তবে ভারতীয় প্লেনে একটা বড় আরাম আছে। যদিও অধিকাংশ যাত্রী ভারতীয় নয়–বিদেশি, এবং প্রধানত ইয়োরোপীয়। তারা জানে, ইন্ডিয়ানরা বেলেল্লাপনা পছন্দ করে না। কাজেই অতিরিক্ত কলরোল, এবং ছাগলের দরে হাতি কেনার মতো স্কচ-ভোদকা সেবনজনিত মাঝে-মধ্যে তদতিরিক্ত কলহরোল থেকে নিশ্চিন্ত মনে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।
.
এ-বাবদে এখানেই থাক। কারণ শ্রদ্ধেয় শ্ৰীযুত তারাশঙ্কর, সম্মানীয় শ্ৰীযুত বুদ্ধদেব, ভদ্র প্রবোধ ও অন্যান্য অনেকেই প্লেনের ভিতরকার হাল সবিস্তর লিখেছেন।
জাগরণ, তন্দ্রা, ঘুম সবই ভালো। কিন্তু তিনটিতে যখন গুবলেট পাকিয়ে যায় তখনই চিত্তির। এ যেন জ্বরের ঘোরে দু দিন না তিনদিন কেটে গেল বুঝবার কোনও উপায় নেই।
চিৎকার চেঁচামেচি। রোম! রোম!! রোম!!!
.
০২.
ক্যাথলিকদের তো কথাই নেই। প্রটেসটান্টদের ঈষৎ সংযত কৌতূহল। বিশেষ করে মার্কিনদের। দেশে ফিরে বড়ফাট্টাই করতে হবে, তেমন কিছু না, তবে কি না, হ্যাঁ, দেয়ালের আর গম্বুজের ছবিগুলো ভালো। কী যেন নাম (ভামিনীর দিকে তাকিয়ে) মাইকেল রাফাএল, না হল না। লেওনার্দো দা বত্তিচেল্লি। ও! সেটা বুঝি মোনালিসার লিনিং টাওয়ার?
বললে পেত্যয় যাবেন না, আমি স্বকর্ণে শুনেছি, তাজমহলের সামনে বসে একই বেঞ্চে বসা এক মার্কিনকে তার মিসিসের উদ্দেশে শুধোতে শুনেছি, কিন্তু আশ্চর্য, এই ইন্ডিয়ানরা এ সব তৈরি করল কী করে– ফরেন সাহায্য বিনা, অর্থাৎ আমাদের সাহায্য না নিয়ে।
রোমে নামতেই হল। সেখানে আমার এক বন্ধু বাস করেন। কিন্তু তার ফোন নম্বর জানা ছিল না বলে যোগসূত্র স্থাপন করা গেল না। একখানা পত্রাঘাত, তদ্দরুন স্ট্যাম্প যোগাড় করতে না করতেই অ্যার কোম্পানির লোক রাখাল ছেলে যেরকম গরু খেদিয়ে খেদিয়ে জড়ো করে গোয়ালে তোলে সেই কায়দায় প্যাসেঞ্জারদের প্লেনের গর্ভে ঢোকালে। প্যাসেঞ্জারদের গরুর সঙ্গে তুলনা করাটা কিছুমাত্র বেয়াদবি নয়। মোটা, পাতলা ঠিক বয়স্ক গরুরই মতো লাউঞ্জের মধ্যিখানে একজোট হয়ে বসেছে বটে কিন্তু বাছুরের পাল, অর্থাৎ চ্যাংড়া-চিংড়িরা যে কে কোনদিকে ছিটকে পড়েছে তার জন্য হুলিয়া সমন বের করেও রত্তিভর ফায়দা নেই। কেউ গেছেন কিওরিওর দোকানে। কাইরোর মতো এখানেও খাঁটি-ভেজাল দুই বস্তুই সুলভ এন্তের পড়ে আছে কিন্তু দুর্লভ, কলকাতার মাছের বাজারকেও হার মানায় গাহকের কান কাটতে। কেউ-বা গেছেন বিনমালের (ট্যাক্স ফ্রি) দোকানে। হয়তো ইতালির নামকরা একখানা আস্ত ফিয়াৎ (মোটামুটি, ফা (F) ব্রিসিয়োনে; ই (i) ইতালিয়ানা; আ (a) ওতোমিবিলে; তু (T) রিনো– এই চার আদ্যাক্ষর নিয়ে FIAT. একুনে, ফ্যাব্রিকশন (মেড ইন) ইতালিয়ানা (of Italy) অটোমবিল (of) তুরিনো। তুরিনো সেই শহরের নাম যেখানে এই স্বতশ্চলশকট নির্মিত হয়; ফিয়াৎ শব্দ আবার আরেক প্রাচীন অর্থ ধরে, ফরমান, তাই হোক।) গাড়ি কিনে নিয়ে আসেন! একটি হাফাহফি আধাআধি, অর্থাৎ পাতে দেওয়া চলে মার্কিন চিংড়ি ওই হোথা বহু দূরে বার-এ বসে চুটিয়ে প্রেম করছেন একটি খাবসুরৎ ইতালিয়ান চ্যাংড়ার সঙ্গে। খাবসুরৎ বলতেই হবে– এই রোম শহরে ছবি এঁকে মূর্তি গড়ে যিনি নাম করেছেন সেই মাইকেল এঞ্জেলো যেন এই সদ্য একে গড়ে চরে খাওগে, বাছা, বলে ছেড়ে দিয়েছেন। আর ইতালিয়ান যুবক-যুবতীর প্রতি মার্কিনিংরেজের যে পীরিত সেটা প্রায় বেহায়ামির শামিল। চিংড়িটা চরে খাবে না কেন? সর্বশেষ বলতে হয়, ইতালির কিয়ান্তি মদ্য দুনিয়ার কুল্লে সুধার সঙ্গে পাল্লা দেয়। সেটা ও মেয়েটা পাওয়া যাচ্ছে ফ্রি, গ্রেটিস অ্যান্ড ফর নাথিং। মুফৎ মে।
প্লেনে ঢুকে দেখি, সত্যি সেটা গোয়ালঘর। মশা খেদাবার তরে গায়ের চাচার বাড়িতে যে রকম স্যাঁৎসেঁতে খড়ে আগুন ধরানো হত এখানেও সেই প্রতিষ্ঠান। তবে হ্যাঁ, এটা বিজ্ঞানের যুগ। নানা প্রকারের ডিসিনফেকটেট, ডি অডরেনট স্প্রে করা হয়েছে প্রেমসে। সায়েবদের যা বি ও বডি ওডার গায়ের বোঁটকা দুর্গন্ধ!!
সকালবেলার আলো দিব্যি ফুটে উঠেছে। ইতোমধ্যে প্লেনে পাক্কা সাড়ে পনেরো ঘন্টা কেটেছে! দমদম ছেড়েছি রাত নটায়; এখন সকাল আটটা। হওয়ার কথা তো এগারো ঘণ্টা! কী করে হল? বাড়ির কাচ্চাবাচ্চাদের শুধোন।
.
প্লেন যখন রোম ছাড়ল তখন অপ্রশস্ত দিবালোক।
দিবালোকের সঙ্গে সময়ের সম্পর্ক আছে। যে দেশে যাচ্ছি, সেই জনির বাঘা দার্শনিক কান্ট নাকি বলেছেন কাল এবং স্থান ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে না। (টাইম অ্যান্ড স্পেস আর আ প্রিয়রি কনসেপশন)।
বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি, যেন দেশের সকালবেলার সাতটা-আটটা। কিন্তু হঠাৎ হাতঘড়ির দিকে নজর পড়াতে দেখি, সেটি দেখাচ্ছে সাড়ে বারোটা! কী করে হয়? আমার ঘড়িটি তো পয়লা নম্বরি এবং অটোমেটিক। অবশ্য এ কথা আমার অজানা নয়, অটোমেটিক বেশি সময় কোনও প্রকারের ঝাঁকুনি না খেলে মাঝে-মধ্যে থেমে গিয়ে সময় চুরি করে। কিন্তু কাল রাতভর যা এপাশ ওপাশ করেছি তার ফলে ওর তো দম খাওয়া হয়ে গেছে নিদেন দু দিনের তরে। আমার পাশের সিটে এক বর্ষীয়সী বাচ্চাটার ঠাকুরমা দিদিমার বয়সী। তার দিকে ঝুঁকে শুধালুম, মাদাম, বেজেছে কটা, প্লিজ? মাদামের উস্কোখুস্কো চুল, সকালবেলার ওয়াশ, মুখের চুনকাম, ঠোঁটের উপর উষার লালবাতি জ্বালানো হয়নি। শুকনো মুখে যতখানি পারেন ম্লান হাসি হেসে বললেন, পারুদো মসিয়ো, জ ন পার্ল পা লেদুস্তানি। অর্থাৎ তিনি হিন্দুস্তানি বলতে পারেন না। ইয়াল্লা। সরলা ফরাসিনী ভেবেছেন, প্লেনটা যখন হিন্দুস্তানি, আমি হিন্দুস্থানের কলকাতাতে প্লেনে উঠেছি, চেহারাও তদ্বৎ, অতএব আমি নিশ্চয়ই হিন্দুস্তানিতে কথা বলেছি। আমি অবশ্য প্রশ্নটি শুধিয়েছিলাম আমার সর্বসত্ব সংরক্ষিত অতিশয় নিজস্ব বাঙাল ইংরেজিতে। ওদিকে এ তত্ত্ব আমার সবিশেষ বিদিত যে ফরাসিরা নটোরিয়াস এক ভাষী– ফরাসি ভিন্ন অন্য কোনও ভাষা শিখতে চায় না। তাদের উহ্য বক্তব্য, তাবশ্লোক যখন হদ্দমুদ্দ হয়ে ফ্রান্সে আসছে, বিশেষ করে কড়ির দেমাক, বন্দুক-কামানের দেমাক, চন্দ্রজয়ের দেমাকে ফাটো ফাটো মার্কিন জাত এস্তেক প্যারিসে এসে ফরাসির মতো নাজুক জবান্ শেখবার ব্যর্থ চেষ্টায় হরহামেশা হাবুডুবু খাচ্ছে তখন ওদের আপন দেশে আপোসে তারা যে কিচিরমিচির করে সেগুলো শেখার জন্য খামোখা উত্তম ফরাসি ওয়াইনে সুনির্মিত নেশাটি চটাবে কেন? তবু মহিলাটির উক্তি শুনে আমারও ঈষৎ ন্যাজ মোটা হল। দূর-দুনিয়ার ভারতীয় প্লেন সার্ভিস না থাকলে মহিলাটি কি কল্পনাও করতে পারতেন যে হিন্দুস্তানিও আন্তর্জাতিক ভাষা হতে চলেছে খলিফে মুসাফির যে রকম এ্যার ফ্রান্সে ফরাসি, কেএলএমে ডাচ্, বিওএসি-তে ইংরেজির জন্য তৈরি থাকে।
তখন পুনরপি আপন ঔন অরিজিনাল ফরাসিতে প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করলুম। আ আ–! বুঝেছি, বুঝেছি! কিন্তু এই সময় সমস্যাটি ভারি কঁপ্লিকে অর্থাৎ কমপ্লিকেটিভ, জটিল। আমি ওটা নিয়ে মাথা ঘামাইনে।
তবু?
সব দেশ তো আর এক টাইম মেনে চলে না। ভোয়ালা!–নয় কি? প্যারিসে যখন বেলা বারোটা তখন রেঙ্গুনে– আমি সেখানে বাস করি বিকেল পাঁচটা-ছটা। কিন্তু আপনাকে ফের বলছি, ওসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনও লাভ নেই। আমি টাইম কত জেনে যাই আমার অতিশয় বিশ্বাসী মিনিসত্র দ্য লেক্টেরিয়রকে (হোম সেক্রেটারি, অর্থাৎ ভিতরকার ইন্টেরিয়ের এঁতেরিয়র-কে) শুধিয়ে। সোজা কথায় পেটটিকে। ওখানে যখন লামার্সেইয়েজ সঙ্গীত (বাংলায় পেটে যখন হুলুধ্বনি) বেজে ওঠে তখন সেটা লাঞ্চের বা ডিনারের সময় উপস্থিত আমার এতেরিয়রেতে সে সঙ্গীত ক্রেসেন্ডতে (তার সপ্তকের পঞ্চমে)। তাই এখন রেঙ্গুনে নিশ্চয়ই দেড়টা-দুটো।
আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললুম, তা এখখুনি বোধহয় লাঞ্চ দেবে।
মাদাম যদিও বলেছেন তিনি টাইম নিয়ে মাথা ঘামান না, কিন্তু দেখলুম, তার প্র্যাকটিকাল দিকটা খাসা বোঝেন। আপত্তি জানিয়ে বললেন, রেঙ্গুনে যখন লাঞ্চ তখন এই মিত্রোপাতে (মিৎ = মিল;- রোপা, ইয়োয়োপা-র শেষাংশ অর্থাৎ মধ্য-ইয়োরোপে) ব্রেকফাস্ট। জাপানে যারা এ-প্লেনে উঠেছে তাদের তো এখন ডিনারের সময় হয় হয়। সুতরাং কোন যাত্রী কোথায় উঠেছে, কার পেট কখন ব্রেকফাস্টলাঞ্চ/ডিনারের জন্য কান্নাকাটি শুরু করে সে হিসাব রেখে তো আর কোম্পানি ঘড়ি ঘড়ি কাউকে লাঞ্চ, কাউকে সাপার, কাউকে স্যানউইচসহ বিকেলের চা দিতে পারে না। তবে কি না, এরা ব্রেকফাস্টে যে পরিমাণ খেতে দেয় সেটা কলেবরে প্রায় লাঞ্চের সমান।… তাই বলছি, এসব টাইম নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। ট্রেনেও যদি ঘড়ি ঘড়ি ঘড়িটার দিকে তাকান তবে সে জনি দীর্ঘতর মনে হয় না? আমি তো প্যারিসে পৌঁছতে পারলে বাঁচি। ব দিয়ো (দয়ালু ঈশ্বর) ঘন্টা দেড়েকের ভিতর পৌঁছিয়ে দেবেন। নাতনিটা নেতিয়ে গিয়েছে।
মহিলাটি যেভাবে সবিস্তর গুছিয়ে বললেন সেটা ধোপে টেকে কি না বলতে পারব না, কারণ আমি যত বার এসেছি-গিয়েছি, আহারাদি পেয়েছি, তখন ঘড়ি মিলিয়ে দেখিনি কোনটা লাঞ্চ কোটা কী? এবং আজকের দিনে পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন টাইমের সালঙ্কার সটীক ফিরিস্তি দেবার বিশেষ প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনে। রেডিও ট্রানজিস্টারের কল্যাণে এখন বাড়ির খুকুমণি পর্যন্ত জ্ঞানগর্ভ উপদেশ দেয়, বুঝিয়ে বলে গ্রিনচ মিন টাইম, ব্রিটিশ সামার টাইম, সেন্ট্রাল ইয়োরোপিয়ান টাইম, কোনটি কী? তবু যে এতখানি লিখলুম, তার কারণ ভিন্ন ভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন টাইম যে কীভাবে কসরৎ বিন্ মেহৎ আয়ত্ত করতে হয় সেটা ফরাসি মহিলাটি আমাকে শিখিয়ে দিলেন অতি প্র্যাকটিকাল পদ্ধতিতে। সেটা কী? রাজা সলমন যেটা গুরুগম্ভীর ভাবে, ধর্মনীতি হিসেবে আপ্তবাক্য রূপে হাজার তিনেক বছর পূর্বে প্রকাশ করে গিয়েছেন, নো দাইসেল নিজেকে চেনো (চিনতে শেখো)। শ-বছর আগে লালন ফকিরও বলেছেন, আপন চিনলে খুদা চেনা যায়। ফরাসি মহিলাটিও সেই তত্ত্বটিই, অতিশয় সরল ভাষায় প্রকাশ করলেন, আপন পেটটিকে বিশ্বাস করো। তার থেকেই লোকাল টাইম, স্ট্যান্ডার্ড টাইম, সর্ব টাইম জানা হয়ে যাবে। ওইটেই মোক্ষমতম ক্রনোমিটার। বরঞ্চ ক্রনোমিটার মাঝে-মধ্যে বিগড়োয়। আলবৎ, পেটও বিগড়োয়। কিন্তু বিগড়োনো অবস্থাতেও সে লাঞ্চ ডিনারের সময়টায় নিগেটিভ খবর দিয়ে জানিয়ে দেয়, তার খিদে নেই।
ইতোমধ্যে ব্রেকফাস্ট না কী যেন এসে গেছে। মাদাম বলেছিলেন, সেটা কলেবর। আমি মনে মনে বললুম, বপু। এ্যাব্বড়া বড়া ভাজা, সসিজ, পর্বতপ্রমাণ ম্যাশ পটাটো, টোস্টমাখন, মার্মলেড়, টমাটো ইত্যাদি কাঁচা জিনিস, আরও যেন কী কী। তখন দেখি, বেশ খাচ্ছি। অতএব পেটের ক্রনোমিটার বলছে এটা কলকাতার লাঞ্চ, অর্থাৎ বেলা একটা-দুটো। ঘড়ি মিথ্যেবাদী, বলছে নটা!
.
০৩.
অজগাঁইয়া যে রকম ওয়াকিফ হবার চেষ্টা না দিয়েই ধরে নেয় দিল্লি মেলও তার ধেধূধেড়ে গোবিন্দপুর ফ্ল্যাগ ইটিশানে দাঁড়াবে এবং চেপে বসে নিশ্চিন্দি মনে তামুক টানে, আমার বেলাও হয়েছিল তাই। আমার অপরাধ আরও বেশি। আমি জেনেশুনেই অপকর্মটি করেছিলুম। আমি ভালো করেই জানতুম, যে প্লেনে যাচ্ছি সেটা যদিও জর্মনির উপর দিয়ে উড়ে যাবে, তবু সে দেশের কোনও জায়গায় দানাপানির জন্যও নামবে না। অবশ্য অ্যার-ইন্ডিয়ার মুরুব্বি আমার, একগাল হেসে আমায় বলেছিলেন, এ প্লেনটা কিন্তু প্যারিসে নামে। আপনি সেখানে চলে যান। দু চারদিন ফুর্তিফার্তি করে চলে যাবেন জর্মনি। খর্চা একই। আর প্যারিস হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ- সঙ্গে যে মিত্রটি ছিলেন তিনিও মৃদু হেসে সায় দিলেন। দু জনারই বয়স এই তিরিশ-পঁয়ত্রিশ। মনে মনে বললুম, এখন কলকাতা-দিল্লির রাস্তাঘাটেই যা দেখতে পাওয়া যায় প্যারিসের নাইট ক্লাব-কাবারে তার চেয়ে বেশি আর কী ভেল্কিবাজি দেখাবে? তদুপরি বানপ্রস্থে যাবার বয়সও আমার তৈলদানং? তাই আখেরে স্থির হল আমি অ্যার-ইন্ডিয়া প্লেন থেকে সুইজারল্যান্ডের জুরিচে (স্থানীয় ভাষায় স্যুরি) নামব। হেথায় চেঞ্জ করে ভিন্ন প্লেনে মৌকামে পৌঁছব– অর্থাৎ জর্মনির কলোন শহরে। তাই সই।
ফরাসিনীকে বিস্তর বঁ ভোয়াইয়াজ (গুড জর্নি, গুড ফ্লাইট) বলে জুরিচের অ্যারপোর্টে নেমে পাসপোর্ট দেখালুম। তার পর গেলুম খবর নিতে কলোনে যাবার প্লেন কখন পাব। উত্তর শুনে আমি স্তব্ধ, জড়। দেশে বলে,
অল্প শোকে কাতর।
অধিক শোকে পাথর।
তখন বেজেছে সকাল নটা। রামপন্টক বলে কি না, কলোন যাবার প্লেন দ্বিপ্রহরে। বিগলিতার্থ আমাকে নিরেট তিনটি ঘণ্টা এখানে বসে বসে আঙুল চুষতে হবে।
শুনেছি, যে রুগী দশ বৎসর ধরে পক্ষাঘাতে অসাড় অবশ সে নাকি মৃত্যুর সময় অকস্মাৎ বিকট মুখভঙ্গি করে, তার সর্বাঙ্গ খিচোতে থাকে, হঠাৎ দশ বৎসরের টান-টান হাঁটু যেন ইলেকট্রিক শক খেয়ে খাড়া হয়ে থুতনির দিকে গোত্তা মারতে চায় এবং মুখ দিয়ে অনর্গল কথা বেরোতে থাকে।
আমার হল তাই। আমি হয়ে গিয়েছিলুম অচল অসাড়। স্তম্ভিত বললুম না, কারণ আজকের দিনের পয়লা নম্বরি অ্যারপোর্টে স্তম্ভ আদৌ থাকে না। যাই হোক যাই থাকু, আমার মুখ দিয়ে বেরুতে লাগল আতশবাজির ঝটকা, তুবড়ির পর তুবড়ির হিংস্র হিসহিস আর পটকা, বোমার দুদ্দাড় বোম্বা। আর হবেই-না কেন? যে জুরিচের কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে কর্ণপটহবিদারক তথা নয়নান্ধকারক আতশবাজি ছাড়ছি সেই আতশবাজিকেই আপন জর্মন ভাষায় বলে বেঙ্গালিশে বেলোয়েষটুঙ অর্থাৎ বেঙ্গল রোশনি; এবং এ দেশের ফরাসি অংশে বলে ফ্য দ্য বাঙাল অর্থাৎ ফায়ার অব বেঙ্গল। তদুপরি বিশেষভাবে লক্ষণীয় ফরাসি ভাষায় বঙ্গদেশকে বাঙালরূপে উচ্চারণ করে। আমি বাঙাল বঙ্গসন্তান। আমি আমার জন্মনি, জন্মনি অধিকার অর্থাৎ বার্থরাইট ছাড়ব কেন? ফায়ার ওয়ার্কস চালাবার যদি কারও হক্ক থাকে তবে সে আমার। হুহুঙ্কার ছাড়লুম :
কী বললে? ঝাড়া তিনটি ঘণ্টা আমাকে এই অ্যারপোর্টে বসে কলোনের প্লেনের জন্য তাজ্জিম মাজ্জিম করতে হবে? আমার দেশ যে-ভারতবর্ষকে তোমরা অন্ডর ডিভালাপড় কন্ট্রি সাদামাটা ভাষায় অসভ্য দেশ– বলল সেখানেও তো তিন-তিনটি ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় না, কনেকশনের জন্য। হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি রেলগাড়ির কথাই বলছি। আমি যদি আজ ভারতের যে কোনও ডাকগাড়িতে করে যে কোনও জংশনে পৌঁছুই তবে আধঘণ্টার ভিতর কনেকশন পেয়ে যাই। না পেলে– সেটাও সাতিশয় কালে কম্মিনে– খবরের কাগজে জোর চেল্লাচেল্লি করি (মনে মনে বললুম অম্মদেশীয় রেলের কর্তারা তার ঘোড়াই কেয়ার করেন) অ্যারোপ্লেনের তো কথাই নেই। সে তো আরও তড়িঘড়ি কনেকশন দেয়। আমাকে যত তাড়াহুড়ো করে মোকামে পৌঁছে দিতে পারে, ততই তার লাভ। অন্যত্র অন্য প্যাসেঞ্জারের সেবার্থে যেতে পারলে তার আরও দু পয়সা হয়।… অ! তোমাদের বিস্তর ধনদৌলৎ হয়ে গিয়েছে বলে তোমরা আর পয়সা কামাতে চাও না? আর শোনো, ব্রাদার, এ তো হল ট্রেন-প্লেনের কাহিনী। গরুর গাড়ির নাম শুনেছ? বুলক কার্ট? সেই গরুর গাড়িতে করে যদি আমি দশ-বিশ মাইল যাই তবে সেখানে পৌঁছেও সঙ্গে সঙ্গে কনেকশন পাই। বোলপুর থেকে ইলামবাজার গিয়ে নদীর ওপারে তদ্দণ্ডেই অন্য গরুর গাড়ির কনেকশন হামেহাল তৈরি। বস্তুত তখন ওপারের গাড়োয়ানরা গাহককে পাকড়াও করার জন্য যা হৈ-হুল্লোড় লাগায় তার সামনে আন্তর্জাতিক পাণ্ডা প্রতিষ্ঠানের পর্ব মহাভারত- থুড়ি, পাঁচখানা ইলিয়াড দশখানা ফাউসট লিখতে পারি। কিন্তু উপস্থিত সেটা স্থগিত থাক। আমার শেষ কথা এইবারে শুনে নাও। এই যে আমি কন্টিনেন্টে এসেছি তার রিটার্ন টিকিটের জন্য কত ঝেড়েছি জানো? এক-একটা টাকা যেন নাক ফুটো করে কুরে কুরে বেরিয়েছে তোমরা যাকে বলল, পেইং প্রু দি নোজ। পরাক্কা ছ হাজার পাঁচশোটি টাকা। তার পর ফরেন এক্সচেন্জ, গয়রহ হিসেবে নিলে দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে সাত হাজারের মতো। এ ভূখণ্ডে থাকব মাত্র তিনটি মাস। এইবারে হিসাব করো তো বসে, তবে বুঝি তোমার পেটে কত এলেম, এই যে কনেকশনের জন্য আমার তিনটি ঘণ্টা বরবাদ করলে তার মূল্যটা কী? সে না হয় গেল। কিন্তু সে সময়টা যে বন্ধুবান্ধবীর সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত করলে তার জন্য তোমার হৃদয়বনে কোনও সন্তাপানল প্রজ্বলিত হচ্ছে না? তারা–
ইতোমধ্যে আমার চতুর্দিকে একটা মিনি মাসির মধ্যিখানের মিডি সাইজের ভিড় জমে গিয়েছে। ফ্রি এনটারটেনমেন্ট। আমার সোক্রোতেসপারা, কিংবা দ্রৌপদী যে রকম রাজসভায় আত্মপক্ষ সমর্থন করেছিলেন সেই ধরনের যুক্তিজাল বিস্তার এদের হৃদয়-মনে যেন মলয়বাতাসের হিল্লোল, দে দোল দোল খেলিয়ে গেল। এদের বেশিরভাগই আমার বেদনাটা সহানুভূতিসহ প্রকাশ করেছে। য়া য়া, উই উই, সি সি যাবতীয় ভাষায় আমাকে মিডিসমর্থন জানাচ্ছে। আমি ফের তেড়ে এগুতে যাচ্ছি এমন সময়
এমন সময় সর্বনাশ! একটি কুড়ি-একুশ বয়সের কিশোরী, আমি যাকে কেছে মুছে ইস্ত্রি মেরে ভাঁজ করে পকেটে ঢোকাতে যাচ্ছি, কাউন্টারের পিছনের কুঠরি থেকে বেরিয়ে এসে তাকে বললে, আপনার টেলিফোন। তনুহূর্তেই সেই মহাপ্রভু তিলব্যাজ না করে, যেন সসেমিরে দে ছুট দে ছুট। লোকটা নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথের আমারে ডাক দিল কে ভিতর পানে গানটি জানে। কিশোরী একগাল হেসে আমাকে শুধোলে, আপনার জন্য কী করতে পারি স্যার? দুত্তোর ছাই। আধ-ফোঁটা এই চিংড়ির সঙ্গে কী লড়াই দেব আমি! নাথিং বাট ইয়োর লড। বলে দুমদুম করে লাউঞ্জের সুদূরতম প্রান্তে আসন নিলুম।
.
সোফাটা মোলায়েম। সামনে ছোট্ট একটি টেবিল।
বেজার মুখে বসে আছি। এমন সময় দেখি একজন বয়স্ক ভদ্রলোক দু হাতে দুটি ভর্তি ওয়াইনগ্লাস নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ঠিক যতখানি নিচু হয়ে অপরিচিত জনকে বাও করাটা কেতাদুরস্ত তাই করে শুধোলেন, ভুপেরমেতে, মসিয়ো–অর্থাৎ আপনার অনুমতি আছে স্যার? নিশ্চয়, নিশ্চয়। যদিও সোফাটির যা সাইজ তাতে পাঁচজন কিংকিং অনায়াসে বসতে পারে তবু ভদ্রতা দেখাবার জন্য ইঞ্চিটাক সরে বসলুম। ভদ্রলোক ফের কায়দামাফিক বললেন, ন ভূ পেঁরাজে পা, জ ভু প্রি। এর বাংলা অনুবাদ ঠিক কী যে হবে, অতখানি ফরাসি জানিনে, বাংলাও না। মোটামুটি না, না, ব্যস্ত হবেন না। ঠিক আছে, ঠিক আছে। উর্দুতে বরঞ্চ খানিকটে বলা যায় তকলুফ কিজিয়ে ওই ধরনের কিছু একটা। তকলু কথাটা তকলিফ (বাংলায় কিছুটা চালু) অর্থাৎ কষ্ট! মোদ্দা: আপনাকে কোনও কষ্ট দিতে চাইনে।
সেই দুটো গ্লাস টেবিলে রেখে একটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আরেকটা নিজে তুলে নিয়ে বললেন, আপনার স্বাস্থ্যের মঙ্গলের জন্য।
চেনাশোনা কিছুই নেই। খোদার খামোখা এ লোকটা একটা ড্রিংক দিচ্ছে কেন? তবে কি লোকটা কনফিডেন্স ট্রিকস্টার? আমাদের হাওড়া-শ্যালদাতে যার অভাব নেই। ভাবসাব (কনফিডেন্স) জমিয়ে বলবে দাদা, তা হলে আপনি টিকিট দুটো কিনে আনুন। এই নিন আমার লিলুয়ার পয়সা, আমি মালগুলো সামলাই।… টিকিট কেটে ফিরে এসে দেখলেন, ভো ভো। আপনার মালপত্র হাওয়া।
কিন্তু এ লোকটা আমার নেবে কী? সুকুমার রায় (?) একদা একটি ব্যঙ্গচিত্র আঁকেন। বিরাট ভূড়িওলা জমিদার টিঙটিঙে দারওয়ানকে শাসিয়ে শুধোচ্ছেন, চোর ভাগা কিও? দারওয়ান বললে, মেরা এক হাতমে তলওয়ার দুসরেমে ঢাল। পকড়ে কৈসে? আমার এক হাতে তলওয়ার, অন্য হাতে ঢাল। ধরি কী করে?
আমার এক পাশে আমার মিত্রের দেওয়া এটাচি, অন্যদিকে অ্যার ইন্ডিয়ার দেওয়া ছোট্ট একটি বাকসো। দুটোই তো বগলদাবা করে বসে আছি। লোকটাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না, ও স্বৰ্গত পিসি সরকার (এ স্থলে বলে রাখা ভালো সরকার কখনও এহেন অপকর্ম করতেন না) যে আমার দুটি বাক্স সরিয়ে ফেলবে। এবং সবচেয়ে বড় কথা, এ রকম রুচিসম্মত পোশাক-আশাক আমি একমাত্র ডিউক অব উইন্ডসরকে (উচ্চারণ নাকি উইনজার) পরতে দেখেছি– জীবনে একবার। ডিউকের জীবনে একবার নয়, আমার জীবনে একবার। সে বেশের বর্ণনা অন্যত্র দেব।
একখানা কার্ড এগিয়ে দিলেন। তাঁর নাম আঁদ্রে দ্যুপোঁ। তার পর একগাল হেসে শুধোলেন, যদি অপরাধ না নেন তবে একটি প্রশ্ন শুধোই, আপনি কি কটিঙে বিশেষজ্ঞ?
আমি থতমত খেয়ে শুধোলুম, কটিঙে? সে আবার কী?
ভুদ্রলোক আরও থতমত খেয়ে কিন্তু চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, সে কী মশাই! এই মাত্র আপনার অনবদ্য লেকচারটি শুনলুম, আপনি ক হাজার টাকা ঝেড়ে কলকাতা থেকে এ দেশে আসার রিটরন টিকিট কেটেছেন, এবং কনেকশন না পেয়ে তিন ঘণ্টাতে আপনার কী পরিমাণ অর্থক্ষয় হল তার পুরোধাক্কা, করেট টু দি লাস্ট সাতিম, ব্যালানস শিট। একেই তো বলে কটিঙ। আমি ব্যবসা-বাণিজ্য করি। ওই নিয়ে নিত্যি নিত্যি আমার ভাবনা-চিন্তার অন্ত নেই। কিন্তু সে কথা থাক। আমি আপনার কাছে এসেছি একটি প্রস্তাব নিয়ে। আপনার যখন তিন ঘণ্টা বরবাদ যাচ্ছে তখন এক কাজ করুন না! মিনিট পনেরো পরে এখান থেকে একটা প্লেন যাচ্ছে জিনিভা : আমার সামান্য একটি বাড়ি আছে সেখানে। আপনার খুব একটা অসুবিধে হবে না। বেডরুম, বাথরুম, ডাইনিংরুম, স্টাডি সব নিজস্ব পাবেন। (আমি মনে মনে মনকে শুধালাম, একেই কি বলে সামান্য একটি বাড়ি?) আমাদের সঙ্গে আহারাদি, দুদণ্ড রসালাপ করে জিরিয়ে নেবেন। তার পর আপনাকে আপনার মোকাম, কলোনগামী প্লেনে তুলে দেব। তার পর একটু ইতিউতি করে বললেন, কিছু মনে করবেন না। আমি এ প্রস্তাবটা নিজের স্বার্থেই পাড়ছি। আমার একটি ছেলে আর দুটি মেয়ে। ষোল, চোদ্দ, দশ। আপনার সঙ্গে আলাপচারী করে তারা সত্যই উপকৃত হবে। এদেশে চট করে একজন ইন্ডিয়ান পাওয়া যায় না। পেলেও তিনি ফরাসি জানেন না। আর আমার বিবি বাসা রাঁধতে পারেন—
আমি বাধা দিয়ে বললুম, কিন্তু এই দশ মিনিটের ভিতর আপনি আমার জন্য জিনিভার টিকিট পাবেন কী করে?
মসিয়ো দ্যুপোঁ মুচকি হেসে বললেন, সেই ফরমুলো, ন ভূ দেরাজে পা- আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। এটা-ওটা ম্যানেজ করার কিঞ্চিৎ এলেম আমার পেটে আছে; নইলে ব্যবসা করি কী করে! কাচ্চা-বাচ্চারা বড় আনন্দ পাবে। প্লেনের ভাড়াটার কথা আপনি মোটেই চিন্তা করবেন না–
আমি ফের বাধা দিয়ে বললুম, আপনি ও-বাবদে চিন্তা করবেন না। অ্যার-ইন্ডিয়ার আমার টিকিটটি অমনিবাস, অর্থাৎ যেখানে খুশি সেখানেই যেতে পারি; তার জন্য আমাকে ফালতো কড়ি ঢালতে হবে না। (পাঠক, এ ধরনের মোটর অমনিবাসকে কবিগুরু নাম দিয়েছেন বিশ্বষহ। এবং তদীয় অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ মোটরগাড়ি, অটোমবিলকে, যেটা আপন শক্তিতে চলে, তার নাম দিয়েছিলেন স্বতশ্চলশকট। অতএব এস্থলে আমরা যানবাহন প্লেনের টিকিটকে স্বতশ্চল বিশ্বষহ মূল্য পত্রিকা অনায়াসে বলা যেতে পারে)।
একটু থেমে বললাম, আমি এখনি আসছি। অর্থাৎ যে স্থলে যাচ্ছি, যেখানে রাজাধিরাজও ঘোড়ায় চড়ে যেতে পারেন না, অর্থাৎ শৌচাগার।
সেদিকে যাইনি। যাচ্ছিলুম অন্য পথে। অ্যাটাচি বাসা সোকাতেই রেখে এসেছি। এরকম সহৃদয় সজ্জনকে বিশ্বাস করে আমি বরঞ্চ ও দুটো হারাব, অবিশ্বাস করতে ঘেন্না ধরে। গেলুম বার-এ। সেখানে মসিয়ো যে ওয়াইন এনেছিলেন তারই দু গ্লাস কিনে ফিরে এলুম সোফায়। একটা গ্লাস তার দিকে এগিয়ে দিয়ে তার স্বাস্থ্য কামনা করে বললুম, আপনার আন্তরিক আমন্ত্রণের জন্য আমার অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমার একটা বড়ই অসুবিধে আছে। কলোন অ্যারপোর্টে আমার বন্ধুবান্ধবরা অপেক্ষা করছে। তারা খবর নিয়ে নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছে, আমি তিন ঘণ্টা পরে কনেকশন পাব। আমি আপনার সঙ্গে জিনিভা গেলে বড় দেরি হয়ে যাবে। তারা বড় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে।
আর মনে মনে ভাবছি, ইহসংসারে, এমনকি ইয়োরোপেও, সেই বাগদাদের আবু হোসেনও আছে যারা রাস্তায় অতিথির সন্ধানে দাঁড়িয়ে থাকে। সে একা একা খেতে পারে না।
মসিয়ো বড্ডই দুঃখিত হয়ে প্রথমে বললেন, কিন্তু আপনি আবার আমার জন্য ড্রিংক আনলেন কেন? এ কি দেনা-পাওনা!
আমি মাথা নিচু করলুম। দ্যুপোঁ বললেন, তা হলে দেশে ফিরে যাবার সময় আমার ওখানে আসবেন।
তার পর একটি পকেটবই বের করে বললেন, কিছু একটা লিখে দিন। ছেলেমেয়েরা খুশি হবে। আমি তৎক্ষণাৎ লিখলুম :
কত অজানারে জানাইলে তুমি
কত ঘরে দিলে ঠাঁই
দূরকে করিলে নিকট বন্ধু,
পরকে করিলে ভাই।
হায়! ফেরার পথেও দ্যুপোঁর বাড়িতে যেতে পারিনি।
.
০৪.
জুরিচের মতো বিরাট অ্যারপোর্টে কী করে মানুষ একে অন্যকে খুঁজে পায় সেটা বুঝবার চেষ্টা করে ফেল মেরেছি। তা হলে নিশ্চয়ই স্বীকার করতে হবে এখানকার কর্মচারীদের পেটেপিঠে এলেম আছে। তাদেরই একজন আমার সামনে এসে বললে, আপনার জন্য একটা মেসেজ আছে স্যার। আমি সত্যিই বিস্মিত হলুম। আমাকে এই সাহারা ভূমিতে চেনে কে বললুম, ভুল করেননি তো? এজ্ঞে না। আমি জানি– সঙ্গে সঙ্গে ছোকরা আমার পুরো নামটি বলে দিল। যদিও সে এদেশেরই লোক তবু আমার মনে হল সে দেশ পত্রিকার পঞ্চতন্ত্র নিত্য সপ্তাহে পড়ে এবং তারই মারফত আমার ভোলা নামটি পুরো পাকা রপতত করে নিয়েছে। হয়তো ডাকনামটাও জানে। হয়তো ভোম্বল কাবলা জাতীয় আমার সেই বিদকুটে ডাকনামটা সে পাঞ্চজন্য শঙ্খধ্বনিতে প্রকাশ করতে চায় না; কিন্তু এসব ভাববার চেয়ে ঢের বেশি জানতে চাই, কে আমাকে স্মরণ করলেন।
অ। ফ্রলাইন ফ্রিডি বাওমান! কিন্তু ইনি জানলেন কী প্রকারে যে আমি আজ সকালে এখানে পৌচচ্ছি। তার মেসেজ খুলে জিনিসটে পরিষ্কার হল। কলকাতা ছাড়ার পূর্বে অ্যার ইন্ডিয়ার ইয়াররা শুধিয়েছিলেন জুরিচে আমার কোনও পরিচিতজন আছেন কি না, কেননা ওখানে আমাকে কনেকশনের জন্য খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। খবর পাঠালে ওঁরা হয়তো আরপোর্টে এসে আমাকে সঙ্গসুখ দেবেন। আমি উত্তরে বলেছিলুম, জুরিচে নেই, তবে সেখান থেকে ত্রিশ-চল্লিশ মাইল দূরে লুৎসের্ন শহরে একটি পরিচিত মহিলা আছেন। এবং তার নাম-ঠিকানা দিয়েছিলুম। এ কথাটা ভুলে গিয়েছিলুম বেবাক। দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি শুড়ের পাটালি; কিছু ঝুনো নারিকেল; / দুই ভাণ্ড সরিষার তেল; / আমসত্ত্ব আমচুর এর মাঝখানে কবিগুরু যদি তার প্রিয় কন্যাকে ভুলে যান তবে সাতান্নটা হাবিজাবির মাঝখানে আমি যে এটা মনে রাখিনি তার জন্য সদয় পাঠক রাগত হবেন না।
কিন্তু এই সুবাদে সেই খাঁটি জাত সুইস মহিলাটির সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করে দিতে চাই। ফ্রিডি বাওমান। ১৯৪২/৪৩-এ ইনি সেই মহারাজা সয়াজি রাওয়ের বরোদা প্রাসাদে প্রবেশ করেন। আজকের দিনে ক্রিকেট কিংবা পলিটিকসের সঙ্গে যাদেরই সামান্যতম পরিচয় আছে তারাই জানেন বরোদার শ্ৰীযুত ফতেহ সিং রাও গায়কোয়াড়কে। এই ফ্রিডির হাতেই তিনি পৃথিবীতে পদার্পণ করেন। অথবা মস্তকাবতীর্ণ করেন। কিন্তু তার ওপর আমি জোর দিচ্ছিনে। রাজা মহারাজা ভিখিরি আতুর পৃথিবীতে সবাই নামেন একই পদ্ধতিতে।
আসল কথা, ফতেহ সিং রাও মানুষ হন ফ্রিডির হাতে। তিনি অসাধারণ শিক্ষিতা রমণী সেই ছাব্বিশ বছর বয়সেই। জর্মন, ফরাসি, স্প্যানিশ, ইংরেজি সব-কটাই বড় সুন্দর জানতেন। এ দেশে এসেছিলেন বেকারির জন্য নয়। রোমান্টিক হৃদয় : ইন্ডিয়াটা দেখতে চেয়েছিলেন। গ্যোটে তার প্রিয় কবি। গ্যোটের ভারতপূজা তাঁর মনে গভীর দাগ কেটেছিল। এদিকে তার উত্তম উত্তম পুস্তক পড়ার অভ্যেস চিরকালের। রাজপ্রাসাদের কাজকর্মও গুরুভার নয়। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি যে কী করে তাঁর প্রিয়সাধক শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের বাণীর মর্মস্থলে পৌঁছে গেলেন সেটা বুঝলাম যেদিন তিনি আমাকে বললেন যে, ছেলেবেলা থেকেই তিনি সেন্ট ফ্রানসিস আসিসির ভক্ত। এবং সকলেই জানেন, এই সন্তটির সঙ্গেই ভারতীয় শ্রমণ, সন্ন্যাসী, সাধুসন্তের সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্য। একদিকে যেমন দরিদ্রনারায়ণের সেবা, অন্যদিকে ঠিক তেমনি পরমাত্মার ধ্যানে মগ্ন হয়ে প্রভু খ্রিস্টের সঙ্গে একাত্ম বোধ করাতে তিনি এদেশের মরমিয়া সাধক, ইরান-আরব-ভারতের সুফিদের সঙ্গে এমনই হরিহরাত্মা যে অনেক সময় বোঝা কঠিন কার জীবনবৃত্তান্ত পড়ছি। খ্রিস্টানের, ভক্তের না সুফির?
কিন্তু আমার কী প্রগলভতা যে আমি তাঁর জীবনীর সংক্ষিপ্ততম ইতিহাসও লিখতে পারি। দেশ পত্রিকার প্রিয়তম লেখক শ্ৰীযুত ফাদার দ্যুতিয়েন যদি বাংলায় তার জীবনী লেখেন তবে গৌড়জন তাহা আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি।
কুমারী ফ্রিডির কথা পুনরায় লিখব। কনটিনেন্ট সেরে, দেশে ফেরার পথে, লুৎসের্নে শ্রীমতীর বাড়িতে সপ্তাহাধিককাল ছিলুম সেই সুবাদে। উপস্থিত ফ্রিডি লিখেছেন, তিনি আমার (অ্যারইন্ডিয়া মারফত) টেলে পেলেন কাল রাত্রে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জুরিচের অ্যারপোর্টে ট্রাংককল করে জানালেন, আমি জুরিচে নেবেই যেন তাঁকে ট্রাংককল করি। বরাবর তিনি বাড়িতেই থাকবেন।
মনে হয় কত সোজা। কিন্তু যারা দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে চান তাদের উপকারার্থে এ স্থলে কিঞ্চিৎ নিবেদন করে রাখি।
প্রথমত আপনাকে টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করতে হবে। সে বুথ আবার সন্ ব্রাহ্মণ। আপন দেশজ খাদ্য ভিন্ন অন্য খাদ্য খান না। অর্থাৎ তার বাসে আপনাকে ছাড়তে হবে এদেশের আপন সুইস মুদ্রা। অতএব গো-খোঁজা করুন, সে সাহারাতে, কোথায় সে পুণ্যভূমি যেখানে আপনার ডলার বা পৌন্ডের বদলে সুইস মুদ্রা দেবে। সবাই তো ইংরেজি বোঝে না। ভুল বুঝে অনেকেই। তারা কেউ বলে ওই তো হোথায়, কেউ বলবে তার জন্য তো শহরে যেতে হবে। শেষটায় পেলেন সেই কাউন্টার পুণ্যভূমি আমি অতি, অতি সংক্ষেপে সারছি। পেলেন সুইস বস্তু। তখন আবার ভুল করে যেন শুধু কাগজের নোট না নেন। কারণ ফোন বুথ কাগজাৰ্থশী নন; তিনি চান মুদ্রা। সেই মুদ্রা আবার ওই সাইজের হওয়া চাই। ঠ্যাঙস ঠ্যাঙস করে চলুন ফের ওই পুণ্যভূমিতে আরও বহুবিধ ফাড়াগৰ্দিশ আছে। বাদ দিচ্ছি।
আহ্! কী আনন্দ!! কী আনন্দ!!!
কে বলছেন? আমি ফ্রিডি।
আমি সৈয়দ।
ওই য যা! ট্রাঙ্ক লাইন কেটে গেল। পাবলিক বুথ থেকে ট্রাঙ্ক-কল করা এক গব্বন্তনা। আমি যে দুটি মুদ্রা মেশিনে ফেলে লুৎসের্ন পেয়েছিলুম, তার ম্যাদ ফুরিয়ে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আর দুটো না ফেলার দরুন লাইন কাট অফফ। ফের ঢালো কড়ি।
অতি অবশ্য সত্য ফোন যন্ত্রের বাকসে সুইটজারল্যান্ডে প্রচলিত তিন-তিনটি ভাষা– ফরাসি, জর্মন এবং ইতালীয় লেখা আছে কোন গুহ্য সরল পদ্ধতিতে যন্ত্রটি ব্যবহার করতে হয়। লেখা তো অনেক কিছুই থাকে। ধর্মগ্রন্থে তো অনেক কিছুই লেখা থাকে। সেগুলো পড়লেই বুঝি মোক্ষ লাভ হয়! জিমনাস্টিকের কেতাব পড়লেই বুঝি কিড় সিঙ-এর মতো মাসল গজায়। প্র্যাকটিস করতে হয়। এবং তার জন্য খেসারতিও দিতে হয়। উপযুক্ত শুরু বিনা যোগাভ্যাস করতে গিয়ে বিস্তর লোক পাগল হয়ে যায়। আমি ইতোমধ্যে প্রায় দেড় টাকার মতো খেসারতি দিয়ে হ্যালো হ্যালো করছি। আর, এ খেসারতির কোনও আন্তর্জাতিক মূল্য নেই। কারণ জনি, ফ্রান্স, ইংলন্ড প্রায় প্রত্যেক দেশই আপন আপন কায়দায় আপন আপন মেশিন চালায়। আর সেখানেই কি শেষ? তিন মাস পরে যখন ফের সুইটজারল্যান্ড আসব, তখন দেখব, বাবুরা এ ব্যবস্থা পালটে দিয়েছেন। নতুন কোনও এক আবিষ্কারের ফলে যন্ত্রটার ব্যবহার নাকি সরলতর করেছেন। সরলতর না কচু! তাই যারা এসব ব্যাপারে ওয়াফিহাল নন, যারা এই হয়তো পয়লা বারের মতো কন্টিনেন্ট যাচ্ছেন, তাদের প্রতি আমার সরলতম উপদেশ, বিশুরু এসব যন্ত্রপাতি ঘাটাতে যাবেন না। অবশ্য গুরু পাওয়া সর্বত্রই কঠিন; এখানে আরও কঠিন। যে যার ধান্দা নিয়ে উধ্বশ্বাসে হন্তদন্ত। কে আপনাকে নিয়ে যাবে সেই বুথ-গুহায়, শিখিয়ে দেবে সে গুহায় নিহিতং ধর্মস্য তত্ত্বং।
যাক। ফের পাওয়া গিয়েছে লাইন।
তুমি লুৎসের্নে কখন আসছ?
অপরাধ নিয়ো না। আমি উপস্থিত যাচ্ছি কলোন। তার পর হামবুর্গ ইত্যাদি। তার পর লন্ডন, নাটিংহাম। সেখান থেকে ফেরার পথে লুৎসের্ন। তুমি খেদিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তোমার বাড়িতে।
দ্যৎ। কিন্তু তদ্দিন এখানে যে বড্ড শীত জমে যাবে। গরম জামাকাপড় এনেছ তো? মা নিস্ (নেভার মাইন্ড- আসে-যায় না), আমার কাছে আছে।
তুমি এখনও ফ্রানসিস আসিসিরই শিষ্যা রয়ে গিয়েছ– কী করে কাতর জনকে মদৎ করতে হয়, সে-ই তোমার প্রধান চিন্তা। আমি কি তোমার স্কার্ট-ব্লাউজ পরে রাস্তায় বেরুব? সে কথা থাক। আমাকে অ্যারপোর্টে আরও তিন ঘণ্টাটাক বসে থাকতে হবে। চলে এসো না এখানে। আজ তো রোববার। তোমাকে অফিস-দফতর করতে হবে না।
রোববার। সেই তো বিপদ। বাড়ি থেকে যেতে হবে লুৎসের্ন স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেনে করে জুরিচ। পঁয়ত্রিশ মাইল। সেখান থেকে বাস-এ করে তোমার অ্যারপোর্টে। রোববার বলে আজ ঢের কম সার্ভিস। সব কটা উঠতি-নাবতিতে টায় টায়, কোথায় পাব কনেকশন-
আমি মনে মনে বললুম হুঁ : ফের সেই কনেকশন। ইলামবাজার রামপুরহাট।
ফ্রিডি বললে, আচ্ছা দেখি।
আমি বললাম, কতকাল তোমাকে দেখিনি।
ফ্রিডি যদি এখানে আসেই তবে তার বাস দাঁড়ায় কোথায়? আমি বসে আছি ট্রানজিট প্যাসেঞ্জারের খোয়াড়ে। এখানে তো ফ্রিডির প্রবেশ নিষেধ। অবশ্য সে দেশের রীতিমতো সম্মানিতা নাগরিকা (সংস্কৃত অর্থে নয়) সিটুজেন। কাজেই সে স্পেশাল পারমিট যোগাড় করতে পারবে। তবে সেটা যোগাড় করতে কতক্ষণ লাগবে, কে জানে? আম আনতে দুধ না ফুরিয়ে যায়। ততক্ষণে হয়তো আমার কলোনগামী প্লেনের সময় হয়ে যাবে।
বাসস্ট্যান্ডে যেতে হলে আমাকে খোয়াড় থেকে বেরোতে হয়। কিন্তু আমাকে বেরুতে দেবে কি? খোয়াড়ের বাইরেই স্বাধীন মুক্ত সুইটজারল্যান্ড। তার জন্য ভিসার প্রয়োজন। আমার সেটা নেই। তবু চেষ্টা করে দেখাই যাক না, কী হয় না হয়। সুকুমার রায় বলেছেন, উৎসাহে কি না হয়, কি না হয় চেষ্টায়। সেইটে পড়ে আমার এক সখা ডাকপিয়নকে বলেছিল, আমার কোনও চিঠি নেই? কী যে বলছ? ফের খুঁজে দেখো। উৎসাহে কি না হয়, কি না হয় চেষ্টায়।
খোঁয়াড়ের গেটে গিয়ে সেখানকার উর্দিপরা তদারকদারকে অতিশয় সবিনয় নিবেদন করলুম, স্যার! আমি কি একটু বাইরে ওই বাসস্ট্যান্ডে যেতে পারি?
আপনি তো ট্রানজিট না?
আমি সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললুম, বাস-এ করে লুৎসের্ন থেকে আমার একটি বান্ধবী–
হায় পাঠক, তুমি সেই তদারকদারের প্রতিক্রিয়া যদি তখন দেখতে। বান্ধবী! বান্ধবী!! সেরতেমা (সার্টলি) চেরআনুতে (ইতালিয়ানে, সার্টলি) এবং তার জর্মনে জিষার জিয়ার (শিওর, শিওর) এবং সর্বশেষে, যদি না কুল পায়, মার্কিন ভাষায় শিয়োঁর, শিয়োঁ।
আমি জানতুম, আমি যদি বললুম, আমার বন্ধু আসছেন, সে বলত, নো। যদি বললুম আমার বিবি, উত্তর তদ্বৎ। যদি বলতুম, বৃদ্ধা মাতা তখনও হত না হয়তো কিঞ্চিৎ থতমত করে। কিন্তু বান্ধবী! আমার সাত খুন মাফ!
কলোনের নাম কে না শুনেছে। বিশেষ করে হেন ফ্যাশনেবল মহিলা আছেন যিনি কস্মিনকালেও প্রসাধনাৰ্থে ও-দ্য-কলোন– জর্মনের ক্যলনিশ ভাষার–কলনের জল ব্যবহার করেননি। বিশ্বজোড়া খ্যাতি এই তরল সুগন্ধিটির। ৪৭১১ এবং মারিয়া ফারিনা এই দুটিকেই সবচেয়ে সেরা বলে ধরা হয়। এ দেশেও কলোন জল তৈরি হয় কিন্তু ওটা বানাতে হলে যে সাত-আট রকমের সুগন্ধি ফুলের প্রয়োজন, তার কয়েকটি এদেশে পাওয়া যায় না– সর্বোপরি প্রাক প্রণালী তো আছেই। বিলেতেও কলোন জলের এতই আদর যে, হিটলারের সঙ্গে দেখা করার জন্য চেম্বারলেন যখন সপারিষদ কলোন থেকে মাইল বিশেক দূরে গোডেসবের্গ-এর মুখোমুখি, রাইন নদীর ওপারে যে বাড়িতে ওঠেন, তার প্রতি ঘরে কলোন জল, কলোন জলের সুগন্ধ দিয়ে নির্মিত গায়ে মাখার সাবান, দাড়ি কামাবার সাবান, ক্রিম, পাউডার- বস্তৃত প্রসাধনের তাবৎ জিনিস রাখা হয়েছিল হিটলারের আদেশে। চেম্বারলেন এই সূক্ষ্ম বিদগ্ধ আতিথেয়তা লক্ষ করেছিলেন কি না জানিনে। কারণ তখন তার শিরঃপীড়া তার এ অভিসার তাঁর দেশবাসী কী চোখে দেখবে। তার আপন ফরেন অফিস যে সেটা নেকনজরে দেখছে না, সেটা তিনি জানতেন, কারণ ইতোমধ্যেই তারা একটা প্যারডি নির্মাণ করে ফেলেছে :
ইফ অ্যাট ফাস্ট ইউ কানট সাকসিড
ফ্লাই ফ্লাই ফ্লাই এগেন।
বলা বাহুল্য চেম্বারলেন ফ্লাই করে গিয়েছিলেন। আর আমি তো সেই গোডেসবের্গ-এর উপর দিয়ে কলোন পানে ফ্লাই করে যাচ্ছিই। সেই সুবাদে প্যারডিটি মনে পড়ল।
জুরিচে ফ্রিডির সঙ্গে মাত্র কুড়ি মিনিট কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলুম। মনটা খারাপ হয়ে আছে।
কলোন শহরের সঙ্গে আমার চল্লিশ বছরের পরিচয়।
এখান থেকে প্রায় চৌদ্দ মাইল দূরে বন। সেখানে প্রথম যৌবনে পড়াশুনা করেছিলাম। ট্রামে, বাসে, ট্রেনে, জাহাজে করে এখানে আসা অতি সহজ। আমার একাধিক সতীর্থ কলোন থেকে বন ডেনিপ্যাসেঞ্জারি করত। তাদের সঙ্গে বিস্তর উইক এন্ড করেছি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শহরটাকে দেখেছি।
সে-সব সবিস্তর লিখতে গেলে পাঠকের ধৈর্যচুতি হবে। আর লিখতে যাবই-বা কেন? জর্মন টুরিস্ট ব্যুরো যদি আমাকে কিঞ্চিৎ ব্রাহ্মণ-বিদায় করত তবে না হয়–
যদি নিতান্তই কিছু বলতে হয়, তবে প্রথম নম্বর সম্বন্ধে বলি যে, সেটি আপনি চান কি না চান, কিছুতেই এড়াতে পারবেন না। কলোনের বিরাট গগনস্পর্শী গির্জা। প্যারিসে যে রকম যেখানেই যান না কেন, অ্যাফ্যাল টাওয়ারটা এড়াতে পারবেন না, কলোনের এই কেথিড্রেলটির বেলাও তাই। তবে অ্যাফ্যাল স্তম্ভ বদখদ, কিন্তু কলোনের গির্জাচুড়ো তন্বী সুন্দরী। যেন মা-ধরণী উৗঁপানে দু বাহু বাড়ায়ে পরমেশ্বরকে তার অনন্ত অবিচ্ছিন্ন নমস্কার জানাচ্ছেন।
এ গির্জা আবার আমাদের কাছে নবীন এক গৌরব নিয়ে ধরা দিয়েছে।
বছর দুত্তিন পূর্বে কলোনবাসী প্রায় শ-দুই তুর্কি ও অন্যান্য মুসলমান ওই গির্জার প্রধান বিশপকে গিয়ে আবেদন জানায়, এ বছরে ঈদের নামাজ শীতকালে পড়েছে। বাইরে বরফ; সেখানে নামাজ পড়ার উপায় নেই। যদি আপনাদের এই গির্জের ভিতর আমাদের নামাজ পড়তে দেন, তবে আল্লা আপনাদের আশীর্বাদ করবেন। বিশপের হৃদয়কন্দরে কণামাত্র আপত্তি ছিল না কিন্তু এ শহরের লোক খ্রিশ্চান। তাদেরই বিত্ত দিয়ে, গরিবের কড়ি দিয়ে এ গির্জা সাত শো বছর আগে গড়া হয়েছে। এখনও ওদেরই পয়সাতে এ মন্দিরের তদারকি দেখভাল চলে। সে-ও কিছু কম নয়। এরা যদি আপত্তি করে? কিন্তু এই বিশপটি ছিলেন বড়ই সন্তপ্রকৃতির সজ্জন। এবং তার চেয়েও বড় কথা : সাহসী। তিনি অনুমতি দিয়ে দিলেন। মা-মেরি মালিক। তিনি সর্ব সন্তানের মাতা।
কিমাশ্চার্যমতঃপরম। তাঁর কাছে কোনও প্রতিবাদপত্রও এল না। খবরের কাগজেও এই অভাবনীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ বেরুল না। অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য!! অবিশ্বাস্য!!!
কিন্তু মার্কিন টাইম কাগজে বেরিয়েছে ও বিলেতেও বেরিয়েছে। তার পর সন্দ করে কোন পিচেশ!
.
কলোন অ্যারপোর্টে নেমে দেখি, দুটো স্যুটকেসের একটা আমার নেই। ছুট ছুট দে ছুট, সেই ঘরের দিকে যেখানে হারানো-প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ সম্বন্ধে তড়িঘড়ি ফরিয়াদ জানাতে হয়। নইলে চিত্তির। অবশ্য এরা নিজের থেকেই হয়তো দু-পাঁচ দিনের ভিতরই আমার বেওয়ারিশ জাদুকে খুঁজে পাবেন, কিন্তু আমি কোন মোকামে আস্তানা গাড়ব, তার ঠিকানাটা এদের না দিলে মাল হস্তগত হবে কী বলে? সেটা তখন তার মালিককে হারাবে। কোনও এক গ্রিক দার্শনিক নাকি বলেছেন একই নদীতে তুমি দু বার আঙুল ডোবাতে পারবে না, একই শিখায় দুবার আঙুল পোড়াতে পারবে না। কারণ প্রত্যেকটি বস্তু প্রতি মুহূর্ত পরিবর্তিত হচ্ছে। মানলুম। কিন্তু একই স্যুটকেস নিশ্চয়ই দু বার, দুবার কেন, দু শো বার হারাতে কোনও বাধা নেই। অতি অবশ্য কবিগুরু বলেছেন, তোমায় নতুন করে পাব বলেই হারাই ক্ষণেক্ষণ/ও মোর ভালোবাসার ধন!! কিন্তু প্রশ্ন, এটা কি হারানো বাক্সের বেলাও খাটে?
আপিসঘরটি প্রমাণ সাইজের চেয়েও বৃহদায়তন। ভিতরে ফুটফুটে মেমসায়েব বসে আছেন। আমার লাগেজ টিকেট দেখাতেই তিনি মুচকি হেসে বললেন, নিশ্চিন্ত থাকুন, ওটা খোওয়া যাবে না। কিন্তু বলুন তো ওটার ভিতরে কী কী আছে?
সর্বনাশ। সে কি আমি জানি? প্যাকিং করেছে আমার এক তালেবর ভাতিজা মুখুজ্যে। তার বাপ প্রতি বৎসর নিদেন তিনবার ইয়োরোপ-আমেরিকা যেতেন। সে নিখুঁত প্যাকিং করে দিত। আমার বেলা এ বারে করেছে নিখুঁততর। কোন বাক্সে কী মাল রেখেছে কী করে জানব!
কিন্তু মিসি-বাবা সদয়া। পীড়াপীড়ি করলেন না। আমার ঠিকানাটি টুকে নিলেন। আর ইতোমধ্যে বার বার বলছেন, অ্যার ইন্ডিয়া বলুন, লুট-হানজা বলুন, সুইস অ্যার বলুন কোনও লাইনেই কোনও লাগেজ খোওয়া যায় না। আপনি পেয়ে যাবেনই যাবেন।
আমি মনে মনে বললুম, বট্ট্যে! বেরোবার সময় তাকে বিস্তর ধন্যবাদ জানিয়ে সবিনয়ে বললুম, গ্রেডিগেস ফ্রলাইন (সদয়া কুমারী)! একটি প্রশ্ন শুধোতে পারি কি?
সুমধুর হাস্যসহ, নিশ্চয়, নিশ্চয়।
আমি বললাম, তাবৎ হারানো মালই যদি ফিরে পাওয়া যায়, তবে এ হেন বিরাট আপিস আপনারা করেছেন কেন? আমি তো শুনেছি, কলোন অ্যারপোর্টের প্রতিটি ইঞ্চির জন্য দশ-বিশ হাজার টাকা ছাড়তে হয়।
প্রত্যুত্তরের প্রতীক্ষা না করেই এক লক্ষে দফতর থেকে বেরিয়ে মাল-সামান নিয়ে উঠলুম বিরাট এক বাস-এ।
***
বাঁচলুম, বাবা, বাঁচলুম। প্লেনের গর্ভ থেকে বেরিয়ে খোলামেলায় এসে বাঁচলুম। বাসটি যদিও পর্বতপ্রমাণ, সাগর করিবে গ্রাস হয় অনুমান, তবু চলছে যেন রোলস রইস রইস খানদানি গতিতে, মৃদু মধুরে। কবিগুরু গেয়েছিলেন, কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসার ঘায়ে– আমি গাইলুম, বাঁচালে তুমি মোরে ভালো বাস-এর ছায়ে।
আহা কী মধুর অপরাহ্নের সূর্যরশি। কখনও মেঘমায়ায়, কখনও আলোছায়ায়। দু-দিকের গাছ-পাতার উপর সে রশ্মি কভু-বা মেঘের ভিতর দিয়ে আলতো আলতো হাত বুলিয়ে যায়, কভু-বা রুদ্রদীপ্ত হয়ে প্রচণ্ড আলিঙ্গন করে। ওই হোথায় দেখছি, বুড়ো চাষা ঘাসের উপর শুয়ে আছে, চোখের উপর টুপি ঢেকে। তার সবুজ পাতলুন যেন ঘাসের ঝিলিমিলির সঙ্গে একতালে যায় মিলি। এদেশের নবান্ন হতে এখনও বেশ কিছুদিন বাকি আছে। চতুর্দিকে অল্পবিস্তর ফসল কাটা হচ্ছে। আজ রোববার। রাইনল্যান্ডের লোক বেশিরভাগই ক্যাথলিক। তাদের অধিকাংশই সেদিন সর্বকর্ম ক্ষান্ত দেয়। তাই খেতখামারে তেমন ভিড় নেই। আমিও মোকামে পৌঁছুতে পারলে বাঁচি। ইংরেজিতে প্রবাদ এ সিনার হ্যাঁজ নো সনডে। পাপীর রোববার নেই। আমি তো তেমন পাপিষ্ঠ নই!!
বাস মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রামের ভিতর দিয়ে যায়। সেখানেও রাস্তা নির্জন। বাচ্চাকাচ্চারা কোথায়? তারা তো ক্লাইপে বা সুধালয়ে যায় না সেখানে অবশ্যই আজ জোর কারবার, বেজায় ভিড়। আমার পাশের সিটে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসে ছিলেন। তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে বললুম, স্যর, ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে আমি এসব গ্রামের ভিতর দিয়ে গিয়েছি। তখন তো ছেলে-মেয়েরা রাস্তার উপর রোল-স্কেটিঙ করত, দড়ি নিয়ে নাচত, এমনকি ফুটবলও খেলত। ওরা সব গেল কোথায়?
বৃদ্ধ বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, একাধিক উত্তর হয়তো আছে। চট করে যেটা মনে আসছে সেটা বলতে গেলে বলি, বন্ধ ঘরে টেলিভিশন দেখছে।
আমি একটু ঘাড় চুলকে বললুম, যদি কিছু অপরাধ না নেন স্যর, তবে শুধাব, এটা কি সর্বাংশ ভালো? ফারসিতে একটি দোহা আছে :
হর চে কুনি ব খুদ কুনি
খাঁ খুব কুনি, খা বদ কুনি।
যা করবে স্বয়ং করবে।
ভালো করো কিংবা মন্দই কর।
এই যে প্যাসিভভাবে বসে বসে টেলি দেখা তার চেয়ে রাস্তায় অ্যাকটিভভাবে খেলাধুলো করা কি অনেক বেশি কাম্য নয়?
গুণী এবারে চিন্তা না করেই বললেন, নিশ্চয়ই। অবশ্য ব্যত্যয়ও আছে। যেমন মনে করুন, আমরা যখন মোৎসার্ট বা শপা শুনি তখন তো আমরা প্যাসিভ। আর তাই-বা বলি কী করে? বেটোফেনকে গ্রহণ করা তো প্যাসিভ নয়। ভেরি ভেরি অ্যাকটিভ কর্ম! কী পরিমাণ কনসানট্রেশন তখন করতে হয়, চিন্তা করুন তো। কিন্তু বাচ্চাদের কথা বাদ দিন কটা বয়স্ক লোকই-বা সে জিনিস করে?
তা হলে শুনুন, আপনাকে পুরো ফিরিস্তি দিচ্ছি। যদিও আমি ওই যন্ত্রটির পূজারি নই। পুরনো ফিল্ম, নয়া থিয়েটার, গর্ভপাতের সেমিনার আলোচনা, পাদ্রিদের বক্তৃতা (এ দুটো তিনি ঠিক পর পর বলেছিলেন সেটা আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে), রাজনৈতিকদের সঙ্গে ইন্টারভ, খেলা, কাবারে, ইতালি ভ্রমণ, চন্দ্রাভিযান, ভিয়েতনাম থেকে প্রত্যক্ষদর্শীর প্রতিবেদন, পার্লামেন্টে হার ভিলি ব্রান্ট ও হার শেলের বক্তৃতা এবং সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে ওই একই কেচ্ছা, একই অন্তহীন খাড়াবড়িহোড়বড়িখাড়া (তিনি জর্মনে বলেছিলেন একই ইতিহাস–ডি জেলবে গেশিষটে)। সর্ববস্তু কুচি কুচি করে পরিবেশন। পরের দিনই ভুলে যাবেন, আগের দিন কী দেখেছিলেন– মনের ওপর কোনও দাগ কাটে না। পক্ষান্তরে দেখুন, বই পড়ার ব্যাপারে আপনি আপনার রুচিমতো বই বেছে নিচ্ছেন।
ইতোমধ্যে আমাদের বাস কতবার যে কত ট্রাফিক জ্যামে কত মিনিট দাঁড়িয়েছে তার হিসাব আমি রাখিনি। অথচ এদেশের রিকশা, ঠ্যালা, গরুর গাড়ি এমন কোনও কিছুই নেই যে-সব হযবরল আমাদের কলকাতাতে নিত্য নিত্য ট্রাফিক জ্যাম জমাতে কখনও স্বেচ্ছায় কখনও অনিচ্ছায় বিশ্ববিজয়ী প্রতিষ্ঠান।
ভদ্রলোক বাইরের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ওই দেখুন, আরেক উকট নেশা। মোটর, মোটর, মোটর। প্রত্যেক জর্মনের একখানা মোটরগাড়ি চাই। জর্মন মাত্রই মোটরের পূজারি।
আমার কেমন যেন মনে হল, আমরা বোধহয় বন্ শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছে গিয়েছি। কিছুটা চেনাচেনা ঠেকছে, আবার অচেনাও বটে। অথচ একদা এ শহর আমি আমার হাতের তেলোর চেয়ে বেশি চিনতুম।
আমি ভদ্রলোককে আমার সমস্যা সমাধান করতে অনুরোধ জানালে তিনি বললেন, এটা বনই বটে। তবে এ অঞ্চলটা গত যুদ্ধে এমনই বোমারু মার খেয়েছিল যে এটাকে নতুন করে গড়া হয়েছে। তবে শহরের মধ্যিখানটা প্রায় পূর্বেরই মতো মেরামত করে বানানো। আসল কথা কী জানেন, বমিঙের ফলে ঘিঞ্জি পাড়াগুলো যে নষ্ট হয়ে গেল সেগুলোকে ভালো করে, নতুন করে প্ল্যান মাফিক বানাবার চান্সটা আমরা মিস করছি। তবে এই যে বললুম, শহরের মাঝখানটা মোটামুটি আগেরই মতো–হার্ট অব দি সিটি– আর জানেন তো পুরনো হার্টের জায়গায় নতুন হার্ট বসানো মুশকিল। এই ধরুন লুটভি ফান বেটোফেন–
আমি বললুম, ওই নামটার ঠিক উচ্চারণটা আমি আজও জানিনে।
হেসে বললেন, ওই তো ফেললেন বিপদে। মাঝখানে Vanটা যে খাঁটি জর্মন নয় তা তো বুঝতেই পারছেন। ওঁরা প্রাচীন দিনের ফ্ল্যামিশ। তখন তারা ভান না ফান উচ্চারণ করত কে জানে– অন্তত আমি জানিনে–
আমি বললুম, থাক, থাক। এবারে যা বলছিলেন তাই বলুন।
সেই বেটোফেনের বাড়ি যদি বোমাতে চুরমার হয়ে যেত তবে সেখানে তো একটা পিরামিড গড়া যেত না।
এমনকি তাজমহলও না।
***
দুম করে গাড়ি থেমে গেল। এ কি? ও। মোকামে পৌঁছে গিয়েছি। অর্থাৎ বন শহরে। এবং সবচেয়ে প্রাণাভিরাম নয়নানন্দদান দৃশ্য যে পরিবারে উঠব তারই একটি জোয়ান ছেলে ডিটরিষ উলানোফস্কি প্রবলবেগে হাত নাড়াচ্ছে। মুখে তিন গাল হাসি। পাশে দাঁড়িয়ে তার ফুটফুটে বউ। সে রুমাল দুলোচ্ছে।
.
০৬.
লক্ষ্মী ছেলে ডিটরিষ। তার মাঝারি সাইজের মোটরখানা এনেছে। আমার কোনও আপত্তি না শুনে বললে, আমি মালপত্রগুলো তুলে নিচ্ছি। আপনি ততক্ষণ বউয়ের সঙ্গে দুটি কথা কয়ে নিন। ও তো আপনাকে চেনে না। মেয়েটিকে বাড়ির কুশলাদি শুধোলুম। কিন্তু বড় লাজুক মেয়ে কয়েকদিন আগে দেশ পত্রিকায় যে সিগারেট-মুখী মডার্ন মেয়ের ছবি বেরিয়েছে তার ঠিক উল্টোটি। কোনও প্রশ্ন শুধোয় না। শুধু উত্তর দেয়। শেষটায় বোধহয় সেটা আবছা আবছা অনুভব করে একটি মাত্র প্রশ্ন শুধোলে, বন কি খুব বদলে গেছে? আমি অবশ্য প্রাচীন দিনের বন চিনিনে। আমার বাড়ি ছিল ক্যোনিষবের্গে।
সর্বনাশ! এবং পাঠক সাবধান।
ক্যোনিষবের্গ শহরটি এখন বোধহয় পোলান্ডের অধীন! ওইসব অঞ্চল থেকে লক্ষ লক্ষ নরনারী বাস্তুহারা সর্বহারা হয়ে পশ্চিমে জর্মনিতে এসেছে। তাদের বেশিরভাগই সে সব দুঃখের কাহিনী ভুলে যেতে চায়। কাজেই সাবধান! ওসব বাবদে ওদের কিছু জিগ্যেস করো না।
তবে এ তত্ত্বও অতিশয় সত্য যে মৌকামাফিক দরদ-দিলে যদি আপনি কিছু শুনতে চান তখন অনেক লোকেই, বিশেষ করে রমণীরা অনর্গল অবাধগতিতে সবকিছু বলে ফেলে যেন মনের বোঝা নামাতে চায়। বিশেষ করে বিদেশির সামনে। সে দু দিন বাদেই আপন দেশে চলে যাবে। ও যা বলেছিল সেটা নিয়ে খামোখা কোনও ঘোটলার সৃষ্টি হবে না। আমি তাই বেমালুম চেপে গিয়ে বললুম, ও! ক্যোনিষবের্গ। যেখানে এ যুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক কাট জন্মে ছিলেন। এবং শুনেছি তিনি নাকি ওই শহরের বারো না চোদ্দ মাইলের বাইরে কখনও বেরোননি। শহরটাকে এতই ভালোবাসতেন। ইতোমধ্যে ডিটরিষ স্টিয়ারিঙে বসে গেছে। এবং আমার শেষ মন্তব্যটা শুনেছে। বললে, ভালোবাসতেন না কচু। আসলে সব দার্শনিকই হাড়-আলসে। আমি বললুম, সে কথা থাক। তোর বউ শুধপাচ্ছিল, বন্ শহরটা কি খুব বদলে গেছে? তারই উত্তরটা দিই। বদলেছে, বদলায়ওনি।
তুমি, মামা, চিরকালই হেঁয়ালিতে কথা কও–
আমি বললুম, থাক, বাবা থাক। বাস্-এ এক বৃদ্ধ বিষয়টির অবতারণা করতে না করতেই মোকামে পৌঁছে গেলাম। আর এ তাবৎ দেখেছিই-বা কী?
***
বন শহরের নাম করলেই দেশি-বিদেশি সবাই বেটোফেনের নাম সঙ্গে সঙ্গে করে বটে, কিন্তু এ বৎসরে বিশেষভাবে করে। কারণ তাঁর দ্বিশত জন্মশতবার্ষিকী সম্মুখেই। ডিসেম্বর ১৯৭০-এ। এ শহর তাঁকে এতই সম্মান করে যে তার সুন্দর প্রতিমূর্তিটি তুলেছে তাদের বিরাটতম চত্বরে, তাদের বৃহত্তম এবং প্রাচীনতম না হলেও তারই কাছাকাছি প্রাচীন মনস্টার গির্জার পাশে। হয়তো তার অন্যতম কারণ, বেটোফেন ছিলেন সর্বান্তকরণে ঈশ্বরবিশ্বাসী। শুধু তাঁর সংগীত নয়, তাঁর বাক্যালাপে চিঠিপত্রে সর্বত্রই তাঁর ঈশ্বরে পরিপূর্ণ বিশ্বাস, প্রভুর পদপ্রান্তে তার ঐকান্তিক আত্মনিবেদন বার বার স্বপ্রকাশ।
সেখান থেকে কয়েক মিনিটের রাস্তা– ছোট গলির ছোট্ট একটি বাড়ির ছোট্ট একটি কামরায়, যেখানে তার জন্ম হয়। বাড়ির নিচের তলায় বেটোফেন মিউজিয়ম। সেখানে তার ব্যবহৃত অনেক কিছুই আছে, যেমন ইয়াসনা পলিয়ানাতে তলস্তয়ের বৃহত্তর, সম্পূর্ণতর, কারণ সেটা দেড়শো বছর পরের কথা এবং অসম্পূর্ণতম রবীন্দ্রনাথের উত্তরায়ণে, যদ্যপি সেটা তলস্তয়ের প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে।…
কিন্তু সেখানে সবচেয়ে মর্মস্পর্শী বেটোফেনের কানের চোঙাগুলো। বত্রিশ বত্সর বয়স থেকেই তিনি ক্রমে ক্রমে কালা হতে আরম্ভ করলেন। বিধাতার এ কী লীলা! বীণাপাণির এই অংশাবতার আর তার বীণা শুনতে পান না। তখন তিনি আরম্ভ করলেন ওইসব কানের চোঙা ব্যবহার করতে। পাঠক, দেখতে পাবে, তার বধিরতা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যেমন বাড়তে লাগল সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চোঙার সাইজও বাড়তে লাগল। তাতে করে তার কোনও লাভ হয়েছিল কি না বলা কঠিন। তবে এটা জানি, তার কিছুকাল পরে, যখন তাঁর সঙ্গীতপ্রেমী কোনও সহচর বলতেন, বাহ্! কী মধুর সুরেলা বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছে রাখাল ছেলেটি, আর তিনি কিছুই শুনতে পেতেন না তখন বেটোফেন বলতেন, তিনি তনুহর্তেই আত্মহত্যা করতেন যদি-না তাঁর বিশ্বাস থাকত যে সঙ্গীতে এখনও তার বহু কিছু দেবার আছে। আমাদের শ্রীরাধা যেরকম উদ্ধবকে বলেছিলেন, যদি-না আমার বিশ্বাস থাকত, প্রভু একদিন আমার কাছে ফিরে আসবেন, তা হলে বহু পূর্বেই আমার মৃত্যু হয়ে যেত। এবং সকলেই জানেন, বদ্ধ কালা হয়ে যাওয়ার পরও বেটোফেন মনে মনে সঙ্গীতের রূপটি ধারণ করে বহুবিধ স্বর্গীয় রচনা করে গেছেন। যেগুলো তিনি স্বকর্ণে শুনে যেতে পাননি। আমি যেন কোথায় পড়েছি, তিনি সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে করুণ আবেদন জানাচ্ছেন, প্রভু যেন তাঁকে একবারের মতো তার শ্রুতিশক্তি ফিরিয়ে দেন যাতে করে তিনি মাত্র একবারের তরে আপন সৃষ্ট সঙ্গীত শুনে যেতে পান। তার পর তিনি সধন্যান্তঃকরণে পরলোকে যেতে প্রস্তুত।
চিন্তাসস্রাতে বাধা পড়ল। ডিটরিষ শুধাল, মামা, কথা কইছ না যে!
বললুম, আমি ভাবছিলুম বেটোফেনের কানের চোঙাগুলোর কথা। ওগুলো সত্যি কি তার কোনও কাজে লেগেছিল?
ডিটরিষ বললে, বলা শক্ত। কোনও কোনও আধাকালা একখানা কাগজের টুকরো দু পাটি দাঁত দিয়ে চেপে ধরে কাগজের বেশিরভাগটা মুখের বাইরে রাখে। ভাবে, ধ্বনিতরঙ্গ ওই কাগজকে ভাইব্রেট করে দাঁত হয়ে মগজে পৌঁছোয়, কিংবা কান হয়ে। কেউ-বা সামনের দু-পাটির চারটি দাঁত দিয়ে লম্বা একটা পেনসিল কামড়ে ধরে থাকে। কী ফল হয় না হয় কে বলবে?… আচ্ছা, মামু, তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ, কী রকম অদ্ভুত, প্রিমিটিভ মিনি সাইজের যন্ত্র দিয়ে তিনি তার বিচিত্র সঙ্গীত রচনা করেছিলেন? আমার কাছে আশ্চর্য লাগে।
আমি বললুম, কেন বত্স, ওই যে তোমার ছোট পিসি, যার সঙ্গে আমার চল্লিশ বছরের বন্ধুত্ব, লিজেল– দেখেছ, ঝড়তি-পড়তি কয়েক টুকরো লেটিসের পাতা, আড়াই ফোঁটা নেবুর রস আর তিন ফোঁটা তেল দিয়ে কীরকম সরেস স্যাল্যাড তৈরি করতে পারে? মুখে দিলে যেন মাখন!!… আর তোর-আমার মতো আনাড়িকে যাবতীয় মশলাসহ একটা মোলায়েম মুরগি দিলেও আমরা যা রাঁধব সেটা তুইও খেতে পারবিনে, আমিও না। পিসি লিজেল কী বলবে, জানিনে। অথচ জানিস ওই অভুক্ত মুরগিটি তাকে তখন দিয়ে দে। তিনি সেটাকে ছোট ছোট টুকরো করে যাকে ফরাসিরা বলে রাও ফাঁরা ফ্রিকা অর্থাৎ লম্বা লম্বা/ ফালি-ফালি করে কেটে, মুরগিটাতে আমরা যেসব বদ রান্নার ব্যামো চাপিয়েছিলুম সেগুলো রাইনের ওপারে পাঠিয়ে এ্যামন একটি রান্না করে দেবেন যে, প্যারিসের শ্যাফত আমরি আমরি বলতে বলতে তরিয়ে তরিয়ে খাবে… প্রকৃত গুণীজন যা কিছুর মাধ্যমে যা কিছু সৃষ্টি করতে পারেন। আমাদের দেশে একরকম বাদ্যযন্ত্র আছে। একতারা তার নাম। তাতে একটিমাত্র তার। তার দু দিকে দুটি ফ্লেক্সিবল বাঁশের কৌশল আছে। সে দুটোতে কখনও হাল্কা চাপ দিয়ে তার মাঝখানের তারটাকে প্লাক করে নাকি বিয়াল্লিশ না বাহান্নাটা নোট বের করা যায়। তবেই দ্যাখ। বেটোফেনের মতো কটা লোক পৃথিবীতে আসে আমাদের দেশেও গণ্ডায় গায় তানসেন জন্মায় না। যদিও আমাদের দেশ তোদর দেশের চেয়ে বিস্তর বিরাটতর, এবং সেখানে কলাচর্যা আরম্ভ হয়েছিল অন্তত চার হাজার বছর পূর্বে। এবং আমাদের কলাজগতে আমরা এখন সাহারাতে এবং–
ডিটরিষ বললে, তুমি আমাদের পার্লামেন্ট হাউসটা দেখবে না? রাইনের পারে। আমি একটু ঘুরপথে যাচ্ছি। সোজা পথে গেলে দু-পাঁচ মিনিট আগে বাড়ি পৌঁছতুম।
দ্যাখ ডিটরিষ, তোর পিসি নিশ্চয়ই বিস্তর কেক পেট্র আমাদের জন্য বানিয়ে বসে আছে।
ডিটরিষের বউ বললে, মামা, শুধু কেক পেসট্রি বললেন। ওদিকে পিসি কী কী বানিয়ে বসে আছেন, জানেন? ক্যেনিসবের্গের ক্লপসে (ক্যানিসবের্গ শহরের একরকম কাতা), ফ্রাঙ্কফুর্টের সসিজ, হানোফারের ষাঁড়ের ন্যাজের শুরুয়া
আমি বাধা দিয়ে বললুম, সে তো জানি। কিন্তু লিজেল পিসি আমার জন্যে কি ক্যাঙারুর ন্যাজের শুরুয়া তৈরি করেছে?…
দু জনাই তাজ্জব। আমি বললুম, সঁড়ের ন্যাজের ভিতর থাকে চর্বি এবং মাংস। তার একটা বিশেষ স্বাদ থাকে। কিন্তু ষাঁড়ের ন্যাজ আর কতটুকু লম্বা? তার চেয়ে ক্যাঙারুর ন্যাজ ঢের ঢের বেশি। ওটা যদি পাঁচজনকে খাওয়ানো যায় তবে বিস্তর কড়ি সাশ্রয় হয়।
ঘ্যাঁচ করে গাড়ি থামল।
এটা কী রে? মনে হয়, গোটা আষ্টেক বিরাট বিস্কুটের টিন একটার উপর আরেকটা বসিয়ে দিয়েছে। বললুম আমি।
ডিটরিষ বললে, এটাই আমাদের পার্লামেন্ট।
.
০৭.
যাকে বলে মডার্ন আর্ট, পিকাসো উপস্থিত যার পোপস্য পোপ, সেই পদ্ধতিটি জর্মনরা কখনও খুব পছন্দ করেনি। কাইজার দ্বিতীয় ভিলহেলম যাকে এখনও মার্কিনিংরেজ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী করে, তিনি ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে আর্ট এবং আর্টের আদর্শ সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা দেন। তাঁর বক্তব্য ছিল : আর্ট হবে সমাজসেবক, রাষ্ট্রসেবক, আর্ট মানুষের দুঃখদৈন্যের ছবি না এঁকে আঁকবে এমন ছবি, কম্পোজ করবে এমন সঙ্গীত, রচনা করবে এমন সাহিত্য যাতে মানুষ আপন পীড়াদায়ক পরিস্থিতি ভুলে গিয়ে আনন্দসায়রে নিমজ্জিত হবে। আজকের দিনে আমরা এটাকে নাম দিয়েছি এসকেপিজম পলায়নমনোবৃত্তি। বলা বাহুল্য জর্মন আর্টিস্ট সাহিত্যিক সঙ্গীতস্রষ্টা– কাইজারের এই পথনির্দেশ খবরের কাগজে পড়ে স্তম্ভিত হন। তা হলে আর্টিস্টের কোনও স্বাধীন সত্তা নেই! সে তার আপন সুখ দুঃখ, আপন বিচিত্র অভিজ্ঞতা, আপন হৃদয়ের উপলব্ধি, ভবিষ্যতের আশাবাদী চিত্র অঙ্কন করতে পারবে না। সে তা হলে রাষ্ট্রের ভাঁড়, ক্লাউন! তার একমাত্র কর্তব্য হল জনসাধারণকে কাতুকুতু দিয়ে হাসানো!
কিন্তু জর্মন জনসাধারণ কাইজারের কথাই মেনে নিল। এটা আমার ব্যক্তিগত মত নয়। এই পরিস্থিতিটা বোঝাতে গিয়ে প্রখ্যাত জর্মন সাংবাদিক, সাহিত্যিক, দার্শনিক শ্ৰীযুক্ত যোখিম বেসার বলেছেন, জর্মন মাত্রই উপরের দিকে তাকায়; রাজা কী হুকুম দিলেন সেই অনুযায়ী কাব্যে চিত্রে সঙ্গীতে আপন রুচি নির্মাণ করে।
১৯১৮-এ কাইজার যুদ্ধে হেরে হল্যান্ডে পলায়ন করলেন।
তখন সত্য সত্য আরম্ভ হল মডার্ন আর্টের যুগ। যেন কাইজারকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করার জন্য আর্টিস্টরা আরম্ভ করলেন রঙ নিয়ে নিত্য নব উন্মাদ নৃত্য, ধ্বনি নিয়ে সঙ্গীতে তাণ্ডব একসপেরিমেন্ট, ভাস্কর্যে বিকট বিকট মূর্তি যার প্রত্যেকটাতেই থাকত একটা ফুটো (তার অর্থ বোঝাতে গেলে পুলিশ আমাকে জেলে পুরবে)। আমি ওই সময়ে জর্মনিতে ছিলুম। মডার্নদের পাল্লায় পড়ে একদিন একটা চারুকলা প্রদর্শনী দেখতে গিয়ে একলক্ষে পুনরপি বেরিয়ে এসেছিলুম। একদা যে রকম কোনও এক জু-তে বোকা পাঁঠার খাঁচার সামনে থেকে বিদ্যুৎগতিতে পলায়ন করেছিলুম। বোটকা গন্ধে।
তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, সেখানে উত্তম দ্রষ্টব্য কিছুই ছিল না। নিশ্চয়ই ছিল। রাস্তার ডাস্টবিন খুঁজলে কি আর খান দুই লুচি, একটা আলুর চপ পাওয়া যায় না? কিন্তু আমার এমন কী দায় পড়েছে।
এর পর ১৯৩৩-এ এলেন হিটলার। তাঁর কাহিনী সবাই জানেন। কিন্তু আর্ট সম্বন্ধে তাঁর অভিমত সবাই হয়তো জানেন না; তাই সংক্ষেপে নিবেদন করছি। হিটলার সর্বক্ষণ কাইজারকে অভিসম্পাত দিতেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, কাইজার যদি কাপুরুষের মতো হার না মেনে লড়ে যেতেন তবে জর্মনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করতই করত।… অথচ আর্ট সম্বন্ধে দেখা গেল হিটলার-কাইজার সম্পূর্ণ একমত পোষণ করেন। তিনি কঠিনতর কণ্ঠে উচ্চৈঃস্বরে বারবার বলে যেতে লাগলেন, আর্ট হবে সমাজের দাস, অর্থাৎ নাৎসিদের দাস। সূর্যনিম্নে এই পৃথ্বীতলে তারা যে ন্যায়সম্মত আসন খুঁজছে তারই সেবা করবে আর্টিস্টরা।
কাইজারের চরম শত্রুও বলবে না তিনি অসহিষ্ণু লোক ছিলেন। তাঁর আমলে তার নির্দেশ সত্ত্বেও যারা মডার্ন ছবি আঁকত তাদের বিরুদ্ধে তিনি কোনও প্রকারেরই কোনও কিছু করেননি।
কিন্তু হিটলার চ্যানসেলার হওয়ার পর আরম্ভ হল এদের ওপর নির্যাতন। উত্তম উত্তম ছবি, নব নব সঙ্গীত ব্যান করা হল। সেরা সেরা পুস্তক পোড়ানো হল– কারণ এগুলো নাৎসি সঙ্গীতের সঙ্গে এক সুরে এক গান গায় না। আমি দূর থেকে এরকম একটা অগ্নিযজ্ঞ দেখেছিলুম। কাছে যাইনি। পাছে প্রভুরা আমার রঙ দেখে আমাকে ইহুদি ঠাউরে আমার নাকটা না কেটে দেন। যদিও আমার নাকটি খাঁটি মঙ্গোলিয়ন। খাটো, বেঁটে, হ্রস্ব। কিন্তু বলা তো যায় না।
হিটলার তার সাধনোচিত ধামে গেছেন। এখন জর্মনরা উঠে-পড়ে লেগেছেন মডার্ন হতে। চোদ্দতলা বাড়ি ভিন্ন অন্য কথা কয় না।
তাই এ বিস্কুটটিন-পারা পার্লিমেন্ট।
***
ডিটরিষকে বললুম, জানো ভাগিনা, আমাদের দেশেও এ ধরনের স্থাপত্য হুশ হুশ করে আকাশ পানে উঠেছে। তারই এক আর্কিটেকটু এসেছেন আমাদের সঙ্গে তাস খেলতে। ভদ্রলোক দেশলাই খোঁজেন।… খেলা শেষ হল। তখন কেন জানিনে তিনি তার দেশলাই আর খুঁজে পান না। আমাদের এক রসিক বন্ধু বসে বসে খেলা দেখছিল। সে দরদী কণ্ঠে বললে, দাদাদের কাছে আমার অনুরোধ, আর্কিটেকটু মশায়ের মডেলটি তোমরা কেউ গাপ মেরো না। দেশলাইটির মডেল থেকে তো তিনি হেথাহেথা সর্বত্র বিয়াল্লিশ তলার বিলডিং হাঁকাচ্ছেন! ওটা গায়েব হলে ওয়ার রুটি মারা যাবে যে।
ডিটরিষ বললে, জানো মামু, আমাদের বিশ্বাস প্রাচ্যদেশীয়রা বড়ই সিরিয়াস। সর্বক্ষণ শুমড়ো মুখ করে লর্ড বুদ্ধের মতো আসন নিয়ে শুধু আত্মচিন্তা মোক্ষানুসন্ধান করে। তারাও যে রসিকতা করে এ কথা ৯৯.৯% জর্মন কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। অথচ তোমার এই বন্ধুটির রসিকতাটি শুধু যে রসিকতা তাই নয়। ওতে গভীর দর্শনও রয়েছে। মডার্ন আর্কিটেকচার সম্বন্ধে মাত্র ওই একটি দেশলাই দিয়ে তিনি তার তাচ্ছিল্য সিনিসিজমসহ প্রকাশ করলেন কী সাতিশয় সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে। ভদ্রলোক কি তোমার মতো লেখেন-টেখেন– লিতেরাত্যের?।
আমি বললুম, তওবা, তওবা! ভদ্রলোক ছিলেন আমাদের ফরেন অফিসের ডেপুটি মিনিস্টার; পণ্ডিত নেহরুর সহকর্মী। খুব বেশিদিন কাজ করেননি। ওইসব দার্শনিক সিনি রসিকতা তিনি সর্বজনসমক্ষে প্রকাশ করতেন তার ভিন্ন ভিন্ন সহকর্মী মন্ত্রীদের সম্বন্ধে। ঠিক পপুলার হওয়ার পন্থা এটা নয়– কী বলো? কাজেই তিনি যখন ফরেন অফিস থেকে বিদায় নিলেন তখন আমি বলেছিলুম, তিনি মন্ত্রীমণ্ডলী থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে বিদায় নেবার সময় উল্লাসে নৃত্য করলেন এবং মন্ত্রীমণ্ডলীও তার থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে উল্লাসে নৃত্য করলেন।
ডিটরিষ চুপ। আমি একটু অবাক হলুম। সে তো সব সময়ই জুম্মাফিক উত্তর দিতে পারে।
সে বললে, আমার অবস্থাও তাই। যে অফিসে আমি কাজ করি সেটা থেকে বেরুতে পারলে আমিও খুশি হই; ওরাও খুশি হয়।
.
০৮.
ওই তো সামনে গোডেসবের্গ। ডিটরিষ শুধোলে, মামু, পিসি বলছিল তুমি নাকি এই টাউনটাকে জর্মনির সর্ব জায়গার চেয়ে বেশি ভালোবাস? কেন বলো তো।
আমি মুচকি হেসে কইলুম, যদি বলি তোর পিসির সঙ্গে হেথায় আমার প্রথম প্রণয় হয়েছিল বলে?
ডি। ধ্যত! আমি ছেলেবেলা থেকেই লক্ষ করেছি, লিজেল পিসির ধ্যানধর্ম শুধু কাজ আর কাজ। ফাঁকে ফাঁকে বই পড়া। এবং সে বইগুলোও দারুণ সিরিয়াস। বড় পিসি বরঞ্চ মাঝে মাঝে হালকা জিনিস পড়ত। কিন্তু ছোট পিসি ওসবের ধার ধারত না। সে যেত প্রতি প্রভাতে ট্রামে চড়ে বন শহরে যেখানে সে চাকরি করত।
আমি। সেই সূত্রেই তো আমাদের পরিচয়। আমো ওই সকাল আটটা পনেরোর ট্রামে বন্ যেতুম। আমরা আর সবাই দু তিনটে সিঁড়ি বেয়ে ট্রামে উঠতুম। আর লিজেল পিসি ডান হাতে একখানা বই আর বাঁ হাতে ট্রামের গায়ে সামান্যতম ভর করে সিঁড়িগুলোকে তাচ্ছিলি করে এক লঞ্চে উঠত ট্রামের পাটাতনে। উঠেই একগাল হেসে ডাইনে-বাঁয়ে সমুখ পানে তাকিয়ে বলত শুটেন মরগেন সুপ্রভাত। ওর ওই লম্ফ মেরে ওঠার কৌশল দেখে আমি মনে মনে বলতুম, একদম টম বয়! ওর উচিত ছিল মার্কিন মুল্লুকে কাউ বয় হয়ে জন্ম নেবার। অথবা ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুঈন গুরুদেবের ভাষায়।
গোডেসবের্গ তখন অতি ক্ষুদ্র শহর। সবাই সবাইকে চেনে। কিন্তু আসল কথা, ওই আটটা পনেরোর ট্রামে থাকত পনেরো আনা কাচ্চাবাচ্চা। ইস্কুলে যাচ্ছে বন শহরে। এরা সবাই জানত যে লিজেল পিসির, অবশ্য কখনও তিনি পিসি খেতাব পাননি, কাছে আছে লেবেনচুস, দু একটা আপেল, হয়তো নবাগত মার্কিন চুইংগাম, মাঝে-মধ্যে চকলেট। কাজেই বাচ্চারা সমস্বরে, কোরাস কণ্ঠে বলত, অন্তত বার তিনেক সুপ্রভাত–। তার পর সবাই তার চারপাশে ঘিরে দাঁড়াত। সবাই বলত, প্লিজ, এজ্ঞে, এই এখানে বসুন।
আমি বললুম, বুঝলি ডিটরিষ, তোর পিসি লিজেল ছিল আমাদের হিরইন অব দ্য প্লে। তবে ঠিকই বলেছিস ও কখনও প্রেম-ফ্রেমের ধার ধারত না। আমি দু একবার তার সঙ্গে হাফাহাফি ফ্লার্ট করতে গিয়ে চড় খেয়েছি। অথচ আমাদের মধ্যে প্রতিবন্ধুত্ব ছিল গভীর। আমাকে কত কী-না খাইয়েছে ওই অল্প বয়সেই বেশ দু পয়সা কামাত বলে। তখনকার দিনে ছিল– এখনও নিশ্চয়ই আছে– একরকমের বেশ মোটা চকলেট– ভিতরে কন্যাক। বড় আক্রা। কিন্তু খেতে– ওহ! কী বলব–মুখে ফেলে সামান্য একটু চাপ দাও। ব্যস হয়ে গেল। ভিজে ভিজে চকলেট আর তরল কন্যা মিশে গিয়ে, দ্যাখ তো না দ্যাখ, চলে গেল একদম পেটের পাতালে। কিন্তু যাবার সময় ওই যে কন্যাক– তোরা যাকে বলিস ব্র্যানটভাইন, ইংরেজিতে ব্র্যান্ডি, নাড়িভূঁড়ির প্রতিটি মিলিমিটার মধুর মধুর চুলবুলিয়ে বুঝিয়ে দিত, যাচ্ছেন কোন মহারাজ!… আর মনের মিলের কথা যদি তুলিস তবে বলব, লিজেল ছিল বড়ই লিবরেল। তাই যদিও নাৎসিরা তখনও ক্ষমতা পায়নি কিন্তু রাস্তাঘাটে দাবড়াতে আরম্ভ করেছে- পিসি সেটা আদৌ পছন্দ করত না। আমিও না। কিন্তু সত্যি বলতে কি, ইংরেজ যে ইতোমধ্যেই হিটলার বাবদে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে সেটা আমার চিত্তে পুলক জাগাত। পিসিও সেটা জানত। ভারতবর্ষের পরাধীনতার কথা উঠলেই সে ব্যথা পেত। বলত, ও কথা থাক না। ওরকম দরদী মেয়ে চিনতে পারার সৌভাগ্য আমি ইহসংসারে অতি অল্পই পেয়েছি।
হঠাৎ লক্ষ করলুম ভাগিনা ডিটরিষ কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছে। শুধোলুম, কী হল রে? তুই কি পরশুদিনের হাওয়া খেতে চলে গিয়েছিস?
কেমন যেন বিষপ্ত কণ্ঠে ভেজা ভেজা গলায় সে বললে, মামা, তুমি বোধহয় জানো না, আমার বাবা অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সে ওপারে চলে গেল কী করে।
ডিটরিষের এখন যৌবনকাল। তার বাপ কেন, ঠাকুন্দাও বেঁচে থাকলে আশ্চর্য হবার মতো কিছু ছিল না। বললুম, আমি তো জানিনে ভাই। কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, আবার হচ্ছেও না। কারণ তোর গলাটা কী রকম যেন ভারী ভারী শোনাচ্ছে।
তুমি এইমাত্র বললে না, তুমি-পিসি দু জনাই নাৎসিদের পছন্দ করতে না। বস্তৃত পিসি পরিবারের কেউই নাৎসি ছিল না। যদিও আমি তোমার বান্ধবীকে পিসি বলে পরিচয় দিয়েছি, আসলে তিনি আমার মাসি। তারা তিন বোন। আমার মা সকলের ছোট। তিনি বিয়ে করলেন এক নাৎসিকে কট্টর নাৎসিকে। কেন করলেন জানিনে। প্রেমের ব্যাপার। তবে হ্যাঁ, চিন্তাশীল ব্যক্তি ছিল। বাড়ি গিয়ে তোমাকে তার ডাইরিটি দেখাব। আর চেহারাটি ছিল সুন্দর
বাধা দিয়ে বললুম, সে তোর চেহারা থেকেই বোঝা যায়।
থ্যাঙ্কউ। আর বাবা ছিল বড্ডই সদয় হৃদয়
ভাগিনা, কিছু মনে করো না। আমি মোটেই অবিশ্বাস করি না যে তোর পিতা অতিশয় করুণ হৃদয়, শান্তস্বভাব ধরতেন– তোর দুই মাসিই সে কথা আমাকে বারবার বলেছে। আবার বলছি কিছু মনে করো না, তা হলে তিনি নাসিদের কনসানট্রেশন ক্যাম্প সয়ে নিলেন কী করে?
ডিটরিষ চুপ মেরে গেল। কোনও উত্তর দেয় না। আমি এবার, বহুবারের পর আবার, বুঝলুম যে আমি একটা আস্ত গাড়োল। এ রকম একটা প্রশ্ন করাটা আমার মোটেই উচিত হয়নি, বললুম, ভাগিনা, আমি মাফ চাইছি। আমি আমার প্রশ্নটার কোনও জবাব চাইনে। ওটা আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি।
ডিটরিষ বললে, না মামু। তুমি যা ভেবেছ তা নয়। আমি ভাবছিলুম, সত্যই তো, বাবা এগুলো বরদাস্ত করত কী করে? এবং আরও লক্ষ লক্ষ জর্মন? এই নিয়ে আমি অনেকবার বহু চিন্তা করেছি। তুমি জানো মার্কিনিংরেজ রুশ-ফরাসি নরেনবের্গ মোকদ্দমায় বার বার নাৎসিদের প্রশ্ন করেছে, তোমরা কি জানতে না যে হিটলার কনসানট্রেশন ক্যাম্পে লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে খুন করছে? উত্তরে সবাই গাইগুই করেছে। সোজা উত্তর কেউই দেয়নি। জানো তো যুদ্ধের সময় কত সেনসর কত কড়াকড়ি। কে জানবে কী হচ্ছে না হচ্ছে। আমার মনে হয়, আবার বলছি জানিনে, বাবার কানে কিছু কিছু পৌঁছেছিল। কিন্তু বাবা তখন উন্মত্ত। তিনি চান জর্মনির সর্বাধিকার। তার ডাইরিতে বারবার বহুবার লেখা আছে, ইংরেজ কে? সে যে বিরাট বিশ্ব শুষে খেতে চায় তাতে তার হক্কো কী? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই মানি, তারা যদি আমাদের কিংবা ফরাসিদের মতো কলচরড় জাত হত তবে আমরা এ নিয়ে কলই করতুম না। কিন্তু ইংরেজ জাতটাই তো বেনের জাত, তারা কলচারের কী বোঝে! ওদের না আছে মাইকেল এঞ্জেলো, না আছে বেটোফেন। আছে মাত্র শেকসপিয়ার। ওদের না আছে স্থাপত্য, না আছে ভাস্কর্য, না আছে–হঠাৎ বললে এই তো বাড়ি পৌঁছে গিয়েছি।
.
০৯.
–ডু হালুঙ্কে সোল্লাসে হুহুঙ্কার ছাড়ল শ্রীমতী লিজেল। তুই গুণ্ডা–
আমরা যেরকম কোনও দুরন্ত ছোট বাচ্চাকে আদর করে গুণ্ডা বলে থাকি, হালুঙ্কে তাই। শব্দটা চেক ভাষাতে জর্মনে প্রবেশ লাভ করেছে। গত চল্লিশ বছর ধরে দেখা হলেই লিজেল এইভাবেই আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছে।
তার পর আমাকে জাবড়ে ধরে দু গালে দুটো চুমো খেল।
ডিটরিষ মারফত পাঠককে পূর্বেই বলেছি লিজেল ছিল ন-সিকে টম-বয়। বরং দু একবার তার সঙ্গে হাফাহাফি ফ্লার্ট করতে গিয়ে চড় খেয়েছি। তবে এটা হল কী প্রকারে? শুচিবায়ুগ্রস্ত পদীপিসিরা ক্ষণতরে ধৈর্য ধরুন। বুঝিয়ে বলছি। এই ষাট বছরে তার কি আর টমবয়তু আছে? এখন আমাকে জাবড়ে ধরে আলিঙ্গন করাতে সে শুধু তার অন্তরতম অভ্যর্থনা জানাল।
আমি মনে মনে বললুম, চল্লিশ বছর ল্যাটে, চল্লিশ বছর ল্যাটে। এই আলিঙ্গন-চুম্বন চল্লিশ বছর পূর্বে দিলেই পারতে, সুন্দরী। পরে তাকে খুলেও বলছিলুম।
ইতোমধ্যে ডিটরিষ আমতা আমতা করে বললে, আমরা তা হলে আসি। রাত্রের পার্টিতে দেখা হবে।
ওরা পাশেই থাকে। তিন মিনিটের রাস্তা। ওদের ভাব থেকে বুঝলুম, ওরা মনে করছে বিদ্যা ও সুন্দর যখন বহু বছর পর সম্মিলিত হয়ে গেছেন তখন ওদের কেটে পড়াই ভালো। আমাদের প্রেমটি যে চিরকালই নির্জলা জল ছিল সেটি হয়তো তারা গলা দিয়ে নাবাতে পারেনি– হজম করা তো দূরের কথা।
লিজেল আমাকে হাতে ধরে ড্রইংরুমের দিকে নিয়ে চলল। আমি বললুম, এ কী আদিখেতো! চল্লিশ বছর ধরে যখনই এ বাড়িতে এসেছি তখনই আমরা বসেছি বাবা, মা, বড়দি, তুমি, ছোড়দি রান্নাঘরে। অবিশ্যি মা রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আজ কেন এ ব্যত্যয়? তদুপরি বিরাট ড্রইংরুম। বাপস। তুই যদি এক কোণে বসিস আর আমি অন্য কোণে, তা হলে একে অন্যকে দেখবার তরে জোরদার প্রাশান মিলিটারি দুরবিনের দরকার হবে; কথা কইতে হলে আমাদের দেশের ডাকহরকরা, নিদেন একটা ট্রাংককল ফোন ব্যবস্থা, আর।
লিজেল সেই প্রাচীন দিনের মতো বললে, চোকোর চোককোর। তুই চিরকালই বড্ড বেশি বকর বকর করিস।
গতি পরিবর্তিত হল। আমরা শেষ পর্যন্ত রান্নাঘরেই গেলুম।
.
কিচেনের এক প্রান্তে টেবিল, চতুর্দিকে খান ছয় চেয়ার। অন্য প্রান্তে দুটো গ্যাসউনুন, তৃতীয়টা কয়লার (সেটা খুব সম্ভব প্রাচীন দিনের ঐতিহ্য রক্ষার্থে)। দুই প্রান্তের মাঝখানে অন্তত দশ কদম ফাঁক। অর্থাৎ কিচেনটি তৈরি করা হয়েছে দরাজ হাতে। বস্তুত লিজেলের মা যখন রাঁধতেন তখন এ প্রান্ত থেকে আমাকে কিছু বলতে হলে বেশ গলা উঁচিয়ে কথা কইতে হত।
লিজেল একটা চেয়ার দেখিয়ে বললে, এটাতেই বস।
সত্যি বলছি, আমার চোখে জল এল। কী করে লিজেল মনে রেখেছে যে, চল্লিশ বৎসর পূর্বে (তিনি গত হয়েছেন বছর আটত্রিশেক হবে) তার পিতা আমাকে ওই চেয়ারটায় বসতে বলতেন। আমি জানতুম, কেন। জানালা দিয়ে, ওই চেয়ারটার দিকে দূর-দূরান্তরের দৃশ্য সবচেয়ে ভালো দেখা যায়। পরে জানতে পেরেছিলুম, তিনি স্বয়ং ওই চেয়ারটিতে বসে আপন খেতখামারের দিকে এবং বিশেষ করে তার বিরাট আপেল বাগানের দিকে নজর রাখতেন– (মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে আমাদের যেরকম আমবাগান)। অবশ্যই তিনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে ভালোবাসতেন। নইলে ওখানে বসতে বলবেন কেন? আমি তো সেখান থেকে তার খেতখামার, আপেলবাগান তদারকি করতে পারব না যারা ঘোরাঘুরি করছে তারা তাঁর আপন মুনিষ না ভিনজন আমি ঠাহর করব কী প্রকারে? আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ? সে দিকে আমার কোনও চিত্তাকর্ষণ নেই। একদিন ওই শেষ কথাটি তাকে আস্তে আস্তে ক্ষীণ কণ্ঠে বলতে- যাতে অনন্যরা শুনতে না পায় তিনি বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে অতিশয় সুন্দর স্মিতহাস্যে বললেন, তোমরা ইন্ডিয়ান। তোমাদের দেশে এখনও কলকারখানা হয়নি। তোমরা এখনও আছ প্রকৃতির শিশু। শিশু কি মায়ের সৌন্দর্য বোঝে না। সে শুধু তার মায়ের স্তনরস চায়– সেই স্তনদ্বয়ের সৌন্দর্য কি সে বুঝে? যেমন তার বাপ বোঝে? ঠিক এরকম তোমরা তোমাদের মা-জননী জন্মভূমিতে খেতখামার করে খাদ্যরস আহারাদি গ্রহণ করো। তোমরা কী করে বুঝবে, নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বলতে কী বোঝায়? সেটা শুধু হয় যখন মানুষ কলকারখানার গোলাম হয়। অর্থাৎ মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর, বড় হয়ে সে তার মাতৃদুগ্ধের মূল্য বুঝতে শেখে–।
আমি বললুম, মানছি, কিন্তু দেখুন গ্রিস, রোম এবং আমার দেশ ভারতবর্ষেও তো কলকারখানা নির্মিত হওয়ার বহু পূর্বে উত্তমোত্তম কাব্য রচিত হয়েছিল এবং সেগুলোতেও বিস্তর প্রাকৃতিক নৈসর্গিক বর্ণনা আছে। তবে কেন-_
এসব কথাবার্তা যেন ওই চেয়ারে বসে কানে শুনতে পাচ্ছি। কত বৎসর হয়ে গেছে। এমন সময় লিজেল আমার মাথায় মারল একটা গাট্টা। আমার স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল। বিশেষ করে তার ঠাকুরমার ছবিটি।
কী খাবে বলছিলে?
আমি আশ্চর্য হয়ে উত্তর দিলুম, আমি তো কিছুই বলিনি।
তবে চলো, তুমি যে সুপ পছন্দ করতে সেই সুপই করেছি– অর্থাৎ পি সুপ (কলাইশুটির সুপ)- এবারে বলো তুমি কী খাবে? তুমি যা খেতে চাও তার জন্য মাছ, মাংস ক্রিম আছে।
আমি বললুম, দিদি, সুপ ছাড়া আমার অন্য কোনও জিনিসের প্রয়োজন নেই। আর এই জর্নিতে আমার সর্বাঙ্গ অসাড়।… তবে কি না আমি বঙ্গসন্তান। হেথায় ডান পাশে রাইন নদী। সে নদীর উত্তম উত্তম মাছ খেয়েছি কত বৎসর ধরে। তারই যদি একটা কিছু–
বেচারি লিজেল!
শুকনো মুখে বললে, রাইনে তো আজকাল আর সে মাছ নেই।
আমি শুধোলুম, কেন?
বললে, রাইন নদের জাহাজের সংখ্যা বড্ড বেশি বেড়ে গিয়েছে। তাদের পোড়ানো তেল তারা ওই নদীতে ছাড়ে। ফলে নদীর জল এমনই বিষে মেশা হয়ে গিয়েছে যে, মাছগুলো প্রায় আর নেই। আমার কাছে যেসব মাছ আছে সেগুলো টিনের মাছ।
আমি বললুম, তা হলে থাক।
.
১০.
বিনু যখন সোয়ামির সঙ্গে ট্রেনে করে যাচ্ছিল তখন বললে, আহা ওরা কেমন সুখে আছে। আমরাও ভাবি ইংরেজ ফরাসি জর্মন জাত কী রকম সুখে আছে। কিন্তু ওদের দুঃখও আছে। তবে আমাদের মতো ওদের দুঃখ ঠিক একই প্রকারের নয়। ওরা খেতে পায়, আশ্রয় আছে। তৎসত্ত্বেও ওদের দুঃখ আছে।
লিজেলদের বাড়ি প্রায় দুশো বছরের পুরনো। সে আমলে স্টিল-সিমেন্টের ব্যাপার ছিল না। বাড়িটা মোটামুটি কাঠের তৈরি। দুশো বছর পর ছাদটা নেমে আসছে। এটাকে বাড়া রাখা যায় কী প্রকারে।
আমি জিগ্যেস করলুম, লিজেল, এটাকে কি মেরামত করা যায় না?
লিজেল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, শুধু ছাদ নয়, দেয়ালগুলো ঝুরঝুরে হয়ে এসেছে। এ বাড়ি মেরামত করতে হলে কুড়ি হাজার মার্ক (আমাদের হিসাবে চল্লিশ হাজার টাকারও বেশি) লাগবে। বাবা গেছেন, আমার কোনও ভাইও নেই। খেতখামার দেখবে কে? আপেলবাগানটা পর্যন্ত বেচে দিয়েছি। তাই স্থির করেছি বাড়িটা সরকারকে দিয়ে দেব। ওরা সব পুরনো বাড়ির কিছু কিছু বাঁচিয়ে রাখতে চায়। কারণ এ বাড়িটির স্টাইল এক্কেবারে খাঁটি রাইনল্যান্ডের।
আমি বললুম, এটা মর্টগেজ করে টাকাটা তোলো না কেন?
লিজেল বললে, যে টাকাটা কখনও শোধ করতে পারব না সে টাকা ধার করব কী করে!
আমার মনে গভীর দুঃখ হল। বাড়িটি সত্যিই ভারি সুন্দর। শুধু বাড়িটি নয়, তার পেছনে রয়েছে ফল-ফুলের বাগান, তরিতরকারির ব্যবস্থা, কুয়ো, হ্যান্ডপাম্প দিয়ে জল তোলার ব্যবস্থা গ্রামাঞ্চলে উত্তম ব্যবস্থা। খেতখামার গেছে যাক। ওদের আপেলবাগান এই অঞ্চলে বৃহত্তম এবং শ্রেষ্ঠতমও ছিল। সে-ও গেছে যাক। কিন্তু এই সুন্দর বাড়িটি সরকারের হাতে তুলে দিতে হবে, এটা আমার মন কিছুতেই মেনে নিতে চাইল না।
ইতোমধ্যে লিজেলের ঘোট বোন মারিয়ানা এল। তিন বোনের ওই একমাত্র যার বিয়ে হয়েছিল। যে ডিটরিষ আমাকে নিয়ে যাবার জন্য বন-এ এসেছিল তার মা। ছেলের বাড়ি দু মিনিটের রাস্তা। সেখানে বউ নিয়ে থাকে।
মারিয়ানা বিধবা। প্রায় সাতাশ বছর পূর্বে তার বিয়ে হয়। বরটি ছিল খাসা ছোকরা কিন্তু…
এ বাড়ির তিন বোনের কেউই নাৎসি ছিল না। এরা সবাই ধর্মভীরু ক্যাথলিক। ইহুদিরা প্রভু খ্রিস্টকে হয়তো ক্রুশবিদ্ধ করেছিল। হয়তো করেনি। যাই হোক, যাই থাক, তাই বলে দীর্ঘ, সুদীর্ঘ, সেই ঘটনার দু হাজার বছর পর ওদের দোকানপাট, ভজনালয়, ওদের লেখা বইপত্র পুড়িয়ে দেবে (মহাকবি হাইনরিষ হাইনের কবিতাও বাদ যায়নি), ইহুদি ডাক্তার, উকিল প্রাকটিস করতে পারবে না– এটা ওরা গ্রহণ করতে পারেনি। এটা ১৯৩৪ সালের কথা। তখনও কনসানট্রেশন ক্যাম্প আরম্ভ হয়নি। যখন আরম্ভ হল তখন আমি দেশে। যুদ্ধ পুরোদমে শুরু হয়ে গিয়েছে। চিঠি-চাপাটির গমনাগমন সম্পূর্ণ রুদ্ধ। কিন্তু আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ ছিল না যে লিজেদের পরিবার এ প্রকারের নিষ্ঠুর নরহত্যা শুধু যে ঘৃণার চোখে দেখবে তাই নয়, এরা যে এর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারছে না সেটা তাদের মনকে বিকল করে দেবে। … এ সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমি জর্মনি যাই; তখন লিজেল আমাকে বলেছিল, ডু হালুঝে, তুই তো ভালো করেই চিনিস, আমাদের এই মুফেনডার্ফ গ্রাম। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের না হোক, জর্মনির ক্ষুদ্রতম গ্রাম। সেই হিসেবে আমরা প্রখ্যাততম গ্রাম। এখানে মাত্র একটা-দুটো ইহুদি পরিবার ছিল। দিদি সময়মতো ওদেরকে সুইটজারল্যান্ডে পাচার করে দিয়েছিল।
এবারে আরম্ভ হবে ট্রাজেডি।
মারিয়ানা বড় সরলা। এসব ব্যাপার নিয়ে আদৌ মাথা ঘামাত না। অবশ্য সে-ও ছিল আর দুই দিদির মতো পরদুঃখকাতর।
বিয়ে করে বসল এক প্রচণ্ড পাঁড় নাসিকে। কেন করল এ মুখকে শুধোবেন না। মেয়েরা কেন কার প্রেমে পড়ে, কেন কাকে বিয়ে করে– এ নিগূঢ় তত্ত্ব দেবতারাও আবিষ্কার করতে পারেননি।
তার পর যুদ্ধ লাগল। সেটা শেষ হল।
***
এইবারে মার্কিন-ইংরেজদের কৃপায় দেশের শাসনভার পেলে নাসিবৈরীরা। এঁরা খুঁজে খুঁজে বের করলেন নাৎসিদের। তখন আরম্ভ হল তাদের ওপর নির্যাতন। আজ ধরে নিয়ে যায়। তিন দিন তিন রাত্রির গারদে নির্জন কারাবাসের পর আপনাকে ছেড়ে দিল। আপনি ভাবলেন, যাক বাঁচা গেল। দশদিন যেতে না যেতে আবার ভোর চারটেয় আপনাকে গ্রেফতার করে ঠাসল গারদে। (এই যে আপনাকে ছেড়ে দিয়েছিল সেটা শুধু আপনার পিছনে গোয়েন্দা রেখে ধরবার জন্য কারা কারা আপনার সহকর্মী ছিল; কারণ স্বভাবতই আপনি তাদেরই সন্ধানে বেরোবেন। দ্বিতীয়ত এরা আপনার দরদী বন্ধু। আপনার দৈন্য-দুর্দিনে একমাত্র তারাই আপনাকে সাহায্য করবে– অবশ্য যদি তাদের দু পয়সা থাকে।…) এটা কিছু নবীন ইতিহাস নয়। আমাদের এই স্বদেশি আন্দোলনের সময়, পরবর্তী যুগে মহামান্য টেগার্ট সাহেবের আমলে
বারে বারে সহস্র বার হয়েছে এই খেলা।
দারুণ রাহু ভাবে তবু হবে না মোর বেলা ॥
সর্বশেষ মারিয়ানার স্বামীর তিন বছরের জেল হল। সেখানে যক্ষ্মা। বেরিয়ে এসে ছয় মাসের পরই ওপারে চলে গেল।
পাঠক ভাববেন না, আমি নাৎসিবৈরীদের দোষ দিচ্ছি।
বার বার শুধু আমার মনে আসছে : এদেশের প্রভু, প্রভু খ্রিস্ট আদেশ দিয়েছেন, ক্ষমা ক্ষমা, ক্ষমা।
জানি, মানুষ এত উঁচুতে উঠতে পারে না।
কিন্তু সেই চেষ্টাতে তো তার খ্রিষ্টত্ব, তার মনুষ্যত্ব।
.
১১.
হুররে, হুররে, হু্ররে।
কৈশোরে অবশ্য আমরা বলতাম, হিপস হিপস হুররে।
পুরোপাক্কা ক্রেডিট নিশ্চয়ই আর ইন্ডিয়া কোম্পানির। দীর্ঘ হাওয়াই মুসাফিরির পর অঘোরে ঘুমিয়েছিলাম সকাল আটটা অবধি। নিচে নামতেই লিজেন চেঁচিয়ে বললে, ভূ হালুঙ্কে। তোর হারানো সুটকেস ফিরে পাওয়া গিয়েছে।
কী করে জানলি?
আমাদের তো টেলিফোন নেই। চল্লিশ বছর আগে এই গডেসবের্গের যে বাড়িতে তুই বাস করতি তার টেলিফোন নম্বরটি তুই কলোনের হারানো প্রাপ্তির দফতরে সুবুদ্ধিমানের মতো দিয়ে এসেছিলি। আশ্চর্য! সে নম্বর তুই, পুতুপুতু করে এত বৎসর ধরে পুষে রেখেছিলি কী করে আর সেটা যে কলোনে সেই হারানো প্রাপ্তির দফতরে আপন স্মরণে এনে ওদের দিয়েছিলি সেটা আরও বিস্ময়জনক। তোর পেটে যে এত এলেম তা তো জানতুম না। আমি তো জানতুম তোর পশ্চাদ্দেশে টাইম বম রাখতে হয়। (আমরা বাংলায় বলি, পেটে বোম না মারলে কথা বেরোয় না), পিউজের হিসহিস শুনে তবে তোর বুদ্ধি খোলে। সে কথা থাক। কলোনের দফতর সেই নম্বরে ফোন করে, আর তোর সেই প্রাচীন দিনের ল্যান্ডলেডির মেয়ে আনা সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেল তুই আমাদের বাড়িতে উঠেছিস। তা ছাড়া যাবি আর কোন চুলোয়।
আনার বিয়ে হয়েছে এক যুগ আগে। ভাতার আর বাচ্চা দুটো রয়েছে। তাই সেখানে না উঠে আমাকে আপ্যায়িত করতে এসেছিস। ফের বলছি সে কথা থাক। আনা কিন্তু বুদ্ধিমতী মেয়ে।
আমি বাধা দিয়ে বললুম, হবে না কেন? আমি ওদের বাড়িতে ঝাড়া একটি বছর ছিলুম। আমার সঙ্গ পেয়েছে বিস্তর।
লিজেল আমার দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে কোনও মন্তব্য না করে বললে, সে জানে আমাদের টেলিফোন নেই। কিন্তু আমাদের পাশের বাড়ির মহিলার আছে। তাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে যে তোর সুটকেসটি পাওয়া গিয়েছে এবং কলোন দফতরে জমা পড়েছে।
আমি বললুম, সর্বনাশ। আমাকে এখন ঠ্যাঙস ঠ্যাঙস করে যেতে হবে সেই ধেড়ধেড়ে গোবিন্দপুর কলোন? আধাখানা দিন তাতেই কেটে যাবে। হেথায় এসেছি ক দিনের তরে? তারও নিরেট চারটি ঘণ্টা মেরে দিয়েছে জুরিচ। কনেকশনে ছিল না বলে। আমি।
লিজেল বাধা দিয়ে বললে, চল্লিশ বৎসর পূর্বে প্রাথমিক পরিচয়ে তোক যে একটা আকাট মূর্খ ঠাউরেছিলুম সেটা কিছু ভুল নয়, কলোনের দফতরে তোর প্র্যাকটিকাল বুদ্ধি ব্যত্যয়। অবশ্য আমি কখনও বলিনে একসেপশন ভজ দি রুল, আমি বলি ফুল ভজ দি একসেপশন। তোর সুটকেস তারাই এখানে পৌঁছে দেবে।
***
ওহ। কী আনন্দ, কাল রাত্রে ভয়ে ভয়ে আমি আমার হারিয়ে না যাওয়া বড় সুটকেসটি খুলিনি। যদি দেখি, এদের এবং আমার অন্যান্য বন্ধুবান্ধবের জন্য ছোটখাটো যেসব সওগাত এনেছি সেগুলো এই বড় সুটকেসটিতে নেই। এটাকেই নাকি বিদেশি ভাষায় বলে অসট্রিচ মনোবৃত্তি।
ইতোমধ্যে বাড়ির সদর দরজাতে ঘা পড়ল। লিজেল সেথায় গিয়ে কী যেন কথাবার্তা কইলে। মিনিট দুই পরে সেই হারিয়ে যাওয়া ফিরে পাওয়া সুটকেসটি নিয়ে এসে আমার সামনে রেখে বললে, তোদের অ্যার কোম্পানি তো বেশ স্মার্ট : কমপিটেনট। এত তড়িঘড়ি হুলিয়া ছেড়ে বাক্সটাকে ঠিক ঠিক পকড় কর তোর কাছে পৌঁছে দিলে। আমার ছাতি সুশীল পাঠক, ইঞ্চি ছয় মাফ করবেন, আজকাল নাকি তাবৎ মাপ সেন্টিমিটার মিলিমিটারে বলতে হয়– অর্থাৎ ১৫ মিলিমিটার (কিংবা সেন্টিমিটারও হতে পারে আমার প্রিনস অব ওয়েলস অর্থাৎ বড় বাবাজি যে ইসকেলখানা রেখে দিয়ে চলে গিয়েছেন সেটাতে তার হদিস মেলে না) ফুলে উঠল।
***
বাকসোটা খুলে দেখি, আমার মিত্র মিত্র যেসব বস্তু খাদি প্রতিষ্ঠান থেকে কিনে দিয়েছিল তার সবই রয়েছে (১) বারোখানা মুর্শিদাবাদি রেশমের স্কার্ফ, (২) উড়িষ্যার মোষের শিঙে তৈরি ছটি হাতি, (৩) পূর্ববৎ ওই দেশেরই তৈরি পিঠ চুলকানোর জন্য ইয়া লম্বা হাতল, (৪) দশ বান্ডিল বিড়ি (এগুলো অবশ্য লিজেল পরিবারের জন্য নয়, এগুলো আমার অন্য বন্ধুর জন্য), (৫) ভিন্ন ভিন্ন গরম মশলা এবং আচার (৬) বর্ধমানের রাজপরিবারের আমার একটি প্রিয় বান্ধবীর দেওয়া একখানি মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ্ম স্কার্ফ (তার শর্ত ছিল সেটি যেন আমি আমার সর্বশ্রেষ্ঠা বান্ধবীকে দিই), (৭) তিনটি স্কার্ফ ক্লাস বেনারসি রেশমের টাই, কাশ্মিরের ম্যাংগো ডিজাইনের শালের মতো ওগুলো বর্ধমানেরই দেওয়া, (৮) দুই পৌন্ড দক্ষিণ ভারতের কফি ও পূর্ববৎ ওজনে দার্জিলিঙের চা… এবং একখানা বই ঠাকুর রামকৃষ্ণ সম্বন্ধে তার এক বিশেষ পূজারিণীর জন্য, তিনি বাস করেন সুইটজারল্যান্ডে। আর কী কী ছিল ঠিক ঠিক মনে পড়ছে না। বেশ কিছু কান্দোও ছিল। এই ইয়োরোপিয়ানদের বড়ই দেমাক, তাদের মাস্টার্ড নিয়ে। দম্ভজনিত আমার উদ্দেশ্য ছিল, এদেরকে দেখানো যে আমাদের বাঙলা দেশের কাসুন্দো এ লাইনে অনির্বচনীয়, অতুলনীয়। পাউডার দিয়ে তৈরি ওদের মাস্টার্ড দু দিন যেতে না যেতেই মনে ধরে সবুজ হয়ে অখাদ্যে পরিবর্তিত হয়। আর আমাদের কাসুন্দো? মাসের পর মাস নির্বিকার ব্রহ্মের মতো অপরিবর্তনশীল।
ডিজেলকে বললুম, দিদি, এসব জিনিস ওই বড় টেবিলটার উপর সাজিয়ে রাখ। আর খবর দে ডিটরিষ ও তার বউকে। মারিয়ানা আর তুই তো আছিসই। যার যা পছন্দ তুলে নেবে।
লিজেল বললে, এটা কি ঠিক হচ্ছে এখান থেকে তুই যাবি ডুসলডফেঁসেখানে তোর বন্ধু পাউল আর বউ রয়েছে। তার পর যাবি হামবার্গে; সেখানে তোর বান্ধবীর (তিনি গত হয়েছেন। তিনটি মেয়ে রয়েছেন। তার পর যাবি স্টুটগার্ট-এ। সেখানে রয়েছেন তোর ফার্স্ট লভ। এখানেই যদি ভালো ভালো সওগাত বিলিয়ে দিস তবে ওরা পাবে কী?…
একেই বঙ্গভাষায় বলে পাকা গৃহিণী। কোন গয়না কে পাবে জানে।
.
১২.
গডেসবের্গ সত্যই বড় সুন্দর। এ শহরের সৌন্দর্য আমাকে বার বার আহ্বান করেছে। রাস্তাগুলো খুবই নির্জন। এতই নির্জন যে পথে কারও সঙ্গে দেখা হলে, সে সম্পূর্ণ অচেনা হলেও আপনাকে অভিবাদন জানিয়ে বলবে, গুটেন টাহ। আপনিও তাই বলবেন। রাস্তার দু পাশে ছোট ছোট গেরস্তবাড়ি। সবাই বাড়ির সামনে যেটুকু ফাঁকা জায়গা আছে তাতে ফুল ফুটিয়েছে। যদি কোনও বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আপনি ফুলগুলোর দিকে মুগ্ধনয়নে তাকিয়ে থাকেন তবে প্রায়ই বাড়ির কর্তা, কিংবা গিন্নি, কিংবা তাদের ছেলে-মেয়ের একজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আপনার সঙ্গে কথা জুড়ে বসবে। শেষটায় বলবে, আপনিও আমাদেরই একজন; কিছু ফুলটুল চাই? বলুন না, কোনগুলো পছন্দ হয়েছে। তার পর একগাল হেসে হয়তো বলবে, প্রেমে পড়েছেন নাকি? তা হলে লাল ফুল। হাসপাতালে রুগী দেখতে যাচ্ছেন নাকি, তা হলে সাদা ফুল। আমি একবার শুধিয়েছিলাম, আর যদি আমার প্রিয়ার সঙ্গে ঝগড়া হয়ে থাকে, তা হলে কী ফুল পাঠাব? যাকে শুধিয়েছিলাম তিনি তখন দু গাল হেসে বলেছিলেন, সবুজ ফুল। সবুজ ঈর্ষার রঙ। আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, সবুজ ফুল তো এদেশে দেখিনি কখনও। আমাদের দেশেও সবুজ ফুল একেবারেই বিরল। ভদ্রলোক বললেন, আমাদের দেশেও। কিন্তু আমাদের এক প্রতিবেশীর বাড়িতে সবুজ ফুল আছে। আমি এখুনি এনে দিচ্ছি। ও মশাই, দাঁড়ান, আমার সবুজ ফুলের তেমন কোনও প্রয়োজন নেই– ও মশাই–
কিন্তু কে-বা শোনে কার কথা!
মিনিট দুই যেতে না যেতেই সেই মহাত্মার পুনরাবির্ভাব। হাতে একটি সবুজ গোলাপ। চোখেমুখে যে আনন্দ তার থেকে মনে হল তিনি যেন বাকিংহাম প্রাসাদ কিংবা কুতুব মিনার কিংবা উভয়ই কুড়িয়ে এনেছেন। আমি বিস্তর ধন্যবাদ, ডাঙ্কে শ্যোন, ডাঙ্কে রেষট শ্যোন বলৈ অজস্র ধন্যবাদ জানালুম।
ইতোমধ্যে বাড়ির দরজা খুলে গেল। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের একটি মহিলা ডেকে বললেন, ওগো তোমার কফি।
হঠাৎ আমাকে দেখে কেমন যেন চুপসে গেলেন।
ভদ্রলোক বললেন, চলুন না। এক পাত্র কফি হেঁ হেঁ—
আমি বললুম, কিন্তু আপনার গৃহিণী?
না, না, না– আপনি চিন্তা করবেন না। আমার গৃহিণী খাণ্ডারিণী নয়। অবশ্য সে আপনাকে কখনও দেখেনি। চলুন চলুন।
বসার ঘরে ঢুকে ভদ্রলোক আমাকে কফি টেবিলের পাশে সযত্নে বসিয়ে বললেন, আপনাকে চল্লিশ বৎসর পূর্বে কত-না দেখেছি। আমার বয়েস তখন চৌদ্দ-পনের। কিন্তু ভয়ে আপনার সঙ্গে পরিচয় করতে পারিনি
আমি বাধা দিয়ে বললুম, সে কী?
এজ্ঞে আমি জানতুম, আপনি ইন্ডিয়ান। আর ইন্ডিয়ানরা সব ফিলসফার। তারা যত্রতত্র যার তার সঙ্গে কথা কয় না। তাই আপনি ধীরে ধীরে পা ফেলে যেতেন রাইন নদের পারে। আমি কত-না দিন আপনার পিছন পিছন গিয়েছি। আপনি একটি বেঞ্চিতে বসে রাইনের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবতেন। তখন কি আর বিরক্ত করা যায়?
আমি বললুম, ব্রাদার, এটা বড় ভুল করেছ। তখন আমার সঙ্গে কথা কইলে বড়ই খুশি হতুম।
ইতোমধ্যে বাড়ির গৃহিণী কেক ইত্যাদি নিয়ে এসে আমাদের টেবিলে রাখলেন। তার গাল দুটো আরও লাল হয়ে গিয়েছে, ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ঝরছে এবং তিনি হাঁপাচ্ছেন। অর্থাৎ এ পাড়ায় কোনও কেকের দোকান নেই বলে তিনি কুড়ি কুড়ি মিনিটের রাস্তা ঠেঙিয়ে কেক টার্ট নিয়ে এসেছেন।
এ স্থলে যে কোনও ভদ্রসন্তান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মাফ চাইত। বলত, এ সবের কী প্রয়োজন ছিল? কিন্তু আমি চাইনি, আমাকে বেয়াদব মূর্খ যা খুশি বলতে পারেন।
আমি শুধু আমার পকেট থেকে একটি রুমাল বের করে তাঁর কপালটি মুছে দিলুম।
.
১৩.
ভ্রমণকাহিনী লিখতে লিখতে মানুষ আশকথা পাশকথার উত্থাপন করে। গুণীরা বলেন এটা কিছু দুষ্কর্ম নয়। সদর রাস্তা ছেড়ে পথিক যদি পথের ভুলে আশপথ পাশপথ, না যায় তবে অচেনা ফুলের নয়া নয়া পাখির সঙ্গে তার পরিচয় হবে কী প্রকারে? কবিগুরুও বলেছেন,
যে পথিক পথের ভুলে,
এল আমার প্রাণের কূলে—
অর্থাৎ প্রণয় পর্যন্ত হতে পারে। তাই আমি যদি মাঝে-মধ্যে এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ি তবে সহৃদয় পাঠক অপরাধ নেবেন না।
***
আলেকজান্ডার ফন হুমবল্টের নাম কে না শুনেছে? নেপোলিয়ন, গ্যোটে, শিলারের সমসাময়িক। দুই কবির সঙ্গে তাঁর ভাবের আদান-প্রদান হত। এবং অনেকেই বলেন, ওই সময়ে পাশ্চাত্য মহাদেশগুলোতে নেপোলিয়নের পরেই ছিল হুমবল্টের সুখ্যাতি। আসলে তিনি ছিলেন বৈজ্ঞানিক এবং পর্যটক– ওদিকে কাব্য দর্শন অলঙ্কারশাস্ত্রের সঙ্গেও সুপরিচিত।
কিন্তু তার পরিপূর্ণ পরিচয় দেওয়া আমার শক্তির বাইরে এবং সে উদ্দেশ্য নিয়ে আমি এ লেখাটি আরম্ভও করিনি।
হুমবল্ট গত হন ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে। যেহেতু তিনি ভিন্ন ভিন্ন দেশের মধ্যে বৈজ্ঞানিক, সাংস্কৃতিক যোগাযোগের জন্য (দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ককেশাস সাইবেরিয়া পর্যন্ত) অতিশয় সযত্নবান ছিলেন তাই ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে বার্লিনের জর্মন পররাষ্ট্র দফতরের উৎসাহে ওই দেশের জনসাধারণ একটি প্রতিষ্ঠান এনডাওমেন্ট দেবোত্তর ব্রহ্মোত্তর, ওয়াকফ, যা খুশি বলতে পারেন নির্মাণ করল, নাম : আলেকজান্ডার ফন হুমবল্ট স্টিফটুঙ। তাদের একমাত্র কর্ম তখন ছিল বিদেশি ছাত্রদের বৃত্তি দিয়ে জর্মনিতে পড়াশুনো করার ব্যবস্থা করে দেওয়া। আমার বড়ই বিস্ময় বোধ হয়, জর্মনির ওই দুর্দিনে (ইনফ্লেশন সবে শেষ হয়েছে, তার খেয়ারি তখন কাটেনি) সে কী করে এ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করল? আমরা বলি আপনি পায় না খেতে। অনেক চিন্তা করে বুঝেছিলুম, দয়াদাক্ষিণ্য আর্থিক সচ্ছলতার ওপর নির্ভর করে না। লক্ষপতি ভিখিরিকে একটা কানাকড়ি দেয় না, অথচ আমি আপন চোখে দেখেছি এক চক্ষুম্মান ভিখিরি এক অন্ধ ভিখিরিকে আপন ভিক্ষালব্ধ দু-চার আনা থেকে দু পয়সা দিতে। আমার এক চেলা এদানীং আমাকে জানালে গঙ্গাস্বরূপা ইন্দিরাজিও নাকি বলেছেন, গরিবই গরিবকে মদৎ দেয়।
সে আমলে ইন্ডিয়া পেত মাত্র একটি স্কলারশিপ আজ অনেক বেশি পায়। সেটি পেলেন আমার বন্ধু সতীর্থ বাসুদেব বিশ্বনাথ গোখলে।২ ইনি সর্বজনপূজ্য স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রাতঃস্মরণীয় ঈশ্বর গোখলের ভ্রাতুস্পুত্র। তার চার বৎসর পর পেলুম আমি। সে কথা থাক। মাঝে মাঝে গাধাও রাজমুকুট পেয়ে যায়।
গোডেসবের্গ শহরের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ দেখি, একটি বাড়ির সমুখে মোটা মোটা হরফে লেখা–
আলেকজান্ডার ফন্ হুমবল্ট স্টিফটুঙ
আমার তখন আর পায় কে? লম্বা লম্বা পা ফেলে তদ্দণ্ডেই সে বাড়িতে উঠলুম। আমি অবশ্যই আশা করিনি যে সেই চল্লিশ বৎসর পূর্বেকার লোক এ আপিস চালাবেন।
কিন্ত এনারাও ভদ্রলোক। অতিশয় দ্রভাবে শুধোলেন,
আপনি কোন সালে হুমবল্ট বৃত্তি পেয়েছিলেন?
১৯২৯।
ভদ্রলোক যেন সাপের ছোবল খেয়ে লম্ফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন।
আমিও তাজ্জব বনে গিয়ে বললুম,
কী হল?
কী! চল্লিশ বছর পূর্বে!
এজ্ঞে হ্যাঁ!
মাইন গট (মাই গড)! এত প্রাচীন দিনের কোনও স্কলারশিপ হোল্ডারকে আমি তো কখনও দেখিনি। ।
আমি একটুখানি সাহস পেয়ে বললাম, ব্রাদার, ইহসংসারে তুমিও অনেক কিছু দেখনি, আম্মো দেখিনি। তুমি কি আপন পিঠ কখনও দেখেছ? তাই কি সেটা নেই?
যেহেতু আমি ও বাড়িতে ঢোকার সময় আমার ভিজিটিং কার্ড পাঠিয়ে দিয়েছিলুম, তাই তারা ইতোমধ্যে চেক-আপ করে নিয়েছে, আমি সত্য সত্যই ১৯২৯-এ স্কলারশিপ পেয়ে এ দেশে এসেছিলুম।
হঠাৎ ভদ্রলোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
অ- অ অ জানেন, আপনি আমাদের প্রাচীনতম স্কলারশিপ হোল্ডার?
আমি সবিনয়ে বললুম,
তা হলে আমাকে আপনাদের প্রাচ্যদেশীয় যাদুঘরে পাঠিয়ে দিন।
টুটেনখামেনের মমির পাশে কিংবা রানি নফ্রেটাট্টির পাশে আমাকে শুইয়ে দিন।
.
১৪.
সুইটজারল্যান্ড, জর্মনি, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেনে টাকাকড়ির এমনই ছড়াছড়ি, সে কড়ি কী করে খরচ করবে যেন সেটা ভেবেই পায় না। বিশ্বময় (সঠিক বলতে পারব না, তবে বোধহয় চীন এবং লৌহ্যবনিকার অন্তরালের দেশগুলো এখনও অপাঙক্তেয়) গণ্ডায় গণ্ডায় স্কলারশিপ ছড়ানোর পরও হুমবল্ট ওয়াকফের হাতে বেশ কিছু টাকা বেঁচে যায়।
তাই তারা প্রতি বৎসর একটা জব্বর পরব করে। তিন দিন ধরে। জর্মনিতে যে শত শত হুমবল্ট স্কলার ছড়িয়ে আছে এবং যারা একদা স্কলার ছিল, উপস্থিত জর্মনিতেই কাজকর্ম করে পয়সা কামাচ্ছে তাদের সবাইকে তিন দিনের তরে বাড গডেসবের্গে নেমন্তন্ন জানায়। যারা বিবাহিত, তাদের বউ কাচ্চা বাচ্চা সহ- বলা বাহুল্য ওই উপরোক্ত সম্প্রদায়, যারা কাজকর্ম করে পয়সা কামায়। আসা-যাওয়ার ট্রেনভাড়া, হোটেলের খাইখর্চা, তিন দিন ধরে নানাবিধ মিটিং পরব নৃত্যগীত, অনুষ্ঠানে যাবার জন্য মোটরগাড়ি– এক কথায় সব– সব। প্রাচীন দিনে আমাদের দেশে যে রকম জমিদারবাড়িতে বিয়ের সময় দশখানা গায়ের বাড়িতে তিন দিন ধরে উনুন জ্বালানো হত না!!
হ্যার পাপেনফুস স্টিফটুঙের অন্যতম কর্তাব্যক্তি। আমাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়ে বললেন, আপনার তুলনায় জর্মনিতে উপস্থিত যেসব প্রাক্তন স্কলার আছেন তারা নিতান্তই শিশু।
আমি বললুম, আমার হেঁটোর বয়স।
পাপেনফুস ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। অর্থাৎ বুঝতে পারেননি। সব দেশের ইডিয়ম, প্রবাদ তো একই ছাঁচে তৈরি হয় না। আমি বুঝিয়ে দেওয়ার পর বললুম, আমাকে যে আপনাদের পরবে নিমন্ত্রণ করেছেন তার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আপনাদের পরব আসছে সপ্তাহ তিনেক পরে। ওদিকে আমাকে যেতে হবে কলোন, ডুসলডর্ফ, হামবুর্গ, স্টুটগার্ট এবং সর্বশেষ স্টুটগার্ট থেকে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ মাইল দূরে পাড়াগাঁয়ে আমার প্রাচীন দিনের এক বিধবা বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে। আমরা একসঙ্গে পড়াশুনো করেছি। তার অর্থ আমার স্কলারশিপের মতো তিনিও চল্লিশ বছরের পুরনো প্লস তাঁর বয়স।
লক্ষ করলুম, তৃতীয় ব্যক্তি সভাস্থলে উপস্থিত ছিলেন তার চোখে-ঠোঁটে কেমন যেন একটুখানি মৃদু হাসি খেলে গেল। এর অর্থ হতে পারে:
(১) এ তো বড় আশ্চর্য! ষাট বছর বয়সের প্রাচীন প্রিয়ার অভিসারে যাচ্ছে এই নাগর।
কিংবা
(২) এর এক-প্রিয়া-নিষ্ঠতাকে তো ধন্যি মানতে হয়। (রামচন্দ্রকে বলা হয় একদারনিষ্ঠ।)
ইতোমধ্যে কর্তা বললেন, সে কী কথা! আপনি আসবেন না, সে তো হতেই পারে না। আপনার ভাষায়ই বলি আপনার মতো মিউজিয়ম পিস আমাদের কর্তাব্যক্তিদের গুণীজ্ঞানীদের দেখাতে পারব না, সে কি একটা কাজের কথা হল? ওনাদের অনেকেই ভাবেন, আমাদের আলেকজান্ডার ফন হুমবল্ট স্টিফটুঙ বুঝি পরশু দিনের বাচ্চা অথচ আমাদের প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন কবে সেই ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে– অবশ্য যুদ্ধের ফলস্বরূপ জর্মনি যখন তছনছ হয়ে গেল তখন কয়েক বৎসর প্রতিষ্ঠান দেউলে হয়ে রইল। এদের আমি দোষ দিইনে– সব জর্মনই তো ঐতিহাসিক মমজেন হয় না। অতএব চল্লিশ বছরের পূর্বেকার জলজ্যান্ত একজন বৃত্তিধারীকে যদি ওদের সামনে তুলে ধরতে পারি, তখন হুজুরদের পেত্যয় যাবে–
আমি মনে মনে বললুম, ঈশ্বর রক্ষতু। যাদুঘরে যে রকম পেডেস্টাইলের উপর গ্রিক মূর্তি খাড়া করে রাখে, সে রকম নয় তো! তা করুক, কিন্তু জামাকাপড় কেড়ে নিয়ে লজ্জা নিবারণার্থে কুল্লে একখানা ডুমুরপাতা পরিয়ে দিলেই তো চিত্তির–
কর্তা বলে যেতে লাগলেন, আপনি পরবের সময় কন্টিনেন্টে যেখানেই থাকুন না কেন, আমরা সানন্দে আপনাকে একখানা রিটার্ন টিকিট পাঠিয়ে দেব। এখানে হোটেলের ব্যবস্থা, যানবাহন সবই তো আমরা করে থাকি। তার পর আপনি ফিরে যাবেন আপন মোকামে। বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন, আপনি কি মাত্র তিনটি দিনও শেয়ার করতে পারবেন না… আচ্ছা, তবে এখন চলুন আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ খেতে।
বড্ডই নেমকহারামি হয়। তদুপরি এরা আমাকে দুই যুগ পরে আবার নেমক দিতে চায়। একদা যে প্রতিষ্ঠান যে জর্মন জাত এই তরুণকে স্কলারশিপ-নেমক দিয়েছিল, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে তাদেরকে নিরাশ করি কী প্রকারে?
আমি সকৃতজ্ঞ পরিপূর্ণ সম্মতি জানালুম।
***
রেস্তোরাঁটি সাদামাঠা, নিরিবিলি, ছোটখাটো, ঘরোয়া। ব্যান্ডবাদ্যি, জ্যাজম্যাজিক, খাপসুরুৎ তরুণীদের ঝামেলা, কোনও উৎপাতই নেই। বুঝতে কোনও অসুবিধা হল না যে এ রেস্তোরাঁতে আসেন নিকটস্থ আপিস-দফতরের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা। তার অন্যতম প্রধান কারণ মেনু (খাদ্যনির্ঘন্ট) দেখেই আমার চক্ষুস্থির। তৃরিতেই হিসাব করে দেখলুম এখানে অতি সাধারণ লাঞ্চ খেতে হলেই নিদেন পনেরো মার্ক লাগার কথা। আমাদের হিসাবে তিনখানা করকরে দশ টাকার নোট। অবশ্য গচ্চাটা আমাকে দিতে হবে না। কারণ ওঁরা আমাকে নিমন্ত্রণ করে এনেছেন। এবং এ দেশের রেস্তোরাঁতে যে ব্যক্তি অর্ডার দিল সেই পেমেন্ট করবে– যে খেলো তার কোনও দায় নেই।
কিন্তু এ স্থলে সেটা তো কোনও কাজের কথা নয়।
যারা আমাকে নিমন্ত্রণ করে এনেছেন তারা আমাকে মেনু এগিয়ে দিয়ে বলেছেন, কী খাবেন, বলুন। আমি কি তখন তাদের ঘাড় মটকাব!
আমি শুধোলুম, আপনারা কি এই রেস্তোরাঁতেই প্রতিদিন লাঞ্চ খেতে আসেন?
এজ্ঞে হ্যাঁ।
কী খান, মানে, কোন কোন পদ?
সুপ মাংস আর পুডিং। কখনও-বা আইসক্রিম– তবে সেটা বেশিরভাগ গ্রীষ্মকালে। মাঝে-মধ্যে শীতকালেও।
আমি অবাক হয়ে শুধোলুম, শীতকালে আইসক্রিম।
তখন আমার মনে পড়ল আমরাও তো দারুণ গরমের দিনে গরমোতর চা খাই তবে এরাই-বা শীতকালে আইসক্রিম খাবে না কেন?
আমি অতিশয় সাদামাঠা লাঞ্চ অর্ডার দিলুম। যে হাঁস সোনার ডিম পাড়ে তার গলা মটকাতে নেই।
.
১৫.
আহারাদির কেচ্ছা শুরু হলেই আমি যে বে-এক্তেয়ার হয়ে যাই আমার সম্বন্ধে সে বদনাম এতই দীর্ঘকালের যে তার সাফাই এখন বেবাক তামাদি– ইংরেজি আইনের ভাষায় টাইম-বার না কী যেন বলে হয়ে গিয়েছে। তাই পাঠক ধর্মাবতারের সমুখে করজোড়ে স্বীকার করে নিচ্ছি, আমি দোষী, অপরাধ করেছি।
কিন্তু আমি জাতক্রিমিনাল। আমার মিত্র এবং পৃষ্ঠপোষক জেল সুপারিনটেনডেন্ট তার একাধিক প্রামাণিক পুস্তকে লিখেছেন, এই বঙ্গদেশে জাতক্রিমিনাল হয় না। হুঃ! আমি জাতক্রিমিনাল সেটা জানার পূর্বেই তিনি এসব দায়িত্বহীন বাক্যবিন্যাস করেছেন। তাই আমি আবার সেই লাঞ্চের বর্ণনা পুনরায় দেব।
সুপ আমি বড্ড বেশি একটা ভালোবাসিনে।
এ বাবদে কিন্তু আমি সমুদ্রে বেলাভূমিতে সম্পূর্ণ একাকী নুড়ি নই। ডাচেস অব উইন্ডসর (উচ্চারণ নাকি উইনজার) অতি উত্তম রান্নাবান্না করতে পারেন। তা সে অনেকেই পারেন। কিন্তু তিনি আরেকটি ব্যাপারে অসাধাণ হুনুরি। ভোজনটি কী প্রকারে কমপোজ করতে হবে– এ তত্ত্বটি তিনি খুব ভালো করে জানেন।
অপরাধ নেবেন না। আমরা বাঙালি মাত্রই ভাবি ভোজনে যত বেশি পদ দেওয়া হয় ততই তার খানদানিত্ব বেড়ে যায়। তিন রকমের ডাল, পাঁচ রকমের চচ্চড়ি, তিন রকমের মাছ, দু-তিন রকমের মাংস, চিনিপাতা দই আর কত হরেক রকমের মিষ্টি তার হিসাব নাই-বা দিলুম।
আর প্রায় সবকটাই অখ্যাদ্য। কারণ, এতগুলো পদের জন্য তো এতগুলো উনুন করা যায় না, গোটা দশেক পাঁচক ডাকা যায় না। অতএব বেগুনভাজা মেগনেলিয়ার আইসক্রিমের মতো হিম, চিনিপাতা দই পাঞ্জাব মেলের এনজিনের মতো গরম, লুচি কুকুরের জিতের মতো চ্যাপটা, লম্বা, খেতে গেলে রবারের মতো। আজকাল আবার ফ্যাশন হয়েছে ঘি-ভাত বা পোলাওয়ের বদলে চীনা ফ্রাইড রাইস। চীনারা র উচ্চারণ করতে পারে না। অতএব বলে স্লাইড লাইস–অর্থাৎ ভাজা উকুন। তা সে যে উচ্চারণই করুক আমার তাতে কানাকড়ি মাত্র আপত্তি নেই। শুনেছি, মহাকবি শেক্সপিয়ার বলেছেন, গোলাপে যে নামে ডাকো গন্ধ বিতরে। তাই ফ্রাইড রাইস বলুন বা ফ্লাইড লাইসই বলুন–সোওয়াদটি উত্তম হলেই হল। কিন্তু আজকালকার কেটারাররা (হে ভগবান, এই সম্প্রদায়কে বিনষ্ট করার জন্য আমি চেঙ্গিস খান হতে রাজি আছি) নেটিভ পাঁচক দিয়ে ফ্লাইড লাইস নির্মাণ করেন। সত্য সত্য তিন সত্য বলছি, সে মহামূল্য সম্পদ জিহ্বা স্পর্শ করার পূর্বেই আপনি বুঝে যাবেন এই অভূতপূর্ব বস্তু উকুন ভাজা। আলবৎ, আমি নতমস্তকে স্বীকার করছি, উকুন ভাজা আমি এই কেটারার সম্প্রদায়ের অবদান– মেহেরবানির পূর্বে কখনও খাইনি। তাই গোড়াতেই বলেছি, আমরা মেনু কম্পোজ করতে জানিনে।
তা সে থাক, তা সে যাক্। পরনিন্দা মহাপাপ। এখানেই ক্ষান্ত দিই। বয়স যত বাড়ে মানুষ ততই খিটখিটে হয়ে যায়।
পুরনো কথায় ফিরে যাই। ডাচেস অব উইনজার নাকি তার লাঞ্চ ডিনারে নিমন্ত্রিতজনকে কখনও সুপ পরিবেশন করেন না। অতিশয় অভিজ্ঞতালব্ধ তাঁর বক্তব্য : এই যে বাবুরা এখন ডিনার খেতে যাবেন তার আগে তেনারা গিলেছেন গ্যালন গ্যালন ককটেল হুইস্কি। জালা জালা সেরি, পোর্ট। সক্কলেরই পেট তরল বস্তুতে টইটম্বুর ছয়লাপও বলতে পারেন। ডাচেসের দীর্ঘ অভিজ্ঞতাপ্রসূত সুচিন্তিত অভিমত : এর পরেও যদি হুজুররা তরল দ্রব্য সুপ পেটে ঢোকান তবে, তার পর আর রোস্ট ইত্যাদি নিরেট সলিড দ্রব্য খাবেন কী প্রকারে? তাই তার ডিনারে নো সুপ! অবশ্য ডাচেস সহৃদয়া মহিলা। কাজেই যারা নিতান্তই সুপাসক্ত তাদের জন্য সুপ আসে। ওদেরকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য তিনিও মাঝে মাঝে দু চার চামচ সুপ গলাতে ঢালেন।
অতএব আমাকেও নিতান্ত সঙ্গ দেওয়ার জন্য হুমবল্ট স্টিফটুঙ্গ প্রদত্ত লাঞ্চে কিঞ্চিৎ সুপ সেবন করতে হল।
বাহ! উত্তম সুপ! ব্যাপারটা তাহলে ভালো করে বুঝিয়ে বলি।
যেসব দেশের কলোনি নেই– বিশেষত ভারত, সিংহল কিংবা ইন্দোনেশিয়ায় তারা গরম মশলা পাবে কোত্থেকে? কেনার জন্য অত রেস্ত কোথায়? শত শত বৎসর ধরে তাদের ছোঁকছোঁকানি শুধু গোলমরিচের জন্য! শুনেছি ভাস্কো দা গামা ওই গোলমরিচের জন্য অশেষ ক্লেশ করে দক্ষিণ ভারতে এসেছিলেন। কোনও কোনও পণ্ডিত বলেন, কলমস নাকি ওই একই মতলব নিয়ে সাপ খুঁজতে গিয়ে কেঁচো পেয়ে গেলেন। অর্থাৎ ভারতবর্ষ আবিষ্কার করতে গিয়ে আমেরিকায় পৌঁছে গেলেন। এর পর ইয়োরোপীয়রা দক্ষিণ আমেরিকায় ঝাল লাল লঙ্কা আবিষ্কার করল, কিন্তু ওটা ওদের ঠিক পছন্দ হল না! যদ্যপি আমরা ভারতীয়রা সেটি পরমানন্দে আলিঙ্গন করে গ্রহণ করলুম।
ইতিহাস দীর্ঘতর করব না।
ইতোমধ্যে জর্মনির এতই ধনদৌলত বেড়ে গিয়েছে যে, এখন সে শুধু কালা মরিচ কিনেই পরিতৃপ্ত নয়– এখন সে কেনে দুনিয়ার যত মশলা। বিশেষ করে কারি পাউডার আর লবঙ্গ, এলাচি, ধনে ইত্যাদির তো কথাই নেই। তবে কি না আমি কন্টিনেন্টের কুত্রপি কাঁচা সবুজ ধনেপাতা দেখিনি। কিন্তু ভয় নেই, কিংবা ভয় হয়তো সেখানেই। যেদিন কন্টিনেন্টের কুবের সন্তানরা ধনেপাতা-লঙ্কা-তেঙুল তেলের চাটনির সোয়াদটি বুঝে যাবেন সেদিন হবে আমাদের সর্বনাশ। হাওয়াই জাহাজের কল্যাণে কুল্লে ধনেপাতা হিল্লি-দিল্লি হয়ে চলে যাবেন কাঁহা কাঁহা মুলুকে। এটা তো এমন কিছু নয়া অভিজ্ঞতা নয়। ভারত-বাঙলা দেশের বহু জায়গাতেই আজ আপনি আর চিংড়ি মাছ পাবেন না। টিনে ভর্তি হয়ে তারা আপনার উদরে না এসে সাধনোচিত ধামে (অর্থাৎ কন্টিনেন্টে- যেখানে চিংড়ি মাছ কেন, সর্বভারতীয় যুবকই যেতে চায়) প্রস্থান করেন। একমাত্র কোলাব্যাঙ সম্বন্ধেই আমাদের কোনও দুঃখ নেই। যাক যত খুশি যাক। ওটা ফরাসিদের বড়ই প্রিয় খাদ্য। তবে কি না বাঙালোর থেকে তারস্বরে এক ভদ্রলোকে প্রতিবাদ করেছেন : পাইকিরি হিসেবে এভাবে কোলাব্যাঙ বিদেশে রফতানি করায় ওই অঞ্চলে মশার উৎপাত দুর্দান্তরূপে বৃদ্ধি পেয়েছে; কারণ ওই কোলাব্যাঙরাই মশার ডিম খেয়ে তাদের বংশবৃদ্ধিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করত।
এটা অবশ্যই একটা সমস্যা দুশ্চিন্তার বিষয়। কিন্তু আমার ভাবনা কী? আমার তো একটা মশারি আছে।
.
গুরমে ভোজনরসিকরা বলেন সুইটজারল্যান্ডের জর্মনভাষী অঞ্চলের খাদ্যই সবচেয়ে ভোতা। অথচ নেপোলিয়ন না কে যেন বলেছেন, ইংরেজ এ নেশন অব শপকিপারজ (অবশ্য ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে সাকী নামক ছদ্মনামের এক অতিশয় সুরসিক ইংরেজ লেখক বলেন, আমরা এখন এ নেশন অব শপলিফটারজ অর্থাৎ লেখক বলেন, আমরা এখন দোকানের ভিড়ে চটসে এটা-ওটা চুরি করতে ওস্তাদ) এবং সুইসরা এ নেশন অব হোটেলকিপারস। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে তাবৎ ইয়োরোপে সুইসরাই পরিচ্ছন্নতম হোটেল রাখে। কিন্তু প্রশ্ন : তোমরা হোটেল-রেস্তোরাঁ যতই সাফসুতরো রাখো না কেন, তোমার রেস্তোরাঁর সুপে ব্লন্ড, ব্রুনেট, কালো চুল না পাওয়া গেলেও (দিনের পর দিন তিন রঙের চুল আবিষ্কার করতে করতে আমার এক মিত্র–সুইটজারল্যান্ডে নয়, অন্য এক নোংরা দেশের হোটেলে একদিন ম্যানেজারকে শুধোলেন, আপনার রান্নাঘরে তিনটি পাচিকা আছেন; না? একজনের চুল ব্লভ, অন্য জনের নেট এবং তেসরা জনের কালো। নয় কি? ম্যানেজার তো থ! এই ভদ্রলোকই কি তবে শার্লক হোমসের বড় ভাই মাইক্রফট হোমস? সবিনয়ে তথ্যটা স্বীকার করে শুধোলে, স্যর, আপনি জানলেন কী করে? আপনি তো আমাদের রসুইখানায় কখনও পদার্পণ করেননি! বন্ধু বললেন, সুপে কোনও দিন ব্লন্ড, কখনও-বা নেট এবং কালো চুল পাই– কালোটাই পাতলা সুপে চোখে পড়ে বেশি। এ তত্ত্বে পৌঁছবার জন্য তো দেকার্ত কান্ট-এর দর্শন প্রয়োজন হয় না। আমি বলছি ওই কালো চুলউলিকে যদি দয়া করে বলে দেন, সে যেন আর পাঁচটা হোটেলের পাঁচজন পাঁচকের মাথায় যে রকম টাইট সাদা টুপি পরা থাকে ওইরকম কোনও একটা ব্যবহার করে। আমার মনে হয় ওর মাথায় দুর্দান্ত খুসকি–পাঠক অপরাধ নেবেন না, এ কেচ্ছাটা বলার প্রলোভন কিছুতেই সম্বরণ করতে পারলুম না।) সুন্ধুমাত্র সুইস হোটেলের সুপমধ্যে হরেকরকম্বা চুল নেই বলেই যে দুনিয়ার লোক হদ্দমু হয়ে সে দেশে আসবে এ-ও কি কখনও সম্ভব? আমার সোনার দেশ পুবপচ্ছিমওতর বাঙলায় সুপ তৈরি হয় না। অতএব প্লাটিনাম ব্লন্ড, সাদামাটা ব্লন্ড, চেশমাট ব্রাউন, মোলায়েম ব্রাউন, কালো-মিশকালো কোনও রঙের কোনও চুলের কথাই ওঠে না। মোটেই মা রাধে না, তার তপ্ত আর পান্তা। কিংবা বলতে পারেন, হাওয়ার গোড়ায় রশি বাধার মতো। তাই বলে কি মার্কিন-সুইস টুরিস্ট এ দেশে আসে না।
বিজনেস ইজ বিজনেস–তাই সুইসরা পর্যন্ত তাদের রান্নাতে প্রাচ্যদেশীয় মশলা ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছে।
আমার কাছে একখানা সুইস সাপ্তাহিক আসে। তার কলেবর প্রায় ষাট পৃষ্ঠা। একদা কেউ ল্যাটে এলে আমরা ঠাট্টা করে বলতুম কী বেরাদর, কেপ অব গুড হোপ হয়ে এলে নাকি?– সুয়েজ কানাল যখন রয়েছে। এখন কিন্তু এটা আর মস্করা নয়। অ্যার মেলের কথা অবশ্য ভিন্ন। কিন্তু ষাট পৃষ্ঠা বপুধারী পত্রিকা তো আর অ্যার মেলে পাঠানো যায় না। খর্চা যা পড়বে সেটা সাপ্তাহিকের দাম ছাড়িয়ে যাবে। হিন্দিতে বলে লড়কে সে, লড়কার গু ভারী বাচ্চাটার ওজনের চাইতে তার মলের ওজন বেশি।
সেই পত্রিকার একটি প্রশ্নোত্তর বিভাগ আছে। কেউ শুধোল, মাংস আলু তরকারিসহ নির্মিত ভোজনের মেন তিশ (পিয়েস দ্য রেজিসাস) খাওয়ার পর যেটুকু তলানি সম্ (শুকনো ঝোল, কলকাত্তাইয়ারা কাইও বলে থাকে) পড়ে থাকে তার উপর পাউরুটি টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়ে কাঁটা দিয়ে সেগুলো নাড়িয়ে চাড়িয়ে চেটেপুটে খাওয়াটা কি প্রতোকোলসম্মত– এটিকেট মাফিক, বেয়াদবি অভদ্রস্থতা নয় তো!
উত্তর : পৃথিবীতে এখন এমনই নিদারুণ খাদ্যাভাব যে ওই সসটুকু ফেলে দেওয়ার কোনও যুক্তি নেই (অবশ্য তার সঙ্গে রুটির টুকরোগুলোও যে গেল সে বাবদে বিচক্ষণ উত্তরদাতা কোনও উচ্চবাচ্য করেননি। কারণ রুটিটি পরের ভোজনেও কাজে লাগত কিংবা গরিব-দুঃখীকে বিলিয়ে দেওয়া যেত— এঁটো প্লেটের তলানি সস তো পরবর্তী ভোজনের জন্য বাঁচিয়ে রাখা যায় না, কিংবা গরিব-দুঃখীকেও বিলানো যায় না– লেখক) তার পর তিনি বলছেন, কিন্তু আপনি যদি নিমন্ত্রিত হয়ে কোথাও যান তবে এই কার্পণ্যটি করবেন না। তার মানে আপনার বাড়ির বাইরের এটিকেট যেন বাড়ির ভিতরের চেয়ে ভালো হয়। আমি কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্নমত ধরি। আমার মতে বাড়ির এটিকেট, আদবকায়দা যেন বাইরের চাইতে ঢের ঢের ভালো হয়।
প্রশ্ন: কোহিনূর প্রস্তর কোন ভাষার শব্দ?
উত্তর : ফারসি।
(সম্পূর্ণ ভুল নয়। কোহ= পাহাড়–ফার্সিতে যেমন কাবুলের উত্তর দিকে কোহিস্তান রয়েছে [ আমার সখা আব্দার রহমান ওই কোহিস্তানের লোক] কিন্তু কোহ-ই-নূরের নূর শব্দটি ন সিকে আরবি। খাঁটি ফারসিতে যদি বলতেই হয় তবে নূর-এর বদলে রওশন বা রোশনি বাংলায় রোশনাই] ব্যবহার করে বলতে হয় কোহ-ই-রওশন। শুদ্ধ আরবিতে বলতে হলে জবলুন (পাহাড়) নূর।… কিন্তু এ রকম বর্ণসঙ্কর সমাস সর্বত্রই হয়ে থাকে। দিল্লীশ্বর ইত্যাদি।)।
প্রশ্ন : আমার বয়স বত্রিশ; আমি বিধবা। আমার মোললা বছরের ছেলের একটি সতেরো বছরের ভেরি ডিয়ার ক্লাসফ্রেন্ড প্রায়ই আমাদের এখানে আসে। কিন্তু কিছুদিন ধরে সে আমার সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা জমাবার চেষ্টা করছে। আমি করি কী?
উত্তর : আপনি ওকে সঙ্গোপনে নিয়ে গিয়ে বলুন, তুমি তোমার অল্পবয়সী মেয়েদের সঙ্গে প্রেমট্রেম করো। আমি তোমার মায়ের বয়সী। তোমার বয়েসী মেয়ের তো কোনও অভাব নেই। কিন্তু, আমার মনে হয়, ছেলেটার বোধহয় মাদার কমপ্লেকস আছে– অতি অল্প বয়সেই তার মা গত হন। কাজেই সে একটি মায়ের সন্ধানে আছে– তার পর আরও নানাপ্রকারের হাবিজাবি ছিল।
এ উত্তর যে কোনও গো-গর্দভ দিতে পারত।
কিন্তু এ প্রশ্নোত্তরমালা নিতান্তই অবতরণিকা মাত্র।
***
কয়েক মাস পূর্বে মনে হল– একটি প্রাচীনপন্থী মহিলা–প্রশ্ন শুধোলেন : আজকালকার ছেলে-ছোকরা এমনকি মেয়েরাও বড় বেশি মশলাদার খানা খাচ্ছে। আমি গ্রামাঞ্চলে থাকি। সেদিন বাধ্য হয়ে আমাকে শহরে যেতে হয়। যদি জানতুম, শহরের মাই লর্ড রেস্তোরাঁওয়ালারা কী জঘন্য ঝাল, মাস্টার্ড (আমাদের কাসুন্দো– লেখক) আর মা মেরিই জানেন কী সব বিদকুটে বিদকুটে বিজাতীয় মশলা দিয়ে যাবতীয় রান্না করেন, তবে কি আমি সে রেস্তোরাঁয় যেতুম! এক চামচ সুপ মুখে ঢালা মাত্রই আমার সর্বাঙ্গ শিহরিত হতে লাগল। আমার কপালে সেই শীতকালে, ঘাম জমতে লাগল। মনে হল, আমার জিভে যেন কেউ আগুন ঠেলে দিয়েছে। আমার চোখ থেকে যা জল বেরুতে আরম্ভ করল সেটা দেখে আমার কাছেরই একটি সহৃদয় প্রাইভিট শুধাল মাদাম, আমি বহু দেশ-বিদেশ দেখেছি যেখানে টিয়ার গ্যাস ছাড়া হয়; কিন্তু আমাদের এই সুইটজারল্যান্ডে তো কখনও দেখিনি। শোকাতুরা হয়ে কান্না করলে রমণীর চোখে অশ্রুজল বেরোয়, এটা তো তা নয়।
একদা সুইস কাগজে প্রশ্ন বেরোল: এই যে আমরা প্রতিদিন আমাদের রান্নাতে মশলার পর মশলা বাড়িয়েই চলেছি এটা কি স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো?
সেই সবজান্তা উত্তরিলা :
মাত্রা মেনে খেলে কোনও আপত্তি নেই। কোনও বস্তুরই বাড়াবাড়ি করতে নেই। (মরে যাই! এই ধরনের মহামূল্যবান উপদেশ পাড়ার পদীপিসি, ইস্কুলবয় সবাই দিতে পারে– লেখক)। তার পর সবজান্তা বলছেন, ডাক্তারদেরও আধুনিক অভিমত, মেকদার মাফিক মশলাদার খাদ্য ভোজনস্পৃহা আহাররুচি বৃদ্ধি করে। তদুপরি আরেকটা গুরুত্বব্যঞ্জক তত্ত্ব আছে। আপনি যদি আপনার ভোজন ব্যাপারে সর্বক্ষণ এটা খাব না ওটা ছোঁব না– এ রকম পুতুপুতু করে আপনার ভোজনযন্ত্রটিকে ন সিকে মোলায়েম করে তোলেন (ইংরেজিতে একেই বলে মলিকল করেন) তবে কী হবে? আপনি যতই চেষ্টা দিন না কেন, আপন বাড়িতে তৈরি মশলা বিবর্জিত রান্নামাত্রই খাব তথাপি ইহসংসারে বহুবিধ ফাড়া-গর্দিশ আছে যার কারণে আপনাকে হয়তো কোনও রেস্তোরাঁতে এক বেলা খেতে হল। কিংবা মনে করুন, আপনি নিমন্ত্রিত হলেন। শক্তসমত্ত জোয়ান আপনি। কী করে বলবেন আপনি ডায়েটে আছেন? ওদিকে রেস্তোরাঁ বলুন, ইয়ার বখশির বাড়িই বলুন সর্বত্রই সর্বজন শনৈঃ শনৈঃ গরম মশলার মাত্রা বাড়িয়ে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই। পরের দিন আপনি কাৎ। অতএব আমাদের সবজান্তা বলছেন, কিছু কিছু মশলা খেয়ে নেওয়ার অভ্যাসটা করে ফেলাই ভালো।
কিন্তু মশলাপুরাণ এখানেই সমাপ্ত নয়। সেটা পরে হবে।
ইতোমধ্যে আমি দুম করে প্রেমে পড়ে গেলুম।
কবিগুরু গেয়েছেন:
যদি পুরাতন প্রেম
ঢাকা পড়ে যায় নব প্রেম জালে
তবু মনে রেখো।
কিন্তু এ আশা রাখেননি, সেই প্রথম প্রিয়াই পুনরায় তাঁর কাছে ফিরে আসবে। আমার কপাল ভালো।
লাঞ্চ সেরে মৃদুমন্থরে যখন বাড়ি ফিরছি তখন বাসস্ট্যান্ডের বেঞ্চিতে বসেই দেখি বেঞ্চির অন্য প্রান্তে যে মেয়েটি বসেছিল সে জ্বলজ্বল করে আমার দিকে তাকাচ্ছে, আমার দুশমনরা তো জানেনই, এস্তেক পোস্তরাও জানেন, আমি কন্দর্পকিউপিডের সৌন্দর্য নিয়ে জন্মাইনি। তদুপরি বয়স যা হয়েছে তার হিসাব নিতে গেলে কাঠাকালি বিঘেকালি বিস্তর আঁক কষাকষি করতে হয়। সর্বশেষে সেটা ভগ্নাংশে না ত্রৈরাশিকে দিতে হবে তার জন্য প্লাশেৎ মারফত ঈশ্বর সুকুমার রায়কে নন্দনকানন থেকে এই য ব ন ভূমিতে নামাতে হবে!
অবশ্য লক্ষ করেছিলুম, আমি ওর দিকে তাকালেই সে ঝটিতি ঘাড় ফিরিয়ে নেয়। রোমান্টিক হবার চেষ্টাতে বলেছিলুম, মেয়েটি। কিন্তু তার বয়স হবে নিদেন চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ– এমনকি পঞ্চাশও হতে পারে। কিন্তু তাতে কী যায়-আসে। বিদগ্ধ পাঠকের অতি অবশ্যই স্মরণে আসবে, বৃদ্ধ চাটুয্যে মশাই যখন প্রেমের গল্প অবতারণা করতে যাচ্ছে তখন এক চ্যাংড়া বক্রোক্তি করে বলেছিল, চাটুয্যে মশাই প্রেমের কী-বা জানেন। মুখে যে কটা দাঁত যাব-যাচ্ছি যাব-যাচ্ছি করছে তাই নিয়ে প্রেম!
চাটুয্যে মশাই দারুণ চটিতং হয়ে যা বলেছিলেন তার মোদ্দা : ওরে মূর্খ! প্রেম কি চিবিয়ে খাবার বস্তু যে দাঁতের খবর নিচ্ছিস! প্রেম হয় হৃদয়ে!… একদম খাঁটি কথা। ভলতের, গ্যোটে, আনাতোল ফ্রাঁস, হাইনে আমৃত্যু বিস্তর বিস্তরবার ফটু ফট করে নয়া নয়া স্ত্রী পরীর সঙ্গে প্রেমে পড়েছেন। এই সোনার বাঙলাতেও দু একটি উত্তম দৃষ্টান্ত আছে। তা হলে আমিই-বা এমন কি ব্রহ্মহত্যা করেছি যে ফুট করে প্রেমে পড়ব না।
বললে পেত্যয় যাবেন না, অকস্মাৎ একই মুহূর্তে একে অন্যকে চিনে গেলুম। যেন আকাশে বিদ্যুৎ বহ্নি পরিচয় গেল লেখি।
একসঙ্গে আমি চেঁচালুম লটে।
সে চেঁচালে হ্যার সায়েড।
তার পর চরম নির্লজ্জার মতো সেই প্রশস্ত দিবালোকে সর্বজন সমক্ষে আমাকে জাবড়ে ধরে দুই গালে ঝপাঝপ এক হর বা দুই টন চুমো খেল।
সুশীল পাঠক, সচ্চরিত্র পাঠিকা, মায় দেশের মরালিটি রক্ষিণী বিধবা পদীপিসি এতক্ষণে একবাক্যে নিশ্চয়ই নাসিকা কুঞ্চিত করে দ্যা, ছ্যা বলতে আরম্ভ করেছেন। আমি দোষ দিচ্ছিনে। এ-স্থলে আম্বো তাই করতুম– যদি-না নাটকের হেরোইন আমার প্রিয়া লটে (তোলা নাম শার্লট) হত। বাকিটা খুলে কই।
ওর বয়স যখন নয়-দশ, আমার বয়স ছাব্বিশ। আমি বাস করতুম ছোট গোডেসবের্গ টাউনের উত্তরতম প্রান্তে লটেদের বাড়ির ঠিক মুখোমুখি। ওদের পাশে থাকত দুই বোন গ্রেটেক্যাটে। আরও গোটা পাঁচেক মেয়ে তাদের বাড়ির পরে। কারওই বয়স বারো-তেরোর বেশি নয়।
লটে ছিল সবচেয়ে ছোট।
আমার জীবনের প্রথম প্রিয়া।
আর সব কটা মেয়ে এ তথ্যটা জানত এবং হয়তো অতি সামান্য কিছুটা হিংসে হিংসে ভাব পোষণ করত। ওদের আশ্চর্য বোধ হত হয়তো, যে লটে তো ওদের তুলনায় এমন কিছু শুলেবাকাওলি নয় যে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এসে আমি এরই প্রেমে মজে যাব। এটা অবশ্য আমি বাড়িয়ে বলছি। প্রেমে মজার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আমার বয়স ছাব্বিশ, ওর নয় কি দশ।
আসলে ব্যাপারটি কী জানেন? জর্মনদের ভিতরে যে চুল অতিশয় বিরল, লটের ছিল সেই চুল। দাঁড়কাকের মতো মিশমিশে কালো একমাথা চুল। ঠিক আমার মা-বোনদের চুলের মতো। ওর চুলের দিকে তাকালেই আমার মা-বোনদের কথা, দেশের কথা মনে পড়ত। আর লটে ছিল আমার বোনদের মতো সত্যই বড় লাজুক। সক্কলের সামনে, নিজের থেকে, আমার সঙ্গে কখনও কথা বলত না।
আমাদের বাড়ির সামনে ছিল একচিলতে গলি। সেখানে রোজ দুপুর একটা-দুটোয় আমরা ফুটবল খেলতুম। আমার বিশ্বাস তুমি পাঠক, আমাদের সে টিমের নাম জানো না। আমিও অপরাধ নেব না। আমরা যে আইএফএ শিলডে লড়াই দেবার জন্য সে আমলে ভারতবর্ষে আসিনি তার মাত্র দুটি কারণ ছিল। পয়লা: অতখানি জাহাজ ভাড়ার রেস্ত আমাদের ছিল না। এবং দোসরা : আমাদের কাইজার টিম-এ পুরো এগারো জন মেম্বর ছিলেন না। আমরা ছিলুম মাত্র আষ্টো জন। তৃতীয়ত, যেটা অবশ্য আমাদের ফেভারেই যায়, আমাদের ফুটবলটি ছিল অনেকটা বাতাবি নেবুর মতো। ওরকম ফুটবল দিয়ে কি সমদ, কি জুম্মাখান কখনও প্যাটার্ন-উইভিং ড্রিবলিং উজিং ডাকিঙের সুযোগ পাননি।
হায়, হায়! এ জীবনটা শুধু সুযোগের অবহেলা করে করেই কেটে যায়। এসব আত্মচিন্তা যে তখন করেছিলুম তা নয়।
চল্লিশ বছর পর পুনরায় এই প্রথম আমাদের পুনর্মিলন। লটে হঠাৎ শুধাল, হার সায়েড! তুমি বিয়ে করেছ?
শুনেছি ইহুদিরা নিতান্ত গঙ্গাযাত্রার জ্যান্ত মড়া না হলে কোনও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন শুধিয়ে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা দেয়। আমি শুধলুম, তুই?
খলখল করে হেসে উঠল।
কেন? আমার আঙুলে এনগেজমেন্ট রিং, বিয়ের আংটি দুটোই এখনও তোমার চোখে পড়েনি। আমি তো দিদিমা হয়ে গিয়েছি। চলো আমাদের বাড়ি।
আমি সাক্ষাৎ যমদর্শনের ন্যায় ভীত চকিত সন্ত্রাসগত হয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠলুম, সে যদি আমায় ঠ্যাঙায়?
দুটি মিষ্টিমধুর ঠোঁটের উপর অতিশয় নির্মল মৃদু হাসি এঁকে নিয়ে বললে, বটে! আমার জীবনের প্রথম প্রিয়কে সে প্যাদাবে? তা হলে সেই হালুঙ্কেটাকে আমি ডিভোর্স করব না?
তওবা, তওবা!