1 of 2

ফোর বীস্টস ইন ওয়ান

ফোর বীস্টস ইন ওয়ান

ঈশ্বর যীশু পৃথিবীতে আবির্ভূত হওয়ার ১৭১ বছর আগেকার কথা। তখন সিরিয়ার অন্তর্গত এপিফানেস নামধারী এক নরাধম রাজাকে নিয়ে ইতিহাসবিদরা অনেক বড় বড় কথা লিখে পাতা ভরেছেন। রাজার কম কথা! রাজার সম্বন্ধে কিছু লিখতে বসলেই কলমের ডগা দিয়ে সবার আগে তার সম্বন্ধে কিছু প্রশস্তি তো গাইতেই হয়। রাজার স্তবস্তুতি না করলে ঐতিহাসিককে আর চাকরি করে খেতে হবে না।

কিন্তু ইতিহাস তো আর একজায়গায় থমকে থাকে না। বরং চক্রাকারে আবর্তিত হয়। ব্যাপারটা সত্যি অত্যাশ্চর্য। রীতিমত অবাক হবার মতোই বটে! কারো সম্বন্ধে সত্য গোপন করে যতভাবেই প্রশস্তি গাওয়া হোক না কেন, প্রকৃত ঘটনা চেপে রেখে যতই মিথ্যার ফুলঝুড়ি ছাড়া হোক, হাজার হাজার বছর পরে দেখা যায়, কবর খুঁড়ে প্রকৃত ঘটনাটাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনা হচ্ছে, ব্যাপারটা যেন নতুন করে ঘটে চলেছে।

সত্যি, ব্যাপারটা অত্যাশ্চর্যই বটে। সত্য চিরদিন গোপন থাকে না। আজ না হোক কাল তা প্রকাশ পাবেই পাবে।

যদি তাই সত্যি হয়ে থাকে পাঠক-পাঠিকা তবে চলুন হাজার দুই বছরের পুরনো ইতিহাসের পাতা ঘাঁটাঘাঁটি করা যাক। খোঁজখবর নিয়ে দেখাই যাক না, কেন নরাধম এপিফানেস আর কতরকম পশুসুলভ কাজে লিপ্ত হতে পেরেছে। ভুলে যাবেন না, এ কল্পকাহিনীটা কিন্তু ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে বসে লিখছি। আমরা বিপরতি ইতিহাসের ভাবী চেহারাটা দেখতে চাচ্ছি। তা যদি না হয় তবে তো সত্যিটা জানা সম্ভব হবে না।

বিশ্রি শহরটার নাম অ্যান্‌টিয়েক। একই নাম কাহিনীতেও উল্লেখ করা হচ্ছে।

মিনিট কয়েকের অদ্ভুত চরিত্রের শহরটার অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা দেখার জন্য মনটাকে শক্ত করে বেঁধে নিজেকে তৈরি করে নিন।

ওই যে, চোখের সামনেই যে নদীটাকে দেখতে পাচ্ছেন, সেটার নাম আরস্টেম। অগণিত ঝর্ণা এসে নদীটাকে অধিকতর পুষ্ট করে তুলেছে। আর সেটার জলপ্রপাতের সংখ্যাও কিন্তু নেহাত কম নয়। সব মিলিয়ে নদীটার রূপ-সৌন্দর্য মনোলোভা হয়ে উঠেছে।

নদীটা কখনো পাহাড়ের গা-বেয়ে কুলকুল রবে নেচে নেচে হেলে দুলে নেমে এসেছে সমতল ভূমির দিকে, আবার কখনো বা বাড়িঘর জঙ্গলের বুক দিয়ে এগিয়ে গেছে আপন গতিতে।

এবার দৃষ্টি ফেরাতে হবে দক্ষিণ দিকে।

বারো মাইল দূরে ওই যে কাঁচের মতো স্বচ্ছ আর স্থির জলরাশি দেখতে পাচ্ছেন, ওটাই হচ্ছে ভূমধ্যসাগর।

এবার আপনার দৃষ্টিকে ওখান থেকে তুলে এদিকে নিয়ে আসুন। এদিকে তাকান। এই যে পুরনো প্রাসাদের সারি অরণ্যের মতো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে–এসব কিন্তু সেই প্রাচিনকালে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দেই নির্মিত হয়েছে।

ইতিহাসের পাতা বিপরীত দিক থেকে ওল্টালে আপনি ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে পৌঁছে দেখতে পাবেন, সবই ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়ে গেছে–এক একটা ঢিবিতে পরিণত হয়ে গেছে।

এখন রূপ-সৌন্দর্যের আকর মনোলোভা এ শহরটার শোভা চাক্ষুষ করে আপনার মনে যদি শেকসপীয়রের কবিতা মনে মনে আবৃত্তি করার বাসনা জাগেই তবে কিন্তু মনে রাখবেন, আপনাকে ইতিহাসের বিপরীত দিককার অনেকগুলো পাতা উলটে অনেকগুলো বছর পিছিয়ে যেতেই হবে। কারণ? আরে ভাই, মহাকবি তো এখনো জন্মগ্রহণ করেননি।

ভাবছেন, অদ্ভুত কথা, তাই না? অবাক হচ্ছেন তো? অবাক হচ্ছেন যে, এমন অত্যাশ্চর্য একটা শহর ধ্বংস হয়ে মাটির ঢিবিতে পরিণত হয়ে যাওয়ায় অবাক হচ্ছেন, ঠিক কি না?

আরে ভাই, অবাক হবার কিছুই নেই। এমনটাই তো হয়ে থাকে। একের পর এক তিনটি ভূমিকম্প যে শহরের ওপর তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়েছে, যাকে লণ্ডভণ্ড– একেবারে ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছিল তার এমন পরিণতিই তো হবার কথা।

সে শহরের বুকে এমন ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে গেছে তার বরাতে আর কী-ই বা ঘটতে পারে? আর প্রকৃতি দেবী এখন সে শহরকেই কেমন অবিশ্বাস্যভাবে বুকে করে আগলে আগলে রেখে দিয়েছেন, নিজের চোখেই তো দেখছেন। ছাইয়ের স্থূপের ওপরেই তো দৃষ্টিনন্দন ফুলের থোকা ফোটে! ধ্বংসস্তূপের ওপরেই তো সৌধ গড়ে ওঠে! একে অবশ্যই প্রকৃতিক নিয়ম আখ্যা না দিয়ে অন্য কি-ই বা বলা যেতে পারে।

আরে ধ্যুৎ ছাই! কেবল নিজের কথা নিয়েই সেই তখন থেকে ঘ্যানর ঘ্যানর করছি! কী ভাবছেন, কী বলছেন? নালা-নর্দমা, ময়লা-আবর্জনা, জমাটবাধা ধোঁয়া, পচা গন্ধ? আরে মশাই এ যে হতেই হবে। এটা যে পুতুল পূজার ঘাঁটি। কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়ে যেখানে মহা ধূমধামের সঙ্গে পুতুল পূজা হয়, সেখানে তো নাকে ধুনোর গন্ধ আসবেই আসবে। আর ধূনোর ধোয়াও দেখা যাবেই।

সুবিশাল, আকাশছোঁয়া প্রাসাদগুলোর লম্বা ও মোটা থামগুলোর আড়ালে সরু সরু গলি থাকার তো কথাই বটে। সেখানে ময়লা আবর্জনা জমার কথা নয়! নালা নর্দমা থেকে দুর্গন্ধ ছড়াবে না! কি যে বলেন ভাই, এসব তো মামুলি ব্যাপার।

না, হাসবেন না। একদম হাসবেন না বলে দিচ্ছি। ওই যে আধা-উলঙ্গ লোকগুলোকে দেখছেন, যার মুখে রঙের প্রলেপ দিয়ে হাত-পা উঁচিয়ে গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে চলেছে, তারা কিন্তু কেউই উন্মাদদশা হয়নি, মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেনি। তবে? কি তাদের পরিচয়? তারা প্রত্যেকে এক-একজন দার্শনিক। জ্ঞানের ভাণ্ডার নিঙড়ে দশজনকে জ্ঞানদান করে চলেছেন। তবে সবাই কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানী নন। ভণ্ডের সংখ্যাও নেহাৎ কম নয়। তারা নীতিকথাই বেশি বলেন। সত্যি বলছি, ভণ্ডরাই বেশি নীতি কথা বলে থাকে, ঠিক কি না?

এবার ওই দিকে, ওই দিকে দৃষ্টিপাত করুন। ভালো করে তাকিয়ে দেখুন কেমন অমানবিক আচরণ! সহজ-সরল-নিরীহ ম প্রকৃতির মানুষগুলোকে লাঠিপেটা করে একদল লোক কেমন উল্লসিত হচ্ছে, মজা লুটছে! ওরা কারা জানতে ইচ্ছা করছে, তাই না। বলছি তবে শুনুন, ওরা রাজার উমেদার, ঠাঙাড়ের দল। ওদের ভাঁড় বললেও ভুল করা হবে না। যেন-তেন প্রকারে রাজাকে সন্তুষ্ট করাই ওদের এক মাত্র লক্ষ্য। ওরা তো ভালোই জানে, রাজাকে খুশি করতে, মুখে হাসি ফোঁটাতে পারলেই তাদের ভাগ্য খুলে যাবে।

কী ব্যাপার বলুন তো ভাই, ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছেন নাকি? হাবভাব দেখে মনে তো হচ্ছে, ভয়ই পেয়েছেন। শহরময় জংলি জন্তু-জানোয়ার দাঁড়িয়ে রয়েছে তাতে আপনার ভয়ে এমন মুষড়ে যাবার কী আছে? ওরা তো মানুষের সেবা করা ছাড়া অন্য কিছুই করছে না। কোনোরকম বদ মতলবও ওদের মাথায় নেই। মানুষের সেবা করাকেই ওরা জীবনের ব্রত বলে গ্রহণ করেছে। আর তা করছে সে তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন। লক্ষ্য করে দেখুন তো ওদের কারো গলায় দড়ি আছে কি? না, কারো গলায়ই নেই।

দেখুন, তাকিয়ে দেখুন, সিংহ, বাঘ আর চিতাবাঘ পর্যন্ত সবাই কেমন স্বাধীনভাবে মনিবদের অনুসরণ করে চলেছে। একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন, ওদের মতো অনুগত ভৃত্য বুঝি আর হয় না।

প্রতিটা জন্তুজানোয়ারকেই ধরে ধরে শিখানো হয়েছে, কখন, কোন কাজ, কিভাবে করতে হবে। তবে এও সত্য যে, ওদের যত শিক্ষাই দেওয়া হয়ে থাক না কেন মাঝে মধ্যে শিক্ষা দীক্ষাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আদি হিংস্র জানোয়ার বনে যায়। হিংস্র মনোভাবই তাদের মধ্যে তখন সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর হিংস্রতার বশবর্তী হয়ে তারা অস্ত্রধারীকেও চিবিয়ে খেয়ে ফেলে, বলদের রক্ত পান করে পরম তৃপ্তি লাভ করে। আরে ভাই, এসব তো নিতান্তই তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যাপার। এসব নিয়ে কেউ তিলমাত্র ভাবে না, প্রয়োজনও তো নেই।

আসল কথা কি জানেন? জীবনমাত্রই তো প্রকৃতির দান। মানুষ? প্রকৃতির আহ্বানকে প্রতিরোধ করা কি মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়, বলুন? তা-ই যদি সত্য হয় তবে ওরা কি করে পারবে। অবশ্যই পারবে না, কিছুতেই পারা সম্ভব নয়।

ও ভাই, এমন উৎকর্ণ হয়ে কি শুনছেন? কি শোনার চেষ্টা করছেন, বলুন তো? ও চেষ্টা ছাড়ান দিয়ে আমার দিকে তাকান। যা শোনার বোঝার জন্য এমন আগ্রহী তা আমার মুখ থেকেই শুনুন। হৈ হট্টগোলটা কীসের তা আমিই বলছি, শুনুন। তবে দেখতে-টেখতে চাইবেন না যেন। কারণ কি? কেন এমন কথা বলছি? আরে ভাই, সহ্য করতে পারবেন না। আপনার কান দুটো ঝালাপালা করবে।

যাক, কথা যখন দিয়েছি তখন ব্যাপারটা তো শোনাতেই হবে, বলতেই হবে খোলসা করে। বলছি শুনুন, আমুদের রাজা মশাই নতুন রঙ্গ তামাশা দেখার জন্য অত্যুৎসাহী। হিপোড্রামে অবশ্যই জীবনপণ মল্লযুদ্ধে মেতেছে, তা যদি না-ও হয় তবে নিদিয়ান কয়েদিদের কচুকাটা করা হচ্ছে। তা না হলে রাজা তার নিজের হাতে তৈরি নতুন রাজপ্রাসাদে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আগুনের লেলিহান শিখা দেখার জন্য অত্যুৎসাহী হয়ে পড়েছেন, অথবা এমনও হওয়া খুবই স্বাভাবিক, দৃষ্টিনন্দন কোনো দেবস্থানকে ভেঙে ধূলিস্যাৎ করে দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে হৈ হট্টগোল যে, কমে যাওয়া তো দূরের কথা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে– কেন? হয়তো বা ইহুদিদের একটা পুরো দলকে জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে মারছে। আর এরই জন্য হয়তো আর্তস্বর আকাশভেদী হয়ে ওঠায় এত হৈ হট্টগোল, আর্তস্বর আর হাসির রোল এমন আকাশে-বাতাসে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। আর কত রকম বাজনাই যে বাজছে–শুনতে পাচ্ছেন কিছু? লক্ষ-লক্ষ মানুষের হৈ-চৈ চিৎকার চাচামেচি, এতসব বাজনার আওয়াজকে ছাপিয়ে কানে আসছে। সে কী হাসি!

শুনুন। আরও মজা দেখার সাধ আছে কী? কোনোই চিন্তা নেই। আমার পিছন পিছন আসুন। সোজা নেমে আসুন, দেখবেন কেবলই মজাদার ব্যাপার স্যাপার।

আসুন, আমার পিছন পিছন সোজা এদিক দিয়ে চলে আসুন। আমার পিছন পিছন সোজা নেমে আসুন। ব্যস, এবার কিন্তু সদর রাস্তায় পৌঁছে গেছেন। সাবধান, খুব সাবধান। দেখেশুনে সতর্কতার সঙ্গে পা চালিয়ে আমাকে অনুসরণ করুন। ওই দেখুন, কেমন দলে দলে কাতারে কাতারে মানুষ অনবরত হাঁটছে তো হাঁটছেই। এ হাঁটার যেন বিরাম নেই এটুকুও।

আরে, আরে, করছেন কী! মানুষের মিছিল যাচ্ছে; যাক। আপনি রাস্তার ধারে চলে যান, সরে দাঁড়ান।

লক্ষ মানুষের এ মিছিল কোত্থেকে আসছে, বলুন তো? রাজপ্রাসাদের দিক থেকে। এরা এমন আনন্দে নাচানাচি করতে করতে এগিয়ে চলেছে। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, এ মিছিলে স্বয়ং রাজা মশাই উপস্থিত রয়েছেন। তাই তো এত হৈ হুল্লোড়–খুশির ঝিলিক।

ওই যে, ওই শুনুন, কান পেতে শুনুন নফির গলা ছেড়ে চিল্লাচিল্লি করছে। সে অনবরত হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে বলছে–সরে যাও! তফাৎ যাও! তফাৎ যাও! দেখছ না, রাজা মশাই আসছেন! তফাৎ যাও!

চলুন, আমরা সামনের ওই মন্দিরটায় গিয়ে দাঁড়াই। সেখানে থাম্বার আড়ালে লুকিয়ে পড়ি। সেখান থেকেই আমরা গোপনে পুরো ব্যাপারটার ওপর নজর রাখি। আর দেরি নয়, পা চালিয়ে চলুন, মন্দিরটায় ঢুকে যাওয়া যাক।

আরে আরে করেছেন কী মশাই। আসুন, এদিকে আসুন। একটু জোরে পা চালান। এই দেখ, কী ঝকমারিতেই না পড়া গেল! একটা কেলেঙ্কারি না বাঁধিয়ে ছাড়বেন না দেখছি!

বিগ্রহ দেখেই ভিমড়ি খাওয়ার যোগার হলেন! এমন অবাক হয়ে দেখার কী যে আছে, আমার মাথায় আসছে না। আপনি কি দেবতা আশীমাহকের আগে কোনোদিন দেখেননি। চিনতে পারছেন না?

দেবতা আশীমাহর বিগ্রহ তো এমন অদ্ভুতদর্শনই বটে। ভবিষ্যৎ সিরিয়ানবাসীরা তো এমন অদ্ভুত দেবতার পূজা করবে। হ্যাঁ, সত্যি বলছি–তারা কিন্তু এমন একটা না-মানুষ, না-ভেড়া আর না-ছাগল, জীবনটাকেই ভগবান বলে অন্তরের অন্তঃস্থলে আসন পেতে দেবে। সবটুকু ভক্তি নিঙড়ে তাঁর পূজায় আত্ম নিয়োগ করবে। এবার ব্যাপারটা বুঝলেন তো। না না, আর পুতুলের মতো ঝুটমুট দাঁড়িয়ে থেকে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বেন না। চলুন মন্দিরের ওই থাম্বার আড়ালে গিয়ে আমরা গা-ঢাকা দিয়ে থাকি। ওখান থেকেই আমরা উঁকি দিয়ে দিয়ে রাজা মশাইয়ের মিছিলটাকে দিব্যি দেখতে পাব, সত্যি বলছি।

আরে সাহেব, চশমাটা কোটের পকেট থেকে বের করে চোখে লাগিয়ে নিন।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, চশমটা চোখে লাগান। লাগিয়েছেন? এবার চোখের সামনে যা দেখছেন, এটা কি? হ্যাঁ, ঠিক, এক্কেবারে ঠিক বলেছেন–বেবুনই বটে। এটা বেবুনেরই বিগ্রহ। এর নামকরণ হয়েছে গ্রীক শব্দ মিমিয়া থেকে। বেবুনের বিগ্রহ বুঝলেন?

তবে একটা কথা ভুলে যাবেন না যেন, বেবুনদেব খুবই প্রভাবশালী দেবতা। ভক্তরা সর্বান্তকরণে এঁর পূজা পাঠ করে। আর এ-দেবতার নামে সবাই ভক্তিভাবে গ গদ হয়ে পড়ে।

এবার কী বলছি, ধৈর্য ধরে শুনুন–বেবুনদেবের পূজা করার কথা শুনে আপনি অবশ্যই বুঝতে পারছেন–দেশের পুরাতত্ত্ববিদরা কেমন অপদার্থ, আহাম্মকের শিরোমণি! এবার একটু উৎকর্ণ হয়ে লক্ষ্য করুন তো। কী শুনতে পারছেন কিছু? ঝাড়া নাকাড়া আর তুরি ভেরির আওয়াজ কানে আসচে না? কুচোকাঁচারা কেমন চিল্লাচিল্লি আর লাফালাফি করছে, দেখতে পাচ্ছেন না? দেখুন, ওই যে দেখুন তারা কেমন ধেই ধেই করে লাফাচ্ছে। তারা কেন এখন নাচানাচি লাফালাফি করছে, বুঝতে পারছেন? কিছুই বুঝতে পারছেন না? আরে মশাই রাজার মিছিল আসছে, স্বয়ং রাজা মিছিলে রয়েছেন, কম খুশির ব্যাপার।

নিছক রাজার মিছিলের জন্যই ছেলে-বুড়ো সবাই এমন খুশির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেয়নি। খুশির আরও কারণ অবশ্যই আছে।

কী সে কারণ, যার ফলে সবাই এমন বলগাহীন খুশিতে মাতোয়ারা? রাজা মশাই আসছেন তাতে তো সবাই খুশি হওয়ার কথাই বটে। সবচেয়ে আনন্দের কথা হচ্ছে, রাজা মশাই সবেমাত্র এক হাজার ইজরায়েলবাসীকে কচুকাটা করে ফিরছেন। নিজেই–একদম নিজের হাতে তিনি এক হাজার মানুষকে যমের দুয়ারে পাঠিয়েছেন। এমন অবিশ্বাস্য বীরত্বের পরিচয় দিয়ে রাজা মশাই এখন সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে বিজয় মিছিল নিয়ে পথে পথে চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছেন। একে মহাবীর, অতি বড় খুনি রাজা মশাইও বলতে পারেন, এমন একজন রাজার তোষামোদকারীরা গলাছেড়ে নানাভাবে স্তোকবাক্যে তাকে তুষ্ট করতে সাধ্যাতীত প্রয়াস চালাচ্ছে।

হতচ্ছাড়া নচ্ছার জংলি কোথাকার!

কেবলমাত্র রাজার চাটুকারদের কথাই বা বলি কেন? সৈন্যরাও কোনো অংশে কম যাচ্ছে না। তারা পর্যন্ত কুচকাওয়াজ করতে করতে ল্যাটিন গানের মাধ্যমে রাজার সন্তোষ উৎপাদন করে তার মনোরঞ্জন করছে।

ওই যে, ওই দিকে দৃষ্টি ফেরান। ভালোভাবে লক্ষ্য করুন, দেশের মানুষগুলোর মুখের রঙ কেমন গাঢ় লাল। গালগুলো যেন রীতিমত টস টস করছে।

কেন তাদের মুখ এমন লক্ষণীয়ভাবে লাল হয়ে উঠেছে, বলতে পারেন? পারলেন না তো? আমিই বলছি, শুনুন। আরে মশাই অফুরন্ত খুশির মেজাজের জন্যই তো মুখের রঙ এমন অভাবনীয়ভাবে পাল্টে গেছে। আর সে সঙ্গে মনের হাসিখুশি ভাবটা আরও বেশি করে উঠেছে। অনবরত রাজার গুনগান গাওয়া আর মাত্রাতিরিক্ত শ্ৰদ্ধাপ্রদর্শনের জন্য। চাটুকাররা যে আর কতভাবে রাজার তোষামোদ করবে, তা তিনি বেশি খুশি হবেন তা যেন তারা ভেবেই পাচ্ছে না। অপদার্থ! আহাম্মক কোথাকার।

ব্যস, রাজা মশাই এসে গেছেন। আরে মশাই, ওই তো ঘাড় ঘুরিয়ে ওইদিকে তাকান–ওই তো স্বয়ং রাজা মশাই সবার সঙ্গে পা মিলিয়ে পথ পাড়ি দিচ্ছেন। কী হল–দেখতে পাচ্ছেন না! কী ঝকমারিতেই পড়া গেল রে বাবা! চশমাটা নাকের ডগা থেকে তুলে জায়গামত তুলে নিয়ে ভালোভাবে তাকান, লক্ষ করুন।

আরে মশাই, ওই যে সদ্য জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা জানোয়ারটাকে দেখছেন– উনিই তো দেশের রাজা। তার গজেগমনে পথ পাড়ি দেওয়া, রাজকীয় ভঙ্গিতে না চালানো, আর থেকে থেকে শিবনেত্র হয়ে চলা প্রজাদের দিকে তাৎপর্যপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকানো–এসব দেখেই নিঃসন্দেহ হওয়া যায়, মিলিলের মধ্যে কোটা রাজা মশাই। আরও খোলসা করে বলছি–কিম্ভুতকিমাকার চেহারা, উদ্ভট ভঙ্গিতে তাকাচ্ছে, অর্ধেক উট আর অর্ধেক উটের আকৃতিবিশিষ্ট জানোয়ারটাই তো দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, এবার চিনতে পেরেছেন তো?

আরে ধুৎ! এখন রাজাকে চিনতে পারলেন না মশাই। ঠিক আছে আঙুল বরাবর তাকান। ওই যে অর্ধেক উট আর অর্ধেক বাঘের আকৃতি বিশিষ্ট জানোয়ার দিব্যি চার পায়ে হেঁটে চলেছে, ওই তো রাজা। আর মাঝে মধ্যে খুর ছুঁড়ে লাথি হাঁকাচ্ছে তাকেই সবাই ভক্তিতে গদগদ হয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। আর তাকে ঘুরে যারা চুমু খেতে আসছে, তাদেরই ক্ষুর চালিয়ে ভালোবাসা জানাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছেন না।

এবার লক্ষ্য করুন, যার পিছন পিছন দুই উপপত্নী, তার ইয়া লম্বা ল্যাজটাকে তুলে কোলে করে পথ চলছে–দেখতে পাচ্ছেন না? কী যে বলছেন, আমার মাথায় আসছে না! এমন রাজাকেও ভীড়ের মাঝখান থেকে চিনে বের করতে পারছেন না। যাচ্ছে তা-ই!

ভাই, আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, আমাদের মহামান্য রাজা মশাই–তিনি তো আর সব সময় তো আর রাজপোশাক পড়ে থাকেন না। দিনক্ষণলগ্ন বিচার করে তবেই রাজপোশাক গায়ে চাপান।

সত্যি কথা বলতে কি, বড় স্বেচ্ছাচারি, দাম্ভিক, অত্যাচারী আর বদ্ধ পাগল রাজা মশাই যে সবেমাত্রই এক হাজার ইজরায়েলকে খতম করে এসেছে। তা-ও আবার সবাইকে নিজে হাতেই কচকুাটা করেছে। সেজন্যই তো এমন একটা আনন্দ-উল্লাসের মিছিলে পশুর পোশাকেই সে উপযুক্ত। সে জন্যই পশুর চামড়ায় নিজেকে মুড়িয়ে নিয়ে, আড়াল করে পশুর চেয়ে অধম রাজা মশাই পথে নেমেছেন।

ওই যে, দুটো পশুর চামড়া দেখতে পাচ্ছেন না? তারই তলায় পশুরও অধম রাজা মশাই অবস্থান করছেন, চার নম্বর পশুটাকে বলতে পারেন? এবার নজরে পড়েছে? চিনতে পেরেছেন তো?

আরে মানুষ! মানুষ! মানুষ কেউই নয়! আসলে সবাই, সব মানুষই পশু। নর পশু! আরে বাবা! এ-কী কাণ্ড! হৈচৈ চিৎকার চ্যাঁচামেচি হঠাৎ কেমন যেন পঞ্চমে উঠে গেল। যে! কেন হৈ হল্লা মুহূর্তের মধ্যে এমন বেড়ে গেল!

এখন ছুটাছুটি দাপাদাপিই বা বেড়ে গেল কেন? এ-কী সর্বনাশ! এ যে রীতিমত সর্বনাশের চূড়ান্ত ঘটতে চলেছে! সিংহ, বাঘ আর চিতা বাঘগুলো ক্ষেপে একেবারে উন্মাদ-দশা হয়েছে! ভেকধারী রাজা মশাইয়ের শয়তানি আর বরদাস্ত করতে পারছে না!

অসহ্য! হিংস্র জন্তু জানোয়ারগুলো সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। এতক্ষণ বহু কষ্টে তারানিজেদের সামলে সুমলে রেখেছিল। এখন রাজা মশাইয়ের নষ্টামি–সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

আর তারা কেনই ক্ষ্যাপবে না? এমনকিম্ভুতকিমাকার জীব তো তারা জীবনে দেখেনি। সে জন্যই তো তারা একজোট হয়ে পড়েছে। ভেকধারী রাজাকে বধ করে গায়ের জ্বালা মেটাবার জন্য তারা এখন ক্ষেপে গেছে।

ওই ওই ওই যে, দেখুন রাজা মশাই প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছে। উপপত্নী দুজনও তার সঙ্গ নিয়েছে। তারা রাজা মশাইয়ের ল্যাজটাকে বুকে জাপ্টে ধরে রেখেই উধশ্বাসে ছুটে পালাচ্ছে। একেবারে ড্রোম পালা! পালা! পালা! এক মুহূর্তও দেরি নয়। সোজা

একেবারে হিপোড্রোম!

দেখুন, রাজা মশাইয়ের উল্লাসের বহরটা একবার দেখুন। অব্যাহতি পেয়ে যাওয়ায় তার উল্লাসের বহরটা একবার দেখুন।

রাজা মশাইয়ের চাটুকারদের কাণ্ডটা একবার দেখুন। তারা কেমন হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করে আনন্দ-উল্লাস করছে। কেমন গলা ছেড়ে গান গেয়ে আনন্দ প্রকাশে মেতে গেছে।

উল্লাস! উল্লাস! উল্লাস! কিন্তু লাগামছাড়া উল্লাস কেন? আছে, কারণ অবশ্যই আছে। কি সে কারণ, জানতে চাইছেন? রাজামশাই নাকি দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান লাভ করেছে। আর সিংহ, বাঘ আর চিতাবাঘের দল হেরে গেছে। একেবারে গো-হারা হেরে গেছে তারা।

ব্যস। এতেই যথেষ্ট! আর দেখতে ইচ্ছুক নয়? এতেই শখ মিটে গেছে? একাধারে চার পশু দেখেই আপনার চিত্ত চমৎকার। জন্মের মতো শখ মিটে গেছে? ভালো কথা, তবে এখানেই ইতি করা যাক।

তবে একটা কথা বলে রাখছি, এভাবেই কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে–পুরনো দিনের ঘটনাবলি ঘুরেফিরে আমাদের সামনে হাজির হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *