ভারত বিভাগের প্রস্তাব গ্রহণ

ভারত বিভাগের প্রস্তাব গ্রহণ

১৯৪০খ্রিস্টাব্দের ২৪ মার্চ লাহোরে সারা ভারত মুসলিম লিগ অধিবেশনে ভারতের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সম্পর্কে প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর থেকে ভারতের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। কংগ্রেস-লিগ বিরোধ ক্রমান্বয়ে তীব্র হতে থাকে। সাম্প্রদায়িক মনোভাব ভারতের রাজনীতিকে জটিল করে তোলে। যদিও এই প্রস্তাব ‘লাহোর প্রস্তাব’ নামে মুসলিম লিগ কার্যবিবরণীতে উল্লেখিত আছে এবং কোথাও ‘পাকিস্তান’ শব্দের উল্লেখ নেই, তবুও পরবর্তীকালে এই প্রস্তাব ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে খ্যাত হয়। কারণ এই প্রস্তাবই ছিল পাকিস্তান দাবির মূল ভিত্তি। ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামকরণের একটি ছোট্ট ইতিহাস আছে। এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর সমস্ত হিন্দু ও জাতীয়তাবাদী কাগজগুলিতে বড়ো বড়ো শিরোনামায় খবর প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয় ‘পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে’। মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দের বক্তব্য, এইভাবেই ‘লাহোর প্রস্তাব’ ‘পাকিস্তান প্রস্তাবে’ রূপান্তরিত হয়। প্রথম দিকে জিন্না এই প্রস্তাবকে ‘লাহোর প্রস্তাব’ বলতেন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর জিন্না সর্বপ্রথম ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে এর উল্লেখ করেন। তখন থেকে এই প্রস্তাব মুসলিম লিগ মহলে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে পরিচিত হয়। জিন্না বলেন: ‘পাকিস্তান’ শব্দ আমরা চালু করিনি, হিন্দুরাই এই শব্দটি আমাদের উপহার দিয়েছেন। লাহোর প্রস্তাব তীব্র ভাষায় সমালোচনা করতে গিয়ে হিন্দুরা পাকিস্তান প্রস্তাবরূপে এর উল্লেখ করেন। তার ফলেই এই শব্দের প্রচলন হয়। অবশ্য এইজন্য জিন্না হিন্দুদের ধন্যবাদ জানান।

২২ মার্চ (১৯৪০ খ্রি.) লাহোরে সারা ভারত মুসলিম লিগের সপ্তবিংশতিতম অধিবেশন আরম্ভ হয়। মহম্মদ আলি জিন্না ওইদিন সভাপতির ভাষণে হিন্দু ও মুসলমান যে দুটি পৃথক জাতি তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি বলেন, হিন্দু ও মুসলমানদের পৃথক ধর্মীয়-দর্শন, সামাজিক প্রথা ও সাহিত্য রয়েছে। তাঁরা পরস্পর বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন না, বা এক সঙ্গে আহারও করেন না, এবং উপরন্তু তাঁরা দুটি পৃথক সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত যা প্রধানত পরস্পর বিরোধী চিন্তাধারা ও মতবাদ ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। জীবন সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ পৃথক। এটাও পরিষ্কার যে, হিন্দু ও মুসলমানেরা ইতিহাসের ভিন্ন উপাদান থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেন। তাঁদের ভিন্ন মহাকাব্য রয়েছে। এইসব মহাকাব্যের নায়কেরা এবং কাহিনিও পৃথক। প্রায়ই দেখা যায় একজনের কাছে যিনি বীর, তিনিই অন্যের কাছে শত্রুরূপে গণ্য হন। সুতরাং, এই দু-টি পৃথক জাতিকে একটি রাষ্ট্রে জুড়ে দিলে তাঁদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেবে এবং পরিশেষে এই রাষ্ট্র কাঠামো ধবংসপ্রাপ্ত হবে।

জিন্না বলেন, ভারতবর্ষ একজাতি নয়। গত বারোশো বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এই ধরনের ঐক্য কখনই গড়ে ওঠেনি। বরঞ্চ ভারতবর্ষ সবসময় ‘হিন্দু ভারত’ ও ‘মুসলিম ভারত’-রূপে বিভক্ত ছিল। ইংরেজরা জয়ী হবার পর বেয়নেটের সাহায্যেই ভারতের কৃত্রিম ঐক্য বজায় রেখেছেন। কিন্তু ইংরেজ শাসন অবসানের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানেরা এক ভয়ানক বিপর্যয়ের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবেন। তাই মুসলিম ভারত এমন শাসনতন্ত্র গ্রহণ করতে পারে না যেখানে হিন্দুদের প্রাধান্য থাকবে। কারণ তা হবে ‘হিন্দুরাজ’। জিন্না আশা পোষণ করেন, ব্রিটিশ সরকার এমন ধরনের কোনো শাসনতন্ত্র মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেবেন না।

ÛÛএই ভাষণ দেবার কয়েক মাস আগে জিন্না ‘Western Democracy Unsuited For India.’ নামক একটি প্রবন্ধ নয়াদিল্লির একটি কাগজে লেখেন। এই প্রবন্ধটি ‘জিন্নার থিসিস’ নামে খ্যাত। এই প্রবন্ধে জিন্না লেখেন, পশ্চিমি গণতন্ত্র ভারতের পক্ষে একেবারেই অনুপযোগী এবং ই গণতন্ত্র চাপিয়ে দেবার ফলেই ভারতবর্ষে এই শাসনতান্ত্রিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। এমন ধরনের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা উচিত যাতে ভারতবর্ষে দুটি জাতি আছে তার স্বীকৃতি থাকে। জিন্না একথাও উল্লেখ করেন যে, মুসলিম লিগ যুক্তরাষ্ট্রীয় (Federation) ব্যবস্থার বিরোধী। কারণ এই ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক পার্লামেন্টারি সরকারের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠদের শাসন কায়েম করবে।

লাহোর অধিবেশনে জিন্নার দীর্ঘ বত্তৃতা এবং জিন্নার থিসিস থেকে জানা যায়, জিন্না মনে করেন ভারতবর্ষের ঐক্যবদ্ধ কোনো রূপ নেই, ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিম দুটি পৃথক জাতি আছে এবং ভারতবর্ষের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে সমাধান করা সম্ভব নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার, তৎকালীন মুসলিম লিগের যেসব দাবি জিন্না ব্রিটিশ সরকারের কাছে পেশ করেন তার মধ্যে প্রধান ক-টি দাবি ছিল:

১. শাসনতন্ত্র সম্পর্কীয় ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন পুরাপুরি বাতিল করতে হবে।

২. মুসলিম লিগের সম্মতি নিয়ে শাসনতন্ত্রের সংস্কার করতে হবে।

৩. কোনো মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে ভারতীয়, বিশেষ করে মুসলিম সৈন্য ব্যবহার করা চলবে না।

৪. সন্তোষজনকভাবে আরব সমস্যা সমাধান করতে হবে।

৫. ভারতের কংগ্রেস শাসিত প্রদেশে নির্যাতিত মুসলমানদের বিষয়ে তদন্ত করতে হবে।

জিন্না মনে করেন, কংগ্রেস হিন্দুদের প্রতিষ্ঠান এবং মুসলমানদের পক্ষ থেকে কথা বলবার অধিকার কেবলমাত্র মুসলিম লিগের আছে। এইভাবে জিন্না ‘দ্বিজাতিতত্ত্বকে’ বিকশিত করেন। আর লাহোর প্রস্তাবে তার বাস্তব রূপায়ন হয়।

২৩ মার্চ (১৯৪০ খ্রি.) বেলা তিনটায় জিন্নার সভাপতিত্বে লিগের প্রকাশ্য অধিবেশন বসে। বেলা ৩-৪৫ মি. সময়ে ফজলুল হক প্যান্ডেলে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে সংবর্ধনা জানান এবং ‘শের-ই-বঙ্গাল জিন্দাবাদ’ ধবনিতে অধিবেশন প্রাঙ্গন আন্দোলিত হয়। তারপর ফজলুল হক মূল প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। এই প্রস্তাবে ভারতের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সম্পর্কে মুসলিম লিগের মনোভাব ব্যক্ত করা হয়েছে। এই প্রস্তাবের মূল বক্তব্য বিষয় হল:

১. সারা ভারত মুসলিম লিগ কাউন্সিল ও ওয়ার্কিং কমিটি শাসনতন্ত্র সম্পর্কে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭ আগস্ট, ১৭–১৮ সেপ্টেম্বর ও ২২ অক্টোবর এবং ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ৩ ফেব্রুয়ারি যেসব প্রস্তাব গ্রহণ করে, তা এই সভা সমর্থন করে। তা ছাড়া এই সভা দৃঢ়তার সঙ্গে উল্লেখ করে যে, ভারত সরকারের ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের আইনের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা দেশের পক্ষে একেবারেই অনুপযোগী এবং তা মুসলিম ভারতের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নয়।১০

২. ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ অক্টোবর ভাইসরয় ঘোষণা করেন, যে নীতি ও পরিকল্পনা ভিত্তি করে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইন প্রণীত হয়, তা ভারতের বিভিন্ন দল ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা করে পুনর্বিবেচনা করা হবে। এই প্রস্তাবে ভাইসরয়ের এই ঘোষণা উল্লেখ করে বলা হয় যে, মুসলিম ভারত এমন কোনো শাসনতন্ত্র গ্রহণযোগ্য মনে করবে না যা তাদের সঙ্গে আলোচনা না করে এবং তাদের সম্মতি না নিয়ে করা হয়েছে।১১

৩. এই প্রস্তাবে বলা হয়, সারা ভারত মুসলিম লিগের মতো কোনো শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা এই দেশে কার্যকরী হবে না, অথবা মুসলমানদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, যদি না তা নিম্লোক্ত মৌলিক নীতি মেনে নেয়, যথা, ভৌগোলিক দিক থেকে সন্নিহিত ইউনিটগুলি নিয়ে এবং তার জন্য প্রয়োজনবোধে আঞ্চলিক রদবদল করে ভারতকে এমন কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করতে হবে যাতে ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চল, যেখানে মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ—সেখানে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে উঠবে এবং সেই সকল রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ইউনিটগুলি হবে স্বশাসিত ও সার্বভৌম।১২

প্রস্তাবে আরও বলা হয়, এই ইউনিট ও অঞ্চলগুলিতে সংখ্যালঘিষ্ঠদের স্বার্থ সর্বতোভাবে রক্ষার ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে থাকবে এবং তা করা হবে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে। তেমনি ভারতেও সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা থাকবে।১৩

এই সভা এই প্রস্তাবের মূলনীতি অনুযায়ী এবং যাতে অঞ্চলগুলি দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র, যোগাযোগ, কাস্টমস এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে সমস্ত কর্তৃত্বলাভ করতে পারে সেদিকে লক্ষ রেখে একটি খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য ওয়ার্কিং কমিটিকে দায়িত্ব দেয়।১৪

এই মূল প্রস্তাব উত্থাপন করে ফজলুল হক কয়েকটি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন:

আমরা এখানে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছি, যা আমরা চাই তা যুক্তরাষ্ট্রীয় (Federation) পরিকল্পনা নয়। আমরা এর বিরোধী। যুক্তরাষ্ট্রীয় চিন্তাধারা পরিহার করার দাবি আমরা জানাচ্ছি। মুসলিম লিগের মঞ্চ থেকে এবং বাংলাদেশের আইনসভায় আমি অনেকবার দৃঢ়তার সাথে বলেছি যে, ভারতের মুসলমানদের সম্মতি না নিয়ে কোনো শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করলে তা তাঁরা গ্রহণ করবেন না। আমরা এই ধরনের শাসনতন্ত্রকে অকেজো করে দেব। আমি আশা করব, যাঁরা ভবিষ্যৎ ভারতের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অধিকারী তাঁরা মুসলিম মনোভাবকে গ্রাহ্য করবেন। আমাদের বক্তব্য তো পরিষ্কার করে বলা হয়েছে। আর সমস্যাও সহজ। বর্তমানে আট কোটি মুসলমান ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে আছেন। সংখ্যার দিক থেকে বৃহৎ মনে হলেও, কার্যত প্রায় সব প্রদেশেই মুসলমানেরা দুর্বল অবস্থায় আছেন। পাঞ্জাব ও বাংলাদেশে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং অন্যত্র আমরা শোচনীয়ভাবে সংখ্যালঘিষ্ঠ। অবস্থা এমন যে, শাসনতন্ত্র যে ধরনের হোক না কেন, তাতে মুসলমানদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হতে বাধ্য। যেমন প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চালু হবার পর থেকে গত তিন বছর ধরে মুসলমানদের ভুগতে হচ্ছে।১৫

ফজলুল হক তাঁর ভাষণে বলেন:

We have stated definitely and unequivocally that what we want is not merely a tinkering with the idea of federation but its thorough overhauling so that the federation may ultimately go. This idea of federation must not only be postponed but abandoned altogether. On many on occasion on the platform of the Muslim League and the other day on the floor of the House in the Bengal Legislative Assembly, I made an emphatic and definite assertion that the Mussalmans of India will not consent to any such scheme which is framed with out our approval. We will make such a constitution absolutely unworkable. I hope those who may have in their power to shape the future constituion of India will take the Muslim feelings into considertion and not take any step which may be regretted. We have made our position absolutely clear. The problem is very simple. At present the Muslims constitute 80 millions scattered all over India. It may sound a big number but, as a matter of fact, the Muslims are in a weak position numerically in almost every province of India. In the Punjab and Bengal we are in an effective majority and are hopelessly in minority elsewhere. The positon is such that whatever may be the constitution, Muslim interests are bound to suffer just as they have suffered during the last three years of the working of provincial autonomy.১৬

প্রসঙ্গত ফজলুল হক বিহারের রামগড়ে সারা ভারত কংগ্রেসের অধিবেশনে (১৯-২০মার্চ), ১৯৪০ খ্রি.) সভাপতিরূপে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ যে ভাষণ দেন তার উল্লেখ করেন। মৌলানা আজাদ এক দীর্ঘ ভাষণে ভারতীয় মুসলমানদের সমস্যা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন।১৭ তিনি বলেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এখানে বিভেদের বীজ বপন করেছে এবং সাম্প্রদায়িক সমস্যাকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। এই মূল সমস্যার প্রতি মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, ভারতে মুসলমানেরা ‘রাজনৈতিক সংখ্যালঘু’ (political minority) নন। যদি মুসলমান জনসমষ্টির আকৃতি ধরা যায় তাহলেও তাঁদের ‘ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু’ (a small minority) বলা চলে না। এক স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতে মুসলমানদের অধিকার ও স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে, এই ভ্রান্ত চিন্তাধারা পোষণ করার ফলে মুসলমানেরা নিজেদের প্রকৃত অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। ভারতে আট থেকে নয় কোটি মুসলমান আছেন। এই সংখ্যা সমগ্র জনসমষ্টির এক চতুর্থাংশ হলেও, সংখ্যায় ও শক্তিতে তাঁদের নগণ্য বলা যায় না। এই বৃহৎ সংখ্যক মুসলমানেরা কী করে ভাবতে পারেন যে, স্বাধীন-গণতান্ত্রিক ভারতে তাঁরা তাঁদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করতে পারবেন না? সমগ্র দেশেই মুসলমানেরা ছড়িয়ে আছেন। এগারোটা প্রদেশের মধ্যে চারটি প্রদেশে মুসলমানেরা সংখ্যাগুরু। ব্রিটিশ বেলুচিস্থান ধরলে সংখ্যাগুরু মুসলিম প্রদেশের সংখ্যা হবে পাঁচ। সুতরাং, সাতটি প্রদেশে তাঁরা সংখ্যালঘু হলেও, পাঁচটি প্রদেশে তারা সংখ্যাগুরু। তাই সংখ্যালঘু এই মনোভাবের দ্বারা মুসলমানদের পীড়িত হবার কোনোই কারণ নেই। ভবিষ্যৎ ভারতের শাসনতন্ত্র সম্পর্কে এখনই বিস্তারিতভাবে কিছু বলা না গেলেও আমরা একথা বলতে পারি, স্বাধীন ভারতে একটি গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হবে, সেখানে প্রতিটি প্রদেশ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে। আর কেন্দ্রীয় সরকারের এক্তিয়ারে থাকবে সর্বভারতীয় বিষয়, যথা—বৈদেশিক সম্পর্ক, দেশরক্ষা, কাস্টমস ইত্যাদি। এই অবস্থায় মুসলমানদের সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু মনোভাবের দ্বারা বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়। সুতরাং মুসলমানদের ভীতি ও আশঙ্কা পরিহার করে সাহস ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে স্বাধীন ভারত গঠনে অগ্রসর হওয়া উচিত। মৌলানা আজাদ মুসলমানদের প্রতি আবেদন করেন, তাঁরা যেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মূল ধারা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন না করেন। এক স্বাধীন ও সুখী ভারত গড়বার জন্য তাঁরা যেন হিন্দুদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক সঙ্গে চলেন।১৮

মৌলানা আজাদ বলেন :

আমি নিজে একজন মুসলমান, এই কথা ভেবে আমি গর্বিত। তেরোশত বছরের ইসলামের ঐতিহ্য আমি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। এই ঐতিহ্যের সামান্য অংশও পরিত্যাগ করতে আমি রাজি নই। ইসলামের শিক্ষা ও ইতিহাস, শিল্পকলা ও সভ্যতা আমার মূল্যবান সম্পদ। একে রক্ষা করা আমার পবিত্র কর্তব্য। একজন মুসলমান হিসাবে ঐশ্লামিক ধর্ম ও সংস্কৃতিতে আমার বিশেষ আগ্রহ আছে এবং এই সব ক্ষেত্রে কোনো হস্তক্ষেপ আমি সহ্য করতে পারি না। কিন্তু এইসব স্বাভাবিক অনুভূতি সত্ত্বেও, অন্যান্য ভাবাবেগও আছে যা আমার জীবনের বাস্তব অবস্থা থেকে উদ্ভুত। ইসলামের প্রকৃত মর্মের সঙ্গে এইসব ভাবাবেগের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। উপরন্তু তা আমাকে সামনের দিকে চলতে সাহায্য করে। আমি একজন ভারতীয় হওয়ায় গর্বিত। আমি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অবিভাজ্য অংশ। আমি ভারতের এক অপরিহার্য অংশ এবং আমাকে বাদ দিয়ে এই দীপ্যমান ভারতভূমির গড়ন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমি একটি একান্ত আবশ্যক উপাদান যা দিয়ে ভারতকে গঠন করা সম্ভব। আমি এই অধিকার কখনই পরিত্যাগ করতে পারি না।১৯

ভারতের ঐতিহাসিক ভাগ্যলিপি হল এই, এখানে অনেক মানবজাতি ও বিভিন্ন সংস্কৃতির ধারা প্রবাহিত হবে, এই আতিথ্যপূর্ণ দেশে আশ্রয় পাবে এবং অনেক চলমান যাত্রীদল এখানে এসে বিশ্রাম লাভ করবে। এমনকি ইতিহাসের ঊষালগ্নের পূর্বেই এই চলমান যাত্রীদল ভারতে ঢুকে পড়েছে এবং ঢেউয়ের পরে ঢেউয়ের মতো নতুন নতুন যাত্রীদল এই ভারতভূমিতে প্রবেশ করেছে। এই বিশাল এবং উর্বরভূমি সবাইকে আবাহন করেছে এবং নিজের বুকে আশ্রয় দিয়েছে। পূর্বপুরুষদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যে সর্বশেষ যাত্রীদল ভারতভূমিতে প্রবেশ করেছেন তাঁরা হলেন ইসলামের সমর্থক। তাঁরা এখানে এলেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। তার ফলে দুটি ভিন্ন জাতির সংস্কৃতির স্রোতধারা এই ভূমিতে মিলিত হয়। গঙ্গা ও যমুনার মতো কিছুদিন ভিন্ন পথে ধাবিত হলেও প্রকৃতির অপরিবর্তনীয় নিয়ম অনুযায়ী এই দুই সংস্কৃতির স্রোতধারা পরস্পর নিকটবর্তী হয় এবং একই সঙ্গমে মিলিত হয়। এই মিলন ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তারপর ভাগ্যবিধাতা অদৃশ্য পথে পুরোনো ভারতের স্থানে এক নতুন ভারত গঠন করতে থাকেন। আমরা আমাদের সম্পদ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। আর ভারতও ঐশ্বর্যপূর্ণ ছিল। আমরা ভারতকে আমাদের সম্পদ উপহার দেই এবং ভারতও তার ঐশ্বর্যের দুয়ার আমাদের সামনে খুলে দেয়। ইসলামের অমূল্য রত্নভাণ্ডার থেকে গণতন্ত্র ও সাম্যের বার্তা সংগ্রহ করে আমরা ভারতকে উপহার দেই। ভারতের তা বিশেষভাবে প্রয়োজন ছিল।২০

তারপরে দীর্ঘ এগারোশত বছর কেটে গেছে। এখন হিন্দুধর্মের মতো ইসলামেরও ভারতভূমির উপরে বিশেষ দাবি আছে। যদি হিন্দুধর্ম কয়েক হাজার বছর ধরে এখানকার মানুষের ধর্ম হয়ে থাকে, তবে ইসলামও এক হাজার বছর ধরে তাঁদের ধর্ম। হিন্দুদের মতোই গর্ব করে আমরা বলতে পারি, আমরা ভারতীয় এবং ইসলামের অনুসরণকারী। আমি এই কক্ষপথকে আরও একটু প্রসারিত করব। একজন ভারতীয় ক্রিশ্চানও অনুরূপভাবে বলতে পারেন, তিনি একজন ভারতীয় এবং ভারতের একটি ধর্ম অর্থাৎ খ্রিস্টধর্ম অনুসরণ করেন।২১

এগারোশত বছরের ইতিহাসে ভারতের সমৃদ্ধি আমাদের যৌথ সাফল্যের ফলেই হয়েছে। আমাদের ভাষা, আমাদের কাব্য, আমাদের সাহিত্য, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের শিল্পকলা, আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, আমাদের ব্যবহার, আমাদের প্রথা, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অসংখ্য ঘটনা, মোটকথা প্রতিটি বিষয়ে, আমাদের যৌথ উদ্যোগের চিহ্ন বিদ্যমান। জীবনের এমন কোনো দিক নেই যেখানে তার প্রভাব পাওয়া যায় না। একসময়ে আমাদের ভাষা ভিন্ন ছিল। কিন্তু পরে আমরা একই ভাষা ব্যবহার করি। আমাদের আচরণ-প্রথাও ভিন্ন ছিল। কিন্তু পরস্পরের যোগাযোগের মধ্য দিয়ে আমাদের এক নতুন আচরণ বিধি গড়ে ওঠে। আর আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদে যে পার্থক্য ছিল তা আজ কেবলমাত্র সেকালের ছবিতেই দেখা যায়। আমাদের একই জাতীয়সত্তা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এই যৌথ সম্পদ আমরা পেয়েছি।২২ আর তা আমরা পরিত্যাগ করতে চাই না এবং সে যুগে ফিরে যেতে চাই না যখন এই যৌথ জীবনের সূচনা হয়নি। যদি আমাদের মধ্যে এমন কোনো হিন্দু থাকেন যিনি হাজার বছরের পূর্বেকার হিন্দুজীবন ফিরিয়ে আনতে চান, তাহলে তিনি অলীক স্বপ্ন দেখছেন। তেমনি যদি এমন কোনো মুসলমান থাকেন যিনি তার অতীত সভ্যতা ও সংস্কৃতি পুনর্জীবিত করতে চান যা তিনি এক হাজার বছর পূর্বে ইরান ও মধ্য এশিয়া থেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন, তাহলে তিনিও স্বপ্ন দেখছেন। যতশীঘ্র এই ধরনের মানুষেরা জেগে ওঠেন, ততই দেশের পক্ষে মঙ্গল। এইসব অস্বাভাবিক কল্পনার বাস্তব জীবনের সঙ্গে কোনোই যোগ নেই। আমি বিশ্বাস করি, ধর্মের ক্ষেত্রে পুনর্জীবনের প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে, কিন্তু সামাজিক ক্ষেত্রে এই ধরনের কোনো প্রচেষ্টা প্রগতিবিরোধী হয়। এক হাজার বছরর যৌথ জীবন আমাদের একই জাতীয় ভাবধারায় নতুনভাবে গঠন করেছে। তা কৃত্রিমভাবে করা কখনই সম্ভব নয়। কয়েকশত বছর ধরে প্রকৃতি তার অদৃশ্য পদ্ধতি অনুযায়ী আমাদের এই নতুন আকৃতি দিয়েছে। আর ভাগ্যবিধাতাও তার উপরে চিহ্ন এঁকে দিয়েছেন। আমরা পছন্দ করি কি না করি, আমরা এখন একটি ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় জাতিতে পরিণত হয়েছি। আমাদের পৃথক ও বিভক্ত করবার জন্য কোনো খেয়াল অথবা কৃত্রিম পরিকল্পনা এই ঐক্যকে ভাঙতে পারবে না। ইতিহাসের ও ঘটনার স্বাভাবিক পরিণতিকে আমাদের মেনে নিতেই হবে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ ভাগ্যকে গঠন করার জন্য সচেষ্ট হতে হবে।২৩

রামগড়ে মৌলানা আজাদের এই অনবদ্য ভাষণ পাকিস্তান দাবির প্রবক্তাদের ক্ষুব্ধ করে। লাহোর প্রস্তাবের সমর্থনে যাঁরা ভাষণ দেন তাঁরা সবাই মৌলানা আজাদের এই ভাষণকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেন। অবশ্য ফজলুল হক মৌলানা আজাদের মূল বক্তব্য বিষয়কে অর্থাৎ ভারতের ঐক্যবদ্ধ জাতীয় সত্তাকে আক্রমণ না করে তাঁর ভাষণের সেই অংশকেই অ-ইসলামি (un-Islamic) বলে সমালোচনা করেন যেখানে তিনি মুসলমানদের উদবিগ্ন হতে নিষেধ করেন।২৪ শাসনতন্ত্রের ত্রুটির জন্য সংখ্যালঘু হিসাবে মুসলমানদের দুর্বল অবস্থার কথা ভেবেই ফজলুল হক এই সমালোচনা করেন। ফজলুল হক বলেন: আট কোটি মুসলমান সংখ্যায় কম নয়, তাই তাদের ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। এই আট কোটির একটি বড়ো অংশ যদি একটি প্রদেশে সমবেত হয়, তবে কোনো কিছুতেই ভয় থাকে না। কিন্তু যেভাবে আমরা আছি, তাতে আমাদের রাজনৈতিক শত্রুরা তার সুযোগ নিতে পারে। আমাদের বন্ধুদের মনে রাখা দরকার, এমনকি পাঞ্জাব ও বাংলাদেশে আমাদের অবস্থা নিরাপদ নয়। আইনসভাতে আমরা সংখ্যায় খুব একটা বেশি নই, তাই ভিন্ন স্বার্থ ও সম্প্রদায়ের সদস্যদের নিয়ে আমাদের কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হয়। শাসনতন্ত্রে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মতে, এই ধরনের সরকার হল সবচেয়ে দুর্বলতম সরকার। অন্য প্রদেশেও আমাদের অবস্থা খুবই দুর্বল এবং সংখ্যাগরিষ্ঠদের দয়ার উপর আমাদের নির্ভর করতে হয়। ততক্ষণ পর্যন্ত মুসলমান জনসমষ্টির অসমান অবস্থানের একটি সন্তোষজনক সমাধান না হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত ভারতের শাসনতন্ত্রের অগ্রগতি অথবা রক্ষাকবচ নিয়ে আলোচনা নিরর্থক। ভারতের সর্বত্র মুসলমান বন্ধুদের নিকট আবেদন করছি, তাঁরা যেন ঐক্যবদ্ধ থাকেন, ধীরস্থিরভাবে বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করেন এবং স্মরণ রাখেন যে, আমাদের নিজেদের পায়ের উপর দাঁড়াতে হবে এবং অন্যের উপর নির্ভর করলে চলবে না। পরিশেষে ফজলুল হক সবাইকে এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে বলেন এবং তিনি আশা করেন এর ফল ভালো হবে।২৫ লাহোর অধিবেশনে ফজলুল হকের মূল ভাষণের অবশিষ্ট অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হল:

Eighty millions was not a small number and they need not be afraid. If a sufficient proportion of 80 millions had been congregated in one province we would have nothing to fear. Situated as we are, our political enemy can take advantage of the situation. Our friends will remember that even in the Punjab and Bengal our position is not very safe. In the legislatures we are not in such large majority ; we have to seek the help of other interests and minorities to form coalition governments which are the weakest form of Governments known to constitutionalists. As regards the other provinces we are in a very weak position and are at the mercy of the majority. Until a satisfactory solution is found of this unequal distribution of Mulsim population it is useless to talk of constitutional advance or of safeguards.

I earnestly appeal to my Muslim friends throughout India to remain united and exercise calm and sober judgment and remember that we have to stand on our own feet an cannot rely on anybody.২৬

প্রথমে লাহোর প্রস্তাব সমর্থন করে চৌধুরী খালিকুজ্জমান। তারপর এই প্রস্তাবের সমর্থনে মৌলানা জাফর আলি খান, এম. এল. এ. (সেন্ট্রাল), সর্দার ঔরঙ্গজেব খান, ফ্রন্টিয়ার আইন-সভার বিরোধী দলের নেতা ও স্যার আবদুল্লা হারুণ, এম. এল. এ. (সেন্ট্রাল) বত্তৃতা করেন। জিন্না খালিকুজ্জমানকে এই প্রস্তাব সমর্থন করতে বলেন। খালিকুজ্জমান বলেন, অবস্থার চাপে পড়ে মুসলমানদের পৃথক হবার দাবি করতে হচ্ছে। এইজন্য তিনি ব্রিটিশ সরকার, কংগ্রেস ও সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়কে অভিযুক্ত করেন। কংগ্রেস শাসিত প্রদেশে মুসলমানেরা যে ব্যবহার পেয়েছে তাতে এই সিদ্ধান্ত নিতে হল। তিনি মৌলানা আজাদের রামগড় ভাষণের সমালোচনা করেন। আজাদ বলেছিলেন, যেহেতু মুসলমানেরা আত্মরক্ষা করতে সমর্থ, তাই মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্র গড়বার দাবি করা উচিত নয়। খালিকুজ্জমান বলেন, যদি কংগ্রেস মুসলমান-কংগ্রেসীদের পরামর্শ অনুযায়ী চলে তবে ভারতে গৃহযুদ্ধ অনিবার্য। মৌলানা জাফর আলি বলেন, কংগ্রেস সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমানদের দমন করতে চায়। সর্দার ঔরঙ্গজেব খান মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র দাবি করেন। কারণ মুসলমানেরা একটি পৃথক জাতি। তিনি বলেন, ব্রিটিশ গণতন্ত্র আমরা চাই না। স্যার আবদুল্লা হারুন বলেন, এ ঘটনা তো সকলের জানা আছে যে সিন্ধুর মধ্য দিয়ে মুসলমানেরা ভারতে প্রবেশ করেন, আর সিন্ধুর মুসলমানেরাই প্রথম এই ধরনের প্রস্তাব উত্থাপণ করেন। তিনি হিন্দুদের এই বলে সতর্ক করে দেন, হিন্দু প্রদেশে যদি মুসলমানেরা ন্যায় বিচার না পান, তবে মুসলিম প্রদেশেও হিন্দুরা অনুরূপ ব্যবহার পাবেন। তিনি বলেন:

If the Muslim in Hindu province were not justly treated, the Hindus is the Muslim provinces would be treated in the same way in which Herr Hitler had treated the Sudetans.২৭

২৪ মার্চ (১৯৪০ খ্রি.) আরও কয়েকজন বক্তা প্রস্তাবের পক্ষে বলেন। বিহারের কে. বি. নবাব মহম্মদ ইসমাইল খান বলেন, বিহারে সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমানদের বাকস্বাধীনতা নেই। এই অধিবেশন একটি ‘মুক্ত দেশে’ হওয়ায় তিনি নিজের মতামত ব্যক্ত করতে পারছেন বলে আনন্দিত। সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের মুসলমানেরা সংখ্যালঘিষ্ঠ প্রদেশের মুসলমানদের সাহায্যে এগিয়ে আসায় তিনি তাঁদের ধন্যবাদ জানান। তিনি একথাও বলেন, রামগড়ে মৌলানা আজাদ যে কথা বলেছেন তা মুসলমানদের কথা নয়। জিন্নাই ভারতীয় মুসলমানদের মনোভাব ঠিকভাবে ব্যক্ত করেছেন। একই ধরনের ভাষণ দেন মহম্মদ ঈশা খান (বেলুচিস্থান), আবদুল হামিদ খান (মাদ্রাজ), ইসমাইল চূন্দ্রীগড় (পাঞ্জাব), সৈয়দ আবদুর রউফ শাহ (সি. পি.), ডা. মহম্মদ আলম, এম. এল. এ. (পাঞ্জাব), সৈয়দ জাকির আলি ও বেগম মহম্মদ আলি। ওইদিন ফজলুল হক কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাব হাত তুলে গৃহীত হয়।২৮

মুসলিম লিগের কার্যবিবরণী থেকে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ সম্পর্কে বিভিন্ন বক্তার যে সব মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা হল, তা থেকে ফজলুল হকের চিন্তাধারার সঙ্গে জিন্না ও তাঁর সমর্থক অন্যান্য বক্তার দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য চোখে পড়বে। যদিও সবাই মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবিতে ঐকমত্য হন। ফজলুল হকের মতে, ভারতে মুসলমানদের অবস্থা দুর্বল। এমনকী সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশেও তাঁদের অবস্থা ভালো নয়, কারণ সেখানে তাঁরা ‘effective majority’ হলেও ততটা প্রভাবশালী নয় (অর্থাৎ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্ষম এমন সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়)। যদি আট কোটি মুসলমানদের একটি বৃহৎ অংশ একটি প্রদেশে থাকত তাহলে ভয় পাবার কোনোই কারণ ছিল না। কিন্তু মুসলমানেরা অসমানভাবে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে আছে। এই অবস্থার কোনো সন্তোষজনক সমাধান না হলে শাসনতান্ত্রিক অগ্রগতি ও রক্ষাকবচ নিয়ে আলোচনা করা নিরর্থক। সুতরাং ফজলুল হক জিন্নার মতো ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ প্রচার করেননি। তা ছাড়া তিনি হিন্দু ও মুসলমানদের পৃথক সত্তার উপরও গুরুত্ব আরোপ করেননি। তিনি সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকেও ইতিহাসের ঘটনাবলি ব্যাখ্যা করেননি। পশ্চিমী গণতন্ত্র ভারতে অচল, জিন্নার এই থিসিসও তিনি গ্রহণ করেননি। মুসলমান সমাজের উন্নতির জন্য পৃথক রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা ফজলুল হক উপলব্ধি করেন। আবার সেখানেও সংখ্যালঘিষ্ঠদের অধিকার সংরক্ষণের প্রতি তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। শুধু তাই নয়। কেন্দ্রিকতার ফলে মুসলিম রাষ্ট্রের ইউনিট ও অঞ্চল যাতে ‘স্বায়ত্তশাসন’ ও ‘সার্বভৌম’ ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত না হয় সেদিকেও তাঁর লক্ষ ছিল। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ফজলুল হক এই প্রস্তাবের বিষময় ফলের কথা তখন বুঝতে পারেননি।

এই পাকিস্তান প্রস্তাবের কয়েকটি ত্রুটি ও স্ববিরোধিতা রয়েছে। এই প্রস্তাবে ‘independent states’ ও ‘Sovereign’ ইত্যাদি শব্দ এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যে প্রকৃত অর্থ উদ্ধার করা কষ্টকর। তিন নং অনুচ্ছেদে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অঞ্চল নিয়ে কয়েকটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই কথা পরিষ্কার করে উল্লেখ করা হয়নি যে, এই রাষ্ট্রগুলি পৃথকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে থাকবে অথবা এই রাষ্ট্রগুলি একটি মাত্র ফেডারেল বা ইউনিটারি ধরনের রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। মোটকথা, এই রাষ্ট্রগুলি নিয়ে ফেডারেশন বা কনফেডারেশন গঠনের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, এই প্রস্তাব পাঠ করে জানা যায় না। এই বিষয়ে ড. বি. আর. আম্বেদকর যে মন্তব্য করেন তা উল্লেখযোগ্য। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ড. আম্বেদকরের গ্রন্থ Pakistan or the Partition of India প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থ পাঠ করে জিন্না সন্তোষ প্রকাশ করেন। পাকিস্তান প্রস্তাব সম্পর্কে আম্বেদকরের উক্তি সম্পর্কে জিন্না কোনো সমালোচনা করেননি। সুতরাং, পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হবার পর ড. আম্বেদকর যে মন্তব্য করেন তার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা দরকার। আম্বেদকর লেখেন:

What does this Resolution contemplate? A reference to para 3 of the Resolution will show that the Resolution contemplates that the areas in which Muslims predominate shall be incorporated into independent states. In concrete terms, it means that the Punjab, the North-Western Frontier Province, Baluchistan and Sind in the North-West and Bengal in the East instead of remaining as the provinces of British India shall be incorporated as independent states outside of British India. This is the sum and substance of the Resolution of the Muslim League.

Does the Resolution contemplete that these Muslim provinces, after being incorporated into states, will remain each an independent sovereign state or will they be joined together into one constitution as members of a single state, federal or unitary? On this point, the Resolution is rather ambiguous, if not self-contradictory. It speaks of grouping the zones into ‘Independent states in which the constituent units shall be autonomous and sovereign.’ The use of the terms ‘constituent units’ indicates that what is contemplated is a Federation. If that is so, then, the use of the word ‘Sovereign’ as an attribute of the units is out of place. Federation of units and sovereignty of units are contradictions. It may be that what is contemplated is a confederation. It is, however, not very material for the moment whether these Independent states are to form into a federation or confederation. What is important is the basic demand, namely, that these areas are to be separated from India and formed into independent states.২৯

অধ্যাপক আর, কুপল্যান্ড বলেন:

It was not clear exactly what this paragraph of the resolution meant. It could scarcely mean that the constituent units of the independent states were really to be ‘Sovereign’, but that it did mean that the states were to be really ‘independent’ was shown by a subsequent paragraph.৩০

মনে রাখা দরকার, ড. আম্বেদকরের গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পরেও জিন্না পাকিস্তান প্রস্তাবের ত্রুটি সংশোধন করতে উদ্যোগী হননি। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে দিল্লিতে মুসলিম লিগের আইনসভার সদস্যদের কনভেনশনে সর্ব প্রথম এই প্রস্তাবের বহুবচন শব্দ ‘Independent States’ নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত হয়। তখন জিন্না বলেন, মুদ্রণ ত্রুটির জন্য ‘States’ শব্দ সংযোজিত হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে ‘State’ শব্দ হবে। তিনি একথাও স্মরণ করিয়ে দেন, আমাদের যা প্রয়োজন তা হল মনোভাব, শব্দ নয়। এই দিল্লি কনভেনশনে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, পাকিস্তান একটি স্বতন্ত্র সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র হবে (‘‘A Sovereign Independent State’’)। সুতরং এই প্রস্তাবে সর্বপ্রথম States শব্দের পরিবর্তে State শব্দ যুক্ত করা হয়। প্রশ্ন হল : জিন্নার এই ব্যাখ্যা কি সঠিক বলে মেনে নেওয়া যায়? মুসলিম লিগের কার্যবিবরণী থেকে জিন্নার উক্তির সত্যতা প্রমাণিত হয় না। কারণ ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে মাদ্রাজে সারা ভারত মুসলিম লিগ অধিবেশনে পাকিস্তান প্রস্তাবকে মুসলিম লিগের মূল আদর্শরূপে ঘোষণা করে যে প্রস্তাব গৃহীত হয় তাতেও States শব্দ রেখে দেওয়া হয়। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে গান্ধি-জিন্না যে পত্রালাপ হয় তাতেও জিন্না States শব্দের কোনো ব্যাখ্যা দেননি এবং মুদ্রণ ত্রুটির জন্য যে এই States শব্দটি সংযোজিত হয়েছে তাও তিনি বলেননি।৩১ মনে হয়, জিন্না ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে এই বহুবচন শব্দ States নিয়ে বিতর্কের সময় এর গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। States শব্দের সূত্রধরে পাকিস্তানের কোনো অংশ যাতে ভবিষ্যতে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে না পারে সেদিকে লক্ষ রেখেই জিন্না এই কথা বলেন এবং দিল্লি কনভেনশনের প্রস্তাবে State শব্দটি যুক্ত করেন। এইভাবে মূল লাহোর প্রস্তাব সংশোধিত হয়। কিন্তু তাতেও বিতর্কের অবসান হয়নি। বাংলাদেশের মুসলিম লিগের একটি অংশ মূল লাহোর প্রস্তাবকেই গ্রহণযোগ্য মনে করেন। যেহেতু বাংলাদেশে জিন্নাপন্থীরা শক্তিশালী ছিলেন সেজন্য তাঁরা দিল্লি কনভেনশনের প্রস্তাবকেই আঁকড়ে থাকেন। লাহোর প্রস্তাবের অন্য কোনো ভাষ্য তাঁরা গ্রহণ করেননি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট ভারতের গভর্নর জেনারেল যে দশটি নির্দেশনামা (Ten Orders) প্রচার করেন তার একটিতে পাকিস্তানকে ‘ফেডারেশন’ রূপে উল্লেখ করা হয়।৩২ তাহলেও দেশ ভাগের পরে মূল লাহোর প্রস্তাব ও তার সংশোধন নিয়ে নতুন করে বিতর্ক ও জটিলতা শুরু হয়। এই লাহোর প্রস্তাবকে ভিত্তি করেই পাকিস্তানের কয়েকটি রাজনৈতিক দল পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করে। আওয়ামি লিগের ছয় দফা কর্মসূচি ও ঘোষণাপত্রে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আওয়ামি লিগের নেতা শেখ মুজিবর রহমান ছয় দফা কর্মসূচি ব্যাখ্যা করে বলেন:

ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করত: পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশনরূপে গড়িতে হইবে। তাতে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার থাকিবে। সকল নির্বাচন সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হইবে। আইনসভা সমূহের সার্বভৌমত্ব থাকিবে। ইহাতে আপত্তির কী আছে? লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তানের জনগণের নিকট কায়েদে-আজমসহ সকল নেতার দেওয়া নির্বাচনী ওয়াদা। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচন এই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই হইয়াছিল। মুসলিম বাংলার জনগণ একবাক্যে পাকিস্তানের বাক্সে ভোট দিয়াছিলেন এই প্রস্তাবের দরুণই। ১৯৫৪ সনের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার মুসলিম আসনের শতকরা সাড়ে ৯৭টি যে একুশ দফার পক্ষে আসিয়াছিল লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার দাবি ছিল তার অন্যতম প্রধান দাবি। মুসলিম লিগ তখন কেন্দ্রের ও প্রদেশের সরকারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। সরকারি সমস্ত শক্তি ও ক্ষমতা লইয়া তাঁরা এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধতা করিয়াছিলেন। এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলে ইসলাম বিপন্ন ও পাকিস্তান ধবংস হইবে, এসব যুক্তি তখনও দেওয়া হইয়াছিল। তথাপি পূর্ব বাংলার ভোটাররা এই প্রস্তাবসহ একুশ দফার পক্ষে ভোট দিয়াছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পক্ষের কথা বলিতে গেলে এই প্রশ্ন চূড়ান্তভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে মীমাংসিত হইয়া গিয়াছে। কাজেই আজ লাহোর প্রস্তাব ভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনার দাবি করিয়া আমি কোনো নতুন দাবি তুলি নাই ; পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পুরোনো দাবিরই পুনরুল্লেখ করিয়াছি মাত্র। তথাপি লাহোর প্রস্তাবের নাম শুনিলেই যাঁরা আঁতকিয়া উঠেন, তাঁরা হয় পাকিস্তান-সংগ্রামে শরিক ছিলেন না, অথবা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি-দাওয়ার বিরোধিতা ও কায়েমি স্বার্থের দালালি করিয়া পাকিস্তানের অনিষ্ট সাধন করিতে চান।৩৩

আওয়ামি লিগের ঘোষণাপত্রে বলা হয়: ‘Pakistan shall be a Federation granting full autonomy on the basis of the six-point formula to each of the federating units.’৩৪ সুতরাং, আওয়ামি লিগের মতে, পাকিস্তান স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলসমূহ নিয়ে একটি ফেডারেল ধরণের রাষ্ট্র হবে।

ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টির নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানিও লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবি করেন। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেশের সমস্যা ও সমাধান নামক পুস্তিকায় লেখেন:

ঐক্য ও সংহতির নামে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উড়াইয়া দিলেও ইহার বাস্তব সত্যতার গুরুত্ব কিছুতেই লাঘব হইবে না। ভারতের দশ কোটি মুসলমান পাকিস্তান হাসিলের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময়ই মুক্ত মন (খোলা দেল) লইয়া কায়েদে আজমের নেতৃত্বে বিশেষভাবে আলোচনা-পর্যালোচনা করিয়াই ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে লাহোর সম্মেলনে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে একবাক্যে গ্রহণ করে। বাস্তব সত্যকে ধামাচাপা দিয়া যতই প্রচার করা হউক-না-কেন, তাহার দ্বারা পাকিস্তানের অখণ্ডতা বা ঐক্য গড়িয়া তোলা সম্ভব হইবে না। একমাত্র পাকিস্তানের মূল ভিত্তি লাহোর প্রস্তাব কার্যকারী করিলেই দশ কোটি মুসলমানের দাবি স্বীকৃতি পাইবে এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবি পূরণ হইলে আল্লার মর্জি পাকিস্তানের ঐক্য, সংহতি ও সার্বভৌমত্ব চিরস্থায়ীরূপে বজায় থাকিবে।৩৫

১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা ভাসানি যে পাঁচ দফা কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেন তাতে ‘পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের’ দাবি সন্নিবেশিত করা হয়। তিনি একটি পুস্তিকাতে লেখেন:

ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের (পাকিস্তান প্রস্তাব) ভিত্তিতে পূর্ব আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য আপোষহীন সংগ্রামের মধ্যেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার পর্র্ব্ব্যত প্রমাণ অর্থনৈতিক বৈষম্য, আঞ্চলিক এবং সর্বপ্রকার বৈষম্যমূলক আচরণ হইতে, সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত, ধনতান্ত্রিক শোষণ ষড়যন্ত্র হইতে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি তথা সারা পাকিস্তানের দশ কোটি মানুষের সত্যিকারের মুক্তি নিহিত রহিয়াছে।৩৬

পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্যান্য বামপন্থী দলগুলিও পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার দুই নম্বর আসামি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ‘লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি’ নামে একটি দল গঠন করেন। তিনি ছিলেন এর সভাপতি। এই কমিটির উদ্দেশ্য ছিল, মূল লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের জন্য রাজনৈতিক অধিকার অর্জন করা।৩৭

.

তথ্যসূত্র

Pirzada, S.S., The Pakistan Resolution and the Historic Lahore Session, Karachi, 1968, pp. 17-18.

Presidential Address delivered by Jinnah at the All India Muslim League, Lahore Session, March 1940. Vide Ahmed, Jamil-ud-din (Collected and edited), Speeches and writings of Mr. Jinnah, 6th edition, Lahore, March 1960, vol. I (1935-1944), pp 143-163.

Ibid.

Ibid.

Time and Tide, 13 February, 1940.

Ibid.

Mitra, N.N., The Indian Annual Register, Calcutta, 1940, vol. I, PP. 305–306.

Ibid p. 311.

Resolution on Pakistan, File No. F. 163/40–R. A big file on this subject is preserved in the National Archives of India, New Delhi.

১০ Ibid.

১১ Ibid.

১২ Ibid.

১৩ Ibid.

১৪ Ibid. পরিশিষ্ট ‘খ’ দ্রষ্টব্য—মূল প্রস্তাবটি দেওয়া হল।

১৫ Ibid ; vide also Mitra, Register, 1940, I, p. 312.

১৬ Ibid ; Ibid.

১৭ Presidential Address delivered by Maulana Abul Kalam Azad at the All India National Congress, Ramgarh Session, March 1940 vide Mitra, Register, 1940, I, pp. 286–300.

১৮ Ibid.

১৯ Ibid.

২০ Ibid.

২১ Ibid.

২২ Ibid.

২৩ Ibid.

২৪ Ibid. pp. 312–313 ; File No. F. 163/40–R.

২৫ Ibid ; Ibid.

২৬ Ibid ; Ibid.

২৭ Ibid, p. 313 ; Ibid.

২৮ Ibid, p. 314.

২৯ Ambedkar, Dr. B. R., Pakistan or The Partition of India, Bombay, Third Edition, 1946, PP. 4–5.

৩০ Coupland, R., The Constitutional Problem in India, Part II, Oxford, 1945, P. 206.

৩১ Khaliquzzaman, C., Pathway to Pakistan, Lahore, 1961, P. 344 ; Ispahani, A.H., Qaid-i-Azam Jinnah As I knew him, Karachi, 1966, P. 159 ; Pirzada, Pakistan Resolution, PP. 20–26.

৩২ Statesman, 19 August, 1947.

৩৩ Rahman, Sheikh Mujibur, Awami Leaguer Chai Dhafa Karmasuchi O Tar Byakhya, Reprinted in Calcutta, 1971, PP. 3–4.

৩৪ ‘The Challenge’, A Manifesto Published by the Awami League, Reprinted in the Nabajatak, Edited by Maiteryi Devi, Bangla Desh Sankhya, Saptam Barsha, Pancham Sankhya, 1377, PP. 223–244 ; Vide also Bangla Desh Documents, Published by the Government of India, New Delhi, 1971, PP. 166.

৩৫ Bhasani, Maulana Abdul Hamid Khan, Desher Samasya O Samadhan, Dacca, 1962, P. 35.

৩৬ Bhasani, Maulana Abdul Hamid Khan, Ekmatra Samajtantra Kaemer Madhyame Desher Sakal Samasyar Susthu Samadhan Sambhab, Ghosanapatra 1, Dacca, 1964, PP. 4–5.

৩৭ Lahore Prastab Bastabayan Committee  : Ki O Kena? Published by Prachar Sampadak, Dacca, 1970, PP. 1–30.

লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, তার নামকরণ করেন ‘বাংলাতন্ত্র’। এই বাংলাতন্ত্রের নীতি অনুযায়ী দেশে কোনো জমিদার ও বৃহৎ পুঁজিপতি থাকবে না। এক লক্ষ টাকার মালিক এমন পুঁজিপতির অস্তিত্ব স্বীকার করা হবে। কলকারখানায় শ্রমিকের কর্তৃত্ব থাকবে। কৃষকদের মধ্যে জমি বন্টন করা হবে। মোয়াজ্জেম হোসেন সশস্ত্র সংগ্রামের মারফত এই পরিকল্পনা কার্যকরী করার পক্ষপাতী ছিলেন। এই উদ্দেশ্যসাধনে তিনি গোপনে ছাত্র-যুবকদের প্রস্তুত করেন। পাক সেনাবাহিনী সবসময় তাঁর উপর কড়া নজর রাখে এবং অনেকবার তাঁকে ডেকে নিয়ে গিয়ে সাবধান করে দেয়। লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটির সম্পাদক ছিলেন করপোরাল সামাদ এবং সহ-সভাপতি ছিলেন সুবেদার তাজুল ইসলাম। এঁরা দুজনেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হওয়ার পর ২৬ মার্চ (১৯৭১ খ্রি.) সকালে পাক সেনাবাহিনী মোয়াজ্জেম হোসেনের ঢাকার বাড়ি ৩৬নং এলিফ্যান্ট রোডে ঢুকে তাঁকে হত্যা করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *