১৪. সরাহখানায় তারা গজল শুনছিল

সরাহখানায় তারা গজল শুনছিল।

কত দূর থেকে আসে লু-হাওয়ার তীর
সে কি তোমার নিঃশ্বাস সাকী,
আমার কদমে জিঞ্জির
কত আমির তোমার উমেদার
এ দীল সংগেল, বেকারার
সুমসাম রাতে আহাজারী সার,
পাথরে কুটা ফুটা শির।
আমার কদমে জিঞ্জির।।

রুবাবের আওয়াজ শুধু এই স্বরে বিষণ্ণতার আমেজ ছুঁইয়ে যায়। বগ্‌দাদের সরাইখানার অন্ধকার। গায়ক হয়ত আদেশ দিয়েছিল আলো নিভিয়ে দিতে।

গজল অনেকক্ষণ ধরে চলতে থাকে। যেন আজ আর শেষ হবে না। শ্রোতারা বুঁদ। বিরহীর আর্তনাদ সকলের বুকে জারিয়ে গেছে। এখানে সবাই প্রেমিক। ঝাপসা অন্ধকারে শুধু বহু মানুষের আন্দাজ পাওয়া যায়।

হঠাৎ একজন হো হো শব্দে চতুর্দিক সচকিত করে হেসে উঠল।

আসরে ফাটল দেখা দেয়, তাই বহু শ্ৰোতাই বিরক্ত!

সত্যি গায়কের গজল থেমে গেল পরিবেশ মোতাবেক। তার কণ্ঠ থেকে আর রাগ বেরোয় না–যা রাগিণীর পুরুষ রূপ। গোস্বাধৃত তার গলার আওয়াজ।

–আবুল আতাহিয়া, বেয়াদবের মত হাসছো কেন?

–আবু নওয়াস, মাথায় জজমের ঠাণ্ডা পানি ঢালো।

নওয়াস : এমন গজলটা ধরেছিলাম। সব জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলে।

আতাহিয়া : তার মালিক তো স্রেফ আল্লা। আমি তো বান্দা।

নওয়াস : তোমার এমন আক্কেল বলেই তো তেমি কবিতা লেখো।

আতাহিয়া : তোমার আক্কেল আছে, স্মৃতিশক্তি আছে?

নওয়াস : আল্লা মাথার খুলিটা এখনও শূন্য করে নেন নি।

আতাহিয়া : নিয়েছে। টের পাও নি।

নওয়াস : দ্যাখো, এখনই লড়াই বেধে যাবে।

আতাহিয়া : তাতো বাধবেই। নাদানকে নাদান বলেই, তার গলা থেকে গান বেরোয় না।

নওয়াস : আমি নাদান?

আতাহিয়া : প্রায়। পুরো নয়। সেদিন যে বলে, তুমি জীবনের কবি, জীবনের গান গাও; আর আমি মৃত্যুর কবি, নিরাশাবাদী অগয়রহ। আরো কি কি বলে। আজ তুমি কি গজল গাইছ?

নওয়াস : উঃ, আবুল আলাহিয়া। তোমার মাথার খুলিটা হেকিমকে দিয়ে একবার দেখিয়ে নাও। ওটা খালি হয়ে গেছে, টের পাও নি।

আতাহিয়া : এই বুঝি জীবনের গান?

নওয়াস : বিরহে দুঃখ আছে। দুঃখ কি জীবনে আসে না? এতে জীবন-বহির্ভূত কি দেখলে?

আতাহিয়া : মৃত্যু কি জীবনে আসে না?

নওয়াস : আসে। সে একবার মাত্র। তা নিয়ে হাজার বার নাকী কান্না কাঁদতে হবে না কি, তুমি যা করো?

আতাহিয়া : নওয়াস, দুঃখের গান গাওয়ার মধ্যে আনন্দ আছে। আজ তুমি যে-বিরহের গান গাইলে এমন মজা আর কোনদিন পাইনি। তোমার কবিতা ফিকে লাগে এর কাছে।

নওয়াস : আবুল আলাহিয়া, ভুল করো না। দুঃখ আর মৃত্যু এক জিনিস নয়। দুঃখের গান গাই দুঃখকে দূর করার জন্যে, দুঃখের মোকাবিলায় দাঁড়াতে পারব, তার জন্যে। যারা এই জীবন জীইয়ে তুলতে পারে না, তারা কবিতা লেখে শকুনদের জন্যে। পারশীরা শকুনের কাছে যেমন মড়া ফেলে দেয়, ওই কবিরা তেমন কবিতা ছুঁড়ে দেয় পাঠকদের জন্যে। আজান দিয়ে মুসল্লি ডাকে, তুমি কবিতা দিয়ে মানুষ ডাকার বন্দোবস্ত করো। তুমি—

আতাহিয়া : থামো, থামো। এলাম দু-দণ্ড মওজ করতে, তুমি কি যে ক ক শুরু করে দিলে। তৌবাস্তগ্‌ফেরুল্লা।

নওয়াস: শয়তান তোমার কাছাকাছি থাকে কি না, তাই তোমার বার বার আস্তাগফেরুল্লা পড়তে হয়।

আতাহিয়া : হাহ্‌ হা, আমি তো শয়তানের কাছেই বসে আছি, ঠিক বলেছো।

নওয়াস : শয়তানই বিশ্বসৃষ্টির আগে প্রথম ন্যায়শাস্ত্রের প্রয়োগসাধন করেছিল। সেই যুক্তিই মানুষের সভ্যতার উন্নতির অন্যতম বড় উপাদান। মনে রেখো আবুল আতাহিয়া। মাঝে মাঝে শয়তানেই হয়তো আসল মনুষ্যত্বের সূচনা ঘটে।

আতাহিয়া : শয়তানের যুক্তি দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে।

নওয়াস : আতাহিয়া, যুক্তির পেছনে কি থাকে জানো?

আতাহিয়া : না।

নওয়াস : তা তোমার জানার কথা নয়। যুক্তির পেছনে থাকে মুক্তির স্বপ্ন। এই মুক্তির স্বপ্নই মানুষকে মানুষ বানায়। আমি তাই দুনিয়ার তামাসা ভাল করে দেখি।

আতাহিয়া : নওয়াস, তোমার সঙ্গে কথায় পেরে ওঠা দায়। কারণ, চোর আর ছেনাল কারচুপিতে খুব দড়।

নওয়াস : আতাহিয়া, আজ কষে গালাগাল দাও। আমি আজ মজে আছি। আমার আর এক মজুলিশ বাকী আছে।

আতাহিয়া : তোমার সঙ্গে আজ রাত কাটাচ্ছি না।

নওয়াস : নীরস তুমি। মওজ দেখলে তোমার দীল বাতাসে কাঁপে। কিন্তু বন্ধু, জীবনকে খুঁজে পেতে হাটে হাটে ঘুরতে হয়।

আতাহিয়া : কিন্তু তুমি যে শুধু রূপের হাটে ঘুরে বেড়াও।

নওয়াস : রূপের হাট-ই আসল হাট। মানুষ যদি তা না আবিষ্কার করত, এই দুনিয়ার বাঁচার আর কোন মজা থাকত না। ফুল তো বনে ফোটে। কিন্তু তাকে আমরা সাজিয়ে ফোঁটাতে চাই। তাই বাগান করি। রূপের নেশা থেকেই কাজের উৎপত্তি অথবা কাজ থেকে রূপের নেশার উৎপত্তি… আর কাজই সমস্ত সংসারকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তোমার মত নিষ্কৰ্মারা আকাশের দিকে তাকায়। কাজে আর রূপে মিতালি পাতিয়েই তো ইনসান এগোচ্ছে। যখন আর ওই দুই খোট একত্রে মেলাতে পারে না, তখনই মানুষ হয় ইব্‌লিশ। মুনাফেকীর (ভণ্ডামি) জন্ম সেইখানে।

আতাহিয়া : কিন্তু নওয়াস, জাহেলী (অজ্ঞতা) থেকেও তো মুনাফেকীর জন্ম হতে পারে।

নওয়াস : তা হয়। কিন্তু জাহেলী তো একটা তাসীর (ফল)। তুমি কেমন মা-বাপ ইয়ার-দোস্ত-মুলুকে মানুষ, তার উপরও অনেকটা নির্ভর করে।

আতাহিয়া : কিন্তু এ আমরা কোথায় যাচ্ছি?

নওয়াস : কেন?

আতাহিয়া : এলাম, দু-দণ্ড মওজ করব। তুমি পান করবে, আমি গান শুনব। সে জায়গায় এসব কি শুরু করলে?

নওয়াস : রুহ্ সাফা (আত্ম-পরিষ্কার) পানি ত তোমার জঠরে যায় না, তাই আমার জায়গাটা তোমার ঠিকানা-মত নয়।

আতাহিয়া : না, ইয়ার। আবার গজল গাও।

নওয়াস : কিন্তু গজল আর জমবে না।

আতাহিয়া : কেন?

নওয়াস : কল্পনার বোরারকে (স্বর্গীয় বাহন) চড়ে, তুমি দুনিয়ার তাবৎ সুলতানার (রানী) সঙ্গে ‘জেনা’ ব্যভিচার করতে পারো, আর এ খাহেশও স্বাভাবিক। কিন্তু মাটির উপর পড়লে, বিবিরও মত নিতে হয়।

আতাহিয়া : লা-হাওয়া, লা-হাওলা। বাঁচাও প্রভু শয়তান থেকে।

নওয়াস : সত্যি।

আতাহিয়া : কিন্তু আমি বলছি, তোমার কল্পনা যদি ভেঙে থাকে, জোড়া দাও।

নওয়াস : তা আর সম্ভব নয়। দ্যাখো আবুল আতাহিয়া, তুমি আর যাই করো আমার সঙ্গে বাজি ধরো না। খোদ্ আমিরুল মুমেনীন আমার সঙ্গে বাজি ধরে প্রায় হারতে বসছেন।

আতাহিয়া : তোমার সঙ্গে বাজি?

নওয়াস : তারই ফয়সালা আছে কাল। পরে সব শুনবে। আজ থাক্‌, চলো ওঠা যাক্।

আতাহিয়া : আবু নওয়াস, বগ্‌দাদ তোমাকে চেনে না, তাই তোমার এত বদনাম।

নওয়াস : বন্ধু মহাপুরুষদের অনেক দেরীতে চেনা যায়। চল্লিশ বৎসর লেগে গিয়েছিল হয়রত মুহাম্মদ (দঃ) কে জানতে। তাই বলে আমি একটা বিশেষ কিছু… তা মনে করো না। এক দেশে বাদশার নাম ছিল হবু। মন্ত্রীর নাম ছিল গুব। মহাপুরুষেরা নবুয়ৎ (নবীত্ব) পায়, আমি এবার গবুয়ৎ পেয়ে যাব।

আতাহিয়া : হা-হা-হা, আবু নওয়াস। তোমাকে ঠিকমত বুঝি না, তবু বুকে বুক মিলাতে ইচ্ছা করে।

নওয়াস : খবরদার। এর নাম বুৎ-পরস্তি–প্রতিমা পূজা। ও মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যায়। অর্থাৎ ধ্বংসের পথে। বুঝবে, তবে বুকে বুক মিলাবে। সব জিনিস তুমি যুক্তি দিয়ে গ্রহণ করবে, নচেৎ তুমিও বুৎ-পরস্ত (প্রতিমা পূজক)–সে তুমি মুসলমানই হও আর ইহুদীই হও। না, আর কথা না। ওহে সরাইওয়ালা তোমার শরাবের দাম কাল নিও।

সরাইওয়ালা : আচ্ছা জনাব। আস্সালামো আলায়কুম।

উভয়ে : ওআলায়কুম আসোলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *