1 of 3

০৪৩. অনাথ ডাক্তারের মেলা টাকা

অনাথ ডাক্তারের মেলা টাকা। ডাক্তারি করেও টাকা করেছে, পাটের চালান দিয়েও করেছে। টাকা রাখার জায়গা নেই। লক্ষ্মী যাকে বর দেন তার দরজা দিয়ে পারতপক্ষে মা সরস্বতী হাঁটতে চান না। অনাথের ছেলেগুলো মানুষ হল না। তবে শহরের একজন মান্যগণ্য লোক হিসেবে অনাথের একটা পরিচিতি আছে। বাড়ি, গাড়ি, টাকা তার কিছুরই অভাব নেই।

হেমকান্তর ঘোড়ার গাড়িটা কালীবাড়ির সামনে এসে থামল। নাতি-নাতনিরা এখানকার পেঁড়া আর বালুসাই ভালবাসে। রোজই কিনে নেন হেমকান্ত। আজও চাকর পেঁড়া আর বালুসাই কিনতে গেছে। হেমকান্ত গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন, অনাথ ডাক্তারের গাড়িটা উলটোদিকে দাঁড়িয়ে। অনাথের ড্রাইভার বনেট খুলে খুটখাট কী যেন করছে।

এ শহরে খুব বেশি লোকের মোটরগাড়ি নেই। যাদের আছে তারা বেশ খাতির পায়। অনাথের গাড়িটার রং কালো। চার দরজার সেভানবডি। কয়েক বছর আগে দু হাজার টাকায় কিনেছিল। মোরগের ডাক দিয়ে হর্ন বাজে, ধুলো উড়িয়ে ঘরঘর করে চলে। বেশ লাগে জিনিসটা। মোটরগাড়ি এখনও হেমকান্তর কাছে একটা বিস্ময়, একটা রহস্য।

হেমকান্ত দরজা খুলে নেমে পড়লেন। পায়ে পায়ে গাড়িটার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তাকে দেখে ড্রাইভার লোকটি তটস্থ হয়ে উঠল।

সাধারণ মানুষেরা রাজা-জমিদার, উকিল-দাবোগা দেখে ভয় পাবে, এটা স্বাভাবিক। হেমকান্ত এর মধ্যে কোনও অসঙ্গতি দেখতে পান না। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে তার মনে হল, এ লোকটা সামাজিক স্তরে তার চেয়ে ক্ষুদ্র বটে, কিন্তু এ মোটরগাড়ির বিজ্ঞান জানে। তিনি তা জানেন না। সুতরাং অন্তত এ ব্যাপারে এ লোকটি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ।

হেমকান্ত গাড়িটার দিকে মোহমুগ্ধ চোখে একটু চেয়ে ড্রাইভারকে বললেন, এ গাড়ি কীসের জোরে চলে বলো তো!

আজ্ঞে, পেট্রল। —লোকটা শশব্যস্তে জবাব দেয়। ভারী বিনয়ের সঙ্গে হাত কচলাতে থাকে।

শুধু পেট্রল?

আজ্ঞে আরও জিনিসপত্র লাগে।

আমাকে একটু বুঝিয়ে দেবে?

লোকটা বিগলিত হয়ে হেসে বলে, আজ্ঞে, দেখবেন?

হেমকান্ত স্মিতহাস্যে বাচ্চা ছেলের মতো মুখ করে বনেট খোলা মোটরগাড়ির যন্ত্রপাতি দেখতে থাকেন।

অনেকক্ষণ ধরে সাগ্রহে তিনি পাঠ নেন। কোনওদিন যন্ত্র সম্পর্কে কিছুই শেখেননি তিনি। বুঝতে একটু অসুবিধা হয়। খুব যে ঠিকঠাক বুঝতে পারেন তাও নয়।

অনেকক্ষণ পর তিনি প্রশ্ন করেন, সবই বুঝতে পারছি, কিন্তু এর প্রাণটা কোথায় তা রহস্য রয়ে গেল।

আজ্ঞে কর্তা, গাড়ির কি প্রাণ থাকে?

থাকে না! এই যে এত যন্ত্রপাতি, কলকব্জা, চাকা, হুইল, আরও কত কী, এ সবই তো জড়বস্তু। একটা কিছু ভিতরে স্পন্দন তোলে, জ্বলে, তবে নড়তে পারে গাড়ি, তাই নয় কি?

লোকটা অত-শত জানে না। বিনয়ের সঙ্গে অবশ্য কথাটা মেনে নিয়ে বলল, সে তো ঠিক কথাই।

হেমকান্ত বললেন, একটা কিছু আছে। সেটা হয়তো আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। এই যে আমাদের শরীর, এত শিরা-উপশিরা, এত স্নায়ু, পেশি, অস্থি এসব তো কিছু নয়। একটা স্কুল প্রকাশ মাত্র। এর ভিতরে এক দাহিকাশক্তি যতক্ষণ আছে, ততক্ষণই এটা পচে না, জড়বস্তু হয়ে যায় না।

আজ্ঞে ঠিক কথা। সেই প্রাণটাই তো আজ্ঞে পেট্রল।

হেমকান্ত মৃদু হেসে বলেন, পেট্রল ইন্ধন। প্রাণ হবে কেন! যাক গে বাপু, তোমার খানিকটা সময় খামোকা নষ্ট করলাম। কিছু মনে কোরো না।

আজ্ঞে, কী যে বলেন। আমার সৌভাগ্য।

হেমকান্ত গাড়িতে এসে উঠলেন। একটু অন্যমনস্ক। মুখে একটা স্মিত হাসি। বাড়ি ফিরতেই নাতি-নাতনি দুজন এসে ধরল তাঁকে। আজকাল এদের সঙ্গে তার বড় ভাব হয়ে গেছে। শিশুদের পছন্দ করলেও, তেমন মাখামাখি পছন্দ ছিল না তার। বাচ্চারা নানা অদ্ভুত কাণ্ড করে, কাদে, বায়না ধরে। বিরক্তিকর। কনককান্তির ছেলেমেয়ে দুটো তার বাইরে নয়। কিন্তু তবু এদের সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটানোর পর হেমকান্তর ভিতরে একটা উষর ভূমিখণ্ড হঠাৎ উর্বর ও সেচ-নম্র হয়েছে। অবোধ শিশুও উর্বর ক্ষেত্র। ঠিকমতো, কর্ষণ, সেচ ও বপন ঘটালে কী কাণ্ডই না করতে পারে বয়সকালে।

আজকাল নাতি-নাতনিরা তার কোচানো ধুতির ভাজ নষ্ট করে, ময়লা হাতের ছাপ লাগায়। পাঞ্জাবিতে। তার ওপর যখন তখন এসে হামলা করে, ধামসায়। হেমকান্ত রাগ করেন না। এক প্রাণ থেকে আর-এক প্রাণের প্রদীপ জ্বলে ওঠাই তো বংশগতি। আমি রইলাম না, কিন্তু আমার প্রাণের অম্লান শিখা রয়ে গেল তো! এইদিক দিয়ে ভেবে আজকাল তার বিরক্তি কমে গেছে।

নাতি-নাতনিদের হাতে পেঁড়া আর বালুসাইয়ের খাঁচাটা ধরিয়ে দিয়ে নিষ্কৃতি পেলেন হেমকান্ত।

বাইরের ঘরে এসে নিশ্চিন্তে বসলেন।

আজ প্রাণতত্ত্বের কথা ভাবা যেতে পারে।

সন্ধে হয়ে গেছে। চাকর বাতি দিয়ে গেছে ঘরে। মশার পনপন শব্দ উঠছে চারধারে।

মনের কথা বলতে গেলেই হেমকান্তর সচ্চিদানন্দর কথা মনে পড়ে। আজ যা ভাবলেন তা সচ্চিদানন্দকে জানানো দরকার। সচ্চিদানন্দ আর-এক দফা গলাগাল দিয়ে চিঠি লিখবে। কিন্তু সচ্চিদানন্দ জানে না, এসব চিঠি তাকে লেখা হলেও তার বিচার-বিবেচনা বা পরামর্শের জন্যই লেখেন না হেমকান্ত। শুধু একটা জায়গায় মনের কথা উজাড় করে দেন। সচ্চিদানন্দ বুঝুক না বুঝুক হেমকান্ত খালাস হয়ে যান।

কালিতে কলম ড়ুবিয়ে একটু ভাবলেন হেমকান্ত।

ভাই সচ্চিদানন্দ, আশা করি আনন্দে আছ। তুমি আনন্দে থাকিবেই। কোনও কোনও লোক আছে, আনন্দের জন্য তাহাদের পরনির্ভরশীল হইতে হয় না, উপকরণেরও বিশেষ প্রয়োজন হয় না। তাহারা আনন্দের একটি অফুরান ভাণ্ডার লইয়াই জন্মায়। তাহারা যেখানে যায় সেই জায়গাটিই যেন হাসিয়া উঠে। পৃথিবীতে জ্ঞানী, গুণী, ধনী বা ত্যাগী যত মানুষ আছে তাহার মধ্যে আমি সর্বাপেক্ষা অধিক ঈর্ষা করি এইসব মানুষগুলিকে। ভাই সৎ চিৎ ও আনন্দ, তুমিও আমার ঈর্ষাভাজন। কী কৌশলে তুমি ওকালতি করিয়া, কংগ্রেস করিয়া এবং পরিবার সামাল দিয়া সুদুর প্রবাসেও অখণ্ড আনন্দে ভাসিতেছ সে কৌশল আমার ইহজীবনে করায়ত্ত হইবে না। ঈশ্বর আমাকে অন্যরকম গড়িয়াছেন। বিমর্ষতা আমার যমজ ভাই। আর আনন্দ তোমার সহজাত কবচকুণ্ডল।

তবে আজ বিমর্ষতার কথা তোমাকে লিখিব না। আজ আনন্দের কথাই লিখিব। কালীবাড়ির সম্মুখে আজ অনাথ ডাক্তারের গাড়িটি বিকল হইয়া পড়িয়াছিল। অনাথকে বোধ করি ভুলিয়া যাও নাই। সহজে ভুলিবার কথাও নহে। তাহার ভগ্নী সুখদার প্রতি তোমার বিলক্ষণ দুর্বলতা ছিল। সেই পুরাতন ক্ষতে আজ একটু খোঁচা লাগিল কি? লাগিলেও ক্ষতি নাই। যে আনন্দের পাইকারি কারবার লইয়া আছে তাহাকে কী ছাই করিবে স্মৃতি! পৃথিবীতে যাহারা আনন্দ লইয়া থাকে তাহাদের স্মৃতিকে উপেক্ষা করিতেই হয়। স্মৃতি-প্রধান হইলে আনন্দ মাটি হইয়া যায়। সুখদার স্মৃতি মনে পড়িলে তোমার পীড়া উপস্থিত হইবে না জানি। তবু সুখদা নামটি যে তাহার কে রাখিয়াছিল তাহা বুঝিয়া পাই না। তুমি যেমন আনন্দময়, সুখদা বোধ করি তেমনই তমসাময়ি। এই কচি বয়সে বিধবা হইয়া ভাইয়ের বাড়িতে হাঁড়ি ঠেলিতেছে।

সে কথা যাক। আজ আনন্দের কথা লিখিব বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছি। অনাথের গাড়িটা দেখিয়া আমি আজ লোভ সংবরণ করিতে পারি নাই। যেসব শকট আপনিই চলে তাহাদের সম্পর্কে আমার কৌতূহল সীমাহীন। আমি যন্ত্রবিদ নই বলিয়াই বোধহয় আগ্রহটা বেশি।

গাড়িটা খারাপ হইয়া গিয়াছিল। অনাথের ড্রাইভার তাহা মেরামত করিতেছে দেখিয়া আমি তাহার কাছে জানিতে চাহিলাম, গাড়ির প্রাণ কোনটা। কাহার জোরে গাড়ি চলে।

সে বেচারা সম্মুখে এক বিশিষ্ট মানুষ দেখিয়া ঘাবড়াইয়া গিয়াছে। তদুপরি সে চালক মাত্র। সে ইন্ধন জানে, যন্ত্রবিদ্যা জানে, কিন্তু প্রাণতত্ত্ব তাহার জানা নাই। গাড়ি কেমন করিয়া চলে তাহা সে জানে কিন্তু কেন চলে তাহা জানিবে কী করিয়া?

কিছুক্ষণ তাহার সহিত কথা বলিয়া গাড়ির যন্ত্রপাতি ইন্ধন সবই বুঝিয়া লইলাম। একটা ধোঁয়াটে আন্দাজ মতো হইল। গাড়ি কেমন করিয়া চলে তাহা তো একপ্রকার বোঝা গেল, কিন্তু কেন চলে, এ প্রশ্নে আবার অগাধ জলে।

ভাই সচ্চিদানন্দ, নরনারীর মিলনে মানুষ জন্মায় ইহা সর্বজনবিদিত। কিন্তু তবু ইহাও মানিতে হইবে মানুষ কখনও একটি মানুষকে তৈয়ারি করে না। সে জন্ম দেয় বটে, কিন্তু কলাকৌশল তাহার হাতে নাই। সে মোটরগাড়ি বানাইতে পারে, মানুষ বানাইতে পারে না।

পারে না যে, তাহার কারণ আমাদের অনধিগম্য, আমাদের সাধ্যাতীত কিছু মানুষের মধ্যে আছে। এমনকী মোটরগাড়ি বানাইলেও সেই গাড়ির প্রকৃত চালক কে তাহা মানুষের পক্ষে ব্যাখ্যা করা বড় সহজ হইবে না। অনাথের ড্রাইভার বড়জোর পেট্রলের কথা বলিয়াছে, পণ্ডিতেরা তাহার অপেক্ষা আর-একটু আগাইয়া বলিবেন,দাহিকাশক্তি। কিন্তু আমি তবু প্রশ্ন করিতে থাকিব, ওই দাহিকাশক্তি কোথায় নিহিত ছিল, কী করিয়া আসিল? ইন্ধন না হইলে আগুন মরিয়া যায়। কিন্তু সেই আগুনই চকমকি, দেশলাই প্রভৃতি স্থূল বস্তুর মধ্যে নিহিত আছে কী করিয়া? এই অগ্নি কোথা হইতে আসিল? সেই রহস্যের সন্ধান যদি দিতে না পারে তবে মোটরগাড়ি কী করিয়া চলে তাহার সঠিক উত্তর মোটরগাড়ির আবিষ্কর্তারও অজ্ঞাত।

এই শরীরের কোথাও প্রাণকে খুঁজিয়া পাই না। তাহা কোথায় আছে? তাহা কোথায় আছে? মস্তিষ্কে? চক্ষুদ্বয়ে? বক্ষদেশে? খুঁজিয়া পাই না। কিন্তু সে আছেই। সে নহিলে এই শরীর জড়মাত্র।

এই ভাবিয়া বড় আনন্দ হইল। আমার ভয়, মানুষ অচিরে একদিন পৃথিবীর সব রহস্যের সমাধান করিয়া ফেলিবে। সব জানিয়া ফেলিলে আর সে বাঁচিবে কী লইয়া। সে যে তখন স্রষ্টার সমকক্ষ। এখনও তাহার অজ্ঞাত কিছু আছে, ইহাই ভরসা।

কেন ভরসা জিজ্ঞাসা করিবে কি? তবে বলি, এই যে চারিদিককার পৃথিবী, এই যে মানুষেরা নিত্য জন্মাইতেছে, হদ্দমুন্দ হইয়া বিষয়কর্মে ছুটিতেছে, নানা সুখ দুঃখ ভোগ ত্যাগ শেষ করিয়া বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া মরিতেছে, ইহার কোনও অর্থ খুঁজিয়া পাও? এই জীবনটা কি গোটাটাই অর্থহীন হইয়া যায় না, যদি না ইহার ভিতরে অন্তর্নিহিত প্রাণরহস্য থাকে?

মোটরগাড়ি আজ আমাকে এই প্রাণরহস্যের সন্ধান দিল, এমন নহে। প্রশ্নটি আমার ভিতর ছিলই। অনাথের অচল মোটরগাড়ি তাহাকে খোঁচাইয়া তুলিল মাত্র।

এদিককার অবস্থা তো সকলই জানো। বিশাখা আমাকে বড়ই হতাশ করিয়াছে। শচীনের মতো পাত্রকে তাহার পছন্দ হইল না। ওদিকে শচীনের জন্য পাত্রী প্রায় স্থির। শ্রীকান্ত রায়ের মধ্যমা কন্যার সঙ্গে বিবাহের কথা প্রায় পাকা হইয়া গিয়াছে। শচীনের দিক দিয়া ভালই হইবে। রায় মহাশয় দিবেন অনেক। উপরন্তু শচীনের ভগ্নীটিকেও নিজ পুত্র জ্যোতিপ্রকাশের জন্য মনোনীত করিয়াছেন। পালটি বিবাহ। শচীন সুখী হইলেই আমার মনের ভার লাঘব হইবে। আমি ছেলেটিকে বড় স্নেহ করি। স্নেহ পাইবার যোগ্যতাও তাহার বিলক্ষণ আছে। অন্য যোগ্যতার কথা ছাড়িয়া দিই। বিশাখা তাহাকে প্রত্যাখ্যান করায় তাহার যে অপমান হইয়াছে তাহা গায়ে না মাখিয়া সে আজও প্রতিদিন আসিয়া আমার এস্টেটের কাজকর্ম দেখিতেছে। নানা সুপরামর্শ দিতেছে। এই অহংকারহীনতা বড় কম কথা নহে।

মেয়েটিই আপাতত আমার দুশ্চিন্তার প্রধান কারণ। বয়স কম তো হইল না। এখনও পাত্রস্থ করিতে পারিতেছি না। মা-মরা মেয়ে, মনে মনে হয়তো আমাকেই দোষারোপ করে। কিন্তু আমি কী করিব? পৃথিবীর সকল ঘটনার হাল ধরিয়া তো আমি বসিয়া নাই।

গভীর ভালবাসা গ্রহণ করো। ঈশ্বর তোমাকে নিত্য আনন্দে রাখুন। তোমারই হেম।

চিঠিটা যখন মুড়ে রাখছেন তখনই রঙ্গময়ি ঘরে এল।

একটু চমকে ওঠেন হেমকান্ত। রঙ্গময়ি আজকাল এত দূর তো আসে না।

কী খবর, মনু?

রঙ্গময়ি একটু হাসল। কেমন দেখাল হাসিখানা? কান্নার মতো?

কী হয়েছে, মনু?–উদ্বিগ্ন হেমকান্ত আবার জিজ্ঞেস করেন।

কেন? তোমার কাছে কি এমনি আসতে নেই?

তা তো বলিনি। হঠাৎ তো এরকম আসো না কখনও।

আজ এলাম একটা কথা বলতে।

কী কথা?

আমরা চলে গেলে কি তোমার এস্টেটের উপকার হয়? আয়পয় বাড়ে?

সে কী কথা! একথা কে বলেছে?

তোমাকে জিজ্ঞেস করছি। বলো না!

আমি তো এরকম ভাবে কখনও ভাবিনি।

রঙ্গময়ির মুখটা আর-একটু ভাল করে দেখলেন হেমকান্ত। মানুষ গভীরভাবে অপমানিত হলে ভিতরকার তাপে সে শুকিয়ে যায়, তাম্রাভ হয়ে ওঠে। রঙ্গময়ির মুখে-চোখে সেইরকম একটা ভাব। চোখদুটোয় পাগলের চোখের মতো অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতা।

রঙ্গময়ি বলল, তুমি নিজে থেকে ভাবোনি, কিন্তু তোমার হয়ে অন্য কেউ হয়তো ভাবছে। তুমি তো সব খবর রাখে না।

কী হয়েছে একটু খুলে বলবে?

আজ বিকেলে বাবাকে কাছারি বাড়িতে কনক ডেকে পাঠিয়েছিল।

কেন বলো তো!–হেমকান্তর বুক কাঁপতে থাকে। কনকের প্রস্তাব তিনি ভুলে যাননি। কিন্তু এখনও হেমকান্ত মতও দেননি। কনক কি তা হলে বিনোদচন্দ্রকে বিদায় হতে বলেছে? বলাটাই স্বাভাবিক।

হেমকান্ত বললেন, ডেকে কিছু বলেছে বুঝি?

খুব বিনয়ের সঙ্গে বলেছে। কিন্তু বলেছে। অন্যত্র আমাদের বাসের ব্যবস্থা করলে অসুবিধে হবে কি না। সঙ্গে এও বলেছে, এস্টেটের অবস্থা খুব খারাপ, বাড়তি কর্মচারী পোষার সামর্থ্য নেই।

হেমকান্ত অভিনয় করতে জানেন না। চুপ করে বুকের কাঁপুনি ভোগ করতে লাগলেন।

রঙ্গময়ি কিছুক্ষণ বিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল হেমকান্তর দিকে। তারপর বলল, কনক যা বলেছে তা অন্যায় বা অন্যায্য নয়।

হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কিন্তু আমি তো এই প্রস্তাবে মত দিইনি।

তোমার কাছে তা হলে প্রস্তাব এসেছিল?

হ্যাঁ। কনকই তুলেছিল কথাটা। ওরা তো আর তোমাদের আসল মূল্য বোঝে না। সবাইকেই ওরা কর্মচারী হিসেবে দেখে। যুগের দোষ, মনু। ওকে ক্ষমা করে দিয়ো।

ক্ষমা করতে একটু আস্পর্ধা লাগে মেজো কর্তা। সেটা আমার নেই।

তোমার অধিকার কিছু কম নয়, মনু। সুনয়নী বেঁচে থাকতে, আর তার মরার পর তুমি যা করেছ তা কি বিনোদচন্দ্রের বেতনে শোধ হয়?

ওসব কথা তুলছ কেন? যে কিছু করে সে সবসময়ে সব করার মূল্য খোঁজে না। তা ছাড়া সে মূল্য দেবেই বা কেন কনক?

কনককে তুমি খারাপ ভাবছ না তো মনু?

রঙ্গময়ি একটু কষ্টের সঙ্গে হাসল। মাথা নেড়ে বলল, কেউ আমাকে অপমান করলেই তাকে খারাপ ভাবব আমি কি এত বোকা? আমাকে তো এ বাড়িতে অনেক এঁটোকাটা খেয়ে বড় হতে হয়েছে, কই অপমান লাগেনি তো! তোমার ছেলে কনক যখন দুধভাত অর্ধেক ফেলে রেখে উঠে যেত তখন আমাকে ডেকে এনে খাওয়ানো হয়েছে কত দিন।

আহা, আবার ওসব কথা কেন? কনক কী বলল বলো তো!

বললাম তো ন্যায্য কথাই বলেছে। বাবা অবশ্য খুব খেপে গেছে। দিব্যি ঘণ্টা নেড়ে দিন কাটছিল, এখন নতুন করে কাজকর্ম দেখতে হবে। দাদা তো এ বাড়ির ভরসায় লেখাপড়াটা পর্যন্ত ভাল করে শেখেনি। ভরসা জমিটুকু, সেটাও তোমরা দিয়েছিলে। এতগুলো পেট চলবে কীসে সেই ভেবে সকলের মাথা গরম।

বললাম তো, তোমাদের কোথাও যেতে হবে না।

তুমি বলছ?

হ্যাঁ। আমি।

কিন্তু তুমি কে?

তার মানে?

তুমি আজ যা বলছ তা ভাল ভেবে বলছ। কিন্তু রোজ যদি তোমার ছেলে আর আত্মীয়রা তোমাকে বোঝাতে থাকে যে, এই পুরুতটা নিতান্তই অকর্মার ধাড়ি, তা হলে তুমিও বুঝবে। বিশেষ করে কথাটা তো মিথ্যেও নয়। বাবা তোমাদের ঘাড়ে বসে একটা জন্ম খেয়ে গেল। কয়েক ঘর যজমান আছে, কিন্তু তারাও হতদরিদ্র।

আর বোলো না, মনু।

শুনতে চাও না?

না। কনক যাই বলুক, ওটা আমার কথা নয়। আজও নয়, কোনওদিনই নয়।

কেন নয়? যদি এস্টেট থেকে অকর্মাদের বিদেয় করতেই হয় তবে সবার আগে আমাদেরই বিদেয় করা উচিত। আর যদি আমাদের রাখো তবে সবাইকেই রাখতে হবে। পারবে?

তুমি কী বলে?

আমি কী বলব? আমার মুখ দিয়ে এসব কথা বেরোনো অন্যায়। তবু বলে ফেললাম।

বেশ করেছ বলেছ। এখন বলো আমি কী করব?

আমাদের জন্য তোমার আলাদা দরদ থাকা উচিত নয়।

সেটা আমি বুঝব।

রঙ্গময়ি একটু হাসল। তারপর হঠাৎ বলল, আমি আজও কেন আছি জানো?

কেন থাকবে না?

থাকার অনেক কারণ ছিল। কিন্তু আছি কেন সেটা তোমার জানা দরকার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *