1 of 2

১১. এখানে দু’কাঠা চার ছটাক জমি

এখানে দু’কাঠা চার ছটাক জমি আছে। দাম পঁচিশ হাজার।

বড্ড বেশি। নাকতলায় এত বেশি জমির দাম নয়।

নাকতলা কি আগের নাকতলা আছে বউদি? জমির সামনে যোলো ফুট চওড়া রাস্তা হবে।

সে যখন হবে তখন দাম বেশি দেব।

আসলে জমিটা পছন্দও নয় বিলুর। বড় ঘিঞ্জি পাড়ার মধ্যে, চারধারে বড় বড় বাড়ি। রাস্তাও ভাল নয়। কাঁচা ড্রেন থেকে ঝাঁঝালো কটু গন্ধ আসছে। সে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে একটু পিছিয়ে এল। পাশেই একটা দোতলা বাড়ি থেকে একটা বউ তাকে লক্ষ করছে।

দালাল লোকটা মরিয়া হয়ে বলল, দুটো প্লট ছেড়ে পরের প্লটে একজন ফিল্ম স্টার থাকে।

কৌতূহলে বিলু জিজ্ঞেস করে, কে?

দালাল যার নাম বলল সে আসলে পড়তি অভিনেত্রী। বিলু তাই আগ্রহী হল না। বলল, গলফ ক্লাবের একটা প্লটের কথা বলেছিলেন যে।

দালাল খদ্দেরের ধাত বুঝে একটু অবহেলার স্বরে বলে, সে বিক্রি হয়ে গেছে। আরও বেশি দাম ছিল।

এই শীতেও পরিশ্রান্ত বোধ করে বিলু। সকাল থেকে এ পর্যন্ত গোটা চারেক প্লট দেখল। বেহালা, কসবা, গড়িয়া আর নাকতলা। সবই কলকাতার বাইরের অঞ্চল। কিন্তু কোথাও তেমন খখালামেলা নেই আর। অবারিত মাঠঘাট নেই। আবার লোকবসতি বেশি বলে তেমন ফ্যাশনদুরস্ত বাজারহাট বা দোকান-পসারও তেমন হয়নি। ভবানীপুরে থেকে থেকে অভ্যাসটাই খারাপ হয়ে

গেছে।

গাড়িটা অনেক দূরে রাখতে হয়েছে। এত দূরে গাড়ি আসেনি। হয়তো আসত, কিন্তু দালালই সাহস পায়নি রাস্তা ভাল নয় বলে।

বিলু একটু উম্মার সঙ্গে বলে, পছন্দসই একটা জমিও কিন্তু আপনি দেখাতে পারলেন না।

দালাল লোকটি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে, কোনওটা তো অপছন্দের নয় বউদি। এই জায়গাগুলো সবই ডেভেলপ করবে, তখন দেখবেন প্লটটা নিয়ে রাখলেন না বলে দুঃখ হবে।

ডেভেলপ করেনি বলছেন, তা হলে দামই বা অত বেশি কেন? এসব জায়গার দাম আরও কম হওয়া উচিত।

দালাল মাথা নেড়ে বলে, পঁচিশ হাজার আজ বলছে। এক মাস পরেই দেখবেন, ত্রিশ উঠে গেছে। আর জমির দাম একবার উঠলে আর কখনও নামে না। ওই একটা জিনিস কেবল উঠেই যাবে।

শীতের রোদ বলে রোদের তেজ কম নয়। মাথা বাঁচাতে ঘোমটা দিয়েছে বিলু, চোখ বাঁচাতে গগলস্‌। এখন বেলা বাড়ায় একটু গরমও লাগছে। হেঁটেছে অনেকটা।

দালাল শেষ কথা বলল, জমির তো আর সাপ্লাই বাড়বে না। ও ভগবান যা মেপে দিয়ে রেখেছেন। তাই চিরকাল থাকবে। কিন্তু চাহিদা বেড়েই যাবে, দামও চড়বে। যত সব বড় ফ্যামিলি ভেঙে টুকরো টুকরো হচ্ছে, আর সঙ্গে সঙ্গে জমির জন্য হন্যে হয়ে উঠছে লোক। বাপ নিজে বাড়ি করল তো তার তিন উপযুক্ত ছেলে তিনটে বাড়ি হাঁকাল, কেউ কারও সঙ্গে থাকতে চায় না আজকাল। প্রত্যেকেই চায় আলাদা সংসার, আলাদা বাড়ি। তা ছাড়া বাড়িওয়ালারা হুড়ো দেয় বলেও লোকে নিজে বাড়ি করতে চায়।

অরুণের সাদা অ্যামবাসাডার গাড়ি রোদে ঝিকোচ্ছে বড় রাস্তায়, অরুণ পিছন ফিরে প্রীতমকে কী যেন বলছে। পিছনের সিটে প্রীতম বসে আছে নির্জীব হয়ে। সে কিছুই শুনছে বলে মনে হল না। চোখ বোজা, ঠোঁটে ক্লান্ত একটু হাসি।

অরুণ বলল, পছন্দ হয়েছে?

না, বড্ড ঘিঞ্জি।

তোমার জন্মেও পছন্দ হবে না।

বিলু কুটি করে বলে, পছন্দের মতো হলেই পছন্দ হবে।

দালাল লোকটা সামনের সিটে অরুণের পাশে উঠে বসে। বিলু পিছনের সিটে প্রীতমের পাশে বসে বলে, তোমাকে খামোখা কষ্ট দিলাম।

প্রীতম চোখ মেলে চেয়ে বলে, খুব নয়, তবে এখন শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।

শোবে? শোও না!–বলে বিলু নিজের কোল দেখিয়ে দিয়ে ঠিক হয়ে বসে।

প্রীতম শোয় না। অরুণের সামনে কেমন দেখাবে। সে বলল, না, পারব।

একটা বা দুটো বালিশ আনলে পারতে।–অরুণ গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলে।

ভুল হয়ে গেছে।–বিলু জবাব দেয়।

প্রীতম লজ্জার সঙ্গে বলে, না না, সেটা খারাপ দেখাত। আমার অত বেশি কষ্ট হচ্ছে না।

হলেই কি আপনি বলবেন!–অরুণ মুখ ফিরিয়ে একটু হাসে। তারপর মাথা নেড়ে বলে, আপনি তাজ্জব লোক।

কেন?–মৃদু উদাস গলায় প্রশ্ন করে প্রীতম। ঠিক প্রশ্নও নয়। সে যে একটু তাজ্জব লোক তা সে জানে।

আপনি ভাবেন, নিজের কষ্টের কথা স্বীকার করার মানেই হল, ডিফিট।

এ কথার নিশ্চয়ই জবাব হয়। কিন্তু প্রীতম জবাব দেওয়ার মতো দমে কুলিয়ে উঠতে পারে না। বহুক্ষণ সে বসে আছে। হেলান দিয়ে যথেষ্ট নরম গদিতে ড়ুবে থাকা সত্ত্বেও তার শরীর এখন খাড়া থাকতে চাইছে না। শরীরের জীবাণুরা খেপে উঠছে। ঝিঝি ডাকছে সারা পা জুড়ে।

একটু মাথা হেলিয়ে দিতেই বিলুর কাঁধে আশা পায় সেটা। বিলু বলে, তোমার লজ্জার কী? ভাল করে মাথা রাখো।

প্রীতম আবার ঘাড় সোজা করে বসে।

উঠলে কেন?

রাস্তাঘাট দেখি। বহুকাল এসব দিকে আসিনি।

বিলু মৃদু স্বরে বলে, দেখতে হবে না। মাথাটা আমার কাঁধে রেখে চোখ বুজে থাকো। কোনও কাজ হল না আজ, শুধু শুধু তোমাকে টেনে আনলাম।

প্রীতম উদাসভাবে বসে থাকে। বলে, পছন্দ হল না কেন?

পাড়াগুলো কেমন যেন!

কেমন?

ভাল নয়।

সব জায়গাতেই মানুষ থাকছে। তুমিও থাকতে পারবে।

এটা বুঝি কোনও কথা হল? মানুষ তো উত্তর মেরুতেও থাকে, মরুভূমিতেও থাকে।

নাকতলা তো মেরুও নয়, মরুও নয়।–অরুণ সামনে থেকে বলে।

তুমি থার্ড পারসন। তোমার কথা বলা সাজে না।–বিলু ধমক দেয়।

প্রীতম উদাসভাবে চেয়ে থাকে বাইরের দিকে। এই পৃথিবীতে তার কোনও জমির আর প্রয়োজন নেই। ভেবে দেখলে কারওরই প্রয়োজন নেই। তবে সেটা সকলে সব সময়ে টের পায় না। প্রীতম আজকাল পায়। তবে তার কাছে গোটা পৃথিবীটাই একটা সুন্দর সম্পূর্ণ বাস্তুজমি। সবটুকুই তার দরকার। আসমুদ্র পর্বত, অরণ্য, বৃষ্টি, আকাশের নীল রোদ, জ্যোৎস্না মিলিয়ে তার বিশাল বাড়ি। গোটা পৃথিবীকেই তার বড় দরকার ছিল। আরও কিছুদিন।

বিলু শালটা ভাল করে জড়িয়ে দিচ্ছিল তার গলায়। একটু বিরক্তির মাথা ঝাকুনি দিয়ে আপত্তি জানাল সে। বাইরে ঝকঝকে রোদে রাসবিহারীর মোড় পেরিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। বাঁ ধারে একটা ঘেয়ো চায়ের দোকানের সামনের ফুটপাথে এই রকম সরল রোদে শীত-গ্রীষ্মে দাঁড়িয়ে থাকত বীতশোক। কোনও কাজ ছিল না, সারা জীবন কোনও পয়সা রোজগার করেনি। ভাল আড়বাঁশি বাজাতে পারত বলে সিনেমা-থিয়েটারে কাজ করেছে বহু। কিন্তু পয়সা আদায় করার এলেম ছিল না। চাইতে জানত না। বেশ বয়স হয়ে যাওয়ার পর যখন বুঝেছিল আর কিছু করার নেই তখন থেকে এইখানে চুপ করে সকাল-সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে থাকার অভ্যাস করে নিয়েছিল। ভাইদের সংসারে অনাদরের ভাত জুটে যেত। দু’আনা-চার আনা হাতখরচও। সেই ছিল তার অঢেল। ট্রামে বাসে চড়ত না। বিড়ি খেত। দাঁড়িয়ে থাকত। কখনও এক নাগাড়ে চেয়ে থাকত পশ্চিম ধারে। কখনও পুব ধারে। কিছু দেখত না। কেবল চেয়ে থাকত। অমন নির্বিকার মানুষ, অমন অহং ও আমি-শুন্য লোক জীবনে দুটো দেখেনি প্রীতম। বীতশোককে সে বহুবার টাকা বা পয়সা দিয়েছে যেচে। হাত পেতে নিত। বলত, খুব ভাল হল। কয়েকদিন আর বাড়িতে পয়সা চাইতে হবে না। বড্ড বকে।

বীতশোকের দীন ভাব বহুবার নকল করার চেষ্টা করেছে প্রীতম। কিছুতেই হয় না। অভিনয় হয়ে যায়, কৃত্রিম হয়ে যায়। কতগুলো জিনিস কিছুতেই নকল করা যায় না। ভিতরে ওই দীনতার কোনও প্রস্রবণ না থাকলে হওয়ার নয়।

গাড়ি বাড়ির সামনে এসে গেল হু হু করে।

দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে লাবু। একটু ঝুঁকে, চোখে প্রবল উৎকণ্ঠা। পাখির মতো স্বরে ডাকল, মামণি।

প্রীতমকে ডাকল না। আজকাল প্রীতমকে ডাকে না লাবু।

অরুণ দরজা খুলে কাঁধ এগিয়ে দিয়ে হাতে তার কোমর জড়িয়ে ধরে।

প্রীতম নামে। পায়ের ওপর খাড়া হওয়ার চেষ্টা করে এবং বুঝতে পারে বৃথা চেষ্টা।

অন্য দিক দিয়ে সযত্নে জড়িয়ে ধরে বিলু। পাড়ার লোকজন দেখছে। রোজই দেখে। কী লজ্জা!

দোতলায় নিজের ঘরে বিছানায় পৌঁছে গড়িয়ে পড়ে প্রীতম। বাইরের পৃথিবী থেকে এসে এই খণ্ড ছোট্ট ঘরের মধ্যে তার যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে যায় সে।

বিলু রান্নাঘরে গেল। অরুণ বাইরের ঘরে দালাল লোকটার সঙ্গে বসে কথা বলছে। রাস্তায় পাড়ার ছেলেদের খেলার হা শোনা যাচ্ছে।

প্রীতম ঝিম মেরে পড়ে থাকে কিছুক্ষণ।

চা খাবে?–বিলু নিঃশব্দে এসে চুলে আঙুল দিয়ে বিলি কেটে জিজ্ঞেস করে।

খাব।

খুব হাফিয়ে পড়োনি তো?

না না।–বলে উঠে বসতে চেষ্টা করে প্রীতম।

উঠো না। আমি জানি, তোমার কষ্ট হচ্ছে।

তবু উঠে বসে প্রীতম। এইমাত্র মৃত্যু সম্পর্কে তার নতুন একটা কথা মনে হল। সে বলল, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে। ওরা চলে গেলে একবার আমার কাছে এসো।

ওরা এক্ষুনি চলে যাবে চা খেয়েই। তুমি শুয়ে থাকো, আমি আসছি।

কিন্তু প্রীতম শোয় না। বসে থাকে। বাইরের ঘর থেকেই অরুণ বিদায় নিয়ে চলে যায়। সদর বন্ধ করে বিলু ঘরে এসে প্রীতমের বিছানায় বসে।

কী বলছিলে?

প্রীতমের মুখে একটা নরম উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। মৃদু হাসি তার মুখে। সে বলে, মনে আছে বিয়ের পর অভিমান হলেই আমি তোমাকে বলতাম, আমি যখন মরে যাব তখন দেখো?

মনে থাকবে না কেন?

কিন্তু আমার মনে হয় কী জানো?

কী?

মানুষ মরে কিছু প্রমাণ করতে পারে না, কিছু প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।

সে তো ঠিকই।

অমন আলগা জবাব দিয়ো না। ভেবে দেখো। খুব গভীরভাবে ভাবো।

আমার কি অত সময় আছে? মেয়েকে চান করাব, তোমাকে চান করাব, রান্নাও অনেক বাকি।

আঃ বিলু! শোনো। যেয়ো না।

বলো।

অংশুকে তোমার মনে আছে?

কোন অংশু?

আমার কলিগ ছিল।

ওঃ। নামটা চেনা। ঠিক মনে পড়ছে না।

অংশু কেন সুইসাইড করেছিল জানো?

কেন?

মা আর বউয়ের ওপর রাগ করে। বনিবনা হত না। ভীষণ গণ্ডগোল হত বাড়িতে। তার মায়ের সঙ্গে বউয়ের ছিল সাংঘাতিক ঝগড়া। অংশু সেই ঝগড়ার মাঝখানে থেকে শুকিয়ে যেতে লাগল দিনকে দিন। তারপর একদিন জ্বালা জুড়োতে ঘুমের ওষুধ খেল।

তাতে কী?

অংশু মরার পর তার মা আর বউ দুজনেই প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিল। হুলুস্থুল কান্নাকাটি বিলাপ। তারপর এ ওকে দুষত। পরে যতদিন একসঙ্গে ছিল ততদিন আবার ঝগড়া করত দু’জনেই। অংশু হয়তো ভেবেছিল, সে মরলে দুজনেরই শিক্ষা হবে। হয়নি। অংশু হয়তো ভেবেছিল মরলে নিষ্কৃতি পাবে। কিন্তু তা পেয়েছে কি না তা পৃথিবীর মানুষের কাছে প্রমাণিত নয়। সুতরাং মৃত্যু দিয়ে অংশু প্রমাণ বা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ঠিক সেই রকম যারা আত্মহত্যা করে তারা কিছুই প্রমাণ করতে পারে না।

সে তো ঠিক।

আমি কয়েকদিন খুব আত্মহত্যা নিয়ে ভাবছি বিলু। আমার জীবনে যে কটা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে সব ক’টার চুলচেরা বিচার করছি। দেখলাম, মৃত্যু একটা মাইনাস পয়েন্ট। জীবনের কোনও কিছুর সঙ্গেই তার মেলে না।

বুঝেছি। এবার কাজে যাই?

তুমি কখনও মরা নিয়ে কিছু ভাবোনি?

সময় কোথায় যে দু’দণ্ড কিছু ভাবব?

প্রীতম খুব সন্দেহের চোখে বিলুর দিকে তাকায়, তারপর বলে, তুমি কি সত্যিই খুব ব্যস্ত? না কি আমাকে অ্যাভয়েড করার জন্য বলছ?

বিলু এ কথার জবাব না দিয়ে একটা গাঢ় নিশ্বাস ফেলল, তারপর একটু ঘন হয়ে বসল প্রীতমের কাছে। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল, তোমার আজ কী হয়েছে বলো তো?

কী হয়েছে তা প্রীতম নিজেও বুঝতে পারছে না। ভিতরে একটা বাঁধ ভেঙেছে। খুব আবেগ আসছে, এলোমলো হয়ে যাচ্ছে মন। গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে মৃত্যুভয়। বিলুর কাছে যে এর কোনও নিদান নেই তাও সে জানে। কিন্তু বিভ্রমশে আজ তার মন ভীষণ কেন যে বিলুবিলু করছে।

প্রীতম কী বলছে তা হিসেব না করেই বলল, তুমি আজ সারা দিন আমার কাছে কাছে থাকো।

থাকব। কাছেই তো থাকি।

প্রীতম মাথা নেড়ে হতাশভাবে বলে, কিছুই আমার কাছে নয়। ওই বাথরুমটাকে মনে হয় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে। খাট থেকে মেঝেটাকে মনে হয়, দোতলা থেকে একতলার ফুটপাথের মতো নিচুতে। এ ঘর থেকে ও ঘর যেন এ পাড়া থেকে ও পাড়া। কেন সব কিছুই এত দুর লাগে বলো তো?

বিলু চুলে হাত বোলাচ্ছে, মাঝে মাঝে একটা অদ্ভুত অবাক চাউনি দিয়ে দেখছে তাকে। আস্তে করে বলল, কিছুই তো দূর নয়।

সবচেয়ে দূরে তুমি আর লাবু।— এ কথা বলার সময় প্রীতমের চোখ ঝাপসা হয়ে এল। তার চোখে কি জল আসছে? ছিঃ ছিঃ! চোখে হাত দিয়ে দেখতে তার লজ্জা করল। কিন্তু বুকের মধ্যে। যে একটা কান্না গোঙাচ্ছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। হঠাৎ হল কী তার? যদি দুর্বলতা আসে, যদি হাল ছেড়ে দেয়, তবে এ লড়াইয়ে তার হার নিশ্চিত।

বিলু একটু রাগ করে বলে, অত ভাবের কথা জানি না বাবা। আমরা তোমার থেকে দূরে হতে যাব কেন? ওইসব ভাবো বুঝি সারা দিন?

প্রীতম গাঢ় স্বরে বলে, মানুষ কতটা মানুষের কাছে হতে পারে বিলু? একজন অন্যজনের ভিতরে ঢুকে যেতে পারে না?

বিলু হাসল। বলল, এও তো ভাবের কথা। যাই তোমার দুধ নিয়ে আসি গে। দুধ খেয়েই ওষুধ খাবে–

প্রীতম মাথা নেড়ে বলল, যেয়ো না। এ সময়টা খুব ডেনজারাস। এক মুহূর্তও আমাকে ছেড়ে থেকো না এখন। আমাকে ছুঁয়ে বসে থাকো।

বিলু সহজে ভয় পায় না, সহজ আবেগে ভেসেও যায় না। কিন্তু এখন হঠাৎ তার চোখে ঘনিয়ে উঠল ভয়। ঠোঁট সাদাটে দেখাল। শরীরটাও হঠাৎ শিউরে উঠল কি? প্রীতমকে এত চঞ্চল কখনও দেখেনি সে। দু’হাতে প্রীতমের রোগা শরীরটা আঁকড়ে ধরে। সে বলল, আছি, আছি। কোনও ভয় নেই তোমার। কেন এরকম করছ? আমি যে ভেবে মরছি।

প্রীতম লক্ষ করে সকালের উজ্জ্বল রোদে ধোয়া এই ঘরে সিলিং থেকে বাদুড়ের মতো ঝুলে আছে কালো কালো অন্ধকার। ঝুলছে, দোল খাচ্ছে। জানালা দিয়ে বাইরে থেকে অতিকায় ডানায় উড়ে আসছে তাদের আরও দোসর। বুক-কেসের তলায়, খাটের নীচে, আলনার পিছনে চোরের মতো দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারের ভূপ। শরীরের জীবাণুরা ঝিনঝিন শব্দে গাইছে মুক্তিসংগীত।

সে বিলুর হাত আঁকড়ে ধরেছিল। তার বড় বড় নখের আঁচড় লেগে বিলুর হাত ছড়ে গিয়েছিল বলে বিলু অক্ষুট ব্যথার শব্দ করল, উঃ!

প্রীতম বড় বড় শ্বাস ফেলছিল। উদভ্রান্ত চোখে বিলুর দিকে চেয়ে বলল, যেয়ো না।

যাচ্ছি না তো।

থাকো। আর একটু থাকো।

সারা দিন থাকব, ভেবো না। ওভাবে তাকিয়ে কী দেখছ?

প্রীতমের মন বলল, আর খুব বেশি সময় নেই। দিনের আলোর ওপর একটা অন্ধকারের ঘোমটা নেমে এসেছে। হালকা ফিকে অন্ধকার। কিন্তু ক্রমে তা গাঢ়তর পুঞ্জীভূত হয়ে উঠবে। শরীরের জীবাণুরা তাদের প্রবল সংগীত গেয়ে চলেছে।

হাল ছেড়ে প্রীতম বালিশে মাথা রাখে। চোখ বোজ। বিলুর সঙ্গে জমির প্লট দেখতে যাওয়া তার ঠিক হয়নি। যেই প্লট দেখতে গেল অমনি এল বিষয়-চিন্তা। সে গাড়িতে বসে থেকে অন্তত গোটা তিনেক প্লট দেখেছে। আর বাজমি কেনার প্রয়োজনীয়তার কথা ভাবতে গিয়ে কেবলই মনে হয়েছে, আমি মরে গেলে বিলু আর লাবুর তো একটা স্থায়ী আস্তানা দরকার। এইসব ভাবতে ভাবতে জীবাণুদের প্রবল প্রশ্রয় দিয়েছে সে। মন মৃত্যুর পুকুরে ড়ুব দিয়ে উঠে এসেছে। এখন তার সমস্ত সত্তা এক ঢালু বেয়ে একমুখী টানে নেমে যাচ্ছে মৃত্যুর উপত্যকায়। একে ফেরানো খুব মুশকিল।

বালিশের কোনা আঁকড়ে দাঁতে দাঁত চেপে সে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ভাল আছি, আমি ভাল আছি; আমার কোনও অসুখ নেই, আমি রোগমুক্ত, সুস্থির, আমি অজর, অমর। ভাল আছি, আমি ভাল আছি…

ওইভাবেই ঘুমিয়ে পড়ল প্রীতম।

বিলু তার গায়ে লেপটা সাবধানে টেনে দিয়ে উঠে পড়ল।

 

মনটা হঠাৎ বড় ভার লাগছে বিলুর। অঘটনের জন্য মনকে সে প্রস্তুত রেখেছে। তবু হঠাৎ সর্বনাশ এসে দরজায় দাঁড়ালে বুক কেঁপে উঠবে না কি?

লাবুকে স্নান করিয়ে খাইয়ে দিল বিলু। রান্না দেখিয়ে দিল ঝিকে। তারপর একটু একা হয়ে বারান্দায় এসে উদাসভাবে চেয়ে রইল দূরের আকাশের দিকে।

কলেজে পড়ার সময় এবং তার পরবর্তী কালেও বিলুর প্রিয় বন্ধু ছিল পুরুষরা। মেয়েদের সঙ্গে সে কখনওই মিশতে ভালবাসত না তেমন। পুরুষদের সঙ্গে বেশি মিশে তার স্বভাবও অনেকটা পুরুষের মতো হয়ে গেছে। সে সহজে অসহায় বোধ করে না, ভেঙে পড়ে না। সে অনেকটাই স্বাবলম্বী, আত্মবিশ্বাসী, স্বাধীনচেতা। তবু আজ প্রীতমের হাবভাব দেখে তার বুকের মধ্যে ধকধক করছে। শুকিয়ে আছে গলা, জিভ। একটু কান্না কান্না ভাব থম ধরে আছে কণ্ঠার কাছে। এখন কোনও আপনজনকে বড় দরকার। কিন্তু কে আছে বিলুর! দাদারা যে যার সংসারে জড়িয়ে থেকে দূরের মানুষ হয়ে গেছে। সেজদা দীপনাথ নানা কাজে ব্যস্ত। ছোড়দা সোমনাথের কাছে আছে বুড়ো অথর্ব বাবা। বিলুর এই অসহায় অবস্থায় কেউই এগিয়ে আসবে না, কাজে লাগবে না।

আপনজনের অভাব এমন কোনওদিন টের পায়নি বিলু। এই রোগা মানুষটাকে এতদিন তো ভারী মনে হয়নি তার। প্রীতম কোনওদিনই বিলুর ওপর নিজেকে ছেড়ে দেয়নি। মনে হচ্ছে, আজ থেকে দিল। ফলে বিলুর ভারী বিপদ হল এখন থেকে। কেউ পাশে থাকলে সে অনেকটা জোর পেত।

প্রীতমের ভার সে একা বইবে কী করে?

মা! আমি একটু খেলনা ধরব?

বিলু ফিরে তাকিয়ে লাবুকে দেখে। ছোট্ট অসহায়, একান্ত নির্ভরশীল। লাবুকেও তো বইতে হবে তার, যতদিন না লাবু নিজের ভালমন্দ বুঝতে শেখে! বাপন্যাওটা লাবুকে বাপের কাছ থেকে কেড়ে নিতে খুব বেগ পেতে হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেরেছে বিলু। ফলে লাবুর ভারও তাকে একা বইতে হয়।

মেয়ের দিকে চেয়ে একটা বড় শ্বাস ফেলে বিলু। লাবু তাকে ভীষণ ভয় পায়। সব সময়ে চোর হয়ে থাকে। সামান্য নড়াচড়া করতেও মায়ের অনুমতি নেয়। তবু এরকম কড়া শাসন ছাড়া উপায়ই বা কী বিলুর! দুষ্টু, দামাল, অবাধ্য মেয়ে হলে বিলুর বড় বিপদ হত।

বিলু গলায় সামান্য মাপমতো আদর মিশিয়ে বলল, খেলো। তবে শব্দ কোরো না। বাবার ঘুম যেন না ভাঙে।

লাবু মাথা নেড়ে চলে গেল।

অনিয়ম বিলু পছন্দ করে না। তবুও প্রীতমকে অঘোরে ঘুমোতে দেখে বিলু স্নান-খাওয়া বাকি রেখে বাইরের ঘরের সোফায় শুয়ে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ল।

উঠল বেলায়, প্রীতমের ডাকে। বিলু! বিলু! আমার খিদে পেয়েছে।

ঘুম ভেঙে বিলুর কেমন একরকম লাগতে থাকে। মাথাটা ফাঁকা এবং টলমলে। বুকটা খাঁ খাঁ করছে তেষ্টায়। কেবল মনে হচ্ছে, কেউ নেই, আমাদের কেউ নেই।

প্রীতমের মাথা ধুইয়ে খাওয়াতে বসে বিলু হঠাৎ আজ বলে ফেলল, শিলিগুড়ি থেকে কাউকে আনাবে?

প্রীতম অবাক হয়ে বলে, কেন?

আমাদের এখন একজন সহায়-সম্বল দরকার। আপনজন বলতে তো কেউ নেই।

প্রীতম মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে, কে আসবে?

তুমি চাইলে নিশ্চয়ই আসবে কেউ না কেউ।

আসার মধ্যে এক আসতে পারে না। কিন্তু তারই বা এসে লাভ কী?

লাভ হয়তো একটু আছে। আমার না হলেও তোমার।

অসময়ের ঘুম থেকে উঠে প্রীতম দেখেছে, ঘরের বাদুড়ঝোলা অন্ধকারগুলো আর নেই। সে ঘৰকে বলেছে, আমি বেশ ভাল আছি। আর এখন সত্যিই সে অনেক ভাল আছে।

প্রীতম মাথা নেড়ে বলল, মা! মায়েদের ভীষণ মায়া। আমার এ চেহারা মায়ের না দেখাই ভাল। তা হলে আর যে ক’দিন বাঁচত তাও বাঁচবে না।

বিলুর কোনওদিন সহজে অভিমান-টান হয় না। আজ এ কথায় হল। বলল, শুধু মায়ের দিকটাই দেখলে! আমি কীভাবে বেঁচে আছি তা দেখলে না!

মা আমাকে পেলে বড় করে দিয়েছে। এখন মায়ের পালা শেষ। ছেলেরা বড় হলে মায়েদের খুব বেশি কিছু করার থাকে না।

বিলু দীর্ঘশ্বাস কখনও ছাড়ে না। এখন ছাড়ল। বলল, তুমি আর বড় হলে কোথায়? এখনও মায়ের আঁচলই তোমাকে ঘিরে আছে।

কথাটার মধ্যে একটু খোঁচা ছিল। প্রীতম মাথা নেড়ে বলল, তুমি যদি না পারো তবে আমাকে কোনও নার্সিং হোম বা হাসপাতালে দাও। আমার মাকে বা আর কাউকে এর মধ্যে টেনে এনো না।

বিলুর মুখ থমথম করে উঠল। ভাতের চামচ তুলেছিল প্রীতমের মুখের কাছে, প্রীতম মুখ ফিরিয়ে নিল বিরক্তিতে। আর খাবে না জানে বিলু। সে নিজে যেমন পুরুষালি স্বভাবের, প্রীতম তেমনি ঠিক মেয়েলি স্বভাবের।

বিলুর ঠোঁটের আগায় অনেক জবাব এসেছিল, কিন্তু সংযত রাখল নিজেকে। ভাতের প্লেট নিয়ে উঠে চলে গেল।

ছাদের দিকে অপলক চেয়ে শুয়ে রইল প্রীতম। চেয়ে থাকলেও তার মন অন্য কাজ করছে। ভিতরে একটা বাঁধ ভেঙে প্লাবন হয়ে গেছে। সেই বাঁধ মেরামত চলছে। এত সহজে সে কি ধরা

পড়বে মৃত্যুর ফাঁদে? আগে বেঁচে থাকাটাকে মাঝে মাঝেই খুব অর্থহীন মনে হত। মনে হত, মৃত্যুটা কেমন? এখন আর তা মনে হয় না। এখন মনে হয়, বেঁচে থাকার জন্যই বেঁচে থাকা। এর প্রতিটি মুহূর্তের দাম কোটি কোটি টাকা। মৃত্যু একটা মাইনাস পয়েন্ট। তা দিয়ে কিছুই প্রমাণ করা যায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *