1 of 2

৩৪. দৈহিক দিক থেকে পঙ্গু

দৈহিক দিক থেকে পঙ্গু দক্ষ একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট বাড়িতে বসে যে-কোনও রকম ট্যাক্স রিটার্ন, হিসাব তৈরি এবং অ্যাকাউন্টস সংক্রান্ত সবরকম পরামর্শ দিতে প্রস্তুত। প্রথম শ্রেণির ফার্মে চাকরির অভিজ্ঞতা আছে।

এই বিজ্ঞাপনটা একটি চেক সহ কিছুদিন আগে পাঠিয়েছিল প্রীতম। রোববারের কাগজে বিজ্ঞাপনটা বেরোল। পার্সোনাল কলমে বিজ্ঞাপনটার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে সে। কাজটা ঠিক হল কি না বুঝতে পারছে না। অরুণ বা বিলু টের পাবে না। বিজ্ঞাপনে ঠিকানা নেই, বক্স নম্বরে আছে। তবে যদি খুঁটিয়ে দেখে এবং দুইয়ে দুইয়ে চার করে তবে প্রীতমের ধরা পড়ার সম্ভাবনা যে একেবারে নেই তা নয়। অরুণের ক্ষুরধার বুদ্ধিকেই তার ভয়। অবশ্য যদি সত্যিই প্রীতম কোনও কেস হাতে নেয় তবে ওদের কাছে শেষ পর্যন্ত কিছুই গোপন থাকবে না।

কাগজটা রাখতে গিয়েও আবার দুইয়ের পাতায় বিজ্ঞাপনটা দেখে নেয় প্রীতম। ওটা চোখে পড়ার পর থেকেই তার রক্তস্রোত কিছু দ্রুত হয়েছে, শ্বাসের উষ্ণতা বেড়েছে। বহুকাল পরে উত্তেজক কিছু ঘটল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যদি ক্লায়েন্ট সত্যিই আসে তবে সে পারবে কি না! এই পারা না-পারার প্রশ্নটিই তার কাছে সবচেয়ে বড়।

ছুটির দিনে বিলু সারাদিনই ঘরে থাকে। চাকরি করে বলে আজকাল সপ্তাহের অনেক কাজ জমে থাকে ছুটির দিনটির জন্য। কাচাকুচি, ভোলা ঝাড়া, একটু-আধটু রান্না। রবীন্দ্রসদনে বাচ্চাদের একটা ফাংশনে যাওয়ার জন্য অনেক দিনের বায়না ছিল লাবুর। আজ মায়ে-মেয়েতে সক্কালবেলা রবীন্দ্রসদনে গেল। দুপুরে ফিরবে। বিলুর খুব ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু লাবুর মুখ চেয়ে যেতে হল। একা ভাল লাগছিল না প্রীতমের। একা কাজ ছাড়া কখনওই ভাল লাগে না। আজ তাই বালিশে হেলান দিয়ে সে পারা না-পারার কথা ভাবতে থাকে।

সুস্থ শরীরের একজন মানুষ কতটা পারে তার কোনও হিসেব হয় না। মানুষের পারার কোনও শেষই নেই। কেবলমাত্র ইচ্ছের জোরেই না মানুষ দক্ষিণ মেরুতে গেছে, সিঁড়িহীন দেয়ালের মতো খাড়া আকাশের মতো উঁচু পাহাড়ে উঠেছে, খড়ের নৌকোয় পাড়ি দিয়েছে সমুদ্র। ক’মাস আগেই তো খবরের কাগজে পড়েছে, আমেরিকার এক ছোকরা ব্যথাহরা ট্যাবলেট খেয়ে তারপর নিজের শরীরে ছুরি চালিয়ে এক মস্ত অপারেশন প্রায় সাঙ্গ করে এনেছিল। মানুষ কি আসলে মানুষ? অনেক মানুষ আছে যারা আসলে দৈত্য, দানব, রাক্ষস বা দেবতা।

ইচ্ছাশক্তির ওপর বিলু বা অরুণের আস্থা নেই। ওদের কখনও ঠিক এরকম প্রয়োজন না পড়লে, এরকম বেঁচে থাকা ও মরে যাওয়ার সমস্যা দেখা না দিলে, নিরন্তর রোগজীবাণুর সংক্রমণ টের না পেলে ইচ্ছাশক্তির ওপর ওদের আস্থা আসবেও না।

কেবল ইচ্ছের জোরে প্রীতম পারবে তো? তার শরীর শুকিয়েছে বটে, কিন্তু রোগ এখনও তার মগজকে স্পর্শ করেনি। হয়তো দীর্ঘ দিন করবেও না এখনও। অডিটের সব আইনকানুন তার মনে আছে।

অচলা!–হঠাৎই ডাকল প্রীতম।

রান্নাঘরে বিন্দুর সঙ্গে বসে কিছু খাচ্ছিল বোধহয়। ভরাট মুখে সাড়া দিল, যাই।

মেয়েটাকে খুব ভাল লাগে প্রীতমের। আগে সহ্য করতে পারত না। মনে হত, বাইরের একজন মানুষ এসে অন্দরমহলে অনধিকার প্রবেশ করেছে। অন্যায় কৌতূহলে চেয়ে চেয়ে দেখছে তার শুকনো শরীর। অস্বস্তি হত। আজকাল হয় না। অচলাকে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা আর ভাবেও না প্রীতম।

কিছু বলছেন?

চাকাওলা চেয়ারটা কই? দেখছি না তো!

ও ঘরে বাধহয় লাবু নিয়ে গাড়ি-গাড়ি খেলছিল কাল। এনে দিচ্ছি।

অচলা হুইলচেয়ারটা সামনের ঘর থেকে টেনে আনলে প্রীতম বিরসমুখে বলল, থাক। শোওয়ার ঘরের রক-এ অ্যাকাউন্টেন্সির কয়েকটা বই আছে, সঙ্গে খাতা। এনে দাও তো। একটা ডটপেন বা কলম দিয়ো, আর পেনসিল।

অচলা এনে দিল। বলল, একটু চা করে দিই?

দাও।

বই খুলে প্রীতম একটার পর একটা এন্ট্রি দেখে যায়। হরেক রকমের প্রবলেম জল করে দিতে থাকে। এখনও মগজ শতকরা একশো ভাগ ক্রিয়াশীল।

অচলা!–আবার ডাকে প্রীতম।

চা নিয়ে যাচ্ছি। অচলা জবাব দেয় এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আসে।

বলুন।

শোনো। আজ থেকে এক সপ্তাহ কেটে গেলে তুমি একটু সজাগ থাকবে। আমার কাছে কেউ কেউ আসতে পারে। তারা বিভিন্ন কোম্পানির লোক। তোমার বউদি যেন ব্যাপারটা টের না পায়।

কোম্পানির লোক কেন আসবে?

তারা কাজ নিয়ে আসবে। কাজ করাতে আসবে।

আপনি য়োগা শরীরে কাজ করবেন?

রোগা শরীর বলেই কাজ বন্ধ করে দেওয়াটা কি উচিত হবে? শোনোনি, অনেক সময় কাজ করলে রোগের প্রকোপ কমে যায়?

আপনাদের তো অভাব নেই, তবে কেন কাজ করবেন?

টাকার জন্যে নয়। বেঁচে থাকার জন্য।

অসুখ হলে শুয়ে থাকতে হয়। ডাক্তাররা বলেন, অ্যাবসোলিউট রেস্ট।

এতকাল তো আমি ডাক্তারদের অবাধ্য হইনি। কিন্তু ডাক্তারদের ওষুধে আমার কাজও হয়নি। তাঁদের কথা শুনে আর কী হবে?

কাজ হয়নি কে বলল? আপনাকে আমি প্রথম এসে যেরকম দেখেছিলাম এখন তার চেয়ে ভাল দেখি।

প্রীতম হাসল। বলল, সত্যিই ভাল দেখোনা কি রুগিকে ওরকম বলতে হয় বলে বলছ?

ভাল দেখছি। চা খান, ঠান্ডা হয়ে যাবে।

প্রীতম তার দু’হাতে প্লেটসুদ্ধ চায়ের কাপ তোলে। কম করেও দু-তিন কেজি ভারী মনে হয় কাপটাকে। একটু একটু কঁপে, চা ছলকায়। তবু পারে প্রীতম আজকাল। চা খেতে ডাক্তার তেমন কিছু বারণ করেনি, কিন্তু সম্প্রতি বিলু তার চা বন্ধ করেছে। বিলু না থাকলে লুকিয়ে অচলা করে দেয়। চা আজকাল বড় প্রিয় হয়েছে প্রীতমের।

চায়ে চুমুক দিয়ে প্রীতম বলে, আমি ভাল আছি। লোকে বিশ্বাস করুক বা না করুক, আমি কিন্তু ভাল আছি।

ভাল হয়ে যাবেন। কিন্তু তা বলে এখনই কাজ-টাজ করতে যাবেন না। কমপ্লিট রেস্ট নিন।

কমপ্লিট রেস্ট বলে কিছু নেই, জানো না? মন যদি অস্থির থাকে, তবে কী করে বিশ্রাম হবে? কারও যদি রাতের বেলা বিছানায় শুয়েও ঘুম না আসে তবে কেবল শুয়ে থাকাটাই তো ঘুমের অলটারনেটিভ হতে পারে না। বরং শুয়ে থাকলে আরও অশান্তি। তার চেয়ে বই-টই পড়ে সময় কাটিয়ে দেওয়া ভাল।

বউদি যে আপনাকে ভাবনা-চিন্তা করতে বারণ করেছেন। কাজ করতে গেলেই তো মাথায় চাপ পড়বে!

কাজ না করলেও পড়ে। সারাদিন কত চিন্তা করি।

অচলা সামান্য হেসে বলে, আপনি নাকি ভীষণ মনের জোর খাঁটিয়ে অসুখ সারানোর চেষ্টা করেন?

সেটা কি দোষের?

জানি না। তবে বউদি বলেছিলেন ওতেও মাথার ওপর চাপ পড়ে।

উদাস গলায় প্রীতম বলে, তোমার বউদি আমার সবটুকু তো জানে না। সে কী করে বুঝবে আমি কীসে ভাল থাকি?

প্রীতমের এই হঠাৎ উদাসীনতা লক্ষ কবে অচলা তাড়াতাড়ি বলল, আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে। কাজ করলে যদি ভাল থাকেন তবে না হয় আমি বউদিকে কিছু বলব না। কিন্তু পরে যেন দোষ না হয়।

সারা দিনটা এই অচলাই আজকাল তাকে সঙ্গ দেয়। স্নেহ-মমতার একটা দুর্লভ ভাণ্ডার আছে। ওর। সহজেই চোখ ছলছলিয়ে ওঠে, অল্প কারণেই উদ্বিগ্ন হয়। লাবু এখন একটু বড় হযেছে। ঠিক বেবিসিটারের দরকার আর ওর নেই। অচলা তাই প্রীতমকে দেখাশোনা করে নিজের গরজেই। কেউ ওকে বলেনি। একজাতের মেয়ে আছে, যারা প্রেমিকা বা স্ত্রী হিসেবে তেমন কাজের নয়। কিন্তু ভারী ভাল মা হতে পারে। অচলা ঠিক সেই জাতের।

ছেলেবেলায় মা ছাড়া প্রীতম আর-কোনও মেয়েকে চিনতই না। বড় হয়ে চিনল বিলুকে। সারা জীবনে নিজের মা, বোন, বউ আর মেয়েএই ছিল প্রীতমের ঘনিষ্ঠ মহিলা-জগৎ। এর বাইরে যারা তাদের কাছে প্রীতমের ভারী লজ্জা, সংকোচ, বুক দুরুদুরু ভয়। এখন সেই ছোট্ট চৌহদ্দিতে কবে অনায়াসে ঢুকে গেছে অচলাও।

প্রীতম বলল, তোমার দোষ হবে না। ভয় নেই।

অচলা মৃদু হেসে বলে, আচ্ছা দেখব দোষ হয় কি না। আজকাল তো বোজ আপনার জন্য আমি বউদির বকুনি খাই।

কেন? আমার জন্য তুমি বকুনি খাবে কেন? বিলুর তো ভারী অন্যায়।

ঠিকই করেন। সেদিন আপনি বাথরুমের ঠান্ডা জলে চান করলেন, পরশুর আগের দিন বিন্দুকে দিয়ে রাস্তার আলুর চপ আনিয়ে খেলেন, গত সপ্তাহে পাপোশে পা আটকে পড়ে গিয়েছিলেন। আপনার ওই সব দুষ্টুমির জন্য বকুনি তো আমারই খাওয়ার কথা।

প্রীতম প্রশ্ন করল না, কিন্তু চোখে প্রশ্ন নিয়ে চেয়ে বইল।

অচলা এবার স্নিগ্ধ চোখে চেয়ে বলল, বউদি কী বলেছেন জানেন? বলেছেন, এ বাড়িতে বাচ্চা কিন্তু একটি নয়, দুটি। এ বাড়ির কর্তার চার্জও তোমার। এমনকী দুটো বাচ্চা দেখাশোনার জন্য আমার মাইনেও বউদি পঞ্চাশ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন।

তাই বলো!–প্রীতম মাথা নাড়ল।

এবার বুঝেছেন, কেন আপনার কিছু হলে আমার জ্বালা!

বুঝেছি। কত বেশি পাও বললে?

পঞ্চাশ টাকা।

মাত্র? আমি তোমাকে কিছু ঘুষ দিতে রাজি অচলা।

আচলা হেসে ফেলে বলে, আমার আর বেশি চাই না। বলুন, কী করতে হবে?

কিছু নয়। শুধু সব কথা তোমার বউদিকে বোলো না।

বলব না। কিন্তু সব কি লুকোতে পারবেন? বিন্দু আছে, লাবু আছে। ওরা ঠিক বলে দেবে। আর আমিও তো আপনাকে যা-খুশি-তাই করতে দিতে পারি না।

আমি কি খুব যা-খুশি-তাই করি?

ওই যে বইপত্র নিয়ে বসেছেন। এখন কি মাথা খাটানো ভাল? আমি ভয়ে কিছু বলি না, পাছে আপনি রেগে যান। আজ বলছি, রুগিদের বইপত্র নিয়ে পড়ে থাকা উচিত নয়।

প্রীতম খানিকক্ষণ শূন্যে চেয়ে থেকে বলল, তোমার বউদি তা হলে আমার ভার তোমার হাতেই ছেড়ে দিল?

তা কেন? বউদিও দেখাশোনা করবেন, আমিও করব। আমি নার্সিং জানি তো, তাই রুগির দেখাশোনা অনেকের চেয়ে ভাল পারি।

প্রীতম একটু গম্ভীর হয়ে বলল, খুব ভাল। কিন্তু বিলু ব্যাপারটা আমাকে জানাল না কেন?

ওমা! আপনি রাগ করলেন নাকি?

প্রীতমের আজকাল বুকভরা অভিমান হয়েছে। বেশিদিন রোগে ভুগলে বুঝি এ রকমই হয়। পাছে অভিমানের ব্যাপার অচলা ধরে ফেলে সেই ভয়ে একটু ক্লিষ্ট হাসি হাসল সে। বলল, না। রাগের কিছু নেই।

সত্যিই নেই। বউদি আপনাকে কত ভালবাসেন। আমি অনেক পরিবারে কাজ করেছি। আপনাদের মতো ভাল সম্পর্ক খুব বেশি পরিবারে দেখিনি।

প্রীতম একটা ছোট শ্বাস ফেলে। বলে, আমি কারও কাছে ভার হতে চাইনি কখনও।

ওই দেখুন! আপনি ঠিক রাগ করছেন।

প্রীতম নিজেকে সামলে নেয়। ঠাট্টার গলায় বলে, দাঁড়াও, দাঁড়াও। আমি একটু ভেবে দেখি, আমার জন্য তোমাদের কী কী করতে হয়। তারপর চেষ্টা করে দেখব, সেগুলো নিজেই পারি কি না।

অচলা উদ্বেগের গলায় বলে, নিশ্চয়ই পারেন। কিন্তু পুরুষমানুষ বলে কথা, মেয়েমানুষ থাকতে তারা কেন সব কাজ করতে যাবে? আমি বাড়ি ফিরলে এখনও আমার কর্তা এক গেলাস জল নিজে গড়িয়ে খান না। কেন খাবেন?

প্রীতম হেসে ফেলে। বলে, সবাই কি তোমার কর্তার মতো? পৃথিবীতে আমার মতো হতভাগাও কিছু আছে।

আপনি কেন এরকম বলুন তো! কী ব্যথা থেকে কোন কথায় চলে গেলেন।

প্রীতম মাথা নেড়ে বলে, বিলুর জন্য নয়, তোমার কথা ভেবেই আমার মনটা খারাপ লেগেছিল, অচলা। আমি ভেবেছিলাম, আমার ওপর বুঝি তোমার মন একটু নরম হয়েছে, তাই যেচে সেধে আমার সেবা করা আজকাল। কিন্তু তা তো নয়, তুমি তো আসলে চাকরি করছ। তাই না?

এ কথায় অচলা থেমে গেল। কী বলবে? তার মানসিকতা একটা বিশেষ স্তর পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তার ওপরে যাওয়া তো সম্ভব নয়। পৃথিবীর খানাখন্দ, অন্ধকার সে কিছু কম চেনে না। মানুষের ভিতরকার ইতর জন্তুর মুখোমুখিও সে কয়েকবার হয়েছে। মাত্র বছরখানেক আগে এক অসুস্থ, দারুণ সুন্দরী মহিলার নার্সিং করছিল সে। স্বামী মস্ত চাকরি করে। দ্বিতীয় রাত্রিতেই সেই সুপুরুষ সবল লোকটি তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল শোওয়ার ঘরে। এসব নিয়ে হইচই করা বোকামি জেনেই সে কিছু করেনি। আগেব অভিজ্ঞতাও কিছু আছে। দিন-রাতের নার্সিং বা বেবি-সিটিং করতে গেলে চোখের সামনে তরতাজা যুবতী মেয়েকে পেয়ে লঘু-প্রেমের ইচ্ছে কত পুরুষের জেগে ওঠে। কিন্তু প্রীতমকে সে চোখে দেখার কিছু নেই। এই এক পুরুষ যে অন্যরকম। সম্পূর্ণ অন্যরকম। এ মানুষ প্রেমে পড়ে না, কিন্তু মা চায়। এর দৃষ্টিতে কখনও পাপের ছোয়া দেখেনি। অচলা। এ যেন তার ছেলেরই এক ভাই। টাকা পায় বটে, কিন্তু টাকার জন্য তো এ মানুষটার জন্য। তার এত দরদ নয়। কিন্তু সে কথা বোঝানোর মতো ভাষা জানা নেই অচলার।

ভাষার অভাবে অচলার তাই চোখে জল এল। মুখটা ফিরিয়ে ধরা গলায় বলল, গরম জল হয়ে গেছে। এখন স্পঞ্জ করে দেব। তৈরি থাকুন।

আমি তোমার কাছে স্পঞ্জ করব না। বিলু আসুক।

নার্স-ডাক্তারদের কাছে লজ্জা করতে নেই।

না, না।–বলে প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে প্রীতম। সে পারবে না। ভারী লজ্জা।

আচ্ছা, তা হলে বউদিই আসুক।

অচলা রান্নাঘরের দিকে চলে গেলে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে প্রীতম। মেয়েটা কি দুঃখ পেল? পৃথিবীর কাউকেই তার এতটুকু দুঃখ দিতে ইচ্ছে হয় না।

কাল রাতে খুব বৃষ্টি গেছে। আজ এত বেলাতেও মেঘলার আঁধার ছেয়ে আছে চারদিকে। এরকম দিনে কিছু ভাল লাগে না। মনটা বড় সঁাৎ স্যাৎ করে। বিলু কেন আসছে না এখনও?

স্পঞ্জ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল প্রীতম। কিছু যায় আসে না, অচলাই স্পঞ্জ করুক। অচলাকে ডাকতে যাচ্ছিল প্রীতম, হঠাৎ ভীষণ চমকে উঠল।

তার শোওয়ার ঘরের দরজায় পাঠানের মতো বিশাল চেহারাব দাড়িওয়ালা একটা লোক দাঁড়িয়ে, তার কাধে মস্ত এয়ারব্যাগ। চোখে হালকা রঙিন কাচের বোদ-চশমা।

অবাক হয়ে চেয়ে ছিল প্রীতম। অস্ফুট গলায় জিজ্ঞেস করল, কে?

ব্যাগটা মেঝেয় নামিয়ে রেখে শতম এগিয়ে এসে বিছানার ধারে বসে।

চিঠি পাওনি? আসব বলে চিঠি পোস্ট করেছি পরশু।

প্রীতম ওঠে। বুক কাঁপছে, অস্তিত্ব কাপছে।

কোন গাড়িতে এলি?

দার্জিলিং মেল, আর কোন গাড়ি!

এত দেরি যে!

চোরাই চাল নিয়ে হুজ্জতি হল ডানকুনিতে। সেখানে ঠায় আড়াই ঘণ্টা লেট। বউদি, লাবু সব কোথায়?

বেরিয়েছে একটু। আসবে এক্ষুনি। বোস।

বিন্দু আছে?

আছে।

দাঁড়াও, ওকে একটু চা করতে বলে আসি।

উঠতে হবে না। এখান থেকেই শুনতে পাবে। অচলা! অচলা!

অচলা কুণ্ঠিত পায়ে আসে। মুখে হাসি নেই।

একগাল হাসিতে মুখ উদ্ভাসিত করে প্রীতম বলে, এই আমার মেজো ভাই। এইমাত্র শিলিগুড়ি থেকে এল। একটু চা করতে পারবে?

মাথা নেড়ে অচলা আবার ধীরে চলে গেল। সেদিকে একটু চেয়ে থাকে প্রীতম! মেয়েটাকে সুযোগ মতো একটু মন-ভোলানো কথা বলতে হবে। বেচারা দুঃখ পেয়েছে।

শতম তার গায়ের টি-শার্টটা খুলে ফেলল। গলায় কালো সুতলিতে বাঁধা ধুকধুকি। হাতে পাঞ্জাবি বালা। গালে ঘেঁষ দাড়ি, মস্ত গোঁফ। একদম চেনা যায় না। তার ওপর সম্প্রতি চেহারাটাও ভাল হয়েছে। এই বড়সড় স্বাস্থ্যবান যুবকটি তার ভাই এ কথা ভাবতেই ভাল লাগে।

পরশু চিঠি ড্রপ করেছিস বললি?

শতম বলে, হ্যাঁ। পাওনি তো?

পাওয়ার কথা নয়। দু’দিন তো মিনিমাম লাগে। বারো-তেরো বছর আগে মা সকালে চিঠি পোস্ট করলে আমি বিকেলে এখানে পেয়ে গেছি কতবার।

আসাটা হঠাৎ ঠিক হল। তাই আগে খবর দেওয়া যায়নি।

তাতে কী? খবর না দিলেও তো কোনও অসুবিধে নেই।

না, তবু ভাবলাম তোমরা যদি কোথাও চেঞ্জে-টেঞ্জে যাও।

কোথায় আর যাচ্ছি।

যা গরম তোমাদের কলকাতায়!

সকাল থেকে কিছু খেয়েছিস?

খেয়েছি।

বাড়ির সবাই ভাল? মা?

ওই এক রকম। মা তোমার জন্য কী সব যেন পাঠিয়েছে।–বলে শতম উঠতে যাচ্ছিল।

প্রীতম বলল, থাক না। বোস। পরে বের করিস।

তুমি কেমন আছ?

ওই এক রকম। তুই অনেকদিন বাদে এলি।

ঠেকায় না পড়লে কে কলকাতায় আসতে চায় বলো? এ তো নরক। দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে শহরটা। বউদি কোথায় গেছে বললে?

একটা ফাংশনে।

ওই মেয়েটা কে?

ও অচলা। লাবুর দেখাশোনা করে।

বউদি চাকরি করছে, না?

হুঁ। না করে উপায় ছিল না।

আমি মেয়েদের চাকরি করা সাপোর্ট করি। তবে বাড়িতে সবাই হয়তো পছন্দ করে না।

স্নান করবি না?–প্রসঙ্গটা পাশ কাটিয়ে জিজ্ঞেস করে প্রীতম।

বাথরুমে জল আছে তো? তোমাদের কলকাতায় খুব জলের ক্রাইসিস বলে শুনি।

প্রীতম বলে, জল আছে।

অচলা ধীর পায়ে ট্রেতে চা নিয়ে এল। সঙ্গে কিছু নোনতা বিস্কুট। এক গেলাস জলও। বুদ্ধি আছে। কারণ শতম প্রথমেই জলের গেলাস নিয়ে এক চুমুকে শুষে নিল।

অচলা বলল, আর-এক গেলাস দেব?

না। কলকাতার জল ভীষণ নোনতা। খাওয়াই যায় না। খুব তেষ্টা ছিল বলে এক গেলাস খেলাম।

অচলা মৃদু হাসল।

বিস্কুট লাগবে না। চায়ের সঙ্গে আমি কিছু খাই না। বলে কাপটা ট্রে থেকে তুলে নেয় শতম।

আপনি ডিম খাবেন তো? আজ ডিম হয়েছে।

ডিম? না, আমি ওসব খাই না। মাছ মাংস ছেড়ে দিয়েছি। শুধু ডাল হলেই চলবে।

ওমা! সে কী?

শতম একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলে, ডিম ছাড়া কিছু হয়নি?

তা হয়েছে। কিন্তু মাছ মাংস খান না কেন?

ওঃ, সে একটা ব্যাপার আছে।–বলে লাজুক হাসি হাসে শতম।

অচলা বলে, তা হলে ছানাব ডালনা করে দিতে বলি। ছানা আছে।

শতম জবাব দিল না। খাওয়া নিয়ে তার বেশি ভাবনা আসে না।

প্রীতম মাছ মাংস নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে ভরসা পেল না। শতম হয়তো জবাব দিতে চাইছে। ভাই বড় হয়েছে, এখন তাকে আর জেরা করা যায় না তো। যদি নিজে থেকে কারণটা কখনও বলে তো বলবে।

প্রীতম বলে, তুই আজকাল খুব মোটরসাইকেল দাবড়াস শুনি।

এখানে সেখানে যেতে হয়।

সাবধানে চালাস তো!

হ্যাঁ হ্যাঁ, ও নিয়ে ভেবো না।

মা বারণ করেনি মোটরসাইকেল কিনতে?

ও বাবা! সে অনেক ঝামেলা গেছে। এখন তেমন কিছু বলে না।

আমার নিজের একটা মোটরসাইকেল বা স্কুটারের খুব শখ ছিল।

না কিনে ভাল করেছ। কলকাতার রাস্তায় ওসব চালানো ভয়ংকর রিস্‌কি।

তা অবশ্য ঠিক।

শোনো দাদা, বউদি আসার আগেই তোমাকে একটা ইমপর্ট্যান্ট কথা বলে নিই। আমি এবার কেন এসেছি জানো?

কেন?

তোমাকে নিয়ে যেতে।

আমাকে নিয়ে যাবি?–প্রীতম কেমন দিশেহারা বোধ করে। কী বলছে শতম তা যেন ঠিক বুঝতে পারে না। আবার বলে, নিয়ে যাবি?

বউদি চাকরি করে, সুতরাং তুমি রুগি মানুষ সারাদিন একা পড়ে থাকো। শোনার পর থেকেই মা খুব অস্থির। নার্স বা আয়ার হাতে তো ঠিক যত্ন হয় না। মা বলে পাঠিয়েছে, শিলিগুড়ির বাড়িতে তোমার সবরকম ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা হবে। আমরা সবাই আছি। এখানে এরকম অসহায় থাকবে কেন?

প্রীতম কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সেটা কি ভাল হবে? বিলু কী ভাববে?

বউদি তো তেমন কিছু ভাবছে না। নইলে এরকম অবস্থায় তোমাকে রেখে চাকরি করছে কেন? তোমার টাকার দরকার হলে একটা পোেস্টকার্ড ছেড়ে দিলেই আমরা টাকা পাঠাতে পারতাম। বউদির চাকরি করার দরকার ছিল না।

প্রীতম মাথা নেড়ে বলে, তা জানি। টাকাটা কোনও কথা নয়, আমি গেলে বিলু আর লাবুর গার্জিয়ান কে থাকবে?

সেটা তুমি বউদির সঙ্গে কথা বলে ঠিক করো! মত হলেই আমি প্লেনের টিকিট কাটব।

তুই স্নানে যা। বিলু আসুক। আমি একটু ভেবে দেখি।

প্রীতম চোখ বুজে থাকে। সংসারে একটা বিরোধ এতকাল চাপা পড়ে ছিল। এখন কি সেটা বেরিয়ে আসবে প্রকাশ্যে? একটা লড়াই শুরু হল নাকি তাকে নিয়ে? শতমের মুখচোখে ওরকম একটা কাঠ-কাঠ শক্ত ভাব কেন? ভিতরে যেন গনগনে রাগের আগুন!

শতম বাথরুমে গেল। দরজার শব্দ শুনল প্রীতম। সংসারে ঝগড়াঝাটিকে বড় ভয় পায় প্রীতম। অশান্তির ভয়ে সে চিরকাল চুপ করে থেকেছে। বহু অন্যায়ের প্রতিবাদ করেনি, অনেক ন্যায্য কথা বলতে চেয়েও বলেনি।

ভিতরে ভিতরে বড় অস্বস্তি হচ্ছিল প্রীতমের। তাকে নিয়েই এখন এই টানা-হ্যাঁচড়ার সূত্রপাত ঘটবে।

ঠিক এই সময়ে কপালে একটা ঠান্ডা নরম করতল কে যেন রাখল। ছোট হাতখানা।

প্রীতম চোখ খুলে দেখে, পৃথিবীতে তার সবচেয়ে প্রিয় মুখখানা ঝুঁকে আছে মুখের ওপর।

ঘুমোচ্ছিলে বাবা?

না। ফাংশন কেমন হল?

খুব ভাল। আমি কিন্তু রাস্তার মোড় থেকে গলিটা হেঁটে একা একা বাড়িতে এলাম।

কেন, তোমার মা?

মা তো অরুণমামার সঙ্গে কথা বলছে। সেই মোড়ে।

অরুণমামা গিয়েছিল নাকি তোমাদের সঙ্গে?

হ্যাঁ তো। আমরা যে অরুণমামার গাড়িতেই গেলাম মোড় থেকে।

ও। ভাল, খুব ভাল।–বলে লাবুর হাতখানা মুঠোয় চেপে চোখ বোজে প্রীতম। তারপর গাঢ়স্বরে বলে, তোমার কাকা এসেছে। শতাকাকা। শোনো মা, আমি যদি শিলিগুড়ি চলে যাই তা হলে কি তোমার খুব কষ্ট হবে?

আমিও যাব।

তোমার যে স্কুল! তোমার মাও এখানে থাকবে।

ইস! তুমি গেলে আমার যে কান্না পাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *