পাকিস্তান প্রস্তাব ও ফজলুল হক – অমলেন্দু দে
.
ভূমিকা
১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৬ অক্টোবর আবুল কাশেম ফজলুল হক বরিশাল জেলার চাখার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এখনও ফজলুল হকের ভূমিকা নিয়ে ঐতিহাসিক ও গবেষক মহলে বিশেষ কোনও আলোচনা শুরু হয়নি। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে ওখানে প্রকাশিত কয়েকখানি গ্রন্থে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে:
১. বি. ডি. হাবিবুল্লাহ, শেরে বাংলা, বরিশাল, আষাঢ়, ১৩৬৯
২. খোন্দকার আবদুল খালেক, এক শতাব্দী, ঢাকা, অগ্রহায়ণ, ১৩৬৯
৩. A.S. M. Abdur Rab, A. K. Fazlul Huq (Life and Achievements), Barisal, 1966
এইসব গ্রন্থে ফজলুল হক সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া গেলেও তা গবেষণামূলক ইতিহাস গ্রন্থের পর্যায়ে পড়ে না। তা ছাড়া আরও কয়েকখানি গ্রন্থে ফজলুল হক সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়:
১. M. A. H. Ispahani, Qaid-E-Azam Jinnah As I Knew Him, Karachi, 1966
২. ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী (মহারাজ), জেলে ত্রিশ বছর ও পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ঢাকা, ১৯৬৮
৩. বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খণ্ড), ঢাকা, ১৯৭০
৪. আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, ঢাকা ১৯৭০
৫. Tariq Ali, Pakistan : Military Rule or People’s Power, London, 1970
ইস্পাহানি, ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী ও আবুল মনসুর আহমদ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তাঁদের গ্রন্থে ফজলুল হক সম্পর্কে মন্তব্য করেন। জিন্নার অনুগত শিষ্য ইস্পাহানি ফজলুল হক বিরোধী ছিলেন। তাই তাঁর মন্তব্য ও আলোচনা ফজলুল হকের ভূমিকা বিশ্লেষণে বিশেষ প্রয়োজন। বদরুদ্দীন উমর ও তারিক আলি ১৯৪৭-১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করার সময়ে স্বাভাবিকভাবে ফজলুল হকের ভূমিকাও আলোচনা করেন।
এই বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গেও কয়েকখানি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে:
১. মুজফফর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা, কলিকাতা, সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫
২. কালিপদ বিশ্বাস, যুক্ত বাংলার শেষ অধ্যায়, কলিকাতা, আগস্ট, ১৯৬৬
৩. প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী, পাক-ভারতের রূপরেখা, চাকদহ, নদিয়া, ভাদ্র, ১৩৭৫
৪. Humayan Kabir, Muslim Politics 1906-47 and Other Essays, Calcutta, 1969
৫. D. N. Banerjee, East Pakistan A Case-Study in Muslim Politics, Delhi, 1969
৬. অমিতাভ গুপ্ত, পূর্ব পাকিস্তান, কলিকাতা, জ্যৈষ্ঠ, ১৩৭৬।
মুজফফর আহমদ ফজলুল হক ও নবযুগ কাগজ সম্পর্কে কিছু তথ্য পরিবেশন করেন। অমিতাভ গুপ্তের গ্রন্থে ১৯৪৮-১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফজলুল হকের ভূমিকা বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। পূর্ববঙ্গের কংগ্রেস নেতা প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী ফজলুল হক সম্পর্কে যেসব মতামত ব্যক্ত করেন তা খুবই উল্লেখযোগ্য। আর হুমায়ুন কবির ও দেবেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর গ্রন্থে মুসলিম রাজনীতি ও ফজলুল হকের কার্যাবলি সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু এইসব গ্রন্থে ফজলুল হক সম্পর্কে কোনো ধারাবাহিক আলোচনা নেই। কেবলমাত্র প্রখ্যাত সাংবাদিক কালিপদ বিশ্বাসের গ্রন্থেই বিশদভাবে ফজলুল হকের রাজনৈতিক জীবন ও কার্যাবলি আলোচিত হয়েছে। তিনি গভীর দরদ দিয়ে বাঙালি ফজলুল হককে বিশ্লেষণ করেন।
সম্প্রতি বিদেশি লেখকেরাও এই বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। জে. এইচ. ব্রুমফিল্ড Elite Conflict in a Plural Society ; Twentieth Century Bengal (Bombay, 1968) নামক গ্রন্থে অনেক তথ্যের সাহায্যে ফজলুল হকের ভূমিকা বিশ্লেষণ করেন। এই গ্রন্থের প্রধান আলোচ্য বিষয় হল ১৯১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক সমস্যা। এই আলোচনা ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেলেও লেখক তার জন্য কোনো মৌলিকত্ব দাবি করেননি। ব্রুমফিল্ডের কোনো কোনো মন্তব্য সম্পর্কে হয়তো আলোচনার অবকাশ আছে। তবুও সমগ্র গ্রন্থখানি পাঠকের মনকে গভীরভাবে নাড়া দেবে। একজন বিদেশি হিসেবে তাঁর সীমাবদ্ধতার কথা মনে রেখেই দু-একটি মন্তব্য করছি। ব্রুমফিল্ডের রচনায় উদার স্বভাব-অসাম্প্রদায়িক বাঙালি ফজলুল হক খুব সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হননি। মুসলমানদের আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ফজলুল হকের সঙ্গে অবাঙালি মুসলিম লিগ নেতৃত্বের কোনো কোনো বিষয়ে মিল থাকলেও নানা বিষয়ে অমিলও একেবারে কম ছিল না। ফজুলল হকের ওপর গ্রাম বাংলার ও অশ্বিনীকুমার দত্ত, আশুতোষ মুখার্জি, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রভৃতির প্রভাব কতটা ছিল, অথবা পরবর্তীকালে স্যার উইলিয়াম হান্টারের মতবাদের দ্বারা তিনি কতটা প্রভাবান্বিত হন, সে বিষয়ে বিশেষ কোনো তথ্য না থাকায় ফজলুল হক চরিত্রের প্রকৃত বিশ্লেষণ তাঁর রচনায় পাওয়া যায় না। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার, শিক্ষিত মুসলমানেরা স্যার হান্টার রচিত দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস গ্রন্থের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত হন। মুসলিম মানসে হান্টারের প্রভাব আলোচনা না করে ভারতে বিভেদের রাজনীতির সম্যক আলোচনা সম্ভব নয়। দিল্লিতে জাতীয় মহাফেজখানায় রক্ষিত ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে সারাভারত মুসলিম লিগ অধিবেশনে সভাপতিরূপে ফজলুল হকের বিখ্যাত ভাষণ আলোচনা করলে সে যুগে তাঁর চিন্তাধারা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা করা যায়। তা ছাড়া ফজলুল হক রচিত কৃষক প্রজা সমিতির আদর্শ ও কর্মসূচি, অসংখ্য ভাষণ ও চিঠিপত্র ইত্যাদির সাহায্যে ফজলুল হকের ভূমিকা আলোচনা না করলে তাঁর সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন করা কষ্টকর। তাই আমার মনে হয়েছে, ব্রুমফিল্ড ঠিক আসল মানুষটিকে বুঝতে পারেননি।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ফজলুল হক উপলব্ধি করেন, তাঁর বিশাল কর্মজীবনের কাহিনি লিপিবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। তাঁর ভূমিকা আলোচনা করে পূর্ববঙ্গে যেসব গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তাতে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেননি। তাই তিনি আত্মজীবনী লেখবার জন্য উদ্যোগী হন। তখন তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি ফজলুল হক তাঁর প্রিয়তম ভাগনে খান বাহাদুর এ. এন. এম. ইউসুফ আলিকে একটি চিঠিতে লেখেন যে, তিনি আত্মজীবনী লিখতে চান। কিন্তু তাঁর জীবনের সমস্ত ঘটনাবলি ভালো করে মনে নেই। তাই তিনি ইউসুফ আলিকে তথ্য সংগ্রহ করতে বলেন। তিনি তাঁকে ওয়াজির আলি ও মঞ্জুর মুরশেদের সঙ্গেও দেখা করতে বলেন এবং তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে প্রয়োজনীয় তথ্য পাঠাতে বলেন। খান বাহাদুর ওয়াজির আলি ফজলুল হকের জামাতা ও ভাগনে এবং খান বাহাদুর মঞ্জুর মুরশেদও ফজলুল হকের ভাগনে ছিলেন। ফজলুল হক ইউসুফ আলিকে এই চিঠিতে লেখেন যে, ‘তুমি আমার জীবনের ঘটনাবলি সম্পর্কে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছো। তা থেকে আমি কীভাবে ভেবেছি, কাজ করেছি, তা জানা যাবে।’ এই চিঠি থেকে পরিষ্কার জানা যায়, ফজলুল হক ইউসুফ আলিকেই তাঁর জীবনের ঘটনাবলির জন্য নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি মনে করেন। আর নির্ভর করেন ওয়াজির আলি ও মঞ্জুর মুরশেদের ওপর। কিন্তু বয়সের ভারে ফজলুল হকের পক্ষে এই দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয়নি। ক্রমান্বয়ে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে এবং ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ এপ্রিল তিনি পরলোকগমন করেন।
১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ইউসুফ আলির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তখন তিনি কলকাতার পার্কসার্কাস অঞ্চলে ১৭এ দিলখুসা স্ট্রিটে থাকতেন। একদিন তিনি আমাকে ফজলুল হক সম্পর্কে তিনি যেসব খবরের কাগজের কাটিং, প্রবন্ধ ও অসংখ্য চিঠিপত্র সংগ্রহ করে রেখেছেন তা দেখান। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে ইউসুফ আলির সঙ্গে আবার যখন আমার দেখা হয় তখন কথা প্রসঙ্গে তাঁকে আমি ফজলুল হকের একটি প্রামান্য জীবনী লিখতে অনুরোধ করি এবং এইভাবে তাঁর অবসর জীবন ব্যয় করতে বলি। আমার এই প্রস্তাব শুনে তিনি খুবই উৎসাহিত হন। নানা পারিবারিক ঝামেলায় ইউসুফ আলির পক্ষে জীবনীগ্রন্থ রচনার কাজে হাত দেওয়া সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া ইতিমধ্যে তাঁর এক আত্মীয় আজিজুল হক ঢাকা থেকে এসে ফজলুল হকের ভাষণ ইত্যাদি সংগ্রহ করা ছিল যে ফাইলটিতে তা কিছুদিনের জন্য চেয়ে নিয়ে যান। আজিজুল হক ইউসুফ আলিকে বলেন যে, তিনি ফজলুল হক সম্পর্কে একটি বই লিখছেন। তার জন্য এই ফাইলটি দরকার। কাজ হয়ে গেলে তিনি ফাইলটি ফেরত পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু সে ফাইলটি আর ইউসুফ আলি ফেরত পাননি। ইউসুফ আলি নিজে এই কথা আমাকে বলেছেন। তা ছাড়া তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ওয়াজির আলিও এই ঘটনা জানেন (এই গ্রন্থের শেষে ওয়াজির আলি লিখিত পত্রটি প্রকাশিত হল)। কিন্তু বেদনার কথা হল এই, আজিজুল হক নিজে কোনো গ্রন্থ রচনায় এই তথ্যসমূহ কাজে না লাগালেও তা টাইপ করে ‘আজিজুল হক কালেকশন’ নামে গবেষক ও ঐতিহাসিকদের নিকট প্রচার করছেন।
১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ৯ জানুয়ারি ইউসুফ আলি কলকাতাতে পরলোকগমন করেন। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী মোতাহেরা বানু ঢাকা চলে যাবার পূর্বে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র আসফ আলিকে ফজলুল হক লিখিত চিঠিপত্র, খবরের কাগজের কাটিং ইত্যাদি যা কিছু অবশিষ্ট আছে তা আমাকে দিতে বলেন। আসফ আলি ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ঢাকা চলে যাবার সময়ে ইউসুফ আলির সংগ্রহ থেকে যে সমস্ত কাগজপত্র অবশিষ্ট ছিল তা আমাকে দিয়ে যান। আসফ আলি বলেন, কয়েকবার বাড়ি পরিবর্তনের ফলে অনেক কাগজপত্র নষ্ট হয়ে যায়। ইউসুফ আলির মৃত্যুর পরে এইসব কাগজপত্রের মধ্যে তাঁর কন্যা শ্রীমতী তাহমিনা বানু ইউসুফ আলির হাতের লেখা তিনটি পৃষ্ঠা পান। তা থেকে জানা যায় ইউসুফ আলি ফজলুল হকের জীবনী লিখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু তিন পৃষ্ঠার বেশি লেখা সম্ভব হয়নি। তাহমিনা বানু এই তিনটি পৃষ্ঠা আমাকে দেন।
১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের মে-জুন মাসে ওয়াজির আলি আমাকে একটানা প্রতিদিন ফজলুল হক সম্পর্কে অনেক ঘটনা বলেন। আমি তাঁর সামনে বসে তা লিখে নিতাম। তারপরে প্রতি পৃষ্ঠায় তিনি স্বাক্ষর দিতেন। তখন ওয়াজির আলির প্রকৃত বয়স ছিল ৭৬ বছর। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর স্মৃতিশক্তি খুবই প্রখর ছিল। তাঁর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হওয়ায় আমার পক্ষে ফজলুল হকের ভূমিকা বিশ্লেষণে খুবই সুবিধা হয়। তিনি ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে পূর্ববঙ্গে মেয়ের নিকট চলে যান। যাবার পূর্বে তিনি অনেক চিঠিপত্র আমাকে দিয়ে যান।
ইউসুফ আলির সংগ্রহ ও ওয়াজির আলির সংগ্রহ পাবার পরই আমি ফজলুল হকের ভূমিকা বিশ্লেষণে সাহসী হই। তাঁদের অকৃপণ সাহায্য ও আশীর্বাদ না পেলে আমার পক্ষে এই কাজে হাত দেওয়া সম্ভব ছিল না। ফজুলল হক যাঁদের ওপর নির্ভর করে আত্মজীবনী লিখতে চেষ্টা করেন তাঁদের দু-জনের কাছ থেকে আমি সাহায্য পেয়েছি। কিন্তু মঞ্জুর মুরশেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তাঁর কাছে ফজলুল হকের লেখা চিঠিপত্র নিশ্চয়ই ছিল এবং তিনি নিজেও অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তাঁর পরিবারের কেউ যদি এই বিষয়ে উদ্যোগী হতেন তা হলে খুবই ভালো হত।
আমার স্ত্রী শ্রীমতী নাসিমা বানু ফজলুল হকের ভূমিকা বিশ্লেষণে আমাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেন। তিনি ইউসুফ আলির তৃতীয় কন্যা। তাই খুবই কাছে থেকে ফজলুল হককে দেখবার তাঁর সৌভাগ্য হয়েছিল। তা ছাড়া বাল্যকাল থেকে পারিবারিক পরিবেশে অনেক আলাপ-আলোচনাও তিনি শুনেছেন। আর কোনো কোনো ঘটনা তাঁর নিজেরও মনে আছে। জিন্নার বিরুদ্ধে ফজলুল হক কতটা ক্ষুব্ধ ছিলেন তার একটি মাত্র দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করছি। এমন অনেক ঘটনা আমার স্ত্রীর কাছ থেকে শুনেছি। নাসিমা তখন সাখওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের ছাত্রী। জিন্নার ও পাকিস্তান দাবির উগ্র সমর্থক পরিবারের ছাত্রীরা প্রায়ই ফজলুল হকের সমালোচনা করতেন। নাসিমাও পাকিস্তান দাবির বিরুদ্ধে মতামত ব্যক্ত করতেন। তার ফলে তর্কবিতর্ক হত। বলাবাহুল্য প্রায় সব ছাত্রীই জিন্নার সমর্থক ছিলেন। তখন ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে পাকিস্তান প্রস্তাব ও জিন্নার ভূমিকা প্রচারের জন্য বাংলায় কয়েকখানি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। নাসিমার একজন সহপাঠিনী এই ধরনের একখানি গ্রন্থ তাঁকে পড়বার জন্য দিয়ে বলেন, ‘তুই আগে এই গ্রন্থ পড়ে দেখ, তারপর তর্ক করিস।’ এই গ্রন্থের কভারে জিন্নার ছবি ছিল। নাসিমা এই গ্রন্থ বাড়িতে নিয়ে এসে পড়ার টেবিলে রেখে দেন। ফজলুল হক ইউসুফ আলির বাড়িতে ছেলে-মেয়েদের পড়ার টেবিলে জিন্নার ছবি সহ গ্রন্থ দেখে ভয়ানক বিরক্তি প্রকাশ করেন। তিনি ইউসুফ আলির ছেলে-মেয়েদের ডেকে বলেন, আর যেন কখনও তিনি জিন্নার মতো একজন বাজে লোকের ছবি দেখতে না পান। তখন থেকে ইউসুফ আলির ছেলে-মেয়েরা সতর্ক হন। তাঁরাও জিন্না-বিরোধী হয়ে পড়েন। আর তার জন্য স্কুল ও কলেজে তাঁদের অনেক দুর্ভোগ ভুগতে হয়। জিন্নাপন্থী মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট হতে তাঁদের অনেক কটু কথাই শুনতে হত।
আমি গত চার বছর ধরে একটানা কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগার ও দিল্লির জাতীয় মহাফেজখানায় কাজ করে ফজলুল হক সম্পর্কে যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছি তা এই গ্রন্থ রচনায় খুবই কাজে লাগে। কলকাতাতে জাতীয় গ্রন্থাগারে স্যার তেজবাহাদুর সাপ্রুর সমস্ত কাগজপত্র রক্ষিত আছে। শ্রী বি. এন. সাপ্রু আমাকে অনুমতি দেওয়ায় ‘সাপ্রু পেপারস’ ব্যবহার করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়। লন্ডনে প্রকাশিত The Transfer of Power, vols. I–XI গ্রন্থ থেকেও আমি অনেক তথ্য পেয়েছি।
মোহম্মদ জ্যাকেরিয়া ও সেলিম কোরেশী ঢাকা থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা সংগ্রহ করে আমাকে এই গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার শ্রী সজলেন্দু দে কিছু তথ্য সরবরাহ করেন। আমার তরুণ জাপানি বন্ধু মি. হিরোসি সাতো অনেক কষ্ট করে পূর্ববঙ্গ থেকে কয়েকখানি দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ, ইস্তাহার ও পত্রপত্রিকা সংগ্রহ করে নিয়ে না আসলে এই গ্রন্থ রচনার কাজ সম্পন্ন করা কষ্ট হত।
বিশ্বভারতীর উপাচার্য ড. প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ছিলেন তখন থেকে আমি তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করি। তিনি আমাকে নানাভাবে উৎসাহিত করেন। বর্তমান বিভাগীয় প্রধান ড. জগদীশ নারায়ণ সরকার এই গ্রন্থ রচনার প্রতিটি স্তরে আমাকে অনুপ্রাণিত করেন। অধ্যাপক ড. অনিলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ ঘটায় আমার খুবই সুবিধা হয়।
এই গ্রন্থে দ্বিজাতিতত্ত্ব সম্পর্কে ফজলুল হকের মতামত বিশদভাবে আলোচনা করা হল। ইচ্ছা আছে অদূর ভবিষ্যতে ফজলুল হকের ভূমিকার অন্যান্য দিক নিয়েও আলোচনা করার। অসাম্প্রদায়িক ও উদারচেতা ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করায় অনেকেই বিস্মিত হন। কিন্তু প্রশ্ন হল: পাকিস্তান দাবির প্রধান প্রবক্তাদের সঙ্গে খাঁটি বাঙালি ফজলুল হকের মানসিক গড়নের কি কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়? জিন্নার বিভেদপন্থার বিরুদ্ধে প্রথম বলিষ্ঠ প্রতিবাদ ফজলুল হকের কণ্ঠে কেন ধবনিত হল? এখনও এইসব প্রশ্ন নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়নি। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না ফজলুল হক সর্বপ্রথম ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের গোটা ভিত আলগা করে দেন এবং পূর্ববাংলার মানুষকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভাবধারায় উদ্দীপিত করেন। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের তাৎপর্য বুঝতে হলে ফজলুল হকের ভূমিকা বিশ্লেষণ একান্ত প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যেই আলোচ্য গ্রন্থের সূত্রপাত। এই গ্রন্থের আলোচ্য বিষয় ১৯৪০-১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও আমি আলোচনার সুবিধার জন্য ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ফজলুল হকের ভূমিকা বিশ্লেষণ করেছি। আর এই আলোচনা শেষ করেছি ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে মুখ্যমন্ত্রীরূপে ফজলুল হকের পদচ্যুতির কথা উল্লেখ করে।
এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু সংক্ষিপ্ত আকারে ইতিহাস পত্রিকায় (নব পর্যায় ষষ্ঠ খণ্ড, ১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ সংখ্যা, ১৩৭৮) ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ক্যালকাটা হিস্টরিক্যাল সোসাইটির পরিচালকমণ্ডলী ও ইতিহাস পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী উদ্যোগী হয়ে এই রচনা প্রকাশ করে আমাকে খুবই উৎসাহিত করেন।
ইতিহাস পত্রিকায় এই রচনাটি পাঠ করে আমার প্রাক্তন ছাত্র শ্রীঅসিতকুমার দলুই এই রচনা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার জন্য আমাকে অনুরোধ করেন। তিনিই প্রথম কয়েকজন প্রকাশকের নিকট আমার রচনাটি দেখান। তার ফলে কয়েকজন প্রকাশক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। অবশেষে শ্রীক্ষিতীশচন্দ্র দে এই গ্রন্থ প্রকাশের দাযিত্বভার গ্রহণ করেন। তাঁরই উৎসাহ ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে এই গ্রন্থ দ্রুত প্রকাশ করা সম্ভব হল। মুদ্রণ পারিপাট্যের সমস্ত কৃতিত্ব বাসু প্রিন্টার্সের প্রাপ্য। এই গ্রন্থের ছবি প্রকাশে সাহায্য করেন ফোটোগ্রাফার শ্রীঅলোক দে ও স্ট্যান্ডার্ড ফোটো এনগ্রেভিং। আর প্রচ্ছদপট আঁকেন শিল্পী শ্রীঅরুণ গুপ্ত। কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগার কর্ত্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা থেকে হাইমচরে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে ফজলুল হকের সাক্ষাৎকারের ছবিটি নেওয়া হয়েছে। ৮৮ বছর বয়সের ফজুলল হকের ছবিটি পাঠিয়েছেন এস. এম. আজিজুল হক (শাজাহান)। আর অন্য দুটো ছবি ইউসুফ আলির সংগ্রহ থেকে পেয়েছি। এই গ্রন্থের প্রথম ছবিটি ফজুলল হক নিজে লিখে ইউসুফ আলিকে উপহার দেন।
আমি এই গ্রন্থে সমগ্র বাংলাদেশের (পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গ-সহ) কথা বোঝাতে গিয়ে ‘বাংলাদেশ’ শব্দ ব্যবহার করেছি। অনেক সতর্ক থাকা সত্ত্বেও কয়েকটি মুদ্রণ ত্রুটি থাকতে পারে। আশাকরি পাঠকবর্গ সেজন্য আমাকে মার্জনা করবেন।
যাঁদের কাছ থেকে এই গ্রন্থ রচনায় সাহায্য ও উৎসাহ পেয়েছি তাঁদের প্রত্যেককে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
অমলেন্দু দে
৩ অজন্তা পার্ক
কলকাতা
Leave a Reply