০৫. সাধারণত একজন টি প্ল্যান্টার

সাধারণত একজন টি প্ল্যান্টার আর একজন সমশ্রেণীর মানুষ সম্পর্কে কটু কথা বলেন না। ড়ুয়ার্স দার্জিলিং এবং আসামে যেকটি চা বাগান আছে, তার মালিক ম্যানেজারের খবর প্রত্যেকের কম-বেশি জানা। একজন ভাল ম্যানেজার টানা একই বাগানে দীর্ঘকাল চাকরি করেছেন এমনটা অবশ্য খুব বেশি দেখা যায় না। যিনি ভাল কাজ জানেন, তাঁকে অন্য কোম্পানি বেশি মাইনে দিয়ে নিয়ে যায়। তাই কেউ চট করে অন্য বাগান সম্পর্কে মন্তব্য করে জনপ্রিয়তা হারাতে চায় না। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ম্যানেজার হিসেবে সুনাম প্রচুর এবং সেইসঙ্গে ভদ্রলোক বলেও স্বীকৃত। তাই ব্যানার্জি টি এস্টেট সম্পর্কে তিনি আর মুখ খুললেন না। বললেন, এবার আপনাদের বিশ্রাম নেওয়া উচিত। আমার পাশের বাংলোয় সব ব্যবস্থা রয়েছে, চলুন ওখানে।

অর্জুনের নীল-সম্পর্কিত কথাবার্তা চালিয়ে যেতে আগ্রহ ছিল। তার মনে পড়ল শিল্পসমিতি পাড়ার বরেন ঘোষালের ছোট ভাই ওই একই রকম বেপরোয়া গতিতে মারুতি চালায়। নীলের সঙ্গে ওর এত মিল কী করে হয়? চাবাগান এলাকায় মালিক এবং সেইসঙ্গে ম্যানেজারই সব ছিল এতকাল। দিন বদলালেও যা কর্তৃত্ব থেকে গেছে, তাতে নীলের পক্ষে নিজের এলাকায় যা করা সম্ভব, তা বরেন ঘোষালের ভাইয়ের পক্ষে জলপাইগুড়ি শহরে কী করে সম্ভব হচ্ছে?

ওরা যে বাংলোয় গেল, সেটি কাঠের এবং বিশাল। সমস্ত আধুনিক ব্যবস্থা আছে। দোতলার বিরাট বারান্দায় চাবাগানের দিকে মুখ করে চেয়ার টেবিল পাতা। তার সামনে সিলিং-এ একটা প্রমাণ সাইজের মৌচাক ঝুলছে। মৌমাছিদের ভিড়ে সেটা টসটস করছে। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ওরা কামড়ায় না?

ভানু ব্যানার্জি হাসলেন, না। আমাদের খুব বন্ধু ওরা। তবে বিরক্ত করলে একটু-আধটু হুল ফুটিয়ে দিলেও দিতে পারে। প্রত্যেক বছর ওরা এখানে চাক বাঁধে।

আপনারা মধু পান?

ইচ্ছে করলেই পেতে পারি, কিন্তু এই চাক ভাঙা হয় না। মধু শেষ হলে ওরা নিজেরাই উড়ে যায়, তখন চাক শূন্য। ওরা বোধ হয় সেটা জানে আর তাই আমাদের বন্ধু ভাবে।

মেজর বললেন, ইন্ডিয়ান মৌমাছিদের হুলে তেমন বিষ থাকে না হে।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কোন মৌমাছি বেশি বিষাক্ত?।

অমল সোম হেসে ফেললেন, তুমি কী হে! কবিরা মৌমাছি নিয়ে কত সুন্দর কবিতা, গান লেখেন, আর তুমি তাদের বিষাক্ত বলছ? হুল ওদের আত্মরক্ষার একটা অস্ত্র মাত্র, কিন্তু ওরা বিষাক্ত হবে কেন? নিজেদের মধ্যে কী সুন্দর ভাব দ্যাখো তো, শতশত মৌমাছি কী চমৎকার একসঙ্গে আছে। আমরা সেটা ভাবতে পারি না। চলুন, ঘরে যাই।

মৌমাছিদের সম্মিলিত আওয়াজ অদ্ভুত ভারী সুর তুলছিল। অর্জুন দেখল, বেশ কিছু মরা মৌমাছি নীচে পড়ে আছে। ওরা নিশ্চয়ই অসুস্থ অথবা বৃদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছে, নিজেরা তো মারামারি করে না।

ভানু ব্যানার্জি অমল সোমকে একটি ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন। মেজর মৌমাছির চাকের নীচে চলে গেলেন। তাঁর মাথার ঠিক দু হাত উঁচুতে চাকের শেষ। ওপর দিকে তাকাতেই কিছু একটা তাঁর নাকের ডগায় পড়ল। সেটা আঙুলে তুলে দেখে নিয়ে জিভে ঘষলেন মেজর। তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে গেল, ডিলিসিয়াস। ভারী মধুর মধু। তারপরেই সচেতন হয়ে বললেন, সুহাসিনী বাগান থেকে নীলগিরির জঙ্গল খুব বেশি দূরে নয়, উনি তাই বললেন তো?

হ্যাঁ। অর্জুন মাথা নাড়ল।

তা হলেও এই মৌমাছিগুলো কাছাকাছি থেকেই মধু সংগ্রহ করছে। যদি সেই বিষাক্ত ফুলের মধু ওরা আনত, তা হলে এতক্ষণে আমার মৃতদেহ দেখতে পেতে তোমরা।

অর্জুন মাথা নাড়ল, মৌমাছিরা সেই ফুলের কাছে গেলে গন্ধেই মারা যাবে, মধু নিয়ে আসবে কী করে? তা ছাড়া সেই সব ফুলে মধু নাও থাকতে পারে।

কারেক্ট। তবে প্রকৃতির ব্যাপার তো, মৌমাছিরা নিশ্বাস বন্ধ করেও ফুলের বুকে ঢুকে পড়তে পারে। তবে ওই মধু সেই সব ফুলের নয়। বলতে বলতে চাকের নীচ থেকে সরে এলেন মেজর। কয়েকটা মৌমাছি ওই সময়ে তাঁর কাঁধ-মাথায় এসে বসেছিল, চলে আসামাত্র তারা উড়ে গেল।

দুটো ঘর। এক্টায় অমলদা, অন্যটিতে মেজরের সঙ্গে অর্জুন। অমলদা বললেন, দেখছি, ওঁদের ভাব বেশি, একসঙ্গে থাকলে অনেক গল্প করতে পারবেন। আসলে অমলদা একা থাকতে বেশি পছন্দ করেন, তা চমৎকার ঘুরিয়ে বললেন।

দ্বিতীয় ঘরে ঢুকে মেজর প্রথমেই বললেন, হুম, ব্রিটিশ কালচার।

তার মানে? অর্জুন ব্যাগ রাখছিল।

ফুটবল খেলার মাঠের মতো বেডরুম, বাথরুমটায় না গিয়েও বলতে পারি হাড়ুড়ু খেলা যাবে। সঙ্গে নিশ্চয়ই সাজগোজ করার ঘর আছে। দ্যাখো গিয়ে।

অর্জুন দেখল এবং মিলে গেল মেজরের অনুমান। ভানু ব্যানার্জি এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন দরজায়, এদেশে চা বাগানের চর্চা ব্রিটিশরাই শুরু করেছিল, তাই ওদের প্রভাব সর্বত্র থাকবেই। আচ্ছা, আমাকে এখন কাজে যেতে হচ্ছে, কোনও দরকার নেই তো?

মেজর বললেন, নাথিং। পেট ভর্তি খাওয়ার পর ভাল বিছানা পাচ্ছি, আর কিসের দরকার?

অর্জুন বলল, বাঘটাকে দেখা যাবে?

ভানু ব্যানার্জি মাথা নাড়লেন, নিশ্চয়ই। ঠিক আছে, আমি আধঘণ্টা বাদে একটা জিপসি পাঠিয়ে দিচ্ছি, ওটা নিয়ে যেখানে ইচ্ছে সেখানে যেতে পারেন। ড্রাইভার ছেলেটি বেশ ওস্তাদ।

ভানু ব্যানার্জির পায়ের শব্দ কাঠের সিঁড়ি থেকে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই মেজর বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে বললেন, আজকাল টের পাই, বুঝলে, বয়স হচ্ছে একটু একটু করে। এখন শুতে পেলে আর কিছুর দরকার হয় না, আবার বেশিক্ষণ শোওয়াও যায় না। যন্ত্রণা। আধ ঘণ্টা পর ডেকে দিয়ো, সঙ্গে যাব, তাই চেঞ্জ করলাম না।

কথা শেষ হওয়ামাত্র নাক ডাকতে লাগল মেজরের। একটা মানুষ কতটা ভাগ্যবান হলে এমন সহজে ঘুমাতে পারে এবং অন্যের ঘুম নষ্ট করে অনায়াসে, তা মেজরকে না দেখলে বোঝা যাবে না। অর্জুন বাইরে বেরিয়ে চেয়ারে বসে মৌচাকের দিকে তাকাল। মোটা-মোটা মৌমাছিরা জানালা দিয়ে উড়ে এসে চাকের গায়ে সেঁটে যাচ্ছে। পাশের গাছগাছালিতে পাখি ডাকছে। পৃথিবীটা কী সুন্দর এখানে!

অমলদা কিছু বললে সে আজ পর্যন্ত অবাধ্য হয়নি। সেই কারণে বলামাত্র এখানে চলে এসেছে। এখানে আসার কারণ হিসেবে সেই ফুলটার হদিস জানার কথা বলা হয়েছে, যার বুকের গন্ধে বিষ আছে। কিন্তু এধরনের ফুল থাকলে এত দিন নাম শোনা যায়নি কেন? জঙ্গল যতই বড় হোক, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে তো সঙ্গে সঙ্গে এলাকাটা ঘিরে ফেলে ফুলের গাছগুলো নষ্ট করে দেবে। তা দিচ্ছে না কেন? যদি ধরে নেওয়া যায় ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট ব্যাপারটা জানে না, তা হলে তো আরও অবিশ্বাস্য হবে। যেখানে বিষ ছড়াচ্ছে সেখানে কেউ জানে না, আর বিদেশের কাগজে সে-সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ছাপা হচ্ছে? অবশ্য অমলদা যেখানে আছেন, সেখানে তার মাথা ঘামানোর কোনও দরকার নেই। অর্জুন ঠিক করল সে নিজেকে একজন টুরিস্ট ছাড়া কিছু ভাববে না। এ যাত্রায় নিছকই বেড়াতে আসা, এইভাবেই উপভোগ করবে। হঠাৎ ওর নজর গেল মৌমাছির চাকটার ওপর। চাকের নীচের দিকের একটা অংশ আচমকা ঝুলে পড়েছে। এমনভাবে ঝুলছে যে, নীচে পড়ে যাওয়া অনিবার্য। সঙ্গে-সঙ্গে একদঙ্গল মৌমাছি ওপরের অংশ থেকে উড়ে এসে ঘিরে ফেলল জায়গাটাকে। তারপর ধীরে ধীরে আবার আগের আকারে নিয়ে গেল ওরা। অর্জুন মুগ্ধ হয়ে দৃশ্যটি দেখল। দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে এ খবর ওরা কী করে পেল এবং সবাই একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ার অভ্যেস কেমন করে তৈরি হল, তা নিয়ে ভাবতে গেলে কোনও থই পাওয়া যাবে না। শুধু এই শিক্ষা যদি মানুষেরা পেত!

অমলদা শুয়ে-শুয়ে বই পড়ছিলেন। সি এইচ স্টকলির লেখা স্টকিং ইন দ্য হিমালয়াজ অ্যান্ড নর্দার্ন ইন্ডিয়া। খাঁচায় আটকানো চিতা বাঘ দেখার চেয়ে সেই বই পড়া নাকি বেশি সুখের, তাই তিনি গেলেন না। প্রায় নতুন জিপসিতে অর্জুন আর মেজর বসে পড়ল।

ড্রাইভারের নাম বৃন্দাবন। বয়স তিরিশের নীচে। কথা বলার জন্যে মুখিয়ে ছিল। ফ্যাক্টরি এলাকা ছাড়িয়ে চা বাগানের মধ্যে ঢুকেই বলল, সার, এর আগে চিতাবাঘের গায়ে হাত দিয়েছেন?

মেজর মাথা নাড়লেন, চিতাবাঘ কি বাড়ির কুকুর যে, গায়ে হাত বোলাব?

আমি বুলিয়েছি সার। আসলে খাঁচাটা ছোট ত, পেছন থেকে গায়ে হাত দিলে বাঘটা কিছু বলতে পারে না। এটা একদম খাঁটি চিতা।

দূর থেকেই জায়গাটা বোঝা গেল। বেশ কিছু আদিবাসী মানুষ ভিড় করে আছে। জিপসি দেখে তারা একটু সরে দাঁড়াল। বৃন্দাবন তাঁদের নিয়ে এল খাঁচার সামনে। ফুট দশেক লম্বা, পাঁচ ফুট চওড়া একটা মজবুত খাঁচা জঙ্গলের মধ্যে এমনভাবে লুকিয়ে রাখা আছে যে, চট করে বোঝা যায় না। চিতাবাঘটি প্রমাণ সাইজের। দুটো থাবা সামনে রেখে চুপচাপ বসে মানুষ দেখছে। পাশে একটা ছাগলের অবশিষ্ট অংশ পড়ে আছে। ওই ছাগলটাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।

মেজর একটু ঝুঁকে এগোতেই চিতাবাঘটা চট করে সোজা হওয়ার চেষ্টা করল এবং সেইসঙ্গে চাপা গর্জন করে উঠল। মেজর হকচকিয়ে গিয়ে দু পা পিছিয়ে এসে বললেন, কী ব্যাপার।

চিতা থাবা তুলে সামনের বন্ধ দরজায় আঘাত করল। চারপাশের দর্শকরা এতে খুব মজা পেল। এতক্ষণ জন্তুটা চুপচাপ বসে থাকায় তাদের আনন্দ হচ্ছিল না। বাঘটাকে খোঁচানো নিষেধ, তাই তারা ধৈর্য ধরে বসে ছিল। মেজরকে দেখে বাঘের প্রতিক্রিয়া হওয়ায় তারা উৎসাহিত হয়ে মেজরকে অনুরোধ করতে লাগল আবার খাঁচার সামনে এগিয়ে যেতে।

মেজর গম্ভীর মুখে দেখলেন লোকগুলোকে। তারপর অর্জুনকে জিজ্ঞেস করলেন, ওরা আমাকে কী মনে করছে? ক্লাউন? দেব নাকি তিম্পেনির ধমক?

সে জিনিসটা কী?

তিম্পেনির ঢাকের নাম শোনোনি? আফ্রিকায় খুব জনপ্রিয়। সেই ঢাক বাজলে জঙ্গলে-জঙ্গলে খবর ছড়িয়ে যায়। ওই ঢাক থেকেই আমার ধমক।

কিন্তু বাঘটা আপনাকে দেখে খেপে যাচ্ছে কেন বলুন তো?

খেপে যাচ্ছে? কোথায়? আবার সেই একই ভুল। গর্জন শুনেই মনে করলে খেপে যাচ্ছে? জন্তু-জানোয়ারের ল্যাঙ্গুয়েজ বোঝার চেষ্টা করো। ও আমার সাহায্য চাইছে। মেজর বৃন্দাবনের দিকে তাকালেন, ওকে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে কখন নিয়ে যাবে?

আজই নিয়ে যাওয়ার কথা।

এই এলাকায় আর কোনও বাঘ আছে?

আরও দুটো আছে।

তারা নিশ্চয়ই এর ধরা পড়ার কথা জেনে গেছে। এই খাঁচায় আর নতুন বাঘ ধরা পড়বে না। বড়সাহেবকে বলল এটাকে ছেড়ে দিতে।

ওকে ছেড়ে দিলে কুলিরা খেপে যাবে। গত সপ্তাহেই একটা বাঘ দু-দুটো গোক মেরেছে। এখন বাগানের সবাই বাঘের ওপর খুব রেগে আছে। ওকে ছাড়া চলবে না। বৃন্দাবন মাথা নাড়ল।

তা হলে এখান থেকে বেরিয়ে চলল। বাঘটাব অসহায় অবস্থা দেখতে আমার ভাল লাগছে না।

ওরা জিপসিতে বসতেই চিতা ডেকে উঠল। মেজরের চলে যাওয়া যেন বেচারা পছন্দ করছে না, এরকম মনে হচ্ছিল। বৃন্দাবন হেসে বলল, আপনাকে ওর মনে হয় পছন্দ হয়েছে।

মেজর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

খানিকটা যাওয়ার পর অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আমরা একটু আশেপাশে ঘুরে আসতে চাই।

বলুন সার, কোথায় যাবেন?

সুহাসিনী বাগানের কাছেই কোনও জঙ্গলে পার্বতী বড়ুয়া নামে একজন বিখ্যাত মহিলা থাকেন।

কথা শেষ করতে দিল না বৃন্দাবন, বুঝেছি। পার্বতীদি কি এখন এদিকে আছেন? চলুন, ঘুরে আসি। বেশি দূরে তো নয়।

মেজর জিজ্ঞেস করলেন, সেই লেডি উইদ অ্যান এলিফ্যান্ট?

আমি যা শুনেছি, তা ঠিক হলে কম বলা হল। উনি গৌরীপুরের রাজ পরিবারের মেয়ে। ওঁর বাবার নাম ছিল প্রকৃতীশ বড়ুয়া। অর্জুনকে কথা শেষ করতে দিল না বৃন্দাবন, লালজি, ওঁকে লালজি বললে সবাই চিনত। একদম বুড়ো বয়সেও হাতি নিয়ে ঘুরতেন।

বড়ুয়া টাইটেল তো অসমের মানুষের হয়?

গৌরীপুর অসমেরই। তবে প্রকৃতীশ বড়ুয়ার দাদা ছিলেন বাঙালির গর্ব। আমাদের বাংলা সিনেমার প্রথম দিকে যাঁর অবদান চিরস্মরণীয়, সেই প্রমথেশ বড়ুয়ার ছবি নিশ্চয়ই আপনি দেখেছেন। আমি একটা ছবি দেখেছি, মুক্তি। অর্জুন বলল।

মাই গড। আমার ফেভারিট হিরো ছিল হে। ওঁকে নকল করে একসময় আমি শার্ট বানাতাম, বড়ুয়া কলার। রাজকুমার ছিলেন। আচ্ছা। ইন্টারেস্টিং। ওঁর ভাইঝি পার্বতী বড়ুয়া? মেজরকে এতক্ষণে বেশ উৎফুল্ল দেখাল। পিচের রাস্তায় গাড়ি ওঠামাত্র পঙ্কজ মল্লিককে নকল করে গাওয়ার চেষ্টা করলেন, দিনের শেষে ঘুমের দেশে…।

একটা ভাঙা ব্রিজের পাশ দিয়ে জিপসি নেমে গেল, বোরাতে এখন জল নেই। তারপর কাঁচা পথ ধরে এগোতে লাগল দুলতে-দুলতে। গাড়ির পেছনে ধুলোর ঝড় উঠেছে। এখন বিকেল, তবে সন্ধে নামতে কিছুটা সময় বাকি। মিনিট পাঁচেক যাওয়ার পর ওরা নীচের মাঠে একটা কাঠের বাড়ি দেখতে পেল। বৃন্দাবন বলল, যাক, পার্বতাদিদি আছে।

কী করে বুঝলে? মেজর জানতে চাইলেন।

ওপাশে দেখুন, দুটো হাতি দাঁড়িয়ে আছে।

জিপসির আওয়াজ পেয়ে গাছের তলায় দাঁড়ানো হাতি দুটো কান খাড়া করল। একজন কয়েক পা এগিয়ে এসে থমকে দাঁড়াল। বাড়িটার কাছে এসে নিরাপদ দূরত্বে থেকে হর্ন বাজাতে লাগল বৃন্দাবন। খুব সাধারণ হালকা কাঠের বাড়ি। কোনও রকম জাঁকজমক নেই। তার দোতলার বারান্দায় একটি শীর্ণ শরীর দেখা গেল। বৃন্দাবন গাড়ি থেকে নেমে চিৎকার করল, সাহেবের বন্ধুরা এসেছেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে। নিয়ে আসব?

মহিলা হাত নেড়ে আসতে বললেন। মেজর ফিসফিস করলেন, এই সেই লেডি, আই মিন রাজকুমারী? অর্জুন জবাব দিল না।

ততক্ষণে মহিলা নীচে নেমে এসেছেন। ওরা নেমে এগিয়ে গেল। ফরসা, ছিপছিপে, রোগা বলাই ভাল, আটপৌরে চেহারার তিরিশের কাছাকাছি মহিলা তখন হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। কাছাকাছি হতেই বললেন, আসুন। আপনারা ভানুদার বন্ধু যখন, তখন আমারও দাদা।

কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের সংঘাত প্রায়ই হয়, কিন্তু তাই বলে এইরকম? অর্জুন ভেবেছিল এই পার্বতী বড়ুয়া হান্টারওয়ালী টাইপের কেউ হবেন, কিন্তু আটপৌরে শাড়ি পরা মহিলাকে দেখে দিদি ছাড়া কিছু ভাবা যায় না! এঁরই ছবি ন্যাশনাল জিওগ্রাফি-র মলাটে ছাপা হয়েছে?

খুব যত্ন করে পার্বতী ওদের দোতলার বারান্দায় নিয়ে এলেন। কয়েকটা বেতের চেয়ার আছে সেখানে। বৃন্দাবন নীচে রইল। পার্বতী জিজ্ঞেস করল, চা খাবেন? লেবু দিয়ে দেব, দুধ-চা দিতে পারব না। না কি কফি?

মেজর চারপাশে তাকাচ্ছিলেন। এই জঙ্গলের মধ্যে একজন মহিলা এভাবে একা থাকতে পারেন, তা যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, চা কি আপনি করবেন?

না, না। লেবু চা বলি, অ্যাঁ? তারপর বারান্দার এক কোণে গিয়ে নীচের দিকে মুখ করে কাউকে চা তৈরির নির্দেশ দিলেন। মেজর বললেন, অদ্ভুত।

ফিরে এসে পার্বতী জিজ্ঞেস করলেন, কে অদ্ভুত?

আপনি এখানে একা থাকেন, ভাবতেই পারছি না।

অসুবিধে কোথায়? পার্বতী হাসলেন। আপনার ভয় লাগে না?

পার্বতী মাথা নেড়ে আঙুল তুলে দেখালেন, ওরা আছে। জঙ্গলের দেবতা। ওরা সঙ্গে থাকলে আমি যমকেও ভয় পাই না।