১০. মেজরের মাথার ঠিক পেছনে

মেজরের মাথার ঠিক পেছনে যেন আধখানা আলু বসানো হয়েছে। ঘুম থেকে উঠেই তিনি তাঁর ব্যাগ খুলে দু-তিনটে ক্যাপসুল খেয়ে নিয়েছেন। খেয়ে বললেন, কারও ভাল করতে নেই, বুঝলে? অর্জুন চুপচাপ দেখছিল। এখন সদ্য ভোর। জঙ্গলে হাজার পাখির ডাক। সূর্যদেব উঠি উঠি করছেন। পৃথিবীটা বড় শান্ত।

অমল সোম দরজায় এসে বললেন, গুড মর্নিং।

মেজর বললেন, মর্নিং।

আপনি সুস্থ?

আমার মাথা বলে আঘাতটা হজম করেছে, একটু ফুলে উঠেছে, এই যা।

আঘাতটা করল কে?

অন্ধকারে মুখ দেখিনি। শুনুন, আমি পেয়ে গেছি। বিষফুল আর মাংসখাদক পিঁপড়ে পেয়ে গেছি। আমাদের এক্ষুনি যাওয়া দরকার। ক্যামেরাটা–।

আমরা আপনার আঘাত নিয়ে কথা বলছিলাম।

ও। বিশ্বাস হল না বুঝি। কী ভাবেন বলুন তো? আমি আপনার চেয়ে গগায়েন্দাগিরি কম বুঝি? এই ক বছর ইংরেজি সাহিত্যের সব গোয়েন্দা বই তো শেষ করেছি, তার ওপর স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের পাঠ্যপুস্তকও নাড়াচাড়া করেছি। গত বছর…। মেজর উত্তেজিত গলায় কথা বলছিলেন, কিন্তু তাকে হাত তুলে থামতে বললেন অমল সোম, আমি গোয়েন্দাগিরি করি না।

অ। মেজর থতমত হয়ে গেলেন।

অন্ধকারে মুখ দেখেননি বললেন, তাই না?

হ্যাঁ। টর্চ সঙ্গে ছিল না তো! প্রথমে মাংসখাদক পিপড়ে তারপর বিষ ফুলের গন্ধ আবিষ্কার করে আমি আপনাদের জানাতে ছুটে আসছিলাম। হঠাৎ দেখি জঙ্গলে জোনাকি জ্বলছে, নিবছে। একটা জোনাকি। তারপরেই বুঝতে পারলাম ওটা বিড়ির আগুন। কাছে গিয়ে লোকটার হাত শক্ত করে ধরে জিজ্ঞেস করলুম, এই তুই কে? এখানে কী করছিস? লোকটা বলল, বিড়ি খাচ্ছি। হাত ছাড়ো। বলার ভঙ্গিতে মনে হল অ্যান্টি সোশ্যাল। হয়তো চোরা শিকারিদের কেউ। বললাম, রেঞ্জারের কাছে চল। বলল, ঠিক আছে কিন্তু আমার ইয়ে পেয়েছে। করে নিই আগে। বিশ্বাস করলাম। করতেই বিড়ির আগুন নিবে গেল। তারপরেই মাথার পেছনে আঘাত। আমার আর কিছু মনে নেই। মেজর গড়গড় করে বলে গেলেন। বলতে বলতে তাঁর হাত উঠে স্পর্শ করল ফোলা জায়গাটা।

অর্জুন বলল, আমরা আপনাকে খুঁজতে জঙ্গলে গিয়েছিলাম। তখন ওই লোকটাই হঠাৎ সামনে এসে হদিস দিয়েই আবার উধাও হয়ে গেল।

তাই নাকি। লোকটা কিন্তু ক্রিমিন্যাল। মেজর বললেন।

অমল সোম বললেন, হ্যাঁ। এখানে দেখছি ক্রিমিনালদের সংখ্যা কম নয়। যাক, এখনও ঘণ্টা দুয়েক সময় আছে গাড়ি আসার। আমি একটু হাঁটাহাঁটি করে আসি।

মেজর তাঁকে সতর্ক করলেন, জঙ্গলে গেলে কোনও গাছের গা ধরে হাঁটবেন না।

কেন? গাছ আমার ক্ষতি করবে নাকি?

মেজর তখন তাঁর দেখা মাংসখাদক পিঁপড়ের কাহিনী শোনালেন। অমল সোম বললেন, পিঁপড়েগুলোকে দেখাতে পারবেন?

অফ কোর্স।

অতএব তিনজনেই রওনা হল। অর্জুন এর আগে পিরানহা মাছের গল্প শুনেছে। সেই ছোট্ট মাছ অবলীলায় একটা মানুষকে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারে। আর এক ধরনের পিঁপড়ে নাকি হাতির মৃতদেহ খেয়ে নিতে পারে কয়েক দিনে। কিন্তু একটা জ্যান্ত হরিণের বাচ্চাকে পিপড়েরা যা করেছে বলে মেজর বললেন, সেটা পৃথিবীর কেউ শুনেছে কিনা তার জানা নেই। মিনিট পনের হাঁটাহাঁটি হল। মেজর কিছুতেই জায়গাটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। যদিও এই হাঁটাহাঁটি খুব আরামপ্রদ নয়, তবুও কৌতূহলের কারণে কেউ আপত্তি করছিল না। শেষ পর্যন্ত মেজরই জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে কোথায় খুঁজে পেয়েছিলে বলো তো?

অর্জুন আরও খানিকটা ডান দিকে হেঁটে জায়গাটা দেখিয়ে দিল। গর্তের মধ্যে শুকনো পাতা মেজরের দেহের চাপে বসে গেছে অনেকটা। মিনিট পাঁচেক হাঁটাহাঁটির পর মেজর চিৎকার করে উঠলেন, ইউরেকা!

মেজরকে ছুটে যেতে দেখে ওরাও পা চালালো। একটা গাছের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন মেজর। গাছটার নিচে পরিষ্কার ধবধবে কয়েকটা হাড় পড়ে আছে। কিন্তু গাছের গুঁড়ির কোনও অংশেই একটাও পিঁপড়ে নেই।

মেজর উত্তেজিত গলায় বললেন, এইখানে পিঁপড়েগুলো ছিল মিস্টার সোম। ওই দেখুন, হরিণটার হাড় পড়ে আছে।

অর্জুন বলল, হরিণটার মাথার খুলি, পা কোথায়?

অমল সোম এগিয়ে গিয়ে একটা হাড় তুলে পরীক্ষা করলেন। তারপর বললেন, উনি ঠিকই বলছেন। কয়েক ঘণ্টা আগে এটা কোনও জন্তুর শরীরে ছিল। মাংস মজ্জা খেয়ে নিয়ে, মেজরের দেখা যদি ঠিক হয়, পিঁপড়েরা চলে গেছে। আর জঙ্গলে তো শেয়াল-হায়েনার অভাব নেই, খুলিটুলিগুলো তারাই নিয়ে গেছে।

একটা হালকা দাগ গাছের গুঁড়িতে ছিল। বোঝাই যাচ্ছে ওখানে কিছু চেপে ছিল অনেকক্ষণ। অমল সোম বললেন, আপনি বলছিলেন পিঁপড়ের চাকের আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল এই জায়গাটা, তাই কালো দেখাচ্ছিল। তা হলে তো হাজার হাজার পিঁপড়ে থাকার কথা। একসঙ্গে ওগুলো গেল কোথায়?

মেজর বললেন, নিশ্চয়ই কাছাকাছি আবার ফাঁদ পেতেছে।

না। জন্তুজানোয়ার থেকে পাখি পর্যন্ত খিদে না পেলে খাবার খোঁজে না। এখন ওদের পেট ভর্তি। যতক্ষণ না খিদে পাবে, ততক্ষণ ওরা ফাঁদ পাতবে না। মানুষের সঙ্গে এটাই পার্থক্য।

অর্জুন আশেপাশে পিঁপড়ে খুঁজল। না কোথাও নেই।

আপনার বিষফুল কোথায়? অমল সোম প্রশ্ন করলেন।

মেজর আবার উৎসাহে এগিয়ে গেলেন, অন্ধকার ছিল, তবু আমি একটা পাতাঝরা গাছকে চিহ্ন হিসেবে রেখে এসেছি।

ন্যাড়া গাছটাকে খুঁজে বের করতে সময় লাগল না। হাত বাড়িয়ে ওদের দেখতে বললেন, একটু এগিয়ে গেলেই গন্ধ পাওয়া যাবে। সাবধান!

অর্জুন চারপাশে তাকাল। সকালের জঙ্গলে পাখিদের ব্যস্ততা থাকে। চার পাশেই তারা চেঁচামেচি করছে। কয়েকটা বাঁদর গাছের ডাল ধরে ওপাশে চলে গেল। সে জিজ্ঞেস করল, আপনি কোন দিকে গন্ধ পেয়েছিলেন?

ওই দিকে।

কিন্তু ওদিকে যদি বিষফুল থাকে, তাহলে পাখি বা বানরের কিছু হচ্ছে না কেন?

অমল সোম বললেন, ঠিক কথা। মেজর, আপনার বোধহয় ভুল হচ্ছে।

অসম্ভব। ওই গন্ধ নাকে ঢোকামাত্রই আমার শরীর ঝিমঝিম করছিল। মেজর প্রতিবাদ জানিয়ে একপা একপা করে এগোতে লাগলেন।

অর্জুন স্বচ্ছন্দে হাঁটতে লাগল তাঁকে ডিঙ্গিয়ে। তারপরেই ওরা হাসনুহানার ঝোপটাকে দেখতে পেল। সকালেও সেই ফুলের গন্ধ বাতাস জুড়ে রয়েছে। মেজর অর্জুনের হাত ধরে টানলেন, খবরদার। আর এগিও না।

গন্ধ নাকে লাগলেও শরীরে কোনও প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল না। অর্জুন ফুলটাকে লক্ষ করছিল। জলপাইগুড়িতে এ রকম হাসনুহানা গাছ সে অনেক দেখেছে। তার ফুলের সঙ্গে এর কোনও পার্থক্য নেই। হাসনুহানার গন্ধে সাপ আসে বলে প্রচার আছে। এ ছাড়া আর কোনও ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। অমল সোম শব্দ করে হাসলেন, জঙ্গলে ঢুকে গন্ধ পেয়েই ভাবলেন, বিষ ফুলের গন্ধ? তিনি এগিয়ে গিয়ে ফুলের ঘ্রাণ নিলেন। সত্যিই কড়া গন্ধ। কিন্তু দেখুন, আমি ঠিকই আছি। কাল রাত্রে আপনি মানসিকভাবে গোলমেলে ছিলেন।

মেজর ততক্ষণে বুঝেছেন তিনি ভুল করেছেন।

অমল সোম এবার ফিরলেন। তাঁর পাশে হাঁটতে হাঁটতে মেজর বললেন, হতে পারে। হতে পারে কেন, ভুল নিশ্চয়ই হয়েছে। কিন্তু পিঁপড়েদের ব্যাপারটা একশো ভাগ সত্যি।

ঠিক। ওই হাড়গুলো তো মিথ্যে নয়। তবে জঙ্গলের এত কাছাকাছি যদি আপনার বিষফুল থাকত, তাহলে রেঞ্জার খবর পেয়ে যেতেন। অমল সোম এগিয়ে চললেন।

 

ব্রেকফাস্ট খাওয়া শেষ না হতেই গাড়ি এসে গেল। অমল সোম বললেন, তা হলে আপনারা চারপাশে ঘোরাঘুরি করুন।

মেজর বললেন, তার মানে? আমাদের তো নিম টি এস্টেটে যাওয়ার কথা।

আপনারা যেতে চান?

হ্যাঁ, আপনাকে একা ছেড়ে দেওয়া যায় না।

অমল সোম হাসলেন, মুখে কিছু বললেন না।

ফরেস্ট থেকে বেরিয়ে গতকালের সেই রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা পথ যাওয়ার পর চা বাগানের গায়ে নিম টি এস্টেটের সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। অমল সোম বললেন, মনে হচ্ছে বাগানটা বেশ বড়। বাঙালি মালিকের বাগান তো এখন হাতে গোনা।

এখানে আসার পথে যে কটা চায়ের বাগান নজরে পড়েছে, তার সাইনবোর্ডে হয় বিদেশি নামের কোম্পানি নয় অবাঙালি নাম চোখে পড়েছে। এসব নিয়ে অর্জুন কখনও মাথা ঘামায়নি। এককালে জলপাইগুড়ির এস পি রায় এবং বীরেন ঘোষ অনেক চা বাগানের মালিক ছিলেন। ওঁদের মৃত্যুর পর এস পি রায়ের ছেলেরা খুব ভালভাবে ব্যবসা করলেও বীরেন ঘোষ মশাই-এর ছেলে তাদের চাবাগান বিক্রি করে দিয়েছেন। এই নিয়ে জলপাইগুড়ির পুরনো মানুষেরা আফসোস করেন। অমল সোমের কথা শুনে মনে হল তাঁরও আফসোস ওই কারণে।

গাড়ি বাগানের গেট পেরিয়ে সরু রাস্তায় ঢুকে পড়ল। সাদা নুড়ি পাথরের রাস্তা। ওপাশে ফ্যাক্টরির শেড দেখা যাচ্ছে। এপাশে অফিস। বেশ নির্জন জায়গা। গাড়ি থেকে নেমে ওরা এপাশ ওপাশে তাকাতেই একজন মঙ্গোলিয়ান যুবক এগিয়ে এসে নমস্কার করল। অমল সোম জিজ্ঞাসা করলেন, মিসেস ব্যানার্জি আছেন?

মেমসাহেব বড়া বাংলোতে আছেন।

বড়া বাংলো?

হ্যাঁ। ওই ওপাশে বড়া বাংলো, আর ডানদিকে ছোটা বাংলো।

মেজর জিজ্ঞেস করলেন, মিস্টার হরপ্রসাদ সেন কি এখানে আছেন?

হ্যাঁ। আসুন আমার সঙ্গে। ছেলেটি এগোল।

অমল সোম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এঁকে চিনলেন কী করে?

অর্জুন জবাব দিল, জলঢাকার কাছে আলাপ হয়েছিল। উনি নীল চ্যাটার্জির পেছন পেছন আসছিলেন। ওই যে ঝামেলাটা।

বুঝেছি। অমল সোম মাথা নাড়লেন।

অফিসটি ছিমছাম। ছেলেটি জানাতেই তাদের ভেতরে নিয়ে আসতে বললেন হরপ্রসাদ সেন। মেজরকে দেখে বৃদ্ধের কপালে ভাঁজ পড়ল, কোথায় যেন—ওহো, কী ব্যাপার?

চিনতে পারছেন? মেজর গম্ভীর গলায় বললেন।

বিলক্ষণ।

ইনি অমল সোম। সত্যসন্ধানী।

অমল সোম নমস্কার করলেন, ওসব কিছু নয়। আমি এই বাগানের মিসেস ব্যানার্জির সঙ্গে দেখা করতে চাই। কিছু ব্যক্তিগত কথা বলব।

হরপ্রসাদ সেন ঘড়ি দেখলেন, ওঁর অফিসে আসার সময় হয়ে গিয়েছে। যদিও ব্যক্তিগত কথা বললেন, তবু জানতে পারি প্রসঙ্গটি আমাদের ছোট সাহেবকে নিয়ে কি?

আপনার অনুমান ঠিক।

তা হলে বলব, কথা বলে কোনও লাভ হবে না। উনি স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে, ছোট সাহেবের কোনও ব্যাপারে থাকবেন না।

সেটা আপনাদের বলেছেন। আমি নিজের কানে শুনে যেতে চাই।

হরপ্রসাদ সেন দরজার দিকে তাকালেন। মঙ্গোলিয়ান ছেলেটি ওদের এই ঘরে পৌঁছে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। হরপ্রসাদবাবু গলা নামালেন, নতুন কোনও ঘটনা ঘটেছে?

অমল সোম বললেন, অনুমান করছি আপনি স্বৰ্গত অশ্বিনী ব্যানার্জীর আমলের লোক।

ঠিক তাই। এসব দেখে শুনে আমি ছুটি চেয়েছিলাম কিন্তু মিসেস ব্যানার্জি আমাকে ছাড়তে চান না। বয়েসও হয়েছে, মানাতে পারছি না তাই। কথা বলতে বলতে কান খাড়া করলেন হরপ্রসাদ সেন, ওই যে, মেমসাহেব এসে গেছেন। আপনারা বসুন।

হরপ্রসাদ সেন তড়িঘড়ি উঠে গেলেন। ততক্ষণে একটা গাড়ি এসে থেমেছে অফিসে। বড়া বাংলো পাথর ছোঁড়া দুরত্বে হলেও মিসেস ব্যানার্জি গাড়িতেই অফিসে আসেন। তাঁকে এই ঘর থেকে দেখা যাচ্ছিল না।

মেজর জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি ওই বদমাসটার বিরুদ্ধে নালিশ করতে চান?

তাতে কি কোনও লাভ হবে? শুনলেন তো ভাইয়ের ব্যাপারে উনি থাকেন না।

বারান্দায় শব্দ হল। তারপরই হরপ্রসাদ সেনের গলা, আসুন, আসুন।

গটগট করে ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকলেন। অমলদাকে অনুসরণ করে ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল। মিসেস ব্যানার্জির বয়স পঞ্চাশের কাছে, মাথার সামনের দিকের চুল ইন্দিরা গান্ধীর মতো সাদা। সাদা জামা আর শাড়িতে বেশ ব্যক্তিত্বময়ী বলেই মনে হচ্ছে।

অমল সোম নমস্কার করে নিজেদের পরিচয় দিলেন।

অর্জুন লক্ষ করল, বাগানের মালিক হওয়া সত্ত্বেও ভদ্রমহিলা হরপ্রসাদ সেনের চেয়ারে না বসে পাশের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বললেন, বসুন মিস্টার সেন। বসুন আপনারা। হ্যাঁ, কী ব্যাপার? আমি তো ভাবতেই পারছি না, আপনাদের মতো নামী লোক, অকারণে আমার বাগানে সময় নষ্ট করতে আসবেন।

হরপ্রসাদ সেন নিচু গলায় বললেন, মিস্টার সোম আপনার সঙ্গে ব্যক্তিগত কথা বলতে চান। বিষয়টা আমাকে বলেননি।

অমল সোম বললেন, মিসেস ব্যানার্জি, আপনাকে বিরক্ত করছি বলে দুঃখিত। কোনও এক সময় আমি আপনার স্বৰ্গত স্বামীকে চিনতাম। অশ্বিনীবাবু মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধেয় ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে আপনি যেভাবে এই বাগান চালাচ্ছেন, তা প্রশংসনীয়।

অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু যেভাবে চালানো উচিত তা পেরে উঠছি না। মডার্ন মেশিনারি ব্যবহার করার মতো আর্থিক সঙ্গতি আমার নেই। আপনি কি আলাদা কথা বলতে চান? আচমকা গলার স্বর বদলে গেল।

দরকার নেই। শুনেছি আপনার ভাই নীল চ্যাটার্জি আপনাদের সমস্ত সম্পদের উত্তরাধিকারী। অতএব তাঁর আচার-আচরণ সম্পর্কে আপনার দায়িত্ব থেকে যাচ্ছে। তিনি এই এলাকায় যেভাবে রাজত্ব করছেন, তা মাফিয়া ডনেরাই করে থাকে। আপনার স্বামী বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই সহ্য করতেন না। আমার একমাত্র প্রশ্ন, আপনি কী করে আপনার ভাইয়ের গুণ্ডামিকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন? অমল সোম খুব শান্ত গলায় প্রশ্ন করলেন। অর্জুন ভাবছিল এসব শুনে মিসেস ব্যানার্জি খুব চটে যাবেন। কিন্তু নিঃশব্দে হাসলেন মাত্র, আর কিছু?

না।

আপনি নিশ্চয়ই তার গুণ্ডামির প্রমাণ পেয়েছেন, নইলে আমাকে বলতে আসতেন না। আপনি বললেন, আমি তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছি। ভাল কথা। কিন্তু একই সঙ্গে স্থানীয় পুলিশ, সরকারী সংস্থাগুলো, জেলার এস পি, স্থানীয় মানুষজন তাকে কি প্রশ্রয় দিচ্ছে না? কোনও এক ব্যক্তির কতখানি ক্ষমতা থাকতে পারে যে, সবাইকে সে হাতের মুঠোয় রাখতে পারে?

আমার প্রশ্নের এটা উত্তর হল না।

মিস্টার সোম, আমি কীভাবে ক্ষতিপূরণ করতে পারি, বলুন?

ক্ষতিপূরণ?

নিশ্চয়ই সে আপনাকে অপমান করেছে?

করেছে। কিন্তু কুৎসিত গালাগাল আর হুমকির ক্ষতিপূরণ কিসে হওয়া সম্ভব?

আমি জানি না।

বেশ। আমি আপনাকে সতর্ক করে দিতে এসেছিলাম। নিশ্চয়ই আপনি ভাই সম্পর্কে অত্যন্ত দুর্বল। কিন্তু এই কারণ আপনার স্বামীর ব্যবসায় বদনাম তৈরি করছে। আচ্ছা, আপনার সময় নষ্ট করার জন্যে আমি দুঃখিত। নমস্কার! অমল সোম উঠে দাঁড়ালেন।

এইসময় বাইরের নুড়ি পাথর ছিটকে ব্রেক কষে গাড়ি থামার আওয়াজ এল। হরপ্রসাদ সেন চাপা গলায় বলে উঠলেন, ছোট সাহেব এসেছেন।

অমল সোম এবং অর্জুন ততক্ষণে বাইরের বারান্দায় পা রেখেছে। মেজর পেছনে। গাড়ি থেকে নেমে নীল চ্যাটার্জি ওদের দেখতে পেয়ে বেশ অবাক হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। দ্রুত পা ফেলে কাছে এসে সে জিজ্ঞেস করল, এখানে কী ব্যাপার? আপনারা তো ফরেস্ট বাংলোয় উঠেছেন?

অমল সোম বললেন, কাল তুমি তুই শুনেছিলাম, আজ আপনি। এসো অর্জুন।

দাঁড়ান, দাঁড়ান, ওরকম চালিয়াতের মতো আমার সঙ্গে কথা বলার সাহস হল কী করে? এটা আমার বাগান, ফরেস্ট বাংলো নয়। চিৎকার করে উঠল নীল।

বাগানটা এখনও মিসেস ব্যানার্জির। উনি মরে না যাওয়া পর্যন্ত তাঁরই। অমল সোম এগিয়ে গেলেন গাড়ির দিকে।

নীল চ্যাটার্জি কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই বারান্দা থেকে মিসেস ব্যানার্জির গলা ভেসে এল, নীল!

নীল পেছন ফিরে তাকাল। আর একটা কথাও আমি শুনতে চাই না। এদিকে এসো।

ওরা গাড়িতে উঠল। গাড়িটা যখন বাগান ছাড়াতে যাচ্ছে, তখন ওপাশ থেকে মারুতিটা বাঁক নিল। দুটো গাড়ি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল। ওপাশের গাড়ির স্টিয়ারিং-এ বসে আছে জলপাইগুড়ির বরেন ঘোষালের ছোট ভাই।