2 of 2

পাইকপাড়া রাজ পরিবার

পাইকপাড়া রাজ পরিবার

প্রাচীন সম্ভ্রান্ত এই পরিবারটির আদি বাস ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দীতে, এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা হরকৃষ্ণ সিংহ মুসলমান সরকারের সরকারের অধীনে চাকরি করে প্রচুর সম্পদের অধিকারী হন। হরকৃষ্ণের পৌত্র বিহারীর দুই পুত্র : রাধাগোবিন্দ ও গঙ্গাগোবিন্দ। নবাব আলিবর্দী খাঁ ও নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার অধীনে রাধাগোবিন্দ রাজস্ব আধিকারিকের পদে নিযুক্ত ছিলেন। ব্রিটিশরা রাজস্ব আদায়ের অধিকার পেলে রাধাগোবিন্দ জরিপ, বন্দোবস্ত ও রাজস্ব সংক্রান্ত সকল প্রকার দলিল দস্তাবেজ তাদের হাতে তুলে দেন; এই উপকারের পুরস্কারস্বরূপ তাঁকে হুগলীর ‘সয়ার মহল’ বা চুক্তি কর আদায়ের অধিকার দেওয়া হয়, ১৭৯০-এ চুঙ্গিকর আদায়ের অধিকার সরকার থেকে অধিগৃহীত হলে, পরিবারটিকে বার্ষিক ৩,৬৯৮ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়; পরিবারটি এখনও (১৮৮১) ক্ষতিপূরণ বাবদ এই অর্থ পাচ্ছেন। (দ্রষ্টব্য : ওয়েস্টল্যান্ডের যেসোর, ১৮৭১, পৃঃ ১৯০)। কনিষ্ঠ, দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ, হিন্দুস্থানের রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতে ভালবাসতেন। উদারচেতা গঙ্গাগোবিন্দ মাতৃশ্রাদ্ধে কয়েক লাখ টাকা ব্যয় করেন। ওয়ারেন হেসটিংসের শাসনকালে গঙ্গাগোবিন্দ অনারেবল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে ভূমি বন্দোবস্তের পূর্ণ অধিকার ও দায়িত্বসম্পন্ন দেওয়ান ছিলেন। পুত্র প্রাণকৃষ্ণকে লালনপালনের ভার দিয়েছিলেন তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ রাধাগোবিন্দর ওপর।

দেওয়ান প্রাণকৃষ্ণ জমিদারী সংক্রান্ত সকল বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন, আবার উদারচেতা ও দয়াবানও ছিলেন। দেওয়ান কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ ওরফে লালা বাবু এঁরই পুত্র। কৃষ্ণচন্দ্র কিছুকাল বর্ধমান ও কটকের কালেক্টরদের অধীনে দেওয়ানের চাকরি করেন। যৌবনেই লালাবাবু সংসার-বিবাগী হন–এর দ্বারা তাঁর নৈতিক সাহসের পরিচয় পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। দীর্ঘ তীর্থভ্রমণের পর তিনি উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে বাস করতে থাকেন, সেখানে তাঁর বিপুল দানের জন্য তিনি বিখ্যাত হন। বৃন্দাবনে তিনি রাজপুতানার মর্মর প্রস্তর দ্বারা একটি মন্দির নির্মাণ করেন, কিন্তু মর্মর প্রস্তর কিনতে রাজপুতানা গিয়ে তিনি রাজনৈতিক জটিলতার মধ্যে জড়িয়ে পড়েন। মথুরা জেলায় রাধাকুন্ড নামে একটি বড় দীঘি আছে; লালা বাবু এর চতুর্দিক বাঁধিয়ে সিঁড়ি করে দিয়েছিলেন। (দ্রষ্টব্য: ওয়েস্টল্যান্ডের ‘যেসোর’, ১৮৭১, পৃষ্ঠা ১৯০-১৯১)। বিপুল সম্পত্তি ও শিশুপুত্র শ্রীনারায়ণ (পরে দেওয়ান)-কে রেখে লালাবাবু বৃন্দাবনে পরলোক গমন করেন।

নিঃসন্তান শ্রীনারায়ণ সিংহ, প্রতাপচন্দ্র ও ঈশ্বরচন্দ্রকে পোষ্য পুত্ররূপে গ্রহণ করেন।

ফিবার হসপিট্যালের জন্য, উদারহস্তে দান, অন্যান্য দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান খয়রাত্ ও এদেশবাসীর উন্নতিতে সক্রিয় অংশ গ্রহণের জন্য প্রতাপচন্দ্র সিংহকে ব্রিটিশ সরকার রাজা বাহাদুর খেতাব দ্বারা সম্মানিত করেন। তিনি ‘কম্প্যানিয়ন অব দি মোস্ট এগজলটেড অর্ডার অব দি স্টার অব ইন্ডিয়া’ খেতাব দ্বারাও সম্মানিত হন। মৃত্যুকালে তিনি চার পুত্র : কুমার গিরিশচন্দ্র সিংহ, কুমার পুর্ণচন্দ্র সিংহ, কুমার কান্তিচন্দ্র সিংহ এবং কুমার শরৎচন্দ্র সিংহকে রেখে যান। কুমার গিরিশচন্দ্র ১৮৭৭ এ মারা যান, তিনি কান্দী হাসপাতালকে ১,১৫,০০০ টাকা দান করে যান।

রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ সংগীতপ্রেমী ছিলেন। তাঁর বেলগাছিয়া ভিলায় তিনি ধুমধাম করে শর্মিষ্ঠা প্রভৃতি নাটকের অনুষ্ঠান করাতেন। তাঁর একমাত্র পুত্র কুমার ইন্দ্রচন্দ্র সিংহ পিতার বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। ১৮৭৭-এর দিল্লীর সাম্রাজ্যিক সমাবেশে বড়লাট লর্ড লিটন তাঁকে একটি পদক দান করেন।

কুমার পূর্ণচন্দ্র, কুমার কান্তিচন্দ্র, কুমার শরৎচন্দ্র এবং কুমার ইন্দ্রচন্দ্র এখন এই বংশের প্রতিনিধি। এঁরা বর্তমান বাংলার শিক্ষিত ধনী সম্মানিত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের অন্যতম।

এই বংশের জমিদারী বাঙলার বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে আছে। এঁরা নাবালক থাকাকালে কোর্ট অব ওয়ার্ডস কর্তৃক নিযুক্ত সুদক্ষ সুপরিচালক ইউরোপীয় অফিসার মিঃ হার্ডি সমগ্র এস্টেটটি পরিচালনা করেন। তাঁর সুপরিচালনার সম্পত্তি ও সম্পদ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *