০১. ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি

আজ সকাল থেকেই ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি এক আকাশ মেঘ থেকে ঝরেই চলেছে। এরকম দিনে বাইরে বেরোতে কারই বা ভাল লাগে। অর্জুন নিজের বিছানায় শুয়ে ছিল চুপচাপ। এখন দুপুর। জানলার বাইরে মরা আলো। কবিরা হয়তো একেই বাদলের দিন বলে সুন্দর লাইন লেখেন, কিন্তু আজ অর্জুনের মাটিতে পা রাখতে একটুও ইচ্ছে করছিল না। দুপুরের খাওয়ার পর ঘুমের অভ্যেস তার কোনওকালে নেই বলেই এখন ঘুমটাই যা আসছিল না। এই সময় টেলিফোনটা বেজে উঠল।

হ্যাঁ, এই বাড়িতে টেলিফোন এসেছে মাসতিনেক। জলপাইগুড়িতে এখন অনেক বাড়িতেই ফোন। দরখাস্ত করতেই কর্তৃপক্ষ খাতির করে বসিয়ে দিয়ে গেছেন যন্ত্রটা। ওটা আসায় লাভ হয়েছে অনেক। আবার বাজে ফোনও আসছে বিস্তর।।

অর্জুন টেলিফোনটার দিকে তাকাল। এর মধ্যে চারবার আওয়াজ করেছে যন্ত্রটা। বিছানা ছেড়ে ওঠার আলস্যটাকে সরাতে-সরাতে সে মায়ের গলা শুনতে পেল, কী রে, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি?

অর্জুন উঠল। রিসিভার তুলে গম্ভীর গলায় বলল, হ্যালো!

ভদ্রলোক প্রথমে নম্বর যাচাই করলেন। তারপর বললেন, আমি শুনেছি তোমার বয়স খুবই কম। আমার বয়স পঁচাশি। তাই তুমি বলছি। তুমি কি এখন খুব ব্যস্ত?।

আপনি কে বলছেন?

আমার নাম বিজনবিহারী ঘোষ। শিল্পসমিতি পাড়ায় থাকি। বাড়ির নাম, সারদাময়ী। যে-কোনও লোককে জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দেবে। তুমি একবার আসতে পারবে ভাই? বৃদ্ধের গলায় একটা আকুতি ফুটে উঠল। কিন্তু মুশকিল হল বেশিরভাগ মানুষ অপ্রয়োজনকেও প্রয়োজন বলে ভাবতে ভালবাসে।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, এরকম আবহাওয়া। যেতে বলছেন, প্রয়োজনটা কি খুব জরুরি?

হ্যাঁ ভাই। আজ এবাড়িতে আমার নিজস্ব চাকর ছাড়া কেউ নেই। সবাই গিয়েছে শিলিগুড়িতে। এরকম আবহাওয়ায় ফিরে আসবে বলে মনে হয় না।

তোমার সঙ্গে কথা বলার এই সুবর্ণ সুযোগ।

আপনি আপনার বাড়ির লোকদের এড়িয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে চান?

হ্যাঁ ভাই। আমি ব্যাপারটা গোপন রাখতে চাই।

বেশ। আমি আসছি।

রিসিভার নামিয়ে রাখামাত্র মায়ের গলা পাওয়া গেল, এমন দিনে বেরোচ্ছিস?

কী করব! ভদ্রলোকের জরুরি দরকার। পঁচাশি বছর বয়স।

ও বাবা! মা পাশ ফিরলেন, বাড়িতে টেলিফোন এসে এই ঝামেলা করল। আগে কষ্ট করে আসতে হত, এখন নম্বর ঘুরিয়ে কথা বলে নিলেই হল। মা চলে গেলেন।

জলপাইগুড়ি শহরের বেশিরভাগ জায়গায় বৃষ্টিতে জল জমে না কিন্তু কাদা প্যাচপ্যাচ করে। আপাদমস্তক বর্ষাতিতে মুড়ে নিয়ে অর্জুন তার লাল বাইকটা বের করল। পায়ে কাদা লাগাবার বিন্দুমাত্র বাসনা নেই তার। কদমতলা থেকে শিল্পসমিতি পাড়া আর কত দূর! রাস্তা ফাঁকা। মাঝে-মাঝে দু-একটা রিকশা ঢেকেঢুকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে রিকশাওয়ালারা, ভিজে কাক হয়ে। শিল্পসমিতি পাড়ায় পৌঁছে বাড়ি খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না।

বিজনবিহারী ঘোষ অবস্থাপন্ন মানুষ। দোতলা বাড়িটা বিশাল। সামনে পাঁচিলঘেরা বাগান। গেটের গায়ে সাদা পাথরের ওপর লেখা, সারদাময়ী। গেট বন্ধ। ঝুপঝুপ বৃষ্টিতে বোঝাই যাচ্ছে না বাড়িতে মানুষ আছে কি না। অর্জুন দুবার বাইকের হর্ন বাজাল। কোনও সাড়া নেই। তৃতীয়বার বাজানোর সময় গেট খুলে একজন প্রৌঢ় ভৃত্যগোছের লোক ছাতা মাথায় ওর দিকে তাকাল। অর্জুন তাকে বলল, আমার নাম অর্জুন। বিজনবিহারীবাবু একটু আগে আমাকে ফোন করেছিলেন।

আসুন। বড়বাবু আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।

নীচের তলায় বর্ষাতি খুলে রেখে সে ভৃত্যটিকে অনুসরণ করে দোতলায় উঠে এল। বেশ সাজানোগোছানো বাড়ি। কোথাও একটুও অপরিষ্কার হয়ে নেই। একটি ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে লোকটি বলল, বাবু, উনি এসেছেন।

এসো ভাই! ঘরে এসো! উদাত্ত কণ্ঠ কানে আসামাত্র অর্জুন পা বাড়াল।

গলার স্বর শুনে যে চেহারা কল্পনা করেছিল অর্জুন, বাস্তবে তার কোনও মিল নেই। সাদা ধবধবে বিছানায় যে-মানুষটি বসে আছেন, তাঁর বয়স মুখ-চোখে স্পষ্ট। কিন্তু ওই রোগা মানুষটির বুকের নীচে একটি চাদর আড়াল করা রয়েছে, যার তলার দিকে খুবই শীর্ণ পায়ের আদল।

তোমার বয়স অল্প বলে শুনেছিলাম, কিন্তু এত অল্প, কল্পনা করিনি। তুমি অর্জুন তো? ভদ্রলোকের গলার স্বর খুবই জোরালো। ওই শরীর থেকে এরকম গলা কী করে বেরিয়ে আসছে, সেটাও বিস্ময়ের! অর্জুন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

বোসো। তুমি ওই চেয়ার টেনে নিয়ে বোসো। আসলে কী জানো, আজকাল অল্পবয়সীরা কেউ কিছু করে না বলে আমরা তাদের আন্ডারএস্টিমেট করতে শুরু করেছি। কী খাবে বলো? বিজনবিহারীবাবুকে এখন বেশ আন্তরিক বলে মনে হচ্ছিল অর্জুনের।

এই সময় আমি কিছু খাই না। অর্জুন চেয়ারে বসল।

বেশ। ভবা নীচে গিয়ে দাঁড়া। এসময় কেউ যেন আমার ঘরে না আসে। দরজায় দাঁড়ানো ভৃত্যটিকে হুকুম করতেই সে দ্রুত সরে গেল। বিজনবিহারী বললেন, অবশ্য কারও আসার সম্ভাবনা খুবই কম। বাড়ি এখন খালি।

কথাটা টেলিফোনেও বলেছিলেন তিনি। অর্জুন দেখছিল। ঘরের একটা দেওয়ালে পর-পর অনেক অয়েলপেন্টিং টাঙানো। বিজনবিহারী সেটা লক্ষ করে বললেন, একদম ডান দিকে আমার পিতামহ, নুটুবিহারী, তাঁর পাশে পিতামহী আশালতা, তিন নম্বর আমার পিতা পবনবিহারী, পাশে মাতা শ্যামাসুন্দরী, মাঝখানের জায়গাটা আমার জন্যে এখনও ফাঁকা, শেষ ছবি আমার স্ত্রী সরস্বতীর।

ফাঁকা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি হল অর্জুনের। দাদু, দিদিমা, বাবা, মায়ের ছবি তিনি টাঙাতেই পারেন, মৃত স্ত্রীর আগে নিজের জন্য জায়গা রেখে দেওয়াটা বেশ অস্বস্তিকর। সেটা বুঝে বিজনবিহারী বললেন, আমার ছবি আমি আঁকিয়ে রেখেছি। কাপড়ে মুড়ে খাটের তলায় রাখা আছে। কিন্তু না মরা পর্যন্ত ছেলেরা টাঙাতে পারছে না হে। বলে শব্দ করে হাসলেন।

আপনি আমাকে কোনও কাজের ভার দেবেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ। তোমার নামডাক হয়েছে শুনেছি। আমাকে যিনি চিকিৎসা করেন, সেই ডক্টর সান্যালও তোমার কথা বলেছেন। তুমি তো বিদেশেও গিয়েছ?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

খুব ভাল। আগে আমার কথা বলি তোমাকে। এই জলপাইগুড়ি শহরে আমার পিতা পবনবিহারী ভাগ্যান্বেষণে এসেছিলেন ১৮৯৯ সালে। তখন তিনি উনিশ বছরের যুবক। আমাদের পৈতৃক বাড়ি ঢাকার কাছে কালীগঞ্জে। ভাগ্যান্বেষণে আসার কারণ অর্থাভাব নয়। পিতামহ নুটুবিহারী খুবই বিত্তবান মানুষ ছিলেন। জমিজমা ছাড়াও তাঁর নানা ব্যবসা ছিল। কিন্তু সে-সবই তিনি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। পিতামহরা দুই ভাই। ছোটজন একটু উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির মানুষ। তিনি কোনও কাজ করতেন না। দাদার কাছে প্রয়োজন হলেই হাত পাততেন। তাঁর দুই ছেলেও একই ধাত পেয়েছিল। ফলে আমার পিতা অনুমান করেছিলেন যে, ভবিষ্যতে গোল বাধবে। তিনি পিতামহের অনুমতি নিয়েই এখানে চলে আসেন। তখন ড়ুয়ার্সে চা-শিল্পের পত্তন হয়েছে। ব্যবসা কেমন হবে তা কেউ সঠিক অনুমান করতে পারছেন না। পিতামহের কাছে ঋণ নিয়ে পিতা একটি চা বাগানের পত্তন করেন। নিজের মায়ের নামে নাম রাখলেন আশালতা।

পিতামহ চায়ের ব্যবসা বুঝতেন না, কিন্তু পিতাকে নিরুৎসাহ করেননি। প্রথমদিকে তিনি যে নিয়মিত পিতাকে অর্থসাহায্য করেছেন, তার প্রমাণ আমি পেয়েছি। তরুণ বয়সে আমিও পিতার ব্যবসায় যুক্ত হই। তখনও পিতামহ জীবিত। যাতায়াতের অসুবিধে থাকা সত্ত্বেও আমি ছাত্রাবস্থাতে প্রতি বছরই কালীগঞ্জে যেতাম। পিতামহ স্নেহ করতেন খুব। পিতার ব্যবসার উন্নতির খবর পেয়ে খুশি হতেন। আমি চাইতাম তিনি জলপাইগুড়িতে চলে আসুন। তিনি রাজি হতেন না। বলতেন, এই জমিজায়গা, মানুষ ছেড়ে আমি স্বর্গে গিয়েও শান্তি পাব না ভাই।

ক্রমশ আমরা বুঝতে পারছিলাম যে, পিতামহের সঙ্গে তাঁর ভাই এবং ভাইপোদের সম্পর্ক ভাল যাচ্ছে না। তারা অলস জীবন যাপন করবে এবং পিতামহকে সে ব্যাপারে অর্থ জোগাতে হবে। পিতামহ বিরক্ত বোধ করলেই ঝামেলা বাধত। শেষপর্যন্ত তারা অভিযোগ আনল সরাসরি। পিতামহ পারিবারিক সম্পত্তি সরিয়ে ড়ুয়ার্সে চা বাগান কেনার জন্যে আমার পিতাকে উৎসাহিত করেছেন। তাঁরা চা বাগানের অংশ দাবি করলেন।

আমার পিতা পবনবিহারী ঝামেলা পছন্দ করতেন না। তিনি অংশ দিলেন না বটে, কিন্তু ওঁদের দাবির কাছাকাছি থোক টাকা ধরে দিলেন। বললেন, আমি যা ঋণ নিয়েছিলাম, তার তিন গুণ ফিরিয়ে দিলাম। পিতার ব্যবসা তখন ভাল চলছিল। কয়েক বছরেই তিনি সামলে উঠলেন। এই সময় পিতামহ মারা গেলেন। তাঁর কাজকর্ম করতে আমি এবং পিতা কালীগঞ্জে গেলাম। বাড়িটির অবস্থা তখন বেশ খারাপ। বাড়ির লোকজন বলতে পিতামহের ভাইয়ের বংশধররা। গ্রামের লোকজন অনুযোগ করতে লাগল যে, তারা সামান্য নগদ টাকার লোভে বিষয়সম্পত্তি বিক্রি করে দিচ্ছে। এমনকী আমার পিতামহীর সঞ্চয়ে নিজস্ব যেসব গহনা ছিল, সেগুলোর হদিস পাওয়া গেল না। পিতা ঢাকা শহরে এসে একটি মামলা করলেন। যেহেতু বসতবাড়িটিতে তাঁরও অংশ আছে, তাই তাঁর অনুমতি ছাড়া ওই বাড়ি বিক্রি করতে না পারে। আদালত থেকে সেই মর্মে একটা আদেশ বেরিয়ে যাওয়ায় পিতা নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে এলেন। কিন্তু সেই থেকেই কালীগঞ্জের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। বিজনবিহারী থামলেন একটু। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ভাই, হয়তো এসব গল্প তোমার ভাল লাগছে না। কিন্তু জানা না থাকলে বুঝতে অসুবিধে হবে।

অর্জুন চুপচাপ মাথা নাড়ল। ভারতবর্ষ বিভক্ত হওয়ার আগেই পূর্ববঙ্গ থেকে বেশ কিছু মানুষ এদেশে এসেছেন। তাঁরা উদ্বাস্তু নন। এদেশে এসে অনেকেই সাফল্য পেয়েছেন। বিজনবিহারীও তাঁদের একজন।

বিজনবিহারী আবার শুরু করলেন, চায়ের ব্যবসা পিতা ভালই বুঝতেন। ওটা আমিও রপ্ত করলাম। একটার বদলে দুটো বাগানের মালিকানা পেলাম। জলপাইগুড়ি শহরের রায় এবং ঘোষ পরিবারের সঙ্গে আমাদের নামও লোকে বলত। কিন্তু ব্যবসার ঝুঁকি কী জানো? তোমার ছেলে যদি ব্যবসাবিমুখ হয়, তা হলে তুমি ব্যবসাটাকে যতই বাড়াও, তা এক সময় গোটাতে বাধ্য হবেই। আমার দুই ছেলে। পিতা দেহ রাখার পর আমি তখন প্রচণ্ড ব্যস্ত। বড় ছেলে পড়াশোনায় ভাল। সে চাটার্ড পাশ করে বিলেতে চলে গেল পড়তে, কিন্তু ছোটটা কলেজের গাঁট পেরোতে পারল না। অথচ আমি দুজনকে সমান সুযোগ দিয়েছিলাম। বিলেতে থাকার সময়ে বড় জানাল তার পক্ষে আর দেশে ফেরা সম্ভব নয়। ভারতবর্ষের ওই একচিলতে শহরে চায়ের ব্যবসায় জীবন কাটাতে সে নাকি জন্মায়নি। ওখানে কাজের সুযোগ বেশি। আর বিলেতে যখন থাকতেই হবে তখন বাঙালি মেয়েকে বিয়ে না করে ইংরেজ মেয়েকে বিয়ে করাই যুক্তিসঙ্গত।

এই ব্যাপারটা ওদের মা মানতে পারল না। বিদেশিনীকে বিয়ে করার জন্যে নয়, যে-ছেলে নিজের জন্মভূমিকে হেয় মনে করে, তার মুখদর্শন করতে চাইল না সে। বলল আমার বড় ছেলে মরে গেছে। কথাটা বড়কে জানিয়ে দেওয়া হল। ছোট ছেলে পড়াশোনায় ভাল না হলেও বাস্তববুদ্ধি প্রখর। সে আমার সঙ্গে ব্যবসায় যোগ দিল। এর কিছুদিন পরেই আমার স্ত্রী হার্টফেল করে। এই শোক আমাকে বেশ কাবু করে ফেলল। আমি ব্যবসা থেকে সরে এলাম। বয়স হয়েছে, ছেলেও উপযুক্ত। ব্যবসার ব্যাপারে তার সঙ্গে আমার মত সব ব্যাপারে মিলবে এমন কথাও নেই। আমি প্রাচীন ভাবনার মানুষ, সে নবীন। প্রায়ই দিল্লি-কলকাতা করে। পছন্দমতো এক আধুনিকাকে বিয়ে করল। মেয়েটি খারাপ নয়, কিন্তু তার জীবনযাপন এত আধুনিক যে আমার পক্ষে তাল রাখা মুশকিল হয়ে পড়ল।

আমার ছেলের প্রচণ্ড উগ্র জীবন আমাকে মেনে নিতে হল। এবং সেটা যে মেনে নিতে পারিনি তার প্রমাণ আমার অসুস্থতা। আমি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হলাম। একটা দিক অসাড় হয়ে গেল প্রথমে। অনেক চিকিৎসার পরে উধ্বাঙ্গে স্বাভাবিকতা ফিরে এলেও কোমরের নীচ থেকে সব অসাড় হয়ে গেল। কারও সাহায্য ছাড়া আমি বিছানা থেকে নামতে পারি না আর।

কিন্তু খারাপ খবর বাতাসের আগে ছোটে। ছোট ছেলে অতিরিক্ত লাভের নেশায় যে ঝুঁকি নিয়েছে তাতে ব্যবসা ড়ুবছে। প্রচুর ঋণ করে ফেলেছে কালোয়ারদের কাছে। এবং শেষপর্যন্ত দু-দুটো বাগান বিক্রি করে নিজেকে বাঁচিয়েছে, এসবই এই বিছানা থেকে শুনলাম। সে আমার ঘরে আসেও না অথচ এই বাড়িতে থাকে। যা কিছু টাকা পয়সা এখনও আছে তা তার স্ত্রী সরাতে পেরেছিল বলেই আছে। কলকাতার সল্টলেকে ওর স্ত্রী একটি বাড়ি কিনেছে। ব্যাঙ্কেও রেখেছে কিছু। বছরের বেশিরভাগ সময় সেখানেই থাকে। আমি ভবাকে নিয়ে এখানে পড়ে আছি।

বিজনবিহারী চুপ করতে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি টেলিফোনে বললেন বাড়ির সবাই শিলিগুড়িতে গিয়েছে। এই সবাই কারা?

আমার পুত্রবধূ এবং তার মেয়ে। ছেলেও গেছে। ওরা দিনসাতেক হল এখানে এসেছে। অনেকক্ষণ কথা বলায় এখন বিজনবিহারীকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল।

অর্জুন বলল, আপনাদের পারিবারিক গল্প খুবই দুঃখজনক। আপনার বাবার সব কাজ এভাবে নষ্ট হতে দেখতে আপনার কীরকম লেগেছে তা অনুমান করছি। কিন্তু আপনি আমাকে এখানে কেন আসতে বললেন, বুঝতে পারছি না। এ ব্যাপারে আমার কী করণীয়? মাথা নাড়লেন বিজনবিহারী, একথা মনে হওয়া খুব স্বাভাবিক। কাহিনী শোনালাম, যাতে সব ব্যাপারটা তুমি বুঝতে পারো। আমাদের এখন অর্থাভাব চলছে। তার মানে এই নয় যে, খেতে-পরতে পারছি না। যা কিছু ব্যাঙ্কে রাখতে পেরেছি তার সুদে বাকি কটা দিন চলে যাবে। কিন্তু…!

বলুন!

হঠাৎ একটা পুরনো চিঠি খুঁজে পেলাম। আমার শরীরের এই অবস্থায় খোঁজা সম্ভব নয়। ভবাকে দিয়ে বাবার আলমারি পরিষ্কার করছিলাম। যা কিছু কাগজপত্র সে আমাকে এনে দিতে তাতে চিঠিটাকে দেখতে পেলাম। আমার পিতামহের চিঠি। বিজনবিহারীর মুখ উজ্জ্বল হল।

চিঠিতে কী লেখা আছে?

ব্যাপারটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তুমি নিশ্চয়ই গোপন রাখবে। অর্জুন হেসে ফেলল, আপনি তো সেই কারণেই আমাকে ডেকেছেন।

হুঁ। আমি চাই না আমার ছেলে বা পুত্রবধু এসব জানুক।

তাঁদের সঙ্গে আমার এখনও পরিচয় হয়নি। কিন্তু আমি আমার বোধবুদ্ধি দিয়ে যে কাজ করি তার সঙ্গে যদি আপনার পাওয়া চিঠির কোনও সম্পর্ক না থাকে তা হলে বলার দরকার নেই।

আছে। চিঠিটা পাওয়ার পর পিতা কেন যে কোনও অ্যাকশন নেননি, তা আমি জানি না। খামের ওপর প্রাপ্তি স্বীকারের তারিখ লিখে রেখেছিলেন এইমাত্র। বিজনবিহারী তাঁর হাতের কাছে রাখা একটা চামড়ার পোর্টফোলিও ব্যাগ টেনে নিয়ে সেটা খুললেন।

অর্জুন দেখল ব্যাগ হাতড়ে ভদ্রলোক একটা খাম বের করলেন। খুব পুরনো আমলের খাম কিন্তু ময়লা হয়নি। খাম থেকে একটি চিঠি বের হল। বিজনবিহারী অল্প কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলেন,

কল্যাণীয়েষু পবনবিহারী,

আশা করি তোমার ব্যবসা ভালই চলিতেছে। তুমি গোয়ালন্দ ত্যাগ করিয়া স্বাবলম্বী হইয়াছ, ইহাতে আমি অত্যন্ত আনন্দ পাই। আমি বৃদ্ধ। নিজস্ব জায়গায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করিলেই শান্তি পাইব বলিয়া এই স্থানে রহিয়া গিয়াছি।

কিন্তু জীবিত অবস্থায় যে অশান্তি কপালে জুটিয়াছে তাহার সমাধান কী আমি জানি না। আমার ভ্রাতৃম্পুত্ররা প্রতিনিয়ত অর্থের জন্য আমাকে বিব্রত করিতেছে। তাহাদের ধারণা আমি সমুদয় অর্থ তোমাকে গোপনে দিয়া দিয়াছি। প্রকৃত সত্য ইহারা বিশ্বাস করে না। অথচ আমার সঞ্চয়ে সামান্যই নগদ অর্থ আছে। আমি বিশেষভাবে চিন্তিত তোমার জননী এবং পিতামহীর স্বর্ণালঙ্কারের জন্য। মূল্যবান পাথর ছাড়াই তাহাদের ওজন প্রায় পাঁচশো ভরি হইবে। এইসব অলঙ্কার তাঁহাদের মূল্যবান স্মৃতি। মুখরা ইহাদের দিকে হাত বাড়াইতে চায়। আমি আমার স্বল্প ক্ষমতায় ইহাদের রক্ষা করিতে চেষ্টা করিতেছি।

গতরাত্রে এখানে প্রচুর ঝড়জল হয়। মধ্যরাত্রে আমি সমুদয় অলঙ্কার মাটিতে পুঁতিয়া আসিয়াছি। আমাদের বাড়ির সমুখে যে শিবমন্দির আছে তাহার দক্ষিণ দিকে যে প্রাচীন বটবৃক্ষ, তাহাকে নিশ্চয়ই স্মরণ করিতে পার। ওই বটবৃক্ষ হইতে দশ কদম পূর্ব দিকে যাইলে এই বাড়ির দোতলার শেষ গবাক্ষ দেখা যায়। গবাক্ষকে নজরে রাখিয়া আর-একটু দক্ষিণে হাঁটলেই পুষ্করিণীর ধাপ শুরু হইবে। সেই ধাপের আগে চার হাত গর্ত খুঁডিয়া একটি টিনের বাক্সে অলঙ্কারাদি ভরিয়া আমি রাখিয়া দিয়াছি। মাটি সমান করিয়া ফিরিয়া আসিতে কষ্ট হইয়াছিল। আজ সকালে গিয়া দেখিলাম, বৃষ্টি মাটি খোঁড়ার চিহ্ন মুছিয়া দিয়াছে। এই তথ্য তোমাকে ছাড়া কাহাকেও বলিব না। আমার মৃত্যুর পর তোমার যদি প্রয়োজন হয় তাহা হইলেই ওইসব অলঙ্কার তুমি গ্রহণ করিবে। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।

—আশীবাদক, তোমার পিতা, নুটুবিহারী ঘোষ।

পড়া শেষ করে বিজনবিহারী মুখ তুললেন।

অর্জুন বলল, আপনার বাবা তো আপনাকে নিয়ে গিয়েছিলেন ওখানে?

হ্যাঁ। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি বাবা এসব মাথায় আনেননি। মাটি খুঁড়ে অলঙ্কার বের করলে সবাই দেখতে পেত। আমিও জানতাম। তখন বাবার অর্থের তেমন প্রয়োজনও ছিল না। পিতামহের শ্রাদ্ধ নিয়েই তিনি ব্যস্ত ছিলেন সে-সময়।

পরে যাননি?

না। আর না। তা ছাড়া বাবার সব কিছু আমি পেয়েছি। তিনি যদি ওগুলো সংগ্রহ করতেন, তা হলে আমি তা দেখতে পেতাম।

একটা কথা। আপনার বাবা মারা গিয়েছেন কবে?

স্বাধীনতার পরের বছরে।

এতদিনেও আপনি চিঠিটার হদিস পাননি কেন?

পেতে চেষ্টা করিনি বলে। বাবা চলে যাওয়ার পর ওঁর যাবতীয় কাগজপত্র আমি ওই আলমারিতে ভরে রেখেছিলাম। বিশেষ করে যে-খামটার ওপর ব্যক্তিগত লেখা ছিল, সেটা খোলা অশোভন মনে করায় খুলিনি। একসময় কাজের চাপে ভুলেই গিয়েছিলাম এসবের কথা। দ্যাখো ভাই, জীবিত অবস্থায় আমরা এমন অনেক কিছু করি, যা একান্ত আমারই। মরে যাওয়ার পর তার সবকিছু ছেলেমেয়েদের পছন্দ নাও হতে পারে। আমি বাবার ব্যক্তিগত খামে সেই কারণেই হাত দিইনি।

চিঠিটা দেখতে পারি?

বিজনবিহারীবাবু খামসুদ্ধ চিঠি এগিয়ে দিলেন। খামের এক কোণে লেখা আছে, আঠারোই শ্রাবণ, ১৩৩৯ সন। অর্থাৎ ষাট বছর আগে চিঠিটা এসেছিল। নুটুবিহারীর চিঠিতে কোনও তারিখ নেই। হাতের লেখা স্পষ্ট। সেই সময় শিক্ষিত মানুষেরা চিঠিপত্রে তারিখ অবশ্যই লিখতেন। নুটুবিহারী লেখেননি কেন? কাগজটি বেশ পুরনো। কিন্তু বোঝা যায়, এই কাগজ বেশি ব্যবহৃত হয়নি। হয়তো চিঠি লেখার পর বারপাঁচেক খোলা হয়েছে ভাঁজ। অর্জুন চিঠিটা মন দিয়ে পড়ল। তারপর সেটাকে ফিরিয়ে দিতেই বিজনবিহারীবাবু সযত্নে খামে বন্ধ করে ব্যাগের মধ্যে ভরে ফেললেন। তারপর গম্ভীরভাবে বললেন, আমার পিতামহের পাঁচশো ভরি সোনা মাটির নীচে পড়ে আছে ষাট বছরের ওপর। পাথরগুলো বাদ দিলেও সোনার দাম কুড়ি লক্ষ টাকা হবে। একমাত্র আমি ওঁর প্রকৃত উত্তরাধিকারী। তুমি আমাকে গহনাগুলো উদ্ধার করে দেবে?

অর্জুন বৃদ্ধকে দেখল। তারপর বলল, আপনার ঠাকুর্দা থাকতেন কালীগঞ্জে। জায়গাটা ভারতবর্ষে নয়। বাংলাদেশের আইনকানুন কী, তা আমি জানি না।

বিজনবিহারী বললেন, এতে আবার আইনকানুনের কথা উঠছে কেন? আমাদের জিনিস ওখানে পড়ে আছে। আমি সেটা নিয়ে আসব, এতে অন্যায় কোথায়?

আপনি ভুলে যাচ্ছেন বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। সেখানে যেতে হলে ভিসার দরকার পড়ে। স্বাধীনতার আগে আপনার জিনিস ওখানে থাকলে এখন সেই জিনিসে আপনার অধিকার আছে কি না সে প্রশ্ন উঠতে পারে। পাঁচশো ভরি সোনা যদি মাটির তলায় খুঁজে পাওয়া যায় তা হলে অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারকে জানানো উচিত। ওই সোনা নিয়ে এদেশে চলে আসা খুব বড় ধরনের অপরাধ। আমার কথা আপনি একটু ভেবে দেখুন। অর্জুন বোঝাবার চেষ্টা করল।

এসব যে আমি ভাবিনি, তা কী করে জানলে? কিন্তু সোনা আমার দরকার।

অর্জুন উঠে দাঁড়াল, কিন্তু কাজটা নেব কি না সে ব্যাপারে আমি একটু ভাবি। আপনাকে আমি দিন তিনেকের মধ্যে জানিয়ে দিতে পারব। নমস্কার।