০৭. মধুমাধবী সারং

মধুমাধবী সারং

সকাল থেকেই দেবুর বাড়িতে আজ তৎপরতা। দুপুরে পাত্রপক্ষের কয়েকজন আসবেন। তাঁদের মধ্যাহ্নভোজনের নিমন্ত্রণ। এমনকী, শানুর উপরেও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দই-মিষ্টি আনার।

তাদের রীতি অনুযায়ী অতিথিরা জেঠু-জেম্মার গৃহে আসবেন।

দেবু ভোরের বেলা তাদের গ্রন্থাগারে চলে গিয়েছিল। কাম্মা রাতেই তার হাত ধরে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, “মেয়ে দেখতে আসা কিছু নয়। পছন্দ করার বিষয় তো ছবিতেই চুকে গিয়েছে। তবু দুটো পরিবার, পরস্পর চেনাজানা তো দরকার! একটা তারিখ ঠিক করতে হবে।”

মা বলল, “বেশি কেউ আসবে না। রাজর্ষির মা, এক মাসি, জ্যাঠামশাই, এক কাকা, আর কোনও এক গুরুবোন। লোকজন বেশি নেই ওঁদের।”

কাম্মা বলল, “রাজর্ষি কেন আসবে না? এটা ঠিক নয়।”

“আমরা তো জোর করতে পারি না।”

“গুপী-বাঘা পর্যন্ত রাজকন্যাদের দেখেশুনে নিয়েছিল।”

“রাজকন্যারাও কম যায় না। গুপী-বাঘার রাজবেশ দেখে তবেই তুষ্ট হয়েছিল।”

“তবে? আমাদের দেবুমণি একবার দেখেশুনে নেবে না?”

“ওরা অনেক এগিয়ে। দেখাশোনা ঠিকই করবে। আজকাল এটাই নিয়ম।”

দেবু তার হাসি লুকনোর জন্য অতিমাত্রায় গম্ভীর। কাম্মা বলল, “সবার সামনে এমন হাঁড়িমুখো থাকলে কান মুলে দেব!”

অমিয়ামাসি বলল, “ছেলের একবার আসা উচিত। নইলে আমরা যাব ছেলে দেখতে। সত্যি বলতে কী, বর-কনের প্রথম দর্শনই শুভদৃষ্টি। সেইটি শুভ হলে আর চিন্তা থাকে না। আমার কাঁথায় প্রথম যে-নকশা তুলি, তাতেই বুঝতে পারি বাকি কেমন হবে। আমাদেরও তো ইচ্ছে করে তাকে দেখি একবার। আমাদের দেবুমণির জন্য নতুন রেশমি কাপড়ে কাঁথা বুনছি। শুক-সারি দু’টিতে গায়ে দিয়ে ঘুমোবে! ছেলের পাঞ্জাবিও একখানায় নকশা করে দেব।”

সে প্রথমে তাদের পাঠাগারের মোডেম দেখে নিল। টেলিফোনের মধ্যে দিয়ে ইন্টারনেট সংযোগ আসে। মোডেমের ছোট্ট একটি আলো। সেই আলো জ্বলে থাকে যদি, দেবুর দিনের শুরুটি ভাল হয়! মনে হয়, এই তো, সব ঠিকঠাক চলবে!

সে ই-পত্রের বাক্স উন্মোচন করল। রাজর্ষি লিখেছে, Kal Mayer songe khub torko holo. Ma chay ami tomader barri jai. Tumi kee chao? ‘Tumi’-ta apnii ese gelo. Bolte pari to?

একটি চিঠি, তার মুখখানি আরক্ত করে তুলল। শরীরে, এই প্রথম বেজে উঠল অজানিত রিমঝিম! কেমন অবশ লাগছে তার। কেমন পিপাসার্ত। সে তাড়াতাড়ি লিখল, Tumi eso.

একটু জল খেল সে। মেল বক্স থেকে বেরিয়ে বই-খাতা খুলে বসল। তাকে মনঃসংযোগ করতেই হবে। জীবনে এক অজানা, অনাস্বাদিতপূর্ব আবির্ভাব ঘটেছে তার। তার শরীর-মন ছেয়ে ফেলছে। সে ভাগ্যবাদী নয়। আজও নয়। কিন্তু এই উপলব্ধি তার হয়েছে, জীবন এক ঘটমান প্রক্রিয়া। নিরন্তর ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়া– সফেন এবং লোনা ও বালুকাময়!

ইতিপূর্বে, মনকে নানা প্রকোষ্ঠের অন্তর্ভুক্ত করতে হয়, একথা কেউ তাকে বলেনি। চিত্ত সংহত করো, যোগারূঢ় হয়ে একাগ্রতার সঙ্গে কর্ম করো, এই সমস্তই তারা স্কুলের প্রার্থনায় জেনেছিল। কিন্তু তখন এমন প্রগাঢ় ভাষ্য ও গভীর উপদেশ গ্রহণ করার পরিণত বুদ্ধি থাকে না। পুকুরে, নদীতে কচুরিপানার মতো হাত ধরাধরি করে ভেসে যায় উপদেশমালা। মনে তার ছায়ামাত্র পড়ে।

সরস্বতীর নির্জন নিবিড় সাধনার আলোকদীপ্ত রূপ খুলে দিচ্ছেন এক পাগল প্রতিভাবান মহাশয় অসীমচন্দ্র চৌধুরী! তিনি শেখাচ্ছেন, জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র চিহ্নিত করো, আত্মীয়, পরমাত্মীয়, বন্ধু, মিত্র, যারা তোমার জীবনে অর্থবহ, যারা সুখ দিতে পারে, দুঃখও দিতে পারে। তাদের পৃথক পৃথক কক্ষে পুরে ফেলো। অর্ধেক মন তাদের জন্য। বাকি অর্ধেক সরস্বতীর পদতলে অঞ্জলি দিয়ে দাও। শিক্ষা, অনুশীলন, প্রয়োগ এবং নিত্যনতুন জ্ঞানের প্রগতির মধ্যে তাঁর বসবাস। জীবনে যাই ঘটুক, আলোড়ন যতই উঠুক, সরস্বতীর ধ্যান কোরো। অধ্যয়ন কোরো। মনের সেই ভাগ হবে অবিচলিত। বাকি প্রকোষ্ঠগুলির দ্বার সময়ে খুলবে, সময়ে বন্ধ করবে। মন হল আকাশের মতো। তাতে সমস্ত ধারণ করা আছে। কেউ কারও গায়ে পড়ছে না। পড়লেই, সংঘর্ষ হলেই, একমাত্র পরিণতি, ধ্বংস। মনের গতি নিয়ন্ত্রণ অভ্যাস করতে হয়। তোমাদেরও করতে হবে। তোমরা পারবে।

সে সংহতচিত্ত হল। তার শরীরের পুলক ও কম্পন নিভে এল ক্রমে। তার মন স্থির হল। সে ডুবে গেল পাঠে। এক ঘণ্টা, দু’ঘণ্টা…

হঠাৎ পিঠে এক বিরাট চাপড়!

“তুমি পড়ছ? তোমার লজ্জা করে না? তোমার জন্য আমায় পড়া বাদ দিয়ে ভবানীপুরে দই-মিষ্টি আনার জন্য ছুটতে হবে, আর তুমি স্বার্থপরের মতো নিজের পড়া করছ? চলো চলো, আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও।”

দেবু মুখ তুলে শানুর দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ, চোখে কোনও ভাষা নেই। জটিল প্রশ্নের সমাধান পথে সে বিচরণ করছিল! অল্প হাসল। বলল, “তাই বলে আমায় মারবি!”

শানু: মারলাম কোথায়? এটাকে মার বলে?

দেবু: এটা কী তবে?

শানু: হাত গরম। ওয়ার্মিং আপ। এবার সত্যিকারের মার শুরু করি?

দেবু: উফ! একটু পড়তে দিবি?

শানু: মারব এমন না! ধ্যান তো অন্য কারও করছ! চলো, মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও না! কাল অনেক রাত জেগেছি।

দেবুদিদির কোল ঘেঁষে বালিশ আঁকড়ে শুয়ে পড়ল শানু। একটা পা তুলে দিল দেবুর প্রসারিত পায়ে। দেবু জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে তোর?”

“বললাম তো, রাত জেগেছি, মাথা ভার ভার লাগছে।”

“তুই হাঁ করলে আমি হাঁড়ি বুঝে যাই শানু।”

“বাজে বোকো না!”

“তোর মনখারাপ। কী হয়েছে? শানু! এই! দেখি মুখটা!”

শানু জোর করে বালিশে মুখ চেপে আছে। এবার তার পিঠ কাঁপছে। কান্না-জড়ানো স্বর বালিশের তুলোয় ঠেসে গুমড়ে উঠছে। ছোট শিশুর মতো কাঁদছে ছেলেটা! “তুমিও চলে যাবে! ভাল্লাগছে না! আমার ভাল্লাগছে না!”

দেবু, শানুর চুলের মুঠি চেপে ধরল। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। এই দিকটা এখনও ভেবে দেখেনি সে! ছেড়ে যাওয়ার বেদনা কেমন হবে ভাবেনি! জিতুদিদি যখন বিয়ে করে চলে গেল তখন সে আর শানু ছিল। এবার শানু একা হয়ে যাবে। তার গলার কাছে ব্যথা করে উঠল। সে ঢোক গিলে বলল, “এত মনখারাপ করিস না সোনা ভাই আমার। আমি তো এ শহরেই থাকব। প্রায়ই আসব। জিতুদিদি আসে না?”

“তবুও কিছুই আগের মতো থাকবে না দেবুদিদি। আমরা সবাই পালটে যাচ্ছি!”

“শানু, দেখ, তুই-ও হয়তো কলকাতা ছেড়ে চলে যাবি একদিন।”

“সেজন্যই তো বলছি।”

“আমরা পালটাব না শানু। আমি-তুই-জিতুদিদি এরকমই বন্ধু থাকব। যেখানেই থাকি, যেমনই থাকি, আমরা মনে-মনে সবসময় কাছাকাছি থাকব!”

শানু ফোঁপাচ্ছে। দেবু মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তার দু’চোখ ভিজে উঠছে! এমন কেন হয়? কেন এমন ছেড়ে যেতে হয়?

সে চুপচাপ শানুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। মাত্র চার বছরের ছোট। কিন্তু কনিষ্ঠ তো বটে। পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। সারাক্ষণ বায়না করছে, পেছনে লাগছে, জেদ করছে, একেবারে নির্ভীক, যে-কোনও ক্ষেত্রে তর্ক জুড়ে দেয়। তার বিষয়জ্ঞান আছে, তর্ক করার সময় খুবই গাম্ভীর্যের সঙ্গে যুক্তি উপস্থাপিত করে। কিন্তু আসলে সে শিশুই রয়ে গিয়েছে। শৈশব মানুষের মানসিক গড়ন নিয়ন্ত্রণ করে। বাকি জীবনের উপর তার প্রভাব নানাভাবে হয়ে থাকে! প্রভাব কেবল অসুখী অসুন্দর শৈশবেরই তো নয়। আদরে-যত্নে প্রতিপালিত হওয়া মানবক তার সেই অপূর্ব পুলকিত অনুভব পরম সম্পদের মতো মনের তলে রেখে দেয়। তার শরীর বাড়ে। প্রকৃতি দেয় যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য। বিষয়বুদ্ধি, স্বার্থবুদ্ধি প্ররোচিত হয়, কিন্তু পরিণতমনস্কতার সেই পুরু সরের তলায়, করতলের নিরাপত্তায় মোমের শিখার মতো, চির অনির্বাণ সেই শৈশবকালের দিব্য আনন্দের আলো। আকাঙ্ক্ষিতকে না পাওয়ার হাহাকার যেমন জীবনব্যাপী, স্নেহে-আনন্দে পরিপ্লুত স্নিগ্ধ শান্তিও তেমনই সারা জীবন সঙ্গে থাকে!

খানিক অশ্রুবর্ষণ করার পর একটু ঘুমিয়ে নিল শানু। এই সময়টুকু দেবু পুনরায় পাঠে মগ্ন হওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল। কিন্তু কাম্মা এসে তাড়া-তাগিদ করলেন।

কাম্মা: এই যে! ঘর-দুয়ার সাজাব বলে জোর করে তুলে দিলাম, এখানে এসে আহ্লাদ খাওয়া হচ্ছে! শানু ওঠ, মিষ্টিগুলো নিয়ে আয়!

শানু: তোমাদের বেশি-বেশি! পাড়ার দোকানের মিষ্টি কিনে ঠাকুর-দেবতাকে দিচ্ছ, আর এঁদের বেলায় যা ভবানীপুর যা।

দেবু: ঠিক বলেছিস রে শানু। আর কাম্মা, আমাদের ঘরবাড়ি তো এমনিতেই সাজানো, আবার কী সাজাবে!

কাম্মা: ও তোরা বুঝবি না। দেবুমণি, যাও তো বাবু, ভাল করে স্নান-টান করো, একটু সাজিয়ে দিই!

দেবু: সাজ! কাম্মা! আর ইউ জোকিং?

কাম্মা: আয়াম সিরিয়াস এনাফ! আমরা সবাই সাজুগুজু করব। তোমায় একটু বেশি সাজানো হবে, কারণ ওঁরা তোমার জন্য আসছেন।

শানু: মা, প্লিজ়! তুমি কীরকম অ-তুমিসুলভ কথা বলছ। দেবুদিদি কি শোকেসের ম্যানিকিন, নাকি মডেল! র‌্যাম্পে হাঁটবে!

কাম্মা: শানু, অসভ্যের মতো কথা বোলো না! সবাই এরকমই করে। তুমি যখন পাত্রী দেখতে যাবে, সে-ও করবে।

শানু: আমার অমন পাত্রীদর্শন দরকার নেই, বুঝলে! গড়িয়াহাট ফুটপাথের পাঞ্জাবি নাকি? ধুলেই রং গায়েব, সাইজ় খাটো, বোতাম ঝুলঝুল করছে, পকেট ছেঁড়া।

কাম্মা: তুই মিষ্টি আনতে যা, পাকা কোথাকার!

দেবু: শোনো কাম্মা, আমাকে সাজানোর দরকার নেই। আমি যেমন, তেমনই থাকতে চাই। ঠিক আছে, বলছ যখন, স্নান করে একটা ভাল ড্রেস পরে নিচ্ছি!

কাম্মা: ড্রেস মানে!

দেবু: স্কার্ট, সালোয়ার– যা হোক!

কাম্মা: না। আজ শাড়ি পরবি। আমি খুব সুন্দর কাঞ্চিপুরম বের করেছি। সঙ্গে একটু সোনার গয়না। একটা টিপ। চুলটা আলগা খোঁপা করে একটু ফুল জড়িয়ে দেব।

শানু: ফিজ়িক্স পড়ানো বাদ দিয়ে একটা বিউটি পার্লার খোলো মা। লাভই লাভ!

দেবু: দুর দুর! ফুল-টুল জড়াব না, শাড়িও পরব না। ভীষণ আড়ষ্ট লাগে। স্কার্ট পরছি কাম্মা।

কাম্মা: তোরা, একালের ছেলেমেয়েরা খুব, খু-উ-ব আত্মকেন্দ্রিক। খুব অবাধ্য! যা তোদের ভাল লাগবে, তাই। আমাদের ভাল লাগা, চাওয়া সব তোদের কাছে মূল্যহীন!

শানু: হোয়াট আ ডায়ালগ! চালিয়ে যাও মা, আমি বেহালায় আবহ তৈরি করছি। টিয়াঁওওও চ্যাঁওও চুঁউউউ! দুঃখের সিন মা!

কাম্মা: যা খুশি কর তোরা!

কাম্মা দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল। শানু চিৎপাত শুয়ে বলল, “দিল মেজাজটা চটকে! যাই, দই-মিষ্টি নিয়ে আসি। কী করবে দেবুদিদি? সাজবে? মা তো চটিতং!”

দেবু: কিছু বিষয় থাকে যা বাধ্যতামূলক হলে অত্যাচার মনে হয়। যেমন সাজ। আমরা আত্মকেন্দ্রিক! নিজের মতে চলতে চাইলেই আত্মকেন্দ্রিক? তোমরা তোমাদের তৃপ্তির জন্য তোমাদের ইচ্ছে চাপিয়ে দিচ্ছ, সেটা আত্মকেন্দ্রিকতা নয়?

শানু: ধুর! গুলি মারো দেবুদিদি! তুমি তো চটে চিটাগং হয়ে গেলে! এসব হল জেনারেশন গ্যাপ, বুঝলে! জিতুদিদি আসুক, সবাই গরম থেকে নরম হয়ে যাবে।

দেবুর সরস্বতী সাধনা মাথায় উঠল। খাতা-বই বন্ধ করে সে ই-পত্র লিখতে বসল, ‘আপনি কি চান আমি আজ শাড়ি পরি?’

সে আবার বই খুলল। ক্রোধ তাকে অস্থির করেছে। হয়তো সে নিজের আনন্দেই অল্প প্রসাধন করত। তাই বলে, ফিল্মের মতো, চরম সাজগোজ করে কাঁপতে কাঁপতে চায়ের ট্রে হাতে এই মূর্ছা যায়-যায় ভাব নিয়ে তাকে দাঁড়াতে হবে? কখনও নয়! তার পিতামহী রক্ষণশীলতা এবং স্বমত অপরে আরোপ করার জন্য নিন্দিত। এখন, তার মনে হচ্ছে, রক্ষণশীলতা নিঃশব্দ অভিশাপের মতো, অদৃশ্য ও বিধ্বংসী অণুজীবের মতো মানুষের শিরা-উপশিরা, হৃদয়-মনে জারি থাকে। সুযোগ পেলেই প্রকাশ ঘটায়। জানান দেয় নিজের অস্তিত্ব!

সে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে রাখল। আশঙ্কা! উদ্বেগ! রাজর্ষির মধ্যেও কি ওই এক সংস্কারের অববাহিকা? একটি উত্তরের উপর সে অনেক সম্ভাবনা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

রাজর্ষির পত্র এল: তুমি কোনও কারণে ক্ষুব্ধ? ‘তুমি’ থেকে ‘আপনি’! বিবর্তন থেকে প্রত্যাবর্তন! তোমার যেমন ইচ্ছে, তেমনই পোশাক পোরো। কখনও তোমায় বলিনি, তুমি সুন্দর। তোমার ব্যক্তিত্ব তোমায় সুন্দরতর করেছে। আমাদের হৃদয়ের সম্বন্ধ। এখানে আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন নেই।

দেবাদৃতা কোনও জবাব দিল না। অসংখ্যবার পড়ল ওই চিঠি। ভাললাগায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। সৌন্দর্য, হৃদয় ও শরীরের সৌন্দর্য, এই বাড়িতে প্রত্যেকের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু যাকে দেখে দেখে চোখ ফেরে না, আশ মেটে না, যে কাছে থাকলে এ জগৎ আনন্দময়, যার কণ্ঠস্বর কাঁপন লাগায় ভিতরে, যার এতটুকু কষ্ট তার নিজের মনে আঘাত দেয়, যার প্রতি সামান্য সন্দেহ তাকে রুষ্ট করে– সে যখন বলে– তুমি সুন্দর, তখন অপূর্ব আলোকময়তায় বিভাসিত হয়ে ওঠে মন! নিজেকেই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, সত্যিই? সত্যিই সুন্দর আমি? আরব্য উপন্যাসের রাজকুমারী, রূপকথার রাজকন্যারা যেমন জিজ্ঞেস করত আয়নাকে!

সে কম্পিউটার বন্ধ করে, বই-খাতা গুছিয়ে নিজের ঘরে গেল। পোশাকের আলমারি খুলে বেছে নিল রাজস্থানি ঘাঘরার মতো কুচি দেওয়া, কালো-লাল-সাদা মেশানো কলমকারি ছাপ দেওয়া, লম্বা ঝুল স্কার্ট, সঙ্গে লালের উপর কালো সুতোয় নকশা করা, কাচের টুকরো বসানো জামা! স্নান সেরে, পছন্দের পোশাক পরে, কপালে আলপনার মতো টিপ পরল লালে-কালোয়। শ্যাম্পু করা চুল খোলা। শুকোলে হাত-খোঁপা করে নেবে। গাঢ় লাল চুনি বসানো দু’টি দুল পরল। কানের লতি থেকে লম্বা সোনার চেনের প্রান্তে, সোনার পাতে মোড়া সেই চুনি দু’টি তার মুখমণ্ডল ও গ্রীবাদেশের সংযোগস্থল চুম্বন করতে লাগল!

এই মুহূর্তে তাকে বিশ্বের সবচেয়ে নন্দিত প্রিয়দর্শিনী প্রেয়সীর মতোই লাগছিল, সে স্নান সেরে প্রেয়ানের অপেক্ষায় দণ্ড-পল হিসেব কষছে। কিন্তু শাড়ি পরেনি বলে কেউ তার সাজপোশাক দেখে খুশি হতে পারল না! শুধু অতিথি আসার আগে শানু বলল, “অনেকদিন পর তোমাকে বেশ তনদুরস্ত লাগছে!”

আর অতিথিরা সকলে এলেন, খেলেন, গল্প করলেন। শানু, রাজর্ষির সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিল। জিতু, শানু, দেবু ও রাজর্ষি তাদের অতিথিভবনে বসে আড্ডা মারল দেদার! এবং, অতিথিরা চলে যাওয়ার পর, তারা কেমন, ইত্যাদি আলোচনাপর্বের ইতি হলে, রাতের পোশাক পরে দেবু যখন প্রতিক্রিয়ার আশায় মেল-বক্স খুলল, সেখানে রাজর্ষির ই-পত্রে লেখা, ‘আমায় হৃদয়ের এক কোণে রেখো, ক্ষতি নেই, সেখানে অনির্বাণ শিখা হয়ে থেকো।’

সে লিখল, ‘তুমি তো আমারই। আমিও কি নিশ্চিন্তে তোমার হতে পারি?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *