1 of 3

০৪৫. কয়েকদিন যাবৎ অনেক ভাবলেন হেমকান্ত

কয়েকদিন যাবৎ অনেক ভাবলেন হেমকান্ত। অবস্থা গতিকে যা দাঁড়িয়েছে তাতে বিনোদচন্দ্রকে কিছুতেই আর চক্ষুলজ্জা বজায় রেখে এ বাড়িতে অধিষ্ঠান করতে দেওয়া যায় না। অথচ মনু চলে যাবে, একথা ভাবতেও পারেন না হেমকান্ত। মনু তো একটা মেয়েই মাত্র নয়, সে তার অস্তিত্বেরই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ।

হেমকান্ত দাপট দেখাতে জানেন না। কৌশল বা কূটবুদ্ধিও তার নেই। তবু মাথা খাটিয়ে অনেক ফন্দি-ফিকির বের করার চেষ্টা করলেন। বলা বাহুল্য, কোনওটাই তেমন গ্রহণযোগ্য মনে হল না।

এর মধ্যেই একদিন কনককান্তি কলকাতায় রওনা হয়ে গেল। তবে বউ আর ছেলেমেয়েকে রেখে গেল কিছুদিনের জন্য। এখনও বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ। চপলারও তেমন যাওয়ার ইচ্ছে নয়। ঠিক হল, পরে কেউ গিয়ে ওদের কলকাতায় পৌঁছে দেবে।

কনককান্তি চলে যাওয়ায় একটু হাঁফ ছাড়লেন হেমকান্ত। ছেলেদের সঙ্গে তাঁর একটা অপরিচয়ের ব্যবধান আছে। তার ওপর ওদের সামনে তিনি নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা তেমন জোরের সঙ্গে প্রকাশ করতে পারেন না। কেমন যেন মিইয়ে যান, প্রতিরোধহীন হয়ে পড়েন। এটাই হয়তো ব্যক্তিত্বহীনতা। তাই কনককান্তি চলে যাওয়ায় তার মনের ওপর থেকে একটা চাপ সরে গেল। মাথায় সম্ভব-অসম্ভব বুদ্ধিও খেলতে লাগল অজস্র।

একদিন সকালে তিনি বিনোদচন্দ্রকে ডেকে পাঠালেন বৈঠকখানায়। বিনোদচন্দ্র ভারী ভীত ও বিষণ্ণ মুখে এসে দাঁড়ালেন। উচ্ছেদের ভয় মানুষের এক মস্ত শত্রু। বিনোদচন্দ্র হাত কচলাচ্ছেন। ব্রাহ্মণোচিত তেজবীর্য তার কোনওদিনই ছিল না। আজ বিরূপ পরিস্থিতিতে মেরুদণ্ড আরও নুয়ে গেছে।

হেমকান্ত আড়চোখে বিনোদচন্দ্রের অবস্থাটা লক্ষ করে বললেন, আপনি সংস্কৃত কীরকম জানেন ঠাকুরমশাই?

কিছু কিছু জানি।

কিছু মানে কতটা?

কাব্য পাশ করেছি।

সে তো বহু কাল আগে। চর্চা কি আছে?

আছে একটু-আধটু।

যদি একটা চতুষ্পঠী খুলি তা হলে পড়াতে পারবেন?

পারব।

এমনিতে পারবেন না। একটু ঝালিয়ে নিতে হবে।

আজ্ঞে, তাও নেব।

আপনার শরীর কেমন?

বড় দুর্বল লাগে। মাথাটা ঘোরেও মাঝে মাঝে।

তা হলে কী করে পারবেন? লক্ষ্মীকান্ত কি সংস্কৃত জানে?

সামান্য জানে।

তা হলে সেও পারবে না।

যদি চেষ্টা করে তা হলে পারবে।

হেমকান্ত একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, আপনাদের বৃত্তিই তো পৌরোহিত্য। তার ওপর মন্ত্র-টন্ত্রও দেন। আপনারা সংস্কৃত চর্চা করেন না কেন?

বিনোদচন্দ্র কাঁচুমাচু মুখ করে মেঝের দিকে চেয়ে রইলেন।

হেমকান্ত বললেন, সংস্কৃতজ্ঞান আপনার কুলকর্মের পক্ষেই একান্ত দরকার। সেটাও যদি না থাকে তবে কী করে কাজ হবে বলুন তো! শুধু একটু নিত্যপূজা আর পঞ্জিকা দেখে শুভকর্মের দিন স্থির করা এইতেই কি সব হয়?

আজ্ঞে, আমি তো কোষ্ঠীও করে থাকি।

হেমকান্ত ভ্রুকুটি করে বললেন, তবে তো হয়েই গেল। কোষ্ঠী করা কি একটা সাংঘাতিক কাজ নাকি?

বিনোদচন্দ্র ফের হাত কচলাতে থাকেন।

হেমকান্ত যথার্থ রূঢ় হতে পারেন না। তার স্বভাবেই সেটা নেই। তাই একটু পরেই গলা নরম করে বললেন, সে যাই হোক। কৃষ্ণকান্তকে আমি একটু সংস্কৃত শেখাতে চাই। ছেলেটি মেধাবী বলেই মনে হয়। আপনি কি কাজটা পারবেন?

আজ্ঞে, খুব পারব।

ভেবেচিন্তে বলুন।

পারব।

লোভের বশবর্তী হলে মানুষ অনেকরকম সম্ভব-অসম্ভব চিন্তা করে, পারগতার কথা ভাবে না। হেমকান্ত তা জানেন বলেই বিনোদচন্দ্রের মুখের দিকে কিছুক্ষণ চিন্তিত ভাবে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, শিক্ষা যেটুকু দিতে পারেন সেটুকুই দেবেন। কিন্তু ভুল শেখাবেন না। এই বয়সে কোনও শিক্ষার মধ্যে ভুল থেকে গেলে তা আর পরে বড় একটা শোধরায় না।

আজ্ঞে, আমি খুব যত্ন করে শেখাব।

হেমকান্ত মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, যদি ওর শিক্ষার ভার আপনাকে দেওয়া হয় তা হলে আপাতত আপনারা এ বাড়িতেই থাকবেন।

বিনোদচন্দ্রের বিমর্ষ মুখ কিছু উজ্জ্বল হল। তবে ভয়টা একেবারে কাটল না। খুব চিন্তিত গলায় বললেন, আমার আর দিন বেশি বাকি নেই। যে কটা দিন আছি এ বাড়িতেই যদি থাকতে দেন।

হেমকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, সেরকম কথা দিতে পারি না। এস্টেটের অবস্থা ভাল নয়। আদায়-উসুল সামান্য। খাজনা বাকি পড়ছে। যুগও পালটাচ্ছে। এখন ছেলেদের সিদ্ধান্তও ভেবে দেখতে হবে। তাই সব অবস্থার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখুন। সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

যে আজ্ঞে।

কটা দিন বইপত্র নাড়াচাড়া করে নিন। চর্চার অভাবে অনেক কিছুই ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক। বইটই যদি কিছু লাগে তবে কাছারিতে বলে দেবেন, ওরা আনিয়ে দেবো।

বিনোদচন্দ্র বিদায় নিলে হেমকান্ত ভাবতে লাগলেন, কাজটা ঠিক হল কি না। মনুর প্রতি তার দুর্বলতার কথা বোধহয় সর্বজনবিদিত। সেক্ষেত্রে যে কাজটা তিনি করলেন তা যে মনুকে কাছে রাখার জন্যই এটা সবাই টের পেয়ে যাবে। কিন্তু তিনি আর কীই-বা করতে পারতেন!

উঠে আস্তে আস্তে কাছারি পেরিয়ে ঠাকুরদালানের দিকে এগিয়ে গেলেন হেমকান্ত। আজকাল কেন যেন তার কিছুই তেমন ভাল লাগে না। কেন লাগে না তা টের পান মাঝে মাঝে। চমকে ওঠেন। বড় বউমা আসার পর মনু আর অনায়াসে তার কাছে আসতে পারে না। আর মনুর সঙ্গে দেখা হয় না বলেই ক্রমে ক্রমে দিনক্ষয় তার কাছে আলুনি লাগে।

ঠাকুরদালানের দিকে বহুকাল আসেননি। দূর থেকে শাখ, ঘণ্টা, কাঁসর শোনেন। তবে নিজে আসেন না। ঠাকুর-দেবতার প্রতি তেমন কোনও আকর্ষণ নেই তার। তিনি অবশ্য নাস্তিকও নন। তাকে নির্বিকার বলা যায়।

সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে তিনি চমৎকার একটা গন্ধ পেলেন। নানারকম ফুল, বেলপাতা, আম্রপল্লব, চন্দন, ধুনোর বহুদিনকার সঞ্চিত গন্ধ। মনটাকে ভিজিয়ে দেয়। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলেন। মন্দিরটার কিছু সংস্কার প্রয়োজন। শ্বেতপাথরে বাঁধানো মেঝের পাথরগুলোর জোড় খুলে এসেছে। থামে ফাটল। পলেস্তারা খসেছে। তবু বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। মন্দিরে মার্জনার কাজটুকু মনু করে, তিনি জানেন।

হেমকান্ত অনুচ্চ স্বরে ডাকলেন, মনু! মনু আছো নাকি?

রঙ্গময়ি মন্দিরের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। পরনে পাটের লালপেড়ে শাড়ি, কপালে তেলসিদুরের ফেঁটা, চোখে বিস্ময়।

তুমি!

তোমার খোঁজে এলাম। আজকাল তো দেখা দাও না।

রঙ্গময়ি মৃদু একটু হাসল, তবু ভাল। দেখা চাও তা হলে!

হেমকান্তর রসিকতাবোধ লুপ্ত হয়েছে। মন বড় অস্থির। আবেগ-কম্পিত। হঠাৎ বললেন, আমরা কে কতদিন বেঁচে থাকব, মনু?

তার মানে? আবার ওসব কথা কেন?

আমাদের আয়ু যে ফুরিয়ে আসছে। তোমার আমার।

বালাই ষাট। আয়ু ফুরোবে কেন! কোন দুঃখে?

ঠাট্টা কোরো না। আমার মন ভাল নেই।

রঙ্গময়ি একটা আসন বের করে পেতে দিল বারান্দায়। বলল, বোসো।

হেমকান্ত বসলেন। বললেন, আমার মন বড় অস্থির, মনু।

কেন অস্থির?

মনে হচ্ছে তোমাকে ছাড়া আমার পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব।

রঙ্গময়ি হেমকান্তর ঈষৎ স্খলিত ও সামান্য কম্পিত কণ্ঠস্বর লক্ষ করে। এতটা আবেগ হেমকান্তর মধ্যে সে কখনও দেখেনি। ঠান্ডা মেঝের ওপর হেমকান্তর মুখোমুখি বসে সে মেঝেতে আঙুলের দাগ দিতে লাগল। তারপর মৃদুস্বরে বলল, এটা তুমি এতদিনে বুঝলে? আমি তো জানিই, আমি চলে গেলে তুমি টিকতে পারবে না এখানে। তাই এত অপমান সয়েও পড়ে আছি। শুধু তোমার জন্যে।

কে তোমাকে অপমান করে, মনু?

কে না করে বলো! তাদের নাম শুনলে কী করবে? মাথা কাটবে?

না। কিন্তু তোমাকে অপমান করে কেন?

করে সেটা নিয়ম বলেই। বামুনঘরের আইবুড়ো মেয়ে। তার ওপর অনেক রটনাও তো আছে।

তোমার অনেক কষ্ট, না মনু?

অনেক। কিন্তু সেগুলোর ভাগ নিতে যেয়ো না। সইতে পারবে না।

কষ্টের ভাগ নিতে কে চায় বলো! কিন্তু তোমার জন্য আমার মন খারাপ লাগে।

সেটুকুই আমার যা কিছু ভরসা। বোঝো না?

হেমকান্ত খানিকক্ষণ ঝুম হয়ে বসে রইলেন। গ্রীষ্মের বেলা বাড়ছে। রোদের তাপে তেতে উঠছে মেঝে। হেমকান্ত ঘামছেন। কিন্তু এসব তেমন খেয়াল করছেন না। অনেকক্ষণ বাদে বললেন, তোমাকে আজ স্পষ্ট করে কথাটা বললাম। বলে একটু লজ্জাও করছে।

লজ্জার কী?

তুমি কী ভাববে।

সেই এইটুকু বয়স থেকে যা ভেবে আসছি তা কি আর পালটায়?

শোনো, তোমাদের এ বাড়িতে রেখে দেওয়ার একটা ব্যবস্থা বোধহয় হয়ে যাবে। আমি তোমার বাবাকে বলেছি কৃষ্ণকান্তকে সংস্কৃত পড়াতে।

রঙ্গময়ি চোখ কপালে তুলে বলে, কবে বললে?

আজই। একটু আগে।

সর্বনাশ। বাবা কি সংস্কৃত জানে নাকি?

জানে না? একটু-আধটু নয়?

রঙ্গময়ি হেসে ফেলে বলে, সে যা জানে তা না জানার মতোই। তুমিও একটা পাগল। বলার আগে আমার সঙ্গে পরামর্শ করে নাওনি কেন?

হয়তো করা উচিত ছিল। কিন্তু ভাবলাম তোমাদের নিয়েই যখন সমস্যা তখন তুমি হয়তো এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাইবে না। লজ্জা পাবে। তোমার আত্মসম্মানবোধও তো সাংঘাতিক।

রঙ্গময়ি স্নিগ্ধ চোখে হেমকান্তর দিকে চেয়ে স্মিতমুখে বলে, আত্মসম্মানজ্ঞান? ও কথা বোলা। সব ভাসিয়ে দিয়েছি জলে। নিজের মধ্যেই তো আমি নিজে থাকি না। সব সময়ে শুধু ভাবি আর তো কেউ তোমাকে বোঝে না। আমি চলে গেলে তোমার কী হবে!

হেমকান্ত কয়েকবার গলা খাঁকারি দিলেন। ব্রহ্মপুত্রের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, কাজটা কি তা হলে ঠিক হয়নি?

কৃষ্ণকে সংস্কৃত পড়ানোর কাজটা তো? না, ঠিক হয়নি।

তা হলে কী হবে?

বাবা সংস্কৃতের চর্চা কোনওকালেই তেমন করেননি। দাদা তো আরও অগামার্কা। কৃষ্ণ মাথাওয়ালা ছেলে, ওকে পড়ানো কি যার-তার কাজ?

তা হলে একটা উপায় তো কিছু করতে হবে।

সেজন্য তুমি ভেবো না। ওকে আমিই পড়াতে পারব।

তুমি সংস্কৃত জানো?

টোলে চতুম্পাঠীতে শিখিনি। তবে হাতে কাজ নেই বলে বসে বসে উপক্রমণিকা নাড়াচাড়া করতাম। তারপর একটু-একটু করে খানিকটা শিখেছি। নিজে নিজেই।

বলো কী?–হেমকান্তর গলায় সত্যিকারের বিস্ময়।

এমন কিছু হাতিঘোড়া কাজ নয়। তোমার তো মনে নেই, কৃষ্ণকে আমি প্রথম থেকেই অ আ ক খ শেখাতাম। এখনও ওর সব বইপত্র আমি নাড়াচাড়া করি। একটু-একটু বুঝিও। ওকে পড়ানো শক্ত হবে না।

তোমার বাবাকে তা হলে কী বলব?

তোমাকে কিছু বলতে হবে না। আমিই বলব।

বাঁচালে।

রঙ্গময়ি একটু হাসল। তার চোখে-মুখে এক আশ্চর্য দীপ্তি দেখা যাচ্ছে। এমনটি আর কখনও দেখেননি হেমকান্ত। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন। রঙ্গময়ি চোখ নামিয়ে নিল। মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ নাতি-নাতনি নিয়ে?

ভালই তো। শুধু তোমার অভাব।

সব কি একসঙ্গে পাওয়া যায়?

বউমার সঙ্গে কি তোমার ভাব নেই, মনু? তা হলে যাও না কেন?

ভাব আছে। আর সেটাকে রাখতে চাই বলেই যাই না।

সে তোমার যা বিবেচনা। তবে আজকাল বউমা সবসময়ে তো বাড়িতে থাকে না। বেড়াতেটেড়াতে যায় বোধহয়। তখন ফাঁকমতো যেয়ো।

রঙ্গময়ি একথায় একটু গম্ভীর হল। বলল, চোরের মতো যাব কেন?

হেমকান্ত রহস্য করে বললেন, কিন্তু তুমি তো চোরই। বরাবর পরের ধনে তোমার পোদ্দারি।

সেটা আবার কী? কার ধনে?–বলে রঙ্গময়িও হেসে ফেলে।

ঠিক বলিনি?

রঙ্গময়ি মাথা নেড়ে বলে না, ঠিক বলোনি। তুমি কখনও পরের ধন ছিলে না।

তাই নাকি?

তা ছাড়া আবার কী? সুনয়নী তোমাকে স্বামী হিসেবে পেয়েছিল সে তার ভাগ্য। আমি তো সেভাবে পাইনি। কিন্তু পাই বা না-পাই, জিনিসটা যে আমার তা আমি মনে মনে জানি।

হেমকান্ত ভেবেছিলেন, তিনি এই পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে যথেষ্ট বুড়ো হয়ে পড়েছেন। কিন্তু লজ্জারক্তিম মুখশ্রী, ফুরিতাধর এবং নতচক্ষু নিয়ে অকপট গভীর গলায় রঙ্গময়ি যা উচ্চারণ করল তা শুনে তার ভিতরে যৌবনোচিত এক শক্তি জেগে উঠল যেন। তিনি ইচ্ছে করলে এখন সেই যুবা বয়সের মতোই এক সাঁতারে ব্রহ্মপুত্র এপার ওপার করতে পারেন, হাজারবার মুগুর ঘোরাতে পারেন, মাইলের পর মাইল নৌকো বেয়ে চলে যেতে পারেন।

হালকা শরীর ও ফুরফুরে মন নিয়ে হেমকান্ত উঠলেন। বললেন, ঠাকুরদালানকে অনেকক্ষণ অপবিত্র করেছি। আমি অভক্ত মানুষ।

রঙ্গময়ি মৃদুস্বরে বলল, তার চেয়েও বড় কথা, এতক্ষণ ধরে অনেক জোড়া চোখ আড়াল-আবডাল থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে তোমাকে আর আমাকে দেখেছে। এসো গিয়ে এখন। ভয় পেয়ো না, আমাকে মেরে না তাড়ালে আমি এ বাড়ি ছেড়ে যাব না।

হেমকান্ত একটা স্বস্তির বড় শ্বাস ছাড়লেন।

যখন নামছেন তখন রঙ্গময়িও কয়েক ধাপ সিঁড়ি সঙ্গে নামল। হঠাৎ মৃদুস্বরে বলল, একটা কথা।

বলো।

বড় বউমার ওপর একটু নজর রেখো।

তার মানে?

সব কথার কি মানে হয়?

হেমকান্ত ভ্রুকুটি করে বললেন, তুমি কোনও কথাই খামোকা বলো না। নজর রাখার প্রয়োজন কী? চপলা কি ছেলেমানুষ?

ছেলেমানুষ ছাড়া আর কী? কতই বা বয়স?

কীভাবে নজর রাখা সম্ভব? আর ও কীই-বা করছে?

রঙ্গময়ি চুপচাপ একটু দাঁড়িয়ে রইল। ভাবল। তারপর বলল, আচ্ছা, সেটা পরে বলা যাবে। সুযোগমতো।

রহস্য রাখছ? জানো তো, এসব ইঙ্গিতপূর্ণ কথা শোনার পর আমি কীরকম উদ্বেগে থাকব!

জানি। তাই কথাটা বলেই মনে হল ভুল করলাম।

আসল কথাটা কী?

তুমি বরং ওকে তাড়াতাড়ি কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে দাও।

আমি ব্যবস্থা করলে কী হবে? বউমা নিজেই তো যেতে চাইছে না বলে শুনেছি।

ঠিকই শুনেছ। আর সেজন্য কনকের সঙ্গে বউমার কিছু কথা কাটাকাটিও হয়। সে খবর রাখো!

আমি কোনও খবরই রাখি না, মনু। কেউ আমাকে কিছু বলে না। ওদের কথা কাটাকাটি হল কেন?

কনকের ইচ্ছে ছিল না চপলাকে রেখে যেতে।

তবে গেল কেন?

সেইটেই তো কারণ। চপলা যায়নি। এদিকে বিশাখার সঙ্গেও চপলার বনিবনা হচ্ছে না। তুমি বোধহয় সে খবরও রাখো না।

না। বলেছি তো, খবর আমি পাই না, বনিবনা হচ্ছে না কেন?

কারণটা শুনতে চাও?

বড় কথা ঘোরাও তুমি।–হেমকান্ত বিরক্ত হলেন।

বলছি। রাগ কোরো না কিন্তু। যা বলছি তা চুপ করে শুনবে। তারপর ঘরে গিয়ে ব্যাপারটা ভাববে।

ঠিক আছে। বলো।

বড় বউমা শচীনের সঙ্গে বড্ড বেশি মাখামাখি করছে।

হেমকান্ত হতভম্ব হয়ে যান। তারপর বলেন, কী করছে?

আঃ এত জোরে নয়। বলেছি না চুপ করে শুনবে।

হেমকান্ত রঙ্গময়ির মুখের দিকে পলকহীন চেয়ে থেকে বললেন, আমি যে কথাটা ভাল বুঝতেই পারছি না।

এখন বুঝবেও না। ঘরে গিয়ে ভাবো একটু। আর বড় বউমার ওপর একটু নজর রাখো। দাসীর কথা বাসি হলে মিষ্টি হয়।

বজ্রাহত হেমকান্ত ঘরে ফিরে এলেন। এরকম সুন্দর একটি সকালের যে এমন পরিণতি হবে তা তিনি আশা করেননি। ঘরে বসে অনেকক্ষণ রঙ্গময়ির কথাটা ভাবলেন। ভেবে মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারলেন না। ইঙ্গিতটা অবশ্য স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল। কিন্তু সেই ইঙ্গিত তার মন গ্রহণ বা অনুবাদ করতে চাইছিল না।

খাওয়ার সময় চপলা সামনে ছিল আজ। বারবার তার মুখের দিকে চেয়ে দেখলেন হেমকান্ত। মানুষ, বিশেষ করে মেয়েমানুষ সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা এত কম যে, মুখ দেখে কিছু অনুমান করা খুবই কঠিন।

চপলা বলল, বাবা, আজ কিছুই খাচ্ছেন না।

খিদে নেই।

শরীরটা কি খারাপ?

না মা, এই বয়সে একটু কম খাওয়াই ভাল।

আপনার বয়স তো তেমন কিছু নয় বাবা। আমার বাবারও তো একই বয়স। বাবা এখনও যা খেতে পারেন!

ওঁর কথা আলাদা। উনি শিকারি মানুষ। মজবুত স্বাস্থ্য।

তা অবশ্য ঠিক।

ছেলের বউ শ্বশুরের সঙ্গে এত কথা বলে এটা সুনয়নীর পছন্দ ছিল না। কিন্তু সুনয়নী নেই। তাই পরদা সরে গেছে। হেমকান্ত আজ চপলার সঙ্গে কথা বলতে কেমন যেন বিব্রত হচ্ছেন বারবার। মনে হচ্ছে, স্ত্রীর মতো কেউ একজন থাকা দরকার ছিল। স্ত্রী অনেক কিছু সামাল দেয়।

হেমকান্ত হঠাৎ বললেন, বিশাখাকে দেখছি না!

সে তো নিজের ঘরে।

ভাল আছে তো?

আছে। ডাকব?

না। দরকার কী? হয়তো কাজ-টাজ কিছু করছে।

চপলা আর-কিছু বলল না এ প্রসঙ্গে। পরিবেশন করতে করতে বলল, সেদিন আপনি এসরাজ বাজালেন না বাবা, আপনার এসরাজ আর শোনাই হল না।

ও আমি ভুলে গেছি।

এসব কি মানুষ ভোলে! আমাদের খুব ইচ্ছে একদিন শুনি।

আচ্ছা, দেখা যাবে।

একদিন জলসা বসাব বাবা?

জলসা! না, তার দরকার নেই।–হেমকান্ত আবার এই প্রগৰ্ভতার সামনে অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন।

আপনি এসরাজ বাজাবেন। শচীনবাবু গান গাইবেন। বেশ জমবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *