• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • লেখক
  • My Account
  • লেখক
  • My Account
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা PDF ডাউনলোড

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

২৯. বর্ণ ও রাষ্ট্র

লাইব্রেরি » নীহাররঞ্জন রায় » বাঙালী হিন্দুর বর্ণভেদ » ২৯. বর্ণ ও রাষ্ট্র

বর্ণ ও রাষ্ট্র

বিভিন্ন পর্বে বর্ণ-বিন্যাসের সঙ্গে রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন বর্ণের সম্বন্ধের কথা না বলিয়া বর্ণ-বিন্যাস প্রসঙ্গ শেষ করা উচিত হইবে না।

বাঙলাদেশে গুপ্তাধিপত্যের আগে এই সম্বন্ধের কোনও কথাই বলিবার উপায় নাই; তথ্যই অনুপস্থিত। গুপ্তাধিকারের কালে ভুক্তির রাষ্ট্রযন্ত্রে অথবা বিষয়াধিকরণে কিংবা স্থানীয় অন্য রাষ্ট্রাধিকরণের কর্তৃপক্ষদের মধ্যে যাঁহাদের নামের তালিকা পাইতেছি তাঁহাদের মধ্যে ব্ৰাহ্মণ প্রায় নাই বলিলেই চলে। ভুক্তিপতি বা উপরিকদের মধ্যে যাঁহাদের দেখা মিলিতেছে তাঁহারা কেহ চিরাতদত্ত, কেহ ব্রহ্মদত্ত, কেহ জয়দত্ত, কেহ রুদ্রদত্ত, কেহ কুলবৃদ্ধি ইত্যাদি; ইঁহাদের একজনকেও ব্রাহ্মণ বলিয়া মনে হয় না। বিষয়াপতিরা বা তৎস্থানীয়রা কেহ বেত্ৰিবৰ্মণ, কেহ স্বয়ম্ভুদেব, কেহ শণ্ডক; ইহাদের মধ্যে বেত্ৰিবৰ্মণ ক্ষত্ৰিয়ত্বের দাবি করিতে পারেন; স্বয়ম্ভুদেব সম্বন্ধে কিছু বলা কঠিন, ব্ৰাহ্মণ হইলে হইতেও বা পারেন; শশুক যে অব্রাহ্মণ এ-অনুমান সহজেই করা চলে। তারপরেই নিঃসন্দেহে যাঁহারা রাজকর্মচারী তাঁহারা হইতেছেন পুস্তপাল এবং জ্যেষ্ঠ বা প্রথম কায়স্থ। ইঁহাদের কাহারও নাম শাম্বপাল, কাহারও কাহারও নাম দিবাকরানন্দী, পত্ৰদাস, দুর্গাদত্ত, অর্কদাস, করণ-কায়স্থ নরদত্ত, স্কন্দপাল ইত্যাদি। এই সব নামও ব্ৰাহ্মণেতর বর্ণের, সন্দেহ করিবার কারণ নাই। অন্তত একজন করণ-কায়স্থ নরদত্ত যে সান্ধিবিগ্রহিক ছিলেন, সে-পরিচয় পাইতেছি। কুমারামাত্যদের মধ্যে একটি নাম পাইতেছি। বেরজাস্বামী; তিনি ব্ৰাহ্মণ ছিলেন বলিয়া কতকটা নিঃসংশয়ে বলা চলে। পুস্তপাল ও জ্যেষ্ঠ বা প্রথম কায়স্থদের সঙ্গে যাঁহারা স্থানীয় অধিকরণের রাষ্ট্ৰকার্য পরিচালনায় সহায়তা করিতেন তাঁহারা হইতেছেন নগরশ্ৰেষ্ঠী, প্রথম সার্থবাহ এবং প্রথম কুলিক; ইঁহাদের নামের তালিকায় পাওয়া যায় ধূতিপাল, বন্ধুমিত্র, রিভুপাল, স্থাণুদত্ত, মতিদত্ত ইত্যাদি ব্যক্তিকে; ইঁহাদের একজনকেও ব্রাহ্মণ বলা যায় না। বস্তুত, এইসব নামাংশ বা পদবী পরবর্তী কালের ব্ৰাহ্মণ-ক্ষত্ৰিয়েতর অন্য ‘ভদ্র’বর্ণের।

ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে (পূর্ব) বঙ্গেও এই একই অবস্থা দেখিতেছি। শুধু সুবর্ণবীথি অন্তর্গত বারকমণ্ডলের বিষয়াধিনিযুক্তক ব্যক্তিদের মধ্যে দুইবার দুইজনের নাম পাইতেছি, গোপালস্বামী ও বৎসপালস্বামী। এই দুইজন ব্রাহ্মণ ছিলেন, সন্দেহ নাই। জ্যেষ্ঠ কায়স্থ পুস্তপাল ইত্যাদির নামের মধ্যে পাইতেছি বিনয়সেন, নয়ভূতি, বিজয়সেন, পুরদাস ইত্যাদিকে; ইহারা অব্রাহ্মণ, তাহাতেও সন্দেহ নাই।

অর্থাৎ, সপ্তম শতক পর্যন্তও রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণদের কোনও প্রাধান্য দেখা যাইতেছে না; বরং পরবর্তীকালে যাঁহারা কারণ-কায়স্থ, অম্বষ্ঠ-বৈদ্য ইত্যাদি সংকর শূদ্ৰবৰ্ণ বলিয়া গণ্য হইয়াছেন তাহাদের প্রাধান্যই দেখিতেছি। বেশি, বিশেষভাবে করণ-কায়স্থদের। শ্রেণী হিসাবে শিল্পী ও বণিক-ব্যবসায়ী শ্রেণীর প্রাধান্যও যথেষ্ট দেখা যাইতেছে; বর্ণ হিসাবে ইহারা বৈশ্যবর্ণ বলিয়া গণিত হইতেন কিনা নিঃসন্দেহে বলা যায় না। বৈশ্য বলিয়া কোথাও ইঁহাদের দাবি সমসাময়িক কালে বা পরবর্তীকালেও কোথাও দেখিতেছি না, এইটুকুই মাত্র বলা যায়। অনুমান হয়, পরবর্তীকালে যে-সব শিল্পী ও বণিক-ব্যবসায়ী শ্রেণী শূদ্র উত্তম ও মধ্যম সংকর বর্ণ পর্যায়ভুক্ত বলিয়া পাইতেছি, তাঁহারাই এই যুগে শ্রেষ্ঠী, সার্থিবাহ, কুলিক ইত্যাদির বৃত্তি অনুসরণ করিতেন। বুঝা যাইতেছে, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্ৰাহ্মণ্য বৰ্ণব্যবস্থা বিস্তৃতি লাভ করিলেও রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণেরা এখনও প্রাধান্য লাভ করিতে পারেন নাই; তাহারা সম্ভবত এখনও নিজেদের বর্ণনুযায়ী বৃত্তিতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। অন্যান্য বর্ণের লোকেদের সম্পর্কে মোটামুটি বলা যায় যে, তাঁহারাও নিজেদের নির্দিষ্ট বৃত্তিসীমা অতিক্রম করেন নাই। রাষ্ট্রে করণ-কায়স্থদের প্রতিপত্তি বৃত্তিগত স্বাভাবিক কারণেই; শিল্পী ও বণিক-ব্যবসায়ীদের প্রতিপত্তির কারণ অর্থনৈতিক। শেষোক্ত কারণের ব্যাখ্যা অন্যান্য প্রসঙ্গে একাধিকবার করিয়াছি।

কিন্তু, ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও বর্ণ-ব্যবস্থার বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে, রাষ্ট্রের সক্রিয় পোষকতার সঙ্গে সঙ্গে সমাজে ক্রমশ ব্রাহ্মণের প্রতিপত্তিশীল হইয়া উঠিতে আরম্ভ করেন; ভূমিদান অর্থদান ইত্যাদি কৃপালাভের ফলে অনেক ব্ৰাহ্মণ ক্রমশ ব্যক্তিগতভাবে ধনসম্পদের অধিকারীও হইতে থাকেন। এই সামাজিক প্রতিপত্তি রাষ্ট্রে প্রতিফলিত হইতে বিলম্ব হয় নাই। কারণ-কায়স্থেরাও রাজসরকারের চাকুরি করিয়া রাষ্ট্রের কৃপালাভে বঞ্চিত হয় নাই; গ্রামে, বিষয়াধিকরণে, ভুক্তির রাষ্ট্রকেন্দ্রে সর্বত্র যাঁহারা মহত্তর, কুটুম্ব ইত্যাদি বলিয়া গণ্য হইতেছেন, রাজকার্যে সহায়তার জন্য যাহারা আহুত হইতেছেন, তাহাদের মধ্যে করণ-কায়স্থ এবং অন্যান্য ‘ভদ্র’ বর্ণের লোকই সংখ্যায়। বেশি বলিয়া মনে হইতেছে। প্রচুর ভূমির অধিকারী রূপে, শিল্প-ব্যবসায়ে অর্জিত ধনবলে, সমাজের সংস্কার, সংস্কৃতি ও বর্ণ-ব্যবস্থার নায়করূপে যে সব বর্ণ সমাজে প্রতিপত্তিশীল হইয়া উঠিতেছেন তাহারা রাষ্ট্রে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হইবেন, ইহা কিছু বিচিত্র নয়। রাষ্ট্রেরও স্বার্থে হইল সেই সব প্রতিপত্তিশীল বর্ণ বা বর্ণসমূহকে সমর্থকরূপে নিজের সঙ্গে যুক্ত রাখা।

সাধারণতঃ অধিকাংশ লোকই নিজেদের বর্ণবৃত্তি অনুশীলন করিতেন, এ-সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ নাই সত্য, কিন্তু ব্যক্তিগত রুচি, প্রভাব-প্রতিপত্তি কামনা, অর্থনৈতিক প্রেরণা ইত্যাদির ফলে প্রত্যেক বর্ণেরই কিছু কিছু লোক বৃত্তি পরিবর্তন করিত, তাহাও সত্য। স্মৃতিগ্ৰন্থাদিতে যে নির্দেশই থাকুক বাস্তবজীবনে দৃঢ়বদ্ধ রীতিনিয়ম সর্বদা অনুসৃত যে হইত না তাহার প্রমাণ অসংখ্য লিপি ও সমসাময়িক গ্রন্থাদিতে পাওয়া যায়। পাল-চন্দ্র এবং সেনা-বর্মণ আমলে যথেষ্ট ব্ৰাহ্মণ রাজা, সামন্ত, মন্ত্রী, ধর্মাধ্যক্ষ, সৈন্য-সেনাপতি, রাজকর্মচারী, কৃষিজীবী ইত্যাদির বৃত্তি অবলম্বন করিতেছেন; অম্বষ্ঠ বৈদ্যেরা মন্ত্রী হইতেছেন; দাসজীবীরা রাজকর্মচারী, সভাকবি ইত্যাদি হইতেছেন, করণ-কায়স্থেরা সৈনিকবৃত্তি, চিকিৎসাবৃত্তি ইত্যাদি অনুসরণ করিতেছেন; কৈবৰ্তরা রাজকর্মচারী ও রাজ্যশাসক হইতেছেন; এ ধরনের দৃষ্টান্ত অষ্টম হইতে ত্ৰয়োদশ শতক পর্যন্ত অনবরতই পাওয়া যাইতেছে।

পাল রাষ্ট্রযন্ত্র বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায় রাষ্ট্র ও সমাজপদ্ধতির পূর্বোক্ত রীতিক্রম সুস্পষ্ট ও সক্রিয়। প্রথমেই দেখিতেছি, রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণদের প্রভাব ও আধিপত্য বাড়িয়াছে। দ্বিজশ্রেষ্ঠ শ্ৰীদর্ভপাণি, পৌত্র কেদারমিশ্র ও প্রপৌত্র গুরবমিশ্র রাজা ধৰ্মপালের সময় হইতে আরম্ভ করিয়া পর পর চারিজন পালসম্রাটের অধীনে পালরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কত করিয়াছিলেন। ইহারা প্রত্যেকেই ছিলেন বেদবিদ পরমশাস্ত্ৰজ্ঞ পণ্ডিত এবং সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধবিদ্যবিশারদ ও রাজনীতিকুশল। আর একটি ব্রাহ্মণ বংশের— শাস্ত্রবিদশ্রেষ্ঠ যোগদেব, পুত্র তত্ত্ববোধভূ বোধিদেব এবং তৎপুত্র বৈদ্যদেব— এই তিনজন যথাক্রমে তৃতীয় বিগ্রহপাল, রামপাল এবং কুমারপালের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এই পরিবারও পাণ্ডিত্যে, শাস্ত্ৰজ্ঞানে, এক কথায় ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতিতে যেমন কুশলী ছিলেন তেমনই ছিলেন রাজনীতি ও রণনীতিতে। নারায়ণপালের ভাগলপুর-লিপির দূতক ভট্ট গুরব ব্রাহ্মণ ছিলেন, সন্দেহ নাই। প্রথম মহীপালের বাণগড়-লিপির দূতক ছিলেন ভট্ট শ্ৰীবামন মন্ত্রী, ইনিও অন্যতম প্রধান রাজপুরুষ সন্দেহ নাই। এই রাজার রাজগুরু ছিলেন শ্ৰীবামরাশি; ইনি বোধ হয় একজন শৈব সন্ন্যাসী ছিলেন। বৌদ্ধরাজার লিপি “ওঁ নমো বুদ্ধায়” বলিয়া আরম্ভ হইয়াছে, কিন্তু প্রথম দুই শ্লোকেই বলা হইতেছে, “সরসীসদৃশ বারাণসী ধামে, চরণাবনত-নৃপতি-মস্তকাবস্থিত কেশপাশ সংস্পর্শে শৈবালাকীর্ণরূপে প্ৰতিভাত শ্ৰীবামরাশি নামক গুরুদেবের পাদপদ্মের আরাধনা করিয়া, গৌড়াধিপ মহীপাল [যাঁহাদিগের দ্বারা] ঈশান-চিত্ৰঘণ্টাদি শতকীর্তিরত্ন নির্মাণ করাইয়াছিলেন–”। কোনও কোনও পণ্ডিত মনে করেন “চিত্রাঘণ্টেশী” নবদুর্গার একতম রূপ; কাজেই, ঈশান চিত্ৰঘণ্টাদি অর্থে নবদুর্গার বিভিন্ন রূপ সূচিত হইয়া থাকা অসম্ভব নয়। শ্ৰীবামরাশি নামটিও যেন শৈব বা শাক্ত লক্ষণের সূচক।

একটি ক্ষত্ৰিয়বর্ণ প্রধান রাজপুরুষের নাম বোধ হয় পাওয়া যাইতেছে। ধর্মপালের খালিমপুরলিপিতে; ইনি মহাসামন্তাধিপতি নারায়ণবর্মা। এই সামন্ত নরপতিটি যেন অবাঙালী বলিয়াই মনে হইতেছে। কিছু কিছু বণিকের নাম পাইতেছি, যেমন বণিক লোকদত্ত, বণিক বুদ্ধমিত্র; নামাংশ বা পদবী দেখিয়া মনে হয়, ইহারা পরবর্তীকালের ‘ভদ্র’, সংকরবর্ণীয়, বৃত্তি অবশ্যই বৈশ্যের; কিন্তু রাষ্ট্রে বর্ণ হিসাবে বা শ্রেণী হিসাবে ইহাদের কোনও প্রাধান্য নাই। কারণ কায়স্থদের প্রভাব ব্রাহ্মণদের প্রভাবের সঙ্গে তুলনীয় না হইলেও খুব কম ছিল না। রামচরিত-রচিয়তা সন্ধ্যাকর নন্দীর পিতা প্রজাপতি নন্দী ছিলেন করণদের মধ্যে অগ্রণী এবং রামপালের কালে পালরাষ্ট্রের সান্ধিবিগ্রহিক। আর এক করণ-শ্রেষ্ঠ শব্দপ্রদীপ গ্রন্থের রচয়িতা; তিনি স্বয়ং, তাহার পিতা ও পিতামহ সকলেই ছিলেন রাজবৈদ্য; দুইজন পাল-রাজসভার, একজন চন্দ্র-রাজসভার। বৈদ্যদেবের কমৌলি-লিপিতে ধর্মাধিকার-পদাভিষিক্ত জনৈক শ্ৰীগোনন্দন এবং মদনপালের মনহলি-লিপিতে সান্ধিবিগ্রহিক দূতক জনৈক ভীমদেবের সংবাদ পাইতেছি; ইঁহারাও করণ-কায়স্থকুলসম্ভূত বলিয়া মনে হইতেছে। কৈবর্ত দিব্য বিদ্রোহী হইবার আগে পাল রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান রাজপুরুষ বা সামন্ত ছিলেন, সে কথা তো আগেই একাধিকবার বলা হইয়াছে। সামন্ত নরপতিদের মধ্যেও করণ-কায়স্থদের দর্শন মিলিতেছে। ত্রিপুরা পট্টেলীর মহারাজা লোকনাথ নিজেই ছিলেন করণ। কিন্তু করণদের প্রভাব পাল রাষ্ট্রের যতই থাকুক, ঠিক আগেকার পর্বের মতন আর নাই। পঞ্চম হইতে সপ্তম শতকের রাষ্ট্রে সর্বত্রই যেন ছিল করণ-কায়স্থদের প্রভাব, অন্তত নামাংশ বা পদবী হইতে তাহাই মনে হয়। পাল-চন্দ্ৰ পর্বে ঠিক ততটা প্রভাব নাই; পরিবর্তে ব্ৰাহ্মণ প্রভাব বর্ধমান।

কম্বোজ-সেনা-বর্মণ পর্বের রাষ্ট্রে এই ব্ৰাহ্মণ প্রভাব ক্রমশ বাড়িয়াই গিয়াছে। ভবদেব ভট্ট ও হলায়ূধের বংশের কথা পূর্বেই একাধিকবার উল্লেখ করিয়াছি; এখানে পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। একাধিক পুরুষ ব্যাপিয়া সেন-বৰ্মণ রাষ্ট্রে এ দুই পরিবারের প্রভাব ছিল অত্যন্ত প্রবল। তাহা ছাড়া, অনিরুদ্ধ ভট্টের মতো ব্ৰাহ্মণ রাজগুরুদের প্রভাবও কিছু কম ছিল না। অধিকন্তু, প্রভৃতিরও প্রভাব এই পর্বের রাষ্ট্রগুলিতে সুপ্রচুর, এবং ইহারা সকলেই ব্ৰাহ্মণ। ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য প্রভাবের পরিচয় বিশেষভাবে কিছু পাওয়া যাইতেছে না; বরং বল্লাল-চরিত, বৃহদ্ধর্ম ও ব্ৰহ্মবৈবর্ত পুরাণের বর্ণতালিকা হইতে মনে হয়, শিল্পী ও ব্যবসায়ী শ্রেণীভুক্ত অনেক বর্ণ রাষ্ট্রের অকৃপাদৃষ্টি লাভ করিয়া সমাজে নামিয়া গিয়াছিল। বণিক-ব্যবসায়ীদের প্রতি সেন-রাষ্ট্র বোধ হয় খুব প্রসন্ন ছিল না। একমাত্র বিজয়সেনের দেবপাড়া-লিপিতে পাইতেছি বারেন্দ্র-শিল্পগোষ্ঠীচূড়ামণি শূলপাণিকে পাইতেছি বণিক সামন্তরূপে। বৈদ্যদের প্রভাব-পরিচয়ের অন্তত একটি দৃষ্টান্ত আমাদের জানা আছে; বৈদ্যবংশ-প্ৰদীপ বনমালীকর রাজা ঈশান দেবের পট্টনিক বা মন্ত্রী ছিলেন; কিন্তু সংবাদটি বঙ্গের পূর্বতম অঞ্চল শ্ৰীহট্ট হইতে পাওয়া যাইতেছে যেখানে আজও বৈদ্য-কায়ন্থে বৰ্ণ-পার্থক্য খুব সুস্পষ্ট নয়। একই অঞ্চলে দেখিতেছি, দাস-কৃষিজীবীরা রাজকর্মচারী এবং সভাকবিও হইতেন। কিন্তু ব্ৰাহ্মণদের পরেই রাষ্ট্রে যাঁহাদের প্রভাব সক্রিয় ছিল তাহারা কারণ-কায়স্থ; ইহাদের প্রভাব হিন্দু আমলে কখনও একেবারে ক্ষুন্ন হইয়াছিল বলিয়া মনে হয় না; কারণ-কায়স্থদের বর্ণগত বৃত্তিই বোধ হয় তাহার কারণ। সেন-রাজসভার কবিদের মধ্যে অন্তত একজন করণ-কায়স্থ উপবর্ণের লোক ছিলেন বলিয়া মনে হয়; তিনি উমাপতিধর। মেরুতুঙ্গের প্রবন্ধচিন্তামণি-গ্রন্থের সাক্ষ্য প্রামাণিক হইলে স্বীকার করিতে হয়, উমাপতি লক্ষ্মণসেনের অন্যতম মন্ত্রী ছিলেন। সদুক্তিকর্ণামৃত-গ্রন্থের সংকলয়িতা কবি শ্ৰীধরদাসও বোধ হয় কারণ-কায়স্থ ছিলেন; শ্ৰীধর নিজে ছিলেন মহামাণ্ডলিক, তাঁহার পিতা বটুদাস ছিলেন মহাসামন্তচূড়ামণি। বিজয়সেনের বারাকপুর-লিপির দূত শালাড্ডনাগ, বল্লালসেনের সান্ধিবিগ্রহিক হরিঘোষ, লক্ষ্মণসেনের মহাসান্ধিবিগ্রহিক নারায়ণদত্ত, এই রাজারই অন্যতম প্রধান রাজকর্মচারী শঙ্করধর, বিশ্বরূপসেনের সান্ধিবিগ্রহিক নাঞী সিংহ এবং কোপিবিষ্ণু, ইত্যাদি সকলকেই করণ-কায়স্থ বলিয়াই মনে হইতেছে। লক্ষ্মণসেনের অন্যতম সভাকবি ধোয়ী কিন্তু ছিলেন তন্তুবায়; তন্তুবায়-কুবিন্দকেরা উত্তম-সংকর বা সৎশুদ্র পর্যায়ের লোক, একথা স্মরণীয়।

রাষ্ট্রে বিভিন্ন বর্ণের প্রভাবের মোটামুটি যে-পরিচয় পাওয়া গেল তাহা হইতে অনুমান হয়, ব্ৰাহ্মণ ও করণ-কায়স্থদের প্রভাব-প্রতিপত্তিই সকলের চেয়ে বেশি ছিল। কারণ-কায়স্থদের প্রভাবের কারণ সহজেই অনুমেয়; ভূমির মাপ-প্রমাপ, হিসাবপত্র রক্ষণাবেক্ষণ, পুস্তপালের কাজকর্ম, দপ্তর ইত্যাদির রক্ষণাবেক্ষণ, লেখকের কাজ প্রভৃতি ছিল ইহাদের বৃত্তি। স্বভাবতই, তাঁহারা রাষ্ট্রে এই বৃত্তিপালনের যতটা সুযোগ পাইতেন অন্যত্র তাহা সম্ভব হইত না। কাজেই এক্ষেত্রে বর্ণ ও শ্রেণী প্রায় সমার্থক হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। ব্ৰাহ্মণদের ক্ষেত্রে তাহা বলা চলে না; ইহারা বৃত্তিসীমা অতিক্ৰম করিয়াই মন্ত্রী, সেনাধ্যক্ষ, ধর্মধ্যক্ষ, সান্ধিবিগ্রহিক ইত্যাদি পদ অধিকার করিতেন। রাজগুরু, রাজপণ্ডিত, পুরোহিত, শান্ত্যাগারিক ইত্যাদিরা অবশ্যই নিজেদের বৃত্তিসীমা রক্ষা করিয়া চলিতেন, বলা যাইতে পারে। কোন সামাজিক রীতিক্রমানুযায়ী ব্ৰাহ্মণের রাষ্ট্রে প্রভুত্ব বিস্তার করিতে পারিয়াছিলেন তাহা তো আগেই বলিয়াছি। বৈশ্যাবৃত্তিধারী বর্ণ-উপবর্ণ সম্বন্ধে বলা যায়, যতদিন শিল্প ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের অবস্থা উন্নত ছিল, ধনোৎপাদনের প্রধান উপায় ছিল শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্য, ততদিন রাষ্ট্রেও তঁহাদের প্রভাব অনস্বীকার্য ছিল, কিন্তু একাধিক প্রসঙ্গে দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি, সপ্তম শতকের পরে ব্যাবসা-বাণিজ্যের প্রসার কমিয়া যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রেও বৈশ্যবৃত্তিধারী লোকেদের প্রভাব কমিয়া যাইতে থাকে। পাল-রাষ্ট্রেই তাহার চিহ্ন সুস্পষ্ট। বল্লাল-চরিতের ইঙ্গিত সত্য হইলে সেন-রাষ্ট্র র্তাহাদের প্রতি সক্রিয়ভাবে অপ্রসন্নই ছিল। তাহা ছাড়া, বৃহদ্ধর্ম-ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণও সে-ইঙ্গিত সমর্থন করে। রাষ্ট্রে ইহাদের প্রভাব থাকিলে সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে ইঁহারা এতটা অবজ্ঞাত, অবহেলিত হইতে পারিতেন না।

যাহা হউক, এ-তথ্য সুস্পষ্ট যে, ব্ৰাহ্মণ ও করণ-কায়স্থদের প্রভাবই রাষ্ট্রে সর্বাপেক্ষা বেশি কার্যকরী ছিল। অম্বষ্ঠ-বৈদ্যদের প্রভাবও হয়তো সময়ে সময়ে কিছু কিছু ছিল; কিন্তু সর্বত্র সমভাবে ছিল এবং খুব সক্রিয় ছিল এমন মনে হয় না। বৈশ্যাবৃত্তিধারী বর্ণের লোকেরা রাষ্ট্রে অষ্টম শতক পর্যন্ত প্রভাবশালীই ছিলেন, কিন্তু পরে তাহাদের প্রভাব কমিয়া যায় এবং তাহাদের কোনও কোনও সম্প্রদায় সংশুদ্রি পর্যায় হইতেও পতিত হইয়া পড়েন। কৈবর্তদের একটি সম্প্রদায় কিছুদিন রাষ্ট্রে খুব প্রভাবশালীই ছিলেন, এবং পরেও সে-প্রভাব খুব সম্ভব অক্ষুন্ন রাখিয়াছিলেন। আর কোনও বর্ণের কোনও প্রভাব রাষ্ট্রে ছিল বলিয়া মনে হয় না।

Category: বাঙালী হিন্দুর বর্ণভেদ
পূর্ববর্তী:
« ২৮. ব্ৰাহ্মণদের সঙ্গে অন্যান্য বর্ণের সম্বন্ধ

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑