১০. মরেডার্স ম্যাপ

১০. মরেডার্স ম্যাপ

সপ্তাহের পুরোটাই হ্যারিকে হাসপাতালে রেখে দেয়ার জন্যে জোর করলেন মাদাম পমফ্রে। ও আপত্তি করেনি, অভিযোগও করেনি, কিন্তু নিম্বাস দুহাজারের অবশিষ্ট টুকরো গুলি ফেলে দিতেও দেয়নি। ও জানে এটা বোকামি হচ্ছে, জানে যে নিম্বাসকে আর ঠিক করা যাবে না, কিন্তু কিছু করারও নেই, ওর যেন মনে হচ্ছে সেরা এক বন্ধুকে হারাল সে।

দর্শনার্থীর ভিড় লেগেই রয়েছে, ওরা সব আসে, ওকে চাঙ্গা করবার চেষ্টা করে। হলুদ বাঁধাকপির মতো দেখতে ফুলের একটা গোছ পাঠালো হ্যাগ্রিড। এবং জিনি উইজলি, ভীষণরকম লাজুক, নিজের বানানো ভালো হয়ে যাও কার্ড নিয়ে এলো লজ্জায় লাল হয়ে। হ্যারি যদি ওটাকে ফলের বোলের নিচে চাপা দিয়ে না রাখে তবে কার্ডটা চিষ্কার করে গান গাইতে থাকে। রোববার সকালে গ্রিফিন্ডর টিম আবার এলো, এবার সঙ্গে উড় রয়েছে। এক ধরনের ফাঁকা মৃত স্বরে হ্যারিকে বলল ও, ওকে সে মোটেই দোষ দিচ্ছে না। রন আর হারমিওন রাত হলে হ্যারির পাশ থেকে উঠে যায়। কিন্তু যে যাই বলুক বা করুক না কেন হ্যারি কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না, কারণ ওর সমস্যার অর্ধেকটাই শুধু ওরা জানে।

গ্রিম সম্পর্কে বলেনি সে কাউকে। এমন কি রন এবং হারমিওনকেও না, কারণ রন আতংকিত হবে এবং হারমিওন পাত্তাই দেবে না, না হয়তো ঠাট্টা করবে। কিন্তু বাস্তব হচ্ছে এ পর্যন্ত দুদুবার দেখা গিয়েছে ওটাকে এবং দুবারই প্রায় প্রাণঘাতি দুর্ঘটনা হতে যাচ্ছিল; প্রথমবার তাকে নাইট–বাসটা প্রায় চাপা দিয়ে দিয়েছিল আর কি; দ্বিতীয়বার পঞ্চাশ ফিট ওপর ব্রুমস্টিক থেকে পড়েছে সে। তার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কি গ্রিম তার পিছু নিতে থাকবে? জীবনের বাকি দিনগুলি কি বার বার পেছন ফিরে ওই জটা আছে কি না দেখতে হবে তাকে?

এরপরও রয়েছে ডিমেন্টাররা। যতবার ওদের কথা মনে হয় ততবারই হ্যারি অসুস্থ এবং অপমানিত বোধ করে। সবাই বলে ডিমেন্টাররা হচ্ছে ভয়াবহ কিন্তু ওদের কাছে গিয়ে প্রতিবারই কেউ জ্ঞান হারায়নি আর কেউ তো মুমু বাবা মার কথার প্রতিধ্বনিও শুনতে পায় না।

এখন হ্যারি জানে ওই আর্তনাদ কার। ও শুনেছে, বার বার শুনেছে রাতের পর রাত হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে, ছাদের এক ফালি চাঁদের আলোর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে তাকিয়ে। ডিমেন্টাররা যখন ওর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল ও তখন ওর মায়ের জীবনের শেষ কয়েকটি মুহূর্তের কথা শুনতে পেয়েছিল, লর্ড ভন্ডেমর্টের হাত থেকে ওকে বাঁচানোর তার প্রাণান্তর প্রয়াস, এবং মাকে খুন করবার আগে ভল্টেমর্টের সেই অট্টহাসি হ্যারির ঝিমুনি আসে, স্বপ্নের মধ্যে ডুবে যায়, চটচটে পঁচা গলা প্রস্তরীভূত হাতের দুঃস্বপ্ন ভীতসন্ত্রস্ত অনুনয়ের দুঃস্বপ্ন। সজোরে আবার স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়, মায়ের স্বরের জগতে ডুবে যাওয়ার জন্যে।

***

সোমবার স্কুলে ফিরে পরিচিত শব্দ আর ব্যস্ততার মধ্যে স্বস্তি ফিরে পেল হ্যারি। এখানে বাধ্য হয়ে ওকে অন্য কিছু চিন্তা করতে হয়। এমনকি ড্র্যাকো ম্যালফয়ের বিদ্রূপ সহ্য করতে হলেও স্বস্তি পেল হ্যারি। গ্রিফিন্ডরের পরাজয়ে আনন্দে আত্মহারা ম্যালফয়; অবশেষে হাতের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেছে সে। এবং দুই হাত সম্পূর্ণ ব্যবহারোপযোগী হওয়াটা পালন করল ব্রুম থেকে হ্যারির পড়ে যাওয়া অনুকরণ করে। পরের পোশন ক্লাসের বেশির ভাগ সময়টা সে কাটাল ডিমেন্টারদের অনুকরণ করে; রন আর সহ্য করতে পারল না। ম্যালফয়ের দিকে বড়সড় একটা কুমিরের হৃৎপিন্ড ছুঁড়ে মারল সে, মুখে লাগল ওটা ম্যালফয়ের। পরিণতি হলো স্নেইপ গ্রিফিন্ডরের পঞ্চাশ পয়েন্ট কেটে নিল।

আবার যদি স্নেইপ ডিফেন্স এগেনস্ট দ্য ডার্ক আর্টের ক্লাস এই ভাবে নিতে থাকে তাহলে আমি আর আসছি না, অসুস্থ হবো, লাঞ্চের পর লুপিনের ক্লাসরুমের দিকে যেতে যেতে বলল রন। হারমিওন দেখতো ভেতরে কে রয়েছে।

দরজা দিয়ে উঁকি দিল হারমিওন।

ঠিক আছে!

প্রফেসর লুপিন ফিরে এসেছেন কাজে। নিশ্চিতভাবেই মনে হচ্ছে তিনি অসুস্থ ছিলেন। পুরনো পোশাকগুলো ঢিলেঢালাভাবে ঝুলছে গায়ে, চোখের নিচে কালি পড়েছে; তারপরও ক্লাসের সবাইকে স্বাগত জানিয়ে স্মিত হাসলেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে সবাই লুপিনের অসুস্থতার সময়ের স্নেইপের আচরণ সম্পর্কে হাজারো অভিযোগে ফেটে পড়ল।

এটা ঠিক নয়, উনি আপনার অনুপস্থিতির সময়টা ক্লাসে আসতেন, আমাদেরকে উনি হোমওয়ার্ক দেবেন কেন?

ওয়েরউলফ সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না।

–দুই রোল পার্চমেন্ট লিখতে হবে!

তোমরা প্রফেসর স্নেইপকে বলেছিলে ওটা আমাদের এখনও পড়া হয়নি? জিজ্ঞাসা করলেন লুপিন, একটু যেন অসন্তুষ্ট।

আবার সকলে একসঙ্গে বলতে শুরু করল।

হ্যাঁ, কিন্তু উনি বললেন আমরা সত্যিই পেছনে পড়ে গেছি।

শুনবেনই না আমার কথা।

দুই রোল পার্চমেন্ট!

সবার ক্রুদ্ধ চেহারা দেখে হাসলেন লুপিন।

ঘাবড়াবার কিছু নেই, আমি প্রফেসর স্নেইপের সঙ্গে কথা বলব। তোমাদের ওটা লিখতে হবে না

ও না, বলল হারমিওন, হতাশ দেখাচ্ছে ওকে। এর মধ্যে ওটা শেষও করে ফেলেছি আমি!

[অনেকদিন পর] ওরা মজা করে ক্লাস করল। কাঁচের বাক্সে করে হিংকিপাংক নিয়ে এসেছেন প্রফেসর লুপিন, এক–পেয়ে জন্তু একটা, দেখে মনে হয় যেন ধোঁয়ার কুণ্ডলি দিয়ে বানানো, রুগ্ন এবং দেখতে একেবারেই নিরীহ।

আগুন্তুকদের ভুলিয়ে জলাভূমির দিকে নিয়ে যায়, বললেন প্রফেসর লুপিন, ওরা ক্লাস–নোট নিচ্ছে। ওটার হাত থেকে একটা বাতি ঝুলছে লক্ষ্য করেছ? লাফিয়ে আগে আগে যায়–মানুষ বাতিটাকে অনুসরণ করে–তারপর…

কাঁচের ভেতর থেকে ভয়ানক একটা প্যাঁচপ্যাঁচে শব্দ করল হিংকিপাংকটা।

ঘন্টা বাজল। বইপত্র গুছিয়ে সকলেই দরজার দিকে হাটা দিল, হ্যারিও রয়েছে। ওদের মধ্যে, কিন্তু

হ্যারি একটু দাঁড়াও, ডাকলেন প্রফেসর লুপিন, তোমার সঙ্গে একটু কথা আছে।

দ্রুত পিছনে এলো হ্যারি, লক্ষ্য করল হিংকিপাংকের বাকস্টাকে কাপড় দিয়ে ঢাকছেন প্রফেসর।

ম্যাচটা সম্পর্কে আমি শুনেছি, বললেন লুপিন, ডেস্কে ফিরে গিয়ে বইগুলো ব্রিফকেসে ভরতে ভরতে, তোমার মস্টিক সম্পর্কে সত্যিই আমি দুঃখিত, ওটা ঠিক করবার কি কোন উপায় রয়েছে?

না, বলল হ্যারি। গাছটা ওটাকে একেবারে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে।

লুপিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

আমি যে বছর হোগার্টস-এ এসেছি সেই বছরই হোমপিং উইলো গাছটা লাগানো হয়েছে। ওটাকে নিয়ে একটা খেলা হতো সে সময়। গাছের গুঁড়িটা ধরবার মতো কাছে কে যেতে পারে। শেষে ডেভি গাজিওন নামে এক ছেলের তো চোখই গিয়েছিল আরকি, এবং ওই গাছের কাছে যাওয়া আমাদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গেল। কোন ক্ৰমস্টিকের সাধ্য নেই ওর সামনে টিকে থাকে।

আপনি ডিমেন্টারদের সম্পর্কেও শুনেছেন? অনেক কষ্টে জিজ্ঞাসা করল হ্যারি।

হ্যাঁ, শুনেছি। আমার মনে হয় না আমাদের মধ্যে কেউই প্রফেসর ডাম্বলডোরকে এত রাগ হতে দেখেছি। বেশ কিছুদিন ধরে অশান্ত হয়ে উঠছিল ওরা

ওদেরকে ডাম্বলডোর মাঠে যেতে দিতে অস্বীকার করায় ওরা ক্ষেপে গেল আমার মনে হয় ওদের কারণেই তুমি পড়ে গিয়েছিলে?

হ্যাঁ, বলল হ্যারি। একটু ইতস্তত করল সে, তারপর যে প্রশ্নটা সে করতে চায়, আটকাবার আগেই সেটা মুখ থেকে বেরিয়ে গেল। কেন? ওরা আমার সঙ্গে এমন করে কেন? আমি কী শুধু–?

দুর্বলতার সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই, তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন লুপিন, যেন হ্যারির মনের কথা পড়ে ফেলেছেন। অন্যদের চেয়ে ডিমেন্টাররা তোমাকে বেশি প্রভাবিত করতে পারে কারণ তোমার অতীতের সঙ্গে কিছু ভীতি জড়িয়ে রয়েছে যা অন্যদের বেলায় নেই।

শীতের রোদ্দুর ক্লাসরুমের ভেতর এসে পড়েছে, লুপিনের সাদা চুল এবং ওর কিশোর চেহারা দুটোই আলোকিত হয়ে উঠল।

পৃথিবীতে যত প্রাণী হাটে তার মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য হচ্ছে ডিমেন্টার। অন্ধকার এবং নোংরা যায়গায় বিচরণ করে বেড়ায়, ক্ষয় এবং হতাশার মধ্যেই এদের আনন্দ, যেখানে থাকে সেখানকার বাতাস থেকে শান্তি, আশা এবং আনন্দ শুষে নেয়। না দেখলেও মাগলরাও এদের উপস্থিতি টের পায়। ডিমেন্টারের খুব কাছে যদি যাও তাহলে সব ভালো লাগা, সব সুখ স্মৃতি তোমার ভেতর থেকে বেরিয়ে যাবে। যদি সম্ভব হয় ডিমেন্টার তোমাকে ওর মতই কলুষিত জীবে পরিণত করে ফেলবে। জীবনের সবচেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতাগুলি ছাড়া তোমার কাছে আর কিছুই থাকবে না। এবং তোমার সঙ্গে যা হয়েছে হ্যারি সেই অভিজ্ঞতাই একজনকে ব্রুম থেকে নিচে ফেলে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। তোমার লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।

ওরা যখন কাছে আসে–লুপিনের ডেস্কের দিকে অপলক তাকিয়ে রয়েছে হ্যারি ওর গলা শুকিয়ে গেছে। শুনতে পাই ভন্ডেমর্ট আমার মাকে হত্যা করছে।

যেন হ্যারির কাঁধ ধরতে যাচ্ছে হাত দিয়ে হঠাৎ এমন একটা ভঙ্গি করলেন লুপিন, কিন্তু ধরলেন না। মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এলো। তারপর

ওদেরকে ম্যাচে আসতে হলো কেন? তিক্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করল হ্যারি।

ওরা ক্ষুধার্ত হচ্ছে, বললেন লুপিন, স্বর ঠাণ্ডা, শব্দ করে ব্রিফকেসটা বন্ধ করলেন। ডাম্বলডোর ওদেরকে স্কুলের ভেতর ঢুকতে দেবেন না, ওদের মানব শিকারের সরবরাহ শেষ হয়ে গেছে… আমার মনে হয় কুইডিচ পিচের চারপাশের ভিড়টার লোভ ওরা সামলাতে পারেনি। উত্তেজনা… আবেগ… ওটা ছিল ওদের ভোজ সম্পর্কিত ধারণা।

আজকাবান নিশ্চয়ই ভয়াবহ, হ্যারি বিড় বিড় করে বলল। লুপিন গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়লেন।

দুৰ্গটা ছোট্ট একটি দ্বীপে রয়েছে, সাগরের মধ্যে, কিন্তু বন্দীদের ভেতরে রাখার জন্যে ওদের দেয়াল বা পানির দরকার নেই। দরকার নেই কারণ ওরা সকলেই যার যার নিজের মাথার মধ্যেই বন্দী হয়ে রয়েছে, সামান্য চিন্তাটুকুও করতে অক্ষম। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই অধিকাংশই পাগল হয়ে যায়।

কিন্তু ওদের ভেতর থেকেই সাইরিয়াস ব্ল্যাক পালিয়ে গেছে, ধীরে বলল হ্যারি। সে পালিয়েছে …

ডেস্ক থেকে লুপিনের ব্রিফকেসটা পিছলে গেল; ওটা ধরবার জন্যে দ্রুত ওকে নিচু হতে হলো।

হ্যাঁ, সোজা হয়ে বললেন লুপিন। ব্ল্যাক নিশ্চয়ই এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবার একটা উপায় বের করেছে। আমি হয়তো বিশ্বাস করতাম না… বেশিদিন ওদের হেফাজতে থাকলে ডিমেন্টার্সরা একজন জাদুকরের শক্তিও নিঃশেষে শুষে নিতে পারে…

ট্রেনে ওই ডিমেন্টারকে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করেছিলেন আপনি, হঠাৎ বলল হ্যারি।

কিছু কিছু প্রতিরোধ ব্যবস্থা রয়েছে যেগুলো একজন ব্যবহার করতে পারে, বললেন লুপিন। কিন্তু ট্রেনে তো মাত্র একজনই ডিমেন্টার ছিল। সংখ্যায় ওরা যত বেশি হবে প্রতিরোধ করা ততই কঠিন হবে।

কী ধরনের প্রতিরোধ? সঙ্গে সঙ্গে বলল হ্যারি। আমাকে শেখাতে পারেন?

আমি ডিমেন্টারদের বিরুদ্ধে লড়বার ব্যাপারে দক্ষ হওয়ার ভান করি না হ্যারি–বরং উল্টোটাই…

হ্যারির মুখের দৃঢ় সংকল্প দেখলেন লুপিন, ইতস্তত করলেন, তারপর বললেন, বেশ ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করব সাহায্য করতে। কিন্তু পরবর্তী টার্ম পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ছুটির আগে আমাকে অনেক কিছু করতে হবে। বড় অসময়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।

***

লুপিনের ডিমেন্টার প্রতিরোধী শিক্ষা দেয়ার প্রতিশ্রুতি, মায়ের মৃত্যুর মুহূর্তের কথা আর শুনতে হবে না-এইসব চিন্তা এবং নভেম্বরের শেষে কুইডিচ ম্যাচে র‍্যাভেনক্ল হাফলপাফদের একেবারে শুইয়ে দেয়ার ঘটনায় হ্যারির মনটা চাঙ্গা হতে শুরু করল। গ্রিফিন্ডররা এখনও প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়ে যায়নি, কিন্তু আরেকটি ম্যাচ হারবার মতো বিলাসিতাও ওদের নেই। উড যেন আবার তার উৎসাহ ফিরে পেল। ডিসেম্বরের শীতের সন্ধ্যার আঁধারেও তার টিমকে কঠোর ট্রেনিং দিতে শুরু করল। মাঠের আশে পাশে ডিমেন্টারের কোন ছায়াও হ্যারির নজরে পড়ল না। মনে হয় ডাম্বলডোরের ক্রোধ তাদেরকে ওদের স্টেশনেই আটকে রেখেছে।

টার্ম শেষ হওয়ার দুই সপ্তাহ আগে হঠাৎ একদিন আকাশটা চোখ ধাঁধানো সাদা ঔজ্জ্বল্যে ভরে গেল। কাদা ভরা মাঠ এক সকালে চকচকে বরফে ঢেকে গেল। প্রাসাদের ভেতরে ক্রিস্টমাসের গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। চার্ম টিচার প্রফেসর ফ্লিটউইক নিজের ক্লাসরুমটাকে ঝিকমিক আলোয় সাজিয়ে নিয়েছেন, যেগুলো আসলে ডানা ঝাপটানো পরী। ছাত্ররা ছুটির পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করছে। রন আর হারমিওন দুজনেই ঠিক করেছে যে ওরা হোগার্টন-এ থেকে যাবে। রন বলছে ও পার্সিকে দুই সপ্তাহ ধরে সহ্য করতে পারবে না [সে জন্যে বাড়ী যাবে না। হারমিওন জোর দিয়ে বলছে ওর লাইব্রেরীতে কাজ করতে হবে। হ্যারিকে অবশ্য বোকা বানানো যায়নি; ওরা যে ওকে সঙ্গ দেয়ার জন্যেই কেউ হোগার্টস ছেড়ে যাচ্ছে না এটা বুঝতে পেরেছে এবং সে জন্যে ওদের কাছে কৃতজ্ঞ বোধ করছে।

টার্ম শেষ হওয়ার আগের সপ্তাহান্তে হগসমিডে আরেকটি যাত্রার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সকলের জন্যে খবরটা আনন্দের হলেও বলাই বাহুল্য হ্যারির জন্যে। সেরকম নয়।

আমাদের ক্রিস্টমাস শপিংটা ওখান থেকেই করতে পারব! বলল হারমিওন। হানিডিউক্স-এর মিন্টস গুলো ড্যাড এবং মাম সত্যিই পছন্দ করবে।

তৃতীয় বর্ষের সেই একমাত্র ছাত্র যাকে স্কুলেই থাকতে হচ্ছে, এটা মেনে নিয়ে হ্যারি উডের কাছ থেকে কোন ব্রুমস্টিক বইটা চেয়ে নিল, দিনটা সে বিভিন্ন ধরনের

মস্টিক সম্পর্কে পড়েই কাটিয়ে দেবে। প্রাকটিসের সময় সে স্কুলের একটা ক্রমে চড়ে প্রাকটিস করেছে, প্রাচীন একটা শুটিং স্টার, ওটা ভীষণ ধীরগতির এবং ঝকায়; ওর নিজের একটা নতুন ব্রুম প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

শনিবার সকালে হগসমিড যাত্রার সময় সে রন আর হারমিওনকে বিদায় জানাল, তারপর মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গ্রিফিন্ডর টাওয়ারের দিকে হাঁটতে লাগল। বরফ পড়ছে, জানালা দিয়ে বাইরে দেখা যাচ্ছে, পুরো প্রাসাদটাই নিথর এবং নীরব।

সসস–হ্যারি!

ঘুরে দাঁড়াল সে, চার–তলার করিডোরের মাঝখানে একটা একচক্ষু কুঁজো জাদুকরের মূর্তির পেছন থেকে ফ্রেড আর জর্জ ওর দিকে উঁকি দিচ্ছে।

তোমরা কী করছ? হ্যারি জিজ্ঞাসা করল। তোমরা যে হগসমিডে যাচ্ছ না?

যাওয়ার আগে তোমাকে উৎসবের শুভেচ্ছা দিয়ে যেতে চাই, রহস্যময় ইশারায় বলল ফ্রেড। এদিকে এসো…

একচক্ষু মূর্তিটার পাশের একটি শূন্য ক্লাসরুমের দিকে মাথা নাড়ল সে। ফ্রেড আর জর্জকে অনুসরণ করে হ্যারি ভেতরে গেল। আস্তে করে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে জর্জ ফিরল হ্যারির দিকে, ওর মুখে উজ্জল হাসি।

তোমার জন্যে আগাম ক্রিস্টমাস পুরষ্কার, বলল সে।

পোশাকের ভেতর থেকে কিছু একটা বের করে ফ্রেড টেবিলের ওপর বিছিয়ে দিল। বড় একটা বর্গাকৃতির ছেঁড়া পার্চমেন্ট, ওতে কিছুই লেখা নেই। ফ্রেড আর জর্জের আরেকটি জোক মনে করে হ্যারি ওটার দিকে তাকিয়ে রইল।

ওটা কী হতে পারে?

এটা, আমাদের সাফল্যের গোপন কথা, পার্চমেন্টায় চাপড় মেরে বলল জর্জ।

তোমাকে এটা দেয়া দুঃখজনক বটে, বলল ফ্রেড, কিন্তু গতরাতে আমরা স্থির করেছি যে তোমার প্রয়োজন আমাদের চেয়ে বেশি।

যাইহোক, আমাদের এটা মুখস্থ হয়ে গেছে, বলল জর্জ। এখন এটা তোমার কাছে সমর্পণ করছি। আর আমাদের প্রয়োজন নেই।

এবং পুরনো এক টুকরো পার্চমেন্ট আমারই বা কোন কাজে লাগবে? বলল হ্যারি।

এক টুকরা পুরনো পার্চমেন্ট! বলল ফ্রেড, চোখ বন্ধ করে, যেন হ্যারি ওকে মর্মান্তিকভাবে আঘাত করেছে। ওকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দাও জর্জ।

বেশ আমরা যখন আমাদের প্রথম বর্ষে ছিলাম–কচি বয়স, ভাবনাহীন এবং নিষ্পাপ

হ্যারি নাক দিয়ে শব্দ করল। ফ্রেড এবং জর্জ কখনও নিষ্পাপ ছিল, হ্যারির সন্দেহ হলো।

 বেশ, এখনকার চেয়ে নিষ্পাপ-ফিলচ এর সঙ্গে একটা যায়গায় আমাদের লেগে গেল।

করিডোরে আমরা একটা পটকা ফুটিয়েছিলাম, ব্যস, অমনি সে ক্ষেপে গেল

 আমাদেরকে তাড়িয়ে তার অফিসে নিয়ে গিয়ে স্বভাবমত হুমকি দেয়া শুরু করল

–ডিটেনশনের—

-নাড়িভূড়ি বের করে নেয়ার

–ওর ফাইলিং ক্যাবিনেটে বাজেয়াপ্ত এবং সাংঘাতিক বিপদজনক লেখা ড্রয়ারটা আমাদের নজর এড়ালো না।

আমাকে আর ওটা বলতে হবে না, বলল হ্যারি, ওর মুখে হাসি।

বেশ, তুমি হলে কী করতে? বলল ফ্রেড। আরেকটা পটকা ফুটিয়ে জর্জ ওর মনোযোগ সরিয়ে নিল, আমি ড্রয়ারটা এক টানে খুলে-এটা হাতিয়ে নিলাম।

যতটা খারাপ শোনায় ব্যাপারটা আসলে ততটা খারাপ নয়, বলল জর্জ। আমাদের মনে হয় এটা কীভাবে কাজ করে ফিলচ কখনও বের করতে পারেনি। সম্ভবত সে বুঝতে পেরেছিল এটা কি, না হলে সে এটা বাজেয়াপ্ত করত না।

এবং তোমরা জান এটা কীভাবে কাজ করে?

ও হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, বলল ফ্রেড আত্মতৃপ্তির হাসি হেসে। এই ছোট্ট জিনিষটা স্কুলের সব শিক্ষকের চেয়ে আমাদের অনেক বেশি শিখিয়েছে।

তোমরা আমাকে হাপ ধরিয়ে দিচ্ছ, বলল হ্যারি টুটা ফাটা পুরনো পার্চমেন্টটার দিকে তাকিয়ে।

ওহ, তাই নাকি? বলল জর্জ।

সে তার জাদুর কাঠি বের করে পার্চমেন্টায় আলতো করে ছোঁয়াল এবং বলল, আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে শপথ করিতেছি যে আমার উদ্দেশ্য মহৎ নয়।

জর্জ যেখানে জাদুদণ্ডটি স্পর্শ করেছিল সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে কতগুলো লাইন ফুটে উঠতে শুরু করল এবং মাকড়সার জালের মতো পার্চসেন্ট জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। লাইনগুলো একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হলো, একে অপরকে ছেদ করল, পার্চমেন্টের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়ল; তারপর ওপরের দিকে কয়েকটি শব্দ ফুটে উঠল, আঁকাবাঁকা সবুজ শব্দ, লেখা

মেসার্স মুনি, ওয়ার্মটেইল, প্যাডফুট অ্যান্ড প্রংস।
ম্যাজিক্যাল মিসচিফের সরঞ্জামাদির সরবরাহকারিগণ
গর্বের সঙ্গে উপস্থাপনা করছে।

মরেডার্স ম্যাপ

মানচিত্রে হোগার্টস প্রাসাদের একেবারে বিস্তারিত দেখানো হয়েছে। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কালির বিন্দু যেগুলো পার্চমেন্টের চারদিক ঘুরছে। প্রত্যেকটিতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অক্ষরে নাম লেখা। হতবাক হ্যারি উবু হয়ে দেখার চেষ্টা করল। উপরে বা দিকের কোণার বিন্দুটিতে দেখা যাচ্ছে প্রফেসর ডাম্বলডোর নিজের স্টাডিতে পায়চারি করছেন; কেয়ারটেকারের বিড়াল মিসেস নরিস তৃতীয় তলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, এবং হল্লাবাজ পিভস পুরস্কার রাখার রুমে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। পরিচিত করিডোর ধরে হ্যারির চোখ ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে আরো কিছু লক্ষ্য করল।

মানচিত্রে দেখা গেল আরো এক সেট পথ রয়েছে, যেগুলোতে ও কখনই প্রবেশ করেনি। এবং অনেকগুলো সোজা গিয়ে উঠেছে

একেবারে হগসমিডে, বলল ফ্রেড, আঙুল দিয়ে একটা পথ ধরে এগিয়ে। এমন সাতটা পথ রয়েছে। কিন্তু এই চারটা সম্পর্কে ফিলচ জানে– আঙুল দিয়ে সেগুলো দেখিয়েও দিল, তবে আমরা নিশ্চিত যে শুধু আমরাই এগুলো সম্পর্কে জানি। পাঁচতলায় আয়নার পেছনে যে পথটা রয়েছে সেটা নিয়ে মোটেই ভাববে না। গত শীতকাল পর্যন্ত ও পথটা আমরা ব্যবহার করেছি, কিন্তু ওটা ভেঙ্গে গেছে সম্পূর্ন বন্ধ। এবং এই পথটা কেউ ব্যবহার করেছে তাও আমাদের মনে হয় না, কারণ এটার প্রবেশ পথে হোমপিং উইলোটা লাগানো রয়েছে। কিন্তু এই যে এই পথটা, এটা একেবারে হানিডিউক্স পর্যন্ত গেছে। আমরা এই পথ ব্যবহার করেছি অসংখ্যবার। এবং হয়তো খেয়াল করেছ এর প্রবেশ পথটা ঠিক এই রুমের বাইরে রয়েছে, এক–চক্ষু মূর্তিটার কুজের ভেতর দিয়ে।

মুনি, ওয়ার্মটেইল, প্যাডফুট এবং প্রংস, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জর্জ, মানচিত্রের মাথায় চাপড় মারল। ওদের কাছে আমাদের অনেক ঋণ।

মহৎ লোক, আইন ভঙ্গকারি নতুন প্রজন্মকে সাহায্য করবার জন্য ক্লান্তিহীন পরিশ্রম করে যাচ্ছে, গম্ভীরভাবে বলল ফ্রেড।

ঠিক বলেছ, বলল জর্জ, ব্যবহার করার পর এটাকে মুছে ফেলবার কথা ভুলে যেও না

–না হলে কেউ পড়ে ফেলতে পারে, সাবধান করে দিল ফ্রেড।

ওটাকে স্পর্শ করে শুধু বলতে হবে মিসচিফ সম্পন্ন! এটা আবার সাদা হয়ে যাবে।

তাহলে, হ্যারি সাহেব, বলল ফ্রেড উদ্ভটভাবে পার্সির নকল করে, মনে রেখ তোমাকে ভালো আচরণ করতে হবে।

তোমার সঙ্গে হানিডিউক্স-এ দেখা হবে, বলে চোখের ইশারা করল জর্জ।

এক ধরনের আত্মতৃপ্তির হাসি হেসে ওরা দুজন ঘর ছেড়ে চলে গেল।

জাদুকরী মানচিত্রটার দিকে চেয়ে থকল হ্যারি। দেখল কালির ক্ষুদ্র বিন্দুটা দিকে, মিসেস নরিস বা দিকে ঘুরল মেঝেতে পড়ে থাকা কিছু শোঁকার চেষ্টা করল। যদি ফিলচ সত্যিই না জানে [মানচিত্রটা সম্পর্কে] তাহলে তাকে মোটেই ডিমেন্টার্সদের, অতিক্রম করে যেতে হবে না।

উত্তেজনায় টইটম্বুর হ্যারির, ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়ই মিস্টার উইজলির একটা কথা মনে পড়ে গেল।

যে জিনিষ নিজের জন্য চিন্তা করতে পারে কখনই তাকে বিশ্বাস করবে না, যদি না দেখতে পাও নিজের মগজটা ও কোথায় রেখেছে।

যে সকল বিপদজনক ম্যাজিক্যাল বস্তু সম্পর্কে মিস্টার উইজলি সতর্ক করে দিয়েছিলেন মানচিত্রটা তার মধ্যে একটি কিন্তু, হ্যারি নিজেকে প্রবোধ দিল সে শুধু হাসমিডে পৌঁছাবার জন্যে ওটা ব্যবহার করতে চায়, কোন কিছু চুরি করবার জন্যে বা কাউকে আক্রমণ করবার জন্যে নয় এবং কোন রকম অঘটন ছাড়াই ফ্রেড ও জর্জ অনেক বছর ধরে এটা ব্যবহার করছে

আঙুল দিয়ে মানচিত্রের ওপর হানিডিউক্স-এর পথটা অনুসরণ করল হ্যারি।

তারপর, হঠাৎ, যেন কোরো নির্দেশ পালন করছে, মানচিত্রটা গুটিয়ে ওর পোশাকের ভেতর লুকিয়ে রাখল হ্যারি, ক্লাসরুমের দরজার দিকে দ্রুত অগ্রসর হলো। দরজাটা কয়েক ইঞ্চি ফাঁক করল সে। বাইরে কেউ নেই। খুব সাবধানে ক্লাসরুম থেকে চুপিসারে বেরিয়ে একচক্ষু ডাইনীটার মূর্তিটার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল।

তাকে কী করতে হতো? মানচিত্রটা আবার বের করল এবং অবাক হয়ে দেখল ওটার ওপর কালির নতুন আরেকটি বিন্দু দেখা যাচ্ছে, ওর ওপর লেখা হ্যারি পটার। এই বিন্দুটি ঠিক ওখানেই রয়েছে যেখানে আসল হ্যারি দাঁড়িয়ে রয়েছে, চতুর্থ তলার করিডোরের মাঝ বরাবর। খুব সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য করল হ্যারি। ওর নিজের প্রতিকৃতি কালির বিন্দুটা অতিশয় ক্ষুদ্রাকৃতির জাদুর কাঠি দিয়ে ডাইনীটার গায়ে টোকা দিচ্ছে। তাড়াতাড়ি হ্যারি ওর আসল জাদুর কাঠিটা বের করে মূর্তিটার গায়ে ওটা দিয়ে টোকা দিল। কোন কিছুই ঘটল না। আবার মানচিত্রটাকে দেখল সে। খুবই ক্ষুদ্র একটা বুদবুদ দেখা গেল ওর বিন্দুটার পাশে। ওর ভেতর লেখা রয়েছে ডিসেনডিয়াম।

ডিসেনডিয়াম ফিস ফিস করে বলল হ্যারি। পাথরের ডাইনীটাকে আবার জাদুর কাঠি দিয়ে টোকা দিল।

সঙ্গে সঙ্গে মূর্তির কুজটা খুলে গিয়ে একজন হালকা পাতলা মানুষের ভেতরে যাওয়ার মতো যায়গা করে দিল। করিডোরের এপাশ ওপাশ দেখে নিল হ্যারি, ম্যাপটা আবার ভেতরে রাখল, তারপর মাথা আগে দিয়ে ভেতরে ঢুকল, পাথরের ঢালু জায়গা দিয়ে নিজেকে সামনের দিকে ঠেলে নিল।

বেশ মাটির সড়কে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। মানচিত্রটা তুলে ধরে জাদুর কাঠিটা স্পর্শ করে বিড় বিড় করে বলল, দুষ্টামি কিছুক্ষণ গড়িয়ে নিচে নামল ও, মনে হলো ঢালু পথটা পাথরের তৈরি, তারপর নামল ঠাণ্ডা স্যাঁতস্যাঁতে মাটির ওপর। দাঁড়িয়ে দেখল চারদিক। ঘন কালো অন্ধকার। জাদুর কাঠিটা তুলে ধরে বলল, লুমাস!. আলো জ্বলে উঠল জাদুর কাঠির মাথায়, দেখা গেল একটা সরু নিচু পথ। এবার ম্যাপটা তুলে ধরে জাদুর কাঠি দিয়ে টোকা দিয়ে বলল সম্পন্ন। সঙ্গে সঙ্গে মানচিত্রটা সাদা হয়ে গেল। আবার ভাঁজ করে ওটা ওর পোশাকের ভেতর রেখে দিল। হৃৎপিণ্ড ধড়াক ধড়াক করছে, উত্তেজিত আবার ভয়ও পাচ্ছে। রওয়ানা হয়ে গেল হ্যারি।

আঁকাবাঁকা হয়ে গেছে পথটা, যেন কোন দৈত্যাকার খরগোশের সুড়ং। দ্রুতগতিতে যাচ্ছে সে, উঁচুনিচু পথটায় কয়েকবার হোঁচট খেল, সামনে জাদুর কাঠিটা ধরা।

যেন এক যুগ পার হয়ে গেল, কিন্তু হানিডিউক্স-এ যেতে হবে এই চিন্তা হ্যারিকে শক্তি যোগাল। প্রায় ঘন্টখানেক পর মনে হলো পথটা উপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে। হাঁপাচ্ছে সে, পা চালালো আরো জোরে, মুখটা গরম হয়ে উঠেছে, কিন্তু পা ঠাণ্ডা।

দশ মিনিট পর, ক্ষয়ে যাওয়া সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়াল হ্যারি, সিঁড়িটিা ওর দৃষ্টির বাইরে উঠে গেছে উপরের দিকে। উপরের দিকে উঠতে শুরু করল ও, কিন্তু যেন কোন শব্দ না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক হলো। একশ ধাপ, দুইশ ধাপ, উপরে উঠছে তো উঠছেই, এক সময় খেই হারিয়ে ফেলল ও, শুধু নিজের পায়ের দিকে ওর নজর তারপর হঠাৎ ওর মাথার সঙ্গে শক্ত কিছুর সংঘর্ষ হলো।

মনে হচ্ছে এটা কোন লুকনো দরজা। ওখানে দাঁড়িয়ে হ্যারি নিজের মাথা ডলতে লাগল, কোন কিছু শোনার চেষ্টা করল। কোন শব্দ শোনা গেল না। খুব ধীরে ধীরে লুকনো দরজাটার একটা পাল্লা ওঠালো উপরের দিকে, উঁকি দিল বাইরে।

মাটির নিচের একটা ঘরে (সেলারে) রয়েছে সে। সেলারটা কাঠের পিপা আর বাক্সে ভর্তি। উপরে উঠে লুকনো দরজাটা নামিয়ে রাখল সে-এমনভাবে মিশে গেল ধুলো ভরা মেঝের সঙ্গে যে বোঝাই মুশকিল ওখানে ওটা রয়েছে। উপরে ওঠার কাঠের সিঁড়ির দিকে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল সে। এখন সে শব্দ শুনতে পাচ্ছে, ঘণ্টার টুং টাং শব্দ এবং দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ।

জেলি শ্লাগ-এর আরেকটি বাক্স নিয়ে এসো, ডিয়ার, ওরা প্রায় সবটাই শেষ করে ফেলেছে– বলল এক নারী কণ্ঠ।

সিঁড়ি দিয়ে এক জোড়া পা নিচে নেমে আসছে, বিশাল একটা পিপার পেছনে লাফ দিয়ে সরে গেল হ্যারি, অপেক্ষা করল কখন পায়ের শব্দ মিলিয়ে যায়। সে শুনতে পাচ্ছে বিপরীত দিকের দেয়ালের কাছের বাক্সগুলো সরাচ্ছে লোকটা। এরপর কোন সুযোগ সে আর নাও পেতে পারে

দ্রুত নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো হ্যারি, সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করল; পেছনে তাকিয়ে দেখল বিশাল একটা পিঠ এবং চকচকে একটা টাক বাক্সগুলোর মাঝে যেন ডুবে রয়েছে। সিঁড়ির উপরের দরজাটায় পৌঁছে গেল সে, দরজার ফাঁক গলে নিজেকে হানিডিউক্স-এর কাউন্টারের পেছনে আবিষ্কার করল হ্যারি–মাথা নিচু করল। হামাগুড়ি দিয়ে সরে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল সে।

হোগার্টস-এর ছাত্র ছাত্রীতে ভর্তি হানিডিউক্স, এত ভিড় যে কেউই দুবার হ্যারির দিকে তাকাল না। ওদের মধ্যে ঘুরে বেড়াত লাগল হ্যারি, সে যে এখন কোথায় রয়েছে সেটা দেখতে পেলে ডাডলির সূচালো মুখটার দশা কি হতে পারে ভেবে মনে মনে একটা হাসি চাপল ও।

শেলফ-এর উপর শেলফ, কত রকমের সুস্বাদু মিষ্টি যে রয়েছে ভাবাও যায়।

ষষ্ঠবর্ষীয়দের এটা দলের মধ্যে নিজেকে সেঁধিয়ে হ্যারি দেখতে পেল দোকানের সবচেয়ে দূরের কোণায় একটা নোটিশ ঝুলছে–(অস্বাভাবিক স্বাদ)। ওটার নিচে দাঁড়িয়ে রন আর হারমিওন ট্রে–ভর্তি রক্ত–গন্ধ সমৃদ্ধ ললিপপ পরীক্ষা করছে। চুপি চুপি ওদের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল হ্যারি।

উঁহু, না, হ্যারি ওগুলো পছন্দ করবে না, ওগুলো ভ্যাম্পায়ারদের জন্য মনে হয়, বলছিল হারমিওন।

এগুলো কেমন হয়? বলল রন, হারমিওনের প্রায় নাকের নিচে এক বৈয়াম ভর্তি করোচ ক্লাস্টার ঠেলে দিয়ে।

অবশ্যই না, বলল হ্যারি।

রন বৈয়ামটা প্রায় ফেলে দিয়েছিল আরকি।

হ্যারি হারমিওনের মুখ দিয়ে আর্তধ্বনি বেরিয়ে এলো। তুমি এখানে কি করছ? কীভাবে–তুমি কীভাবে?

ওঔ! বলল রন, ওকে খুব খুশি দেখাচ্ছে। তুমি তাহলে অপ্রত্যাশিত যায়গায় অপ্রত্যাশিত সময়ে উপস্থিত হতে শিখে গেছ!

নিশ্চয়ই না, শিখিনি, বলল হ্যারি গলা নামিয়ে, যেন সিক্সথ ইয়ারের কেউ শুনতে না পায়, ওদেরকে মরেডার্স ম্যাপ সম্পর্কে সব খুলে বলল সে।

কি আশ্চর্য ফ্রেড আর জর্জ আমাকে কখনও ওটা দিল না কেন! বলল রন, বেশ রেগে গেছে সে। আমি ওদের ভাই!

কিন্তু হ্যারিও ওটা নিজের কাছে রাখবে না! বলল হারমিওন, যেন ধারণাটা খুবই হাস্যকর। ও সেটা প্রফেসর ম্যাকগোনাগল-এর কাছে ফিরিয়ে দেবে, তাই না হ্যারি?

না, দেব না! বলল হ্যারি।

তুমি কী পাগল? বলল রন, হারমিওনের দিকে চোখ পাকিয়ে। অমন ভালো একটা জিনিষ প্রফেসরের হাতে তুলে দিতে হবে?

যদি ওটা প্রফেসরের হাতে তুলে দিতে যাই, তাহলে বলতে হবে কোথা থেকে পেয়েছি! ফিলচ তাহলে জেনে যাবে যে ফ্রেড আর জর্জ ওটা চুরি করেছে!

কিন্তু, সাইরিয়াস ব্ল্যাক-এর কথা মনে আছে তো? ক্রুদ্ধ চাপা স্বরে বলল হারমিওন। ওই ম্যাপে আঁকা যে কোন একটা পথ দিয়ে ব্ল্যাক প্রাসাদে ঢুকতে পারে! শিক্ষকদের ব্যাপারটা জানা দরকার।

সে এই ম্যাপ-এর পথগুলি দিয়ে আসছে না হয়তো, দ্রুত বলে উঠল হ্যারি। ম্যাপ-এ সাতটি গোপন পথ রয়েছে, ঠিক? ফ্রেড এবং জর্জ মনে করে ফিলচ ইতোমধ্যেই চারটির কথা জানে। অন্য তিনটি-একটা ভেঙ্গে পড়েছে, ওটার ভেতর দিয়ে কেউই যেতে পারবে না। একটার মুখে হোমপিং উইলো গাছটা লাগানো রয়েছে, এটা দিয়ে বেরনো সম্ভব নয়। আর একটা হচ্ছে যেটা দিয়ে আমি এখানে এসেছি–কিন্তু–নিচের কুঠুরিতে যে এটার প্রবেশমুখ সেটা বোঝার কোন উপায় নেই সুতরাং সে যদি না জানে যে ওটা এখানেই রয়েছে

ইতস্তত করল হ্যারি। কিন্তু ব্ল্যাক যদি জানে এখানেই ওটার প্রবেশমুখ তাহলে? রন বেশ জোরে গলা খাঁকারি দিল, আঙুল তুলে দোকানটার ভেতরে লাগানো একটা নোটিশ দেখালো।

ম্যাজিক মন্ত্রণালয়ের আদেশক্রমে
ক্রেতা সাধারণকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে, পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত, সূর্যাস্তের পর থেকে প্রতি রাত হগসমিড-এর রাস্তায় টহল দেবে ডিমেন্টাররা। হগসমিড-এর বাসিন্দাদের নিরাপত্তার স্বার্থেই এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এবং সাইরিয়াস ব্ল্যাক ধরা পড়লে তুলে নেয়া হবে। সুতরাং সংশ্লিষ্টদেরকে সন্ধ্যার আগেই কেনাকাটা শেষ করবার অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
আনন্দময় হোক ক্রিসমাস।

দেখেছো? শান্ত স্বরে বলল রন। পুরো এলাকাটায় ডিমেন্টাররা ঘুরে বেড়াচ্ছে, এ অবস্থায় ব্ল্যাককে দরজা ভেঙ্গে হানিডিউকস-এ ঢুকেছে এটা আমি দেখেতে চাই। তবে যাই বলল হারমিওন, যদি দরজা ভাঙ্গে, তবে হানিডিউকস-এর মালিকরা নিশ্চয়ই শুনতে পাবে কারণ ওরা উপরেই থাকে!

হ্যাঁ, কিন্তু–কিন্তু– মনে হলো আরেকটা সমস্যা খুঁজে বের করবার জন্যে হারমিওন জোর চেষ্টা করছে। দেখো, এরপরও হ্যারির হগসমিড-এ আসা উচিৎ নয়, কারণ অভিভাবকের স্বাক্ষর করা অনুমোদনপত্র নেই ওর। যদি কেউ জানতে পারে তাহলে কঠিন সমস্যায় পড়বে সে! এখনও তো রাত হয়নি, যদি আজই এখানে সাইরিয়াস ব্ল্যাক এসে হানা দেয়? এখনই?

প্রথমে তো তাকে এখানে হ্যারি রয়েছে সেটা জানতে হবে বা হ্যারিকে খুঁজে পেতে হবে, বলল রন, জানালার বাইরে তাকিয়ে রয়েছে সে, ঘন সাদা বরফ পড়ছে ঘুরতে ঘুরতে। দেখো হারমিওন, এখন ক্রিসমাস, হ্যারিরও একটা সুযোগ পাওয়া উচিৎ।

ঠোঁট কামড়ে ধরল হারমিওন, ওকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে।

তুমি কি আমার সম্পর্কে নালিশ জানাবে? দাঁত বের করে জিজ্ঞাসা করল হ্যারি।

ওহ–না, নিশ্চয়ই না–কিন্তু সত্যিই বলছি, হ্যারি

ফিজিং হুইজবিজ দেখেছ, হ্যারি? বলল রন, ওকে সজোরে ধরে ওদের কেনা জিনিষগুলোর কাছে নিয়ে গেল। এবং জেলি শ্লাগগুলো? এসিড পপস? আমার সাত বছরের সময় ফ্রেড দিয়েছিল আমাকে–আমার চিহ্বা পুড়িয়ে দিয়েছিল ওটা। মনে আছে ব্রুমস্টিক নিয়ে ওকে তাড়া করেছিল মা।

কেনা সমস্ত কিছুর দাম মিটিয়ে দিল রন আর হারমিওন। হানিডিউক্স থেকে বাইরে বরফ–বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে এলো ওরা।

হগসমিড এখন একেবারে ক্রিসমাস কার্ডের মতো দেখতে হয়েছে, ছোট ছোট কুটির এবং দোকানগুলো বরফে ছেয়ে গেছে; দরজায় দরজায় পবিত্র ফুলের মালা শোভা পাচ্ছে, গাছে গাছে ঝুলছে জাদু করা মোমবাতি।

কেঁপে উঠল হ্যারি, অন্য দুজনের মতো ওর গায়ে কোট আলখাল্লা নেই। রাস্তা ধরে সামনে এগিয়ে গেল ওরা, বাতাসের কারণে মাথা নিচু করে রেখেছে,

এরই মধ্যে চেঁচিয়ে রন আর হারমিওন ওকে এটা ওটা চিনিয়ে দিচ্ছে।

ওটা পোস্ট অফিস।

ওখানে জোংকো

আমরা শিকিং শ্যাক-এ যেতে পারি

শোন আমি বলি কি, বলল রন, ঠাণ্ডায় দাঁতে দাঁতে বাড়ি লাগছে, আমরা কি থ্রি ব্রুমসস্টিক-এ বাটারবিয়ার পান করতে যাবো?

খুবই ইচ্ছা করছে হ্যারির ওখানে যেতে প্রবল বাতাস আর ওর হাত একেবারে জমে গেছে, রাস্তাটা পেরিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে ছোট্ট পানশালাটায় ঢুকল ওরা।

প্রচণ্ড ভিড় আর হৈ চৈ, গরম এবং বোয়ায় আচ্ছন্ন। বাঁকা একজন মহিলা, মুখটা সুন্দর, বার-এ পানীয় সার্ভ করছে এক দঙ্গল জাদুকরকে।

ওই হলেন ম্যাডাম রোজমের্তা, বলল রন। আমি ড্রিংকসগুলো নিয়ে আসছি আনব? বলল সে, মুখটা লাল হয়ে গেছে একটু।

পেছন দিকের একটা খালি টেবিলে গিয়ে বসল হ্যারি আর হারমিওন, কাছেই ফায়ারপ্লেস-এর কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা সুন্দর ক্রিসমাস ট্রি। পাঁচ মিনিট পর রন এলো তিনটি ধূমায়িত পাত্রে গরম গরম বাটারবিয়ার নিয়ে।

হ্যাপি ক্রিসমাস! বাটারবিয়ারের গ্লাসটা তুলে বলল উফুল্ল রন।

দীর্ঘ একটা চুমুক দিল হ্যারি। এ পর্যন্ত যত কিছু খেয়েছে, ওর কাছে এটাই সবচেয়ে সুস্বাদু মনে হলো। ওর ভেতরের প্রতিটি ইঞ্চি যেন গরম হয়ে গেল।

হঠাৎ একটা বাতাস যেন ওর চুলটাকে এলোমেলো করে দিল। থ্রি মস্টিকের দরজাটা খুলে গেল, হাতে ধরা গ্লাসটার ওপর দিয়ে ও দিকে তাকাতেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল হ্যারির।

চোখে মুখে বরফের কুঁচি নিয়ে ঢুকলেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল এবং ফ্লিটউইক, পেছন পেছন এলো হ্যাগ্রিড, কথা বলতে বলতে সঙ্গে হৃষ্টপুষ্ট লোকটার সঙ্গে; কর্ণেলিয়াস ফাজ, ম্যাজিক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী।

মুহূর্তের মধ্যে রন আর হারমিওন হ্যারিকে ঠেলে টেবিলের নিচে পাঠিয়ে দিল। তখনও ওর মুখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা বাটারবিয়ার পড়ছে। খালি পানপাত্রটা আঁকড়ে ধরে টেবিলের নিচ থেকে ও দেখতে পাচ্ছে মন্ত্রী ফাজ আর টিচারদের পাগুলো একবার বার-এর দিকে গেল, থামল, তারপর ঘুরে সোজা ওর দিকে এগিয়ে এল।

ওপর থেকে হারমিওন ফিসফিস করে বলল মবিলিয়ারবাস!

টেবিলের পাশ থেকে ক্রিসমাস ট্রি–টা মাটির উপরে কয়েক ইঞ্চি উঠে গেল, তারপর উড়ে এসে থপ করে পড়ল ঠিক ওদের টেবিলের সামনে। আড়াল হয়ে গেল ওরা। ডালপালার মধ্য দিয়ে হ্যারি দেখতে পেল চারটা চেয়ার ওদের পাশের টেবিলের পেছন দিকে গেল, তারপর শুনতে পেল টিচার আর মন্ত্রীর বসে পড়ার শব্দ।

আরেক জোড়া পা দেখতে পেল হ্যারি চকচকে আসমানি রঙের হাইহিল পরনে, একজন মহিলার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল।

ছোট একটা গিলিওয়াটার

আমার জন্য, বললেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল।

চার পাইন্ট মধুর জারক

রোজমের্তা, বলল হ্যাগ্রিড।

বরফ দেয়া সোডা আর চেরি সিরাপ

মমম! ঠোঁটে আঙুল বুলাতে বুলাতে বললেন প্রফেসর ফ্লিটউইক।

তাহলে, মন্ত্রীমহোদয় আপনি লাল কিসমিসের রাম–।

ধন্যবাদ, রোজমের্তা, ফাজ-এর কণ্ঠস্বর শোনা গেল। ভালো লাগছে তোমাকে আবার দেখতে পেয়ে। তুমিও নাও, বসো আমাদের সাথে

বেশ, ধন্যবাদ, মন্ত্রীমহোদয়।

হ্যারি দেখল চকচকে হিল জোড়া একবার চলে গেল আবার ফিরে এলো। বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ডটা ধড়াস ধড়াস বাড়ি মারছে। তার কেন মনে হয়নি যে এটা শিক্ষকদের জন্যেও টার্মের শেষ সপ্তাহ? ওখানে ওরা কতক্ষণ বসবেন? ওকে তো আবার চুপি চুপি হানিডিউকস-এ ফিরে যেতে হবে, যদি সে আজ রাতে স্কুলে ফিরতে চায় ওর পাশেই হারমিওনের পাটা কেঁপে উঠল।

তাহলে, এই জঙ্গলে কী করে এলেন মন্ত্রীমহোদয়? মাদাম রোজমের্তার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। হ্যারির মনে হলো ফাজ-এর স্থূল দেহটার নিচের অংশটা বাঁকা হয়ে গেল যেন আড়িপাতা কাউকে খুঁজছেন। তারপরে শান্তস্বরে বললেন, কী আবার, সাইরিয়াস ব্ল্যাক? আমার মনে হয় হ্যালোঈন-এর সময় স্কুলে যা ঘটেছে। সেটা শুনেছো?

একটা গুজব শুনেছিলাম বটে, বললেন রোজমের্তা।

হ্যাগ্রিড, পুরো সরাইখানায় সবাইকে কী বলে দিয়েছো? প্রফেসর ম্যাকগোনাগল জিজ্ঞেস করলেন।

আপনার কী মনে হয়, মন্ত্রীমহোদয়, ব্ল্যাক এ এলাকাতেই রয়েছে? ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলেন মাদাম রোজমের্তা।

আমি নিশ্চিত, ফাজ-এর সংক্ষিপ্ত জবাব।

আপনি জানেন যে ডিমেন্টাররা দুইবার আমার এই সরাইখানা তল্লাশি করেছে? রোজমের্তা বললেন, কণ্ঠস্বরে উত্মার আভাস। আমার সব খদ্দেরদের ভয় পাইয়ে দিয়েছে … ব্যবসার জন্য এটা খুবই খারাপ।

রোজমের্তা, তুমি ওদেরকে যতটা অপছন্দ কর আমিও ঠিক ততটাই করি, অস্বস্তির স্বরে বললেন ফাজ। প্রয়োজনীয় সতর্কতা আর কি দুঃখজনক, কিন্তু সব ঠিকঠাক চলছে … এইমাত্র ওদের কয়েকজনের সঙ্গে দেখাও হলো। কিন্তু ওরা ক্ষেপে আছে ডাম্বলডোরের বিরুদ্ধে তিনি ওদেরকে কিছুইতে প্রাসাদের ভেতরে যেতে দেবেন না বলে।

দেয়াও উচিত নয়, বললেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল তীক্ষ্ণ কণ্ঠে। ওইরকম ভীতিকর সব চারদিকে ঘুরে বেড়ালে আমরা ক্লাস নেব কীভাবে?

ঠিক, ঠিক বলেছো! ক্ষীণ স্বরে বললেন ফ্লিটউইক, মাটি থেকে এক ফুট উপরে ওর পা দুটো ঝুলছে।

একই কথা, বললেন ফাজ, ওরা এখানে সবাইকে আরও খারাপ কিছুর হাত থেকে রক্ষা করতে এসেছে … আমরা সবাই জানি কি না করতে পারে ব্ল্যাক

জানেন, আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, বললেন মাদাম রোজমের্তা চিন্তিত স্বরে। শেষ পর্যন্ত কিনা সাইরিয়াস ব্ল্যাক ওই পথে গেল, আমি ভাবতাম সবাই গেলেও কালো জাদুর পথে সে কিছুতেই যাবে না মানে আমি বলতে চাচ্ছি, আমার মনে আছে হোগার্টস-এ ও তখনো ছাত্র। আমাকে যদি তখন কেউ বলতো যে ভবিষ্যতে ও এ পথে যাবে, তাহলে আমি ওকে বলতাম সে নিশ্চয় একটু বেশিই পান করে ফেলেছে।

যা ঘটেছে, রোজমের্তা, তুমি তার অর্ধেকও জান না, গম্ভীরভাবে বললেন ফাজ। সবচেয়ে খারাপ, যা সে করেছে সেটা সবাই জানেও না।

সবচেয়ে খারাপ? মাদাম রোজমের্তা জিজ্ঞাসা করলেন, কণ্ঠস্বরের কৌতূহল। আপনি বলতে চাইছেন, অতগুলো নিরীহ লোককে হত্যা করার চেয়েও খারাপ?

নিশ্চয়ই আমি সেটাই বুঝাতে চাইছি, বললেন ফাজ।

আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। এর চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে?

তুমি বলছ, রোজমের্তা, ও যখন হোগার্টস-এ ছিল তখনকার কথা তোমার মনে আছে, বিড়বিড় করে বললেন ম্যাকগোনাগল। তোমার কী মনে আছে তোমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কথা?

অবশ্যই, ছোট্ট হেসে বললেন রোজমের্তা। দুজনকে কখনও বিচ্ছিন্ন দেখিনি, আপনি দেখেছেন? এখানে ওরা যতবার এসেছে–উহ, আমাকে হাসিয়ে মেরেছে। একেবারে একজন আরেকজনের পরিপূরক, সাইরিয়াস ব্ল্যাক এবং জেমস পটার!

টেবিলের নিচে হ্যারির হাত থেকে ওর গ্লাসটা পড়ে গেল শব্দ করে, রনি ওকে একটা লাথি মারল।

ঠিক তাই, বললেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল। ব্ল্যাক এবং পটার। ওদের ছোট্ট দলের দুই নেতা। দুজনে খুবই বুদ্ধিমান, এবং অবশ্যই অসাধারণ মেধাবী, বস্তুত–আমার মনে হয় না আমরা আর কখনও এমন একজোড়া বিছু দেখেছি।

আমি জানি না, বলল হ্যাগ্রিড। ফ্রেড এবং জর্জও ওদের সঙ্গে পেরে উঠত।

ব্ল্যাক এবং পটারকে মনে হতো যেন দুই ভাই! মধুর স্বরে বললেন প্রফেসর ফ্লিটউইক। অবিচ্ছেদ্য!

অবশ্যই ওরা তাই ছিল, বললেন ফাজ। সব বন্ধুদের মধ্যে পটার ব্ল্যাককে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করত। স্কুল ছাড়ার পরও ওদের মধ্যে কোন কিছু বদলায়নি। জেমস যখন লিলিকে বিয়ে করল তখন ব্ল্যাক ছিল প্রধান সাক্ষী। তারপর ওকে ওরা হ্যারির গডফাদার বানালো। অবশ্য এ সম্পর্কে হ্যারির কোন ধারণা নেই। বুঝতেই পারছ শুনতে পেলে ও কি রকম মর্মাহত হবে।

কারণ পরে দেখা গেল ব্ল্যাক ইউ–নো–হুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, ফিসফিস করলেন রোজমের্তা।

তারচেয়েও খারাপ  আরও নিম্নস্বরে বললেন ফাজ। খুব বেশি লোক জানত না যে পটাররা জেনে গিয়েছিল যে ওদের পেছনে লেগেছে ইউ–নো–হু। অবশ্য ডাম্বলডোর, ইউ. নো–হুর বিরুদ্ধে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছিলেন, তার কয়েকজন গুপ্তচর এ ব্যাপারে কাজ করছিল। ওদেরই একজন ওকে খবর দিলে, সে জেমস এবং লিলিকে সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক করে দেয়। ওদেরকে লুকিয়ে থাকতে বলে। অবশ্য, ইউ–নো–হুর কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়াটা সহজ ব্যাপার ছিল না। ডাম্বলডোর ওদেরকে বলেছিলেন ওদের জন্যে সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা হচ্ছে ফাইডেলিয়াস চার্ম।

ওটা কীভাবে কাজ করে? জিজ্ঞাসা করলেন মাদাম রোজমের্তা, আগ্রহে তার দম বন্ধ হয়ে আছে। প্রফেসর ফ্লিটউইক গলা পরিষ্কার করে নিলেন।

একটা খুবই জটিল জাদু, বললেন তিনি, একজন জীবিত ব্যক্তির মধ্যে জাদুবলে গোপন কোন তথ্য লুকিয়ে রাখা। একজন মানুষকে বেছে নিয়ে তার মধ্যে তথ্যটি লুকিয়ে রাখা হয়। ওই ব্যক্তি, বা সিক্রেট–কিপার যদি গোপন তথ্যটি ফাঁস করে তাহলে ওটি আর জানার কোন উপায় থাকে না। সিক্রেট–কিপার যতক্ষণ বলবে, ততক্ষণ জেমস এবং লিলি কোন এক জায়গায় থাকলেও, এবং সেই জায়গাটি ইউ–নো–হু যদি তন্নতন্ন করেও খোঁজে তাহলেও তাদেরকে খুঁজে পাবে না। এমনকি ওরা যে ঘরে বসে থাকবে সে ঘরের জানালার মধ্য দিয়ে উঁকি দিয়েও ওদেরকে পাবে না!

তাহলে ব্ল্যাক–ই ছিল পটারদের সিক্রেট–কিপার? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন রোজমের্তা।

সেটাই তো স্বাভাবিক, বললেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল। ডাম্বলডোরকে বলেছিল পটার যে ব্ল্যাক বরং মরে যাবে কিন্তু তারা কোথায় আছে সেটা কিছুতেই বলবে না, এবং ব্ল্যাক নিজেও লুকিয়ে থাকার জন্য তৈরি হচ্ছে … কিন্তু তারপরও, ডাম্বলডোরকে বিচলিত মনে হয়েছে। আমার মনে আছে উনি পটারদের সিক্রেট কিপার হওয়ার জন্য নিজের কথাই বলেছিলেন।

উনি ব্ল্যাককে সন্দেহ করতেন? রোজমের্তা বিস্মিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

উনি একটা বিষয় নিশ্চিত ছিলেন পটারদের খুব ঘনিষ্ঠ কেউ ওদের চলাফেরা সম্পর্কে ইউ–নো–হুকে সব সময় অবহিত করছে, গম্ভীর স্বরে বললেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল। বস্তুত বেশকিছু দিন ধরেই তিনি সন্দেহ করছিলেন আমাদের পক্ষ থেকেই কেউ বেঈমানি করছে এবং ইউ–নো–হুর কাছে প্রচুর তথ্য পাচার করছে।

কিন্তু জেমস পটার ব্ল্যাককে ব্যবহার করার ব্যাপারেই জোর দিয়েছিল?

সে তাই করেছিল, ভারি কণ্ঠস্বরে বললেন ফাজ। এবং তারপর ফাঁইডেলিয়াস চার্ম শুরু করার এক সপ্তাহও যায়নি

ব্ল্যাক ওদের সঙ্গে বেঈমানি করল? মাদাম বরাজমার্তার প্রশ্ন।

তাই করল সে। নিজের দুমুখো গুপ্তচর বৃত্তির ভূমিকায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ব্ল্যাক। ইউ–নো–হুর পক্ষে ওর সমর্থন খোলাখুলিভাবে ঘোষণা করার জন্য তৈরি সে। তখন থেকেই পটারদের মৃত্যুর পরিকল্পনাও করছিল সে। কিন্তু আমরা সবাই জানি যে ইউ–নো–হুর পতন হলো ছোট্ট হ্যারি পটার-এর কাছে। ক্ষমতা নিঃশেষ, নিজে দুর্বল হয়ে পড়ায় পালিয়ে গেল সে। এর ফলে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পড়ল ব্ল্যাক। ওর প্রভুর পতন হলো যে মুহূর্তে বেঈমান হিসেবে সে তার আসল রূপটা দেখালো। এরপর পালিয়ে বেড়ানো ছাড়া তার সামনে আর কোন পথ ছিল না।

নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত বিশ্বাসঘাতক! উচ্চস্বরে বলল হ্যাগ্রিড, এত জোরে যে বার-এর অর্ধেকটা নিশ্ৰুপ হয়ে গেল।

শশশ! বললেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল।

আমি ওর দেখা পেয়েছিলাম, চাপা গর্জনে বলল হ্যাগ্রিড। আমিই সম্ভবত শেষ ব্যক্তি যে ওকে দেখেছিল ওই হতভাগা মানুষগুলোকে মারার আগে! আমিই লিলি আর জেমস নিহত হওয়ার পর হ্যারিকে ওদেরকে বাসা থেকে উদ্ধার করেছিলাম! ধ্বংসস্তূপ থেকে ওকে বের করে নিয়ে এসেছিলাম, বেচারা, কপালে বিরাট একটা কাটা দাগ, বাবা-মা দুজনেই মৃত এবং তখনই সাইরিয়াস ব্ল্যাক এল ওর উড়ন্ত মোটরসাইকেলটা চড়ে। আমার তখন একবারও মনে হয়নি যে ও এখানে কি করছে। আমি জানতামই না যে ও ছিল লিলি আর জেমস-এর সিক্রেট কিপার। ভেবেছিলাম ও হয়তো তখনই ইউ–নো–হুর হামলার কথাটা শুনেছে এবং দেখতে এসেছে ও কিভাবে সাহায্য করতে পারে। ভয়ে বিবর্ণ এবং কাঁপছিল। তোমরা জান আমি কী করেছিলাম? আমি ওই বেঈমান ঘাতককে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম! গর্জন করল হ্যাগ্রিড।

হ্যাগ্রিড, প্লিজ! বললেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল। গলার স্বর নিচু রাখ!

আমি কিভাবে জানব যে সে আসলে লিলি এবং জেমস-এর ব্যাপারে মোটেই চিন্তিত ছিল না? ও চিন্তিত ছিল ইউ–নো–হুর জন্য! এবং তারপরে আমাকে বলল, হ্যারিকে আমার কাছে দাও হ্যাগ্রিড, আমি ওর গডফাদার, আমি ওকে লালন করব– হা! কিন্তু আমার প্রতি ডাম্বলডোর-এর কঠোর নির্দেশ ছিল, এবং আমি ব্ল্যাককে বললাম না, ডাম্বলডোর বলেছিলেন হ্যারি তার আংকল এবং আন্টির কাছে গিয়ে থাকবে। ব্ল্যাক তর্ক করল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিল। আমাকে বলল ওর মোটরসাইকেলটা নিয়ে হ্যারিকে ওখানে পৌঁছে দিতে। ওটা আর আমার দরকার হবে না। বলেছিল ব্ল্যাক।

আমার বোঝা উচিত ছিল কিছু একটা রহস্য রয়েছে। ওই মোটরসাইকেলটা ওর খুব প্রিয়, আমাকে ওটা দিতে চাচ্ছিল কেন? ওর আর ওটার দরকার হবে না কেন? আসল কথা হচ্ছে, ওটাকে খুব সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। ডাম্বলডোর জানতেন ও ছিল পটারদের সিক্রেট–কিপার। ব্ল্যাক জানত ওকে এখন প্রাণ নিয়ে পালাতে হবে, জানত খুব অল্প সময়ের ভেতরে ম্যাজিক মন্ত্রণালয় ওর পেছনে হন্যে হয়ে লাগবে।

কিন্তু আমি যদি ওর হাতে হ্যারিকে তুলে দিতাম, তাহলে কী হতো? বাজি ধরে বলতে পারি মোটরসাইকেল থেকে ওকে মাঝপথে সাগরে ফেলে দিত। ওর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর পুত্র! কিন্তু একজন জাদুকর একজন যখন অসৎ পথে যায় ওর কাছে তখন কোনকিছুই বা কোন ব্যক্তিই আর মূল্যবান থাকে না

হ্যাগ্রিড-এর দীর্ঘ কাহিনীর পর নীরবতা নেমে এল। তারপর এক ধরনের সন্তুষ্টির স্বরে রোজমো বললেন, ওতো পালাতে পারল না তাই না? পরদিনই ধরা পড়ে গেল!

কিন্তু হায়, যদি আমরা ধরতে পারতাম, তিক্ত স্বরে বললেন ফাজ। আমরা ওকে ধরতে পারিনি। বেটেখাটো পিটার পেট্টিগ্রু–পটারদের আরেক বন্ধু, সন্দেহ নেই রাগে দুঃখে ক্ষেপে গিয়েছিল এবং জানত যে ব্ল্যাক ছিল পটারদের সিক্রেট কিপার, নিজেই ব্ল্যাক-এর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

পেট্টিগ্রু ওই মোটা ছোট্ট ছেলেটা, হোগার্টস-এ সবসময় ওদের পেছন পেছন ঘুরতো? বললেন রোজমের্তা।

ব্ল্যাক এবং পটারকে বীরের মতো পূজা করতো, বললেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল। ওদের সমকক্ষ ছিল না, মেধার দিক থেকে। ওর ওপর মাঝে মাঝে আমি ক্ষেপেই যেতাম। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে, এর জন্য আমি অনুতপ্ত

ঠিক আছে, মিনারভা, সদয়ভাবে বললেন ফাজ, বীরের মতো মৃত্যুবরণ করেছে পেঞি। প্রত্যক্ষদর্শী–মাগল,–আমাদেরকে বলেছিল কিভাবে পেট্টিগ্রু ব্ল্যাককে কোণঠাসা করে ফেলেছিল–অবশ্য আমরা ওদের স্মৃতি মুছে দিয়েছি–ও কাঁদছিল, লিলি এবং জেমস, সাইরিয়াস! কিভাবে পারলে তুমি! এবং তারপর সে তার জাদুর কাঠি বের করার চেষ্টা করেছিল। অবশ্য ব্ল্যাক হচ্ছে অনেক ক্ষিপ্র গতির, মুহূর্তের মধ্যে ওকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল।

নাক ঝেড়ে নিলেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল। ভারি গলায় বললেন, বোকা ছেলে একেবারেই বোকা দ্বন্দ্ব যুদ্ধে সে সব সময়ই দুর্বল ছিল ব্যাপারটা মন্ত্রণালয়ের হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত ছিল

আমি তোমাকে বলছি, যদি আমি পেট্টিগ্রুর আগে ব্ল্যাককে ধরতে পারতাম, আমি ওই জাদুর কাঠি নিয়ে কেরামতির দেখানোর চেষ্টা করতাম না–ওর হাত–পা একটা একটা করে ছিঁড়ে ফেলতাম, হ্যাগ্রিড-এর গর্জন শোনা গেল।

তুমি জান না কি বলছ, তীক্ষ্ণ স্বর বললেন ফাজ। একমাত্র ম্যাজিক আইন। বাস্তবায়নকারী স্কোয়াডের সদস্য ছাড়া, কোণঠাসা ব্ল্যাক-এর বিরুদ্ধে আর কারও দাঁড়াবার ক্ষমতাই ছিল না। ওই সময়ে আমি ম্যাজিক্যাল বিপর্যয় বিভাগের জুনিয়র মন্ত্রী ছিলাম এবং ওই অতগুলো লোককে হত্যা করার পর ওইখানে আমিই প্রথম গিয়ে পৌঁছেছিলাম। আমি–আমি কখনই দৃশ্যটা ভুলতে পারব না। এখনও মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখি। রাস্তার মাঝখানে বিরাট একটা গর্ত, এত গভীর যে নিচের স্যুয়ারেজ পাইপও ফেটে গেছে। চারিদিকে মৃতদেহ। মাগলরা আর্তনাদ করছে। ব্ল্যাক ওখানে দাঁড়িয়ে হাসছে, ওর সামনে পেট্টিগ্রুর কিছু অবশিষ্ট রক্তমাখা কাপড় আর ওর কয়েকটা টুকরো–

হঠাৎ থেমে গেল ফাজ-এর কণ্ঠস্বর। পাঁচজনের নাক ঝাড়ার শব্দ শোনা গেল।

এই তো ঘটনা, রোজমের্তা, শুনলে তো, ভারি কণ্ঠস্বর ফাজ-এর। ব্ল্যাককে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো আর পেট্টিগ্রুকে অর্ডার অফ মার্লিন, ফার্স্টক্লাস, পদকে ভূষিত করা হলো। ওটাই ছিল ওর মায়ের একমাত্র সান্ত্বনা। তারপর থেকে আজকাবানেই ছিল ব্ল্যাক।

গভীরভাবে শ্বাস ত্যাগ করলেন মাদাম রোজমের্তা।

সে যে পাগল এটা কী সত্যি?

আমি যদি ওটা বলতে পারতাম, বললেন ফাজ ধীরে ধীরে। আমি বিশ্বাস করি ওর প্রভুর পরাজয় ওকে সাময়িকভাবে বেসামাল করে দিয়েছিল। পেট্টিগ্রু এবং অতগুলো মাগল-এর হত্যা ছিল কোণঠাসা হয়ে পড়া বেপরোয়া একজন মানুষের কাণ্ড–নিষ্ঠুর … অকারণ। তারপরও আজকাবানে আমার সর্বশেষ পরিদর্শনের সময় ব্ল্যাক-এর সঙ্গে আমি দেখা করেছিলাম। তোমরা জান, সব কারাবন্দিই অন্ধকারে বসে নিজের মনে বিড়বিড় করে, তাদের কোন বোধশক্তি নেই কিন্তু ব্ল্যাককে অত্যন্ত স্বাভাবিক দেখে মনে মনে আমি আঘাতই পেয়েছিলাম। আমার সঙ্গে বেশ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গেই কথা বলেছিল সে। একটুও ভীত নয়। মনে হতে পারে যেন সে ওখানে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। জিজ্ঞাসা করেছিল আমার পত্রিকা পড়া হয়ে গেছে কি না, অত্যন্ত স্থির মাথায়, বলেছিল ও ক্রসওয়ার্ড পড়তে পারছে না। হ্যাঁ, ওর ওপরে ডিমেন্টরদের এত সামান্য প্রভাব দেখে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম–তোমরা জান নিশ্চয়ই, ও ছিল সবচেয়ে কঠোরভাবে পাহারায় রাখা বন্দি। দরজার বাইরে দিনে রাতে চব্বিশ ঘণ্টা ছিল ডিমেন্টার।

কিন্তু ও জেল ভেঙে বেরিয়ে এসেছে কেন, কী মনে হয়, কি করার জন্য? মাদাম রোজমের্তা জিজ্ঞেস করলেন। হা ঈশ্বর, মন্ত্রীমহোদয়, সে কী ইউ–নো হুর সঙ্গে আবার হাত মেলাবার চেষ্টা করছে?

আমার মনে হচ্ছে ওটাই–মানে–ওটাই ওর আসল প্ল্যান, বললেন ফাজ, একটু যেন ফাঁক রাখলেন কথায়। কিন্তু তার আগেই আমরা ওকে ধরে ফেলব বলে আশা করছি। স্বীকার করতেই হবে, ইউ–নো–হু একা এবং বন্ধুহীন হলে একরকম

কিন্তু যদি ওকে ওর সবচেয়ে বিশ্বস্ত তাস ফিরিয়ে দেয়া যায়, তাহলে কত দ্রুত যে আবার তার উত্থান ঘটবে ভাবতেও আমি শিউরে উঠছি। 

কাঠের উপরে গ্লাস নামিয়ে রাখার শব্দ পেল হ্যারি।

কর্নেলিয়াস, যদি হেডমাস্টারের সঙ্গে ডিনার খেতে হয় তাহলে আমাদেরকে প্রাসাদে ফিরে যেতে হবে একত্রে এখনই, বললেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল।

এক এক করে এক এক জোড়া পা হ্যারির চোখের সামনে থেকে দূরে সরে যেতে লাগল। থ্রি ব্রুমস্টিক-এর দরজাটা খুলে গেল, আরেক দমকা তুষার ঢুকল ভেতরে ওদের দলটা হারিয়ে গেল বাইরে।

হ্যারি?

রন এবং হারমিওনের মুখ দুটো দেখা গেল টেবিলের নিচে। ওরা দুজনেই তাকিয়ে আছে ওর দিকে, মুখে কোন কথা নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *