০৩. হাসিমারার তেমাথায় অমলদা

ঠিক হয়েছিল হাসিমারার তেমাথায় অমলদা সকাল এগারোটায় ওদের জন্যে অপেক্ষা করবেন। সকালের বাস ধরে গেলে ওঁর পক্ষে ওই সময়ে পৌঁছতে অসুবিধে হবে না। অর্জুন আটটা নাগাদ অমলদার বাড়িতে গিয়ে দেখল, মেজর তৈরি হয়ে বসে আছেন। দেখা হওয়ামাত্র দাঁড়িয়ে উঠলেন, লেটস স্টার্ট। যাওয়ার আগে হাবুর হাতের চা খেয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল অর্জুনের, কিন্তু মেজরের ভঙ্গি দেখে সেটা বলতে পারল না। মেজরের হাত খালি, দুই কাঁধে স্ট্র্যাপ ঝোলানো ব্যাগ পিঠে ঝুলছে।

বাইকের ইঞ্জিন চালু করার পর মেজর বসতেই মনে হল চাকা কিছুটা ছোট হয়ে গেল। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। মেজর বললেন, অল রাইট?

বাইক চালু করে অর্জুন বলল, ঠিক আছে, আপনি চেষ্টা করুন সহজ হয়ে বসতে।

সহজ? আমার মতো সহজ পৃথিবীতে আর কে আছে জানি না। একবার আল্পসে স্কি করছিলাম। বাধ্য হয়ে নয়, নটোরিয়াস একটা গ্যাং পেছনে তাড়া করছিল, হঠাৎ বাঁ হাঁটুতে অসম্ভব যন্ত্রণা। নিজেকে বললাম, সহজ হও, সঙ্গে সঙ্গে সহজ হয়ে গেলাম। বরফের ওপর আমার স্পিড় দেখে ব্র্যালবার্ন তো হতভম্ব। পাঁচ মিনিট কথা বলতে পারেনি। ছোট্ট হাসি বের হল মেজরের দাড়ির জঙ্গলে ঢাকা ঠোঁট থেকে।

অর্জুন জানতে চাইল, ব্র্যালবার্ন কে?

জুরিখে থাকে ছোকরা। তিন-তিনবার স্কিতে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ান।

অর্জুন আর কথা বাড়াল। মেজরের ভারী শরীর ব্যাক সিটে মাঝে-মাঝে নড়ছে। অর্জুন সতর্ক হয়ে চালাচ্ছিল। মেজর যা বলেন তা শুনলে স্রেফ গুল বলে মনে হয়। কিন্তু আমেরিকা ইংল্যান্ডে গিয়ে মেজরের পরিচিতি সে নিজের চোখে দেখে এসেছে এবং তারপর তো অবিশ্বাস করার উপায় নেই।

তিস্তা ব্রিজ ছাড়িয়ে ময়নাগুড়ি বাইপাস দিয়ে যেতে-যেতে অর্জুনের মনে হল মেজরকে বলা দরকার। এদিকে উনি আগে আসেননি। অর্জুন মুখ ঘুরিয়ে বলল, ওই যে রাস্তাটা দেখছেন, ওটা জল্পেশ্বর মন্দির পর্যন্ত গিয়েছে। ড়ুয়ার্সের সবচেয়ে নামকরা শিবমন্দির।

বিশেষত্ব কী?

খুব প্রাচীন মন্দির। কোচবিহারের রাজা স্বপ্নে আদেশ পেয়ে ওখানে এমন একটা শিবলিঙ্গ পেয়েছিলেন, যার কোনও শেষ নেই। অর্জুন বলতে বলতে বাইক মোড়টা পেরিয়ে গেল।

হল্ট। মেজর চিৎকার করে উঠতেই অর্জুন ব্রেক কষল।

মেজর বললেন, শেষ নেই। তার মানে পাথরটা মাটির তলায় পোঁতা। তাই তো?

হ্যাঁ।

কিন্তু তার শেষ নেই মানে? মাটি খুঁড়ে দেখা হয়নি?

হয়েছিল। বলা হয়েছে অখণ্ড শিব।

ইন্টারেস্টিং। লেটুস গো, নিজের চোখে দেখে আসি। এরকম পাথর গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে প্রচুর পাওয়া যায়। তুমি জানো কি, ওখানে যেসব পাহাড়ের চূড়া রয়েছে, তাদের নাম সব ভারতীয় দেবতাদের নামে। শিব, বিষ্ণু, ইত্যাদি। দুটোর মধ্যে মনে হচ্ছে যোগসূত্র আছে।

অর্জুন খবরটা শুনে অবাক হল। কিন্তু এখন যদি বাইক ঘুরিয়ে জল্পেশ্বরের রাস্তা ধরা হয়, তা হলে হাসিমারায় পৌঁছতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। যদিও অমলদা বাসে যাচ্ছেন এবং পৌঁছতে দেরি হবে, তবু ফেরার সময় নাহয় মন্দিরটা দেখা যেতে পারে। মেজর রাজি হলেন।

অর্জুন বাইকের গতি বাড়াল। খানিকক্ষণ পরে মেজর কিছু সময় গুনগুন করে গলা তুলে জিজ্ঞেস করলেন, হিন্দিতে র‍্যাপ গাইতে শুনেছি, বাংলায় কেউ গাইছে?

র‍্যাপ? অর্জুন হাওয়ার জন্যে চেঁচাল। হ্যাঁ।

জানি না। তবে এখন জীবনমুখী গান খুব হচ্ছে।

কী মুখী?

জীবনমুখী।

ও, সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতাগুলোয় সুর দেওয়া হচ্ছে বুঝি? ওটা তো হেমন্তকুমার অনেক দিন আগেই গেয়েছেন। নতুন কী হল! র‍্যাপ ব্যাপারটা একদম আলাদা। আফ্রিকাতে এক ধরনের পাখি আছে, যাদের ডানা তিন ফুট লম্বা। রেগে গেলে তারা হাততালি দেওয়ার মতো করে ডানাতালি দেয়। তাতে যে আওয়াজ ওঠে তার সঙ্গে র্যাপের রিদমের মিল আছে। বুঝলে?

মেজরের সঙ্গে থাকলে অনেক তথ্য জানতে পারা যায়। কিন্তু এই র‍্যাপ গান বেশিক্ষণ শুনতে অর্জুনের একটুও ভাল লাগে না। মেজর যদি উৎসাহিত হয়ে হেঁড়ে গলায় র‍্যাপ গাইতে আরম্ভ করেন, তা হলে বিপদ। সে প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্যে বলল, ওই দেখুন, জলঢাকা নদী।

দুপাশে ধানের মাঠ, বড় পিচের রাস্তাটা উঁচুতে উঠছে ব্রিজে পৌঁছতে এবং তারপরেই বেশ চওড়া নদী। যদিও এসময় নদীতে জল নেই তেমন, তবু দৃশ্যটি দেখতে ভালই লাগে। মেজর বললেন, পাঁচ মিনিটের জন্যে বিশ্রাম নেওয়া যাক।

বিশ্রাম? অর্জুন গতি কমাল ব্রিজের ওপর।

আমার পা অসাড় হয়ে আসছে হে। একটু স্বাভাবিকভাবে রক্ত সঞ্চালন করুক, তারপর আবার পেছনের সিটে বসব।

অতএব অর্জুন ব্রিজের একধারে বাইকটাকে রাখল। নীচে পা দিয়ে কয়েক সেকেন্ড মেজর নড়বড় করলেন। বোঝা যাচ্ছিল ওঁর পায়ে জোর নেই। সেটা ফিরে এলে চারপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, জলপাইগুড়ি, ময়নাগুড়ি তারপরে কী?

ধুপগুড়ি।

আচ্ছা! এরকম নাম আরও আছে?

হ্যাঁ, লাটাগুড়ি, বিনাগুড়ি। ড়ুয়ার্সে গুড়ি ছাড়া আর একটা শব্দ পাওয়া যায়, কাটা। যেমন নাগরাকাটা, গয়েরকাটা, ফালাকাটা।

এই গুড়ি আর কাটার মানে জানো?

অর্জুন একটু ভাবল। একসময় কার কাছে যেন ঐতিহাসিক কিছু তথ্য শুনেছিল। ভুটান এবং তিব্বতের মানুষেরা এই অঞ্চলে নিয়মিত আসতেন এবং তাঁদের ব্যবহৃত শব্দ থেকে এদিকের অনেক জায়গার নাম হয়েছে। সে বলল, আলাদা করে বলা মুশকিল। যেমন জলপাইগুড়ি। লোকে ভাবে এখানে অনেক জলপাই গাছ ছিল। গুড়ি মানে জায়গা। কিন্তু এ তথ্য ঐতিহাসিকরা মানেননি। আসল শব্দ হল জিলেপিগোড়ি। জিলে মানে বাজার বা বিনিময় কেন্দ্র, পে মানে উল বা কম্বল, গো মানে দরজা আর রি-এর অর্থ পাহাড়। ভোট-তিব্বতিতে এই জিলেপিগগাড়ির নামে পাহাড়ের দরজায় কম্বল উল বিক্রি করার জায়গা বা বাজার।

মেজর বললেন, মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। আমি ভাই গুড়ি মানে জায়গা আর কাটা মানে টুকরো করা ভেবে নিচ্ছি। ওসব জায়গায় গাছটাছ টুকরো হত।

ভাবুন, কিন্তু কাউকে বলবেন না। জলপাইগুড়িতে ফিরে গিয়ে একজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব, যাঁর কাছে সমস্ত তথ্য পাবেন। অর্জুন বলল।

মেজর নদীর দিকে তাকালেন, জলঢাকা। তার মানে জলে ঢেকে যায় চারদিক।

মোটেই নয়। অর্জুন হেসে ফেলল, শব্দটা হল জলঢাক্কা। ভোট-তিব্বতিতে একে বলা হত দিচু। দি মানে এই, this, আর চু-এর অর্থ নদী। এই নদীর ধার দিয়েই শুনেছি ভোট-তিব্বতে যাওয়ার রাস্তা ছিল।

ইন্টারেস্টিং। এই নদীকে ফলো করলে তিব্বতে যাওয়া যায়? ইদানীং কেউ কি গিয়েছে?

জানি না। সম্ভবত না।

তা হলে এটা নিয়ে পরে ভাবতে হবে।

ওরা যখন কথা বলছিল, তখন জলপাইগুড়ির দিক থেকে একটা নীল মারুতি জিপসিকে ছুটে আসতে দেখা গেল। জিপসি যে চালাচ্ছে হয় তার হাত পাকা নয়, অথবা নেশা করে স্টিয়ারিং-এ বসেছে। জিপসিটা প্রচণ্ড গতিতে রাস্তার এপাশ-ওপাশ করতে-করতে ছুটে আসছে। ব্রিজের ওপর উঠেও সেটার ধরন যখন পালটাল না, তখন অর্জুন তার বাইকটাকে ফুটপাতের ওপর তুলে আনার চেষ্টা করল।

একচুলের জন্যে বেঁচে গেল অর্জুনের বাইক। হাওয়ার ধাক্কায় টলে গিয়েছিল অর্জুন, মেজর চিৎকার কবে গালাগালি করছিলেন। জিপসিটা কিন্তু কোনও রকম ভুক্ষেপ না করে তেমনই এলোমেলো হয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। মেজর চিৎকার করলেন, ফলো হিম। ওকে ধরে থানায় নিয়ে যেতে হবে।

মেজরকে পেছনে বসিয়ে বাইক চালাল অর্জুন। গতি বাড়াতেই ওরা তীরের মতো ছুটল। যেহেতু রাস্তার এপাশ ওপাশ মাড়িয়ে জিপসিটা এগোচ্ছে তাই কাছাকাছি পৌঁছতে বেশি দেরি হল না। কিন্তু ওই রাস্তা জুড়ে চলার জন্যেই টপকে যাওয়া যাচ্ছে না। মেজর চিৎকার করলেন থামার জন্যে, অর্জুন হর্ন বাজাল। কিন্তু গাড়ির ড্রাইভারের কোনও ভুক্ষেপ নেই। এবার উলটো দিক থেকে একটা বাস আসছে দেখা যেতেই জিপসিটা আচমকা রাস্তার ডান দিকে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাসটা চলে যেতে অর্জুন বাইক নিয়ে এল পাশে। জিপসির একমাত্র আরোহী তখন কালো চশমার আড়াল থেকে তাদের দেখছে।

মেজর সদর্পে এগিয়ে গেলেন, এ কী রকম গাড়ি চালানো হচ্ছে, অ্যাাঁ? ড্রিঙ্ক করেছ নাকি?

লোকটি কোনও উত্তর দিল না। অর্জুন লক্ষ করল লোকটি আদৌ নেশাগ্রস্ত নয়। গায়ের রং টকটকে ফর্সা, রোগা, ঠোঁটের ওপর ধনুকের মতো কুচকুচে কালো গোঁফ।

তোমার ঠাকুদার নাম কী? অদ্ভুত শীতল গলায় প্রশ্নটা এল।

অ্যাাঁ? মানে? হোয়াট ইজ দিস? মেজরের শরীর এক পা পিছিয়ে গেল।

আমার সঙ্গে ওই ভাষায় কথা বললে সেই নামটি তোমাকে ভুলে যেতে হবে। এটা অবশ্য দ্বিতীয়বারে। তৃতীয়বারে ঠাকুর্দার ছেলের নাম তোমাকে ভুলতে হবে। চতুর্থবারে …। গিয়ার চেঞ্জ করল লোকটি, ড়ুয়ার্সে এসেছ, জেনে রেখো আমি নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে কৈফিয়ত দিই না। আচমকা গতি বাড়িয়ে এগিয়ে গেল জিপসি। এবার আর এঁকেবেঁকে নয়, সোজা, মুহূর্তেই চোখের আড়ালে চলে গেল বাঁক নিয়ে।

বদমাশ, ভিলেন। মেজর আকাশে মুঠো করা দু হাত ছুঁড়লেন, আমাকে ভয় দেখাচ্ছে? অন্যায় করেও আমার সঙ্গে এই ব্যবহার! দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা, তোমার মতো পুঁটি মাছকে এই শমা তোয়াক্কা করে না। যদি আবার দেখা পাই। শুন্যে শব্দগুলো ছুড়ে দিচ্ছিলেন মেজর সশব্দে।

এইসময় একটা অ্যাম্বাসাডার গাড়ি জলপাইগুড়ির দিক থেকে ধীর গতিতে এগিয়ে আসছিল। মেজরের উত্তেজিত চেহারা দেখে উলটো দিকে দাঁড়িয়ে গেল সেটা। গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে এক বৃদ্ধ বসে আছেন। বৃদ্ধের আদেশে ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

মেজর আড়চোখে তাকালেন। তারপর বৃদ্ধ বুঝেই গলা চড়ালেন, এই ড়ুয়ার্সে কি জঙ্গলের আইন চলে? মগের মুল্লুক? আমার বাপ-ঠাকুদার নাম ভুলিয়ে দেবে বলল?

এবার ওপাশের দরজা খুলে বৃদ্ধ নেমে এলেন, যিনি বলেছেন, তিনি কি নীল জিপসিতে ছিলেন?

ইয়েস। নীল জিপসি।

বৃদ্ধ সঙ্গে-সঙ্গে হাতজোড় করলেন, যদি কোনও তিক্ততা হয়ে থাকে, তা হলে আমি তার জন্যে দুঃখপ্রকাশ করছি। আপনাকে অনুরোধ করব ভুলে যেতে।

অর্জুন এতক্ষণ নাটকের দর্শকের মতো দেখে যাচ্ছিল। এখন ওই বৃদ্ধের বক্তব্য শোনার পর তার আগ্রহ বাড়ল। সে বৃদ্ধের সামনে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার পরিচয়?

আমার নাম হরপ্রসাদ সেন। আপনারা যাঁকে দেখেছেন, তিনি আমাদের ছোটসাহেব। ব্যানার্জি টি গার্ডেনসের পরবর্তী মালিক। আমাদের বড় সাহেব স্বৰ্গত অশ্বিনী ব্যানার্জি ড়ুয়ার্সে গোটা চারেক চা বাগানের মালিক ছিলেন। উনি চলে যাওয়ার পর মিসেস ব্যানার্জিই সব দেখাশোনা করেন। ওঁদের কোনও সন্তান নেই। ছোট সাহেব মিসেস ব্যানার্জির ভাই। মানুষটি খুব খামখেয়ালি। আজ আমাদের একসঙ্গে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু উনি আগে চলে এলেন। বৃদ্ধ বললেন।

আপনি কী করে আন্দাজ করলেন যে উনি এখানে গোলমাল করেছেন।

এর আগে পথে দুটো গোলমাল থামিয়ে এসেছি। আশংকা হল এখানেও করতে পারেন।

অর্জুন মাথা নাড়ল, এরকম লোককে তো জেলে পোরা উচিত।

তা সম্ভব নয়। ওঁর প্রতাপ-প্রতিপত্তি প্রচুর। তবে আমাদের মালকিন অন্য ধরনের মানুষ। তিনি ভাই-এর ব্যবহার সমর্থন করেন না, আবার তাকে শাসনও করতে পারেন না।

আপনারা কোন চা বাগানে যাচ্ছেন?

নিম টি এস্টেট।

এবার মেজর এগিয়ে এলেন, শুনুন মশাই, আপনাদের ছোট সাহেব যে অভদ্র ব্যবহার করেছেন তার ফল ওঁকে ভোগ করতে হবে। ওঁকে সামনে এসে ক্ষমা চাইতে হবে।

প্লিজ, এ নিয়ে আর জোরাজুরি করব না। এই যে আমি আপনাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তা জানতে পারলে উনি চিবিয়ে খাবেন। অবশ্য আমি স্বেচ্ছায় এটা করিনি, মিসেস ব্যানার্জির নির্দেশ আছে বলেই করেছি। তবে ছোট সাহেবকে না ঘাটানোই ভাল।

ভদ্রলোকের পুরো নাম কী?

নীল চ্যাটার্জি। ড়ুয়ার্সে সবাই ওকে নীল বলেই জানে। আচ্ছা নমস্কার। বৃদ্ধ ফিরে গেলেন গাড়িতে। অ্যাম্বাসাডারটা বেরিয়ে গেল।

মেজর বললেন, বড়লোকের অপদার্থ ছেলে। চাবকে সোজা করে দিতে হয়।

অর্জুন আর কথা বাড়াল। মেজরকে পেছনে বসিয়ে সে স্পিড তুলল। বেশ দেরি হয়ে গেছে। অমলদা হাসিমারা বাজারে অপেক্ষা করবে। তবে যাই হোক, নীল চ্যাটার্জি বেশ ইন্টারেস্টিং চরিত্র। মনে হচ্ছে লোকটার সঙ্গে এ যাত্রায় আবার দেখা হবে।

অপমানিত হয়েছেন বলেই মেজর আর একটাও কথা বলেননি। মন খারাপ হলে মানুষ চুপ করে যায়। ধুপগুড়ি গয়েরকাটা পেরিয়ে বীরপাড়া ছাড়ানোর পর অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনার কী হল?

তোমার ব্যবহার দেখলাম। পেছনে বসা মেজর জবাব দিলেন। কী রকম?

লোকটা, আমার পূর্বপুরুষের কথা বলে অপমান করল, আর তুমি সেটা কান পেতে শুনলে? আমি তোমার বয়সে হলে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতাম।

তাতে জেলে যেতে হত। তা ছাড়া আমি দেখলাম, আপনি বেশ দক্ষ হাতে সিচ্যুয়েশন ট্যাক্স করছিলেন। তাই মাথা গলালাম না।

বলছ? দক্ষ হাতে! বাংলা ভাষার কোন মাথামুণ্ডু নেই।

তার মানে? হঠাৎ এমন মন্তব্যে হকচকিয়ে গেল অর্জুন।

দক্ষ মানে এফিসিয়েন্ট। তাই তো? আবার শিবের শ্বশুরের নাম দক্ষ। সেই পাজি লোকটার যজ্ঞ নষ্ট করতে শিবকে কী কাণ্ড করতে হয়েছিল। ওই লোকের নাম দক্ষ হয় কী করে?

অর্জুন হাসল, দক্ষ ব্রহ্মার মানসপুত্র। ব্রহ্মার বুড়ো আঙুল থেকে জন্ম বলে ওঁর নাম দক্ষ।

তুমি দেখছি পুরানের গল্পগুলো ভাল জানেনা।

না। শুধু পৌরাণিক অভিধান বলে একটা বই পড়েছি। দারুণ ইন্টারেস্টিং। একবার ধরলে আর ছাড়তে পারবেন না। ডান দিকে জলদাপাড়া ফরেস্ট।

ওরা বাঁক নিচ্ছিল। মেজর তাকালেন, এমন কিছু জঙ্গল নয়। বাঘ সিংহ তো থাকবে না, হাতি, গণ্ডার আছে বলছে। আসলে বাঘ, সিংহ ছাড়া জঙ্গল একেবারেই আলুনি।

ওরা হাসিমারার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সুন্দর পিচের নির্জন রাস্তা। পাখি ডাকছে। দু পাশে জঙ্গল। একটা নদী পড়ল। অর্জুনের মনে পড়ল সেই পাখি শিকারী সুন্দরের কথা। লোকটার চাকরির জন্যে ফরেস্ট অফিসে নিয়ে যেতে হবে। কাছাকাছি যেখানে প্রকৃতীশ বড়ুয়ার মেয়ে পার্বতী বড়ুয়া থাকেন, সেখানে গেলে সুন্দরের ঠিকানা পাওয়া যাবে।

সে বলল, এই সামনের জঙ্গলের কোথাও এমন একজন ভদ্রমহিলা থাকেন, যাঁর ছবি ছাপা হয়েছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর মলাটে।

তাই নাকি? কেন? মেজর জানতে চাইলেন।

ড়ুয়ার্সের হাতিরা তাঁর কথায় ওঠেবসে। হাতিকে ওঁর মতো আর কেউ চেনে না।

দারুণ ব্যাপার! আলাপ করা যাবে? মেজর নড়ে-চড়ে বসলেন।