০৩. আর্যীকরণের সূচনা : বর্ণবিন্যাসের প্রথম পর্ব

আর্যীকরণের সূচনা : বর্ণবিন্যাসের প্রথম পর্ব

বাঙালীর ইতিহাসের যে অস্পষ্ট ঊষাকালের কথা আমরা জানি তাহা হইতে বুঝা যায়, আর্যীকরণের সূচনার আগে এই দেশ অষ্ট্রিক ও দ্রাবিডভাষাভাষী—অষ্ট্রিক ভাষাভাষীই অধিকসংখ্যক,— খুব স্বল্পসংখ্যক অন্যান্য ভাষাভাষী, কৃষি ও শিকারিজীবি, গৃহ ও অরণ্যচারী, অসংখ্য কোমে বিভক্ত লোকদের দ্বারা অধ্যুষিত ছিল। সাম্প্রতিক নৃতাত্বিক গবেষণায় এই তথ্য উদঘাটিত হইয়াছে যে এইসব অসংখ্য বিচিত্র কোমদের ভিতর বিবাহ ও আহার-বিহারগত সম ও আচারগত নানাপ্রকার বিধিনিষেধ বিদ্যমান ছিল; এবং এই সব বিধিনিষেধকে কেন্দ্র করিয়া বিচিত্র কোমগুলির পরস্পবের ভিতর যৌন ও আহারবিহার সম্বন্ধগত বিভেদ-প্রাচীরেরও অন্ত ছিল না।(১৪) পরবর্তী আর্য ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাসেব মূল অনেকাংশে এইসব যৌন ও আহার-বিহার সঙ্গন্ধগত বিধিনিষেধকে আশ্রয় করিয়াছে, তাহা প্রায় অনস্বীকার্য; তবে আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতি গুণ ও কর্মকে ভিত্তি করিয়া তাহাদের চিন্তা ও আদর্শানুযায়ী এইসব বিধিনিষেধকে ক্রমে ক্রমে কালানুযায়ী প্রয়োজনে যুক্তি ও পদ্ধতিতে প্রথাশাসনগত করিয়া গডিয়াছে, তাড়াও অস্বীকার করিবার উপায় নাই। সমাজ ও নৃতাত্বিক গবেষণাব নির্ধারণানুযায়ী বিচার করিলে ভারতীয় বর্ণবিন্যাস আর্যপূর্ব ও আর্য্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতির সম্মিলিত প্রকাশ। অবশ্যই এই মিলন একদিনে হয় নাই; বহু শতাব্দীর নানা বিরোধ, নানা সংগ্রাম, বিচিত্র মিলন ও আদানপ্রদানের মধ্য দিয়া এই সমন্বয় সম্ভব হইয়াছে। এই সমন্বয়-কাহিনীই এক হিসাবে ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতির এবং কতকাংশে ভারতীয় মুসলমান সংস্কৃতিরও ইতিহাস। যাহাই হউক, বাংলা দেশে এই বিরোধ-মিলনসমন্বয়েব সূচনা কি ভাবে হইয়াছিল তাহার কিছু কিছু আভাস প্রাচীন আর্য ব্রাহ্মণ্য ও আর্য-বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থাদিতে পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য, এই সব গ্রন্থের সাক্ষ্য এক পক্ষীয়, এবং তা হাতে পক্ষপাত দোষ নাই এমনও বলা চলে না; আর্যপূর্ব জাতি ও কোমদের পক্ষ হইতে সাক্ষ্য দিবার মতন কোনও অকাট্য প্রমাণ উপস্থিত নাই। তাহা ছাড়া, বাংলা দেশ উত্তর-ভারতের পূর্ব প্রত্যন্ত দেশ; আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতির স্পর্শ ও প্রভাব এদেশকে আক্রমণ করিয়াছে সকলের পরে, তখন তাহা উত্তর-ভারতের আর প্রায় সবত্রই বিজয়ী, সুপ্রতিষ্ঠিত ও শক্তিমান। অন্যদিকে, তখন সমগ্র বাংলা দেশে আর্য পূর্ব সংস্কার ও সংস্কৃতিসম্পন্ন বিচিত্র কোমদের বাস; তাহারাও কম শক্তিমান নয়। তাহাদের নিজস্ব সংস্কার ও সংস্কৃতিবোধ গভীর ও ব্যাপক। কাজেই এইদেশে আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতির বিজয়াভিযান বিনা বিরোধ ও বিনা সংঘর্ষে সম্পন্ন হয় নাই। বহু শতাব্দী ধরিয়া এই বিরোধ-সংঘর্ষ চলিয়াছিল, ইহা যেমন স্বভাবতই অনুমান করা চলে, তেমনিই ঐতিহাসিক সাক্ষ্য দ্বারাও তাহা সমর্থিত। লিপি প্রমাণ হইতে মনে হয়, গুপ্ত আমলে আর্য-ব্রাহ্মণ্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাস, ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি এদেশে সম্যক স্বীকৃতই হয় নাই। তাহার পরেও ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাসের নিম্নস্তরে ও তাই বি বাহিরে সংস্কার ও সংস্কৃতির সংঘর্ষ বহুদিন চলিয়াছিল; সেন-বর্মণ আমলে (একাদশ-দ্বাদশ শতকে) বর্ণসমাজের উচ্চস্তরে আর্যপূর্ব লোক সংস্কৃতিব পরাভব প্রায় সম্পূর্ণ হয়। কিন্তু তাহা সত্বেও বাঙালী সমাজের অন্তঃপুরে এবং একান্ত নিম্নস্তরে এই সংস্কার ও সংস্কৃতির প্রভাব আজও একেবারে বিলুপ্ত হয় নাই—ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাসের আদেশ সেখানে শিথিল দৈনন্দিন জীবনে, ধর্মে, লোকাচারে, ব্যবহারিক আদর্শে, ভাবনা-কল্পনায় আজও সেখানে আর্যপূর্ব সমাজের বিচিত্র স্মৃতি ও অভ্যাস সুস্পষ্ট। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে শিল্পে, ধর্মে বতর্মান বাঙালীর ধ্যানে মননে আচারে ব্যবহারে এখনও সেই স্মৃতি বহমান, একথা কখনও ভুলিলে চলিবে না।

ঐতরেয় আরণ্যক গ্রন্থের “বয়াংসি বঙ্গাবগধাশ্চেরপাদা’ এই পদে কেহ কেহ বঙ্গ, মগধ, চের এবং পাণ্ড্য কোমের উল্লেখ আছে বলিয়া মনে করেন; এই সব কোমকে বলা হইয়াছে ‘বয়াংসি’ বা ‘পক্ষী-বিশেষাঃ’, এবং ইহারা যে আর্য-সংস্কৃতির বহির্ভূত তাহাও ইঙ্গিত করা হইয়াছে।(১৫) এই পদটির পাঠ ও ব্যাখ্যা এইভাবে হইতে পারে কিনা এ সম্বন্ধে মতভেদের অবসর বিদ্যমান। কিন্তু ঐতরেয় ব্রাহ্মণ গ্রন্থে পুণ্ড্র, প্রভৃতি জনপদের লোকদিগের যে ‘দস্যু’ বলা হইয়াছে এ সম্বন্ধে সন্দেহের কোন কারণ নাই। এই দুইটি ছাড়া আর কোনও প্রাচীনতম গ্রন্থেই প্রাচীন বাংলার কোনও কোমের উল্লেখ নাই। বুঝা যাইতেছে, সেই সুপ্রাচীন কালে আর্যভাষীরা তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে পরিচিতই হন নাই; পরবর্তী সংহিতা ও ব্রাহ্মণ গ্রন্থাদি রচনার সময় তাহারা পুণ্ড্র, বঙ্গ, ইত্যাদি কোমের নাম শুনিতেছেন মাত্র। ঐতরেয় ব্রাহ্মণের একটি গল্প এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। ঋষি বিশ্বামিত্র একটি ব্রাহ্মণ বালককে পোষ্যপুত্ররূপে গ্রহণ করেন—দেবতার প্রীত্যর্থে যজ্ঞে বালকটিকে আহুতি দিবাব আয়োজন হইয়াছিল, সেইখান হইতে বিশ্বামিত্র তাহাকে উদ্ধার করিয়া আনিয়াছিলেন। যাহা হউক, পিতার এই পোষ্যপুত্র গ্রহণ বিশ্বামিত্রের পঞ্চাশটি পুত্রের সমর্থন লাভ করেন নাই। ক্রুদ্ধ বিশ্বামিত্র পুত্রদের অভিসম্পাত দেন যে তাঁহাদের সন্তানেরা যে উত্তরাধিকার লাভ করিবে তাহা একেবারে পৃথিবীর প্রান্ততম সীমায় (বিকল্পে : তাঁহাদের বংশধরেরা একেবারে সব নিম্ন বর্ণ প্রাপ্ত হইবেন)। ইহারাই ‘দস্যু’ আখ্যাত অন্ধ্র, পুণ্ড্র, শবর, পুলিন্দ, এবং মুতিব কোমের জন্মদাত।(১৬) এই গল্পের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি মহাভারতের এবং কতিপয় পুরাণের একটা গল্পেও শুনিতে পাওয়া যায়।(১৭) অন্যত্র ভীমের দিগ্বিজয় প্রসঙ্গে বাংলার সমুদ্রতীরবাসী কোমগুলিকে বলা হইয়াছে ‘ম্লেচ্ছ’; ভাগবত পুরাণে কিরাত, হূণ, অন্ধ্র, পুলিন্দ, পুক্কস, আভীর, যবন, থস এবং সূহ্ম কোমের লোকদের বলা হইয়াছে ‘পাপ’।(১৮) বৌধায়নেব ধৰ্মসূত্রে আবট্ট (পাঞ্জাব), পুণ্ড্র (উত্তরবঙ্গ) সৌবীর (দক্ষিণ পঞ্জাব ও সিন্ধুদেশ), বঙ্গ (পূর্ব বাংলা), কলিঙ্গ (উড়িষ্যা) প্রভৃতি কোমের লোকদের অবস্থিতি নির্দেশ করা হইয়াছে আর্যবহির্ভূত দেশের প্রত্যন্ততম সীমায়; ইহাদের বলা হইয়াছে “সংকীর্ণ যৌনয়ঃ” এবং এই সব দেশ একেবারে আর্য-সংস্কৃতির বাহিরে, এই সব জনপদে কেহ স্বল্প কালের প্রবাসে গেলেও ফিরিয়া আসিয়া তাহাকে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইত।(১৯) স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, বৌধায়নের কালে বাংলাদেশের সঙ্গে পরিচয় যদি বা হইয়াছে, যাতায়াতও হয়ত কিছু কিছু আরম্ভ হইয়াছে, কিন্তু তখনও আর্যব্রাহ্মণ্য সংস্কারের দৃষ্টিতে এই সব অঞ্চলের লোকেরা ঘৃণিত এবং অবজ্ঞাত। এই ঘৃণা ও অবজ্ঞা প্রাচীন আর্য জৈন ও বৌদ্ধ গ্রন্থাদিতেও কিছু কিছু দেখা যায়। আচাবঙ্গ = আয়ারঙ্গ সূত্রের একটি গল্পে পথহীন রাঢ়দেশে মহাবীর এবং তাহার শিষ্যদের লাঞ্ছনা ও উৎপীড়নের যে-বর্ণনা আছে, বজ্রভূমিতে যে অখাদ্য কুখাদ্য ভক্ষণের ইঙ্গিত আছে তাহাতে এই ঘৃণা ও অবজ্ঞা সুম্পষ্ট।(২০) বৌদ্ধ আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প-গন্থে গৌড়, পুণ্ড্র, সমতট ও হরিকেলের লোকদের ভাষাকে বলা হইয়াছে ‘অসুর’ ভাষা এই সব বিচিত্র উল্লেখ হইতে স্পষ্টই বুঝা যায়, ইহা্রা এমন একটি সুদীর্ঘকালের স্মৃতি-ঐতিহ্য বহন করে যে-কালে আর্য ভাষাভাষী এবং আর্যসংস্কৃতির ধারক ও বাহক উত্তর ও মধ্যভারতের লোকে বা পূর্বতম ভারতের বঙ্গ, পুণ্ড্র, রাঢ়, সূহ্ম প্রভৃতি কোমদের সঙ্গে পরিচিত ছিল না, যে-কালে এইসব কোমদের ভাষা ছিল ভিন্নতর, আচার-ব্যবহার অন্যতর। এই অন্যতর জাতি, অন্যতর আচার-ব্যবহার, সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং অন্যতর ভাষাভাষী লোকদের সেইজন্যই বিজেতা, উন্নত ও পরাক্রান্ততর জাতিসুলভ দর্পিত উন্নাসিকতায় বলা হইয়াছে, ‘দস্যু’, ‘ম্রেচ্ছ’, ‘পাপ’, ‘অসুর’ ইত্যাদি।

কিন্তু এই দর্পিত উন্নাসিকতা বহুকাল স্থায়ী হয় নাই। নানা বিরোধ সংঘর্ষের ভিতর দিয়া এই সব দস্যু, ম্লেচ্ছ, অসুর, পাপ কোমের লোকদেব সসে আর্যভাষাভাষী লোকদের মেলামেশা হইতে ছিল। এই সব বিরোধ সংঘর্ষের কিছু কিছু আভাস পাওয়া যায় ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত নানা পৌরাণিক গল্পে—রামায়ণে রঘুর দিগ্বিজয়, মহাভারতে কর্ণ, কৃষ্ণ ও ভীমের দিগ্বিজয়, আচারঙ্গসূত্রে মহাবীরের রাঢ়দেশে জৈনধৰ্ম প্রচার, ইতাদি প্রসঙ্গে। ইহাদের মধ্য দিয়াই আর্য ও আর্যপূর্ব সংস্কৃতির মিলনপথ প্রশস্ত হইতেছিল এবং আর্যপূর্ব সংস্কৃতির ‘ম্রেচ্ছ’ ও ‘দস্যু’রা আর্যসমাজে স্বীকৃতি লাভ করিতেছিল। এই স্বীকৃতি লাভ ও আর্যসমাজে অন্তর্ভূক্তির দুইটি দৃষ্টান্ত আহরণ করা যাইতে পারে। রামায়ণে দেখা যাইতেছে,(২২) মৎস্য-কাশী-কোশল কোমেব সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গ-অঙ্গ-মগধ কোমের রাজবংশগুলি অযোধ্যা রাজবংশের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হইতেছেন। ইহাপেক্ষা ও আর একটি অর্থবহ গল্প আছে বায়ু ও মৎস্যপুরাণে, মহাভারতে। এই গল্পে অসুররাজ বলির স্ত্রীর গর্ভে বৃদ্ধ অন্ধ ঋষি দীর্ঘতমসের পাঁচটি পুত্র উৎপাদনের কথা বর্ণিত আছে; এই পাঁচপুত্রের নাম অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র এবং সূহ্ম; ইহাদের নাম হইতেই পাঁচ পাঁচটি কৌম জনপদের নামের উদ্ভব।(২৩)

প্রাথমিক পরাভব ও যোগাযোগের পর বাংলাদেশের এইসব দস্যু ও ম্লেচ্ছ কোমগুলি ধীরে ধীরে আর্যসমাজ ব্যবস্থায় কথঞ্চিৎ স্বীকৃতি ও স্থান লাভ করিতে অরম্ভ করিল। এই স্বীকৃতি ও স্থানলাভ যে একদিনে ঘটে নাই, তাহা তো সহজেই অনুমেয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া একদিকে বিরোধ ও সংঘর্ষ অন্যদিকে স্বীকৃতি ও অন্তর্ভূক্তি চলিয়াছিল— কখনও ধীর শান্ত, কখনও দ্রুত কঠোর প্রবাহে, এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। রাষ্ট্ৰীয় ও অর্থনৈতিক পরাভব ঘটিয়াছিল আগে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরাভব ঘটিয়াছিল ক্রমে ক্রমে, অনেক পরে, এ সম্বন্ধেও সন্দেহের অবসর কম। মানবধর্মশাস্ত্রে আযাঁবর্তের সীমা দেওয়া হইতেছে পশ্চিম সমূদ্র হইতে পূর্ব সমূদ্র তীর পর্যন্ত, অর্থাং প্রাচীন বাংলাদেশের অন্ততঃ কিয়দংশ আযাঁবর্তের অন্তর্গত, এই যেন ইঙ্গিত।(২৪) মনু পুণ্ড্র, কোমের লোকদের বলিতেছেন ‘ব্রাত্য’ বা পতিত ক্ষত্রিয়, এবং তাগাদের পংক্তিভুক্ত করিতেছেন দ্রাবিড, শক, চীন প্রভৃতি বৈদেশিক জাতিদের সঙ্গে। মভাভারতের সভাপর্বে।(২৫) কিন্তু বঙ্গ ও পুণ্ড্রদের যথার্থ ক্ষত্রিয় বলা হইয়াছে; জৈন প্রজ্ঞাপনা গ্রন্থেও বঙ্গ এবং রাঢ় কোম দুটিকে আর্য কোম বলা হইয়াছে।(২৬) শুধু তাহাই নয়, মহাভারতেই দেখিতেছি, প্রাচীন বাংলার কোনও কোনও স্থান তীর্থ বলিয়া স্বীকৃত ও পরিগণিত হইতেছে, যেমন পুণ্ড্র ভূমিতে করতোয়াতীর, সূহ্মদেশের ভাগীরথী সাগর-সঙ্গম।(২৭) অর্জুন অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের তীর্থস্থানসমূহ পরিভ্রমণকালে ব্রাহ্মণদিগকে নানা প্রকারে উপহৃত করিয়াছিলেন; বাৎস্যায়ন তাঁহার কামসূত্রে (৩য়-৪র্থ শতক) গৌড়-বঙ্গের ব্রাহ্মণদের উল্লেখ করিয়াছেন। অর্থাৎ বাংলা এবং বাঙালীর আর্যীকরণ ক্রমশঃ অগ্রসর হইতেছে, ইহাই এইসব পুরাণকথার ইঙ্গিত। এই ইঙ্গিতের সমর্থন পাওয়া যায় মভাভারত ও পুরাণগুলিতে। বায়ু ও মংস্যপুরাণে, মহাভারতে বঙ্গ, সূহ্ম, পুণ্ড্রদের তো ক্ষত্ৰিয়ই বলা হইয়াছে, এমন কি শবর, পুলিন্দ এবং কিরাতদেরও। (২৮) কোনও কোনও বংশ যে ব্রাহ্মণ পর্যায়েও স্বীকৃত ও অন্তর্ভূক্ত হইয়াছিল, ঋষি দীর্ঘতমসের গল্পটি তাহার কতকট প্রমাণ বহন করে। অধিকাংশ বিজিত লোকই স্বীকৃত ও অন্তর্ভূক্ত হইয়াছিল শূদ্রবর্ণ পর্যায়ে, এ সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ নাই। মনু বলিতেছেন, পৌণ্ড্রক ও কিরাতেরা ক্ষত্রিয় ছিল, কিন্তু বহুদিন তাহার ব্রাহ্মণদের সঙ্গে সংস্পর্শে না আসায় তাহারা ব্রাহ্মণ্য পুজাচার প্রভৃতি পরিত্যাগ করিয়াছিল, এবং সেই হেতু তাহাদের শূদ্র পর্যায়ে নামাইয়া দেওয়া হইয়াছিল। (২৯) অন্যান্য কোমদের ক্ষেত্রেও বোধ হয় এইরূপ হইয়া থাকিবে। মনু কৈবর্তদদের বলিয়াছেন সংকর বর্ণ, কিন্তু বিষ্ণুপুরাণ তাহাদের বলিতেছে “অব্রহ্মণ্য,” অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য সমাজ বহির্ভূত। কিন্তু একদিকে স্বীকৃতি অন্তর্ভূক্তি এবং আর একদিকে উন্নীত অবনীতকরণ যাহাই চলিতে থাকুক না কেন, এ-তথ্য সুস্পষ্ট যে আর্য সংস্কৃতির প্রভাব বিস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে আর্য বর্ণবিন্যাসও বাংলা দেশে ক্রমশঃ তাহার মূল প্রতিষ্ঠিত করিতেছিল। শুধু ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বীরাই যে আর্য সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থা বাংলাদেশে বহন করিয়া আনিয়াছিলেন তাহাই নয়, জৈন ও বৌদ্ধধমাবলম্বীরাও এ-সম্বন্ধে সমান কৃতিত্বের দাবি করিতে পারেন। তাঁহারা বেদবিরোধী ছিলেন সন্দেহ নাই, কিন্তু আর্য সমাজ-ব্যবস্থা বিরোধী ছিলেন না, এবং বর্ণব্যবস্থাও একেবারে অস্বীকার করেন নাই।(৩০)

মৌর্য ও শুঙ্গাধিপত্যের সঙ্গে সঙ্গে এবং তাহাকে আশ্রয় করিয়া আর্য সংস্কৃতি সমাজব্যবস্থা ক্রমশঃ বাংলাদেশে অধিকতর প্রসার লাভ করিয়াছিল সন্দেহ নাই, বিশেষতঃ ব্রাহ্মণ্যধররমাবলম্বী রাষ্ট্রের আদিপত্যকালে। কিন্তু, মহাস্থান লিপির গলদন পুরাদস্তুর বাংলা নাম বলিয়াই মনে হইতেছে; প্রাকৃত গলদনকে সংস্কৃত গলদন বলিলেও তাহার দেশজ রূপ অপরিবর্তিতই থাকিয়া যায়। লিপিটির ভাষা প্রাকৃত; মৌর্য আমলের সবলিপির ভাষাই ত তাহাই; কিন্তু বঙ্গে যে আর্য সামাজিক আদর্শ গৃহীত ও স্বীকৃত হইতেছিল তাই সুস্পষ্ট। বোধ হয় এই সময় হইতেই ব্যবসা-বাণিজ্য, ধৰ্ম প্রচার, রাষ্ট্রধর্ম প্রভৃতিকে আশ্রয় করিয়া অধিকতর সংখ্যায় উত্তর ভারতীয় আর্যভাষীরা বাংলাদেশে আসিয়া বসবাস আরম্ভ করিতে থাকে। কিন্তু আর্য, বৌদ্ধ, জৈন এবং সর্বোপরি ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতির পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা গুপ্তকালের আগে হইয়া ছিল বলিয়া মনে হয় না, এবং আর্য বৰ্ণব্যবস্থা ও বাংলাদেশে বোধ হয় তাহার আগে দানা বাঁধিয়া গড়িয়া উঠে নাই।

বাংলাদেশের অধিকাংশ জনপদ গুপ্তসাম্রাজ্যভুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালী সমাজ উত্তরভারতীয় আর্য-ব্রাহ্মণ্য বর্ণ ব্যবস্থান অন্তর্ভূক্ত হইতে আরম্ভ করে। এই যুগের লিপিমালাই(৩১) তাহার নিঃসংশয় সাক্ষ্য বহন করিতেছে। লিপিগুলি বিশ্লেষণ করিলে অনেকগুলি তথ্য জানা যায়।

———————
(১৪) দৃষ্টান্তস্বরূপ দ্রষ্টব্য, Census Report of India, 1931., vol. I, part I, Section on Caste.
(১৫) ঐতরেয় আরণ্যক ২.১.১; Aita. Ara., ed. Keith, 101, 200.
(১৬) ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, ৭৷১৩-১৮
(১৭) মহাভারত, সভাপর্ব, ৫২৷১৭; বায়ু পুরাণ, ৯৯৷১১৷৮৫…; মৎস্যপুরাণ, ৪৮৷৭৭…
(১৮) মহাভারত, ২।৩০; ভাগবতপুরাণ, ২৪।৪।১৮
(১৯) বোধায়ন, ১।১।২৫-৩১
(২০) আচারঙ্গ সূত্র ১।৮।৩ , S. B. E. XXII. 84, 264
(২১) Ed. Ganapati Sastri, ২২ পটল, পৃ. ২৩২-৩৩
(২২) রামায়ণ, ২।১০।৩৬-৩৭
(২৩) মহাভারত, সভাপর্ব ৫২৷১৭; বায়ুপুরাণ ৯৯৷১১।৮৫…; মৎস্যপুরাণ, ৪৮।৭৭…
(২8) মানবধর্মশাস্ত্র,
(২৫) ৫২।১৭
(২৬) lnd. Ant. p. 375
(২৭) বনপর্ব ৮৫।২-৪, ১।২১৬, কামসূত্র, ৬।৩৮, ৪১
(২৮) মহাভারত, ১।১০৪, ২।৫১, ১৪।২৯, বিষ্ণুপুরাণ, ৪।৮।১; মৎস্যপুরাণ, ৪৮।১।৪, মনুস্মৃতি, ১০।৪৪।
(২৯) মনুস্মৃতি, ১০।৪৪
(৩০) Rhys Davids, Buddhist India.
(৩১) এই পর্বে যে-সমস্ত লিপি হইতে তথ্য সংগৃহীত হইয়াছে তাহার তালিকা ও সূচীর জন্য পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *