রাজা ও রানী – ৪র্থ অঙ্ক

চতুর্থ অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

জালন্ধর

রণক্ষেত্র। শিবির

বিক্রমদেব ও সেনাপতি

সেনাপতি।            বন্দীকৃত শিলাদিত্য, উদয়ভাস্কর;
শুধু যুধাজিৎ পলাতক– সঙ্গে লয়ে
সৈন্যদলবল।
বিক্রমদেব।                           চলো তবে অবিলম্বে
তাহার পশ্চাতে। উঠাও শিবির তবে।
ভালোবাসি আমি এই ব্যগ্র ঊর্ধ্বশ্বাস
মানব-মৃগয়া; গ্রাম হতে গ্রামান্তরে,
বন গিরি নদীতীরে দিবারাত্রি এই
কৌশলে কৌশলে খেলা। বাকি আছে আর
কে বা বিদ্রোহীদলের?
সেনাপতি।                                      শুধু জয়সেন।
কর্তা সে’ই বিদ্রোহের। সৈন্যবল তার
সব চেয়ে বেশি।
বিক্রমদেব।                               চলো তবে সেনাপতি,
তার কাছে। আমি চাই উদগ্র সংগ্রাম,
বুকে বুকে বাহুতে বাহুতে– অতি তীব্র
প্রেম-আলিঙ্গন-সম। ভালো নাহি লাগে
অস্ত্রে অস্ত্রে মৃদু ঝনঝনি– ক্ষুদ্র যুদ্ধে
ক্ষুদ্র জয়লাভ।
সেনাপতি।                              কথা ছিল আসিবে সে
গোপনে সহসা, করিবে পশ্চাৎ হতে
আক্রমণ; বুঝি শেষে জাগিয়াছে মনে
বিপদের ভয়, সন্ধির প্রস্তাব-তরে
হয়েছে উন্মুখ।
বিক্রমদেব।                              ধিক্‌, ভীরু, কাপুরুষ।
সন্ধি নহে– যুদ্ধ চাই আমি। রক্তে রক্তে
মিলনের স্রোত– অস্ত্রে অস্ত্রে সংগীতের
ধ্বনি। চলো সেনাপতি।
সেনাপতি।                                       যে আদেশ প্রভু।

[ প্রস্থান

বিক্রমদেব।            এ কী মুক্তি। এ কী পরিত্রাণ। কী আনন্দ
হৃদয়-মাঝারে। অবলার ক্ষীণ বাহু
কী প্রচণ্ড সুখ হতে রেখেছিল মোরে
বাঁধিয়া বিবর-মাঝে। উদ্দাম হৃদয়
অপ্রশস্ত অন্ধকার গভীরতা খুঁজে
ক্রমাগত যেতেছিল রসাতলপানে।
মুক্তি, মুক্তি আজি। শৃঙ্খল বন্দীরে
ছেড়ে আপনি পলায়ে গেছে। এতদিন
এ জগতে কত যুদ্ধ, কত সন্ধি, কত
কীর্তি, কত রঙ্গ– কত কী চলিতেছিল
কর্মের প্রবাহ– আমি ছিনু অন্তঃপুরে
পড়ে; রুদ্ধদল চম্পককোরক-মাঝে
সুপ্ত কীট-সম। কোথা ছিল লোকলাজ,
কোথা ছিল বীরপরাক্রম। কোথা ছিল
এ বিপুল বিশ্বতটভূমি। কোথা ছিল
হৃদয়ের তরঙ্গ-তর্জন। কে বলিবে
আজি মোরে দীন কাপুরুষ। কে বলিবে
অন্তঃপুরচারী। মৃদু গন্ধবহ আজি
জাগিয়া উঠিছে বেগে ঝঞ্ঝাবায়ুরূপে।
এ প্রবল হিংসা ভালো ক্ষুদ্র প্রেম চেয়ে,
প্রলয় তো বিধাতার চরম আনন্দ!
হিংসা এই হৃদয়ের বন্ধন-মুক্তির
সুখ। হিংসা জাগরণ। হিংসা স্বাধীনতা।

সেনাপতির প্রবেশ

সেনাপতি।            আসিছে বিদ্রোহী সৈন্য।
বিক্রমদেব।                                       চলো, তবে চলো।

চরের প্রবেশ

চর।                    রাজন, বিপক্ষদল নিকটে এসেছে।
নাই বাদ্য, নাই জয়ধ্বজা, নাই কোনো
যুদ্ধ-আস্ফালন; মার্জনা-প্রার্থনা তরে
আসিতেছে যেন।
বিক্রমদেব।                                থাক্‌, চাহি না শুনিতে
মার্জনার কথা। আগে আমি আপনারে
করিব মার্জনা; অপযশ রক্তস্রোতে
করিব ক্ষালন। যুদ্ধে চলো সেনাপতি।

দ্বিতীয় চরের প্রবেশ

দ্বিতীয় চর।           বিপক্ষশিবির হতে আসিছে শিবিকা
বোধ করি সন্ধিদূত লয়ে।
সেনাপতি।                                         মহারাজ,
তিলেক অপেক্ষা করো– আগে শোনা যাক
কী বলে বিপক্ষদূত–
বিক্রমদেব।                                    যুদ্ধ তার পরে।

সৈনিকের প্রবেশ

সৈনিক।                মহারানী এসেছেন বন্দী ক’রে লয়ে
যুধাজিৎ আর জয়সেনে।
বিক্রমদেব।                                       কে এসেছে?
সৈনিক।                মহারানী।
বিক্রমদেব।                        মহারানী! কোন্‌ মহারানী?
সৈনিক।                আমাদের মহারানী।
বিক্রমদেব।                                   বাতুল উন্মাদ!
যাও সেনাপতি। দেখে এস কে এসেছে।

[ সেনাপতি প্রভৃতির প্রস্থান

মহারানী এসেছেন বন্দী ক’রে লয়ে
যুধাজিৎ-জয়সেনে! এ কি স্বপ্ন নাকি!
এ কি রণক্ষেত্র নয়? এ কি অন্তঃপুর?
এতদিন ছিলাম কি যুদ্ধের স্বপনে
মগ্ন? সহসা জাগিয়া আজ দেখিব কি
সেই ফুলবন, সেই মহারানী, সেই
পুষ্পশয্যা, সেই সুদীর্ঘ অলস দিন,
দীর্ঘনিশি বিজড়িত ঘুমে জাগরণে?
বন্দী? কারে বন্দী? কী শুনিতে কী শুনেছি?
এসেছে কি আমারে করিতে বন্দী? দূত!
সেনাপতি! কে এসেছে? কারে বন্দী লয়ে?

সেনাপতির প্রবেশ

সেনাপতি।            মহারানী এসেছেন লয়ে কাশ্মীরের
সৈন্যদল– সোদর কুমারসেন সাথে।
এসেছেন পথ হতে যুদ্ধে বন্দী করে
পলাতক যুধাজিৎ আর জয়সেনে।
আছেন শিবিরদ্বারে সাক্ষাতের তরে
অভিলাষী।
বিক্রমদেব।                         সেনাপতি, পালাও, পালাও।
চলো, চলো সৈন্য লয়ে– আর কি কোথাও
নাই শত্রু, আর কেহ নাই কি বিদ্রোহী।
সাক্ষাৎ? কাহার সাথে? রমণীর সনে
সাক্ষাতের এ নহে সময়।
সেনাপতি।                                         মহারাজ–
বিক্রমদেব।            চুপ করো সেনাপতি, শোনো যাহা বলি।
রুদ্ধ করো দ্বার– এ শিবিরে শিবিকার
প্রবেশ নিষেধ।
সেনাপতি।                             যে আদেশ মহারাজ।

দ্বিতীয় দৃশ্য

দেবদত্তের কুটির

দেবদত্ত ও নারায়ণী

দেবদত্ত।

প্রিয়ে, তবে অনুমতি করো– দাস বিদায় হয়।

নারায়ণী।

তা যাও না, আমি তোমাকে বেঁধে রেখেছি না কি?

দেবদত্ত।

ওই তো, ওইজন্যেই তো কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠে না– বিদায় নিয়েও সুখ নেই। যা বলি তা করো। ওইখানটায় আছাড় খেয়ে পড়ো। বলো, হা হতোইস্মি, হা ভগবতি ভবিতব্যতে। হা ভগবন্‌ মকরকেতন।

নারায়ণী।

মিছে ব’কো না। মাথা খাও,সত্যি করে বলো, কোথায় যাবে?

দেবদত্ত।

রাজার কাছে।

নারায়ণী।

রাজা তো যুদ্ধু করতে গেছে। তুমি যুদ্ধু করবে নাকি? দ্রোণাচার্য হয়ে উঠেছ?

দেবদত্ত।

তুমি থাকতে আমি যুদ্ধ করব? যা হোক, এবার যাওয়া যাক।

নারায়ণী।

সেই অবধি তো ওই এক কথাই বলছ। তা যাও না। কে তোমাকে মাথার দিব্যি দিয়ে ধরে রেখেছে?

দেবদত্ত।

হায় মকরকেতন, এখানে তোমার পুষ্পশরের কর্ম নয়– একেবারে আস্ত শক্তিশেল না ছাড়লে মর্মে গিয়ে পৌঁছয় না। বলি ও শিখরদশনা, পক্কবিম্বাধরোষ্ঠী, চোখ দিয়ে জলটল কিছু বেরোবে কি? সেগুলো শীঘ্র শীঘ্র সেরে ফেলো– আমি উঠি।

নারায়ণী।

পোড়া কপাল। চোখের জল ফেলব কী দুঃখে? হাঁ গা, তুমি না গেলে কি রাজার যুদ্ধু চলবে না? তুমি কি মহাবীর ধূম্রলোচন হয়েছ?

দেবদত্ত।

আমি না গেলে রাজার যুদ্ধ থামবে না। মন্ত্রী বার বার লিখে পাঠাচ্ছে রাজ্য ছারখারে যায় কিন্তু মহারাজ কিছুতেই যুদ্ধ ছাড়তে চান না। এদিকে বিদ্রোহ সমস্ত থেমে গেছে।

নারায়ণী।

বিদ্রোহই যদি থেমে গেল তো মহারাজ কার সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাবেন?

দেবদত্ত।

মহারানীর ভাই কুমারসেনের সঙ্গে।

নারায়ণী।

হাঁ গা, সে কী কথা। শ্যালার সঙ্গে যুদ্ধ? বোধ করি রাজায় রাজায় এইরকম করেই ঠাট্টা চলে। আমরা হলে শুধু কান মলে দিতুম। কী বল?

দেবদত্ত।

বড়ো ঠাট্টা নয়। মহারানী কুমারসেনের সাহায্যে জয়সেন ও যুধাজিৎকে যুদ্ধে বন্দী করে মহারাজের কাছে নিয়ে আসেন। মহারাজ তাঁকে শিবিরে প্রবেশ করতে দেন নি।

নারায়ণী।

হাঁ গা, বল কী? তা তুমি এতদিন যাও নি কেন। এ খবর শুনেও বসে আছ? যাও, যাও, এখনি যাও। আমাদের রানীর মতো অমন সতীলক্ষ্ণীকে অপমান করলে? রাজার শরীরে কলি প্রবেশ করেছে।

দেবদত্ত।

বন্দী বিদ্রোহীরা রাজাকে বলেছে– মহারাজ, আমরা তোমারই প্রজা– অপরাধ করে থাকি তুমি শাস্তি দেবে। একজন বিদেশী এসে আমাদের অপমান করবে এতে তোমাকেই অপমান করা হল– যেন তোমার নিজ রাজ্য নিজে শাসন করবার ক্ষমতা নেই। একটা সামান্য যুদ্ধ, এর জন্যে অমনি কাশ্মীর থেকে সৈন্য এল, এর চেয়ে উপহাস আর কী হতে পারে। এই শুনে মহারাজ আগুন হয়ে কুমারসেনকে পাঁচটা ভর্ৎসনা করে এক দূত পাঠিয়ে দেন। কুমারসেন উদ্ধত যুবাপুরুষ, সহ্য করতে পারবে কেন? বোধ করি সেও দূতকে দু-কথা শুনিয়ে দিয়ে থাকবে।

নারায়ণী।

তা বেশ তো– কুমারসেন তো রাজার পর নয়, আপনার লোক, তা কথা চলছিল বেশ তাই চলুক। তুমি কাছে না থাকলে রাজার ঘটে কি দুটো কথাও জোগায় না? কথা বন্ধ করে অস্ত্র চালাবার দরকার কী বাপু। ওই ওতেই তো হার হল।

দেবদত্ত।

আসল কথা একটা যুদ্ধ করবার ছুতো। রাজা এখন কিছুতেই যুদ্ধ ছাড়তে পারছেন না। নানা ছল অন্বেষণ করছেন। রাজাকে সাহস করে দুটো ভালো কথা বলে এমন বন্ধু কেউ নেই। আমি তো আর থাকতে পারছি নে– আমি চললুম।

নারায়ণী।

যেতে ইচ্ছে হয় যাও, আমি কিন্তু একলা তোমার ঘরকন্না করতে পারব না। তা আমি বলে রাখলুম। এই রইল তোমার সমস্ত পড়ে রইল। আমি বিবাগী হয়ে বেরিয়ে যাব।

দেবদত্ত।

রোসো, আগে আমি ফিরে আসি তার পর যেয়ো। বল তো আমি থেকে যাই।

নারায়ণী।

না না তুমি যাও। আমি কি আর তোমাকে সত্যি থাকতে বলছি? ওগো তুমি চলে গেলে আমি একেবারে বুক ফেটে মরব না, সেজন্যে ভেবো না। আমার বেশ চলে যাবে।

দেবদত্ত।

তা কি আর আমি জানি নে? মলয়-সমীরণ তোমার কিছু করতে পারবে না। বিরহ তো সামান্য, বজ্রাঘাতেও তোমার কিছু হয় না!

[ প্রস্থানোন্মুখ

নারায়ণী।

হে ঠাকুর, রাজাকে সুবৃদ্ধি দাও ঠাকুর। শীঘ্র শীঘ্র ফিরিয়ে আনো।

দেবদত্ত।

এ-ঘর ছেড়ে কখনো কোথাও যাই নি। হে ভগবান, এদের সকলের উপর তোমার দৃষ্টি রেখো।

[ প্রস্থান

তৃতীয় দৃশ্য

জালন্ধর

কুমারসেনের শিবির

কুমারসেন ও সুমিত্রা

সুমিত্রা।                ভাই, রাজাকে মার্জনা করো; করো রোষ
আমার উপরে। আমি মাঝে না থাকিলে
যুদ্ধ করে বীর নাম করিতে উদ্ধার।
যুদ্ধের আহ্বান শুনে অটল রহিলে
তবু তুমি; জানি না কি অসম্মান-শেল
চিরজীবী মৃত্যু-সম মানীর হৃদয়ে?
আপন ভায়ের হৃদে দুর্ভাগিনী আমি
হানিতে দিলাম হেন অপমান-শর
যেন আপনারি হস্তে। মৃত্যু ভালো ছিল,
ভাই, মৃত্যু ভালো ছিল।
কুমারসেন।                                        জানিস তো বোন
যুদ্ধ বীরধর্ম বটে, ক্ষমা তার চেয়ে
বীরত্ব অধিক। অপমান অবহেলা
কে পারে করিতে মানী ছাড়া?
সুমিত্রা।                                                  ধন্য, ভাই,
ধন্য তুমি। সঁপিলাম এ জীবন মোর
তোমার লাগিয়া। তোমার এ স্নেহঋণ
প্রাণ দিয়ে কেমনে করিব পরিশোধ?
বীর তুমি, মহাপ্রাণ, তুমি নরপতি
এ নরসমাজ-মাঝে–
কুমারসেন।                                  আমি ভাই তোর।
চল্‌ বোন, আমাদের সেই শৈলগৃহে
তুষারশিখরঘেরা শুভ্র সুশীতল
আনন্দ-কাননে। দুটি নির্ঝরের মতো
একত্রে করেছি খেলা দুই ভাইবোনে,
এখন আর কি ফিরে যেতে পারিবি নে
সেই উচ্চ, সেই শুভ্র শৈশব-শিখরে?
সুমিত্রা।                চলো ভাই, চলো। যে ঘরেতে ভাইবোনে
করিতাম খেলা সেই ঘরে নিয়ে এসো
প্রেয়সী নারীরে,– সন্ধ্যাবেলা বসে তারে
তোমার মনের মতো সাজাব যতনে।
শিখাইয়া দিব তারে তুমি ভালোবাস
কোন্‌ ফুল, কোন্‌ গান, কোন্‌ কাব্যরস।
শুনাব বাল্যের কথা; শৈশব-মহত্ত্ব
তব শিশু হৃদয়ের।
কুমারসেন।                                  মনে পড়ে মোর,
দোঁহে শিখিতাম বীণা। আমি ধৈর্যহীন
যেতেম পালায়ে। তুই শয্যাপ্রান্তে বসে
কেশবেশ ভুলে গিয়ে সারা সন্ধ্যাবেলা
বাজাতিস, গম্ভীর অনন্দমুখখানি।
সংগীতেরে করে তুলেছিলি তোর সেই
ছোটো ছোটো অঙ্গুলির বশ।
সুমিত্রা।                                                 মনে আছে,
খেলা হতে ফিরে এসে শোনাতে আমারে
অদ্ভুত কল্পনা-কথা; কোথা দেখেছিলে
অজ্ঞাত নদীর ধারে স্বর্ণস্বর্গপুর,
অলৌকিক কল্পকুঞ্জে কোথায় ফলিত
অমৃতমধুর ফল; ব্যথিত হৃদয়ে
সবিস্ময়ে শুনিতাম; স্বপ্নে দেখিতাম
সেই কিন্নর কানন।
কুমারসেন।                                 বলিতে বলিতে
নিজের কল্পনা শেষে নিজেরে ছলিত।
সত্য মিথ্যা হত একাকার মেঘ আর
গিরির মতন; দেখিতে পেতেম যেন
দূর শৈল-পরপারে রহস্য-নগরী।
শংকর আসিছে ওই ফিরে।  শোনা যাক
কী সংবাদ।

শংকরের প্রবেশ

শংকর।                              প্রভু তুমি, তুমি মোর রাজা,
ক্ষমা করো বৃদ্ধ এ শংকরে।  ক্ষমা করো
রানী, দিদি মোর।  মোরে কেন পাঠাইলে
দূত করে রাজার শিবিরে।  আমি বৃদ্ধ,
নহি পটু সাবধান বচন-বিন্যাসে,
আমি কি সহিতে পারি তব অপমান?
শান্তির প্রস্তাব শুনে যখন হাসিল
ক্ষুদ্র জয়সেন, হাসিমুখে ভৃত্য যুধাজিৎ
করিল সুতীব্র উপহাস, সভ্রূভঙ্গে
কহিলা বিক্রমদেব জালন্ধররাজ
তোমারে বালক, ভীরু; মনে হল যেন
চারিদিকে হাসিতেছে সভাসদ যত
পরস্পর মুখ চেয়ে, হাসিতেছে দূরে
দ্বারের প্রহরী– পশ্চাতে আছিল যারা
তাদের নীরব হাসি ভুজঙ্গের মতো
যেন পৃষ্ঠে আসি মোর দংশিতে লাগিল।
তখন ভুলিয়া গেনু শিখেছিনু যত
শান্তিপূর্ণ মৃদুবাক্য। কহিলাম রোষে–
“কলহেরে জান তুমি বীরত্ব বলিয়া,
নারী তুমি, নহ ক্ষত্রবীর। সেই খেদে
মোর রাজা কোষে লয়ে কোষরুদ্ধ অসি
ফিরে যেতেছেন দেশে, জানাইনু সবে।”
শুনিয়া কম্পিততনু জালন্ধরপতি।
প্রস্তুত হতেছে সৈন্য।
সুমিত্রা।                                          ক্ষমা করো ভাই।
শংকর।                এই কি উচিত তব, কাশ্মীর-তনয়া
তুমি, ভারতে রটায়ে যাবে কাশ্মীরের
অপমান-কথা? বীরের স্বধর্ম হতে
বিরত ক’রো না তুমি আপন ভ্রাতারে,
রাখো এ মিনতি।
সুমিত্রা।                                   ব’লো না, ব’লো না আর
শংকর।                মার্জনা করো ভাই। পদতলে
পড়িলাম। ওই তব রুদ্ধ কম্পমান
রোষানল নির্বাণ করিতে চাও? আছে
মোর হৃদয়-শোণিত। মৌন কেন ভাই।
বাল্যকাল হতে আমি ভালোবাসা তব
পেয়েছি না চেয়ে, আজ আমি ভিক্ষা মাগি
ওই রোষ তব, দাও তাহা।
শংকর।                                               শোনো প্রভু।
কুমারসেন।           চুপ করো বৃদ্ধ। যাও তুমি, সৈন্যদের
জানাও আদেশ– এখনি ফিরিতে হবে
কাশ্মীরের পথে।
শংকর।                                   হায় এ কী অপমান,
পলাতক ভীরু বলে রটিবে অখ্যাতি।
সুমিত্রা।                শংকর, বারেক তুই মনে করে দেখ্‌
সেই ছেলেবেলা। দুটি ছোটো ভাইবোনে
কোলে বেঁধে রেখেছিলি এক স্নেহপাশে।
তার চেয়ে বেশি হল খ্যাতি ও অখ্যাতি?
প্রাণের সম্পর্ক এ যে চিরজীবনের–
পিতা-মাতা-বিধাতার আশীর্বাদে ঘেরা
পুণ্য স্নেহতীর্থখানি। বাহির হইতে
হিংসানলশিখা আনি এ কল্যাণ-ভূমি,
শংকর, করিতে চাস অঙ্গার-মলিন?
শংকর।                চল্‌ দিদি, চল্‌ ভাই ফিরে চলে যাই
সেই শান্তিসুধাস্নিগ্ধ বাল্যকাল-মাঝে।

চতুর্থ দৃশ্য

বিক্রমদেবের শিবির

বিক্রমদেব, যুধাজিৎ ও জয়সেন

বিক্রমদেব।           পলাতক অরাতিরে আক্রমণ করা
নহে ক্ষাত্রধর্ম।
যুধাজিৎ।                               পলাতক অপরাধী
সহজে নিষ্কৃতি পায় যদি, রাজদণ্ড
ব্যর্থ হয় তবে।
বিক্রমদেব।                              বালক সে, শাস্তি তার
যথেষ্ট হয়েছে। পলায়ন, অপমান,
আর শাস্তি কিবা?
যুধাজিৎ।                                   গিরিরুদ্ধ কাশ্মীরের
বাহিরে পড়িয়া রবে যত অপমান।
সেথায় সে যুবরাজ, কে জানিবে তার
কলঙ্কের কথা।
জয়সেন।                                 চলো মহারাজ, চলো
সেই কাশ্মীরের মাঝে যাই,–  সেথা গিয়ে
দিয়ে আসি কলঙ্কের ছাপ।
বিক্রমদেব।                                           তাই চলো।
বাড়ে চিন্তা যত চিন্তা কর।  কার্যস্রোতে
আপনারে ভাসাইয়া দিনু, দেখি কোথা
গিয়া পড়ি, কোথা পাই কূল।

প্রহরীর প্রবেশ

প্রহরী।                                                     মহারাজ,
এসেছে সাক্ষাৎ-তরে ব্রাহ্মণতনয়
দেবদত্ত
বিক্রমদেব।                        দেবদত্ত? নিয়ে এস, নিয়ে
এস তারে। না, না, রোসো, থামো, ভেবে দেখি।
কী লাগিয়ে এসেছ  ব্রাহ্মণ? জানি তারে
ভালোমতে। এসেছে সে যুদ্ধক্ষেত্র হতে
ফিরাতে আমারে। হায় বিপ্র, তোমরাই
ভাঙিয়াছ বাঁধ, এখন প্রবল স্রোত
শুধু কি শস্যের ক্ষেত্রে জলসেক করে
ফিরে যাবে তোমাদের আবশ্যক বুঝে
পোষমানা প্রাণীর মতন? চূর্ণিবে সে
লোকালয়, উচ্ছন্ন করিবে দেশগ্রাম।
সকম্পিত পরামর্শ উপদেশ নিয়ে
তোমরা চাহিয়া থাকো, আমি ধেয়ে চলি
কার্যবেগে, অবিশ্রাম গতিসুখে, মত্ত
মহানদী যে আনন্দে শিলারোধ ভেঙে
ছুটে চিরদিন। প্রচণ্ড আনন্দ-অন্ধ,
মুহূর্ত তাহার পরমায়ু; তারি মধ্যে
উৎপাটিয়া নিয়ে আসে অনন্তের সুখ
মত্ত করিশুণ্ডে ছিন্ন রক্তপদ্ম-সম।
বিচার বিবেক পরে হবে। চিরকাল
জড় সিংহাসনে পড়ি করিব মন্ত্রণা।
চাহি না করিতে দেখা ব্রাহ্মণের সনে।
জয়সেন।              যে আদেশ।
যুধাজিৎ।              ( জনান্তিকে জয়সেনের প্রতি )
              ব্রাহ্মণেরে জেনো শত্রু বলে।
বন্দী করে রাখো।
জয়সেন।                                   বিলক্ষণ জানি তারে।
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *