বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফজলুল হকের আবির্ভাব
১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে আবুল কাশেম ফজলুল হক বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য হন। তখন থেকেই তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। তারপর থেকে একটানা ভারত বিভাগের সময় পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের আইনসভার সদস্য ছিলেন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের ঢাকা বিভাগীয় কেন্দ্রের শূন্যপদে উপনির্বাচনে ফজলুল হকের সঙ্গে রায়বাহাদুর কুমার মহেন্দ্রনাথ মিত্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। এই নির্বাচন কেন্দ্রের বেশির ভাগ ভোটারই ছিলেন হিন্দু। তখন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার ছিল না। খাজনা ও সেস প্রদানের সামর্থ্য যাঁদের ছিল তাঁরাই ছিলেন ভোটার। বঙ্গ-ভঙ্গ রহিত হবার পরে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে যথেষ্ট তিক্ততা ছিল। তাই অন্য কোনো মুসলমান নেতা বর্ণ-হিন্দুদের প্রাধান্য আছে এমন একটি কেন্দ্রে নির্বাচন প্রার্থী হতে সাহসী হননি। ফজলুল হক এই নির্বাচন সংগ্রামে অবতীর্ণ হন।১ স্বদেশি যুগের প্রখ্যাত নেতা অশ্বিনী কুমার দত্ত তাঁকে সমর্থন করেন। ফজলুল হকের পিতা মৌলবী মহম্মদ ওয়াজেদকে অশ্বিনী কুমার দত্ত খুবই শ্রদ্ধা করতেন এবং ফজলুল হককে তিনি পুত্রতুল্য স্নেহ করতেন। তাই অশ্বিনী কুমার দত্তের স্নেহধন্য ফজলুল হকের পক্ষে এক জটিল সাম্প্রদায়িক পরিবেশের মধ্যেও অগ্রসর হওয়া কষ্টকর হয়নি।২ ফজলুল হকের অসাধারণ বাগ্মিতা ও আন্তরিকতায় নির্বাচকমণ্ডলী স্বাভাবিকভাবেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়। তিনি যেসব ভাষণ দেন তাতে একটি পরিচ্ছন্ন বাঙালি মনের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ঘোষণা করেন, তিনি বাঙালির উন্নতি ও কল্যাণের জন্য সংগ্রাম করবেন। বাঙালির সম্মান ও আত্মমর্যাদার কথা বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরায় গোটা নির্বাচনী পরিবেশ তাঁর অনুকূলে যায়। তাই মুসলমান হয়েও বর্ণ-হিন্দুদের ভোটে বর্ণ-হিন্দু প্রার্থীকে তিনি পরাজিত করতে সক্ষম হন। এইভাবেই বাঙালি ফজলুল হকের রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে।৩
১৯১৩ খ্রিস্টাব্দেই ফজলুল হক বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লিগের সম্পাদক হন। স্যার সলিমুল্লা ছিলেন সভাপতি। তাছাড়া ফজলুল হক সারা ভারত মুসলিম লিগের সহ-সম্পাদকও ছিলেন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে স্যার সলিমুল্লার মৃত্যুর পরে তাঁকেই বাংলাদেশের মুসলিম লিগের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়। এই সময়ে তিনি জাতীয় কংগ্রেসেও যোগদান করেন এবং কংগ্রেসের নেতৃত্বপদে আসীন হন। একই সঙ্গে তিনি লিগ ও কংগ্রেসের মধ্যে থেকে দেশের সেবা করেন।৪ ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি সারা ভারত মুসলিম লিগের দিল্লি অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন।৫ এখানে তিনি সভাপতির ভাষণে ভারতের দুঃখ বেদনার এক করুণ চিত্র তুলে ধরেন। তিনি রমেশচন্দ্র দত্তের গ্রন্থ সমূহ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করেন। তিনি বিশ্বাস করেন, ব্রিটিশ শাসনের ফলেই ভারত এক দরিদ্র দেশে পরিণত হয়েছে। তিনি এই সময়ে রমেশচন্দ্র দত্তের চিন্তাধারার দ্বারা খুবই অনুপ্রাণিত হন। ফজলুল হক তাঁর ভাষণে বলেন:
I believe we are now in a position to offer a complete answer to Lord George Hamilton, on the basis of the test laid down by him. We have seen that India is now chronically famine stricken and that these famines are really due to the abject poverty of the Indian people. We have also seen that this poverty has been directly due to the fact that under British Rule the sources of national wealth in India been gradually narrowed and that unjust charges on the Indian people have drained away all available wealth in the country. India therefore has materially retrograded in material prosperity under British Rule, in consequence of the policy hitherto pursued by our British Rulers…In dealing with the present economic condition of the country, I have not said anything new, nor have I been able to put forward any novel arguments in support of the proposition that the present system of Indian Administration has been productive of the most baneful results. It has been said of the ancient Roman Empire that it sucked the orange off its provinces dry and left only the rind to its subjects. The Economic History of India shows that a similar process has unfortunately been going on in this country under British Rule and our Rulers have not only sucked the Indian orange juiceless, but the chances are that if they are not pulled up in time, even the rind will not be left over for the Indian people.৬
তাঁর মতে, পূর্ণ দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই ভারতের মুক্তি অর্জিত হতে পারে। যাঁরা বলেন, পূর্ণ দায়িত্বশীল সরকার কার্যত হিন্দু আধিপত্য স্থাপন করবে এবং ব্রিটিশের হাত থেকে ক্ষমতা চলে গেলে মুসলমান ও অনুন্নত সম্প্রদায়ের লোকেরা বিপন্ন হবেন, তাঁদের সঙ্গে ফজলুল হক একমত হতে পারেননি। পূর্ণ দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা যাঁরা মানতে রাজি নন, তাঁরা তাঁদের যুক্তির স্বপক্ষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং হিন্দু জমিদার, মহাজন, আইনজীবী প্রভৃতি কর্তৃক মুসলমানদের শোষণ ও পীড়নের কথা উল্লেখ করেন। ফজলুল হক বিস্তারিতভাবে এইসব প্রশ্ন নিয়ে তাঁর ভাষণে আলোচনা করেন। তিনি মনে করেন, হিন্দুরা মুসলমানদের শত্রু নন। শিক্ষার অভাবে ও অন্যান্য কারণে ধর্মান্ধতা দুই সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষের মধ্যে দানা বেঁধে আছে। তাই তাঁরা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারেন না। এই কারণে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তারা লিপ্ত হন। শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের মন প্রসারিত হবে এবং পরস্পরের মধ্যে সহনশীলতার ভাব জাগ্রত হবে। আর হিন্দু জমিদার, মহাজন, আইনজীবী প্রভৃতির শোষণ ও পীড়ন সম্পর্কে তিনি বলেন, এই শোষণ ও পীড়ন কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য নয়। সমভাবে মুসলমান জমিদার, মহাজন, আইনজীবী প্রভৃতিও শোষণ ও পীড়ন করে থাকেন।৭ ফজলুল হক বলেন:
On the question of Hindu-Moslem relations I consider it a gross libel on both communities to say that the Hindu is the natural enemy of the Mussalmans, Those who base their case on unfortunate incidents like the Arrah riots and similar disturbances at once betray the weakness of their arguments. These disturbances are due to the fanaticism and ill conceived religious fervour of those sections of the two communities who, from want of education and other causes, have not learnt to be tolerant of the feelings and sentiments of others. We must look to a liberal spread of education and to all that education brings in train, to effect that broadening of view and to inspire our people with that spirit of mutual toleration and forbearance which alone can put an effective quietus to such disturbance. No one has ever heard of a riot between educated Hindus and educated Mussalmans; sectional differences between he lower orders must always exist and riots between different sections of one and the same community are also not unknown, these are amongst the numerous ills incidental to human life, which only give opportunities for leaders of men to discharge one of the highest duties to society by bringing their erring brethren to the paths of reason. As regards the oppressions of Hindu landlords, money-lenders, lawyers and others, I do not think that the Mahomedan representatives of these sections of society are less merciful to their respective victims ; the relation between a landlord and his tenant, between a money-lender and his debtor, between a lawyer and his client are merely personal and individual and are seldom affected by communal consideration. I know of instances of actual oppressions by Mahomedan landlords and money-lenders of Mahomedan tenants and debtors which can hardly be surpassed by any authentic records of oppressions, by any members of non-Moslem communities. These oppressions, again, can only be effectively minimized, for they cannot be completely wiped out of society, by the spread of education amongst the masses, which will give them the necessary resisting power.৮
তিনি মনে করেন, পূর্ণ দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেই মুসলমানদের সার্বিক উন্নতি সম্ভব। যাঁরা এখনও বিদেশি সরকারের আশ্রয়ে থাকতে চান, তাঁদের তিনি তিরস্কার করে বলেন:
The belief in an alien government as a heaven of refuge is as sillyos it is incorrect.৯
ফজলুল হক এই ভাষণে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রশ্ন বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেন। তিনি মনে করেন, নিজেদের প্রয়োজনেই হিন্দু ও মুসলমানকে এক সঙ্গে চলতে হবে। মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, তাঁরা যেন অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে সদভাব বজায় রাখতে তৎপর হন। কারণ তা না করতে পারলে তাঁরা শক্তিহীন হয়ে পড়বেন। তিনি বলেন:
We can not render any real services to our country unless we are prepared to rise above petty selfish considerations and if need be to sacrifice self at the glorious altar of duty. All the different communities must learn to outvie one another coming forward to serve the motherland, and it will be glorious day for our community if in this race for the honours of unselfish patriotism. Islam can win her way to the forefront of the noble band of Indian patriots. Even from the point of view of selfishness and self protection, Indian Mussalmans must learn to sink their differences with other communities and win their cooperaton, help and assistance in all their programme of work for the future. We would lose half of our strength, if in our struggles for safeguarding the interests of our community, we fail to have our non-Moslem brethren by our side, If racial and communal strifes have sometimes tarnished the history of the various communities in India, recent events have also shown that non-Moslems have not failed us in moments of real peril. Throughout the recent disturbances in Calcutta, it was a Hindu Journal, the redoubtable ‘Amritabazar Patrika’—which espoused the cause of the poor Mussalmans whose own journals had been suppressed by a rigorous exercise of the provisions of the Defence of India Act. I take this oppertunity of publicly acknowledging the services rendered to our community by the ‘Amritabazar Patrika’, the ‘Bharatmitra’ a vernacular organ of the Murwari Community in Calcutta, and also to the Hindu leaders in Bengal who were ever ready to help us with advice and assistance. It is through the cooperation of Hindu leaders that we were enabled to work up a commission to enquire into circumstances connected with the Calcutta Disturbances. I mention these facts with a little pardonable pride if only to show that Hindus and Mussalmans do not always cut one another’s throat but can even render one another material help and support.১০
যেসব মুসলমানেরা অ-মুসলমানদের প্রতি অসহিষুতা প্রদর্শন করে গর্ব অনুভব করেন এবং ভাবেন, ইসলামের প্রতি অনুরক্ত থাকতে হলে এই বিদ্বেষের মনোভাব পোষণ করা দরকার, তাঁদের আচরণ শুধু নীতিগতভাবে নিন্দনীয় নয়, রাজনৈতিক দিক থেকেও ক্ষতিকারক। বিশেষ করে এমন একটা সময়ে এই মনোভাব পোষণ করা হচ্ছে যখন প্রতিটি ভারতবাসীকে ঐক্যবদ্ধভাবে একটি শক্তিশালী আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো প্রয়োজন। ফজলুল হক বলেন:
Above all, we should renounce any luking spirit of strike and quarrel with other communities, and seek their help and assistance in our troubles and difficulties. There are some Mussalmans who think that intolerance of non-Moslems is a point of bravery and that a contrary feeling betokens cowardice. I have even come across Moslems who take a particular pleasure in assuming a militant attitude towards non-Moslems, as if devotion to Islam demands that we should always be on the war-path, irrespective of consequences. All this is not mere morally reprehensible, but politically a grievous blunder. We are daily drifting towards a position when we shall have to tackle one of the most obstinate and powerful bureaucracies known in history.১১
এই ভাষণে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে মুসলিম জগতের অবস্থা নিয়েও আলোচনা করেন। তিনি বলেন, ইউরোপের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলি যেভাবে তুরস্ক রাজ্যকে নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে নিয়েছে তাতে খলিফা ও পবিত্র স্থানগুলির নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রতিটি মুসলমানই ডদ্বিগ্ন।১২
মুসলিম লিগের এই দিল্লি অধিবেশনের সময়েই খেলাফত আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পথকে সুগম করার জন্য ফজলুল হক ঐকান্তিকতার সঙ্গে চেষ্টা করেন। কংগ্রেস-খেলাফত যুক্ত আন্দোলন এক নতুন ভাবাবেগের সৃষ্টি করে। কিন্তু কামাল আতাতুর্কের সংস্কারের ফলে খেলাফত আন্দোলনে ভাটার টান পড়ে। যে ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে ভারতের মুসলমানেরা আন্দোলন পরিচালনা করেন তার ভিত আলগা হয়ে যায়। কংগ্রেসের সঙ্গে ব্রিটিশ শাসকশ্রেণির বিরোধ তীব্রতর হলেও, একই সময়ে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে জটিল হয়ে ওঠে। ‘লক্ষ্ণৌ প্যাক্ট’ ও ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ এই জটিলতা দূর করতে পারেনি। ফজলুল হকও কংগ্রেস থেকে দূরে সরে যান। তিনি মহাত্মা গান্ধি পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন সমর্থন করতে পারেননি। তিনি বিদ্যালয় বয়কট নীতির বিরোধী ছিলেন। অন্যদিকে খেলাফতি আন্দোলন শেষ হলে জিন্নাও সক্রিয়ভাবে মুসলিম লিগে যোগদান করেন। গোলটেবিল বৈঠক হতে সৃষ্টি হল ‘কম্যুনাল এওয়ার্ড’ বা সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা। তারপরে হল ‘পুনা প্যাক্ট’। এইভাবে সব কিছু মিলিয়ে এক জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। সর্বত্র সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। আর ঐক্যের আশাও সমূলে বিনাশ প্রাপ্ত হয়।
ছেলেবেলা থেকেই গ্রাম-বাংলার সঙ্গে ফজলুল হকের নাড়ির যোগ ছিল। কৃষক-প্রজার দুঃখ-বেদনার সঙ্গে তাঁর পরিচয় কোনো পুথিগত বিদ্যা মারফত হয়নি। তিনি জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার বিভিন্ন সময়ে প্রত্যক্ষ করেন। তিনি অনুভব করেন, জমিদারী-মহাজনীপ্রথা উচ্ছেদ করতে না পারলে বাংলাদেশের কৃষক-প্রজার মুক্তি নেই। রাজনীতিতে প্রবেশ করার দুই বছরের মধ্যেই গ্রাম-বাংলার এই প্রধান সমস্যা নিয়ে তিনি ব্যস্ত থাকেন। তিনি বিভিন্ন জেলায় প্রজা আন্দোলন গড়ে তোলেন। নিজের জেলা বরিশালেই প্রথমে তিনি এই আন্দোলন শুরু করেন। তিনি ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে বরিশালের মুসলমান ও নমশূদ্র কৃষক প্রজাদের সঙঘবদ্ধ করতে চেষ্টা করেন।১৩ ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তাঁরই অনুপ্রেরণায় গৌরনদীর আগৈলঝারায় এক প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মুসলমান ও নমশূদ্র কৃষক-প্রজা একই সঙ্গে মিছিল করে এই সভায় যোগদান করে। হিন্দু ও মুসলমান নেতৃবৃন্দ কৃষক-প্রজাদের সমস্যা নিয়ে এই সভায় ভাষণ দেন।১৪ ক্রমান্বয়ে পূর্ব বঙ্গের অন্যান্য জেলায় প্রজা-আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এই সময়ে জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার সম্পর্কে কয়েকটি জেলায় কিছু পুস্তিকাও প্রকাশিত হয়।১৫ প্রজা আন্দোলনের প্রয়োজনে ফজলুল হক বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত শুরু করেন এবং বিভিন্ন জনসভায় ভাষণ দেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার মানিকগঞ্জ মহকুমায় কৃষক-প্রজা ও জমিদার-মহাজনদের মধ্যে বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করে। দেনার দায়ে ওই অঞ্চলের কৃষকদের প্রায় সব জমি জমিদার-মহাজনেরা কেড়ে নেয়। কৃষক-প্রজাদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে এই মহকুমার ঘীওর হাটে এক বিরাট প্রজা সম্মেলন আহ্বান করা হয়।১৬ প্রজা আন্দোলনের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ফজলুল হককে সভাপতিত্ব করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। তিনি সানন্দে এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। এই সম্মেলনকে সফল করার জন্য সর্বত্র স্বতঃস্ফূর্ত কর্মতৎপরতা শুরু হয়। ঢাকা সদর, পাবনা, টাঙ্গাইল এবং আরও কয়েকটি স্থান থেকে অনেক কর্মী এই সম্মেলনে যোগদান করেন। এক বিশাল কৃষক-প্রজা জমায়েতে ফজলুল হক জ্বালাময়ী ভাষায় প্রজা আন্দোলনের কর্মপন্থা ব্যাখ্যা করেন। মানিকগঞ্জ মহকুমার জমিদার-মহাজনদের অত্যাচার থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য ফজলুল হক কৃষকদের জমিদার-মহাজনদের জমি চাষ করতে নিষেধ করেন। তিনি বলেন: ‘দয়া করে জমি যখন নিয়েছে, এবার কর্তারা লাঙল চষুক মাঠে নেমে। ফসল বুনুক, ফসল ফলাক, ফসল কাটুক!’ কৃষক-প্রজারা কঠোর প্রতিজ্ঞা করে, তারা এবার জমিদার-মহাজনদের জমিতে লাঙল দেবে না।১৭ প্রায় এক বছর ধরে এই আন্দোলন চলে। অবশেষে জমিদার-মহাজন কৃষক-প্রজাদের প্রায় সব জমি ফেরত দিয়ে একটা আপস-রফা করে।১৮
এই আন্দোলনের সাফল্যে ফজলুল হক খুবই অনুপ্রাণিত হন। তিনি প্রজা আন্দোলনকে একটি সুসংহত রূপ দেবার জন্য তৎপর হন। তিনি ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে কৃষক-প্রজাদের একটি রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরই পরামর্শ অনুযায়ী এই দলের নামকরণ হয় ‘নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতি’। আর তিনিই হলেন এই সমিতির সভাপতি ও নেতা।১৯ তারপরে বিভিন্ন জেলায় এই সমিতি গঠিত হয়। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে পটুয়াখালি মহকুমার বরগুনা থানার গৌরীচন্নায় এক বিরাট কৃষক-প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।২০ মুসলিম লিগের নেতৃত্বপদে আসীন থাকলেও ফজলুল হক তাঁর সমস্ত শক্তি কৃষক-প্রজা সমিতির প্রয়োজনেই নিয়োজিত করেন। তিনি খেলাফতি আন্দোলনের শেষে নিজের হাতে গড়া দলকে ভিত্তি করেই বাংলাদেশে নিজের প্রভাববৃদ্ধি করতে তৎপর হন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার, ফজলুল হক পরিচালিত প্রজা আন্দোলনের নেতৃত্ব শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতেই ছিল। তখন সবাই ছিল প্রজা। কিন্তু সবাই তো আর কৃষক হতে পারত না। এই কারণে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে ‘প্রজা’ শব্দটি সহজেই গ্রহণযোগ্য হয়। আর তাঁরাও গ্রামের কৃষক ও অন্যান্য পেশার মানুষের স্বার্থ নিয়ে সহজেই আন্দোলন পরিচালনা করতে সক্ষম হন। এই সময়ে প্রজার স্বার্থের সঙ্গে কৃষকের স্বার্থ যুক্ত করে ফজলুল হক এক নতুন রাজনৈতিক আবহাওয়া সৃষ্টি করেন।
ফজলুল হক সর্বভারতীয় রাজনীতিতে যোগদান করলেও তাঁর দৃষ্টি সীমিত ছিল বাংলাদেশেই। তিনি উপলব্ধি করেন, সর্বভারতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের সুযোগ গ্রহণ করে অবাঙালি নেতৃবৃন্দ অন্যান্য প্রদেশে নিজেদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করতে ব্যস্ত এবং তাঁরা এই উদ্দেশ্য সাধনেই বাংলাদেশকে হাতিয়ার করে ব্যবহার করেন।২১ স্বভাবতই তিনি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদবিগ্ন হন। মুসলিম লিগের নেতৃত্বপদে আসীন থেকে মুসলমান সমাজের উন্নতির জন্য বিশেষ চেষ্টা করেও, তিনি বাংলাদেশের সামগ্রিক স্বার্থের কথা কখনই ভুলে যাননি। যখন তিনি দেখতে পেলেন মুসলিম লিগে অবাঙালির প্রাধান্য প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রকৃতপক্ষে তাঁরাই লিগের পরিচালক, তখন তিনি কৃষক-প্রজা সমিতিকে শক্তিশালী করেন।
বাংলাদেশেও মুসলিম লিগ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে। সাধারণত মুসলিম লিগের কাজ-কর্ম ইংরেজি ভাষায় হত, আর প্রয়োজন মতো উর্দুতে তা অনুবাদ করা হত। উর্দু ভাষা প্রচলনের জন্য অবাঙালিরা ‘অল বেঙ্গল উর্দু এসোসিয়েশন’ গঠন করেন। এই সমিতি বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষা মুসলমানদের মধ্যে প্রচার করতে চেষ্টা করে। অবাঙালি মুসলমানেরা প্রচার করেন, উর্দু ভাষার মাধ্যমেই বাঙালি মুসলমানেরা ইসলামের শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন। বাংলা ভাষার মাধ্যমে তা করা কখনই সম্ভব নয়।২২ প্রকৃত মুসলমান হতে হলে উর্দু ভাষা আয়ত্ত করা একান্ত কর্তব্য। শহরের কতিপয় শিক্ষিত বাঙালির পক্ষে উর্দু ভাষা আয়ত্ত করার সুযোগ থাকলেও, গ্রাম-বাংলার অগণিত অশিক্ষিত মুসলমানদের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। উচ্চশ্রেণির বাঙালি মুসলমানেরা উর্দু ভাষা আয়ত্ত করে সাধারণ বাঙালি মুসলমানদের সঙ্গে নিজেদের পার্থক্য প্রমাণ করে আভিজাত্য প্রকাশ করেন, আর অন্যান্য প্রদেশের মুসলমানদের কাছে নিজেদের প্রকৃত মুসলমানরূপে পরিচয় দিয়ে গর্ব অনুভব করেন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে হিন্দুদের ব্যাপার মনে করে তাঁরা দূরত্ব বজায় রাখেন। এই ধরনের মানসিকতা এক শ্রেণির বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে দেখা যায়। উর্দু ভাষী অবাঙালি মুসলিম নেতৃবৃন্দ তাঁদের অপপ্রচারে কিছুটা সাফল্য লাভ করলেও ব্যাপক জনসাধারণের মধ্যে উর্দু ভাষা চালু করতে ব্যর্থ হন।
আগা খাঁ বলেন, বাংলা ভাষার মাধ্যমে ইসলামের সংস্কৃতি, চিন্তা ও দর্শন বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে দ্রুত প্রচার করা সম্ভব এবং তাতে ইসলামীকরণের কাজটি সহজ হবে। এইজন্য তিনি একটি সংস্থা গঠন করতে বলেন। এই সংস্থা ইসলামের গ্রন্থসমূহ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করার ব্যবস্থা করবে এবং এইসব পুস্তিকা বিতরণ করে বাঙালি মুসলমানদের ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষিত করে তুলবে। তাঁর মনে হয়েছে, ইসলামের স্বার্থেই এই কাজটি করা একান্ত দরকার। ভারতের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি বৃহৎ প্রদেশরূপে গণ্য করা হয়। পৃথিবীর মুসলিম দেশগুলির মধ্যেও বাংলাদেশকে বৃহৎ বলা চলে। আর কোনো মুসলিম দেশ নেই যেখানে পূর্ব বাংলার মতো অল্প পরিসর স্থানে এত অধিক সংখ্যক মুসলমান বসবাস করেন। পূর্ব বাংলার মুসলমানদের সংখ্যা পারস্য, আরব, আফগানিস্তান ও মিশরের চেয়েও বেশি। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ হল ইসলামে বিশ্বাসীদের শেষ আশ্রয়স্থল। আগা খাঁ ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে বঙ্গীয় লেজিস্লেটিভ কাউন্সিলের মুসলিম সদস্যদের নিকট একটি ভাষণে এইসব কথা বলেন।২৩ আগা খাঁ বলেন:
Bengal was and would always remain the premier proince of India. It was equally the premier country of Islam in the world, because there was no other country where they had such a large Moslem population concentrated in such a small area as in Eastern Bengal, which is more than Persia, Arabia, Afghanistan and Egypt. It was in truth the citadel of the faith of Islam.
Bengali is one of the most magnificent languages in which highest and noblest ideas and aspirations of men could be represented and interpreted and he would suggest that suitable Islamic books should be translated into Bengali and a regular society established for the distribution of pamphlets for the education of Moslems in Bengal as far as possible in the highest tradition of Islamic culture, thought and philosophy.
His Highness regretted that so far they had not recognised the need of bringing this culture of Bengali Mohamedans in their own language, and he urged the necessity of text books in the Bengalee language for East Bengal Mohamedans.২৪
কিন্তু আগা খাঁ এইসব কথা বললেও, তিনি ওই বছরেই অল ইন্ডিয়া মুসলিম কনফারেন্সের কার্যকরী কমিটিতে এগারোজন সদস্যের মধ্যে মাত্র একজন বাঙালিকে অন্তর্ভুক্ত করেন। আর তা ছাড়া তিনি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে কোনো ব্যবস্থাও অবলম্বন করেননি। সারা ভারত মুসলিম লিগের সভাপতি ও সম্পাদক পদে কোনো বাঙালির স্থান ছিল না।২৫ অবশ্য উর্দুর গোঁড়া সমর্থকেরা আগা খাঁর উপদেশও গ্রহণ করেননি। তাঁরা উর্দু ভাষার প্রচার ও উর্দু ভাষীদের নেতৃত্ব বাংলাদেশের মুসলিম লিগে বজায় রাখার জন্য জোর তৎপরতা শুরু করেন। জিন্না সারা ভারত মুসলিম লিগের সভাপতি হবার পরে বাংলাদেশে উর্দু ভাষী নেতৃবৃন্দের দাপট আরও বৃদ্ধি পায়। এই সময়ে শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে একটি অংশ, তাঁরা সংখ্যায় খুবই নগণ্য হলেও, উর্দু ভাষী লিগ নেতৃবৃন্দের এই আক্রমণাত্মক অভিযান বাংলাদেশের মুসলমানদের স্বার্থের পরিপন্থী মনে করেন। এই বিষয়ে অনেক পত্রালাপ ১৯৩৪-১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়।২৬ তাতে শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানদের চিন্তাধারার খানিকটা পরিচয় পাওয়া যায়। ফজলুল হক সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে উর্দুর স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা চাইলেও বাংলাদেশে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু প্রচলনের বিরোধী ছিলেন। উর্দুর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করলেও মাতৃভাষার ক্ষতি করে তার প্রসার কামনা তিনি কখনই স্বীকার করেননি।২৭ কিন্তু উর্দু ভাষী নেতৃবৃন্দ বাংলা ভাষার মর্যাদা স্বীকার করেননি। তাই তাঁরা সারা ভারত মুসলিম লিগের নেতৃত্বের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের মুসলমানদের উপর নিজেদের সিদ্ধান্তসমূহ চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। অথচ বাংলাদেশে উর্দু ভাষী মুসলমানদের সংখ্যা খুবই নগণ্য ছিল।২৮ এই অবস্থা পর্যালোচনা করে যাঁরা সেদিন উদবিগ্ন হন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ফজলুল হক।
সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের নীতিকে ভিত্তি করে, এক উদার-অসাম্প্রদায়িক মনোভাব সামনে রেখে ফজলুল হক নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতি গঠন করেন। কৃষক প্রজা সমিতির আদর্শ ও কর্মসূচি থেকে ফজলুল হকের মনোভাব সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা করা যায়।২৯ এই সমিতির পক্ষ থেকে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে যে ইস্তাহার প্রচার করা হয়, তা এখানে উল্লেখ করা হল:
উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য:
১. মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বন করে ভারতে একটি দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে অবিলম্বে বর্তমান প্রাদেশিক শাসনতন্ত্রের এবং পরিকল্পিত কেন্দ্রীয় শাসনতন্ত্রের পরিবর্তে পূর্ণ গণতান্ত্রিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের জন্য পরিশ্রম করতে হবে।৩০
২. ভারতের মুসলমানদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণ ও প্রসারণ করতে হবে।
৩. ভারতের মুসলমান ও অ-মুসলমানদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
৪. ভারতের মুসলমানদের সঙ্গে অন্যান্য দেশের মুসলমানদের ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে ও সুদৃঢ় করতে হবে।
৫. আইনানুগ ও শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুযায়ী জনসাধারণের স্বার্থ-বিরোধী জমিদারি প্রথার (চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত) অবসান ঘটাতে হবে।
কর্মসূচি:
১. মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। ধর্মীয় বিষয়ে যদি কোনো জটিলতা দেখা দেয় তবে জামিয়াত-উল-উলেমা হিন্দের এবং মুজতাহিদসের মতামতের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে তা সমাধান করতে হবে।
২. সকলপ্রকার পীড়নমূলক আইন, যথা, বেঙ্গল ক্রিমিন্যাল ল এমেণ্ডমেন্ট অ্যাক্ট, পাবলিক সিকিউরিটি অ্যাক্ট ইত্যাদি বাতিল করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে।
৩. যেসব বিধি-ব্যবস্থা বাংলাদেশ ও ভারতের স্বার্থবিরোধী, যা জনসাধারণের মৌলিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করে এবং দেশকে অর্থনৈতিক শোষণের অন্তর্ভুক্ত করে, তার বিরোধিতা করতে হবে।
৪. প্রাদেশিক শাসনযন্ত্রের জন্য যে প্রভূত খরচ হচ্ছে তা কমাতে হবে এবং দেশগঠনের প্রয়োজনীয় বিভাগগুলির জন্য আরও অর্থ বরাদ্দ করতে হবে।
৫. কুটিরশিল্পসহ অন্যান্য শিল্প গঠনের প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করতে হবে। এই জন্য কয়েকটি ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে:
ক. অবিলম্বে পাটের সর্বনিম্ল মূল্য বেঁধে দিতে হবে।
খ. প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপন্নজাত দ্রব্য গোটা প্রদেশে কেনা-বেচার ব্যবস্থা করার জন্য একটি সংস্থা গঠন করতে হবে।
গ. সমস্ত সরকারি প্রয়োজনে ভারতীয় দ্রব্য ব্যবহার করতে হবে।
ঘ. বৃহৎ ও ভারী শিল্প গঠনের জন্য ঋণদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৬. দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রয়োজনে মুদ্রা, বিনিময় ও মূল্য নির্ধারণ করতে হবে।
৭. গ্রামের সাধারণ মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষার উন্নতিসাধন করতে হবে।
৮. প্রয়োজন হলে অর্থ সংগ্রহ করে ঋণে জর্জরিত কৃষকদের দুরবস্থা লাঘব করতে হবে।
৯. কৃষকদের উপর কোনো নতুন কর বা সেস না বসিয়ে প্রাইমারি শিক্ষাকে অবৈতনিক ও আবশ্যিক করতে হবে।
১০. মাতৃভাষার উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করে উর্দু ভাষা ও হরফ রক্ষা করতে হবে ও তার উন্নতি সাধন করতে হবে।
১১. মুসলমানদের, বিশেষ করে বাংলাদেশের মুসলমানদের, অবস্থা উন্নয়নের জন্য উপায় উদ্ভাবন করতে হবে।
১২. দরিদ্র জনসাধারণের উপর করের বোঝা লাঘব করতে হবে।
১৩. সমগ্র দেশে রাজনৈতিক চেতনা ও একটি সুস্থ জনমত গঠন করতে হবে।
১৪. কৃষিজীবী মানুষের স্বার্থে এবং জমিতে কৃষকের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য ‘বেঙ্গল টেনান্সি অ্যাক্ট’ সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন করতে হবে এবং নিম্লোক্ত বিষয়গুলি একটি নতুন আইনে যুক্ত করতে হবে:
ক. নজর ও সেলামি আদায়ের যে অধিকার জমিদারেরা ভোগ করেন তা রহিত করতে হবে।
খ. অতিরিক্ত খরচ না করেও কৃষকদের নাম পরিবর্তনের অধিকার মেনে নিতে হবে।
গ. খাজনার পরিমাণ কমাতে হবে।
১৫. জমিদার, মহাজন ও তাদের প্রতিনিধি কর্তৃক বে-আইনি আদায়ের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ও কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে।
১৬. পাটের উপর শুল্ক বাবদ আদায়ীকৃত অর্থের সবটাই ভারত সরকারের কাছ থেকে নেবার জন্য ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে এবং কৃষি ও গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির জন্য খরচও নির্ধারণ করতে হবে।
১৭. কৃষি ও গবাদি পশুর উন্নতি ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৮. গ্রামে প্রয়োজনীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৯. বাংলাদেশের মজা নদীগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।
২০. প্রতিটি সম্প্রদায়ের মানুষ যাতে সুবিচার পান সেদিকে লক্ষ্য রেখে বিভিন্ন কর্মে মুসলমান ও তপশীলি সম্প্রদায়ের লোকেদের নিয়োগ যাতে প্রয়োজনানুরূপ হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে।
২১. বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য উপায় উদ্ভাবন করতে হবে।
২২. শ্রমিকদের সর্বনিম্ল মজুরি নির্দিষ্ট করে এবং বাসস্থান ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের অবস্থার উন্নতিসাধন করতে হবে।৩১
মুসলিম লিগের কর্মসূচিতে ফজলুল হক সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই তিনি একটি নতুন কর্মসূচি প্রণয়ন করেন। মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কৃষক প্রজা সমিতির নেতার চিন্তাধারায় যে যথেষ্ট পার্থক্য ছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ফজলুল হক এই কর্মসূচি ব্যাখ্যা করে বলেন: কৃষক প্রজা সমিতি দরিদ্রদের স্বার্থ রক্ষা করবে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য এই দলের দরজা খোলা থাকবে। খাদ্য ও বস্ত্রের সমস্যাই হল সবচেয়ে জরুরি। সাধারণ মানুষের অস্তিত্বের জন্যই এই সমস্যার আশু সমাধান প্রয়োজন। অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে একসঙ্গে উদ্যোগী হওয়া একান্ত প্রয়োজন। দুর্ভিক্ষ, বন্যা এবং অন্যান্য একই রকমের দুঃখ-বেদনা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে কোনো পার্থক্য সাধন করে না। কৃষক প্রজা সমিতির দাবি অত্যন্ত ন্যায়সংগত। তাই দরিদ্র মানুষ এই পার্টিকে সমর্থন করছে। কিন্তু কায়েমি স্বার্থের সমর্থক সরকারি অফিসারেরা এবং জমিদার-মহাজন শ্রেণি এই পার্টির বিরোধিতা করছে। মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের মনোভাব সংহত করাই এই দলের উদ্দেশ্য। আসন্ন নির্বাচনে এমন প্রতিনিধিদের আইনসভাতে পাঠানো উচিত যাঁরা ক্ষুধার্ত মানুষের দুঃখের বোঝা লাঘব করতে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করবেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর বরিশাল শহরের অশ্বিনীকুমার হলে একটি জনাকীর্ণ সভায় ফজলুল হক এইসব কথা বলেন। এই সভায় বরিশাল মিউনিসিপ্যালটির চেয়ারম্যান শরৎচন্দ্র গুহ সভাপতিত্ব করেন।৩২ প্রধানতঃ অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া ও কৃষক প্রজার অভাব অভিযোগ ভিত্তি করেই কৃষক প্রজা সমিতির নীতি নির্ধারিত হলেও, রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও এই পার্টি বলিষ্ঠ মনোভাব ব্যক্ত করে। তাই এই পার্টি পূর্ণ গণতান্ত্রিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের দাবি উত্থাপন করে। এই পার্টির ইস্তাহার বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় একটি সুস্থ-সবল বাঙালি জাতি গঠন করাই ছিল ফজলুল হক প্রবর্তিত কৃষক-প্রজা সমিতির প্রধান লক্ষ্য। তাই তাঁর দলের কাজে অনেক হিন্দু ও মুসলমান কর্মী সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। এই দলের কর্মসূচি যে নিছক ভোট আদায়ের উদ্দেশ্যেই রচিত হয়নি তা বোঝা যায় ‘লিগ পার্লামেন্টারি বোর্ড’ গঠনের সময়ে ফজলুল হকের দৃঢ় মনোভাব দেখে।
বাংলাদেশে মুসলিম লিগের শক্তিবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দ মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন গ্রুপ নিয়ে ‘ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি’ গঠন করেন। এই পার্টি গঠনে তাঁরা কখনই ফজলুল হকের সঙ্গে আলোচনা করেননি। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে এই ইউনাইটেড মুসলিম-পার্টিই জিন্নার নেতৃত্বে ‘বেঙ্গল মুসলিম লিগ পার্লামেন্টারি বোর্ডে’ রূপান্তরিত হয়। এই লিগ পার্লামেন্টারি বোর্ড ও ফজলুল হকের অবর্তমানে করা হয়েছে। তাঁর সঙ্গে কোনো পরামর্শ করা হয়নি। অথচ তখনও তিনি বাংলাদেশে লিগের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন। এই বোর্ড এমনভাবে গঠন করা হয় যাতে ফজলুল হক এই ব্যবস্থা অনুযায়ী দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃত হলে বাংলাদেশে তাঁকে মুসলমানদের একতা বিনষ্টকারী হিসাবে দোষারোপ করা যায়। বিভিন্ন গ্রুপের প্রতিনিধিদের নিয়ে লিগ পার্লামেন্টারি বোর্ড সংগতভাবে গঠিত হবার পূর্বেই এবং বোর্ডে নিখিলবঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতির প্রতিনিধিদের নাম পাঠানোর পূর্বেই একটি নোটিস প্রচার করে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ সেপ্টেম্বর কলকাতাতে বোর্ডের সভা ডাকা হয়।৩৩ প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল, বোর্ডের কর্মকর্তা নির্বাচন করা এবং নির্বাচনী ইস্তাহারের শর্তসমূহ নির্ধারিত করা। এই সময়ে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের আইনের প্রাদেশিক পরিকল্পনা কার্যকরী করার জন্য ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। এই নির্বাচন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশেও বিভিন্ন দল তৎপর হয়। জিন্না লিগ পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন করে মুসলিম লিগের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করতে অগ্রসর হন। স্বভাবতই ফজলুল হকের সঙ্গে জিন্নার বিরোধ অনিবার্য হয়। যেভাবে জিন্না বোর্ড গঠন করতে চেষ্টা করেন তা অসম্মানজনক হলেও এবং তাতে সংঘাতের উপকরণ লুক্কায়িত থাকলেও, ফজলুল হক মুসলমানদের স্বার্থের কথা ভেবে শর্তসাপেক্ষ সহযোগিতা করতে সম্মত হন।৩৪ তিনি বলেন, যদি বোর্ড কৃষক প্রজা সমিতির আদর্শ ও কর্মসূচি পুরোপুরি গ্রহণ করে তবেই তিনি এই বোর্ডের সঙ্গে সহযোগিতা করবেন। মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দ যদি তাঁদের দলীয় ও ব্যক্তিগত স্বার্থ পরিহার করে জনসাধারণের স্বার্থ রক্ষার্থে অগ্রসর হতে পারেন তাহলে কৃষক প্রজা সমিতির সমর্থন ও সহযোগিতা লাভে কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু যদি দেখা যায় যে জনসাধারণের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করে কথা বললেও তা শুধু লোক দেখানো ব্যাপার, অথবা যদি দেখা যায় যে তাঁরা কৃষক প্রজা সমিতিকে বোর্ডে যোগদান করতে বলছেন এই কারণে যাতে তাঁরা সহজে এই সমিতির আদর্শ বিনষ্ট করতে পারেন, তাহলে কৃষক প্রজা সমিতিকে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই বোর্ডে যোগদান করলেও কৃষক প্রজা সমিতি তার পৃথক অস্তিত্ব বজায় রাখবে এবং নিজেদের উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি প্রচার করবে। যদি কোনো নির্বাচনী ঐক্য হয় তাহলে তা কেবলমাত্র আইনসভায় মুসলমান সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রেই কার্যকরী হবে। অ-মুসলমান প্রার্থীদের নির্বাচনের ব্যাপারে কৃষক প্রজা সমিতির নিজস্ব নির্বাচনী বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে ও তাঁদের নির্বাচনে সমর্থন করবে।৩৫
জিন্না কর্তৃক গঠিত বেঙ্গল মুসলিম লিগ পার্লামেন্টারি বোর্ড যে সভা আহ্বান করে তাতে ফজলুল হক ও প্রজা পার্টির তেরোজন সভ্য যোগদান করেন। কলকাতার ক্যামাক স্ট্রিটে ঢাকার নবাব বাহাদুরের বাসগৃহে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। মৌলবি আবদুল করিম, এম, এল, সি সভাপতিত্ব করেন। বাংলাদেশের দুইটি প্রধান মুসলিম গ্রুপের (লিগ ও কৃষক প্রজা সমিতি) মধ্যে মীমাংসার সূত্র নিয়ে আলোচনা চলে। কিন্তু মত পার্থক্য হওয়ায় ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ সেপ্টেম্বর কৃষক প্রজা সমিতির প্রতিনিধিরা সভা বর্জন করে চলে যান।৩৬ কৃষক প্রজা সমিতির সম্পাদক সামসুদ্দিন আহমেদ সভাপতির অনুমতি নিয়ে প্রথমেই সারা ভারত মুসলিম লিগের এবং কৃষক প্রজা সমিতির উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি পাঠ করে শোনান এবং বলেন, সভায় উপস্থিত সকল সদস্য কর্তৃক এই উদ্দেশ্য ও কর্মসূচিসমূহ অনুমোদিত ও স্বাক্ষরিত হবার পরেই কৃষক প্রজা সমিতি এই সভার অন্য কাজে অংশগ্রহণ করবে, তার পূর্বে নয়। যখন সামসুদ্দিন আহমেদ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলোপের শর্ত কৃষক প্রজা সমিতির ইস্তাহার থেকে পাঠ করে শোনাচ্ছিলেন তখন মুসলিম লিগের জিন্নাপন্থীরা ভয়ানক গণ্ডগোল ও চিৎকার করে তাঁকে বাধা দেন। এই শর্তটি আলোচনা থেকে বাদ দিতে বলেন। তখন ফজলুল হক কৃষক প্রজা সমিতি কেন এই সভায় আসতে সম্মত হয় তা ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, কৃষক প্রজা সমিতির উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি পুরাপুরি গ্রহণ করলেই সমিতি বোর্ডের সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত, তা পূর্বেই জানিয়ে দেওয়া হয়। কাজেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলোপের শর্ত বাতিলের প্রশ্ন ওঠে না। তারপরেও জিন্নাপন্থীরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সভার কাজ ব্যাহত করেন। এই অবস্থায় কৃষক প্রজা সমিতির প্রতিনিধিরা ও কয়েকজন লিগ সদস্য সভাকক্ষ পরিত্যাগ করে চলে যান। ফজলুল হক একটি বিবৃতিতে এইসব তথ্য প্রকাশ করেন।৩৭
ঢাকার নবাব বাহাদুর পরবর্তী সভার দিন উল্লেখ করে ফজলুল হককে যে চিঠি দেন তার উত্তরে ফজলুল হক লেখেন যে, লিগ পার্লামেন্টারি বোর্ডের সকল সদস্য কর্তৃক কৃষক প্রজা সমিতির উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের পক্ষে সভায় যোগদান করা সম্ভব হবে না এবং তাতে কোনো কাজ হবে না বলেই তাঁদের ধারণা।৩৮ ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ আগস্ট জিন্না স্বীকার করেন, কৃষক প্রজা সমিতি তাদের পৃথক অস্তিত্ব বজায় রেখেই নতুন গঠিত লিগ পার্লামেন্টারি বোর্ডে যোগদান করবে এবং মুসলিম লিগের আদর্শ ও কর্মসূচির সঙ্গে কৃষক প্রজা সমিতির আদর্শ ও কর্মসূচি সংযোজিত হবে। এই দু-টি দলের উদ্দেশ্য ও কর্মসূচিসমূহ মেনে নিয়েই লিগ ও কৃষক প্রজা সমিতির প্রতিনিধিরা বোর্ডে অংশগ্রহণ করবেন। কিন্তু তা সত্বেও পরে জিন্নার পরামর্শ অনুযায়ী বাংলাদেশে তাঁর সমর্থকেরা জটিলতা সৃষ্টি করেন। জিন্না যে প্রতিশ্রুতি ফজলুল হককে দিয়েছিলেন তা তিনি সহজেই ভুলে গেলেন। অথচ কৃষক প্রজা-সমিতির প্রতিনিধিরা লিগের আদর্শ ও কর্মসূচি গ্রহণ করতে সম্মত ছিলেন। তাই এই ঐক্য প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার জন্য ফজলুল হককে মোটেই দায়ী করা যায় না।৩৯
১০ সেপ্টেম্বর (১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ) ঢাকার নবাব বাহাদুরের বাসগৃহে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লিগ পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভা হয়। এই সভায় যাঁরা বোর্ডের কর্মকর্তা নির্বাচিত হলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন: সভাপতি—ঢাকার নবাব বাহাদুর ; ট্রেজারার—আদমজি হাজি দাউদ; যুগ্ম-সম্পাদক—আবুল হাসান ইস্পাহানি ও হোসেন শঈদ সুরাবর্দি। এই সময়েই জিন্নার সঙ্গে সুরাবর্দির ঘনিষ্ঠতা হয় এবং তিনি বাংলাদেশে জিন্নার একজন বিশ্বস্ত প্রতিনিধিরূপে লিগ নেতৃত্বে আসীন হন।৪০ প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, ৮ সেপ্টেম্বর (১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ) সভা পণ্ড করার প্রধান দায়িত্ব ছিল জিন্নাপন্থী লিগ নেতা আবুল হাসান ইস্পাহানির। তিনিই সবচেয়ে বেশি অশোভন আচরণ করেন। এই সভার সভাপতি মৌলবি আবদুল করিম একটি বিবৃতিতে এই অভিযোগ করেন। কৃষক প্রজা সমিতিকে দায়ী করে জিন্নাপন্থীরা যেসব বিবৃতি দেন তার উত্তরে আবদুল করিম বলেন, এই সভা পণ্ড করার ব্যাপারে কৃষক প্রজা সমিতিকে মোটেই দায়ী করা যায় না। তিনি একথাও বলেন, জিন্নাপন্থীদের বিবৃতিতে সত্য ঘটনার উল্লেখ নেই। তিনি তাঁদের একথাও স্মরণ করিয়ে দেন, কৃষক প্রজা সমিতির নেতা ফজলুল হক সারা ভারত মুসলিম লিগের সভাপতি ছিলেন এবং এখনও তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লিগের সহ-সভাপতি। তাঁরা এক অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি করার ফলেই কৃষক প্রজা সমিতির প্রতিনিধিরা ও কয়েকজন মুসলিম লিগের প্রতিনিধি সভাকক্ষ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন।৪১
এই সময়ে ইস্পাহানি ও সুরাবর্দি মুসলিম লিগ পার্লামেন্টারি বোর্ডকে ফজলুল হকের প্রভাব বিনাশ করতে ব্যবহার করেন। তাঁরা দুজনেই উপলব্ধি করেন, কৃষক প্রজা সমিতির উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি সাধারণ মুসলমানদের আকৃষ্ট করেছে। এই অবস্থায় তাঁদের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য তাঁরা এক অভিনব পন্থা অবলম্বন করেন। কৃষক প্রজা সমিতির উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি অনুকরণ করে লিগ পার্লামেন্টারি বোর্ড ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর একটি ইস্তাহার রচনা করে খবরের কাগজে প্রকাশের জন্য বিতরণ করে। ইস্পাহানির ও সুরাবর্দির পরামর্শ অনুযায়ী এই ইস্তাহার রচিত হয় এবং তাঁরা বলেন, বঙ্গীয় আইন সভায় মুসলিম লিগ সদস্যরা এই কর্মসূচি কার্যকরী করবেন। এই ইস্তাহারে বলা হয়, যদি সম্ভব হয় তবে মুসলিম লিগ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলোপ করার ব্যবস্থা করবে। মুসলিম স্বার্থ রক্ষার্থে আরও অনেক দাবি এই ইস্তাহারে সম্বলিত করা হয়।৪২ এইভাবে লিগের নবাবেরা ও খান বাহাদুরেরা নির্বাচনে সাফল্যলাভ করতে চেষ্টা করেন। এই কর্মসূচি কার্যকরী করার ব্যাপারে তাঁদের আন্তরিকতার যে যথেষ্ট অভাব ছিল তা বিভিন্ন ঘটনা থেকেই প্রমাণিত হয়।
মুসলিম লিগ পার্লামেন্টারি বোর্ড ফজলুল হকের বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার করে যেসব অভিযোগ আনে তিনি তা খণ্ডন করে এক দীর্ঘ বিবৃতি প্রচার করেন:
১. অভিযোগ করা হয়, ফজলুল হককে হিন্দুরা অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন। ফজলুল হক বলেন, এই অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা। তিনি হিন্দু বা অন্য কারও কাছ থেকেই কোনো অর্থ সাহায্য পাননি। যাঁরা এইসব কুৎসা প্রচার করেন, তিনি তাঁদের তা প্রমাণ করতে বলেন।৪৩
২. ফজলুল হক বলেন, জমিদার, ধনিক ও কায়েমি স্বার্থবাদীদের বিরুদ্ধেই তাঁর সংগ্রাম। জমিদার শ্রেণির শতকরা ৯৫ জন হলেন হিন্দু এবং ধনিক-মহাজনদের শতকরা ৯৮ জন হলেন হিন্দু। সাহায্য করার পরিবর্তে তাঁরা তাঁর অগ্রগতির পথে সমস্ত রকমের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এই শ্রেণির বিত্তশালী হিন্দুরা মুসলিম জমিদার, ধনিক ও অন্যান্যদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁকে পর্যুদস্ত করতে চেষ্টা করবেন। ফজলুল হক বলেন:
My fight is with landlords, capitalists and holders of vested interests. The landlords are 95 per cent Hindus and capitalists and others are about 98 per cent Hindus. Far from helping me, they are already out to throw all obstacles in my way. I apprehend that in the near future they will join hands with their Muslim compatriots, viz. Muslim landlords, capitalists and others to thwart me.৪৪
৩. ফজলুল হক মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট করেন—এই অভিযোগও তিনি অস্বীকার করেন। বর্তমানে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান সমস্যা হল: গো-হত্যা, মসজিদের সম্মুখে গীত-বাদ্য এবং মুসলমান বেকারদের সমস্যা। বেকার সমস্যা নিয়ে কেবলমাত্র মুসলমানেরাই নন, সকল শ্রেণি, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের লোকেরাই সমানভাবে উদবিগ্ন। তাঁরা সবাই এই জরুরি সমস্যা সমাধানের জন্য উদগ্রীব। কৃষক প্রজা সমিতির মুসলমান সদস্যরা অভাবগ্রস্ত শিক্ষিত বা অশিক্ষিত মুসলমানদের এক মুঠো খাদ্য এগিয়ে দেবার জন্য যেকোনো আন্দোলনে প্রথম সারিতে থাকবেন। আর অন্য দুইটি সমস্যা নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে কাউন্সিলে কোনো আন্দোলন করার সম্ভাবনা নেই।৪৫
৪. স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে ফজলুল হক কিসের জন্য সংগ্রাম করেন? তিনি বলেন, এর উত্তরও তিনি সুস্পষ্টভাবে দিয়েছেন। তিনি অন্ন সমস্যার অর্থাৎ বাংলাদেশের ‘ডাল ভাত সমস্যার’ সন্তোষজনক সমাধানের জন্য সংগ্রাম করেন। তা ছাড়া প্রজাস্বত্ব আইনের আমূল পরিবর্তন করে বাংলাদেশের কৃষিজীবীদের দুর্দশা মোচন করাও তাঁর উদ্দেশ্য। কিন্তু এই কাজ মুসলিম লিগ পার্লামেন্টারি বোর্ডের দ্বারা সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। কারণ এই বোর্ডের ২৮ জন সদস্যের মধ্যে ১১ জন হলেন অবাঙালি, যাঁরা ইসপাহান, তেহরান, বাদাকসান ও সমরকন্দ এবং বাংলাদেশের বাইরে অন্যান্য স্থানের অধিবাসী। অন্যদিকে বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে শতকরা ৮৯ জন হলেন জমিদার ও ধনিক শ্রেণিভুক্ত। এই জমিদার ও ধনিকদের পক্ষে কৃষক প্রজা সমিতির সঙ্গে সহযোগিতা করে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা সম্ভব নয়। কারণ তাঁদের বিরুদ্ধেই কৃষক প্রজা সমিতির সংগ্রাম পরিচালিত।৪৬ ফজলুল হক বলেন:
This brings me to the question, what am I fighting for? As I have made it adundantly clear already, I am fighting for a satisfactory solution of the bread problem or in other words, of the ‘dal bhat’ problem of Bengal and also for the thorough overhauling of the Tenancy Laws in Bengal so as to give some relief to agriculturists. This can not be effected by the Muslim League Parliamentary Board because in that Board out of 28 members, as many as 11 are non-Bengalees who hail from Ispahan, Teharan, Badakshan and Samarkand and other places outside Bengal and 89 per cent are landlords and capitalists. These landlords and capitalists cannot certainly join us in this fight, because they are the very people with whom we will have to carry on a life and death struggle.৪৭
৫. ঢাকার নবাব বাহাদুর এবং তাঁর অন্যান্য সহযোগীরা ঘোষণা করেন যে, তাঁরা কৃষক প্রজা সমিতির উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এমন কি তাঁরা জমিদারিপ্রথারও (চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত) অবসান চান। তাঁদের এই উক্তি ফজলুল হক বিশ্বাস করতে পারেননি। তাঁদের অতীত কার্যকলাপ দেখে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি আশান্বিত হতে পারেননি। তাঁরা কখনই মুসলমানদের সাহায্য করেন না। তাঁদের জমিদারি কার্যে তাঁরা কখনই মুসলিম প্রার্থীকে উকিল, নায়েব, ম্যানেজার বা তহশীলদার পদে নিযুক্ত করেন না। অবশ্য এইসব সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের আন্তরিকতার পরিচয় দিতে পারেন। ফজলুল হক তাঁদের উদ্দেশ্য করে বলেন, বর্তমান বেঙ্গল কাউন্সিলের আয়ু ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বর্ধিত হয়েছে। বাংলাদেশ গভর্নরের পরিষদে (Cabinet) জিন্নার সমর্থক মুসলমান সদস্যদের সংখ্যাই অধিক। তাঁরা বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন (Bengal Tenancy Act) নিম্ললিখিতভাবে সংশোধন করে দরিদ্র কৃষক প্রজাদের প্রতি তাঁদের আন্তরিক সহানুভূতির পরিচয় দিতে পারেন:
ক. জমি হস্তান্তরের সময় জমিদারদের অগ্রে জমি ক্রয় করবার অধিকার বিলোপ করা।
খ. নজরানা ও সেলামি প্রথার উচ্ছেদ করা।
গ. জমিদারদের খাজনা বৃদ্ধি করবার ক্ষমতা লোপ করা।
বাংলাদেশের কেবিনেটের মুসলমান সদস্যরা চাইলেই এখনই এই সংশোধন সমূহ কার্যকরী করা সম্ভব। যা প্রয়োজনে তা হল সরকারের পক্ষ থেকে একটি সংশোধনী বিল উত্থাপন করা। বর্তমানে বেঙ্গল কাউন্সিল এতটা অনুগত যে সরকার কর্ত্তৃক উত্থাপিত বিল তাঁরা সমর্থন করবেন। কেবিনেটের মুসলমান সদস্যদের বর্তমান সরকারকে এই ধরনের সংস্কার প্রবর্তন করতে বলা উচিত। কারণ বড়লাট থেকে আরম্ভ করে দেশের সকলেই আজকাল দরিদ্র কৃষকদের প্রতি সহানুভূতি দেখান। সুতরাং, লেজিস্লেটিভ কাউন্সিলে এই ধরনের আইন প্রণয়ন করতে কোনোই অসুবিধা হবে না। কাউন্সিলে প্রজাস্বত্ব সংশোধন বিল উত্থাপন করলে এক পক্ষকালের মধ্যেই তা পাস করানো সম্ভব। জমির উপর কৃষকের মালিকানা স্বত্ব স্বীকার করে ফজলুল হকের প্রস্তাব অনুযায়ী যদি প্রজাস্বত্ব সংশোধন বিল কাউন্সিলে আনা হয়, তাহলে ফজলুল হক কৃষক প্রজা সমিতির স্বতন্ত্র কার্যকলাপ বন্ধ করে দেবেন। এই প্রতিশ্রুতি তিনি জিন্না ও বাংলাদেশে জিন্নাপন্থীদের দেন।৪৮
৬. ফজলুল হক বলেন, ঢাকার নবাব বাহাদুর, স্যার নাজিমুদ্দিন, নবাব ফারুকি এবং লিগ পার্লামেন্টারি বোর্ডের অন্যান্য জমিদার সদস্যবৃন্দ অবিলম্বে নিজেদের জমিদারিতে নজরানা ও সেলামিপ্রথা রদ করে ঘোষণা জারি করুন। আইনসভায় কোনো আইন প্রণয়ন না করেই এই কাজটি করা যায়। এর দ্বারা অন্তত এটা প্রমাণিত হবে যে, তাঁরা কৃষকদের প্রতি সহানুভূতিশীল। বড়ো বড়ো কথা বলে কোনো লাভ নেই যদি না তা বাস্তবে রূপায়িত করা যায়।৪৯
৭. প্রচার করা হচ্ছে, ফজলুল হক মন্ত্রীত্বলাভের চক্রান্তে লিপ্ত আছেন। তিনি বলেন, যদি তিনি মন্ত্রী হতে চান তবে তা অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে না। তাঁর বড়ো শত্রুও তাঁর যোগ্যতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ পোষণ করতে পারেন না। তিনিই সেই কর্মীদলের মধ্যে একমাত্র জীবিত আছেন যাঁরা ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এবং গোলটেবিল বৈঠকের দুইটি অধিবেশন পর্যন্ত এই দেশের শাসন সংস্কার প্রবর্তনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তাই তিনি যদি মন্ত্রী হন তাহলে তাঁর ব্যক্তিগত লাভ অপেক্ষা তাঁর নিজের সম্প্রদায় ও দেশ অধিক লাভবান হবে।৫০
৮. ফজলুল হক একথাও বলেন, তিনি যদি প্রকৃতই মন্ত্রিত্ব কামনা করতেন তাহলে তাঁর পক্ষে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা ছিল বিপক্ষ দলে যোগদান করা, যাঁরা এখনও তাঁর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে আগ্রহশীল এবং স্বপক্ষ ত্যাগের পুরস্কার স্বরূপ মন্ত্রীসভায় তাঁকে একটি আসন দিতে ইচ্ছুক। কিন্তু তিনি এই প্রলোভন উপেক্ষা করতে কৃতসংকল্প।৫১
৯. তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর অতীত সেবা সম্বন্ধে তাঁর সমালোচকেরা নিশ্চয়ই স্মৃতিভ্রংশ হয়েছেন, নতুবা তাঁরা আত্মপ্রবঞ্চনা করছেন। তাঁদের জানিয়ে রাখতে চাই, মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার্থে ও অগ্রগতির জন্য তাঁর চেয়ে অধিক কার্য করেছেন এমন কেউ বাংলাদেশে নেই। বর্তমানে সরকারি চাকুরির বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত মুসলমানদের শতকরা ৫০ জন তাঁর কাছে ঋণী।৫২
১০. এত অধিক সংখ্যক কুৎসা রটনাকারীর সম্মুখীন হবার জন্য তিনি মোটেই বিস্মিত হননি। সর্বযুগে ও সর্বদেশে সংস্কারকদের এই ধরনের দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে। প্রভাব ও পদমর্যাদা থাকায় তাঁর প্রতিপক্ষ খুবই ক্ষমতাসম্পন্ন। কারণ তাঁরা চাকুরি, খেতাব, সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটারের পদ ও আরও অনেক প্রলোভন দেখিয়ে অসাধু স্তাবকের দল সংগ্রহ করতে পারেন। কিন্তু কৃষক প্রজা সমিতির এ ধরনের কোনো প্রলোভন দেখানোর সুযোগ নেই।৫৩
১১. ফজলুল হককে মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা ও হিন্দুদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রের বিপদ সম্পর্কে যাঁরা সতর্ক করে দেন তাঁদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, তিনি কারও সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত নন। তা ছাড়া মিরজাফরের ষড়যন্ত্রের প্রধান সহযোগীরা হিন্দু নন। হিন্দুরা তাঁবেদারি করেছে মাত্র। যে সব মুসলিম নাইট ও নবাবেরা আসন্ন লেজিস্লেটিভ কাউন্সিলে ক্লাইভ স্ট্রিটের সহযোগিতার উপর নির্ভর করতে চান তাঁদের তিনি এই সত্য উপহার দেন।৫৪ ফজলুল হক বলেন:
I have been reminded of the treachery of Mirjafar and the dangers of a conspiracy with the Hindus. In the first place I am not in conspiracy with anybody. Secondly, Mirjafar’s chief co-conspirator was not the Hindus. The Hindus played the second fiddle, I make a present of this fact to the Muslim Knights and Nawabs who are banking upon cooperation with Clive Street in the future Legislative Councils৫৫
ফজলুল হক বলেন, প্রথম থেকেই স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিরা কৃষক প্রজা সমিতির উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি সম্বন্ধে অসত্য প্রচার করে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করে। মুসলমানদের মধ্যে প্রচার করা হয়, এই সমিতি মুসলমানদের মধ্যে দলাদলি সৃষ্টি করে মুসলিম সংহতি বিনাশ করছে। অন্যদিকে হিন্দুদের মধ্যে প্রচার করা হয়, এই সমিতি আর্থিক স্বার্থ রক্ষার দাবির আড়ালে সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যসাধন করছে। ফজলুল হক মনে করেন, মুসলমান জনসমষ্টির শতকরা ৯০ জনের অধিক হলেন কৃষক। সুতরাং মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার্থে প্রস্তুত যেকোনো পরিকল্পনায় কৃষকদের স্বার্থকেই প্রধান বিষয়বস্তু করা উচিত। তা না করে নিছক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে মুসলিম ঐক্য ও সংহতির কথা বলা ক্ষতিকারক। যাদের হাড়ভাঙা খাটুনির ফল অপরে ভোগ করে সেইসব কৃষক ও প্রজাদের স্বার্থ সম্পর্কে হিন্দু ও মুসলমানদের পার্থক্যের কথা উঠতেই পারে না। কারণ তাদের স্বার্থ সমসূত্রে গ্রথিত। এই আর্থিক দাবির ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমান একত্রে মিলিত হবেন এবং এক সঙ্গে থাকলেই তারা জয়লাভ করবেন। এই উদ্দেশ্যসাধনে জিন্নাপন্থীরা কৃষক প্রজা সমিতির সঙ্গে সহযোগিতা করবেন, এই কথা বিশ্বাস করা ফজলুল হকের পক্ষে কষ্টকর ছিল। কারণ জিন্নাপন্থীদের স্বার্থ ও কৃষক প্রজাদের স্বার্থ এক নয়। তাঁদের প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপত্তি, তাদের জীবিকা ও প্রাধান্য, যাদের এতকাল তাঁরা শোষণ করছেন সেই জনসাধারণের মৌলিক অধিকারের অস্বীকৃতির উপরেই প্রতিষ্ঠিত।৫৬ ফজলুল হক বলেন:
Attempts were made to misrepresent our real aims and aspirations and to delude the public about our programme and ultimate goal. Among the Mussalman masses, interested parties carried on a propaganda against us, and accused us of dividing the Mussalmanas among themselves, and thus impairing Muslim solidarity. Among the Hindu masses, propaganda was carried on against us that we were in fact a communal party, masquarading under the cloak of the economic interest of the masses. These two criticisms quite obviously cancel one another, and hardly demand any reply from me. But I should like to take this opportunity of stating once again in unambiguous terms what are the aims of our party and what we ultimately seek to achieve. All talks of Muslim unity and solidarity for merely political ends are worse than useless when it is remembered that the Mussalman cultivating classes constitute more than 90 per cent of the total Muslim population of Bengal, and it is therefore their interst which must be fundamental in any scheme we may lay down for ourselves, or for the sake of any ideal which we may seek to achieve. On the fundamental question of the interest of the Projas and the Krishaks, the tillers of the soil who sweat so that others might enjoy the fruits of their labour, there is no difference whatever between the Hindus and the Mussalmans, for their interests are welded into one another, together they stand and together, we are confident, they shall triumph.৫৭
ফজলুল হক এই অভিযোগ করেন, দিল্লি ও সিমলাতে ষড়যন্ত্রের ফলেই বাঙালি মুসলমানেরা সর্বভারতীয় লিগ নেতৃত্ব থেকে কার্যত বিতাড়িত হন। আর তার পরেই জিন্না লিগ নেতৃত্ব করায়ত্ত করেন এবং লিগের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে বসেন। তিনি একথাও বলেন, জিন্না মুসলিম সংহতির জন্য কিছুই করছেন না। বরঞ্চ ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের সঙ্গে একযোগে জিন্না মুসলিম ভারতের আশা-আকাক্ষাকে শ্বাসরোধ করে মারবার জন্য এক রহস্যজনক খেলা খেলছেন। লিগ পার্লামেন্টারী বোর্ড তার খেয়াল প্রসূত এক আজব চিজ। আর এই বোর্ডই মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করেছে।৫৮
এইসব কারণে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনের সময় বাংলাদেশে মুসলিম লিগের সঙ্গে কৃষক প্রজা সমিতির কোনো নির্বাচনী আঁতাত করা সম্ভব হয়নি। এই নির্বাচনে প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রেই মুসলিম লিগ প্রার্থীর সঙ্গে কৃষক প্রজা পার্টির তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। আর এই নির্বাচন উপলক্ষ্যেই জিন্না সর্বপ্রথম বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বত্তৃতা দিয়ে বেড়ান। কিন্তু তাকে ফজলুল হকের মতো একজন শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্মুখীন হতে হয়।৫৯ কৃষক প্রজা সমিতির উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি সন্নিবিষ্ট করে ফজলুল হক একটি নির্বাচনী ইস্তাহার রচনা করেন। তাতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলোপের দাবি উত্থাপন করা হয়। অসংখ্য নির্বাচনী সভায় তিনি এই প্রথা বিলোপের ও আমূল কৃষি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেন। এই সময়ে ফজলুল হক গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষকে, বিশেষ করে কৃষকশ্রেণি ও দরিদ্র জনসাধারণকে, এক নতুন ভাবধারায় উদ্দীপিত করেন। প্রধানত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলোপের দাবি কেন্দ্র করেই বরিশাল জেলার পটুয়াখালি কেন্দ্রে ফজলুল হকের সঙ্গে মুসলিম লিগের বিখ্যাত নেতা ও ঢাকার নবাব বংশের প্রতিনিধি স্যার নাজিমুদ্দিনের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। এই নির্বাচনী কেন্দ্র ছিল নাজিমুদ্দিনের জমিদারি এলাকা। পটুয়াখালি কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফজলুল হক একটি বিবৃতিতে বলেন:
An all-out fight ensues from today between the zamindars and the peasants. By he grace of God I shall abolish zamindary within the shortest possible time. Eight crores of peasants of Bengal would stand firmly on their legs with heads high and would realise all their rights and privileges. God is with us and our victory is inevitable. But God forbid if I am defeated, this defeat will be more glorious than the defeat of Napoleon at Waterloo.৬০
ফজলুল হকের নিকট নাজিমুদ্দিন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। তারপর নাজিমুদ্দিন আর কখনই গ্রাম-বাংলার নির্বাচনী কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সাহস পাননি।৬১ সুরাবর্দি অভিযোগ করেন, হিন্দুরা ও কয়েকটি স্বার্থান্বেষী পার্টি ফজলুল হককে সমর্থন করায় নাজিমুদ্দিন পরাজিত হন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি সুরাবর্দি কলকাতা থেকে মুন্সিগঞ্জের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াজির আলিকে একটি চিঠিতে লেখেন:
I don’t think that Sir Nazimuddin would have lost to Mr. Fazlul Huq but for the support which Mr. Fazlul Huq received from the Hindus and certain other interested parties.৬২
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার, ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লিগের প্রতিষ্ঠা থেকে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে লিগ পার্লামেন্টারি বোর্ডের কর্মসূচি প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত মুসলিম লিগ কখনই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলোপের দাবি করে কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করেনি।৬৩ যদিও বাংলাদেশে কৃষক বিদ্রোহের এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে এবং বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন পরিচালিত হয়, তবুও কৃষকদের এক আলাদা সংগঠনে সমবেত করার কোনো প্রচেষ্টা দীর্ঘকাল ধরে হয়নি। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে একদিকে যেমন কংগ্রেসের নেতৃত্বে কয়েকটি অঞ্চলে কৃষকেরা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে, তেমনি কমিউনিস্ট ও কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন কর্মীরাও স্বতন্ত্র কৃষক সংগঠন তৈরি করতে উদ্যোগী হন। অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের প্রভাব কৃষক সমাজের মধ্যেও পড়ে। তাই অনেক কংগ্রেস কর্মীর মধ্যে পৃথক কৃষক সংগঠনের প্রশ্ন বড়ো হয়ে ওঠে। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ কৃষকদের জন্য পৃথক শ্রেণি সংগঠন তৈরি করতে উদ্যোগী হননি। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে বে-আইনি কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে কলকাতায় বিভিন্ন জেলার কৃষক কর্মীদের কনভেনশন ডাকা হয়। এই সভা থেকেই একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়। তারপরে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে বাঁকুড়া জেলার পাত্রসায়রে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন বসে। এখানেই কৃষক সভার কর্মসূচি ও গঠনতন্ত্র গৃহীত হয়।৬৪ অবশ্য তখন কৃষক সভার প্রভাব বিশেষ ছিল না। তাই ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে কৃষক সভা কৃষক প্রজা সমিতি ও কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের সমর্থন করে।৬৫ এই সময়ে ফজলুল হক পরিচালিত কৃষক প্রজা সমিতির প্রভাবই সবচেয়ে বেশি ছিল। এই নির্বাচন উপলক্ষ্যে ফজলুল হক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলোপের দাবিতে জনমত গঠন করেন এবং জমিদার-মহাজনদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষক প্রজাকে সংঘবদ্ধ হতে আহ্বান জানান। ফজলুল হকের মতো বাংলাদেশের আর কোনো রাজনীতিবিদই এতটা বলিষ্ঠভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলোপের দাবি জনসমক্ষে তুলে ধরেননি।
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে ফজলুল হক মুসলিম লিগকে পরাজিত করতে সক্ষম হন। আর কংগ্রেসও এই নির্বাচনে সাফল্যলাভ করে। মোট কথা, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল চক্র পর্যুদস্ত হয় এবং প্রগতিশীল শক্তি বিজয়ী হয়।৬৬ স্বভাবতই প্রতিটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বাঙালি আশা করেন, এবার কংগ্রেস ও কৃষক প্রজা সমিতির নেতৃবৃন্দ যুক্তভাবে সঠিকপথে বাংলাদেশকে পরিচালনা করবেন। তাঁরা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত রেখে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। অনেকদিন থেকেই ফজলুল হক অনুভব করেন, হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের অসমান বিকাশের ফলেই সুযোগ সন্ধানী দলগুলি জনসাধারণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে দিতে পারছে। তিনি কৃষি ও শিক্ষা সংস্কারের মাধ্যমে এই বিপদ থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করতে তৎপর হন। তিনি বিশ্বাস করেন, কৃষি ও শিক্ষা সংস্কারের ফলেই মুসলমানেরা বর্তমান পশ্চাৎপদ অবস্থা থেকে মুক্ত হবেন, পরস্পরের অসমান অবস্থা দূরীভূত হয়ে হিন্দু ও মুসলমান সমপর্যায়ে উন্নীত হবে এবং এই ভাবেই সুখী ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গঠন করা সম্ভব হবে।৬৭ তাই নির্বাচনে জয়ী হবার পরেই ফজলুল হক বাংলার কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। প্রাদেশিক কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিল। তাই তাঁর আশা ছিল তিনি তাঁদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য পাবেন। কিন্তু এই আবেদনে তাঁরা সাড়া দেননি। বাংলাদেশে একটি স্থায়ী মন্ত্রীসভা গঠন করবার জন্য এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ধারাগুলি জনসাধারণের স্বার্থে প্রয়োগ করবার উদ্দেশ্যে ফজলুল হক বারে বারে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে তাঁর সঙ্গে যুক্ত হতে অনুরোধ করেন।৬৮ কিন্তু কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কংগ্রেস-কৃষক প্রজা কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করতে সম্মতি দেননি। তার ফলে ফজলুল হক খুবই বিপন্নবোধ করেন। এরজন্য তিনি মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এই বন্ধ্যানীতি ফজলুল হক কখনই ভুলতে পারেননি।৬৯
ফজলুল হক পরিচালিত আন্দোলন বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পথকে প্রশস্ত করে। বাংলাদেশের কংগ্রেস নেতৃবৃন্দও এই সময়ে সাম্প্রদায়িক পরিবেশ থেকে এই প্রদেশকে মুক্ত রাখতে উদ্যোগী হন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট ও ২ সেপ্টেম্বর এই বিষয়ে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২ সেপ্টেম্বর বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির কার্যকরী সভাপতি শরৎচন্দ্র বসুর উদ্যোগে কার্যকরী সমিতি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত একটি প্রস্তাবে আইনসভার ভেতরে ও বাইরে কম্যুনাল এওয়ার্ড বর্জনের জন্য আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়। তাতে বলা হয়, প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যুক্তনির্বাচন প্রথা এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকার ভিত্তি করে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানের জন্য একটি সর্বসম্মত পথ খুঁজে বের করতে চেষ্টা করবে।৭০ কংগ্রেস কমিটি নির্বাচনী ইস্তাহারে এই প্রস্তাব যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২ সেপ্টেম্বর (১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে) প্রাদেশিক কংগ্রেস কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাবটি এখানে উদ্ধৃত করা হল:
Resolved (A) That this council places on record its sense of satisfaction at the clear declaration in the Congress Election Manifesto adopted by the All-India Congress Committee that the rejection of the new Act involved rejection of the communal decision, that even apart from the Act the communal decision was wholly unacceptable, that the attitude of the Congress towards the communal decision was not one of indifference or neutrality and that the Congress disapproved strongly the communal decision and liked to end it ;
(B) That the council desires to disabuse the Congressmen and the general public of Bengal of the impression (if any) that the Congress Election Manifesto places a ban on agitation against the communal decision by Congress organisations;
(C) That the council is not concerned with or affected by any agitation against or for the communal decision by non-Congress organisations or one-sided organisations ;
(D) That inasmuch as the communal decision, apart from being an All-India problem, is one of the gravest and most vital problems affecting the province of Bengal and is a barrier to the progress of this province, this council declares that it is the duty of the provincial Congress organisation which represents the people of this province belonging to all communities, and all Congress organisations subordinate to it, to carry on agitation both in and outside the legislature for the rejecton of the communal decision and thereby to pave the way for an agreed solution of the communal problem on the basis of joint electorate and adult franchise or any other agreed basis consistent with independence and principles of democracy.
(E) That the Congress Election Manifesto will be supplemented by a statement on the lines indicated in clause (D) above and then issued in this province.৭১
প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির এই সিদ্ধান্তকে সারা ভারত কংগ্রেসের সভাপতি পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু আপত্তিকর মনে করেন এবং তিনি কৈফিয়ত তলব করে চিঠি পাঠান। পণ্ডিত নেহরু মনে করেন, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রাদেশিক কমিটি সারা ভারত কংগ্রেস কমিটি কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাবের বিরোধী নীতি অনুসরণ করছে।৭২ তাই এই প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে প্রাদেশিক নেতৃত্বের বিতর্ক চলে। কোনো কোনো মহল থেকে এমনও অভিযোগ করা হয়, বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি সর্বভারতীয় কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে যেতে চায়। তাই তারা এই ধরনের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। শরৎচন্দ্র বসু এইসব ভিত্তিহীন অভিযোগের উত্তর দিয়ে গৃহীত প্রস্তাবের বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ১৬ আগস্ট ও ২ সেপ্টেম্বর (১৯৩৬ খ্রি.) প্রাদেশিক কমিটি যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাতে বাংলাদেশের জনপ্রিয় মুসলিম নেতা ত্রিপুরার মৌলবি আশরাফুদ্দিন আহমদ চৌধুরীর বিশেষ অবদান আছে। তাঁরই পরামর্শ অনুযায়ী ‘যুক্ত নির্বাচন প্রথা’ এবং ‘প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার’ শব্দগুলি প্রস্তাবে যুক্ত করা হয়।৭৩ শরৎচন্দ্র বসু আশা করেন, বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির এই প্রস্তাব আগামীদিনে সারা ভারতের সিদ্ধান্তরূপে সাদরে গৃহীত হবে।৭৪ তিনি যে বিবৃতি দেন, তা এখানে উল্লেখ করা হল:
Bengal stands united to-day in the fight for freeedom. She is determined to take her rightful place once more in the vanguard of the forces that are out to demand and secure the country’s birth right. She will carry on an unceasing campaign both inside and outside the legislatures for the rejection of the new constitution and what is involved in it, namely, the rejection of the communal decision of the Imperial Government. The decision of the B.P.C.C. of August 16 last is clear and unequivocal is the decision of the Executive council of the B. P. C. C. of the 2nd instant. It is significant that both these decisions were arrived at without a single dissentient voice. It is even more significant that both these decisions had the warm support of, amongst others, Moulvi Ashrafuddin Ahmed Choudhury of Tippera than whom no one in Bengal commands greater influence to-day over the Moslem masses of the province. I am not disclosing any secret when I say that it was at his suggestion that I introduced the words ‘on the basis of joint electrorate and adult franchise’ in the resolution of the 2nd instant. Congressmen and Congress-minded men in Bengal feel that agitation for the rejection of the new constitution and non-agitation for the rejection of the communal decision cannot logically and consistently go together. I venture to prophesy (though to do so is proverbially dangerous) that Bengal’s decision to-day will be India’s decision to-morrow.৭৫
প্রাদেশিক কমিটির প্রস্তাব সম্পর্কে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মনোভাবে অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করেন। অমৃতবাজার পত্রিকা এক দীর্ঘ সম্পাদকীয় প্রবন্ধে (‘Pandit Jawaharlal and Bengal Congress’) পণ্ডিত নেহরুর মনোভাবের সমালোচনা করেন। বাংলাদেশের সমস্যা কংগ্রেস নেতৃত্ব সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারছেন না, সে কথাই এই প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়।৭৬ কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ায় বাংলাদেশের কংগ্রেস একটি বলিষ্ঠ পথ অনুসরণ করতে পারেনি। যে নতুন সম্ভাবনা দেখা দেয় তাও তারা কাজে লাগাতে পারেনি। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনের পরেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশের কংগ্রেস ফজলুল হকের সঙ্গে মন্ত্রীসভা গঠনে উদ্যোগী হতে পারেনি। এই সময়ে বাংলাদেশের বিশেষ পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রাদেশিক নেতৃবৃন্দকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না দেওয়ায় কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মারাত্মক ভুল করে।
এইভাবে কংগ্রেস নেতৃত্ব ফজলুল হককে জিন্নার কোলে নিক্ষেপ করেন। আর জিন্নাও এই সুযোগের অপেক্ষায় অধীরভাবে বসেছিলেন। জিন্না উপলব্ধি করেন, ফজলুল হকের নেতৃত্বকে অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশে মুসলিম লিগকে শক্তিশালী করা সম্ভব নয়। সুতরাং, তিনি তাঁর সমর্থকদের ফজলুল হকের নেতৃত্বে হক-লিগ কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করতে নির্দেশ দেন। এই সময়ে জিন্না ফজলুল হককে সক্রিয়ভাবে মুসলিম লিগেও টেনে নিয়ে আসেন এবং তাঁকে সারা ভারত মুসলিম লিগের সব ক-টি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার সভ্য করেন।৭৭ আর তাঁর সঙ্গে জিন্না ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলেন। এই মন্ত্রীসভার আমলেই (১৯৩৭-১৯৪১ খ্রি.) জিন্না বাংলাদেশে মুসলিম লিগের প্রভাব বৃদ্ধি করেন। শক্তিশালী সংগঠনরূপে মুসলিম লিগের আবির্ভাব বাংলাদেশের রাজনীতির ভারসাম্য সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত করে।
মুসলিম লিগের প্রাদেশিক নেতৃত্বেও লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন ঘটে। ধীরে ধীরে অবাঙালি মুসলমানেরা প্রাধান্য স্থাপন করেন। বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের যেসব অবাঙালি মুসলমানেরা বসবাস করেন তাদের উপর অবাঙালি মুসলিম নেতৃবৃন্দের প্রভাব সবচেয়ে বেশি ছিল।৭৮ তা ছাড়া মুসলমান ব্যবসায়ী, জমিদার, মহাজন এবং শিক্ষিত মুসলমানেরা মুসলিম লিগকেই মুসলমানদের একমাত্র প্রতিষ্ঠানরূপে গ্রহণ করেন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে মুসলমানদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়াশীল অংশ সাময়িকভাবে পিছু হটতে বাধ্য হয় তারাই এই সময়ে মুসলিম লিগের পতাকাতলে সমবেত হন। আর এই অংশ কখনই ফজলুল হককে সুখী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গঠন করবার পরিকল্পনা কার্যকরী হতে দেয়নি। তাই এক অস্বাভাবিক জটিল পরিস্থিতির মধ্যে ফজলুল হককে মন্ত্রীসভার দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়। তখন থেকেই ভারতের রাজনীতির পট দ্রুত পরিবর্তিত হয়।
.
তথ্যসূত্র
১ Bengal Legislative Assembly Proceedings, Fifteenth Session, 1943, Vol. LXIV—No. 3, p. 588 ; Abdur Rab, A.S.M., A.K. Fazlul Huq (Life and Achievements), Barisal, 1966, p. 17.
২ Habibullah, B.D. Shere Bangla (In Bengali), 3rd edition, Barisal, 1374, p. 22.
৩ Ibid; Vide also Abdur Rab, Fazlul Huq. pp. 17 and 28.
৪ Abdur Rab, Fazlul Huq, pp. 28, 59–60.
৫ Presidential Address delivered by the Hon’ble Mr. A.K. Fazlul Huq, 30 December, 1918, at the All India Moslem League, 1918 Session, Delhi. Vide File of the Home Department Political, March, 1919, A., NOS. 251–259. (In the National Archives of India, New Delhi).
৬ Ibid
৭ Ibid
৮ Ibid
৯ Ibid
১০ Ibid
১১ Ibid
১২ Ibid
১৩ Habibullah, Shere Bangla, pp. 30–31.
১৪ Ibid, p. 31.
১৫ Ibid, pp. 33–35.
রাজেশ্বর রায়চৌধুরী ছিলেন বরিশালের কলসকাঠির প্রতাপশালী জমিদার। তাঁরই কর্মচারী ছিলেন বাগাদিয়া গ্রামের মুন্সি মহম্মদ ইয়াসিন হাওলাদার। তাঁর সঙ্গে রাজেশ্বর রায় চৌধুরীর একটানা দীর্ঘকাল বিরোধ হয়। তিনি ১৯২৪-২৫ খ্রিস্টাব্দে ‘জমিদারের দয়া প্রজার শাসন’ নামক একখানি পুস্তিকা রচনা করেন। তাতে জমিদারের জুলুম সম্পর্কে এক মর্মস্পর্শী বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি এই পুস্তিকায় আইনগত প্রতিকার দাবি করেন এবং সবাইকে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে আহ্বান করেন। মহম্মদ ইয়াসিন আরও কয়েকখানি পুস্তিকা রচনা করেন। তিনি তাঁর পুস্তিকায় প্রজাস্বত্ব আইন পাশের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন। ফজলুল হক এই আইন পাশ করার পরে তিনি যে পুস্তিকা প্রকাশ করেন তার নাম ছিল ‘হক সাহেবের আইনে প্রজার মুক্তি’।
(Ibid)
১৬ Abdul Khalek, Khondakar, Ek Shatabdi (In Bengali), 3rd edition, Dacca, 1373, p. 117.
১৭ Ibid, p. 118.
১৮ Ibid, p. 119.
১৯ Ibid.
শ্রী বি, ডি, হাবিবুল্লাহ তাঁর গ্রন্থে লেখেন, ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় প্রাদেশিক প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং এই সম্মেলনে ফজলুল হক সভাপতিত্ব করেন। এই সম্মেলনেই ‘নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতি’ গঠিত হয়। (পৃ. ৩৬-৩৭)। শ্রী এ, এস, এম, আবদুর রব তাঁর গ্রন্থে একই তথ্য পরিবেশন করেন (পৃ. ২৯-৩০)। কিন্তু খোন্দকার আবদুল খালেক তাঁর গ্রন্থে লেখেন, ১৯২৭খ্রিস্টাব্দে এই সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু কোথায় এই সমিতি গঠন করা হয় সে বিষয়ে তিনি কিছু উল্লেখ করেননি (পৃ. ১৯৯)।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত ‘কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস ও সমস্যা’ (কলিকাতা, ১৯৫৯) নামক পুস্তিকায় লেখা হয় যে, ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে নিখিলবঙ্গ প্রজা সমিতির ঢাকা সম্মেলনে তার নাম বদল করে নিখিলবঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতি রাখা হয়। তখনই এই দলের প্রতিষ্ঠা হয় (পৃ. ১৭)। মহম্মদ আবদুল্লাহ রসুলও তাঁর গ্রন্থে লেখেন, ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকাতে নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতি গঠিত হয়। (দ্র. কৃষক সভার ইতিহাস, পৃ. ৫২)
২০ Ibid, p. 124.
২১ Biswas, Kalipada, Jukta Banglar Shesh Adhyay (In Bengali), Calcutta, 1966, pp. 342–343.
২২ Letter of W. C. Banerjee, President, Bengalee Protection League, 7 Swallow Lane, Calcutta, vide Amrita Bazar Patrika, 14 September, 1936.
২৩ Ibid.
২৪ Ibid.
২৫ Ibid.
২৬ Ibid, vide also Hayat, Abul, Mussalamans of Bengal, Calcutta, 1966, pp. 74–101. আবুল হায়াত তাঁর গ্রন্থে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে উর্দু ভাষা প্রচারের বিষয় নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেন।
২৭ Objects and Programme of the Nikhil Banga Krishak Praja Samity, Calcutta, September, 1936. vide Amrita Bazar Patrika, 10 September, 1936.
২৮ Amrita Bazar Patrika, 14 September, 1936.
এই সময়ে ‘বেঙ্গলি প্রটেকশন লিগ’ নামক একটি সংস্থা বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানদের দুরবস্থা নিয়ে আলোচনা করে। অবাঙালিরা বাঙালির স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করছে এইসব তথ্য তারা প্রচার করে। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গলি প্রটেকশন লিগের সভাপতি বলেন, আমাদের বাঙালি মুসলমান ভাইয়েরা যেন অবাঙালি মুসলমান নেতৃবৃন্দের দ্বারা পরিচালিত না হন। এমনিতেই মুসলমানেরা শিক্ষায় অনগ্রসর। বাংলা ভাষাকে পরিত্যাগ করলে তাঁদের দুরবস্থা আরও বৃদ্ধি পাবে। অন্য প্রদেশের মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিশীল হবার কোনই কারণ নেই। কারণ দিল্লি বা বোম্বের মুসলমানেরা তাঁদের কলকারখানা ও দোকানে কর্মচারীরূপে একজনও বাঙালিকে নিযুক্ত করেন না। কলকাতার কলুটোলা স্ট্রিটের দোকানসমূহ এবং আশেপাশের জুট মিলের দিকে তাকালেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ‘বেঙ্গলি প্রটেকশন লিগ’ একটি প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান না হলেও, শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে একটি অংশ বাঙালির দুরবস্থা সম্পর্কে কীভাবে চিন্তা করেন তার পরিচয় এইসব উক্তিতে পাওয়া যায়।
২৯ Objects and Programme of the Nikhil Banga Krishak Praja Samity, September, 1936. Vide Amrita Bazar Patrika, 5 September, 1936.
৩০ Ibid.
৩১ Ibid. কৃষক প্রজা সমিতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং কর্মসূচি ইংরেজি ভাষায় রচিত। তাই মূল ইস্তাহারটি এখানে দেওয়া হল। পরিশিষ্ট ‘ক’ দ্রষ্টব্য।
৩২ Address delivered by A. K. Fazlul Huq at Barisal, dated 2 September, 1936. vide Amrita Bazar Parika, 5 September, 1936.
৩৩ Statement issued by A. K. Fazlul Huq. vide Amrita Bazar Patrika. 1 September, 1936.
৩৪ Ibid.
৩৫ Ibid. এই বিষয়ে কিছু তথ্য ‘বাঙলার অন্ন সমস্যা আমার সমস্যা’ নাম দিয়ে এস. এম. আজিজুল হক (শাহজাহান) ফজলুল হকের কয়েকটি বিবৃতি ও চিঠি বাংলার অনুবাদ করে ‘শেরে বাংলা স্মরণে সংকলন ১৯৭০ নামক সংকলন গ্রন্থে প্রকাশ করেন। এই সংকলন সম্পাদনা করেন সরদার ফজলুল করিম ও আমিরুল ইসলাম। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে বরিশাল জেলা সমিতির পক্ষ থেকে এই সংকলনটি প্রকাশিত হয়। (পৃষ্ঠা ৮-২০ দ্রষ্টব্য)।
৩৬ Amrita Bazar Patrika, 9 September, 1936.
৩৭ Statement issued by A.K. Fazlul Huq. vide Ibid.
৩৮ Letter of A. K. Fazlul Huq deted 9 September, 1936 to the Nawab Bahadur of Dacca. Vide Ibid. 10 September 1936.
৩৯ ‘Bursting of the Bubble’, Editorial article, Ibid.
৪০ Abdur Rab, A. S. M., Sahid Suhrawardy (In Bengali), Second Edition, Dacca, 1968, PP. 20–21.
৪১ Statement issued by Moulvi Abdul Karim. M.L.C., vide Amrita Bazar Patrika, 11 September, 1936.
৪২ The Programme of work in Assembly outlined by the Muslim League Board, vide Ibid, 13 September, 1936.
৪৩ A.K. Fazlul Huq’s reply to critics, vide Ibid 24 September, 1936.
৪৪ Ibid
৪৫ Ibid
৪৬ Ibid
৪৭ Ibid
৪৮ Ibid
৪৯ Ibid
৫০ Ibid
৫১ Ibid
৫২ Ibid
৫৩ Ibid
৫৪ Ibid
৫৫ Ibid
৫৬ Statement issued by A. K. Fazlul Huq. Ibid 1 September, 1936.
৫৭ Ibid
৫৮ Sardar Fazlul Karim and Amirul Islam (Edited). Shere Bangla Smarane Sankalan 1970 (In Bengali), Barisal, 1970, p. 19.
৫৯ Abdur Rab, A.K. Fazlul Huq, p. 87.
৬০ Ibid, p. 88, quoted in this book.
৬১ Bengal Legislative Assembly Proceedings, Thirteenth Session. 1942, vol. LXII—No. 2, pp. 34–35.
৬২ Letter from H.S. Suhrawardy, 3 Wellesley 1st. Lane, Calcutta, dated 30 January, 1937, to A. H. M. Wazir Ali, Deputy Magistrate, Munshigunje.
৬৩ Bengal Legislative Assembly Proceedings. Thirteenth Session, 1942, vol. LXII—No. 2, pp. 34 and 36.
৬৪ Krishak Andolaner Itihasa O Samasya (In Bengali), Published by the West Bengal Unit, C. P. I, Calcutta, August, 1959, pp. 13–23.
৬৫ Rasul, Abdullah Muhammad, Krishak Sabhar Itihasa, Calcutta, 1969, pp. 59–61.
৬৬ Kabir, Humayun, Muslim Politics 1906–47 and Other Essays, Calcutta, 1969, pp. 25–26.
৬৭ Speeches and Letters of A. K. Fazlul Huq. collected by me.
৬৮ Ibid ; vide also Biswas, Jukta Banglar, p. 316.
৬৯ Bengal Legislative Assembly Proceedings, Eighteenth Session, 1944, vol. LXVII—No. 2, p. 208.
৭০ Resolution on Communal Award adopted by the B. P. C. C. on 2 September, 1936. Vide Amrita Bazar Patrika, 3 September, 1936.
৭১ Ibid
৭২ Amrita Bazar Patrika, 14 September, 1936.
৭৩ Statement issued by Sarat Chandra Bose, Acting President of B.P.C.C., dated 10 September, 1936, vide Ibid.
৭৪ Ibid
৭৫ Ibid
৭৬ Pandit Jawaharlal and Bengal Congress, An Editorial Article, Ibid, 14 September, 1936.
৭৭ Abdur Rab, Fazlul Huq, p. 89.
৭৮ Letter of A.K. Fazlul Huq, dated 8 September, 1941, to Liaquat Ali Khan. Vide Statesman, 11 September, 1941.