১০. যাকারিয়া ও ইয়াহয়া (আ)

যাকারিয়া ও ইয়াহয়া (আ)

আল্লাহর বাণী : বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

—কাফ-হা-ইয়া-আয়ন-সাদ; এটা তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহের বিবরণ তার বান্দা যাকারিয়ার প্রতি। যখন সে তার প্রতিপালককে আহবান করেছিল নিভৃতে। সে বলেছিল, আমার অস্থি দুর্বল হয়েছে। বার্ধক্যে আমার মস্তক শুভ্রোজ্জ্বল হয়েছে : হে আমার প্রতিপালক! তোমাকে আহবান করে আমি কখনও ব্যৰ্থকাম হইনি। আমি আশাংকা করি আমার পর আমার স্বগোত্রীয়দের সম্পর্কে; আমার স্ত্রী বন্ধ্যা। সুতরাং তুমি তোমার নিকট হতে আমাকে দান কর উত্তরাধিকারী। যে আমার উত্তরাধিকারিত্ব করবে এবং উত্তরাধিকারিত্ব করবে। ইয়াকুবের বংশের, এবং হে আমার প্রতিপালক! তাকে করো সন্তোষভাজন। তিনি বললেন ৪ হে যাকারিয়্যা! আমি তোমাকে এক পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি। তার নাম হবে ইয়াহয়া; এ নামে পূর্বে আমি কারও নামকরণ করিনি। সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! কেমন করে আমার পুত্র হবে যখন আমার স্ত্রী বন্ধ্যা ও আমি বার্ধ্যাক্যের শেষ সীমায় উপনীত। তিনি বললেন, এ এরূপই হবে। তোমার প্রতিপালক বললেন, এ তো আমার জন্যে সহজসাধ্য, আমি তো পূর্বে তোমাকে সৃষ্টি করেছি। যখন তুমি কিছুই ছিলে না। যাকারিয়্যা বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি নিদর্শন দাও। তিনি বললেন, তোমার নিদর্শন এই যে, তুমি সুস্থ থাকা সত্ত্বেও কারও সাথে তিন দিন বাক্যালাপ করবে না। অতঃপর সে কক্ষ হতে বের হয়ে তার সম্প্রদায়ের নিকট আসল। ইংগিতে তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতে বলল। (আমি বললাম) হে ইয়াহয়া! এই কিতাব দৃঢ়তার সাথে গ্রহণ করা! আমি তাকে শৈশবেই দান করেছিলাম জ্ঞান এবং আমার নিকট হতে হৃদয়ের কোমলতা ও পবিত্ৰতা; সে ছিল মুত্তাকী। পিতামাতার অনুগত এবং সে ছিলনা। উদ্ধত-অবাধ্য। তার প্রতি শান্তি যেদিন তার মৃত্যু হবে এবং যে দিন সে জীবিত অবস্থায় পুনরুখি হবে (১৯ মারায়াম : ১-১৫ )

উক্ত ঘটনা প্রসংগে আল্লাহ অন্যত্র বলেন :

এবং তিনি তাকে (মরিয়ামকে) যাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে রেখেছিলেন। যখনই যাকারিয়া কক্ষে তার সাথে সাক্ষাত করতে যেত, তখনই তার নিকট খাদ্য-সামগ্ৰী দেখতে পেত। সে বলত, হে মরিয়ম। এসব তুমি কোথায় পেলে? সে বলত, এ আল্লাহর নিকট হতে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা! অপরিমিত জীবনোপকরণ দান করেন। সেখানেই যাকারিয়া তার প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা করে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে তুমি তোমার নিকট হতে সৎ বংশধর দান কর। তুমিই প্রার্থনা শ্রবণকারী। যখন যাকারিয়া কক্ষে সালাতে দাঁড়িয়েছিল তখন ফেরেশতাগণ তাকে সস্বোধন করে বলল, আল্লাহ তোমাকে ইয়াহয়ার সুসংবাদ দিচ্ছেন, সে হবে। আল্লাহর বাণীর সমর্থক, নেতা, স্ত্রী-বিরাগী এবং পুণ্যবানদের মধ্যে একজন নবী। সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! বাৰ্ধক্য এসেছে এবং আমার স্ত্রী-বন্ধ্যা। তিনি বললেন, এভাবেই। আল্লাহ যা ইচ্ছা! তা-ই করেন। সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি নিদর্শন দাও। তিনি বললেন, তোমার নিদর্শন এই যে, তিন দিন তুমি ইঙ্গিত ব্যতীত কোন মানুষের সাথে কথা বলতে পারবে না। আর তোমার প্রতিপালককে অধিক স্মরণ করবে। এবং সন্ধ্যায় ও প্ৰভাতে তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করবে (৩ আলে-ইমরান : ৩৭-৪১)

সূরা আম্বিয়ায় আল্লাহ তাআলা বলেন :

এবং স্মরণ করা যাকারিয়্যার কথা, যখন সে তার প্রতিপালককে আহবান করে বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একা রেখো না, তুমি তো শ্ৰেষ্ঠ মালিকানার অধিকারী। অতঃপর আমি তার আহবানে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে দান করেছিলাম ইয়াহয়া এবং তার জন্যে তার স্ত্রীকে যোগ্যতা সম্পন্ন করেছিলাম। তারা সৎ কাজে প্রতিযোগিতা করত, তারা আমাকে ডাকত আশা ও ভীতির সাথে এবং তারা ছিল আমার নিকট বিনীত। (২১ আম্বিয়া? ৮৯-৯০) আল্লাহ আরও বলেন :

—এবং যাকারিয়্যা, ইয়াহয়া, ঈসা ও ইলিয়াস, সকলেই সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত।

ইব্‌ন আসাকির তাঁর বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থে হযরত যাকারিয়্যা (আ)-এর বংশ তালিকা নিম্নরূপ বর্ণনা করেছেন, যথা : যাকারিয়্যা ইব্‌ন বারখিয়া বা যাকারিয়্যা ইব্‌ন দান কিংবা

ইব্‌ন আয়নামান ইব্‌ন রাহবিআম ইব্‌ন সুলায়মান ইব্‌ন দাউদ। যাকারিয়্যা ছিলেন বনী ইসরাঈলের নবী ইয়াহয়া (আ)-এর পিতা। তিনি পুত্ৰ ইয়াহয়ার সন্ধানে দামিশকের বুছায়না শহরে গিয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন, পুত্ৰ ইয়াহয়া নিহত হওয়ার সময় তিনি দামিশকেই অবস্থান করছিলেন। তার নিসাবনামা সম্পর্কে আরও বিভিন্ন মত রয়েছে। উচ্চারণে যাকারিয়্যা। (দীর্ঘ স্বরবিশিষ্ট) যাকারিয়্যা বা যাকরা বলা হয়ে থাকে।

আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে যাকারিয়া নবীকে সন্তান প্রদানের ঘটনা মানুষের নিকট বর্ণনা করার নির্দেশ দেন। আল্লাহ যখন যাকারিয়াকে পুত্ৰ সন্তান দান করেন তখন তিনি ছিলেন বৃদ্ধ। তার স্ত্রী যৌবনকাল থেকেই ছিলেন বন্ধ্যা। আর এখন বার্ধক্যে আক্রান্ত। কিন্তু এসব প্রতিকূল অবস্থা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তিনি আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হননি। আল্লাহ বলেন :  (এটা তোমার পালনকর্তার অনুগ্রহের বিবরণ তাঁর বান্দা যাকারিয়ার প্রতি, যখন সে তার পালনকর্তাকে আহবান করেছিল নিভৃতে।)। কাতাদা। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, আল্লাহ স্বচ্ছ অন্তর ও ক্ষীণ আওয়াজ সম্পর্কে সম্যক অবহিত। কোন কোন প্রাচীন আলিম বলেছেন, হযরত যাকারিয়া (আ) রাত্ৰিবেলা নিদ্রা থেকে উঠে অতি ক্ষীণ আওয়াজে, যাতে তার কাছের কেউ শুনতে না পায় আল্লাহকে আহবান করে বলেন, হে আমার প্রভো! হে আমার প্রভো! হে আমার প্ৰভো! আল্লাহ তাআলা আহবানে সাড়া দিয়ে বললেন : লাব্বায়েক; লাব্বায়েক!! লাব্বায়েক!!! এরপর যাকারিয়া বলেন, … -1, 1।। ৬৯%,। ৩-৩ —প্ৰভো! আমার অস্থি দুর্বল হয়ে পড়েছে, বয়সে দেহ ভারাবনত হয়ে গিয়েছে। [….. …।। J, ../3 —বার্ধক্যে মস্তক সুশুভ্র হয়েছে। অগ্নি শিখা যেমন কাষ্ঠখণ্ড গ্রাস করে, তেমন বাৰ্ধক্য আমার কাল চুল গ্রাস করে নিয়েছে।

হযরত যাকারিয়া (আ) আল্লাহকে জানালেন যে, বার্ধক্যের দুর্বলতা বাহ্যিকভাবে ও অভ্যন্তরীণভাবে তাঁকে গ্রাস করে ফেলেছে।,,,, etc., 521.13

হে আমার পালনকর্তা! আপনাকে ডেকে আমি কখনও বিফল মনোরথ হইনি। অর্থাৎআমি ইতিপূর্বে আপনার নিকট যা কিছু চেয়েছি, আপনি তা আমাকে দিয়েছেন। হযরত যাকারিয়্যার সন্তান কামনার পশ্চাতে যে প্রেরণাটি কাজ করেছিল, তা এই যে, তিনি হযরত মরিয়ম বিনত ইমরান ইব্‌ন মাছানকে বায়তুল মুকাদাসে দেখাশুনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বায়তুল মুকাদাসের যে কক্ষে বিবি মরিয়ম থাকতেন, সে কক্ষে যাকারিয়্যা (আঃ) যখনই যেতেন। দেখতেন, ভিন্ন মওসুমের পর্যাপ্ত ফল মরিয়মের পাশে মওজুদ রয়েছে। বস্তৃত এটা ছিল আওলিয়াদের কারামতের একটি নিদর্শন। তা দেখে। হযরত যাকারিয়ার অন্তরে এ কথার উদয় হল যে, যে সত্তা মরিয়মকে ভিন্ন মওসুমের ফল দান করছেন, তিনি আমাকে এই বৃদ্ধ বয়সে সন্তানও দান করতে পারেন। সূরা আলে-ইমরানে আছে, সেখানেই যাকারিয়া তার পালনকর্তার নিকট প্রার্থনা করল। বললো, হে আমার পালনকর্তা! তোমার নিকট থেকে আমাকে পূত-পবিত্র সন্তান দান কর! নিশ্চয়ই তুমি প্রার্থনা শ্রবণকারী। (৩ : ৩৮)।

সূরা মরিয়ামে আল্লাহর বাণী :

—আমি ভয় করি আমার পর আমার স্বগোত্রকে এবং আমার স্ত্রী বন্ধ্যা। [… বা স্বগোত্র বলতে গোত্রের এমন একটি দলের কথা বুঝানো হয়েছে, যাদের ব্যাপারে নবী আশংকা প্রকাশ করেছেন যে, তাঁর মৃত্যুর পরে এরা বনী-ইসরাঈলকে বিভ্রান্ত করে শরীয়তের পরিপন্থী ও নবীর আনুগত্য বিরোধী কাজে জড়িয়ে ফেলবে। এ কারণে তিনি আল্লাহর নিকট একটি সুসন্তান প্রার্থনা করেন। তিনি বললেন : (, J, এ14, –, -4/3 —আপনি আমাকে নিজের পক্ষ থেকে একজন উত্তরাধিকারী দান করুন। ير ئنى নবুওতের দায়িত্ব পালনে এবং বনী ইসরাঈলের নেতৃত্ব প্রদানে সে হবে আমার স্থলাভিষিক্ত। –j; — UT – ১.১-৫ —এবং সে প্রতিনিধিত্ব করবে। ইয়াকুব বংশের। অর্থাৎ ইয়াকুবের সন্তানদের মধ্যে তার (অর্থাৎ আমার প্রার্থিত পুত্রের) পূর্ব-পুরুষগণ যেভাবে নবুওত, মর্যাদা ও ওহী প্রাপ্ত হয়েছে, তাকেও সেই সুমহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করুন! এখানে উত্তরাধিকারী বলতে ধন-সম্পদের উত্তরাধিকারী হওয়া বুঝানো হয়নি। কিন্তু শী আ সম্প্রদায় এখানে ধন-সম্পদের উত্তরাধিকার অর্থই গ্রহণ করেছে। ইব্‌ন জারীরও এখানে শীয়া মতকে সমর্থন করেছেন। তিনি সালিহ ইব্‌ন ইউসুফের উক্তির কথাও নিজের মতের সমর্থনে উল্লেখ করেছেন।

কিন্তু কয়েকটি কারণে এই মত গ্রহণযোগ্য নয়। (এক) সূরা নামল এর ১৬ নং আয়াত 3:16, LA, 1. এ.533 -সুলায়মান দাউদের (নবুওত ও রাজত্বের) উত্তরাধিকারী হয়। এ আয়াতের অধীনে আমরা বুখারী মুসলিমসহ। সহীহ, মুসনাদ ও সুনান গ্রন্থাদিতে বিভিন্ন সূত্রে বহু সংখ্যক সাহাবী থেকে বর্ণিত সেই প্রসিদ্ধ হাদীস আমরা কোন উত্তরাধিকারী রেখে যাই না, মৃত্যুর পরে যা কিছু পরিত্যক্ত সম্পদ থাকে, তা সর্বসাধারণের জন্যে সাদাকা বা দান হিসেবে গণ্য হবে। এ হাদীস থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পরিত্যক্ত সম্পদের কোন উত্তরাধিকারী রেখে যাননি। এ কারণেই রাসূল (সা) তাঁর জীবদ্দশায় যে সব সম্পত্তি ব্যক্তিগতভাবে ভোগ করতেন, হযরত আবু বকর সিদীক (রা) সেগুলো রাসূল (সা)-এর উত্তরাধিকারীদের হাতে তুলে দেননি। অথচ উপরোক্ত হাদীস

সহধর্মিণী ও তার চাচা হযরত আব্বাস (রা) প্ৰমুখের হাতে আসতো। এসব উত্তরাধীকারীদের দাবির বিরুদ্ধে হযরত আবু বকর (রা) উপরোক্ত হাদীসটি দলীল হিসেবে পেশ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে উপরোক্ত হাদীস বর্ণনার প্রতি সমর্থন দেন। হযরত উমর, হযরত উছমান, হযরত আলী, হযরত আব্বাস, আবদুর রহমান ইব্‌ন আওফ তালহা, যুবায়র, আবু হুরায়রা (রা) প্রমুখ সাহাবায়ে কিরাম। 鸭

(দুই) উপরোক্ত হাদীসটি ইমাম তিরমিয়ী তাঁর গ্রন্থে বহুবচনের শব্দ দ্বারা বর্ণনা করেছেনফলে সকল নবীই এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। তিনি এভাবে বর্ণনা করেছেন। –&L-এ এ -, এ, ১১, ১ °L_ ৭১। অর্থাৎ আমরা নবীরা কোন উত্তরাধীকারী রেখে যাই না। ইমাম তিরমিয়ী এ বর্ণনাটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

(তিন)। নবীগণের নিকট দুনিয়ার সহায়-সম্পদ সর্বদাই অতি নগণ্য ও তুচ্ছ বলে গণ্য হয়েছে। তারা কখনই এগুলো সংগ্রহে লিপ্ত হননি, এর প্রতি ভ্ৰক্ষেপ করেননি এবং এর কোন গুরুত্বই দেননি। সুতরাং সন্তান ধন-সম্পদ সঞ্চায়ের জন্যে প্রার্থনা করার প্রশ্নই আসে না। কারণ, যে সন্তান ত্যাগের মহিমায় নবীদের মর্যাদার সীমানায় পৌঁছতে পারবে না, সে তো নবীর পরিত্যক্ত সামান্য সম্পদকে কোন গুরুত্বই দেবে না। তাই সেই তুচ্ছ সম্পদের উত্তরাধিকারী বানানোর লক্ষ্যে কোন সন্তান কামনা করা একেবারেই অবান্তর।

(চার) ঐতিহাসিক মতে নবী যাকারিয়া পেশায় ছিলেন ছুতার। স্বহস্তে উপার্জিত রোয়গার দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন, যেমনটি করতেন। হযরত দাউদ (আ)। বলাবাহুল্য, নবীগণ সাধারণতঃ আয়-রোযগারে এমনভাবে আত্মনিয়োগ করতেন না, যার দ্বারা অতিরিক্ত মাল সঞ্চয় হতে পারে এবং পরবর্তী সন্তানগণ তার উত্তরাধিকারী হতে পারবে। ব্যাপারটি দিবালোকের মত স্পষ্ট। সামান্য চিন্তা করলেই যে কেউ বিষয়টি সহজেই বুঝতে পারে।

ইমাম আহমদ ……. আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যাকারিয়া নবী ছিলেন একজন ছুতার। ইমাম মুসলিম ও ইব্‌ন মাজাহ অভিন্ন সূত্রে হাম্মাদ ইব্‌ন সালমা থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। আল্লাহর বাণী : হে যাকারিয়া! আমি তোমাকে এক পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি, তার নাম হবে ইয়াহয়া; এ নামে পূর্বে আমি কারও নামকরণ করিনি। এখানে এ কথাটি সূরা আল-ইমরানের-৩৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে : যখন যাকারিয়া কক্ষে সালাতে দাড়িয়েছিল তখন ফেরেশতাগণ তাকে সম্বোধন করে বলল, আল্লাহ তোমাকে ইয়াহয়ার সুসংবাদ দিচ্ছেন, সে হবে আল্লাহর বাণী সমর্থক, নেতা, স্ত্রী-বিরাগী এবং পুণ্যবানদের মধ্যে একজন নবী। এরপর যখন তাকে পুত্ৰ সন্তানের

ংবাদ দেয়া হল এবং তিনি নিশ্চিত হলেন তখন নিজের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করে সন্তান হওয়ার বিষয়ে বিস্মিত হয়ে আল্লাহর নিকট জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, হে আমার প্রতিপালক! কেমন করে আমার পুত্র হবে, যখন আমার পত্নী বন্ধ্যা ও আমি বার্ধক্যের শেষ সীমায় উপনীত? অর্থাৎ একজন বৃদ্ধ লোকের সন্তান কিভাবে হতে পারে? কেউ কেউ বলেছেন, হযরত যাকারিয়ার বয়স ছিল তখন সাতাত্তির বছর। প্রকৃত পক্ষে তাঁর বয়স ছিল এর থেকে আরও বেশী। আমার স্ত্রী বন্ধ্যা অর্থাৎ যৌবনকাল থেকেই আমার স্ত্রী বন্ধ্যা- কোন সন্তানাদি হয় না। এমনি এক অবস্থায় হযরত ইবরাহীম খলীলকে ফিরিশতাগণ পুত্র হওয়ার সুসংবাদ দিয়েছিলেন, তখন তিনি বিস্ময়ভরে জিজ্ঞেস করেছিলেন— বাৰ্ধক্য যখন আমাকে পেয়ে বসেছে, তখন তোমরা আমাকে সুসংবাদ জানাচ্ছি, বল, কি সেই সসুংবাদ? তাঁর স্ত্রী সারা বলেছিলেন, কী আশ্চৰ্য্য! সন্তানের জননী হব আমি, যখন আমি বৃদ্ধা এবং এই আমার স্বামী বৃদ্ধ!! এটা অবশ্যই এক অদ্ভুত ব্যাপার! ফেরেশতারা বলল, আল্লাহর কাজে তুমি বিস্ময়বোধ করছ? হে পরিবারবর্গ! তোমাদের প্রতি রয়েছে আল্লাহর অনুগ্রহ ও কল্যাণ! তিনি প্রশংসাহ ও সম্মানাহঁ (১১ হৃদ : ৭২, ৭৩)।

হযরত যাকারিয়া (আ)-কেও আগত ফেরেশতা ঠিক এ জাতীয় উত্তর দিয়েছিলেন। ফেরেশতা বলেছিলেন, এরূপই হবে; তোমার প্রতিপালক বলেছেন, এ কাজ আমার জন্যে সহজসাধ্য; আমি তো পূর্বে তোমাকে সৃষ্টি করেছি, যখন তুমি কিছুই ছিলে না। অর্থাৎ আল্লাহ যখন তোমাকে অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে অস্তিত্ব দান করতে পেরেছেন, তখন তিনি কি তোমার বৃদ্ধ অবস্থায় সন্তান দিতে পারবেন না?। সূরা আম্বিয়ায় (৯০) আল্লাহর বাণী অতঃপর আমি তার আহবানে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে দান করেছিলাম ইয়াহয়া এবং তার জন্যে তার স্ত্রীকে যোগ্যতাসম্পন্ন করেছিলাম। তারা সৎকর্মে প্রতিযোগিতা করত, তারা আমাকে ডাকত আশা ও ভীতির সাথে এবং তারা ছিল আমার নিকট বিনীত। স্ত্রীকে যোগ্যতা সম্পন্ন করার অর্থ- স্ত্রীর মাসিক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, পুনরায় তা চালু হয়ে যায়। কারও মতে তার স্ত্রী মুখরা ছিলেন, তা ভাল করে দেয়া হয়। যাকারিয়া বললেন, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি নিদর্শন দাও। অর্থাৎ আমাকে এমন একটি লক্ষণ দাও, যা দ্বারা আমি বুঝতে পারি যে, এই প্রতিশ্রুত সন্তান আমার থেকে স্ত্রীর গর্ভে এসেছে। আল্লাহ জানালেন, তোমার নিদর্শন এই যে, তুমি সুস্থ থাকা সত্ত্বেও কারও সাথে তিন দিন বাক্যালাপ করবে না। অর্থাৎ তোমার বুঝবার সে লক্ষণ হল, তোমাকে নীরবতা আবিষ্ট করে ফেলবে, ফলে তিন দিন পর্যন্ত মানুষের সাথে ইশারা ইংগিত ব্যতীত কথা বলতে পারবে না। অথচ তোমার শরীর, মন ও মেজাজ সবই সুস্থ অবস্থায় থাকবে। এ সময়ে তাকে সকাল-সন্ধ্যায় অধিক পরিমাণ আল্লাহর যিকর ও তাসবীহ মনে মনে পাঠ করার নির্দেশ দেয়া হয়। এ সুসংবাদ পাওয়ার পর হযরত যাকারিয়া (আ) কক্ষ হতে বের হয়ে আপন সম্প্রদায়ের নিকট চলে আসলেন এবং তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্ৰতা ও মহিমা ঘোষণা করতে ইঙ্গিত (ওহী) করলেন। এখানে ওহী শব্দটি গোপন নির্দেশ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মুজাহিদ ও সুদীর মতে, এখানে ওহী অর্থ লিখিত গোপন নির্দেশ। কিন্তু ওহাব, কাতাদা ও মুজাহিদের ভিন্ন মতে ইংগিতের মাধ্যমে নির্দেশ। মুজাহিদ, ইকরিম, ওহাব, সুদী ও কাতাদা বলেছেন, কোনরূপ অসুখ ব্যতীতই যাকারিয়া (আ)-এর জিহবা আড়ষ্ট হয়ে যায়। ইব্‌ন যায়দা বলেছেন, তিনি পড়তে ও তাসবীহ পাঠ করতে পারতেন; কিন্তু কারও সাথে কথা বলতে পারতেন না। আল্লাহর বাণী, হে ইয়াহয়া, এই কিতাব দৃঢ়তার সাথে গ্রহণ কর, আমি তাকে শৈশবেই দান করেছিলাম জ্ঞান। এ আয়াতের মাধ্যমে পূর্বে যাকারিয়া (আ)-কে যে পুত্রের সুসংবাদ দেয়া হয়েছিল, তারই অস্তিত্বে আসার কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাকে শৈশবকালেই কিতাবের জ্ঞান ও প্ৰজ্ঞা দান করেছিলেন।

আবদুল্লাহ ইব্‌ন মুবারক (র) বলেন, মামার বলেছেন : একবার কতিপয় বালক ইয়াহয়া ইব্‌ন যাকারিয়াকে তাদের সাথে খেলতে যেতে বলেছিল, তখন তিনি তাদেরকে বলেছিলেন, খেলার জন্যে আমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়নি। শৈশবে তাকে জ্ঞান দান করেছিলাম- এ আয়াতেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। উক্ত ঘটনায়। আল্লাহর বাণী : এবং আমার নিকট হতে তাকে দেয়া হয়েছিল হানোনা, অর্থাৎ হৃদয়ের কোমলতা ও পবিত্রতা এবং সে ছিল মুত্তাকী  ইব্‌ন জারীর …… ইব্‌ন আব্বাস (র) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, হানোনা কি তা আমি জানি না। ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে অপর সূত্রে এবং মুজাহিদ, ইকরিম, কাতাদা ও যাহাহাক থেকে বর্ণিত, হানানা অর্থ দয়া। আমার নিকট থেকে দয়া এসেছিল অর্থাৎ যাকারিয়ার প্রতি আমি দয়া করেছিলাম, ফলে তাকে এই পুত্ৰ সন্তান দান করা হয়েছিল। ইকরিমা বলেন, হানোনা অর্থ মহব্বত; অর্থাৎ তাকে আমি মহব্বত করেছিলাম। উপরোক্ত অর্থ ছাড়া হানোনা শব্দটি ইয়াহয়া (আ)-এর বিশেষ গুণও হতে পারে। অর্থাৎ মানুষের প্রতি ইয়াহয়ার ভালবাসা ছিল অধিক; বিশেষ করে তাঁর পিতা-মাতার প্রতি মহব্বত ও ভালবাসা ছিল অতি প্রগাঢ়। ইয়াহয়াকে পবিত্ৰতা দেয়া হয়েছিল অর্থাৎ- তার চরিত্র ছিল নিষ্কলুষ এবং ত্রুটিমুক্ত।

মুত্তাকী অর্থ আল্লাহর নির্দেশ পালনকারী ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে অবস্থানকারী। এরপর আল্লাহ পিতা-মাতার প্রতি ইয়াহয়া (আ)-এর উত্তম ব্যবহার, তাদের আদেশ-নিষেধের আনুগত্য এবং কথা ও কাজের দ্বারা পিতা-মাতার অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকার কথা উল্লেখ পূর্বক বলেন : এবং সে ছিল পিতা-মাতার অনুগত এবং সে ছিল না। উদ্ধত, অবাধ্য। অতঃপর আল্লাহ বলেন : তার প্রতি শান্তি যে দিন সে জন্মলাভ করে, যে দিন তার মৃত্যু হবে এবং যে দিন সে জীবিত অবস্থায় পুনরুখিত হবে। উল্লেখিত সময় তিনটি মানব জীবনে অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন অবস্থা হিসাবে বিবেচিত। কারণ, এ তিনটি সময় হল এক জগত থেকে আর এক জগতে স্থানান্তরের সময় ৷ এক জগতে কিছুকাল অবস্থান করায় সে জগতের সাথে পরিচিতি লাভ ও ভালবাসা সৃষ্টি হওয়ার পর তা ছিন্ন করে এমন এক জগতে চলে যেতে হয়, যে জগত সম্পর্কে তার কিছুই জানা থাকে না। তাই দেখা যায় নবজাত শিশু মাতৃগর্ভের কোমল ও সংকীর্ণ স্থান ত্যাগ করে যখন এ সমস্যাপূর্ণ পৃথিবীতে আসে তখন সে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।

অনুরূপভাবে এ পৃথিবী ছেড়ে যখন সে বরযখ জগতে যায়, তখনও একই অবস্থা দেখা দেয়। এসব জগত ত্যাগ করে মৃত্যুর আংগিনায় পৌঁছে সে কবরের বাসিন্দা হয়ে ইস্রাফীলের সিংগায় ফুক দেওয়ার অপেক্ষায় থাকে। এর পরেই তার স্থায়ী বাসস্থান। কবর থেকে পুনরুথিত হবার পর হয় স্থায়ী শান্তি ও সুখ, না হয় চিরস্থায়ী শাস্তি ও দুঃখ। কেউ হবে জান্নাতের অধিবাসী, আর কেউ হবে জাহান্নামের বাসিন্দা। জনৈক কবি অতি সুন্দরভাবে কথাটি বলেছেন :

অর্থঃ যে দিন তোমার মা তোমাকে ভূমিষ্ট করেছিল, সে দিন তুমি চিৎকার দিয়ে কাদছিলে, আর লোকজন পাশে থেকে খুশিতে হাসছিল। এখন তুমি এমনভাবে জীবন গড়ে তোল, যেন

মৃত্যুকালে তুমি আনন্দচিত্তে হাসতে হাসতে মরতে পোৰ, আর লোকজন তোমার পাশে বসে কান্দতে বাধ্য হয়।

উপরোক্ত স্থান তিনটি যখন মানুষের উপর অত্যধিক কঠিন, তখন আল্লাহ হযরত ইয়াহয়াকে প্রতিটি স্থানেই শান্তি ও নিরাপত্তার ঘোষণা দান করে বলেছেন : তার প্রতি শান্তি যে দিন সে জন্ম লাভ করে, যে দিন তার মৃত্যু হবে এবং যে দিন সে জীবিত অবস্থায় পুনরুথিত হবে। সাঈদ ইব্‌ন আবী আরূবা কাতাদার সূত্রে হাসান থেকে বর্ণনা করেন, এক দিন ইয়াহয়া ও ঈসা (আ) পরস্পর সাক্ষাতে মিলিত হন। ঈসা (আঃ) ইয়াহয়া (আঃ)-কে বললেন, আমার জন্যে ইস্যুতিগফার কর, কেননা তুমি আমার চাইতে উত্তম। ইয়াহয়া বললেন, বরং আপনি আমার জন্যে ইস্তিগফার করুন, যেহেতু আমার তুলনায় আপনি শ্রেষ্ঠ। ঈসা বললেন, তুমি আমার চাইতে শ্রেষ্ঠ। কেননা, আমি নিজেই আমার উপর শান্তি ঘোষণা করেছি, আর তোমার উপর শান্তি ঘোষণা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ। এর দ্বারা উভয়ের উচ্চ মর্যাদার কথা জানা গেল। সূরা আলে-ইমরানের ৩৯নং আয়াতে উল্লেখিত সে হবে নেতা, স্ত্রী-বিরাগী এবং পুণ্যবানদের 3 – آگiج ام)l{Tگ (سیدا و حصور او نبیا من الصالحین.) ۲۹ l < SI۹۹گ آk)}ه বিরাগী প্রসংগে কেউ কেউ বলেছেন- হাসূরা বলা হয় ঐ ব্যক্তিকে, যে কখনও কোন নারীর সঙ্গ ভোগ করে না, কেউ কেউ ভিন্ন অর্থও করেছেন। এটিই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। কেননা, যাকারিয়া (আ) দোয়ায় বলেছিলেন, আমাকে তুমি তোমার নিকট থেকে পবিত্ৰ বংশধর দান কর। এ দোয়ার সাথে উপরোক্ত অর্থই বেশী মিলে। ইমাম আহমদ . ইব্‌ন আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আদম সন্তানের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে কোন গুনাহ৷ করেনি; কিংবা অন্ততঃ গুনাহর ইচ্ছা পোষণ করেনি, একমাত্ৰ ইয়াহয়া ইব্‌ন যাকারিয়া ব্যতীত। আর কারও পক্ষেই এরূপ কথা বলা বাঞ্ছনীয় নয় যে, আমি ইউনুস ইব্‌ন মাত্তার চেয়ে ভাল। এ হাদীছের সনদে আলী ইব্‌ন যায়দ ইব্‌ন জাদ আন নামক বর্ণনাকারী সম্পর্কে একাধিক ইমাম বিরূপ মন্তব্য করেছেন। তার বর্ণিত হাদীছ গ্রহণযোগ্য নয়। ইব্‌ন খুযায়মা ও দারাকুতনী ও হাদীছটিকে আবু আসিম আবাদানীর সূত্রে উক্ত আলী ইব্‌ন যায়দ ইব্‌ন জাদআন থেকে আরও বিশদভাবে বর্ণনা করার পর ইব্‌ন খুযায়মা (র) বলেছেন : এই হাদীছের সনদ আমাদের শর্ত অনুযায়ী নয়।

ইব্‌ন ওহাব … ইব্‌ন শিহাব থেকে বর্ণনা করেছেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) সাহাবাদের মাঝে আসেন। তারা তখন বিভিন্ন নবীদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে আলোচনা করছিল।

একজন বলছিল, মূসা (আঃ) আল্লাহর সাথে কথা বলেছেন, তিনি কালীমুল্লাহ। আর একজন বলছিল, ঈসা আল্লাহর রূহ ও তার কালেমা-ঈসা। রূহুল্লাহ। আর একজন বলছিল, ইবরাহীম আল্লাহর বন্ধু খলীলুল্লাহ। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বলছেন: শহীদের পুত্র শহীদের উল্লেখ করছ না কেন? তিনি তো পাপের ভয়ে উটের লোমের তৈরী বস্ত্র পরতেন এবং গাছের পাতা খেতেন। ইব্‌ন ওহাব বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) এ কথার দ্বারা ইয়াহয়া ইব্‌ন যাকারিয়াকে বুঝিয়েছিলেন। মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক….. ইবনুল আস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, প্রত্যেক আদম-সন্তান কিয়ামতের দিন কোন না কোন ত্রুটিসহ আল্লাহর সম্মুখে হাজির হবে: কেবল ইয়াহয়া ইব্‌ন যাকারিয়াই হবেন তার ব্যতিক্রম। মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক হাদীস বর্ণনায় তান্দলীস* করেন।

আবদুর রাযযাক… সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিাব (রা) থেকে এ হাদীস মুরসালভাবে বর্ণনা করেছেন। ইব্‌ন আসাকিরও এ হাদীসখানা বিভিন্ন সূত্রে বর্ণনা করেছেন। এ কথা বলে রাবী তিলাওয়াত করতেন : ১৫-২-২, 1, …। এরপর তিনি মাটি থেকে কিছু একটা তুলে ধরে বললেন, এ জাতীয় কিছু ব্যতীত তার নিকট আর কিছুই ছিল না; তারপর তিনি একটা পশু কুরবানী করেন। এ বর্ণনাটি মাওকুফ পর্যায়ের, তবে এর মারফু হওয়ার চাইতে মাওকুফ হওয়াটি বিশুদ্ধতর। ইব্‌ন আসাকির মামার থেকে বিভিন্ন সূত্রে উক্ত হাদীছ বর্ণনা করেছেন। অনুরূপ তিনি আবু দাউদ আত্-তায়ালিসী প্রমুখ আবু সাঈদ (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : হাসান ও হুসায়ন জান্নাতবাসী যুবকদের নেতা; তবে দুই খালাত ভাই ইয়াহিয়া ও ঈসা (আঃ) তার ব্যতিক্রম। আবু নুআয়ম ইসফাহানী…… আবু সুলায়মান থেকে বর্ণনা করেন, একদা ঈসা ইব্‌ন মারিয়াম ও ইয়াহ্ইয়া ইব্‌ন যাকারিয়া (আ) একত্রে হেঁটে যাচ্ছিলেন। পথে এক মহিলার সাথে ইয়াহয়ার ধাক্কা লাগে। ঈসা (আ) বললেন, ওহে খালাত ভাই! আজি তুমি এমন একটি গুনাহ করে ফেলেছে যা কখনও মাফ হবে বলে মনে হয় না। ইয়াহয়া (আ) জিজ্ঞেস করলেন, খালাত ভাই! সেটা কী? ঈসা (আ) বললেন, এক মহিলাকে যে ধাক্কা দিলে! ইয়াহয়া বললেন, আল্লাহর কসম, আমি তো টেরই পাইনি। ঈসা বললেন, সুবহানাল্লাহ! কী আশ্চর্য! তোমার দেহ তো আমার সাথেই ছিল, তা হলে তোমার রূহ কোথায় ছিল? ইয়াহয়া (আ) বললেন, আমার রূহ আরশের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। আমার রূহ যদি জিরাবাঈল (আ) পর্যন্ত যেয়ে প্রশান্তি পায়, তাহলে আমি মনে করি, আল্লাহকে আমি কিছু মাত্রই বুঝতে পারিনি। এ বর্ণনাটি গরীব পর্যায়ের এটা ইসরাঈলী উপাখ্যান থেকে নেয়া হয়েছে। রাবী ইসরাঈল …খায়।ছামা থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা ইব্‌ন মারিয়াম ও ইয়াহয়া ইব্‌ন যাকারিয়া ছিলেন পরস্পর খালাত ভাই। ঈসা ভেড়ার পশমজাত বস্ত্র পরতেন, আর ইয়াহয়া পরতেন উটের লোমের তৈরী বস্ত্ৰ। উভয়ের মধ্যে কারোরই কোন দীনারা-দিরহাম, দাস-দাসী ছিল না। ছিল না আশ্রয় গ্রহণের মত কোন ঠিকানা। যেখানেই রাত হত। সেখানেই শুয়ে পড়তেন। তারপর যখন একে অপর থেকে বিদায় নেয়। তখন ইয়াহয়া (আ) ঈসা (আ)-কে বললেন, আমাকে কিছু উপদেশ দিন। ঈসা।

১. যার নিকট থেকে হাদীস শুনেছেন, তার নাম উহ্য রেখে পরবর্তী বর্ণনাকারীর নাম উল্লেখ করাকে তাদলীস বলে।

বললেন, ক্ৰোধ সংবরণ করা। ইয়াহয়া বললেন, ক্ৰোধ সংবরণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ঈসা (আ) বললেন, সম্পদের মোহে পড়ো না। ইয়াহিয়া (আ) বললেন, এটা সম্ভব।

হযরত যাকারিয়া (আ) স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, না নিহত হয়েছিলেন -এ সম্পর্কে ওহাব ইব্‌ন মুনাব্বিহ থেকে একটি বর্ণনায় রয়েছে- যাকারিয়া (আঃ) তাঁর সম্প্রদায় থেকে পালিয়ে একটি গাছের মধ্যে ঢুকে পড়েন। সম্প্রদায়ের লোকজন ঐ গাছটি করাত দ্বারা দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে। করাত যখন তার দেহ স্পর্শ করে, তখন তিনি চিৎকার করেন। আল্লাহ তখন ওহী প্রেরণ করে তাঁকে জানান, তোমার চিৎকার বন্ধ না হলে যমীন উলটিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর তিনি চিৎকার বন্ধ করে দেন এবং তার দেহ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। এ ঘটনা মারফুভাবেও বর্ণিত হয়েছে— যা আমরা পরে উল্লেখ করব। অপর বর্ণনায় বলা হয় যে, যিনি গাছের মধ্যে প্ৰবেশ করেছিলেন, তার নাম যীশাইর। আর হযরত যাকারিয়া স্বাভাবিকভাবেই ইনতিকাল করেছিলেন।

ইমাম আহমদ. হারিছ। আনসারী থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা ইয়াহয়া ইব্‌ন যাকারিয়াকে পাঁচটি বিষয়ে আমল করতে এবং বনী ইসরাঈলকেও আমল করার নির্দেশ দিতে প্ৰত্যাদেশ পাঠান। তিনি একটু বিলম্ব করেছিলেন। তখন ঈসা (আঃ) তাঁকে বলেছিলেন, আল্লাহ তোমাকে পাঁচটি বিষয়ে আমল করতে ও বনী ইসরাঈলকে আমল করার হুকুম করতে আদেশ পাঠিয়েছেন। এখন বল, বনী ইসরাঈলের নিকট এ সংবাদ তুমি পৌঁছিয়ে দিবে, না। আমি যেয়ে পৌঁছিয়ে দিব? ইয়াহয়া (আঃ) বললেন, ভাই! তুমি যদি পৌঁছিয়ে দাও, তাহলে আমার আশংকা হয়, আমাকে হয় শাস্তি দেয়া হবে, না হয় মাটির মধ্যে ধ্বসিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর ইয়াহয়া (আঃ) ইসরাঈলীদেরকে বায়তুল মুকাদ্দাসে সমবেত করলেন। মসজিদ লোকে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। ইয়াহয়া সম্মুখ দিকের উচু স্থানে বসলেন। প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা ও স্তুতি জানালেন। অতঃপর বললেন, আল্লাহ পাঁচটি বিষয়ের হুকুম করেছেন। আমাকে ঐগুলো আমল করতে বলেছেন এবং তোমাদেরকেও আমল করার আদেশ দিতে বলেছেন।

এক : তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত করবে, তার সাথে অন্য কাউকে শরীক করবে না। কেননা তার সাথে শরীক করার উদাহরণ হল যেমন, এক ব্যক্তি তার উপার্জিত খাটি স্বর্ণ বা রৌপ্য দ্বারা একটা গোলাম ক্রয় করল। ঐ গোলাম সারা দিন কাজ করে উপার্জিত ফসল নিজের মনিবকে বাদ দিয়ে অন্যের বাড়িতে উঠায়। তবে এরূপ গোলামের উপর তোমরা কেউ কি সন্তুষ্ট থাকবে? জেনে রেখো, আল্লাহই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই তোমাদের রিযিকের ব্যবস্থা করেছেন; সুতরাং একমাত্র তারই ইবাদত করবে, অন্য কাউকে তার সাথে শরীক করবে না।

দুই : আমি তোমাদেরকে সালাতের আদেশ দিচ্ছি। কেননা আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি তাঁর * অনুগ্রহ অব্যাহত রাখেন, যতক্ষণ না বান্দা অন্য দিকে ফিরে তাকায়। অতএব, যখন তোমরা

সালাত আদায় করবে, তখন অন্য দিকে তাকাবে না।

তিন : সিয়াম পালন করার জন্যে আমি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছি। কেননা, যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করে, তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে এমন ব্যক্তি, যে একটি দলের মধ্যে অবস্থান করছে। তার

নিকট মিশকের একটা কৌটা আছে। আর ঐ মিশকের সুঘাণ দলের প্রতিটি লোক পাচ্ছে। আর শুন, সত্তম পালনকারীর মুখের দুৰ্গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের চাইতে অধিকতর সুঘাণ হিসেবে বিবেচিত।

চার : দান-সাদকা করার জন্যে আমি তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছি। কেননা, যে ব্যক্তি দান সাদকা করে, তার উদাহরণ ঐ ব্যক্তির ন্যায়, যে শত্রুর হাতে ধরা পড়ে বন্দী হয়েছে। তারা তার হাত পা বেঁধে হত্যা করার জন্যে উদ্যোগ নিয়েছে। ঠিক সেই মুহুর্তে সে প্রস্তাব দিল, আমি অর্থের বিনিময়ে মুক্তি চাই। তারা রাজী হল এবং সে ব্যক্তি কম-বেশী অর্থ দান করে জীবন রক্ষা করল।

পাঁচ : আল্লাহর যিকর (স্মরণ) অধিক পরিমাণ করার জন্যে আমি তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছি। কেননা, যে ব্যক্তি অধিক পরিমাণে আল্লাহর যিকর করে, তার দৃষ্টান্ত এমন এক ব্যক্তি, যাকে ধরার জন্যে শত্রুরা দ্রুত ধাওয়া করছে। অতঃপর সে একটি সুরক্ষিত দুর্গে প্রবেশ করে আত্মরক্ষা করল। অনুরূপ বান্দা যতক্ষণ আল্লাহর যিকিরে নিমগ্ন থাকে, ততক্ষণ সে শয়তানের পাকড়াও থেকে নিরাপদে অবস্থান করে।

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন; আমি নিজে তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ের আমল করার জন্যে নির্দেশ দিচ্ছি। এগুলো সম্পর্কে আল্লাহ আমাকে হুকুম করেছেন; (১) জামায়াত বদ্ধভাবে থাকা (২) নেতার কথা শোনা (৩) নেতার আনুগত্য করা (৪) প্রয়োজনে হিজরত করা এবং (৫) আল্লাহর পথে জিহাদ করা। কেননা যে ব্যক্তি জামায়াত থেকে এক বিঘাত পরিমাণও বের হয়ে যায়, সে প্রকৃত পক্ষে ইসলামের রজ্জ্বকে নিজের ঘাড় থেকে খুলে ফেলে। তবে যদি পুনরায় জামায়াতে ফিরে আসে তা হলে ভিন্ন কথা। আর যে ব্যক্তি জাহিলী যুগের রীতি-নীতি প্রতিষ্ঠার জন্যে আহবান করবে, সে জাহান্নামের ধুলিকণায় পরিণত হবে। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে ব্যক্তি যদি সালাত-সাওমে অভ্যস্ত হয়? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, যদি সে সালাত সাওম আদায় করে এবং নিজেকে মুসলমান বলে মনে করে। তবুও। মুসলমানদেরকে সেই নামে ডাকবে, যে নাম তাদেরকে আল্লাহ দিয়েছেন। অর্থাৎ মুমিন, মুসলমান, আল্লাহর -বান্দা। আবু ইয়ালা, তিরমিয়ী, ইব্‌ন মাজাহ, হাকিম তাবারানী বিভিন্ন সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

ইব্‌ন আসাকির. রাবী ইব্‌ন আনাস থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহাবীগণের উদ্ধৃতি দিয়ে আমাদেরকে জানান হয়েছে; তারা বনী ইসরাঈলের আলিমদের থেকে শুনেছেন যে, ইয়াহয়া ইব্‌ন যাকারিয়া পাঁচটি বিধানসহ প্রেরিত হয়েছিলেন। অতঃপর পূর্বোল্লেখিত পাঁচটি বিষয়ের উল্লেখ করেন। তারা আরো বলেছেন, ইয়াহয়া (আ) অধিকাংশ সময় মানুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে গিয়ে নির্জনে অবস্থান করতেন। তিনি বনে-জংগলে থাকতে বেশী পছন্দ করতেন, গাছের পাতা খেয়ে, নদীর পানি পান করে, কখনও কখনও টিডি খেয়ে জীবন ধারণ করতেন এবং নিজেকে সম্বোধন করে বলতেন, হে ইয়াহয়া! তোমার চেয়ে অধিক নিয়ামত আর কার ভাগ্যে জুটেছে? ইব্‌ন আসাকির বর্ণনা করেন, একবার ইয়াহয়ার পিতা-মাতা ছেলের সন্ধানে বের হন। বহু অনুসন্ধানের পর তাকে জিদান নদীর তীরে দেখতে পান। পুত্রকে সেখানে আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর ভয়ে ভীত-কম্পিত দেখে তারা উভয়ে অঝোরে কান্দতে থাকেন। ইব্‌ন ওহাব … মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেন, ইয়াহয়া ইব্‌ন যাকারিয়ার খাদ্য ছিল সবুজ ঘাস। আল্লাহর ভয়ে তিনি অঝোরে কাঁদতেন। তাঁর এ কান্না এত বেশী হতো যে, যদি চোখে আল-কাতরার আস্তরও থাকতো, তবে নিশ্চয়ই তাও ভেদ করে অশ্রু পড়তো।

মুহাম্মদ ইব্‌ন ইয়াহয়া . ইব্‌ন শিহাব থেকে বর্ণনা করেন যে, একবার আমি ইদরীস আল-খাওলানীর মজলিসে বসা ছিলাম। তিনি বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করছিলেন। এক পর্যায়ে এসে বললেন, তোমরা কি জান, সবচেয়ে উত্তম খাদ্য কে খেতেন? সকলেই তখন তাঁর দিকে দৃষ্টি ফিরালো। তিনি বললেন, সবচেয়ে উত্তম খাদ্য খেতেন। হযরত ইয়াহয়া ইব্‌ন যাকারিয়া (আ)। তিনি বনের পশুদের সাথে আহার করতেন। কেননা মানুষের সাথে জীবিকা নির্বাহ তার নিকট খুবই অপছন্দনীয় ছিল। ইবনুল মুবারক বর্ণনা করেন, হযরত যাকারিয়া (আ) একবার তাঁর পুত্ৰ ইয়াহয়াকে তিন দিন যাবত পাচ্ছিলেন না। অতঃপর তিনি তাকে সন্ধান করার জন্যে জংগলে গমন করেন। সেখানে তিনি দেখতে পান যে, ইয়াহয়া একটি কবর খনন করে তার মধ্যে দাড়িয়ে অঝোরে কাঁদছেন। তিনি বললেন, প্রিয় বৎস! তোমাকে আমি তিন দিন যাবত খুঁজে ফিরছি, আর তুমি কিনা। কবর খুঁড়ে তার মধ্যে দাঁড়িয়ে কাদছ। তখন ইয়াহয়া উত্তর দিলেন, আব্বাজান! আপনিই তো আমাকে বলেছেন, জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝে এক বিশাল কঠিন ও দুৰ্গম ময়দান- যা কান্নার পানি ব্যতীত অতিক্রম করা যায় না। পিতা বললেন, সত্যিই বৎস! প্ৰাণ ভরে কাদো। তখন পিতা-পুত্র উভয়ে একত্রে কাঁদতে লাগলেন। ওহাব ইব্‌ন মুনব্বিহ ও মুজাহিদ অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইব্‌ন আসাকির মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেছেন, জান্নাতবাসীদের নিকট যে নিয়ামত সামগ্ৰী থাকবে, তার স্বাদ উপভোগে মত্ত থাকায় তারা নিদ্রা যাবে না। সুতরাং সিন্দীকীন যারা, তাদের অন্তরে আল্লাহর মহব্বতের যে নিয়ামত আছে, তার কারণে তাদেরও নিদ্ৰা যাওয়া সমীচীন নয়। অতঃপর তিনি বলেন, কতই না পার্থক্য উক্ত দুই নিয়ামতের মধ্যে। বর্ণনাকারীগণ বলেছেন, নবী ইয়াহয়া (আ) এত অধিক পরিমাণ কাঁদতেন যে, চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে পড়তে তাঁর দুই গালে স্পষ্ট দাগ পড়ে যায়।

হযরত ইয়াহয়া (আ)-এর হত্যার বর্ণনা

হযরত ইয়াহয়া (আ)-এর হত্যার বিভিন্ন কারণের মধ্যে প্রসিদ্ধতম কারণ এই যে, সে যুগে দামিশকের জনৈক রাজা তার এক মুহরাম* নারীকে বিবাহ করার সংকল্প করে। হযরত ইয়াহয়া (আঃ) তাকে এ বিবাহ করতে নিষেধ করেন। এতে মহিলাটির মনে ইয়াহয়ার প্রতি ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এক পর্যায়ে উক্ত মহিলা ও রাজার মধ্যে সম্পর্ক গভীর হয়ে ওঠে। তখন মহিলাটি রাজার নিকট ইয়াহয়াকে হত্যার আবদার জানায়। সে মতে রাজা তাকে উক্ত মহিলার হাতে তুলে দেন। মহিলাটি ইয়াহয়া (আ)-কে হত্যা করার জন্যে ঘাতক নিয়োগ করে। ঐ ঘাতক নির্দেশ মত তাকে হত্যা করে এবং কর্তিত মস্তক ও তার রক্ত একটি পাত্রে রেখে মহিলার সামনে হাজির করে। কথিত আছে, মহিলাটি তৎক্ষণাৎ মারা যায়।

* যাকে বিবাহ করা বৈধ্য নয়।

অন্য একটি বর্ণনায় রয়েছে, উল্লেখিত রাজার স্ত্রীই হযরত ইয়াহয়াকে মনে মনে ভালবাসত এবং তাঁর সাথে মিলনের প্রস্তাব পাঠায়। হযরত ইয়াহয়া (আঃ) তাতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। মহিলাটি নিরাশ হয়ে তাকে হত্যার বাহানা খোজে। সে রাজার নিকট সে জন্য অনুমতি প্রার্থনা করে। রাজা প্রথমে নিষেধ করলেও পরে অনুমতি দিয়ে দেয়। মহিলাটি ঘাতক নিয়োগ করে। সে ইয়াহয়ার রক্তমাখা ছিন্ন মস্তক একটি পাত্রে করে মহিলার সামনে হাজির করে।

ইসহাক ইব্‌ন বিশার-এর মুবতাদা নামক গ্রন্থে এই মর্মে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি…. ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন: মিরাজের রাত্রে রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত যাকারিয়া (আ)-কে আসমানে দেখতে পান। তিনি সালাম দিয়ে বলনেন, হে ইয়াহয়ার পিতা! বনী-ইসরাঈলরা আপনাকে কেন এবং কিভাবে হত্যা করেছিল, আমাকে বলুন! তিনি বললেন, হে মুহাম্মদ! এ বিষয়ে আমি আপনাকে বিস্তারিত বলছি, শুনুন!! আমার পুত্ৰ ইয়াহয়া ছিল তার যুগের অনন্য গুণের অধিকারী শ্রেষ্ঠ যুবক, সুদর্শন ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। যার সম্পর্কে আল্লাহ নিজেই বলছেন, সে হবে নেতা ও স্ত্রী বিরাগী। নারীদের প্রতি তার কোন মোহ ছিল না। বনী ইসরাঈলের রাজার স্ত্রী ইয়াহয়ার প্রতি আসক্ত হয়। সে ছিল ব্যাভিচারিণী। সে ইয়াহয়ার নিকট কু-প্রস্তাব পাঠায়। আল্লাহ তাকে হেফাজত করেন। সে মহিলার প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। এতে মহিলাটি ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। বনী ইসরাঈল সমাজে একটি বার্ষিক উৎসবের প্রচলন, যে দিন সবাই নির্দিষ্ট স্থানে একত্রিত হয়। উক্ত রাজার নীতি ছিল, কাউকে প্রতিশ্রুতি দিলে ভঙ্গ করত না এবং মিথ্যা কথা বলত না। রাজা উক্ত উৎসবের নির্দিষ্ট দিনে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়। তার স্ত্রী তাকে বিদায় অভিনন্দন জানায়। রাজা তাকে খুব ভালবাসত, অতীতে কিন্তু রাজা কখনো এরূপ করেনি। অভিনন্দন পেয়ে খুশী হয়ে রাজা বলল, তুমি আমার নিকট যে আবদার করবে, আমি তা-ই পূরণ করবো। স্ত্রী বলল, আমি

রাজা বলল, এটা নয়, অন্য কিছু চাও। স্ত্রী বলল, না, ওটাই আমি চাই। রাজা বলল, ঠিক আছে, তা-ই হবে। অতঃপর রাজার স্ত্রী ইয়াহয়ার হত্যার জন্যে জল্লাদ পাঠিয়ে দেয়। তখন তিনি মিহরাবের মধ্যে সালাত আদায়ে রত ছিলেন। যাকারিয়া (আঃ) বলেন, আমি পুত্রের পাশেই সালাত রত ছিলাম। এ অবস্থায় জুল্লাদ ইয়াহয়াকে হত্যা করে এবং তার রক্ত ও ছিন্ন মস্তক একটি পাত্রে করে উক্ত মহিলার নিকট নিয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, আপনার ধৈর্য তো

ংসাহঁ। যাকারিয়া (আ) বললেন, এ ঘটনার সময় আমি সালাত থেকে কোনরূপ অন্যমনষ্ক হইনি। যাকারিয়া (আ) আরো বলেন, জল্লাদ ইয়াহয়ার কর্তিত মস্তক মহিলার সম্মুখে রেখে দেয়। দিন শেষে যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে তখন আল্লাহ ঐ রাজা, তার পরিবারবর্গ ও লোক-লশকরকে মাটির নীচে ধ্বসিয়ে দেন। পরদিন সকালে ঘটনা দেখে বনী ইসরাঈলরা পরস্পর বলাবলি করল, যাকারিয়ার মনিব যাকারিয়ার অনুকূলে ক্রুদ্ধ হয়েছেন; চল আমরাও আমাদের রাজার অনুকূলে ক্রুদ্ধ হই এবং যাকারিয়াকে হত্যা করি। তখন আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তারা সম্মিলিতভাবে আমার সন্ধানে বের হয়। ইতিমধ্যে এক ব্যক্তি বনী ইসরাঈলের এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমাকে সাবধান করে দেয়। আমি তাদের হাত থেকে বাচার জন্যে সে স্থান থেকে পলায়ন করি। কিন্তু ইবলীস তাদের সম্মুখে থেকে আমার গমন পথ দেখিয়ে দেয়। যখন দেখলাম, তাদের হাত থেকে বঁাচার কোন উপায় নেই, তখন সম্মুখে একটি গাছ দেখতে পাই। তার নিকট যাওয়ার জন্যে গাছটি তখন আমাকে আহবান করছিল এবং দুভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন তাতে ঢুকে পড়ি। কিন্তু ইবলিস তখন আমার চাদরের আঁচল টেনে ধরে, বৃক্ষের ফাটল মুদে যায়। কিন্তু আমার চাদরের আঁচলটি বাইরে থেকে যায়। বনী ইসরাঈল সেখানে উপস্থিত হলে ইবলীস জানায় যে, যাকারিয়া যাদুবলে এই গাছটির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। বনী ইসরাঈল বলল, তাহলে গাছটিকে আমরা পুড়িয়ে ফেলি। ইবলীস বলল, না বরং গাছটি করাত দিয়ে চিরে ফেল। যাকারিয়া বলেন, ফলে বৃক্ষের সাথে আমিও দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাই।

রাসূলুল্লাহ (সা) জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি করাতের স্পর্শ বুঝতে পেরেছিলেন, কিংবা ব্যাথ্যা অনুভব করেছিলেন? যাকারিয়া বললেন, না; বরং ঐ গাছটি তা অনুভব করেছে, যার মধ্যে আল্লাহ আমার রূহ রেখে দিয়েছিলেন। এ হাদীসটি অত্যন্ত গরীব পর্যায়ের। এ এক অদ্ভুত কাহিনী। রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে এ হাদীছ বর্ণিত হওয়ার ব্যাপারটি আন্দীে গ্রহণযোগ্য নয়। এ ঘটনার মধ্যে এমন কিছু কথা আছে, যা কোন মতেই গ্রহণ করা চলে না। এ বর্ণনা ছাড়া মিরাজ সম্পর্কে বর্ণিত কোন হাদীসেই যাকারিয়া (আ)-এর উল্লেখ নেই। অবশ্য সহীহ হাদীসের কোন কোন বর্ণনায় এ কথা আছে যে, আমি ইয়াহয়া ও ঈসা দুখালাত ভাইয়ের পাশ দিয়ে গমন করেছিলাম। অধিকাংশ আলিমের মতে তারা ছিলেন পরস্পর খালাত ভাই। হাদীস থেকেও তাই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। কেননা, ইয়াহয়ার মা আশয়া বিনত ইমরান মারিয়াম বিনত ইমরানের বোন ছিলেন। কিন্তু কারও কারও মতে ইয়াহয়ার মা আশয়া অৰ্থাৎ যাকারিয়ার স্ত্রী ছিল মারিয়ামের মা হান্না। অৰ্থাৎ ইমরানের স্ত্রীর বোন। এ হিসেব মতে ইয়াহয়া হয়ে যান মারিয়ামের খালাতো ভাই।

হযরত ইয়াহয়া (আ) কোন স্থানে নিহত হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে মতভেদ আছে। কারও মতে বায়তুল মুকাদ্দাসের ভিতরে; কারও মতে মসজিদের বাইরে অন্য কোথাও। সুফিয়ান ছাওরী (র) বলেন যে, বায়তুল মুকাদ্দাসের অভ্যন্তরে যে ঐতিহাসিক পাথর আছে, সেখানে সত্তরজন নবীকে হত্যা করা হয়। ইয়াহয়া (আঃ) তাদের অন্যতম। আবু উবায়দ… সাঈদ ইবনুল মুসায়িত্ব (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, বুখত নসর যখন দামিশকে অভিযানে আসে, তখন ইয়াহয়া (আঃ)-এর রক্ত মাটির নীচ থেকে উপরের দিকে উত্থিত হতে দেখতে পায়। সে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে লোকজন প্রকৃত ঘটনা জানায়। তখন বুখত নসর এ রক্তের উপরে সত্তর হাজার বনী ইসরাঈলকে জবাই করে। ফলে রক্ত উঠা বন্ধ হয়ে যায়। এ বর্ণনার সূত্রে সাঈদ ইবনুল মুসায়িত্ব (রা) পর্যন্ত সহীহ। এ বর্ণনা অনুযায়ী ইয়াহয়ার হত্যাস্থল দামিশক। আর বুখত নসরের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। হযরত ঈসা মাসীহর পরে। আতা ও হাসান বসরী (র) এই মত পোষণ করেন।

ইব্‌ন আসাকির … যায়দ ইব্‌ন ওয়াকিদ থেকে বর্ণনা করেন যে, তার আমলে দামিশকের মসজিদ পুনঃনির্মাণের সময় হযরত ইয়াহয়া (আ)-এর মস্তক বের হয়ে পড়ে। আমি তা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। মসজিদের পূর্ব দিকের মিহরাবের নিকট কিবলার যে দেয়াল ছিল, তার নীচ থেকে ঐ মস্তক বের হয়েছিল। মস্তকের চামড়া ও চুল অক্ষত ছিল। এক বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, মস্তকটি দেখলে মনে হয় যেন এই মাত্র কর্তন করা হয়েছে। অতঃপর উক্ত মসজিদের সাকাসিকা নামক প্ৰসিদ্ধ স্তম্ভের নীচে মস্তকটি দাফন করা হয়।

ইব্‌ন আসাকির তাঁর আল-মুসতাকিসা ফ্ৰী ফাযাইলিল আকসা নামক গ্রন্থে মুআবিয়ার আপন দাস কাসিম থেকে বর্ণনা করেন, দামিশকের জনৈক রাজার নাম ছিল হাদদাদ ইব্‌ন হাদার। রাজা তার এক পুত্রকে তার ভাই আরিয়ালের কন্যার সাথে বিবাহ করায়। পুত্র-বধুটি ছিল বহু ভূ-সম্পত্তির মালিক। দামিশকের সকল বাজার-ঘাট ছিল তার কর্তৃত্ত্বিাধীন। রাজপুত্ৰ একদা কসম খেয়ে স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে দেয়। কিন্তু কিছু দিন পর সে আবার ঐ স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করে এবং হযরত ইয়াহয়া (আ)-এর নিকট এ ব্যাপারে মাসআলা। জিজ্ঞেস করে। ইয়াহয়া বললেন, অন্যত্র বিবাহ ব্যতীত এই স্ত্রী পুনরায় গ্রহণ করা তোমার জন্যে বৈধ নয়। এ রকম সিদ্ধান্ত দেওয়ায় উক্ত মহিলার মনে ইয়াহয়ার প্রতি বৈরিতা সৃষ্টি হয় এবং সে তাকে হত্যা করার জন্যে রাজার নিকট অনুমতি চায়। মহিলার মা-ই এ কাজে তাকে প্ররোচিত করে। রাজা প্রথম দিকে বারণ করলেও পরে অনুমতি দিয়ে দেয়। ইয়াহয়া (আ) জায়রন নামক স্থানে এক মসজিদে সালাত আদায় করছিলেন। এ অবস্থায় উক্ত মহিলা কর্তৃক প্রেরিত এক ব্যক্তি তাকে হত্যা করে এবং ছিন্ন মুস্তক একটি পুত্রে করে নিয়ে যায়; কিন্তু তখনও

(অন্যত্র বিবাহ ব্যতীত ঐ স্বামীর কাছে যাওয়া বৈধ হবে না, বৈধ হবে না) এ অবস্থা দেখে মহিলাটি পাত্রের উপর ঢাকনা দিয়ে আবদ্ধ করে নিজের মাথার উপর রেখে তার মায়ের নিকট নিয়ে আসে। কিন্তু তখনও পাত্রের মধ্য থেকে অনুরূপ আওয়াজ বের হচ্ছিল। মহিলাটি ইয়াহয়ার মস্তক রেখে তার মায়ের সম্মুখে যখন ঘটনার বিবরণ দিচ্ছিল, তখন তার দুই পা মাটির মধ্যে পুঁতে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে তার দেহ কোমর পর্যন্ত মাটির নীচে চলে যায়। মহিলার মা তুলুল এবং তার দাসীরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে চীৎকার করতে থাকে এবং নিজ নিজ মুখে করাঘাত করতে থাকে। দেখতে দেখতে মহিলার কাঁধ পর্যন্ত মাটির মধ্যে গেড়ে যায়। তখন তার মা সান্তুনা লাভের উদ্দেশ্যে মেয়েটির মস্তক মাটির নীচে চলে যাওয়ার আগে কেটে রাখার জন্যে এক জনকে নির্দেশ দেয়। উপস্থিত জল্লাদ সাথে সাথে তরবারী দ্বারা মস্তক কেটে নিয়ে আসে। কিন্তু সেই মুহুর্তেই মাটি মহিলার অবশিষ্ট দেহ ভিতর থেকে উগরে ফেলে দেয়। এভাবে মহিলাটির গোটা পরিবারই লাঞ্ছনা ও অভিশাপে ধ্বংস হয়ে যায়।

অপরদিকে ইয়াহয়া (আ) যে, নিহত হয়েছিলেন, সে স্থানে মাটির নীচ থেকে রক্ত উপরের দিকে উথলে উঠছিল। এরপর বুখত নসর এসে পঁচাত্তর হাজার বনী ইসরাঈলকে হত্যা করলে রক্তের ঐ প্রবাহ বন্ধ হয়। সাঈদ ইব্‌ন আবদিল আয়ীম (র) বলেছেন, ঐ রক্ত ছিল সমস্ত নবীদের মিশ্রিত রক্ত। মাটির তলদেশ থেকে সর্বদা উথলে উঠত এবং বাইরে গড়িয়ে যেত। হযরত আরমিয়া (আঃ) সে স্থানে দাঁড়িয়ে রক্তকে সম্বোধন করে বলেন, হে রক্ত! বনী ইসরাঈল তো শেষ হয়ে গিয়েছে, আল্লাহর হুকুমে এখন থাম। এরপর রক্ত থেমে যায়। বুখত নসর অতঃপর হত্যাকাণ্ড বন্ধ করে এবং তলোয়ার গুটিয়ে নেয়। তার এ অভিযানকালে দামিশকের বহু লোক পালিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসে চলে যায়। বুখত নসর সেখানে গিয়েও তাদেরকে ধাওয়া করে এবং হত্যা করে। কত লোক যে এ অভিযানে তার হাতে নিহত হয়েছিল তার কোন হিসেব নেই। হত্যাযজ্ঞ শেষ হলে বহু সংখ্যক লোক বন্দী করে বুখত নসর দামিশক ত্যাগ করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *