1 of 2

দ্য ডেভিল ইন দ্য বেলফ্রাই

দ্য ডেভিল ইন দ্য বেলফ্রাই

ভন্ডারভট্টিমিটিস!

ভন্ডারভটিমিটি এক ওলন্দাজ নগর। এটা যে বিশ্বের সুন্দরতম স্থান তা সবারই মোটামুটি জানা আছে। আজকের দিনে না হলেও এক সময় অন্তত এ নগরটা পৃথিবীর সুন্দরতম স্থান হিসেবে গণ্য হত।

জায়গাটা খুবই ছোট, অখ্যাত-অজ্ঞাত। আর রাজপথ থেকে বহু দূরে এর অবস্থান। তাই অনেকের কাছেই সে জায়গাটা অজানা-অচেনা। এ কথা বিবেচনা। করেই জায়গাটা সম্বন্ধে কিছু বিবরণ দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি।

আর বর্তমানে সে জায়গা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যে সব ভয়ঙ্কর বিপদজনক ঘটনা ঘটেছে–তার আদ্যোপান্ত বিবরণ উল্লেখ করছি। উপযাচক হয়ে যে কাজটা আমি হাতে নিয়েছি, তা যে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হব, আমাকে যারা জানেন চেনেন তাদের মনে এ ব্যাপারে কোনো রকম সন্দেহের অবকাশ আছে বলে মনে করি না।

বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি, শিলালিপি আর মুদ্রার ওপর নির্ভর করে আমি এ-কথা রীতিমত দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি ভন্ডারভিট্টিমিটি নগরটার পরিস্থিতি সম্প্রতিকালে যেমন লক্ষিত হচ্ছে সুপ্রাচীনকালেও পরিস্থিতি একইরকম ছিল। বর্তমানে কিছুমাত্রও হেরফের হয়েছে বলে মনে হয় না।

তবে এ-কথাও সত্যি যে, নগটরটার উৎপত্তিকাল সম্বন্ধে নিশ্চিত কোনো ধারণা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু এটুক অন্তত বলা যেতে পারে, নগরটার প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে যে কোনো সুদূর অতীতের কাল্পনিক চিত্র মনে মনে এঁকে নেওয়া যেতে পারে। তবে এ-কথা অবশ্যই মনে করে নেওয়া যেতে পারে সম্প্রতি নগরটার অবস্থা যেমন নজরে পড়ছে, চিরদিন একই রকম অবস্থা ছিল। কেবলমাত্র আমার কথাই বা বলি কেন? নগরের প্রাচীনতম বাসিন্দাটিও নগরটার কোনো পরিবর্তন-পরিবর্ধনের কথা স্মৃতিতে আনতে পারেন না। উপরন্তু এ নগরটার কোনোরকম পরিবর্তন যে ঘটা সম্ভব, এমন কোনো কথাকেও অপমানজনকই জ্ঞান করেন।

যাক গে, যে কথা বলতে চাচ্ছি, জায়গাটা পরিপূর্ণ বৃত্তাকার একই উপত্যকায় অবস্থান করছে। সিকি মাইলের কাছাকাছি এর পরিধি। আর শান্ত পাহাড়ের ঘেরা, সবুজে ঢাকা এক মনোরম পরিবেশ নগরটাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে।

পাহাড়গুলোর চূড়া খুবই উঁচু আর রীতিমত খাড়াই। আর সে সঙ্গে গভীর পার্বত্য বনানীর বাধা বন্ধনের সমস্যা তো আছেই। হয়তো বা এই কারণেই স্থানীয় বাসিন্দারা সাহসে ভর করে কোনোদিনই পাহাড়গুলোর চূড়ায় উঠতে উৎসাহি হয়নি। পাহাড়গুলোর দুর্গমতা ছাড়াও তার আর একটা ধারণাকে গুরুত্ব দিয়েই ও-পথ কোনোদিন মাড়ায়নি। তাদের বিশ্বাস পাহাড়গুলোর বিপরীত দিকে কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই।

সমতল উপত্যকাটাকে কেন্দ্র করে চারিদিকে ছোট ছোট ষাটটা বাড়ি অবস্থান করছে। রাস্তাঘাট পাথরের, মনে হয় টালি বিছিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে।

সবগুলো বাড়িই পাহাড়কে পিছনে রেখে তৈরি, আর সামনের অঞ্চলটা বাড়ির প্রথম ফটক থেকে ঠিক ষাটগজ দূরে গাছগাছালির সমন্বয়ে তৈরি একটা করে সূর্যঘড়ি।

সবগুলো বাড়ির গঠনশৈলী অবিকল একইরকম। আর প্রাচীনত্বের জন্য নগরটার ভাস্কর্যশৈলী কিছুটা বিচিত্র প্রকৃতির হলেও বাড়িগুলোর সৌন্দর্য কিছুমাত্রও বিঘ্নিত হয়নি।

কড়া করে পোড়ানো ইট স্তরে স্তরে সাজিয়ে বাড়িগুলোর দেওয়াল গাঁথা হয়েছে। তাদের রং লাল আর চারদিক বিশিষ্ট। ইটের বিচিত্র রংয়ের জন্যই বাড়িগুলো কালো রং দেখলে মনে হয়, বড়সড় দাবার ঘুটি বুঝি বসিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিটা বাড়ির কার্নিশ সমান উচ্চতায় অবস্থিত আর পাশপালিগুলো সামনের দিকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। জানালাগুলো স্বাভাবিকের তুলনায় ছোট আর তাদের গায়ে বড় বড় কাঁচ ব্যবহার করা হয়েছে। আর কাঠের আসবাবপত্রগুলোর গায়ে সূক্ষ্ম কারুকার্য করা। হাতের কাজ এতই সূক্ষ্ম যে, যে কোনো শিল্পরসিকের বিস্ময়ের উদ্রেক করার ক্ষমতা রাখে। তবে সে সব কারুকার্যের মধ্যে সামান্য কিছু পার্থক্য অবশ্যই নজরে পড়বে। এর কারণও রয়েছে যথেষ্টই। ব্যাপারটা হচ্ছে, সুদূর অতীত স্মরণাতীত কাল থেকে ভান্ডারভট্টিমিটিস নগরের কাঠমিস্ত্রি খোদাইকারকরা সব জায়গায় এবং সব সময় দুটোমাত্র চিত্রই খোদাই করেছে। তাদের মধ্যে একটা হচ্ছে, বাঁধাকপি আর দ্বিতীয়টা ঘড়ি। তবে স্বীকার করতেই হবে, এ কাজটায় তারা খুবই দক্ষ, চমৎকার করে।

এদিকে বাড়িগুলোর বাইরের দিক যেমন লক্ষ্যণীয় ঠিক তেমনই ভেতরের অংশও কম আকর্ষণীয় নয়। যাবতীয় আসবাবপত্র একই পরিকল্পনা মাফিক তৈরি। প্রত্যেক মেঝে একই রকম চতুষ্কোণ টালি বসিয়ে বসিয়ে তৈরি। আসবাবপত্রগুলো একই রকম আবলুস কাঠের মতো কালো কাঠ দিয়ে তৈরি আর পাগুলো সরু ও বাঁকানো।

এমনকি চুল্লির তারগুলো পর্যন্ত সমান চওড়া আর সবগুলোই একই উচ্চতা বিশিষ্ট। তার সেগুলোর প্রত্যেকটার গায়ে যে কেবলমাত্র বাঁধাকপি আর ঘড়িই খোদাই করা আছে তাই নয়, মধ্যস্থলে, সবচেয়ে ওপরে একটা করে সত্যিকারের ঘড়ি রক্ষিত আছে। আর সে ঘড়ি অদ্ভুত আওয়াজ করে করে বাজে।

আর প্রত্যেক ঘড়ি আর বাঁধাকপির মাঝখানে রক্ষিত আছে একজন করে চীনা মানুষের মূর্তি। সেটা দাঁড়ানো আর ভুড়িটা ইয়া বড়। আরও আছে। লোকটার ভুড়ির গর্তটার ভিতর দিয়ে একটা ঘড়ির ডায়ালপেট নজরে পড়ে। মোদ্দা কথা, ঘড়ির ভেতরের সবকিছুই বিচিত্র ধরনের।

এবার চুল্লিগুলো সম্বন্ধে কিছু বলা যাক। সেগুলো বেশ বড়সড় আর গভীরতাও যথেষ্টই। চুল্লির ভেতরের গর্তে অনবরত লকলকে আগুন জ্বলে চলেছে। সে আগুনের ওপরে একটা বড় পাত্র বসানো। ভেতরে মাংস রয়েছে–সিদ্ধ হচ্ছে।

বাড়ির মানুষগুলোর মধ্যে গৃহকত্রী সবচেয়ে ভালো। ভালো মানুষ যাকে বলে তিনি ঠিক তাই। তিনি সব সময়ই কাজের মধ্যে ডুবে থাকেন। তিনি মোটাসোটা ও বেটে খাটো আর বুড়ি। তার মুখটা, বিশেষ করে গাল দুটো লাল আর চোখের মণি দুটো নীল।

তার পোশাক-পরিচ্ছদ? কমলা রঙের পোশাক তার পরনে, পিছনদিকটা ঢোলা ও একটু বেশিরকম ঝুলে পড়েছে আর কোমরটা আটসাট। আর মাথায় একটা চওড়া টুপি। তার গায়ে লাল-হলুদ ফিতে জড়িয়ে দেওয়া রয়েছে। দুপায়ে ইয়া লম্বা সোজা আর লাল চামড়ার জুতা। হলুদ ফিতে দিয়ে বাঁধাকপির ঢঙে গিঁট বাঁধা। আর বাঁ । হাতের কবজিতে বড় সড় একটা হলন্দাজ ঘড়ি বাধা, ডান হাতের মুঠোয় একটা মুণ্ডি। ধরে রাখা। মোটাসোটা, প্রায় গোলগাল একটা বিড়াল প্রায় সর্বক্ষণ তার পাশে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে।

বাড়িতে তিনটি ছেলে। সবাই বাগানে শুয়োর চড়ায়। সবাই বেটেখাটো। সবারই উচ্চতা দু-ফুট করে। তাদের মাথায় একটা করে উঁচু ত্রিভুজাকৃতি টুপি। গায়ে ওয়েস্ট কোট। উরু পর্যন্ত নামিয়ে-দেওয়া। আর পরনে ব্রীটেস। হরিণের চামড়া দিয়ে তৈরি। পায়ে পড়েছে প্রায় হাঁটু অবধি লাল মোজা। পশমের তৈরি। আর ভারী এক জোড়া জুতা, রূপার বকলেস দিয়ে পায়ের সঙ্গে এমনভাবে আটকে দেওয়া হয়েছে যাতে ছুটোছুটি করলেও কিছুতেই খুলে যাওয়ার জো নেই।

এ তো গেল বাড়ির ছেলে তিনজনের পোশাক আশাকের বিবরণ। আর তাদের প্রত্যেকের দুঠোঁটের ফাঁকে একটা করে পাইপ প্রায় সর্বক্ষণই আটকানো থাকে। সেগুলো থেকে গলগল করে ধোয়া ছাড়ে আর শুয়োরগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখে নেয়, আবার ধোঁয়া ছাড়ে আর দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শুয়োরগুলোকে দেখে নেয়। আরে, কথায় কথায় তাদের ডান হাতে যে একটা করে ছোট ঘড়ি বাঁধা আছে, বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম।

গৃহকর্তা ভদ্রলোক অতি বৃদ্ধ। চামড়ায় মোড়া আর উঁচু পিঠযুক্ত একটা আরাম কেদারায় শরীর এলিয়ে দিয়ে বৃদ্ধ গৃহকর্তা সর্বক্ষণ খোলা সদও দরজায় বসে থাকেন। বেটেখাটো তার চেহারা, আর ভুড়িটা লক্ষ্যণীয়। চোখ দুটো গোল আর বড় বড়। আর থুনিটা যেন দুই ভাঁজ করা।

গৃহকর্তা বৃদ্ধের পোশাক-পরিচ্ছদ ধরতে গেলে ছেলেদের মতোই। তবে অমিল যা রয়েছে হচ্ছে, তার দুঠোঁটের ফাঁকে আঁকড়ে-রাখা পাইপটা তাদের পাইপগুলোর তুলনায় বেশ বড়–লম্বা। আর গল গল করে ধোঁয়াও বেরোয় প্রচুর পরিমাণেই। আর ছেলেদের মতো তারও একটা ঘড়ি রয়েছে। তবে ছেলেদের মতো কবজিতে বাঁধা নয়, ফিতের সাহায্যে কোটের পকেটে রেখে দিয়েছেন।

বৃদ্ধ গৃহকর্তা আরাম কেদারাটায় শরীর এলিয়ে দিয়ে বাঁ হাঁটুর ওপর ডান পা টা তুলে দিয়ে বিশেষ-ভঙ্গিতে আয়েশ করে বসে। তার চোখেমুখে গাম্ভীর্যের ছাপ সুস্পষ্ট। একটা চোখ সর্বক্ষণ বিশেষ একটা বস্তুর ওপরনিস্পলকভাবে নিবদ্ধ রাখেন। আর সে বিশেষ বস্তুটা সমতলের কেন্দ্রস্থলে অবস্থান করছে।

সে বিশেষ বস্তুটা নগরের পারিষদ ভবনের চূড়ায় রক্ষিত আছে। নগর-পরিষদের সদস্যরা সবারই চেহারা বেটেখাটো, প্রায় বলের মতোই গোলগাল। যাকে বলে নাদুস নুদুস। তাদের গা দিয়ে যেন তেল চুঁইয়ে পড়ে। তাদের সবার চোখও গোল, আর থুনি ভাঁজ করা।

আমি নগরে যতদিন ছিলাম, তার মধ্যে নগর পারিষদরা কয়েকটা অধিবেশন আহবান করেছিল। নগর পরিষদ ভবনেই অধিবেশন বসেছিল। পারিষদরা সবাই একমত হয়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। নিচে যে সিদ্ধান্ত গুলো উল্লেখ করা হল:

‘সে আসলের প্রচলিত নিয়ম-কানুনের পরিবর্তন অন্যায়।’

‘ভান্ডারভটিমিটিসের বাইরে কিছুমাত্রও গ্রহণ করার মতো নয়।’

‘আমাদের বাঁধাকপি আর ঘড়িকেই আমরা আঁকড়ে ধরে রাখব।’

এ সুযোগে নগর-পরিষদের অধিবেশনকটা সম্বন্ধে দু-চার কথা বলে রাখছি। তার মাথায় শোভা পাচ্ছে একটা চূড়া, চূড়াটা খুবই উঁচু। তার মধ্যে রয়েছে একটা ঘণ্টাঘর। আর সেখানে হ্যাঁ, সেখানেই রয়েছে সুদূর অতীত থেকেই রয়েছে, এ অঞ্চলের বড়াই করার মতো ও বিস্ময়কর বস্তু–ভন্ডারভট্টিমিটি নগরের সুবিশাল ঘড়িটা। চামড়ায় মোড়া আরাম কেদারায় আয়েশ করে বসে বৃদ্ধ গৃহকর্তা নিস্পলক চোখে এ ঘড়িটার দিকেই তাকিয়ে থাকেন। হবে না-ই বা কেন? এ ঘড়িটার জন্য সে নগরবাসীদের গর্বের অন্ত নেই।

সুবিশাল ঘড়িটার সাতটা মুখ এমনভাবে তৈরি যে, যে কোনো অঞ্চলের যে কোনো প্রান্ত থেকে কোনো-না-কোনো মুখ দেখা যাবেই। অর্থাৎ আকাশচুম্বী চূড়ার সাতটা দিকের প্রতিটা দিকে ঘড়িটার একটা করে মুখ অবস্থান করছে। এ ব্যবস্থার কথা তো আগেই বলা হয়েছে যে, সব দিক থেকে যাতে অনায়াসেই সময় দেখা যায়, এ কথা মাথায় রেখেই এমনটা করা হয়েছে।

ঘড়িটার মুখগুলো সাদা আর বড়। আর এর কাঁটাগুলো মোটা মোটা ও কালো।

ঘণ্টাঘরের কাজকর্ম দেখাশোনা করার জন্য একজনের ওপর দায়িত্ব দেওয়া আছে। তার প্রথম ও প্রধান কাজ ঘড়িটার দিকে নজর রাখা, কাঁটাগুলো ঠিকঠিক ভাবে চলে কিনা দেখভাল করা। আর এ কাজটা কর্মহীন বেতনভোগি পদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণনিদর্শক। এ কথা বলার যুক্তিও আছে যথেষ্টই। কারণ, ভন্ডারভটিমিটিসের সুবিশাল এ ঘড়িটার কোনোরকম বেয়াদপি, গোলযোগের কথা আজ পর্যন্ত কোনোদিন কারো মুখে শোনা যায়নি।

কিছুদিন আগে অবধিও সেরকম যে কোনো বক্তব্যকেই খুবই গর্হিত, ধর্মবিরোধী বলে বিবেচনা করা হত।

সেই আদিকাল থেকেই বড় ঘড়িটা সর্বদাই বাজে। সঠিক সময় জানার মতো এমন কোনো অবলম্বন, কোনো স্থান আর কোথাও ছিল না। অর্থাৎ নগরবাসীদের সঠিক সময় জানতে হলে এঘড়িটার ওপর নির্ভর না করে কোনো উপায় ছিল না।

কর্মহীন অবৈতনিক পদে যারা বহাল রয়েছে সচরাচর লোকে তাদের অবজ্ঞার চোখে দেখে থাকে। আর যেহেতু ভন্ডারভটিমিটি নগরের ঘণ্টাঘরের কাজকর্ম দেখভাল করার জন্য নিযুক্ত কর্মচারীটা কর্মহীন তেনভোগীদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো, গুরুত্বপূর্ণ পদটা অধিকার করে রয়েছে, তাই তো সবাই তাকে বিশ্বের সবচেয়ে সেরা সম্মানিত লোক বলে জ্ঞান করা হয়, রীতিমত সমীহ করে। এমনকি নগরের একরোখা লোকগুলো পর্যন্ত তাকে যথেষ্ট সমীহ করে মান্য করে।

ঘণ্টাঘরের দায়িত্বশীল লোকটার কোটের লেজ চার দিকেই সমান লম্বা, সবচেয়ে লম্বাও বটে। নগরের অন্যান্য বুড়ো লোকগুলোর থেকে তার সবকিছুই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধরনের। যেমন ধরা যাক, তার ব্যবহারের পাইপটা, তার জুতার বকলেসের সঙ্গে অন্য কারো পাইপ আর জুতার ফিতের তুলনাই চলে না। আবার তার চোখ দুটো অন্য সবার চেয়ে বড়, তার ভূড়িটা পর্যন্ত নগরের যে কোনো বুড়ো মানুষের ভুড়িকে টেক্কা দিতে পারে। আর তার থুৎনিটা? অন্য সবার মতো দুই ভাঁজ নয়, পুরোপুরি তিন ভাঁজ। ফলে সহজেই যে কোনো লোকেরই তার থুৎনিটার দিকে নজর যায়।

এতক্ষণ তো আমি ভন্ডারভিট্টিমিটিস নগরের চমৎকার বিবরণটা পাঠকদের সামনে সবিস্তারে তুলে ধরলাম। হায় ঈশ্বর! এমন সুন্দর একটা নগরের বরাতে এত অবর্ণনীয় দুর্দশা ছিল! এর দুর্দশার কথা বলে শেষ করা যাবে না।

নগরটার পুরনো বাসিন্দাদের মধ্যে বহুকাল আগে থেকেই একটা কথা প্রচলিত আছে–‘পাহাড়ের ওপর থেকে কোনোদিনই ভালো কিছু আসবে না। এ কথাটাকে নগরের সবাই ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবেই জ্ঞান করে।

বেশিদিন আগের কথা নয়, এই তো গতকাল দুপুরের পাঁচ মিনিট আগের কথা। ঠিক তখনই পূর্বদিকে পাহাড়ের চূড়ায় এক বিচিত্র দর্শন বস্তু দেখতে পাওয়া গেল সত্যি। একেবারেই অদ্ভুত বস্তু সেটা।

সে বস্তুটার, সে ঘটনাটার প্রতি সবারই সতর্ক দৃষ্টি পড়ল। চামড়ায় মোড়া আরাম কেদারায় বসে-থাকা প্রত্যেক বেটেখাটো বৃদ্ধ ভদ্রলোকেরই একটা চোখ অত্যুগ্র আগ্রহভরা দৃষ্টিতে সে দিকে তাকিয়ে রইল। আর দ্বিতীয় চোখটা? সেটা পাহাড়ের। শীর্ষদেশের অতিকায় ঘড়িটার দিকে। কিন্তু বিচিত্র দর্শন বস্তুটা কি?

দুপুর হতে মাত্র তিন মিনিট বাকি। তিন মিনিট বাকি থাকতেই নগরের সবাই বুঝতে পারল যে, সে বিচিত্রদর্শন প্রাণীটা খুবই বেটেখাটো এক যুবক, বিদেশি যুবক। সে লম্বা লম্বা পায়ে পাহাড়ের গায়ের পথ ধরে নিচে নেমে এলো।

নিচে নেমে আসার পরই নগরের সবাই সে পরদেশি যুবকটাকে ভালোভাবে দেখতে পেল।

এত বেটে, একেবারে ফিনল্যান্ডের দেশের মানুষের মতো কোনো বেটে মানুষকে ভন্ডারভটিমিটিস নগরে, এর আগে কেউ, কোনোদিনও দেখেনি।

আগন্তুক যুবকটার মুখটা গাঢ় নস্যি রংয়ের, নাকটা খুব লম্বা আর খুবই খাড়া। চোখ দুটো মটরদানার মতো গোল, মুখটা চওড়া আর দাঁতের পাটি দুটো সুদৃশ্য–যাকে বলে রীতিমত চমৎকার। তার মুখটা জুড়ে রয়েছে গোঁফ-দাড়ি। আর এ জন্যই তার মুখের বাকি অংশটা পুরোপুরি দেখার উপায় নেই। বহু চেষ্টা করেও কেউ তার মুখটা দেখতে পায়নি।

তার মাথাটা খোলা, চুলগুলো সুন্দরভাবে আঁচড়ে পাট-করা। আর গায়ে আটসাট লেজ-ঝোলা কালো একটা কোট। সেটার একটা পকেট থেকে বেশ বড়সড় একটা সাদা ভাঁজ করা রুমাল ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। বীচেসটা কালো। পায়ে কালো মোজা। আর পাম্প সু। জুতার সঙ্গে একটা করে সার্টিনের ফুল সেঁটে দেওয়া আছে।

তার বগলে সর্বক্ষণ একটা টুপি আর নিজের দৈহিক উচ্চতা থেকে পাঁচ গুণ বেশি দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট একটা বেহালা অন্য বগলে ধরা থাকে। আর বাঁ হাতে একটা সোনার নস্যির কৌটা সর্বক্ষণ থাকবেই থাকবে।

পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে-আসা আঁকাবাঁকা পথ ধরে নামতে নামতে পরমানন্দে অনবরত নস্যি টেনে চলেছে।

খুবই সত্য যে, ভন্ডারভটিমিটিস নগরের মানুষগুলোর দৃষ্টিতে ঘটনাটা একটা লোভনীয়, কৌতূহল উদ্দীপক-অপলক চোখে দেখার মতো দৃশ্যই বটে। আর হবে-ই বা কেন? এমন একটা বিচিত্র মানুষ পাহাড় থেকে হেলেদুলে নামতে থাকলে এমন কোন বেরসিক মানুষ আছে যে চোখ ফিরিয়ে থাকতে পারবে?

সত্যি কথা বলতে কি, লোকটা যতই ধবধবে সাদা দাঁতগুলো বের করে হাসিহাসি মুখ করুক না কেন, তার চোখ-মুখে কিন্তু একটা ধৃষ্টতা আর অশুভ ইঙ্গিত প্রকাশ পাচ্ছে।

লোকটা যখন অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করে লাফিয়ে লাফিয়ে পাড়ায় ঢুকল, তখন তার পায়ের পুরনো পাম্প সুর দিকে চোখ পড়তেই সবার মনে সন্দেহ দানা বাঁধল। আর তার ঢিলেঢালা মাত্রাতিরিক্ত লেজ-ঝোলা কোটের পকেট থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া কেমব্রিজের সাদা রুমালটার তলা দিয়ে উঁকি দেওয়ার সুযোগ লাভের বিনিময়ে তাকে কিছু অর্থ ঘুষ দিতেও সম্মত হল।

কিন্তু সে আত্মম্ভরী হতচ্ছাড়াটা যখন পথের মাঝে সবার সামনে প্রাচীন নাচ দেখাতে আরম্ভ করল, তখন সেখানে এমন অঙ্গভঙ্গি করে কোমর দোলাতে আরম্ভ করল যে, সবার রীতিমত তাক লেগে গেল, বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।

দুপুর হতে তখন ঠিক দেড় মিনিট বাকি। নগরের ভালো মানুষগুলো তখনও ভালোভাবে চোখ মেলে তাকাতে পর্যন্ত পারেনি তখন সে শয়তান লোকটা ভিড় ঠেলে এক লাফে একদম সবার মাঝখানে পৌঁছে, তারপর কোমর দুলিয়ে, হাত পা নেড়ে চেড়ে এমনভাবে এখানে একটু, ওখানে একটু নাচানাচি করল। নগরবাসীরা বিস্ময় বিমূঢ় অবস্থায় যেননির্বাক-নিস্পন্দ হয়ে তার নাচন-কোদন দেখল। তারপরই সে লম্বা লম্বা পায়ে যেন পাখির মতো উড়তে উড়তে সোজা পারিষদ-ভবনের ওপরকার ঘন্টাঘরে গিয়ে হাজির হল।

ঘণ্টাঘরের কাজের নিযুক্ত দায়িত্বশীল লোকটা তার কাণ্ড কারখানা দেখে তো একদম হতবাক হয়ে গেল। সে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পকেট থেকে পাইপটা বের করে ধূমপান করতে শুরু করল।

কিন্তু বেঁটেখাটো আগন্তুক একলাফে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ল। পর মুহূর্তেই তার নাকটা চেপে ধরে এক পাক ঘুরিয়ে দিয়েই আচমকা এমন এক ধাক্কা দিল, দুম করে মাথায় একটা চাটি বসিয়ে দিল। ব্যস, ঘণ্টাঘরের কর্তব্যরত লোকটা সঙ্গে সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।

আগন্তুক ঘণ্টা ঘরের লোকটার বগল থেকে ছিটকে পড়া বেহালাটা কুড়িয়ে নিয়ে সেটা দিয়ে দমাদম আঘাত হানতে লাগল যে, সবাই ভাবল ঘণ্টা ঘরে বুঝি একদল ঢাকি অনবরত ঢাক পেটাচ্ছে। সত্যি সে যে কী ও গমৃগম্ আওয়াজ তা আর বলার নয়।

এ কী অরাজকতা! এসব কী বে-আইনি কাজ শুরু হয়েছে রে বাবা! আর এ যে রীতিমত জবরদস্তি শুরু হল! এসব বে-আইনি জবরদস্তি কাজের বদলা নেবার জন্য নগরের মানুষগুলো একাট্টা হয়ে গেল। তারা উপযুক্ত বদলা নেবার জন্য এমন এক ভয়ানক কাণ্ড করল, সেটা সবাই জানতেও পারল না।

তখন দুপুর হয় হয়। দুপুর হতে ঠিক আধা সেকেন্ড বাকি। ঘণ্টাটা ঢং ঢং শব্দে বেজে ওঠার সময় হয়ে এলো বলে। সবাই নিজের নিজের ঘড়ির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে ব্যস্ত।

তবে এটাও সত্য যে বাড়ির শীর্ষদেশের অতিকায় ঘড়িটাকে নিয়ে আগন্তুক বেটেখাটো লোকটা এমনকিছু একটা কাজ করতে মেতে গেল, যা তার কর্তব্যের আওতায় পড়ে না, মোটেই তার করার কথা নয়।

কিন্তু ঘড়িটা যখন গুরুগম্ভীর শব্দে বাজতে আরম্ভ করল, ঠিক সে মুহূর্তেই সবাই ঘড়ির শব্দ শোনার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে লোকটার কাজকর্মের দিকে নজর দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থা বা সময় কোনোটাই তাদের নেই। সবাই যে নিজের নিজের পকেটঘড়ি নিয়েই পুরোপুরি মেতে রয়েছে।

বাড়ির চূড়ার অতিকায় ঘড়িটা ‘ঢং’ শব্দ করে বেজে উঠল।

ব্যস, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই ভন্ডারভট্টিমিটিস নগরের প্রত্যেক বুড়ো গৃহকর্তাই চামড়ার মোড়া আরাম কেদারায় তড়া করে সোজাভাবে বসে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল–‘টং’।

আর তাদের প্রত্যেকের পকেটঘড়িতে বেজে উঠল–‘টং’। তাদের শুয়োর আর বেড়ালেরা লেজ-মার্কা পকেটঘড়িগুলোর কথা বলছি।

আর তাদের ছেলেদের ঘড়িতেও একই সঙ্গে বেজে উঠল–‘টং’! অতিকায় ঘড়িটায় বেজে উঠল–‘ঢং’!

পকেটঘড়িতে বেজে উঠল–‘ঢং’!

বড় ঘড়িটায় একের পর এক বাজতে লাগল ‘থ্রি! ফোর! ফাইভ! সিক্স! সেভেন! এইট! নাইন! টেন!

আর একই সঙ্গে অন্যসব ঘড়িতেও বাজতে লাগল–‘থ্রি! ফোর! ফাইভ! সিক্স! সেভেন! এইট! নাইন! টেন!’

পর মুহূর্তেই বাড়ির শীর্ষদেশের বড় ঘড়িটা বলে উঠল–‘ইলেভেন’!

সবাই একই সঙ্গে বলে উঠল–‘ইলেভেন’!

অতিকায় ঘড়িটা বলল–‘টুয়েলভ’!

গবা ইনিচু গলায় বলে উঠল–‘ডবলেফ!’

নিজনিজ ঘড়ি বন্ধ করে বেটেখাটো গৃহকর্তা ভদ্রলোকেরা বলল–এখন সময় ঠিক ডবলেফ!’ ডবলেফ!

অতিকায় ঘড়িটা কিন্তু এখনও তার স্বর থামাল না, বলেই চলল। সেটা পরমুহূর্তেই বলল–‘থারটিন!

গৃহকর্তা বৃদ্ধরা বলে উঠলেন–‘ডের টিউফেল’! ডের টিউফেল’!

এবার তাদের সবার মুখেই ঘন কালো মেঘ নেমে এলো। দুম দুম করে সবার মুখ থেকে জ্বলন্ত পাইপ মেঝেতে পড়ে গেল। আর সবারই ডান পা বা হাঁটুর ওপর থেকে তড়াক করে নেমে গেল। আর সে সঙ্গে সবাই আরাম কেদারায় খাড়াভাবে বসে পড়ল।

সবাই সমস্বরে আর্তনাদ করে উঠল–‘ডের টিউফেল!’ সবাই আবার সমস্বরে আর্তনাদ করে উঠল–‘ডারটিন! ডারটিন! –মেইন গট ঘড়িতে তো এখন বাজে ডারটিন!’

এবার সে ভয়ঙ্কর দৃশ্য ঘটে গেল তা আর বলার নয়। কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য রে বাবা! পুরো ভন্ডারভটিমিটিস নগর শোকে হাহাকার করে উঠল। হরদম কপাল চাপড়াতে লেগে গেল।

কেবলমাত্র বৃদ্ধরাই নয়। ছেলেরাও তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আর্তনাদ জুড়ে দিল।

হাহাকার হা-হুঁতাশ করতে করতে গৃহকর্তা বৃদ্ধরা নিজনিজ পাইপে তামাক খুঁজে তাতে অগ্নি সংযোগ করলেন। তারপর লাল চামড়ায় মোড়া আরাম কেদারায় নিজেদের পুরোপুরি সঁপে দিয়ে ঘন ঘন টান দিয়ে গল গল করে ধোয়া ছাড়তে লাগলেন। তারা এত বেশি পরিমাণে ধোয়া ছাড়ল যে, পুরো উপত্যকাটাই ধোয়ার আস্তরণে চাপা পড়ে গেল। দুর্ভেদ্য সে ধোয়ার আস্তরণ ভেদ করে এমনকি নিজের হাতটাকে পর্যন্ত দেখা যায় না।

আর এদিকে? বাঁধাকপিগুলো টকটকে লাল রং ধারণ করল। ক্রমে পরিস্থিতি এমন অবিশ্বাস্য রকম ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়াল, যা আর বলে কি হবে! পরিস্থিতিটা দেখে। একটা কথাই বার বার মনে হতে লাগল যে, ‘স্বয়ং নিক’ বুঝি বা ঘড়ির রূপ পরিগ্রহ করে নগরের সবকিছুর ওপর ভর করেছে। আসবাবপত্রের ওপরকার খোদাই করা মনোলোভা কারুকার্যসমৃদ্ধ ঘড়িগুলোর কথাই ধরা যাক না কেন। সেগুলো যেন ভূতচাপার মতো তিড়িং তিড়িং করে অদ্ভুতভাবে নাচনা-কোদন জুড়ে দিল।

আর চুলির ওপরকার তাকের ওপরে রক্ষিত ঘড়িগুলো আরও অনেক, অনেক বেশি অদ্ভুত কাণ্ডে মেতে উঠেছে। সেগুলোর আকস্মিক তীব্র ক্রোধ সম্বরণ করতে না পেরে একনাগাড়ে কেবল থারটিন-থারটিন বাজতে লাগল। আরও আছে, তাদের দোলকগুলো এমন অত্যাশ্চর্যভাবে এদিক-ওদিক এঁকে বেঁকে দোল খেতে লাগল যে, সে ভয়ঙ্কর বুক-কাঁপানো দৃশ্য চোখে দেখা বাস্তবিকই কষ্টসাধ্য।

পরিস্থিতি কিন্তু ক্রমেই আরও ভয়ঙ্কর–খারাপ হয়ে পড়তে লাগল।

লেজে বাঁধা পকেট ঘড়িগুলোও আর চুপ করে রইল না। তারাও হঠাৎ এমন ক্ষেপে উঠল যা ভাবলেও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। তাদের এমন অসহনীয় কাণ্ডকারখানায় অতিষ্ট হয়ে শুয়োর আর বিড়ালগুলো রীতিমত ক্ষেপে গিয়ে লম্ফ ঝম্ফ শুরু করেছিল। অনবরত ঘঁাও মাও ফেস-ফোঁস করতে একে-ওকে আঁচড় আর কামড় দিতে লাগল।

শুধু কি এই? আচমকা এর-ওর মুখেও আঁচড় মারতে বাকি রাখল না। পরমুহূর্তেই সেটি কোটের ভেতর ঢুকে গিয়ে এমন বিচ্ছিরি তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিল যা কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবতে পারেনি।

এসব ব্যাপার নিঃসন্দেহে অভাবনীয়। কিন্তু এসবের চেয়েও আরও বেশি পরিতাপের ব্যাপার হচ্ছে, বাড়িটার শীর্ষদেশে বসে হতচ্ছাড়া বেঁটে লোকটা যা খুশি এমন তা-ই করে চলেছে। ধোয়ার পর্দার ভেতর দিয়ে একটু পর পরই হতচ্ছাড়াটার মূর্তি চোখে পড়ছে।

আরে, ঘণ্টা ঘরের লোকটার এ কী হাল হয়েছে! সে যে একেবারে কুপোকাৎ! চিৎ হয়ে মেঝেতে পড়ে রয়েছে। আর হতচ্ছাড়াটা তার বুকের ওপর চেপে বসে পড়েছে!

শুধুই কি তার বুকের ওপরে বসে? ঘণ্টার দড়িটাকে সে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছে। আর বার বার মাথা ঝাঁকিয়ে মুখ দিয়ে অনবরত যেমন বিচ্ছিরি শব্দ করে চলেছে, সে কথা মনে পড়লে এখনও আমার কানে তালা লেগে যায়। সে কী বিদঘুঁটে শব্দ রে বাবা!

আর ইয়া পেলাই বেহালাটাকে কোলের ওপর উঠিয়ে নিয়েছে। এবং তার তার গুলোর ওপর হাত দুটোকে এমন আনাড়িভাবে চালাচ্ছে, যার ফলে তাল আর বেতাল যা-ই বলা যাক না কেন, হঠাৎ করে শুনলে মনে হবে সেটা নির্ঘাৎ পাগলের কাণ্ডকারখানা শুরু হয়ে গেছে। পাগল ছাড়া অন্য কিছু ভাবারই জো নেই।

না, আমি আর পারলাম না। আমার পক্ষে সেখানে কিছুতেই থাকা সম্ভব হলো । কেবলমাত্র আমিই নয়, অন্য কারো পক্ষেই সেখানে আর এক মুহূর্তও থাকা সম্ভব। হত না। যা-ই হোক, আমি নিরুপায় হয়েই সেখান থেকে চলে এলাম।

এখন সঠিক সময় আর সুরের পিয়াসি যারা তাদের কাছে আমি একটা অনুরোধ, সনির্বন্ধ অনুরোধ রাখছি–চলুন, আমরা জোট বেঁধে সে নগরটায় যাই। আর সে হতচ্ছাড়া বেঁটে খাটো লোকটাকে বাড়িটার শীর্ষদেশ থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে আনি। তাকে ঘাড় ধরে একেবারে নগরটার সীমানার বাইরে বের করে দিয়ে আসি। আর ভন্ডারভটিমিটিস নগরটার সে পুরনো দিনের শান্তি ও আনন্দঘন পরিবেশ ফিরিয়ে আনি। কী? যাবেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *