মোজেল

মোজেল

চার বছরে প্রথমবার ত্রিলোচন আকাশ দেখল। রাতের আকাশ। চিন্তায় ছটফট করতে করতে ঘরের মধ্যে তার প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তাই খোলা হাওয়ায় শ্বাস নেওয়ার জন্য সে চার বছরে প্রথমবার আডবাণী চেম্বার্স-এর ছাদে উঠল।

আকাশ পরিষ্কার। ছিটেফোঁটাও মেঘ নেই। যেন ধূসর চাদরে পুরো বোম্বে শহর ঢেকে আছে! দূর পর্যন্ত বিভিন্ন দিকে আলো দেখা যাচ্ছে। ত্রিলোচনের মনে হল যেন আকাশ থেকে নক্ষত্র ঝরে বড় বড় গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বিল্ডিংগুলোয় আটকে গেছে। রাতে খোলা আকাশ দেখা তার জীবনের এক নতুন অভিজ্ঞতা। চার বছর ধরে নিজের ফ্ল্যাটের খুপরিতে আবদ্ধ হয়ে সে কত কিছু থেকেই না বঞ্চিত থেকেছে!

ভোর তখন প্রায় তিনটে বাজে। অল্পস্বল্প হাওয়া দিচ্ছে।

ত্রিলোচন যান্ত্রিক পাখার হাওয়ায় অভ্যস্ত ছিল। পাখা চললেই তার শরীর যেন বিষম ভারী হয়ে উঠত। সকালে উঠেই তার মনে হত যেন কেউ তাকে সারারাত ধরে পিটিয়েছে। প্রথমবার রাতের এই প্রাকৃতিক হাওয়ায় তার সমস্ত শরীর জুড়িয়ে গেল। উপরে আসার আগে যে অশান্তি তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, তা খোলা আকাশের নীচে হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা কমে গেল।

তখন সে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে শুরু করল।

কৃপাল কৌর আর তার বাপ-মা একটা কট্টর মুসলমান এলাকায় থাকে। সেখানে অনেক বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক মাথা কাটা পড়েছে। পারলে ত্রিলোচন তক্ষুনি গিয়ে কৃপালদের সবাইকে নিজের বাড়িতে নিয়ে চলে আসত; কিন্তু তখন কার্ফু চলছে! কতক্ষণের তাও সে ঠিক করে জানে না। বোধহয় আটচল্লিশ ঘণ্টার। ত্রিলোচন নিতান্ত অসহায় বোধ করতে লাগল।

ওই পাড়ায় বেশ ভয়ঙ্কর মুসলমানেরা থাকে। ওদিকে পাঞ্জাব থেকে ক্রমাগত খবর আসছে যে শিখেরা অমুক জায়গায় মুসলমানদের মেরে ফেলেছে, তমুক জায়গায় তাদের মেয়েদেরকে তুলে নিয়ে গেছে…! ফলে কোনো মুসলমান হাতেরই নরমসরম কৃপাল কৌর-কে মৃত্যুর মুখে পৌঁছে দিতে বিশেষ বেগ পেতে হবে না।

কৃপাল কৌরের মা অন্ধ, বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত। এক দাদা আছে যে তখন দেবলালীতে। তার সদ্য কেনা মদের ঠেক দেখভাল করছে!

ভাবতে ভাবতে কৃপাল কৌরের দাদা নিরঞ্জনের উপর ত্রিলোচনের ভীষণ রাগ ধরল। খবরের কাগজে পড়ে দাঙ্গার ভয়াবহতার ব্যাপারে সপ্তাহ খানেক আগেই সে নিরঞ্জনকে জানিয়েছিল।

‘নিরঞ্জন, এই ঠেকা-টেকা এখন ছাড়ো। কঠিন সময় চলছে। তুমি বরং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাদের ওই এলাকা থেকে জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে আমার বাড়ি চলে এস। জায়গা খুব বেশি নেই, কিন্তু এরকম সময়ে প্রাণ বাঁচানো সবার আগে। সবাই মিলে ঠিক থেকে যাব।…’

নিরঞ্জন শোনেনি। এত লম্বা লেকচারের পর সে গোঁফের ফাঁক দিয়ে হেসে বলেছিল, ‘ভাই, তুমি অকারণ ভয় পাচ্ছ!…অনেক দাঙ্গা দেখেছি আমি…এটা অমৃতসর বা লাহোর নয়, বোম্বাই…তুমি মাত্র চার বছর এখানে আছ আর আমি বারো বছর! কিচ্ছু হবে না। ফালতু চিন্তা কোরো না।…’

নিরঞ্জন বোম্বাইকে কী ভাবে কে জানে! দাঙ্গা হলে নিজে থেকেই মিটে যাবে নাকি? নাকি বোম্বাই কোনো রূপকথার কেল্লা যেখানে গণ্ডগোল হতেই পারে না?

ত্রিলোচন দিব্যি বুঝতে পারল যে কৃপালদের জায়গাটা সুরক্ষিত নয়। সকালের কাগজে যদি সে ওই তিনজনের মৃত্যুর খবরও দেখে, সেও কিছুমাত্র আশ্চর্যের নয়!

কৃপাল কৌরের অন্ধ মা আর পক্ষাঘাতে আক্রান্ত বাবা মরে গেলে ত্রিলোচনের বিশেষ কিছু যাবে-আসবে না। দেবলালীতে দাদা নিরঞ্জন খুন হলে তো আরো ভালো! ত্রিলোচনের পথে আর কোনো বাধা থাকবে না! নিরঞ্জন সিং নেহাতই তার পথের কাঁটা। কৃপাল কৌরের সঙ্গে কখনো কথা হলে সে নিরঞ্জনকে কাঁটা সিং বলে উল্লেখ করত।

অল্প অল্প হাওয়া দিচ্ছে। ত্রিলোচনের অল্প চুলে ঢাকা মাথায় যেন কেউ ঠান্ডা হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মাথার ভেতরে এদিকে হাজারটা আশঙ্কা পাক খাচ্ছে।

কৃপাল কৌর কিছুদিন হল তার জীবনে এসেছে। শক্তসমর্থ কাঁটা সিংয়ের বোন কৃপাল কৌর নরম, কমনীয়। দেহাতে বড় হলেও অন্য দেহাতি শিখ মেয়েদের মতো তার মধ্যে কাঠিন্য বা পুরুষালি হাবভাব নেই। পাতলা চেহারা, ছোট ছোট বুক, ফর্সা রং। মার্সেরাইজড কাপড়ের মতো মোলায়েম শরীর। তার উপর সে ভীষণ লাজুক।

ত্রিলোচন একই গ্রামের। কিন্তু গ্রামে থাকতে সে কৃপাল কৌরকে চিনত না। প্রাইমারি স্কুল শেষ হতেই সে শহরে চলে গেছিল। হাই স্কুল, কলেজ সবই তার কেটেছিল শহরে। তখন গ্রামে অল্প ক’দিনের জন্য গেলেও আবার শহরে ফিরতে সে এত ব্যস্ত থাকত যে আশেপাশের লোককে চেনার সময় তার হত না।

সেই কলেজ আর আজকের এই আডবাণী চেম্বার্স-এর মাঝে দশ বছর কেটে গেছে। এই দশ বছরে ত্রিলোচন বর্মা, সিঙ্গাপুর, হংকং ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে অবশেষে চারবছর আগে বোম্বাইতে এসে থিতু হয়েছে।

এই চার বছরে সে প্রথমবার রাতের আকাশ দেখল। ধূসর চাদরে যেন হাজারো প্রদীপ জ্বলছে। অল্পস্বল্প ঠান্ডা হাওয়া বইছে।

কৃপাল কৌরের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎই তার মনে পড়ল মোজেলের কথা। মোজেল আডবাণী চেম্বার্সেই থাকত। ইহুদি। ত্রিলোচন ঘাড়-মোড় ভেঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিল। পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনে প্রথমবার!

এক খ্রিস্টান বন্ধুর মারফৎ সে আডবাণী চেম্বার্সে ফ্ল্যাট নিয়েছিল। প্রথমদিন সেখানে ঢুকতেই তার সঙ্গে মোজেলের দেখা হয়।

প্রথম দর্শনে তার মোজেলকে বেশ খ্যাপাটে বলে মনে হয়। ছোট করে কাটা এলোমেলো অবিন্যস্ত বাদামি চুল! ঠোঁটের উপর জায়গায় জায়গায় খুবলে ওঠা গাঢ় লিপস্টিক! সাদা রঙের ঢিলেঢালা চোগার মধ্যে থেকে বড় বড় নীলচে বুক দেখা যাচ্ছে! ছোট্ট ছোট্ট লোমে ঢাকা দুটো হাত! ঠোঁট দুটোকে গোস্তের টুকরোর মতো দেখাচ্ছে!

ত্রিলোচনের ফ্ল্যাটের ঠিক সামনের ফ্ল্যাটটাই মোজেলের। মাঝখানে একফালি সরু জায়গা। ত্রিলোচন ফ্ল্যাটে ঢুকতে যাবে, ঠিক তখন মোজেল নিজের ফ্ল্যাট থেকে বেরোল। পায়ে খড়ম। খড়মের শব্দ শুনে ত্রিলোচন দাঁড়িয়ে পড়ল। এলোমেলো চুলের ফাঁক দিয়ে বড় বড় ইহুদি চোখ দুটো তুলে তার দিকে তাকিয়ে মোজেল হাসল। ত্রিলোচন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। পকেট থেকে চাবি বের করে সে তাড়াতাড়ি নিজের দরজার দিকে এগোল। এমন সময় মোজেলের খড়ম সিমেন্টের মেঝেতে পিছলে গেল। মোজেল এসে পড়ল তার উপর। টাল সামলাতে না পেরে ত্রিলোচন মেঝেতে পড়ে গেল। উপরে মোজেল। তার লম্বা ঢিলা পাজামা উঠে গিয়ে নগ্ন পা দুটো দেখা যাচ্ছে! ধড়ফড় করে উঠতে গিয়ে দুজন আরো জড়াজড়ি করে পড়ে গেল।

কোনওরকমে উঠে ত্রিলোচন মিনমিন করে ক্ষমা চাইল। মোজেল জামাকাপড় ঠিক করতে করতে হেসে বলল, ‘এই খড়ম একেবারে জঘন্য একটা জিনিস!’

খড়মটা আঙুলের ফাঁকে নিয়ে দোলাতে দোলাতে করিডর দিয়ে হেঁটে সে বেরিয়ে গেল।

মোজেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানো দুষ্কর বলেই ত্রিলোচনের মনে হয়েছিল। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই মোজেল দিব্যি তার সঙ্গে গল্পগাছা শুরু করে দিল। অবশ্য ত্রিলোচনকে সে খুব একটা পাত্তা দিত না। একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, সিনেমা দেখা, জুহুতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্নান করা অবধি ঠিক ছিল। কিন্তু হাত আর ঠোঁটের পর আর এগোতে গেলেই সে ত্রিলোচনকে এমন ধমক দিত যে সব উদ্দীপনা তার দাড়ি-গোঁফের ফাঁকে আটকে যেত।

ত্রিলোচন আগে কখনো প্রেমে পড়েনি। লাহোর, বোম্বাই, সিঙ্গাপুর, হংকং সব জায়গাতেই সে কিছু সময়ের জন্য মেয়ে কিনে নিত। ইচ্ছা মিটে গেলেই সেসব শেষ হয়ে যেত। সে স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবেনি যে একটা বিদঘুটে ইহুদি মেয়ের প্রেমে সে এরকম পাগল হয়ে উঠবে!

মোজেল তার ব্যাপারে অদ্ভুত ঔদাসীন্য দেখাত। তার সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়ে হলে কোনো চেনা লোককে দেখতে পেলেই সঙ্গে সঙ্গে তাকে অবজ্ঞা করে সেই লোকের পাশে গিয়ে বসত। কখনো এরকমও হয়েছে যে দুজন রেস্তোরাঁয় খেতে গেছে। মোজেলের পছন্দসই খাবার অর্ডারও করা হয়েছে। এদিকে কোনো পুরোনো বন্ধু বা প্রেমিকের দেখা পেতেই মোজেল খাবারদাবার ছেড়ে সেই বন্ধুর পাশে গিয়ে বসে পড়েছে!

এসব দেখলেই ত্রিলোচনের গা জ্বলে যেত। দুমদাম মোজেল কখনো কখনো পুরোনো সখাদের সঙ্গে ঘুরতে চলে যেত দিনের পর দিন ত্রিলোচনের সঙ্গে দেখা করত না। কখনো পেটে ব্যথা, কখনো মাথা ব্যথা এসব হরেকরকম বাহানা করত। ত্রিলোচন ভালোভাবেই জানত যে মোজেল শক্ত ধাতের মেয়ে। তার অত সহজে শরীর-টরীর খারাপ হয় না। ওসব নিতান্তই বাজে অজুহাত।

কিছু বলতে গেলেই মোজেল বলত, ‘তুমি শিখ…এই সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো তোমার মাথায় ঢুকবে না।’

ত্রিলোচন আরো রেগে যেত, ‘কোন সূক্ষ্ম ব্যাপার? তোমার পুরোনো প্রেমিকদের কাহিনি?’

মোজেল নিজের চওড়া কোমরে দু’হাত রেখে পা দুটো আরো খানিকটা ছড়িয়ে উত্তর দিত,

‘খোঁটা দিচ্ছ কেন?…হ্যাঁ, সেই প্রেমিকদের আমার ভীষণ ভালো লাগে… তোমার হিংসা করতে হয় তো করো গে!’

ত্রিলোচন ওকালতির কায়দায় জিগ্যেস করত,

‘এভাবে আমাদের দুজনের কী করে চলবে?’

মোজেল উচ্চস্বরে হেসে উঠত, ‘তুমি শিখই বটে!…ইডিয়ট কোথাকার!… আমার সঙ্গে চালাতে কে বলেছে! চালাতে হলে একটা শিখনী খোঁজো না বাপু!…আমার সঙ্গে তো এরকমভাবেই চলবে!…’

ত্রিলোচন চুপ করে যেত।

মোজেল ছিল তার দুর্বলতা। তার সান্নিধ্য পেলেই ত্রিলোচন উৎফুল্ল হয়ে উঠত। অনেকবারই অনেক জায়গায় মোজেলের জন্য তার অসম্মানও হয়েছে—যেমন বেশ কিছু ফালতু খ্রিস্টান ছোকরার সামনে।

তবু শুধু ভালোবাসার খাতিরে সে সব বরদাস্ত করে নিত।

সাধারণত অপমান সহ্য করার একটা সীমা থাকে। কিন্তু ত্রিলোচনের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটেছিল। সে যুক্তি-বুদ্ধির চোখে ঠুলি, মুখে কুলুপ আর কানে তুলো এঁটে দিয়েছিল। তার মনে হত বাকি জীবনটা এই প্রেমের গেরোতেই কেটে যাবে। প্রাণ বেরোলে তবেই বোধহয় এর থেকে তার মুক্তি!

দু’বছর ধরে এরকমই চলল। কিন্তু ত্রিলোচনের প্রেমে ফাটল ধরল না।

একদিন মোজেলকে জড়িয়ে ধরে সে জিগ্যেস করল, ‘মোজেল, তুমি কি আমায় ভালোবাসো না?’

মোজেল সরে চেয়ারের উপর গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ নিজের ফ্রকের ঘেরে চোখ গুঁজে রেখে তারপর বড় বড় চোখ তুলে বলল, ‘আমি কোনো শিখকে ভালোবাসতে পারব না।’

ত্রিলোচনের পাগড়ির ভিতর দিয়ে যেন কেউ তার চুলের মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে দিল, ‘মোজেল, সবসময় আমায় নিয়ে ঠাট্টা করো কেন? আমায় ছাড়ো, আমার ভালোবাসা নিয়ে ঠাট্টা করো কেন?’

মোজেল উঠে দাঁড়াল। ছোট করে কাটা বাদামি চুল ঝাঁকিয়ে বলল, ‘তুমি দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে আর চুল কেটে ফেল। বাজি ফেলে বলছি, ছোকরারা তোমার পিছনে পাগল হয়ে উঠবে!…তুমি সুন্দর দেখতে।’

ত্রিলোচনের মাথার আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। সে এগিয়ে গিয়ে মোজেলকে জাপটে ধরে তার বেগুনি ঠোঁটে নিজের গোঁফসুদ্ধ মুখ চেপে ধরল।

মোজেল ফুঁ-ফুঁ করতে করতে তার কাছ থেকে ছিটকে সরে গেল, ‘আমার সকালে দাঁত ব্রাশ করা হয়ে গেছে…তোমার আর কষ্ট না করলেও চলবে!’

ত্রিলোচন চেঁচিয়ে উঠল, ‘মোজেল…!’

মোজেল ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা আয়না বার করে নিজের ঠোঁট দেখতে লাগল। গাঢ় লিপস্টিক জায়গায় জায়গায় উঠে গেছিল। ‘ভগবানের দিব্যি, তুমি নিজের দাড়ি-গোঁফের ঠিকঠাক ব্যবহার জানো না…এত ভালো চুল যে তা দিয়ে আমার নেভি-ব্লু স্কার্টটা দুর্দান্ত পরিষ্কার হবে!…শুধু একটু পেট্রল লাগতে পারে এই যা!’

ত্রিলোচন রাগে পাথর হয়ে সোফায় বসে পড়ল। মোজেল পাশে এসে বসল আর তার দাড়ি খুলতে শুরু করে দিল। দাড়ির পিনগুলো খুলে সে নিজের দাঁতের ফাঁকে গুঁজতে লাগল।

ত্রিলোচন সত্যিই সুন্দর দেখতে ছিল। যখন তার দাড়ি-গোঁফ গজায়নি, খোলা চুলে তাকে দেখে লোকে ভাবত কোনো অল্পবয়েসি সুন্দরী মেয়ে। তারপর ধীরে ধীরে চুলের আড়ালে তার যাবতীয় রূপ ঢেকে গেছিল। কিন্তু সে খুবই ধর্মপ্রাণ ছিল। ধর্ম এবং তা সম্বন্ধীয় সমস্ত জিনিস তার কাছে পরম গর্বের বিষয় ছিল। শিখ পরিচয়ের এই চিহ্নগুলোকে নিজের থেকে আলাদা করতে তার মন চাইত না।

দাড়ি পুরো খুলে গিয়ে যখন বুক অবধি পৌঁছে গেল, সে জিগ্যেস করল, ‘মোজেল, কী করছটা কী তুমি?’

দাঁতে পিন গুঁজে হেসে মোজেল বলল, ‘তোমার চুল কী নরম!…ভুল বলেছিলাম, বুঝলে!…এ দিয়ে আমার নেভি-ব্লু স্কার্ট মোছা ঠিক হবে না…ত্রিলোচ, তোমার চুলগুলো আমায় দিয়ে দাও না! আমি নিজের জন্য ফার্সক্লাস একটা বটুয়া বানাব!’

এবার ত্রিলোচনের দাড়ির মধ্যে আগুন জ্বলতে লাগল। গম্ভীরভাবে সে মোজেলকে বলল, ‘আজ পর্যন্ত আমি কক্ষনো তোমার ধর্ম নিয়ে ঠাট্টা করিনি। তুমি কেন করো?…কারুর বিশ্বাস নিয়ে ইয়ার্কি মারা ঠিক নয়। শুধু তুমি বলে আমি এসব কথা সহ্য করছি…শুধু তোমায় ভালোবাসি বলে…জানো না?’

‘জানি।’

‘তাহলে?’

ত্রিলোচন মোজেলের দাঁত থেকে পিন বের করে দাড়িটাকে গুছিয়ে আটকে আবার বলল, ‘তুমি যথেষ্ট ভালোভাবে জানো আমি তোমায় কতটা ভালবাসি! আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই!’

‘জানি।’ চুল ঝাঁকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে মোজেল বলল, ‘আমিও প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি যে তোমাকে বিয়ে করব।’

ত্রিলোচন লাফিয়ে উঠল, ‘সত্যি!!’

মোজেলের বেগুনি ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দাঁতের আভাস দেখা গেল, ‘হ্যাঁ।’

ত্রিলোচন তাকে বুকে টেনে নিল, ‘কবে?’

‘যবে…যবে তুমি এই চুল-দাড়ি কেটে ফেলবে।’

ত্রিলোচন তখন আনন্দে আত্মহারা, ‘কালই কেটে ফেলব।’

মোজেল মেঝের উপর নাচতে আরম্ভ করল,

‘বাজে বোকো না তো!…অত সাহস নেই তোমার।’

ত্রিলোচনের মনে যেটুকু দ্বিধা ছিল সেটাও উড়ে গেল, ‘তুমি দেখে নিও।’

‘দেখে নেব।’

এগিয়ে এসে ত্রিলোচনের গোঁফে চুমু খেয়ে ফুঁ-ফুঁ করতে করতে মোজেল বেরিয়ে গেল।

সেই রাতে ত্রিলোচন কী কী ভেবেছিল, কতটা বিবেকদংশনে ভুগেছিল, কতক্ষণ অস্থির উদ্বেগে কাটিয়েছিল, সে আলোচনা মুলতুবি থাক। আসল কথাটা হল যে পরের দিনই ফোর্টে গিয়ে সে চুল আর দাড়ি কাটিয়ে ফেলল। যখন সেগুলো কাটা হচ্ছিল, সে চোখ বন্ধ করে বসেছিল। চোখ খোলার পর বহুক্ষণ সে বাহ্যজ্ঞানশুন্য হয়ে আয়নায় নিজের মুখ দেখতে লাগল। সেই মুখ দেখলে নিশ্চিতভাবে বোম্বাইয়ের ডাকসাইটে সুন্দরীদেরও তাক লেগে যেত।…

ভাবতে ভাবতে ছাদে দাঁড়িয়ে ত্রিলোচনের ভিতরে যেন একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। ঠিক যেমন সেদিন নাপিতের দোকান থেকে বেরোনোর পর হয়েছিল। সে হনহন করে ছাদের উপরের কল আর ট্যাঙ্কের মাঝখান দিয়ে টহল দিতে শুরু করল যাতে বাকি ঘটনাটা তার আর মনে না পড়ে। কিন্তু স্মৃতির মতো শত্রু আর ক’টা আছে!

চুল-দাড়ি কাটানোর পর সে প্রথমদিন বাড়ি থেকে বেরোল না। পরেরদিন চাকরের হাত দিয়ে মোজেলকে একটা চিঠি পাঠাল, যে সে অসুস্থ আর মোজেল যেন অবিলম্বে তাকে দেখতে আসে।

মোজেল এল। ত্রিলোচনকে দেখে সে হকচকিয়ে গেল। তারপরই ‘মাই ডার্লিং ত্রিলোচ’ বলে লাফিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। চুমুতে চুমুতে ত্রিলোচনের সারা মুখ বেগুনি হয়ে গেল। মোজেল তার পরিষ্কার নরম গালে হাত বোলাতে লাগল। তার বিদেশি কায়দায় কাটা ছোট চুলের ভিতরে আঙুল চালাতে লাগল। আর আরবি ভাষায় স্লোগান দিতে শুরু করল। চিৎকারের চোটে মোজেলের নাক দিয়ে জল গড়াতে লাগল। খেয়াল হতেই সে স্কার্ট তুলে নাক মুছে নিল।

ত্রিলোচন লজ্জা পেয়ে গেল। মোজেলের স্কার্টটা ধরে নামিয়ে দিয়ে সে বলল, ‘নীচে কিছু পরো না কেন?’

মোজেল পাত্তা দিল না। বাসি রঙচটা লিপস্টিকের ফাঁক দিয়ে হেসে সে বলল, ‘পরলেই বুক ধড়ফড় করে…এটাই ঠিক আছে।’

ত্রিলোচনের প্রথম দিনটার কথা মনে পড়ে গেল যেদিন তাড়াহুড়োয় দুজন জড়িয়ে-মড়িয়ে পড়ে গেছিল। আশ্লেষে মোজেলকে কাছে টেনে নিয়ে সে বলল, ‘কালই বিয়েটা হোক।’

‘ঠিক আছে।’ মোজেল ত্রিলোচনের নরম থুতনিতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল।

দুজনে মিলে ঠিক করল যে বিয়ে পুনেতে করবে। সিভিল ম্যারেজ। নিয়ম অনুযায়ী পনেরো দিন আগে নোটিশ দিতে হবে। দুজনেই ভেবে দেখল যে পুনেই ভালো। কাছেও, আবার ত্রিলোচনের কিছু বন্ধুও থাকত সেখানে। পরের দিনই পুনের জন্য রওনা দেবে ঠিক হল।

ফোর্টের একটা দোকানে মোজেল সেলস-গার্লের কাজ করত। দোকান থেকে একটু দূরেই একটা ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। সেখানেই দেখা করা স্থির হল।

ঠিক সময়ে ত্রিলোচন পৌঁছে গেল। দেড় ঘণ্টা কেটে গেল। মোজেল এল না।

পরের দিন ত্রিলোচন জানতে পারল সে নাকি কোন পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর নতুন কেনা মোটরে চেপে দেবলালী চলে গেছে। কবে আসবে কেউ জানে না।

ত্রিলোচনের উপর দিয়ে কী ঝড় বয়েছিল সে আর না বলাই ভালো! মোদ্দা কথা এই যে, মনপ্রাণ শক্ত করে সে মোজেলকে ভুলে গেল।

তার ক’দিনের মধ্যেই তার কৃপাল কৌরের সঙ্গে দেখা হল। ধীরে ধীরে সে কৃপালকে ভালোবাসতে শুরু করল। তার মনে স্থির বিশ্বাস হল যে মোজেল অত্যন্ত জঘন্য একটা মেয়ে।…পাথরের মতো। কাউকে সে ভালোবাসতে পারে না। তার উপর আবার তার কোনো ভরসাও ছিল না। আজ এর সঙ্গে তো কাল ওর সঙ্গে।…ত্রিলোচন শান্তির নিঃশ্বাস ফেলত যে মোজেলকে বিয়ে করার মতো কাঁচা কাজ সে শেষ পর্যন্ত করেনি।

তবুও মাঝে মাঝে হঠাৎ তার মোজেলের কথা মনে পড়ে যেত। বেহায়া, নির্লজ্জ, প্রেমহীন একটা মেয়ে! তার কাছে আবেগের কোনো মূল্য ছিল না। ত্রিলোচন তবু কিসের জন্য তাকে ভালোবাসত! ‘মোজেল কি সেই মোটরওয়ালা বন্ধুর সঙ্গেই এখনও আছে! নাকি তাকে ছেড়ে আবার অন্য কারোর কাছে চলে গেছে!’—এসব ভাবনা মনে এলেই ত্রিলোচনের বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠত। মোজেল যেমনই হোক, নিজেকে ছাড়া অন্য কারোর সঙ্গে তাকে ভাবতে গেলেই ত্রিলোচন রাগে পাগল হয়ে যেত।

মোজেলের পিছনে সে হাজার হাজার টাকা খরচ করেছিল। কিন্তু পুরোটাই নিজের ইচ্ছায়। মোজেলের দামি জিনিসের প্রতি কোনো মোহ ছিল না। সোনার কানের দুল দেবে বলে একবার সে মোজেলকে নিয়ে দোকানে গেছিল। সেখানে একটা জবরজং ঝুটো সস্তা দুল দেখে সে এমনই ঝুলোঝুলি শুরু করেছিল যে সোনাদানা ছেড়ে তাকে ওইটা কিনে দিতে ত্রিলোচন বাধ্য হয়েছিল।

ত্রিলোচন বুঝতেই পারেনি মোজেল কী ধরনের মানুষ! ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার সঙ্গে শুয়ে থাকত, চুমু খেত, সাবানের ফেনার মতো তার গায়ে লেপ্টে থাকত, কিন্তু এক ইঞ্চিও এগোতে দিত না। শুধু তাকে বিরক্ত করার জন্য বলত, ‘তুমি শিখ…আমার তোমাকে বিচ্ছিরি লাগে।’

ত্রিলোচন জানত যে সেটা সত্যি নয়। কিছু অপছন্দ হলে সেটা করার মেয়ে মোজেল নয়। পছন্দ না হলে অন্তর্বাসই পরত না সে! অপছন্দের পুরো একটা মানুষের সঙ্গে দু’বছর কাটানো তার পক্ষে অসম্ভব!

অন্তর্বাস পরতে বললে মোজেল রেগে যেত। লজ্জাশরমের কথা তুললে সেই রাগ দ্বিগুণ হয়ে যেত।

‘লজ্জাশরম সব ফালতু কথা!…তোমার লজ্জা করলে চোখ বন্ধ করে নাও। কোন জামায় পুরোপুরি সব ঢাকা পড়ে? কোন জামা পরলে লোকে চোখ দিয়ে শরীর মাপে না? বল তো একটু, শুনি!…তুমি শিখ…আমি জানি যে পাতলুনের নীচে একটা সিল্লি আন্ডারওয়্যার পরো তুমি!…এই দাড়ি আর চুলের মতো ওটাও তোমার ধর্মের গেরো…তোমার লজ্জা হওয়া উচিত! এত বড় হয়ে গেছ, তবু এখনো নিজের জাঙ্গিয়ায় ধর্ম গুঁজে রাখো!…’

প্রথম প্রথম এসব শুনে ত্রিলোচন রেগে যেত। কিন্তু পরে ভাবনাচিন্তা করে সে বুঝেছিল যে কথাটা সত্যি! চুল আর দাড়ি কেটে ফেলে তার মনেও হয়েছিল বেকারই এতদিন এই বোঝা বয়ে বেড়িয়েছে!

হাঁটতে হাঁটতে জলের ট্যাঙ্কের কাছে গিয়ে ত্রিলোচন দাঁড়িয়ে পড়ল। মোজেলকে মনে মনে গাল দিয়ে সে অন্য কথা ভাবতে শুরু করল।… কৃপাল কৌর বিপদে! তার এলাকায় কট্টর মুসলমানদের বাস। এর আগেই সেখানে দু’তিনটে গণ্ডগোল হয়ে গেছে! আটচল্লিশ ঘণ্টার কার্ফু বলে সেখানে যাওয়াও সম্ভব না। এই আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে ভেতরে ভেতরে কৃপাল আর তার বাড়ির লোককে মেরে ফেলা কোনো দুরূহ ব্যাপার না!

ভাবতে ভাবতে ত্রিলোচন একটা মোটা পাইপের উপর বসে পড়ল। তার চুল ততদিনে বড় হয়েছে। আর এক বছরেই সেটা আবার আগের মতো হয়ে যাবে। দাড়ি অবশ্য সে লম্বা করার পক্ষপাতী নয়। ফোর্টের এক নাপিত তার দাড়ি এমন সূক্ষ্মভাবে চেঁছে দিত যে বোঝাই যেত না যে তাতে কারোর হাত পড়েছে!

নিজের নরম চুলে আঙুল চালিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ত্রিলোচন। উঠি উঠি করছে এমন সময় একটা খড়মের শব্দ শুনতে পেল।

এই সময়ে কে হতে পারে? বিল্ডিংয়ে অনেক ইহুদি মেয়ে থাকে। তারা সবাই খড়ম পরে। শব্দটা কাছে এগিয়ে এল। হঠাৎ করেই আরেকটা ট্যাঙ্কের পাশে সে মোজেলকে দেখতে পেল। সেই ঢিলেঢালা চোগা পরা। দু’হাত তুলে জোরসে আড়মোড়া ভাঙছে। এত জোরে যে ত্রিলোচনের মনে হল আশেপাশের হাওয়ারও চোট লেগে যেতে পারে!

ত্রিলোচন উঠল। মনে মনে ভাবল, ‘এ আবার কোত্থেকে উদয় হল!… এইসময় ছাদেই বা কেন উঠেছে!’

মোজেল আবার আড়মোড়া ভাঙল। ঢিলা কুর্তার ভিতরে মোজেলের বড় বড় নীলচে বুক উঠছে-নামছে! ত্রিলোচন গলা খাঁকারি দিল।

মোজেল এদিকে ফিরল। দেখতে পেয়ে স্বচ্ছন্দে বিশেষ প্রতিক্রিয়া ছাড়াই সে খড়ম ঘষতে ঘষতে এগিয়ে এল।

‘আরে ত্রিলোচ, তুমি আবার শিখ হয়ে গেছ!’

ত্রিলোচনের দাড়ি যেন আচমকাই কুটকুট করতে আরম্ভ করল।

মোজেল আরো কাছে এসে তার থুতনিতে হাত বুলিয়ে হাসল, ‘এবার এই ব্রাশটা আমার নেভি-ব্লু স্কার্ট ঝাড়ার জন্য একদম ঠিক হয়ে গেছে… কিন্তু মুশকিল হল যে স্কার্টটা আমি দেবলালীতে ফেলে এসেছি।’

ত্রিলোচন কোনো উত্তর দিল না।

মোজেল তার হাতে একটা চিমটি কেটে বলল, ‘সর্দার সাহেব! মুখে কথা নেই কেন?’

ত্রিলোচন দ্বিতীয়বার একইরকম বোকামি করার বান্দা নয়। সকালের আধা আলো আধা অন্ধকারে মোজেলের দিকে ভালো করে তাকিয়ে সে দেখল, মোজেল আগের মতোই আছে। বোধহয় একটু রোগা হয়ে গেছে!

‘অসুখ করেছিল?’

‘না।’ মোজেল তার ছোট করে কাটা বাদামি চুল ঝাঁকিয়ে বলল।

‘আগের চেয়ে বেশ রোগা লাগছে!’

‘হুঁ। আমি ডায়েটিং করছি।’ সামনের একটা জলের পাইপের উপর বসে মোজেল মেঝেতে খড়ম ঠুকতে লাগল, ‘তুমি কীরকম যেন আবার নতুন করে শিখ হয়ে গেছ!’

ত্রিলোচন জেদি গলায় বলল, ‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে আর কি! অভিনন্দন!’ একটা খড়ম খুলে নিয়ে সে পাইপের উপর ঠুকে বাজাতে লাগল, ‘আবার প্রেমে পড়লে?’

ত্রিলোচন আস্তে করে বলল, ‘হ্যাঁ।’

‘আরে! দারুণ ব্যাপার! এই বিল্ডিংয়েই থাকে?’

‘না।’

‘ধ্যাৎ! এটা এক্কেবারে বাজে জিনিস! সবসময় কাছাকাছির মধ্যে প্রেম করতে হয়।’

ত্রিলোচন চুপ করে রইল।

মোজেল উঠে এসে ত্রিলোচনের দাড়িতে টোকা মারতে মারতে বলল, ‘অ! ও-ই তোমায় চুল লম্বা করতে বলেছে?’

‘না।’ ত্রিলোচনের গলায় তিক্ততা।

মোজেলের লিপস্টিকমাখা ঠোঁট বাসি গোস্তের মতো লাগছিল। সে যখন হেসে উঠল, ত্রিলোচনের মনে হল যেন ঝটকার দোকানের কসাই এক কোপে গোস্তকে দু’টুকরো করে দিল।

‘তুমি এবার দাড়ি কামিয়ে ফেল। আমি তোমাকে ঠিক বিয়ে করে নেব…কার দিব্যি করব বলো?’ মোজেল হাসতে হাসতে বলল।

ত্রিলোচনের একবার মনে হল তাকে বলে যে কৃপাল কৌর একটা ভদ্র, সভ্য, পবিত্র মেয়ে। তার সামনে মোজেল নিতান্তই চরিত্রহীন, অসভ্য আর অভদ্র! কিন্তু এই ধরনের কথা বলতে ত্রিলোচনের রুচিতে বাধল। সে শুধু বলল, ‘আমি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি…আমারই গ্রামের মেয়ে…সাদাসিধে, ধার্মিক…তাই আমি চুল বাড়াচ্ছি।’

মোজেল একটুক্ষণ ভেবে বলল,

‘কিন্তু ও জানে না তুমি একবার চুল কাটিয়েছ?’

‘এখনো জানে না। তুমি দেবলালী চলে যাওয়ার পরই আমি আবার চুল রাখতে শুরু করি। কিছুটা হয়তো জেদের বশে।…সঙ্গে আমার তার পরে দেখা হয়েছে…এমনিতেও আমায় পাগড়ি পরা অবস্থায় দেখলে একশোজনের মধ্যে নিরানব্বইজন বলতে পারবে না যে আমার চুল ছোট। আর এই চুলটাও বেড়ে যাবে তাড়াতাড়ি।’

মোজেল পাজামা উঠিয়ে মোটা ফর্সা ঊরু চুলকোতে শুরু করল।

‘এই মশার ব্যাটাগুলো এখানেও চলে এসেছে!…কামড়েছে দেখো!’

ত্রিলোচন অন্যদিকে মুখ ফেরাল।

যেখানে মশা কামড়েছে, সেখানে আঙুলে করে খানিকটা থুতু লাগিয়ে মোজেল পাজামা আবার নামিয়ে দিল।

‘কবে বিয়ে করছ ত্রিলোচ?’

‘জানি না’, ত্রিলোচনের কপালে ভাঁজ পড়ল।

কিছুক্ষণ পর্যন্ত কেউ কোনো কথা বলল না। ত্রিলোচন কিছু একটা নিয়ে চিন্তায় আছে বুঝতে পেরে মোজেল গম্ভীর গলায় তাকে প্রশ্ন করল, ‘ত্রিলোচ? কী ভাবছ বল তো তুমি?’

ত্রিলোচনের তখন সহানুভূতির একান্ত দরকার! তা সে যারই সহানুভূতি হোক না কেন! সে মোজেলকে পুরোটা বলল।

শুনে মোজেল হেসে উঠল, ‘তুম পয়লা নম্বরের ইডিয়ট!…যাও ওকে নিয়ে এস! এটা আবার এমন কী ব্যাপার!’

‘এমন কী ব্যাপার? মোজেল, তুমি সমস্যাটা বুঝতে পারছ? অবশ্য তুমি তো কোনো সমস্যার গভীরতাই বুঝতে পারো না! এইজন্যই তোমার আর আমার মধ্যে কিছু হয়নি। সে আমার যত দুঃখই হোক না কেন, এত ছন্নছাড়া আর বেপরোয়া মেয়ের সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়!’

মোজেল খড়মটা নিয়ে জলের পাইপের উপর টং করে মারল।

‘তোমার দুঃখ বি ড্যামড!…সিল্লি ইডিয়ট!…তুমি এখন ভাবো যে তোমার ওই মেয়েটা…কী যেন নাম ওর…ওই যাই হোক না কেন, তাকে…তাকে কী করে নিয়ে আসবে! তা না, আমার সঙ্গে সম্পর্ক থাকল কি থাকল না তাই নিয়ে ঘ্যানঘ্যান আরম্ভ করেছ!…তোমার সঙ্গে আমার এমনিও কিছু হত না। তুমি একটা সিল্লি ভীতু লোক। আমার চাই সাহসী কাউকে।…যাকগে, এসব কথা ছাড়ো। চলো যাই, তোমার ওই বউকে নিয়ে আসি।’

মোজেল ত্রিলোচনের হাত ধরে টানল। ত্রিলোচন ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করল, ‘কোথা থেকে নিয়ে আসব?’

‘যেখানে ও থাকে সেখান থেকে!…সিল্লি!…ওই মহল্লার প্রত্যেকটা ইঁট আমার চেনা। চলো।’

‘কিন্তু কার্ফু চলছে তো!’

‘মোজেলের জন্য কোনো কার্ফু নেই!…এসো।’

মোজেল ত্রিলোচনের হাত ধরে তাকে সিঁড়ির দরজার কাছে নিয়ে গেল। দরজা খুলে নামতে যাওয়ার মুখে সে দাঁড়িয়ে গেল। পিছন ফিরে ত্রিলোচনকে ভালো করে দেখল।

‘উম…তোমার দাড়ি…না ঠিক আছে, এমন কিছুও বড় নয়…হ্যাঁ, মাথা না ঢেকে গেলে কেউ তোমায় শিখ বলে বুঝতে পারবে না।’

‘খালি মাথায় যাব?’ ত্রিলোচন চমকে গেল, ‘না, আমি পাগড়ি না পরে যেতে পারব না।’

মোজেল অবুঝ গলায় জিগ্যেস করল, ‘কেন?’

ত্রিলোচন নিজের চুল ঠিক করল। ‘তুমি বুঝতে পারছ না! ওখানে পাগড়ি না পরে আমি যেতে পারব না।’

‘কেন পারবে না?’

‘উফ! তুমি কিছুই বুঝতে পারো না!…ও আমায় কখনো পাগড়ি ছাড়া দেখেনি…ওর ধারণা আমার লম্বা চুল!…এভাবে গেলে ও জানতে পেরে যাবে।’

মোজেল বিরক্তির চোটে চৌকাঠে একটা লাথি মেরে বলল, ‘সত্যিই তুমি পয়লা নম্বরের ইডিয়ট!…গাধা কোথাকার!…মেয়েটার বাঁচা-মরার ব্যাপার আর তুমি এসব ভুলভাল বকছ!’

ত্রিলোচন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, ‘মোজেল, ও খুবই ধর্মপ্রাণ একটা মেয়ে…আমার ছোট চুল দেখলে ওর আর আমার প্রতি কোনো ভালোবাসা থাকবে না…’

‘ওহ তোমার ভালোবাসা বি ড্যামড!…সবক’টা শিখ কি তোমার মতই গাধা?…ওর প্রাণ বাঁচাবে তা না পাগড়ি নিয়ে ন্যাকামো শুরু করেছ! নিশ্চয়ই তোমার ওই ধর্মের জাঙ্গিয়াটা নিয়েও শুরু করবে!’

‘ওটা আমি সবসময় পরে থাকি।’

‘খুবই গর্বের কাজ করো…কিন্তু একটু বুদ্ধি খুলে ভাবো! যে এলাকায় যাব সেখানে সব মিঞা ভাইয়েরা থাকে। ওদের মধ্যে বেশ কিছু গুণ্ডা-বদমাইশও আছে।…পাগড়ি পরে গেলে তোমায় ওখানেই মেরে দেবে!’

ত্রিলোচন সংক্ষেপে বলল, ‘গেলে পাগড়ি পরেই যাব। যাই হোক না কেন! আমার প্রেমে কোনো বাধাবিপত্তি আসুক তা আমি চাই না।’

মোজেল রাগে ফুঁসে উঠল, ‘সাধে কি আর তোমায় গাধা বলি!…প্রেমে বাধাবিপত্তি!…তুমিই না থাকলে প্রেমটা থাকবে কোত্থেকে! তোমার ওই মাগীটা…কী যেন নাম…সে আর তার বাপ-মা বেঁচে না থাকলে প্রেম নিয়ে কী করবে!…সত্যিই, তুমি একটা ইডিয়ট শিখ!…’

‘বাজে বোকো না!’

মোজেল হা-হা করে হেসে উঠল। ছোট ছোট লোমে ঢাকা হাত দিয়ে ত্রিলোচনের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ডার্লিং, তোমার যা ইচ্ছা তাই করো!…পাগড়ি পরে এস। আমি নীচে বাজারে অপেক্ষা করছি।’

বলে সে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। ত্রিলোচন ডাকল, ‘নীচে কিছু পরবে না?’

মোজেল মাথা নেড়ে উত্তর দিল, ‘উঁহু। এটাই ঠিক আছে।’

খটখট করে সে নেমে গেল।

একতলা পর্যন্ত তার খড়মের আওয়াজ শোনা গেল। শুনতে শুনতে ত্রিলোচন নীচে নেমে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকল। তাড়াতাড়ি জামাকাপড় বদলে, বাঁধা পাগড়িটা মাথায় চাপিয়ে সে ফ্ল্যাটের দরজায় তালা লাগিয়ে নীচে নামল।

বাইরে ফুটপাথে মোটা পা দুটো ছেলেদের মতো ফাঁক করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মোজেল সিগারেট খাচ্ছিল। ত্রিলোচন সামনে গিয়ে দাঁড়াতে সে তার মুখের উপর ধোঁয়া ছেড়ে হাসতে লাগল।

ত্রিলোচন রাগতস্বরে বলল, ‘তুমি ভীষণ অসভ্য!’

‘এটা আবার নতুন কী কথা! তোমার আগেও কত লোক আমায় অসভ্য বলেছে!…আরে! তোমার পাগড়িটা সত্যি দারুণ বেঁধেছ তো! বোঝাই যাচ্ছে না যে চুল ছোট!’

দুজন হাঁটতে শুরু করল। বাজার নিস্তব্ধ। হাওয়াও যেন কার্ফুর ভয়ে চুপিচুপি বইছে। রাস্তার আলোগুলো যেন বহুদিন ধরে অসুখে ভুগে ম্লান হয়ে গেছে! অন্যান্য সময় এতক্ষণে সকালের ট্রাম চালু হয়ে যায়, রাস্তায় লোকজন আনাগোনা শুরু করে দেয়, দৈনিক শোরগোল আরম্ভ হয়ে যায়। কিন্তু সেদিন সব সুনসান। রাস্তায় কোনো প্রাণী নেই। যেন কেউ কখনো এই রাস্তায় হাঁটেনি আর হাঁটবেও না!

মোজেলের পিছন পিছন ত্রিলোচন চলতে থাকল। ফুটপাথের পাথরে মোজেলের খড়মের আওয়াজ যেন চারদিকের নৈঃশব্দ্যকে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছিল। ত্রিলোচন মনে মনে তার খড়মটাকে শাপশাপান্ত করতে লাগল। খুলতে বললে মোজেল কিছুতেই শুনবে না বলে সে মুখে কিছু বলল না।

ত্রিলোচন ভয়ে অর্ধেক হয়ে ছিল। কোথাও কোনো পাতা পড়ার আওয়াজেই সে চমকে চমকে উঠছিল। ওদিকে মোজেল নিশ্চিন্ত! খটখট করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সে হেঁটে যাচ্ছে। যেন প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছে!

মোড়ের মাথায় পৌঁছতে সিপাইয়ের গলা ভেসে এল, ‘এই! কোথায় যাচ্ছ?’

মোজেল তার কাছে গিয়ে চুল ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ওহ তুমি! তুমি আমায় চিনতে পারলে না! আমি মোজেল!…ওই গলিতে আমার বোন থাকে। খুউব অসুস্থ। দেখো না ডাক্তার নিয়ে যাচ্ছি!’

সিপাই তাকে চেনার চেষ্টা করতে করতে সে কোথা থেকে সিগারেটের টিন বার করে তাকে একটা সিগারেট দিল।

‘নাও, খাও…’

সিপাই সিগারেটটা নিয়ে নিল। মোজেল নিজের জ্বলন্ত সিগারেট সিপাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিল, ‘হিয়ার ইজ লাইট!’

সিপাই সিগারেট ধরাল। তাকে ডান চোখ আর ত্রিলোচনকে বাঁ-চোখ টিপে মোজেল গলির দিকে এগিয়ে গেল। এই গলি ধরেই ওই এলাকার রাস্তা।

ত্রিলোচন চুপচাপ হাঁটতে থাকল। আগুন নিয়ে খেলা করা মোজেলের স্বভাব! আগে যখন তারা জুহু যেত, সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে লাফাতে লাফাতে সে বহুদূর পর্যন্ত চলে যেত। ত্রিলোচনের বুক কেঁপে উঠত। ফিরলে দেখত তার সারা শরীরে লালচে নীলচে কাটাছেঁড়ার দাগ। কিন্তু তাতে মোজেলের কিছুই যেত আসত না। সে পরেরবার আবার একই কাণ্ড করত।

মোজেল সামনে, সে পিছনে। ভয়ে ভয়ে সে চারিদিকে তাকাতে লাগল, কখন কোথা থেকে ছুরি নিয়ে কেউ বেরিয়ে আসে!

হঠাৎ মোজেল থেমে গেল। ত্রিলোচন কাছে এলে সে বলল,

‘ত্রিলোচ ডিয়ার, এরকম ভয় পেও না!…ভয় পেলেই বিপদ হয়।…সত্যি বলছি, আমি অনেকবার দেখেছি!’

সেই গলি পেরিয়ে তারা পরের গলিতে ঢুকল। এই গলিতেই একদিকে কৃপাল কৌরদের বাড়ি। আচমকা মোজেল দাঁড়িয়ে পড়ল।

একটু দূরে এক মাড়োয়ারির দোকান লুট হচ্ছিল। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা জরিপ করে মোজেল বলল, ‘হুঁ…ঠিক আছে…চলো।’

দুজন এগোতে লাগল।

একটা বড় থালা মাথায় একটা লোক এদিকে আসছিল। ত্রিলোচনের সঙ্গে ধাক্কা লেগে থালাটা ঠং করে নীচে পড়ে গেল।

লোকটা ভালো করে ত্রিলোচনকে দেখেই কোমরবন্ধে হাত ঢোকাল। যেন বুঝতে পেরে গেছে সে শিখ! সঙ্গে সঙ্গে মোজেল টলতে টলতে এগিয়ে এল। যেন নেশায় চুর! লোকটাকে একটা ঠেলা দিয়ে জড়ানো গলায় সে বলল, ‘কী হচ্ছেটা কী! ভাই হয়ে ভাইকে মারছ!…আমি একে বিয়ে করব!… জানো না সেটা?…’, বলে ত্রিলোচনের দিকে ঘুরে গেল, ‘করিম! থালাটা তুলে এর মাথায় রাখো তো!’

লোকটা হাত সরিয়ে নিয়ে লোলুপ দৃষ্টিতে মোজেলের দিকে তাকাল। তারপর এগিয়ে গিয়ে মোজেলের বুকে কনুই মেরে বলল, ‘কর কর, আয়েশ কর!’

বলে থালা উঠিয়ে নিয়ে সে চলে গেল।

ত্রিলোচন বিড়বিড় করে বলল, ‘কী অশ্লীল! হারামজাদা!’

মোজেল নিজের বুকে হাত বুলিয়ে বলল, ‘কিচ্ছু অশ্লীল নয়…এসব একটু হয়…যাকগে চলো।’

এবার সে একটু তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগল। তাই দেখাদেখি ত্রিলোচনও হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল।

গলির শেষে তারা কৃপাল কৌরের বাড়ির এলাকায় এসে পড়ল। মোজেল জিগ্যেস করল, ‘এবার কোনদিকে?’

ত্রিলোচন ফিসফিস করে বলল, ‘তিন নম্বর রাস্তাটায়। রাস্তার উপরের প্রথম বিল্ডিং।’

মোজেল আবার এগোল। এই এলাকাটা আরো চুপচাপ। এত বাড়ি কিন্তু একটা বাচ্চার কান্না অবধি শোনা যাচ্ছে না!

তিন নম্বর রাস্তার কাছাকাছি পৌঁছতে সামনে কিছু একটা গণ্ডগোল হচ্ছে বলে মনে হল। একটা লোক তীরবেগে একটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে অন্যদিকের বাড়িটাতে ঢুকে গেল। একটু পরে প্রথম বাড়িটা থেকে আরো তিনটে লোক বেরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে ফুর্তির সঙ্গে দ্বিতীয় বাড়িটাতে ঢুকল। মোজেল একটু ঘাবড়ে গেল। ত্রিলোচনকে ইশারায় বলল লুকিয়ে পড়তে। তারপর মৃদু গলায় বলল, ‘ত্রিলোচ ডিয়ার, পাগড়িটা খুলে ফেল।’

ত্রিলোচন উত্তর দিল, ‘কোনো অবস্থাতেই আমি পাগড়ি খুলব না।’

মোজেল রেগে আগুন হয়ে গেল, ‘যা ইচ্ছা করো!…দেখছ না সামনে কী হচ্ছে?’

সামনে যা হচ্ছিল দুজনেই দেখতে পাচ্ছিল। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল যে বেশ বড় রকমের একটা গড়বড় চলছে। ডানদিকের বিল্ডিংটা থেকে পিঠে বস্তা নিয়ে যখন দুটো লোক বেরোল, মোজেল কেঁপে উঠল। বস্তার ভিতর থেকে গাঢ় কালচে রঙের কিছু একটা চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে!

মোজেল দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরল।

লোকদুটো গলির অন্য মুখে পৌঁছে অদৃশ্য হয়ে যেতেই সে ত্রিলোচনকে বলল, ‘শোনো। আমি ওর বাড়িটায় দৌড়ে ঢুকব। তুমি আমার পিছন পিছন দৌড়ে আসবে। যেন আমায় তাড়া করছ।…বুঝেছ? তাড়াতাড়ি করতে হবে কিন্তু!’

ত্রিলোচনের উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে সে দৌড় লাগাল। খটখট করে দ্রুতবেগে সে কৃপাল কৌরদের বিল্ডিংটার ভিতর ঢুকে পড়ল। ত্রিলোচনও তার পিছনে জোরে জোরে দৌড়ে সেখানে ঢুকল।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দুজন ভিতরে সিঁড়ির সামনে পৌঁছে গেল। ত্রিলোচন হাঁপাচ্ছিল, কিন্তু মোজেলের কোনো ভাবান্তর নেই!

মোজেল জিগ্যেস করল, ‘কোন তলায়?’

‘দোতলা।’

‘চলো।’

দুজন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। সিঁড়িতে বড় বড় রক্তের দাগ। দেখে ত্রিলোচনের গলা শুকিয়ে গেল।

দোতলায় উঠে একটা দরজায় ত্রিলোচন হালকা করে কড়া নাড়ল। মোজেল একটু দূরে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে।

ত্রিলোচন আরেকবার কড়া নেড়ে দরজায় মুখ লাগিয়ে আস্তে করে ডাকল, ‘মেহঙ্গা সিং জি, মেহঙ্গা সিং জি!’

ভিতর থেকে সরু গলায় ভেসে এল, ‘কে?’

‘ত্রিলোচন!’

দরজা অল্প ফাঁক হল। ত্রিলোচন মোজেলকে ইশারায় ডাকল। দুজন মুহূর্তের মধ্যে ভিতরে ঢুকে পড়ল।

মোজেলের সামনে একটা রোগাপাতলা ভীত-সন্ত্রস্ত মেয়ে দাঁড়িয়ে! মোজেল ভালো করে তাকে দেখল। পাতলা নরম চেহারা। সর্দিতে নাক টানছে। মোজেল তাকে জড়িয়ে ধরে নিজের কুর্তা তুলে তার নাক মুছে দিল।

ত্রিলোচন লজ্জায় লাল হয়ে গেল।

মোজেল কৃপাল কৌরকে মিষ্টি করে বলল, ‘ভয় পেও না!…ত্রিলোচন তোমায় নিয়ে যেতেই এসেছে।’

কৃপাল কৌর ত্রিলোচনের দিকে ভীত চোখে তাকিয়ে মোজেলের কাছ থেকে একটু সরে দাঁড়াল।

ত্রিলোচন বলল, ‘সর্দার সাহেবকে বলো তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে… তোমার মা-কেও বলো…তাড়াতাড়ি!…সময় নেই!’

হঠাৎ উপর থেকে জোরে আওয়াজ শোনা গেল। মারপিট আর তীক্ষ্ম চিৎকারের আওয়াজ।

কৃপাল কৌর শুকনো গলায় ফিসফিস করে বলল, ‘ওকে ধরে ফেলেছে!’

ত্রিলোচন জিগ্যেস করল, ‘কাকে?’

কৃপাল কৌর কিছু বলার আগেই মোজেল তাকে টেনে এক কোণে নিয়ে গেল, ‘বেশ হয়েছে ধরে ফেলেছে…তুমি জামাকাপড় খোলো।’

কৃপাল কৌর বুঝতে না বুঝতেই মোজেল তার জামা টেনে খুলে ফেলল। সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দু’হাত দিয়ে নিজের অনাবৃত শরীর ঢাকার চেষ্টা করতে লাগল।

ত্রিলোচন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল।

মোজেল নিজের ঢিলেঢালা কুর্তাটা খুলে কৃপালকে পরিয়ে দিল। তারপর দড়ি খুলে তার শালওয়ারটাকেও নামিয়ে আরেকদিকে ফেলে দিল। ত্রিলোচনকে ডেকে সে বলল, ‘যাও! একে নিয়ে যাও!…এক মিনিট দাঁড়াও!’

কৃপাল কৌরের চুল খুলে দিয়ে সে বলল, ‘এবার নিয়ে যাও…তাড়াতাড়ি!…’

ত্রিলোচন কৃপাল কৌরকে বলল, ‘এস!’ বলেই থেমে গেল। পিছন ফিরে সে মোজেলের দিকে তাকাল। নগ্ন মোজেল কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। হাতের ছোট ছোট লোম খাড়া হয়ে আছে।

মোজেল বিরক্ত স্বরে জিগ্যেস করল, ‘তুমি যাচ্ছ না কেন?’

ত্রিলোচন আস্তে আস্তে বলল, ‘ওর মা-বাবাও তো আছে!’

‘চুলোয় যাক! তুমি ওকে নিয়ে বেরোও বলছি!’

‘আর তুমি?’

‘আমি চলে আসব।’

এমন সময় সিঁড়িতে অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের দরজা ভাঙবার চেষ্টা শুরু হয়ে গেল।

কৃপাল কৌরের অন্ধ মা আর পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাবা পাশের ঘরে ভয়ে গোঙাতে লাগল।

মোজেল চুল ঝাঁকিয়ে ত্রিলোচনকে বলল, ‘ইডিয়ট!…শোনো, আর একটাই উপায় আছে…আমি দরজা খুলছি…’

কৃপাল কৌর অস্ফুটে আর্তনাদ করে উঠল, ‘দরজা!’

সেদিকে কান না দিয়ে মোজেল ত্রিলোচনকে বলতে থাকল, ‘আমি দরজা খুলে বাইরে দৌড় লাগাব…তুমি আমার পিছনে দৌড়বে…আমি দৌড়ে উপরতলায় যাব…এই যে লোকগুলো দরজা ভাঙছে, এরা সব ভুলে আমাদের পিছন পিছন আসবে…’

ত্রিলোচন প্রশ্ন করল, ‘তারপর?’

‘তোমার এই যে এ…কী যেন নাম…যাকগে…এ সুযোগ বুঝে বেরিয়ে যাবে…এই জামায় একে দেখলে কেউ কিছু বলবে না…’

ত্রিলোচন তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা কৃপালকে বোঝাল।

মোজেল একটা তীব্র আর্তনাদ করে দরজা খুলল। খুলেই দড়াম করে বাইরের লোকগুলোর উপর গিয়ে পড়ল। সবাই হকচকিয়ে গেল। তড়িদগতিতে উঠে দাঁড়িয়ে সে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উপরে উঠতে শুরু করল।

ত্রিলোচন তার পিছু নিল। লোকগুলো একপাশে সরে গেল।

মোজেল দিগ্বদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উঠছিল। পায়ে খড়ম।

যারা দরজা ভাঙার চেষ্টা করছিল, সামলে নিয়ে পিছন পিছন দৌড়ল।

মোজেল তখন অনেকটাই উপরে উঠে গেছে, এমন সময় হঠাৎ তার পা হড়কে গেল! গড়াতে গড়াতে পাথরের সিঁড়ি আর লোহার রেলিঙে ঠোকর খেতে খেতে সে নীচে এসে পড়ল।

ত্রিলোচন থমকে দাঁড়াল। তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সে মোজেলের কাছে গেল। তার মুখ-নাক-কান দিয়ে রক্ত পড়ছে!

যারা দরজা ভাঙতে এসেছিল, একটু দূরে চারিদিকে জড়ো হয়ে গেল। কেউ এগিয়েও এল না, কিছু জিগ্যেসও করল না, শুধু মোজেলের ক্ষতবিক্ষত অনাবৃত ফর্সা শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকল।

ত্রিলোচন তাকে ঠেলে ডাকল, ‘মোজেল…মোজেল!’

মোজেল বড় বড় ইহুদি চোখ দুটো খুলল। রক্তের মতো লাল! চোখ খুলে সে মৃদু হাসল।

ত্রিলোচন পাগড়ি খুলে মোজেলের শরীর ঢেকে দিল।

মোজেল হেসে এক চোখ টিপে মুখ দিয়ে রক্তের বুদ্বুদ ওড়াতে ওড়াতে বলল, ‘আমার আন্ডারওয়্যার কই?…ঘরেই আছে না গেছে!’

ত্রিলোচন ইশারা বুঝতে পারল। কিন্তু সেখান থেকে সরে যেতে তার ইচ্ছা করল না।

মোজেল বিরক্ত স্বরে বলল, ‘শিখই বটে!…যাও দেখে এস বলছি!’

অগত্যা ত্রিলোচন উঠে কৃপাল কৌরের ফ্ল্যাটের দিকে এগিয়ে গেল।

মোজেল আবছা দৃষ্টিতে চারপাশের লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মিঞা ভাই হয়েও বোধবুদ্ধি কিছুমাত্র নেই…এক্কেবারে বুড়োটে একটা… শিখ বলব না তো কী বলব একে!’

অল্প সময়ের মধ্যেই ত্রিলোচন ফিরে এল। চোখের ইশারায় মোজেলকে বুঝিয়ে দিল যে কৃপাল কৌর বেরিয়ে গেছে।

মোজেল শান্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মুখ থেকে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এল। ‘ওহ! ড্যাম ইট!’, বলে ছোট ছোট লোমে ঢাকা হাতটা তুলে সে মুখ মুছল। তারপর ত্রিলোচনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অলরাইট ডার্লিং!…বাই বাই!…’

ত্রিলোচন কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না।

মোজেল নিজের গায়ের উপর থেকে ত্রিলোচনের পাগড়ি সরিয়ে দিল।

‘নিয়ে যাও…তোমার ধর্মকে নিয়ে যাও…’

বলতে-বলতেই তার হাত দুটো বুকের উপর নিথর হয়ে পড়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *