॥ ১০০ ॥
ধ্রুব খুবই মনোযোগ দিয়ে রেমিকে লক্ষ করছিল। বিশেষ করে ওর চোখ, দৃষ্টিতে কিছু অনিশ্চয়তা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব আছে, কিন্তু পাগলামি নেই। তবে কিছুই বলা যায় না। মানসিক ভারসাম্য এমন একটা জায়গায় হয়ত পৌঁছে গেছে যেখান থেকে এক পা এগোলেই পাগলামির অথৈ খাদ।
এর জন্য কি আমিই দায়ী? মনে মনে আজ এই প্রশ্ন উদ্যত হল তার নিজের দিকে! ধ্রুব রেমিকে নিজের খুব কাছে টেনে আনল। একটা হাত দিয়ে তার কোমর জড়িয়ে নিজের শরীরের সঙ্গে লেপ্টে রেখে বলল, তোমার কিছুই হয়নি। কেন ভাবছ?
রেমি দীনভাবে তার মুখখানা তুলে ধরল ধ্রুবর মুখের দিকে। এত কাছাকাছি দুজনের মুখ যে পরস্পরের শাস পরস্পরের মুখে পড়ছে। রেমি অনেকক্ষণ ধ্রুবর চোখে তার দুটি চোখ পেতে রাখল। তারপর বলল, তুমি বলছ? তুমি যদি আরো জোর দিয়ে বল যে সত্যিই আমার কিছু হয়নি তাহলে বোধহয় আমার কিছু হবে না।
ধ্রুব কিছু বলল না, শুধু আরো ঘন করে, শক্ত করে ধরে রইল রেমিকে।
রেমি ভ্রূ কুঁচকে ধ্রুবর মুখের দিকে চেয়ে সন্দিহান গলায় বলে, হঠাৎ এত আদর করছ কেন বল তো! পাগল হয়ে যাচ্ছি বলে ভয় পাচ্ছ?
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলে, না। তুমি পাগল হবে না রেমি। পাগলামির লক্ষণ তোমার মধ্যে নেই।
তুমি তো আর ডাক্তার নও।
না হলেই বা! পাগলামির লক্ষণ চেনা যায়। বিশেষ করে নিজের বউয়ের।
আমি তোমার বউ তো কেবল নামে।
ধ্রুব মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। বলল, সেটাই ভাবছিলাম। যদি তুমি পাগল হও তাহলে হয়ত আমার জন্যই হবে। আমি তোমার মাথায় এতদিন ধরে নানা উল্টোপাল্টা আইডিয়ার বীজ বুনেছি। কাজটা হয়তো ঠিক হয়নি।
রেমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, যা বিশ্বাস কর তাই বলেছ। সেটা তো অন্যায় নয়। কিন্তু আমি একটা জিনিস একদম সইতে পারি না, সেটা হল আমাকে তোমার ত্যাগ করার কথা। তোমার ওই ত্যাগ করার কথা আমাকে দিনরাত কুরে কুরে খেয়েছে। ভিতরে ভিতরে কেবল ভয়, কেবল অনিশ্চয়তা, পায়ের তলা থেকে যেন কেবলই মাটি সরে যায়। আমি কোথায় দাঁড়াব বল তো!
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলল, ঠিক ত্যাগ নয় রেমি, যাক গে, সেসব কথা বড় পুরনো হয়ে গেছে। তোমাকে যে কথাটা আজ বলতে চাই, তা একটু অদ্ভুত শোনাবে।
কী গো? ভয়ের কথা কোন? কি জানি। কথাটা শুনে তুমি ভয় পেতেও পারো।
কী কথা?
আমার আজকাল মনে হচ্ছে, আমি খুব বেশিদিন বাঁচব না।
রেমি একটু শিউরে উঠে ধ্রুবর হাত খামচে ধরল। তারপর স্তব্ধ হয়ে রইল। অনেকক্ষণ বাদে বলল, তোমার কী হয়েছে?
তেমন কিছু নয়। শরীর ভালই আছে। কিন্তু কি জান, আমি এই জীবনের কোন পারপাস খুঁজে পাচ্ছি না, বেঁচে থাকাটা বড্ড অর্থহীন, বড্ড জোলো।
রেমি আবার কেঁপে উঠল। কাঁপুনিটা উঠে এল বুক থেকে। একটা কান্নার তরঙ্গ বয়ে গেল সমস্ত শরীরে। ভেজা গলায় সে বলল, ওসব কী বলছ!
শোনো, তোমাকে বুঝিয়ে বলি। তুমি ছাড়া আমার বিশেষ কেউ বন্ধু নেই যাকে সব কথা উজাড় করে বলা যায়।
বন্ধু! আমাকে তুমি সত্যিই বন্ধু মনে কর?
করি রেমি। ইউ আর এ ফেইথফুল ফ্রেণ্ড। গুড ফেণ্ড।
রেমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এতদিন এ কথাটা বলনি কেন?
বলিনি, দরকার হয়নি বলে। আজ আমি মনে মনে একজন বিশ্বস্ত বন্ধু খুঁজছি। খুঁজতে খুঁজতে তোমার কথা মনে হল।
তাহলে বল তোমার কী হয়েছে?
কিছু হয়নি আর সেটাই সমস্যা। আমার কিছু হচ্ছে না, আমি কিছু হয়ে উঠছি না, আমার অস্তিত্বের কোন তরঙ্গ নেই। ভিতরে একটা বিরাট ভ্যাকুয়াম। তোমার পাগলামির চেয়েও যেটা বেশি যন্ত্রণাদায়ক।
একটু বুঝিয়ে বল। আমার তো বেশি বুদ্ধি নেই।
বুদ্ধির দরকার নেই রেমি। শুধু একটু অনুভব করার চেষ্টা কর তাহলেই হবে। বুদ্ধি দিয়ে কাউকে বোঝা যায় না, ভালবাসলে বোঝা যায়।
তাহলে তুমি স্বীকার করছ যে আমি তোমাকে ভালবাসি?
স্বীকার করি। তোমার ভালবাসা সাফোকেটিং, আমার কাছে অস্বস্তিকর। আমি যে ধরনের ফ্রিডমে বিশ্বাস করি তাতে পজেজিভ ভালবাসার স্থান নেই। দখলদারি ভাব স্বাধীনতার অন্তরায়। মানুষে মানুষে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও স্বাধীনতা এবং অধীনতার জটিল সব সমস্যা আছে। তুমি হয়ত বুঝবে না।
হ্যাঁ গো, আমার মত তুমিও কি একটু পাগল হয়েছ?
তুমি আমি কেউ পাগল নই। শুধু পরিস্থিতির শিকার। তোমার আর আমার মধ্যে একটা অদৃশ্য লড়াই ছিল। সে লড়াইটা আইডিয়া ভারসাস প্রিমিটিভনেস। কিন্তু ওসব তুমি বুঝবে না। তোমাকে শুধু আমার প্রবলেমটার কথা বলি।
বল না গো।
আমার মনে হচ্ছে, অনেকদিন বেঁচে আছি। আরো বহুদিন বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। আমি তা পেরে উঠব না। কারণ আমার আর কিছু করার নেই।
সে কী গো?
আমি জমিদার পরিবারে জন্মেছি, বাবা নেতা এবং মন্ত্রী। জীবনে আমাকে কোন অর্থনৈতিক সংগ্রাম করতে হয়নি, হবেও না। যদি মা বাবা বউ বাচ্চার জন্য রুজি রোজগারের লড়াই করতে হত তবে বোধ হয় জীবনটা এত আলুনি লাগত না। আমি কাউকেই তেমন ভালবাসি না, কারো জন্য কোন রেসপনসিবিলিটি আছে বলেও মনে হয় না, আমার কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। কিসের জন্য বেঁচে থাকা রেমি?
রেমি খুব কষে আঁকড়ে ধরে ধ্রুবকে। বুকে গাল ঘষতে ঘষতে বলে, তোমার ছেলে হয়েছে না? তাকে মানুষ করবে কে?
ছেলের জন্য আমার কিছু করার আছে কি রেমি? দাদুর দেদার টাকা, আদরের নাতির জন্য সব বন্দোবস্তই তিনি করবেন। আমার কাছ থেকে ওর কিছু নেওয়ার নেই। না কোন সৎ শিক্ষা, না ধনদৌলত বা বাড়ি জমি। আর যদি বাপের স্নেহের কথা তোল, তাহলে বলব তারও ওর দরকার নেই।
রেমি বড় বড় চোখ করে বলে, তুমি কী বলতে চাইছ বল তো? মরতে চাও মানে কি সুইসাইডের কথা ভাবছ?
মাঝে মাঝে ভাবি। কিন্তু আমার মনে হয় তার দরকার নেই। মানুষের যখন বাঁচার ইচ্ছেটা একদম নিবে যায় তখন তার শরীরও আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ে। তুমি ইচ্ছাশক্তিতে বিশ্বাস কর?
জানি না।
আমার হল নেতিবাচক ইচ্ছাশক্তি। বাঁচার ইচ্ছেটা নিবে গিয়ে একটা মৃত্যুপ্রেম দেখা দিচ্ছে। কেবল মনে হচ্ছে, আর নয়, আর নয়। বহুদিন হয়ে গেল এইখানে।
রেমির বিখ্যাত বড় বড় দুখানি চোখ টসটসে জলে ভরে উঠল। গাল ভাসিয়ে নামল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে।
কাঁদছো কেন? কাঁদলে আমার কী লাভ? আমি তোমাকে আমার প্রবলেমটার কথা বললাম। তোমার কাছে যদি সলিউশন থাকে তো দাও। আমার বাঁচার ইচ্ছেটাকে জাগিয়ে তোল, যদি পার। কেঁদে ভাসিয়ে দিলে তো সমস্যাটা মিটবে না।
আমি বোকা, আমার বুদ্ধি নেই, আমি এসব কথা শুনে আরো পাগল পাগল হয়ে যাচ্ছি।
ধ্রুব হেসে রেমির নাকটা টিপে দিয়ে বলল, এরকম বন্ধু দিয়ে আমার কী হবে বল তো! বন্ধু হবে শক্ত সমর্থ, দৃঢ়চেতা, যার ওপর হেলান দেওয়া যায়, যাকে অবলম্বন করে বাঁচার জোর পাওয়া যায়।
রেমি চোখ মুছল। ধ্রুবকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলল, মরার কথা ভাবতে পারবে না। কথা দাও।
এসব কি প্রতিজ্ঞা করা যায় রেমি? ভিতরকার ব্যাপার, নানারকম জটিল কজ অ্যাণ্ড এফেকটের ওপর নির্ভরশীল।
আমি আজ থেকে তোমার প্রবলেম নিয়ে ভাববো কিন্তু আমি তো স্লো থিংকার, একটু সময় লাগবে। আমাকে সময় দেবে তো!’
দিলাম।
আর শোনো, আজ থেকে আমি এই ঘরে থাকব।
ওয়েলকাম, মন্ত্রীমশাই চটবেন না তো?
না, চটবেন কেন?
ভয় পাচ্ছ একা ঘরে কিছু করে বসি পাছে?
রেমি মাথা নেড়ে বলে, তা নয়। তোমার কাছে কাছেই ত আমার থাকার কথা! ফিরে তাকাও না বলেই বাবা আমাকে দোতলায় থাকতে বলেছেন।
ধ্রুব মাথা নেড়ে জানাল যে, সে সবই জানে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তোমাকে আর একটা জটিল সমস্যার কথা জানাতে চাই। শুধু ভয় পাচ্ছি তুমি কি ভাবে ব্যাপারটা নেবে।
একসঙ্গে বেশি কি আমি সইতে পারব?
পারবে। পারতেই হবে। যদি আমার বন্ধু হতে চাও তাহলে শেয়ার কর।
রেমি ঝকমকে চোখে চেয়ে দেখল ধ্রুবকে। বলল, ঠিক আছে বলো।
আজই তোমাকে বলার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু ভাবি, কি জানি কি হয়। হাতে হয়ত বেশি সময় নেই।
উঃ ফের সেইসব কথা।
আমার সঙ্গে কোন মেয়ের কখনো কোন ফিজিক্যাল রিলেশন ছিল না। তুমি ছিলে একমাত্র। মুখে আমি যতই আধুনিক হই না কেন, চিন্তায় যতই বিপ্লব করি না কেন, আমি বেসিক্যালি ইনঅ্যাকটিভ, চিন্তাকে আমি কদাচিৎ কাজে অনুবাদ করি, ভাষাটা একটু সাধু শোনাল রেমি?
উঃ, বল আমি বুঝতে পারছি। কার সঙ্গে তোমার কী হয়েছে?
পচা শামুকে পা কাটল, তুমি চিনবে না তাকে, নষ্ট ভ্রষ্ট একটা মেয়ে। আমাদের দেশের বাড়ির পুরুতের নাতনী, ওর মা এক সময় মেয়েটাকে আমার সঙ্গে বিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল। তাতে হেড অফিস চটে যায়। মেয়েটার এক দাদা তোমার শ্বশুরের অফিসে চাকরি করত। হেড অফিস অথাৎ তোমার শ্বশুর তাকে নিজের চাকরি থেকে তাড়ায়। ছেলেটা সেই থেকে নিরুদ্দেশ। এটুকু হল ব্যাকগ্রাউণ্ড। বুঝলে?
বুঝছি, বল।
মেয়েটা সংসার চালাতে নিচে নামতে থাকে। এরকম আকছার হচ্ছে। কিন্তু এই মেয়েটার ক্ষেত্রে নষ্ট হয়ে যাওয়ার পিছনে তোমার শ্বশুরের অবদান যথেষ্ট।
মেয়েটাকে আমি চিনি?
বোধহয় না। তার নাম নোটন, সিনেমা থিয়েটারে ছোট পার্ট করে। আসলে কল গার্ল, কেপট এবং আরও হয়তো কিছু। অত জানি না। এক পিকনিকে মেয়েটার সঙ্গে হঠাৎ দেখা। দুঃখী মেয়ে, নিচে নেমেছে, তার ওপর ওর জীবনে আমাকে নিয়ে একটা ট্রাজেডী আছে বলে আমি খুব একটা এড়াতে পারিনি ওকে।
সে কী? বলে রেমি বড় বড় চোখে তাকায়।
বন্ধু, শক্ত হও। অমন চমকে উঠলে বা রিঅ্যাক্ট করলে আমার মনের জোর কমে যাবে। আমি ভীষণ দুর্বল, শূন্য, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনাহীন। এখন আমাকে গাইড করার দায়িত্ব তোমার। শান্তভাবে শোন, উত্তেজিত হয়ো না।
রেমি স্তিমিত হল। বলল বল।
এখন আমি তোমার স্বামীই শুধু নই, বন্ধু। তাই না?
বেশ, বল।
মেয়েটার কাছে আমি বশ মানলাম। কিন্তু কেন মানলাম তার কারণটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়, আমার মনে হল সামথিং ইজ ভেরি মাচ রং উইথ মি। ভিতরে যে ভ্যাকুয়ামটার কথা তোমাকে বলছিলাম সেটাই কারণ কিনা কে জানে! একদিন বিনা কারণে ধারার গলা টিপে ধরেছিলাম। মেয়েটা মরতে বসেছিল।
রেমি চমকে উঠে বলে, বল কি গো! গলা টিপে—
ধ্রুব কঠিন গলায় বলল, রেমি! প্লীজ ডোন্ট রি-অ্যাক্ট। পাদ্রীরা যে রকম মুখ করে কনফেশন শোনে, পাকা জুয়াড়িরা যেমনভাবে জুয়া খেলে ঠিক সেইরকমভাবে তোমাকে এসব শুনতে হবে। পাথর হও। কঠিন হও।
রেমি নিজের কপাল টিপে ধরে বলে, পারছি না। ধারাকে খুন করতে চেয়েছিলে
না। আমি চাইনি। আমার ভিতরে একজন অচেনা ধ্রুব চেয়েছিল। সেই ধ্রুবকে আমি ভয় পাই। কে জানে একদিন সে তোমারও গলা টিপে ধরতে চাইবে কিনা।
ধরো, তাহলে বেঁচে যাই।
আবার রি-অ্যাক্ট করছ?
রেমি একটা মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আচ্ছা বল।
নোটনের সঙ্গে মিশবার সময় আমার কোন প্রতিক্রিয়া হল না। ঘেন্না হল না।
রেমি আচমকা প্রশ্ন করে, নোটন দেখতে কেমন?
মজানোর মত রূপ নয়। তবে চটক আছে। প্লীজ ওটা নিয়ে আর খুঁটিয়ে জানতে চেও না। তুমি ওর চেয়ে অনেক সুন্দর।
সত্যি কথা বলছ?
মিথ্যে বলব কিসের ভয়ে বল তো? কোন ভয় থাকলে কি এত কথা বলতাম?
মাপ চাইছি। রাগ কোর না। বল।
আমার সমস্যাটা বুঝতে পারছ তো? নোটনের সঙ্গে শারীরিক মেলামেশা আমার পক্ষে স্বাভাবিক নয়। কারণ আমি ওরকম নই। তবে কেন হল? আমি ভাবতে বসলাম। ভেবে কিছুতেই সলভ করতে পারলাম না। আমাদের বংশটা কেমন জান? জমিদারি হাবভাব থাকলেও লাম্পট্য নেই! আমার দাদু বুড়ো বয়সে একটা বিয়ে করেছিলেন বলে খুব হই হই হয়েছিল। কিন্তু আমি জানি তার মধ্যে কোন কামের উন্মাদনা ছিল না। তোমার শ্বশুরের জ্যাঠামশাই সন্ন্যাসী হয়ে যান কাকা স্বদেশী এবং ব্রহ্মচারী ছিলেন। তোমার শ্বশুরকেও লোকে চোর, ক্ষমতালোভী স্বজনপোষক বললেও কেউ কখন লম্পট বলেনি। আমার মধ্যেও সম্ভবত ওই শুচিতার বোধ ছিল। প্রতিরোধ ছিল। সেই প্রতিরোধ নোটন ভাঙল কি করে? নোটনের কি সেই ক্ষমতা আছে? ৫৭৭
সিনেমা থিয়েটারের মেয়েরা অনেক ছলাকলা জানে।
ধ্রুব মাথা নাড়ল, না রেমি। প্রতিরোধ ভাঙবার ক্ষমতা নোটনের ছিল না। প্রতিরোধ ভেঙেছে আমার ভিতরকার অন্য এক ধ্রুব। তাকে আমি চিনি না। তাকে আমি ভয় পাই।
রেমি বলল, ওরকম করে বোল না, আমার গা ছম ছম করে।
তা করলে চলবে কেন সিস্টার? এ তো ভূতের গল্প নয়।
কিন্তু এমন করে বলছ যে ভয় করে।
ডাক্তার যেমন রোগীর রোগের বিবরণ শোনে তেমনি করে শোন। এক্ষুনি বললাম এটা ভূতের গল্প নয়, তাই না? আসলে কিন্তু আমার বিশ্বাস এটা বাস্তবিক ভূতেরই গল্প। একটা ধ্রুব আর একটা ধ্রুবর ভূত।
আবার?
রেমি, সবটা না শুনলে বুঝবে না। না বুঝলে চিকিৎসা করবে কি করে?
আচ্ছা বল।
এবার আসল কথাটা বলছি। আজ বিকেলে আমি নোটনের কাছে ছিলাম।
সে কী! আজও?
আবার চমকাচ্ছ?
রেমি সাদা মুখ করে চেয়ে থাকে।
প্লীজ রেমি!
রেমি ফের দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমি ভাবছিলাম এসব অনেক আগের কথা।
না। একেবারে টাটকা খবর।
বল।
যখন ওর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছিলাম তখন দেখি নিচে টালিগঞ্জ পাড়ার এক মেজো মস্তান দাঁড়িয়ে আছে। আমার চেনা।
মারল নাকি তোমাকে?
ধ্রুব হাসল, মাথা নেড়ে বলল, না। আমাকে মারলে কালই গিয়ে জগাদা ওর হাত কেটে দিয়ে আসবে।
জগাদা কি গুণ্ডা?
গুণ্ডাদের গুরু। তবে আদর্শবাদী গুণ্ডা। প্রফেশন্যাল নয়। জগাদার কথাতেই আসছি। সেই মেজো গুণ্ডা আমাকে খুব অভয় দিল, নোটনের কাছে আমার যাতায়াতকে অ্যাপ্রুভও করল। আমি ওকে দু’চার কথা জিজ্ঞেস করতেই যা বেরিয়ে এল সেটা শুনলে তুমি বোধহয় মূর্ছা যাবে।
কী গো!
সে যা বলল তাতে বুঝলাম জগাদা সব খবর রাখে। সে গিয়ে ফ্যাতনকে বলে এসেছে যেন আমি নিরাপদে নোটনের কাছে যাতায়াত করতে পারি সেদিকে নজর রাখতে।
জগাদা! দাঁড়াও শ্বশুরমশাইকে ওর নাম বলছি।
ধ্রুব ম্লান হেসে বলে, সবটা শুনে নাও। অস্থির হয়ো না।
অত আস্তে আস্তে ভাঙছ কেন?
রহস্য কাহিনী এ ভাবেই বলতে হয়। একটু আগে বাড়ি ফিরে আমি জগাদাকে চার্জ করেছিলাম। সে কী বলল জান? বলল, নোটনের কাছে আমার যাতায়াত স্বয়ং তোমার শ্বশুরমশাই অনুমোদন করেছেন।
রেমি রাঙা হয়ে উঠে বলল, ধ্যাৎ! হতেই পারে না।
জগাদা প্রয়োজনে মিথ্যে কথা বলে বটে, কিন্তু কৃষ্ণকান্ত প্রসঙ্গে কখন বলবে না। গলা কেটে ফেললেও না।
শ্বশুরমশাই কি তেমন মানুষ?
জানি না, তোমার শ্বশুরমশাইকে আমি ভাল চিনি না। আমার শুধু মায়ের মৃত্যুর দৃশ্য মনে পড়ে। আগুনের মধ্যে মা বেগুন পোড়া হচ্ছে।
আবার পুরনো কথা?
ঠিক আছে, থাক। কিন্তু আমার প্রশ্ন তোমার শ্বশুর আমাকে লাম্পট্যের পথ দেখাচ্ছেন কেন? কেন রি-অ্যাক্ট করলেন না?
উঃ, আমি এত ভাবতে পারি না।
ভেঙে পোড় না। তোমার শ্বশুর সম্পর্কে আমার মনে অনেক ধাঁধা আছে ঠিকই, কিন্তু আজকের ব্যাপারটা আমি হজম করতে পারছি না। উনি কি ভাবেন যে আমার কোন সেকসুয়াল চাহিদা মিটছে না বলেই আমি বখে যাচ্ছি? আর তাই সেই পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছেন?
উনি ওরকম করেননি, জগাদা মিথ্যে বলেছে।
তুমি অন্ধ, একদেশদর্শী। আমার বন্ধু হতে গেলে আর একটু নিরপেক্ষ হতে হবে। নিজেকে রেফারি বলে ভেবে নাও। ফাউল যে করবে তার বিরুদ্ধেই বাঁশি বাজাবে।
শ্বশুরমশাই এরকম ফাউল করতে পারেন না।
কেন পারবেন না? উনি বহু ফাউল জীবনে করেছেন।
তা বলে নিজের ছেলেকে নিয়ে—
নিজের ছেলে বলে কি তাকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে নেই। আমার তো মনে হয় উনি আমার রোগ ধরতে না পেরে মরীয়া হয়ে এখন বেপরোয়া নিদান দিচ্ছেন।
ছিঃ, তোমার মুখে কিছু আটকায় না।
না, আমার মুখ তোমার শ্বশুরও আটকাতে পারেননি। আর সেইটেই ওর মস্ত অশান্তির কারণ।
চল আমরা কোথাও চলে যাই।
যেতে তো হবেই রেমি। তোমার শ্বশুর এনিমি প্রপার্টির বিস্তর টাকা পাচ্ছেন। সেই টাকা দিয়ে আমাকে তিনি নাসিকে পাঠাবেন তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশীপে ব্যবসা করতে। সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না।
কেন, তুমি যাবে। আমিও যাব।
যেতে আপত্তি নেই। কিন্তু আমি এতদিনে বুঝে গেছি কোথাও গিয়েও আমি ভাল থাকব না।
হ্যাঁ গো, মদ ছেড়ে দিয়ে কি তোমার কষ্ট হয়?
না রেমি। মদের কোন নেশা আমার ছিল না। বন্ধুরা জানে আমি বরাবর জোর করে মদ খেতাম। একথা জিজ্ঞেস করলে কেন?
ভাবছিলাম এতদিনের নেশা ছেড়ে দেওয়ায় তোমার ব্রেনটা হয়তো গোলমাল করছে।
না। ওসব নয়। আমার ব্রেন ঠিক আছে। শুধু বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা চলে যাচ্ছে।
আমি কী করব বল তো?
বসে বসে ভাবো। সারাদিন ভাব। দেখ কিছু করতে পার কিনা।
আমি দিব্যকে নিয়ে আজই চলে আসছি এ ঘরে।
দিব্যটা আবার কে?
তোমার ছেলে।
ওর নাম দিব্য? কে রাখল?
শ্বশুরমশাই। দিব্যকান্ত। পছন্দ নয়?
বেশ নাম।
ওর মুখের দিকে রোজ কিছুক্ষণ চেয়ে থেক। দেখো তোমার সব অসুখ সেরে যাবে।
তাই নাকি? তবে তুমি নিজে পাগল হয়ে যাবে বলে ভয় পাচ্ছ কেন?
রেমি লজ্জায় হাসল। মাথা নেড়ে বলল, আর তেমন মনে হচ্ছে না। পাগলামি তুমি সারিয়ে দিয়েছ।