১৫. জঙ্গলের আড়ালে শরীর রেখে

জঙ্গলের আড়ালে শরীর রেখে ওরা খানিকটা এগিয়ে যেতেই চিৎকারটা কানে এল।

চিৎকারটা যে কোনও বন্দি জন্তুর, তাতে সন্দেহ নেই। ডালপালা সরাতেই ওরা দেখতে পেল, দুটো তাঁবু পড়েছে ফাঁকা জমিতে। তাঁবুর একপাশে একটা লাল জিপসি দাঁড়িয়ে, ওপাশে একটা বড় খাঁচা।

চিৎকারটা ভেসে আসছে তাঁবুর আড়াল থেকে। খাঁচাটা শূন্য।

একটু পরেই একজন ষণ্ডামাকা লোক কুচকুচে কালো একটা প্রাণীকে টানতে-টানতে এনে খাঁচার মধ্যে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। প্রাণীটা দৌড়ে খাঁচার দেওয়াল ভাঙার চেষ্টা করে বিফল হল। তার খাঁজকাটা শিং খাঁচার লোহার শিকে আটকে যাওয়ায় সে আবার আর্তনাদ করল। লোকটা দাঁড়িয়ে যেন মজার দৃশ্য দেখছিল, এবার হেসে তাঁবুর ওপাশে চলে গেল।

অমল সোম তাঁর দূরবিন বের করলেন। কিছুক্ষণ দেখে নিচু-গলায় বললেন, গায়ের রং এখনও কাঁচা রয়েছে। পাকা হাতের কাজ নয়।

রং? অর্জুন অবাক হল।

ওই জন্তুটার নাম সারাও, নেপালিরা একেই থর বলে।

মেজর বললেন, কিন্তু দেখতে তো ছাগলের মতো।

সেইজন্যেই ওরা রং করে দিল। কিন্তু লক্ষ করে দেখুন, মাথাটা অনেক বড়। গাধা আর ছাগলের মিশ্রণ। কানও বড়, চোয়ালের পাশের চুল বেঢপ লম্বা। পায়ের মরচে পড়া লাল অংশটা কিন্তু লোকটা কালো রং ঢেলে আড়াল করতে পারেনি।

এই সারাও ধরা তো ক্রাইম। মেজর উত্তেজিত হলেন।

যে-কোনও বন্যজন্তু ধরাই অপরাধ। ওই প্রাণীটির কদর বিদেশে খুব বেড়েছে। আর সাধারণ মানুষ যাতে বুঝতে না পারে তাই রং করা হয়েছে।

মনে হচ্ছে লোকটা এখন একাই আছে। এগিয়ে যাব? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

না, আসল অপরাধীরা ওপরে গিয়েছে। বেস ক্যাম্প করে রয়েছে এরা। ওরা ওপরে কী করছে, তা একবার দেখে আসা দরকার। এ তো পালিয়ে যাচ্ছে না। অমল সোম ঘুরে দাঁড়ালেন, সুন্দর, তুমি সাবধানে বাঁ দিক দিয়ে ওপরে উঠে যাও। কিছুতেই ওদের চোখে যেন না পড়ে যাও, খেয়াল রাখবে। দেখা পেলেই আমাকে জানাবে। কীভাবে জানাবে?

সুন্দর মাটি থেকে একটা কাঠি তুলে দু টুকরো করে জিভের নীচে ফেলে আওয়াজ করল।

চমৎকার! তুমি দেখছি বেশ গুণী লোক! মেজর, আপনি ফোর্ট আগলান।

ফোর্ট মানে? মেজর হতভম্ব।

অমল সোম বললেন, যুদ্ধক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল ফোর্ট আগলানো। আমরা ফিরে না এলে অথবা কোনও ঝামেলা হলে আপনি সোজা থানায় চলে যাবেন। কিন্তু তার আগে যতটা সম্ভব নিজেকে আড়ালে রাখুন। চলো অর্জুন। অমল সোম পা বাড়ালেন।

সুন্দর খুব দ্রুত কাঁচা জায়গা পেয়ে বানরের মতো পাহাড়ের সঙ্গে মিশে গেল। একা থাকা যে পছন্দ নয়, তা মেজরের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু কিছু করার নেই তাঁর।

অর্জুন হাত বাড়াল, আপনার কলমটা আমাকে দেবেন?

একটু দোনোমনা করে কলমটি হস্তান্তর করলেন মেজর। একা থাকতে হবে। বলে যতটা নয়, তার চেয়ে ঢের বেশি তাঁর খারাপ লাগছিল অভিযানে অংশ নিতে না পেরে।

গাছের আড়ালে ওরা ডান দিকে সরে এল অনেকটা। এবার সামনে ফাঁকা জমি, তারপর পাহাড়। এই পাহাড়ের গায়ে ছোট-ছোট বুনো ঝোপ, লতানো গাছ। লম্বা গাছে রয়েছে অনেক ওপরে। মাঝে মাঝে ন্যাড়া পাথর। একটু আগে যে-পথ দিয়ে লোকদুটো ওপরে উঠে গিয়েছিল, সেই পথ তৈরি হয়েছে। চলতে-চলতেই। পাহাড়ের এই দিকটায় মানুষজন আসে না বলে রাস্তা তৈরির দরকার হয়নি। অর্জুন খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর জলের শব্দ শুনতে পেল। খুব আস্তে, তিরতির শব্দ। সে বলল, মনে হচ্ছে, কাছাকাছি ঝরনা আছে।

শব্দটা অমল সোমও শুনতে পেয়েছিলেন। মাথা নেড়ে আরও কিছুটা এগিয়ে গেলেন তিনি। তাঁবুর কাছ থেকে ওরা অনেকটা সরে এসেছে। এবার ঝরনা চোখে পড়ল। বৃষ্টি না হলে এই ঝরনা শুকিয়েই থাকে। কিন্তু জল পড়ায় পাথর ক্ষয়ে গেছে। অমল সোম বললেন, ওখানে চলো। প্রকৃতি আমাদের জন্যে সিঁড়ি তৈরি করে দিয়েছে।

দৌড়ে ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে পাথরের আড়ালে খানিকক্ষণ দাঁড়াল ওরা। ছুটে আসার সময় কারও নজরে পড়েছে কি না তা বোঝা যাচ্ছে না। অমল সোম পাথরগুলো দেখতে লাগলেন। বিশাল আয়তনের পাথর এ ওর গায়ে হেলান দিয়ে রয়েছে।

যাকে সিঁড়ি বলে মনে হয়েছিল তা হঠাৎ দেওয়াল হয়ে গেল। খাঁজে পা দিয়ে কিছুটা উঠতেই আর কোনও অবলম্বন পাওয়া গেল না। তার ওপর জলে ভিজে ভিজে শ্যাওলাও পড়ে গিয়েছে মাঝে মাঝে। অমল সোম ইশারায় অর্জুনকে তাঁর কাঁধে পা রেখে উঠতে বললেন। এখন আর কোনও বিকল্প নেই। সঙ্কোচ কাটিয়ে অর্জুন ওপরে উঠে পাথরের ওপর শুয়ে পড়ল। হাত বাড়িয়ে অমল সোমকে টেনে তুলল সে।

প্রায় আধ ঘণ্টা ওঠার পব ওবা একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল। এখন পায়ের তলায় জঙ্গলের মাথা। কালচে-সবুজ কার্পেট যেন দিগন্তে ছড়িয়ে গেছে। পাথরের খাঁজে-খাঁজে বুনো ঝোপ এখন বেশ ঘন। ওরা নিজেদের আড়ালে রেখে সরে আসতে লাগল। আর তখনই গুলিব শব্দ ভেসে এল। শব্দটা পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ভয়ঙ্কর শোনাল। পাখিরা ভয়ে চিৎকার করে উড়ে গেল নীচের জঙ্গলের দিকে। অর্জুনের মনে হল সুন্দরের কথা। লোকটা ওদের চোখে পড়ে যায়নি তো!

অমল সোম দ্রুত এগোচ্ছিলেন। এই বয়সেও তিনি এত চটপটে কীভাবে আছেন, তা অৰ্জুন বুঝতে পারছিল না। পাহাড় ভাঙতে গিয়ে সে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছে, কিন্তু অমল সোমকে দেখে তা বোঝা যাচ্ছে না।

হোয়াট ইজ দিস! গুলি করলে কেন? চিৎকারটা শুনতে পেল ওরা।

সঙ্গে-সঙ্গে সতর্ক হয়ে গেলেন অমল সোম। ইশারায় অর্জুনকে নিঃশব্দে এগোতে বললেন। দ্বিতীয় গলা কানে এল, গুলি না বলে সাপটা আমাকে মেরে ফেলত।

মেরে ফেলত! ওকে ডিস্টার্ব না করলে ও তোমার কিছুই করত না। ননসেন্স।

বকাঝকা করো না।

তোমার বুদ্ধি কম, একথা স্বীকার করতে পারছ না কেন? তোমার ওই গুলির আওয়াজে ওরা কেউ আর কাছাকাছি থাকবে বলে ভেবেছ? সব হাওয়া হয়ে গেছে। দিলে সব বিগড়ে।

এবার ওরা দেখতে পেল। নীল চ্যাটার্জি ধমকে যাচ্ছে বরেন ঘোষালের ভাইকে।

বরেন ঘোষালের ভাই সাপটাকে তুলতে যাচ্ছিল একটা ডাল দিয়ে, কিন্তু তার হাত ধরে টানল নীল, ছেড়ে দাও। যত ফালতু সময় নষ্ট।

ওরা চোখের সামনে থেকে সরে গেল।

ওদের অনুসরণ করতে গিয়ে অমল সোম দাঁড়িয়ে গেলেন। একটা মোটাসোটা বনমুরগি কঁক কঁক করতে করতে বুনো ঝোপ থেকে বেরিয়ে ছুটে যাচ্ছিল। তাকে তাড়া করে আসছে আর-একটা মোরগ। হঠাৎ মুরগিটা শুন্যে লাফিয়েই স্থির হয়ে গেল এক লহমার জন্য, তার পরেই ডানা ঝাপটে চিৎকার করতে লাগল। ওর শরীর নীচে পড়ছে না কিন্তু কাছাকাছি কোথাও একটানা শব্দ বাজতে লাগল। সঙ্গে-সঙ্গে মানুষের পায়ের আওয়াজ এদিকে দ্রুত এগিয়ে এল। মোরগটা খুব ঘাবড়ে গিয়ে তৎক্ষণাৎ পেছন ফিরে বুনো ঝোপের মধ্যে মিলিয়ে গেল। অমল সোম আবার পাথরের আড়ালে সরে এলেন।

দুজন কর্মচারীকে নিয়ে নীল এবং বরেন ঘোষালের ভাই দৌড়ে এল। ঝুলন্ত মুরগিটাকে দেখে নীল খুব হতাশ হলেও বরেন ঘোষালের ভাই হেসে বলল, চমৎকার। বনমুরগির রোস্ট খাওয়া যাবে আজ।

কথাটা শোনামাত্র নীল এগিয়ে মুরগিটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিল দূরে। কঁক-কঁক করতে করতে সেটা প্রাণ নিয়ে উধাও হল। বরেন ঘোষালের ভাই চিৎকার করে উঠল, এটা কী হল? ছেড়ে দিলে কেন?

আমি এখানে মুরগি খেতে আসিনি। যা ধরতে এসেছি তা না ধরে কী করে মুরগি দেখে তোমার জিভে ল্ল আসে, তা আমার মাথায় ঢোকে না।

যা ধরতে এসেছি তা ধরবই, তাই বলে ফাউ পেতে দোষ কী?

নীল জবাব না দিয়ে আবার ফিরে গেল। তার দুই কর্মচারী তাকে অনুসরণ করল। বরেন ঘোষালের ভাই মুরগিটা যেদিকে ঢুকেছে, সেদিকে কয়েক পা এগিয়ে মাথা নাড়ল। তাকে খুব হতাশ দেখাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত সেও ফিরে গেল।

অমল সোম বললেন, সাবধানে এগোতে হবে। ওরা জঙ্গলে নেট টাঙিয়েছে।

চোখে দেখা যাচ্ছে না কিন্তু। অর্জুন বলল।

তৈরি হয়েই এসেছে। তবে নিশ্চিত থাকো, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সারাও এদিকে আর আসবে না। যতক্ষণ সারাও না আসে, আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও উপায় নেই।

কেন?

এখন পর্যন্ত নীচের রং করা জন্তুটা ছাড়া ওদের বিরুদ্ধে আমাদের কোনও অভিযোগ নেই। থাকলেও কোনও আদালতে সেটা প্রমাণ করা যাবে না।

অর্জুনের মনে হল ওদের অভিযুক্ত করার জন্য ওই একটা সারাও তো যথেষ্ট। অমলদার কথামতো অপেক্ষা করতে হলে হয়তো অনন্তকাল এখানে বসে থাকতে হবে। এত বড় পাহাড় ছেড়ে সারাও যে এখানে আসবেই, তা কেউ জোর করে বলতে পারে?

এই সময় মৃদু আওয়াজ ভেসে এল। ওটা সুন্দরের পাঠানো সঙ্কেত, তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না। অমল সোম বললেন, এই আওয়াজ বেশিক্ষণ করলে ওরা সন্দেহ করতে পারে।

অর্জুন বলল, ওকে বলা হয়েছিল দেখতে পেলে যেন আওয়াজ করে।

আওয়াজটা থামল। অর্জুন বলল, আমার মনে হয় আর একটু এগিয়ে যাওয়া ভাল।

অমল সোম কিছু বলার আগে মানুষের গলা শোনা গেল। ওপর থেকে নীচে নেমে যাচ্ছে। ওরা এবার এগোল। অমল সোম বললেন, সাবধানে পা ফেলো। সারাও-এর জন্যে ওরা জাল পেতে রেখেছে।

এবার ওদের দেখা পাওয়া গেল। নীল চ্যাটার্জি দাঁড়িয়ে দূরবিনে পাহাড় দেখছে খুঁটিয়ে। ওরা যেখানে চেয়ার পেতেছে, সেই জায়গাটা প্রায় পরিষ্কার। দুটো ফোল্ডিং চেয়ার আর টেবিল ওপরে তুলে নিয়ে এসেছে আরামের জন্য। তার একটাতে বসে আছে বরেন ঘোষালের ভাই। সে চোখ বন্ধ করে সিগারেট খাচ্ছে। টেবিলের ওপর বন্দুক জাতীয় একটি অস্ত্র পড়ে আছে, যা লম্বায় বেশি নয়। অর্জুন এ-জাতীয় অস্ত্র আগে দ্যাখেনি।

নীল চ্যাটার্জি বলল, গুলি ছুড়ে তুমি বারোটা বাজিয়ে দিয়েছ।

এক কথা বারংবার শুনতে ইচ্ছে করছে না।

দূরবিন থেকে চোখ সরিয়ে নীল তাকাল, ঘোষাল, বিদেশে তোমার কানেকশনস না থাকলে তোমার কানে কথাটা আমি হাজারবার ঢোকাতাম। সে আবার দূরবিনে চোখ রাখল।

বরেন ঘোষালের ভাই উঠে দাঁড়াল, একটা হেলিকপ্টার ভাড়া করে পাহাড়টাকে সার্চ করলেই ঝামেলা মিটে যেত। এভাবে সময় নষ্ট হত না।

চমৎকার! সমস্ত পৃথিবীকে ডেকে বলতে চাও আমরা এক মহা মূল্যবান প্রাণী ধরতে চলেছি, তোমরা দ্যাখো। ননসেন্স। পাহাড় দেখতে লাগল নীল।

বরেন ঘোষালের ভাই অস্ত্রটায় হাত দিয়ে সরিয়ে নিল। তারপর উলটো দিকে হাঁটতে লাগল। কয়েক পা যাওয়ার পর তাকে বুনো ঝোপ সরাতে হচ্ছিল। নীল চেঁচিয়ে ডাকল, কোথায় যাচ্ছ?

বোর লাগছে, ঘুরে আসি। জঙ্গলের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল বরেন ঘোষালের ভাই। বোঝা যাচ্ছিল, ওর ব্যবহারে নীল বেশ বিরক্ত। সে নীচের দিকে দুরবিন নামাল। খানিকক্ষণ দেখার পর হঠাৎ ওকে উত্তেজিত বলে মনে হল। দ্রুত আঙুলে ফোকাস ঠিক করছিল সে। তারপর ছুটে এল টেবিলের কাছে। অস্ত্রটাকে তুলে নিয়ে নীল নীচের দিকে দৌড়ে নেমে গেল। অমল সোম কিছু বলার আগেই সুন্দরকে দেখা গেল সামনে। ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়ে ওদের কাছে এসে সুন্দর বলল, সর্বনাশ হয়ে গেল। দাড়িওয়ালা মোটা সাহেবকে নীলবাবু দেখে ফেলেছে!

অমল সোম জিজ্ঞেস করলেন, কী করে বুঝলে?

আমি খালি চোখেই ওঁকে ঝাপসা দেখতে পাচ্ছিলাম যখন, তখন উনি তো দূরবিনে স্পষ্ট দেখতে পাবেন। ধরা পড়লে সাহেবের খুব বিপদ হবে। সুন্দর হাঁপাচ্ছিল।

অমল সোম ঢালের দিকে সরে গিয়ে দূরবিনে চোখ রাখলেন, ওঃ, এত করে বলে এলাম।

অর্জুন তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে মেজর একটা গাছের ডালে উঠে বসেছেন। তিনি চেষ্টা করছেন গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যেতে। তাঁর লক্ষ্যবস্তু কী, তা বোঝা যাচ্ছে না। নীচ থেকে তাঁকে অবশ্যই দেখা যাবে না। কিন্তু পাহাড়ের ওপর থেকে যে তাঁকে স্পষ্ট দেখা যাবে, এটা ওঁর খেয়ালে নেই। চিৎকার করে ওঁকে সতর্ক করতে গেলে নিজেদের অস্তিত্ব আর লুকিয়ে রাখা যাবে না। নীল চ্যাটার্জির হাতে মেজর ধরা পড়বেনই।

অমল সোম বললেন, আমি নীচে যাচ্ছি। সঙ্গে না থাকলে মেজর অসহায় বোধ করবেন।

অর্জুন আপত্তি করল, আপনাকে একলা পেলে নীল কিছুতেই ছাড়বে না। যেতে হলে তিনজনেই যাব।

না। তোমরা বরং ওই ছছাকরাকে আটকাও। তা হলে বারগেন করা যাবে। অমল সোম দ্রুত নেমে গেলেন। অর্জুনের মনে হচ্ছিল, মেজরের জন্য সমস্ত ব্যাপারটা গোলমাল হয়ে গেল। সে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করতে সুন্দর বলল, চলুন, আড়ালে যাই।

মেজরের কী হাল হল, তা দেখার সুযোগ এখন নেই। বরেন ঘোষালের ভাই যদি বেরিয়ে আসে, তা হলে স্পষ্ট দেখতে পাবে। ছেলেটার হাতে অস্ত্র আছে। ওরা দ্রুত জঙ্গলের আড়ালে চলে গেল। সুন্দর এগোচ্ছে নিঃশব্দে, অভ্যস্ত পায়ে। ওর সঙ্গে তাল রাখতে বেশ অসুবিধে হচ্ছিল। হঠাৎ শিস শুনতে পেল ওরা। সুন্দর অর্জুনকে ইশারা করল থামতে।

শিসটা বেজেই চলেছে। সুন্দর প্রায় গুড়ি মেরে এগিয়ে চলেছে। শেষ পর্যন্ত দৃশ্যটা দেখতে পেল ওরা। বরেন ঘোষালের ভাই দাঁড়িয়ে আছে রিভলভার হাতে। তার হাত-ছয়েক দূরে একটা ভুটানি কোবরা ফণা তুলে দুলছে। বরেন ঘোষালের ভাই যে শিস দিচ্ছে তা কোবরাটাকে স্থির রাখার জন্য, বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। হয়তো নীলের বকুনি খেয়ে ও গুলি ছুড়ছে না এখন, কিন্তু অর্জুন বুঝল ছেলেটার সাহস আছে। মাটি থেকে প্রায় তিন ফুট উঁচুতে ফণা তুলেছে যে-সাপ, তার সামনে দাঁড়িয়ে শিস দেওয়া সহজ ব্যাপার নয়।

হঠাৎ সাপটা ধীরে-ধীরে মাথা নামাল। তারপর ডান দিকে একটা পাথরের খাঁজে দ্রুত শরীরটা লুকিয়ে ফেলল। বরেন ঘোষালের ভাই পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছল। রিভলভারটা একবার ওপরে ছুঁড়ে আবার লুফে নিল। অর্জুন দেখল সুন্দর তার কোমরের গেঁজ থেকে একটা গুলতি বের করছে। সে চট করে ওর হাত চেপে ধরে ইশারায় নিষেধ করল। আর তখনই সাপটা যে-পাথরের খাঁজে লুকিয়ে ছিল, সেখানে হুটোপাটি শুরু হল। বরেন ঘোষালের ভাই রিভলভার হাতে দ্রুত এগিয়ে যেতেই একটা কালো গোলার মতো প্রাণী ছিটকে বেরিয়ে এল। তার ধাক্কায় ছিটকে পড়ল ছেলেটা, রিভলভার চলে গেল ঝোপের মধ্যে। চিত হয়ে মাটিতে পড়েই উঠতে গিয়ে যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল বরেন ঘোষালের ভাই। যে জন্তুটা বেরিয়েছিল সেটা যে সারাও, তা বোঝার সঙ্গে-সঙ্গেই অর্জুন আর তাকে দেখতে পেল না। কিন্তু সে সাপটাকে দেখতে পেল। খাঁজ থেকে বেরিয়ে এসে প্রচণ্ড আক্রোশে সে আবার ফণা তুলেছে। বরেন ঘোষালের ভাই মাটিতে পড়ে ছিল তখনও। মৃত্যুভয় এখন তার চোখে-মুখে। তবু ওই অবস্থায় সে একটা ছুরি বের করল।

এইসব দৃশ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুন্দর কখন যে তার গুলতিতে পাথর পুরেছে, লক্ষ করেনি অর্জুন, সাঁ শব্দে পাথরটা ছুটে গিয়ে সাপের মাথায় আঘাত করতেই সেটা নীচে লুটিয়ে পড়ল। ভুটানি কোবরার শরীরটা তখনও প্রচণ্ড আক্রোশে পাক খাচ্ছে, কিন্তু তার আর মাথা তোলার সামর্থ্য নেই।

অর্জুন এবার বেরিয়ে এল আড়াল থেকে। যন্ত্রণা সামলাচ্ছিল বরেন ঘোষালের ভাই, সাপটাকে বিধ্বস্ত হতে দেখে সে যতটা অবাক হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি হল অর্জুনকে সামনে দেখে। কিন্তু তারপরেই নিজের স্বভাব ফিরে পেল সে, আর এক-পা এগোলেই খুন করে ফেলব।

সুন্দর বলল, আমি না বাঁচালে তুমি এতক্ষণে যমের বাড়ি চলে যেতে, বাবু।

তুই? তুই এদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিস? গর্জে উঠল ছেলেটা।

অর্জুন বলল, সুন্দর, আমি তিন গুনব। তার মধ্যে যদি ও ছুরিটা না ফেলে দেয়, তা হলে ওর কপাল লক্ষ করে গুলতি ছুঁড়বে।

সুন্দর সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়ে গেল, ঠিক আছে।

অর্জুন এক বলতেই ঘোষাল ছুরিটা সরিয়ে দিল।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তুমি উঠে দাঁড়াতে পারবে?

না। মনে হচ্ছে হাড়টাড় ভেঙেছে। এত জোরে বেরিয়ে এল–! শোনো, নীচে আমার লোকজন আছে, তাদের ডেকে আনো, জলদি। হুকুম করল ঘোষাল।

এত তাড়াহুড়োর কী আছে?

আমার যন্ত্রণা হচ্ছে।

তা একটু হোক না! চিকিৎসা করার সময় অনেক পাওয়া যাবে, কিন্তু তার আগে আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দাও। অর্জুন ছুরিটাকে লাথি মেরে আরও দূরে সরিয়ে দিল। ঘোষালের মুখ ঘামে চকচক করছে। একটা পা ভাঁজ করতে পারছে না সে, দু হাতের ওপর ভর দিয়ে বসার চেষ্টা করে যাচ্ছে এখন।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কটা সারাও তোমরা এখন পর্যন্ত ধরেছ?

সারাও? সেটা আবার কী জিনিস? খিঁচিয়ে উঠল ঘোষাল।

পকেট থেকে কলম বের করল অর্জুন, এটা চেনো?

এক পলক দেখে নিয়ে, আবার চোখ বন্ধ করল, আমি ওসব কিছু জানি। যা জিজ্ঞেস করার, নীলকে জিজ্ঞেস করো। কথাটা শেষ করেই প্রচণ্ড জোরে সে চিৎকার করে উঠল, নীল, নীল! সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ে পাহাড়ে তার প্রতিধ্বনি বাজল, নী–ল, নী–ল।