৫. গগনের গলার স্বর

২১.

গগন অনেকক্ষণ হল চলে গেছে। যাবার আগে সুরেশ্বরকে কী যে বলেছিল সুরেশ্বর খেয়াল করে শোনেনি। গগনের গলার স্বর থেকে মনে হয়েছিল তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে; ক্রুদ্ধ, বিরক্ত হয়ে সে চলে গেছে। গগন আশা করেছিল সুরেশ্বর আরও কিছু বলবে, আশায় আশায় সে অপেক্ষা করেছে। সুরেশ্বর কিছু বলেনি। অস্পষ্ট, অসংলগ্ন দু-একটা মামুলি কথা যে যথেষ্ট নয়, এমনকী কোনও কৈফিয়তও নয়– গগন সম্ভবত সুরেশ্বরকে সেই কথাটা উচ্চস্বরে জানিয়ে চলে গেছে।

গগন চলে যাবার পর সুরেশ্বরও আরও কিছু সময় একই ভাবে বসে থাকল। গগনের শূন্য আসন, গগনের রেখে যাওয়া চায়ের কাপ তার চোখে পড়ছিল; অথচ গগনের কথা সে ভাবছিল না। গগন অসন্তুষ্ট হয়েছে একথা বুঝেও যেন সে চঞ্চল নয়।

পৌষের রাত যে কতটা হয়েছে সুরেশ্বরের খেয়াল ছিল না। ভরতুর বদলে অন্য কে যেন ঘরে এসে রাতের খাবার রেখে গেল। সুরেশ্বর অন্যমনস্কভাবে লক্ষ করল, গগনের টেনে আনা চেয়ার পাশের ঘরে রেখে, চায়ের কাপ ধুয়ে মুছে লোকটা চলে গেছে।

শেষ পর্যন্ত সুরেশ্বর উঠল। বাইরের ঘরে দরজা ভেজানো, বাতি জ্বলছে, টেবিলে এলোমেলো কাগজপত্র। দরজা বন্ধ করল সুরেশ্বর; খোলা জানলা দিয়ে কনকনে ঠাণ্ডা ঢুকছে, জানলাটাও বন্ধ করল। কাগজপত্র গুছিয়ে, বাতি নিবিয়ে ভেতরের বারান্দায় এল। বারান্দার একপাশে ছোট কলঘর, জলে হাত দেওয়া যায় না। চোখ মুখ ধুয়ে সামান্য আরাম পাওয়া গেল, গলাটা কেন যেন জ্বালা করছে।

শোবার ঘরে ফিরে এসে সুরেশ্বরের মনে হল, গগন যেন একবার তাকে কী একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিল। কী কথা? কথাটা মনে করতে পারল না সুরেশ্বর, তবে অনুমান করল গগন তার কথায় সন্দেহ প্রকাশ করে তার স্বার্থপরতা সম্পর্কে কোনও একটা কটু মন্তব্য করেছিল।

টাইমপিস ঘড়িটাতে রাত দশটা বেজে গেছে। অন্যদিন এসময় তার খাওয়া-দাওয়া হয়ে যায়। আজ কেন যেন আর খেতে ইচ্ছে করছিল না। দুধটুকু সুরেশ্বর খেয়ে নিল।

ঘরের জানলা ভেজিয়ে সুরেশ্বর তার বিছানার মশারিটা টাঙিয়ে ফেলল। গগন কি রাগ করে কলকাতায় ফিরে যাবে? কথাটা হঠাৎ মনে হল সুরেশ্বরের। পরক্ষণেই আবার মনে হল, হেমও কি হঠাৎ গগনের সঙ্গে চলে যাবে?

লণ্ঠনটা নিবিয়ে দেবার আগে সুরেশ্বর তার টর্চটা খুঁজে নিল, নিয়ে বাতি নিবিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল।

ঘন অন্ধকারের মধ্যে কিছুক্ষণ চোখের পাতা বন্ধ করে থেকে সুরেশ্বর যেন নিজেকে শিথিল করে রাখল, স্রোতে গা ভাসানোর মতন তার মন ও চিন্তাকে যত্রতত্র ভেসে যেতে দিল। অথচ সামান্য পরেই সুরেশ্বর অনুভব করল কোনও স্থায়ী ক্ষতের বেদনার মতন তার মন ঘুরেফিরে সেই একই চিন্তার দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। চোখের পাতা খুলে অন্ধকারে তাকাল সুরেশ্বর, গভীর অন্ধকারে দৃষ্টি যেন আরও নিখুঁত হয়ে সেই একই বিষয়ের ছবিগুলি সাজিয়ে নিচ্ছে। গগনের সামনে যাকে স্পষ্ট করে দেখতে পায়নি সুরেশ্বর, যে অত্যন্ত ধূসর হয়েছিল, অতি ম্লান, এখন সে অতি স্পষ্ট। মনে হল, নির্মলা তখন এমন কোনও স্থানে ছিল যেখানে অন্যের উপস্থিতির জন্যে তাকে স্পষ্ট করে দেখা যায়নি, এখন দেখা যাচ্ছে।

সুরেশ্বর অপলকে, নিশ্বাস প্রশ্বাস স্তব্ধ করে নির্মলাকে যেন দেখল। নির্মলার সেই শীর্ণ, নিবন্ত প্রদীপের শিখার মতন অনুজ্জ্বল, বিষণ্ণ মূর্তিটি বুঝি সুরেশ্বেরের দিকে কেমন এক স্তিমিত আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল।

সুরেশ্বর অপেক্ষা করল। নির্মলা ক্ষীণদৃষ্টি ছিল; সে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে আসতে পারত না; পা ফেলে ফেলে চারপাশে দেখে অত্যন্ত ধীরে ধীরে আসত। আজ, এই মুহূর্তেও সুরেশ্বর যেন নির্মলাকে তার অভ্যাসমতন কাছে আসতে দিল।

নির্মলা কাছে এলে সুরেশ্বর তার মুখটি আর নিবিষ্ট চোখ লক্ষ করল; ওই মুখে এমন কিছু ছিল যা রূপ নয় অথচ যার আকর্ষণ রূপের অধিক। নির্মলাকে এখন এত স্পষ্ট ও একান্ত করে দেখতে পেয়ে সুরেশ্বর খুব খুশি হল।

নির্মলার সঙ্গে সুরেশ্বরের পরিচয়ের মধ্যে একটা আকস্মিকতা ছিল। সুরেশ্বর এখনও সেই পার্কের কৃষ্ণচূড়ার গাছটি যেন দেখতে পায়, যার তলায় কালবৈশাখীর ভয়ংকর ঝড়ের মধ্যে নির্মলা দাঁড়িয়ে ছিল।

তখন বৈশাখ, কলকাতা শহরের গাছপালা মাটি পথ যেন কয়েক দিন ধরে পুড়ে যাচ্ছিল; সারাদিন গুমট, কোথাও একটু বাতাস বয় না, গাছের পাতা নড়ে না। সেই দুঃসহ গ্রীষ্মে একদিন বিকেলের পর সুরেশ্বর পার্কে এসে বসে ছিল। আশেপাশে অজস্র মানুষ, বাতাসের আশায় পার্কে এসেছে, বসে আছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাবুগাছের পাতাগুলি নিশ্চল, বেড়া দেওয়া কলাফুলের ঝোপে একটিও ফুল নেই, আকাশ যেন সারাদিন পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে মাথার ওপর ভস্মতূপের মতন পড়ে আছে।

সুরেশ্বর মাটিতে মরা ঘাসের ওপর চুপচাপ বসে ছিল। গরমে তার নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। হঠাৎ তার মনে হল, চারপাশে কেমন অদ্ভুত একটা থমথমে ভাব হয়ে এসেছে, সমস্ত বিশ্বচরাচর যেন এই সন্ধ্যার মুহূর্তে হঠাৎ কেমন অচেতন হয়ে গেছে, গাছপাতা কাঁপছে না, ধুলো উড়ছে না, পাখিদের স্বর স্তব্ধ, শূন্যতার মধ্যে শুধু অদ্ভুত এক শোষণ চলেছে, সমস্ত অবশিষ্ট আর্দ্রতাও শুষে নিচ্ছে। সুরেশ্বরের চোখ কান জ্বালা করছিল। গায়ের চামড়াও যেন কীসের আঁচ লেগে পুড়ে যাচ্ছে। …হঠাৎ, সন্ধের ঠিক মুখে একরাশ ধুলো উড়ে গেল। কেউ খেয়াল করেনি আকাশের এক কোণ ইতিমধ্যে সেজে উঠেছে। ধুলোর ঝাঁপটা থেমে যাবার পর পরই গাছের মাথায় পাতাগুলো কাঁপতে লাগল। বাতাস এল কয়েক ঝলক। তার পরই হু হু করে আকাশ ভাসিয়ে কালো মেঘ আসতে লাগল, অন্ধকার হল, ধুলোর ঝড় এল ঝাঁপটা মেরে। লোকজন ততক্ষণে পার্ক থেকে পালাচ্ছে। সুরেশ্বর উঠল না, আরও একটু অপেক্ষা করে যাবে। আসন্ন ঝড়টুকু গায়ে সামান্য মেখে নিতে তার আপত্তি নেই।

দেখতে দেখতে কালবৈশাখীর ঝড় এসে গেল। সাবুগাছের পাতার কুঁটি টেনে শনশন বাতাস বইছে, ধুলো উড়ছে, বৃষ্টির ফোঁটা পড়ল। পার্ক তখন শূন্য। সুরেশ্বর কোনও রকমে চোখ বাঁচিয়ে চলে যেতে যেতে হঠাৎ দেখল পার্কের ফটকের কাছে কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায় একটি যুবতী মেয়ে দুহাতে চোখ মুখ আড়াল করে কোনও রকমে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে। চলে যেতে যেতেও সুরেশ্বর কেমন থমকে দাঁড়াল। তার মনে হল, মেয়েটি এত দুর্বল যে এই ঝড়ে পা বাড়াতে সাহস করছে না।

বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা পড়তে শুরু করেছিল, তপ্ত শুষ্ক মাটি থেকে গরম ভাপ উঠছে, মাটির গন্ধ, গাছের ডাল বুঝি ভেঙে পড়বে। পার্কের দু-চারটি বাতি জ্বলতে জ্বলতে নিবে যাবার অবস্থা, আকাশে বিজলী।

সুরেশ্বর কৃষ্ণচূড়া গাছের কাছে এসে মেয়েটিকে সাবধান করে দিয়ে কী যেন বলতে গিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।

নির্মলা ভেবেছিল তার দাদা প্রমথ এসেছে।

প্রমথ যতক্ষণে পার্কে এল ততক্ষণে সুরেশ্বর নির্মলাকে নিয়ে পার্কের উলটো দিকে এক ডাইংক্লিনিংয়ের দোকানের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

বৃষ্টির মধ্যেই প্রমথকে পার্কে ঢুকতে দেখে বোঝা গিয়েছিল মানুষটা বিভ্রান্ত ও উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে এসেছে। নির্মলা বলেছিল : দাদা আসবে। অনেক কষ্টে প্রমথকে ডেকে নিতে হয়েছিল দোকানে।

ঝড়বৃষ্টি থেমে গেলে রিকশা করে যেতে যেতে পরিচয় হল। নির্মলা সামনের রিকশায়, পেছনে প্রমথ আর সুরেশ্বর।

প্রমথ বলল, ও চোখে খুব কম দেখে। আমার ভীষণ ভয় হয়ে গিয়েছিল।

সুরেশ্বর বলল, বলছিলেন বটে চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না।

কী করে বুঝব, হঠাৎ এরকম কালবোশেখী উঠবে। …আমারই ভুল হয়েছিল ওকে এভাবে রেখে দিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি।

কোথায় গিয়েছিলেন?

বেশি দূরে নয়। ওর চশমার ডাঁটি খুলে গিয়েছিল, সারিয়ে আনতে গিয়েছিলাম।

 উনি তাই বলছিলেন।

বিকেলে ওকে একেটু বেড়াতে নিয়ে এসেছিলাম। যা গরম, সঙ্গে করে না আনলে হয় না, বুঝলেন না…। তবু রক্ষে ও একলা পার্ক থেকে চলে যাবার চেষ্টা করেনি করলে নির্ঘাত গাড়ি চাপা পড়ত।

সুরেশ্বর কৌতূহল বোধ করলেও নির্মলার দৃষ্টিক্ষীণতার কথা তখন কিছু জিজ্ঞেস করেনি।

প্রমথ নিজের থেকেই বলছিল, ঝড় উঠেছে প্রথমটায় আমি বুঝতেই পারিনি। দোকানটাও আবার সেই রকম, অন্দরমহলে প্রায়, ভেতরে বাড়ির মধ্যে ছিলাম, কিছু দেখাও যায় না, বোঝাও যায় না, তারপর যখন বুঝলাম, ছুটতে ছুটতে আসছি। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, মশাই। …আপনার নামটা যেন কী?

সুরেশ্বর নাম বলল।

প্রমথ তার পরিচয় দিল। যৎসামান্য পরিচয়। বেসরকারি কলেজে পড়ায়, থাকে কাছাকাছি এক ভাড়াটে বাড়িতে। গলির মধ্যে। বিপত্নীক, সংসারে আত্মীয়-পরিজন বলতে এই বোন।

জল ঠেলে গলির মধ্যে রিকশা ঢুকল। বাতি জ্বলছে কি জ্বলছে না। চারপাশ চাপা, আকাশে তখনও মেঘ ডাকছে, দুঃসহ গরমটা বৃষ্টির জলে যেন ধুয়ে গেছে।

ঘরে এনে বসাল প্রমথ। সুরেশ্বর রিকশায় ওঠার সময় প্রথম যা আপত্তি জানিয়েছিল তারপর আর আপত্তি জানায়নি। ঠিক যে কী হয়েছিল সুরেশ্বর জানে না, কিন্তু কোনও অদ্ভুত আকর্ষণবশে অথবা কৌতূহলে সে প্রমথদের সঙ্গে চলে এসেছিল। এই আকর্ষণ কীসের, অথবা তার কৌতূহল কতটা যুক্তিযুক্ত সে কথা তখন ভাবেনি।

আকস্মিকভাবে যা ঘটেছিল সাধারণভাবে তা শেষ হতে পারত। পার্কের উলটোদিকের সেই লন্ড্রিতে দাঁড়িয়ে, কিংবা রাস্তায় নেমে, এমনকী রিকশাতে যেতে যেতেও সৌজন্য ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রমথ এই তুচ্ছ ঘটনার সমাপ্তি ঘটাতে পারত। ঘটালে তাকে দোষ দেওয়ার কিছু থাকত না। কিন্তু প্রমথ তা দেয়নি। সদালাপী, সরল মানুষ ছিল প্রমথ, তার চরিত্রে সুহৃদজনোচিত আন্তরিকতা ছিল। বয়সে সুরেশ্বরের চেয়ে কিছু বড় হলেও প্রমথ চরিত্রমাধুর্যে সুরেশ্বরকে বন্ধুর তুল্য করে নিয়েছিল। কিন্তু উভয়পক্ষের পরিচয় ক্রমশ যে ঘনিষ্ঠতায় দাঁড়ায় তার মূলে সম্ভবত নির্মলার আকর্ষণই ছিল প্রধান।

জীবনের কিছু সরল সাধারণ নিয়ম অনুসারে নির্মলা কোনও যুবকের আকর্ষণের বস্তু হতে পারে না। নির্মলার বাহ্য কোনও রূপ ছিল না। তার গায়ের রং ময়লা, শরীর শীর্ণ লতার মতন ক্ষীণ, সে দুর্বল ও শিশুর মতন অসহায় ছিল। শাঁখের মতন লম্বা মুখ, দীর্ঘ কপাল, সরু চিবুকে রূপের এমন কিছু কারুকার্য ছিল না যা দৃষ্টিকে নিষ্পলক করতে পারে। নির্মলা পুরু কাচের চশমা পরত, চশমার তলায় তার চোখের পাতা মোটা দেখাত, মনে হত চোখ বুজে আছে। ওর চোখের মণির রং ছিল ধূসর, নির্মলা প্রায় সব সময়ই আনত-চোখে তাকাত, যেন এই আলো বড় প্রখর, তার চোখে সহ্য হচ্ছে না।

নির্মলার রূপ ছিল না, কিন্তু আশ্চর্য এক সৌন্দর্য ছিল। এই সৌন্দর্য তার শরীরে নয় এটা বোঝা যেত, কিন্তু বোঝা যেত না ঠিক কোথায় এই সৌন্দর্য আছে। কৃষ্ণপক্ষের দুর্বল চাঁদের আলোর মতন একটি আভা যেন তার ময়লা গায়ের রঙে মেশানো থাকত, এবং কখনও কখনও মনে হত, এই আভা বুঝি কোনও নিভৃত স্থান থেকে উৎসারিত হচ্ছে। নির্মলার শঙ্খসদৃশ মুখ কখনও কখনও এমন একটি বেদনা সঞ্চার করত যা হৃদয়ের কোনও অজ্ঞাত স্থানে অনুভব করা যেত, অথচ তাকে ব্যক্ত করা যেত না। সুরেশ্বর অনেক দিন বোঝেনি নির্মলার প্রতি তার আকর্ষণ কেন। পরেও যে বুঝেছিল তা নয়–তবু একটা ধারণা হয়েছিল। তার মনে হয়েছিল, নির্মলা কখনও তার অদৃষ্টের কথা বলত সহিষ্ণুতার, এ সংসারে মানুষের যে নির্দিষ্ট নিয়তি–সেই বেদনাদায়ক স্থির পরিণতির জন্যে সে অপেক্ষা করে আছে, অথচ তার আচরণে ক্ষিপ্ততা অথবা ভীতি নেই; নির্মলা কখনও তার অদৃষ্টের কথা বলত না। সুরেশ্বরের কেন যেন মনে হত, নির্মলার পক্ষে এতটা সহিষ্ণুতা অনুচিত।

প্রমথ বলেছিল, নির্মলা ক্রমশ অন্ধ হয়ে আসছে, শেষ পর্যন্ত অন্ধ হয়ে যাবে।

ঠিক কী কারণে নির্মলার চক্ষুরোগ দেখা দিয়েছিল–এ কথা কেউ বলতে পারেনি। নানা মুনির নানা মত ছিল। শিশুকাল থেকেই নির্মলার চোখে কষ্ট ছিল, বয়স বাড়ার পর সেটা ব্যাধি হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম প্রথম সাধারণ চিকিৎসা ও চশমা পরিয়ে ব্যাধিটাকে আটকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। পরে আরও নানা রকম চিকিৎসা হয়েছে, প্রমথ সাধ্যাতীত চেষ্টা করেছে, কিন্তু এই ব্যাধির কোনও প্রতিকার হয়নি। এখন প্রমথ নিরুপায়, শুধু অক্ষমের মতন অপেক্ষা করে আছে। বস্তুত তার কিছু করার ছিল না, এক শুধু বোনকে আগলে আগলে রাখা ছাড়া, আর ছুটিছাটায় নির্মলাকে সঙ্গে করে বাইরে বেড়াতে যাওয়া ছাড়া। প্রমথ প্রায় প্রত্যেকটি ছুটিতে নির্মলাকে সঙ্গে করে বেড়াতে বেরুত। কে যেন তাকে বলেছিল, বাইরের খোলামেলা আকাশ বাতাসে নির্মলা সাময়িক একটা উপকার পেতে পারে। উপদেশটা প্রায় সংস্কারের মতন প্রমথকে ভর করেছিল। ছুটি পেলেই সে নির্মলাকে নিয়ে বাইরে ছুটতে চাইত। নির্মলা বাইরে যেতে ভালবাসত, তবে দাদার বাড়াবাড়ি তার শরীরে সইত না। প্রমথর ইচ্ছে ছিল, সে কলকাতা ছেড়ে বাইরে কোথাও চলে যায় চাকরি নিয়ে, নির্মলার পক্ষে সেটা উপকারের হবে; কিন্তু তার ভয় ছিল বাইরে হঠাৎ কোনও গণ্ডগোল ঘটলে নির্মলার চিকিৎসা সম্ভব হবে না, বরং কলকাতায় সেটা সম্ভব; কলকাতায় তাদের পুরনো ডাক্তার ছিল। প্রমথ এই দোটানায় পড়ে মতিস্থির করতে পারত না।

সুরেশ্বর এ সময় প্রমথদের সঙ্গে বাইরে যেতে শুরু করেছিল। কখনও কখনও এমনও হয়েছে, সুরেশ্বর প্রথমে যায়নি, ওরা চলে গেছে, তারপর কয়েক দিন যেতেই সুরেশ্বর ওদের কাছে এসে পড়েছে। নির্মলার ওপর সুরেশ্বরের যে দুর্বলতা জন্মে গিয়েছিল তা ভালবাসা কি না স্পষ্ট করে বলা মুশকিল। হয়তো ভালবাসা, হয়তো এমন কোনও অনুরাগ যা ব্যাখ্যা করে বলা যায় না।

নির্মলা জানত, তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে, অবশেষে সে অন্ধ হয়ে যাবে। এ নিয়ে তার যেন আর কোনও উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা ছিল না। সুরেশ্বর ঠিক এভাবে নির্দিষ্ট ও অবশ্যম্ভাবী পরিণতি মেনে নিতে পারত না। সে অস্থির ও কাতর হত, ক্ষোভ প্রকাশ করত প্রমথর কাছে।

একবার, রাঁচির দিকে বেড়াতে এসে হঠাৎ কী যেন হয়ে গেল নির্মলার। ডান দিকের চোখে দুদিন প্রায় কিছু দেখতে পেল না। তৃতীয় দিনে নির্মলার পক্ষে স্বাভাবিক দৃষ্টি ক্রমে ফিরে আসতে লাগল। প্রমথ বিচলিত হয়ে পড়েছিল, সুরেশ্বর আরও বেশি বিচলিত, শঙ্কিত। সে চেয়েছিল কলকাতায় ফিরে যেতে। নির্মলা রাজি হয়নি।

কয়েক দিনের মধ্যে মোটামুটি সুস্থ হয়ে ওঠার পর নির্মলা একদিন বলল : তুমি নাকি বলছ, কলকাতায় গিয়ে চোখটা অপারেশন করিয়ে নিতে?

সেই রকমই তো শুনেছিলাম, প্রমথ বলে–কোন ডাক্তার যেন বলেছেন অপারেশন করে একবার চেষ্টা করা যেতে পারে…

আগেও দুবার হয়েছে…কই কিছু তো হয়নি…

তবু…

তোমার খুব ভয়, না?

হ্যাঁ, চোখ চলে গেলে তোমার কী থাকবে?

আমার চোখ দুটোই কি আমি?

সুরেশ্বর অবাক হয়ে নির্মলার দিকে তাকিয়ে ছিল : কথাটা বুঝেও যেন বুঝছিল না।

নির্মলা ধীরে ধীরে বলল, আমার এই হাত দুটো, কিংবা শুধু এই মুখ, এই চোখ যদি আমি হই তবে সে আমি কিছু না। … তুমি সেই গল্পটা জানো না?

নির্মলা এক রাজা আর সন্ন্যাসীর গল্প বলেছিল, রাজা এসেছিলেন একা এক সন্ন্যাসীর আশ্রমে মৃগয়াক্লান্ত হয়ে। সন্ন্যাসী যথোচিত রাজসম্মান প্রদর্শন করেননি, কেননা তিনি রাজাকে চিনতে পারেননি। এই অপরাধে রাজা সন্ন্যাসীকে রাজসভায় ডেকে পাঠালেন। সেই সভায় রাজা এবং সন্ন্যাসীর মধ্যে পরিচয় নিয়ে কূট তর্ক হল। সন্ন্যাসী বলেছিলেন : হে রাজন, যদি আপনার কর্তিত একটি বাহু পথে পড়ে থাকে কেউ কি সেই বাহুকে রাজন বলে সম্বোধন করবে? যদি আপনার বিচ্ছিন্ন পদযুগল নদীর জলে ভেসে যায় আপনার কোন প্রজা তাকে চিনে নিতে পারবে? আপনার রথের অশ্ব কি আপনি? আপনার রাজদণ্ড কি আপনি? সর্ব পরিচয়যুক্ত হলেই আপনার পরিচয়, অন্যথা আপনার কোনও পরিচয় নেই। আমার আশ্রমে আপনি রাজবেশে রাজরথে অমাত্যদল নিয়ে উপস্থিত হননি। আমার ভ্রম হয়েছিল। এই ভ্রম সত্য ও স্বাভাবিক।

গল্প বলা শেষ করে নির্মলা বলল, আমার চোখ দুটো চিরকাল থাকবে না। সুরেশ্বর কোথাও যেন পরাস্ত হয়েছিল, তবু বলল, চিরকাল কিছুই থাকে না। জানি। তবু আজীবন কিছু কি থাকে না?

কী থাকে?

 থাকে। তুমি ভেবে দেখো কী থাকে?

 একটা কথা বলবে?

কী কথা?

তোমার ভয় করে না? চোখ হারালে তোমার কতখানি যাবে তা ভেবে দুশ্চিন্তা হয় না?

নির্মলা মাথা নাড়ল, এক সময় হত। এখন বোধহয় সহ্য হয়ে গেছে। বলে সামান্য থেমে হাসির মুখ করে বলল, সংসারে কতশত অন্ধ আছে, বলো! তারাও তো রয়েছে।

তারাই তোমার ভরসা?

তোমরাও আমার ভরসা।

আমরা যদি না থাকি?

আমি তর্ক করতে জানি না। এত বড় জগতে কেউ না কেউ থাকবে।

ভগবান নাকি?

 ভগবানে আমার ভক্তি আছে। মানুষেও আমার বিশ্বাস আছে। …সেদিন পার্ক থেকে তুমি তো আমার হাত ধরে নিয়ে এসেছিলে। কেন এনেছিলে?

সুরেশ্বর কোনও জবাব দিতে পারেনি।

রাঁচির সেই সাময়িক দৃষ্টিহীনতাকে কাটিয়ে উঠলেও পরের বছর এক বসন্তের সন্ধ্যায় কী যেন ঘটে গেল।

.

২২.

পরের বছর যা ঘটল তার সঙ্গে রাঁচির ঘটনার সম্পর্ক হয়তো ছিল, কিন্তু বোঝা যায়নি। কলকাতায় ফিরে প্রমথ নির্মলাকে তাদের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি নির্মলার চোখে কোনও নতুন। উপসর্গ খুঁজে পাননি। রাঁচিতে যা ঘটেছিল তা এতই বিচিত্র ও সাময়িক যে তার কোনও চিহ্ন আর ছিল না।

প্রমথ নিশ্চিন্ত হল।

নির্মলা যেন সামান্য পরিহাস করেই সুরেশ্বরকে বলল, দেখলে…!

পরিহাসের কারণ অবশ্য ছিল। রাঁচিতে থাকতে সুরেশ্বরের কেমন একটা সদা-আতঙ্কের ভাব হয়েছিল। তার আচরণ দেখলে মনে হত, যে-কোনওদিন, যে-কোনও সময় নির্মলার চোখের শেষ দৃষ্টিশক্তিটুকু ফুরিয়ে যাবে এ দুশ্চিন্তায় সে শঙ্কিত হয়ে আছে। নির্মলা কাছে থাকলে সুরেশ্বর এমনভাবে তাকে লক্ষ করত, মনে হবে প্রতি মুহূর্তে সে নির্মলার নতুন কোনও অস্বাচ্ছন্দ্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করছে। নির্মলা পথে বেরুলে সুরেশ্বর তার পাশে পাশে ছায়ার মতো থাকত, মনে হত যেন কোনও পঙ্গু শিশুকে সে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি সকালে ঘুম থেকে উঠে যতক্ষণ না নির্মলার গলা শুনত ততক্ষণ আড়ষ্ট ও সন্ত্রস্ত হয়ে থাকত, ঘরের বাইরে আসত না।

রাঁচি থেকে কলকাতায় ফিরে সুরেশ্বরের এই সদাশঙ্কিত অবস্থাটা কাটল। অথচ তখনও তার আচরণে উদ্বেগ ভাবটা ছিল।

একদিন কি কথায় যেন নির্মলা বলল, তোমার মতন মানুষ আমি দেখিনি।

কেন?

দাদাকে কী বলেছ?

কী বলেছি।

ঘড়ির কাঁটা দেখতে আমার ভুল হয়।

সেদিন হয়েছিল।

না, কাঁটা দেখতে হয়নি; বলতে ভুল হয়েছিল। আমি অন্যমনস্ক ছিলাম।

 তবে আমারই ভুল। …

তোমার স্বভাবে আগে এসব ছিল না। আজকাল যেন কেমন অস্থির-অস্থির ভাব হয়েছে।

হয়েছে নাকি! … মানুষ বদলায়।

সুরেশ্বর হাসত। সুরেশ্বর যে বদলাচ্ছিল এটা হয়তো তারও জানা ছিল।

এই সময় সুরেশ্বর নিত্য অনুভব করতে শুরু করেছিল, নির্মলা তার কাছে এই আশ্চর্য আনন্দ ও অদ্ভুত বেদনার মিশ্রণ। এই আনন্দের কোনও নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা সে করতে পারত না। তার মনে হত, এ-আনন্দ অবারিত, স্ফুর্ত; সে ভেবে দেখতে, নির্মলা তার দেহ ও মন নিয়ে যতটুকু সীমিত, যদি সেটা তার স্থূল অস্তিত্ব হয়–তবে এই অস্তিত্বের বাইরেও নির্মলার এক আনন্দ-স্পর্শ আছে; যেমন জ্যোৎস্নালোকের থাকে। সুরেশ্বর একদা এই ধরনের এক স্বপ্নও দেখেছিল : দেখেছিল, সে যেন কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, আশেপাশে কোথাও নির্মলা নেই, তবু তার নির্মলার কথা মনে হচ্ছিল, এবং সে নির্মলাকে মনে মনে খুঁজছিল। হঠাৎ সে নিজের সর্বাঙ্গে জ্যোৎস্নালোক অনুভব করল, তার খেয়াল ছিল না যে জ্যোৎস্নার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ তুলে সুরেশ্বর চাঁদ দেখতে গেল, আড়ালে কোথাও বুঝি চাঁদ ছিল, দেখা গেল না। সহসা তার চারপাশে সে নির্মলার উপস্থিতি অনুভব করল, মনে হল নির্মলা কোনও অলৌকিক শক্তিবলে চাঁদের কিরণ হয়ে তার চতুর্দিকে বিরাজ করছে।

জীবনে এই ধরনের আনন্দের সঙ্গে সুরেশ্বরের পূর্বপরিচয় ছিল না। বাল্যাবধি সে যাদের মনে করতে পারে বাবা, মা, বিনুমাসি–কেউই তার কাছে আনন্দের মূর্তি নয়। বাবা তার কাছে সব সময়েই নিরানন্দ ও বিতৃষ্ণার–এমনকী করুণার পাত্র ছিল। মা ছিল দুঃখের মূর্তি; অবজ্ঞাত বলে মার মধ্যে অভিমানের বেদনা পুঞ্জীভূত হয়ে ছিল; মার কোথাও আনন্দ ছিল না, মা তাকে আনন্দ বিলোতে পারত না। মার মধ্যে একটা জলুস ছিল, এই জলুস মার অহঙ্কার। সুরেশ্বর আবাল্য আনন্দ দেখেনি, আনন্দ জানেনি–এই যেন প্রথম দেখছে নির্মলার মধ্যে।

হেমের কথা তার এ সময় খুব মনে হত। হেমের বাড়ি তার আসা-যাওয়াও ছিল। হেম বেশ সুন্দর হয়ে উঠেছিল, ডাক্তারি পড়ছিল। হেমের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথাও সুরেশ্বর চিন্তা করত। হেম যে মাত্র সে-দিনও তার কাম্য বস্তু ছিল, সুখ ছিল–এ কথা সে অস্বীকার করতে পারত না। হেমের প্রতি তার মমতা ও স্নেহ কোনও অংশে কমেনি। কিন্তু সুরেশ্বর হেমের মধ্যে কোনও গভীর আনন্দ খুঁজে পেত না। কিংবা বলা ভাল, নির্মলার মধ্যে যে আনন্দ পাওয়া যেত, হেমের মধ্যে তা ছিল না। কেন ছিল না, কেন সুরেশ্বর হেমের মধ্যে তার আনন্দ পেত না–সে জানে না।

এ সময় কলকাতায় থাকলেও সুরেশ্বর হেমদের বাড়ি আসা-যাওয়া ধীরে ধীরে কমিয়ে আনছিল। যেন তখন সে কোনও দ্বিধার মধ্যে পড়েছে। বুঝতে পারত না তার এই দ্বিধার যথার্থ কারণ কী? অথচ হেমের প্রতি তার মমতা বা স্নেহ হ্রাস পায়নি।

নির্মলার কাছে হেমের কথা মাঝে মাঝে গল্প করত সুরেশ্বর। হেমের অসুখ, তার হাসপাতালে থাকা, আরোগ্যলাভ, লেখাপড়া–এই সব গল্প। নির্মলা সহানুভূতির সঙ্গে শুনত, শুনতে শুনতে হেম যেন নির্মলার অতিপরিচিত হয়ে উঠেছিল।

সুরেশ্বর বলত, হেমকে একদিন এ বাড়ি নিয়ে আসবে। কিন্তু আনা হত না।

মাঝেমধ্যে নির্মলাই তাগাদা দিত, কই, হেমকে তো আনলে না?

 আনব। …পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত দেখি।

একদিন তো আনতে পার।

তা পারি।

আমার কী মনে হচ্ছে জানো–?

কী?

আনতে তোমার ইচ্ছে নেই।

না, ইচ্ছে নেই যে তা নয়, তবে……আনব একদিন…।

তুমি ভাবছ, আমি তাকে ভাল করে দেখতে পাব না? ঠিক পাব। নির্মলা যেন স্নিগ্ধ কৌতুক করল।

 সুরেশ্বর ভেবেচিন্তে আস্তে করে বলল : তুমি পাবে, হেম হয়তো পাবে না।

এমন করেই দিন কাটছিল। সুরেশ্বর সেবার পুজোর সময় দেশে যাবে ঠিক করল। অনেক দিন দেশবাড়ি যাওয়া হয়নি, ঘরদোরের অবস্থা কেমন হয়ে আছে কে জানে, দেশ থেকে হালদারমশাই চিঠি লেখেন, তাগাদা দেন যাবার জন্যে, যাওয়া হয়ে ওঠে না।

প্রমথকে বলল সুরেশ্বর, এবার পুজোর সময় আমাদের ওখানে চলো।

 চলো, ভালই হবে।

 চিঠি লিখে দিচ্ছি তা হলে!

দাও। তোমাদের বাড়িতে সাপখোপ আর সিঁড়ি বেশি নেই তো?

 সুরেশ্বর অবাক। কেন? হঠাৎ সাপখোপ আর সিঁড়ির দুশ্চিন্তা হল কেন?

সাপখোপে আমার ভীষণ ভয়– প্রমথ হাসতে হাসতে বলল, আর সিঁড়িওলা বাড়িতে নির্মলাকে নিয়ে থাকতে ভয় হয়।

সাপখোপের দুশ্চিন্তা সুরেশ্বরের হয়নি, কিন্তু সিঁড়ির দুশ্চিন্তা হয়েছিল। নির্মলার কথা ভেবে যাওয়ার ব্যবস্থাটা হয়তো সে বন্ধ করত, নির্মলা হতে দেয়নি।

পুজোর সময় দেশে গিয়ে সুন্দর লেগেছিল। অত বড় বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে, নীচের মহলে একটা প্রাইমারি স্কুল বসেছে, ঠাকুরদালান অব্যবহৃত, জঞ্জাল জড়ো হয়েছে অনেক। তবু হালদারমশাই যথাসাধ্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিয়েছিলেন। দোতলায় ওরা থাকত। পুবের জানলা খুললে নদীর চর আর আদিগন্ত মাঠ দেখা যেত। সেই আমবাগান আর ছিল না। রথতলার মাঠ তখনও ছিল।

নির্মলাকে ধরে ধরে ছাদে নিয়ে যেত সুরেশ্বর। ছাদের সিঁড়িটা বরাবরই কেমন ছোট ও অন্ধকার মতন ছিল। ছাদে এসে নির্মলা হাত ছাড়িয়ে নিত; ধীরে ধীরে পায়চারি করত, সকাল অথবা বিকেলের বাতাস তার খুব পছন্দ ছিল। নদীর চরে বেড়াতে নিয়ে যেত নির্মলাকে, মাঠের সবুজের দিকে তাকাতে বলত, আকাশের দিকে চোখ তুলে সাদা ভাসন্ত মেঘ দেখতে বলত। দৃষ্টিশক্তিকে যতদূর সম্ভব ছড়িয়ে দেবার জন্যে নির্মলার ব্যগ্রতা অপেক্ষা সুরেশ্বরের ব্যর্থতা ছিল বেশি। ক্ষণে ক্ষণে সে আঙুল তুলে কাছের কিছু দেখাত; ওটা কী গাছ বলো তো? বক দেখতে পাচ্ছ ওখানে, পাচ্ছ না? তোমার পায়ের কাছে ফড়িংটা ধরো…

নির্মলা এক একদিন বলত, তোমার ডাক্তারিতে আমি মরে যাব।

ডাক্তারি কোথায়! এসব তো চোখের পক্ষে ভাল।

মাঝে মাঝে আমি ভাবি, আমার চোখ দুটো যেন তোমার, নিজের চোখ নিয়েও মানুষ বোধহয় এত করে না…

সুরেশ্বর কোনও জবাব দিত না।

একদিন নির্মলা সন্ধেবেলায় ছাতে বসে কথা বলতে বলতে হঠাৎ বলল, আমি কতদিন তারা দেখি না, তারা দেখতে বড় ইচ্ছে করে…।

প্রমথ আপনমনে গান গাইছিল, গান থামিয়ে বলল, আজ তারা নেই। চাঁদের খুব আলো, কাল পূর্ণিমা। তার কথা থেকে যেন মনে হবে, আকাশে তারা নেই বলে নির্মলা দেখতে পাচ্ছে না, তারা থাকলেই দেখতে পেত।

এমন কিছু কথা নয়, তবু সুরেশ্বর কোথায় যেন এক বুকভাঙা বেদনা অনুভব করল। এত বড় বিশ্ব, মাথার ওপর অনন্ত আকাশ, এই চাঁদের আলো-সব যেন মলিন ও অর্থহীন মনে হল। সুরেশ্বর পরে বলল, নীচে যাওয়া যাক হিম পড়ছে যেন।

আনন্দের মতন নির্মলা সুরেশ্বরের কোনও বেদনারও উৎস ছিল। জীবনের নানা দুঃখের সঙ্গে সুরেশ্বরের বাল্যাবধি পরিচয়। তার বাবা, মা, বাবার উপপত্নী, বিনুমাসি, এমনকী হেম সংসারের কোনওনা-কোনও দুঃখের ছবি। এরা যে দুঃখী–তাতে সুরেশ্বরের সন্দেহ নেই। এদের দুঃখ সুরেশ্বর বোঝে। কিন্তু তার মনে হয় না, সেই সব দুঃখ আর নির্মলার মধ্যে যে বেদনার উৎস আছে তা এক।

মার দুঃখ যেন অত্যন্ত ব্যক্তিগত, অসাধারণ রূপ ছিল অথচ মা তার স্বামীর অনুরাগ ও সাহচর্য পায়নি, মা অবজ্ঞা পেয়েছে। এই দুঃখ মা পেত না যদি বাবা মার ওপর অনুরক্ত হতেন। আর সমস্ত দুঃখই একজনের বঞ্চনা থেকে এসেছে।

বাবা ঠিক দুঃখী নয়, হতভাগ্য। বাবার কোনও দুঃখবোধ ছিল না, বা বাবাকে দেখলে দুঃখ পাবার কারণও ছিল না। অনাচারী মানুষকে দেখলে যে ধরনের করুণা হতে পারে বাবাকে দেখলে বড় জোর সেই রকম করুণা হত।

এক সময় হেমকেও দুঃখী মনে হত সুরেশ্বরের : যখন হেম অসুস্থ, যখন হেম হাসপাতালের বিছানায় অসহায় হয়ে পড়ে ছিল। সেসময় হেমের বিবর্ণ খড়িমাটি ওঠা চেহারা, তার কোটরগত করুণ দুটি চোখ দেখলে সুরেশ্বর ব্যাকুল ও অভিভূত হত। এত অল্প বয়সে ভয়ংকর এক ব্যাধি তার জীবনীশক্তিকে তিলে তিলে শুষে নিচ্ছে–এই চিন্তা সুরেশ্বরকে কাতর ও পীড়িত করেছিল। তার মনে হয়েছিল : এ-ভাবে জীবনের অপচয় ঘটতে দেওয়া অর্থহীন। হেমকে নীরোগ করে তোলা তার কর্তব্য বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু হেমের অসুস্থতা, তার রোগশয্যা, অসহায় ও দুঃখ, সুরেশ্বরকে বৃহৎ কোনও বেদনার সঙ্গে পরিচিত করায়নি। তার কখনও মনে হয়নি, হেম সাংসারিক রোগশোকের ভোগ ছাড়া আর কিছু ভোগ করছে। তারপর হেম সুস্থ হয়ে গেল। তার আরোগ্যলাভের পর হেমের দুঃখের চেহারাটা ধুয়ে গেছে। এক সময় কিছু ময়লা পড়েছিল, এখন তা পরিষ্কার হয়ে স্বাভাবিক মানুষটি ফুটে উঠেছে এর বেশি কিছু হেমকে দেখে মনে হয় না।

নির্মলার মধ্যে যে-বেদনা তা যেন তার ব্যক্তিগত দুর্ভাগ্য নয়। সুরেশ্বর বুঝতে পারত না কিন্তু অনুভব করত, নির্মলা যেন মানুষের এমন একটি অবস্থাকে ইঙ্গিত করছে যার ওপর তার কোনও হাত নেই। আয়ত্তাতীত এই অদৃষ্ট, অথবা সেই পরিণতি যাকে রোধ করার ক্ষমতা মানুষের নেই–নির্মলা যেন সেই পরিণতির অসহায়তা প্রকাশ করছে। শেষাবধি মানবজীবন মৃত্যুর কাছে পরাজিত, ভাগ্যের কাছে তার সমস্ত উদ্যম মিথ্যা হয়ে যেতে পারে, এই মুহূর্তের সুখ পরমুহূর্তে বিষাদ হতে পারে। শৃঙ্খলাহীন, যুক্তিহীন, স্বৈরাচারী নির্মম কি যেন এক আছে। তার কাছে জীবনের সমস্ত কিছুই যেন আকস্মিক, অর্থহীন। দুঃখ বই জীবনে বস্তুত কিছু নেই, যন্ত্রণা ও ক্ষোভ বিনা মানব-ভাগ্যের অন্য পরিণতি নেই।

সুরেশ্বরের মনে ক্রমশ এক নৈরাশ্য দেখা দিতে শুরু করেছিল। নিরর্থক জীবনধারণ, অস্থায়ী এই সুখ, অকারণ এই আত্মরক্ষার কী যে প্রয়োজন সে বুঝে উঠতে পারত না। অথচ এই নৈরাশ্য সুরেশ্বরের স্বভাবজাত নয়। সে অদৃষ্টবাদী ছিল না। নির্মলার বেদনা তার মনে এই নৈরাশ্য কেমন করে সংক্রামিত করছিল সে জানে না, কিন্তু নির্মলার কোথাও নৈরাশ্য ছিল না। নির্মলার সহিষ্ণুতা, ধৈর্য এবং বিশ্বাস মাঝে মাঝে সুরেশ্বরকে এত বিচলিত করত যে সে ক্ষুব্ধ ও অপ্রসন্ন হত।

তুমি সব বুঝেও বোঝো না, নির্মলা বলত, আমাদের দুটো হাত, সবদিকে লড়াই করা যায়, যায় না।

তবে তো সংসারে আমরা খুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকতে পারি।

না, তা পারি না।

কেন? …

জানি না। সাধ্য আর অসাধ্য বলে দুটো কথা আছে। ..যা অসাধ্য তা না করতে পারলে আমার দুঃখ হয় না।

সুরেশ্বর যে এইসব সহজ কথাগুলো না বুঝত এমন নয়, বুঝেও কোনও মানসিক চাঞ্চল্যের জন্যে অকারণে ক্ষোভ প্রকাশ করত। সে বুঝতে পারত, এতকাল তার জীবনের যেদিকে গতি ছিল, এখন সেদিকে তার জীবন বইতে পারছে না। প্রকৃতপক্ষে সে অকর্মণ্য, অকারণ জীবন যাপন করে যাচ্ছিল। তার জীবনের প্রয়োজন অথবা অর্থ সম্পর্কে তার কোনও জিজ্ঞাসা ছিল না। কখনও আবেগ, কখনও অভ্যাসবশে, কখনও স্বাভাবিক দুর্বলতায় সে গা ভাসিয়েছে। কখনও স্বার্থ, কখনও অহঙ্কার, কখনও সামাজিক লোকলজ্জায় সে উদার হয়েছে। কিন্তু এর কিছুই তার অন্তরের নয়। জীবনের সঙ্গে তার সম্পর্ক যেন নিরপেক্ষ দর্শকের, সক্রিয়তার নয়।

মানসিক এই অশান্তি এবং চাঞ্চল্যের সময় সুরেশ্বর একদিন নির্মলার বিদায়পর্বটা নির্বোধ, অক্ষম পশুর মতন লক্ষ করল।

সেদিন দোল পূর্ণিমা, সারাদিন কলকাতার পথে রঙের ছড়াছড়ি গেছে, লাল বেগুনি নীলের ছোপ ধরা রাস্তা, বাতাসে ফাগের ডো উড়ছে, ছেলেমেয়েগুলোর মাথার চুল রুক্ষ, গালে-গলায় রঙের ছোপ, বাড়ির দেওয়ালে পানের পিচের মতন বিচিত্র রং সব ছিটোনো, বিকেলে চৈত্রের বাতাস বইতে শুরু করল, চাঁদ টলটল করে ফুটে উঠল আকাশে।

সুরেশ্বর হেমদের বাড়ি হয়ে প্রমথদের বাড়ি পৌঁছল যখন তখন সন্ধেরাত। প্রমথ ঘরে বসে তার কলেজের কজন বন্ধুর সঙ্গে হা হা করে গল্প করছে, ঘরের মধ্যে অট্টনোল।

নির্মলা বলল, এসো, তুমি বরং আমার ঘরে বসো; ওঁরা একটু পরেই চলে যাবেন।

সুরেশ্বর প্রমথকে মুখ দেখিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে বসল।

 নির্মলা দুধ-সাদা খোলের শাড়ি পরেছিল, পাড়টা ছিল কালোর ওপর মুগা করা। নির্মলা কোনও কালেই যত্ন করে চুল বাঁধত না, কোনও রকম খোঁপা জড়িয়ে নিত, সেদিন বুঝি মাথা ঘষে ছিল, রুক্ষ চুল তার পিঠময় ছড়ানো, শাড়ির আঁচলে চাপা দেওয়া।

সুরেশ্বর বলল, ব্যাপার কী, আজকের দিনে এরকম সাদা শাড়ি?

ব্যাপার আবার কী, পরেছি। কেন?

আজকে সাদা কিছু দেখলেই হাত কেমন করে…

 রং দেবে! দাও!

বরং আবির দিই একটু…।

আমি দেব, না তুমি এনেছ..

সুরেশ্বর হাসল, তুমিই দাও।

নির্মলা তার ঘরের কোন কোণ থেকে কাঠের পাউডার-কৌটোয় রাখা লাল আবির এনে দিল। আবিরের সঙ্গে গন্ধ মেশানো।

চশমাটা খোলো…সুরেশ্বর বলল।

 মুখে দেবে নাকি? না না

কপালে দেব; চশমার কাছে পড়তে পারে। …

নির্মলা চশমা খুলে হাতে রাখল।

সুরেশ্বর আবিরের একটি ছোট টিপ পরিয়ে দিল, তারপর বলল, বাঃ! বেশ দেখাচ্ছে।

নির্মলা হেসে ফেলল। তোমায় একটু দিই, পায়ে দিই।

না; পা ছোঁবে না।

তুমি আমার চেয়ে বয়সে বড়, আমি ছোট; তোমার পায়ে হাত দিতে আমার লজ্জা নেই।

কপালে দাও।

নির্মলা শেষ পর্যন্ত অবশ্য পায়ে আবির দিল। দিয়ে অল্প একটু দাঁড়িয়ে থেকে দু-চারটে কথা বলে শেষে বলল, বসো, চা নিয়ে আসি।

নির্মলা চলে যাবার পরও যেন তার দুধের মতন সাদা শাড়ির, তার আঁচল চাপা এলো রুক্ষ চুলের, তার কপালের আবিরের ছোট টিপটির সৌন্দর্য এবং পবিত্রতা সুরেশ্বরের চোখে ভাসছিল।

হঠাৎ কেমন একটা অদ্ভুত, অবর্ণনীয় বীভৎস আতঙ্কের চিৎকার ভেসে এল। শব্দটা ঠাওর করে ছুটে যাবার আগে যা ঘটার ঘটে গেছে। বাড়ির রাঁধুনিদিদির নাবালিকা মেয়েটি রান্নাঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেছে, তার সর্বাঙ্গ কাঁপছে, আর রান্নাঘরে নির্মলা তখনও তার শাড়ি এবং চুলের আগুন নেভাবার চেষ্টা করছে।

হাসপাতালে নিয়ে যাবার সময় নির্মলা অজ্ঞান ছিল।

পরে দিন দুয়ের মাথায় তার জ্ঞান হয়েছিল; এই জ্ঞান কুয়াশাচ্ছন্নচেতনার। অবশিষ্ট কয়েকটি দিন নির্মলার ওই ভাবেই কেটেছে। কথা বলার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল, পারত না; অস্পষ্ট করে কিছু বলত, কিছু বলতে বলতে থেমে যেত। কয়েকটি দাহের জ্বালা যেন তার দুর্বল শীর্ণ দেহটিকে শববাহকের মতন বহন করে ক্রমে ক্রমে মৃত্যুর কাছে নিয়ে গেছে। কিন্তু এই সরল সমাপ্তির আগেই নির্মলা অন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

কী করে হয়েছিল সেটা রহস্য। হয়তো সেদিন রান্নাঘরে চাকরার সময় সে হঠাৎ তার চোখের সামনে সব আলো নিবে যেতে দেখে বিহ্বল হয়ে চলে আসার চেষ্টা করতে গিয়ে শাড়ির আঁচলে আগুন ধরিয়ে ফেলেছিল, হয়তো সে দৃষ্টিশক্তির ক্ষীণতাবশত এবং অসতর্কতাহেতু শাড়িতে আগুন লাগিয়ে ফেলেছিল আগেই–তারপর সহসা আতঙ্কে তার স্নায়ু আহত হয়ে পড়েছিল, সেই আঘাত তার অতি দুর্বল দৃষ্টিশক্তির পক্ষে অসহ্য হয়ে পড়ে। অন্য কিছুও হতে পারে… কে জানে! নির্মলা মনে করে কিছু বলতে পারেনি। বলা যায় না হয়তো।

নির্মলার মৃত্যু সুরেশ্বরের পক্ষে দুঃসহ হয়ে পড়েছিল। কী যেন তাকে সর্বক্ষণ তাড়িত করে নিয়ে। বেড়াত; অন্তরের কোনও নিভৃত যন্ত্রণা ও প্রশ্ন তাকে ব্যাকুল ও বিভ্রান্ত করত; এই জীবন মূল্যহীন অর্থহীন মনে হত; কোনও সান্ত্বনা ছিল না। এমন নিঃস্ব, রিক্ত, শূন্য আর কখনও মনে হয়নি নিজেকে।

সুরেশ্বর বুঝি কিছু অন্বেষণের আশায় বিভ্রান্তের মতন কলকাতা ছেড়ে চলে যায় তারপর। কয়েক মাস পরে ফিরে আসে, আবার চলে যায়। এইভাবে তার কলকাতায় আসা-যাওয়া ছিল। প্রমথও আর কলকাতায় ছিল না। ক্রমে সুরেশ্বর কলকাতা ছাড়ল।

.

সুরেশ্বর যেন ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখতে দেখতে জেগে উঠল, জেগে উঠে দেখল নির্মলা আর নেই। অন্ধ আশ্রমের ঘরে সে শুয়ে আছে, রাত কত বোঝা যায় না, টাইমপিস ঘড়িটার শব্দ বাজছে, নিকষ কালো অন্ধকার, পৌষের অসহ শীত তার ঘর জুড়ে বসে আছে।

.

২৩.

দেখতে দেখতে ক্রিসমাস এসে পড়ল।

এ কদিন গগনরা কাছাকাছি জায়গাগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছিল। অবনী প্রায় নিয়মিত আসত, দুপুরের পর পর; নিজের অফিসের কাজকর্ম এবং হৈমন্তীর হাসপাতালের কথা ভেবে এই সময়টা সে ঠিক করে নিয়েছিল। কোনও অসুবিধে হত না হৈমন্তীর, সে যেতে পারত। ইতিমধ্যে ওরা শহরে গিয়েছিল। শহরটা কিছু কম পুরনো নয়, সেকালের মিশনারিদের বোধহয় খুব পছন্দ হয়েছিল জায়গাটা, ঢালাও স্কুল কলেজ আর চার্চ করেছে, এখনও তার যথেষ্ট গরিমা; চাঁদমারির দিকে সরকারি অফিস-আদালত, ওদিকটায় ছবির মতন পথঘাট কাঁকর ছড়ানো রাস্তা, দুপাশে গাছপালা, উঁচুনিচু মাঠ ময়দান, বাংলো বাড়ি। রিফরম্যাটরি স্কুল, বিহার গভর্নমেন্টের এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনসটিটিউট…এসবও আছে। শহরের একটা অংশ এই রকম, বাকিটা ঘিঞ্জি আর নোংরা, যত ধুলো তত মাছি।

আর একদিন যাওয়া হল সহদেও পাহাড়ে বেড়াতে। পাহাড়টা তেমন কিছু নয়, পাহাড়তলিটা চমৎকার। দূর থেকে দেখলে মনে হবে শাল আর মহুয়ার সবুজ জঙ্গল অঞ্জলিবদ্ধ হয়ে বৃক্ষলতাকীর্ণ পাহাড়টি উধ্বাকাশকে নিবেদন করছে। পাহাড়তলিতে হরিণ আর অজস্র বুনো পাখি।

তারপর গগনরা গেল রাম-সীতাকুণ্ড দেখতে। গরম জলের এই কুণ্ডের কাছে মেলা বসে পৌষের শেষে, মেলার তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছিল।

এইভাবে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছিল গগনরা। এমনকী একদিন রিজার্ভ ফরেস্টও বেড়িয়ে এল রাত করে। সেদিন বিজলীবাবুও সঙ্গে ছিলেন। বিজলীবাবুকে গগন যেন আলাপে চিনত, আসল মানুষটিকে জানত না। সেদিন জানল। জেনে বিজলীবাবুর পরম ভক্ত হয়ে গেল, এমন রসিক-মানুষ বড় একটা তার চোখে পড়েনি। বিজলীবাবু অচিরেই তার বিজলীদা হয়ে গেল।

যদিও গগন ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছিল, মুখে হাসিখুশি ছিল, তবু মনে তার বিন্দুমাত্র সুখ ছিল না। এখানে আসার প্রধান উদ্দেশ্য তার ব্যর্থ হয়েছে। আসার পর তার যদি বা সন্দেহ হয়েছিল, তবু দিদির কথাবার্তা এবং মনোভাব থেকে সে দিদিকে যতটা বুঝেছিল সুরেশদাকে ততটা নয়। দিদি কী বলছে না বলছে এটা কলকাতায় ফিরে গিয়ে মাকে বলার জন্যে সে আসেনি, সেটা অর্থহীন হত; সুরেশদার কী বলার আছে তা জানতেই এসেছিল। এখন তার সবই জানা হয়ে গেছে। কলকাতায় ফিরে মাকে কীভাবে কথাটা বলবে সে বুঝতে পারছিল না। বেচারি মা একেবারে ভেঙে পড়বে।

এখানে থাকতেও যে গগনের আর তেমন ইচ্ছে করছিল তাও নয়। কিন্তু হঠাৎ চলে যাওয়া আরও দৃষ্টিকটু হত। ভেতরের গোলমালটা আরও প্রকাশ্য দেখাত, অন্তত সুরেশদার কাছে তাদের বিরক্ত, বীতস্পৃহ, ক্রোধের মনোভাব সরাসরি প্রকাশ হয়ে পড়লে যেন কোথাও একটু খেলো হয়ে থাকতে হত। গগন ভাবছিল, আর কয়েকটা মাত্র দিন কোনও রকমে কাটিয়ে সে নতুন বছরের শুরুতেই কলকাতায় ফিরে যাবে।

গগনের অন্য দুশ্চিন্তা দাঁড়িয়েছিল হৈমন্তী। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে, না আপাতত রেখে যাবে।

সেদিন সুরেশ্বরের কাছ থেকে আসার পর হৈমন্তী স্পষ্ট করে জানতে চেয়েছিল সব। তার ইচ্ছে ছিল না গগন যায়; গগন ঝোঁকের মাথায় চলে গিয়েছিল। ফিরে এসে গগনের বোধহয় মনে হয়েছিল, সুরেশদা যা যা বলেছে অবিকল তা বলা হয়তো রূঢ় হবে। সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছিল :তোর পক্ষে এখানে থাকার আর কোনও মানে নেই।

হৈমন্তীর না বোঝার কিছু ছিল না; সে অন্য কিছু আশাও করেনি। তবু গগনের এই ছুটে যাওয়া এবং ফিরে আসার মধ্যে যে-গ্লানি তাকে অপ্রসন্ন, অধোবদন করে রাখল।

তারপর একদিন এই ঘোরাঘুরি হচ্ছিল। গগন মনে মনে মুষড়ে ছিল, তবু মুখে হাসিখুশি নিয়ে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছিল; হৈমন্তী যে ঠিক কী ভাবছিল বোঝা যেত না–মুখ দেখে মনে হত তার উৎসাহ কিছু কম নয়।

মনে মনে দুই ভাইবোনে পরস্পরের কাছে কিছু যেন লুকোবার চেষ্টা করছিল। গগন বুঝি জানতে দিতে চাইত না, সুরেশ্বরের প্রত্যাখ্যানের মধ্যে কতটা নির্মমতা আছে; হৈমন্তীও যেন বুঝতে দিতে চাইত না, সে কতটা অসম্মানিত বোধ করছে, কী প্রচণ্ড গ্লানি এবং বিতৃষ্ণা। সম্ভবত ওরা দুজনে নিজেদের মনোভাব লুকোবার জন্যে তৃতীয় এমন কিছু চাইছিল, যা সাময়িকভাবে তাদের অন্যমনস্ক করে রাখে। ওরা হয়তো কেউই এটা চাইছিল না, এখানে এমন কিছু সহসা ঘটুক যাতে সুরেশ্বর এবং তাদের মধ্যেকার ব্যক্তিগত ব্যাপারটা অন্যদের চোখে কৌতূহল ও সন্দেহের বিষয় হয়ে ওঠে। হঠাৎ তারা কলকাতা চলে যেতে পারে না, অবনীর সঙ্গে ঘুরে বেড়াবার সব ব্যবস্থা ঠিক করে এসে আজ আচমকা দুই ভাইবোনে, তা বাতিল করতে পারে না, তারা সুরেশ্বরকেও হয়তো বুঝতে দিতে চায় না, সুরেশ্বর তাদের মনের সুখ আনন্দ হাসিখুশি সব কেড়ে নিয়েছে। এমন কিছু যেন না হয় যা প্রকট, যা কুৎসিত, যার লজ্জা তাদের দুই ভাইবোনকে মাটিতে মেশায়। বরং এই ভাল, সুরেশ্বর দেখুক–তারা সৌজন্য ভোলনি, তারা কোথাও ইতরতা প্রকাশ করল না। তারা কলহ করল না–ক্রোধ বা তিক্ততা দেখাল না। এমনকী সুরেশ্বর এ কথাই মনে করুক, তারা স্বাভাবিকভাবে ঘোরাফেরা করছে, বেড়াচ্ছে, আশ্রমে যাচ্ছে। কিছুই যেন হয়নি, বা যা হয়েছে তার গুরুত্ব যেন ওরা কেউ দিচ্ছে না।

ক্রিসমাসের আগের দিন দুপুরবেলায় গগনের হঠাৎ খেয়াল হল, সুরেশ্বর তাকে কোথায় যেন নিয়ে যাবে বলেছিল, কোন মেলায়।

হাসপাতাল থেকে ফিরে স্নান খাওয়া-দাওয়া শেষ করে হৈমন্তী বিশ্রাম করছিল। গগন এসে বলল, কী রে, ঘুমোচ্ছিস নাকি?

হৈমন্ত গায়ে লেপ টেনে কাত হয়ে শুয়ে ছিল, বালিশে তার মাথা, মুখ ওপাশে ফেরানো–দেখা যাচ্ছিল না। বালিশের পাশে একটা বই পড়ে আছে।

সাড়া দিয়ে হৈমন্তী বলল, না, ঘুমোইনি। বলল কিন্তু মুখ ফেরাল না। তার গলার স্বর উদাস, নিরাবেগ।

গগন জানলার দিকে গিয়ে দাঁড়াল একটু, ফিরে এসে রেডিয়োর সুইচ টিপল, নব ঘোরাল, সেতার বাজছিল, রেডিয়ো বন্ধ করল, আবার জানলার দিকে সরে এসে দাঁড়াল। এসবের মধ্যে প্রায়ই চোখ তুলে সে দিদিকে দেখছিল। হেম যেভাবে পাশ ফিরে শুয়েছিল সেইভাবেই শুয়ে আছে, গগন তার মুখ দেখতে পাচ্ছে না।

শেষ পর্যন্ত গগন বসল, তুইও কি কাল মেলায় যাচ্ছিস?

হৈমন্তী মুখ না ফিরেই বিস্ময়ের গলায় জবাব দিল, কীসের মেলা!

কী জানি! তোদেরই তো জানার কথা…….তুই কি দেওয়াল দেখছিস? শেষের কথাটা ঠাট্টা করে বলা।

হৈমন্তী একটু চুপচাপ, তারপর পাশ ফিরে সোজা হয়ে শুল, কীসের মেলার কথা বলছিলি..?

আমি জানি না। সুরেশদা বলেছিল। ভাবলাম তুই জানিস। কোন মেলায় নাকি তোরা স্লাইড দেখাবি?

হৈমন্তী এবার বুঝতে পারল; সে যে ব্যাপারটা জানে তা নয়, তবে শুনেছে। বলল, তা মেলায় কী?

তুই যাবি নাকি?

 না। আমি কেন যাব! হৈমন্তী যেন উপেক্ষার সঙ্গেই বলল, ওরা যাবে।

 সুরেশদা আমায় যেতে বলেছিল। বিরাট নাকি মেলা মতন হয়: নাচ-ফাচ, গাধার পিঠে চড়া…

বলেছে তো চলে যা। হৈমন্তীর বলার ভঙ্গিটা ব্যঙ্গের মতন শোনাল।

দূর…র, আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই ওসব মেলা-ফেলায়।

 তা হলে যাস না।

 তাই ভাবছি। …মুশকিল কী জানিস, না বললে কী আবার ভাববে–তাই মহা ঝামেলায় পড়েছি।

হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না। গগনের সঙ্কোচটা যে কোথায় এ যেন খানিকটা অনুমান করতে পারছিল সে।

মনের মধ্যে কোনও খুঁত খুঁত থাকলে যেভাবে মানুষ এলোমলো করে কথা বলে গগন সেইভাবে কথা বলল; বলার আগে শব্দ করল জিবের। একটা কিছু বলে দেব কী বল? শরীর ফরীর খারাপ বললেই হবে।

আমি কী বলব! হৈমন্তী ওপর দিকে চোখ তুলে বলল।

গগন কিছুক্ষণ আর কথা বলল না। তার মনে যেসব কথা ক্রমাগত আজ কদিন ধরে তাকে অস্বস্তি দিচ্ছিল, এবং যা বলে ফেললে তার স্বস্তি হত সেসব কথা বলতে না পারার জন্যে তার কোনও একরকম অশান্তি ছিল। সুরেশ্বরের সঙ্গও তার এখন কাম্য ছিল না। গগন সব সময় মাথা ঠাণ্ডা করে কথা বলতে পারে না, কী প্রসঙ্গে কোন কথা উঠবে, গগন মাথা গরম করে কী বলে ফেলবে–এইসব ভয় বা খুঁতখুঁতুনি তার ছিল। তা ছাড়া বাস্তবিকই তার ওই দেহাতি মেলায় যাবার আগ্রহ নেই।

গগন বলল, বরং আমি ভাবছি কাল স্টেশনে গিয়ে থাকব। ওঁরা তো বলেছিলেন সেদিন।

হৈমন্তী গলার তলায় লেপ সরিয়ে দিয়ে এবার পাশ ফিরল, গগনের মুখোমুখি হয়ে থাকল।

অবনীবাবুর ওখানে দিব্যি থাকা যাবে, আমাদের বিজলীদা আছেন, খুব একটা হইহই করে ক্রিসমাস করা যাবে। …আমার, বুঝলি দিদি, তোদের এই আশ্রম আর পোযাচ্ছে না।

হৈমন্তী বুঝতে পারছিল গগন ঠিক যে কথাটা বলতে চায় তা বলতে পারছে না, না পেরে ভূমিকা করছে।

হৈমন্তী বলল, তুই কবে কলকাতায় ফিরছিস?

পয়লা…

ছুটি শেষ হচ্ছে কবে?

ওই রকমই, দু তিন তারিখে। গগন পকেট হাতড়ে সিগারেট বের করল। তার আগে সে উঠে গিয়ে জল গড়িয়ে নিয়ে খেল।

হৈমন্তী কখন যেন গালের তলায় হাত রেখে শুয়েছে।

গগন সিগারেট খেল খানিক, তারপর বলল, বুঝলি দিদি, আমি সেদিন সুরেশদাকে বলছিলাম, ব্যাপার যাই হোক, আমাদের মধ্যে যেন ভুল বোঝাবুঝি না হয়। বলছিলাম বটে, কিন্তু এসব বলার কোনও মানে হয় না। সুরেশদাকে আমি খারাপ বলছি না, কিন্তু আমার আর তাকে ভাল লাগছে না। মানে আগে যেমন ভাল লাগত এখন আর তেমন লাগছে না। আমি তাকে অ্যাভয়েড করছে চাইছি।

হৈমন্তী বলল, জানি।

গগম দিদির মুখের দিকে তাকাল। তার মনে হল, দিদি হয়তো আরও একটু বেশি জানলে ভাল হত। জানলে এখানে আসত না। কী রকম বোকার মতন এসেছে, অন্ধের মতন!

কাউকে ভাল না লাগার সঙ্গে হয়তো মানুষের স্বার্থ থাকে– গগন বলল, কেনই বা থাকবে না। তবে সুরেশদাকে আমার এ রকম মনে হয়নি।

হৈমন্তী নীরব, পায়ের দিকের লেপটা সামান্য নড়ল,দুপুরের রোদ সরে গেছে–ঘরে কোথাও রোদ নেই, জানলায় নেই, পরদার আড়াল দিয়ে কিছু দেখাও যাচ্ছে না, সারা মাঠে আজ সকাল থেকে উত্তরের খেপা বাতাস : সেই বাতাসের শব্দ, কুয়ার লাটাখাম্বা উঠছে নামছে তার শব্দ, কখনও কাকের ডাক, কদাচিৎ কোনও পাখির ডাক শোনা যাচ্ছিল।

গগন আবার বলল, সেদিন আমার মনে হল, সুরেশদা নিজের দামটাই বেশি দেয়। …একটা লোক সব সময় নিজের পাওনা হিসেব করবে এটা আমার কাছে অসহ্য।

হৈমন্তী হঠাৎ বলল, সেদিন কী বলল?

গগন যেন না-চেয়েও শেষ পর্যন্ত অবাঞ্ছিত প্রসঙ্গটায় চলে এসেছে। ইতস্তত করে বলল, কী আর, তোকে তো বলেছি।

না, তুই বলিসনি। …তুই আমার কাছে লুকিয়েছিস।

 আমি তো বললাম, সুরেশদার কথাবার্তা থেকে মনে হল না তার আর কোনও আগ্রহ আছে।

তুই কী বললি তা শুনেছি, ও কী বলল তা বলিসনি। তোর মুখ দেখে আমার সেদিনই সন্দেহ হয়েছে, এমন কিছু ও বলেছে যা তুই বলতে পারছিস না।

আমার সঙ্গে সুরেশদার এব্যাপারে কথা খুব কমই হয়েছে, বিশ্বাস কর…

গগন– হৈমন্তী যেন ধৈর্যহীন হয়ে ধমকে উঠল।

গগন সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিল, বলল, একটা লোক মুখে কখন কী বলে সেটা বড় কথা নয়, মুখের কথার সত্যিই তেমন কোনও দাম নেই। তবে তুই ঠিকই ধরেছিলি, সুরেশদা আর সে-মানুষ নেই। ভালবাসাটা তার কিছু নয়। ..সুখ-টুখ…আনন্দ এইসব কী যেন বলছিল। আসলে কিছুই বলছিল না। চুপ করে ছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এসব জ্ঞান তোমার এতদিনে হল? জবাবে বলল, না আগেই হয়েছে…। আমি কিছু বুঝলাম না। জ্ঞান যদি আগেই হবে তবে এতদিন ধরে এইভাবে ধোঁকা দেওয়া কেন? তার কোনও জবাব নেই। মামুলি কথা : আমার ভুল হয়েছে…। ওটা কোনও জবাব নয়, কৈফিয়ত নয়। … যাকগে, এ একপক্ষে ভাল, যা হবার হয়ে গেল। সেই যে–মামা বলে, মামলার তারিখ পড়ার চেয়ে জজের রায় ভাল, কথাটা ঠিক…। গগন যেন শেষের দিকে তার হতাশা ও ক্ষোভ দমন করার চেষ্টায় কোনওরকম সান্ত্বনা খুঁজল।

হৈমন্তী কথা বলল না, অল্প একটু শুয়ে থেকে এবার উঠে বসল, হাঁটু মোড়া, কোমর থেকে পা লেপে ঢাকা রয়েছে।

বসে থাকতে থাকতে গগন বলল, সুরেশদা যখন আনন্দ-টানন্দ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে তখন আমার মনে হয় না তোর আর এখানে থাকা চলে। মাও রাজি হবে না। …আমি চলে যাই, তুইও কয়েকটা দিন পরে আয়।

হৈমন্তী এবারও কথার কোনও জবাব দিল না, কপাল এবং মুখের পাশ থেকে এলোমেলো চুলের গুচ্ছ হাতে করে সরিয়ে নিতে লাগল।

গগন কেমন অপরাধীর মতন একবার দিদিকে দেখল কয়েক পলক, তারপর গলা উঁচু করে জানলার বাইরে তাকাল। শেষে ইতস্তত করে বলল, দেখ দিদি, কথায় বলে ভালবাসা মরে যাবার পর ভালবাসার ভানটা সাঙ্ঘাতিক, ওর চেয়ে বিচ্ছিরি আর কিছু হতে পারে না। …আমায় যদি বলিস আমি বলব, সুরেশদার ও ব্যাপারটা আর নেই, আমার তো তাই মনে হল… বোধহয় তোর দিক থেকেও এখন আর কোনও… কথা গগন শেষ করল না।

গগনের চোখে চোখে তাকিয়ে ছিল হৈমন্তী। মনে হচ্ছিল, হৈমন্তী যেন তার অভ্যস্ত দক্ষ দৃষ্টিতে গগনের চোখের সবটুকু দেখে নিচ্ছিল। দৃষ্টি তীব্র, স্থির, প্রখর। গগন রোগীর মতন তার চোখ খুলে বসে থাকল।

হৈমন্তী বলল, যতক্ষণ মুখফুটে না বলছিল ততদিন বুঝি তোর মনে হচ্ছিল ওর ভালবাসা আছে? গগন এবার নীরব থাকল, মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকাল।

আর কী বলল–! … বলল না যে, আমার বড় অন্যায় হয়েছে, তোমরা আমায় ক্ষমা করো, মাসিমাকে বোলো তিনি যেন কিছু মনে না করেন– ব্যঙ্গ করে করে হৈমন্তী বলছিল।

গগন মাথা নাড়ল ধীরে ধীরে, বলল, ভুলের কথা বলছিল। …একটা কথা আমি বুঝতে পারলাম না, কী বলছিল–একবার এক ঘটনা থেকে হঠাৎ তার সব কেমন হয়ে গেল, দ্বিধা-টি চলে এল…

কী ঘটনা?

 কী জানি! কিছু বলল না। …তুই কিছু জানিস?

হৈমন্তী মাথা নাড়ল, না জানে না। কিন্তু সে বিস্মিত হয়েছিল এবং ভাবছিল।

সেদিন অবনীর আসতে দেরি হল; যখন এল তখন আর বিকেল ছিল না, পৌষের অপরাহ্ন ধূসর হয়েছে, অন্ধকার হয়ে এল প্রায়। উত্তরের বাতাসটাও আজ সারাদিন প্রখর, মাঠে-ঘাটে শনশন ছুটে বেড়াচ্ছিল। আকাশের রোদ দুপুর থেকেই ঘোলাটে হয়ে গিয়েছিল, মাঝে মাঝে জমছিল, আবার ভেসে যাচ্ছিল।

গগন বলল, আমরা ভেবেছিলাম আজ আর আপনি এলেন না।

অবনী বলল, আজ তো কোথাও যাবার কথা নেই, দেরি করেই এলাম। কাল ছুটি, পরশুও; কাজকর্ম সেরে বাড়ি ফিরেছি দুপুরে।

গগন অবনীকে নিজের ঘরে এনে বসাল। বলল, আজকের ওয়েদারটা কী রকম যেন। শীত খুব, কিন্তু ডাল।

বৃষ্টি হতে পারে।

এই শীতে বৃষ্টি–

এ-সময় একটু-আধটু হয়। …আচ্ছা শুনুন, পরশুদিন আমরা কিন্তু হাইড্রো-ইলেকট্রিক ইনস্টলেশান দেখতে যাচ্ছি, ইনস্পেকশান বাংলো পাওয়া যাবে।

বাঃ, ওয়ান্ডারফুল। ওটা হলেই আপাতত হয়ে যায় আমার– গগন হাসল, তারপরই ঘরের ছেলে ঘরে।

কবে ফিরছেন?

 পয়লা…

 এত তাড়াতাড়ি! সেকি, আরও থেকে যান কদিন।

গগন হেসে মাথা নাড়ল। না; আর থাকা যাবে না। এসেছিও তো দশবারো দিন হয়ে গেল। বসুন, দিদিকে ডেকে আনি। গগন হৈমন্তীকে ডাকতে গেল।

সামান্য পরেই ফিরল গগন। বলল, আমি তো ভাবছিলাম কাল আপনাদের ওখানে যাব। আমার একটা নেমন্তন্ন পাওনা রয়েছে। গগন হাসল।

অবনী ততক্ষণে সিগারেট ধরিয়েছে, জবাব দিল, চলে আসুন। বলা তো আছেই—

বিজলীদা মুরগি-টুরগি খাওয়াবেন বলেছেন

বিজলীবাবুর রান্নার হাতযশ আছে; অবনী হেসে বলল। ঠিক আছে, ব্যবস্থা করা যাবে, আপনারা চলে আসুন।

দিদি কি যাবে?

যাবেন না? কেন?

জানি না। ওদের হাসপাতাল বন্ধ থাকলে যাবে। আমি সকালবেলাতেই পালাতে চাই। নয়তো ঝামেলায় পড়ব।

অবনী কিছু বুঝল না।

 গগন নিজের থেকেই বলল, সুরেশদারা কোথায় কোন মেলায় গিয়ে চক্ষুরোগের প্রতিকার না কি তার স্লাইড দেখাবে। আমায় বলেছে, চল। ধ্যত, ওসব আমার পোয় নাকি? তার আগেই পালাতে চাই। গগন সরল গলায় হেসে হেসে বলল।

অবনী হেসে ফেলল। এই ব্যাপার?

আপনি কি মেলাটায় গিয়েছেন নাকি, স্যার? মাঝে মাঝে গগন মুখফসকে রসিকতা করে স্যার বলে ফেলে, এটা তার অভ্যেস।

না। অবনী মাথা নাড়ল; তারপর বলল, মেলা-ফেলায় এখন যাওয়া রিসকি। সেদিন কোথায় যেন শুনলাম বিদঘুটে এক রোগে কোন মেলায় দুটো লোক মারা গেছে।

কী জানি! অফিসে কে বলছিল। ..এ সময়টা এদিকে গাঁয়েটায়ে স্মল পক্সটা খুব হয়, প্লেগও শুনেছি হত।

এমন সময় হৈমন্তী এল। ঘর বেশ অন্ধকার হয়ে আসছে জেনেই যেন সে বাতি এনেছিল। বাতিটা নামিয়ে রাখল।

গগন বলল, দিদি, কাল তোর হাসপাতাল?

কেন?

না, তা হলে সকালের দিকে স্টেশনে চলে যেতাম। বড়দিনটা ওখানেই করা যেত।

তুই বুঝি নিজেই পাকা ব্যবস্থা করে ফেলেছিস!

 তা করেছি। সুরেশদার সঙ্গে মেলায় যাওয়ার চেয়ে নেমন্তন্ন খাওয়া কি খারাপ?

 গগন হাসতে লাগল।

 হৈমন্তী গগনের বিছানার পাশ ঘেঁষে বসল।

অবনী বলল, কাল আপনারা আসুন।

 হৈমন্তী হাসপাতালের কথা তুলল না, মাথা হেলিয়ে বলল, যাব।

 গগন কেমন যেন অবাক হল। তোর হাসপাতাল?

ওরা দেখবে, হৈমন্তী সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, তার জবাব শুনে মনে হল প্রসঙ্গটা তার আর আলোচনা করার ইচ্ছে নেই।

গগন চুপ করে গেল। অবনীও কথা বলছিল না। হঠাৎ কেমন একটা স্তব্ধতা নামল ঘরে।

শেষে গগনই কথা বলল। চায়ের কথা বলেছিস?

না, মালিনীকে পেলাম না। দেখ তো ফিরেছে কিনা?

গগন উঠল, ঘরের এক কোণে টুলের ওপর তার সুটকেস, সুটকেসের ওপর রাজ্যের গরম জামা-টামা পড়ে আছে, পুরোহাতা পুলওভারটা টেনে নিয়ে পরে নিল, যদিও ভেতরে তিন প্রস্থ জামা আগেই পরেছে। বলল, আমি এই ফাঁকে বোঁ করে সুরেশদাকে বলে আসি, কাল মেলায় যাওয়া হবে না। বলে মালিনীর খোঁজ করতে চলে গেল।

অবনী হৈমন্তীর মুখের দিকে তাকাল, দেখল, চোখ ফেরাল, তারপর আবার তাকাল। অন্য দিনের তুলনায় হৈমন্তীকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। অবনী বলল, আপনার কি শরীর খারাপ?

হৈমন্তী চোখ ফিরিয়ে তাকাল। না; কেন?

মনে হল… অবনী হাসল, খুব গম্ভীর…

 গম্ভীর থাকলে শরীর খারাপ বোঝায়?

জানি না, লোকে বলে, বোধহয় ওটা অভ্যেস। আপনিই বেশি বুঝবেন, ডাক্তার বদ্যি লোক।

হৈমন্তী অন্যমনস্ক চোখে অবনীর সকৌতুক মুখভঙ্গি লক্ষ করছিল। অবনীর সম্পর্কে তার নানাবিধ গভীর কৌতূহল জাগে আজকাল। এখন অবশ্য সেরকম কোনও কৌতূহল জাগছিল না, বরং অবনীর দিকে তাকিয়ে থাকলেও অন্য কিছু ভাবছিল। হৈমন্তী বলল, মাথাটা বিকেল থেকে ধরে আছে; হয়তো ঠাণ্ডা লেগেছে। আজ খুব ঠাণ্ডা।

অবনী মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, বেশ শীত; বৃষ্টি বাদলা হতে পারে সামান্য।

হৈমন্তী এমন একটা মুখভাব করল, মনে হল শীতের বৃষ্টি তার বিন্দুমাত্র পছন্দ নয়।

দুজনেই প্রায় চুপচাপ। অল্প পরে অবনী বলল, গগনবাবু তো চললেন–

আপনি গগনকে বাবুটাবু বলে যেরকম বাড়িয়ে দিলেন– হৈমন্তী হালকা হবার চেষ্টা করল, ও কত ছোট, আমার চেয়েও ছোট…

অল্প দিনের পরিচয়, বেশিদিন থাকলে হয়তো গগন বলেই ডাকতাম।

কিছু না, আপনি অনায়াসেই ডাকতেই পারেন। আপনার আড়ালে ও মাঝে মাঝে যেরকম ঠাট্টা করে।

তাই নাকি?

হৈমন্তী হাসবার চেষ্টা করল, পারল না। অবনীর সামনে সাধাসিধে মুখে গল্প-টল্প করতে গিয়েও সে পারছে না। মাথাটা সত্যিই ধরে আছে। দুপুর থেকে ক্রমাগত সে কেন যে এত ভাবছে, কী আছে এত ভাববার, সুরেশ্বরের জীবনে কত ঘটনাই তো ঘটতে পারে, তাতে তার কী আসে-যায়!

আপনাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি অবনী হঠাৎ বলল।

 হৈমন্তী সচকিত হয়ে তাকাল।

অবনী বলল, আমায় পাটনা যেতে হচ্ছে না!

 হৈমন্তী খুশি হল। খুশির পরক্ষণেই তার চোখে বিমর্ষ ভাব ফুটল। গেলেই পারতেন; এভাবে জীবনের উন্নতি নষ্ট করতে নেই।

আমার জীবন খুব ছোট– অবনী হাসল, উন্নতি আর চাই না, একটু স্বস্তি চাই।

এখানে স্বস্তিতে আছেন?

 অনেকটা।

অবনী অবশ্য আগেও অনেকবার বলেছে কথাটা। হৈমন্তী চুপ করে থাকল, কী ভাবল, তারপর বলল, আপনারা সবাই দেখছি এই জায়গাটায় খুব স্বস্তি পাচ্ছেন। তার কথাটা শেষ হয়েও হল না যেন।

অবনী প্রথমটায় বুঝতে পারেনি, পরে বুঝল। বলল, আমরা কে কে সুরেশ্বরবাবু আর আমি! ওঁর কথা আলাদা, আমি তো ছোটখাটো সুখ-স্বস্তিতেই বেঁচে যাই।

তা হোক, তবু এটা জায়গার গুণ.. হৈমন্তী পরিহাস করে বলতে গেল।

অবনী পূর্ণদৃষ্টিতে হৈমন্তীকে লক্ষ করল, বলল, আপনার বোধহয় তেমন স্বস্তি হল না।

হৈমন্তী চেষ্টা করল অবনীর দিকে তাকাবার, কোনও রকম অদ্ভুত এক ভয়ে তাকাতে পারল না। আলোর দিকে মুখ করে বসে থাকল।

অবনীও কোনও কথা বলছিল না।

শেষ পর্যন্ত হৈমন্তী নিজেকে যেন কোনও অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে বাঁচাবার জন্য বলল, আজ স্বস্তি স্বস্তি করছেন, পরে আফশোস, করবেন।

কেন?

 হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলছেন বলে?

অবনী হাসল না, হাসির মতন মুখ করল; বলল, আফশোসের কথা বলবেন না, ওটা আমি সারা জীবনই প্রায় করে যাচ্ছি। এতদিনে গা সওয়া হয়ে গেছে। বলে অবনী চেয়ারে পিঠ হেলিয়ে গা সামান্য ছড়িয়ে দিয়ে ছাদের দিকে তাকাল। কী ভেবে সামান্য পরে বলল, লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী দুইয়ের জন্যই তো দেখি মানুষের আফশোস। …তার বাইরেও কত রকমেরই আফশোস আছে! অবনী যেন কথার শেষে হাসতে চাইল।

হৈমন্তী নীরব থাকল। অবনী ঠিকই বলেছে। আফশোসের কি অন্ত আছে জীবনে!

পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল অবনী, হৈমন্তীর দিকে তাকাল, তারপর মুখ নিচু করে সিগারেট ধরাল। কে যেন বলেছিল– অবনী মুখ তুলে বলল, জগৎটাকে গড়ার সময় বিধাতা ভদ্রলোকের কাণ্ডজ্ঞান বিশেষ ছিল না, কাঁচা হাতে বোকার মতন এই সংসারটা গড়ে ফেলেছেন; মোস্ট ইমপারফেক্ট…। কথাটা বন্দ বলেনি, কী বলেন? খানিকটা ভদ্রলোকের মন গড়তে পারলে এত আফশোস-টাফশোস থাকত না…অবনী এবার হাসল। হাসিটা ছাই চাপা আগুনের মতন, ওপরে হাসি ভেতরে যেন কীসের আঁচ রয়েছে।

হৈমন্তী গায়ের চাদর খুলে আবার গুছিয়ে নিল, নিজের এই স্থির অনড় ভাবটা যেন তার ভাল লাগছিল না। সামান্য নড়েচড়ে বসল। শেষে হেসে বলল, সংসারের গড়নটা আপনার তা হলে পছন্দ নয়?

মাথা নাড়ল অবনী, না। কোনওকালেই ছিল না।

কিন্তু কিছু করতেও পারলেন না।

কিছু না; শুধু বসে বসে আফশোস।

কী জানি….! আফশোস করেই বা কী লাভ! হৈমন্তী অন্যমনস্কভাবে বলল।

কিছু না। বিজলীবাবু হলে ওমর খৈয়াম শোনাতেন। আমার কাব্য-টাব্য জানা নেই। তবে মাঝে মাঝে মনে হয়, কোনওদিন ছাদ ফুড়ে দুম করে যদি কিছু পেয়ে যাই–অমূল্য রতন, তবে আর আফশোস, করব না। অবনী হাসছিল।

গগন এল। ঘরে এসে বলল, চা দেয়নি? ..আনছে তা হলো… বুঝলি দিদি, সুরেশদাকে বলে এলাম। বললাম, কাল আমাদের স্টেশনে নেমন্তন্ন, মেলায় যাচ্ছি না। …ভেরি বিজি সুরেশদা, লোকজন রয়েছে। বলে কী মনে হওয়ায় গগন অবনীর দিকে তাকাল, আপনি ঠিকই বলছিলেন স্যার, কোথায় যেন কীসের একটা এপিডেমিক ব্রেক-আউট করেছে। ওখানেও শুনলাম।

.

২৪.

পথ মাইল পঞ্চাশের কিছু বেশি। অবনী দুপুর নাগাদ এসেছিল, বেরুতে বেরুতে তিনটে বাজল।

হৈমন্তীও যাচ্ছে। তার যাবার কিছু ঠিক ছিল না; বরং বরাবরই সে বেশি দূর পথ যেতে, বাইরের ঠাণ্ডায় রাতে ঘোরাঘুরি করতে অনুৎসাহ দেখিয়েছে। গুরুডিয়া থেকে অতটা পথ জিপে করে গিয়ে মাদাউআলের বনজঙ্গল পাহাড়ের মাঝখানে হাইড্রো ইলেকট্রিক পাওয়ার হাউস দেখার উৎসাহ তার ছিল না। তা ছাড়া সারারাত সেখানে কাটাতে হবে। অসুবিধেও ছিল। তবু সে শেষ পর্যন্ত যাচ্ছে।

গতকাল, অবনীর বাড়িতে গগনের সঙ্গে বড়দিন করতে এসে সারাটা দিন ভালই কেটেছিল। গল্পগুজব, হাসিঠাট্টা, বিজলীবাবুর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া, অনেক দিন পরে হঠাৎ গগনের পাল্লায় পড়ে তাস খেলা–এসব যেন মনের কোনও গুরুভার সাময়িকভাবে অনেকটা হালকা করে দিয়েছিল। ফেরার সময় অবনী বলল, আপনিও চলুন কাল, সাইটটা খুব সুন্দর, বাঁধের গায়ে পাহাড়ের ওপর ইনসপেকশান বাংলো, চমৎকার লাগবে। একটা তো রাত। অসুবিধে খুব হবে না। পরশু দিন বেলা নটার মধ্যে যথাস্থানে পৌঁছে দেব আপনাকে।

গগন বলল, চল দিদি, এই চান্স। পরে আর তোর যাওয়া হবে না।

হৈমন্তী তখনও স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। সে গগন নয়, যাব বললেই যেতে পারে না। কিছু যেন ভাবার ছিল।

আজ সকালে হাসপাতালে রোগী ছিল না; অনেকটা বেলায় দুজন এল : একটার চোখ উঠেছে, অন্যটার ঠাণ্ডায় চোখ মুখ ফুলে টসটসে। তারপর এল সুরেশ্বর, সঙ্গে শিবনন্দনজি। দুজনেই যেন ব্যস্ত; কথা বলতে বলতে এসেছিল, কথা বলতে বলতেই চলে গেল, কেন এসেছিল বোঝা গেল না। কিন্তু মনে হল, যেন এই আসা-যাওয়ার মধ্যে হৈমন্তীকে দেখে গেল।

হাসপাতালে বসে থাকতে থাকতে হৈমন্তী স্থির করে ফেলল : সে যাবে। আসার সময় যুগলবাবুকে বলে এল, কাল আসতে তার বেলা হবে, রোগী এলে যেন বসিয়ে রাখা হয়। হাসপাতাল থেকে ফিরে গগনকে বলল, আমরা আজ থাকছি না তোর সুরেশদাকে বলে আয়।

পথটা নতুন; এর আগে হৈমন্তী আর এদিকে আসেনি। ছড়ানো কালো ফিতের মতন পথ, যত যাও ততই যেন ফিতেটা খুলে যাচ্ছে, আঁকবাঁক তেমন একটা নেই, পরিষ্কার ছিমছাম, ডাইনে বাঁয়ে ঢেউ-ভাঙা প্রান্তর, দূরে গায়ে গায়ে কোথাও পাহাড়ের টিলা, কোথাও বা তরুলতায় আচ্ছাদিত ছোট ছোট পাহাড়। শীতের মরা রোদ পার্বত্য পাদদেশকে ক্রমশই নিষ্প্রভ করে আনছিল। ছায়া নেমেছে তরুমূলে, ছোটখাটো দেহাতি গ্রাম, অল্পস্বল্প ক্ষেত খামার, সবজি মটরশুটি, কাঁচা কুয়ো থেকে জল তুলছে বউ ঝি, কুল ঝোপ, দু-একটা কুকুর। কদাচিৎ এক আধটা বাস চলে যাচ্ছিল।

সামনে অবনী, পাশে বিজলীবাবু। পেছনে হৈমন্তী আর গগন। নেব না নেব না করেও কয়েকটা জিনিস হয়ে গেছে। তার মধ্যে বিছানার ব্যবস্থাই প্রধান, ছোটখাটো স্যুটকেসও। হৈমন্তীর জন্যে গগন কম্বল নিয়ে নিয়েছিল, আর দুই ভাইবোনের কিছু গরম বস্ত্র। গগনরাও সুটকেস নিয়েছে একটা। জল আর চায়ের ফ্লাস্ক, টিফিন কেরিয়ার–এসব বিজলীবাবুর ব্যবস্থা। উপরন্তু বিজলীবাবুর আরও একটি ব্যবস্থা ছিল, হৈমন্তী আসছে শুনে তিনি সঙ্কুচিত ও বিব্রত হয়ে আগেভাগেই সেটা লুকিয়ে ফেলেছিলেন।

দেখতে দেখতে অনেকটা পথ চলে আসা গেল।

বিজলীবাবু বললেন, মিত্তিরসাহেব এবার একটু রেস্ট দিন। বিকেলের চা-টা খেয়ে ফেলা যাক।

 ক মাইল এলাম? গগন শুধোল।

প্রায় আধাআধি, মাইল পঁচিশ হবে– বিজলীবাবু জবাব দিলেন।

 বিজলীদার দেখছি মাইলেজ পর্যন্ত মুখস্থ, গগন হেসে বলল।

এখানকার দেহাতি লোক ভাই, কোথায় কী তার একটা মোটামুটি জ্ঞান না থাকলে চলে। বলে বিজলীবাবু ডান হাত তুলে দূরে একটা পাহাড় দেখালেন, বললেন, ওই পাহাড়টা হল চন্দ্রগিরি, এখানকার লোকে বলে চাঁদওআরি, ওর নীচে দিয়ে আমাদের যেতে হবে।

পাহাড়টা তো কাছেই, গগন বলল।

মাইল ছয়েক বিজলীবাবু বললেন।

 গগনের বিশ্বাস হল না, বলল, ছ মাইল? কী বলছেন! …এখানের মাইলের হিসেবটাও কি দেহাতি?

বিজলীবাবু হেসে জবাব দিলেন, পাহাড় জিনিসটা ওই রকমই মনে হয় পাই পাই তবু তারে পাই না।

বিজলীবাবুর বলার ভঙ্গিতে গগন জোরে হেসে উঠল। হৈমন্তীও হেসে ফেলল। অবনী হাসতে হাসতে বলল, বিজলীবাবু, এটা ওমর খৈয়াম নয়। বলে চা খাবার জন্যে গাড়ি দাঁড় করাল।

বিজলীবাবু সহাস্য মুখে জবাব দিলেন, না, ওমর খৈয়াম নয়। এ হল পুরনো দিনের বাংলা গান । সে যে দেখা দিয়ে দেখা দেয় না, ধরা দিয়ে হায় ধরা দেয় না। জংলা কারফা।

অবনী গলা ছেড়ে হেসে উঠল। গগনও হাসতে লাগল।

অবনী বলল, বিজলীবাবুর তা হলে পুরনো বাংলা গানও জানা আছে।

গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিলেন বিজলীবাবু, পথে দাঁড়িয়ে গায়ের জামাটা ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, একটু আধটু আছে। আমার বাবার মুখে শুনেছি। হারমোনিয়াম বাজিয়ে ডুগি তবলার সঙ্গে সঙ্গত করে গাইতেন। বলে বিজলীবাবু গাড়ির মধ্যে হাত বাড়ালেন, হৈমন্তীকে বললেন,  দিন তো দিদি, চায়ের ফ্লাস্কটা। ওই যে হলুদ মতন কাপড়ের থলে ওর মধ্যে কাপ টাপ আছে।

গগনও নীচে নেমে দাঁড়িয়েছিল। অবনী রাস্তায় দাঁড়িয়ে জিপগাড়িটার সামনে চাকায় বার কয়েক জুতোর ঠোক্কর মেরে কী যেন দেখে নিল।

হৈমন্তী চায়ের কাপ বের করল। বিজলীবাবুর সব কাজ ব্যবস্থা মতন, কোথাও এতটুকু ভুল হবার জো নেই। চায়ের কাপ, জলের গ্লাস, কলাপাতায় মোড়া পান। হৈমন্তী গাড়ির পিছন দিক থেকে জলের ফ্লাস্ক নিয়ে কাপ ধুতে ধুতে বলল, বাড়ি থেকে সব গুছিয়ে দিয়েছে না?

বিজলীবাবু হাসলেন। ওইটুকুই সুখ, কোথাও যাব বললে আর রক্ষে নেই, মরণকালে মুখে দেবার গঙ্গাজলটুকু পর্যন্ত এগিয়ে দেবে।

হৈমন্তী হাসিমুখে ভর্ৎসনা করল, ছি, ও কথা বলবেন না।

 গগন বলল, আপনি এমন তোফা আছেন বিজলীদা যে আপনাকে দেখে ম্যারেজ সম্পর্কে আমার প্যানিকটা কেটে যাচ্ছে।

ফক্কড়….! হৈমন্তী ধমক দিল যেন।

হাসাহাসির মধ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাওয়া হল। হৈমন্তী নামল না।

মাঠ ঘাট থেকে রোদ এবার উঠতে শুরু করেছে, যেন এতক্ষণ সারাটা সকাল দুপুর ধরে আকাশ এসে মাটিতে রোদ মেলে দিয়েছিল, এবার বেলা পড়ে যাওয়ায় দ্রুত হাতে তা তুলে নিয়ে কোলে জড়ো করছে।

অবনী এসে গাড়িতে বসল, ঠোঁটের ডগায় সিগারেট। বিজলীবাবু পান মুখে পুরেছেন, জিবের ডগায় একটু চুন চুঁইয়ে ধীরে ধীরে গাড়ির মধ্যে উঠে এলেন। গগনও সিগারেট টানতে টানতে উঠে পড়ল।

প্রায় সাড়ে চার বাজছে। রোদ পালাচ্ছে বলে বুঝি শীতের দমকা উত্তরের বাতাস তাকে তাড়া করতে শুরু করে দিয়েছিল। গাছের ছায়াগুলি এখন বেশ দীর্ঘ এবং মাটির রঙের সঙ্গে ছায়ার রং মিশে আছে।

অবনী গাড়িতে স্টার্ট দিল।

কতক্ষণ লাগবে পৌঁছতে? গগন জিজ্ঞেস করল।

ঘণ্টাখানেক, অবনী বলল; বলে বিজলীবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, নাওদা না কী বলে যেন, ওখান থেকে একটা কাঁচা রাস্তা ধরলে নাকি শর্টকাট হয়।

বিজলীবাবু মাথা নাড়লেন, রাস্তা খুব খারাপ, আমার চেনা নেই; পুরনো রাস্তাই ভাল।

গাড়ি চলতে শুরু করল। অল্প এগিয়েই অতি শীর্ণ এক নদী, নদীতে জল নেই, বালির ওপর ছায়া নেমেছে, ধীরে ধীরে যেন বনাঞ্চলের মধ্যে রাস্তাটা হারিয়ে যাচ্ছে, বড় বড় শালগাছ, অজস্র হরীতকী আর নিম। শীতের বাতাস এসে গাছপাতায় ক্ষণে ক্ষণে কাঁপুনি তুলেছে, আমলকী বন যেন হঠাৎ ছুটে এসে পালাল, আর কোথাও গাঁ-গ্রাম চোখে পড়ছে না, শুধু জঙ্গল, বিচিত্র গাছপালা, পথে মানুষজন নেই, গাড়ি নেই, নির্জন নিস্তব্ধ এক জগতে যেন ক্রমশই গাড়িটা এগিয়ে যাচ্ছে।

বিজলীবাবু তাঁর হাতে-পাকানো সিগারেট ধরিয়েছেন। হৈমন্তীর শীত ধরতে শুরু করেছিল, গায়ের কোটটা জড়িয়ে নিল। গগন ঝুঁকে পথঘাট দেখছে, অন্যমনস্ক।

অবনী বলল, বিজলীবাবু, আপনার কপিলকে দিয়ে ক্লাচটা একবার দেখাবেন তো, মাঝে মাঝে বড় ডিস্টার্ব করে…।

বিজলীবাবু অবনীর পায়ের দিকে তাকালেন।

গগন হঠাৎ বলল, আমরা কি পাহাড়ের তলায় এসে পড়লাম?

হ্যাঁ, বিজলীবাবু জবাব দিলেন, আর একটু এগিয়েই দুদিকে পাহাড় পড়ে যাবে, মাঝ দিয়ে রাস্তা। …চন্দ্রগিরির এক গল্প আছে।

কী গল্প?

এখন তো বলা যাবে না…চেঁচাতে হবে; পরে বলব।

গগন চুপ করে গেল।

সামান্য পরেই চারপাশ থেকে পাহাড়ের আড়াল উঠে এল, যেন বনবৃক্ষ ও লতাগুল্মপূর্ণ পাথরের এক মস্ত ঝাঁপি তাদের দুপাশে। দীর্ঘশীর্ষ গাছ, কুণ্ডলী পাকানো জটাজুটধারী অশ্বথ, ভূপীকৃত ছায়া, কদাচিৎ কোনও সূর্যরশ্মির রেখা, গভীর খাদ, আর পরিপূর্ণ স্তব্ধতা; শুধু গাড়ির শব্দ শ্বাসপ্রশ্বাসের মতন কানের পরদায় মিশে আছে।

তারপর কখন যেন এই ঝাঁপি খুলে যেতে লাগল, মাথা তুলে দাঁড়ানো আড়াল সরে যাচ্ছে, বনজঙ্গল বিচ্ছিন্ন ও দূরবর্তী হয়ে আসতে লাগল, সামনে উতরাই, শেষ বিকেলের ম্রিয়মাণ আলোয় ঝাঁক বেঁধে পাখি উড়ে যাচ্ছে, নিমফুলের গন্ধের মতন কেমন এক গন্ধ এল, কয়েকটি বনজ কুসুম।

গগন এতই মুগ্ধ ও উচ্ছ্বসিত হয়েছিল যে সে হঠাৎ গাইতে শুরু করল :বুঝি বেলা বয়ে যায়, কাননে আয় তোরা আয়…।

গগন গানে পারদর্শী নয়; তবু তার মোটা সাদামাটা গলা, তার উচ্ছ্বসিত মুগ্ধ হৃদয় গানটিকে কেমন সুন্দর ও জীবন্ত করে তুলল।

বিজলীবাবু ঘাড় পিছু দিকে হেলিয়ে দিয়ে গান শুনতে লাগলেন। অবনী একবার ঘাড় ফেরাল। হৈমন্তী হাঁটুর ওপর কনুই রেখে গালে হাত দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল।

গান শেষ হলে বিজলীবাবু বললেন, বাঃ।

গগন যেন এবার লজ্জা পেল। হৈমন্তীর দিকে চকিতে চেয়ে বলল, হঠাৎ কেমন ফিলিং চলে এল বিজলীদা, আমি গাইয়ে নয়।

না হলে গাইয়ে, কিন্তু বেশ গেয়েছ। দেখো ভাই, গান হল আধা-গাইয়েদের জন্যে; আর সুর হল পাকা-গাইয়েদের জন্যে।

গগন কেমন অবাক হয়ে বলল, সে কী! মানেটা তো বুঝলাম না।

বিজলীবাবু হেসে বললেন, মানেটা সহজ। একটা হল অন্তরের জিনিস, অন্যটা যন্তরের।

ঠিক যেন গোধূলি বেলায় মাদাউআলের কাছে ওরা পৌঁছে গেল। কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া সরকারি জঙ্গল দুপাশে, মনে হল এক সময়ে এই জঙ্গল কেটে মাঠ হয়েছিল, আবার নতুন করে সামনের দিকটায় গাছের চারা পোঁতা হয়েছে। ছোট ছোট গাছ, সাজানো, গোছানো, একটা সজারু ছুটে গেল, কিছু পাখি, শীতের ধূসরতা নেমে গেছে, আকাশ গড়িয়ে গোধূলির আলো মেঘের আড়ালে ডুবে যাচ্ছে, ঠাণ্ডা কনকনে মুঠো ক্রমশ শক্ত হয়ে আসছে শীতের।

দেখতে দেখতে এই বনের মধ্যে মানুষের পদচিহ্ন ফুটে উঠল। হলুদ রঙের কোয়াটার্স, মস্ত মস্ত লোহার থাম, ওভারহেড লাইন, নদীর রেখা, অন্যদিকে পাহাড়ের দেওয়াল। যেতে যেতে সরকারি জঙ্গলে গগন একটা হরিণ দেখতে পেল। আঙুল দিয়ে হরিণটা দেখাবার আগেই সে অদৃশ্য।

অবনী ডাইনে বেঁকল, তারপর আবার বাঁয়ে। সামান্য পথ এগিয়েই চোখের সামনে বাঁধটা দেখা গেল। এপাশ ওপাশ যেন আর দেখা যাচ্ছে না স্পষ্ট করে, অন্ধকার হয়ে এসেছে, বাতি জ্বলছে, দুরন্ত তীক্ষ্ম এক বাতাসের দমকা এসে সর্বাঙ্গ শিহরিত করল।

বিজলীবাবু বললেন, বছর পাঁচেক আগে একবার এসেছিলাম মিত্তিরসাহেব, তখন কাজ চলছে। এখন দেখছি ভোল পালটে ফেলেছে।

অবনী বলল, আসতে তো চাইছিলেন না, জোর করে নিয়ে এলুম।

গগন বলল, ইস, এখানে এসে সাতটা দিন থাকলেই হত। মার্ভেলাস সাইট। …কী রে দিদি, ভাল লাগছে না?

হৈমন্তী ঘাড় কাত করল। তার ভাল লাগছিল।

.

যতক্ষণ ভেতরে ছিল মনে হচ্ছিল এ এক রহস্যপুরী, যা দেখা যায় তার চেয়েও যা দেখা যায় না তার চিন্তাই যেন বিহ্বল করে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় উদাসীন বিরাটাকার কত যন্ত্র ধ্যানীর মতন বসে আছে, কোথাও তার ভ্রূক্ষেপ নেই, অথচ তার আভ্যন্তরিক রহস্যের পরিচয় শুনলে বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। দুর্বোধ্যের সামনে দাঁড়ালে চমৎকৃত হবার যে স্বাভাবিক আবেগ, গগনরা সেই আবেগে চমৎকৃত ও বিহ্বল হচ্ছিল। অবনীর পক্ষে বিমূঢ় অথবা বিস্মিত হবার কোনও কারণ ছিল না। বরং পাওয়ার হাউসের ছোকরা মতন শিফট ইঞ্জিনিয়ার শ্রীবাস্তব যা দেখাচ্ছিল এবং বোঝাচ্ছিল অবনী তার বিস্তৃত ও সরল ব্যাখ্যা করে গগনদের কৌতূহলকে মোটামুটি পরিতৃপ্ত করছিল। যন্ত্রের সেই জটিল জগৎ, যেখানে কেমন একটি নিরবচ্ছিন্ন গুঞ্জন ছিল, যেখানে প্রত্যক্ষের চেয়ে অপ্রত্যক্ষে এবং অন্তরালে কত বিচিত্র কিছু হয়ে যাচ্ছিল, যেখানে আলোকিত মঞ্চে কয়েকটি মাত্র কুশীলব দৈত্যসদৃশ লৌহপিণ্ডকে করতলগত করে রেখেছিল–সেই জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে গগন বলল, এসব দেখলে মানুষের ওপর ভক্তি বেড়ে যায়। জলস্থল তাও তার হাতে বাঁধা পড়ল।

ততক্ষণে সন্ধে হয়ে গেছে। চারপাশে কেমন একটা ময়লা আলোর ভাব, টিলা আর পাহাড়, গাছপালার অন্ধকার, কৃষ্ণপক্ষের শুরু, চাঁদ উঠে আসছে, দুরে দুরে বাতি জ্বলছে, যেন একটি আলোর মালা সমস্ত উপত্যকার গলায় ঝোলানো, বাতাসের ধারালো চোট গায়ে লাগছে, কুয়াশা ঝাপসায় ডান দিকের বাঁধটি মাঝরাতের তেপান্তরের মাঠের মতন দেখাচ্ছিল।

হৈমন্তীর শীত করছিল, গগন কুঁকড়ে গিয়েছে। বিজলীবাবু কান মাথা ঢেকে নিয়েছেন চাদরে। খানিকটা পথ চড়াই উঠে ইনসপেকশান বাংলো।

গগন শীতের চোটে সিগারেট ধরাল। বলল, ভেতরে যতক্ষণ ছিলাম মনেই হয়নি বাইরে এ রকম ঠাণ্ডা।

বিজলীবাবু বললেন, একে উঁচু জায়গা, পাহাড়ি; তার ওপর ওই বেঁধে রাখা জলকুল কিনারা দেখছি না; শীতের দাপট রাত্রে বোঝাবে।

হৈমন্তীর মনে হচ্ছিল একটা স্কার্ফ কিংবা মাথায় গলায় জড়ান কিছু যেন না নিয়ে এসে সে ভুল করেছে। নিয়ে নিলেই হত। গাড়ি থেকে নেমেই তারা সটান চলে এসেছিল। জিনিসপত্র যা, বেহারা-খানসামাগুলো ঘরে নিয়ে চলে গেল। বাংলোয় তারা ঢোকেনি পর্যন্ত। …একটা জিনিস হৈমন্তী লক্ষ করল, অবনীর চাকরির মর্যাদা এখানে বেশ। তার পরিচয়–অন্তত সরকারি পরিচয় এরা জানে হয়তো, খাতির কিছু কম করল না। সাধারণের জন্যে যা নিষিদ্ধ, নানা বিষয়ে যে কড়াকড়ি তার কিছুই তাদের পোয়াতে হল না। দিব্যি সব ঘুরে ফিরে বেড়িয়ে দেখে এল।

রাস্তাটা সুন্দর, পাহাড়ের গায়ে গায়ে ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে, তফাতে তফাতে বাতি, পাশে গাছপালা, নীচে তাকালে স্টাফ কোয়ার্টার্সের আলো চোখে পড়ে। ওপাশে দৈত্যের মতন ড্যাম।

অবনী বলল, আপনার বোধহয় কষ্ট হচ্ছে?

হৈমন্তী হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিল, তেমন কিছু নয়; একটু ঠাণ্ডা লাগছে।

 আর বেশি হাঁটতে হবে না, কাছেই…

আপনি এখানে মাঝে মাঝে আসেন?

 না; বার দুয়েক কাজে আসতে হয়েছে।

আপনাকে চেনে…

ঠিক সেভাবে নয়। তবে এখানের যিনি কর্তা ছিলেন মিস্টার মজুমদার তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। কাজের ব্যাপারেই হয়েছিল। চমৎকার মানুষ। তিনি এখন নেই। বদলি হয়ে গেছেন।

বিজলীবাবু ও গগন অন্যপাশে কথা বলছিল।

কথা বলতে বলতে পথটুকু পেরিয়ে এসে ওরা বাংলোয় উঠল।

.

দুটো ঘর, প্রায় মুখোমুখি। মাঝখানে ঢাকা বারান্দা। ঘরে আসবাবপত্রের বাহুল্য না থাকলেও মোটামুটি খাট, টেবিল, চেয়ার ছিল; দেওয়ালে গাঁথা র‍্যাক। ঘরের লাগোয়া বাথরুম। ঘরের জানলায় কাঁচ আর খড়খড়ি।

বেয়ারা-খানসামাগুলো জিনিসপত্র ঘরে তুলে রেখেছিল।

 চায়ের পাট বসল পুবের ঘরটায়। জানলা বন্ধ, দরজা ভেজানো, বাতি জ্বলছে, ঘরের আবহাওয়ায় অনেকটা স্বস্তি পাচ্ছিল হৈমন্তী।

গরম জল, রাত্রের খাওয়া-দাওয়া, ঘরে আগুন তুলে দেবার ব্যবস্থা ইত্যাদির তদারকি শেষ করে এসে অবনী বলল, আপনাদের বিছানাপত্র পেতে দিক; গরম জল দিচ্ছে বাথরুমে মুখহাত ধুয়ে বিশ্রাম করে নিন খানিক। আমরা ওঘরে আছি।

অবনী আর বিজলীবাবু তাদের ঘরে চলে গেল।

.

ঘরে এসে বিজলীবাবু বললেন, মিত্তিরসাহেব, সবই তো ভাল হল, কিন্তু শেষরক্ষা হবে তো?

অবনী বুঝতে পারল না, সিগারেট ধরাতে ধরাতে তাকাল।

 বিজলীবাবু হেসে বললেন, অমন হুইস্কিটার একটা গতি করা দরকার।

অবনী হেসে ফেলল।

বিজলীবাবু চাদর বালিশ বের করতে করতে বললেন, আমি ভেবেছিলাম উনি আসবেন না। …যখন শুনলাম আসছেন তখন থেকেই ঝিমিয়ে পড়েছি। মানে, আর কিছু নয়, আমাদের হল চোরের মন, সিদ দেবার আগে ধরা পড়ার ভয় থাকে।

অবনী হাসতে হাসতে জানলা-ঘেঁষা খাটের ওপর গিয়ে বসল, বসে পায়ের ওপর পা তুলে নিয়ে জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে বলল, আপনি তো গুণী লোক, বুঝেসুঝে ব্যবস্থা করুন।

বিজলীবাবু ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন, বললেন, তা তো করতেই হবে, কোলের ছেলে বয়ে এনেছি বাঁধের জলে ভাসিয়ে দিয়ে যেতে তো পারব না।

অবনী জুতোজাড়া খুলে ফেলে গায়ের কোট খুলল। খোলা হোন্ডঅল থেকে র‍্যাগ, স্লিপার এটা ওটা বের করতে লাগল।

খানসামাটাকে সোড়ার কথা বলেছিলেন? বিজলীবাবু শুধোলেন।

 আনিয়ে রাখবে।

তা হলে আমার বিবেচনায়, দুটো মুখে দিয়েও ঘরের দরজা বন্ধ হলেই শুরু করা যাবে।

অবনী মাথা হেলিয়ে সায় দিল।

বাথরুমে জল দিয়ে দিয়েছে বেয়ারা, অবনী চোখে মুখে জল দিতে গেল। বেয়ারা এসেছিল। ঘরদোর বিছানা গুছিয়ে দিয়ে চলে গেল।

বিজলীবাবু তাঁর বিছানাটা হাতে করে ঝাড়লেন, অকারণে, তাঁদের আনা চাদর বালিশই বিছানায় পাতা হয়েছে। বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে আপন মনে গুন গুন করে গাইছিলেন : সে দেখা দেয়, দেয় না, ধরা দিয়ে হায় ধরা দেয় না। বিজলীবাবুর চোখেমুখে কিছু অন্যমনস্কতা; কী ভেবে ভেবে যেন কোনও হাসিও ঠোঁটে লেগে ছিল। স্যুটকেস টেনে দু-একটা কী যেন বের করলেন, মাথার গরম টুপিটাও।

অবনী বাথরুম থেকে সামান্য পরে বেরিয়ে এল, ট্রাউজারস বদলে পায়জামা পরেছে, গায়ে পাঞ্জাবির ওপর পুরু পুলওভার। বিজলীবাবু তখনও চেয়ারে বসে গুন গুন করে গাইছেন :সে যে ধরা দিয়ে ধরা দেয় না, শুধু আশার ভাষায় ফিরে চায় না।

অবনী হেসে বলল, আপনার সেই গান?

সুরটা একবার আনবার চেষ্টা করছিলাম, বিজলীবাবু হেসে হেসে জবাব দিলেন, ঠিক আসে না। বুঝলেন মিত্তিরসাহেব, এও ওইরকমধরা দিয়ে ধরা দেয় না। বলে তাঁর সকৌতুক চাপা চোখ নিয়ে অবনীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন, পরে বললেন, জগতে এ বড় মজার খেলা, না মিত্তিরসাহেব, ধরা দিয়েও ধরা দেয় না।

অবনী বিজলীবাবুর চোখের দিকে দু মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল, তারপর বলল, সব খেলাই মজার। …যান, গরম জল ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, ঘুরে এসে বসুন।

বিজলীবাবু আর কিছু বললেন না, বাথরুমে চলে গেলেন।

অবনী অন্যমনস্কভাবে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকল।

হৈমন্তীর ঘরে বসে গল্পগুজব হচ্ছিল। ঘরে আগুন রেখে গেছে বেয়ারা, জানলা বন্ধ, দরজাও ভেজানো; বাইরে শীতের প্রচণ্ডতা এখন আর অনুভব করা যাচ্ছিল না। গগন খানিকটা গল্পগুজব করার পর বিজলীবাবুর গান শুনতে উঠে গেল। আসলে গগন বিজলীবাবুর সঙ্গে খানিকটা রঙ্গরসিকতা করতে চায়। তা ছাড়া, সে আপাদমস্তক আবৃত হয়েছে, উদ্দেশ্য : বিজলীবাবুকে টেনে নিয়ে পশ্চিমের ঢাকা বারান্দায় গিয়ে জ্যোৎস্নালোকে বাঁধের জল দেখবে।

.

অবনী আর হৈমন্তী মুখোমুখি বসে, হৈমন্তী বিছানায়, অবনী কাছাকাছি চেয়ারে।

অবনী বলল, আপনিও একবার বাইরে গিয়ে দেখলে পারতেন। এতটা উঁচু থেকে সামনের লেকটা দেখতে এখন ভালই লাগত। চাঁদের আলোয় অতটা জল, আশেপাশে পাহাড় জঙ্গল, অদ্ভুত দেখায়।

দেখব হৈমন্তী বলল, এখন উঠতে ইচ্ছে করছে না, কুঁড়েমি ধরে গেছে ঠাণ্ডায়।

আপনারা দুই ভাইবোনেই ঠাণ্ডায় বেশ কাবু হয়ে পড়েন, অবনী হাসিমুখে বলল।

অভ্যেস নেই। গগনের তো একেবারেই নেই, আমি তবু খানিকটা সইয়ে নেবার সময় পেয়েছি। হৈমন্তীও হাসিমুখে জবাব দিল।

তবু সইছে না– অবনী ঠাট্টা করে বলল।

 না। হৈমন্তী মাথা নেড়ে হেসে উঠল।

অবনী চোখ সরাল না, হৈমন্তীর হাসি দেখতে লাগল। তারপর হঠাৎ বলল, আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবে একটা কথা বলি–

হৈমন্তী তাকিয়ে থাকল, মুখের হাসি তখনও মুছে যায়নি।

অবনী বলল, আমার আজকাল মনে হয়, এই জায়গাটা আপনার কোনও দিক থেকেই সইছে না।

 হৈমন্তীর মুখের হাসি মুছে গেল; ভীরুর মতন, হঠাৎ বিচলিত হয়ে পড়ার মতন তার চোখের কোলে এবং পাতায় কেমন অসহায়তার ভাব ফুটল। দৃষ্টি নত করে নিল।

অবনী অপেক্ষা করল, কেন করল সে জানে না; হৈমন্তী কিছু বলবে এই আশায় হয়তো; বা এই দ্বিধায়, হৈমন্তী অসন্তুষ্ট হল কি হল না?

কিছু মনে করলেন?

হৈমন্তী মাথা নাড়ল, না মনে করেনি।

অবনী সামান্য নীরব থেকে বলল, আপনাকে আমি বন্ধুর মতন একটা কথা বলতে পারি। … প্রথম যখন এসেছিলেন কী রকম, মানে আপনাকে অন্যরকম দেখাত; আমার মনে হয়েছিল, আপনিও ডেডিকেটেড, সুরেশ্বরবাবুর মতন, ওই ধরনের কিছু…। আমি বোধহয় ঠিক বোঝাতে পারছি না, নয়– অবনী দ্বিধার হাসি হাসল। সে যাই হোক, আপনাকে এখন তা মনে হয় না। …আপনার এখানে ভাল লাগছে না, আনহ্যাপি। অন্ধ আশ্রমে আপনার কোনও টান নেই। আপনি ডেডিকেটেড নন।

হৈমন্তী নিস্পন্দ বসেছিল; অবনীর দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছিল। তার কোথাও ক্রোধ নেই, বিরক্তি নেই, অসন্তোষ নেই।

অবনী মুহূর্তে কয় অপেক্ষা করল। আমি ভেবে পাই না, ঘরবাড়ি মা ভাই ছেড়ে কেন আপনি এখানে এলেন? …নিজের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে আপনি খুব জীবন্ত। … সুরেশ্বরবাবুর কাজকর্ম আপনি বিশ্বাস করেন না, তাঁর সেবা-টেবা দয়া-ধর্ম এসবেও আপনার মতি নেই। …ক্রিশ্চান নান আমি দেখেছি, আপনি নান নন।

হৈমন্তী পায়ের ওপর থেকে শাল সামান্য তুলে নিল। তার ঈষৎ কুঁজো হয়ে নত মুখে বসে থাকা, তার নীরবতা, অসহায় আড়ষ্ট ভঙ্গি এখন কেমন ছেলেমানুষের মতন দেখাচ্ছিল। যেন এই হৈমন্তীর মধ্যে বয়সের দৃঢ়তা নেই; তার সেই গাম্ভীর্য, পেশার পৃথক মর্যাদা, ব্যক্তিগত সংযম ও গোপনতা আর নেই।

যেখানে আপনার মন নেই, যা ভাল লাগে না, যাতে বিশ্বাস নেই–সেখানে আপনি কেন এলেন আমি জানি না। অবনী যেন ধৈর্য হারাচ্ছিল।

হৈমন্তী হঠাৎ মুখ তুলে তাকাল। বেশিদিন আর থাকব না।

অবনীর মনে হল হৈমন্তীর গলার স্বরে শীতের বাতাসের মতন ঠাণ্ডা কনকনে একটা ভাব ফুটল।

আমার কথায় রাগ করলেন?

 না।

আমার পক্ষে হয়তো এসব কথা বলা উচিত হল না। তবু বললাম। …আপনাকে আমার অদ্ভুত মনে হয়…কেন এসেছেন, কেন আছেন…

কিছু না। হয়তো শখ…

শখ নয়।

তা হলে কিছু ভেবে এসেছিলাম। …আপনি কি শুধু চাকরির জন্যে এখানে এসেছেন?

অবনীর চোখ মুখের ওপর প্রবল জোরে যেন কেউ ফুঁ দিল, চমকে ওঠার মতন হল অবনীর। হৈমন্তীকে দেখল, বলল, সত্যি কথা শুনবেন?

হৈমন্তী তাকিয়ে থাকল।

আমি পালিয়ে এসেছি।

হৈমন্তী কথা বলল না, কিন্তু তার চোখে গভীর কৌতূহল ও প্রশ্ন ছিল, যেন তার দৃষ্টি বলছিল : পালিয়ে এসেছেন? কিন্তু কেন?

অবনী হৈমন্তীর চোখের বিস্ময় ও প্রশ্ন লক্ষ করতে করতে বলল, আমার আর কিছু ভাল লাগত না, চাকরিবাকরি, বন্ধুবান্ধব, বাড়ি কিছু না। সব কেমন একঘেয়েমির মতন হয়ে উঠেছিল। খুব ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলাম। অবনীর মুখে ক্লান্তি ও বিরক্তির ভাব ফুটছিল, গলার স্বরে হতাশা। বোঝানো মুশকিল, ঠিক যে কী বোঝাতে চাইছি তাও জানি না– অবনী ম্লান একটু হাসল, আমার মনে হত, আমার মধ্যে আর কিছু নেই, শুকিয়ে গেছে, বা যা ছিল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। জীবনের এই অবস্থাটা এত খারাপ…অসহ্য..

হৈমন্তী অপলকে তাকিয়ে থাকল। মনে মনে যেন বোঝবার চেষ্টা করছিল।

কিছু সময় দুপক্ষই নীরব। শেষ পর্যন্ত অবনী এই বিষণ্ণ স্তব্ধতা কাটাবার জন্যে নড়েচড়ে বসল, সিগারেট ধরাল, তারপর বলল, আমার আসার সঙ্গে আপনার আসার কোনও মিল নেই। আমি যেন অনেকটা পালিয়ে কোথাও মাথা লুকোতে এসেছিঃ আপনি তো তা নন–আমার ধারণা, আপনি কোনও আশা নিয়ে এসেছিলেন।

হৈমন্তী অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। তার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেল না, কিন্তু বুকপিঠের ওঠানামা লক্ষ করা গেল।

সামান্য পরে হৈমন্তী হঠাৎ বলল, চলুন, বাইরেটা দেখে আসি।

.

স্বপ্নের মধ্যে দেখা বুঝি; অস্পষ্ট কোমল কেমন এক আচ্ছন্নতার জগৎ যেন স্থির হয়ে আছে। হিম-জ্যোৎস্নায় জড়ানো চরাচর, ব্যাপ্ত শূন্যতার মধ্যে কোনও স্তব্ধ শান্ত বিশাল এক হ্রদ যেন পড়ে আছে, নীচে, দূরে রেখার মতন পার্বত্য অঞ্চল, স্যুইস গেটের পদতলে বিষণ্ণ এক নদী। হৈমন্তী শূন্য দৃষ্টিতে দেখছিল, তার চেতনার কোথাও বুঝি কিছু ছিল যার অদ্ভুত এক অনুভূতি তাকে নির্বাক, পরম দুঃখী, বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ করে তুলেছিল। বাঁধের জলের দিকে চোখ রেখে হৈমন্তী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল, শীত আবার তাকে শিহরিত করল।

অবনী বলল, ঘরে যাবেন?

হৈমন্তী নীরব। তার মাথায় ঘোমটার মতন শাল জড়ানো, শালের পাড়ের একটা পাতা কপালের কাছে শুকনো পাতার মতন কালচে দেখাচ্ছিল।

চলুন যাই– হৈমন্তী বলল, কেমন যেন লাগে দেখতে—

থাকবেন আর খানিকটা?

না। আমার বেশি ঠাণ্ডা লাগানো উচিত হবে না– হৈমন্তী ফেরার জন্যে পা বাড়াল। ফিরতে ফিরতে বলল, আজ এসে ভালই করেছি। না এলে কত কিছু দেখতে পেতাম না।

অবনীর মনে হল, হৈমন্তী কত কিছু কথাটা যেন কেমন করে বলল।

.

মাঝ এবং শেষরাতের কোনও সময়ে অবনীর ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল, কে যেন তাকে ডাকছে। নেশায় সে কিছু শুনছে কি শুনছে না, অথবা ঘুমের ঘোরে শুনছে, বুঝল না। ঘর অন্ধকার। বিজলীবাবু অঘোরে ঘুমোচ্ছেন, তাঁর শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

অবনী বালিশ থেকে সামান্য মাথা তুলে শোনবার চেষ্টা করল, কে তাকে ডাকছে।

.

২৫.

গভীর স্তব্ধতার মধ্যে অবনী কিছুক্ষণ উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করল; কোনও সাড়া শব্দ নেই, কেউ তাকে ডাকছে না। মনে হল, সে ঘুমের মধ্যে জেগে উঠেছে, জেগে ওঠার সময় মনে হয়েছিল কেউ ডাকছে; বা স্বপ্নের মধ্যে সে কাউকে ডাকতে শুনেছিল। অথচ কোনও স্বপ্ন অবনীর মনে পড়ল না। সহসা ডাক শুনে ঘুমের মধ্যে জেগে ওঠায় সে সামান্য চঞ্চল ও বিস্মিত হয়েছিল; ভ্রম দূর হলে নিশ্বাস ফেলল।

বালিশে মাথা রেখে চোখের পাতা বুজে অবনী আবার ঘুমোবার চেষ্টা করল। অন্ধকারে কয়েকটা মাছির মতন তার চোখের পাতার তলায়, চেতনায় কী যেন উড়ছিল; তারপর মনে হল, মাছিগুলো উড়ে গেলে সরষের দানার মতন কী যেন বা এক মুঠো তিল তার চোখ, নাক এবং কপালের মাঝখানে ভুরুর কাছাকাছি কেউ ছুঁড়ে দিল। অবনী অস্বস্তি বোধ করল। কিছু না, তবু এই মাছি বা দানার মতন কোনও কিছুর অনুভূতি চোখের ওপর ভুরুর কাছে অনুভব করা অস্বস্তিকর। অবনী চোখ খুলল।

চোখ চেয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সে শুয়ে থাকল। মনে করবার চেষ্টা করল, কোনও স্বপ্ন দেখেছিল কি না। কোনও স্বপ্নের কথা তার মনে পড়ল না; এইমাত্র মনে পড়ল যে–ঘুমের মধ্যে কোনও এক সময়ে সে সুরেশ্বরকে দেখেছিল। সুরেশ্বর নির্জন কোন পথ দিয়ে যেন হনহন করে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ মাটি থেকে ওপরে উঠে হাত পা এলিয়ে মাথা উঁচু পা নিচু করে বাতাসে ভেসে যাওয়া মস্ত একটা খোলা খবরের কাগজের মতন ভেসে যেতে লাগল। হাড়গোড়বিহীন রক্তমাংসশূন্য সেই অদ্ভুত মানুষটিকে দেখে অবনী প্রথমে ভীষণ অবাক হল, পরে মশাই মশাই বলে ডাকল। পরের আর কিছু অবনীর মনে পড়ল না! .. সুরেশ্বর তাকে উড়ন্ত অবস্থায় ডেকেছিল বা দেখেছিল বলেও অবনীর মনে হল না।

গায়ের র‍্যাগ গলার ওপর চিবুক পর্যন্ত তুলে নিল অবনী। ঘরের বাতাস শীতে যেন জমে শক্ত হয়ে আছে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। বিজলীবাবু জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন, তাঁর নাক বন্ধ হয়ে গেছে। হুইস্কির গন্ধ ঘরে আছে কি না অবনী বুঝতে পারল না।

কখনও চোখ বন্ধ করে, কখনও চোখ চেয়ে অবনী শুয়ে থাকল, অপেক্ষা করল, ঘুম এল না। শেষে একটা সিগারেট ধরাল। ধীরে ধীরে, গলা ভরতি করে কয়েক টান ধোঁয়া নিল, খেল, হাই তুলল একবার, তারপর পাশ ফিরে শুয়ে থাকল। হাতের আঙুলে সিগারেট জ্বলছে।

ঠিক কেন যে ঘুম ভেঙে গেল অবনী বুঝতে পারল না, কিন্তু তার মনে হল, ঘুম আর আসবে না। তন্দ্রাচ্ছন্ন অথবা আলস্যের কোনও ভাব নেই, তার চোখ বুজে আসছে না, এমনকী সে ক্লান্তি অনুভবও করছে না। অথচ কী যেন তাকে স্থির হতে দিচ্ছিল না, অব্যবস্থচিত্তের মতন সে অস্বস্তি বোধ করছে।

এখন কত রাত হতে পারে অবনী অনুমান করার চেষ্টা করল। তিনের কম নয়, অবনী অন্যমনস্কভাবে হিসেব করল, তাদের শুতে শুতে বারোটা বেজে গিয়েছিল প্রায়, ঘণ্টা তিনেক সে নিশ্চয় ঘুমিয়েছে, হুইস্কির পর আরও ভাল ঘুম হওয়া উচিত ছিল। এখন সে প্রায় কিছুই অনুভব করছে না।

শুকনো গলায় আচমকা এক মুখ সিগারেটের ধোঁয়া টেনে ঢোঁক গিলতে গিয়ে কণ্ঠনালী জ্বালা করল; কাশি এল। অবনী কাশল। নিঃশব্দ অসাড় ঘরে নিজের কাশি কানে শুনে হঠাৎ মনে হল, সে অন্য কারও গলার শব্দ পাচ্ছে। মুহূর্ত কয়েকের জন্যে এরকম মনে হলেও অবনী বিশেষ কিছু ভাবল না, আবার চোখের পাতা বন্ধ করে শুয়ে থাকার চেষ্টা করল।

সুরেশ্বর একটা ছড়ানো মস্ত কাগজের মতন বাতাসে ভেসে যাচ্ছে–এই দৃশ্যটা আবার তার মনে এল! এবং তার পরই হৈমন্তীর কথা। হৈমন্তী নির্বোধ। অবনীর মনে হল, কলকাতা থেকে ছুটতে ছুটতে হৈমন্তী একটা উড়ন্ত কাগজ লুটতে এসেছিল, ঠিক যেভাবে কিছু বাচ্চাটাচ্চা কাটা ঘুড়ির পেছনে পেছনে ঘুড়ি লুটতে ছোটে, আর শেষ পর্যন্ত অনেকটা দৌড়োদৗড়ি করে হাঁপিয়ে ঘুড়ি ধরতে না পেরে ফিরে আসে। হৈমন্তীর জন্যে দুঃখ ও সহানুভূতি বোধ করল অবনী।

সিগারেটের টুকরোটা আঙুল থেকে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, পোড়া সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ নাকে লাগতে অবনী উঠব কী উঠব না করে শেষ পর্যন্ত উঠল। অন্ধকারে লাইটার জ্বেলে আলোর সুইচ দেখল, আলো জ্বালল। পোড়া সিগারেটের টুকরোটা নিবিয়ে বাথরুমে গেল।

ফেরার পথে অবনী ঘড়ি দেখল, সাড়ে চার। তার অনুমান ভুল হয়েছিল তবে। প্রায় ভোর হয়ে আসছে। আর সামান্য পরেই সকাল। আপাতত কী করা যায় অবনী বুঝতে পারল না। তার ঘুম আসবে আর, চুপচাপ বিছানায় শুয়ে সময় কাটানো ছাড়া উপায় নেই। বাতিটা অকারণে ঘরের মধ্যে জ্বালিয়ে রাখতেও তার ইচ্ছে হল না।

শুকনো কাশি কাশল বার কয়েক, পুলওভারটা টেনে নিয়ে গায়ে দিল, ঠাণ্ডা লাগছিল। বাতি নিবিয়ে আবার বিছানায় এল।

কিছুক্ষণ চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে অবনী যেন অস্পষ্ট ভাবে অনুভব করল, যে অস্বস্তিবশে সে জেগে উঠেছে সেই অস্বস্তি তার বুকের কোথাও এতক্ষণ লুকিয়ে ছিল, এখন আবার দেখা দিতে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা লাগার বেদনার মতন একটি বেদনা অবনী অনুভব করছে। এই বেদনা সম্পূর্ণ শারীরিক হতে পারে, হয়তো রাত্রের দিকে ঠাণ্ডা লেগেছে। বা এই বেদনা শারীরিক নাও হতে পারে, কিছু বোঝা যায় না।

বুকে হাত রেখে অবনী বেদনা অনুভব করল। কখন ঠাণ্ডা লেগেছে, কী ভাবে লেগেছে সে অনুমান করার চেষ্টা করল, পারল না। অগত্যা নিজের বেদনার ওপর সেঁক দেবার মতন গরম হাতটি রাখল, আস্তে আস্তে হাত ঘষল। হাত ঘষার সময় তার বুকের পাঁজরার একটি ভাঙা হাড়ের ওপর বুড়ো আঙুল রেখে স্থির হয়ে থাকল।

তার বুকের পাঁজরার একটি হাড় ভাঙা, কবে ভেঙেছিল মনে নেই, নিশ্চয় খুব ছেলেবেলায়, যখন তার তেমন কোনও জ্ঞান জন্মায়নি, পরে ভাঙলে তার মনে থাকত। হাড়ের জোড়টায় কিছু খুঁত তখন থেকেই থেকে গেছে, জোড়ের জায়গাটা সামান্য উঁচু, আঙুল দিলে বোঝা যায়। অসতর্কভাবে হাত পড়ে গেলে কিংবা জোরে কিছু লাগলে ব্যথা লাগে। না, ঠিক, ব্যথা নয়, বেদনার মতন। হয়তো বাস্তবিকই ওখানে কোনও ব্যথা নেই, তবু কোনও কারণে ছেলেবেলা থেকেই মানসিক একটা বেদনার ভাব ওখানে জমে উঠেছে। একবার, অবনীর মনে পড়ল, ললিতা বিছানার মধ্যে খেলাচ্ছলে তার বুকের ওপর মাথা রেখে গড়াগড়ি করছিল, হঠাৎ সে মাথা তুলে আবার যখন মাথা রাখতে গেল অবনী তীব্র বেদনা বোধ করেছিল। ললিতাকে বলেছিল, এই জায়গাটা বাঁচিয়ে ললিতা আঙুল বুলিয়ে জায়গাটা দেখেছিল; সে পরে অনেকবার ওখানে আচমকা ধাক্কা মেরেছে, হাতের বালা দিয়ে আঘাত করেছে, এমনকী প্রাণপণে হাতের মুঠো ছুঁড়েছে যাতে অবনী ভীষণ কোনও ব্যথা পায়। আশ্চর্য, অবনী যা লুকিয়ে-চুরিয়ে বাঁচাতে চাইত, যে-আঘাত সে ভয় করত, ললিতা তা বাঁচাতে দিত না। ললিতার কাছে অবনীর এই দুর্বলতা কেন যে সুখকর আনন্দ ছিল অবনী বুঝতে পারত না। তার শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের জন্য অবনীর ভয় বা ক্লেশ ছিল না, ললিতা হিংস্রভাবে সেই সব অঙ্গপ্রতঙ্গ দংশন করলেও অবনী অনায়াসে সহ্য করতে পারত।

ললিতার কথায় এবং বুকের বেদনার বিচ্ছিন্ন চিন্তার মধ্যে অবনীর হঠাৎ মনে হল, সে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে; জলের মধ্যে ডুবে সাঁতার কেটে খেলা দেখাবার সময় শরীর যেমন নির্ভার হয় এবং হাত পা গা শিথিল হয়ে ভাসে। অল্পক্ষণ এই রকম মনে হলেও অবনী আবার স্বাভাবিক অনুভবের মধ্যে ফিরে এল। নিজের এই রকম শিথিল নির্ভার অনুভূতি তাকে সুরেশ্বরের কথা মনে করাল। সুরেশ্বরের মতন সেও কী উড়ন্ত কাগজের মতন ভাসবে? অবনী হাসল, মৃদু হাসি।

অথচ, আরও কয়েক দণ্ড পরে, অবনী পুনরায় অনুভব করল তার জাগ্রত ও শায়িত অবস্থার মধ্যেও সে ভেঙে যাচ্ছে, বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। নিজের ভিন্ন দুই অস্তিত্ব অনুভব করার সময় আয়নার সামনে মুখোমুখি দাঁড়ানোর কথা ভাবা চলে। অবনী তেমন কিছু ভাবল না, বরং তার মনে হল, কী যেন তার শরীরের তলা থেকে উঠে এসে তাকে জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। ছেলেবেলায় অবনী তার মার একটা ছবি দেখত : মা অবশ বিহ্বলা যুবতী হয়ে পালঙ্কে শুয়ে আছে, আর মার মাথা, পা ও পিঠের দিক থেকে কটি বৃহৎ ধূপদানের ধোঁয়া মাকে যেন জড়িয়ে ধরছে। ছবিটা মার থিয়েটারের, রংচঙে, ফ্রেমে বাঁধানো ছিল। ওই ছবি সম্পর্কে মার দুর্বলতা ছিল, কেননা ওইনাটকে মা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা এবং সোনার মেডেল পেয়েছিল। অবনীর বারবারই মনে হত, ছবিটা শ্মশানঘাটে চাপানো চিতার মতন। সতীদাহের কোনও জমকালো দৃশ্য।

অবনী এসময় আবার একটা সিগারেট ধরাল। হয়তো কিছুই নয়, তবু লাইটারের আলো, ঠোঁটের সিগারেট এবং ধোঁয়ার ঘ্রাণ থেকে এই মুহূর্তে নিজের জীবন্ত অস্তিত্বটা পরখ করে নেওয়া হল। চুপচাপ, আস্তে আস্তে সিগারেট খেতে লাগল অবনী। আপাতত তার আর কিছু মনে হচ্ছিল না।

কিছুক্ষণ মানসিক স্থিরতার মধ্যে কাটল। এলোমেলো বিশৃঙ্খল চিন্তা বুদ্বুদের মতন উঠছিল, কিন্তু অবনী তাতে মনোযোগ দিচ্ছিল না। ক্রমশ সিগারেট শেষ হল। সিগারেটটা ফেলে দেবার আগে আর-এক মুখ ধোঁয়া নেবার সময় সহসা সে অনুভব করল, কী যেন এবং কিছু যেন তার মধ্যে থেকে বাইরে আসার জন্যে ছটফট করছে, চাপা এবং অনির্দিষ্ট এক ব্যাকুলতা এতক্ষণে তীব্র হয়ে আসছে। ফলে গলা এবং বুকের কাছে শ্বাস থেমে গিয়ে কেমন কষ্ট হচ্ছে। অবনী সিগারেটের ধোঁয়া গিলে নিল। তার বুকের পুরনো ভাঙা হাড়ের জায়গাটা কনকন করে উঠল।

বিছানার ওপর উঠে বসে সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিয়ে নিবিয়ে ফেলল অবনী। বসে থাকল কয়েক দণ্ড। অন্ধকারে তার মনে হল, খুব কাছাকাছি প্রায় মুখের সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। এমনকী এখন তার মনে হল, হাত বাড়ালে সামনের মানুষটিকে সে স্পর্শ করতে পারে। কী কারণে অকস্মাৎ তার বুকে উত্তেজনার তাপ সঞ্চারিত হল, মুহূর্তের জন্যে ভীত এবং সঙ্গে সঙ্গে আবেগবশে অস্থির হয়ে ওঠায় হৃদপিণ্ড দ্রুত হয়ে উঠল। সেই অন্ধকারে অবনী হৈমন্তীর উপস্থিতি অনুভব করল।

অবনীর কেমন সন্দেহ হল। সন্দেহ হল, সে হৈমন্তীর স্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছিল। সুরেশ্বরের সেই অদ্ভুত উড়ন্ত অবস্থাটি দেখার পর, হয় সেই বিক্ষিপ্ত স্বপ্নের সঙ্গে জড়িয়ে, অথবা আলাদা ভাবে হৈমন্তীকে দেখেছিল। যেমন করে চোখ বন্ধ করে ভুরুতে আঙুল রেখে অবনী কোনও প্রয়োজনীয় চিন্তা করে সেইভাবে চোখ বুজে হাতের আঙুলে ভুরু টিপে সে স্বপ্নের দৃশ্যটি মনে করবার চেষ্টা করল।

আশ্চর্য, কিছুই মনে আসছে না। কিছুই নয়। যেন অবনী অন্ধ, অন্ধতাহেতু সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে।

অবনী এতক্ষণে তার ঘুম ভেঙে জেগে ওঠার কারণটা যেন ধরতে পারল। এরকম হয়, চোখের সামনে অনেক জিনিসের মধ্যে ছিল বলে বোঝা যায়নি যে কিছু হারিয়ে গেছে;হঠাৎ চোখে পড়ল, বা খেয়াল হল, ওটা হারিয়ে গেছে। হৈমন্তীকে অবনী স্বপ্নে দেখেছিল কি না অথবা স্বপ্নে হৈমন্তী তাকে ডেকেছিল কি না–অবনী মনে করতে পারল না; কিন্তু নিঃসন্দেহে অনুভব করল তার সমস্ত অস্থিরতার মধ্যে হৈমন্তী রয়েছে। এই যে ঘুম ভেঙে গেছে, এই যে সে এক টুকরো স্বপ্নে সুরেশ্বরকে গা-হাত-পা এলিয়ে বাতাসে ভাসতে দেখেছে, ললিতার কথা এবং তার বুকের ভাঙা হাড়ের বেদনার কথাও তার মনে আসছে–এ-সবই হৈমন্তীর জন্যে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার নানারকম অদ্ভুত চিন্তা, এক একবার এক এক রকম মনে হওয়া, ঘুম না আসা, অস্থিরতা বোধ সমস্ত কিছুর পিছনেই হৈমন্তী।

হারানো জিনিসটা খুঁজে পেলে যেরকম স্বস্তির নিশ্বাস ফেলা যায়, অবনী অনেকটা সেই রকম নিশ্বাস ফেলল স্বস্তির। তার উত্তেজনা, অস্থিরতা কমে এল। প্রায় শান্ত স্থির হয়ে বসে থাকল কিছু সময়।

বসে থাকতে থাকতে অবনী মনে মনে হৈমন্তীকে সামনে বসিয়ে রেখে একটা কাল্পনিক কথোপকথন তৈরি করছিল :

আপনি তা হলে ফিরে যাবেন? অবনী বলছিল।

 যার।

সুরেশ্বর বোধহয় খুব আশা ভরসা করে এনেছিল।

অন্য কাউকে আনবে।

ডাক্তার…

হ্যাঁ…

আপনাকে ঠিক সেভাবে বোধহয় সুরেশ্বর আনেনি।

 কী জানি। নিজের স্বার্থে এনেছিল।

আমার প্রথম প্রথম নানারকম কৌতূহল ছিল; পরে দেখলাম–আপনি ওকে ভালবেসেই এসেছিলেন। …আপনাদের অনেক দিনের পরিচয়…

অনেক দিনের।

 ভালবাসা?

 হৈমন্তী জবাব দিল না।

অবনী বোধহয় বুঝতে পারল। বলল, সুরেশ্বরকে আমি আকাশে উড়তে দেখলাম। স্বপ্নে। আপনি সার্কাসে ট্রাপিজ খেলা দেখেছেন? ট্রাপিজ খেলোয়াড়রা যেভাবে হাত তুলে পা সোজা করে ঝাঁপ দেয়, অনেকটা সেইরকম ভঙ্গিতে সুরেশ-মহারাজ আকাশ দিয়ে উড়ছে। …বেশ মজার স্বপ্ন।

হৈমন্তী জবাব দিল না; কিন্তু মনে হল সে বর্ণনাটা উপভোগ করল।

অবনী হাসল; হাসতে হাসতে হঠাৎ সে কেমন আক্রোশ অনুভব করল সুরেশ্বরের ওপর। বলল, একটা উড়ন্ত মানুষকে ধরবার জন্যে ছোটাছুটি করাটা ছেলেমানুষি, নিছক খেলা। …আমার ধারণা, এ রকম খেলা কোনও কাজের নয়।

আমি আর খেলছি না।

ফিরে যাচ্ছেন।

হ্যাঁ।

অবনী একটু ভাবল। আর থাকতে পারেন না?

না; কী হবে থেকে।

সুরেশ্বরের অন্ধ আশ্রমে থাকার কথা বলছি না। …অন্য কোথাও।

হৈমন্তী চোখ তুলে তাকাল। তাকিয়ে থাকল। তার দুই চোখ বড় হল, টলটল করে উঠল, ঘনান্ধকার চোখের মধ্যে অতি দূরে বিজলী ঝলকের মতন চোখের তারায় চকিতের জন্যে আলো ফুটল।

অবনী বলল, আপনাকে আমার ভাল লাগে।

জানি, হৈমন্তী অস্ফুটস্বরে জবাব দিল।

 অবনী চঞ্চল হল, অস্থিরতা বোধ করল। তা হলে যাবেন না।

হৈমন্তী যেন ভাবল সামান্য, কী যেন বলল, এত ধীরে এবং জড়ানো গলায় যে অবনী শুনতে পেল না। তার মনে হল, হৈমন্তী বলল : আপনার কি মনে হয়, আমি থাকতে পারি?

অবনী সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বলতে যাচ্ছিল, হ্যাঁ–পারেন; কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারল না, কী যেন বাধা এল, কথাটা জিবের ওপর থেমে থাকল।

হৈমন্তী তার দিকে অপলকে চেয়ে আছে। অবনী বিব্রত বোধ করছিল। যে বাধা তার মুখের ওপর হাত চাপা দিয়ে শক্ত হয়ে পড়ে আছে সেই বাধা সরাবার জন্যে সে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করল : যেন ঝটকা মেরে এই কুৎসিত হাতটা সরিয়ে দিতে চাইল। পারল না। না পেরে অসম্ভব ক্রোধে এবং ঘৃণায় ললিতা ও কুমকুমের দিকে তাকাল। ওরা দুজন যেন কখন নিঃশব্দে, অবনীর অজ্ঞাতে কাছে এসে গেছে।

অবনী চুপ; হৈমন্তী অপেক্ষা করছে। এতটা বিলম্ব যেন তার প্রত্যাশিত নয়।

আমি জোচ্চোর, প্রবঞ্চক বা শঠ হতে পারি না, অবনী অস্থিরভাবে মাথা নাড়ল, ঠকানো মুশকিল। শেষ পর্যন্ত অবনী বলল, আমার স্ত্রী ছিল, মেয়ে আছে। স্ত্রীর সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। ডিভোর্স চেয়ে নেব।

মেয়ে!

কুমকুম। …কুমকুমকে.অবনী ব্যাকুল চোখে হৈমন্তীর দিকে তাকাল। যেন বলতে চাইল, কুমকুম। বাচ্চা, সে কলকাতায় তার মার কাছে আছে, অযত্নে, নানা অভাব-অসুবিধের মধ্যে, তার মা তাকে নষ্ট করে ফেলছে, কুমকুম দেখতে বড় সুন্দর : ছিপছিপে, ফরসা, তার গলার স্বর খুব মিষ্টি; কাছে রাখলে যত্ন করলে, ভাল শিক্ষা দিলে… পাগলের মতন এবং ভীষণ অস্থিরতার মধ্যে অবনী এইসব ভাবতে ভাবতে বা বলার জন্যে ব্যাকুল হয়েও শেষ পর্যন্ত কিছু বলতে পারল না।

হৈমন্তী বলল, মেয়েকে আপনি ছাড়তে পারেন না।

অবনীর কেমন অদ্ভুত এক দুঃখ হল। যাকে সে ধরে রাখেনি, তাকে ছাড়ার কথা ওঠে না। তবু, মেয়েকে ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা অন্যরকম। অস্বীকার কি? অবনীর পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।

হৈমন্তী বলল, আপনি বলছিলেন, আপনার মধ্যে কিছু নেই, শুকিয়ে গেছে–পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে…

তাই মনে হত।

এখনও মনে হয়? হৈমন্তী যেন স্নিগ্ধ সুন্দর করে হেসে বলল।

অবনী চুপ করে থাকল। মুখ নিচু করে কিছু ভাবছিল। তারপর যখন চোখ তুলল–হৈমন্তীকে আর দেখতে পেল না।

শুন্য দৃষ্টিতে অবনী কিছু সময় বসে থাকল। কল্পনায় হৈমন্তী এসেছিল। চলে গেছে। অথচ অবনীর মনে হচ্ছিল, এই আসা-যাওয়ার মধ্যে হৈমন্তী হঠাৎ যেন তার বুকের পুরনো বেদনার জায়গায় পরম সহানুভূতিতে হাত বুলিয়ে গেছে।

কুয়ার মধ্যে মুখ ঝুঁকিয়ে দেখার মতন অবনী তার হৃদয়কে দেখার চেষ্টা করছিল। একসময় তার মনে হয়েছিল প্রখর তাপে, অসহ দাহে যেমন করে কুয়ার জল শুকিয়ে যায় এবং অভ্যন্তরে, গভীরে জলস্তরও শুকিয়ে আসে–সেই রকম তার সমস্ত হৃদয় আদ্রতাহীন ও শুষ্ক হয়ে গিয়েছিল। কোথাও কোনও রকম আর্দ্রতা ছিল না। অথচ এখন মনে হচ্ছে, কেমন করে যেন তার শুষ্ক ক্লান্ত হৃদয়ে কিছু আর্দ্রতা সৃষ্টি হয়েছে। হয়তো এই আর্দ্রতার সম্ভাবনা কিছু ছিল, অবনী খেয়াল করেনি। সম্ভবত এখন সেই আর্দ্রতা জলবিন্দুর মতন চুঁইয়ে চুঁইয়ে ক্রমে ক্রমে কিছুটা সঞ্চিত হয়েছে। হয়তো তার পক্ষে এখন এই সজীবতা অনুভব করা সম্ভব হচ্ছে।

কোনও আশ্চর্য সান্ত্বনার মতন, সুখের মতন অবনী প্রসন্ন বোধ করছিল।

দরজা খুলে বাইরে এল অবনী। সবেমাত্র বুঝি প্রত্যুষ হয়েছে। চারদিকে কুয়াশা, কুয়াশা এবং হিমের স্তরে স্তরে ভোরের সাদাটে আলো জমছে, কনকন করছে ঠাণ্ডা, এখনও বড় বেশি কিছু চোখে পড়ছে না, কুয়াশা এবং অস্পষ্টতায় ঢেকে আছে।

শীতে আড়ষ্ট হয়ে কাঁপতে কাঁপতে অবনী কয়েক পা এগিয়ে গগনদের ঘরের দিকে এল। দরজা জানালা বন্ধ। গগনরা এখনও ঘুমোচ্ছে। অবশ্য ঘণ্টাখানেক সময় আছে। তারপর ফিরতে হবে। রোদ ওঠার সময় সময় অবনী বেরুতে চায়।

ঘরের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে থাকার সময় অবনীর চোখে পড়ল দরজার তলা দিয়ে আলো আসছে। গগনরা কি উঠে পড়েছে? নাকি আলো জ্বেলে রেখেই শুয়েছিল? বা এমনও হতে পারে, এই মুহূর্তে কেউ জেগে উঠেছে। অবনী অপেক্ষা করল। চারপাশ এত হিম হয়ে আছে যে অবনী কেঁপে উঠল আবার। গগনদের ঘরের বাতি নিবছে না। তবে কি ওরা জেগে উঠেছে? কে জানে, হয়তো এভাবে নতুন জায়গায় ওদের ঘুম হয়নি, গগনের বা হৈমন্তীর।

ঘরের মধ্যে থেকে কোনও সাড়া শব্দ আসছিল না। অবনীর মনে হল না, দুজনেই জেগে আছে।

দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল অবনী, ইতস্তত করে আঙুলের টোকা দিল দরজায়। কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। শীতের দাপটে আঙুল এত ঠাণ্ডা হয়েছিল যে, জোরে টোকা দেওয়া যাচ্ছিল না। এবার অবনী মুঠো করে দরজায় শব্দ করল।

কে? ভেতর থেকে হৈমন্তীর গলা শোনা গেল।

 আমি।

হৈমন্তী দরজার ছিটকিনি নামাল, শব্দ পেল অবনী।

দরজা খুলে দিল হৈমন্তী। গরম চাদরে তার মাথা গলা বুক জড়ানো।

বাতি জ্বলছে দেখে ডাকলাম, অবনী বলল, সকাল হয়ে গেছে। বলে হৈমন্তীর ভোরবেলার বাসি মুখের দিকে তাকাল। সকালের এই মুখে রাত্রের, বালিশের, চুলের, ঘুমের, হয়তো বা জাগরণের কেমন এক অদ্ভুত স্বাদ মাখানো আছে।

হ্যাঁ, আমি জেগে ছিলাম। ঘড়ি দেখেছি।

ঘুমোননি? ঘুম হয়নি? অবনী বলল। বলার সময় নজরে পড়ল তার কথার সঙ্গে সঙ্গে মুখ থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে।

ওই এক রকম। …খুব ঠাণ্ডা, ভেতরে আসুন।

চৌকাঠের কাছ থেকে অবনী ভেতরে পা দিল। গগনবাবু খুব ঘুমোচ্ছন। … আপনার কি নতুন জায়গায় ঘুম হয় না?

খানিকটা। অস্বস্তি হচ্ছিল। ঠাণ্ডাও খুব।

 সারারাত জেগে?

 না, মাঝে মাঝে ঘুমিয়েছি।

 তবে তো কষ্টই হল।

না, কষ্ট কীসের?

আমারও ভাল ঘুম হয়নি; অনেকক্ষণ থেকে জেগে আছি। অবনী হৈমন্তীর চোখের দিকে তাকাল। মনে হল যেন সে বোঝবার চেষ্টা করছে হৈমন্তীর ভাল ঘুম না হবার বা জেগে থাকার অন্য কোনও কারণ আছে কিনা।

বিছানার খানিকটা পরিষ্কার করে হৈমন্তী যেন বসার মতন ব্যবস্থা করল। বলল, আমরা বেরুব?

ছটা সাড়ে ছটার মধ্যে।

হৈমন্তী হাতে ঘড়ি পরে নিয়েছিল, সময় দেখল। সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে।

 চুপচাপ। গগন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শব্দ করল।

বাইরে এখন খুব ঠাণ্ডা, না হয় এখানের সকালটা দেখতাম– হৈমন্তী বলল, বসবেন না?

 এখন বসে আর লাভ নেই, যাবার আয়োজন করতে হবে।

 বিজলীবাবু উঠেছেন?

 না। …ওঁকে ওঠাতে সময় লাগবে বোধহয়– অবনী হাসল।

 হৈমন্তী হাসল। গগনও ভীষণ কুঁড়ে, শীতকালে ওকে বিছানা থেকে ওঠানো যায় না।

অবনী ফাঁকা চেয়ার এবং হৈমন্তীর বিছানার দিকে তাকাল। তারা দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে, ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে, বাইরে সকাল হচ্ছে বোঝা যায় না, এখানে রাত্রের মতন সব। অবনী বলল, কাল একটা মজার স্বপ্ন দেখলাম, বলে হাসল, সুরেশ্বরবাবু…

কথাটা শোনার আগেই হৈমন্তী বাধা দিয়ে বলল, আপনার গলার কাছে ওটা কী হয়েছে?

 গলার কাছে হাত দিল অবনী।

 ওখানে নয়, আরও ওপাশে ঘাড়ের দিকে।

 কী জানি। … অবনী অন্য জায়গায় হাত রাখল।

হৈমন্তী সামনে এগিয়ে ঝুঁকে বলল, আলোর দিকে ফিরুন।

অবনী আলোর দিকে মুখ করল।

হৈমন্তী দেখল, তারপর আস্তে করে আঙুল তুলে দাগের পাশে গলার চামড়ার কাছে রাখল। অবনী ঠাণ্ডা অথচ কোমল আঙুলের স্পর্শ অনুভব করল।

কিছু কামড়েছে?

মনে করতে পারছি না।

ব্যথা আছে?

অবনী আঙুল তুলে ব্যথা অনুভব করতে গেল, হৈমন্তীর আঙুলের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে আঙুলটা থামল। না; তবে জ্বালা করে উঠল যেন।

হৈমন্তী হাত নামাল। দুপলক তাকিয়ে তাকিয়ে অবনীর চোখ মুখ দেখল। কিছু না হয়তো।

 পোকা টোকা কামড়াতে পারে…

বোধহয়। ..লালচে দেখাচ্ছে। আমার কাছে ক্রিম আছে, লাগিয়ে নেবেন একটু।

অবনী হাসল। নেব।

হৈমন্তী সামনে থেকে সরে গিয়ে দরজার দিকে তাকাল, তাকিয়ে থাকল কয়েক দণ্ড, তারপর বলল, বেশ ফরসা হয়ে গেছে।

অবনী ঘুরে দাঁড়াল। বাইরের ফরসা দরজার চৌকাঠ পর্যন্ত এসে গেছে।

গুরুডিয়ায় ফিরতে ফিরতে প্রায় সাড়ে নটা বাজল। লাট্‌ঠার মোড়ে এসে গাড়ি ঘুরিয়ে নেবার সময় অবনী জিজ্ঞেস করেছিল, কটা বাজল?

ঘড়ি দেখে সময় বললেন বিজলীবাবু, নটা পনেরো।

অফুরন্ত পৌষের রোদ, শিশির-শুকোনো মেঠো গন্ধ, শাল আর পলাশের চারা ঝাঁপটানো উত্তরের বাতাস, কয়েক মুঠো ফড়িং যেন সারাটা পথ পাশে পাশে ছুটে এল। দুহাত বিস্তার করে সেই মাঠ, ঘাট, শিশিরের সজীবতা নিয়ে গাড়িটা অন্ধ আশ্রমের মধ্যে এসে দাঁড়াল।

বিজলীবাবু নামলেন, অবনী নেমে দাঁড়াল। গগনও নেমেছে।

নামতে নামতে হৈমন্তীর চোখে পড়ল সামান্য দূরে একটা ভোলা গরুর গাড়ি ঘিরে ভিড়ের মতন হয়েছে। বিজলীবাবু, অবনী সেদিকে তাকিয়ে ছিল। গগন গাড়ির ভেতর থেকে তাদের হোন্ডঅল আর সুটকেস বের করে নিচ্ছিল।

গাড়ির শব্দে ভিড়ের অনেকেই এদিকে তাকাল। মালিনীকেও দেখা গেল। মালিনী হৈমন্তীকে দেখতে পেয়ে দ্রুত পায়ে আসছিল।

কাছে এসে মালিনী রুদ্ধশ্বাসে বলল, মনোহর ছুটি নিয়ে মেলায় গিয়েছিল না হেমদি, পরশু ফেরার কথা, ফেরেনি। কালও নয়। আজ এতক্ষণে ওকে কারা নিয়ে এসেছে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। গা নাকি আগুনের মতন গরম।

কী হয়েছে?

জানি না। ওরা বলাবলি করছে, এই রোগে মেলায় খুব লোক মরছে, এখানে সব জায়গায়… মালিনী বিহ্বল, ভীত, বিচলিত, দাদা একটা ঘর খালি করাতে গেছে, ওকে রাখার জন্যে।

হৈমন্তী অবনীর দিকে তাকাল। অবনী এবং বিজলীবাবু চোখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। অবনী বলল, সেই এপিডেমিক না কি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *