2 of 2

অনারেবল প্রসন্নকুমার ঠাকুর সি এস আই

অনারেবল প্রসন্নকুমার ঠাকুর সি এস আই

গোপীমোহন ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র প্রসন্নকুমারের জন্ম হয় ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে। ইংরেজির প্রাথমিক শিক্ষা তিনি লাভ করেন মিঃ শেরবোর্নের বিদ্যালয়ে। ঠাকুর পরিবারের যশ ও প্রভাব-প্রতিপত্তিতে তাঁর দানও কম নয়। “তিনি ও তাঁর মতো ব্যক্তিদের জন্যই আজ বাংলাদেশ ভারতে উচ্চ স্থানের অধিকারী হয়েছে। যুক্তিযুক্ত কারণেই বাঙালীদের ভারতের অ্যাথেনীয় বলা হয়। ভারতের মতো গ্রীসবাসীরাও ছিল বহু জাতি উপজাতিতে বিভক্ত এবং ঈর্ষা দ্বেষে জর্জরিত। আধুনিক ভারতকে সভ্যতা, সংস্কৃতি ও সুরুচির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য নেতার গৌরবজনক ভূমিকা বাংলার। এই বাংলা থেকে ভারতবর্ষ পেয়েছে রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কেশবচন্দ্র সেনের মতো সংস্কারক। সতী প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, বিধবা বিবাহের প্রচলন ও প্রসার এবং উন্নত আধুনিক ব্যাপক শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন, সে-ও শুরু হয়েছিল এই বঙ্গদেশে। প্রাচীন কালের ডোরীয়দের মতো শিখ ও মারাঠাগণ যুদ্ধাভিযান ও যুদ্ধ জয়ের জন্য বিখ্যাত ছিলেন, কিন্তু বাঙালীরা, এথেনীয়দের মতো সংস্কৃতি, সাহিত্য, চারুশিল্প, সমাজ সংস্কার এবং প্রগতির জন্য ওদের অপেক্ষা অনেক উন্নত ছিলেন।”

আগেই বলেছি, প্রসন্নকুমার ঠাকুরের মতো মানুষদের জন্য বাংলা এই অগ্রগণ্য স্থানের অধিকারী হতে পেরেছে। যে জাতি জাতিগৌরব নিম্নে অন্য সকলকে দূরে সরিয়ে রাখে বা সরে থাকে, অহংকারী, জগতে অন্যের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলে, বরং নিজেকে সংকুচিত বিচ্ছিন্ন করে রাখে, সেইরূপ একটি জাতির সর্বপ্রকার কুসংস্কারের মধ্যে ব্রাহ্মণ হিসাবে, হিন্দু হিসাবে প্রসন্নকুমার তাঁর বাল্যকালে পালিত হয়েছিলেন। এই সব কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠতে হলে অনেক শক্তিশালী মনের অধিকারী হওয়া দরকার। অতি অল্প সংখ্যক মানুষই বাল্যের অভ্যস্ত কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন। অভ্যস্ত আচার আচরণ ও সামাজিক ব্যবস্থার বাঁধন ভেঙে নূতন সমাজব্যবস্থা ও আচার আচরণের জন্য যে সঠিক বিচারবুদ্ধি, সংস্কারমুক্তি ও নিগড় ভাঙার সংকল্পের প্রয়োজন, তা দশ হাজার মানুষের মধ্যে এক জনেরও থাকে কিনা সন্দেহ; পারিপার্শ্বিকের মূল্যায়ন এবং তার থেকে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন প্রশান্ত মনন, যা সব কিছুর মধ্যে থেকেও সত্যকে সঠিকভাবে চিনে নিতে সক্ষম। যে সমাজ ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আমরা পালিত হই, তার সঠিক ও পক্ষপাতশূন্য মূল্যায়ন আমাদের অনেকের মধ্যেই কঠিন। শৈশবের অভ্যন্ত চিন্তাধারার রেশ সারা জীবনই টিকে থাকে; সেই মজ্জাগত অভ্যাস ও গার্হস্থ্য জীবনের আহ্বান উপেক্ষা করা বড় কঠিন। প্রসন্নকুমার সত্যের সন্ধান পেলে, অন্তত সত্য বলে তাঁর কাছে যা প্রতীয়মান হত, তাকে গ্রহণ এবং সর্বজনের কাছে তার সত্য ঘোষণা করতে দ্বিধা করবার মতো মানুষ ছিলেন না; আদর্শ স্থাপন দ্বারা অপরকে শিক্ষা দেয়ার, মিথ্যাকে টেনে নামাবার এবং সত্যকে স্বস্থানে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে নৈতিক সাহসের প্রয়োজন প্রসন্নকুমারের তা ছিল।

রামমোহন রায়ের সঙ্গে মেলামেশা ও বন্ধুত্বের ফলে, তিনি যে গোঁড়া হিন্দু সমাজব্যবস্থার মধ্যে পালিত হয়েছিলেন তার সব কিছুই যাচাই করে দেখতে লাগলেন; পরিণামে তিনি ‘দেশবাসীর নিকট আবেদন’ (An Appeal to his Countrymen ) নাম দিয়ে একখানি পুস্তিকা প্রকাশ ও প্রচার করলেন। এর মাধ্যমে তিনি সর্ব সত্তার স্রষ্টা সব কিছুর নিয়ামক একেশ্বরের আরাধনার জন্য আহ্বান জানালেন। তাই বলে তিনি ‘প্রতিমা ভঙ্গকারী’ হয়ে ওঠেন নি– ধর্মান্ধের মতো তিনি তাঁর নববিশ্বাসের বিরোধী সব কিছু এবং সকলকে আঘাত করে বেড়ালেন না। তর্ক, যুক্তি ও রুচিশীল উপদেশ– এতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকতেন; মূলাজোড়ের পারিবারিক মন্দির ও তার ব্যবস্থাদি অক্ষুণ্ন রইল; মাতৃভক্তি ছিল তাঁর শৈশবের শিশুসুলভ ধর্ম, বাল্যের বিশ্বাস, যৌবন ও পরিণত বয়সের পবিত্র পালনীয় কর্তব্য– তাই তাঁর মায়ের রূপোর পালঙ্কখানিকে তিনি মূলাজোড় মন্দিরে নিয়ে গিয়ে দেবতার চৌকিতে পরিণত করেন; যাতে সাধারণে ব্যবহার করে সেটিকে অপবিত্র করতে না পারে। মাতৃদেবী এই পালঙ্কে শুয়ে ঘুমোতেন; প্রসন্নকুমারের কাছে তাই সেটি অতি পবিত্র বস্তু। সেটিকে সাধারণ ব্যবহার দ্বারা তিনি অপবিত্র হতে দিতে পারেন না। মূলাজোড়ের বিগ্রহকে তাঁর মা সর্বান্তঃকরণে ভক্তি করতেন, তাই পালঙ্কখানি তিনি সেই দেবমন্দিরেই উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন।

শুধুমাত্র ধর্মীয় বা পারিবারিক স্নেহ প্রীতি শ্রদ্ধার ব্যাপার নয়, প্রসন্নকুমার তাঁর চিন্তার স্বাধীনতা, সচেতন ও সৎ ভাবে সত্যানুসন্ধান, কৈশোর-বাল্যের প্রীতিভক্তির প্রতি শ্রদ্ধা ও মৃতের প্রতি ভক্তি রক্ষা করে এসেছেন। শ্রেণি সচেতনতা দিয়ে তিনি কখনও তাঁর চিন্তাকে আচ্ছন্ন হতে দেন নি। এই শ্রেণি সচেতনতাই সামাজিক কুসংস্কার, অবিচার এবং সামাজিক স্বেচ্ছাচারের মূল। শ্রেণি সচেতনতার মতো কিছু চিন্তাধারাই আমাদের বিচারবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে, আদর্শ থেকে আমাদের বিচ্যুত করে, প্রভাবিত করে আমাদের কর্মধারা অনেক সময় এর সপক্ষে কোন যুক্তি থাকে না, আরার অনেক সময় যুক্তির বিরুদ্ধে গিয়েও আমরা কাজ করি। এই বিচার বিমূঢ়তা সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব বেশি দেখা যায়; দেখা যায় জাতীয়তার নামে জাতীয় অহমিকা প্রকাশে; দেখা যায় সমাজের স্বেচ্ছাচারে! এই ভ্ৰান্ত বুদ্ধিই যা-কিছু নূতন তাকেই ভ্রান্ত বা ঘৃণ্য ভাবে। অভ্যস্ত পথ থেকে সামান্যতম বিচ্যুতি হলেই ধরে নেওয়া হয় যে, প্রভাব প্রতিপত্তি ধ্বংস হবে, মানমর্যাদা লোপ পাবে, শ্রেণি-শক্তির অবসান ঘটবে।

প্রসন্নকুমার সদর আদালতের উকিল হতে চাইলে চারিদিক থেকে গেল গেল রব উঠল। প্রচুর পরিশ্রম সহকারে কয়েক বছর তিনি আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তাঁর আইন পড়ার কথা শুনে জনৈক ঘনিষ্ঠ বন্ধু তিরস্কার করে বললেন, অনন্ত্রক অপমানজনক এই আইন পড়ে তুমি কী করবে? তোমার এত সম্পত্তি, এত ধনদৌলত, আইন ব্যবসায়ে তোমার কী দরকার? উত্তরে প্রসন্নকুমার বললেন, মন হল সুগৃহিণীর মতো। ভাঁড়ারে তাঁর যা-কিছু থাকে, তাকেই তিনি কোনো-না-কোনো সময় কোনো-না- কোনো কাজে লাগাতে পারেন। আইন শাস্ত্রে তাঁর গভীর জ্ঞানকে কাজে লাগাতে বিলম্বও খুব একটা হল না। তিনি নীল চাবের ব্যবস্থা করেছিলেন, একটি তেলকল ও খুলেছিলেন; মামলায় দুটি ক্ষেত্রেই তাঁর প্রচুর লোকসান হয়ে গেল; তাঁর ধারণা হল মকদ্দমা ঠিকমত পরিচালিত হলে তাঁর লোকসান হত না; তাই ঠিক করলেন ভবিষ্যতে নিজের মামলা-মোকদ্দমা নিজেই লড়বেন। উকিল হিসাবে নিজের নাম নথিভুক্ত করলেন; অল্পদিনের মধ্যে সদর আদালতে তাঁর পসার সব আশা ছাড়িয়ে গেল। তখন সরকারি উকিল ছিলেন মিঃ বেইলি। তাঁর অবসর গ্রহণের পর অধিকাংশ জজ প্রসন্নকুমারের নাম সরকারি উকিল পদের জন্য সুপারিশ করলেন। অবশ্য কয়েকজন জজ এবং বোর্ড অব রেভেনিউ’র একজন সদস্য তাঁর নিয়োগের বিরুদ্ধে এই কারণে আপত্তি জানালেন যে, তিনি বাংলার অন্যতম মুখ্য জমিদার। উকিল হিসাবে তিনি যে কতখানি সাফল্য লাভ করবেন, তা তাঁর অতীব শুভানুধ্যায়ী বন্ধুরাও আশা করতে পারেন নি। জমিদারী তিনি শুধু রক্ষা করলেন না, বাড়ালেনও; ওকালতিতে তাঁর বার্ষিক আয় দাঁড়াল গড়ে দেড় লাখ টাকা।

তিনিই প্রথম সম্ভ্রান্ত পরিবারের যুবকদের মধ্যে নিজের জন্য একটি পেশা বেছে নিয়ে উকিল হলেন, ফলে এসব পরিবারের শিক্ষিত যুবকদের সামনে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপিত হল।

প্রসন্নকুমার যেসব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, এবং জয়ীও হয়েছিলেন, সেসবের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো বড় কঠিন। এই সংস্কার বা কুসংস্কারগুলি আমাদের বয়োবৃদ্ধি ও শিক্ষার সঙ্গে বেড়ে উঠেছে। ছোট থেকেই কোনো কোনো বস্তু ও বিষয়কে শ্রদ্ধা করতে বা ঘৃণা করতে আমাদের শিক্ষা দেওয়া হয়; কিন্তু উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে পৌঁছলে আমাদের সেই বাল্যের ও কৈশোরের সংস্কার বা কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠতে বলা হয়, এটাই হয় তখন আমাদের শিক্ষার অঙ্গ। এ একটা সংগ্রাম– এ সংগ্রামে কেউ জেতে, আবার অনেকেই হেরে যায়। কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষরা যতক্ষণ নিজের মতো চলতে চালাতে পারেন ততক্ষণ তাঁরা বড় অমায়িক এমনকি পরোপকারী; কিন্তু তাঁদের খেয়ালের ঘোড়ার একটা বালামচিও যদি কেউ স্পর্শ করে, অমনি তাঁরা বাঘের মতো রুখে ওঠেন। যা কিছু তাঁদের মতের বিরুদ্ধে যায়, তাই হয়ে দাঁড়ায় মিথ্যাচার, ক্ষতিকারক, কুসংস্কার। আর যা কিছু তাদের মতের সঙ্গে মেলে তাই হয় পরম সত্য। এই ধরনের মানুষরা কখনও নিজেদেরও ভালভাবে বুঝতে পারেন না। আর নিজেকে না বুঝলে মানুষ কখনও জ্ঞান অর্জন বা কুসংস্কারমুক্ত হতে পারে না। অপরের মতামত শোনার সময় আমাদের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটলে, বুঝতে হবে আমরা নিজেরাই কুসংস্কারে ডুবে আছি।

প্রসন্নকুমার এ শিক্ষা লাভ করেছিলেন নিরবচ্ছিন্ন অধ্যয়ন ও পরিপার্শ্ব লক্ষ্য করে। তাঁর বহু বন্ধু বোঝালেন : দেখ, যে কুসংস্কার নিজেদের পরিবার জাতি দেশ বা বাল্যের অভ্যাসের সঙ্গে যুক্ত তা কোন-না-কোনভাবে আমাদের উপকারই করে। প্রসন্নকুমারের উত্তর, “কক্ষনো না, নিজের গুণেই যদি সত্য মঙ্গলজনক হয় এবং মিথ্যা হয় ক্ষতিকর তা হলে প্রতিটি মানুষকে মন খোলা রেখে সব বিষয়ের সম্মুখীন হতে হবে; পূর্বপঠিত স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে সত্যের সম্মুখীন হতে যাওয়া ক্ষতিকর। প্রসন্নকুমারের মতই ছিল ঠিক। সত্যের প্রকাশে যে মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়– সে মন অবশ্যই কুসংস্কারাচ্ছন্ন এই হল দর্শনশাস্ত্রের সর্বোচ্চ শিক্ষা।

এই কাহিনীর নায়ক প্রসন্নকুমার হিন্দু কলেজের গভর্নর হিসাবে সক্রিয় এবং মঙ্গলজনক ভূমিকা নেন। বাংলা শিক্ষা বিভাগের নথিপত্রের মধ্যে আজও অ্যাংলো- বেঙ্গলি স্কুল কলেজের জন্য তাঁর প্রদত্ত পরিকল্পনা ও পাঠ্যপুস্তকের তালিকা পাওয়া যাবে। হিন্দু কলেজের ওপরও সম্পৃক্ত ব্যাপারে একমাত্র বর্ধমানের মহারাজা এবং এই দুই ভাই হরকুমার ও প্রসন্নকুমারের কায়েমী বা স্থায়ী অধিকার ও সুযোগ সুবিধা প্রাপ্য ছিল। এই অধিকার ও সুযোগ সুবিধা ত্যাগ না করলে এবং শিক্ষা বিভাগের হাতে তুলে না দিলে কলেজটির পুনর্গঠন সম্ভব হচ্ছিল না; প্রসন্নকুমার নিঃস্বার্থ দেশাত্মবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়ে হরকুমারের কাছে ঐ অধিকার ও সুযোগ সুবিধা ত্যাগের প্রস্তাব করলে, সেই অনুযায়ী দুই ভাই ঐ কলেজের ওপর তাঁদের সকল অধিকার ছেড়ে দেন। তখন লর্ড ডালহৌসির শাসনকাল। তিনি তাঁর সংক্ষিপ্ত নির্দেশে আদেশ দেন যে, কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের জনহিতৈষণার এই মনোভাব যেন স্থায়ী স্মারকরূপে কলেজেই প্রদর্শিত হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজে একটি মর্মর-ফলক স্থাপন করে মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর এই কাজ সম্পন্ন করেন। ফলকটিতে লেখা আছে :

Erected
To commemorate
The liberality and public spirit of the donors
Whose names are recorded below
Who mainly contributed to
the founding of the
Hindu College.
Now represented by the
Hindu School
and
presidency College

His Highness the Maharaja of Burdwan.
Babu Gopi Mohon Tagore.
Babu Joy Kissan Singh,
Raja Gopi Mohan Dev,
Babu Ganga Narayan Das.

[বর্তমান হিন্দু স্কুল ও প্রেসিডেন্সি কলেজে রূপান্তরিত হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় প্রধান দাতাদের জনহিতৈষণ! স্মরণীয় করবার জন্য এই স্মৃতিফলক স্থাপিত হল। নিচে প্ৰধান দাতাদের নাম দেওয়া হল :

(হিজ হাইনেস) বর্ধমানের মহারাজা। বাবু গোপীমোহন ঠাকুর। বাবু জয়কৃষ্ণ সিংহ। রাজা গোপীমোহন দেব। বাবু গঙ্গানারায়ণ দাস।]

সরকার বা সরকারের শিক্ষা বিভাগেরই এই স্মৃতিফলক স্থাপন করা উচিত ছিল। তাঁরা কেউ এ কর্তব্য সম্পাদনা না করায়, এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন গোপীমোহন ঠাকুরের এক পৌত্র।

প্রসন্নকুমার মেয়েদের স্কুল কলেজে গিয়ে শিক্ষা লাভের পক্ষপাতী ছিলেন না। নিজের মেয়ে ও নাতনীদের তিনি অতি উত্তম ও উচ্চশিক্ষা দিয়েছিলেন, কিন্তু সে হয়েছিল বাড়িতে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করে। তাঁর মতে, মেয়েদের স্কুল কলেজে শিক্ষা লাভ করতে যাওয়া চিরাচরিত বিশ্বাসের বিরোধী, সামাজিক মনোভাবের প্রতি তা আঘাতস্বরূপ এবং ধর্মীয় সংস্কারের পরিপন্থী। মাননীয় মিঃ বেথুনকে লিখিত একখানি সুরচিত পত্রে তিনি তাঁর এই সব মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল যে, এদেশের সমাজের ওপর প্রকাশ্য (অর্থাৎ স্কুল কলেজে) স্ত্রীশিক্ষা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা চলছে, তাঁর আশঙ্কা ছিল এর পরিণাম হবে ভয়াবহ। এ আশঙ্কা ঠিকই ছিল।

প্রবীণ বয়সে তিনি দুখানি পত্রিকা– বাংলায় ‘অনুবাদক’ এবং ইংরেজিতে ‘রিফর্মার’ সম্পাদনা করেন। দুখানিতেই তিনি দেশের, রাজনৈতিক, সামাজিক, আইনকানুন সংক্রান্ত এবং ধর্ম বিষয়ক প্রশাসনে অত্যন্ত ধীরস্থির ভাবে বিচার বিবেচনা করে অগ্রসর হবার প্রবক্তা ছিলেন। প্রতিটি সরকারী বা বেসরকারী তরফ থেকে আসা সংস্কারমূলক প্রস্তাবকে তিনি যুক্তি তর্ক দিয়ে অনেক বিচার বিবেচনার পর তাঁর পত্রিকায় লিখতেন ৷

সরকারের দাবীমত খাজনা দিয়ে কোন ব্যক্তি ভূসম্পত্তি ভোগ করলে বা প্রজাদের নিকট হতে ভূমি রাজস্ব আদায় করলে রাজস্ব কর্তৃপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে যে রায় দিতেন, সে রায়ের বিরুদ্ধে আপীলের দ্রুত বিচার নিষ্পত্তির জন্য ১৮২৮-এর রেগুলেশন ৩ গৃহীত হলে প্রসন্নকুমার দেখলেন যে দ্রুত নিষ্পত্তির নামে আপীল কেসগুলি দেওয়ানী আদালতের এক্তিয়ার হয়ে সরিয়ে নিয়ে বিশেষ কমিশনের হাতে দেওয়া আইনটিতে এমন কতকগুলি ধারা সন্নিবিষ্ট হয়েছে যার দ্বারা লাখেরাজদারদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। (রাজা) রামমোহনের সহযোগিতায় তিনি এই নূতন আইনের বিরুদ্ধে কোর্ট অব ডিরেকটরের কাছে একখানি কড়া প্রতিবাদ-পত্র পাঠালে, কোর্ট ভারত সরকারের কাছে নূতন আইন প্রবর্তনের কারণ জানতে চাইলেন; কোর্টের আশঙ্কা নিরশনের জন্য আইনটির সপক্ষে ভারত সরকার যে ব্যাখ্যা পাঠালেন তাতে এ-ও বলা হল যে, জনগণ এই আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ নন, প্রতিবাদটি মাত্র তিন ব্যক্তি : দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর এবং রামমোহন রায়ের মস্তিষ্কপ্রসূত। ক্ষতিকর আইনটি প্রত্যাহৃত না হলেও, কোর্ট অব ডিরেকটর্স উপলব্ধি করলেন যে, রাজনৈতিক বিষয়ের আলোচনায় ভারতবাসীরাও আর পিছিয়ে নেই।

সতীদাহ প্রথা বিলোপের বিরুদ্ধে কিছু ভারতীয় (হিন্দু নেতা) আপত্তি জানিয়ে প্রিভি কাউন্সিলে যে আবেদন করেছিলেন, ইংল্যান্ডের রাজা সেটি খারিজ করে দেওয়ায় তাঁকে ধন্যবাদ জানাবার জন্য ১৮৩২-এর নভেম্বরে জোড়া-সাঁকোর ব্রাহ্মসমাজ মন্দির প্রাঙ্গণে যে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল তার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন প্রসন্নকুমার ঠাকুর।

১৮৩৭ ও ১৮৩৮-এ বোর্ড অব রেভেনিউ-র তদানীন্তন সচিব মিঃ রস ম্যাঙ্গলস সকল জেলায় একই সঙ্গে লাখেরাজ সম্পত্তি সংক্রান্ত আপীলের শুনানীর জন্য সরকারকে উদ্বুদ্ধ করে জেলায় জেলায় বিশেষ আয়ুক্ত ও বিশেষ সাব-কালেক্টর নিয়োগ করলেন, যাতে আপিলের শুনানি একই সময়ে হতে পারে। এই সকল কাজকে আক্রমণ করে প্রসন্নকুমার বেঙ্গল হরকরায় লিখলেন; মিঃ ম্যাঙ্গও অবশ্য সেগুলির উপযুক্ত জবাব উক্ত পত্রিকায় প্রকাশ করলেন। দুজনেই যোগ্যতার সঙ্গে স্ব স্ব যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়াস পেলেন। জনসাধারণ অবশ্য স্বীকার করলেন যে, প্রসন্নকুমারই এই বিতর্কে জয়ী হয়েছেন।

রাজস্ব কর্তৃপক্ষের অন্যায়, বে-আইনী সিদ্ধান্ত এবং যে পদ্ধতিতে ডিক্রি জারী করে লাখেরাজদারদের ও জোতদারদের কাছে থেকে খাজনা আদায় করা হতে থাকল, তাতে সারা বাংলায় অসন্তোষ ও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ল। তহসিলদাররা সরকারি রাজস্ব আদায়ের নাম করে মহিলাদের নোলক মাকড়ি ও অন্যান্য গহনা আইনী ও বে- আইনীভাবে ছিনিয়ে নিতে লাগল। ১৮৩৯-এর কোন এক সময় বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর ও অন্যান্য কয়েকজন বন্ধু মিলিত হয়ে–(এই অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার জন্য) একটি সভা আহ্বান করলেন– এই সভার কথা এখনও লোকের মনে আছে– তাঁরা এর নাম দিয়েছিলেন লাখেরাজদারদের মহাসম্মেলন। দেশের সকল অংশ থেকে লোকে উদ্যোক্তাদের আহ্বানে সাড়া দিলেন। টাউন হলের একতলায় সভা অনুষ্ঠিত হল– শ্রোতাদের ভিড়ে হল’ উপচে পড়ল- জনতার ভিড়ে চাঁদপাল ঘাট থেকে গভর্নমেন্ট হাউস পর্যন্ত রাজপথ পূর্ণ হয়ে গেল। সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি নির্বাচিত হলেন রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর। সেকালে কলকাতা বার-এর মিঃ লেইথের মতো যে-সকল (বিদেশী) ব্যবহারজীবী জনস্বার্থ বিষয়ক আলোচনায় সক্রিয় অংশ নিতেন, তাঁদের কয়েকজন, বিশেষত মিঃ লেইথ এই আন্দোলনের সমর্থনে চমৎকার একটি বক্তৃতা করেন। সভায় দ্বারকানাথ ঠাকুর বললেন, ‘ভদ্রমহোদয়গণ, যে মুসলমান শাসনকে আমরা বর্বর বলতে অভ্যস্ত, সেই বর্বর শাসকগণ বিভিন্ন সময়ে শিক্ষা ও ধর্ম বিষয়ে উৎসাহ দিতে যে-সব ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন, ভদ্রমহোদয়গণ, সে-সব ব্যবস্থা এই খ্রিস্টীয়ান সরকার, যে-সরকার নিজেকে জগতের সর্বাপেক্ষা সভ্য সরকার বলে দাবী করেন, আজ ছিনিয়ে নিতে চলেছেন।’ তাঁর বক্তৃতা উচ্ছ্বসিত করতালি ধ্বনি দ্বারা অভিনন্দিত হয়। প্রসন্নকুমার এই সভায় বিশেষ কিছু বলেননি; কিন্তু এই আন্দোলন ও সভার প্রধান উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপক ছিলেন তিনি; তাঁরই সুপরিচালনায় সভাটি–সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পেরেছিল। লর্ড অকল্যান্ড বিরাট এক গন্ডগোলের আশঙ্কা করে, সকল ম্যাজিস্ট্রেটকে এই সভায় উপস্থিত থাকতে আদেশ দিয়েছিলেন, ইউরোপীয় ও দেশীয় পুলিশ গভর্নমেন্ট হাউস পর্যন্ত, রাস্তার উভয় পার্শ্বে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর স্বয়ং লর্ড অকল্যান্ড সরকারের সকল বিভাগের সচিবদের সঙ্গে নিয়ে উদ্‌গ্রীব হয়ে সভার সংবাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন– প্রতি আধ ঘণ্টা অন্তর তাঁকে সভার সংবাদ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছিল।

এই মহতী সভার তাৎক্ষণিক ফল হল এই যে, গ্রামের পঞ্চাশ বিঘা অপেক্ষা অল্প পরিমাণ নিষ্কর ভূমির রাজস্ব মওকুফ করা হল।

জনগণের সাংস্কৃতিক মানোন্নয়নের বিষয়েও তিনি উদাসীন ছিলেন না। তাঁর সুরার (শুরার) বাগানে তিনিই প্রথম বাংলায় দেশীয়দের থিয়েটার মঞ্চ স্থাপন করলেন; তাঁর সঙ্গে এতে যোগদান করলেন তাঁরই মতো হিন্দু কলেজের বহু প্রাক্তন ছাত্র। এখানেই প্রথম সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত হল উত্তররাম চরিতের উইলসন কৃত অনুবাদের এবং শেক্সপীয়ারের জুলিয়াস সীজারের। তাঁর দেশীয় ও বিদেশী বন্ধুগণ বিপুল সংখ্যায় এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে ১৮৩১-এর ৩০ ডিসেম্বর তারিখে একোয়ারার লেখে : যে দেশীয় থিয়েটার বিষয়ে কথাবার্তা চলছিল গত বুধবার সেটির উদ্বোধন হয়। প্রথম অভিনয় হয় উত্তররাম চরিতের ডাঃ উইলসন কৃত অনুবাদ নাটকের প্রথম অঙ্কটির, পরে শেক্সপীয়ারের জুলিয়াস সীজার নাটকের পঞ্চম অঙ্কের। প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হয় বাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুরের বাগান বাটীতে। অভিনেতারা সকলেই ছিলেন অপেশাদার– এঁদের অনেকেই হিন্দু কলেজে শিক্ষালাভ করেছিলেন। সুঅভিনয়ে চরিত্রগুলি মূর্ত হয়ে উঠেছিল।….. অনারেবল স্যার এডওয়ার্ড রায়ন, কর্নেল ইয়ং, মেজর বীটসন, মিঃ হেয়ার, মিঃ মেলভিল এবং আরও কয়েকজন পদস্থ ও সভ্রান্ত ইউরোপীয় ভদ্রলোক উপস্থিত ছিলেন। অভিনয় দর্শনে তাঁরা বিশেষ প্রীতি লাভ করেন। তাঁর দৃষ্টান্ত কলকাতার অধিকতর ধনী নাগরিকগণ অনুসরণ করেন, এবং জাতীয় উন্নয়ন ও মুক্তি এবং সুরুচিপূর্ণ আমোদ-প্রমোদের এই মাধ্যমটি বাংলা থেকে মাদ্রাজ, বোম্বাই, পাঞ্চাব এমন কি সিন্ধুদেশেও অনুসৃত হয়।

তাঁর দানও ছিল ব্যাপক তবে সুবিবেচিত। তাঁর স্বগৃহে দৈনিক শতাধিক দরিদ্র মানুষকে খাওয়ানো হত। অন্নের সংস্থান নেই এমন অনেক দরিদ্র ছাত্রও তাঁর বাড়িতে প্রতিদিন খেতে পেত। দরিদ্র হয়ে পড়েছেন এমন কিছু ব্যক্তি ও পরিবারকে তিনি নিয়মিত মাসিক বৃত্তি দিতেন, অনেকের জন্য আবার বার্ষিক বরাদ্দও থাকত ৷

তাঁর পরিজন, পরিচারক-পরিচারিকাদের এবং পোষ্যবর্গের জন্য তিনি বিনাব্যয়ে চিকিৎসারও ব্যবস্থা করেছিলেন; বাইরের লোকও ওষুধ কিনতে পারছেন না জানতে পারলে তার দামও তিনি দিয়ে দিতেন। নেটিভ হাসপাতাল (বর্তমানে মেয়ো হাসপাতাল নামে পরিচিত)-এর তিনি ছিলেন সক্রিয় গভর্নর। তাঁর উদার ও নিঃস্বার্থ দান না পেলে গরাণহাটা শাখা ডিসপেন্সারীটি বহু পূর্বেই লুপ্ত হয়ে যেত, তাহলে স্থানীয় অভাবী অসুস্থ মানুষদের দুর্দশার সীমা পরিসীমা থাকত না। (সংস্কৃত) পন্ডিতবর্গ ও দুঃস্থ শিক্ষিতজনের দুঃখের কাহিনী তিনি ধৈর্য্যের সঙ্গে শুনতেন এবং প্রয়োজনবোধে যথোচিত আর্থিক সাহায্য দিতেন। দূর্গাপূজায় কলকাতার ধনীরা ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের দান-দক্ষিণা ও পার্বনী দিতেন; এটা ছিল রেওয়াজ– এ বিষয়ে তিনি ছিলেন সবার অগ্ৰণী।

তাঁর স্বগৃহে স্থাপিত নিজস্ব গ্রন্থাগারটি সাহিত্য ও আইন-বিষয়ক গ্রন্থে ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সদর আদালতে ও হাইকোর্টের জজগণ প্রয়োজন হলেই এই গ্রন্থাগারের সাহায্য নিতেন। তাছাড়া উপযুক্ত সুপারিশপ্রাপ্ত যোগ্য ছাত্রগণের জন্যও এই গ্রন্থাগারের দ্বার ছিল অবারিত।

নিজের প্রজাদের মঙ্গলের প্রতি এত দৃষ্টি বোধ হয় আর কেউ দেন নি। পত্তনি প্রথার তিনি অত্যন্ত বিরোধী ছিলেন– তাঁর ধারণা ছিল ঐ প্রথায় প্রজারা সাধারণত অত্যাচারিত হয়। প্রায়ই তিনি তাঁর জমিদারী পরিদর্শনে বের হতেন– সেখানে তিনি অতি দরিদ্র দিনমজুরদের সঙ্গে দেখা করে তাদের কথা শুনতেন। জমিদারীর বিভিন্ন স্থানে প্রজাদের মঙ্গলের জন্য তিনি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন; প্রয়োজনে প্রজাদের তিনি ঋণ দিতেন; আর প্রকৃত চাষীদের কারও ওপর খাজনার বোঝা বেশি হচ্ছে বুঝতে পারলে তিনি তার খাজনা হয় কমিয়ে দিতেন, না-হয় মাফ করে দিতেন। তাঁর দেওয়া ঋণ উপযুক্ত ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত দানে পর্যবসিত হত; কিন্তু তিনি যদি বুঝতে পারতেন যে, খাতক মিথ্যা অজুহাত দিচ্ছে বা পরিশোধে সক্ষম হয়েও এড়িয়ে যাচ্ছে, তা হলে টাকা আদায়ের ব্যাপারে তিনি যে উদ্যমের পরিচয় দিতেন তারও তুলনা মেলা ভার। সত্য-সত্যই যারা অভাবী, সৎভাবে পরিশ্রম করে, তাঁদের তিনি ছিলেন পরম উপকারী বন্ধু, কিন্তু অলস অপদার্থগণ তাঁকে শত্রু বলে ভাবত।

একবার তিনি রংপুরে জমিদারী পরিদর্শনে গেছেন; সেখানকার বিশিষ্ট প্রজারা তাঁর সঙ্গে দেখা করে বললেন, হুজুরের মতো এত বড় মান্যগণ্য মানুষের আর কাঠের পাল্কীতে জমিদারিতে ঘোরা শোভা পায় না। প্রসন্নকুমার হেসে উত্তর দিলেন, কী করি বলুন, গরীব ব্রাহ্মণ আমি, চাঁদির পাল্কী পাব কোথায়। অমনি প্রজারা চাঁদা তুলতে লাগলেন; রূপোর পাল্কী গড়াবার মতো টাকা তুলে তাকে দিতে এলে, তাঁদের অনেক অনুরোধ উপরোধ করে বোঝালেন, গ্রামাঞ্চলে চাঁদির পাল্কী উপযোগী নয়; তাছাড়া তিনি চাঁদির পাল্কী ব্যবহার করতেও চান না, কাজেই তাঁরা যেন যাঁর যাঁর টাকা ফেরৎ নিয়ে যান!

দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়া জেলায় তাঁর জমিদারী ছিল। এইসব জেলায় অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের উন্নতির জন্য করতোয়া নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তিনি লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করেন; তাঁরই উদ্যোগে ১৮৫৬-র ১২নং আইন গৃহীত হয় উক্ত নদীর নাব্যতা বাড়াবার জন্য। তাঁর কাজ পরীক্ষা করে দেখতে কলিকাতা ও ইস্টার্ন ক্যানাসের একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার বগুড়ায় প্রেরিত হয়েছিলেন; ১৮৬৩-র ১৩ মে তিনি রিপোর্ট দিলেন, নদীটিকে সারা বছর নাব্য রাখবার জন্য বাবু যে চেষ্টা করেছেন, সত্যই তা প্রশংসার্হ। তাঁর কৃতিত্ব এইখানে যে বহুবার ব্যর্থ হয়েও তিনি অধ্যবসায়ের সঙ্গে আবদ্ধ কাজ সম্পন্ন করেছেন। নদীর দু’পাশের বালুময় মৃত্তিকার জন্য অবশ্য শেষ পর্যন্ত তাঁর এই প্রকল্প ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

লর্ড ডালহৌসির নেতৃত্বে লেজিসলেটিভ কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া গঠিত হলে তিনি প্রসন্নকুমারকে উক্ত সংস্থার ক্লার্ক অ্যাসিসটেন্টের পদ গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান। প্রসন্নকুমার সানন্দে বড়লাট বাহাদুরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁর সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা, দেশের আইনকানুন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান, বিশেষত দেশবাসীর চরিত্রগঠনে ও উন্নতিবিধানে কিরূপ আইন কিভাবে প্রয়োগ হওয়া উচিত সে সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা দিয়ে উক্ত সংস্থাকে সাহায্য করতে অগ্রসর হন। ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলগুলিতে একই ধরনের আইনকানুন প্রচলিত করতে লন্ডনস্থ রয়্যাল কমিশন এ-বিষয়ে যে-সকল পরিকল্পনা ও সুপারিশ পেশ করেন, সেগুলি পর্যালোচনা করে কার্যে পরিণত করবার জন্য ভারতীয় লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের একটি কমিটি গঠন করা হয়; এই কমিটির প্রতিবেদনে অন্যান্য কথার মধ্যে মন্তব্য করা হয় : ক্লার্ক অ্যাসিস্টেন্টের বিস্তৃত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা এবং অদম্য কর্মোদ্যমের জন্য কমিটি অসাধারণভাবে উপকৃত হয়েছেন, এবং কমিটি তাঁর ঋণ স্বীকার করছেন। পেনাল কোর্ড সুবিন্যস্ত করার কাজে তিনি এককভাবে এবং কোডের দেশীয় ভাষায় অনুবাদের কাজে অন্যান্য কয়েকজন প্রাচ্য পন্ডিতের সঙ্গে স্যার বার্নেস পীকক ও তাঁর সহকর্মীদের সাহায্য করেন। তিনিই প্রথম বাঙালী (তথা ভারতবাসী) যাঁকে ভাইসরয়ের লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য হবার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল; দূর্ভাগ্যবশত তিনি তখন অত্যন্ত অসুস্থ, এজন্য এই আমন্ত্রণ তাঁর বা ভারতের কোন উপকারে আসে নি। তবে, বাংলার লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর প্রচুর; কাউন্সিলের তদানীন্তন কার্যবিবরণীতে তাঁর যুক্তিপূর্ণ বিতর্ক, পরিষ্কার চিন্তাশক্তি ও দেশাত্মবোধের বহু বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। আইন বিষয়ক তাঁর কার্যাবলী তো অমূল্য।

ইউরোপীয় বা ভারতীয় যিনিই আইন বিষয়ে তাঁর পরামর্শ চাইতেন তিনি আগ্রহের সঙ্গে এবং বিনা পারিশ্রমিকেই পরামর্শ দিতেন। তাঁর স্মরণশক্তি ছিল বিস্ময়কর। কারও কোন পূর্ব নজিরের বা ঐতিহাসিক কোন ঘটনার বিবরণ প্রয়োজন হলে, তিনি শুধু সংশ্লিষ্ট বই নয়, তার কোন পৃষ্ঠায় সেটি আছে তাও বলে দিতেন।

মহারাজা গোলাব (গুলাব) সিংহের কাশ্মীর শাসনকালে তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ভ্রমণ করেন। মহারাজা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলে, প্রসন্নকুমার এই শর্তে রাজি হন যে, তিনি মহারাজাকে কোন নজরানা দেবেন না এবং মহারাজাও তাঁকে কোন খেলাৎ দেবেন না। (মহারাজা তাঁর শর্তে রাজি হয়ে যাওয়ায়) তিনি কাশ্মীরে পঁচিশ দিন অতিবাহিত করেন। এই সময় প্রায়ই তাঁর মহারাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ হত; প্রয়োজনে মহারাজাকে তিনি মূল্যবান পরামর্শও দিতেন। বিদায় নেবার সময় তিনি মহারাজাকে বললেন, ‘মহারাজার কাজে লাগতে পারে, দেবার মতো এমন কোন উপহার আমার নেই, বা আমার কোন কাজে লাগতে পারে এমন কোন উপহার আমার নেই, বা আমার কোন কাজে লাগতে পারে এমন কোন উপহারও মহারাজা আমাকে দিতে পারবেন না। কিন্তু দূরবীন যন্ত্র দূরবর্তী বস্তুকে নিকটবর্তী করে দেখায় আমিও সেইভাবে মহারাজাকে কিছু স্মারক দ্রব্য দিতে চাই, যাতে কখনও কখনও আমার কথা মহারাজের মনে পড়তে পারে।’ তাঁর এই মন্তব্য ও উপহার দুয়েতেই মহারাজা খুব খুশি হয়েছিলেন।

উইল দ্বারা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ঠাকুর আইন অধ্যাপক পদ, তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কীর্তিগুলির অন্যতম। এই কাজটির জন্য লোকে তাঁকে যুগ যুগ ধরে স্মরণ করবে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত এই পদের অধিকারিগণের বক্তৃতাসমূহের বিশেষ মূল্য আছে। তবু বলতে হয় যে, তাঁর সমগ্র জীবনটিই ছিল এইরূপ গুরুত্বপূর্ণ কাজের সমষ্টি। সরকার কর্তৃক ব্যাঙ্ক স্ট্র্যান্ড রোড এলাকা অধিগ্রহণ এবং শ্মশানঘাট তুলে দেবার সরকারি উদ্যোগের বিরোধী আন্দোলনে তিনি সফল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত কলকাতার উন্নতির জন্য তিনি সর্বদাই সচেষ্ট ছিলেন। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। রাজা রাধাকান্ত দেবের পর তিনিই হন সংগঠনটির সভাপতি। মূলাজোড়ে তাঁর পিতার ধর্মীয় দানের সঙ্গে তিনি স্থায়ী আমানত স্থাপন করে সেখানে একটি সংস্কৃত বিদ্যালয় স্থাপন করেন; আজও এই বিদ্যালয়ে অধ্যাপকগণ ব্যাকরণ, ছন্দঃ, ন্যায় ও স্মৃতি শিক্ষা দিচ্ছেন। এই প্রসঙ্গে এখানে তাঁর কয়েকটি দানের দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় :
টাকা
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঠাকুর আইন অধ্যাপক পদের জন্য ৩,০০,০০০
জেলা দাতব্য সমিতিকে ১০,০০০
‘নেটিভ’ হাসপাতালকে ১০,০০০
মূলাজোড় সংস্কৃত বিদ্যালয়ের গৃহনির্মাণ কল্পে ৩৫,০০০
মূলাজোড় দাতব্য চিকিৎসালয় প্রভৃতির জন্য ১,০০,০০০
নির্ভরশীল আত্মীয়পরিজন ও পোষ্যদের জন্য ১,০৯,০০০
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঠাকুর আইন অধ্যাপক পদের জন্য ১,০৬,০০০
জমিদারির ও অন্যান্য বিভাগের কর্মচারী ও গৃহভৃত্যদিগকে ৩,০০,০০০
মোট ৬,৭০,০০০


ভিতরে বাহিরে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যখন বিপন্ন হয়ে পড়েছিল, সেই সিপাহী বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ রাজের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য যে প্রদর্শনী করা হয়েছিল, তার উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অগ্রণী। ১৮৬১ ও ১৮৬৬-র দুর্ভিক্ষের সময় আর্ত মানুষের ত্রাণের জন্য উদার দান নিয়ে তিনিই সর্বাগ্রে এগিয়ে এসেছিলেন; বার বার যাতে এমন দুর্বিপাক না হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় সৎপরামর্শও তিনি দিয়েছিলেন।

তাঁর সম্পর্কে আর একটি ঘটনার বিবরণ দিয়ে আমরা এই প্রসঙ্গ শেষ করব। ১৮৬৫-তে রেওয়ার মহারাজা প্রাসাদপুরী কলকাতা এলে আমাদের নায়ক নিজ প্রাসাদে তাঁকে তাঁর পদমর্যাদায় এবং প্রসন্নকুমারের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক যোগ্যতার উপযোগী বিপুল এক সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন। মহারাজার জন্য নির্মিত জরি বসান মসনদের পাশে মণিমুক্তা খচিত হাতলযুক্ত একখানি তলোয়ার রাখা হয়েছিল। সেখানি দেখে, রেওয়ার মহারাজা হেসে জিগেস করলেন, ‘বাঙালীরা কি এখনও তলোয়ার ব্যবহার করেন?’ তাৎক্ষণিক উত্তরে প্রসন্নকুমার বললেন, “না মহারাজা, অনেকদিন হল বাঙালিরা তলোয়ারের বদলে কলম ব্যবহার করছেন; ইংরেজ রাজের সুশাসনের জন্য তলোয়ার ব্যবহারের প্রয়োজনও আর আমাদের নেই। তলোয়ারটি এখানে রাখা হয়েছে আমাদের আদর্শ স্থানীয় পূর্বপুরুষদের বিশেষত হলায়ুধের, স্মারক হিসাবে। মহারাজতো জানেন, হলায়ুধ ছিলেন বাঙলার শেষ রাজা লক্ষণ সেনের প্রধানমন্ত্রী,” এর থেকে প্রসন্নকুমারের স্বভাবসিদ্ধ সৌজন্যবোধ এবং সপ্রতিভতার একটি ভাল দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

প্রসন্নকুমার তাঁর মনন, যৌক্তিকতাপূর্ণ বাগ্মিতা এবং নেতৃত্বের যোগ্য মনীষার জন্য বাঙলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অন্যতম হিসাবে অবশ্যই গণ্য হবেন। মহামান্যা মহারাণীর সরকার তাঁর সম্পর্কে যে শ্রদ্ধা পোষণ করতেন, তার প্রতীক হিসাবে ১৮৬৬-র ৩০ এপ্রিল তাঁকে “দি কমপ্যানিয়নশিপ অব দি মোস্ট এক্জটেড অর্ডার অব দি স্টার অব ইন্ডিয়া’ খেতাব দ্বারা সম্মানিত করা হয়। (দ্রষ্টব্য : ওরিয়েনটাল মিসেলিনি সংখ্যা ১৯, অক্টোবর ১৮৮০– প্রসন্নকুমার ঠাকুর সম্পর্কিত বিবরণ)। প্রসন্নকুমার ছিলেন সেই সামান্য সংখ্যক হিন্দুদের অন্যতম যাঁরা ছিলেন ইউরোপীয় ও ভারতীয়দের মধ্যে সামাজিক মেলামেশার পক্ষপাতী। কোন না কোন উচ্চপদস্থ ইউরোপীয় বা অন্য মাননীয় ইউরোপীয়কে তাঁর সঙ্গে আহারের জন্য তিনি নিমন্ত্রণ না করতেন, এমন দিন ছিল না। বেলজিয়ামের বর্তমান রাজা লিওপোল্ড ২য়, তখন ডিউক অব ব্র্যাবান্ট, কলকাতা দর্শনে এসে প্রসন্নকুমারের অতিথি হয়েছিলেন। ১৮৬৮-র ৩০ আগস্ট প্রসন্নকুমারের মৃত্যু হয়; তাঁর মৃত্যুতে তাঁর বন্ধুবর্গ এবং গুণমুগ্ধ ব্যক্তিগণ শোকসাগরে নিমগ্ন হন।

গণেন্দ্রমোহন : প্রসন্নকুমারের একমাত্র পুত্র গণেন্দ্র খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি বাঙালীদের মধ্যে প্রথম ব্যারিস্টার। সাধারণত ইংল্যান্ডেই তিনি বসবাস করেন।

হরিমোহন : দর্পনারায়ণের চতুর্থ পুত্র হরিমোহন ইংরেজিতে কৃতবিদ্য ছিলেন। ধর্মীয় নিষ্ঠার জন্য তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর একমাত্র পুত্র উমানন্দন (ওরফে, নন্দলাল) ছিলেন এক্সপোর্ট ওয়েরহাউসের দেওয়ান। উমানন্দনের পুত্র উপেন্দ্রমোহন এখন এই পরিবারের কর্তা।

পিয়ারীমোহন : দর্পনারায়ণের পঞ্চম পুত্র। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন।

লাড্‌লিমোহন : দর্পনারায়ণের ষষ্ঠ পুত্র। তাঁর এই দুই পুত্র, হরলাল ও শ্যামলাল। হরলালের পুত্র ত্রৈলোক্যমোহনের পুত্রসন্তান ছিল না।

মোহিনীমোহন : দর্পনারায়ণের সপ্তম পুত্র। বিষয়কর্মে পারদর্শী মোহিনীমোহন পৈতৃক সম্পত্তি বহুলাংশে বৃদ্ধি করেন। নূতন সম্পত্তির মধ্যে বাখরগঞ্জ জেলার এদিলপুর পরগণার জমিদারিটিও ছিল। নিলামে তিনি জমিদারিটির জন্য সকল ভাইয়ের যৌথ নামে ডাক দেন; কিন্তু তাঁরা এই জমিদারি কিনতে রাজি না হওয়ায়, জমিদারিটি শেষ পর্যন্ত তাঁর নামে বর্তায়। এই জমিদারির জন্য তিনি বহু মামলায় জড়িয়ে পড়েন। যা হক, এই সব মামলায় শেষ পর্যন্ত তিনিই জয়ী হন। কিন্তু বেশি দিন তিনি এই সম্পত্তি ভোগ করতে পারেন নি। প্রায় ত্রিশ বছর বয়সের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তিনি তাঁর দুই নাবালক পুত্র, নয় বছরের কানাইলাল এবং পাঁচ বছরের গোপাললালেরও বিপুল সম্পত্তির দায়িত্ব অর্পণ করেন তাঁর সহোদর ভাই লাড্‌লিমোহনের হাতে। লাড্‌লিমোহন তাঁর ওপর অর্পিত এই পবিত্র দায়িত্ব বিশেষ সততা ও যোগ্যতার সঙ্গে সম্পাদন করেন। সাবালক হয়ে কানাইলাল বর্ধিত খাজনা সহ অটুট পৈতৃক সম্পত্তি এবং জমানো বিপুল অর্থ লাভ করেন।

কানাইলাল ছিলেন অমিতব্যয়ী। অল্পকালের মধ্যেই তিনি সমস্ত পৈতৃক সম্পত্তি বিপন্ন করে ফেললে দুই ভাইয়ের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই সময় গোপাললাল যে ভ্রাতৃপ্রেমের আদর্শ স্থাপন করেন, আজকের অধঃপাতের দিনে লোকে হয়তো তাকে ভাব-বিলাস বলে গণ্য করবেন। সম্পত্তি ভাগ করবার সময়, তিনি জ্যেষ্ঠের ঋণের অর্ধেকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিশেষ সততার সঙ্গে এবং নিয়মিত ভাবে তিনি এই ঋণ পরিশোধ করেন। তাঁর দয়া ও সহানুভূতি ভ্রাতৃপ্রেমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বিপদে পড়ে কেউ তাঁর সাহায্যে চাইলে–সে অর্থ বা পরামর্শ যাই হোক, তিনি উদারভাবে সারাজীবন অর্থী প্রত্যর্থীদের সাহায্য করেছেন।

বাবু কালীকিষেণ : গোপাললালের পুত্র কালীকিষেণের জন্ম হয় আনুমানিক ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে। বাংলার অভিজাত ও ভদ্রপরিবারসমূহের হ্যাঁরো হিন্দু কলেজেই তাঁর শিক্ষা আরম্ভ হয়। কিন্তু উক্ত প্রতিষ্ঠানে মুসলমান বাঈজীর পুত্র ভর্তি হওয়ায়, তাঁকে হিন্দু কলেজ থেকে ছাড়িয়ে এনে, ওরিয়েন্টাল সেমিনারীতে ভর্তি করা হয়; এখানে তিনি অতি অল্প সময় শিক্ষালাভ করেন। এরপর তাঁকে ভর্তি করা হয় ডাভটন কলেজে। কিন্তু খারাপ স্বাস্থ্যের জন্য এই প্রতিষ্ঠানও তাঁকে ছাড়তে হয়। তখন সেযুগের শ্রেষ্ঠ ইউরোপীয় পণ্ডিতদের গৃহশিক্ষকতায় তাঁর শিক্ষা পরিচালিত হতে থাকে। অধ্যয়নশীল কালীকিষেণ লেখাপড়ায় কঠোর পরিশ্রম করতে থাকেন। এতে তাঁর স্বাস্থ্য আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকায়, তিনি কম পরিশ্রমসাধ্য জমিদারী সেরেস্তার কাজ দেখতে আরম্ভ করেন। জমিদারী বিস্তৃত, কিন্তু এ বিষয়ে তিনি বিশেষ শিক্ষা ও সহায়তা লাভ করেন তাঁদের আত্মীয় মদনমোহন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। বাখরগঞ্জ জেলার এদিলপুর ও অন্যান্য পরগণার হিসাব নিকাশ পরিচালনা করেই, তাঁর অধিকাংশ সময় ব্যয়িত হয়। ফল আশানুরূপই হয়েছে। তাঁর জমিদারীর প্রজাসাধারণ তাঁর কাছে যে সহানুভূতিপূর্ণ ও সহৃদয় ব্যবহার পেয়ে থাকেন, বাংলার অতি সুপরিচালিত জমিদারীগুলিতেও তা প্রায় দুর্লভ।

তাঁর পুত্রের বিবাহের সময়, বাবু কালীকিষেণ প্রচুর দান করেন। তাছাড়া অভাবী মানুষদের দারিদ্র্যমোচনে তিনি উদারহস্তে দান করে থাকেন। তাঁরই দয়া লাভ করে বহুসংখ্যক দরিদ্র ছাত্র শিক্ষা লাভ করেছেন, যাতে ভবিষ্যতে তাঁরা নিজেদের ও পরিবার পরিজনের ভরণপোষণ করতে পারেন। এখন, যত দিন যাচ্ছে, গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করাই কঠিন হয়ে পড়েছে; এই সময় ছাত্রদের শিক্ষালাভে সহায়তা করে তিনি তাদের এবং সাধারণভাবে বহু পরিবারের অশেষ উপকার করছেন।

ছোট তরফ

ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, জয়রামের কনিষ্ঠ পুত্র নীলমণির বংশকেই বলা হয় ছোট তরফ। নীলমণি ঠাকুরের পাঁচ পুত্র; রামতনু, রামরত্ন, রামলোচন, রামমণি এবং রামবল্লভ। রামমণির তিন পুত্রের মধ্যে মধ্যমপুত্র দ্বারকানাথ ঠাকুরকে তাঁর অপুত্রক জ্যেঠামশায় রামলোচন ঠাকুর দত্তক নেন। কনিষ্ঠ পুত্রের নাম ছিল রমানাথ ঠাকুর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *