০৮. তুমি আমাকে গাড়ি চালানো শেখাচ্ছ চাঁদু

তুমি আমাকে গাড়ি চালানো শেখাচ্ছ চাঁদু? অদ্ভুত গলায় বলল চালক।

বয়স্কদের সঙ্গে তুমি এ ভাষায় কথা বলো বুঝি? গাড়ি সরাও নইলে একে বলব তোমার ওই টিনের বাক্সটাকে গুঁড়িয়ে দিতে। ড্রাইভার ভাই, আপনি ব্যাক করুন তো! অমল সোমের হুকুম হওয়া মাত্র ড্রাইভার বেশ কিছুটা পিছিয়ে নিয়ে গেল জিপসিটাকে। তারপর নিচু গলায় বলল, ধাক্কা মারতে বলবেন না,

আমি কখনও অমন কাজ করিনি।

জিপসিটাকে পেছনে হটে গিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়াতে দেখে উলটো দিকের গাড়ির চালক অনুমান করল পরিস্থিতি ভাল নয়। সে চিৎকার করল,

কী হচ্ছে এসব? ইচ্ছে করে অ্যাকসিডেন্ট করবেন নাকি?

তুমি থেকে আপনিতে ওঠায় অমল সোম ঈষৎ খুশি হলেন। তিনি গলা তুলে বললেন, সেই রকমই ইচ্ছে আছে। বেয়াদপ বানরদের শিক্ষা দিতে আমার খুব ভাল লাগে। তবে তুমি যদি গাড়িটাকে এক পাশে সরিয়ে নিয়ে যাও, তা হলে আলাদা কথা।

আপনি কার সঙ্গে এসব করছেন, তা জানেন? নীল চ্যাটার্জি আমার বন্ধু।

সে আবার কে? অমল সোম যে চমক্কার অভিনয় করতে জানেন, তা মেজর বুঝতে না পেরে ব্যাখ্যা করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ওঁকে হাত তুলতে দেখে থেমে গেলেন।

বুঝবেন, বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে নীল চ্যাটার্জি কে? কথা শেষ করেই ওই ছোট রাস্তাতেই গাড়িটা ঘুরিয়ে নিল চালক। তারপর একরাশ ধুলো উড়িয়ে ছুটে চলল, যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে। ড্রাইভার বলল, এবার নীলবাবু এসে ঝামেলা করবেন।

আমরা যেখানে যাচ্ছি সেই জায়গাটা প্রোটেকটেড প্লেস। ঝামেলা করতে এলে তিনি বিপদে পড়বেন। তা ছাড়া আমরা কোথায় যাচ্ছি তা জানতে তো সময় লাগবে। অমল সোম তাকে আশ্বস্ত করলো।

চাপা গলায় মেজর বললেন, আম্পর্দ্ধা দ্যাখো।

অর্জুন বলল, আমেরিকায় শুনেছি অল্প বয়সীরা এর চেয়েও খারাপ ব্যবহার করে।

একটু হকচকিয়ে গেলেন মেজর, তা করে। কিন্তু আমাদের বেশ সাবধানে থাকতে হবে। এই সব চুনোপুঁটি গুণ্ডাদের আর যাই হোক বিশ্বাস করা চলে না। মেজর তাঁর ব্যাগটা কোলে টেনে নিলেন। যেন সেটাই তাঁর আত্মরক্ষার অস্ত্র।

অর্জুন নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, আপনি কি সঙ্গে কোনও অস্ত্র এনেছেন?

দাড়ি-গোঁফের ফাঁক দিয়ে বিরাট মুখে এবার হাসি ফুটল, সাসপেন্সে থাকো।

আগের গাড়িটাকে আর দেখা যাচ্ছিল না। ধুলোর ঝড়টাও মিলিয়ে গেল। কিছুটা চলার পর অমল সোম ড্রাইভারকে বললেন গাড়ি থামাতে। তারপর মুখ ফিরিয়ে অর্জুনকে ইশারা করলেন নামতে।

মেজর জিজ্ঞেস করলেন, এখানে আবার কী দরকার?

অমল সোম বললেন, অর্জুনের সঙ্গে একটু ব্যক্তিগত কথা বলব।

ওরা গাড়ি দাঁড় করিয়েছিল একটা বাঁক ঘুরে। অমল সোমের আচরণে একটুও অবাক হয়নি অর্জুন। রাস্তার একপাশে সেগুন গাছের আড়ালে পৌঁছে অমল সোম প্রশ্ন করলেন, আমাদের নেমে আসার উদ্দেশ্য কী বলো তো?।

আপনি সন্দেহ করছেন শিল্প সমিতি পাড়ার বরেন ঘোষালের ছোট ভাই আদৌ এগিয়ে যায়নি। সে রাস্তার পাশে কোথাও গাড়ি লুকিয়ে আমাদের পিছন নেবে বলে অপেক্ষা করছে। এখন তাকে দেখা যাবে। তাই তো? অর্জুন উত্তর দিল।

গুড! এই কাজটা তুমি হলে করতে না?

হ্যাঁ। আমার শত্রুদের ঠিকানা নিশ্চয়ই আমি জানতে চাইতাম। তবে ছেলেটাকে যে রকম নিশ্চিত দেখাচ্ছিল, তাতে ও বোধ হয় নীল চ্যাটার্জিকে সরাসরি জানাবার কথাই ভাবছে।

অর্জুনের অনুমানই ঠিক হল। মিনিট পনেরোর মধ্যে কোনও গাড়িকে পেছনে আসতে দেখা গেল না। অগত্যা ওরা আবার জিপসি চালু করল। এখন থেকেই একপাশে চায়ের বাগান, অন্যপাশে ফরেস্ট শুরু হয়ে গিয়েছে। ফরেস্টে ঢোকার চিহ্নিত পথে ওরা এগোল। খানিকটা যাওয়ার পর চেকপোস্ট। লোহার রড় ব্যারিকেড তৈরি করেছে। পাশের ওয়াচ কম থেকে বনরক্ষী এগিয়ে এলে ড্রাইভার পরিচয় দিল। ডি এফ ও সাথে যে এখানেও খবর দিয়ে রেখেছেন, তার প্রমাণ পাওয়া গেল বনরক্ষীর সন্ত্রস্ত হয়ে সেলাম করার ভঙ্গি দেখে। এখন দুপাশে ঘন জঙ্গল আর অজস্র পাখির চিঙ্কার। মাঝে-মাঝে বানরেরা রাস্তার ধারে নির্লিপ্তের মতো বসে আছে।

অমল সোম বললেন, উত্তর বাংলায় মোট ৩১৫১ প্রজাতির উদ্ভিদ আছে।

উদ্ভিদ? মেজর সোজা হলেন।

হ্যাঁ। তার মধ্যে গাছ হল ৫৪০ রকমের, গুল্ম ১৮৭৯, লতা ২১৬ আর মস, লাইকেন, ফার্ন ৫১৬ ধরনের। ঠিক একশো বছর আগে জে এম কোয়ান একটা বই লিখেছিলেন, দি ট্রিস অব নদার্ন বেঙ্গল ইনক্লডিং শ্রাবস, উডি ক্লাইম্বার্স, বাম্বুস, পাম অ্যান্ড ট্রি ফার্নস। তাতে তিনি ৯৮৮ প্রজাতির উল্লেখ করেছিলেন।

মেজর জিজ্ঞেস করলেন, কী ধরনের গাছ সংখ্যায় বেশি?

শাল, নিম, কাওলা, শিশু আর গামার। এ ছাড়া খয়ের, শিরীষ, ওদাল, শিমুল, বনকাপাস, জামরুল, অমলতাস, নাগেশ্বর গাছ দেখতে পাবে। এখানে ইউক্যালিপটাস গাছ কম, কিন্তু চাপ এবং বহেড়া গাছ পরিমাণে বেশি। এদের ফলও হয় প্রচুর। তাই এদিকে জীবজন্তুর আধিক্য বেশি। অমল সোম বললেন।

বাঘ আছে? মেজর প্রশ্ন করলেন।

তিনি যে আছেন, তা সুহাসিনীতে ভানু ব্যানার্জি প্রমাণ দিয়েছেন।

মেজর শব্দ করে হাসলেন, তবু রক্ষে সিংহ নেই। বুঝলে অর্জুন, ওই। প্রাণীটিকে আমি একদম বুঝতে পারি না। তুমি সিংহ দেখেছ?

সাকাসে দেখেছি।

কেমন সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসী ভাবভঙ্গী। একবার আফ্রিকায়–।

আমরা বোধহয় এসে গিয়েছি। অমল সোম গল্পটাকে গড়াতে দিলেন।

ততক্ষণে চোখের সামনে চমৎকার একটা বাংলো ভেসে উঠেছে। গাড়ির আওয়াজ পেয়েই বোধহয় একজন সুবেশ যুবক বাংলোর সামনে এসে দাঁড়াল।

জিপসি থামতেই যুবক এগিয়ে এসে নমস্কার করল, মিস্টার সোম?

অমল সোম জিপসি থেকে নেমে বললেন, আমি।

আসুন সার। বড়সাহেব জানিয়ে দিয়েছেন আপনাদের আসার কথা। আমার নাম রঞ্জিত দত্ত, এখানকার রেঞ্জের দায়িত্বে আছি।

অমল সোম তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পর একজন আদলি ব্যাগপত্র বয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। জিপসির ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, আমাকে কি দরকার আছে?

অমল সোম মাথা নাড়লেন, না। কিন্তু তুমি একা ফিরবে?

প্রশ্নের অর্থ বুঝতে পেরে ড্রাইভার বলল, আমি লোকাল মানুষ, আমার কিছু হবে না। আর হলে কে আটকাবে? চলি।

জিপসি চলে গেলে রঞ্জিত দত্ত জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?

অমল সোম বললেন, তেমন কিছু নয়।

দোতলায় ব্যালকনি-সমেত দুটো পাশাপাশি ঘরে থাকার ব্যবস্থা। চমৎকার আয়োজন। মেজর বললেন, গুড।

দোতলা থেকে জঙ্গলের চেহারা আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। সামনে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। মনে হচ্ছিল ছুটতে ছুটতে জঙ্গল ওই ফাঁকা জায়গায় এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। পাখি ডাকছে খুব। মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে আসছে মাঝে-মাঝে। কাঁঠালি চাঁপার গন্ধ।

রঞ্জিত দত্ত বলল, এই বাংলোতে একজন বাবুর্চি আর একজন আদালি চব্বিশ ঘণ্টা থাকবে। আপনাদের যখন যা দরকার ওদের বললেই হবে।

গাড়ি থেকে সবজির ঝুড়ি নামানো হয়েছিল। সেদিকে তাকিয়ে রঞ্জিত বললেন, আরে ব্বাস, এসব আনতে গেলেন কেন? আমি তো মাছমাংসের ব্যবস্থা করেছি।

অমল সোম বললেন, আমাদের না লাগলে আপনার সংসারে লাগতে পারে।

আমি সার একা। কলকাতার ছেলে, জঙ্গলের চাকরি নিয়ে এখন আর শহরে ফিরতে ইচ্ছে হয় না। আপনারা চা খাবেন?

অমল সোম কাঁধ নাচালেন, তারপর পাশের ঘরে ঢুকে গেলেন। রঞ্জিত দত্ত ইশারা করতেই আদালি নীচে নেমে গেল। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি কতদূরে থাকেন?

হাফ কিলোমিটার দূরে। এদিকে এখন হাতির উৎপাত বেশি।

কেন? মেজর মুখ খুললেন।

এই সময়টা ওরা আশেপাশের গ্রামে হানা দেয় খাবারের জন্যে। কেউ কেউ এই বাংলোর সামনে চলে আসে কিছু পাওয়া যাবে বলে। মনে হয় ওদের দর্শন আপনারা পেয়ে যাবেন দু-এক দিন থাকলেই। রঞ্জিত দত্ত মাথা নাড়ল।

আপনি আফ্রিকান হাতি দেখেছেন? আচমকা মেজর প্রশ্ন করলেন।

না। হকচকিয়ে গেলেন রঞ্জিত দত্ত।

তাদের কাছে ভারতীয় হাতিকে শিশু মনে হবে। বাই দ্যা বাই, মিস্টার দত্ত, আপনি যখন এখানকার রেঞ্জার, তখন নিশ্চয়ই আপনার কাছে জঙ্গলের একটা ম্যাপ পাওয়া যাবে।

রঞ্জিত দত্ত বললেন, ম্যাপ আছে, তবে সেটা দেখতে আমার অফিসে আপনাকে যেতে হবে। দেওয়ালে টাঙানো তো, খুলে আনা যাবে না।

আপনি এখানে কতদিন আছেন?

আট মাস।

এই জঙ্গলের কোনও রহস্যময় বস্তু, যেমন ধরুন, গাছপালা, পশুপাখি, ফুল, এসবের সন্ধান পেয়েছেন? মেজর এমন ভাবে প্রশ্ন করলেন যে অর্জুন বুঝল তিনি আসল উদ্দেশ্য প্রকাশ করতে চান না।

রঞ্জিত দত্ত মাথা নাড়লেন, সত্যি কথা বলতে কী এখন জঙ্গল তার সমস্ত রহস্য হারিয়েছে। তবে আমরা একটা হরিণের বাচ্চা পেয়েছিলাম যার চামড়া দেখলে মনে হবে নেকড়ে বা শেয়াল জাতীয় কোনও প্রাণীর।

মাথা নাড়লেন মেজর, এমন কোনও ফুলের সন্ধান পাননি, যার গন্ধ নাকে গেলে মানুষ মরে যেতে পারে। কিলার ফ্লাওয়ার!

রঞ্জিত দত্ত মাথা নেড়ে না বললেন।

আপনি সমস্ত জঙ্গল চষে দেখেছেন?

সেটা কি সম্ভব? হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছে এমন ভঙ্গিতে রঞ্জিত দত্ত বললেন, অবশ্য ঘুম থেকে সান্দাকফু যাওয়ার পথে বিকেভঞ্জন নামে একটা জায়গার কথা শুনেছি। সেখানে খানিকটা জায়গা জুড়ে যখন ফুল ফোটে, তখন বাতাসে অক্সিজেন কমে যায়। ওই ফুল নাকি অক্সিজেন শুষে নেয়। ফুলটার নাম লোকেতি।

লোকেতি?

হ্যাঁ।

আচ্ছা মিস্টার দত্ত, আপনার এই জঙ্গলে স্বাধীনভাবে ঘোরাঘুরি করা। যাবে?

না করাটাই ভাল। হঠাৎ যদি কোনও হিংস্র জন্তুর সামনে পড়ে যান, তা হলে বিপদ হবে। আপনারা যখন ঘুরতে চান বলবেন, আমি সঙ্গে গার্ড দিয়ে দেব। আচ্ছা, আমি কি এখন একটু অফিসে যেতে পারি, অনেক কাজ ফেলে এসেছি। সবিনয়ে বললেন রঞ্জিত দত্ত। মেজর তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়লেন। ভদ্রলোক একবার অমল সোমের ঘরের দিকে তাকিয়ে নীচে নেমে গেলেন। একটু পরে তাঁকে সাইকেলে চেপে উলটো দিকের জঙ্গলে মিলিয়ে যেতে দেখা গেল। আধ কিলোমিটার দূরত্ব এমন কিছু বেশি নয়।

অমল সোম তাঁর ঘরে বসেই চা খেলেন। বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে মেজর বললেন, আমি লক্ষ করেছি অর্জুন, তোমার দাদার মধ্যে একটুও রোমান্টিক ব্যাপার নেই। এই জঙ্গলে এসে কেউ কি ঘরে বসে থাকে? আমার ইচ্ছে করছে এখনই বেরিয়ে পড়ি।

যাবেন?

যেতে পারি। তবে প্রথম দিন তো, বেশিদূর না যাওয়াই ভাল। ওই রেঞ্জার ছছাকরার অফিস থেকে ঘুরে আসা যাক। ম্যাপটা নোট করে নেওয়া যাবে। মেজর উঠে দাঁড়ালেন।

বেরোবার আগে অর্জুন অমল সোমের দরজায় যেতে তিনি বললেন, ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ঘুরে এসো।

অমল সোম শুয়েছিলেন চোখ বন্ধ করে। একটু আগেও ওঁকে যখন অসুস্থ বলে মনে হয়নি, তখন এভাবে শুয়ে থাকা বিস্ময়ের।

নীচে নেমে মেজর বললেন, সাসপেন্সটা এবার ভাঙি?

অর্জুনের খেয়াল ছিল না। সে জিজ্ঞেস করল। কোন সাসপেন্স?

বাঃ, তখন তুমি জিজ্ঞেস করলে না, আমি সঙ্গে কোনও অস্ত্র এনেছি কিনা?

অর্জুনের মনে পড়ল। মেজর বললেন, জঙ্গলে ঢুকতে হবে বলে আমি তৈরি হয়েই এসেছি। চলো, আর একটু এগিয়ে যাই, আদালিটা বারান্দা থেকে আমাদের লক্ষ করছে।

অর্জুন মুখ ঘুরিয়ে দেখল লোকটাকে। আদৌ কোনও মতলব আছে বলে মনে হল না। গাড়ি চলার পথ ছেড়ে মেজর জঙ্গলে ঢুকলেন। গা ছাড়া-ছাড়া গাছগাছালি। পাতা মাড়িয়ে হাঁটা যায়। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, এখানে ঢুকলেন কেন?

গায়ের পাশে গাছ না থাকলে জঙ্গলে হাঁটার থিম থাকে না। কাঠঠোকরা ডাকছে শুনতে পাচ্ছ? কী রকম একটা ছন্দ আছে। গুড। হ্যাঁ, এইবার দ্যাখো। মেজর বুক পকেট থেকে একটা কলম বের করলেন। মোটা ডট পেন।

এটা কী?

কলম।

ঠিকই, কিন্তু এ কলম সে ক নয়। দাঁড়াও। মেজর মুখ ঘুরিয়ে চারপাশে তাকালেন। হতাশ হয়ে বললেন, সব নিরীহ পাখি। আরও একটু চলো।

কিছুক্ষণ হাঁটার পর গাছের পাতায় সরসর শব্দ বাজল। ওরা দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করল। পাতার ভূপ রয়েছে যেখানে, শব্দটা সেই স্কুপের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। মেজর ফিসফিস করে বললেন, এই কলমে টর্চের মতো একটা সুইচ আছে দেখতে পাচ্ছ?

হ্যাঁ।

এবার ওই পাতাগুলোর দিকে টিপ করে সুইচটা টিপলাম। কথা বলা মাত্র মেজরের আঙুল সুইচটাকে সরাতেই পাতাগুলোয় আগুন জ্বলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে একটা বড়সড় গিরগিটি লাফিয়ে উঠেই পড়ে গেল আগুনে।

মেজর বললেন, স্যরি। আমি সাপ ভেবেছিলাম।

পাতাগুলো জ্বলছিল। অর্জুন দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সেটাকে নেভাবার চেষ্টা করল। মেজর এসে পা লাগাতে আগুন নিভে গেল। এখন উট ধোঁয়া চারপাশে ছড়াচ্ছে। অর্জুন বলল, সাঙ্ঘাতিক জিনিস তো।

হ্যাঁ হে। আমার বন্ধু মাইকেল এটা উপহার দিয়েছে। এর রেঞ্জ কম-সেকম কুড়ি মিটার। পুরো টিপলে একটা হাতির শরীরের অনেকটা জ্বলে যাবে। অথচ পকেটে রাখলে কেউ বুঝতেই পারবে না এটা কী বস্তু। একবার ট্রাই করবে নাকি?

না। দেখলাম তো। চলুন, আলো পড়ে আসছে।

ওরা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলছিল। হঠাৎ গাড়ির আওয়াজ কানে এল। তারপরেই বোঝা গেল ওটা গাড়ি নয়, মোটর বাইক। বেশ জোরে বাইকটা ছুটে গেল পাশ দিয়ে। যেহেতু ওরা জঙ্গলের খানিকটা ভেতরে দাঁড়িয়েছিল, তাই মোটরবাইকের আরোহীর নজরে পড়েনি। আবার একইভাবে লোকটির পরিষ্কার চেহারা তাদেরও নজরে আসেনি।

মেজর বললেন, জঙ্গলের ভেতর এমন উৎকট শব্দ করে বাইক চালাচ্ছে, ওর পানিশমেন্ট হওয়া উচিত। ননসেন্স।

কিছুদুর যাওয়ার পর ওরা গাছ-ভাঙার শব্দ পেল। এবং তারপরেই ক্যানেস্তারা বাজার আওয়াজ। বেশ কিছু লোক একসঙ্গে চেঁচাচ্ছে। অর্জুন মেজরের হাত ধরল, ফিরে চলুন।

কেন?

মনে হচ্ছে কোনও বন্যজন্তু এদিকে এসে পড়েছে। আর না এগোনোই ভাল।

সঙ্গে সঙ্গে মেজর জঙ্গল ছেড়ে রাস্তায় পা বাড়ালেন। শব্দটা ওদিকে হচ্ছে খুব। এবার পটকা ফাটতে লাগল। আর তার পরেই অর্জুন দেখতে পেল ওদের। গোটা তিনেক হাতি জঙ্গল ছেড়ে এসে দাঁড়িয়েছে রেঞ্জারের অফিসে যাওয়ার পথে। অন্তত একশো গজ দূরে দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে একরোখা ভঙ্গিতে।

মেজর বললেন, বিউটিফুল। কী অহঙ্কারী ভঙ্গি। ক্যামেরা আনা উচিত ছিল।

আর তখনই একটা লোক পাশের গাছপালার মধ্যে দিয়ে ছিটকে রাস্তায় উঠে চিৎকার করে বলল, পালাও, পালাও, হাতি বেরিয়েছে।

লোকটাকে বাংলোর দিকে ছুটতে দেখে ওরাও দৌড়ল। মেজর ভারী শরীর নিয়ে তাল রাখতে পারছিলেন না। সামনে, ছোটা লোকটাকে ছুটতে ছুটতে অর্জুন লক্ষ করছিল। ওর শার্ট ছিড়ে গেছে। পায়ে জুতো রয়েছে একপাটি। পাম্প-শ্য গোছে। ডান হাত থেকে রক্ত পড়ছে। নির্ঘাত লোকটার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।

বাংলোর কাছাকাছি পৌঁছে ধপ করে বসে পড়ল লোকটা। অর্জুন দৌড় থামিয়ে ওর পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

মরে গিয়েছিলাম। জোর বেঁচে গিয়েছি আজ। ওরে বাবা, সাক্ষাৎ যম। হাঁপাতে হাঁপাতে কথাগুলো বলে যাচ্ছিল লোকটা।

আপনি হাতিদের সামনে গেলেন কেন?

কী করে জানব ওরা বাঁকের আড়ালে আছে? উঃ, কী যন্ত্রণা হচ্ছে হাতটায়। বাইকে স্পিড ছিল, ব্রেক কষতে কষতে একেবারে ওদের সামনে আছড়ে পড়েছি। একটা গুড় দিয়ে মারতে আমি ছিটকে প্রাণ নিয়ে দৌড়ালাম জঙ্গলের ভেতরে। বাইকটা শেষ হয়ে গিয়েছে। ওরে বাবা। লোকটা কাতরাতে লাগল।

অর্জুন ওকে বাংলোয় তুলে নিয়ে এল। সঙ্গে ফার্স্ট এইড বক্স সব সময় রাখেন অমল সোম। লোকটিকে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিতে দিতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, মেজর কোথায়?

অর্জুনের মনে পড়ল। সতি তো! মেজর তো তার পেছনে ছুটে আসছিলেন। কোথায় গেলেন তিনি? বুকের ভেতর হাতুড়ির শব্দ শুরু হয়ে গেল অর্জুনের।