1 of 3

০২২. কূট সন্দেহ

কূট সন্দেহ যখন সত্য হয়ে দেখা দিল অবশেষে, তখন রেমির সত্যিকারের ঘেন্না এল ধ্রুবর ওপর। আর রাগ। পারলে সে লোকটাকে খুন করে।

দুহাতে জামা খামচে ধরে ধ্রুবকে এত জোরে নাড়া দিতে লাগল সে যে মাতাল ধ্রুবর মাথাটা লটপট করতে লাগল ঘাড়ের ওপর। বুঝি-বা ঝাঁকুনিতে খসে পড়ে। চিৎকার করে রেমি জিজ্ঞেস করতে লাগল, কী বললে? ঠিক করে বলো! স্পষ্ট করে বলো! বলো! নইলে তোমাকে আমি খুন করে ফেলব!

ঝাঁকুনির চোটে ধ্রুব কেমন ভ্যাবলা হয়ে গিয়েছিল। কথা বলতে পারছিল না। হাঁফাতে হাফাতে শুধু একবার অতি কষ্টে বলল, মাইরি! তোমার গায়ে তো সাংঘাতিক জোর!

রেমির রাগ তাতে আরও চড়ল। উত্তুঙ্গ সেই পিশাচ রাগ লুপ্ত করে দিল তার কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান। দুহাতে সে ধ্রুবর গলা টিপে ধরে বলল, বলো! স্পষ্ট করে বলো! কী করেছ তুমি? আমার পেটে সত্যিকারের বাচ্চা এসেছিল! তুমি আমাকে মিথ্যে করে বুঝিয়ে সেটা নষ্ট করেছ! বলল, ঠিক কি না!

ধ্রুব সভয়ে রেমির দিকে চেয়ে বলে, ঠিক।

ঠিক? —আর্তনাদ করে উঠে রেমি চেপে ধরল ধ্রুবর গলা। প্রাণপণে তার শ্বাসনালি অবরোধ করে বলল, তা হলে তুমিই-বা কেন বেঁচে থাকবে? খুনি! ছোটলোক! চণ্ডাল! তুমিই-বা কেন বেঁচে থাকবে? মরো! মরো! মরো!

আশ্চর্য এই, ধ্রুব নিজেকে বাঁচানোর জন্য একটা হাতও তুলল না। একটুও বাধা দিল না রেমিকে। রেমির প্রচণ্ড মুঠোর চাপে দম আটকে আসছিল তার। চোখ দুটো বড় বড়। কপালে রক্তোচ্ছাস। মুখটা হাঁ করা।

রেমি সম্ভবত মেরেই ফেলত ধ্রুবকে। যদি সে ধ্রুবর মুখের দিকে না তাকাত। যদি চোখ বুজে থাকত রেমি, তা হলে হয়তো পারত। কারণ সেই মুহূর্তে খুন করার মতোই একটা রাগ ভর করেছিল তার শরীরে। কিন্তু ধ্রুবর অসামান্য মুখশ্রীতে যে কষ্টের ছাপ ও মৃত্যুযন্ত্রণার ভয়াবহতা ফুটে উঠেছিল তার দিকে চেয়ে শিথিল হয়ে গেল রেমি। নিজের কাছে এক রহস্যময় অদ্ভুত প্রশ্ন রয়ে গেল তার। কেন কেন আমি এই খুনি এই পিশাচকে ভালবাসি? কেন ভালবাসি?

রেমির হাত থেকে মুক্ত ধ্রুব গড়িয়ে পড়ে গেল বিছানায়। একটা বীভৎস হেঁচকিব শব্দ উঠতে লাগল তার গলা দিয়ে। ঠোঁটের কোনা বেয়ে কষ ও ফেনা গড়াতে থাকে।

রেমি প্রথমটায় অবাক হয়ে চেয়ে থাকে ধ্রুবর দিকে। তারপর তার বুক জুড়ে দেখা দেয় ভয়। ও কি মরে যাবে? ও কি মরে যাচ্ছে? হায় হায় হায়। ওকে ছাড়া আমি বাঁচব কী করে?

পাগলের মতো রেমি তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে ধ্রুবর ওপর, ওগো! তোমার কী হল? বলো না! পায়ে পড়ি, ওরকম কোরো না। কী হয়েছে তোমার? ওগো!

ধ্রুবর খাস চলছিল, জ্ঞান কিছুটা লুপ্ত হয়ে গিয়ে থাকবে। তবে তার শরীর অত্যন্ত মজবুত। ভাল ভিতের ওপর তৈরি বাড়ি ভাঙতে সময় লাগে। অস্পষ্ট আধো চেতনার মধ্যেও সে বুঝল আতঙ্কিত রেমি যদি চেঁচায়, তা হলে লোক জানাজানি হবে। বিশ্রী এক পরিস্থিতির মুখে পড়ে যাবে রেমি। ধ্রুব অতি কষ্টে একখানা হাত একটু তুলে রেমির একখানা হাত ছুঁল। একটু মাথা নাড়ল। বোধহয় বোঝাতে চাইল, তার তেমন কিছু হয়নি।

হতবুদ্ধি রেমি এইটুকু দেখেই বুঝতে পারল, ধ্রুব হয়তো মরে যাচ্ছে না। সে দৌড়ে গেল বাথরুমে। জল এনে ছিটে দিতে লাগল ধুবর মুখে-চোখে। ফ্যান খুলে দিল মাথার ওপর। খুলে দিল। বুকের বোতাম।

অনেকক্ষণ ধরে কাশল ধ্রুব। গভীর শ্বাস টেনে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল। গলার ফরসা চামড়ায় তখনও লাল দগদগে হয়ে বসে আছে রেমির আঙুলের ছাপ।

ওঠার মতো অবস্থা তখনও তার নয়। বালিশে ক্লান্ত মাথা এলানো। ম্লান একটু হেসে বলল, পারলে না?

রেমি অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে ছিল ওর মুখের দিকে। বলল, কী পারলাম না?

আর একটুক্ষণ চেপে রাখলেই তো হত। পারলে না কেন?

রেমি উপুড় হয়ে পড়ল ধ্রুবর বুকে। দুহাত আঁকড়ে ধরে পাগলের মতো কাঁদতে লাগল, বোলো না! বোলো না! আমি রাক্ষুসি।

ধ্রুব সেই কান্নায় বাধা দিল না। চুপচাপ শুয়ে রইল। কিছুক্ষণ। তারপর ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলল, একটু ব্র্যান্ডি দাও।

একটুও প্রতিবাদ করল না রেমি। উঠে কাঁদতে কাঁদতে, ফোঁপাতে ফোপাতেই আলমারি থেকে ব্র্যান্ডির বোতল বের করে গেলাসে ঢেলে জল মিশিয়ে ধ্রুবর হাঁ করা মুখে একটু একটু করে ঢেলে দিতে লাগল যত্ন করে। জীবনে এই প্রথম স্বামীকে মদ খাওয়াচ্ছে সে। তবে মদ হিসেবে নয়।

ধ্রুব গিলতে পারছিল না। গিলতে গিয়ে একবার বিষম খেল। পরের বার কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল অনেকটা। ফিসফিস করে বলল, পারছি না।

রেমি ওর বুকে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল সস্নেহে। জিজ্ঞেস করল, কষ্ট হচ্ছে?

ধ্রুব মাথা নেড়ে সেইরকম ফিসফিসে গলায় বলে, না। তেমন কিছু নয়।

আমি ডাক্তারকে খবর দেব।

না রেমি। ওসব কোরো না। কেউ যেন জানতে না পারে। একটা মাফলার বের করে আনো।

রেমি আনল।

ধ্রুব বলল, গলাটা ঢেকে দাও।

কেন গো?

দাও না।

তোমার কেমন লাগছে সত্যি করে বলো।

ভাল। গলাটায় একটু অস্বস্তি। ওটা কেটে যাবে।

ঠিক করে বলো। ঠিকই বলছি, রেমি। শোনো, কাউকে কিছু বোলো না। ডাক্তার ডেকো না।

রেমি বুঝল, ধ্রুব তাকেই বাঁচাতে চাইছে। আর কিছু নয়।

সেই রাতটা ধ্রুব খুব কাশল। গলাটা একটু ফুলে উঠেছিল লাল হয়ে। আর তেমন কিছু হল না। পরদিন ধ্রুবকে খুবই স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। সারারাত রেমি এক সেকেন্ডও ঘুমোয়নি। চিত্ৰাপিতের মতো বসে ধ্রুবর মুখখানার দিকে চেয়ে থেকেছে অপলকে। সারা রাত ধরে সে নিজেকে প্রশ্ন করেছে, কেন এই লোকটিকে ছাড়া আমি আর কিছু ভাবতে পারি না? কেন এই মানুষটিকে আমি কিছুতেই অস্বীকার করতে পারি না! এই মাতাল, খুনি, নিষ্ঠুর, উদাসীন ও অপ্রকৃতিস্থ লোকটা কোন জাদুবলে আমাকে দখল করে আছে?

এ এক রহস্য। এক অদ্ভুত জটিল রহস্য। ধ্রুবর ওপর যেরকম প্রচণ্ড রাগ ও ঘৃণা ক্ষণিকের জন্য। পাগল করে তুলেছিল তাকে, তেমনি ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পর বুক ভাসিয়ে এল করুণা মায়া গভীর এক ভালবাসা। সেই দুকূল ছাপানো ভালবাসায় বয়ঃসন্ধির প্রথম প্রেমের মতো উন্মন চঞ্চল হল রেমি। কিন্তু হায়! যাকে নিয়ে তার এই ভালবাসা সেই অপ্রকৃতিস্থ পুরুষ আবার এঁটে দিল তার অভ্যন্তরের কপাট। রেমিকে যেন চেনেই না।

পরদিন গলায় মাফলার জড়িয়েই অফিসে বেরোল ধ্রুব। গভীর রাতে ফিরল মাতাল হয়ে।

দুদিন পর চলে গেল ব্যাঙ্গালোর অফিসের কাজে। রওনা হওয়ার আগে রেমি বলল, আমাকে নিয়ে যাও। কলকাতা বড় একঘেয়ে লাগছে।

আরে দূর! আমি যাচ্ছি হারিকেন ট্যুরে। কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকব। তোমার কি আর হোটেলে একা-একা বসে থাকতে ভাল লাগবে?

তবু তো চেঞ্জ!

আচ্ছা, পরের বার হবে।

আমাকে অ্যাভয়েড করছে?

ধ্রুব একটু কাঁচুমাচু হয়ে বলে, ঠিক তা নয়। তবে অনেক ঝামেলা আছে। আমরা ইচ্ছেমতো বউ নিয়ে বেড়াতে যেতে পারি না। শ্বশুরের পারমিশন নিতে হবে তোমাকে।

নিতে হলে নেব।

উনি দেবেন না।

কেন দেবেন না?

উনি আমাকে বিশ্বাস করেন না। দার্জিলিং-এ আমি কী কাণ্ড করেছিলাম মনে নেই?

মদ খাবে, এই তো? সে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।

আর যদি ফের মারপিট লাগে?

তা হলেও তো আমার সঙ্গে থাকা দরকার। তোমাকে দেখবে কে?

প্লিজ রেমি, চাপাচাপি কোরো না।

আমার সঙ্গ তোমার ভাল লাগে না?

ধ্রুব একটু হেসে বলল, কথাটা মিথ্যেও নয়। তোমার সঙ্গ বলে কথা নেই, আসলে আমি মেয়েদের বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারি না।

কেন পারো না?

রেগে যেয়ো না। গার্লস আর এ অফুল লট। তাদের এতরকম প্রবলেম থাকে।

আমি তোমাকে কখনও কোনও প্রবলেমের কথা বলি?

না। তবে তুমি নিজেই একটি জ্যান্ত প্রবলেম।

কীরকম?

ধ্রুব হাতঘড়ি দেখে বলল, অত সময় নেই রেমি। এ নিয়ে পরে কথা হবে।

রেমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলে, তুমি অনেক কথাই শুরু করে, কিন্তু শেষ করো না। মেয়েদের যদি তুমি অতই অপছন্দ করে তা হলে বিয়ে করেছিলে কেন?

একথার একটা পেটেন্ট জবাব আছে ধ্রুবর। সে বলে, বিয়ে আমি করিনি, বিয়ে আমাকে করানো হয়েছে। আমি মন্ত্র উচ্চারণ করিনি বিয়ের সময়। কিন্তু আজ ধ্রুব সে জবাব দিল না। বরং মুখে একটা অবাক ভাব ফুটিয়ে বলল, আমি বিয়ে না করলে তোমার বিয়ে হত কার সঙ্গে?

রেমি বলল, অনেক ভাল ছেলে ছিল। অনেক ব্রাইট, লাভিং, ব্রড-হার্টেড পাত্র জুটতে পারত।

তাই নাকি? তা হলে ম্যারেজেস আর মেড ইন হেভেন কথাটা সত্যি নয় বলছ?

মোটেই নয়।

আমার তো মনে হয় বিয়েটা বাস্তবিকই ভবিতব্য। আমি ছাড়া তোমার গতি ছিল না।

না, মোটেই না। আমি এ বিয়ে মানছি না।

ধ্রুব বড় বড় চোখে রেমির বিদ্রোহী চেহারাটার দিকে চেয়ে রইল। তারপর বলল, সাব্বাস! এই তো চাই।

তার মানে? ইয়ার্কি করছ নাকি?

ধ্রুব দুহাত রেমির কাঁধে রেখে বলে, না রেমি, একটুও ইয়ার্কি নয়। শোনো, আমি বাস্তবিকই তোমাকে বিয়ে করিনি। অন্তত স্বেচ্ছায় নয়। তুমি কি আমাকে স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছ?

রেমির চোখ ফেটে জল আসছিল। ফুসে উঠে বলল, তোমাকে চিনলে কখনও স্বেচ্ছায় বিয়ে করতাম না।

তোমার কোনও লাভার ছিল না?

না। কিন্তু তাতে কী?

ছিল। বলবে না। ঠিক আছে, শুনতে চাই না। তবে আমার মনে হয়, তোমার মতো সুন্দরী মেয়েদের লাভার না থাকাটাই অস্বাভাবিক।

রেমি ছিটকে সরে গিয়ে বলল, ঘোটলোক! ছুঁয়ো না আমাকে। তুমি ছুঁলে আমার ঘেন্না করে।

ধ্রুব হাসল। উদার গলায় বলল, আরে সিস্টার খুব রেগে যাচ্ছ। সেন্টুতে সুড়সুড়ি দেওয়ার জন্য কথাটা বলিনি মাইরি। আমি বলতে চাই, সত্যিই যদি কোনও লাভার থেকে থাকে তবে তার কাছেই তোমার ফিরে যাওয়া উচিত।

মুখে এল কথাটা তোমার? বলতে জিব সরল? ছিঃ!

আঃ, মাইরি! ফের তুমি সেন্টু হয়ে যাচ্ছ। কিন্তু আদত কথাটা যদি বুঝতে! তুমি কি জানোনা বা এতদিনেও টের পাওনি যে, কৃষ্ণকান্তর বখে যাওয়া এক ছেলেকে আবার লাইনে আনার জন্য তোমার মতো একটি সুন্দরী মেয়েকে ভারচুয়ালি উৎসর্গ করা হয়েছে। ঠিক যেভাবে পাঁঠা বলি দেয়! পারছ বুঝতে?

রেমির নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছিল রাগে। বলল, হ্যাঁ। এখন আমার তা-ই মনে হয়। তোমার মতো একজন লম্পট মাতালের সঙ্গে আমার বিয়ে দেওয়ার পিছনে হয়তো ওইটাই কারণ।

তা হলে? —বলে ধ্রুব খুব বিজ্ঞের মতো হাসল, এই বিয়ের বিরুদ্ধে কি তোমার বিদ্রোহ করা উচিত নয় রেমি? উচিত নয় কি আদালতে গিয়ে আইনের আশ্রয় নেওয়া! বলো!

উচিত। নিশ্চয়ই উচিত।

তা হলে তাই করো রেমি। ভাঙো, ভাঙো এই পরিবারের ভিত। কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রাচীনপন্থী, প্রগতিবিরোধী, সংকীর্ণমনা, মতলববাজ ও কায়েমি স্বার্থের এই বাস্তুঘুঘুর প্রতিষ্ঠানটিকে উড়িয়ে দাও। পাবলিকলি অপমান করো কৃষ্ণকান্ত চৌধুরীকে। লম্পট ধ্রুব চৌধুরীর মুখোশ খুলে দাও। কেন চুপ করে মেনে নিচ্ছো সব কিছু? এই পারিবারিক প্রতিষ্ঠানটির ভিত ভেঙে স্বাধীন ও মুক্ত হয়ে চলে যাও নিজের সত্যিকারের প্রেমিকের কাছে। জয়ি হও, মুক্ত হও, ঘৃণা করো আমাদের।

অভিনয়! পুরোটাই অভিনয়! কিন্তু তবু কী চমৎকার অভিনয়! ধ্রুব রওনা হয়ে যাওয়ার একঘণ্টা। বাদে রেমি বিছানায় বসে আনমনে আঙুল দিয়ে বিছানায় আঁকিবুকি করতে করতে আপনমনে হাসছিল, পাগল! একটা পাগল!

ফুল ফুটলে পতঙ্গ আসেই। সেই অর্থে রেমিরও কি প্রেমিক ছিল না দু-একজন? ছিল। দাদার বন্ধু মানিকদা। দারুণ চেহারা, ইঞ্জিনিয়ার। সন্তু নামে পাড়ার একটি বেকার ছেলে। দায়ে-দফায় এসে সব সময় হাজির হত। একজন অধ্যাপক ছিলেন চিন্ময় সান্যাল নামে। চমৎকার মানুষ। একটু নরম। হয়ে পড়েছিলেন তার প্রতি। রাস্তায় ঘাটে কতবার সপ্রশংস বা লোভী চোখ তাকে অনুসরণ করেছে। কিন্তু প্রেম করার অবকাশ ঠিক পায়নি সে। বড্ড অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে গেল। তবে আজ তার মনে হয়, পৃথিবীর আর কোনও পুরুষ নয়, আর কেউ নয়, একজনকেই তার চাই। পুরোপুরি চাই। যে লোকটা তাকে এত অপমান করে নাকের ডগা দিয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে গেল। তার প্রতি যার এত উপেক্ষা। এত উদাসীনতা। ওই পাগলকে সে একদিন বলবে, এসো, বিয়ে ভেঙে দিই। আমি কুমারী হয়ে যাই, তুমিও কৌমার্যে ফিরে যাও। তারপর আমার স্বয়ংবর হোক। কাকে মালা দেব জানো? আহাম্মক কোথাকার? বোঝো না?

বউমার উড়ুউড় ভাবটা ব্যস্ততার মধ্যেও একদিন লক্ষ করেন কৃষ্ণকান্ত। ডেকে বলেন, দামড়াটা ব্যাঙ্গালোর না কোথায় গেছে যেন!

হ্যাঁ।

তোমাকে চিঠিপত্র দিয়েছে?

না।

ফোন-টোনও করে না?

না।

চমৎকার। হিরের টুকরো আর কাকে বলে! কোন হোটেলে আছে তাও বোধহয় জানো না?

রেমি মাথা নেড়ে বলে, না। বলে যায়নি।

দিন সাতেক হল বোধহয়।

তা হয়েছে।

কৃষ্ণকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, এবার থেকে যখন বাইরে যাবে তখন ওর হোটলের নামটা অন্তত জেনে নিয়ো। তোমার মুখ দেখেই মনে হচ্ছে, দামড়াটার জন্য দুশ্চিন্তা করছ। কিন্তু তাতে লাভ নেই। কাল বোধহয় লতু দক্ষিণেশ্বর যাবে। সঙ্গে জগা থাকবে। গাড়ি যাচ্ছে। ওই সঙ্গে তুমিও ঘুরে এসো গে যাও। লতুটা তোমার সঙ্গে মেশে-টেশে, না কি নিজের বন্ধু-টন্ধু নিয়েই মত্ত থাকে?

প্রশ্নটা খুবই প্রাসঙ্গিক। রেমির ননদ লতু বউদিকে প্রচণ্ড ভালবাসে বটে, কিন্তু তার কলেজ এবং বাইরের জগৎটা বড্ড বেশি বড়। তা ছাড়া এই বয়সেই সে নানারকম সোশ্যাল ওয়ার্ক করে বেড়ায়। ফলে বউদির জন্য তার দেওয়ার মতো সময় থাকে না। একজন ভাসুর ও একটি দেওর আছে রেমির। তারা প্রায় না থাকার মধ্যেই। ভাসুর দেরাদুন মিলিটারি স্কুল থেকে পাশ করে এখন সামরিক বাহিনীর উঁচু পোস্টে বসে আছে পুনায়। বিয়ের পর তাকে এক-আধবার দেখেছে রেমি। অবাঙালির মতো চেহারা। লম্বা চওড়া। একজন ডিভোর্সি মারাঠি ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করার পর থেকেই এ বাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্ক একরকম চুকে গেছে। তার নামও কেউ উচ্চারণ করে না। দেওর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে রুরকিতে। বড় একটা আসে না। এলেও বউদির সঙ্গে খুব একটা কথাটথা বলে না। লজ্জা পায় বোধহয়। সুতরাং এ বাড়িতে রেমি একরকম একা।

একা যেমন, তেমনি আবার একচ্ছত্র আধিপত্যও তার। কৃষ্ণকান্ত ইদানীং তার হাতেই সংসার খরচের টাকা পয়সা দিচ্ছেন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করছেন তাকে। স্বামীর কাছ থেকে যা সে পায় না। তার সেই শূন্যতাকে পূরণ করার এ এক অক্ষম চেষ্টা।

রেমি পরদিন দক্ষিণেশ্বর গেল না। কেন যাবে? তার তত বেড়াতে ইচ্ছে করে না একা একা। একা ছাড়া কী? লতু, জগাদা এরা থাকলেও তার একাকিত্ব ঘোচে না কিছুতেই।

পেটের বাচ্চাটা যদি থাকত তা হলে হয়তো এত একা লাগত না। শরীরের মধ্যে আর একটা শরীর। তার প্রাণস্পন্দন টের পেত রেমি। তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখত। ধ্রুবর অভাব তাতেই পূরণ হয়ে যেত অনেকটা।

কেন মারল ধ্রুব? কেন? ধ্রুবর কাছ থেকে সত্যিকারের জবাবটা আজও পায়নি রেমি। কেন বাচ্চা হবে শুনে সাদা হয়ে গিয়েছিল ওর মুখ? কোথায় বাধা ছিল?

দশদিন বাদে ধ্রুব ফিরল। হা-ক্লান্ত চিমসে চেহারা হয়ে গেছে। ট্যাকসি থেকে নেমেই রেমিকে বলল, শিগগির ভাত খাওয়াও। দশদিন প্রায় আধপেটা খেয়ে ছিলাম।

তখন অবেলা। বিকেলের ফ্লাইটে ধ্রুব ফিরেছে। তবু প্রশ্ন না করে আগে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল রেমি। পুরুষমানুষ বড় একটা খিদে সহ্য করতে পারে না।

খাওয়ার টেবিলে মুখোমুখি বসে রেমি জিজ্ঞেস করল, রোগা হয়ে গেছ কেন?

ধ্রুব ফিচেল হেসে বলল, বিরহে।

বিরহ কেমন তা তুমি জানো?

আহা তোমার বিরহে নয়।

তবে কার বিরহে?

বিরহ ফর ফুড। দক্ষিণ ভারতের খাবার সহ্য হচ্ছিল না।

রেমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তাই বলো।

ধ্রুব চোখের কোনা দিয়ে তাকে একবার দেখে নিয়ে বলল, তোমার শরীরটা তো তেমন কৃশ দেখছি না।

দেখবে কেন? কৃশ তো হইনি।

অথচ হওয়ার কথা।

কেন? হওয়ার কথা কেন?

রওনা হওয়ার সময় মনে হচ্ছিল তুমি খুব বিরহ ফিল করছ।

মোটেই নয়।

একদম করোনি?

না। বিরহটা একতরফা তো হয় না।

দূর মাইরি! তুমি একদম উলটপুরাণ। বিরহ চিরকালই একতরফা।

তাই নাকি?

কেষ্টর জন্য রাধা যত কেঁদেছিল, তার টুয়েন্টিফাইভ পারসেন্টও কেষ্ট কাঁদেনি।

তোমার সেই টুয়েন্টিফাইভ পারসেন্টও বোধহয় নেই।

না। তবে তোমার জন্য আমি ফিল করি।

সেটা কীরকম?

একটা বাজে লোকের জন্য তোমাকে অনেক স্যাক্রিফাইস করতে হচ্ছে।

তা হচ্ছে।

আমি সেটা ফিল করি।

শুধু ফিল করলেই হবে? তোমার কিছু করার নেই?

ধ্রুব মাথা নেড়ে বলে, আমার নেই। কিন্তু তোমার আছে।

কী করব?

ওই যে বলেছিলাম, এ বাড়ির ভিত নাড়িয়ে দাও। ভাঙো, আগুন জ্বালো।

এ বাড়ির ওপর তোমার এত রাগ কেন?

রাগ তোমারও হওয়ার কথা ম্যাডাম।

কেন তা আগে বলো।

এরা ভণ্ড, অহংকারী, রক্তের বিশুদ্ধতায় বিশ্বাসী।

তাই নাকি?

ধ্রুব মাথা নেড়ে বলে, কেন, তুমি কি জানো না?

কী জানব?

বুদ্ধি থাকলে বুঝতে পারতে।

আমার বুদ্ধি নেই। বুঝিয়ে দাও।

নির্বোধদের মাথায় কোনও ফ্যানটাস্টিক আইডিয়া ঢোকাতে নেই, রেমি। তাতে সে খেপে উঠে যাচ্ছেতাই কাণ্ড করে বসতে পারে।

আমি কি ততটাই নির্বোধ?

তা কে জানে! তুমি নিজেই তো নিজেকে নির্বোধ বললে।

তুমি আমাকে একটা কিছু বলতে চাইছ। কিন্তু পারছ না। কেন বলো তো?

আমার কিছু বলার নেই।

আছে। আমি জানি।

ওসব এখন বাদ দাও। আমি টায়ার্ড অ্যান্ড হাংরি।

ঠিক আছে। পরে বোলো। আমি অপেক্ষা করব।

ধ্রুব অবাক হয়ে বলল, মনে হচ্ছে, তোমারও কিছু বলার আছে।

আছে। আমি তোমাদের রক্তের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।

ধ্রুব একটু ম্লান হেসে বলল, ব্লাড ইজ এ স্ট্রেঞ্জ থিং।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *