সারারাত পুলিশ হোটেল ঘিরে রইল বটে, কিন্তু সন্ধের পর কিছু ছেলেছোকরা জুটে দুর থেকে ঢিল আর কিছু গালাগাল ছুড়তে লাগল। হোটেলের কয়েকটা কাচ ভাঙা ছাড়া তেমন গুরুতর ঘটনা নয় সেটা। তবু ভয়ে কাঁপুনি ধরে গেল রেমির। ভয়ে মুখে কথা আসছে না, রক্তহীন ফ্যাকাসে মুখে বিছানায় কম্বল জড়িয়ে বসে রইল সে।
ধ্রুব একবার বলল, তুমি খুব ঘাবড়ে গেছ। একটু ব্রান্ডি খাবে? খেয়ে শুয়ে পড়ো। গা-ও গরম হবে, ঘুমও চলে আসবে।
রেমি মাথা নেড়ে জানাল, খাবে না।
ধ্রুব আর সাধল না। পাজামা চড়িয়ে, শাল চাপিয়ে ঘর থেকে বেরোনোর মুখে বলল, সমীর বোধহয় এখনও আছে। ওকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। একটু কমপ্যানি দিতে পারবে।
রেমি হঠাৎ উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করে, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
লাউঞ্জে। পুলিশ থেকে আমার একটা স্টেটমেন্ট নিতে এসেছে।
আমিও যাব।–বলে উঠতে গেল রেমি। কিন্তু পায়ে একরত্তি জোর পেল না সে। শরীরে ঠকাঠক কাঁপুনি। পা দুটো অবশ। আবার বসে পড়ল।
ধ্রুব উদাস গলায় বলল, গিয়ে কী লাভ? আমি আবার মদ খাই কি না দেখতে চাও? খেলেও তো ঠেকাতে পারবে না।
ধ্রুব বেরিয়ে যাওয়ার পর রেমি টেলিফোনে কলকাতার লাইন চাইল। লাইটনিং কল। মিনিট পনেরো সময় যেন অন্তহীনতায় প্রসারিত হতে লাগল। পনেরো মিনিটের মধ্যেই সে পি বি এক্স অপারেটরকে বার দুই তাগাদা দিল এবং কৃষ্ণকান্তর ফোন নম্বর মনে করিয়ে দিল।
অবশেষে কৃষ্ণকান্ত লাইনে এলেন, বউমা, তোমরা ভাল আছ তো?
বাবা, আমাদের ভীষণ বিপদ। চারদিক ঘিরে ফেলেছে গুন্ডারা, ঢিল মারছে। আমরা বোধহয় দার্জিলিং থেকে আর ফিরতে পারব না।
কৃষ্ণকান্ত একটু চিন্তিত গলায় বলেন, কেন, এখনও পুলিশ পিকেট দেয়নি?
দিয়েছে, কিন্তু তবু আমরা বোধহয় ফিরতে পারব না।
দরকার হলে পুলিশ গুলি চালাবে। তুমি চিন্তা কোরো না।
গুলি!–বলে আর্তনাদ করে ওঠে রেমি, গুলি চালাবে কেন?
কৃষ্ণকান্ত একটু হাসলেন, গুলি চালাতে হয়তো হবে না, কিন্তু ছেলেগুলো যদি বাড়াবাড়ি করে তাহলে তো একটা কিছু করতে হবে। কী বলো?
তা বলে গুলি? আমি তা হলে ভয়েই মরে যাব।
কৃষ্ণকান্ত শান্ত স্বরেই বললেন, লামা নামে একজন লোক তোমার সঙ্গে দেখা করবে। তোমার কাছে বোধহয় হাজার তিন-চারেক টাকা এখনও আছে, না?
আছে, বাবা। আপনি যা দিয়েছিলেন তার কিছুই খরচ হয়নি। পুরো পাঁচ হাজারই আছে।
ঠিক আছে। ওটা থেকে লামাকে দুহাজার টাকা দিয়ো।
দেব, কিন্তু এই বিপদ থেকে কী করে বেরোব বাবা?
ওটা নিয়ে তো আমি ভাবছি। কিন্তু কিছু খেয়েছ এখনও?
না, খিদে নেই।
খিদে নেই তো ভয়ে। ভাল করে মুরগির ঝোল দিয়ে ভাত খাও, তারপর শুয়ে পড়। আমি লামার সঙ্গে কনট্যাক্ট করেছি, তোমাকেও ফোন করতাম ওকে টাকাটা দেওয়ার জন্য।
টাকা নিয়ে লামা কী করবে বাবা?
ওই ছেলেগুলোকে দেবে। ওরা বেকার ছেলে, কাজকর্ম নেই, হুজুগ পেলেই একটা কিছু করে বসতে চায়। টাকাটা হাতে পেলেই ফুর্তি করতে চলে যাবে। কিন্তু খবরদার, নিজে গিয়ে আবার ওদের টাকা সেধো না। যা করবার লামা করবে। ও হচ্ছে আমার পলিটিক্যাল এজেন্ট।
রেমি উদ্বেগের সঙ্গে বলল, আপনার ছেলেকে পুলিশ কী সব জিজ্ঞেস করছে। ওর সঙ্গে কথা বলবেন?
কৃষ্ণকান্ত বললেন, না। কথা বলে লাভ নেই। ও কেন ওকাজ করেছে জানো? ইলেকশনের মুখে আমাকে একটা স্ক্যান্ডালে জড়ানোর জন্য। ওকে কিছু বলা বৃথা। তবে তুমি যদি পারো ওকে ইমিউন রেখো।
কিন্তু আমি যে পারছি না বাবা!
চট করে তো পারবে না। সময় লাগবে। যদি মাথা ঠান্ডা রেখে চলো তাহলে হয়তো একদিন ওকে কনট্রোল করতে পারবে। তোমার ওপর আমার অনেক ভরসা।
এমন সময়ে একটা ঢিল এসে ঝনঝন করে উত্তর দিককার শার্শি ভাঙল। চমকে উঠল রেমি। টেলিফোনে কৃষ্ণকান্তকে শুনিয়েই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল, আমি যে ভীষণ ভয় পাচ্ছি। আমার মাথা কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। আমি কী করব?
এক্সচেঞ্জের তিন মিনিটের ওয়ার্নিং পার হয়েও কান্নাটা গড়াল।কৃষ্ণকান্ত বাধা দিলেন না। রেমির রুদ্ধ আবেগটা একটু কমে এলে বললেন, শোনো বউমা, ধ্রুব খুব বেশিদিন বেঁচে থাকবে বলে আমার মনে হয় না। হয় খুন হয়ে যাবে, নয় তো লিভার পচাবে, না হয় তো মাতাল অবস্থায় গাড়ি টাড়ি চাপা পড়বে। ওর আয়ু বেশিদিন নয়।
রেমি শিউরে উঠে বলল, কী বলছেন?
কথাটা শুনতে খারাপ, তবু যুক্তিসঙ্গত। কে ওকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখবে বলো? সব পরিস্থিতিতে তো আর আমি বাঁচাতে পারব না। বিয়ের সময় সুপাত্রের হাতে কন্যা সম্প্রদান করা হয়। আমি কিন্তু মা, ধ্রুবকেই তোমার হাতে সম্প্রদান করেছি। এখন তুমি যা বুঝবে করবে। অপাত্রে পড়েছ বলে যদি সারাজীবন মনে মনে আমাকে গালমন্দ করো তো কোরো, তবু আমার ছেলেটাকে দেখো। ওর কেউ নেই। বাস্তবিকই কেউ নেই।
শেষ দিকে কৃষ্ণকান্তর গলাটা ভারী শোনাল কি না তা ভাল বুঝতে পারছিল না রেমি। পাথুরে কৃষ্ণকান্ত সহজে গলেন না। তবু যদি গলাটা ভারী শুনিয়ে থাকে তবে সেটা কৃষ্ণকান্তর অভিনয়ও হতে পারে। রেমিকে একটা পতিত উদ্ধারের সকাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই হয়ত্রে অভিনয়টুকুর দরকার ছিল।
টেলিফোন রেখে রেমি হাঁটুতে মুখ গুঁজে কান্না চাপবার বৃথা চেষ্টা করতে করতে ফেঁপাচ্ছিল। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। বাইরে থেকে সমীর ডাকল, বউদি।
সেই সময়ে রেমির মাথাটা হঠাৎ খারাপও হয়ে গিয়ে থাকবে। বিয়ের পর থেকে কাণ্ডজ্ঞানহীন, হিতাহিতজ্ঞানশূন্য একটা লোকের সঙ্গ তাকে তিলে তিলে পাগল করে তুলেছে। তার ওপর আছে দেহ ও মনের যৌবনোচিত চাহিদায় দিনের পর দিন বঞ্চনা। কৃষ্ণকান্ত সুকৌশলে যে গুরুভার তার ওপরে চাপাতে চাইছেন তাতেও তার মন বিদ্রোহী হয়ে থাকবে। ঠিক কী হয়েছিল তা বলা মুশকিল। তবে এই সময়ে আর-একটা মস্ত পাথর এসে উত্তর দিককার আর-একটা শার্শি ভাঙল।
রেমি পাগলের মতো গিয়ে দরজা খুলেই আঁকড়ে ধরল সমীরকে, আমাকে এক্ষুনি নিয়ে চলুন। এক্ষুনি! আমি আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে চাই না। প্লিজ—
অপ্রতিভ সমীর নিচু জরুরি গলায় বলল, মিস্টার লামা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। এই যে—
রেমি সামলে গেল। ঠিক সমীরের পিছনেই লোকটা দাঁড়ানো। দৃশ্যটা কুতকুতে দুই চোখে দেখছে। গায়ে ওভারকোট, মাথায় টুপি, মুখে তীব্র মদের গন্ধ। হাসতেই চোখদুটো মুখের থলথলে চর্বির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
রেমি লজ্জা পেয়ে সরে এল ঘরে। সমীরের সশ্রদ্ধ ভাব দেখে সে বুঝতে পারছিল, তার শ্বশুরের পলিটিক্যাল এজেন্ট লামা দার্জিলিং-এর কেওকেটা লোক। তার চেহারাতেও যথেষ্ট বুদ্ধি এবং আত্মবিশ্বাসের ছাপ আছে। তবে খুব হাসছিল লোকটা।
লজ্জা ঢাকতে রেমি তার সুটকেস খুলে দুহাজার টাকা বের করে দিয়ে বলল, আমার শ্বশুরমশাই টাকাটা আপনাকে দিতে বলেছেন।
লামা টাকাটা বুকপকেটে রেখে ভাঙা বাংলায় জিজ্ঞেস করল, খুব ভয় পাচ্ছেন তো।
আর-একটা ঢিল এসে শার্শি ভাঙতেই কাচের টুকরো ছিটকে পড়ল চারদিকে। তবে ঘরখানা বড় এবং উত্তরের জানালায় ভারী পরদা টানা দেওয়া থাকায় তাদের গায়ে এসে পড়ল না।
রেমিকে কিছু বলতে হল না, পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে লামা নিজেই মাথা নাড়ল। মৃদুস্বরে বলল, সিচুয়েশন ইজ গ্রেভ অ্যান্ড স্যাড। লোকে এটার মধ্যে পলিটিক্যাল মোটিভেশন পেয়ে যাবে অ্যান্ড দেয়ার উইল বি স্ক্যান্ডাল। এনিওয়ে, আমি দেখছি। আপনারা আজ একটু বেশি রাতে কিংবা কাল খুব ভোরে দার্জিলিং কুইট করলে ভাল হয়।
লামা চলে গেল এবং ঠিক দশ মিনিটের মধ্যেই ভোজবাজিতে থেমে গেল বাইরের হাঙ্গামা।
শুকনো মুখে সমীর বলল, ম্যাডাম কী করবেন?
আমি চলে যাব।
কিন্তু ধ্রুববাবু যেতে চাইছেন না। আমি একটু আগেই লাউঞ্জে ওঁর সঙ্গে কথা বলেছি।
ও না গেলে যাবে না, আমার কিছু করার নেই। আমি যাব।
একা?
আপনি আমাকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত নিয়ে চলুন। কাল আমি প্লেন ধরে কলকাতা ফিরে যাব।
কাজটা কি ঠিক হবে?
অত চিন্তা করতে পারব না। আমি যাব। আপনি গাড়ি রেডি রাখবেন।
গাড়ি রেডিই আছে। তবে শিলিগুড়ি থেকে কাকা আসছেন। তার জন্য একটু ওয়েট করা ভাল। রেমি জেদি মেয়ের মতো মাথা নেড়ে বলল, আমি অপেক্ষা করতে রাজি নই।
একটু রিস্ক নিচ্ছেন বউদি।
নিলে নিচ্ছি। অবশ্য যদি আপনার কোনও অসুবিধে না থাকে–
সমীর একটু হেসে বলল, অলওয়েজ অ্যাট ইয়োর সারভিস। আপনি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিন। আমি ধ্রুববাবুকে একটু জানিয়ে আসি। নইলে হয়তো ভাববেন তার বউকে নিয়ে পালিয়ে গেছি।
রেমি স্পষ্ট করে সমীরের দিকে চেয়ে বলল, আমি কিন্তু সত্যিই পালাচ্ছি। আপনি ওকে জানালে জানাতে পারেন, কিন্তু আমি আর ওর সঙ্গে থাকছি না।
বলেন কী?
আমি ডিসিশন নিয়ে ফেলেছি। কলকাতায় ফিরেই ডিভোর্সের দরখাস্ত করব।
সমীরের চোখেমুখে সত্যিকারের আতঙ্ক ফুটে উঠল। আমতা-আমতা করে বলল, এটা তো একটা মেজর ডিসিশন। এত তাড়াতাড়ি নিলেন?
ডিসিশনটা তাড়াতাড়ি নিলে জীবনটা আবার নতুন করে তাড়াতাড়ি শুরু করতে পারব। আমাদের সম্পর্কটা কেমন তা তো আপনাকে বলেছিও।
বলেছেন ঠিকই। কিন্তু আমি ভাবছিলাম ধ্রুববাবুর এসব ব্যাপার বোধহয় খুব ডিপ সেট নয়। খানিকটা অভিনয়ও থাকতে পারে।
তার মানে?— প্রায় চেঁচিয়ে উঠল রেমি।
উনি হয়তো সকলকে বিপন্ন করে তুলে এক ধরনের আনন্দ পান। যাক গে, আপনি নিশ্চয়ই সেটা আমার চেয়ে ভাল বোঝেন। মার কাছে মাসির গল্প করে লাভ কী?
কথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়েছিল রেমির। কিন্তু সে তো জানে, তা নয়। রেমি ম্লান হেসে মাথা নেড়ে বলল, অভিনয়-টয় নয়। আমি জানি। কখন বেরোকেন?
রাত দশটার মধ্যে দার্জিলিং ঘুমিয়ে পড়ে। দশটায় স্টার্ট দিলে আমি আপনাকে সাড়ে বারোটায় শিলিগুড়ি পৌঁছে দিতে পারব।
বাড়ির লোক আমাকে অত রাতে দেখে কিছু বলবে না?
বলতে পারে। তবে আমি একটা টেলিফোন করে আগেই জানিয়ে দেবোখন। তা হলে আর কোনও প্রশ্ন উঠবে না।
সমীর চলে গেলে রেমি নিশ্চিন্ত হয়ে একটা শ্বাস ফেলল।
প্ল্যানটা ঠিকমতোই এগোচ্ছিল। রেমি বাক্স গুছিয়ে নিয়েছে। অনিচ্ছের সঙ্গেও ঘরে খাবার আনিয়ে খানিকটা খেয়েছে। গরম পোশাক পরে অপেক্ষা করেছে সমীরের জন্য। আর তার পালানোর পথ বিপ্নহীন করতে ধ্রুব গিয়ে ঢুকেছে বার এ। রাত নটার মধ্যে তার চেতনা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। তাকে একবার বলেছিল সমীর, বউদি শিলিগুড়ি চলে যাচ্ছেন ধ্রুববাবু। আপনিও যাবেন তো?
ধ্রুব মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে এই তুচ্ছ প্রসঙ্গ উড়িয়ে দিয়েছে।
রাত দশটার কয়েক মিনিট আগে বেয়ারা এসে রেমির মালপত্র নিয়ে গাড়িতে তুলল। রেমি নেমে এল নীচে। যখন গাড়িতে উঠতে যাবে তখনই আকস্মিক ঘটনাটা ঘটল।
হোটেলের সামনের বাগানের গাছপালার আড়াল থেকে নিঃশব্দে এগিয়ে এল লামা। গায়ে ওভারকোট, মুখে মার্কামারা হাসি। তবে হাসিটা তখন আর স্বতঃস্ফূর্ত নয়। রেমিকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছেন?
ভীষণ চমকে উঠেছিল রেমি। শীত বাতাসের একটা চাবুক যেন তাকে কাপিয়ে দিয়ে গেল। কষ্টে বলল, আমি চলে যাচ্ছি। ধ্রুববাবু কোথায়?
ও যাচ্ছে না।
কেন যাচ্ছে না?
রেমি নিজেকে সামলে নিয়েছে। ভ্রুকুটি করে বলল, সেটা তো ও জানবে, আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন?
সমীর সামনের সিটে উঠতে গিয়েও লামাকে দেখে স্থিরচিত্র হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার দিকে ফিরে লামা হাসিমুখে বলল, কৃষ্ণকান্তবাবুর সঙ্গে আমার টেলিফোনে কথা হয়েছে। উনি চান ধ্রুববাবুকে ওঁর স্ত্রীর সঙ্গেই কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হোক। আপনি রেমি দেবীকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?
লামাকে দেখে সমীর যে ভয় পেয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। সে কাঁধটা উঁচু করে বলল, ধ্রুববাবুর পারমিশন নিয়েই উনি যাচ্ছেন। আমি পৌঁছে দিতে যাচ্ছি।
লামা একটু ক্ষুব্ধ গলায় বলল, কাজটা ঠিক হল কি? ধ্রুববাবু এখন সেনসে নেই, এ সময়ে ওঁর স্ত্রী চলে যাচ্ছেন।
আমার কিছু করার ছিল না মিস্টার লামা।
লামা রেমির দিকে ফিরে বলল, আপনি যেতে চাইছেন, কিন্তু এভাবে যেতে পারবেন না। হাঙ্গামা থেমেছে বটে কিন্তু রাস্তা এখনও পরিষ্কার নয়। দেখবেন? আসুন আমার সঙ্গে।
লামা গেট-এর দিকে হাঁটতে লাগল। সমীর নিচু স্বরে রেমিকে বলল, কিছু করার নেই। চলুন দেখা যাক।
ফটকের কাছে এনে লামা তাদের দেখাল। হাটেলের সামনেই একটা ঢাল। রাস্তাটা মোড় নিয়ে পাইন গাছের একটু জড়ামড়ির মধ্যে ড়ুবে গেছে। সেখানে আবছা আলোয় কয়েকটা সিগারেটের আগুন ঠিকরে ঠিকরে উঠছে। অন্তত দশ-পনেরোটা ছেলে অপেক্ষা করছে রাস্তা জুড়ে।
রেমি আতঙ্কিত হয়ে বলল, ওরা কী চায়?
লামা মৃদু হেসে বলে, নাথিং। শুধু আপনাদের বেরোনোর রাস্তাটা আটকে আছে। এখন যাওয়াটা সেফ নয় মিসেস চৌধুরী।
তা হলে কখন?
কাল সকালে।
তখন সেফ হবে?
হবে। ধ্রুববাবু আপনাকে অ্যাকমপ্যানি করবেন। কোনও ট্রাবল হবে না। এখন ঘরে ফিরে যান। হতাশ রেমি ফিরে এল ঘরে। ধ্রুবকে ধরাধরি করে এনে বিছানায় দিয়ে গেল কয়েকজন বেয়ারা।
পরদিন প্রকাশ্য দিনের আলোয় তারা দার্জিলিং ছাড়ল। রেমি, ধ্রুব আর সমীর। কার্শিয়াং-এ চা খেতে নেমে এক ফাঁকে সমীর চুপি চুপি রেমিকে বলল, বউদি, একটা বিপদ বাঁধিয়ে রেখে গেলেন কিন্তু।
কী বিপদ?
আপনি কাল একবার আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন, মনে আছে?
রেমি লজ্জা পেয়ে বলে, সে তো ভয়ে।
সমীর বিকৃত মুখ করে বলে, ভালবাসায় নয় তা জানি। কিন্তু মিস্টার লামা সেটাকে ওভাবেই ইন্টারপ্রেট করেছে। লোকটার ওয়ান ট্র্যাক মাইন্ড। একবার যা ভেবে নেবে তা থেকে আর সরানো যাবে না। খুব সম্ভব আপনার শ্বশুরকেও ব্যাপারটা জানিয়েছে।
সে কী?
সেটাই বিপদের। কৃষ্ণকান্তবাবু যদি কাকাকে জানান তা হলে আমি খুব মুশকিলে পড়ে যাব।
কীসের মুশকিল? বুঝিয়ে বললেই হবে। আমার শ্বশুব অবুঝ লোক নন।
সমীর তবু নিশ্চিন্ত হল না। কেমন ম্রিয়মাণ হয়ে রইল।
আচমকাই রেমি জিজ্ঞেস করল, আসল ভয়টা কাকে বলুন তো? ছন্দাকে? ওকে আমি চিঠি লিখে জানিয়ে দেব যে, আপনি সত্যিই আমার প্রেমে পড়েননি।
একথায় কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল সমীর। অবিশ্বাসভরা চোখে রেমির দিকে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ। কিন্তু প্রতিবাদ করল না। খুব বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল, মেয়েদের চোখ বোধহয় সবই দেখতে পায়। কিন্তু ব্যাপারটা ভীষণ গোপন, বউদি। ভীষণ গোপন।
ঘেন্নায় রেমির ঠোঁট বেঁকে গেল। ধ্রুব, মাতাল ও মতিচ্ছন্ন বর চোখ তা হলে ভুল করেনি।
আশ্চর্য, সেই মুহূর্তে তার ধ্রুবকে আবার ভালবাসতে ইচ্ছে করল। আর অস্থির ব্যাকুল হৃদয়ে সে অপেক্ষা করতে লাগল ধ্ৰুবকে একা পাওয়ার জন্য।
পেল ট্রেনে। আবার সেই কুপে কামরা। সে আর ধ্রুব।
রেমি ঝাঁপিয়ে পড়ল ধ্রুবর ওপর, বলল তোমার পাগলামি আর মাতলামি সব অভিনয়! সব ভাঁড়ামি। বলো তুমি অস্বাভাবিক নও! এত বুদ্ধি এত চোখ কখনও কোনও মাতালের থাকে? বলো! বলছ না কেন?
সেই আক্রমণে ধ্রুব যেমন অবাক, তেমনি বিপন্ন। বলল, আরে কী করছ? ডাকাত পড়েছে ভেবে লোকজন ছুটে আসবে যে!
আসুক। তবু তুমি বলো এসব তোমার অভিনয়, এগুলো কিছুই সত্যি নয়!
ধ্রুব একটু বিচ্ছুর হাসি হেসে বলল, তা হলে খুশি হবে?
হব। তা হলে এমন খুশি হব যে আনন্দে ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ব নীচে। খুব জোরে হো-হো করে হাসব। কেঁদেও ফেলতে পারি।
ধ্রুব কিছুক্ষণ থম ধরে বসে রইল চুপচাপ। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে বলল, রেমি, তোমার সমস্যা একটাই। আমি মদ এবং পাগলামি ছাড়লেই তোমার সেই সমস্যাটা বোধকরি মিটে যায়। কিন্তু আমার সমস্যাটা অত সরল নয়।
তোমার কাছে ভিক্ষে চাইছি। পায়ে পড়ছি।
ধ্রুব একটু হেসে বলে, দার্জিলিং-এ আমাকে ফেলে চলে আসতে চেয়েছিলে, তবু কথাটা বিশ্বাস করছি। আমি নিজেও লক্ষ করেছি তুমি আমাকে ভালবাসার চেষ্টা করছ।
চেষ্টা নয়। আমি তোমাকে ভালবাসি গো।
সেটাও মানলাম। বাট আই হ্যাভ টু সেটল মাই অ্যাকাউন্টস উইথ আদার পিপল। রেমি, আপাতত আমার কাছে কিছু প্রত্যাশা কোরো না।