০২. নেতাজির স্ট্যাচু

নেতাজির স্ট্যাচুটাকে বাঁ দিকে রেখে করলা সেতুর ওপর উঠে বাইকটাকে থামাল অর্জুন। একপাশে সেটাকে দাঁড় করিয়ে রেখে রেলিঙে ভর করে নদীর দিকে তাকাল। এখন নদীর জল কচুরিপানায় ছাওয়া। আর একটু দূরে যেখানে করলা গিয়ে তিস্তায় পড়েছে, সেখানে জল স্থির হয়ে গেছে চড়া ওঠায়। এই জায়গাটা বড় ছিমছাম, নির্জন। অর্জুন একটা সিগারেট ধরাল। গত বছর ভোট দিয়েছে সে। এখন একজন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক। কিন্তু জলপাইগুড়ি শহরের মানুষেরা এখনও কিছু ব্যাপার মেনে চলে। অর্ধ-পরিচিত বয়স্ক মানুষ দেখে অনেকেই সিগারেট লুকোয়। পরিচিতি বেড়ে যাওয়ায় অর্জুনের পক্ষে অচেনা মানুষকে বোঝা মুশকিল হয়ে পড়েছে। বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিতে এইরকম নির্জন জায়গা বেছে নিতে হয় সেই কারণে।

পুরো ব্যাপারটাকেই তার অবিশ্বাস্য এবং অবাস্তব মনে হচ্ছে। অথচ অমল সোম বললেন, ইন্টারেস্টিং।

কয়েকশো বছর আগে একটি অত্যাচারী সেনাপতি কোথায় কী লুকিয়ে রেখেছিল তাই খোঁজার দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে এসেছেন হরিপদ সেন। এ যেন হিমালয়ের বরফের মধ্যে থেকে একটা সঁচ খুঁজে নিয়ে আসার মতো ব্যাপার। লোকটাকে স্বচ্ছন্দে পাগল বলা যেত, যদি না ওই চিঠিটা তিনি দেখাতেন। হঠাৎ অর্জুনের মনে হল, এই চিঠি হরিপদবাবু নিজেই লিখে নিয়ে আসতে পারেন ঘটনার গুরুত্ব বাড়াতে। অমলদা এটা ভাবলেন না কেন? এমন চিঠি অন্য কাউকে দিয়ে লেখানোর বোকামি কেউ করে না, নিশ্চয়ই হরিপদ সেনও নির্বোধ নন। ভদ্রলোকের হাতের লেখার নমুনা যদি পাওয়া যেত। কিন্তু মুশকিল হল কোনও সমস্যারই এত সহজে সমাধান হয় না।

জীবিত মানুষকে খুঁজে পেতেই হিমশিম খেতে হয়, আর এ তো মৃত মানুষ। পনেরশো আশি খ্রিস্টাব্দে যে মানুষটি মারা গিয়েছে সে কোথায় কিছু সোনাদানা লুকিয়ে রেখেছে তা খুঁজে পাওয়া। অর্জুন হেসে ফেলল। এই তো, কুড়ি বছরেই জলপাইগুড়ির চেহারা কত বদলে গেল। আটষট্টির বন্যার আগে শহরটার চেহারা নাকি অন্যরকম ছিল। অমলদা বলেন, তিস্তায় বাঁধ হওয়ার আগে চরে অদ্ভুত চেহারার ট্যাক্সি চলত। এসব এখন কি তারা ভাবতে পারে? অত কথা কী, জলপাইগুড়ির খেলাধুলোর জগতে যাঁর দান সবচেয়ে বেশি সেই রায়সাহেব তো মারা গিয়েছেন কয়েক বছর হল। এখন যদি তাঁকে বলা হয় রায়সাহেব, কখন কোথায় গিয়েছেন তার বিস্তারিত বর্ণনা আবিষ্কার কর, তা হলে কি সে সক্ষম হবে? অথচ অমলদা বলে দিলেন কাল সকালের মধ্যে কালাপাহাড় লোকটা, মানে ইতিহাসের সেই সেনাপতি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা তৈরি করে এস। কালাপাহাড় সম্পর্কে চালু ইতিহান্স বইয়ে নাকি দু-চার লাইনের বেশি জানতে পারা যায় না। এখন লাইব্রেরি খোলার সময় নয়। তা হলে বাবুপাড়া পাঠাগারে গিয়ে দেখা যেত কালাপাহাড়ের ওপর কোনও বই পাওয়া যায় কি না! সিগারেটটা শেষ হল তবু অর্জুন ভেবে পাচ্ছিল না অমল সোম এরকম কেস নিলেন কেন! আগামীকাল সকালে যদিও দেখা করতে বলেছেন, আর সেটাই তো নেওয়ার লক্ষণ।

এই সময় ওর গৌরহরিবাবুর মনে পড়ল। স্কুলে ইতিহাস পড়াতেন। খুব পণ্ডিত মানুষ। দুবছর আগে অবসর নিয়ে সেনপাড়ায় আছেন। অনেককাল ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়নি। অবসর নেওয়ার কথাটা সে শুনেছিল। খুব রাগী মানুষ, পড়া না করে এলে ক্ষেপে যেতেন। অর্জুন বাইক ঘোরাল।

সেনপাড়ায় গৌরহরিবাবুর বাড়িতে সে ছাত্রাবস্থায় একবার এসেছিল। আজ খুঁজে বের করতে অসুবিধে হল না। টিনের ছাদ, গাছপালা আছে। রাস্তার দিকটা টিনের দেওয়াল তুলে একটু আব্রু রাখার চেষ্টা। গরিব মাস্টারমশাইয়ের কোনও ছেলেমেয়ে নেই। অর্জুন বাইরের দরজায় তিনবার শব্দ করার পর একটি মহিলা কণ্ঠ ভেসে এলো, কে?

সার আছেন? আমি অর্জুন।

তিরিশ সেকেন্ড বাদে দরজাটা খুললেন এক প্রৌঢ়া, ওঁর শরীর ভাল নেই।

ও, ঠিক আছে তা হলে। অর্জুন ফেরার জন্য ঘুরছিল, এই সময় ভেতর থেকে গৌরহরিবাবুর গলা শোনা গেল, হ্যাঁ গো, কে এসেছে, সার বলল যেন?

তোমার নাম অর্জুন বললে? প্রৌঢ়া জিজ্ঞেস করতেই সে মাথা নাড়ল। তিনি তখন গলা তুলে সেটা জানিয়ে দিতেই গৌরহরিবাবু ভেতরে নিয়ে যেতে আদেশ করলেন।

অর্জুন উঠোনে পা দিল। নানারকম ছোট গাছে উঠোন সাজান। টাঙানো দড়িতে কাপড় শুকচ্ছে। গলার স্বর যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকের বারান্দায় পা দিল সে। দরজা দিয়ে ভেতরের ঘরটিতে যে আলো ঢুকছে তাতেই গৌরহরিবাবুকে দেখা গেল। একটা খাটে শুয়ে আছেন তিনি, মুখে হাত চাপা দিয়ে। অর্জুন বলল, সার, আপনি অসুস্থ?

হাত সরালেন গৌরহরিবাবু, অর্জুন মানে, আমার ছাত্র যে গোয়েন্দা হয়েছে?

অর্জুন হাসলো, আমি বলি সত্যসন্ধানী।

ভাল শব্দ। গর্ব হয়। বুঝলে হে। তোমরা যারা নাম করেছ তাদের জন্য গর্ব হয়। অসুস্থ, মানে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস। চোখে কম দেখি। এখন আলো পড়লে কষ্ট হয়। তা কী ব্যাপার বাবা? আমার কথা হঠাৎ মনে পড়ল কেন? চোখ বন্ধ করেই প্রশ্ন করলেন গৌরহরিবাবু। অর্জুন অস্বস্তিতে পড়ল। ঠিক কীভাবে প্রশ্নটা করবে বুঝতে পারছিল না। তাছাড়া শুধু স্বার্থের প্রয়োজনে সে এসেছে এটা জানাতেও খারাপ লাগছিল।

অর্জুন বলল, আপনি অসুস্থ, আপনাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না।

কথা বলতে তো কোনও অসুবিধে নেই। চোখ বন্ধ রাখতে হবে এই যা।

আমি একটু সমস্যায় পড়েছি। ইতিহাসে কালাপাহাড় নামে একটি মানুষের কথা পড়েছিলাম। আপনার কাছে তাঁর সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।

কালাপাহাড়? দাউদ খাঁয়ের সেনাপতি। পনেরোশো আশি খ্রিস্টাব্দে মারা যান।

হ্যাঁ। ওঁর সম্পর্কে বিস্তারিত খবর কোথায় পাব?

বিস্তারিত জানতে হলে অনেক বই পড়তে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিস্টরি অব বেঙ্গল নামে একটা বই বেবিয়েছিল, এখানে তো পাবে না। এই উত্তরবাংলায় কালাপাহাড়ের আনাগোনা ছিল। মনে করে তোমাকে আমি একটা বই-এর লিস্ট তৈরি করে দেব যা পড়লে অনেকটাই জেনে যাবে। এই কালাপাহাড়ের আসল নাম কী জান?

উনি আগে হিন্দু ছিলেন।

হ্যাঁ। তখন হয় রাজকৃষ্ণ, রাজচন্দ্র নয় রাজনারায়ণ, এই তিনটির একটি হল ওঁর আসল নাম। লোকে জানতো রাজু বলে। মুসলমান ঐতিহাসিকরা দাবি করেছিলেন যে, উনি আফগান। এই দাবির পক্ষে কোনও প্রমাণ নেই। অসমে গেলে দেখবে লোকে ওঁকে পোড়াকুঠার, অথবা কালাকুঠার বলে চেনে। আমাদের কী অবস্থা, চারশো বছর আগের ঘটনাতে কত ধোঁয়াশা ছড়িয়ে আছে।

অর্জুন আজকাল পকেটে একটা ছোট্ট ডায়েরি রাখে। তাতেই গৌরহরিবাবুর বলা নামগুলো নোট করে নিচ্ছিল। গৌরহরিবাবু একটু ভেবে নিলেন, রাজু ব্রাহ্মণের ছেলে। কিন্তু শাস্ত্র ছেড়ে অস্ত্র চালাতে সে পারদর্শী হয়ে উঠল। ছেলের এই মতিগতি তার বাবার পছন্দ হওয়ার কথা নয়। তখন বাংলার নবাব সুলেমান কিরানি। কিন্তু ছোট-ছোট নবাবের সংখ্যাও বেশ। এরা নামেই নবাব, আসলে জায়গিরদার ধরনের। সুলেমান কিরানিকে কর দিত। এই রকম এক জায়গিরদারের মেয়ের প্রেমে পড়ল রাজু। মুসলমানের মেয়ের সঙ্গে ব্রাহ্মণতনয়ের সম্পর্ক হলে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া চারশো বছর আগে হতে পারত তা অনুমান করতে পার নিশ্চয়ই। হঠাৎ থেমে গেলেন গৌরহরিবাবু। কিছু ভাবলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, বাঙালির ইতিহাসটা তুমি জান তো?

অর্জুন ফাঁপরে পড়ল। সে যেটুকু জানে তা গত দুশো বছরের। পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজ এ-দেশের দখল নেওয়ার পরে যা ঘটেছিল সেই ঘটনাগুলো। স্বীকার করল সে। গৌরহরিবাবু হাসলেন, না, এতে সঙ্কোচ করার কিছু নেই। তোমরা জান না সেটা আমাদের লজ্জা। আমরা ইতিহাস বইয়ে রাজা নবাবের গল্প লিখি। তাই পাঠ্য হয়। কিন্তু নিজেদের কথা আলাদা করে তোমাদের পড়াইনি। আমরা আবেগে চলি। ইতিহাস খুবই বাস্তব।

অর্জুন চুপচাপ রইল। কালাপাহাড়ের কথা জানতে এসে কেন বাঙালির ইতিহাস শুনতে হবে এই প্রশ্ন করা যায় না। তবে বাঙালি হিসেবে নিজেদের ইতিহাসটা নিশ্চয়ই জানা দরকার।

গৌরহরিবাবু বললেন, আগে যাদের আদি অস্ট্রেলীয় বলা হত এখন তাদের ভেজ্জিড বলা হয়। এরাই ভারতবর্ষের এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা। লম্বা মাথা, চওড়া নাক, কালো রং আর মধ্যম আকার। এখনও বাঙালিদের মধ্যে ভেজ্জিড়দের কিছু শব্দ চালু আছে, গ্রামের হাটে গেলে শুনবে এক কুড়ি পান, দু কুড়ি লেবু। হাত-পায়ের আঙুল মিলিয়ে এই কুড়ি শব্দটি ভেন্ড্রিডদের দান।

অস্ট্রিক ভাষা-ভাষী মানুষেরা এককালে এ-দেশের নদনদী পাহাড় আর জায়গার যে নামকরণ নিজেরা করেছিল এখনও আমরা তাই বলি। যেমন কোল দব-দাক বা দাম কাক থেকে কপোতাক্ষ বা দামোদর নদ। দা বা দাক মানে জল।

বাংলা নামটা এল কোত্থেকে? আবুল ফজল তাঁর আইন-ই আকবরি বইয়ে বলেছেন বঙ্গ শব্দের সঙ্গে আল যুক্ত হয়ে বাঙ্গাল বা বাংলা হয়েছে। আল মানে বাঁধ। জলের দেশে বাঁধ দরকার হয়। তাই বাংলা। বাংলাদেশে একসময় অনেক মানুষের ভিড়। বঙ্গ, গৌড়, পুন্ড্র, রাঢ়। বঙ্গের নাম মহাভারতে আর বৃহৎসংহিতায় পাওয়া যায়। আমি এসব বেশি বললে তুমি হয়তো বিরক্ত হবে। ওই চারটি ভাষার মানুষ চারটি জায়গা জুড়ে ছিল যা পরে সমগ্র বাঙালি জাতির মাতৃভূমি বলে চিহ্নিত হয়েছে। আগে ছিল সব টুকরো-টুকরো। এ ওর ভাষা বুঝত না। সপ্তম শতাব্দীতে শশাঙ্ক এসে মুর্শিদাবাদ থেকে ওড়িশা পর্যন্ত একটা রাষ্ট্রীয় ঐক্যের চেহারা দেন। শশাঙ্কের পর তিনটে জনপদ হল। পুন্ড্রবর্ধন, গৌড় এবং বঙ্গ। পাল আর সেনরাজারা সমস্ত বাংলাদেশকে গৌড় নামে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন। তা সম্ভব হয়নি। তিনটে কমে দুটোতে এসে ঠেকেছিল। গৌড় এবং বঙ্গ।

শশাঙ্কের পর এ-দেশে মাৎস্যন্যায় চলেছিল। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশ থেকে নানা ভাষার মানুষ এখানে এল। এমনকী কাশ্মীরের রাজা মুক্তাপীড় ললিতাদিত্য পর্যন্ত গৌড় আক্রমণ করে বিজয়ী হন। শশাঙ্ক ছিলেন শৈব। বাংলার অন্য রাজারা ব্রাহ্মণ্য-ধর্মাবলম্বী। শশাঙ্ক সম্ভবত হর্ষবর্ধনের জন্যই বৌদ্ধধর্মবিরোধী। এর পরে গোপালদেব এসে মাৎস্যন্যায় দূর করেন। শুরু হল পাল বংশ। আজকের বাঙালি জাতির গোড়াপত্তন হয়েছে এই যুগেই। অথাৎ অষ্টম শতক থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে। সেই অর্থে বাঙালির ইতিহাস হাজার বছরের বেশি নয়।

অর্জুন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, আমাদের ইতিহাস মাত্র হাজার বছরের?

হ্যাঁ। তাও ধাপে-ধাপে এগিয়েছে। লক্ষ্মণসেনরা ছিলেন কণটিকের মানুষ। ওঁর পূর্বপুরুষ পালরাজার সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। কয়েকপুরুষ থাকার ফলে এখানকার মানুষ হয়ে যান শেষ পর্যন্ত। তা আজকের বাঙালির অনেকের পূর্বপুরুষ ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছেন। তারপর মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি লক্ষ্মণসেনকে ঢাকার কাছে লক্ষ্মণাবতীতে পাঠিয়ে এদেশ দখল করে নিলেন। পালেদের সময় এদেশে বৌদ্ধরা এসেছিলেন। কিন্তু তাঁদের প্রভাব খুব সীমায়িত ছিল। পাঠানরা ক্ষমতা পাওয়ার পর এদেশে যারা কিছুটা নিযাতিত তারা পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মুসলমান হলেন। কেউ-কেউ চাপে পড়ে বা অতিরিক্ত সুবিধে পাওয়ার জন্যও ধর্মবদল করেন। পরিষ্কার বোঝা যায় যে, এইসব ধর্মান্তরিত মানুষকে হিন্দু বাঙালি সহ্য করতে পারেনি। কিন্তু নবাবের ভয়ে সরাসরি কোনও ব্যবস্থাও নিতে পারেনি। সামাজিক জীবনে হিন্দু-মুসলমানের দুটি ধারা পৃথকভাবে বয়ে চলে, দিনে-দিনে এ-দেশীয় মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে লাগল। এইরকম পরিস্থিতিতে রাজু বা রাজকৃষ্ণ ধর্মান্তরিত হন।

সে সময় হিন্দু থেকে মুসলমান অথবা বৌদ্ধ হওয়া খুব সহজ ছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণদের সঙ্কীর্ণতা অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য হিন্দুধর্মে প্রবেশের দরজা বন্ধ করে রেখেছিল পাঠানদের এদেশের মানুষ সাধারণত শত্রু বলেই মনে করত।, তাদের ধর্ম যেসব স্বদেশি গ্রহণ করেছে তাদের ক্ষমা করার উদারতা এদের ছিল না।

ধর্মান্তরিত রাজু তাই বিতাড়িত হল। তার পরিবার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে সে বাধ্য হল। পরবর্তীকালে রাজুকে আবার ব্রাহ্মণরা গ্রহণ করেনি। মন্দিরে প্রবেশের অধিকার নির্মমভাবে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। এই আচরণ তাকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। স্বভাবতই হিন্দুবিদ্বেষী হতে তার বেশি দেরি হয়নি। রাজু ক্রমশ নবাবের সৈন্যদলে বিশিষ্ট হয়ে উঠল। নবাবি সৈন্য যখন কোনও অভিযান করত তখন তার লক্ষ ছিল সেই অঞ্চলের মন্দির ভাঙা, বিগ্রহ চূর্ণ করা আর হিন্দুদের ওপর অত্যাচার চালানো। আর এই কারণেই লোকে তার নামকরণ করল কালাপাহাড়।

কালাপাহাড়ের প্রসঙ্গে চলে আসায় অর্জুন খুশি হল। এতক্ষণ সে একটু বিষন্ন ছিল। ইংরেজ বা ফরাসিরা নাকি হাজার-হাজার বছর ধরে নিজেদের সভ্য করেছে, রোমানদের সংস্কৃতিও সেইরকম। কিন্তু বাঙালির নিজস্ব কোনও সংস্কৃতি হাজার বছরের বেশি নয়, এটা ভাবতে তার খুব খারাপ লাগছিল।

গৌরহরিবাবু একটু দম নিয়ে বলতে শুরু করলেন, কালাপাহাড় সুলেমান কিরানি এবং পরে ওঁর ছেলে দাউদের সেনাপতি হয়েছিলেন। ওদিকে অসম আর এদিকে কাশী এবং ওড়িশার প্রায় কোনও মন্দির কালাপাহাড়ের হাত থেকে পরিত্রাণ পায়নি। বোঝা যাচ্ছে এই অঞ্চল জুড়ে ওর গতিবিধি ছিল। গল্পে আছে, মন্দির ধ্বংস করার আগে কালাপাহাড় সৈন্যদের দূর থেকেই কানাকাড়া বাজাতে বলত।

কালাপাহাড় ওড়িশা-অভিযান করে পনেরোশো পঁয়ষট্টি খ্রিস্টাব্দে। তখন রাজা মুকুন্দদেব পুরীতে। মুকুন্দদেবের পরাজয় হয়। ওঁর ছেলে গৌড়িয়া গোবিন্দকে পদানত করে কালাশহাড় পুরীর মন্দির ধ্বংস করতে যায়। পাণ্ডারা এই খবর পেয়ে জগন্নাথদেবের মূর্তি নিয়ে গড় পারিকুদে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। কালাপাহাড়ের হাত থেকে তবু সেই মূর্তি রক্ষা পায়নি। জগন্নাথদেবের মূর্তি পুড়িয়ে সে সমুদ্রের জলে ফেলে দেয়। কালাপাহাড়ের অনেক আগে তিনশো আঠারো খ্রিস্টাব্দে রক্তবাহু নামে একজন পুরী আক্রমণ করেছিল কিন্তু তখন পাণ্ডারা জগন্নাথদেবকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল।

আকবরনামায় আছে দাউদের বিদ্রোহী স্বভাবের জন্য মুগল সম্রাট সেনাপতি মুনিম খাঁকে পাঠায় তাকে বন্দি করতে। কালাপাহাড় দাউদের সেনাপতি হিসেবে প্রচণ্ড যুদ্ধ করে। একসময় সে কাঙ্গাল নামে একটি জায়গাও অধিকার করে। কিন্তু পনেরোশো আশি খ্রিস্টাব্দে কালীগঙ্গার তীরে মোগলবাহিনীর তোপে কালাপাহাড় মারা যায়।

একজন বাঙালি হিসেবে কালাপাহাড় আমাদের ইতিহাসের প্রথম দিকে সবচেয়ে বিতর্কিত চরিত্র। অত্যন্ত সাধারণ অবস্থা থেকে লোকটা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছিল। ব্রাহ্মণরা ওকে হিন্দুবিদ্বেষী করেছিল। সেই মানুষ আজ কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু একটি রহস্য আমাকে খুব ভাবায়। আমি অনেককে চিঠি লিখেছিলাম। কেউ আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তুমি শুনতে চাও?

বলুন। অর্জুন এখন এই কাহিনী রসে প্রায় ড়ুবে গিয়েছে।

কালাপাহাড় ওড়িশা অভিযান করে পনেরোশো পঁয়ষট্টি খ্রিস্টাব্দে। তার ঠিক বত্রিশ বছর, মাত্র বত্রিশ বছর আগে এক বাঙালি মহাপুরুষের পুরীতে মৃত্যু হয়। তিনি শ্রীচৈতন্য। নবদ্বীপ ছেড়ে পুরীতে গিয়েছিলেন পনেরোশো দশ খ্রিস্টাব্দে। তখন পুরীর রাজা প্রতাপরুদ্র তাঁর ভক্ত হন। পরে যখন চৈতন্য পুরীতে পাকাপাকি বাস করছেন তখন রাজা তাঁর সঙ্গে পরামর্শ না করে কোনও কাজ করতেন না। পনেরোশো কুড়ির পর থেকে রাজা প্রতাপরুদ্র শ্রীচৈতন্যের সঙ্গেই সময় কাটাতেন। জগন্নাথ দাস, বলরাম দাস, অচ্যুতানন্দ দাস আর তিনি মহাপুরুষের সঙ্গে বৈষ্ণব ধর্ম নিয়ে আলোচনা করতেন। রাজার এক ভাই গগাবিন্দ বিদ্যাধর পাণ্ডাদের ক্ষেপিয়ে তুললেন। তাদের বোঝানো হল রাজা জগন্নাথের চেয়ে চৈতন্যকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। যে চৈতন্য জাত বিচার করল না, রাজা যদি তাঁর শিষ্য হন তা হলে জগন্নাথের মন্দির তো অপবিত্র হয়ে যাবে। পুরীতে তখন কিছু বৌদ্ধসঙ্ঘ ছিল। রাজার ভাই তাঁদেরও ক্ষেপিয়ে তুললেন চৈতন্যের বিরুদ্ধে। রাজা না-জগন্নাথ না-বৌদ্ধসঙঘ কারও দিকে নজর দিচ্ছেন না, শুধু চৈতন্য নামে নবদ্বীপ থেকে আসা লোকটির মায়ায় ভুলে আছেন, এই তথ্য অনেককেই ক্রুদ্ধ করল। গোবিন্দ বিদ্যাধর গোপনে ষড়যন্ত্র করতে লাগল।

চৈতন্যদেব জগন্নাথে লীন হননি, সমুদ্রে ভেসে যাননি। তা হলে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যেত। শুধু তিনি নন, তাঁর পার্ষদদের কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। পনেরোশো তেত্রিশের ঊনত্রিশে জুন দুপুর থেকে রাত্রের শেষ ভাগ পর্যন্ত জগন্নাথদেবের মন্দিরের সমস্ত দরজা বন্ধ ছিল। চৈতন্যদেবকে সপার্ষদ সেখানে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারপর তাঁরা উধাও। রাজা এই অন্তর্ধানের তদন্ত করতে চেয়েও সফল না হয়ে কটকে চলে গিয়েছিলেন। তিনি যুবরাজকে পাঠিয়েছিলেন। যুবরাজ মাস-চারেকের মধ্যেই নিহত হন। চৈতন্যদেব বৈষ্ণবধর্মের প্রচারক এবং পাণ্ডাদের শত্রু হিসেবে প্রচার করে যাঁর লাভ হত সেই রাজার ভাই গোবিন্দ বিদ্যাধরের সিংহাসন দখল করার বাসনা পৃর্ণ হয়নি।

নবদ্বীপে নিশ্চয়ই এই খবর পৌঁছেছিল। মহাপ্রভু দিব্যান্মাদ হয়ে লীন হয়ে গেছেন, এই বিশ্বাস অনেকেই করেননি। পুরী অভিযানের আগে কালাপাহাড় গিয়েছিল নবদ্বীপে। অদ্ভুত ব্যাপার, সে সেখানকার মন্দিরের ওপর তেমনভাবে ক্রুদ্ধ হতে পারেনি। সেই প্রথম সে জানতে পারে চৈতন্য নামের একটি মানুষ হিন্দু-মুসলমানকে সমানভাবে মর্যাদা দিয়েছেন। মুসলমানকে আলিঙ্গন করেছেন। কোনও ভেদাভেদ রাখেননি। এই তথ্য কি কালাপাহাড়ের হৃদয়ের ক্ষতকে শান্ত করেছিল? তার নিজের অভিজ্ঞতার বিপরীত ছবি দেখে সে কি চৈতন্য সম্পর্কে শ্রদ্ধান্বিত হয়েছিল? তার কানে কি চৈতন্যের অন্তর্ধানের খবর পৌঁছেছিল? পাণ্ডাদের রাজনীতির শিকার হয়েছিলেন চৈতন্য, এইরকম ধারণা করেই কি সে প্রতিশোধ নিতে পুরী অভিযান করেছিল? মাত্র বত্রিশ বছর পরেই আর-এক বাঙালির এই অভিযান কি শুধুই রাজ্যজয়ের আকাঙক্ষা? কালাপাহাড় অন্য জায়গার মন্দির ধ্বংস করেছে। কিন্তু জগন্নাথের মন্দির পাণ্ডাদের দখলে বলে কোন প্রতিশোধের ইচ্ছায় বিগ্রহ পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল? কেউ উত্তর দিতে পারেননি। যদি আমার সন্দেহ সত্যি হয় তাহলে কালাপাহাড়ের চরিত্রের আর-একটি দিকে আলো পড়বে। আমরা নতুনভাবে বিস্মিত হব।

এই সময় সেই প্রৌঢ়া দরজায় এসে দাঁড়ালেন, তুমি অনেকক্ষণ কথা বলেছ। আর নয়।

গৌরহরিবাবু হাসলেন, প্রিয় বিষয়, পুরনো ছাত্র!

তা হোক। দরকার থাকলে না হয় পরে আসবে।

অর্জুন উঠে দাঁড়াল, সার, আমি চলি। দরকার হলে পরে আবার আসব।

গৌরহরিবাবু শুয়ে-শুয়েই হাত নাড়লেন। তাঁর চোখ বন্ধ। প্রায় দৃষ্টিহীন এই ইতিহাস-প্রেমিক অন্তদৃষ্টি দিয়ে অতীত দেখে যান চুপচাপ, অর্জুনের তাই মনে হল।

লাল মোটরবাইকে চেপে বাড়ির দিকে যাওয়ার সময় অর্জুন হেসে ফেলল। হরিপদ সেন চেয়েছিলেন কালাপাহাড় উত্তর বাংলার কোন কোন অঞ্চলে ছিলেন এবং সেখানে ওই বর্ণনাব সঙ্গে মিলে যায় এমন জায়গা আছে কি না। যেখানে সোনাদানা পুঁতে রাখা সম্ভব, তা খুঁজে বের করে দিতে। সারের সঙ্গে কথা বলে তার ধারে কাছে যাওয়া গেল না। শুধু কালাপাহাড় সম্পর্কে একটা ভাসা-ভাসা ছবি পাওয়া গেল, আর সেইসঙ্গে বাঙালির ইতিহাস। অবশ্য অমল সোম শুধু এইটুকুই চেয়েছিলেন।

কদমতলার বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে সে অবাক। হাবু রাস্তার একপাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। অমলদার এই স্বাস্থ্যবান বোবা-কালা কাজের লোকটিকে খুব ভালবাসে অর্জুন। তাকে দেখামাত্র হাবু হাত-পা নেড়ে মুখ বেঁকিয়ে বুঝিয়ে দিল অমলদা তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। বোঝমাত্র হাবুকে পেছনে বসিয়ে মোটরবাইক ঘুরিয়ে হাকিমপাড়ার দিকে ছুটে গেল অর্জুন।