বিজলী পালোয়ান

বিজলী পালোয়ান

বিজলী পালোয়ানের ব্যাপারে অনেক গল্প লোকের মুখে মুখে ফিরত। তার আক্রমণের গতি নাকি সাঙ্ঘাতিক! শত্রুপক্ষের কিছু বুঝতে পারার আগেই সে নাকি বিদ্যুৎবেগে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত!

আমি তাকে প্রথম দেখি মুঘল বাজারে। তাকে দেখে আমার মনে হল নিতান্তই গোবেচারা, শান্তশিষ্ট একটা লোক। থলথলে ভুঁড়ি, শিথিল চেহারা, গাল দুটো ঝুলে পড়েছে। গায়ের রং অবশ্য টকটকে ফর্সা।

মুঘল বাজারের একটা কাপড়ের দোকানে সে বাবু হয়ে বসেছিল।

ভালো করে তার দিকে তাকালাম। তাকে দেখে কোনোদিক থেকেই গুন্ডা বলে মনে হল না। যদিও লোকে বলত, বিজলী পালোয়ান নাকি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় গুন্ডা!

আমি সামনের একটা বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে থাকলাম।

কিছুক্ষণের মধ্যে দেখলাম, এক মুসলমান মহিলা হেঁটে আসছে। গরীব দুঃস্থ চেহারা। কাপড়ের দোকানে গিয়ে সে জিগ্যেস করল, ‘বিজলী পালোয়ান সাহেবের সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।’

বিজলী পালোয়ান হাতজোড় করে নমস্কার করে বলল, ‘মা, আমিই বিজলী পালোয়ান।’

মহিলা তাকে সালাম করল, ‘আল্লাহ তোমার ভালো করুন। শুনেছি তুমি বড় দয়ালু! আমার উপর দয়া কর, বাবা।’

বিজলী পালোয়ান দার্শনিকের মতো বলল, ‘মা, দয়ালু তো ওই উনি!…পরমেশ্বর!…আমি কিছুই না।…যাইহোক…তোমার কী দরকার?…আমি তোমার কী সেবা করতে পারি?’

‘বাবা, আমার মেয়ের বিয়ে দিতে হবে…একটু কিছু সাহায্য কর!…আমার খরচ করার মতো অবস্থা নেই…’

‘কত টাকা লাগবে?’

‘বাবা, তোমার যা মনে হয়!…আমি তো ভিক্ষা চাইতে এসেছি…যা মনে হয় দাও।’

‘মা! ভিক্ষা চেও না। আমার এটা কর্তব্য!’

বলে বিজলী কাপড়ের দোকানের মালিকের দিকে তাকাল, ‘লালাজি, দু’হাজার টাকা দিয়ে দিন।’

লালাজি তৎক্ষণাৎ দু’হাজার টাকা সিন্দুক থেকে বার করে বিজলী পালোয়ানের হাতে দিল।

বিজলী পালোয়ান মহিলার হাতে টাকাটা তুলে দিয়ে বলল, ‘ঈশ্বর করুন, তোমার মেয়ের বিয়ে যেন ভালোয় ভালোয় হয়ে যায়!’

মহিলা কিছুক্ষণ টাকাগুলো হাতে নিয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। সে ভাবতে পারেনি, এতগুলো টাকা পেয়ে যাবে! একটু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে সে ধরা গলায় বিজলী পালোয়ানকে আশীর্বাদে আশীর্বাদে ভরিয়ে দিল।

দেখলাম, বিজলী পালোয়ান যেন একটু অস্বস্তিবোধ করছে! শেষে সে মহিলাকে বলল, ‘মা, আমায় লজ্জা দিও না!…তুমি বরং মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা কর…তাকে আমার বুকভরা আশীর্বাদ জানিও, মা!’

আমিও যারপরনাই অবাক হলাম। এ কেমন গুন্ডা যে অচেনা অজানা একজন মুসলমান মহিলাকে এক কথায় দু’হাজার টাকা ধরিয়ে দেয়! পরে শুনলাম, সে নাকি প্রচুর দানধ্যান করে থাকে।

আমার তার ব্যাপারে অসম্ভব কৌতূহল জাগল। আমি খোঁজখবর নিতে শুরু করলাম। কিছু দিনের মধ্যেই তার সম্বন্ধে বেশ কিছু খবর জোগাড়ও করে ফেললাম।

মুঘল বাজারের বেশিরভাগ দোকানই তার হাতে। মিষ্টির দোকান, কাপড়ের দোকান, শরবতের দোকান, পানের দোকান—মোটামুটি বাজারের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত অবধি! একটা লাইন অফ কমিউনিকেশন তৈরি করে রাখা ছিল যাতে পুলিশ এলে সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে খবর পৌঁছে যায়।

বিজলীর নিজের দুটো ঠেক ছিল। কাপড়ের দোকানের ঠিক মুখোমুখি। তাতে সারাক্ষণই জুয়ার আসর চলত। ফলে সেখান থেকে দিনে তার কয়েক হাজার টাকা আয় হত।

সে নিজে মদও খেত না, জুয়াও খেলত না। কিন্তু তার ঠেকে সবসময়ই মদ পাওয়া যেত। মদ বিক্রি করেও তার অনেক টাকা আমদানি হত।

শহরের সমস্ত বড় বড় গুন্ডাকে সে হপ্তায় হপ্তায় টাকা দিত। অনেকটা বেতনের মতো। আমার ধারণা, এই ব্যবস্থা সে করে রেখেছিল যাতে তার কাজে কোনো বাধা না আসে।

যদ্দূর মনে পড়ে, এই গুন্ডাদের প্রায় সকলেই মুসলমান। হাতি-দরজার কাছে তাদের ডেরা। প্রত্যেক সপ্তাহে তারা এসে বিজলীর কাছ থেকে টাকা উসুল করে নিয়ে যেত। বিজলী পালোয়ান কাউকে কখনো খালি হাতে ফেরাত না। কারণ তার টাকার কোনো অভাব ছিল না।

একদিন আরেকটা গল্প শুনলাম। বিজলী নাকি কাপড়ের দোকানে বসেছিল, এমন সময় এক ধনী হিন্দু বেনে তার কাছে যায়।

‘পালোয়ানজি!…আমার ছেলেটা বখে গেছে!…ওকে ঠিক রাস্তায় এনে দিন, সর্দার!’

বিজলী পালোয়ান মুচকি হেসে বলল, ‘আমার দু’ছেলে। নম্র, ভদ্র। লোকে আমায় গুন্ডা-বদমাশ বলে ঠিকই, কিন্তু আমি আমার ছেলেদের মধ্যে আমার কাজকর্মের কোনো প্রভাব পড়তে দিইনি। তাদের এমনভাবে মানুষ করেছি যাতে তারা কখনো কোনো খারাপ কাজ না করে!…মশাই! এ আপনার দোষ। ছেলের না।’

বেনে কাঁচুমাচু মুখে হাতজোড় করল, ‘পালোয়ানজি! আমিও ওকে ভালো শিক্ষা দিয়েই মানুষ করেছি, বিশ্বাস করুন! তাও লুকিয়ে লুকিয়ে উল্টোপাল্টা জিনিস করতে শুরু করেছে। আগে জানতাম না। এই ক’দিন হল জানতে পেরেছি।’

বিজলী পালোয়ান রায় দিল, ‘বিয়ে দিয়ে দিন।’

এই ঘটনার দিন দশেক পরেই জানলাম, বিজলী পালোয়ান নাকি প্রেমে পড়েছে! তার সম্বন্ধে এরকম খবর অকল্পনীয়!

মেয়েটার বয়স ষোলো কি সতেরো। বিজলীর বয়স পঞ্চাশের উপর। কিন্তু অঢেল টাকা থাকায় মেয়ের বাবা-মা তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেল। যথাসময়ে বিয়ে হয়েও গেল।

বিজলী পালোয়ানের একটা বিশাল বাড়ি ছিল শহরের বাইরের দিকে। প্রাসাদের মতো। নতুন বউকে নিয়ে সে সেখানে উঠল। তার মনে হল যেন প্রাসাদের সব ঝাড়-লণ্ঠন নতুন বউয়ের রূপের কাছে ম্লান হয়ে গেছে!

তার বউ ছিল অপরূপা।

প্রথম রাতে চেয়েও বিজলী পালোয়ান বিশেষ কিছু করতে পারল না। তার মাথার মধ্যে প্রথম বউয়ের স্মৃতি যেন দমকে দমকে ফিরে আসতে লাগল।…তার প্রথম পক্ষের দুই ছেলেও সেই একই বাড়িতে থাকত। তারা তখন নিজেদের ঘরেই ঘুমিয়ে ছিল। বা হয়তো জেগে ছিল।…

প্রথম বউকে সে ক’দিন আগেই বাইরে কোথাও একটা পাঠিয়ে দিয়েছিল। সে বেচারি কিছুই জানত না যে তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করছে।

প্রথম রাতটা শুধু এই ভেবে ভেবেই তার কেটে গেল,—প্রথমজনকে কি তার জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল?

সারারাত ধরে ষোলো-সতেরো বছর বয়সি নতুন বউ বিশাল পালঙ্কে বসে বিজলী পালোয়ানের আবোলতাবোল কথা শুনে গেল।

সে বুঝতে পারছিল না, এ কেমন বিয়ে! রোজ রাতেই কি তাকে এরকম উৎপটাং কথা শুনতে হবে?

‘কাল তোমার জন্য দশ হাজার টাকার গয়না কিনে আনব!…’

‘তুমি বড্ড সুন্দর!…’

‘বরফি খাবে না পেঁড়া?…’

‘এই বাড়িটা আমি তোমার নামে লিখে দেব…’

‘ক’জন দাসদাসী চাই তোমার? আমায় বলো। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।…’

‘আমার দুটো ছেলে আছে…জোয়ান বয়স। যা চাও ওদের বলবে। ওরা তোমার সব কথা শুনে চলবে।…’

ছ’মাস ধরে বউ এসবই শুনল। রোজ রাতে।

এই ক’মাসে বিজলী পালোয়ান তার প্রেমে আরো পাগল হয়ে গেল। তার ধারালো সুন্দর চোখমুখ দেখলেই সে নিজের পালোয়ানি ভুলে যেত।

তার প্রথম বউ দেখতে ভালো ছিল না। তার মধ্যে কোনওরকম আকর্ষণই ছিল না। সে আর পাঁচটা সাধারণ মহিলার মতোই। একটা বাচ্চা হতেই বুড়িয়ে গেছিল। এদিকে দ্বিতীয় বউ ছিল ছিপছিপে, দোহারা। বিজলীর মনে হত, দশটা বাচ্চা হয়ে গেলেও তার শরীর বোধহয় এরকমই থাকবে। এইসব ভেবে সে ক’দিন ধরেই এক বদ্যির কাছে যাচ্ছিল। বদ্যি তার বন্ধু। বন্ধু তাকে বলল, ‘চিন্তা নেই! সব ঠিক হয়ে যাবে।’

বিজলী পালোয়ানও শুনে খুশি।

একদিন বদ্যির বাড়ি থেকে ফেরার পথে সে উৎফুল্ল মনে প্ল্যান ঠিক করল। প্রথমে গিয়ে মিষ্টি কিনল। তারপর দুটো সোনার বালা নিল, আর বারোটা শালওয়ার-কামিজের জন্য উৎকৃষ্ট মানের থান কিনল। এইসব করে প্রায় সন্ধে সাতটায় সে বাড়ি পৌঁছল। ঘরে গিয়ে দেখল, দ্বিতীয় বউ সেখানে নেই।

সে ভাবল, স্নান করতে গেছে হয়তো!

সব জিনিসপত্র পালঙ্কের উপর রেখে সে স্নানঘরের দিকে গেল। কিন্তু সেও খালি!

সে বেশ অবাক হল। কোথায় যেতে পারে!…অনেক ভেবেও সে কিছু ঠাহর করতে পারল না।

বদ্যির দেওয়া পুরিয়া মুখে নিয়ে সে পালঙ্কে বসে পড়ল। ভাবল, ‘বউ চলেই তো আসবে! অপেক্ষা করাই ভালো।’

ওষুধ শেষ করে সে কামিজের কাপড়গুলো ঘষে ঘষে দেখতে লাগল। হঠাৎ তার কানে এল তার বউয়ের হাসির আওয়াজ।

সে চমকে উঠল। তারপর উঠে হাঁটতে শুরু করল যেদিক থেকে আওয়াজ আসছিল। আরেকটা ঘরের সামনে গিয়ে সে থামল। ভিতর থেকে তার বড় ছেলে আর নতুন বউয়ের উচ্চকণ্ঠে হাসির আওয়াজ আসছে।

সে দরজার কড়া নাড়ল। কেউ দরজা খুলল না।

সে চিৎকার করতে আরম্ভ করল, ‘দরজা খোলো! দরজা খোলো!’

তার রক্ত তখন টগবগ করে ফুটছে!

তবুও দরজা খুলল না। ঘরের ভিতরে এমন নিস্তব্ধতা যেন তার বড় ছেলে আর তার ষোলো-সতেরো বছর বয়সি বউ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফেলছে না!

সে নিজের ঘরে ফিরে এল। একটা কাগজের উপর গুরুমুখীতে লিখল যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘এই বাড়ি এখন তোমার। আমার বউও তোমার। সুখে থেকো। কিছু উপহার এনেছিলাম, সেগুলো রেখে যাচ্ছি।’

লিখে সে সাটিনের থানের সঙ্গে সেটা সেলাই করে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *