০৫. কায়স্থ-করণ

কায়স্থ-করণ

উপরোক্ত অন্ত্যনামগুলি যাঁহাদের ব্যক্তিনামের সঙ্গে ব্যবহৃত হইতেছে তাঁহারা কোন বর্ণ বা উপরর্ণের স্থির করিবার কোনও উপায় নাই, এ কথা আগেই বলিয়াছি। এই যুগের লিপিগুলিতে কায়স্থ নামে পরিচিত এক শ্রেণীর রাজকর্মচারীর সংবাদ পাওয়া যায়, যেমন, প্রথম কায়স্থ শাম্বপাল, স্কন্দপাল, বিপ্রপাল, করণ-কায়স্থ নবদত্ত, কায়স্থ প্রভুচন্দ্র, রুদ্রদাস, দেবদত্ত, কৃষ্ণদাস, জ্যেষ্ঠকায়স্থ নয়সেন, ইত্যাদি। ইঁহারা যে রাজকর্মচারী এসম্বন্ধে সন্দেহ করিবার অবকাশ নাই। কায়স্থ বলিতে মূলত কোনও বর্ণ বা উপবর্ণ বুঝাইত না, কোষাকার বৈজয়ন্তী (একদশ শতক) কায়স্থ অর্থে বলিতেছেন লেখক, এবং কায়স্থ ও করণ সমর্থক ইহাও বলিতেছেন।(১) ক্ষীরস্বামী কৃত অমরকোমের টীকায়ও(২) করণ বলিতে কায়স্থদের মতই একশ্রেণীর রাজকর্মচারীকে বুঝান হইয়াছে। গাহডবালরাজ গোবিন্দচন্দ্রের দুইটি পট্টোলিক লেখক জলহণ একটিতে নিজের পরিচয় দিতেছেন কায়স্থ বলিয়া, আর একটিতে তিনি “করণিকোদ্গতো”।(৩) চান্দেল্লরাজ ভোজবর্মণের অজয়গড় লিপিতেও করণ ও কায়স্থ সমার্থক বলিয়া ধরা হইয়াছে।(৪) কায়স্থরা যে রাজকর্মচারী তাহা প্রাচীন বিষ্ণু ও যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতিদ্বারাও সমর্থিত।(৫) বিষ্ণুস্মৃতিমতে তাহারা রাজকীয় দলিল-পত্রাদির লেখক ছিলেন; যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতির টীকাকার বলেন কায়স্থরা ছিলেন লেখক ও হিসাবরক্ষক। এখনও তো বিহার অঞ্চলে হিসাব রাখার লিখনপদ্ধতির যে বিশিষ্ট ধরণ তাহাকে বলা হয় “কাইথী” লিপি। করণ শব্দও লেখক ও হিসাবরক্ষক অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে; সমস্ত পববর্তী সাক্ষ্যের ইঙ্গিতই এইরূপ, দু’এক ক্ষেত্রে মাত্র করণ ও কায়স্থ দুইটি শব্দ পৃথক পৃথক ভাবে ব্যবহৃত হইয়াছে, যেমন ৮৭০ খ্রীস্টাব্দের গুরম্‌হ তাম্র পট্টোলিতে।(৬) বৃহদ্ধর্মপুরাণে কিন্তু করণ ও কায়স্থ সমার্থক বলা হইয়াছে।(৭) উত্তর বিহারে করণ সম্প্রদায় এখনও কায়স্থদেরই একটি শাখা বলিয়া পরিগণিত, উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থরা আজও নিজেদের করণ বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকেন। মেদিনীপুর, উড়িষ্যা ও মধ্যপ্রদেশের করণরা চিত্রগুপ্তকেই তাহাদের আদিপুরুষ বলিয়া মনে করেন, বাঙালী কায়স্থরাও তো তাহাই করেন। প্রাচীন কালে যাহাই হউক, পরবর্তী কালে অর্থাং খ্রীস্টীয় নবম-দশম শতক নাগাদ বাংলাদেশে করণ ও কায়স্থ সমার্থক বলিনাই বিবেচিত হইত; ভারতের অন্যত্র ও হইত। বাংলাদেশে করণেরা ক্রমে কায়স্থ নামের মধ্যেই বিলীন হইয়া গিয়াছিল। যাহাই হউক, আমরা যে-যুগের আলোচনা করিতেছি সেই যুগে বাংলার লিপিগুলিতে কায়স্থ শব্দের ব্যবহার যেমন পাইতেছি, তেমনই পাইতেছি করণ শব্দের ও প্রাচীন গ্রীক ও পারসিক দলিলপত্রে কাইথিঅয়, ক্ষযতিয় নামে এক শ্রেণীর রাজকর্মচারীর সংবাদ পাওয়া যায়; তাহারা ও লেখক ও হিসাবরক্ষক। এই কাইথিঅয় –ক্ষয়তিয়-র সঙ্গে আমাদের কায়স্থ শব্দের একটা যোগাযোগ থাকা কিছু অসম্ভব নয়। এ তথ্য নিঃসংশয় বলিয়া মনে করা যাইতে পাবে যে এই যুগের লিপিগুলিতে কায়স্থ কোন ও বর্ণ বা উপবর্ণজ্ঞাপক শব্দ নয় —জীবনবৃত্তিবাচক শব্দ, অর্থাং কায়স্থর এই যুগে এখনও বর্ণ বা উপবর্ণ বলিয়া গড়িয়া উঠে নাই। এই যুগের অন্তত দুইটি লিপিতে করণদের উল্লেখ পাইতেছি। গুণাইঘর পট্টোলির লেখক সন্ধিবিগ্ৰহাপিক মানদত্ত ছিলেন করণ-কায়স্থ, এবং ত্রিপুরার লোকনাথ পট্টোলির মহারাজ লোকনাথও নিজের পরিচয় দিতেছেন করণ বলিয়া। কারণ-কায়স্থ বলিয়া নবদত্তের আত্মপরিচয় লক্ষ্যণীয়, করণ এবং কায়স্থ একেবাবে সমার্থক একথা স্পষ্ট না হইলে ও উভয়েব মধ্যে যে একটা ঘনিষ্ঠ যোগ বিদ্যমান তাহা এই ধরণের উল্লেখের মধ্যে যেন সুস্পষ্ট। লোকনাথের করণ-পরিচয় ও অন্য দিক দিয়া উল্লেখযোগ্য। তাঁহার মাতামহ কেশবকে বলা হইয়াছে, ‘পারশর’; পিতামহ ‘দ্বিজবর’, প্রপিতামহ ‘দ্বিজসত্তমা’, এবং বুদ্ধপ্রপিতামহ মুনি ভরদ্বাজের বংশধর। ‘পরাশর কেশব’ কথার অর্থ তো এই যে কেশবের ব্রাহ্মণ পিতা একজন শূদ্রাণীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। অথচ, কেশব ছিলেন রাজার সৈন্যাধ্যক্ষ, এবং সমসাময়িক রাষ্ট্রে ও সমাজে তিনি যথেষ্ট মান্যও ছিলেন। ব্রাহ্মণ বর ও শূদ্র কন্যার বিবাহ বোধ হয় তথন ও সমাজে নিন্দনীয় ছিল না, পরবর্তী কালেও নিন্দনীয় না হউক অপ্রচলিত যে ছিল না তাহা তো স্মৃতিকার ভবদেব ভট্ট এবং জীমূতবাহনের রচনা হইতেই জানা যায়। লোকনাথের নিজের করণ-পরিচয়েব কারণ বলা বড় কঠিন। বুঝা যাইতেছে, লোকনাথের পিতা একজন পারশর-দুহিতাকে বিবাহ করিয়াছিলেন; এই জন্যই কি লোকনাথ বর্ণসমাজে নীচে নামিয়া গিয়াছিলেন, অথবা, তাঁহার পিতাও ছিলেন করণ? এক্ষেত্রে করণ বর্ণ না বৃত্তিবাচক শব্দ তাহাও কিছুই নিশ্চয় করিয়া বলা যাইতেছে না। যাহা হউক, এইটকু বুঝা গেল, করণ বা কায়স্থ এখন ও নিঃসন্দেহে বর্ণ বা উপবর্ণ হিসাবে বিবেচিত হইতেছে না, এই দুই শব্দেরই ব্যবহার মোটামুটি বৃত্তিবাচক, তবে বৃত্তি ক্রমশ বর্ণে বিধিবদ্ধ হইবার দিকে ঝুঁকিতেছে।

 

————————
(১) “কায়স্থঃস্যার্ল্লিপিকয়ঃ  করণোক্ষর জীবনঃ লেখকোক্ষর চূঞ্চুশ্চ”।
(২) অমরকোষ।
(৩) Ep. Ind IV, p. 14o, VIII, p. I53
(৪) Ep. Ind. I, p. 330
(৫) Kane, History of Dharmasasta.
(৬) Bhandan kar, List of Inscriptions….no. 34.
(৭) পরে দ্রষ্টব্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *