০৬. পাওয়া গেল গঙ্গা

পাশের বারান্দা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে দেখতে পাওয়া গেল গঙ্গা। নৌকের ছোট-ছোট আলো। নীলচে আকাশে ছেড়া-ছোড়া সাদা মেঘ।

হঠাৎ সন্তুর মনে হল, সে যেন কতদিন আকাশ দেখেনি! একটা জানলাহীন ঘরে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল। তারপর হাত-পা-মুখ বেঁধে গাড়িতে করে কলকাতার একধার থেকে আর-একাধারে নিয়ে আসা হয়েছে। যেন কলকাতাটাও একটা জঙ্গল বা মরুভূমি বা পাহাড়ের গুহা।

কিন্তু এই জায়গাটা মোটেই ছাতলা উঁচু নয়। চারতলাই ঠিক। লিফটের বোতাম ওরকম কেন?

খাকি পোশাক পরা লোকটি যে ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল, সেটা একটা ঠাকুরঘর। ভেতরে অনেক ঠাকুর-দেবতার ছবি ও মূর্তি, অনেক ফুল। একটা বাঘের চামড়ার আসনে বসে আছেন সেই ভদ্রলোক, কিন্তু এখন তাঁর সাজপোশাক অন্যরকম। তিনি পরে আছেন একটা টকটকে লাল রঙের কাপড়, খালি গায়ে সেই রঙেরই একটা চাদর জড়ানো। কপালে চন্দনের ফোঁটা।

তিনি চোখ বুজে পুজো করছিলেন। এতগুলো পায়ের শব্দে মুখ ফিরিয়ে বললেন, এই যে রায়চৌধুরীসাহেব, আসুন! দেখুন, আপনার ভাইপো এসে গেছে, ওই মেয়েটিকেও আনিয়েছি, ওদের খাইয়ে-দাইয়ে সুস্থ করে দিয়েছি। তা হলে আমার কথা রেখেছি?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, তা রেখেছেন।

লোকটি বলল, এবারে আপনার কাজ শুরু করে দিন। এই ছেলেমেয়ে দুটিকে নিয়ে এখন কী করবেন? বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন?

কাকাবাবু বললেন, তা মন্দ হয় না। ওরা আর শুধু শুধু এখানে থেকে কী করবে? সন্তু, তুই বাড়ি চলে যা!

সন্তু বলল, আমি এক? আর তুমি?

কাকাবাবু বললেন, আমাকে এখানে আরও কিছুক্ষণ থাকতে হবে।

সন্তু বলল, তা হলে আমি এখন যাব না। তোমার সঙ্গে যাব!

দেবলীনা বলল, আমিও যাব না, আমিও থাকব!

কাকাবাবু বেশ পরিতৃপ্তির সঙ্গে হো-হো করে হেসে উঠে বললেন আজকালকার ছেলেমেয়েরা কী চালাক দেখেছেন? ঠিক ধরে ফেলেছে। আপনি যে ওদের বাড়ি পাঠাবার নাম করে অন্য কোথাও নিয়ে আটকে রাখবেন, তা ওরা ঠিক বুঝে গেছে।

লোকটি অবাক হবার ভাব দেখিয়ে বলল, কেন, কেন, আমায় অবিশ্বাস করছেন কেন? বাচ্চা ছেলেমেয়ে, ওদের আটকে রেখে আমার কী লাভ?

কাকাবাবু বললেন, উঁহু, ওরা তত বাচ্চা নয়। বেশ সেয়ানা। এখান থেকে একবার বেরুতে পারলেই ওরা পুলিশ ডেকে এই বাড়ি খুঁজে বার করবে।

আমি কি ওদের সঙ্গে কোনও শত্রুতা করেছি যে, পুলিশ ডাকবে? আমি বরং ওই রাজকুমার ব্যাটার হাত থেকে ওদের ছাড়িয়ে এনেছি। কী বলো, খোকা-খুকুরা?

সন্তু চুপ করে রইল। দেবলীনার মুখ দেখে মনে হল, সে খুকু ডাক শুনে বেশ রেগে গেছে!

কাকাবাবু বললেন, যাকগে, এবারে কাজের কথা বলুন।

বসুন। বসে-বসে কথা হোক। ওরাও যদি থাকতে চায় থাক।

আপনি আমার নাম জানেন, কিন্তু আপনার নাম তো জানা হল না। আগে আলাপ-পরিচয় হোক?

সে কী রায়চৌধুরীবাবু, আপনি এত অভিজ্ঞ লোক, আপনি আমায় চেনেন না? এ-লাইনে আমাকে সবাই একডাকে চেনে। তিন পুরুষ ধরে আমাদের জাহাজের ব্যবসা!

আমি বেশিরভাগ কাজই করেছি। বাইরে-বাইরে। কলকাতার এ-লাইনের লোকদের ভাল চিনি না। চেনা উচিত ছিল। তা, আপনার নামটা?

আমাকে সবাই মল্লিকবাবু বলে চেনে?

মল্লিকবাবু? হ্যাঁ, হ্যাঁ, নাম শুনেছি। আপনাকে চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আপনি তো বিখ্যাত লোক। তা আপনারা যমজ দুভাই না? আপনি কোন জন, যোগেন না মাধব?

আমার নাম যোগেন। আর আমার ছোট ভাই, মানে যে ঠিক আমার বারো মিনিট পরে জন্মেছে, তার নাম মাধব।

লাইনের লোকরা আপনাদের জগাই মাধ্যই বলে। আপনাদের দুজনকে দেখতে হুবহু এক রকম, তাই না?

রায়চৌধুরীবাবু, দয়া করে আমার সামনে ওই নাম উচ্চারণ করবেন না। আমাদের শত্রুপক্ষের ব্যাটাচ্ছেলেরা ওই নাম রটিয়েছে।

সে যাকগে। এবারে কাজের কথাটা বলুন।

জগাই মল্লিক একবার আড়চোখে সন্তু আর দেবলীনার দিকে তাকাল। তারপর অখুশিভাবে বলল, এইসব ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের সামনে এসব কাজের কথা আলোচনা করা কি ঠিক? বললুম, ওদের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে। আমার নিজেরও এই বয়েসী ছেলেমেয়ে আছে।

কাকাবাবু পরিহাসের সুরে বললেন, ওরা বড় হচ্ছে! ওরা সব বুঝুক, শিখুক যে পৃথিবীটা কত শক্ত জায়গা! আপনার ছেলেমেয়েদের এসব শেখাচ্ছেন না? তারা বড় হয়ে আপনার কারবার বুঝে নেবে কী করে?

আমার ছেলেমেয়েদের আর এই কারবারে নামবার দরকার হবে না। আমি যা রেখে যাব, তাতেই তাদের তিন পুরুষ দিব্যি চলে যাবে।

সন্তু আর ধৈর্য রাখতে পারছে না। এই সব বাজে কথা শুনতে তার একটুও ভাল লাগছে না। এই জগাই মল্লিক নামে লোকটা কাকাবাবুকে দিয়ে কী কাজ করাতে চায়? এই লোকটাকে প্ৰথমে দেখে তার ভাল লোক মনে হয়েছিল!

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, বলুন, মল্লিকবাবু।

জগাই মল্লিক বলল, ওই রাজকুমার নামে লোকটা আপনাকে ধরে নিয়ে আটকে রেখেছিল। আপনার জন্যে নাকি ভাল খদের আছে। ইজিপ্টে কোন ব্যবসায়ীকে আপনি খুব শক্ৰ বানিয়েছেন, তাকে নাকি এক পিরামিডের তলায় আটকে রেখে আপনি খুব শাস্তি দিয়েছেন, সে আপনাকে পঁচিশ হাজার টাকায় কিনতে চায়।

কাকাবাবু ছদ্ম বিস্ময়ে বললেন, অ্যাঁ, মাত্র পঁচিশ হাজার টাকা? আমার মাথার দাম। এত সস্তা?

এরকম অবস্থার মধ্যেও কাকাবাবুর কথা শুনে দেবলীনা ফিকফিক করে হেসে উঠল।

এতক্ষণে দেবলীনা সম্পর্কে সন্তু একটু সন্তুষ্ট হল। বিপদের মধ্যেও যে হাসতে পারে সে একেবারে এলেবেলে নয়।

দেবলীনার হাসি শুনে জগাই মল্লিক বলল, চোপ! বেয়াদপি করবে না।

কাকাবাবু বললেন, আহা, অন্যদিকে মন দিচ্ছেন কেন, আপনার কাজের কথাটা বলুন।

পূজারীর বেশ ধরে, এত ঠাকুর-দেবতার সামনেও জগাই মল্লিক ফশ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল, তারপর পর পর দুটো বড় টান দিল।

কাকাবাবু বললেন, শুনুন মল্লিকবাবু, এক সময়ে আমি খুব সিগার আর পাইপ খেতুম! সে-সব ছেড়ে দিয়েছি। এখন তামাকের গন্ধ আমার সহ্য হয় না। সিগারেটটা নিভিয়ে ফেলুন!

জগাই মল্লিক একেবারে হাঁ হয়ে নিম্পলকভাবে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল কাকাবাবুর দিকে। তারপর বলল, আপনি বেড়ে লোক তো মশাই? এটা আপনার বাড়ি না। আমার বাড়ি? আপনি বাঁচবেন কি মরবেন, সেটা নির্ভর করছে আমার ইচ্ছের ওপর। অথচ আপনি আমার ওপর হুকুম ঝাড়ছেন?

কাকাবাবু ইয়ার্কির সুরে বললেন, আহা, বাঁচা বা মরাটা তো বড় কথা নয়। বড় কথা হল কাজ, সেই কাজের কথা বলুন। আমি তো আপনাকে হুকুম করিনি। সিগারেটের গন্ধ আমার সহ্য হয় না বলে আপনাকে অনুরোধ করলুম!

সামনের কোষা-কুষির জলের মধ্যে সিগারেটটা ঠেসে নিভিয়ে দিয়ে রাগতভাবে জগাই মল্লিক বলল, ঠিক আছে, কাজের কথাই হোক। ওই রাজকুমার ব্যাটা তো আপনাকে পাঁচিশ হাজার টাকায় বিক্রি করে ইজিপ্টে পাঠাবার ব্যবস্থা করে ফেলেছিল। মাঝপথে আমি খবর পেয়ে ভাবলুম, আরেঃ, আপনাকে তো আমারই খুব দরকারী! আপনার মতন একজন মাথাওয়ালা লোক শুধু শুধু ইজিপ্টে গিয়ে পচবেন কেন? আপনি আমার দু একটা কাজ করে দেবেন, তারপর আমি আপনার ভরণপোষণ করব।

কাকাবাবু মাথা নিচু করে অভিবাদনের ভঙ্গি করে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ!

জগাই মল্লিক। এতে সন্তুষ্ট হয়ে বলল, দেখুন মশাই, আমরা বনেদি বাঙালি, আমরা খাঁটি ভদ্রলোক। আমরা পারতপক্ষে ভায়োলেন্স পছন্দ করি না, আমরা গুণীর কদর বুঝি!

কাকাবাবু সঙ্গে-সঙ্গে সুর পালটে বললেন, আমি কিন্তু ততটা ভদ্রলোক নই। আমি অনেক সময় লোকদের মারধোর করি, রিভলভার দিয়ে ভয় দেখাই। সে-রকম সে-রকম বদমোশদের পুলিশের হাতেও ধরিয়ে দিই। যাকগে সে-সব কথা। তা রাজকুমার আমাকে এককথায় আপনার হাতে তুলে দিল?

এমনি-এমনি দেয়নি। আমি তিরিশ হাজার দর দিয়েছি। রাজকুমারের সঙ্গে আমার কিছু কাজ-কারবার আছে। ব্যবসার স্বার্থে ওকেও আমার কথা শুনতে হয়, আমাকেও ওর কথা শুনতে হয়।

কাজ-কারবার মানে রাজকুমার যখন মানুষ পাচার করে তখন আপনি সেই সব লোকদের গোপনে আরবমুখে জাহাজে তুলে দেন। আগে জানতুম। এসব কাজ বোম্বে থেকেই হয়। কলকাতা থেকেও যে হয় তা আমার জানা ছিল না।

দেখুন রায়চৌধুরীবাবু, আমি চার্টার করা জাহাজে মাল পাঠাই। তা কেউ আলুর বস্তা পাঠাচ্ছে, না মশলা পাঠাচ্ছে, না জ্যান্ত মানুষ পাঠাচ্ছে, তা তো জানিবার দরকার নেই আমার। ওরা যদি কাস্টমস আর পুলিশকে ম্যানেজ করতে পারে, তারপর আর আমার কী বলবার আছে! আমার হল মাল পাঠানো নিয়ে কথা!

কাকাবাবু বললেন, তা তো বটেই, তা তো বটেই! কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। রাজকুমারের সঙ্গে আপনার আমাকে নিয়ে বোঝাপড়া হয়ে যাবার পরেও রাজকুমার আর টাইগার ওইদিকের একটা ঘরে বসে আছে কেন?

ওকে এখনও পেমেন্ট করিনি, তাই বসে আছে। ও কিছু না।

আমি যতদূর জানি, আপনাদের এ-লাইনের যা কাজ-কারবার সব মুখের কথায় বিশ্বাসের ওপর চলে। কেউ তো এরকম হাত পেতে নগদ টাকা নেবার জন্য বসে থাকে না! ও কেন বসে আছে তা আমি জানি বোধহয়! এবারে আসল সত্যি কথাটা বলে ফেলুন তো!

আরে, ছি, ছি, ছি! আমি কি আপনাকে মিথ্যে কথা বলছি! আপনি আমার দু একটা কাজ করে দেবেন, তার বদলে আপনাকে আমি মুক্তি দিয়ে দেব। আপনার এই ভাইপো-ভাইঝি সমেত!

উঁহু, এটা তো সত্যি কথা যে, আমি ছেলেমানুষ নই, জগাইবাবু!

জগাই নয়, যোগেন।

ওই একই হল। আমি জানি আপনার মনের ইচ্ছেটা কী। আপনি আমাকে দিয়ে আপনার জরুরি কাজ করিয়ে নেবেন আমাকে ছেড়ে দেবার লোভ দেখিয়ে। তারপর যে-ই আপনার কার্য উদ্ধার হয়ে যাবে, অমনি হয় আপনি আমাকে রাজকুমারের হাতে তুলে দেবেন অথবা মেরে ফেলবেন। আপনার লাল রঙের কাপড়-টাপড় দেখে মনে হচ্ছে আপনি কালীসাধক। আপনি কি ভেবেছেন কালীঠাকুরের সামনে আমাদের বলি দেবেন?

আরো ছি, ছি, ছি, কী যে বলেন! ওসব চিন্তা আমার মাথাতেই আসেনি। আমি শুধু চাই…

এমন সময় সিঁড়িতে দুপদাপ শব্দ হল। খাকি পাশাক-পরা লোকটি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, ঠিক ওই রকমই পোশাক-পরা অন্য দুজন লোক দৌড়ে এল ঠাকুরঘরের কাছে। জুতো খুলে ভেতরে এসে জগাই মল্লিকের কানে কানে কী যেন বলতে লাগল।

জগাই মল্লিকের মুখের একটা রেখাও কপিল না। সে মন দিয়ে সব শুনে বলল, যা, ঠিক আছে। অত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? ওদের নীচের জলসা-ঘরে বসা। খাতির-যত্ন কর। শরবত খেতে দে। তারপর আমি আসছি।

সেই লোক দুটি চলে যাবার পর জগাই মল্লিক। তীব্রভাবে কাকাবাবুর দিকে চেয়ে বলল, রায়চৌধুরীবাবু, আপনি কি পুলিশে খবর দিয়েছেন?

কাকাবাবু বললেন, ইচ্ছে তো ছিল, কিন্তু সুযোগ পেলাম কই? আপনার লোক অনেক পরীক্ষা করে দেখেছে যে, আমার এই ক্রাচ-দুটোর মধ্যে কোনও লুকোনো ট্রান্সমিটারও নেই, কোনও অস্ত্ৰও নেই।

জগাই মল্লিক একটুক্ষণ চিন্তা করে বলল, পুলিশ এমনি রুটিন চেকেও আসে মাঝে-মাঝে, বুঝলেন। নাম কো ওয়াস্তে। ওদেরও তো মাঝে-মাঝে রিপোর্ট দেখাতে হয়।

কাকাবাবু বললেন, তা তো বটেই! তা তো বটেই!

উঠে দাঁড়িয়ে জগাই মল্লিক বলল, আগেও অনেকবার এসেছে, বুঝলেন? আমাদের এই বাড়িটার ওপর শত্রুপক্ষের যে খুব নজর।

চমৎকার বাড়িখানা আপনার। দেখলে যে-কোনও লোকেরই লোভ হবে।

আপনাকে একটু গা তুলতে হচ্ছে যে, রায়চৌধুরীবাবু। বলা যায় না, পুলিশ হয়তো ওপরে উঠে এসে এ-ঘরেও উঁকিঝুঁকি মারতে পারে।

হ্যাঁ, কোনও অতি-উৎসাহী ছোকরা-অফিসার হলে সারা বাড়িটাই সার্চ করে দেখতে চাইবে হয়তো।

অবশ্য ঠাকুরঘরে ঢুকে বেশি কিছু ঘাঁটাঘাঁটি করতে কোনও পুলিশই সাহস পায় না। পাপের ভয় আছে তো। যাই হোক, সাবধানের মার নেই। কিছুক্ষণের জন্য আপনাদের আমি একটু অন্য জায়গায় লুকিয়ে রাখতে চাই।

একদিকের দেয়ালে একটা মস্ত বড় কালীঠাকুরের ছবি। জগাই মল্লিক সেটা নামিয়ে ফেলতে দেখা গেল, তার পেছনের দেয়ালে একটা কাঠের হ্যান্ডেল মতন লাগানো রয়েছে। জগাই মল্লিক সেই হ্যান্ডেলটা ধরে ঘোরাতে চেষ্টা করল। বেশ জোর দিয়েও কোনও কাজ হল না। তখন সে খাকি পোশাক-পরা লোকটিকে ডেকে বলল, এই পাল্টে, এদিকে এসে হাত লগা তো!

সেই লোকটি এসে খুব জোরে হ্যান্ডেল ঘোরাতেই দেয়ালটা খানিকটা ফাঁক হয়ে গেল। ওপাশে আর একটা ঘর আছে।

জগাই মল্লিক বলল, ঢুকে পড়ুন, আপনারা ওখানে চটপট ঢুকে পড়ুন। দেবলীনা কেউ কিছু বোঝবার আগেই ছুটে বেরিয়ে গেল ঠাকুরঘর থেকে। তারপর বারান্দার রেলিং ধরে চিৎকার করে উঠল, পুলিশ! পু…

বেশি চ্যাঁচাতে পারল না। কাছাকাছি অন্য লোক পাহারায় ছিল, সে ছুটে এসৈ মুখ চেপে ধরল। দেবলীনার। তার এক হাতে খোলা তলোয়ার।

জগাই মল্লিকের মুখখানা রাগে বীভৎস হয়ে গেছে, সে বলল, এই জন্যই আমি ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ-কারবার করি না! এই ওকে মারিস না, এদিকে নিয়ে আয়।

দেবলীনা নিজেকে ছাড়াবার জন্য ছটফট করছে, কিন্তু সেই লোকটার ভীমের মতন চেহারা। সে টানতে-টানতে দেবলীনাকে নিয়ে এল। ঘরের মধ্যে।

সন্তুও ভেবেছিল, নীচে যখন পুলিশ এসেছে তখন এই সুযোগে একটা গোলমাল বাধিয়ে পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই তো ভাল। জগাই মল্লিকের হাতে কোনও অস্ত্রই নেই, তাকে অনায়াসে ঘায়েল করা যায়। কিন্তু সে একবার কাকাবাবুর দিকে তাকাতেই কাকাবাবুঘাড় নেড়ে তাকে নিষেধ করলেন।

গোপন দরজা দিয়ে ভেতরের ঘরের মধ্যে প্রথমে দেবলীনাকে ছুঁড়ে দেওয়া হল। তারপর কাকাবাবু আর সন্তুকেও ঠেলে-ঠেলে ঢোকানো হল। ভেতরটা একেবারে ঘুটফুটে অন্ধকার। জগাই মল্লিক সুইচ টিপে আলো জ্বালতেই দেখা গেল, সেই ঘরেও অনেক পাথরের মূর্তি আর ছোট-ছোট বাক্স রয়েছে।

জগাই মল্লিক বলল, শুনুন, রায়চৌধুরীবাবু, কোনও রকম গণ্ডগোল করার চেষ্টা করলে আর এ-ঘর থেকে জ্যান্ত বেরুতে পারবেন না। সেরকম ব্যবস্থা করা আছে। এখান থেকে হাজার চ্যাঁচালেও কেউ শুনতে পাবে না। এই বিছুদুটোকে সামলান 1 এর পরের বার কিন্তু আমি আর দয়া-মায়া দেখাব না।

কাকাবাবু বললেন, আপনাকে বোধহয় একবার নীচে যেতে হবে। ঠিক আছে চলে যান, দয়া-মায়া নিয়ে এখন চিন্তা করতে হবে না?

জগাই মল্লিক এক পা এগিয়ে এসে বলল, ততক্ষণে আপনি একটা কাজ সেরে ফেলুন!

এক কোণে কালো কাপড় দিয়ে কিছু একটা ঢাকা রয়েছে। সেই কালো কাপড়টা তুলে জগাই মল্লিক বলল, এই দেখুন, চিনতে পারেন?।

কাকাবাবু বিস্ময়ে শিস দিয়ে উঠলেন। বললেন, এতক্ষণে বুঝলুম, আমাকে ধরে রাখার জন্য আপনার এত গরজ কেন?

দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা হয়েছে দুটি হুবহু একরকম কালো পাথরের মূর্তি। প্রায় দেড় হাত লম্বা। দুটো মূর্তিরই ডান দিকের কান ভাঙা!

জগাই মল্লিক বলল, আপনারই আবিষ্কার, আপনি তো চিনবেনই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে…

দুটো ছিল না। একটা ছিল। বালুরঘাট মিউজিয়াম থেকে চুরি যায়।

যে চুরি করেছে। সে কী সেয়ানা দেখুন! সঙ্গে-সঙ্গে একটি কপি বানিয়ে ফেলেছে। কোনটা আসল, কোনটা নকল ধরবার উপায় নেই। এখন দুটোই আমার হাতে এসে পড়েছে। আসলটার জন্য বিদেশের এক পার্টি অর্ডার দিয়ে রেখেছে, ভাল দাম দেবে। কিন্তু দুটোর মধ্যে কোনটা যে আসল সেটা বুঝতে পারছি না। জানেন তো, ফরেনে ভেজাল মাল পাঠালে ওরা কীরকম চটে যায়? নাম খারাপ হয়ে যায়? আমি সেরকম কারবার করি না?

কাকাবাবু মুর্তি দুটোর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন।

জগাই মল্লিক বলল, আপনার জিনিস, আপনি আসলটা বেছে দিন। তারপর আপনার ছুটি। ভেজালটা আমি বালুরঘাটে পাঠিয়ে দেব। মিউজিয়ামে কটা লোকই বা যায়, সেখানে আসল মূর্তি রইল না নকল রইল, তাতে কিছু আসবে যাবে না! চটপট কাজ শেষ করে ফেলুন। আমি পুলিশকে ভজিয়ে ফিরে আসছি।!