1 of 2

লিজিয়া

লিজিয়া

শতকরা একশো ভাগ সত্যি বলছি, একটা বর্ণও বা নিয়ে বলছি না, ঠিক কোথায় বা কখন লেডি লিজিয়া-র সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ও পরিচয় হয়েছিল তা এখন আর আমি মনে করতে পারছি না।

তারপর এক দুই করে বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছে। ইতিমধ্যে অনেক দুঃখ যন্ত্রণায় আমার স্মৃতিশক্তি স্তিমিত হয়ে গেছে। কোনো কথাই আমার স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে না।

অথবা হয়তো এসব কথা যে আমার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে না তার প্রকৃত কারণ আমার মনের মানব প্রেয়সীর চরিত্র, তার অতুলনীয় পাণ্ডিত্য, তার শান্ত, মনোলোভা রূপ সৌন্দর্য এবং তারনিচু অথচ সুরেলা কণ্ঠের ভাষার যাদু এমনই ধীরে মন্থর গতিতে আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে প্রবেশ করেছিল যে, সে সবকিছুই গোপন অন্তরালে এবং অজানা-অচেনাই রয়ে গেছে। আজ আমি একটা বর্ণও স্মৃতির পাতায় টেনে আনতে পারছি না।

তবুও আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি তার সঙ্গে আমার প্রথম আর তারপর থেকেই রাইন নদীর অদূরবর্তী একটা বড়, পুরনো ও দ্রুত ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চালা নগরে দেখা সাক্ষাৎ হত।

আমাদের মধ্যে বহু কথাই হত কিন্তু তার পরিবার সম্বন্ধে কোনো কথাই আমি তার মুখ থেকে কোনোদিনই শুনতে পাইনি। তবে সে যে বহু প্রাচীন এক বংশদ্ভুতা এ বিষয়ে আমার অন্তরে তিলমাত্রও সন্দেহ নেই।

লিজিয়া। আমার লিজিয়া! আমার প্রাণ-প্রেয়সী লিজিয়া!

সত্যি কথা বলতে কি, আমি পুঁথিপত্রের পাতায়, পড়াশুনার মধ্যে এমন গভীরভাবে ডুবে গিয়েছিলাম যার ফলে বাইরের জগত্তার অস্তিত্বের কথা আমার মন ধুয়ে মুছে গিয়েছিল।

লিজিয়া। লিজিয়া’ এ মিষ্টি মধুর নামটার জন্যই সে আজ আর ইহলোকে নেই কল্পনার সাহায্যে তারই মুখটা আমার চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলি।

আর আজ, তার স্মৃতিচারণ করতে বসে, লেখা শুরু করতে গিয়ে বার বার একটা কথাই আমার স্মৃতির পটে ভেসে উঠছে, সে ছিল আমার অন্তরতমা, বন্ধু আর বাগদত্তা, যে আমার প্রতিদিনের পাঠসঙ্গিনী, আর শেষপর্যন্ত আমার প্রিয়তমা সহধর্মিনী। কিন্তু, কিন্তু তার পৈত্রিক নামটাই কোনোদিন আমার পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। আমি নিজে কোনোদিন জিজ্ঞাসা করিনি, আর সে-ও কোনোদিন মুখ ফুটে আমাকে বলেনি। কেন? এটাকে কি আমার প্রেয়সী লিজিয়ার খেয়াল বলেই মনে করব? অথবা এ ব্যাপারে তাকে আমি কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করি না, আমার প্রেমের গভীরতার পরীক্ষা করাই কি তার উদ্দেশ্য ছিল? তা যদি না-ই হয় তবে এটা নিছকই আমার একটা খেয়াল ছাড়া কিছু নয়–প্রেমের ব্যাপারে আমার এক নির্ভয় রোমাঞ্চকর আত্মনিবেদন?

আমার অন্তরের গভীরে একমাত্র সে ঘটনার কথাই মোমবাতির শিখার মতোই টিমটিম করে জ্বলছে–খুবই ঝাপসা মনে আছে, ব্যস। অস্পষ্টভাবে মনে আছে, এর বেশি কিছু শত চেষ্টা করেও স্মৃতিতে আনতে পারি না। প্রেমের প্রথম সূচনা কখন, কিভাবে যে ঘটেছিল তা আমার স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণভাবে মুছে গেছে–তাতে অবাক হবার তো কিছু নেই। বরং এটাকেই স্বাভাবিক বলেই মনে নেওয়া যেতে পারে।

তবে একটা কথা, একটা প্রিয় ঘটনা কিন্তু আমার স্মৃতি থেকে আজও ধুয়ে মুছে যায়নি। আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে আজও যা জাগরিত আছে, সেটা কী? তার চেহারাটা যেন আজও আমি চোখ বুজলে স্পষ্ট দেখতে পাই।

লিজিয়া ছিল দীর্ঘাঙ্গিনী আর একহারা। আর শেষের দিকে সামান্য ক্ষীণদেহী হয়ে পড়েছিল।

কিন্তু তার শান্ত সৌম্য সরলতা আচরণের মাহাত্মের কথা অথবা তার ধীর-স্থির নমনীয় হাঁটা চলার বিবরণের ব্যর্থ প্রয়াস থেকে আমি বিরত থাকতে চাইছি। তবে এটুকু না বলে পারছি না, তার চলাফেরা-আসা-যাওয়া যেন নিতান্তই একটা ছায়া ছাড়া কিছু নয়।

তারনিটোল তুষার শুভ্র বাহুপল্লবটা আমার কাঁধের ওপর আলতোভাবে রেখে কোকিলের মতো মিষ্টি-মধুর স্বরে আমার নাম ধরে যতক্ষণ সমোধন না করত ততক্ষণ পর্যন্ত আমি অনুভবই করতে পারতাম না আমার ঘরে তার আগমন ঘটেছে। তার মুখাবয়বের মনোলোভ রূপ লাবণ্য? এক কথায় তার ব্যাখ্যা করলে বলতে হয়, বাস্তবিকই অনন্য। অন্য কারো মুখের সঙ্গে তুলনাই চলে না। রূপ-সৌন্দর্যের আকর আমার প্রেয়সী যেন দেবীসুলভ অতুলনীয় মহিমা নিয়ে বিরাজ করত। তার আত্মিক সৌন্দর্যের মহিমা ছিল যথার্থই দেবীসুলভ।

আরও আছে, তার সমুন্নত ললাটও কম দৃষ্টিনন্দন ছিল না। সে দিকে মুহূর্তের জন্য চোখ ফেরালেই মনে হত সম্পূর্ণ নিখুঁত।

সত্যি স্বীকার না করে পারা যায় না, এমন দেবীসুলভ রূপ লাবণ্য আর মহত্বকে বুঝি ভাষার মাধ্যমে যথাযথভাবে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। তার ত্বকের গাত্রবর্ণের বর্ণনা যদি দিতেই হয় তবে আমি প্রথমেই বলব, তার শুভ্রতা হাতির দাঁতের শুভ্রতাকেও দূরে ঠেলে দিত। আর মাথায় সুনিবিড় কৃষ্ণমেঘের মতো একগোছা কেশ তার ঘাড়ে এলিয়ে পড়ত। তারই দু-চারটা উন্নত ললাটের ওপর যখন আলতোভাবে দোল খেত তখন সে শোভা কী মনোলোভা দৃশ্যেরই না সঞ্চার করত! মহাকবি হোমার যাকে ‘হায়াসিন্থসম’ আখ্যা দিয়েছেন।

তার সুডৌল নাসিকার দিকে চোখ ফেরালে মনে হত এর সঙ্গে একমাত্র হিব্রুদের পদকের সৌন্দর্যের সঙ্গেই তুলনা চলতে পারে। সত্যি কথা বলতে কি বাঁশির মতো এমন সুন্দর নাক অন্য কেউ দেখে থাকলেও আমার চোখে অন্তত পড়েনি।

আর তার সৌন্দর্যে ভরপুর মনোলোভা মুখমণ্ডলের দিকে মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মায়, স্বর্গের যাবতীয় সৌন্দর্যরাশি যেন তার মুখে একত্রে পুঞ্জীভূত করা হয়েছে। আহা! তার ওপরের ঠোঁটের সে অতুলনীয় বাকটা নিচের ঠোঁটের সে মনোলোভা সুপ্তি–সে তিলের স্বপ্নময় নীলা ও ছন্দময় বর্ণেও ভাষা, সুপবিত্র তুষারশুভ্র অত্যুজ্জ্বল দাঁতের পাটি দুটো আর ফুটন্ত ফুলের মতো প্রশান্ত হাসি বাস্তবিকই চমত্ত্বারিত্বের দাবি রাখে।

আর? হ্যাঁ, আরও আছে। তার চপল চাপল হরিণীর মতো আয়ত চোখ দুটো যথার্থই দৃষ্টি আকর্ষণ করার ক্ষমতা রাখে। সব মিলিয়ে রূপসি তন্বী কুমারি তরুণি লিজিয়া ছিল আমার স্বপ্নরাজ্যের রাণী।

লিজিয়ার রূপ-সৌন্দর্যের কথা তো একটু-আধটু বললামই। এবার সে বিবরণ থেকে সরে এসে তার জ্ঞানের কথা যৎকিঞ্চিৎ বলছি। তার জ্ঞানের গভীরতার কথা সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়–তার পাণ্ডিত্য ছিল যথার্থই অগাধ। পাণ্ডিত্যের এমন ব্যাপ্তি, এমন গভীরতা অন্য কোনো নারীর মধ্যে আজ পর্যন্ত লক্ষিত হয়নি। প্রাচীন ভাষার ওপর তার দখল ছিল অপরিসীম।

ইউরোপীয় আধুনিক ভাষা সম্বন্ধে আমার যতদূর জানা আছে তার ওপর নির্ভর করে বলতে পারি, কথাবার্তা বলতে গিয়ে সে কোথাও, কোনোদিন এতটুকুও ভুল করেছিল এমন কথা আমার কানে অন্তত লাগেনি। মিষ্টি মধুর সুরেলাকণ্ঠে সে যখন, যে ভাষাতেই কথা বলত আমি শুনে যারপর নাই মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। মোদ্ধা কথা, সে যতদিন আমার সান্নিধ্যে কাটিয়েছে ততদিন আমি সহধর্মিনীর বিদ্যা-বুদ্ধিতে মুগ্ধ হয়েছি। সত্যি কথা বলতে কি, তার বিদ্যা-বুদ্ধির কথা মনে পড়লে আরও আমি ভাবাপ্লুত হয়ে পড়ি।

কিন্তু হায়! বছর কয়েক কাটতেই দেখলাম আমাকে আশাহত করে, হতাশা আর হাহাকারের সমুদ্রে ভাসিয়ে সে জীবনের ওপাড়ে চলে গেল। তখন কী যে অন্তহীন ব্যথা-বেদনা আমার বুকটাকে ভেঙে টুকরো করে দিল তা আমার পক্ষে ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়।

সত্যি বলছি, আমার প্রেয়সী লিজিয়ার অবর্তমানে আমি অন্ধকারে পথ-হারিয়ে ফেলা শিশুর মতো হয়ে গেলাম। আমি যেন তার সজীব উপস্থিতি, তার সুপরিচিত সুরেলা কণ্ঠস্বর নতুন করে বার বার অনুভব করতে আরম্ভ করলাম।

চোখের সামনে যখনই আমি কোনো পুস্তিকা ধরি, তার পাতায় অলস চোখের মণি দুটোকে ভুলাতে চেষ্টা করি তখন প্রতিটা ছত্রে ছত্রে তার অনিন্দ্য সুন্দর অনাবিল হাসিমাখা মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

লিজিয়া ব্যাধির শিকার হয়ে বিছানা আশ্রয় করল। তার চোখের মণি দুটো আগের চেয়ে অনেক, অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়ে পড়ল।

এসেই তার চেহারার পরিবর্তন ঘটতে লাগল। ফ্যাকাশে বিবর্ণ আঙুলগুলোতে কোনো অদৃশ্য তুলির টান যেন মোম রঙের প্রলেপ দিয়ে ছিল। সমুন্নত ললাটের নীলচে শিরাগুলো প্রতিটা আবেগের সঙ্গে যেন বার বার ওঠা নামা করতে লাগল।

আমি তার বিছানা আঁকড়ে পড়ে থাকা দ্রুত পরিবর্তনশীল শরীরটার দিকে নিষ্পাপ চোখে তাকিয়ে থেকে বারবার ফুসফুস নিঙড়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার পরিণতির কথা উপলব্ধি করতে পারলাম, মৃত্যু তার শিয়রে দাঁড়িয়ে।

খুবই সত্যি যে, তার সান্নিধ্যে নিতান্ত ঘনিষ্ঠভাবে বছর কয়েক কাটিয়ে যতটুকু বুঝতে পেরেছিলাম, মৃত্যুর প্রতি তার ভীতি নেই। মৃত্যুকে সে তিলমাত্রও ভয় কওে

। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, এ ব্যাপারে তার সম্বন্ধে যে ধারণা আমি এতদিন অন্তরে পোষণ করেছি তা আদৌ সত্যি নয়, বরং সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। আজ সে মৃত্যুর ছায়ার সঙ্গে যে তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে তা ভাষায় বর্ণনা করা বাস্তবিকই সাধ্যাতীত। চোখের সামনে যে করুণ হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে আমার বুকের ভেতরে ফুসফুস কুঁকড়ে যাবার জোগাড় হত। আমি আর্তনাদ করে উঠতাম। আমি একটু অনুকূল মুহূর্ত পেলেই সমবেদনা প্রকাশ করতাম, তাকে সান্তনা দিতাম, বহুভাবে বোঝাবার ব্যর্থ চেষ্টা করতাম।

আমার প্রবোধ-বাক্যকে তিলমাত্র মূল্য না দিয়েই সে জীবনের জন্য বেঁচে থাকার জন্য এমন তীব্র আকাঙ্খ প্রকাশ করত, যা কানে যাবার আমার প্রবোধ বাক্য এবং যুক্তিগুলো উভয়কেই সমান মূর্খতা বোধ হত। আর এও মনে হত, এতক্ষণ আমি যা কিছু বলে তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছি তা নিছকই ছেদো কথা ছাড়া কিছু নয়।

তা স্বত্ত্বেও এত অন্তর্দাহ, এত ব্যথা বেদনার মধ্যেও একেবারে শেষ মুহূর্তটার পূর্ব পর্যন্ত তার মনোবল ভেঙে পড়েনি।

তার কণ্ঠস্বর ক্ষীণ আর শান্ত হতে হতে এক সময় একেবারেই মিইয়ে গেল। আরও অনেক বেশি খাদে নেমে গেল। এত কিছু সত্ত্বেও তার মুখ নিঃসৃত শব্দগুলোর কথা আমি বলতে পারব না–কিছুতেই না। তার জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত তার সুরেলা কণ্ঠস্বর আমি যত শুনেছি ততই মুগ্ধ হয়েছি, অভিভূত হয়ে পড়েছি।

একটা কথা খুবই সত্য সে যে আমাকে ভালোবাসত এতে তিলমাত্র সন্দেহও আমার নেই, থাকা মোটেই সঙ্গতও নয়। তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের মুহূর্তেই আমি পরিষ্কার উপলব্ধি করতে পেরেছি, তার মতো অন্তকরণের অধিকারী মানুষের বুকে যে প্রেমের সঞ্চার ঘটে তাকে কিছুতেই একটা সাধারণ অনুভূতি বলে মনে করা যায় না, আর তা হতে পারেও না। সংক্ষেপে বললে, তার ভালোবাসা ছিল গভীর আর শতকরা একশো ভাগই নিখাদ।

সবকিছু বুঝেও আমি তাকে আরও ভালোভাবে বুঝলাম, চিনতে পারলাম তার মৃত্যুর পর। তার জীবদ্দশায় তার প্রেমের যে গভীরতা সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত হতে পারিনি তা পূর্ণত্ব প্রাপ্ত হল–সে ইহলোক ত্যাগ করে যাবার পর।

আজও আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, তার হাত দুটোর মুঠোর মধ্যে আমার হাতটাকে রেখে, জড়িয়ে ধরে সে যে এক নিশ্বাসে তার মনের কথাগুলো বলে যেত তা স্বর্গের দেবীদের ভাবানুরাগকেও হার মানাত।

হায় ঈশ্বর! আমার অদৃষ্টে কি এত সুখ, এত আনন্দও ছিল? আমার জীবনে যখন পরম সুখ-শান্তি নেমে এলো তখনই চুপিচুপি আমার প্রাণ প্রেয়সীকে হারাবার অভিশাপ আমার মাথায় নেমে এলো। একে বজ্রপাতের সঙ্গে তুলনা করলেও বুঝি কম করেই বলা হবে। কেন আমি অভিশাপ-জ্বালায় জর্জরিত হচ্ছি? কেন? কেন?

না, এ আলোচনা আমার পক্ষে দীর্ঘ সময় ধরে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়? আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারি না। বুকের ভেতরটা অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে থাকে।

আজ আমি কেবলমাত্র এটুকুই বলতে পারি, প্রেমের বেদীমূলে আমার প্রেয়সী লিজিয়ার এই যে আত্মনিবেদন, তা কি যোগ্য পাত্রে? হায়! না, যে বুকের ভালোবাসা নিঙড়ে নিতান্তই অপাত্রে দান করেছিল।

লিজিয়া, আমার প্রেয়সী–আমার কাছে ধরা দেয় অত্যুগ্র এক জীবনতৃষ্ণারূপে। অফুরন্ত, অনন্ত ছিল যে তৃষ্ণা, যে জীবন দ্রুত পদচারণার মাধ্যমে উড়ে চলে যাচ্ছে তার কাছ থেকে তাকেই আঁকড়ে ধরে কাছে কাছে রাখার অতুলনীয় ও পরম আকৃতি। তার বুকের অন্তরতম কোণে মহাতৃষ্ণা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তার যে অনুভূতিকে তুলির টানে ফুটিয়ে তোলার মতো শিল্পজ্ঞান আমার মধ্যে অনুপস্থিত, লেখনীর মাধ্যমে বুঝিয়ে বলার মতো ভাষার একান্ত অভাব।

অভিশপ্ত যে রাতে সে আমার কাছ থেকে চিরদিনের শোকান্তরে চলে গেল। যেদিন ক্ষীণ অথচ ভাবাপ্লুত কণ্ঠে আমাকে ডাকল।

আমি ধীর পায়ে তার রোগশয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। শিয়রে বসার জন্য হাতের ইশারা করল।

আমি তার মাথার কাছে বসলাম।

সে তার কাঁপা কাঁপা ক্ষীণ হাত দুটো দিয়ে আমার একটা হাত জড়িয়ে ধরল। দুর্বল কণ্ঠে আমাকে অনুরোধ করল, তারই সদ্যরচিত কয়েকটা কবিতা পাঠ করে শোনাতে।

আমি তার অনুরোধ ফেলতে পারলাম না, সে ইচ্ছাও ছিল না।

আমি তার কবিতার গোছো থেকে পরিবেশটার উপযোগি একটা কবিতা বেছে নিয়ে তাকে পাঠ করে শোনালাম।

আমি কবিতাটা পাঠ করে হাতের পাণ্ডুলিপিটা থেকে মুখ তুলে তার দিকে তাকালাম।

লিজিয়া দুর্বল হাত দুটোর ভর দিয়ে খাট থেকে নেমে এলো। মেঝেতে দাঁড়াল। বাহু দুটোকে উর্ধ্বে উত্থিত করে ক্ষীণ কাঁপা কাঁপা গলায় আর্তস্বর উচ্চারণ করল–‘হে ঈশ্বর! হে পরম পিতা!

এই কথা তখন আমার কণ্ঠও বার বার উচ্চারণ করতে লাগল–‘হে ঈশ্বর! হে পরম পিতা!’ এ দৃশ্যটারই পুনরাবৃত্তিই কি চলতে থাকবে? এর কি সমাপ্তি ঘটবে না? এ বিজয়ীকে কি কিছুতেই জয় করা হবে না? জয় করা সম্ভব হবে না।

হে ঈশ্বর, আমরা কি তোমার সন্তান নই। মানুষের কামনা-বাসনার রহস্য কে-ইবা বলতে পারে? সে যে কী অন্তহীন তেজের অধিকারী? দেবদূতের কাছে মানুষ মাথা নত করে না, কিছুতেই পরাজয় স্বীকার করে না–কারো কাছেই নয়। এমনকি ভয়ঙ্কর মৃত্যুর কাছেও না। কিন্তু কেন? এর একমাত্র কারণই হচ্ছে কামনা-বাসনাই তার একমাত্র দুর্বলতা। আর এ দুর্বলতাটুকুর জন্যই মানুষ পরাজয় স্বীকার করতে উৎসাহি হয় না।

ঠিক সে মুহূর্তেই, হয়তো বা গভীর আবেগবশত হৃতশক্তি হয়ে বহু কষ্টে সে তারনিস্তেজ ছাইয়ের মতো বিবর্ণ হাত দুটো ধীরে ধীরে নামিয়ে বিছানায় পাতল।

সে ক্ষণিকের জন্য মৃত্যুশয্যায় নিস্তেজ শরীরটা নাড়াল। তার ফুসফুস নিঙড়ে শেষ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার সঙ্গে তার ঠোঁট দুটোর ফাঁক দিয়ে অস্পষ্ট একটা গুঞ্জনধ্বনি বেরিয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল।

আমি তার নিঃসাড় দেহের ওপর সাধ্যমত ঝুঁকে কান পাতলাম। গ্লালভিল-এর শেষের কথাগুলো কানে বাজতে লাগল।–‘দেবদূতের কাছে মানুষ পরাজয় স্বীকার কওে না, এমনকি মৃত্যুর কাছেও না। মানুষের একমাত্র দুর্বলতা তার দুর্বল কামনা বাসনা।’

আমার প্রেয়সী, আমার লিজিয়া মারা গেল। তাকে হারিয়ে মর্মবেদনায় আমি একেবারে মিইয়ে, মাটির সঙ্গে মিশে গেলাম। বুকভরা হাহাকার আমার একমাত্র সম্বল হয়ে দাঁড়াল।

রাইন নদীর তীরবর্তী অবক্ষয়ের পথে ধেয়ে যাওয়া নির্জন-নিরালা বাড়িটা আমার পক্ষে বেশিদিন আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হলো না। অসহ্য! আমার কাছে বাড়িটা। একেবারেই অসহ্য হয়ে দাঁড়াল।

বিষয় আশয় ধন-সম্পদ বলতে যা বোঝায় তার কিছুমাত্র অভাবও আমার ছিল না। সাধারণ মানুষ ভাগ্যগুণে যা লাভ করতে পারে তার চেয়ে ঢের বেশি লিজিয়া আমাকে দিয়েছিল।

অতএব আর একটা দিনও দেরি না করে নির্জন সে বাড়িটা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে দিশেহারা উদ্দেশ্যে এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে এক সময় হাঁপিয়ে উঠলাম। শেষপর্যন্ত ইংল্যান্ডের এক নির্জন বনাঞ্চলের একটা পুরনো মঠ খরিদ করে নিলাম। কিছু অর্থ ব্যয় করে তার কিছু কিছু অংশ মেরামত করে ব্যবহার উপাযযাগি করে নিলাম।

জীর্ণ যে বাড়িটার বিষণ্ণ ও ভয়ঙ্কর নির্জনতা আর গাম্ভীর্য, আর জঙ্গলাকীর্ণ পরিবেশ, তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত বহু দুঃখ যন্ত্রণাময় প্রাচীন স্মৃতি যেন আমার মন-প্রাণের বিবাগীসুলভ মনোভাবের সঙ্গে হুবহু মিলে গেল। বাড়িটার মধ্যে আমি একটা ভালোলাগার পুরোপুরি ভাব খুঁজে পেলাম। আমার মধ্যে একটা চঞ্চল শিশু যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। শিশুদের মতোই মন দিয়ে, শিশুদের মতোই উম্মাদনার শিকার হয়ে আমি অদ্ভুত অদ্ভুত খেলনা দিয়ে বাড়িটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে নিলাম।

কী একটা অদ্ভুত খেয়াল, পাগলামিও যাকে বলা চলে আমার মাথায় ভর করল। বাড়িটাকে মনের মতো করে সাজিয়ে তোলার জন্য অত্যাশ্চর্য জমকালো বেশ কয়েকটা পর্দা, মিশরের খোদাই করা দৃষ্টিনন্দন বহুমূল্য মূর্তি, বিচিত্র ধরনের কার্নিশ আর চোখ ধাঁধানো কারুকার্যমণ্ডিত আসবাবপত্র আর সে সঙ্গে জরির কাজ করা গালিচ প্রভৃতি আরও কত কি যে বেছে বেছে ফরিদ করে আনলাম বলে শেষ করা যাবে না ।

যাক, উপরোক্ত প্রসঙ্গ আপাতত চাপা যাক। এখন আমি কেবলমাত্র এক অভিশপ্ত ঘরের কথাই বলব।

এক সামরিক উত্তেজনার শিকার হয়ে সোঁ-র শকুন্তলা এবং নীলাক্ষী লেডি রোয়েনা ত্রিভেনিয়নকে নিয়ে গীর্জায় গেলাম। উদ্দেশ্য বিয়ে করে ঘর বাঁধা। করলামও তা-ই। পুরোহিতের তত্ত্বাবধানে বিয়ের পাট চুকিয়ে আমার স্মৃতির পটে চিরজাগরুক লিজিয়ার উত্তরাধিকারিনীর মর্যাদা দিয়ে তাকে গীর্জা থেকে নিয়ে পথে নামলাম। আর স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে তাকে সে বিশেষ ঘরটায় এনে তুললাম।

সদ্য বিবাহিতা স্বামী-স্ত্রীর সে বিশেষ ঘরটার কথা আমার স্মৃতিতে আজও জ্বল জ্বল করছে। সে কথা আমার মন থেকে মুছে যাওয়া তো দূরের কথা, এতটুকুও ম্লান পর্যন্ত হয়নি।

প্রায় দুর্গের মতো দেখতে মঠটার উঁচু গম্বুজের মধ্যে অবস্থিত ঘরটা ছিল গম্বুজের মতোই। আর সেটা ছিল খুবই বড়। পাঁচটা ভুজযুক্ত ঘরটার দক্ষিণ দিককার ভুজটায় ছিল একটামাত্র জানালা। সেটাও বেশ বড়সড়ও বটে। আর তাতে কাঁচ লাগানো ছিল। কাঁচ ছিল উৎকৃষ্ট কারুকার্য মণ্ডিত এবং অখণ্ড একটামাত্র কাঁচ। ভেনিস থেকে সেটাকে আনানো হয়েছিল।

আর কাঁচটার বিশেষত্ব ছিল, সেটার রং ছিল সিসার মতো। তাই সূর্য বা চাঁদের আলো একটু বেশি মাত্রায়ই ঘরে ঢুকত। আর তা কাঁচটার ভেতর দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে ঘরে যাবতীয় বস্তুর ওপর অত্যাশ্চর্য, যাকে বলে ভৌতিক দ্যুতিতে যাবতীয় বস্তুর ওপর ছড়িয়ে পড়ত।

জানালাটা ছিল সুবিশাল। তারও পরের অংশটা গম্বুজের শ্যাওলা ধরা দেওয়ালের সঙ্গে মিলেমিশে ছিল। সেটা বেয়ে একটা পুরনো দ্রাক্ষ্মালতা উঠে চারদিকে তুলির টানে আঁকা নকশার মতো সুন্দরভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।

আর দীর্ঘদিন ধরে একইভাবে অবস্থান করায় ওক কাঠের সিলিংটাকে কেমন। ম্রিয়মান হয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছিল। আর গোলাকার সিলিংটা ছিল খুবই উঁচুতে। তার সঠিক শিল্পরীতি সমৃদ্ধ কারুকার্যও কম মনোলোভা ছিল না। এতে গণিত শিল্পরীতি এবং অর্ধেক ড্রইডিং শিল্পরীতি সমৃদ্ধ কারুকার্য ছিল যা যে কোনো শিল্পরসিকেরই মন জয় করতে বাধ্য।

বেলনাকার সে সিলিংটার ঠিক মাঝখানে থেকে নেমে আসা একটা সোনার চেনের সঙ্গে একটা সোনার ধূপদানি ঝুলিয়ে দেওয়া ছিল। তার গায়ে সারাসেনিক শিল্পরীতির কৌশলে অসংখ্য ছিদ্র করা ছিল যার ফলে সেগুলোর ভিতর দিয়ে বিভিন্ন রঙের আগুনের শিখা কুণ্ডলি পাকিয়ে পাকিয়ে বেরিয়ে আসত। তখন সব মিলিয়ে যে অপরূপ শোভা ধারণ করত তা বাস্তবিকই দৃষ্টি নন্দন।

ঘরটার ভেতরে রুচিসম্মতভাবে সাজানো ছিল প্রাচ্য শিল্পরীতি সমৃদ্ধ খান কতক ঘাট এবং সোনার বাতিদান। আরও আছে, ভারতীয় শিল্পরীতির অনুকরণে তৈরি একটা চেয়ার। এমনকি সুদৃশ্য একটা বিয়ের চেয়ারও সেখানে রক্ষিত ছিল। এ দুটোইনিরেট আবলুশ কাঠ দিয়ে তৈরি আর উভয়েরই মাথার ওপর চমৎকারভাবে একটা করে বহুমূল্য ও সুদৃশ্য চাঁদোয়া শোভা পাচ্ছিল।

আর হায়! দরজা-জানালায় যে সব পর্দা ঝুলিয়ে রাখা ছিল সেগুলোকেই তো দরাজ হাতে চরমনিদর্শন বলে মনে করা যেতে পারে।

কেবলমাত্র দরজা-জানালার পর্দাগুলোর কথাই বা বলি কেন? ঘরটার দেওয়ালগুলো বিশাল আর উচ্চতাও খুবই বেশি–বে-মানানও বটে। দেওয়ালগুলোর আগাগোড়া খুবই ভারি ও সুদৃশ্য শিল্পসমৃদ্ধ। যে সব জিনিসপত্র দিয়ে পর্দাগুলো তৈরি করা হয়েছে ঠিক একই জিনিস দিয়েই মেঝের গালিচাটাও তৈরি করা হয়েছে। আর একই মূল্যবান কাপড় দিয়ে গালিচাটাকে মোড়া হয়েছে তা দিয়েই বিছানার চাদোয়া, ঘাটের ঢাকনা আর পর্দার কুঁচি দেওয়ার কাজ সারা হয়েছে। আর এও বলে রাখা দরকার যে, বহুমূল্য জরির আর সুতো দিয়ে যে কাপড় বোনা হয়েছে। কেবলমাত্র জরি ব্যবহারের জন্যই নয়। কাপড়ের এখানে-ওখানে গাঢ় কালো রং দিয়ে আরবি শিল্পরীতির অনুকরণে বিভিন্ন নকশা ও ফুল-পাতা এঁকে অধিকতর দৃষ্টি নন্দন করে তোলা হয়েছে। আর নকশাগুলো বাস্তবিকই বৈচিত্র্যের দাবি করতে পারে। বিভিন্ন দিক ও কোণ থেকে দেখলে বিভিন্ন রকম দেখায়। ঘরে না পা দিয়েই সেগুলোর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যাবে যেন বিচিত্র সব জীবজন্তুর ছবি। আরও আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, ঘরটার ভেতর দিকে যতই অগ্রসর হওয়া যাবে ততই যেন তাদের রূপ পরিবর্তিত হতে হতে ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে।

তারপর এক পা দুপা করে এগোতে এগোতে ঘরটার কেন্দ্রস্থলে হাজির হলে দেখা যাবে একটু আগে যাদের বিচিত্র জন্তু-জানোয়ার মনে হয়েছে সেগুলোই ক্রমে হরেক রকম ভৌতিক মূর্তি হয়ে আপনাকে আক্রমণ করার জন্য চারদিক থেকে ধেয়ে আসছে।

ভৌতিক পরিবেশটাকে আরও বেশি ভয়ঙ্কর করে তোলা হয়েছে, ঘরের ভেতরে কৃত্রিম উপায়ে একটা তুফানের মতো তীব্র বাতাস সৃষ্টির মাধ্যমে। সে বাতাসটা পর্দাগুলোকে পিছন দিক থেকে অদ্ভুতভাবে হরদম নাচায়। আর এরই ফলে পর্দার গায়ে আঁকা ছবিগুলো যেন ভয়ঙ্কর জীবন্ত রূপ ধারণ করে অন্তরে রীতিমত ত্রাসের সঞ্চার করে। সব মিলিয়ে ঘরটার পরিবেশ এমন ভয়ঙ্কর ও অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে যে ভাষার মাধ্যমে তার যথাযথ বিবরণ দেওয়া মোটেই সম্ভব নয়।

এরকম পরিবেশ সম্বলিত একটা ঘরে, বাসর ঘরে, সো-র লেডিকে নিয়ে আমাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম রাতটা কাটল। কেবলমাত্র প্রথম রাতের কথাই বা বলি কেন? বিবাহিত জীবনের প্রথম মাসের ঘণ্টা, দিন, সপ্তাহগুলো কিছুটা অস্বস্তির মধ্যেই কাটল।

দিন যতই যেতে লাগল একটা ব্যাপার আমার কাছে ততই স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল, আমার সহধর্মিনী আমার কথাবার্তা আর আচরণের হিংস্রতাকে রীতিমত ভয় করে, আমার সংস্রব থেকে দূরে দূরে থাকতেই আগ্রহী, আমার প্রতি তিলমাত্র ভালোবাসাও তার মনে নেই।

আমি কিন্তু তার রকম সকম বুঝে মর্মাহত না হয়ে বরং খুশিই হলাম? তার ওপর বিতৃষ্ণায় আমার মন ভরে উঠল। আর তা মানবসূলভ নয়, বরং নিশ্চিত করে বলা যায় দানবসূলভ।

এরকম নির্মম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে আমার স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠল জ্বলজ্বলে লিজিয়ার স্মৃতি। উফ! কী তীব্র সে অনুতাপ জ্বালা। সেই লিজিয়া যে আমার অন্তরতমা, সবচেয়ে বেশি সোহাগিনী, রূপের আকরতন্বী তরুণি, আজ সে করবে চিরনিদ্রায় সমাহিত।

আমার প্রেয়সী, আমার দেবী লিজিয়ার পবিত্রতা, তার অতুলনীয় বিদ্যাবুদ্ধি-জ্ঞান, তার স্বর্গীয় আচরণ আর গভীর প্রেম–সবকিছু এক এক করে আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে জেগে উঠে আমাকে নতুনতর এক উম্মাদনার জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে চলল দূরে বহুদূরে এক মায়াচ্ছন্ন স্বপ্নলোকে।

আমি যে আফিমের নেশার কবলে পড়েছি, আত্মসমর্পণ করেছি সে আফিমের ঘোরে আমি স্বপ্নে মশগুল হয়ে পড়ি। গলা ছেড়ে আবেগ মধুর স্বরে তার নাম ধরে ডাকি। আমার আকুল স্বরে, ডাকাডাকিতে রাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে, আবার কখনও বা দিনের ফুটফুটে আলোয় উপত্যকার ছায়ায় দাঁড়িয়ে পরিবেশটাকে রীতিমত সরগম করে তুলতাম।

আমার দৃঢ় প্রত্যয় ছিল, পরলোকগত প্রেয়সীর প্রতি আমার মনের তীব্র আকর্ষণ, একাগ্র ও ঐকান্তিক বাসনার জোরেই তাকে আবার ইহলোকে, আমার বুকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হব। হায় ঈশ্বর! তাও কি কখনও সম্ভব, কোনোদিন বাস্তবতায় পরিপূর্ণ হতে পারে! কি করে বা তা ঘটবে? সে যে চিরদিনের মতো ইহলোক ত্যাগ করে গেছে।

যাক, ত্রাঁসা-র লেডি রোয়েনাকে নিয়ে আমি বিবাহিত জীবন যাপন করতে লাগলাম।

বিয়ের পর প্রথম মাস পেরিয়ে আমরা দ্বিতীয় মাসে পা দিলাম। দ্বিতীয় মাসের গোড়ার দিকেই আমার সহধর্মিনী লেডি রোয়েনা ব্যানোর কবলে পড়ে বিছানানিল। অস্বাভাবিক জ্বর। জ্বরের প্রকোপে রাতগুলো ক্রমেই বিরক্তিকর হয়ে পড়তে লাগল। ঘুম… না, ঘুম নয়, চোখ বন্ধ করে বিছানায় শরীর এলিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় সে মুখ দিয়ে বার বার এমন সব আওয়াজ করে বলতে লাগল, বহু মানুষের যাতায়াতের কথা যাদের অস্তিত্ব কেবলমাত্র তার কল্পনার রাজ্যে আর ঘরটার ভৌতিক পরিবেশ ছাড়া ইহলোকের কোথাও থাকা সম্ভব নয়।

আমার সহধর্মিনী সো-র লেডি রোয়েনা-র ব্যামো ক্রমে সারতে লাগল, ভালো হয়ে উঠতে লাগল। শেষপর্যন্ত পুরোপুরি সেরে উঠল।

কিন্তু সে কতদিনই বা সুস্থ থাকল। দিন কয়েক কাটতে না কাটতেই সে দ্বিতীয়বার কঠিন ব্যাধিতে পড়ল। আপাদমস্তক তীব্র যন্ত্রণা বোধ করতে লাগল। ক্রমে তা যন্ত্রণার তীব্রতা বাড়তে বাড়তে তাকে অস্থির করে তুলল। এবার পাকাপাকিভাবে বিছানায় আশ্রয়নিল।

রোয়েনার শরীর তো প্রথম থেকেই দুর্বল ছিল। এবার ব্যাধির আক্রমণে সে পাকাপাকিভাবে বিছানায় নিজেকে সঁপে দিতে বাধ্য হল।

চিকিৎসক এসে রোয়েনাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আঁতকে উঠলেন। দীর্ঘ পরীক্ষার মাধ্যমেও তার রোগনির্ণয় এবং নিরাময়ের উপায় হয়ে উঠল হতাশার ছাপ।

রোগের প্রকোপ ক্রমেই বাড়তে লাগল। আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্নায়ুবিক বিকার বেড়ে গিয়ে মেজাজ মর্জি তিড়িক্কি হয়ে পড়ল।

এক সময় রোগীর পরিস্থিতি এমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল যে, সামান্যতম কোনো ভয়ের কারণ ঘটামাত্র সে যারপরনাই উত্তেজিত হয়ে পড়ে আর নানাভাবে ক্রোধ প্রকাশ করতে থাকে। এবার সে মাঝে মধ্যেই দারুণ চমকে উঠে বলতে লাগল, সে নাকি চাপা একটা শব্দ শুনতে পায়। ফিসফিস করে কে বা কারা প্রায় প্রতি মুহূর্তেই কি যেন বলে। আর এও বলল, পর্দার আড়াল থেকে মানুষের হাঁটাচলার শব্দ শুনতে পায়। হায় ঈশ্বর! এ কী ভয়ঙ্কর কথা।

সেপ্টেম্বর মাস শেষ হতে চলল। তখন এক রাতে সে বেশ তেড়েমেরেই তার ভয়ানক অস্বস্তিকর অবস্থার কথা আমার কাছে বলল।

ভয়ঙ্কর যন্ত্রণাদায়ক তন্ত্রাচ্ছন্ন অবস্থা থেকে সবেমাত্র সে জেগে উঠে চোখ মেলে তাকাল। কিছুটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর ভয়ে ভয়ে আমি শীর্ণ আর চকের মতো ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকালাম।

আবলুস কাঠের রোগ শয্যার এক গায়ের একটা ভারতীয় অটোমানে বসে আমি তার অস্বাভাবিক মুখটার ওপর-দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। সে দুর্বল হাত দুটোর ওপর ভর দিয়ে কোনোরকমে কঙ্কালসার শরীরটাকে সামান্য তুলল। অনুচ্চকণ্ঠে ধরতে গেলে একেবারে ফিসফিস্ করে সে বলল। জান, এইমাত্র সে শব্দটা শুনলাম! এই তো, এই মাত্র!

অথচ আমার কানে কিছুই ধরা পড়েনি।

এই তো, এখনই সে কাকে যেন হাঁটাচলা করতে দেখেছে। সে দেখেছে, অথচ আমার চোখে কিছুই পড়ল না।

আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলাম, তুফানের মতো তীব্র বাতাস পিছন থেকে ধেয়ে ক্রমে পর্দার গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।

আমি তার কথা শুনে একবার ভাবলাম। সে যাকে ফিসফিসা নিভেবে আতঙ্কিত হচ্ছে তা আসলে অস্ফুট নিশ্বাসের শব্দ, ঘরের মূর্তিগুলোর বাতাসে লে খাওয়া তুফানের মতো হাওয়ার স্বাভাবিক পরিণতি ছাড়া অন্য কিছুই নয়।

আমি এ ব্যাপারে কিছু বলব কি বলব না ভাবছি ঠিক তখনই তার মুখ অস্বাভাবিক ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে উঠল। সে দৃশ্য েেখ আমি নিঃসন্দেহ হলাম। এসব ব্যাপার তাকে বুঝিয়ে বলে স্বস্তিদান করার চেষ্টা করা নিছকই পন্ডশ্রম ছাড়া কিছুই নয়।

তার পরিস্থিতি দেখে আমি বুঝতে পারলাম। সে বুঝি সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়বে। ডাকাডাকি করেও তার সাড়া পাওয়া যাবে না।

তখন হঠাৎই আমার মনে পড়ে গেল, চিকিৎসকের পরামর্শনুযায়ী এক বোতল মদ কিনে এনে ঘরে রেখেছিলাম। ব্যস্ত হয়ে উঠে সেটা আনার জন্য এগিয়ে গেলাম।

হেঁটে সে ঝুলন্ত বাতি দানটার নিচে গিয়ে দাঁড়ানোমাত্র এমন দু-দুটো অত্যাশ্চর্য, অবিশ্বাস্য ঘটনার দিকে আমার দৃষ্টি আকৃষ্টহল।

সত্যি আমি রীতিমত চমকে উঠলাম। অদৃশ্য হলেও আমার মনে হলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোনো লোক বা অন্য কিছু ধীরে মন্থর গতিতে আলতো পায়ে আমার পাশ দিয়ে প্রায় গা-ঘেঁষে লে গেল।

শুধু কি এ-ই? আরও লক্ষ্য করলাম, বাতি দানটা থেকে বিচ্ছুরিত উজ্জ্বল আলোক রশ্মির ঠিক কেন্দ্রস্থলে পেতে রাখা সোনালি গালিচাটার ওপরে একটা ছায়া স্থিরভাবে অবস্থান করছে। অনুসন্ধিৎসু নজর মেলে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, দেবদূতের আকৃতিবিশিষ্ট, অনির্দিষ্ট একটা ছায়ামূর্তি। সঠিকভাবে বললে সেটা আধো আলো আধো ছায়ার একটা মূর্তি। একে আলোর ছায়াও মনে করা যেতে পারে।

কিন্তু আফিমের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশি হয়ে যাওয়ার দরুণ আমার নেশাটা যেন বেশ চড়েই গিয়েছিল। তাই ও ব্যাপার স্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানো থেকে নিজেকে সরিয়েই রাখলাম। আর এ ব্যাপারে রোয়েনের কাছেও মুখ খুললাম না, পুরোপুরি চেপেই গেলাম।

হাত বাড়িয়ে মদের বোতলটা নিয়ে মূৰ্হিতা মহিলার বিছানার কাছে ফিরে এলাম। সেটা থেকে এক পেয়ালা মদ ঢেলে তার কাঁপা কাঁপা ঠোঁট দুটোর সামনে ধরলাম।

ইতিমধ্যে সে নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। নিজেই শীর্ণ-দুর্বল হাত বাড়িয়ে আমার কাছ থেকে মদভর্তি পেয়ালাটানিল। আমি এবার অটোম্যানার ওপর শরীর এলিয়ে দিয়ে অপলক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

সে মুহূর্তেই হ্যাঁ, ঠিক সে মুহূর্তেই গালিচার ওপর থেকে মৃদু একটা পদধ্বনি আমার কানে এলো। আমি সচকিত হয়ে পড়লাম। এর এক সেকেন্ড পরেই রোয়েনা হাতের মদের পেয়ালাটা ঠোঁটের কাছে নিয়ে গেল। ঠিক সে মুহূর্তেই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, অথবা আমি হয়তো স্বপ্নই দেখলাম, ঘরের ভেতরের কোনো গোপন ঝর্ণা থেকে চুনির মতো রঙের তরল পদার্থের তিন-চারটি ফোঁটা পেয়ালাটার ভেতরে পড়ল।

অবিশ্বাস্য দৃশ্যটা আমি দেখলাম বটে, কিন্তু রোয়েনা-র চোখে কিছুই পড়ল না। ফলে সে নিঃসঙ্কোচে পাত্রের মদটুকু গলায় ঢেলে দিল। পুরো ব্যাপারটা আমি সতর্কতার সঙ্গে চেপে গেলাম, টু-শব্দটিও করলাম না।

তবু তো এত বড় সত্যটাকে আমার পক্ষে নিজের বুকের ভেতরে চেপে রাখা সম্ভব নয়। সত্যি কথা বলতে কি, ওই চুনি রঙের ফোঁটাগুলো দিয়ে মদটুকু রোয়েনার পেটে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার শারীরিক পরিস্থিতি দ্রুত খারাপের দিকে যেতে লাগল। অবস্থা এত দ্রুত খারাপের দিকে মোড়নিল যা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়।

সে ঘটনার পর তৃতীয় রাতেই আমার পরিচারিকারা নিজেরাই তার কবর খুঁড়ে ফেলল।

চতুর্থ রাত। সে রাতে ভৌতিক ঘরটার বিছানায় এলিয়ে পড়ে থাকা তার আচ্ছাদিত প্রাণহীন নিঃসাড় দেহটাকে আগলে আমি নিশ্চল-নিথর পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলাম। একদিন সে নতুন বৌ হয়ে এ ঘরেই গুটিগুটি ঢুকেছিল না!

আমার আফিমের নেশা তখন তুঙ্গেই রয়েছে। নেশার ঘোরে আমি দেখলাম, একেবারেই অত্যাশ্চর্য অভাবনীয় দৃশ্য একের পর এক আমার চোখের সামনে দিয়ে দ্রুত সরে যাচ্ছে, আবার তেমনই অভাবনীয়ভাবে ঘুরে ঘুরে আসছে।

ঠিক যে মুহূর্তেই আগেকার এক রাতের আর একটা অকল্পনীয় ঘটনা আমার মনের কোণে উঁকি দিয়ে উঠল, ঠিক সে মুহূর্তেই ঝুলন্ত বাতিদানিটার দিকে আমার চোখ পড়ল। সেদিন গালিচার যেখানে আমি অস্পষ্ট একটা ছায়ামূর্তি দেখেছিলাম। তবে এও সত্য যে, এ মুহূর্তে মূর্তিটা এখানে অনুপস্থিত। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমি শ্বাস টেনে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বিছানার ওপর শায়িত ও প্রায় আচ্ছাদিত ফ্যাকাশে বিবর্ণ ও কাঠের মতো শক্তনিষ্প্রাণ দেহটার দিকে তাকালাম।

মৃতদেহটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই আমি পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলাম। ঠিক সে মুহূর্তেই আমার স্বপ্নসাধের লিজিয়া-র গুচ্ছের খানেক স্মৃতি আমার মাথায় এসে ভিড় করল। উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্রের দুর্বার স্রোতের মতো আমার অন্তরকে ভাসিয়ে নিয়ে চলল সে অবর্ণনীয় ব্যথা-বেদনা যা আমি তার মৃতদেহ আগলে বসে থাকার সময় অনুভব করেছিলাম।

রাত শেষ হতে চলেছে। একটু পরেই পূর্ব-আকাশের গায়ে রক্তিম ছোপ ফুটে উঠবে। তখনও আমার যে একমাত্র প্রেয়সীর তিক্ত চিন্তায় বুকভরে নিয়েনিস্পলক চোখে রোয়েনা-র প্রাণহীন দেহটার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধই রাখলাম।

তখন হয়তো বা মাঝরাতই হবে। আবার তার কিছু আগে পরও হতে পারে। আসলে সময়ের হিসেব আমার ছিল না। আফিমের নেশার ঝোঁকে সময়ের হিসেব টিসাব করা আমার পক্ষে সম্ভবই ছিল না। যাক, তখন হঠাৎ শান্ত অথচ খুবই পরিষ্কার চাপা কান্নার স্বর আমার কানে বাজল। কান্নাটা শোনামাত্র আমার নেশা ঝোঁক, তন্দ্রাভাবটা একেবারে হঠাই কেটে গেল।

আমি তৎক্ষণাৎ যন্ত্রচালিতের মতো সোজাভাবে বসে গেলাম। উকর্ণ হয়ে কান্নার উৎসটা আবিষ্কারে মন দিলাম। মনে হলো আবলুশ কাঠের ঘাটটার ওপর থেকেই মৃত্যুর কান্নাটা ভেসে আসছে।

আতঙ্কিত দুরু দুরু বুকে আবার উত্তর্ণ হয়ে রইলাম। কিন্তু অবাঞ্ছিত শব্দটার পুনরাবৃত্তি ঘটল না।

ঘাড় ঘুরিয়ে ঘাটের ওপর শায়িত মৃতার দিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি মেলে সতর্কতার সঙ্গে তাকালাম, মৃতদেহটা কোনোরকম গতি পরিবর্তন করেছে কিনা। না, সে রকম কোনো ঘটনাই আমার চোখে পড়ল না।

কিন্তু কিন্তু আমার শোনার ভুল বলেও তো মেনে নিতে উৎসাহ পাচ্ছি না। শব্দটা যত অস্পষ্টই হোক না কেন আমার কানে তো ঠিকই বেজেছে। আর তো শোনামাত্র আমার অন্তরাত্মা সচেতন হয়ে উঠেছে।

অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে শবদেহটার দিকে আমার মন আর দৃষ্টিকে আবদ্ধ করে রাখলাম।

এক-এক মুহূর্ত করে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেল। তবু সে রহস্যটা ভেদ করা কিছুতেই সম্ভব হলো না।

শেষপর্যন্ত এক সময় আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, ক্ষীণ অথচ খুবই ম্লান একটা প্রায় অদৃশ্য একটা রঙের প্রলেপ যেন তার গালে আর চোখের পাতার সূক্ষ্ম শিরাগুলোতে লেগে রয়েছে।

এক বিশেষ অনুচ্চারিত আতঙ্ক ও ভীতির সঙ্গে মানবীয় কোনো ভাষায় যার ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়–আমার হৃদযন্ত্রের ধুকপুকানি যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। স্থবিরের মতো আমি যেখানে ছিলাম ঠিক সেখানেই বসে থাকলাম, একচুলও নড়লাম না। তবু কর্তব্যজ্ঞানই আমাকে শেষপর্যন্ত নিজেকে সামলে রাখার ক্ষমতা ফিরিয়ে দিল।

না। আমার মনে তিলমাত্র সন্দেহই রইল না যে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন আমরা একটু আগেই সেরে রেখেছি। রোয়েনার দেহে এখনও প্রাণের চিহ্ন বর্তমান, জীবিতই রয়েছে। যত শীঘ্র সম্ভব কিছু একটা করতে হয়। কিন্তু চাকরবাকরদের বাসস্থল থেকে গম্বুজটার দূরত্ব বেশ কিছুটা। চিৎকার করে ডাকলেও কারো সাড়া মিলবে না।

ঘর থেকে বেশ কিছুক্ষণের জন্য বাইরে না গেলে সাহায্য-সহযোগিতা করার মতো কাউকেই ডেকে আনার কোনো রাস্তাই নেই। কিন্তু তা করা আমার সাহসে কুলিয়ে উঠল না।

তাই সে আত্মাটা এখনও এখানেই ঘুরপাক খাচ্ছে, আমি একাই তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য সচেষ্ট হলাম।

তবে অল্পক্ষণের মধ্যেই লক্ষ্য করলাম রোগীর পরিস্থিতি আবার ক্রমে খারাপ হয়ে উঠছে, রোগের প্রকোপ বেড়েই চলেছে।

রোগীর গাল আর চোখের পাতার রক্তিম ছোপটুকু ক্রমেই উঠে গিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে উঠছে।

রোগী কোঁচকালো ঠোঁট দুটোকে একত্র চেপে ধরেছে। আর তাতে মৃত্যুর ভয়ঙ্করতা প্রকাশ পাচ্ছে।

রোগীর গায়ে হাত দিয়ে আমি নতুন করে চমকে উঠলাম। দেখলাম, তার সর্বাঙ্গ বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে আসছে আর শরীর ক্রমেই দ্রুত কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ছে।

আমার সর্বাঙ্গ আবার কম্পন দেখা ছিল। আমি আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে আবার অটোমানটায় ধপাস করে বসে পড়লাম। লিজিয়া-র জাগ্রত ছবিগুলো আবার নতুন করে ক্রমান্বয়ে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল।

নিদারুণ আতঙ্ক আর অস্থিরতার মধ্য দিয়ে একটা ঘণ্টা কেটে গেল। ঠিক যে মুহূর্তেই আমার কানে দরজার দিক থেকে দু-একটা অস্পষ্ট শব্দ আমি শুনতে পেলাম, কিন্তু এ কি করে হতে পারে?

শব্দগুলো শোনামাত্র আমার বুকের মধ্যে ধুক পুকানি শুরু হয়ে গেল। আতঙ্কে আমার সঙ্গি আড়ষ্ট হয়ে আসতে লাগল। আবার-আবারও সে অবাঞ্ছিত শব্দটা শুনতে পেলাম, পর মুহূর্তেই শুনতে পেলাম একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস।

আমি যন্ত্রচালিতের মতো মৃতদেহটার ওপর ঝুঁকে দেখতে পেলাম স্পষ্ট দেখতে পেলাম, ঠোঁটে দুটো তিরতির করে কাঁপছে।

মিনিট খানেক পরেই কাঁপা-কাঁপা ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক হতেই চোখের সামনে মুক্তোর মতো চকচকে ঝঝকে দাঁতের পাটি স্পষ্ট হয়ে দেখা দিল। আতঙ্কে আমার শরীরের সব কটা স্নায়ু যেন এক সঙ্গে বিকল হয়ে পড়তে লাগল আর বুকের ভেতরে বয়ে চলল উদ্দাম সমুদ্রের ঢেউ।

আমি উপলব্ধি করতে পারলাম। আমার দৃষ্টি ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছে, বুদ্ধি বিবেচনা ভোতা হয়ে পড়ছে, আমি যেন ক্রমেই ঝিমিয়ে পড়ছি।

শেষপর্যন্ত প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়ে কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করার মতো শারীরিক ও মানসিক বল ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলাম।

গাল দুটো আর কপালে আবার কিছুটা আলোর আভা ফিরে এসেছে, সর্বাঙ্গে ঈষদুষ্ণতা লক্ষিত হচ্ছে, আর বুকের ধুক ধুক্ শব্দটাও তাতে জানান দিচ্ছে।

মহিলার দেহে প্রাণের লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে, বেঁচে উঠেছে। তাকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য দ্বিগুণ উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলাম।

এক চিলতে ন্যাকড়া ঠাণ্ডা পানি ভিজিয়ে তার কপাল আর হাত দুটো ভালো করে মুছিয়ে দিলাম। অভিজ্ঞতার ঝোলা ঝেড়ে এমন সব পদ্ধতিতে কাজ চালিয়ে যেতে লাগলাম চিকিৎসাশাস্ত্রে যার হদিস মিলবে না। কিন্তু সবই ছাইয়ে পানি ঢালার সামিলই হয়ে গেল।

তার গাল আর চোখের পাতা দুটোর রক্তিম ছোপটুকু একেবারেই হঠাৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, নাড়ির গতি স্তব্ধ হয়ে গেল, ঠোঁটে দুটোতে মৃত্যুর ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল। আর চোখের পলকে সর্বাঙ্গ বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে এলো আর পাণ্ডুরতাও কাঠিন্য ভাবটাও স্পষ্ট হয়ে উঠল। আর দীর্ঘদিন কারাযন্ত্রণা ভোগ করছে এখন মানুষের দেহে যে সব লক্ষণ দেখা দেয় সে সবই তার দেহে এক-এক করে প্রকট হয়ে উঠতে লাগল।

আবার হ্যাঁ, আবারও আমি লিজিয়ার স্বপ্ন দৃশ্যগুলোর মধ্যে আমি পুরোপরি নিমজ্জিত হয়ে পড়লাম! এ কী অদ্ভুত কাণ্ড! লিখতে গিয়ে আমার হাত, আমার সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে কেন? এ কী হাল হলো আমার।

আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম। আবলুস কাঠের খাটটা থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। আমি সে কান্নার করুণ স্বর স্পষ্ট শুনতে পেলাম।

কিন্তু আমার সে রাতের ভয়-ভীতির বিস্তারিত বিবৃতি দেওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে কি? আর ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগে পর্যন্ত রাতভর আমি কিভাবে এরকম একই জীবন-মৃত্যুর ভয়ঙ্কর নাটকের দৃশ্য মর্মাহিত হয়েছি, কেনই বা বলব? নিষ্ঠুর মৃত্যু প্রতিবারে কিভাবে ফিরে এসেছিল, কিভাবেই বা অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে আমাকে যন্ত্রণাকাতর হৃদয়ে কঠিন সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়েছিল তা তো আমি নিজেই ভালোভাবে জানি না, অন্যের কাছে সে বিবরণ কি করেই বা তুলে ধরা সম্ভব? আর এও আমার বিন্দু বিসর্গও জানা নেই। প্রতিটা সংগ্রামের পরিণতিতে মৃতার দেহে অত্যাশ্চর্য, নিতান্তই অবিশ্বাস্য পরিবর্তন ঘটেছিল?

অভিশপ্ত, ভয়ঙ্কর রাতটা ফুরিয়ে আসছে। যে মহিলার মৃত্যু হয়েছিল সে আর তিরতির করে কাঁপতে লাগল, নড়ে উঠল। এবারের মৃত্যুটা যদিও পূর্বের অন্যান্য মৃত্যুর চেয়েও অধিকতর ভয়ঙ্কর, তবু সে অপেক্ষাকৃত জোরে নড়ে চড়ে উঠল।

আমি মুহূর্তের জন্য তার দিকে তাকিয়েই ঝট করে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। আকস্মিক ভয়ে একেবারে শক্ত কাঠ হয়ে গিয়ে অটোমানটার ওপর নিজেকে সঁপে দিয়ে হাত-পা ছেড়ে পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল-নিথরভাবে বসে রইলাম। একের পর এক ভয়ঙ্কর সব অনুভূতি আর আতঙ্কের শিকার হওয়াতেই আমার এ হাল হয়েছে।

একটু পরে আমি খাটটার দিকে আড় চোখে তাকালাম। দেখলাম, অভাবনীয় শক্তিতে তার মুখ জুড়ে জীবনের রঙ ঝলমলিয়ে উঠল। হাত-পা অবশ হয়ে এলো। আর আমি, আমি হয় ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছি, রোয়েনা বুঝি শেষমেষ মৃত্যুর শৃঙ্খলাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। মৃত্যুকে সে তিলমাত্র পরোয়া করে না।

আমি স্বপ্নে বিভোর হয়ে সবকিছু দেখছিলাম কিনা আমার পক্ষে নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে আমার মধ্যে কিছুমাত্রও সন্দেহ রইল না যখন চোখের সামনে দেখলাম। যেন বিছানায় উঠে বসল, ধীরে-ধীরে একের পর এক কাঁপা-কাঁপা পা দুটো নামিয়ে খাট থেকে নেমে মেঝের কার্পেটের ওপর দাঁড়াল, চোখ দুটো বন্ধ রেখে চলতে-চলতে স্বপ্নবিষ্ট মানুষের মতোই আচ্ছাদিত সে মৃতদেহটা সাহস সঞ্চয় করে গুটি গুটি ঘরটার একেবারে কেন্দ্রস্থলে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার সর্বাঙ্গ অনবরত টলেই চলেছে।

আমি এতটুকুও নড়লাম না, সামান্যতম কাঁপলামও না। কেন? এর কারণ, সে মূর্তিটার হাবভাব প্রত্যক্ষ করায় অকল্পনীয় ও অবর্ণনীয় হাজারো কল্পনা আমার মাথায় ভর করে কিলবিল করতে লাগল। সেগুলোই আমার সবকটা ইন্দ্রিয়কে বিকল করে দিয়ে আমাকে পরোপুরি পাথরের মূর্তিতে পরিণত করে দিয়েছে।

আমি স্থবিরের মতো অটোমানটায় বসে মুখে কলুপ এঁটে ছায়ামূর্তিটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখলাম। আমি যেন কেমন তাল হারিয়ে বসলাম। মাথার মধ্যে শুরু হয়ে গেল অস্থির তুমুল কাণ্ড।

কে? কে ওখানে দাঁড়িয়ে? জীবিত রোয়েনা-ই কী আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে? রোয়েনাই বটে–সেই নীলাক্ষী লেডি রোয়েনা ত্ৰিভানিয়ন-ই তো সে?

কেন? কেন দ্বিধা, এ সন্দেহ কেন আমার মনে দানা বাঁধল? আমি তো তার জীবদ্দশার গোলাপি গাল দুটোই দেখছি, কথা ঠিক কিনা? হ্যাঁ, জীবিত লেডি রোয়েনা র রক্তিম দুটো গালই তো আমার চোখের সামনে দেখছি। এ যে সেই পরিচিত চিবুক, সেই সুস্পষ্ট তিলটা–তারই কি নয় এগুলো নাকি অন্য কারো? তা-ই বা কি করে হয়?

কিন্তু, কিন্তু রোয়েনা কি আগের চেয়ে আরও একটু লম্বা হয়ে গেছে? হ্যাঁ, সে রকমই যেন মনে হচ্ছে, নাকি আমারই ভুল?

ধৎ! এ চিন্তাটাই সবচেয়ে বেশি করে আমাকে অস্থির করে তুলছে। আমি যেন। পুরোপুরি পাগল হয়ে পড়েছি।

নিদারুণ অস্থিরতার শিকার হয়ে আমি আচমকা একটা লাফ দিয়ে সবাচ্ছনে নিজেকে ঢেকেঢুকে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তিটার একেবারে পায়ের কাছে হাজির হলাম।

আমার ছোঁয়া পাওয়ামাত্র তার সর্বাঙ্গ অস্বাভাবিক কুঁকড়ে গেল। বিদ্যুৎগতিতে এক ধারে সরে গেল। যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুত শবাচ্ছাদনের বস্ত্রখণ্ডটা মাথা থেকে খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তার খোলা, এলোমেলো কুচকুচে কালো চুলগুলো বাতাসে আরও ছড়িয়ে পড়ল। আমি বিস্ময় মাখানো অপলক চোখে নীরবে মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

আমার চোখের সামনে সে মূর্তিটা ধীরে-ধীরে চোখের পাতা দুটো মেলল।

আমি উন্মাদের মতো চেঁচিয়ে উঠলাম–‘তুমি! শেষপর্যন্ত সেই তুমি, তুমি এলে! ভুল না, কিছুতেই না। কিছুতেই আমার ভুল হতে পারে না। সেই আয়ত চোখ, কালো, উদাসিন চোখ দুটো তো আমার হারিয়ে-যাওয়া প্রেয়সী, আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে আজও জাগরুক সেই। সেই লেডি লিজিয়ার চোখ দুটোকেই আমি দেখছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *