1 of 2

১৩. বদ্রীর ইনফ্লুয়েনজা হয়েছিল

বদ্রীর ইনফ্লুয়েনজা হয়েছিল, খবর পেয়েছিল শ্রীনাথ। তারপর থেকে সে আর আসছে না। নদীর ওধারে মাইল দশেক ভিতরে শ্যামগঞ্জ বলে একটা জায়গা আছে। যেখানে এক লপ্তে প্রায় বিঘে দশেক জমি আছে। তাতে বর্গা নেই। খবরটা ভালই ছিল। কিন্তু বদ্রী একদম নাপাত্তা। সে থাকেও বহু দূরে। লাইনের ওধারে অনেকটা যেতে হয় কাঁচা রাস্তায়। জায়গাটা খুব ভাল চেনেও না শ্রীনাথ।

দাদার এই বাড়ি থেকে তার যে বাস উঠে গেছে সেটা সে টের পেয়েছে বহুকাল। ভাবন-ঘরের চাবি তার সঙ্গে থাকে। মজবুত তালা ঝোলে দরজায়। ড়ুপলিকেট চাবিটা সে বিছানার তলায় লুকিয়ে রেখেছে। সেটা যেমন কে তেমনই আছে। খোয়া যায়নি। তবু সজল কী করে ঘরে ঢোকে এবং তার জিনিসপত্র ঘাঁটে তা প্রথম-প্রথম ততটা খেয়াল করে ভাবেনি সে। কদিন আগে আবার তার ক্ষবে হাত পড়ায় হঠাৎ খেয়াল হল।

স্বপ্না এসেছিল সকালে, চা দিতে। তাকে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ রে, আমার ঘরের তালাটা সজল খোলে কী করে জানিস?

স্বপ্না বা স্বল্পলেখা রোগা মেয়ে। খুব শান্ত, খুব নীরব এবং দুঃখী চেহারা। মুখখানা ভীষণ ধারালো বটে, কিন্তু স্বভাবের সঙ্গে তার মুখশ্রীর কোনও মিল নেই। নিজের এই মেয়েটিকে শ্রীনাথ কখনও ঠিক বুঝতে পারে না।

শ্রীনাথের প্রশ্ন শুনে স্বপ্ন ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থেকে বলল, বোধ হয় চাবি আছে।

চাবি তো আমার কাছে।

তা হলে ঠিক জানি না।

সজলকে দেখতে পেলে পাঠিয়ে দিস তে।

ও আসবে না।

কেন?

সেদিন সেই মোরগ চুরির পর থেকে মা ওকে দক্ষিণের ঘরে সারাদিন শেকল দিয়ে আটকে রাখে।

ও।–বলে একটু গম্ভীর হয়ে যায় শ্রীনাথ। ভিতরবাড়িতে কী হয় না হয় তার সব খবর তার কানে এসে পৌঁছয় না। শ্রীনাথ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আচ্ছা যা।

স্বপ্ন চলে যাচ্ছিল। শ্রীনাথ ডাকল, শোন।

বলো।

চাবির কথাটা তোর মায়ের কানে তুলিস না।

স্বপ্ন একটু হেসে বলল, কে ওসব কথা তুলবে বাবা! মা যে রেগে আছে দু’দিন ধরে! ভাইকে শুধু গলা টিপে মেরে ফেলতে বাকি রেখেছে। ছোটমামা না আটকালে কী যে হত!

বিরক্ত হয়ে শ্রীনাথ বলল, দোষ যখন স্বীকারই করেছে তখন অত মারধরের কী দরকার ছিল!

মা জানতে চাইছিল মোরগটাকে ও মারল কেন! সেই কথাটার জবাব দেয়নি যে। শুধু বলেছে, আমি চুরি করেছি. আমিই কেটেছি। কিন্তু কেন তা বলতে পারছে না।

কেন আবার! রক্তের দোষ! মায়াদয়াহীন বলেই তরতাজা মোরগটাকে মেরে মজা দেখেছে। আমি তো দেখেছি ও প্রায়ই ডিম চুরি করে এনে ঢিল ছোড়ে তাই দিয়ে।

স্বপ্না চলে গেল। চাবির রহস্যটা বসে বসে ভাবতে লাগল শ্রীনাথ। ভেবে কোনও হদিশ করতে পেরে বাগানে নেমে গেল।

গাছপালার মধ্যে শ্রীনাথের আনন্দ অগাধ। আচার্য জগদীশ বোস গাছপালার মধ্যে প্রাণ আবিষ্কার করেছিলেন। সারা দুনিয়ার বোকা লোকেরা এক বাঙালির কাছে শিখেছিল এই মহান সত্য, তবু নোবেল প্রাইজ দেয়নি। শ্রীনাথের হাতে ক্ষমতা থাকলে জগদীশবাবুকে চারবার নোবেল প্রাইজ দিত। গাছপালার প্রাণ যে কত বড় আবিষ্কার তা কেন যে তেমন স্বীকার করল না সাহেবরা! জগদীশ বোস নেটিভ বলেই কি? হবে। সাহেবরা বড় নাকউঁচু জাত।

প্রতিদিন শ্রীনাথ নিজেও গাছপালার প্রাণ আবিষ্কার করে। এখানে এক অদ্ভুত নীরব অনুভূতির সাম্রাজ্য। বাক্য নেই, শ্রবণ নেই, যৌনতা নেই, তবু জন্ম আছে, বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার আপ্রাণ প্রয়াস আছে। ক্রিসেনথিমাম, কসমস, পপি বা গোলাপ বলে কথা নেই, নগণ্য আগাছাও শ্রীনাথের প্রিয়। ফুলের বাগান থেকে বহুবার ওপোনো আগাছা সে ঘের-দেয়ালের ধারে ধারে পুঁতে দিয়ে। এসেছে। আজও বীজ থেকে গাছের জন্ম দেখে অবাক হয় শ্রীনাথ। বসে বসে ভাবে। চোখে। সবুজের ঘোর লেগে যায় তার। মাটির ভিতব পোঁতা শুকনো বীজ থেকে গুপ্ত সৈনিকের মতো সারি সারি ওরা কী করে যে বেরিয়ে আসে! কী অদ্ভুত! কী আশ্চর্য! একই মাটি থেকে বীজের রকমফেরে কী করে জন্মায় এত রকমের গাছ!

শ্রীনাথের হাতের গুণে সামনের বাগানটা হয়েছে দেখবার মতো। অবশ্য কারও চোখে পড়ে না তেমন। লোক লাগিয়ে শুকনো ডালপালা দিয়ে দেড় মানুষ সমান উঁচু দুর্ভেদ্য একটা বেড়া দিয়ে রেখেছে শ্রীনাথ, যাতে তেমন চোখে না পড়ে। খ্যাপা নিতাইয়ের কুকুরটা আর কোনও কাজের না হোক, গাছের পাতা খসলেও চেঁচায়। শুধু চেঁচাতে জানে। তবু সেই ভয়েই ফুলচোররা বড় একটা হানা দেয় না। এ হল শ্রীনাথের নিজস্ব বাগান। নার্সারি থেকে বিচিত্র ফুলের বা ফলের বীজ আর চারা নিয়ে আসে সে। সার দেয়, জল দেয়, আর দেয় অগাধ মায়া মেশানো ভালবাসা। গাছ তেজে বেড়ে ওঠে। বার বার অবাক করে, আনন্দে ভরে দেয় শ্রীনাথকে। যতক্ষণ সে বাগানে থাকে ততক্ষণ সে অন্য মানুষ। কাম নেই, ক্রোধ নেই, লোভ নেই, অভিমান নেই, এমনকী অহংবোধটুকু পর্যন্ত থাকে না। ওয়ার্ডসওয়ার্থ বা বিভূতিভূষণের মতো সেও তখন অর্ধেক নিজেকে প্রকৃতির মধ্যে বিসর্জন দেয়। সম্মোহিত হয়ে থাকে নীরব প্রাণের খেলা দেখে।

একটা নাইট কুইনের গোড়া উসকে দিচ্ছিল শ্রীনাথ। হঠাৎ নজরে পড়া বাগানের পিছন দিয়ে তাগাছায় ঢাকা পড়ো এক ফালি জমির দিকে। কেউ চলাচল করে না, দুর্ভেদ্য জঙ্গলে ঢেকে আছে। কিন্তু ওই পড়ো জমি দিয়ে যেতে পারলে সকলের অলক্ষে দক্ষিণের ঘরের পিছন দিকটায় হাজির হওয়া যায়।

একটু ভাবল শ্রীনাথ। যাওয়াটা ঠিক হবে কি?

তারপর ভেবে দেখল, তার সংকোচের কোনও কারণ তো নেই। সে তো এখনও এ বাড়ির কর্তা।

খুরপি রেখে শ্রীনাথ উঠল। জঙ্গলে কাঁটাগাছ থাকতে পারে বলে ঘরে গিয়ে বাগানের কাজের হাওয়াই চটি ছেড়ে একজোড়া পুরনো রবারের বর্ষার জুতো পরে নিল। সা বা অন্য কিছুর ভয় তার নেই। জন্মসুত্রেই বোধ হয় সে কোনও জায়গায় সাপ আছে বা নেই তা টের পায়। গত গ্রীষ্মেও একদিন ভোররাতে অন্ধকারে বারান্দার সিঁড়িতে পা বাড়িয়েও সে পা ফেলেনি। মন থেকে কে যেন সাবধান করে দিয়েছে। পা আটকে গেছে। পরে টর্চ জ্বেলে দেখেছে, কেউটে। এখন শীতকাল বলে আরও ভয় নেই।

পড়ো জমিটা মোটামুটি নির্বিঘ্নেই পেরিয়ে গেল শ্রীনাথ। দক্ষিণের ঘরের পিছনে নিষ্পত্র ঝোপঝাড়। একটু খড়মড় শব্দ হয়ে থাকবে।

ঘরের ভিতর থেকে ভয়ে ভয়ে সজল বলল, কে রে?

শ্রীনাথ জানালায় পৌঁছে দেখল, পড়ার টেবিলে বসে সজল সোজা জানালার দিকেই চেয়ে আছে। ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক হয়ে আছে। চোখে অবাক চাউনি।

বাবা!

শ্রীনাথ মৃদু ম্লান একটু হাসল। বলল, ভয় পাওনি তো!

না। তুমি ওখানে কী করছ?

তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল।

সজল আরও অবাক। বাবার কথা থাকলে এমন চোরের মতো পিছনের জানালা দিয়ে কেন? কিন্তু সেটা বলল না সজল। চেয়ে রইল।

শ্রীনাথ বলল, তোমাকে তোমার মা আটকে রেখেছে বুঝি?

সজল মৃদু একটু হাসল। চমৎকার দেখাল ওকে। সুপুরুষ ছেলেটি। গালে টোল পড়ল। ঘন জ্বর নীচে চোখ দুটো ঝিকিয়ে উঠল বুদ্ধির দীপ্তিতে। চাপা স্বরে বলল, হ্যাঁ। কিন্তু আমার খারাপ লাগছে না।

আটক থাকলে তো খারাপ লাগারই কথা। তোমার তবে লাগছে না কেন?

খারাপ লাগলে তো আমি মার কাছে হেরে যাব। তো চায় আমার খারাপ লাগুক।

এ কথায় একটু অবাক হয় শ্রীনাথ। সজল যে অনেক গভীর করে ভাবতে পারে তা টের পায়নি কখনও। এ প্রসঙ্গে আর না গিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, সারাদিন তুমি কী করো?

বই পড়ি। আর পাটাতনের ওপর অনেক পুরনো জিনিস আছে। এত জিনিস যে অবাক হতে হয়।

পাটাতনে ওঠা না তোমার বারণ? ওঠবার মইটা তেমন ভাল নয়। নড়বড় করে। পড়ে গেলে?

সজল ভয় খেয়ে বলে, সব সময় নয়। যখন একঘেয়ে লাগে, ঘুমটুম পায়, তখন উঠি। সাবধানে।

উঠে কী করো?

জিনিস দেখি। ওপরে অনেক জিনিস বাবা! আমি রোজ ওখানে গুপ্তধন খুঁজি।

এত সহজভাবে সজল কখনও শ্রীনাথের সঙ্গে কথা বলে না। এখন কেন বলছে তাও বোঝে শ্রীনাথ। সজল জানে তার বাবা আর মা দুই প্রতিপক্ষ। সব সময়েই সজল তার মায়ের পক্ষে। কিন্তু সেই মোরগ চুরির ঘটনার পর মায়ের ওপর গভীর ও তীব্র বিরাগ থেকে সজল সাময়িকভাবে তার বাবার পক্ষ নিয়েছে। এবং এও হয়তো কারণ যে, শ্রীনাথকে এভাবে চুপি চুপি পিছনের জানালায় হাজির হতে দেখে সে বাবার গুরুত্বটা খানিক হারিয়ে ফেলেছে।

শ্রীনাথ বলল, আমি কখনও ওই পাটাতনে উঠিনি। কী আছে বলো তো!

অনেক ট্রাংক বাক্স। পুরনো সব মেটে হাঁড়ির মুখে মালসা দিয়ে ঢেকে ন্যাকড়া জড়িয়ে রাখা। পুরনো বই আর খবরের কাগজের ভাই।

আর কী?

একটা টর্চ থাকলে বুঝতে পারতাম। পাটাতনটা দিনের বেলাতেও এত ঘুটঘুটি অন্ধকার যে কিছুই ভাল করে বোঝা যায় না।

আর উঠো না। মা টের পেলে আবার শাস্তি দেবে।

দিলেই কী? আমাকে যে গুপ্তধন খুঁজতে হবে।

ভ্রুকুটি করে শ্রীনাথ বলে, শাস্তিকে তুমি ভয় করো না?

সজল বাবার দিকে চেয়ে ফাঁকাসে হয়ে গিয়ে বসা স্বরে বলে, করি।

করবে। শাস্তিকে ভয় যে না করে তার সর্বনাশ।

সজল চুপ করে চেয়ে থাকে।

বাবা-ছেলের মধ্যে একটু আগের সহজ সম্পর্কটা হঠাৎ কেটে যায়।

শ্রীনাথ গলা খাকারি দিয়ে বলে, ইয়ে, তোমাকে একটা প্রশ্ন করার ছিল। জবাব দিতে ভয় খেয়ে। সত্যি কথা বললেও আমি রাগ করব না।

কী?

আমার ঘরের তালাটা তুমি কীভাবে খোলো? চাবি দিয়ে, না অন্য কোনও যন্ত্রপাতি আছে?

সজল একটু অবাক হয়ে বলে, কেন? চাবি দিয়েই খুলি। অবশ্য খোলাটা অন্যায় হয়েছে। আর কখনও–

বাধা দিয়ে শ্রীনাথ বলে, অন্যায় তুমি স্বীকারও করেছ। সেটা নিয়ে আমার কোনও প্রশ্ন নেই। কথা হল, চাবি দিয়েই বা খোলো কী করে? চাবি তো আমার কাছে থাকে।

সজল একটু আমতা-আমতা করে বলে, মায়ের কাছে যে চাবিটা আছে, সেইটে চুরি করি।

মায়ের কাছে! শ্রীনাথ ভীষণ অবাক হয়। ঘরের তালাটা সে মাস দুই আগে চাদনি বাজার থেকে বাইশ টাকায় কিনেছে। নামকরা তালা। দুটো চাবিই তার কাছে। তৃষার কাছে আর একটা চাবি যায় কী করে? এলেবেলে তালা নয় যে, যে-কোনও চাবিতে খুলে যাবে। শ্রীনাথ কঠিন স্বরে বলে, তোমার মায়ের কাছে তো চাবি থাকার কথা নয়।

সজল বাপের দিকে চেয়ে আবার ফ্যাকাসে হয়। শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বলে, গুরুপদ চাবিওলা মাকে চাবিটা বানিয়ে দিয়েছে।

শ্রীনাথ অবাক ভাব চেপে রেখে বলে, ও তালার চাবি কি বানানো যায়? চাবি বানাবে কীভাবে? সজল মাথা নেড়ে বলে, জানি না তো! গুরুপদদা একদিন চাবিটা দুপুর বেলায় মাকে দিয়ে যায়। সেই চাবি দিয়ে মা একদিন তোমার ঘর খুলে বৃন্দাদিকে দিয়ে ঘর পরিষ্কার করিয়েছিল।

ও।–বলে স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে থাকে শ্রীনাথ।

সজলের ভয় কাটেনি, বরং বাড়ল। সে তাড়াতাড়ি বলল, দোষটা আমারই।

তুমি মোরগটাকে মেরেছিলে?

হ্যাঁ।

মরার সময় মোরগটা কেমন করেছিল?

খুব ডানা ঝাপটাচ্ছিল। ভীষণ ডাকছিল। আমাকে ঠোকরানোর চেষ্টা করছিল। অথচ যখন চুরি করে ঠ্যাং ধরে নিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন কিছু করেনি। ঠিক যখন কাটব তখন ওই রকম করতে লাগল। কী করে যেন টের পেল, আমি ওকে কাটব।

মোরগের তো অত বুদ্ধি নেই, তবে টের পেল কী করে?

সজল কিছুক্ষণ ভেবে বলে, ক্ষুরটা দেখে বোধ হয়।

ওরা তো ক্ষুর চেনে না।

অসহায় ভাব করে সজল বলে, তা হলে কী?

শ্রীনাথ একটু হেসে বলল, ওরা অস্ত্র চেনে না ঠিকই। তবে বোধ হয় ওরা কখনও-সখনও মানুষের চোখ মুখ আর হাবভাব দেখে কিছু টের পায়। আর কিছু না হোক, নিষ্ঠুরতাটা বুঝতে পারে, মৃত্যুর গন্ধও পায় নিশ্চয়ই।

সজল একটু অন্যমনস্ক হয়ে বোধ হয় দৃশাটা কল্পনা করে। তারপর মাথা নেড়ে বলে, আমি অতটা বুঝতে পারিনি।

শ্রীনাথ সান্ত্বনার গলায় বলে, তোমার এখনও বোঝার বয়সও হয়নি। বয়স হলেও অনেকে ব্যাপারটা বোঝে না।

কাজটা খুব অন্যায় হয়েছিল, না?

শ্রীনাথ একটা শ্বাস ফেলে বলে, আমরা সবাই যখন মাছ মাংস খাচ্ছি তখন কাজটাকে একা তোমার অন্যায় বলি কী করে? মোরগ তো সবাই মারছে। সজল একটু হেসে বলে, তা হলে অন্যায় নয় তো?

তা ঠিক বলতে পারি না। হয়তো অন্যায়ই হবে। কিন্তু তুমি ওটা করতে গেলেই বা কেন? মাংস খেতে ইচ্ছে হয়ে থাকলে মংলুকে বললেই তো পারতে। ও কেটে দিত।

মাংস খেতে ইচ্ছে হয়নি তো! মা রোজ টেংরির জুস খাওয়ায়। রোজ খেতে ভাল লাগে, বলল? খেতে খেতে এখন মাংসের গন্ধে আমার বমি আসে।

শ্রীনাথ বলে, তা হলে কাটলে কেন?

এমনিই।

শ্রীনাথ হাসে, দূর পাগল! এমনি এমনি কিছু করে নাকি মানুষ? কারণ একটা থাকেই। একটু ভেবে দেখ তো!

আমার খুব রাগ হয়েছিল।

কার ওপর?

সকলের ওপর।

আমার ওপরেও?

সজল লজ্জা পায়। মাথা নেড়ে বলে, না, তোমার ওপর নয়।

তবে কি মায়ের ওপর?

হুঁ।

কেন?

সজল এবার আবার একটু ভাবে। ভেবে বলে, ঠিক মায়ের ওপরেও নয়।

তবে কার ওপর?

এই বাড়িটার ওপর। গাছপালার ওপর। হাঁস-মুরগির ওপর।

তোমার অত রাগ কেন?

এক-একদিন খুব রাগ হয়।

শ্রীনাথ আবার ক্ষীণ হাসে। বলে, রেগে যদি মোরগ মারতে পারো, তা হলে একদিন মানুষকেও খুন করে বসবে যে!

না, তা নয়। –সজল মাথা নিচু করে।

শ্রীনাথ এই বাক্যালাপে আগাগোড়া কৌতুক বোধ করছে। সে হেসেই বলল, স্কুলে যাচ্ছ না?

না। দু’দিন মা স্কুলে যাওয়া বন্ধ রেখেছে।

কবে তোমার ছুটি হবে?

বোধ হয় আজ। বৃন্দাদি সকালে এসে বলে গেছে পড়া করে রাখতে। আজ স্কুলে যেতে হবে।

রাত্রে তুমি এই ঘরে একা থাকো?

না, ছোটমামা শোয়।

ও।–শ্রীনাথ মৃদু স্বরে বলে, শোনো। তোমার সঙ্গে আমার আরও কয়েকটা কথা আছে। সন্ধের পর একবার আমার ঘরে এসো।

আচ্ছা।

তারপর শ্রীনাথ একটু ইতস্তত করে বলে, আমার সঙ্গে এই যে কথা হল এটা কাউকে বোলো না। আমি লুকিয়ে তোমার কাছে এসেছিলাম।

সজল এক গাল হেসে বলল, জানি।

শ্রীনাথও হাসল।

বলতে কী, মল্লিদাদার ওপর শ্রীনাথের কোনও রাগ নেই।

 

আগাছায় ভরা পড়ো জমি পেরিয়ে সামনের দিকে ফিরে আসতে আসতে শ্রীনাথ ভাবে, স্ত্রী বা মেয়েমানুষের ওপর অধিকারবোধটা ভুলে যেতে পারলে পৃথিবীটা কি আরও একটু সুন্দর হয়? কুকুব, বেড়াল, পাখি, পতঙ্গের তো বউ থাকে না। ওরকম হলেই কি ভাল? তা হলে সজল কার ছেলে, তার বউ কার সঙ্গে শুয়েছে, না শুয়েছে এসব বাজে চিন্তায় আর কষ্ট পেতে হয় না। ভেবে দেখলে, সজলের ওপরেও তার বিরাগ থাকা উচিত নয়। নিজের জন্মের জন্য সে তো দায়ী ছিল না!

গাছপালা, কীটপতঙ্গের কাছ থেকে শ্রীনাথ আজকাল অনেক শিখছে।

পালং ক্ষেতে সরিৎ দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে বলল, জামাইবাবু, কোথায় ছিলেন? কখন থেকে খুঁজছি।

শ্বশুরবাড়ির কারও ওপর খুব খুশি নয় শ্রীনাথ। অবশ্য ওদের কোনও দোষও নেই। ভালমন্দে মিশিয়ে যেমন মানুষ হয়, ওরাও তেমনি সাধারণ। তবু তৃষার ওপর থেকে যেদিন তার মন সরে গেছে সেদিন ওদের ওপর থেকে গেছে।

শ্রীনাথ জোর করে মুখে হাসি এনে বলল, খুঁজছিলে?

হ্যাঁ। ভাবলাম, কোনও কাজ নেই যখন, জামাইবাবুর বাগানটা দেখে আসি। আমি খানিকটা বাগানের কাজ জানি।

খুব ভাল। এর পর থেকে এই বাগান তোমরাই দেখবে।

কেন, ওকথা বলছেন কেন? বাগান তো আপনারই।

কিছুই আমার নয়। জানো না?–মুখ ফসকে কথাটা বেরোল।

সরিৎ বোধ হয় মুখোমুখি কথাটা শুনে লজ্জা পেল। বলল, আমার বেশি জানার দরকার কী?

শ্রীনাথ অবশ্য সামলে গেল। বলল, আসলে কী জানো? এসব এখন ভাল লাগে না। এখন ভাল লাগে চুপচাপ সময় কাটিয়ে দিতে। কেউ একজন যদি বাগানটা দেখে তো ভালই।

সরিৎ মাথা নেড়ে বলে, আমি দেখব। আপনি কী করে কী করতে হয় বলে দেবেন।

বেশ তো!

সরিৎ বেশ লম্বা-চওড়া ছেলে। ওদের ধাতটাই ওরকম। সা জোয়ান সব। তবে খুব একটা বুদ্ধি বা রুচি নেই। একটু ভেতা, ব্যক্তিত্বহীন। এক সময়ে এই সরিৎ খুব প্রিয় ছিল শ্রীনাথের।

সরিৎ বলল, আগে আপনি আমাকে সব সময়ে ব্রাদার বলে ডাকতেন। এবার এসে একবারও ডাকটা শুনিনি।

শ্রীনাথ হাসল। বলল, কতকাল দেখা হয়নি। কী ডাকতাম তা মনেই ছিল না। এবার থেকে ডাকব।

আমাদের ভুলে গিয়েছিলেন তবে?–সরিৎ সকৌতুকে প্রশ্ন করে।

শ্রীনাথ বিপাকে পড়ে বলে, আরে না। ডাক ভুলতে পারি, মানুষকে কি ভোলা যায় সহজে!

শুধু মানুষ কেন, আমরা তো আত্মীয়। নয় কি?

সে তো বটেই।

তবে?

শ্রীনাথ কথার পিঠে কথা বলতে জানে না। তাই লজ্জা পেয়ে বলল, এসো, ঘরে এসো।

ঘরে ঢুকেই সরিৎ বলে, দারুণ তো! ঘর না বার তা বোঝা যায় না এত আলো বাতাস!

শ্রীনাথ তার ইজিচেয়ারে বসে বলল, তোমাদের বাড়ির সকলের খবর-টবর কী?

সরিৎ জবাবের জন্য তৈরিই ছিল। বলল, দিন পনেরো হল এসেছি, এই প্রথম এ কথাটা জিজ্ঞেস করলেন।

শ্রীনাথের বাস্তবিকই কারও কোনও খবর জানার কৌতূহল হয়নি। এইসব নীতি-নিয়ম ভদ্রতাবোধ তার মাথা থেকে উবে যাচ্ছে কেন?

সরিৎ ফের বলল, এ কয়দিন ভাল করে কথাই বলছিলেন না। আমি ভাবলাম, আমাদের ওপর বুঝি রাগ করে আছেন।

কথাটার জবাব হয় না। শুধু হাসি দিয়ে সেরে দিতে হয়। শ্রীনাথ যতদূর সম্ভব অপরাধী হাসি হেসে বলল, সংসারের নানা রকম ব্যাপার। আমি ঠিক এত বড় একটা এস্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে অভ্যস্ত নই কিনা। তাই বড় ভুলও হয় সব কাজে।

সরিৎ বিছানায় বসে বলল, কার খবর জানতে চান?

শ্রীনাথের মনে পড়ল প্রথমেই শাশুড়ির কথা। বিয়ের সময় শ্রীনাথ খুব খেতে পারত। শাশুড়িও তাকে তখন প্রাণভরে খাইয়েছেন। থালার চারদিকে বাটি সাজিয়ে গোটা দুই বৃত্ত রচনা করে ফেলতেন প্রায়। প্রথমেই সেই ভদ্রমহিলার কথা মনে পড়ে। শুনেছে, খুব সুখে নেই। শ্বশুর রিটায়ার করার পর ছেলের হাততোলা হয়ে আছেন।

শ্রীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, জিজ্ঞেস না করাই বোধ হয় ভাল। বরং মনে মনে সকলের মঙ্গল প্রার্থনা করাটাই এখন দরকার।

সরিৎ কথাটা বুঝল। একটু গম্ভীর হয়ে বলল, এটা খুব ঠিক কথা। জানতে গেলেই মন খারাপ হবে। কেউই তো ভাল নেই।

তুমি কেমন সরিৎ?

সরিৎ না, ব্রাদার।

হ্যাঁ হ্যাঁ, ব্রাদার।

আমিও ভাল না জামাইবাবু। বড়দার কাছে ছিলাম। ভাল ছিলাম না। সেজদি ডেকে আনল, এলাম। দেখি এখানে কেমন থাকি।

খারাপ লাগছে না তো এখানে?

ভাল কি লাগার কথা! বেকারকে কাজ না দিয়ে যত ভালই রাখুন সে ভাল থাকে না।

শ্রীনাথ চিন্তিত মুখে বলে, সেটা তো সকলেরই প্রবলেম ব্রাদার।

আমারও। তাই বলি, কেমন আছি না জানতে চেয়ে বরং আমারও মঙ্গল প্রার্থনা করুন।

দূর পাগলা! তোমার তো বয়স কম, জীবনটাই পড়ে আছে।

একটা চাকরি দিন, তবেই জীবন থাকবে। নইলে কবে শুনবেন, ট্রেনের তলায় গলা দিয়েছি।

যাঃ!–বলে হাসে শ্রীনাথ।

মাইরি জামাইবাবু! বিশ্বাস করুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *