১২. এখন মধ্যরাত

এখন মধ্যরাত। অন্ধকারে ড়ুবে থাকা অকেজো এই চা বাগানের শেডট্রিগুলো থেকে মাঝে-মাঝেই অদ্ভুত ডাক ভেসে আসছে। কৃষ্ণপক্ষের এমন রাতেও সব শান্ত হয়ে গেলে আকাশ থেকে একরকম মায়াবী আলো চুপিসারে নেমে আসে পৃথিবীতে। ঘন চায়ের লিকারে আধা চামচ দুধের মতো মিলে যায় সবার অজান্তে। দোতলার জানলায় বসে অর্জুন এইরকম দৃশ্যাবলী দেখে যাচ্ছিল। এই ঘরের একমাত্র খাটে পা ছড়িয়ে শুয়ে মেজর সশব্দে ঘুমোচ্ছিলেন। আজ রাত্রে তাঁর এখানে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না। প্রতিবাদে কাজ না হওয়ায় বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে বসেছিলেন, খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে ভাববেন, একবার ডাকলেই উঠে পড়তে দেরি করবেন না। অর্জুনের মনে হল বাইরের পৃথিবীর সব শান্তি একা মেজরই ধ্বংস করতে পারেন। একসময় অর্জুন আর পারল না জানলা ছেড়ে এসে মেজরকে জাগাতে হল। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে মেজর বিস্ফারিত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। অর্জুন বলল, আপনার নাক থেকে এমন শব্দ বেরোচ্ছে যে, পাশে বসে থাকা যাচ্ছে না।

তোমাকে বসে থাকতে কে বলেছে? রাগী গলা মেজরের।

অর্জুন কাঁধ ঝাঁকাল, আপনি বলেছিলেন নাক না ডাকার কি একটা প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছিলেন, সেটা কাজে লাগাতে পারলে ঘুমোন, নইলে প্লিজ, জেগে থাকুন। এরকম গর্জন শুনলে সিকি মাইলের মধ্যে কোনও লোক আসবে না।

ঘরের কোণে একটা ছোট্ট ডিমবাতি জ্বলছিল। মেজর খাট থেকে নেমে সংলগ্ন টয়লেটে ঢুকলেন। জলের শব্দ হল। তারপর বেরিয়ে এসে বললেন, দ্যাখো অর্জুন, যে ব্যাপারে মানুষের কোনও হাত নেই সেই ব্যাপারে তাকে দায়ী করা উচিত নয়। একজন চোখে দেখতে পান না, একজন হাঁটতে পারেন না ভাল করে। এমন মানুষকে ভাল বাংলায় কী বলা হয়ে থাকে?

প্রতিবন্ধী।

গুড। আমিও তাই। খন ঘুমিয়ে পড়ি তখন আমার শরীর থেকে যে শব্দ বের হয় তার জন্য এই আমি কি দায়ী?

তাহলে নাক ডাকা বন্ধ করার কোনও কৌশল আপনি জানেন না?

জানি। কিন্তু এক কৌশলে দুদিন কাজ দেয় না।

অর্জুন হেসে ফেলল। তারপর জানলায় ফিরে গেল। মেজর বললেন, আমি তোমার মতলব কিছুই বুঝতে পারছি না। মিসেস দত্তকে নিয়ে ওরা সবাই চলে গেল আর তুমি কেন জিদ ধরলে আজকের রাতটা এখানে থেকে যেতে?

অর্জুন-চাপা গলায় বলল, অসুবিধা কী? আপনার খাওয়া হয়ে গেছে, বাংলোর ভেতরটাও বেশ আরামদায়ক।

আর আমাদের সঙ্গে তো কোনও অস্ত্র নেই।

একজন মহিলাকে যারা আক্রমণ করতে এসেছিল তারা দুজন পুরুষকে ভয় পাবেই।

ওই আনন্দে থাক। যে দারোয়ানুটাকে ওরা খুন করেছে সে যেন পুরুষ ছিল না। তাছাড়া তুমি যখন এই কেস নিচ্ছ তা তখন খামোকা থেকে যাওয়ার কী দরকার ছিল। মিস্টার ভানু ব্যানার্জির সঙ্গে চলে গেলেই হত। এত অনিচ্ছা সত্ত্বেও মিসেস দত্তও শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন। মেজর আরও কথা বলতেন কিন্তু তিনি অর্জুনকে নিঃশব্দে হাত তুলে ইশারা করতে দেখলেন। তাঁর রোমাঞ্চ হল। চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কেউ আসছে নাকি?

অর্জুন হাত নামিয়ে নিল, জবাব দিল না। মেজর ধৈর্য ধরতে পারলেন। যতটা সম্ভব নিঃশব্দে অর্জুনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ডিমবাতির আলোয় চোখ অভ্যস্ত থাকায় প্রথমে কিছুই ঠাওর করতে পারলেন না। বাইরেটা ঘন অন্ধকার মনে হল তাঁর হতাশ হয়ে আবার ফিরে গেলেন ঘরের মাঝখানে। বিড়বিড় করে বললেন, নিজেকে কেমন বন্দি বন্দি মনে হচ্ছে।

আকাশি আলোয় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া চোখে অর্জুন ছায়ামূর্তিটাকে দেখতে পেল। গেটের ওপাশে ঝুঁকে পড়ে কিছু করছে। তারপরেই নজরে এল, একজন নয়, আরও সঙ্গী আছে। এরা সবাই খুব নিষ্ঠার সঙ্গে ওখানে কিছু করছে। মাঝে-মাঝে পাশের জঙ্গলে ঢুকে যাচ্ছে লোকগুলো। জঙ্গলে ঢুকতেই সরু আলো জ্বলতে দেখল অর্জুন। ওরা টর্চ জ্বেলে কিছু খুঁজছে।

অর্জুন নিঃশব্দে জানালা ছেড়ে চলে এল। মেজর পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর সামনে এসে নিচু গলায় বলল, আপনি ফোর্ট সামলান। আমি একটু ঘুরে আসছি। যদি কাল সকালের মধ্যে না ফিরি তাহলে অমলদাকে খবর দেবেন।

তোমাকে একা ছাড়ব ভেবেছ? আমি কি এমনি এমনি রয়ে গেছি?

না। আপনার যাওয়া চলবে না। দুজনের কিছু হলে সারা পৃথিবী জানতে পারবে না!

মাই গড। তা হলে তোমার যাওয়ার দরকার কী? এই কেস তো তুমি নিচ্ছ না।

অর্জুন কোনও উত্তর না দিয়ে নীচে নেমে এল। মিসেস দত্তের কাজের মানুষ দুজন বাংলোর একতলাতেই শুয়ে আছে। বেরতে হলে দরজা বন্ধ করার জন্য ওদের ডাকা দরকার। কিন্তু শব্দ করার ঝুঁকি নিল না অর্জুন। পেছনের দরজা খুলে সে নিঃশব্দে বাইরে বেরিয়ে এল। দরজাটাকে যতটা সম্ভব চেপে বন্ধ করার চেষ্টা করল।

আকাশ নীল। প্রচুর তারা সেখানে। তাদের শরীর থেকে আলো চুইয়ে আসছে। অর্জুন পেছনের বাউন্ডারি ডিঙিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল। হঠাৎই একটা হতচ্ছাড়া প্যাঁচা চিৎকার করে মাথার ওপরের ডাল থেকে ডানা ঝাপটে উড়ে গেল। মিনিটখানেক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে জঙ্গল ছেড়ে চা-বাগানের গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল অর্জুন। গুড়ি মেরে সে অনেকটা ঘুরে বাংলোর গেটের দিকটায় চলে এল। কান পাতল। কোনও কথা শোনা যাচ্ছে না। সে আর একটু এগোতেই গাছের ডালে আঘাত পেল। সামান্য শব্দ হল, কিন্তু সেই সময় কাছেপিঠে একটা শেয়াল গলা ছেড়ে ডেকে উঠতেই শব্দটা চাপা পড়ে গেল। অর্জুন নিজের কাঁধে হাত বোলাল। আর তখনই পাতা মাড়াবার আওয়াজ কানে এল। কেউ খুব কাছাকাছি হাঁটছে। সে চা-গাছের মধ্যে হাঁটু মুড়ে বসে রইল। গাছের তলার ফাঁক দিয়ে হাত পাঁচেক দূরে সরু টর্চের আলো পড়তে দেখল সে। আলোটা ইতস্তত ঘুরে যেখানে স্থির হল সেখানে একটা ছোট্ট পাতাওয়ালা আগাছা লাল হয়ে আছে। তারপরেই একটা হাত সেই আগাছাটাকে মাটিসুদ্ধ উপড়ে নিল। আলো নিভে গেল এবং আওয়াজ ফিরে গেল যেদিক থেকে এসেছিল।

ব্যাপারটা স্পষ্ট হল। ওরা ফিরে এসেছে রক্তের নাম করে যা ছড়িয়েছিল তার চিহ্ন মুছে ফেলতে। অর্থাৎ অত্যন্ত সাবধানী মানুষের বুদ্ধি ওদের নিয়ন্ত্রিত করছে। চা-বাগানের গলিতে হাঁটলেই পাতা মাড়াবার শব্দ হবেই। অর্জুন প্রায় বুকে হেঁটে বাগানের ভেতর দিয়ে এগোতে লাগল। হাতকুড়ি যাওয়ার পর সে লোকগুলোকে দেখতে পেল। মোট চারজন। একজনের হাতে একটা ব্যাগ। নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় কিছু বলল। তারপরই একজন একটা ছোট পাথর কুড়িয়ে নিয়ে প্রচণ্ড জোরে বাংলোর দিকে ছুঁড়ে মারল। পাথরটা দোতলার জানালার কাচে লাগতেই সেটা ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল এবং তার সঙ্গে সঙ্গে মেজরের আকাশ ফাটানো চিৎকার ভেসে এল, কে? কে ছোঁড়ে ঢিল? ঢিল ছুঁড়লে পাটকেল খেতে হয় তা জানিস? মেরে একেবারে হুতুম প্যাঁচা করে দেব শয়তানের নাতিদের। বদমাশ, মস্তানি হচ্ছে আমার সঙ্গে? সাহস থাকে তো সামনাসামনি এসে লড়।

চ্যাঁচামেচি চলছিল বটে কি স্বরের ভেতর যে ভয়ার্ত ভাব, তা অর্জুনের কান এড়িয়ে যাচ্ছিল না। লোকগুলো চাপা গলায় হেসে উঠল। একজন হিন্দিতে বলল, ওরা আজ বাংলো ছেড়ে বের হবে না। চল।

হেলতে-দুলতে ওরা হাঁটা শুরু করল। এখন আর জঙ্গুলে পথে নয়, চওড়া যে রাস্তা হাইওয়ে থেকে ভাঙা সাঁকো পেরিয়ে বাংলোয় পৌঁছেছে সেটি ধরে ওরা হাঁটতে লাগল। এই রাস্তা ধরে ওদের অনুসরণ করা বিপজ্জনক। অন্ধকারে চোখ অভ্যস্ত থাকলে পেছন ফিরলেই ওরা তাকে দেখতে পাবে। কিন্তু পাশের চা বাগান এত ঘন যে, ওদের সঙ্গে তাল রাখা যাবে না সেখান। দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করলে। বাধ্য হয়ে অর্জুন ঝুঁকি নিল। ওদের বেশ কিছুটা। এগিয়ে যেতে দিয়ে ও নিঃশব্দে অনুসরণ শুরু করল। যেহেতু নিশ্চিন্ত হয়ে পড়ায় লোকগুলো নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে হাঁটছিল তাই ওদের ঠাওর পেতে অসুবিধে হচ্ছিল না অর্জুনের।

এক সময় ওরা রাস্তা ছেড়ে চা বাগানের মধ্যে নামল। সুবিধে হল অর্জুনের। সে সঙ্গে সঙ্গে ওদের সমান্তরাল আর-একটি গলিতে নেমে পড়ল। এদিকে চা-গাছ অব্যবহারে বেশ লম্বা হয়ে গিয়েছে। ফলে চমৎকার একটা আড়াল পেয়ে যাচ্ছে সে। ওরা এই পথে কোথায় যাচ্ছে? অর্জুন খুব। কৌতূহলী হয়ে পড়ছিল।

মিনিট দশেক সতর্ক হাঁটার পরে ওরা একটা হাঁটু-জলের নদীর ধারে পৌঁছে গেল। পাহাড়ী নদী।.জলে স্রোত আছে। অর্জুন দেখল ওদের একজন ব্যাগ উপুড় করে সংগৃহীত পাতা-ঘাস জলের স্রোতে ফেলে দিল। রক্তের সব চিহ্ন জল গ্রাস করে নিল তৎক্ষণাৎ।

চা বাগানের শেষ এখানেই, এই নদীর পারে। ওপারে জঙ্গলের শুরু। লোকগুলোকে নদীর পাড় ধরে এবার নীচে এগোতে দেখা গেল। এবার ওদের অনুসরণ করতে হলে নদীর গায়ে ফাঁকা জায়গায় আসতেই হবে। ভোর হতে এখনও বেশ দেরি, অন্ধকারের আড়ালে যতটা সম্ভব এগিয়ে যেতে লাগল অর্জুন। ব্যবধান যা, তাতে ওরা ঘাড় ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে না থাকলে তাকে দেখতে পাবে না! অসতর্ক মানুষ তার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া অনেক দৃশ্য দেখতে পায় না। এক্ষেত্রে ওরা তো কাজ সফলের আনন্দে বিভোর।

এবার নদী একটু সঙ্কীর্ণ এবং তার ওপরে বাঁশের সাঁকো দেখা গেল। সেই সাঁকো বেয়ে লোকগুলো ওপারের জঙ্গলে ঢুকে গেল। এখানে জল বেশি নয়। যদি সাঁকোর ওপরে কেউ এদের অপেক্ষায় থাকে তাহলে সহজেই সাঁকোয় উঠলে তাকে দেখতে পাবে। এমনও হতে পারে লোকগুলো অনুমান করেছে কেউ পেছনে আছে তাই সাঁকোয় ওঠার জন্য অপেক্ষা করছে। সে ঝুঁকি না নিয়ে জলে নামল। গুটিয়ে নেওয়ায় প্যান্টের প্রান্ত হাঁটু পর্যন্ত থাকলেও জল মাঝে-মাঝেই স্পর্শ করতে লাগল। জুতো ভিজছে কিন্তু কিছু করার নেই। নদীটা পেরিয়ে সে জঙ্গলে এসে দাঁড়াল। লোকগুলো ঢুকেছে হাত কুড়ি তফাত দিয়ে। তাদের কোনও অস্তিত্ব এখন নেই। এদিকের জঙ্গল বেশ গভীর এবং হাঁটার পক্ষে নিতান্তই খারাপ।

মিনিট দশেক অন্ধকারে হাতড়ে শেষ পর্যন্ত একটা পায়ে-চলা পথ পেল অর্জুন। সে অনুমান করল এই পথেই লোকগুলো এগিয়েছে। এই জঙ্গল অবশ্যই নীলগিরি ফরেস্টের একটা অংশ। হিংস্র জন্তুজানোয়ারের কথা প্রায়ই শোনা যায় এই জঙ্গলে। একেবারে খালি হাতে এখোন ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু মনে হচ্ছে মানুষ এখানে নিয়মিত যাওয়া-আসা করে। হিংস্র মানুষের চেয়ে কোনও জন্তু হিংস্রতর হতে পারে না।

হঠাৎ চোখে আলো এল। অর্জুন পথ ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকল। মিনিট তিনেক চলার পর একটা ভোলা চত্বর নজরে এল। জঙ্গলের মধ্যে তাঁবু, তাঁবুর বাইরে কারবাইডের গ্যাসের আলো জ্বলছে গোটা চারেক। পাতার আড়ালে দাঁড়িয়ে

সে লক্ষ করল পাশাপাশি আরও গোটা তিনেক ছোট তাঁবু আছে।

মূল তাঁবু থেকে কয়েকজন বেরিয়ে এলযে লোকগুলোকে সে অনুসরণ করে এখানে পৌঁছেছে তাদের দেখতে পাওয়া গেল। খুব বিনীত ভঙ্গিতে কথা শুনছে। তাঁবু থেকে বের হওয়া নতুন দুজন মানুষ ওদের পিঠ চাপড়াল। এবার কাজ সেরে আসা লোকগুলো ছোট তাঁবুর দিকে চলে গেল। অর্জুন দেখল দুজন কর্তাব্যক্তি নিজেদের মধ্যে কথা বলে আবার তাঁবুর ভেতর ফিরে গেল। এবার সব শান্ত। শুধু গ্যাসের আলো দপদপ করে জ্বলছে। কোথাও কোনও পাহারাদার আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। না থাকাটাই অস্বাভাবিক। যারা এত পরিকল্পনামাফিক কাজ করছে তারা নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভাববে না এমন হতেই পারে না। আর এগিয়ে যাওয়া বোকামি হবে, অর্জুন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল। মচমচ শব্দ হচ্ছে শুকনো পাতায় পা পড়ায়, মাঝে মাঝেই সে থেমে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা চিৎকার ভেসে এল। জন্তুজানোয়ার তাড়ানোর জন্য মানুষ ওই গলায় আওয়াজ করে। যতটা সম্ভব দূরত্ব রেখে খোলা চত্বরটাকে ঘুরে দেখল অর্জুন। জঙ্গলের মাঝখানে চমৎকার জায়গা বেছেছে এরা। ইতিমধ্যে নদীর দিকের পথ দিয়ে আরও চারজন লোক এসেছে। তারা বড় তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে সাহেব বলে ডাকার পর একজন কর্তা বেরিয়ে এসেছে। অর্জুন শুনল লোকটা রিপোর্ট করছে ডেডবডিটাকে নদীর জলে চুবিয়ে ভাল করে পাথর দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। ভেসে যাওয়ার কোনও চান্স নেই।

কতটির গলার স্বর জড়ান। অদ্ভুত হিন্দি উচ্চারণে লোকটা বলল খুব ভাল কাজ হয়েছে, কিন্তু তোমাদের এখানে এখন কে আসতে বলেছে। যে জায়গায় ডিউটি দেওয়া হয়েছে সেখানে ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।

সাহেব, এখন বাগানে কোনও মানুষ নেই। পুলিশ চলে গিয়েছে অনেকক্ষণ। ভয়ে কেউ বা নে ঢুকবে না, তাই ভাবলাম খবরটা দিয়ে আসি।

তোমাদের কিছু ভাবতে হবে না। যা ভাববার আমরা ভাবব। যাও। কর্তা আবার তাঁবুর ভেতর ঢুকে গেল। অর্জুনের মনে হল লোকগুলো এমন ব্যবহার আশা করেনি। তাঁবুর কাছ থেকে কিছুটা সরে এসে তারা একটু গজরাল, তারপর নদীর দিকে চলে গেল।

এবার ফেরা উচিত। ভোর হতে মাত্র ঘণ্টা দেড়েক বাকি আছে। ভানু ব্যানার্জি অনেক করে বলেছিলেন মিসেস দত্তের সঙ্গে বাগান থেকে চলে যেতে। না গিয়ে ভাল লাভ হল। অন্তত দরোয়ানের মৃতদেহের হদিস আর তাঁবুগুলোর অস্তিত্ব অজানা থাকত তা হলে। অর্জুন ডালপালা সরিয়ে হাঁটতে লাগল। তাঁবু ছেড়ে কিছুক্ষণ হাঁটার পর তার মনে হল সে দিক ভুল করেছে। নদীর দিকে যাওয়ার বদলে সে উল্টো দিকে চলে এসেছে। এখানে গাছের তলায় আগাছা বেশি। সে যত হাঁটছে তত ওপরের ডালে বসা বানরেরা হইচই শুরু করে দিয়েছে। এবং তখনই সে টিন পেটানোর শব্দ শুনতে পেল। দু-তিনটে টিন একসঙ্গে পেটানো হচ্ছে।

এই ঘন জঙ্গলে মানুষ টিন পেটায় জন্তুজানোয়ার তাড়াতে। কিন্তু এত গভীরে এই অসময়ে মানুষ কী করছে? জঙ্গলে যারা চুরি করে কাঠ কাটতে আসে তারা নিজেদের অস্তিত্ব এভাবে জানাবে না। চোরা শিকারীরাও নিঃশব্দে থাকে। মাথার ওপর ঘুম-ভাঙা বানরের দল কিছুতেই শান্ত হচ্ছিল না। অর্জুন তাদের এড়াতেই টিনের শব্দ লক্ষ করে এগোল। খুঁটিমারি রেঞ্জে থাকার সময় সে জেনেছিল বাঘজাতীয় হিংস্র পশু এলে বানরেরা এভাবে সারা জঙ্গলকে জানিয়ে দেয়। বানরের চিৎকারে পাখিদেরও ঘুম ভেঙেছে। মুহূর্তেই সমস্ত নৈঃশব্দ্য ভেঙে বাজার হয়ে গেল জঙ্গলটা। অর্জুন অসহায়ের মূতো তাকাল। সে বুঝতে পারল, যারা টিন পেটাচ্ছে তারা বানরের চিৎকার শুনে ভুল করছে। জায়গাটা ছেড়ে যাওয়ার জন্য সে দ্রুত পা চালাল। বানরগুলো পেছন ছাড়ছে না। এ-ডাল থেকে আর এক ডাল অন্ধকারেই লাফাতে লাগল তারা। অর্জুন টিনের আওয়াজ যেখানে হচ্ছে সেখানে পৌঁছে যেতেই গুলির শব্দ শুনল। আকাশ কাঁপিয়ে সেই শব্দ জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়তেই সব চিঙ্কার আচমকা থেমে গেল।

একটা মানুষের হাসি শোনা গেল। সে হিন্দিতে বলল, টিন পেটালে আজকাল কাজ হয় না। শেরগুলো সব চালাক হয়ে গেছে। গুলির আওয়াজে এবার ভাগবে।

দ্বিতীয় গলা প্রতিবাদ করল, সাহেব গুলি ছুঁড়তে মানা করেছিল কিন্তু?

বাঘ খেয়ে গেলে সাহেব আমাদের বাঁচাবে? যা শুয়ে পড়, এখন আর কোনও ভয় নেই। আমি জেগে আছি।

অর্জুন আর-একটু এগোল। তারপরেই তার চোখের সামনে এই অন্ধকারেও দৃশ্যটি অস্পষ্ট ভেসে উঠল। অনেকটা জঙ্গল পরিষ্কার করে মাটি খোঁড়া হচ্ছে। প্রায় পুকুরের আদল নিয়ে নিয়েছে জায়গাটা। পুকুরের গায়ে তাঁবু পড়েছে। মনে হচ্ছে শ্রমিকরা সেখানেই রাত্রে থাকে। একটি লোককে বন্দুক হাতে তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। অন্ধকারে তার নাক-চোখ বোঝা যাচ্ছে না।

অর্জুনের চোয়াল শক্ত হল। তাহলে ব্যাপারটা এই। আসল কাজটি হচ্ছে এখানে। এবং বোঝাই যাচ্ছে কাজটি এখনও সফল হয়নি। কিন্তু চারপাশে নেহাতই জঙ্গল, গভীর জঙ্গল। লোকগুলো মাটি খুঁড়ে করছেটা কী?

ধীরে ধীরে সে সরে এল। অনেকটা ঘুরে শেষ পর্যন্ত এক কোমর জল পেরিয়ে সে চাবাগানে পৌঁছল যখন, সুর্যদেব তখন জঙ্গলের মাথায় উঠে বসেছেন। বাংলোয় পৌঁছতে কোনও বাধা পাওয়া গেল না। গেট খুলে ভেতরে ঢোকার সময় সে ভটভটির আওয়াজ শুনতে পেল। আড়াল খুঁজতে যাওয়ার মুখে সে মোটরবাইকে বসা ভানু ব্যানার্জিকে দেখতে পেল। ভানুবাবু হাত তুললেন। তারপর কাছে এসে বাইক থামিয়ে সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন, এ কী অবস্থা? প্যান্ট ভিজে কেন? কোথায় গিয়েছিলে?।

অর্জুন বলল, তার আগে আপনি বলুন হঠাৎ এত ভোরে ফিরে এলেন কেন?

অস্বস্তিতে। তোমাদের এখানে ফেলে রেখে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না।

কোনও সমস্যা হয়নি তো?

সমস্যা নয়, সমাধানের দিকে একটু এগোন গিয়েছে।

হঠাৎ ভানু ব্যানার্জি চিৎকার করে থামতে বললেন তাকে। বাইক থেকে নেমে এসে ঝুঁকে পড়ে ভানু ব্যানার্জি অর্জুনের পা থেকে টেনে-টেনে যেগুলো ফেলতে লাগলেন সেগুলো ফুলে-ফেঁপে ঢোল হয়ে আছে। অর্জুন জোঁকগুলো দেখল। অনেক রক্ত খেয়ে গেছে অসাড় করে। ভানু ব্যানার্জির জুতোর চাপেও মরছে না। ওদের জন্য নুন দরকার।