• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Book । বাংলা লাইব্রেরি

Read Bengali Books Online @ FREE

  • লেখক
  • অনুবাদ
  • সেবা
  • PDF
  • Bookmarks

লেখক

অনুবাদ

সেবা

কৌতুক

লিরিক

ডিকশনারি

PDF

Bookmarks

অঙ্ক স্যার, গোলাপীবাবু আর টিপু

লাইব্রেরি » সত্যজিৎ রায় » গল্প (সত্যজিৎ রায়) » অঙ্ক স্যার, গোলাপীবাবু আর টিপু

অঙ্ক স্যার, গোলাপীবাবু আর টিপু

টিপু ভূগোলের বইটা বন্ধ করে ঘড়ির দিকে দেখল। সাতচল্লিশ মিনিট পড়া হয়ে গেছে একটানা। এখন তিনটে বেজে তেরো মিনিট। এবার যদি ও একটু ঘুরে আসে তা হলে ক্ষতি কী? ঠিক এমনি সময় তো

সেদিন লোকটা এসেছিল। সে তো বলেছিল টিপুর দুঃখের কারণ হলে তবে আবার আসবে। তা হলে? কারণ তো হয়েছে। বেশ ভাল রকমই হয়েছে। যাবে নাকি একবার বাইরে?

নাঃ। মা বারান্দায় বেরিয়েছেন কীসের জন্য জানি। হুস করে একটা কাগ তাড়ালেন এক্ষুনি। তারপর ক্যাঁচ শব্দটায় মনে হল বেতের চেয়ারটায় বসলেন। বোধহয় রোদ পোয়াচ্ছেন। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।

লোকটার কথা মনে পড়ছে টিপুর। এমন লোক টিপু কোনওদিন দেখেনি। ভীষণ বেঁটে, গোঁফদাড়ি নেই, কিন্তু বাচ্চা নয়। বাচ্চাদের এমন গম্ভীর গলা হয় না। তা হলে লোকটা বুড়ো কী? সেটাও টিপু বুঝতে পারেনি। চামড়া কুঁচকোয়নি কোথাও। গায়ের রঙ চন্দনের সঙ্গে গোলাপি মেশালে যেমন হয় তেমনই। টিপু মনে মনে ওকে গোলাপীবাবু বলেই ডাকে। লোকটার আসল নাম টিপু জানে না। জানতে চেয়েছিল, কিন্তু লোকটা বলল, কী হবে জেনে? আমার নাম উচ্চারণ করতে তোমার জিভ জড়িয়ে যাবে।

টিপু বেশ রেগে গিয়েছিল। কেন, জড়িয়ে যাবে কেন? আমি প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব বলতে পারি, কিংকর্তব্যবিমূঢ় বলতে পারি, এমনকী ফ্লকসিনসিনিহিলিপিলিফিকেশন বলতে পারি, আর তোমার নাম বলতে পারব না? তাতে লোকটা বলল, একটা জিভে আমার নাম উচ্চারণ হবে না।

তোমার বুঝি একটার বেশি জিভ আছে? জিজ্ঞেস করেছিল টিপু।

বাংলা বলতে একটার বেশি দরকার হয় না।

বাড়ির পিছনে যে নেড়া শিরীষ গাছটা আছে, তারই নীচে দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা। এদিকটা বড় একটা কেউ আসে না। শিরীষ গাছটার পিছনে খোলা মাঠ, তারও পিছনে ধান খেত, আর তারও অনেক, অনেক পিছনে পাহাড়ের সারি। কদিন আগেই টিপু এদিকটায় এসে একটা ঝোঁপের ধারে একটা বেজিকে ঘোরাফেরা করতে দেখেছিল। আজ হাতে কিছু পাঁউরুটির টুকরো নিয়ে এসেছিল ঝোঁপটার ধারে ছড়িয়ে দেবার জন্য, যদি তার লোভে বেজিটা আবার দেখা দেয়। এমন সময় হঠাৎ চোখ পড়ল গাছতলায় দাঁড়ানো লোকটার দিকে। চোখাচুখি হতেই লোকটা ফিক করে হেসে বলল, হ্যালো।

সাহেব নাকি? সাহেব হলে কথা বলে বেশিদূর এগোনো যাবে না, তাই টিপু কিছুক্ষণ কিছু না বলে লোকটার দিকে তাকিয়ে ছিল। এবার লোকটাই ওর দিকে এগিয়ে এসে বলল, তোমার কোনও দুঃখ আছে?

দুঃখ?

দুঃখ।

টিপু তো অবাক! এমন প্রশ্ন তাকে কেউ কোনওদিন করেনি। সে বলল, কই না তো। দুঃখ তো নেই।

ঠিক বলছ?

বা রে, ঠিক বলব না কেন?

তোমার তো দুঃখ থাকার কথা। হিসেব করে তো তাই বেরোলো।

কীরকম দুঃখ? ভেবেছিলাম বেজিটাকে দেখতে পাব, কিন্তু পাচ্ছি না। সেরকম দুঃখ?

উঁহু উঁহু। যে-দুঃখে কানের পিছনটা নীল হয়ে যায়, হাতের তেলো শুকিয়ে যায়, সেরকম দুঃখ।

মানে ভীষণ দুঃখ?

হ্যাঁ।

না, সেরকম দুঃখ নেই।

লোকটা এবার নিজে দুঃখ ভাব করে মাথা নেড়ে বলল, নাঃ, তা হলে এখনও মুক্তি নেই।

মুক্তি?

মুক্তি। ফ্রিডম।

ফ্রিডম মানে মুক্তি সেটা আমি জানি, বলল টিপু। আমার দুঃখ হলে বুঝি তোমার মুক্তি হবে?

লোকটা টিপুর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বলল, তোমার বয়স সাড়ে দশ?

হ্যাঁ, বলল টিপু।

আর নাম শ্রীমান তর্পণ চৌধুরী?

হ্যাঁ।

তা হলে কোনও ভুল নেই।

লোকটা যে ওর বিষয়ে এত খবর পেল কোত্থেকে, সেটা টিপু বুঝতে পারল না। টিপু বলল, শুধু আমার দুঃখ হলেই তোমার মুক্তি? আর কারুর দুঃখে নয়?

দুঃখে মুক্তি নয়, দুঃখ দূর করলে তবে মুক্তি।

কিন্তু দুঃখ তো অনেকের আছে। আমাদের বাড়িতে নিকুঞ্জ ভিখিরি এসে একতারা বাজিয়ে গান গায়। সে বলে তার তিন কুলে কেউ নেই। তার তো খুব দুঃখ।

তাতে হবে না, লোকটা মাথা নেড়ে বলল। তর্পণ চৌধুরী, বয়স সাড়ে দশ–এখানে তুমি ছাড়া আর কেউ আছে?

বোধহয় না।

তবে তোমাকেই চাই।

এবার টিপু একটা কথা জিজ্ঞেস না করে পারল না।

তুমি কীসের থেকে মুক্তির কথা বলছ? তুমি তো দিব্যি চলেফিরে বেড়াচ্ছ।

এটা আমার দেশ নয়। এখানে তো আমায় নির্বাসন দেওয়া হয়েছে।

কেন?

অত জানার কী দরকার তোমার?

বা রে, একজন লোকের সঙ্গে আলাপ হল, আর তার বিষয় জানতে ইচ্ছা করবে না? তুমি কোথায় থাকো, কী করো, কী নাম তোমার, আর কে কে চেনে তোমাকে সব জানতে ইচ্ছা করছে আমার।

অত জানলে জিঞ্জিরিয়া হবে।

লোকটা আসলে জিঞ্জিরিয়া বলেনি; বলেছিল একটা ভীষণ কঠিন কথা যেটা টিপু চেষ্টা করলেও উচ্চারণ করতে পারবে না। তবে খুব সহজ করে বললে সেটা জিঞ্জিরিয়াই হয়। না জানি কী ব্যারামের কথা বলছে, তাই টিপু আর ঘাঁটাল না। কার কথা মনে হচ্ছে লোকটাকে দেখে? রামখেল তিলক সিং? না কি ঘ্যাঁঘাসুরের সেই একহাত লম্বা লোকটা, যার সঙ্গে মানিকের দেখা হয়েছিল? নাকি স্নো হোয়াইটের সেই সাতটা বামুনের একটা বামুন? টিপু রূপকথার পোকা। তার দাদু প্রতিবারই পুজোয় কলকাতা থেকে আসার সময় তার জন্য তিন-চারখানা করে রূপকথার বই এনে দেন। টিপুর মনটা সে সব পড়ে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী ছত্রিশ পাহাড় পেরিয়ে কোথায় যেন উড়ে চলে যায়। সে নিজেই হয়ে যায় রাজপুত্তুর–তার মাথায় মুক্তো বসানো পাগড়ি, আর কোমরে হিরে বসানো তলোয়ার। কোনওদিন চলেছে গজমোতির হার আনতে, কোনওদিন ড্রাগনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে।

গুড বাই।

সে কী, লোকটা যে চলল।

কোথায় থাকো তুমি, বললে না?

লোকটা তার প্রশ্নে কান না দিয়ে শুধু বলল, তোমার দুঃখ হলে তখন আবার দেখা হবে।

কিন্তু তোমায় খবর দেব কী করে?

ততক্ষণে লোকটা এক লাফে একটা দেড় মানুষ উঁচু কুলগাছ টপকে হাইজাম্পে ওয়র্লড রেকর্ড করে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

এটা প্রায় দেড়মাস আগের ঘটনা। তারপর থেকে লোকটা আর আসেনি। কিন্তু এখন তো আসা দরকার, কারণ টিপুর সত্যিই দুঃখের কারণ হয়েছে। আর সেই কারণ হল তাদের ইস্কুলের নতুন অঙ্কের মাস্টার নরহরিবাবু।

নতুন মাস্টারমশাইকে টিপুর এমনিতেই ভাল লাগেনি। প্রথমদিন ক্লাসে ঢুকে কিছু বলার আগে প্রায় দুমিনিট খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে সারা ক্লাসের ছাত্রদের উপর যেভাবে চোখ বোলালেন তাতে মনে হয় যেন আগে সকলকে ভস্ম করে তারপর পড়াতে শুরু করবেন। তালগাছের হুসুর মুসুরের মতো এমন ঝাঁটা গোঁফ যে সত্যি-মানুষের হয় সেটা টিপু জানতই না। তার ওপর ওরকম মুখে-হাঁড়িধা গলার আওয়াজ। ক্লাসের কেউই তো কালা নয়, তা হলে অত হুমকিয়ে কথা বলার দরকার কী?

আসল গোলমালটা হল দুদিন পরে, বিষুদবারে। দিনটা ছিল মেঘলা, তার উপর পৌষ মাসের শীত। টিফিনের সময় টিপু ক্লাস থেকে না বেরিয়ে নিজের ডেস্কে বসে পড়ছিল ডালিমকুমারের গল্প। কে জানত ঠিক সেই সময়ই অঙ্কের স্যার ক্লাসের পাশ দিয়ে যাবেন, আর তাকে দেখতে পেয়েই ক্লাসে ঢুকে আসবেন?

ওটা কী বই, তর্পণ?

স্যারের স্মরণশক্তি যে সাংঘাতিক সেটা বলতেই হবে, কারণ দুদিনেই সব ছাত্রদের নাম মুখস্থ হয়ে গেছে।

টিপুর বুকটা দুরদুর করলেও, টিফিনে গল্পের বই পড়াটা দোষের নয় মনে করে সে বলল, ঠাকুরমার ঝুলি, স্যার।

কই দেখি।

টিপু বইটা দিয়ে দিল স্যারের হাতে। স্যার মিনিট খানেক ধরে সেটা উলটেপালটে দেখে বললেন, হাঁউ মাউ কাঁউ মানুষের গন্ধ পাঁউ, হিরের গাছে মোতির পাখি, শামুকের পেটে রাজপুত্তুর–এসব কী পড়া হচ্ছে শুনি? যত আজগুবি ধাপ্পাবাজি! এসব পড়লে অঙ্ক মাথায় ঢুকবে কেমন করে, অ্যাঁ?

এ গল্প, স্যার, টিপু কোনওরকমে গলা দিয়ে আওয়াজ বার করে বলল।

গল্প? গল্পর তো একটা মাথামুণ্ডু থাকবে, না কি যেমন-তেমন একটা লিখলেই হল?

টিপু অত সহজে হার মানতে চাইছিল না। বলল, রামায়ণেও তো আছে হনুমান জাম্বুমান, আর মহাভারতে বক রাক্ষস আর হিড়িম্বা রাক্ষসী আর আরও কত কী।

জ্যাঠামো কোরো না, দাঁত খিঁচিয়ে বললেন নরহরি স্যার। ওসব হল মুনিঋষিদের লেখা, দুহাজার বছর আগে। সে তো গণেশ ঠাকুরেরও–মানুষের গায়ে হাতির মাথা, আর মা দুর্গার দশটা হাত। ও জিনিস আর তোমার এ মনগড়া গাঁজাখুরি গল্প এক জিনিস নয়। তোমরা এখন পড়বে মনীষীদের জীবনী, ভাল ভাল ভ্রমণ কাহিনী, আবিষ্কারের কথা, মানুষ কী করে ছোট থেকে বড় হয়েছে সেইসব কথা। তোমাদের বয়সে বাস্তব কথার দাম হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। তোমরা হলে বিংশ শতাব্দীর ছেলে। আদ্যিকালে পল্লীগ্রামে যে জিনিস চলত সে জিনিস আজ শহরে চলবে কী করে? এসব পড়তে হলে পাততাড়ি নিয়ে পাঠশালায় গিয়ে বসতে হবে, আর দুলে দুলে কড়াকিয়া গণ্ডাকিয়া মুখস্থ করতে হবে। সে সব পারবে তুমি?

টিপু চুপ করে রইল। এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে এত কথা শুনতে হবে, সেটা ও ভাবতে পারেনি।

ক্লাসে আর কে কে এসব বই পড়ে? অঙ্ক স্যার জিজ্ঞেস করলেন।

সত্যি বলতে কি, আর কেউই প্রায় পড়ে না। শীতল একবার টিপুর কাছ থেকে হিন্দুস্থানী উপকঞ্চ ধার নিয়ে গিয়েছিল, পরদিনই ফেরত দিয়ে বলল, ধুস, এর চেয়ে অরণ্যদেব ঢের ভাল।

আর কেউ পড়ে না স্যার, বলল টিপু।

 হুঁ।…তোমার বাবার নাম কী?

তারানাথ চৌধুরী।

কোথায় থাকো তোমরা?

স্টেশন রোড। পাঁচ নম্বর।

হুঁ।

বইটা ঠক করে ডেস্কের উপর ফেলে দিয়ে অঙ্ক স্যার চলে গেলেন।

ইস্কুলের পর টিপু সোজা বাড়ি ফিরল না। স্কুলের পুব দিকে ঘোষদের আমবাগানটা ছাড়িয়ে বিষ্ণুরাম দাসের বাড়ির বাইরে বাঁধা সাদা ঘোড়াটার দিকে কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক ভাবে চেয়ে রইল জামরুল গাছটায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। বিষ্ণুরামবাবুর বিড়ির কারখানা আছে। ঘোড়ায় চড়ে কারখানায় যান। বয়স পঞ্চাশের উপর, কিন্তু এখনও মজবুত শরীর।

টিপু প্রায়ই এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘোড়াটাকে দেখে, কিন্তু আজ আর কিছু ভাল লাগছিল না। তার মন বলছে অঙ্ক স্যার তার গল্পের বই পড়া বন্ধ করার মতলব করছেন। গল্পের বই না পড়ে সে থাকবে কী করে? সারা বছরের একটা দিনও তার গল্পের বই পড়া বন্ধ থাকে না, আর সবচেয়ে ভাল লাগে ওইসব বইগুলো, যেগুলোকে অঙ্ক স্যার বললেন আজগুবি আর গাঁজাখুরি। কই, ও তো এসব বই পড়েও অঙ্কেতে কোনওদিন খারাপ করেনি! গত পরীক্ষায় পঞ্চাশে চুয়াল্লিশ পেয়েছিল। আর আগের অঙ্কের স্যার ভূদেববাবুর কাছে তো অঙ্কের জন্য কোনওদিন ধমক খেতে হয়নি!

শীতকালের দিন ছোট বলে এমনিতেই টিপু এবার বাড়ি ফিরবে ভাবছিল, এমন সময় একটা ব্যাপার দেখে ঝট করে গাছের আড়ালে গা-ঢাকা দিতে হল।

অঙ্ক স্যার নরহরিবাবু বই ছাতা বগলে এদিকেই আসছেন।

তা হলে কি ওঁর বাড়ি এইদিকেই? বিষ্ণুরামবাবুর বাড়ির পরে আরও গোটা পাঁচেক বাড়ি আছে অবিশ্যি এ রাস্তায়। তারপরেই হামলাটুনির মাঠ। ওই মাঠের পুব দিকে এককালে রেশমের কুঠি ছিল। হ্যামিলটন সাহেব ছিলেন তার ম্যানেজার। ভয়ংকর কড়া মেজাজের মানুষ ছিলেন তিনি। বত্রিশ বছর ম্যানেজারি করে কুঠির পাশেই তাঁর বাংলোতে মারা যান। তাঁর নামেই ওই মাঠের নাম হয়ে গেছে হামলাটুনির মাঠ।

আলো পড়ে আসা পৌষ মাসের বিকেলে জামরুল গাছের আড়াল থেকে ও দেখছে নরহরি স্যারকে। ভারী অবাক লাগছে তাঁর হাবভাব দেখে। স্যার এখন বিষ্ণুরামবাবুর ঘোড়ার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ঠোঁট ছুঁচোলো করে চুক চুক করে ঘোড়ার কাঁধে হাত বুলোচ্ছেন।

এমন সময় খুট করে বাড়ির সদর দরজা খোলার শব্দ হল, আর বিষ্ণুরামবাবু নিজেই চুরুট হাতে বেরিয়ে এলেন।

নমস্কার।

ঘোড়ার কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে অঙ্ক স্যার বিষ্ণুরামবাবুর দিকে ফিরলেন। বিষ্ণুরামবাবুও নমস্কার করে বললেন, এক হাত হবে নাকি?

সেইজন্যেই তো আসা, বললেন অঙ্ক স্যার। তার মানে অঙ্ক স্যার দাবা খেলেন। বিষ্ণুরামবাবু যে খেলেন সেটা টিপু জানে। অঙ্ক স্যার এবার বললেন, দিব্যি ঘোড়াটি আপনার পেলেন কোত্থেকে?

কলকাতা। শোভাবাজারের দ্বারিক মিত্তিরের ছিল ঘোড়াটা। ওঁর কাছ থেকেই কেনা। রেসের মাঠে ছুটেছে এককালে। নাম ছিল পেগাসাস।

পেগাসাস? নামটা যেন চেনা চেনা মনে হল টিপুর, কিন্তু কোথায় শুনেছে মনে করতে পারল না।

পেগাসাস বললেন অঙ্ক স্যার। কিম্ভুত নাম তো মশাই!

ঘোড়দৌড়ের ঘোড়ার ওইরকমই নাম হয়। হ্যাপি বার্থডে, শোভান আল্লা, ফরগেট-মি-নট…

আপনি চড়েন এ ঘোড়া?

চড়ি বইকী। তালেবর ঘোড়া। একটি দিনের জন্যও বিগডোয়নি৷

অঙ্ক স্যার চেয়ে আছেন ঘোড়াটার দিকে। বললেন, আমি এককালে খুব চড়িছি ঘোড়া।

বটে?

তখন আমরা শেরপুরে। বাবা ছিলেন ডাক্তার। ঘোড়ায় চেপে রুগি দেখতে যেতেন। আমি তখন ইস্কুলে পড়ি। সুযোগ পেলেই চড়তুম। ওঃ, সে কি আজকের কথা!

চড়ে দেখবেন এটা?

চড়ব?

চড়ুন না!

টিপু অবাক হয়ে দেখল অঙ্ক স্যার হাত থেকে বই ছাতা দাওয়ায় নামিয়ে রেখে ঘঘাড়ার দড়িটা খুলে এক ঝটকায় সেটার পিঠে চড়ে বসলেন। তারপর বাঁ পায়ের গোঁড়ালি দিয়ে ঘোড়ার পাশে দুবার চাপ দিতেই সেটা খট খট করে চলতে আরম্ভ করল।

দেখবেন, বেশিদূর যাবেন না, বললেন বিষ্ণুরামবাবু।

আপনি খুঁটি সাজান গিয়ে, বললেন অঙ্ক স্যার, আমি খানিকদূর গিয়েই ঘুরে আসছি।

টিপু আর থামল না। আজ একটা দিন গেল বটে!

কিন্তু ঘটনার শেষ এখানেই নয়।

তখন সন্ধ্যা সাতটা। টিপু পরের দিনের পড়া শেষ করে সবে ভাবছে এবার গল্পের বইটা খুলবে কিনা, এমন সময় বাবা ডাক দিলেন নীচে থেকে।

টিপু নীচে বৈঠকখানায় গিয়ে দেখে নরহরি স্যার বসে আছেন বাবার সঙ্গে। টিপুর রক্ত হিম হয়ে গেল। বাবা বললেন, তোমার দাদুর দেওয়া যে বইগুলো রয়েছে সেগুলো ইনি একবার দেখতে চাইছেন। যাও তো, নিয়ে এসো গিয়ে।

টিপু নিয়ে এল। সাতাশখানা বই। তিন খেপে আনতে হল।

অঙ্ক স্যার ঝাড়া দশ মিনিট ধরে বইগুলো দেখলেন। মাঝে মাবো মাথা নাড়েন আর হু করে একটা শব্দ করেন। তারপর বইগুলো রেখে দিয়ে বললেন–দেখুন মিস্টার চৌধুরী, আমি যেটা বলছি সেটা আমার অনেকদিনের চিন্তা-গবেষণার ফল। ফেয়ারি টেইল বলুন আর রূপকথাই বলুন আর উপকথাই বলুন, এর ফল হচ্ছে একই–ছেলেমেয়েদের মনে কুসংস্কারের বীজ বপন করা। শিশুমনকে যা বোঝাবেন তাই তারা বুঝবে। সেখানে আমাদের বড়দের দায়িত্বটা কতখানি সেটা একবার ভেবে দেখুন! আমরা কি তাদের বোঝাব, বোয়াল মাছের পেটে থাকে মানুষের প্রাণ?–যেখানে আসল কথাটা হচ্ছে। যে প্রাণ থাকে মানুষের হৃৎপিণ্ডে–তার বাইরে কোথাও থাকতে পারে না, থাকা সম্ভব নয়।

বাবা পুরোপুরি কথাটা মানছেন কিনা সেটা টিপু বুঝতে না পারলেও, এটা সে জানে যে, ইস্কুলের মাস্টারদের কথা যে মেনে চলতে হয়, এটা তিনি বিশ্বাস করেন। ছেলেবয়সটা মেনে চলারই বয়স, টিপু, একথা বাবা অনেকবার বলেছেন। বিশেষ করে গুরুজনদের কথা মানতেই হবে। নিজের ইচ্ছেমতো সবকিছু করার বয়সও আছে একটা, কিন্তু সেটা পড়াশুনো শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর। তখন তোমাকে কেউ বলবে না এটা করো, ওটা করো। বা বললেও, সেখানে তোমার নিজের মতটা দেবার অধিকার আছে। কিন্তু সেটা এখন নয়।

আপনার বাড়িতে অন্য ধরনের শিশুপাঠ্য বই নেই? জিজ্ঞেস করলেন নরহরি স্যার।

আছে বইকী,বললেন বাবা। আমার বুক শেলফেই আছে। আমার ইস্কুলে প্রাইজ পাওয়া বই। টিপু তুই দেখিসনি?

সব পড়া হয়ে গেছে বাবা, বলল টিপু।

সবগুলো?

সবগুলো। বিদ্যাসাগরের জীবনী, সুরেশ বিশ্বাসের জীবনী, ক্যাপ্টেন স্কটের দক্ষিণ মেরু অভিযান, মাঙ্গো পার্কের আফ্রিকা ভ্রমণ, ইস্পাতের কথা, আকাশযানের কথা… প্রাইজ আর কটাই বা পেয়েছ বাবা?

তা বেশ তো, বললেন বাবা। নতুন বই এনে দেওয়া যাবেখন।

আপনি এখানে তীর্থঙ্কর বুক স্টলে বললে ওরা কলকাতা থেকে আনিয়ে দেবে বই, বললেন অঙ্ক স্যার, সেইসবই তুমি পড়বে এবার থেকে, তর্পণ। এগুলো বন্ধ।

এগুলো বন্ধ। ওই দুটো কথায় যেন এক মুহূর্তে পৃথিবীটা টিপুর চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেল।–এগুলো বন্ধ!

আর বন্ধ যাতে হয় তার জন্য বাবাও অঙ্ক স্যারের থেকে নিয়ে বইগুলো তাঁর আলমারির তাকে ভরে ফেলে চাবিবন্ধ করে দিলেন।

মা অবিশ্যি ব্যাপারটা শুনে বেশ খানিকক্ষণ গজর গজর করেছিলেন। খাবার সময় একবার তো বলে ফেললেন, যে লোক এমন কথা বলতে পারে তাকে মাস্টার করে রাখা কেন বাপু?

বাবা পরপর তিনবার উঁহু বলে মা-কে থামিয়ে দিলেন।–তুমি বুঝছ না। উনি যা বলছেন টিপুর ভালর জন্যই বলছেন।

ছাই বলছেন। তারপর টিপুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তুই ভাবিসনে রে। আমি বলব তোকে গল্প। তোর দিদিমার কাছ থেকে অনেক গল্প শুনেছি ছেলেবেলায়। সব তো আর ভুলিনি।

টিপু কিছু বলল না। মুশকিল হচ্ছে কি, মার কাছে টিপু এককালে অনেক গল্পই শুনেছে। তার বাইরে মা আর কিছু জানেন বলে মনে হয় না। আর জানলেও, বই পড়ার মজা মুখে শোনা গল্পে নেই। বইয়ে ডুবে যাওয়া একটা আলাদা ব্যাপার। সেখানে শুধু গল্প আর তুমি–মাঝখানে কেউ নেই। সেটা মা-কে বোঝাবে কী করে?

আরও দুদিন গেল টিপুর বুঝতে যে, এবার সত্যি-সত্যিই সে দুঃখ পাচ্ছে। গোলাপীবাবু যে দুঃখের কথা বলেছিলেন, এটা সেই দুঃখ। এবার এক উনিই যদি কিছু করতে পারেন।

আজ রবিবার। বাবা ঘুমোছেন। মা বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢুকে সেলাই-এর কল চালাচ্ছেন। এখন। বেজেছে সাড়ে তিনটে। এখন একবার পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে যাওয়া যেতে পারে। লোকটা যে কেন বলে গেল না সে কোথায় থাকে! সে না এলে টিপু সটান তার বাড়িতে চলে যেতে পারত।

টিপু পা টিপে টিপে একতলায় নেমে পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল।

চারদিকে রোদ ঝলমল করছে, কিন্তু তাও বেশ শীত শীত ভাব। দূরে ধানখেতে সোনালি রঙ ধরে আছে পাহাড়ের লাইন অবধি। একটা ঘুঘু ডেকে চলেছে একটানা, আর চিড়িক চিড়িক শব্দটা নিশ্চয়ই ওই শিরীষ গাছের বাসিন্দা কোনও একটা কাঠবেড়ালি করছে।

হ্যালো।

আরে! কী আশ্চর্য! কখন যে লোকটা এসে দাঁড়িয়েছে গাছতলায়, সেটা টিপু দেখতেই পায়নি!

তোমার কানের পিছনে নীল রঙ, হাতের তেলো খসখসে, বুঝতেই পারছি তোমার দুঃখের কারণ ঘটেছে।

তা ঘটেছে বইকী!

লোকটা এগিয়ে আসছে টিপুর দিকে। আবার সেই পোশাক। আবার মাথার চুলগুলো ফ্যূৎ করে ঝুঁটির মতো উড়ছে বাতাসে।

কী ঘটেছে সেটা বলতে হবে তো, নইলে আমি কিংকর্তব্যমতিত্ব।

টিপুর হাসি পেলেও, লোকটাকে শুধরোবার চেষ্টা না করে অঙ্ক স্যারের পুরো ব্যাপারটা সংক্ষেপে বলে ফেলল। বলতে বলতে চোখে জল এসে গেলেও মনের জোরে নিজেকে সামলে নিল টিপু।

হুঁ, বলে লোকটা ষোলোবার ধীরে ধীরে মাথা উপর-নীচ করল। টিপু ভেবেছিল আর থামবেই না; আর সেইসঙ্গে এও মনে হয়েছিল যে, লোকটা হয়তো কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। যদি না পায় তা হলে যে কী দশা হবে সেটা ভেবে টিপুর আবার চোখে জল এসে গিয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত লোকটা মাথা নাড়া থামিয়ে আবার হু বলাতে টিপুর ধড়ে প্রাণ এল।

তুমি কিছু করতে পারবে কী? টিপু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল।

ভেবে দেখতে হবে। পাকস্থলীটা খাটাতে হবে।

পাকস্থলী? কেন, তোমরা মাথা খাটাও না বুঝি?

লোকটা কোনও উত্তর না দিয়ে বলল, তোমার এই নরহরি স্যারকে কাল দেখলাম না মাঠে ঘোড়া চড়তে?

কোন মাঠে? হামলাটুনির মাঠে?

যে মাঠে ভাঙা বাড়িটা আছে।

হ্যাঁ হ্যাঁ। তুমি কি সেইখানেই থাকো?

ওই ভাঙা বাড়িটার পিছনেই আমার ট্রিডিঙ্গিপিডিটা রয়েছে।

টিপু কথাটা ঠিক করে শোনেনি নিশ্চয়ই। তবে শুনলেও সেটা যে তার জিভ দিয়ে কিছুতেই বেরোত সেটা সে জানে।

লোকটা এখনও আছে, আর আবার মাথাটা উপর-নীচ করতে আরম্ভ করেছে।

এবার একত্রিশবার নাড়াবার পর মাথা থামিয়ে লোকটা বলল, আজ ফুল মুন। তুমি যদি ব্যাপারটা দেখতে চাও, তা হলে চাঁদ যখন মাঠের মাঝখানের খেজুর গাছটার ঠিক মাথায় আসবে তখন মাঠে এসে যেও। আড়ালে থেকো; কেউ যেন দেখে না ফেলে। তারপর দেখা যাক কী করা যায়!

টিপুর হঠাৎ একটা চিন্তা মাথায় ঢুকে তাকে ভীষণ ভয় পাইয়ে দিল।

তুমি অঙ্ক স্যারকে মেরে-টেরে ফেলবে না তো?

এই প্রথম লোকটাকে হো হো করে হাসতে দেখল টিপু, আর সেইসঙ্গে দেখল লোকটার মুখের ভিতর একটার উপর আরেকটা জিভ। আর দেখল যে, লোকটার দাঁত বলে কিছু নেই।

মেরে ফেলব?–লোকটা কোনওরকমে হাসি থামাল।–উঁহু। আমরা কাউকে মারি-টারি না। একজনকে চিমটি কাটার কথা ভেবেছিলাম বলেই তো আমার নির্বাসন প্রথম ছক কেটে বেরোলো পৃথিবীর নাম, সেখানে হবে নির্বাসন; তারপর ছক কেটে বেরোলো এই শহরের নাম; তারপর তোমার নাম। তোমার দুঃখ থেকে মুক্তি দিয়েই মুক্তি।

ঠিক আছে, তা হলে–

লোকটা সেদিনের মতোই টিপুর কথা শেষ হবার আগেই কুলগাছের উপর দিয়ে হাই জাম্প করে হাওয়া।

.

টিপুর শরীরের ভিতরে সেই যে মিহি কাঁপুনি শুরু হল সেটা রইল রাত অবধি। আশ্চর্য কপাল, আজ মা বাবা দুজনেই রাত্রে নেমন্তন্ন খেতে যাবেন সুশীলবাবুদের বাড়ি। সুশীলবাবুর নাতির মুখে ভাত। টিপুরও নেমন্তন্ন ছিল, কিন্তু সামনে পরীক্ষা, তাই মা নিজেই বললেন, তোর আর গিয়ে কাজ নেই। বাড়িতে বসে পড়াশুনা কর।

সাড়ে সাতটায় বাবা বেরিয়ে গেলেন। টিপু পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে পুব দিকটা হলদে হতে শুরু করেছে দেখে বেরিয়ে পড়ল।

ইস্কুলের পিছনের শর্টকাটটা দিয়ে বিষ্ণুরামবাবুদের বাড়ি পৌঁছতে লাগল মিনিট দশেক। ঘোড়াটা নেই। টিপুর ধারণা, ওটা বাড়ির পিছন দিকে আস্তাবলে থাকে। সামনের বৈঠকখানার জানলা দিয়ে আলো রাস্তায় এসে পড়েছে, ঘরের ভিতর চুরুটের ধোঁয়া।

কিস্তি।

অঙ্ক স্যারের গলা। দাবা খেলছেন বিষ্ণরামবাবুর সঙ্গে। তা হলে কি আজ ঘোড়া চড়বেন না? সেটা জানার কোনও উপায় নেই। লোকটা কি বলেছে হামলাটুনির মাঠে যেতে। টিপু যা থাকে কপালে করে সেইদিকেই রওনা দিল।

ওই যে পূর্ণিমার চাঁদ। এখনও সোনালি, রুপোলি হবে আরও পরে। নেড়া খেজুর গাছটার মাথায় পৌঁছতে এখনও মিনিট দশেক দেরি। ফুটফুটে জ্যোৎস্না যাকে বলে সেটা হতে আরও সময় লাগবে, তবে একটা ফিকে আলো চারদিক ছেয়ে আছে। তাতে গাছপালা ঝোঁপঝাড় সবই বোঝা যাচ্ছে। ওই যে দূরে ভাঙা কুঠিবাড়ি। ওর পিছনে কোথায় থাকে নোকটা?

টিপু একটা ঝোঁপের পিছনে গিয়ে অপেক্ষা করার জন্য তৈরি হল। তার প্যান্টের পকেটে খবরের কাগজে মোড়া একটুকরো পাটালি গুড়। টিপু তার খানিকটা মুখে পুরে চিবোতে লাগল। শেয়াল ডাকছে দূরের বন থেকে। আকাশ দিয়ে যে কালো জিনিসটা উড়ে গেল সেটা নিশ্চয়ই পেঁচা। গরম কোটের উপর একটা খয়েরি চাদর জড়িয়ে নিয়েছে টিপু। তাতে গা ঢাকা দেওয়ার সুবিধে হবে, শীতটাও বাগে আসবে।

আটটা বাজার যে শব্দটা এল দূর থেকে, সেটা নিশ্চয়ই বিষ্ণুরামবাবুদের ঘড়ির শব্দ।

আর তারপরেই টিপু শুনতে পেল–খটমট-খটমট-খটমট-খটমট…

ঘোড়া আসছে।

টিপু ঝোঁপের পাশ দিয়ে মাথাটা বার করে একদৃষ্টে চেয়ে আছে মোড়ের দিকে।

হ্যাঁ, ঘোড়া তো বটেই, আর তার পিঠে নরহরি স্যার।

কিন্তু ঠিক এই সময় ঘটে গেল একটা সাংঘাতিক দুর্ঘটনা। একটা মশা কিছুক্ষণ থেকেই টিপুর কানের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছিল, টিপু হাত চালিয়ে চালিয়ে সেটাকে যথাসম্ভব দূরে রাখতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু হঠাৎ সেটা সুড়ুৎ করে ঢুকল গিয়ে তার নাকের ভিতর।

দুআঙুল দিয়ে নাক টিপে যে হাঁচি চাপা যায় সেটা টিপু আগে পরীক্ষা করে দেখেছে। কিন্তু এখন নাক টিপলে মশাটা আর বেরোবে না মনে করে সে হাঁচিটা আসতে দিল, আর তার শব্দটা খোলা মাঠের শীতের রাতের থমথমে ভাবটাকে একেবারে খানখান করে দিল।

ঘোড়া থেমে গেছে।

ঘোড়ার পিঠ থেকে একটা জোরালো টর্চের আলো এসে পড়ল টিপুর উপর।

তর্পণ!

টিপুর হাত পা অবশ হয়ে গেছে। সে যেন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ছি ছি ছি! এইভাবে সমস্ত ব্যাপারটা ভেস্তে দেওয়াতে লোকটা না জানি কী মনে করছে!

ঘোড়াটা এগিয়ে আসছিল তারই দিকে, পিঠে অঙ্ক স্যার, কিন্তু এমন সময় স্যারকে প্রায় পিঠ থেকে ফেলে দিয়ে ঘোড়াটা সামনের পা দুটো তুলে একটা আকাশচেরা চিহিহি ডাক ছেড়ে এক লাফে রাস্তা থেকে মাঠে গিয়ে পড়ল।

আর তারপরেই টিপুর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল, দেখে যে ঘোড়া আর মাটিতে নেই।

ঘোড়ার দুদিকে দুটো ডানা। সেই ডানায় ঢেউ তুলে ঘোড়া আকাশে উড়তে লেগেছে, অঙ্ক স্যার উপুড় হয়ে ঘোড়ার পিঠ জাপটে ধরে আছেন, তাঁর জ্বলন্ত টর্চ হাত থেকে পড়ে গেছে রাস্তায়। চাঁদ এখন খেজুরগাছের মাথায়, জ্যোৎস্না এখন ফুটফুটে, সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে অঙ্ক স্যারকে পিঠে নিয়ে বিষ্ণুরাম দাসের ঘোড়া আকাশভরা তারার দিকে উড়তে উড়তে ক্রমশই ছোট থেকে ছোট হয়ে আসছে।

পেগাসাস!

ধাঁ করে টিপুর মনে পড়ে গেল।

গ্রিসের উপকথা। রাক্ষসী মেডুসা–তার মাথায় চুলের বদলে হাজার বিষাক্ত সাপ, তাকে দেখলে মানুষ পাথর হয়ে যায়–তরোয়াল দিয়ে তার মাথা কেটে ফেলল বীর পারসিয়ুস, আর মেডুসার রক্ত থেকে জন্ম নিল পক্ষিরাজ পেগাসাস।

তুমি বাড়ি যাও, তর্পণ।

পাশে দাঁড়িয়ে সেই অদ্ভুত লোটা, চাঁদের আলো তার মাথার সোনালি ঝুঁটিতে।–এভরিথিং ইজ অল রাইট।

.

তিনদিন হাসপাতালে ছিলেন অঙ্ক স্যার। শরীরে কোনও জখম নেই, খালি মাঝে মাঝে শিউরে ওঠেন, জিজ্ঞেস করলে কিছু বলেন না।

চারদিনের দিন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে অঙ্ক স্যার টিপুদের বাড়িতে এলেন। বাবার সঙ্গে কী কথা হল সেটা টিপু জানে না। অঙ্ক স্যার চলে যাবার পরেই বাবা টিপুকে ডাকলেন।

ইয়ে, তোর বইগুলো নিয়ে যা আমার আলমারি থেকে। উনি বললেন ওসব গল্পে ওঁর আপত্তি নেই।

সেই লোকটাকে আর দেখেনি টিপু। তার খোঁজে একদিন গিয়েছিল কুঠিবাড়ির পিছনটায়। পথে যেতে দেখেছে বিষ্ণুরামবাবুর ঘোড়া যেমন ছিল তেমনই আছে। কিন্তু কুঠিবাড়ির পিছনে কিছু নেই।

শুধু একটা গিরগিটি দেখতে পেয়েছিল টিপু, যেটার রঙ একদম গোলাপী।

সন্দেশ, শারদীয়া ১৩৮৯

« পূর্ববর্তী:
« অক্ষয়বাবুর শিক্ষা
পরবর্তী: »
অতিথি »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি – জোক্স – লিরিক – রেসিপি – কামসূত্র – হেলথ – PDF

Return to top