১০১. যখন বাড়ি ফিরিলাম

“যখন বাড়ি ফিরিলাম তখন বেশ ঘোরের মধ্যে আছি। চারিদিকে কিছুই ভাল করিয়া লক্ষ করিতেছি। কেমন যেন এক অলীক পৃথিবীর স্বপ্নবৎ দৃশ্যাবলী আমাকে ঘিরিয়া ধরিয়াছে। মনে মনে কেবল একটি প্রশ্নই গুঞ্জন তুলিতেছে, নিরুদ্দেশ যাত্রায় এক ক্ষুদ্র নৌকায় আমার প্রাণপ্রিয় কিশোর পুত্রটি কোথায় ভাসিয়া গেল? যাহা আমার প্রিয়, যে আমার প্রিয় তাহাকেই কেন দেশের প্রয়োজন হইল? কেন তাহাকেই গ্রাস করিল এই মহাপৃথিবী?

“জানি এই সকল প্রশ্নের সদুত্তর নাই। আমি চিরকাল মনে মনে আন্দোলন করিব, ভাবিব, কাঁদব। কিন্তু আমার করার কিছুই থাকিবে না। আমরা তো ঘটনাবলীর নিয়ামক নই। আমরা কর্তা নহি। ঘটনা আমাদের লইয়া ঘটে মাত্র।

“নানাভাবে নিজেকে স্তোক দিতে দিতে, আচ্ছন্ন হৃদয়ে এবং ক্লান্ত শরীরে ফিরিতেছিলাম। বাড়ির অনতিদূরে রাস্তার পাশে কিছু ঝোপঝাড়। হঠাৎ তাহার আড়াল হইতে এক ব্যক্তি বাহির হইয়া আসিল। বেশ শক্ত পোক্ত চেহারা, পরনে পুলিশের পোশাক। লোকটা আসিয়া আমার পথ আটকাইয়া কহিল, আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে।

“বিস্মিত হইয়া কহিলাম, কী কথা?

“এখানে নয়, আমার সঙ্গে আসুন।

“আমার যাইবার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু পুলিশকে ইদানীং সমীহ করিতে শিখিয়াছি। বুঝিয়াছি এই একটি জায়গায় বেশি ট্যান্ডাই ম্যান্ডাই করিলে মান লইয়া সংসারে বাস করা কঠিন হইবে। ইংরাজ কর্তারা ইহাদের কাঁধে ভর দিয়াই রাজ্য শাসন করিতেছে। কাজেই একটু দ্বিধার ভাব করিয়া কহিলাম, কেন বলুন তো?

“উনি সামান্য উম্মার সহিত কহিলেন, বলার জন্যই আড়ালে নিয়ে যেতে চাইছি।

“আমার বাড়িতে অনেক ফাঁকা ঘর আছে। সেখানে বসে কথা বললে হয় না?

“উনি এবার সামান্য হাসিয়া বলিলেন, তাতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আপনার মেয়ের বিয়ে, বাড়ি ভর্তি আত্মীয়স্বজন, সেই পরিস্থিতিতে বাড়িতে পুলিশ গেলে নানা কথা উঠতে পারে। ভেবে দেখুন।

“ভাবিবার কিছু নাই। কথাটা যুক্তিযুক্ত। লোকটিকে ভাল করিয়া দেখিলাম। আমি মানুষের মুখ দেখিয়া কিছুই অনুমান করিতে পারি না। আমার সেই ক্ষমতা নাই। কিন্তু এই লোকটির মুখে পুলিশসুলভ রূঢ়তা কিছু নাই। একধরনের ভদ্র বিচক্ষণতা ও গাম্ভীর্য আছে। বুকটা একটু কাঁপিতেছিল। বিপ্লবী পুত্রের পিতা হওয়া বড় কম বিপজ্জনক তো নয়!

“বলিলাম, চলুন।

“লোকটি আমাকে ঝোপের আড়ালে একটা ফাঁকা জায়গায় লইয়া গেল। জায়গাটি নির্জন। মুখোমুখি দাঁড়াইয়া কহিল, কোথায় গিয়েছিলেন?

“বিপদের গন্ধ পাইলাম। সেঁক গিলিয়া কহিলাম, আমার মেয়ের বিয়ে। কত কাজ। একটু কাজে গিয়েছিলাম।

“মিথ্যাবাদী হিসাবে আমি নিতান্তই অপটু। তাই গলায় আত্মবিশ্বাস বা দৃঢ়তা ফুটিল না। অনেকটা দয়াভিক্ষার সুর বাহির হইল।

“লোকটা আমার দিকে কিছুক্ষণ স্থির চোখে চাহিয়া থাকিয়া কহিল, আপনি কোথায় গিয়েছিলেন তা আমি জানি।

“জানেন? বলিয়া বেকুবের মতো চাহিয়া রহিলাম।

“উনি কহিলেন, কৃষ্ণকান্তকে অ্যারেস্ট করা আমার পক্ষে শক্ত ছিল না। কিন্তু করিনি কেন জানেন?

“আমি মাথা নাড়িলাম, না।

“তিনি কহিলেন, একটি মাত্র কারণে। আপনার বাড়িতে একটা শুভ কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে চাইনি। কিন্তু আমি কৃষ্ণকান্তর গতিবিধি জানতে চাই। আপনি কি বলবেন?

“আমি ফাঁপরে পড়িলাম। কৃষ্ণ ধরা দিবে বলিয়াই রওনা হইয়াছে। কিন্তু এখানে নয়। আমি তাহার সেই পরিকল্পনা বানচাল করিব কেন? যদি এ লোকটা কৃষ্ণ ঢাকা পৌঁছাইবার আগেই তাহাকে গ্রেফতার করে? তাই কহিলাম, আমি জানি না। সে আমাকে কিছু বলেনি।

“লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া কহিল, সেটাই স্বাভাবিক। তবে সে বলে থাকলেও আপনি আমাকে কিছুতেই বলতেন না। তাই না?

“আমি নীরব রহিলাম।

“উনি ধীর স্বরে কহিলেন, ও যেখানে যেতে চায় যাক। আমার তাতে ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। কিন্তু বিপদ কী জানেন? সর্বত্র কৃষ্ণের জন্য ফঁদ পাতা আছে। হয় ধরা পড়বে, নয়তো মারা পড়বে। আমার এলাকা থেকে বেরিয়ে গেলেই যে পরিত্রাণ পাবে তা নয়।

“আমি কী বলিব! চুপ করিয়া রহিলাম।

“উনি গাঢ় স্বরে কহিলেন, ও কোথায় যাচ্ছে হদিশ দিলে ওর উপকারই হত।

“কীভাবে? আমি ওকে নিরাপদে সেখানে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতাম।

“আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিলাম। পুলিশকে বিশ্বাস নেই। ইহারা মিষ্ট কথায় নানা ছলে মানুষকে। ভুলাইতে জানে। রামকান্ত রায়কেও দেখিয়াছি কখনও মিছরি কখনও ছুরি। তাই মাথা নাড়িয়া কহিলাম, আমি জানি না।

“লোকটা আর চাপাচাপি করিল না। শুধু কহিল, আপনার এবং আপনার বাড়ির সকলের ওপরেই পুলিশের নজর আছে। কাজেই একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন। আর কৃষ্ণর সঙ্গে যদি যোগাযোগ হয় তবে তাকে বলবেন, কিছুতেই যেন দিদির বিয়ের সভায় উপস্থিত না থাকে।

“আমি মাথা নাড়িয়া সম্মতি জানাইলাম। গলার স্বর ফুটিতেছে না।

“লোকটি চলিয়া গেলে আমি ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরিলাম। কুঞ্জবনের যে রন্ধ্রটি দিয়া নির্গত হইয়াছিলাম সেইটি দিয়াই প্রবেশ করিলাম। ঘরে আসিতেই উদ্বিগ্ন মনু জিজ্ঞাসা করিল, দেখা হল?

তুমি সবই জানো, তাই না?

না গো। তবে আন্দাজ করেছিলাম। কী বলল?

অনেক কথা। মনু, ফেরার সময় পুলিশের খপ্পরেও পড়েছি।

তারা কী বলল?

লোকটা ভাল না খারাপ বুঝলাম না। কৃষ্ণর খবর চাইছিল।

দিলে নাকি?

না। পাগল তো নই।

লোকটা কে?

চিনি না।

বেশ লম্বা ছিপছিপে চেহারা? নীচের ঠোঁটে কাটা দাগ?

“লোকটাকে ভাল করিয়া লক্ষই করি নাই। এত ঘাবড়াইয়া গিয়াছিলাম যে, লক্ষ করিবার মতো মানসিক স্থৈর্য ছিল না। কিন্তু মনুর বিবরণ শুনিয়া মনে হইল, লোটা ওইরূপই বটে। তাই কহিলাম, হ্যাঁ, চেনো নাকি?

ও মৃত্যুঞ্জয়। ওকে বললেও ভয় ছিল না।

কেন?

স্বদেশিদের প্রতি ওর একটু দয়ামায়া আছে।

তা আমি কী করে জানব?

বলে ভালই করেছ। এবার কৃষ্ণের কথা একটু শুনি।

“আনুপূর্বিক সবই তাহাকে বলিলাম। সে মন দিয়া ছলোছলে চোখ করিয়া শুনিল। তারপর দুটি হাত জোড় করিয়া কপালে ঠেকাইয়া কহিল, ধরা দিচ্ছে। ঠাকুর, দেখো।

ঠাকুর দেখবেন বলেই আমার বিশ্বাস। যদি না দেখেন তো ভবিতব্য, মনু।

তোমাকে কেমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। শরীর ভাল তো!

ভালই। তবে বুকটা কাঁপছে, একটু ব্যথাও টের পাচ্ছি।

শোও। চুপ করে একটু শুয়ে থাকো।

না। অনেক কাজ।

কাজ তো কী? একটা শক্ত অসুখ বাঁধালে কাজটা করবে কে? বুকের ব্যথা খুব ভাল কথা নয়। ডাক্তারকে খবর পাঠাই।

লাগবে না, মনু। ঠিক আছে, শুচ্ছি।

“শুইলাম। আমার হৃদযন্ত্র যে ঠিকমতো কাজ করিতেছে না তাহা টের পাইতেছিলাম। কিন্তু শরীর লইয়া আজ আর আমার মাথাব্যথা নাই। আমি এখনও স্বপ্নবৎ একটি ঘোরের মধ্যে বিরাজ করিতেছি। কৃষ্ণর মুখখানা চোখের সম্মুখে ভাসিতেছে। চোখে জল আসিল। বুক ফুলিয়া উঠিতে লাগিল। এত স্নেহ আমার কোথায় ছিল জানি না। আমার অন্য সন্তানদের কাহাকেও লইয়া আমার পিতৃত্ব এমন উথলিয়া উঠে নাই।

“মনু মাথার কাছে বসিয়া কহিল, বুকে একটু হাত বুলিয়ে দেব?

দাও।

“মনু নরম হাতে আমার বুক স্পর্শ করিয়া কহিল, তোমাকে নিয়ে আমার অনেক সাধ।

তাই নাকি? সাধ কি বুড়োকে নিয়ে হয়?

তুমি বুড়ো হলে আমিও তো বুড়ি। বয়সটা তো কথা নয়। যতদিন বাঁচি ততদিনই তো জীবন। মরার আগে অবধি তো ছাড়াছাড়ি নেই।

“একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া কহিলাম, তা বটে। কিন্তু আমার কেবলই কেন মনে হয় বলো তো যে, আর বেঁচে থাকার কোনও মানেই হয় না?

মানে হবে না কেন?

কেবল মনে হয় যথেষ্ট বেশিদিন বেঁচে আছি। এবার বিদায় নেওয়াই ভাল। কে জানে কোথা থেকে আবার কোনও দুঃখ বা আঘাত আসে!

এই ভয় তো তোমার চিরকালের। কিন্তু ভয় পেলে চলবে কেন? ভয়ের কিছু নেই। তুমি কৃষ্ণর কথা বড্ড বেশি ভাবো।

ভাবি। না ভেবে পারি না।

এবার আমাকেও একটু ভাবতে দাও। তোমার ভাবনার ভার নেব বলেই না বউ হয়েছি।

ভাবনা কি ভাগ করা যায়, মনু?

ধরে নাও, মনু যখন ভাবছে তখন আমি একটু কম করে ভাবি না কেন। ওরকম মনে করলেই দেখবে দুশ্চিন্তা কমে যাচ্ছে।

চেষ্টা করব।

একবারটি ডাক্তার ডাকি?

আবার ডাক্তার কেন? তুমিই তো আমার ডাক্তার।

তা বটে। কিন্তু সামনে একটা শুভ কাজ, অনেক খাটুনি। একটু দেখিয়ে রাখা ভাল।

“চুপ করিয়া রহিলাম। মনু ডাক্তার ডাকিল। ডাক্তার আসিয়া বুক পরীক্ষা করিয়াই কহিল, করেছেন কী!

কী হয়েছে, ডাক্তার?

প্রেশার ভীষণ বেড়েছে। একটু মোক্ষণ দরকার।

মোণ! বলো কী?

“ডাক্তার আমাকে বিশেষ আমল না দিয়া তাহার আসুরিক চিকিৎসার আয়োজন করিতে লাগিল। আমি ভয়ে কাঁটা হইয়া রহিলাম। ছেলে মেয়ে বউ নাতি-নাতনিরা আসিয়া ভিড় করিল। ডাক্তার ছুরি শানাইতে লাগিল।

“শরীরটা যে আমার ভাল নাই, অপরিসীম ক্লান্তি ও দুর্বলতা যে আমাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছে তাহা টের পাইতেছিলাম। সারা শরীরে ঘাম, উত্তাপ। খাস গরম। মাথা ঘুরিতেছে। বারবার চোখে অন্ধকার দেখিতেছি।

“মনু আমার ডান হাত শক্ত করিয়া ধরিল। ডাক্তার স্পিরিট দিয়া বাহুর ঊধ্বদিকে একটা জায়গা ভাল করিয়া মুছিল। ছুরির আঘাত আমি টেরই পাইলাম না। শুধু শুনিতে পাইলাম একটি পাত্রে কলকল করিয়া রক্ত ঝরিয়া পড়িতেছে। কত রক্ত ঝরিল তাহা বলিতে পারব না। হঠাৎ প্রগাঢ় এক নিদ্রাবেশ আসিল। আমি ঢলিয়া পড়িলাম।

“ঘুম ভাঙিল সকালে। শরীর অতিশয় দুর্বল। পাশ ফিরিবার সাধ্য নাই। শিয়রে ম্লানমুখী মনু উপবিষ্টা।

আমি কেমন আছি, মন?

ভাল আছ। শুয়ে থাকো, উঠো না।

খুব ফাঁড়া গেল নাকি?

গেল। ডাক্তার না ডাকলে কী যে হত!

কী আর হত?

খুব দুষ্টু হয়েছ। ডঙ্কা বাজিয়ে চলে যেতে সবাই পারে। সংসার দেখত কে?

আমার সংসার আর কোথায়, মনু? তুমি ছাড়া আর কে আছে?

আমি তো আছি। আমার প্রতি তোমার দায়িত্ব নেই?

“হাসিলাম। কে কাহার দায়িত্ব লইয়াছে তাহা আমি ভাবিয়া পাই না। এতকাল তো মনুর উপর নির্ভর করিয়াই কাটিল, বাকি জীবনটাও সেইভাবেই যাইবে বলিয়া অনুমান করি। আমি আর তাহার কী ভার লইব। হাতটা বাড়াইয়া তাহার হাতখানা মুঠা করিয়া ধরিলাম। কী যে এক ভরসা ও শান্তি অনুভব করিলাম তাহা বলিবার নয়, স্পর্শমাত্রই যেন মনটা নির্ভরতা, বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের অনুষঙ্গ পাইয়া নাচিয়া উঠিল, আর কেহ না থাক, মনু আছে। মনু কাছে থাকিলে কিছুদিন বাঁচিয়া থাকা যায়।

“মনু আর-একটু ঘন হইয়া বসিয়া কহিল, সারা রাত ওই মুখখানা দেখে দেখে কেটে গেল। ভালবাসা কেমন হয় তা জানো?

সারা রাত জেগে ছিলে?

জাগব না? এই তো আমার বাসর জাগা।

জেগে থাকার দরকার ছিল না। আমি তো ঘুমোচ্ছিলাম।

কাল ডাক্তার কত রক্ত বের করে ফেলল শরীর থেকে। ভয়ে মরি। বুকের ব্যথাটা কেমন?

টের পাচ্ছি না।

শুয়ে থাকে। একদম উঠবে না। আমি বিছানাতেই তোমার সব করে দেব।

“আমি মাথা নাড়িয়া কহিলাম, শুয়ে থাকলে শয্যাকণ্টকী হয়ে যাবে, মনু। আমার মেয়ের বিয়ে, ভুলে যেয়ো না।

যাইনি। কিন্তু আমি আছি, ছেলেরা আছে, তোমার অত ভাবনার কী?

“ভাবনা লইয়াই জগৎ, ভাবনার হাত হইতে নিষ্কৃতি কোথায়? বলিলাম, আমাকে না হলেও চলে জানি। কিন্তু বড় অস্থির লাগে।

আজকের দিনটা বিশ্রাম করো।

“করিলাম। প্রাতঃকৃত্যাদির পর নির্জন ঘরে আবার ঘুমাইয়া পড়িলাম। আমার এই দীর্ঘ বিশ্রামটির যেন প্রয়োজন ছিল। বিকাল গেল। ঘুম হইতে জাগিয়া আবার ঘুমাইলাম। অজান্তে দিন কাটিল রাত কাটিল।

“যখন বিছানা ছাড়িয়া উঠিলাম তখন সানাই পোঁ ধরিয়াছে। মনু মৃদু হাসিয়া কহিল, এই তো ঝরঝরে লাগছে!

“ম্লান হাসিলাম।

 

“বিপদে পড়িলেই মানুষ চেনা যায়, এই সাবেকি কথাটি যে কত খাঁটি তাহার প্রমাণ আর-একবার পাইলাম। বিশাখা ও শচীনের বিবাহ উপলক্ষে লোক জড়ো হইয়াছিল মন্দ না। আত্মীয়স্বজন কুটুম বয়স্য পরিচিত মিলাইয়া হাজার দেড়েক। তাহার উপর প্রজারা তো আছেই। আত্মীয় কুটুমদের কথাই বলি, যে-বিবাহ উপলক্ষে তাহারা আমন্ত্রিত সেই বিবাহ লইয়া কাহারও মাথাব্যথা নাই। মাথাব্যথা যত আমাকে ও মনুকে লইয়া। সকলেই কেবল আমাদের কথা ফুস ফুস গুজ গুজ করে, টিপ্পনী কাটে, তামাশা করে, এমনভাবে তাকাইয়া থাকে যেন আমরা দুটি চিড়িয়াখানার কিস্তৃত জন্তু। জীবনে আমি কদাচ এরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হই নাই। প্রবল অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিলাম। সম্ভবত রক্তচাপ বাড়িল।

“আমার তো সমস্যা একটি নহে। শ্লেষ বিদ্রুপ সহ্য করিতে হইতেছে, পুত্রের জন্য দুশ্চিন্তা ভোগ করিতে হইতেছে, শরীরও বেচাল। মনু শুধু মাঝে মাঝে কানে কানে বলিয়া যায়, একটু সহ্য করো। আর কটা দিন। আমরা তো চলেই যাব।

“বিবাহের দিন সকাল হইতেই ধুম লাগিয়াছে। আমি উপরের বারান্দায় একটি ইজিচেয়ারে বসিয়া সেই কর্মব্যস্ততা কিছু লক্ষ করিতেছি। মনু আছে। সে বহু যজ্ঞ সামলাইয়াছে, এটিও পারিবে। তাই দুশ্চিন্তা নাই। কিন্তু অস্বস্তি আছে। তাহাকে হয়তো অনেক কটুকাটব্য বিদ্রুপ ও অপমান সহ্য করিতে হইতেছে। গহনার অধিকার সে ছাড়ে নাই। বিশাখাই সুনয়নীর অবশিষ্ট গহনা পাইয়াছে। ইহা এক স্থায়ি অশান্তির কারণ হইয়া রহিল। কৃষ্ণকে সর্বস্ব উইল করিয়া দিতেছি, ইহা জানাজানি হইলে অশান্তি চরমে উঠিবে। কাশী গিয়াও পরিত্রাণ পাইব না।

“বসিয়া বসিয়া এই সকল ভাবিয়া মনটা বিকল হইতেছিল। এক বয়স্কা আত্মীয়া উপরে আসিয়া কহিলেন, ও হেম, কেউ তো কাজ করছেনা। যে যার ঘরে বসে আছে। বলি বিয়েটা ওতরাবে কী করে?

কী হয়েছে?

জানি না বাপু, কী সব রাগবাগ হয়েছে সকলের। তোমার মেয়েরা বউমারা কেউ ঘর থেকে বেরোচ্ছে না। কাজকর্ম দেখিয়ে দেবে কে?

কেন? মনু নেই?

সে তো কালীবাড়ি পুজো দিতে গেছে। একা মানুষের সাধ্যও তো নয়। কত লোক এসে কত কিছুর খোঁজ করছে।

মনু আসুক, আমি কী বলব? কনককে খুঁজে দেখো। আজ সেই কন্যাকর্তা।

কনক তো বিদ্ধি করতে বসেছে। এ বেলা আর উঠতে পারবে না।

“একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিলাম। স্পষ্টই অসহযোগ। কিন্তু আমার তো কিছু করিবার নাই। চোখ দুইটি মুদিয়া রহিলাম। কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়াইয়া পড়িল।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *