১৭. অমল সোমের সঙ্গে

অমল সোমের সঙ্গে এতদিন ঘনিষ্ঠভাবে থেকেও তাঁর অনেক আচরণের ঠিকঠাক ব্যাখ্যা অর্জুন এখ, পায়নি। এই মুহূর্তে সেটাই মনে হল। লোকগুলোকে ধরার ব্যাপারে আর কৌতূহলই যেন নেই তাঁর। এস. পি. সাহেবরা কাজে লেগে গেলেন। অর্জুন আর ভানু ব্যানার্জি অমল সোমকে অনুসরণ করল।

সেই বিশাল খাদ, যেটা গতরাতে অর্জুন দেখে গিয়েছিল, তার পাশে এসে দাঁড়াল ওরা। কিছু সেপাই জনাদশ বারো লোককে একটা জায়গায় দড়ি দিয়ে বেঁধে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। তিনটে মৃতদেহ চোখে পড়ল। অর্জুনের মনে হল এদের দুজনকে গতরাতে সে দেখেছে। খাদটা, যেটা খোঁড়া হয়েছে, সেটা মন্দিরের কাছেই। অমল সোম সেদিকে তাকিয়ে বললেন, অর্জুন, এতবড় একটা কর্মকাণ্ড এখানে দিনের পর দিন চলেছে, আর তারা কেউ খবর পেলেন না, এদেশেই এটা সম্ভব। কিন্তু লোকটির বুদ্ধি আছে।

ভানু ব্যানার্জি বললেন, এমন পাণ্ডববর্জিত জায়গার খোঁজ এরা পেল কী করে?

পেয়েছে তো দেখতে পাচ্ছি। হরিপদ সেন যেটা জানতেন না এরা তা জানত। কিন্তু মন্দির থেকে এতদূরে কেন? সুড়ঙ্গের কথা ওরা জানত। মন্দিরের গায়েই সুড়ঙ্গ। কালাপাহাড় নিশ্চয়ই সুড়ঙ্গের ভেতরেই সম্পদ লুকিয়ে রেখেছিলেন। তা হলে এখানে খাদ খোঁড়া কেন? অমল সোম যেন নিজের সঙ্গে কথা বলছিলেন।

অর্জুন বলল, এখানে কোনও বিল নেই অমলদা।

সেটাও রহস্য। কিন্তু ওরা জায়গা নির্বাচন করতে ভুল করেছে এটা কিন্তু মানতে পারছি না।

অমল সোম খাদের মধ্যে নেমে গেলেন। কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে এসে বললেন, ধারণাটা ঠিক। এখানে একসময় জল ছিল। মাটির এত নীচে গুগলি আর শামুক চাপা পড়ে সচরাচর থাকে না। তোমার কি ধারণা ওরা গুপ্তধন পেয়ে গেছে?

অর্জুন বলল, ওরা আজই এখান থেকে পাততাড়ি গোটাবার কথা ভেবেছিল। আগামিকাল কাউকেই পাওয়া যেত না। তার মানে ওরা কাজ শেষ করেছিল।

অমল সোম মাথা নাড়লেন, কাজ শেষ হয়ে গেলে এখানে পড়ে থাকার লোক এরা নয়। খোদ কতা ওগুলো নিয়ে আগে হাওয়া হয়ে যেতেন। চলল, মন্দিরের ভেতরে যাই। অমল সোম এগোতে লাগলেন। দূরে জঙ্গলের মাথায় ধোঁয়া দেখা গেল। ওরা মন্দিরের ভেতর ঢুকে সেপাইদের দেখতে পেল। পাহারা দিচ্ছে।

অমল সোম মন্দিরের ইট পরীক্ষা করে বললেন, কালাপাহাড় নবদ্বীপের মন্দির স্পর্শ করেননি। এটির প্রতি অনুগ্রহ হল কেন তাঁর? কোচবিহারের রাজাকে হারিয়ে এখানে এসে, উঁহু, কেমন যেন হিসাব মিলছে না। তিনি কি নন্দলাল সেনের অনুরোধ রেখেছিলেন? অবশ্য হতে পারে। মন্দির গুঁড়িয়ে দিলে সম্পদ লুকিয়ে রাখার জায়গাটা পরে চেনা যাবে না, তাই।

ভানু ব্যানার্জি বললেন, যে-লোক অমন ছিল সে কেন মন্দিরের গায়ে সম্পদ লুকোতে যাবে?

অমল সোম বললেন, মানুষটি বুদ্ধিমান ছিলেন। তিনি জানতেন কেউ ভাবতেও পারবে না অত সম্পদ মন্দিরের গায়ে কালাপাহাড় রেখে যেতে পারে। এখন আমার বিশ্বাস হচ্ছে কিছু যদি থেকে থাকে তা হলে ওই সুড়ঙ্গেই আছে।

অমল সোম কথা শেষ করা মাত্র কাঠের প্ল্যাটফর্মে শব্দ হল। ওরা সঙ্গে-সঙ্গে সতর্ক হয়ে দাঁড়াল। প্ল্যাটফর্মটা ধীরে ধীরে ঘুরছে। গর্তটা চোখে পড়ল। তারপর একটা হাত, মাথা সন্তর্পণে বাইরে বেরিয়ে আসতেই সেপাইরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। টেনে-হিচড়ে তাকে বাইরে বের করে আনা মাত্র নীচে থেকে গলা ভেসে এল, কী হল শরৎ? এনি প্রব্লেম?

শরৎ নামের লোকটাকে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছিল। নীচে থেকে কাসির আওয়াজ পাওয়া গেল। লোকটা আর থাকতে পারছিল না। অর্জুন এখানে দাঁড়িয়েই ধোঁয়ার গন্ধ পেল। মিনিট তিনেকের মধ্যেই আরও একজন বন্দি হল। ওদের মন্দিরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হল। ভানু ব্যানার্জি এবং সেপাইরা তৃতীয়জনের অপেক্ষায় রইলেন।

বন্দী দুজনের দিকে তাকিয়ে মনে হল এরা বেশ দুধে-ভাতে ছিলেন। হাত বেঁধে মাটিতে বসিয়ে রাখা হয়েছে ওঁদের। অমল সোম জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের মধ্যে কার উপাধি সেন?

লোক দুটো নিজেদের দিকে তাকাল। অর্জুন দেখল যে-লোকটিকে সে আঘাত করেছিল সে এদেরই একজন। অমল সোম ঠাণ্ডা গলায় বললেন, জবাব দিন।

আমরা কেউ সেন নই। একজন উত্তর দিল। সেন কোথায়?

নীচে।

আপনারা ওঁর পার্টনার?

হ্যাঁ।

সম্পত্তি পেয়েছেন?

না।

সে কী! এত খোঁড়াখুঁড়ি, খুনোখুনি।

লোক দুটো চুপ করে রইল। অমল সোম বললেন, চুপ করে থেকে কোনও লাভ হবে না। আপনারা একের-পর-এক খুন করেছেন এখানে। জায়গাটা আদিম করে তুলো, লন। এস.পি. সাহেব ঠিক সেই কাজটা করতে পারেন। কালাপাহাড়ের সম্পত্তি কোথায়?।

একজন বলল, নিরাপদ জায়গাটা ঠিক বেছেছিল, কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি।

নিরাপদ কে? যিনি মাটির নীচে আছেন?

হ্যাঁ।

আপনারা শিলিগুড়িতে যাওয়ার সময় আমাদের লিফট দিয়েছিলেন মনে পড়ছে? গুড। হরিপদ সেনকে খুন করে কে?

আমি জানি না।

বাজে কথা, বিশ্বাস করি না।

আমরা যাওয়ার আগে খুন হয়েছিল হরিপদ সেন।

নিরাপদ সেন কোথায় ছিল তখন?

শিলিগুড়িতে।

সে আপনাদের কিছু বলেনি?

না। তবে হরিপদ খুব বাগড়া দিচ্ছিল, অথচ ওর কোনও রাইট নেই। কালাপাহাড়ের সম্পত্তির ওপর। সেটা আছে নিরাপদর।

কেন? হরিপদর দাদু তাঁকে অধিকার দিয়েছেন।

মিথ্যে কথা। হরিপদর যিনি দাদু তিনি নিরাপদরও দাদু। তিনি আমাদের এই জায়গার কথা বলেন, হরিপদকে বলেননি।

আপনারা বলছেন এই জায়গার কথা তিনি জানতেন?

হ্যাঁ। কারণ তিনি নিজে এসে কয়েকবার খুঁজে গিয়েছেন, পাননি। ওঁর বাবাও এসেছিলেন। নন্দলাল সেনের প্রতিটি বংশধর এসে ফিরে গিয়েছে বিফল হয়ে। এবার আমরা তাই তৈরি হয়ে এসেছিলাম।

আপনারা কিছু পাননি?

না। কারণ কিছুই ছিল না এখানে।

মানে?

গতরাতে আমরা আবিষ্কার করি সম্পদ এখানে নেই! দশটা লোহার বাক্স পাওয়া গিয়েছে ওই খাদে। ভাঙাচোরা, মাটিতে পোঁতা ছিল কয়েকশো বছর ধরে। নিরাপদর ঠাকুরদা লোহার বাক্সের কথা বলেছিলেন।

কে নিয়েছে সম্পদগুলো?

নিরাপদ বলছে স্বয়ং কালাপাহাড় নিয়ে গেছে। পুরীতে নন্দলাল সেন উধাও হয়ে যাওয়ার পর লোকটা বোধহয় সন্দেহ করেছিল।

এর কোনও প্রমাণ আছে?

না, নেই। তবে লোহার বাক্সগুলো দেখলে বোঝা যায় ওগুলো কয়েকশো বছর মাটির নীচে পোঁতা ছিল।

ওই জায়গাটা আপনারা খুঁড়লেন কী করে?

কাগজে লেখা ছিল, দুর্ভেদ্য জঙ্গল, বিশাল বিল, শিবমন্দির, মন্দির থেকে কুড়ি হাত দূরে বিলের ভেতরে ড়ুবতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে আমরা কোথায় বিল ছিল জেনেছি।

অমল সোম অর্জুনের দিকে তাকালেন। হরিপদ সেন যে কাগজ দিয়েছিলেন তাতে শেষ লাইনটা ছিল না। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, হৈমন্তীপুর বাগানে এমন ত্রাস কেন সৃষ্টি করলেন। এত খুন কেন করতে হল?

ওটা নিরাপদর প্ল্যান। ও বাগানটাকে কিনতে চেয়েছিল কাজের সুবিধা হবে বলে। মিসেস দত্ত বিক্রি করতে চাননি। বাগান চালু থাকলে এত নিঃশব্দে কাজ করা যেত না। কিন্তু কোনও লাভ হল না। লোকটা নিশ্বাস

ফেলল।

আপনার নাম কী?

শরৎচন্দ্র রায়।

আপনার?

গৌরাঙ্গ দাস।

নিবাস?

পুরী।

ঠিক এই সময় মন্দিরের ভেতরের সেপাইরা চিৎকার করে উঠল। অর্জুন ছুটল। আর তারপরেই গুলির শব্দ। মন্দিরে ঢুকে অর্জুন দেখল, প্ল্যাটফর্মটা খাড়া হয়ে আছে আর সেখান থেকে গলগল করে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সেপাইরা নাক চাপা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। বাইরে এসে জিজ্ঞেস করতে জানা গেল একজন নীচ থেকে ওপরে আসতে চাইছিল। কিন্তু চিৎকার করতেই সে আবার নীচে নেমে গিয়েছে এবং তারপরেই গুলির শব্দটা ভেসে আসে।

ঘণ্টাখানেক বাদে ধোঁয়া বন্ধ হলে সেপাইরা নিরাপদ সেনের মৃতদেহ নীচে থেকে তুলে নিয়ে এল। অত্যন্ত সম্রান্ত চেহারা। নিজের মাথায় নিজেই গুলি করেছেন তিনি।

অমল সোম অপেক্ষা করতে চাইলেন। নদী পার হয়ে গেলে বেশি হাঁটতে হবে বলে আবার জঙ্গল-পথ ধরতে চাইলেন না। কিন্তু ভানু ব্যানার্জি কষ্টটা করতে দিলেন না। তিনি এর মধ্যে নিরাপদের জিপ আবিষ্কার করে ফেলেছেন। জঙ্গলের আড়ালে সেটা লুকানো ছিল। ডি.এফ. ও. এবং এস.পি. সাহেব বন্দি এবং মৃতদের ব্যবস্থা করতে থেকে গেলেন পেছনে।

সুভাষিণী চা বাগানে যাওয়ার পথে জিপটা চালাচ্ছিলেন ভানু ব্যানার্জি। অমল সোম চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন। হঠাৎ ভানু ব্যানার্জি বলে উঠলেন, এত করে কী লাভ হলো?

চোখ বন্ধ অবস্থায় অমল সোম বললেন, যারা করে তারা এটা বুঝতে চায় না। এটাই ঘটনা। কিন্তু আ িভাবছি অন্য কথা।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কী?

হরিপদ সেন আমাকেও বিশ্বাস করেননি। উনি চোরের ওপর বাটপাড়ি করতে এসেছিলেন। আসল বাটপাড়ি কে করেছে বুঝতে পারছ?

ভানু ব্যানার্জি বললেন, নিরাপদ সেন?

না। কালাপাহাড়। লোকটা কাউকেই বিশ্বাস করত না। এই বেচারারা কয়েকশো বছর ধরে সেটাই বুঝতে পারেনি। অমল সোম আবার চুপ করে গেলেন। তাঁর চোখ বন্ধ। অর্জুন দেখল নীলগিরির জঙ্গল ক্রমশ পেছনে চলে যাচ্ছে।