০৪. জলপাইগুড়িতে ফিরতে সন্ধে

কাল জলপাইগুড়িতে ফিরতে সন্ধে পেরিয়ে গিয়েছিল। জল্পেশ্বর মন্দির দেখে ত্রিদিববাবু গিয়েছিলেন জটিলেশ্বর মন্দির দেখতে। ফলে দেরি হয়ে গেল বেশ। জটিলেশ্বর জল্পেশ মন্দির থেকে মাত্র চার মাইল দূরে। অথচ এর কথা শহরে এসে তেমন শোনা যায় না। শহরে ফিরে আসার সময় ত্রিদিববাবু বললেন, জল্পেশ মন্দিরের আকৃতি নিশ্চয়ই পরবর্তীকালে কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। দেখেছেন, মুসলিম সংস্কৃতির ছাপ রয়েছে ওর নির্মাণে। অথচ মূল মন্দিরের কাছে বাসুদেব মূর্তি বা ক্ষয়ে যাওয়া গণেশ মূর্তি দেখলে বোঝা যায় পালবংশের সময়েই মন্দির তৈরি। তখন তো মুসলিম সংস্কৃতি এ-দেশে আসেনি।

অর্জুন কানখাড়া রেখেছিল। কালাপাহাড় এই মন্দিরের ক্ষতি করার পর যখন সংস্কার করা হয়েছিল তখনই কি ওই পরিবর্তন এসেছিল? ত্রিদিববাবুকে সেকথা বলতে তিনি বললেন, এ ব্যাপারে তাঁর কিছু জানা নেই।

রাত হয়ে গিয়েছিল বলেই সে অমলদার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। বাড়ি ফিরে দেখল বাইরের ঘরে আলো জ্বলছে। রাস্তা থেকেই দেখল কেউ একজন বসে আছেন। এখন মাঝে-মাঝেই তার কাছে মানুষজন সমস্যা নিয়ে আসেন। মা তাঁদের বসতে বলেন তার ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকলে। দরজায় দাঁড়াতেই সে এক ভদ্রমহিলাকে দেখতে পেল। চল্লিশের কোঠায় বয়স, শরীর একটু ভারী হলেও সুন্দরী না বলে পারা যায় না। জামাকাপড়ে এবং ভঙ্গিতে বেশ পয়সাওয়ালা ঘরের মহিলা বলেই মনে হয়।

ভদ্রমহিলা বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি অর্জুনবাবু?

হ্যাঁ। কাঠের টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ারটায় বসল সে।

ও। আমি এক্সপেক্ট করিনি আপনি এত অল্পবয়সী।

বলুন, কেন এসেছেন?

আমি মিস্টার অমল সোমের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। প্রায় ঘন্টাদেড়েক অপেক্ষা করছি।

আপনার সমস্যা কী?

হৈমন্তীপুর চা বাগানটা আমাদের। আমার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়ার পরে বাগানে খুব গোলমাল হয়েছিল। শ্রমিক বিক্ষোভ, মারামারি। তখন বাগান বন্ধ করে দিতে হয়। এর পরে আমার স্বামী মারা যান। সমস্তটা বুঝে নিতে আমার সময় লাগে। তারপর সরকার এবং ইউনিয়নের সঙ্গে অনেক কথা বলে আমি বাগান খুলেছিলাম। অনেকদিন বন্ধ থাকায় লেবাররা কাজের জন্য অন্য জায়গায় চলে গিয়েছিল। তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছিল। কিন্তু এই সময় বাগানে নানারকম রহস্যময় ঘটনা ঘটতে লাগল।

কীবকম ঘটনা?

আমার বাগানের পাশে নীলগিরি ফরেস্ট। খুব গভীর জঙ্গল। কুলি লাইন ওদিকেই। কাজের জন্য যখন কুলিরা ফিরে আসছে তখন পর-পর তিন রাত্রে তিনজন খুন হয়ে গেল। কে খুন করেছে, কেন করেছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

পুলিশের বক্তব্য কী?

পুলিশ! কোনও কুলই পাচ্ছে না তারা। অথচ আমার বাগানে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যারা এসেছিল তাদের অনেকেই আমার বাগান ছেড়েছে। নতুন কাজের লোকের আসার সম্ভাবনা নেই। এমন চললে আমাকে বাধ্য হয়ে বাগান বিক্রি করে দিতে হবে। কিন্তু আমি সেটা চাইছি না। আমার স্বামীর পূর্বপুরুষেরা ওই বাগান তৈরি করেন। বুঝতেই পারছেন।

আপনার নাম?

মমতা দত্ত।

অমলদাকে ঘটনাটা বলেছেন?

হ্যাঁ। উনি বললেন অন্য একটি কেস নিয়ে ব্যস্ত আছেন। আপনাকে পুরো ব্যাপারটা জানাতে। পুলিশের ওপর আমি পুরো ভরসা করতে পারছি না।

হৈমন্তীপুর চা-বাগানটা ঠিক কোথায়?

হাসিমারার কাছে।

দেখুন, এখনই আমি কিছু বলতে পারছি না আপনাকে। আগামিকাল সকালে একটা কেস নিয়ে আলোচনা আছে। সেটা যদি না নেওয়া হয় তা হলে অবশ্যই আপনার ব্যাপারটা দেখব। কিন্তু ওই কেস নেওয়া হলে একদম সময় পাব না।

মমতা দেবী খুবই বিমর্ষ হলেন। তিনি জানালেন, তাঁর টেলিফোন এখনও চালু আছে এবং খবর যা হোক, তা অর্জুন কাল দুপুরের মধ্যেই জানিয়ে দেবে। অর্জুন অবাক হয়ে শুনল ভদ্রমহিলা গাড়ি নিয়ে বাগান থেকে বেরিয়ে মাঝপথে বাসে চেপে জলপাইগুড়িতে এসেছেন, যাতে কেউ যদি অনুসরণ করতে চায় তা হলে বিভ্রান্ত হবে। আজ রাত্রে এখানে এক আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে কাল সকালে ট্যাক্সি নিয়ে ফিরে যাবেন। তাঁর ধারণা প্রতিপক্ষ সবসময় নজর রাখছে। অর্জুন তাঁকে মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে রিকশার ব্যবস্থা করল। ভদ্রমহিলা যাওয়ার আগে বারংবার অনুরোধ করলেন তাঁকে সাহায্য করতে।

রাত্রে বিছানায় শুয়ে অর্জুনের মনে হল অতীতের পেছনে না ছুটে বর্তমানের সমস্যা সমাধান করা অনেক বেশি উত্তেজনাপূর্ণ ব্যাপার। কবে কখন কোথায় কালাপাহাড় তার লুটের সোনাদানা লুকিয়ে রেখেছে এবং সেটা উদ্ধার করে হরিপদ সেনকে তুলে দিতে হবে—এমন অসম্ভব ব্যাপার নিশ্চয়ই অমলদা করতে চাইবেন না। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে অমলদা ভদ্রলোকের কাছে অ্যাডভান্স নিয়ে ফেলেছেন। বেশির ভাগ কেসেই এটা উনি করেন না। অ্যাডভান্স নিলে কাজটা করবেন বুঝেই নেন। কালাপাহাড়ের সোনা খোঁজা মানে অন্ধকারে হাতড়ানো। হৈমন্তীপুর চা-বাগানের হত্যা রহস্যের তো একটা মোটিভ দেখা যাচ্ছে। মমতা দেবীকে বাগানছাড়া করা। ওই পথে এগোলে হত্যাকারীদের সন্ধান পেতে তেমন অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। বাগানটা অনেকদিন বন্ধ ছিল। পাশেই নীলগিরি জঙ্গল। কুলিরা যখন আসতে শুরু করল তখন তাদের সংখ্যা নিশ্চয়ই বেশি ছিল না। তাই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে কোনও দল যদি দু-চারজনকে হত্যা করে আবার জঙ্গলে ফিরে যায় তা হলে আতঙ্ক ছড়াতে বেশি দেরি হবে না।

সকালে বাইক চালিয়ে বেশ উত্তেজিত হয়েই অর্জুন অমল সোমের বাড়িতে চলে এল। অমলদা এবং বিষ্টুসাহেব বাগানেই চেয়ার পেতে বসে চা খাচ্ছিলেন। বিষ্ণুসাহেব চিৎকার করে বললেন, সুপ্রভাত। কাল দুপুরের পর আর দর্শন পেলাম না কেন?

ইতিমধ্যে হাবু তৃতীয় চেয়ারটি নিয়ে এল। বসে পড়ল অর্জুন, কাল বিকেলে জল্পেশের মন্দিরে গিয়েছিলাম। আচমকাই।

জল্পেশের মন্দির? আহা, গেলে হত সেখানে। বিষ্টুসাহেব মাথা নাড়লেন।

অমল সোম বললেন, গেলেই হয়। আছেন তো কদিন।

অর্জুন দেখল অমলদা এটুকু বলেই চুপ করে গেলেন। এটাই অস্বস্তিকর। কিন্তু বিষ্ঠুসাহেবই তাঁকে মনে করিয়ে দিলেন, ওই যে, কাল এক ভদ্রমহিলা এসেছিলেন, কোনও চা-বাগানের মালিক যেন…।

অর্জুন দেখল অমলদা তার দিকে তাকিয়ে আছেন। সে বলল, হ্যাঁ, উনি আমার বাড়িতে এসেছিলেন। আপনি কেসটা শুনেছেন অমলদা?

হ্যাঁ। ভদ্রমহিলার দুশ্চিন্তা হওয়া খুবই স্বাভাবিক।

আমরা কি কেসটা নিতে পারি?

সময় পাওয়া যাবে না।

কেন?

তুমি তো জান, আজকাল সাধারণ ঘটনা আমাকে একদম টানে না। বরং ওই হরিপদ সেনের ব্যাপারটা ক্রমশ আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠেছে। ওঁর দেওয়া কাগজপত্তরগুলো পড়লাম। এই কেস নিয়ে কাজ করা যায়।

অর্জুন বলল, ব্যাপারটা কিন্তু খুবই গোলমেলে।

ঠিকই। তাই আমাকে টানছে। অর্জুন, তুমি কি মনে কর কালাপাহাড়ের মতো একজন ক্ষমতাবান লোক সবাইকে দেখিয়ে একটা জায়গায় মাটি খুঁড়ে সোনা-মুক্তো পুঁতে রাখবে? যখন তার জানাই আছে যুদ্ধের প্রয়োজনে কাশী থেকে কামাখ্যা ঘুরে বেড়াতে হয়? লোকটা নিশ্চয়ই তার নবাবকে লুকিয়ে ওগুলো সরাতে চেয়েছে! কালাপাহাড়কে এতটা বোকা আমার কখনওই মনে হয়নি।

অর্জুনের একটু অস্পষ্ট ঠেকল, কিন্তু হরিপদবাবু বলে গেলেন যে নন্দলাল সেন জানতেন কোথায় কালাপাহাড় ওসব লুকিয়েছেন।

কথাটা হরিপদবাবুকে তাঁর ছোটঠাকুদা বলেছেন। তিনিও নিশ্চয়ই তাঁর পূর্বপুরুষদের মুখে শুনে থাকবেন। কথা হল, এতদিন এঁরা চুপ করে বসে ছিলেন কেন? পুরী থেকে অনেক আগেই তো অভিযান করতে পারতেন ওঁরা।

অর্জুনের মনে হল অমলদা ঠিক কথাই বলছেন। বিষ্ণুসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ওই কাগজপত্রে কিছু পেলেন?

হ্যাঁ। সেইটেই ইন্টারেস্টিং। ওগুলো আসলে নন্দলাল সেনের জীবনের বৃত্তান্ত। তাঁর নিজের লেখা নয়। যিনি লিখেছেন তিনি। কণটিকী শব্দ জানেন। ইচ্ছে করেই হয়তো মানেটাকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। কণাটকী আমিও জানি না। যেটুকু বোঝা গেল তাতে নন্দলাল কালাপাহাড়ের পুরী অভিযানের পর একেবারে নিঃশব্দে সরে যান দল থেকে। হয়তো কালাপাহাড়ের অত্যাচার তাঁর আর সহ্য হয়নি। এই দল-ছাড়ার আগে তিনি অনুমতিও নেননি। কালাপাহাড় হয়ত নন্দলালের ওই ধৃষ্টতা মেনে নিত না যদি তাকে জরুরি প্রয়োজনে পুরী থেকে চলে না আসতে হত।

অর্জুন চুপচাপ শুনছিল। এবার জিজ্ঞেস করল, আপনি কালাপাহাড়ের সম্পর্কে সব কিছু জেনেছেন? মানে যেটুকু জানা সম্ভব? অমলদা হাসলেন, খুব বেশি কিছু নয়। তুমি যা জেনেছ, তাই। গতকাল বিকেলে আমরা বেড়াতে-বেড়াতে তোমার মাস্টারমশাই-এর কাছে গিয়ে শুনলাম তুমি আমাদের আগেই পৌঁছে গিয়েছ। ভদ্রলোক সারাজীবন ইতিহাস নিয়ে আছেন, অনেক কিছু জানেন। কিন্তু তাঁর জানাতেও বিস্তর অনুমান আছে।

আপনি কীভাবে কেসটা শুরু করবেন?

এখনও ভাবিনি। কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিং লাগছে।

কালাপাহাড়ের অতীত, মানে জন্মবৃত্তান্ত…!

এইখানে একটা কথা। অমলদা হাত তুলে থামালেন, ধরো, কোনও মানুষ খুন হলেন। অপরাধী কে সেটা আন্দাজ করতে পারছ। কিন্তু তার গতিবিধি জানবার জন্য কি তুমি তার বাল্যকাল হাতড়াবে?।

না, তা নয়। কিন্তু তার অভ্যেস বা সংস্কার জানবার জন্য পেছনের দিকে হয়তো যেতে হতে পারে। আপনি বলছেন কালাপাহাড় কোনও সাক্ষী রেখে ধনসম্পদ লুকিয়ে রাখবে না। তা হলে নন্দলাল সেটা জানলেন কী করে? জানলেও নিজের অংশ নেননি কেন?

দুটো কারণ থাকতে পারে। কালাপাহাড় যে সম্পত্তি পরে ব্যবহার করবে বলে লুকিয়েছিল তা যদি নন্দলালের জানা থাকে তা হলে কালাপাহাড়ের মৃত্যুর পরেই ওঁর মনে হতে পারে এবার ওই সম্পত্তি বেওয়ারিশ, আর কেউ যখন জানে না তখন আমি ভাগ নিই। তা হলে ভাগ কেন? পুরোটাই তো নিতে পারতেন। মুগল ফৌজের তোপে কালীগঙ্গার ধারে কালাপাহাড় মারা যায়। তবু হরিপদবাবুর দেওয়া কাগজপত্রে পাচ্ছি—-নন্দলাল অংশের কথা বলছেন। কালাপাহাড় পুরী আক্রমণ করে ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে। ধরা যাক, তখনই বা তার কিছু পরে নন্দলাল দত্যাগ করেন। এর প্রায় পনেরো বছর পরে কালাপাহাড় মারা যায়। ততদিন নন্দলাল পুরীতেই আত্মগোপন করে থাকতে পারেন। কিন্তু কালাপাহাড় মারা যাওয়ার পরে তো নিজেই যেতে পারতেন ধনসম্পদ উদ্ধার করতে!

অমল সোম চোখ বন্ধ করলেন, নন্দলাল যাননি। হয় তিনি অসুস্থ ছিলেন, নয় অন্য কারণ ছিল। নন্দলালের কথা যিনি লিপিবদ্ধ করেছেন তিনিও অংশের কথাই বলেছেন। তা হলে কি আর কেউ নন্দলালের সঙ্গী ছিল?

বিষ্টুসাহেব মাথা নাড়লেন, বাঃ। চমৎকার। দুটো কারণ বলছিলেন, আর-একটা কী? একটা না হয় অসুস্থতা অথবা অন্য কোনও সঙ্গীর জন্যই যেতে পারেননি ভদ্রলোক।

অমলদা বললেন, দ্বিতীয় কারণ খুব সোজা। কালাপাহাড়ের একার পক্ষে অত ধনসম্পদ লুকোনো সম্ভব ছিল না। সেইজন্য বিশ্বস্ত অনুচর নন্দলালকে সঙ্গে নিয়ে সেটা করেছেন। তারপর হয়তো আশ্বাস দিয়েছিলেন কিছুটা অংশ পরে দেবেন। কিন্তু পুরী আক্রমণের পরে ভদ্রলোকের মনে অনুতাপ আসে। তিনি তাঁর প্রভুর সঙ্গ ত্যাগ করেন। ওরকম মনের অবস্থায় লুণ্ঠিত ধনসম্পত্তি সম্পর্কে মনে ঘৃণা জন্মানো অস্বাভাবিক নয়। তাই তিনি কালাপাহাড় মারা যাওয়ার পরেও উদ্ধারের চেষ্টা করেননি। কিন্তু ঘটনাটা ছেলে বা নাতিকে বলেছিলেন। তাঁরাই লেখার সময় ধনসম্পত্তির উল্লেখ করে নিজেদের অংশ দাবি করে বসে আছে। কিন্তু ততদিনে এ-দেশের রাজনৈতিক চরিত্র ঘন-ঘন বদল হচ্ছে। নন্দলালের বংশধরদের পক্ষে ইচ্ছে থাকলেও উদ্ধার করা সম্ভব ছিল না। আর নন্দলাল তাঁদের বিস্তারিত বলেও যাননি।

এবার অর্জুন জিজ্ঞেস করল, এত বছর পরে আমরা জায়গাটা বের করব কী করে?

অমলদা হাত নেড়ে হাবুকে ডাকলেন। ইশারায় কাপ-প্লেট তুলে নিতে বললেন। তারপর চোখ বন্ধ করলেন, কালাপাহাড় কেন ধনসম্পত্তি লুকিয়েছিল? তার তো প্রচণ্ড প্রতাপ ছিল। নিশ্চয়ই সে চায়নি ওগুলোর কথা অন্য লোক জানুক। এই অন্য লোক সম্ভবত বাংলার নবাব দাউদ খাঁ, কালাপাহাড় যাঁর সেনাপতি। অভিযান করে সেনাপতি যা লুঠ করবে তা অবশ্যই নবাবের প্রাপ্য। যতই প্রতাপশালী সেনাপতি হোক, নবাবের কাছে কালাপাহাড়কে জবাবদিহি করতেই হত। কোনও একটা অভিযান করে রাজধানীতে ফেরার পথে কালাপাহাড় ওগুলো লুকিয়ে রাখে। নন্দলালের বর্ণনা অনুযায়ী মনে হয় জায়গা এই উত্তরবঙ্গ। কারণ দাউদ খাঁর রাজধানী ছিল মালদহের তাণ্ডা নামে একটা শহরে। এবার ব্যাপারটা একটু সহজ হয়ে গেল। মালদহে ফেরার পথে উত্তরবঙ্গ যদি পড়ে তা হলে কালাপাহাড় অসম অভিযান করেই ফিরছিল এবং সেটা পুরী অভিযান করার ঠিক আগে। তা হলে ওর ওই ফেরার পথ ধরে আমাদের এগোতে হবে।

ঠিক এই সময় একটা জিপ এসে গেটের সামনে থামল। অর্জুন দেখল জিপ থেকে থানার দারোগা শ্রীকান্ত বক্সি নামছেন। সে এগিয়ে গেল। শ্রীকান্তবাবু গেট খুলে কাছে এসে বললেন, মিস্টার সোম, আপনাদের একটু বিরক্ত করতে এসেছি। স্রেফ রুটিন কাজ।

অমলদা বললেন, স্বচ্ছন্দে।

হরিপদ সেন গতকাল আপনার কাছে এসেছিলেন। কী কথা হয়েছে?

কী ব্যাপার? আপনি আমার ক্লায়েন্টের ব্যক্তিগত কথা জানতে চাইছেন কেন?

শ্রীকান্ত বক্সি গম্ভীর মুখে জবাব দিলেন, আজ সকালে হরিপদবাবুকে তাঁর হোটেলে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। শিলিগুড়ি পুলিশ একটু আগে জানাল।

অমলদা চমকে উঠলেন, সে কী! হরিপদবাবু মারা গিয়েছেন?

শ্রীকান্ত বক্সি মাথা নাড়লেন, এ্যা। ওঁকে খুন করা হয়েছে।

আক্ষেপে আকাশে হাত ছুঁড়লেন অমলদা, ইস। ভদ্রলোককে বললাম জলপাইগুড়ির কোনও হোটেলে থাকতে, কিন্তু কথাটা শুনতেই চাইলেন না।

আপনি কি ওঁর কথা শুনে কিছু আন্দাজ করেছিলেন?

না। উনি আমাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেটা নেব কি না তা ভাবতে একদিন সময় নিয়েছিলাম। ইন ফ্যাক্ট আপনার বদলে এখন হরিপদবাবুকেই আশা করেছিলাম। আজ সকালে ওঁকে জানিয়ে দিতাম ওঁর প্রস্তাবে আমি রাজি। শিলিগুড়ি থেকে যাওয়া-আসা না করে আমি তাই ওঁকে জলপাইগুড়িতেই থাকতে বলেছিলাম।

উনি রাজি হননি?

না, বললেন সেখানে জিনিসপত্র রেখে এসেছেন। অথচ…।

উনি কী প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন?

হাত নাড়লেন অমলদা। খুব হতাশ দেখাচ্ছিল তাঁকে, সেটা কি আমি বলতে বাধ্য?

হয়তো ওঁর খুনের কোনও ইঙ্গিত আমরা পেতে পারি। ইন ফ্যাক্ট, ওঁর হোটেলের ঘরে আপনার নাম-ঠিকানা লেখা একটা কাগজ পাওয়া গিয়েছে যার জন্য শিলিগুড়ি পুলিশ আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারে।

অমলদা একটু চিন্তা করলেন, উনি আমাকে কিছু টাকা অ্যাডভান্স করে গিয়েছিলেন, ওঁর কাগজপত্রও আমার কাছে। কিন্তু আমার সন্দেহ ওঁর কাছে আরও কিছু ছিল যা আমাকে বিশ্বাস করে দিতে পারেননি। যা হোক, ওঁকে যখন ক্লায়েন্ট বলে ভেবেছি তখন ওঁর হত্যাকারীকে খুঁজে বের করা আমার নৈতিক কর্তব্য। মিস্টার বক্সি, উনি আমার কাছে এসেছিলেন গুপ্তধন উদ্ধার করার সাহায্য চাইতে।

গুপ্তধন? শ্রীকান্ত বক্সি হতভম্ব।

আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে মাটিতে পুঁতে রাখা ধনসম্পত্তি যা ঠিক কোথায় আছে তিনি জানেন না।

তা হলে খুঁজবেন কী করে?

সেই কারণেই ওঁর কাছে একদিন সময় চেয়েছিলাম।

আচ্ছা! তা হলে হত্যাকারী এই গুপ্তধনের খবর জানত!

মনে হচ্ছে তাই। অমলদা উঠে দাঁড়ালেন, আমরা একবার শিলিগুড়িতে যেতে চাই। ওঁর হোটেলে। সাহায্য করবেন?

নিশ্চয়ই। আমিও যাচ্ছিলাম। আপনারা আমার সঙ্গে আসতে পারেন। ৩৬

 

আপনি কেন যাচ্ছিলেন?

পুলিশের কাজ মশাই। ছুটোছুটিই তো আমাদের চাকরি।

বিষ্টুসাহেব বাড়িতেই থেকে গেলেন। অর্জুন আর অমল সোম দারোগাবাবুর জিপে উঠে বসতেই চাকা গড়াল। অর্জুনের মনে পড়ল গতকাল হরিপদবাবু এই সময় বেঁচে ছিলেন। এই বাড়ির গেট দিয়ে বেরিয়ে গাড়িতে উঠেছিলেন। আজ তিনি নেই। কে সেই লোক যে একজন অংশীদার কমিয়ে দিল?