৪. উইলিয়াম হিকির স্মৃতিকথা ১৭৭৭-১৮০৮

উইলিয়াম হিকির স্মৃতিকথা ১৭৭৭-১৮০৮

১. হিকির স্মৃতিকথা

১ নভেম্বর, ১৭৭৭ সন। ভোর চারটে থেকে সাগর পাড়ি দিয়ে বেলা প্রায় দুপুর আন্দাজ সাগরদ্বীপে এসে পৌঁছলাম। কিছুক্ষণ পরে একখানি পানসি নৌকা এল, কর্নেল ওয়াটসন আগেই সেটি ভাড়া করে রেখেছিলেন কলকাতায় যাবার জন্য। বেলা দুটোর সময় আমরা সকলে মিলে পানসিতে করে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করলাম। পানসিতে যেতে আমার আপত্তি ছিল, কারণ বাংলা দেশের এই বিচিত্র নৌকাটি এমনভাবে তৈরি যে তার মধ্যে সোজা হয়ে বসা যায় না, অথবা রোদবৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষা করাও যায় না। এমনকি পা ঝুলিয়ে একটু আরাম করে বসাও সম্ভব নয়। তবু পানসির অভিনবত্বের জন্য এই অসুবিধাটুকু আমাদের সয়ে গেল। ছ’জন ‘কালা আদমি’ (মাঝি) খুব জোরে জোরে দাঁড় বাইছিল, পানসিও চলছিল তরতর করে দুরন্ত বেগে। সন্ধে ছ’টার সময় আমরা কুলপিতে এসে পৌঁছলাম। আবার জোয়ার আসা পর্যন্ত সেইখানেই বিশ্রাম নেওয়া হবে স্থির হল।

পাশের খালের ভিতর দিয়ে বেশ খানিকটা এগুবার পর একটা ট্যাভার্ন (সরাইখানা) নজরে পড়ল। যেমন নোংরা তেমনি কুৎসিত ও জরাজীর্ণ সরাইখানা ঘর। বাংলা দেশের ‘house of entertainment’—এর এই দুরবস্থা দেখে আমরা অবাক হয়ে গেলাম। ওয়াটসনের ইচ্ছা হল এইখানেই রাত্রিযাপন করা, কিন্তু বিছানাপত্তর কিছুই পাওয়া গেল না। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে আমাদের জন্য তোফা খানা তৈরি করে দিলেন সরাইখানার মালিক—চমৎকার মাছ, চলনসই মুরগি, প্রচুর ডিম ও বেকন (কোথায় পেলেন?), এবং আমার কাছে যা চরম বিলাসিতার ব্যাপার, সেইরকম উৎকৃষ্ট রুটি। ক্ল্যারেট ও মদিরা (মদ্যবিশেষ) আমাদের সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিল। সুতরাং খানা আমাদের বেশ ভালই জমল।

ভোজনান্তে শয়নের ব্যবস্থা করা হল একটি বিলিয়ার্ড টেবিলের উপর। কর্নেল ওয়াটসন, মেজর মেস্টেয়ার ও আমি—তিনজনে লম্বা সটান হয়ে তার উপর শুয়ে পড়লাম। চোখে ঘুম এল না, কারণ হাজার হাজার মশা সশব্দে গুনগুন করে আমাদের আক্রমণ করতে লাগল। প্রায় ঘণ্টা তিনেক মশার কামড়ে টেবিলের উপর ছটফট করে আমি উঠে পড়লাম, এবং ঘরের মেঝেয় পায়চারি করতে লাগলাম। এমন সময় বাইরে থেকে বিকট চিৎকার শুনতে পেলাম—’ক্যাহুয়া ক্যাহুয়া হুক্কাহুয়া হুক্কাহুয়া’। শেয়ালের ডাক। ধীরে ধীরে রাত ভোর হয়ে গেল, দিনের আলো হওয়ায় মশার দলও পালাল। তিনখানি চেয়ার জুড়ে নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে আমি শুয়ে পড়লাম, এবং ঘণ্টা দুই ঘুমিয়ে উঠে বেশ ঝরঝরে বোধ করলাম।

সকাল আটটায় গরম গরম চা—কফির সঙ্গে প্রাতরাশ খাওয়া শেষ করে, প্রচুর সিদ্ধ মুরগি ও অন্যান্য খাদ্য নিয়ে আমরা আবার যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলাম। বেলা দশটার সময় জোয়ার আসতে পানসি ছাড়ল। আমরা ভেবেছিলাম, সন্ধ্যার আগেই গার্ডেনরিচে কর্নেল ওয়াটসনের বাড়িতে পৌঁছতে পারব। কিন্তু হঠাৎ উত্তুরে হাওয়া বইতে তা সম্ভব হল না, মাঝিরা রীতিমতো ক্লান্ত হয়ে পড়ল। বাধ্য হয়ে আমরা উলুবেড়িয়া (Woolburreah) নামে একটি ছোট্ট গ্রামে রাত্রিবাস করলাম। কর্নেল আমাদের গরম গরম ভাত ও মাংসের ঝোল খাওয়াবেন আশ্বাস দিলেন। গ্রামের লোকের সঙ্গে তিনি এ দেশীয় ভাষায় কথা বলবার চেষ্টা করছেন দেখে আমরা সকলেই চমৎকৃত হলাম। তাঁর কথা বলার ভাবভঙ্গি দেখে ‘নেটিব’দের ভিড় জমে গেল। আমরাও হাসাহাসি করছিলাম দেখে কর্নেল চটে গিয়ে বললেন, ‘আমি চেষ্টা করছি আপনাদের জন্যে গরম ভাত—মাংস জোগাড় করতে, বোঝাতে আমার প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে, আর আপনারা হাসছেন?’ আমরা অবশ্য বোঝালাম যে তাঁকে দেখে আমরা হাসিনি, নেটিবদের হাবভাব দেখে আমাদের হাসি পাচ্ছে, কারণ এ দৃশ্য আমরা আগে কোনোদিন দেখিনি! কর্নেল ঠান্ডা হলেন, এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই তাঁর চেষ্টা যে সফল হয়েছে, গরম ভাত—মাংস দেখে তা বোঝা গেল। প্রচুর পরিমাণে তা—ই আহার করে আমরা পরম তৃপ্তিলাভ করলাম। সুরাসংযোগে খাদ্য খুব তাড়াতাড়ি গলা দিয়ে পেটে তলিয়ে গেল।

শেষরাতে জোয়ার এল, পানসি ছাড়ল। ভোর হল, পানসির মাথার উপর আমরা উঠে বসলাম। নদীর পূর্বতীরে গার্ডেনরিচের দৃশ্য ধীরে ধীরে আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠল। চমৎকার সব বাগান—ঘেরা বড় বড় বাড়ি, দেখতে অতি মনোরম—এরকম সুন্দর দৃশ্য দেখলে কার না আনন্দ হয়! কোম্পানির বড় বড় কর্তাব্যক্তিরা এখানকার সুন্দর পরিবেশে বাস করেন। কেউ কেউ কেবল গ্রীষ্মকালে কয়েক মাসের জন্য এখানে থাকেন, কেউ বা সব সময় এখানেই বাস করেন, শহরে কেবল কাজকর্ম করতে যান। চারদিকের গাছতলায় যেন সবুজের বন্যা নেমেছে মনে হয়। নিসর্গে কেবল সবুজের ঢেউ, যেন রঙের তুফান উঠেছে। এরকম অপূর্ব দৃশ্য দেখব, বিশেষ করে বাংলার মতন গ্রীষ্মপ্রধান দেশে, কল্পনা করিনি কখনও।

গা র্ডে ন রি চ

রিচের কোল পানসি ভিড়ল। তীর থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে কর্নেল ওয়াটসনের বাড়ি। কী সুন্দর বাড়ি যে তা ভাষায় বর্ণনা করার সাধ্য নেই আমার। ভিতরে উচ্চতা প্রায় তিরিশ ফুট। তার উপরে বাড়ি, বিশাল তার আয়তন, স্থাপত্যেরও মনোমুগ্ধকর নিদর্শন। সমস্ত গার্ডেনরিচটাকে বাড়িটা যেন দাবিয়ে রেখেছে। উঁচু ভিতের জন্য অন্যান্য বাড়িগুলোকে মনে হয় যেন তলায় হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছে। বহু দূরে—প্রায় নয় মাইল লম্বা ও দু’মাইল চওড়া জলের একটা আস্তরণের উপর দিয়ে ফোর্ট উইলিয়াম ও কলকাতা শহরের অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়। আগাগোড়া নদীর জলের উপর ছোটবড় শত শত জাহাজ ও নৌকা নোঙর বেঁধে রয়েছে। তারই ভিতর থেকে যেন কলকাতা শহর নদীস্নান করে গাত্রোত্থান করেছে তার বিচিত্র সৌন্দর্য নিয়ে।

প্রাচীর দিয়ে ঘেরা প্রায় ৪০০ বিঘা জমির মধ্যে কর্নেল ওয়াটসনের বাড়ি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁকে এই জমি গ্রান্ট দিয়েছিলেন, জাহাজঘাট ও জাহাজ তৈরির ডক নির্মাণের জন্য। তার মধ্যে তিনি অনেক ঘরবাড়ি তৈরি করে ফেলেছিলেন, কামার, ছুতোর ও অন্যান্য কারিগরদের কাজের জন্য। এ ছাড়া আর—একদিকে তিনি বড় বড় গুদামঘরও তৈরি করেছিলেন, জাহাজ তৈরির যাবতীয় মালপত্তর ও যন্ত্রপাতি মজুত করার জন্য। তাঁর জমির চারদিকে কাঠও ছিল পর্যাপ্ত পরিমাণে ছড়ানো। সত্যি কথা বলতে কী, পৃথিবীর আর কোনো জায়গায় এরকম বৃহৎ আকারের এত অর্থ ব্যয় করে এই ধরনের একটি বিরাট নির্মাণযজ্ঞের আয়োজন করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। বিশ্বকর্মার একটি বিরাট কারখানা যেন ওয়াটসন সাহেব ফেঁদে বসেছিলেন। তাঁর বিপুল প্রচেষ্টা নিশ্চয় সার্থক হত, যদি না তাঁর বিরোধী কয়েকজন হীনচরিত্রের লোক তাঁর পরিকল্পনাকে বানচাল করার চেষ্টা করতেন। এমন জাহাজঘাট ও কারখানা তিনি তৈরি করতে পারতেন গার্ডেনরিচে, যার জন্য সারা এশিয়াতে ব্রিটিশ জাতির সম্মান ও গৌরব বাড়ত।

খি দি র পু র ড ক নি র্মা ণ

ডক—নির্মাণের পরিকল্পনার ব্যাপারে কর্নেল ওয়াটসনের সঙ্গে আর—একজন ব্যক্তি ছিলেন—তার নাম মেজর আর্কিবল্ড ক্যাম্পবেল। তিনি বাংলা দেশে কোম্পানির চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, মাদ্রাজের গবর্নর হন। এঁরা দু’জন রাদারপুরে (Raderpore, খিদিরপুর) ডক—নির্মাণের পরিকল্পনা করে কোম্পানির অনুমতিলাভের জন্য ইংলন্ড যাত্রা করেন। কোম্পানির ডিরেক্টররা সন্তুষ্টচিত্তে তাঁদের পরিকল্পনা অনুমোদন করেন এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় জমিও দান করার ব্যবস্থা করেন। জমি ছাড়া জাহাজ নির্মাণের অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও সাজসরঞ্জাম বাংলা দেশে নিয়ে যাবার বিশেষ সুব্যবস্থাও তাঁরা করে দেন। তার সঙ্গে তাঁরা বাংলার গবর্নরকে লিখে দেন যেন যথাসাধ্য তাঁরা ওয়াটসনের পরিকল্পনা করতে সাহায্য করেন।

১৭৭৭ সনের গোড়ার দিকে ওয়াটসন মেজর ক্যাম্পবেলের অংশ সম্পূর্ণ কিনে নেন এবং নিজে তাঁর একমাত্র মালিক হন। আমি যখন তাঁর সঙ্গে বাংলা দেশে যাত্রা করি, তখন তিনি এই জাহাজঘাট ও কারখানা ইত্যাদি নির্মাণের জন্য প্রায় এক লক্ষ আশি হাজার পাউন্ড খরচ করে ফেলেছিলেন—‘an incredible amount for a private person to risk upon any speculation’ বিলেতে যখন ওয়াটসনের সঙ্গে আমার আলাপ হয়, তখন তিনি আমার সঙ্গে যথেষ্ট ভদ্র ব্যবহার করেন। সমুদ্রপথে একসঙ্গে আসার সময় তাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গভীর হয়, এবং আমার অ্যাটর্নির ব্যবসায়ে কলকাতার সম্ভ্রান্ত লোকজনের কাছে আমাকে চিঠিপত্র দিয়ে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। শুধু তা—ই নয়, আমাকে তাঁর বাড়িতে থাকতেও তিনি অনুরোধ করেন।

গর্ডেনরিচে পৌঁছে ওয়াটসনের জাহাজের কলকারখানা দেখে আমার খুব আনন্দ হল। আমরা যখন কারখানা দেখছিলাম, তখন তাঁর একজন ইয়োরোপীয় ম্যানেজারও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কলকাতার খবর কী?’ ‘কিছু জানি না’ বলে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বললেন, ‘ওহো, বলতে ভুলে গেছি, দু’জন বিরাট লোকের মৃত্যু হয়েছে এর মধ্যে। একজন আমাদের সেনাধ্যক্ষ জেনারেল ক্লেভারিং, আর—একজন বিচারপতি লা মেতর। আজই সকালে বিচারপতির স্মৃতির সম্মানার্থে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে কামান দাগা হয়েছে, হয়তো শুনে থাকবেন।’ জাস্টিন মেতরের মৃত্যুতে মিস্টার মর্স ও আমার একটু ক্ষতি হল, কারণ আমরা দু’জনেই তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য বিলেত থেকে চিঠিপত্র এনেছিলাম। বিলেতে মর্স ও আমি ঠিক করেছিলাম যে আমরা এক সঙ্গে একবাড়িতে থাকব। সেইজন্য মর্স একটি ভাল বাড়ির সন্ধান করতে আরম্ভ করেছিলেন।

বেলা এগারোটার সময় আমার বন্ধু রবার্ট পট ফিটনে করে এসে হাজির হল। দু’জনেই দেখা হতে খুব খুশি হলাম। পট বলল যে সে আমার জন্য চমৎকার একটি বাড়ির একাংশ সাজিয়ে—গুছিয়ে একেবারে ফিটফাট করে রেখেছে। এখনই সেটি আমার দখল, করা দরকার, এবং তার জন্য তার সঙ্গে ফিটনে চড়ে সেখানে যাওয়াও দরকার। ওয়াটসন পাশে থেকে আমাদের কথাবার্তা হয়তো শুনতে পেয়েছিলেন। তিনি বললেন যে তা হবে না, হিকি আমার এখানেই থাকবেন, এবং পট যখন ইচ্ছা ডক এলাকায় তাঁর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ ও গল্পগুজব করতে করতে আসতে পারেন। তাতে তিনি আরও বেশি খুশি হবেন। এই কথা বলে তিনি পটকে সেইদিনই ডিনারে নেমন্তন্ন করলেন, এবং পট তা গ্রহণও করল। আমাকে বারবার কলকাতায় যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করাতে আমি রাজি হলাম, এবং প্রায় চার মাইল পথ ফিটনে করে যেতে বেশ ভালই লাগল।

শীতকাল হলেও তখন সূর্যের তেজ বেশ কড়া ছিল। পট সোজা আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ঠেলে তুলল। বাড়িটি হল সুপ্রিম কৌন্সিলের বিখ্যাত সদস্য রিচার্ড বারওলের (Richard Barwell)। তিনি তাঁর ছোট ভাই ড্যানিয়েল বারওয়েল ও তার তিন বন্ধু পট, কেটর ও গর্সলিংকে বাড়িটি ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। পট আমাকে অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল, এবং বাড়ির যে অংশ আমার জন্য ঠিক করা ছিল সেখানে আমাকে নিয়ে গেল। বিশাল বড় বড় ঘর, যেমন লম্বাচওড়া তেমনি উঁচু, অত্যন্ত মূল্যবান সুদৃশ্য সব আসবাবপত্তরে সাজানো। শোবার ঘরে একদিকে বিছানা—পাতা খাট, আর—একদিকে একটি রাইটিং ডেস্ক। ডেস্কের উপর দেখলাম কতকগুলি চিঠি রয়েছে। পট বলল, এগুলি সে আমার জন্য লিখে রেখেছিল। যদি সে কোনো কারণে আমার আসার সময় কলকাতায় উপস্থিত থাকতে না পারে এবং তার জন্য আমাকে যাতে কোনো অসুবিধায় না পড়তে হয়, সেইজন্য এই চিঠিগুলি লিখে রাখা সে প্রয়োজন মনে করেছিল। সব চিঠিতে একটি কথাই লেখা ছিল এই যে দুনিয়ায় আমার চেয়ে অভিন্নহৃদয় বড় বন্ধু পটের আর কেউ নেই, এবং সেই কারণে আমাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করা সকলের কর্তব্য। যাঁদের চিঠিগুলি লেখা হয়েছিল, তাঁদের নাম উইলিয়ম পামার, জন শোর (এখন Lord Teignmouth), মন্টগোমেরি, নেলার, পার্লিং, ডুকারেল, বার্ড, ব্রিস্টো, গ্রাহাম, হ্যাচ, অ্যাডেয়ার, এভেলিন ও জাস্টিস হাইড।

পা ল কি র গ ল্প

বেলা একটার সময় সাধারণত সাহেবরা মধ্যাহ্নভোজন করেন। আর বেশি দেরি নেই দেখে আমি ওয়াটসনের ডিনারের কথা পটকে স্মরণ করিয়ে দিলাম। পটের ঘোড়া দুটি খুব ভাল ছুটতে পারত। আমরা খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলাম। পৌঁছে দেখি ওয়াটসন সাহেব আমাদের জন্য বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। ডিনারে মিস্টার ক্লিভল্যান্ডও আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন। সেইদিনই সকালবেলা তিনি কলকাতা পৌঁছেছেন, এবং কর্নেলের কাছে তিনি তাঁর পালকি চড়ার বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে এরকম অদ্ভুত যান আগে কখনও তিনি দেখেননি, এবং এরকম অভিজ্ঞতাও কখনও হয়নি। পালকিতে তিনি চড়ে বসলেন, বেয়ারাদের কাঁধে পালকিও চলতে আরম্ভ করল। কিন্তু চলার পথে বেয়ারাদের কণ্ঠের ধ্বনি শুনে ক্লিভল্যান্ড উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলেন। ধ্বনি যত বিলম্বিত টানে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল, তাঁর উৎকণ্ঠাও তত বাড়তে লাগল। তিনি ভাবলেন, হতভাগ্য পালকি—বেয়ারারা তাঁকে কাঁধে করে বহন করার জন্যই হয়তো চরম ক্লান্তিতে গোঙাতে আরম্ভ করেছে। অবিলম্বে তাদের রেহাই না দিলে তিনি নরহত্যার দায়ে পড়তে পারেন। সুতরাং তিনি থামাতে বললেন। কিন্তু পালকি কাঁধ থেকে নামিয়ে তিনি দেখলেন, বেয়ারারা বেশ মহানন্দে রঙ্গরসিকতা করছে। দেখে তিনি একটু অবাকই হলেন, কারণ তাদের গোঙানির মতন শব্দ শুনে তিনি ভেবেছিলেন যে কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা মুখ থুবড়ে পড়ে মারা যাবে। কিন্তু কোথাও আর কোনো চিহ্ন দেখা গেল না, এমনকি তারা যে ক্লান্ত তা—ও তাদের কথাবার্তা শুনে বোঝা যায় না। আবার তিনি তাই পালকিতে চড়ে বসলেন। পালকি চলতে লাগল এবং আবার সেই শব্দ শোনা গেল—হৈ আরে হোঃ, হৈ আরে হোঃ। ক্লিভল্যান্ড সাহেব এবারে আরও বেশি বিচলিত হয়ে পালকি থামাতে বললেন, এবং বেয়ারাদের হাতে একটি টাকা গুঁজে দিয়ে কোনো কথাবার্তা না বলে হনহন করে হাঁটতে আরম্ভ করলেন। আর তাঁর ভরসা হল না পালকি চড়তে।

আমরা সকলে ক্লিভল্যান্ডের পালকির গল্প খুব উপভোগ করলাম। কর্নেল ওয়াটসন বুঝিয়ে দিলেন যে এ দেশের পালকি বেয়ারারা এইভাবে সুর করে গান গাইতে গাইতে পালকি বয়ে নিয়ে যায়। সামনে যে সর্দারবেয়ারা থাকে সে পথের বিবরণ দেয়, অন্যেরা চলার মন্ত্রের মতন ধ্বনি উচ্চারণ করতে থাকে। যেমন—’সামনে মাঠ, হৈ আরে; মাঠ রে ভাই হৈ আরে; ওই যে গ্রাম, হৈ আরে; পুকুর ঘাট, হৈ আরে; খাল পেরুবি, হৈ আরে’ ইত্যাদি। ওয়াটসন এত সুন্দর করে দৃষ্টান্ত দিয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন যে আমরা যারা পালকি চড়িনি তারাও এ দেশের পালকি—মাহাত্ম্য বুঝে ফেললাম।

হে স্টিং স ও ফি লি প ফ্রা ন্সি স

পরদিন ওয়াটসন আমাকে গবর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য গবর্নমেন্ট হাউসে নিয়ে গেলেন। সেখানে প্রধান সেনাপতি স্টিবার্ট ও বারওয়েলের সঙ্গেও আলাপ হয়ে গেল। বারওয়েলের প্রতি ওয়াটসন কোনো কারণে বিরূপ ছিলেন বলে মনে হল। বারওয়েল ছিলেন হেস্টিংসের কাউন্সিলের একজন সদস্য, এবং তাঁর সমর্থক। কাউন্সিলের আর—একজন বিখ্যাত সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিস সেই সময় চুঁচুড়ায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। তিনি কীভাবে আমাদের অভ্যর্থনা করবেন, সে সম্বন্ধে ওয়াটসনের মনে সন্দেহ ছিল। সন্দেহের কারণ—তাঁরা দু’জনেই যখন ইংলন্ডে ছিলেন তখন একটি ঘটনা ঘটে যায়। ঘটনাটি এই :

কর্নেল ওয়াটসন ব্রিটিশ সেনাবিভাগে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন ইঞ্জিনিয়ার—বাহিনীর সাবঅল্টার্ন হয়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে হাভানা অবরোধের সময় তিনি বিশেষ কৃতিত্ব দেখান। তারপর তাঁকে ইংলন্ডে জরুরি তলব করে আনা হয়, এবং তিনি লন্ডনে এসে দেখেন, লর্ড ক্লাইভ তাঁকে একখানি চিঠি লিখে জানিয়েছেন তাঁর সঙ্গে অবিলম্বে সাক্ষাৎ করার জন্য। ক্লাইভ তাঁকে সঙ্গে করে বাংলা দেশে নিয়ে যাবেন বলে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, এবং ওয়ার—সেক্রেটারি ওয়েলবোর এলিসের কাছে এই মর্মে ওয়াটসনের জন্য আর—একখানি চিঠিও তাঁর চিঠির সঙ্গে লিখে পাঠিয়েছেন। সেই চিঠি নিয়ে ওয়াটসন যথাসময়ে এলিসের সঙ্গে দেখা করেন। এলিস তাঁকে যুদ্ধবিভাগের বড় কেরানির কাছে তাঁর চাকুরি সংক্রান্ত কাগজপত্র বুঝে নেবার জন্য পাঠিয়ে দেন। ওয়াটসন তাঁর নির্দেশপত্র নিয়ে কেরানিরা সঙ্গে দেখা করতে যান। এই কেরানি হলেন ফিলিপ ফ্রান্সিস। সেক্রেটারির চেয়ে কেরানি অনেক বেশি উদ্ধতচরিত্র ছিলেন। তাঁর ব্যবহারের মধ্যে শিষ্টতার লেশ ছিল না, এবং তিনি তা ওয়াটসনের প্রতি প্রকাশ করতেও দ্বিধা করেননি। বড় কয়েকটি বাঁধানো ভলিউম উলটে—পালটে তিনি ওয়াটসনের মুখের দিকে চেয়ে গম্ভীরভাবে বলেন, ‘আমার মনে হয় আপনি ভুল করেছেন। ওয়ার—সেক্রেটারির কাছে না এসে আপনার যাওয়া উচিত ছিল অর্ডন্যান্স—বিভাগের মাস্টার—জেনারেলের কাছে।’ উত্তরে ওয়াটসন বলেন, ‘কার কাছে আমার যাওয়া উচিত বা উচিত নয়, আশা করি সেক্রেটারি এলিস তা বিলক্ষণ জানেন। অতএব তা নিয়ে তর্ক করার মতন সময় আমার নেই। কাগজপত্র দেবার থাকে দিন, না—হয় এলিসের নোটটি ফেরত দিন, আমি চলে যাই।’ এই কথা বলে ফ্রান্সিসের টেবিলের উপর থেকে এলিসের ‘নোট’টি তুলে নিয়ে ওয়াটসন চলে যান। যাবার সময় তিনি শুনতে পান, ফ্রান্সিস পেছন থেকে তাঁকে ডাক দিয়ে বলছেন, ‘শুনে যান মশাই, শুনে যান, অত ব্যস্ত হবেন না।’

ওয়াটসন সোজা এলিসের কাছে গিয়ে ব্যাপারটা বলেন। ফ্রান্সিসকে এলিস ডেকে পাঠান, এবং তাঁর ঔদ্ধত্যের জন্য তাঁকে বেশ ধমকানি দেন। ফ্রান্সিস তাঁর জীবনের এই ঘটনাটি ভুলতে পেরেছেন বলে মনে হয় না, ওয়াটসন বললেন, এখন তিনি বিলেতের কেরানি থেকে বাংলার গবর্নর জেনারেলের কাউন্সিলের সদস্য হয়েছেন। কলকাতার ইংরেজ—সমাজে হেস্টিংস—বিরোধী দলের নেতা হিসেবে তাঁর প্রতিপত্তিও যথেষ্ট আছে। অতীতের কথা মনে করে তিনি তাঁকে সাদরে অভ্যর্থনা করতে না—ও পারেন বলে ওয়াটসনের সন্দেহ হয়েছিল। ফ্রান্সিসের সঙ্গে দেখা হবার পর অবশ্য সন্দেহ তাঁর দূর হয়ে গেল। ফ্রান্সিস তাঁর সঙ্গে যথেষ্ট ভদ্র ব্যবহারই করেছিলেন, আগেকার কথা মনে করে কোনো বিরক্তি বা ঔদাসীন্য প্রকাশ করেননি। অল্পদিনের মধ্যে ওয়াটসনের জাহাজঘাট নির্মাণের পরিকল্পনার সবচেয়ে বড় সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন ফিলিপ ফ্রান্সিস।

.

অ্যা ট র্নি ত্ব গ্র হ ণ

বন্ধু পটকে আমি ‘বব’ বলে ডাকতাম, এবং তা না ডাকলে সে রাগ করত। বব আমাকে একটা বগি ঘোড়া উপহার দিয়েছিল, তার পিঠে চড়ে রোজ আমি ব্রেকফাস্ট খাবার পর কলকাতায় বেড়াতে আসতাম। জাস্টিস হাইড ও তাঁর পরিবারের সকলের সঙ্গে বব আমাকে আলাপ করিয়ে দিল। সুপ্রিমকোর্টের চিফ জাস্টিস সার এলিজা ইম্পে ও সার রবার্ট চেম্বার্সের সঙ্গেও যথাসময়ে আলাপ—পরিচয় হল। উভয়েই আমার প্রতি খুবই সহৃদয় ব্যবহার করতেন। চেম্বার্স—পরিবারের সঙ্গে আমার যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতাও হয়ে গেল। মিস্টার ও মিসেস চেম্বার্স আমাকে তাঁদের বাড়িতে প্রত্যেক শনিবার ও রবিবার থাকবার জন্য বিশেষ অনুরোধ করতেন। লেডি চেম্বার্স যেমন রূপসি তেমনি গুণবতী মহিলা ছিলেন। তখন তাঁর বয়স বছর আঠারো, দুটি সুন্দর সন্তানের জননী তিনি, একটি ছেলে, একটি মেয়ে। সার রবার্টের মা—ও তখন বেঁচে ছিলেন, বৃদ্ধা হলেও সঙ্গী হিসেবে চমৎকার। এঁরা ছাড়া, উইলিয়াম জনসন ও উইলিয়াম স্মোন্ট নামে দু’জন ক্লার্ক তাঁদের পরিবারে থাকতেন। আমি যখন কলকাতায় এলাম তখন এঁরা দু’জনই মারা গেছেন।

কথা ছিল, মর্স ও আমি কলকাতায় এসে একসঙ্গে এক বাড়িতে থাকব এবং কোর্টে প্র্যাকটিস করব। কিন্তু মর্স বললেন, আমাদের পেশার দিক থেকে দু’জনের এক বাড়িতে থাকা ঠিক হবে না। কারণ, আমরা বন্ধু বলে মক্কেলদের মনে সন্দেহ হতে পারে। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল আমরা আলাদা বাড়িতে থেকেই কাজকর্ম করব, এবং তাতে আমাদের বন্ধুত্বের হানি হবে না।

১২ নভেম্বর (১৭৭৭) সার এলিজা ইম্পে জানালেন যে পরদিন আমাকে কোর্টে হাজির হতে হবে অ্যাটর্নির শপথগ্রহণের জন্যে। যথাসময়ে আমি কোর্টে হাজির হলাম, এবং বিচারকের সামনে যথারীতি শপথ করে সুপ্রিমকোর্টের সলিসিটার, অ্যাটর্নি ও প্রোক্টর হলাম প্রোক্টর হওয়াতে আমার রোজগারের খুব সুবিধা হয়েছিল, কারণ ধর্ম সংক্রান্ত ব্যাপারে আমরা দ্বিগুণ ‘ফি’ পেতাম। আমার সহযাত্রী বন্ধু দু’জন (টিলঘম্যান ও মর্স) সেদিন অ্যাডভোকেট হিসেবে নাম লিখিয়েছিলেন।

অল্পদিনের মধ্যে আমি শহুরে সমাজে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলাম, চেনাপরিচিতের সংখ্যাও বেড়ে গেল অনেক। ঘন ঘন চারদিকে নেমন্তন্ন হতে লাগল। আগে থেকেই মদ্যপানের অভ্যাস করে ফেলেছিলাম, জাহাজে আসার পথে অভ্যাসটি বেশ পোক্তও হয়ে গিয়েছিল। বাংলা দেশে এসে ভোজের আমন্ত্রণে তা দিন দিন আরও বেড়ে যেতে থাকল। শ্যাম্পেন ও ক্ল্যারেট খুব বেশি মাত্রায় চালাতে আরম্ভ করলাম। স্বদেশে যা সহ্য হত, বিদেশে বাংলা দেশের পরিবেশে তা সহ্য হবে কেন? কিছুদিনের মধ্যেই অত্যধিক মদ্যপানের কুফল দেখা দিল। মধ্যে মধ্যে প্রচণ্ড মাথাধরা ও অন্যান্য শারীরিক যন্ত্রণায় শয্যাশায়ী হয়ে থাকতাম।

হা র ম নি ক ট্যা ভা র্ন

১২ নভেম্বর আমাকে শহরে যেতে হয়েছিল কোর্টের কাজে। বেলা প্রায় একটার সময় বগিতে চড়ে ওয়াটসনের গৃহে ফিরছিলাম, এমন সময় পথে জাস্টিস হাইডের সঙ্গে দেখা হল—পালকিতে করে কোথায় যাচ্ছেন। আমাকে দেখে পালকির ভিতর থেকে ইশারা করে থামতে বললেন, এবং খালি মাথায় এইভাবে রোদে ঘুরে বেড়াচ্ছি দেখে বেশ বকুনি দিলেন। বললেন যে, এ দেশে এইভাবে রোদ্দুরে ঘুরলে শীঘ্রই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ব। আমার চেহারা দেখে তিনি শঙ্কিত হয়ে বললেন, এখনই ডাক্তার দেখাতে। নিশ্চয়ই দেখাব বলে তাঁর কাছ থেকে ছাড়া পেলাম। কিন্তু পরদিনই আমার একটি বেশ বড় ভোজের নিমন্ত্রণ ছিল কলকাতার এক বিখ্যাত ট্যাভার্নে। ভোজ দিচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন উইলিয়াম পামার। ট্যাভার্ন ‘হারমনিক’ (Harmonic Tavern)। এত বড় একটা লোভনীয় ভোজ হাইডের পরামর্শে ছেড়ে দিতে একেবারেই ইচ্ছা হল না। নির্দিষ্ট দিনে ভোজ্য ও পানীয়ের প্রবল টানে হারমনিকে গিয়ে হাজির হলাম। তখনও আমার মাজায় ও মাথায় রীতিমতো যন্ত্রণা হচ্ছিল। যন্ত্রণা এত বেড়ে গেল যে ভোজ অর্ধেক শেষ হতে—না হতে আমি টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লাম, এবং সঙ্গে সঙ্গে ট্যাভার্ন ছেড়ে আমাকে চলে যেতে হল। কথায় বলে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। আমারও সেই দশা হল। বব আমার এই অবস্থা দেখে রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছিল। সে আমাকে সঙ্গে করে তার বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যেতে চাইল। আমিও রাজি হলাম, কারণ তখন আমার পেটে এমন সাংঘাতিক যন্ত্রণা হচ্ছিল যে ওয়াটসন সাহেবের বাড়ি পর্যন্ত যাবার আমার ক্ষমতাই ছিল না।

পটের বাড়ি গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। পট তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকতে চলে গেল, এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই জেমস লেয়ার্ড ও তাঁর বড় ভাই জন লেয়ার্ড, দু’জন ডাক্তারকে সঙ্গে করে ফিরে এল। জেমস ও জন দু’জনেই তখন এ দেশে জন কোম্পানির সেরা ডাক্তার ছিলেন। জনের কথাবার্তা থেকে আমি পরিষ্কার বুঝলাম যে তাঁরা আমার সম্বন্ধে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। তা হলেও ওষুধপত্রের যথাসম্ভব ব্যবস্থা হল, কিন্তু দ্রুত কোনো ফল পাওয়া গেল না। সারারাত ধরে বমি করলাম। ভোরের দিকে ভুল বকতে আরম্ভ করলাম এবং চার দিন পর্যন্ত অঘোর অচৈতন্য হয়ে পড়ে রইলাম পটের ঘরে।

চার দিন পরে আমার চেতনা হল। মনে হল, কে যেন আমাকে এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের কবল থেকে এইমাত্র জাগিয়ে তুলেছে। জেগে উঠে দেখলাম, আমার বিছানার পাশে প্রিয়বন্ধু পট ভৃত্যদের নিয়ে একদৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চোখে—মুখে বেদনার এমন গভীর ছাপ পড়েছে যে দেখলেই মনে হয় দুশ্চিন্তায় নিমগ্ন। দুশ্চিন্তার কারণ তখন বুঝিনি, পরে বুঝলাম। আমার সম্বন্ধে ডাক্তাররা নাকি সাফ জবাব দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, আমার বাঁচার কোনো সম্ভাবনা নেই, বমি থামলেও থামতে পারে, কিন্তু বিকার থামবে না। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে হয়তো বিকার থামতে পারে। আমার বিকারের ঘোর কেটে গেছে দেখে পটের তাই মনে হল যে হয়তো আমার শেষ মুহূর্তও ঘনিয়ে এসেছে। আমার বুকের উপর একখানি চাদর ঢাকা ছিল বলে ভীষণ অস্বস্তি লাগছিল। তার একটা দিক আলগা ঝুলছিল বলে আমি পটের কাছে একখানা কাঁচি চাইলাম। পট মনে ভাবল, আমার বোধহয় আবার বিকার দেখা দিচ্ছে। সুতরাং সে হন্তদন্ত হয়ে বলল, ‘না না, কাঁচিটাচি হবে না, চুপ করে শুয়ে থাকো।’ আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, সে বুঝল না। আবার ডাক্তার ডাকা হল। এবারে দু’জন নয় সাতজন এলেন—ডঃ ক্যাম্পবেল, ডঃ স্টার্ক, ডঃ রবার্টসন, দুই লেয়ার্ড ভাই, এবং আমার দু’জন জাহাজের সহযাত্রী ক্লিভল্যান্ড ও হোয়ার্থ। ডাক্তারদের গুরুগম্ভীর বিষণ্ণবদন দেখে আমার মতন সাহসী রোগীরও প্রাণ উড়ে গেল। আমার মনোবল তখনও অবশ্য কিছুমাত্র কমেনি, এবং আমি যে মরব না সে বিশ্বাস আমার অটুট ছিল। কিন্তু সাতজন ডাক্তারকে দেখে মনে হল তাঁরা প্রত্যেকে যেন আমার জন্য মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন।

এই হতাশার মধ্যে আমায় দশ দিন কাটাতে হল। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাকি ডাক্তারদের মতে আমার ‘যায়—যায়’ অবস্থা হত, এবং সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্তও ভবনদীর পার থেকে ফিরে আসার আশা দেখা দিত না। এরকম পরিত্যক্ত অবস্থায় আমাকে তাঁরা পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্ল্যারেট পান করতে দিতেন এবং তার সঙ্গে বেশ তাজা কমলালেবুও প্রচুর পাওয়া যেত।

মধ্যে মধ্যে যখন প্রচণ্ড জ্বর উঠত, তখন বিছানা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে আমাকে একটি গরম বাথটবের মধ্যে চুবিয়ে রাখা হত। ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এইভাবে কাটল, কোনো উপকার হল না। অবশেষে গরম বাথটব থেকে একদিন ঘরে আসছি, এমন সময় আমার সর্বাঙ্গে গুটি বেরিয়ে গেল, এবং অফুরন্ত ধারায় ঘাম ঝরতে লাগল গা দিয়ে। ডাক্তার ক্যাম্পবেল তখন উপস্থিত ছিলেন। আমার অবস্থা দেখে তিনি তাড়াতাড়ি ভৃত্যদের ডেকে বললেন, পশমি শাল দিয়ে আমার গা ঢেকে দিতে। সঙ্গে সঙ্গে এ কথা জানাতেও তিনি ভুললেন না যে এইবারই চরম সঙ্কট উপস্থিত হয়েছে, এবং খুব বেশি দেরি হলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমার মানবলীলা শেষ হয়ে যাবে। তারপর বোধহয় শেষ মুহূর্তের অপেক্ষায় আমার বিছানার পাশে তিনি বসলেন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, তার কয়েক মিনিট পরেই তিনি আমার বন্ধু পটকে আশা দিলেন যে আমি হয়তো বেঁচে উঠতেও পারি। একটা নতুন ওষুধ বেরিয়েছে, তাতে ভাল কাজ হতে পারে বলে তাঁরা মনে করেন। সেদিন সন্ধ্যার সময় ডাক্তাররা পরামর্শ করে বললেন, আমার পুনর্জীবনলাভের সম্ভাবনা আছে।

পরদিন পয়লা ডিসেম্বর আমার অল্প একটু জ্বর হল বটে, কিন্তু ওষুধ খেয়ে সহজেই তা সেরে গেল। ধীরে ধীরে আমি সুস্থ হয়ে উঠলাম। দীর্ঘদিন আমার দুর্বলতা কাটল না এবং খাবার রুচিও একেবারে চলে গেল। সাত—আট দিন পরে একখানি কড়া টোস্ট খাবার উগ্র বাসনা হল। টোস্টের কামড় শেষ হতে—না হতে ডঃ স্টার্ক এসে হাজির হলেন। ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিছু খেয়েছেন কি?’ আমি বললাম, ‘দু—একখানা কড়া টোস্ট খেয়েছি।’ ‘যা—ই হোক, খাবার যে রুচি হয়েছে সেটাই ভাল লক্ষণ, তবে কড়া টোস্ট খাবেন না, অপকার হবে।’ এই কথা বলে স্টার্ক চলে গেলেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ডঃ ক্যাম্পবেল এলেন, এবং ঠিক ওইভাবেই খাওয়া সম্বন্ধে প্রশ্ন করলেন। আমি যখন টোস্টের কথা বললাম, তখন তিনি বললেন যে রোগীর পক্ষে এর চেয়ে ভাল খাবার আর হয় না। সামান্য টোস্ট নিয়ে দুই ডাক্তারের এই মতভেদে আমি বেশ মজা উপভোগ করলাম। টোস্ট খেয়ে অবশ্য আমার উপকারই হয়েছিল, কোনো ক্ষতি হয়নি।

ধীরে ধীরে আমি সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলাম, কিন্তু এত ধীরে ধীরে যে ১৭ ডিসেম্বরের আগে আমি কারও কাঁধে ভর না দিয়ে একা হাঁটতেই পারতাম না। ডঃ ক্যাম্পবেল বললেন যে জীবনে তিনি এই ধরনের অসুখ থেকে কাউকে আরোগ্যলাভ করতে দেখেননি। এতগুলি ডাক্তার আমার জন্য যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, তার জন্য সত্যিই আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। পট ও তার ভৃত্যদের কাছে আমার দেনা সবচেয়ে বেশি। সে দেনা আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না। পটের ভৃত্যদের মধ্যে একজন ছিল যে আগে লর্ড ক্লাইবের কাছেও কাজ করেছে। ক্লাইবের এই পুরাতন ভৃত্যটি অসুখের সময় সারাক্ষণ আমার রোগশয্যার পাশে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকত। কোনোদিন তাকে দেখে মনে হয়নি যে ক্লান্তি বোধ করছে। তার এই রোগীসেবা দেখে সকলেই খুব অবাক হয়ে গেছে।

অসুখের পর আমার যখন খুব অরুচি হল তখন ভৃত্যটি এটা—ওটা নানারকমের খাবার নিয়ে আমাকে প্রায়ই সাধাসাধি করত, এবং বলত, ‘এটা খেয়ে নিন, অসুখ হলে লর্ড ক্লাইব এটা খেতে খুব ভালবাসতেন, এবং খেয়ে খুব উপকারও পেতেন।’ মধ্যে মধ্যে যখন আমার খুব মন খারাপ হয়ে যেত তখন সে আমাকে নানাভাবে তার বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্পগুজব করে চাঙ্গা করার চেষ্টা করত। কখনও কোনো কারণে সে আমাকে দমে যেতে দিত না।

২৪ ডিসেম্বর ডঃ ক্যাম্পবেল অনুমতি দিলেন বাইরে বেরুবার। আমার জন্য একটি পালকি এল, এবং তার মধ্যে শালমুড়ি দিয়ে আমি উঠে বসলাম। অনেকদিন পরে জাহাজঘাটে কর্নেল ওয়াটসনের বাড়ি ফিরে গেলাম। গঙ্গার ধারে ডক, সুন্দর স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, কাজেই অল্পদিনের মধ্যে আমি দেহে ও মনে বল ফিরে পেলাম। তিন দিনের মধ্যে আমার খিদে এত বেড়ে গেল যে খেয়ে তৃপ্তি হয় না। ১৭৭৭ সনের বাকি কয়েকটা দিনও এইভাবে কেটে গেল।

পয়লা জানুয়ারি ১৭৭৮ আমি বেশ সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ হয়ে উঠলাম। অসুখের চিহ্ন অবশ্য চেহারা থেকে তখনও যায়নি। শীর্ণ ও ফ্যাকাশে মুখ—চোখ দেখে বোঝা যেত যে দীর্ঘদিন অসুখে ভুগে উঠেছি। বাড়িতে ফিরে আসতে ওয়াটসন বললেন যে ক্লিভল্যান্ড একটি বড় বাড়ি দেখেছেন আমার সঙ্গে একসঙ্গে থাকবেন বলে। বাড়িটি কোর্ট হাউসের কাছে। আমার কাজকর্মের খুব সুবিধা হবে বলে আমি তৎক্ষণাৎ এই প্রস্তাবে রাজি হলাম। কয়েকদিন পরে আরও একটু সুস্থ হয়ে বাড়ি দেখতে গেলাম কলকাতায়। চমৎকার বাড়ি। যেমন জায়গা তেমন বাড়ি, খোলামেলা এসপ্ল্যানেডের উপর। দক্ষিণ ও পুব একেবারে খোলা। বাড়ি থেকে ভাগীরথীর চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়। বাড়ির একমাত্র আপত্তিকর ব্যাপার হল, কাঁচা গাঁথনি। আগেকার দিনে বাংলা দেশের অধিকাংশ বাড়িরই গাঁথনি ছিল কাঁচা। এখন কলকাতা শহরে অন্তত এরকম কাঁচা গাঁথনির বাড়ি নেই। সবই চুনসুরকির পাকা গাঁথনির বাড়ি। এই বাড়ির ভাড়া ঠিক হল মাসিক তিনশো টাকা। কোনো আসবাবপত্তর নেই দেখে পট রীতিমতো আশ্চর্য হয়ে গেল, এবং বলল যে প্রয়োজনীয় সমস্ত ফার্নিচার দিয়ে সে নিজে বাড়ি সাজিয়ে দেবে। তার জন্য আমাদের প্রায় বারো—তেরো হাজার টাকা খরচ হল। ৬ জানুয়ারি ১৭৭৮ আমি ও ক্লিভল্যান্ড নতুন বাড়িতে উঠে গিয়ে একত্রে বাস করতে আরম্ভ করলাম।

সু প্রি ম কো র্টে র বা র্ষি ক উ ৎ স ব

পরদিন ৭ জানুয়ারি সুপ্রিমকোর্টের বার্ষিক উৎসবের দিন। ওইদিন সার এলিজা ইম্পে, রবার্ট চেম্বার্স, কোর্টের অন্যান্য অফিসার, ব্যারিস্টার ও অ্যাটর্নিরা সকলে প্রতি বছরে জাস্টিস হাইডের গৃহে ব্রেকফাস্টে আমন্ত্রিত হন। ব্রেকফাস্ট খাওয়া শেষ হলে তাঁরা সোজা লাইন করে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে কোর্টের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। এই শোভাযাত্রায় শেরিফ, আন্ডার—শেরিফ থাকেন, তাঁদের কনস্টেবলরাও যোগদান করে। আদালতগৃহের সামনে এলে সুপ্রিম কাউন্সিলের একজন সদস্য শোভাযাত্রায় যোগ দেন এবং বিচারকদের বেঞ্চে গিয়ে বসেন। এইভাবে তখন বিচারকদের সম্মান প্রদর্শন করতেন কোম্পানির শাসকরা। অল্পদিনের মধ্যেই অবশ্য এই প্রথা উঠে যায়। পরে আর কোনোদিন তা পালন করা হয়েছে বলে আমি জানি না।

কোর্টে প্র্যাকটিস আরম্ভ করার পর আমার মক্কেলের অভাব হয়নি। এক সপ্তাহের মধ্যেই আমি বারোটি ‘অ্যাকশন’ ও তিনটি ‘ইকুইটি’র মামলা পেলাম। গোড়ার দিকে আমার একটু অসুবিধা হত, কারণ এ দেশের আদালতের হালচাল সম্বন্ধে আমার কিছুই জানা ছিল না। তা হলেও আমার বিশেষ ক্ষতি হয়নি তাতে, কারণ অ্যাটর্নি ও অ্যাডভোকেট বন্ধুরা আমাকে এ ব্যাপারে বেশ তৎপর হয়েই সব শিখিয়ে—পড়িয়ে দিয়েছিলেন। ওইদিন ৭ জানুয়ারি সার এলিজা ইম্পের বাড়িতে আমাদের ডিনারের নেমন্তন্ন ছিল। কোর্ট ভাঙার পর বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়ি পোশাক বদলে আমি তাঁর বাড়ি গেলাম। ভোজসভায় শহরের অনেক গণ্যমান্য সাহেবসুবোর সঙ্গে পরিচয় হল, এবং সময়টা বেশ ভালই কাটল।

পরদিন ৮ জানুয়ারি মিঃ ফিলিপ ফ্রান্সিসের বাড়িতে ‘পাবলিক ব্রেকফাস্ট’—এর নেমন্তন্নে যেতে হল। তখনকার দিনে অপরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে সাহেবসমাজে এটাই ছিল আলাপ—পরিচয়ের রীতি। গবর্নর জেনারেল ও তাঁর কাউন্সিলের সদস্যরা প্রত্যেকে এইজন্য সপ্তাহে একদিন করে ‘পাবলিক ব্রেকফাস্ট’ দিতেন। আমার জাহাজের সহযাত্রী টিলঘম্যান ছিলেন ফ্রান্সিসের আত্মীয়, তাঁর বাড়িতেই তিনি থাকতেন। আমাকে দূর থেকে দেখে তিনি টেবিলের পাশে উঠে দাঁড়ালেন। প্রায় তিরিশজন নিমন্ত্রিত ব্যক্তি টেবিল ঘিরে বসে ছিলেন, ফ্রান্সিস ছিলেন মাঝখানে। উঠে এসে টিলঘম্যান আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ফ্রান্সিসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার কাছে যে পরিচয়পত্রগুলি ছিল সেগুলি তাঁকে দিলাম। আঙুল দেখিয়ে পাশের চেয়ারে আমাকে বসতে বলে ফ্রান্সিস চিঠিগুলি সাগ্রহে পড়লেন। প্রথম চিঠিখানা পড়ে তিনি আমার মুখের দিকে চেয়ে হো—হো করে হেসে উঠলেন। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। তিনি অবশ্য ভদ্রতার খাতিরে মাফ চাইলেন বটে, কিন্তু তারপর যা বললেন, তাতে আমি আরও অবাক হয়ে গেলাম। চিঠিখানা উলটে—পালটে তিনি বললেন, ‘আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, মিঃ বার্ক কী করে ভাবলেন যে একজন অ্যাটর্নির কাজকর্মে সাহায্য করার মতন আমার সময় আছে!’ এমন ভঙ্গিতে তিনি ‘অ্যাটর্নি’ কথা উচ্চারণ করলেন যেন তাঁদের মতন অবজ্ঞার পাত্র আর কেউ নেই।

এতগুলি বিশিষ্ট লোকের সামনে তাঁর এই উদ্ধত ব্যবহারে আমি খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম—তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, কারণ হঠাৎ দেখি তিনি বেশ ভদ্র ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছেন। আমাকে তিনি ডিনার খেতে নেমন্তন্ন করলেন এবং শরীর কী করে সুস্থ রাখতে হবে সে সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ উপদেশ দিলেন। যেমন পিত্ত ও পেটের ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকার জন্য তিনি আমাকে প্রত্যহ সকালে খালি পেটে এক গ্লাস এবং রাতে শোবার আগে আর—এক গ্লাস জল খেতে বললেন। লন্ডনের কোনো বিচক্ষণ ডাক্তার তাঁকে নাকি এই উপদেশ দিয়েছিলেন এবং তা মেনে চলে তিনি খুব ভাল ফল পেয়েছেন।

ডিনারে অনেকের সঙ্গে আলাপ হল, পরে কয়েকজনের সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়ে গেল। ফ্রান্সিস একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কবে ইয়োরোপ রওনা হচ্ছেন। ‘মাসখানেকের মধ্যে,’ তিনি উত্তর দিলেন। তারপর পটের দিকে ফিরে বললেন, ‘আপনি কবে যাচ্ছেন?’ পট আমার পাশে বসেই খাচ্ছিল। সে বলল, ‘তোড়জোড় কিছুই এখনও করিনি, সপ্তাহখানেকের মধ্যে করব।’ পট যে ইংলন্ডে ফিরে যাবে এ কথা আমি ঘুণাক্ষরেও জানতাম না। আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম। জিজ্ঞাসা করতে পট বলল যে কথাটা শুনলে আমি দুঃখিত হব বলে সে এতদিন বলতে গিয়েও বলেনি।

ডি না রে হুঁ কো খা ও য়া ও ‘পে লে টিং’

ফ্রান্সিসের পর গবর্নর—জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস থেকে আরম্ভ করে হুইলার, জেনারেল স্টিবার্ট, বারওয়েল প্রভৃতি প্রত্যেক বড়সাহেবের বাড়িতে একে একে ডিনারের নেমন্তন্ন হল। কলকাতা শহরের বড়সাহেবদের সমাজ সম্বন্ধেও অভিজ্ঞতা কম হল না। অসুখের পর যতগুলি ডিনার খেয়েছি তার মধ্যে ড্যানিয়েল বারওয়েলের ডিনারের কথা আমার মনে আছে। ড্যানিয়েল আমার বন্ধু পটের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকতেন। তাঁর ভোজসভায় হুঁকো খাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা আমার বহুদিন মনে থাকবে। সভায় পৌঁছবার কিছুক্ষণ পরে একটি সুন্দর সুসজ্জিত হুঁকো (গড়গড়া) তাঁরা আমার সামনে জ্বলন্ত কলকেসহ উপস্থিত করলেন। আমি কয়েকটা টান দিয়ে ধূমপানের আনন্দ উপভোগ করবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কৃতকার্য হলাম না। বারংবার চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ হলাম, তখন আমন্ত্রিতদের জিজ্ঞাসা করলাম, এই পদ্ধতিতে ধূমপান না করলে কি কোনো ক্ষতি হবে, মর্যাদার হানি হবে? একজন বললেন, ‘নিশ্চয়ই হবে। কলকাতার সাহেবসমাজের একটাই হল ফ্যাশন; হুঁকো না খেলে বড়সাহেবদের সমাজে আপনি কলকেই পাবেন না।’ আর—একজন, অপেক্ষাকৃত একটু গম্ভীর প্রকৃতির, আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘ওসব চালবাজ ছোকরাদের কথায় মোটেই কান দেবেন না। আপনি যদি না পছন্দ করেন, তাহলে হুঁকো খেতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। হুঁকো—খাওয়া আমাদের ইংরেজ—সমাজে একটা ফ্যাশন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সঙ্গে তাল দেবার কোনো অর্থ হয় না। আমি জানি আমাদের অনেকেই হুঁকো খান না, অতএব আপনিও স্বচ্ছন্দে না খেতে পারেন।’ এই কথা শোনার পর আমি যে হুঁকো ছাড়লাম, ভবিষ্যতে আর কোনোদিন তা স্পর্শও করিনি। তাতে আমার উপকারই হয়েছে, কারণ হুঁকো যে কত অনর্থের মূল তা আমি বহু বন্ধুবান্ধবের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছি। হুঁকোর আসল সমস্যা হল, অনির্বাণ অগ্নিসহযোগে কলকেতে তামাক জোগানো। তার জন্য হুঁকোবরদার ভৃত্যের গভীর মনোযোগ চাই। কিন্তু যে কোনো ভৃত্যের কাছ থেকে তা পাওয়া যে কত কঠিন, সকলেই জানেন। কাজেই হুঁকোখোরদের জন্য ভৃত্যদের সব সময় তটস্থ থাকতে হয় এবং তাই গৃহে অশান্তির কারণ ঘটে।

ড্যানিয়েল বারওয়েলের এই ভোজসভাতেই আমি কলকাতার সাহেবসমাজে প্রচলিত আর—একটি অসভ্য প্রথা দেখে রীতিমতো স্তম্ভিত ও ব্যথিত হয়েছিলাম। প্রথাটি হল, খাবার সময় রুটির টুকরোগুলি পাকিয়ে অন্যের গায়ে ছুড়ে মারা (pelleting)। আরও আশ্চর্য হলাম দেখে, প্রথাটি কেবল পুরুষদের মধ্যে চলিত হয়, মেয়েদের মধ্যেও প্রচলিত। কেউ কেউ গুলিটি এমনভাবে পাকিয়ে এত জোরে ছুড়তে পারেন যে, কারও চোখে—মুখে লাগলে তিনি বেশ আঘাত পান। গুলিগুলো তিরের মতন গিয়ে গায়ে লাগে। ড্যানিয়েল নিজে এই ব্যাপারে এত দক্ষ ছিলেন যে তিন—চার গজ দূর থেকে তিনি গুলি মেরে বাতি নিবিয়ে দিতে পারেন এবং দু’একবার নয়, বার বার অনেকবার।

এই রুটি—ছোড়াছুড়ির ব্যাপার যে ভদ্রসমাজের প্রথা হতে পারে, সে সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। প্রায় এই ব্যাপার নিয়ে খাবার টেবিলে ঝগড়াঝাঁটি হত। অবশেষে একবার এক ভোজসভায় এমন একটি ঘটনা ঘটে যা নিয়ে তুমুল কাণ্ড হয়ে যায়। জনৈক ক্যাপ্টেন মরিসন খাবার টেবিলে এই ‘পেলেটিং’ একেবারেই পছন্দ করতেন না। কোনো ডিনারে গেলে তিনি গোড়াতেই সকলকে তা জানিয়ে দিতেন। তাঁর মিলিটারি মেজাজ দেখে সহজে কেউ তাঁকে লক্ষ্য করে রুটি ছুড়তেন না। একদিন কোনো ভোজসভায় তাঁর এই সতর্কতা সত্ত্বেও একটি দুর্ঘটনা ঘটে যায়। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে একজন একটি রুটির টুকরোর বেশ কড়া গুলি পাকিয়ে ক্যাপ্টেনকে লক্ষ্য করে ছুড়ে মারেন। লাগবি তো লাগ, গুলিটি দিয়ে ক্যাপ্টেনের প্রায় রগের কাছাকাছি লাগে। ক্যাপ্টেন রীতিমতো আঘাত পান, এবং যিনি ছুড়েছিলেন তাঁকে হাতেনাতে ধরতে পারেন। তারপর তাঁর মাটনের ঠ্যাংসহ কাচের ডিশটি তুলে ধরে, তিনি ঠিক একজন সুদক্ষ জাগলারের মতন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকে লক্ষ্য করে ছুড়ে দেন। অব্যর্থ লক্ষ্য—ডিশটি ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে তাঁর কপালে লাগে এবং অনেকটা কেটে যায়। কপাল দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত পড়তে থাকে। তারপরেই দু’জনে প্রচণ্ড ‘ডুয়েল’ আরম্ভ হয়ে যায়। এ—ও ইংরেজ—সমাজে প্রচলিত আর একটি অসভ্য প্রথা। ডুয়েলের মধ্যে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। মিলিটারি ক্যাপ্টেনের সঙ্গে ভদ্রলোক পারলেন না। পিস্তলের গুলির আঘাতে অল্পক্ষণের মধ্যেই তিনি ধরাশায়ী হয়ে পড়লেন। এর জন্য দীর্ঘদিন তাঁকে শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হয়েছিল। স্বভাবতই ঘটনাটি অতি দ্রুত শহরময় রাষ্ট্র হয়ে যায়। বিশেষ করে সাহেবসমাজে প্রচণ্ড চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়, এবং আমি যত দূর জানি, এই ঘটনার পর থেকে পেলেটিং প্রথা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।

ক্যাপ্টেন সাটন ও কয়েকজন ভদ্রলোক আমাকে ট্যাভার্নে নেমন্তন্ন করে বেশ বড় একটি ভোজ দিয়েছিলেন। লৌকিকতার খাতিরে আমাকেও একটি পালটা ভোজ দিতে হল ‘হারমনিক ট্যাভার্ন’—এ। ভোজের দিন প্রায় উনচল্লিশজন খেতে এলেন, এবং সকলেই গাণ্ডেপিণ্ডে গিললেন। মদ্যপানও পর্যাপ্ত পরিমাণে চলল। অনেক রাত্রি, প্রায় তিনটে পর্যন্ত ট্যাভার্নে বসে অবিরাম পান করলেন এবং ভোরবেলা আমাকে প্রায় তুলে ধন্যবাদ দিয়ে টলতে টলতে গৃহাভিমুখে যাত্রা করলেন।

২. হিকির স্মৃতিকথা

আমি যখন বাংলা দেশে এসে পৌঁছলাম, তখন এখানকার ইংরেজরা নানা রকমের লেস—ঝালর দেওয়া খুব জমকালো পোশাক—পরিচ্ছদ পরে বাইরের সমাজে চলাফেরা করতেন। আমার নিজের বরাবরই একটা ঝোঁক ছিল বাবুগিরির দিকে। সহজেই তাই চলতি ফ্যাশনের স্রোতে আমি গা ভাসিয়ে দিলাম। আমার দামি দামি লেস—ভেলভেটের সাজগোজ দেখে সকলে রীতিমতো অবাক হয়ে যেতেন। এ ছাড়া একজোড়া ঘোড়ার সুন্দর একটি ফিটনগাড়ি, এবং পিঠে চড়ার জন্য চমৎকার একজোড়া আরবি ঘোড়াও আমার ছিল। আমার পোশাক ও চালচলনের সঙ্গে কেউ টেক্কা দিয়ে চলার সাহস পেতেন না। কলকাতা শহরে আমার তাই নাম হয়ে গেল ‘জেন্টলম্যান অ্যাটর্নি’। অ্যাটর্নিদের মধ্যেও আমি একটা ফারাক রেখে চলতাম, দু’চারজন সেরা অ্যাটর্নি ছাড়া আর কারও সঙ্গে বিশেষ মেলামেশা করতাম না। সপ্তাহে একটা করে ডিনার পার্টি দিতাম বাড়িতে, এবং তাতে বেশ হই—হল্লা করে খানিকটা সময় কাটত। আমার সঙ্গী ক্লিভল্যান্ড এসব ব্যাপারে বিশেষ যোগ দিতেন না, তাড়াতাড়ি কিছু কোনোরকমে মুখে দিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তেন। তাঁর ধারণা ছিল এসব করলে তিনি একেবারে বয়ে যাবেন।

মদ্যপান ও রাত্রিযাপনের ব্যাপারে ক্রমেই আমি বেশ বাড়াবড়ি করতে লাগলাম। ঠিক আমার মতন এতটা উচ্ছৃঙ্খল হতে কাউকে দেখিনি। সকালে সাতটার সময় কাজের জন্য আমি আমার ডেস্কে বসতাম, এবং আধ ঘণ্টা ব্রেকফাস্টের জন্য কাটিয়ে একটানা ডিনারের সময় পর্যন্ত কাজ করতাম। তারপর খুব জরুরি কোনো কাজ না থাকলে আর আমি সহজে কাগজ—কলম নিয়ে বসতাম না। মক্কেলের অভাব হয়নি কোনোদিন, বরং দিন দিন তার সংখ্যা বেড়েই গেছে। টাকাপয়সাও যথেষ্ট রোজগার করেছি, কোনোদিন কিছুর অভাব বোধ করিনি। জিনিসপত্র কেনাকাটা সম্বন্ধে আমার সেইজন্য কোনো চেতনাই ছিল না। যা প্রাণে চাইত, তা—ই কিনতাম। যে কোনো দোকান থেকে নয়, সেই জিনিসের সবচেয়ে বড় দোকানে অর্ডার দিতাম। মাসের ঠিক পয়লা তারিখেই বাজারের ধারদেনা সব শোধ করে দিতাম। কাজকর্মের প্রবল চাপের জন্য তিনজন ‘নেটিব’ ক্লার্কও আমাকে নিযুক্ত করতে হয়েছিল।

যত কাজই থাক, সপ্তাহে অন্তত একবার করে কর্নেল ওয়াটসনের ডকইয়ার্ডে আমাকে যেতেই হত। একদিন তাঁর ওখানে গিয়ে দেখলাম, মজুররা মাটি পরীক্ষার জন্য জমির নানা স্থানে খুঁড়তে আরম্ভ করেছে। মাটির তলা থেকে প্রায় তিন ফুট পুরু সব কাঠের বড় বড় টুকরো পাওয়া গেল। এগুলি কীসের কাঠ, কোথা থেকে এল, আমরা কেউ তা বুঝতে পারলাম না। ফেব্রুয়ারি মাসে (১৭৭৮) আমার বন্ধুবর (পট) ইংলন্ডে চলে গেল। মাসের শেষদিকে ড্যানিয়েল বারওয়েলও যাত্রা করলেন, কিন্তু পথে এক অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়ের ফলে তাঁর মৃত্যু হল। তাঁর এক আধপাগলি কুমারী বোন তা—ই নিয়ে যথেষ্ট হেস্তনেস্ত করবার চেষ্টা করলেন, কোম্পানির ডিরেক্টরদের পর্যন্ত চিঠিপত্র লিখলেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু করতে পারলেন না। যে কোনো কারণেই হোক, মিস বারওয়েলের ধারণা হয়েছিল যে তাঁর ভাইকে ডাচরা সম্পত্তির লোভে খুন করেছে। এই বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত হয়েছিল, কিন্তু ডাচদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই সত্য প্রমাণিত হয়নি। বারওয়েলের পর কোম্পানির অ্যাটর্নি জ্যারেটও ইংলন্ড যাত্রা করেন, এবং তাঁর স্থানে ইম্পের প্রস্তাবে নেলর কোম্পানির অ্যাটর্নি নিযুক্ত হন।

ক র্নে লে র উ ই ন্ড মি ল নি র্মা ণ

আমার বন্ধু কর্নেল ওয়াটসন খুব মনোযোগ দিয়ে ডক—নির্মাণের কাজ আরম্ভ করেছিলেন। তিনি গঙ্গার ধারে তাঁর ডকের কাজের জন্য দুটি বড় বড় বায়ুযন্ত্র (windmill) স্থাপন করেন। আমার মনে হয় এ দেশে ওয়াটসনই এই যন্ত্র আমদানি করেন। যন্ত্র দেখে নেটিবদের মনে বিপুল বিস্ময়ের সঞ্চার হয়েছিল। যন্ত্র দুটি দেখতে একরকম প্রায় ১১৪ ফুট উঁচু; পাঁচটি তলবিশিষ্ট (floors)। উপরের তলা শস্য—পেষাইয়ের জন্য এবং নিচের তলা কাঠ—চেরাইয়ের জন্য। বায়ুচালিত বড় বড় জাঁতায় ও করাতে পেষাই—চেরাই করা হয়। এরকম আশ্চর্য যন্ত্র এ দেশের লোক আগে কখনও চোখে দেখেনি। তবে ইউরোপের লোকের কাছেও এর যথেষ্ট নতুনত্ব ছিল।

আমার কাছেও ওয়াটসনের ‘উইন্ডমিল’ কম বিস্ময়কর মনে হয়নি। প্রতিদিন আমি ডকে যেতাম, এবং যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম তার বিচিত্র কর্মশক্তি ও কর্মপদ্ধতি। এ দেশের নেটিবরা কিছুতেই যন্ত্রশক্তিতে বিশ্বাস করতে পারত না। যখন তাদের বলা হত যে উপরের পালে বাতাস লাগলে যন্ত্র চলতে আরম্ভ করবে, এবং বড় বড় জাঁতাগুলি গুমগুম করে শস্য পিষতে থাকবে, তখন তারা তা আজগুবি গল্প মনে করে মুখের দিকে চেয়ে হাসত। একদিন তাদের এই অবিশ্বাস দূর করার জন্য সকলের সামনেই যন্ত্র চালানো হবে ঠিক হল। সেইদিন যখন যন্ত্র চলতে আরম্ভ করল, তার প্রতিশব্দে পাঁচটি তলা কাঁপতে থাকল, তখন উপরতলা প্রায় একশো মজুর কাজ করছিল। বড় বড় চাকা জাঁতা পাটাতন ইত্যাদি ঠকঠক করে কাঁপছে নড়ছে ও ঘুরছে দেখে ভয় পেয়ে তারা হুড়মুড় করে দৌড়ে বাড়ি ছেড়ে পালাবার চেষ্টা করল। ভাবল, কোন যাদুকর কিছু তুকতাক করে এই কাণ্ড করেছে। একটা ভয়ঙ্কর ভূত যেন ভর করেছে বাড়িটাকে, তাই সব এমনভাবে কাঁপছে আর ঘুরছে। সেই ভূত যদি তাদের ঘাড়েও চেপে বসে তাহলে তাদেরও এই দশা হবে অর্থাৎ ঘুরতে হবে ও কাঁপতে হবে। এই চিন্তাতেই তারা কাঁপতে কাঁপতে সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময়, পরস্পর মাথা ঠোকাঠুকি করে ও আছাড় খেয়ে প্রায় অর্ধেক জখম হয়ে গেল। চারদিকে কেবল ‘ওরে বাবা, ওরে বাবা’ শব্দে একটা চিৎকার শোনা যেতে লাগল। এরকম বিচিত্র দৃশ্য ও অসহায় করুণ আর্তনাদ আমি দেখিনি বা শুনিনি কখনও।

ওয়াটসন সাহেব প্রথম শ্রেণির একখানি জাহাজ তৈরি করবেন বলে বিরাট একটি কাঠামো তৈরি করেছিলেন। অর্ধেক তৈরি হবার পর তাঁর সেগুনকাঠে ঘাটতি পড়ল, উপরের ‘ফ্ল্যাট টেরাস’ তৈরি করা সম্ভব হল না। তখন তিনি স্থির করলেন, এ দেশের ঘরের চালের মতন ঢালু চাল দিয়ে ছেয়ে দেবেন। কিন্তু কাঠামোটি এত চওড়া হয়ে গিয়েছিল যে তার উপর ঢালু চাল দেওয়া (pitched roof) সম্ভব হল না। উপরের অংশ বেশ খানিকটা সংকুচিত করতে হল। ইঞ্জিনিয়ার মিঃ ক্রেসি ইট গেঁথে তা করতে রাজি হলেন না, গড়ন টিকবে না বলে। ওয়াটসন কিন্তু নাছোড়বান্দা, করবেনই প্রতিজ্ঞা করলেন। আমাকেও একদিন সে কথা তিনি বললেন। পরদিনই তিনি বিখ্যাত স্থপতি টমাস লায়ন (Thomas Lyon)—কে ডেকে পাঠালেন। লায়ন সবকিছু দেখেশুনে বিরূপ মনোভাবের প্রতিশোধ নেবার জন্য তিনিও বদ্ধপরিকর হলেন। কর্নেলের কাজে তিনি পদে পদে বাধা দিতে লাগলেন।

ডক তৈরি করার জন্য গবর্নমেন্ট যখন প্রথম ক্যাম্বেল সাহেবকে জমি দান করেছিলেন তখন তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, স্থানীয় নেটিব বাসিন্দাদের টাকাপয়সা বা অন্য কোনো বাসের জমি ন্যায্য ক্ষতিপূরণস্বরূপ দিয়ে জমি দখল করতে। কিন্তু জমির প্রতি ভারতীয়দের মমতা এত বেশি যে কেউ বসবাসের ভিটে প্রাণ থাকতে ছাড়তে চায় না, কোনো লোভ দেখিয়েই তাদের বশ করা যায় না। এ ব্যাপারে উঁচুনিচু ভেদ নেই বিশেষ। ক্যাম্বেল সাহেব কিছুতেই তাদের ভিটে ছাড়ার জন্য রাজি করাতে পারেননি। ঘরবাড়ি বলতে কতকগুলি ভাঙাচোরা পর্ণকুটির ছাড়া তাদের আর কিছুই ছিল না। কিন্তু তার প্রতি কী প্রচণ্ড আসক্তিই না ছিল। ক্ষতিপূরণের কোনো লোভ দেখিয়েই তাদের তোলা গেল না। অবশেষে ওয়াটসন সাহেব একদিন একদল সেপাই পাঠিয়ে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে দিলেন। তারপর রাতারাতি সেই জায়গা চষে একেবারে মাটির সঙ্গে এমনভাবে সমান করে দিলেন যে দেখে সেখানে কোনোদিন লোকের বসবাস ছিল বলে চেনাই যেত না।

উদ্বাস্তু লোকেরা কয়েকদিন পরে দল বেঁধে কাউন্সিল হাউসে গেল, এবং সেখানে চিৎকার করে তাদের দাবি জানাতে লাগল। ক্যাম্বেলকে উৎখাত করার কারণ জিজ্ঞাসা করতে তিনি বলেন যে ঘরবাড়ির ন্যায্য দামের পাঁচগুণ এবং অন্য ভাল জমিজমা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তাদের স্বেচ্ছায় স্থান থেকে সরানো সম্ভব হয়নি। তাতে জনকল্যাণকর কাজে নিশ্চয় বাধার সৃষ্টি হচ্ছিল। এই অবস্থায় বলপ্রয়োগে উচ্ছেদ না করে উপায় ছিল না। এই কথা শুনে গবর্নমেন্ট চারজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক নিয়ে একটি কমিটি গঠন করলেন, ক্ষতিপূরণের দাবিদাওয়াটা বিচারের জন্য। দশ মাস ধরে কমিটির বৈঠক বসল অন্তত বিশবার, আলোচনা হল অনেক, কিন্তু কিছুই মীমাংসা হল না। চারজনের চাররকম মত হল, এবং শেষ পর্যন্ত মতে মিল হল না। যাঁরা উৎখাত হয়েছিল, তারা আর পৈতৃক ভিটেতে ফিরে আসতে পারেনি, এই পর্যন্ত জানি। ক্ষতিপূরণ কি তারা পেয়েছিল, অথবা আদৌ পেয়েছিল কি না, তা জানি না।

ক্যাম্বেলের সঙ্গে ওয়াটসন পরে এই ডক—নির্মাণ পরিকল্পনায় যোগ দিয়েছিলেন। বড় বড় ইমারত অনেক তৈরি করা হয়েছিল ডকের কাজের জন্য, এবং তার সঙ্গে বেশ লম্বা লম্বা ব্যারাকবাড়ি মজুরদের জন্য। ওয়াটসন ঠিক করেছিলেন, ডক এলাকায় মজুরের কাজের জন্য মোজাম্বিক ম্যাডাগাস্কার প্রভৃতি অঞ্চল থেকে ক্রীতদাস আমদানি করবেন। ডকের জন্য তাঁরা এত টাকা খরচ করেছিলেন যে কোম্পানির কাছ থেকে কোনো পাকাপোক্ত পাট্টা না পেলে তাঁরা আর কাজে এগুতে সাহস করছিলেন না।

খি দি র পু রে র গো কু ল ঘো ষা ল

গোকুল ঘোষাল নামে খিদিরপুর অঞ্চলে একজন ধনী ব্যক্তি ডকের কাজের জন্য তাঁর নিজের অনেকখানি জায়গা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। ওয়াটসন আসার পর তাঁর সঙ্গে তিনি কয়েকবার সাক্ষাৎ করেন এবং জমির ব্যাপার নিয়ে দু’জনের মধ্যে কথাবার্তাও হয়। দু’একবার কথাবার্তার সময় আমি নিজে উপস্থিতও ছিলাম। কর্নেলকে তিনি সাদর অভিনন্দন জানিয়ে বললেন যে তাঁর ডক—নির্মাণের পরিকল্পনা সফল হলে তিনি খুব খুশি হবেন। দেখাসাক্ষাতের সময় গোকুল ঘোষাল নিজের জমি সম্বন্ধে কোনো কথাই উত্থাপন করলেন না, বরং এ ব্যাপারে তাঁকে তাঁর সাধ্যমতো সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। প্রসঙ্গত তিনি জানিয়েও দিলেন যে, প্রয়োজন হলে যে কোনো সময় তিনি কর্নেলকে তিন—চার লক্ষ টাকা পর্যন্ত ধারও দিতে পারেন। কর্নেলের সঙ্গে যাঁর এত দূর কথাবার্তা হল, সেই গোকুল ঘোষাল শেষে তাঁর সবচেয়ে বড় বিরুদ্ধাচারী হয়ে দাঁড়ালেন। বারওয়েল সাহেবই যে তাঁকে এ কাজে প্ররোচিত করেছিলেন, তা আমাদের বুঝতে দেরি হয়নি।

গোকুল ঘোষালের একখণ্ড জমি ওয়াটসন তাঁর ডকের জন্য অধিকার করেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই বারওয়েলের পরামর্শে ঘোষাল তাঁর জমির দখল দাবি করে কর্নেলকে একখানি চিঠি লিখলেন। ওয়াটসন তার জবাবে জানালেন, বিষয়টি গবর্নর—জেনারেল ও কাউন্সিলের কাছে পেশ করলে ভাল হয়। গোকুল ঘোষাল লিখলেন যে গবর্নমেন্টের সঙ্গে তাঁর জমির কোনো সম্পর্ক নেই। জমির মালিক তিনি এবং কর্নেল ওয়াটসন সেই জমি জবরদস্তি দখল করেছেন। অতএব নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে জমির দখল যদি তিনি ফিরে না পান, তাহলে তার জন্য সুপ্রিমকোর্টে তাঁকে মামলা রুজু করতে হবে। ঘোষালের মনোভাবে কর্নেল একটু চিন্তিত হলেন, এবং তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করে একখানি চিঠি লিখলেন। গোকুলবাবু বারবার কথা দিয়েও দেখা করতে এলেন না। অবশেষে কর্নেল নিজেই তাঁর বাড়িতে যাবেন ঠিক করলেন, এবং আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। গোকুলবাবু সবিনয়ে মার্জনা ভিক্ষা করে বললেন যে তাঁর অসুস্থতার জন্য তিনি যেতে পারেননি। সেইজন্য তিনি সত্যিই দুঃখিত ও লজ্জিত। কর্নেল বললেন, ‘সে কথা ঠিক, কিন্তু আপনি যা করেছেন তা নিশ্চয় অসুস্থ বলে করেননি। বারওয়েল সাহেবের পরামর্শেই তো আপনি এই জমি দাবি করেছেন?’ কয়েক মিনিট চুপ করে থেকে এবং মুখটা অত্যন্ত কাঁচুমাচু করে ঘোষাল বললেন, ‘হ্যাঁ, তা তো বটেই, বারওয়েল সাহেব মস্তবড় লোক, আমার জন্য একজন রক্ষকও বলা চলে। তাঁর কথা আমি কি অমান্য করতে পারি?’ কর্নেল খানিকটা উত্তেজিত হয়েই তাঁকে বললেন, ‘বুঝেছি; আর বলতে হবে না। যেমন আপনি, তেমনি আপনার রক্ষক বারওয়েল, দু’জনেই রাস্কেল।’ এই কথা বলে কর্নেল তৎক্ষণাৎ তাঁর বাড়ি ছেড়ে চলে এলেন।

মামলা আরম্ভ হবার দিন তিনেক পরে কর্নেল ওয়াটসন গবর্নর—জেনারেল হেস্টিংস, ফ্রান্সিস ও হুইলার, এই তিনজনের সঙ্গে দেখা করে জমির ব্যাপার তাঁদের জানালেন। সকলেই একবাক্যে বারওয়েলের নিন্দা করলেন, এবং হেস্টিংস নিজে কথা দিলেন যে ব্যাপারটা মিটমাট করে ফেলার জন্য তিনি বারওয়েলকে অনুরোধ করবেন। গোকুল ঘোষালকে যে তিনি কোনো পরামর্শ দিয়েছেন, এ কথা অবশ্য হেস্টিংসের কাছে বারওয়েল একেবারে অস্বীকার করেন। আপসে মামলা নিষ্পত্তির আর কোনো সম্ভাবনা নেই দেখে ওয়াটসন মামলা লড়ার জন্য প্রস্তুত থাকেন।

যে জমির জন্য গোকুল ঘোষাল মামলা করেছিলেন, ওয়াটসনের পরিকল্পনার দিক থেকে তার গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। গঙ্গাতীরের লম্বা একখণ্ড জমি, তার উপর দিয়ে ঘোষাল—পরিবারের লোকজন স্নানাদি নিত্যকর্মের জন্য যাতায়াত করতেন। এই জমির উপরেই কর্নেল তাঁর বায়ুকল (windmill) বসিয়েছিলেন, এবং এ জমি বাদ দিয়ে তাঁর ‘wet’ বা ‘dry’ কোনো ডকই নির্মাণ করা চলে না। সুতরাং গোকুল ঘোষাল মামলায় জিতলে কর্নেলের ডকের পরিকল্পনা ত্যাগ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।

গোকুল ঘোষাল তখনকার কলকাতার একজন বিখ্যাত ও প্রবল প্রতিপত্তিশালী ধনী ব্যক্তি। কোম্পানির সলিসিটার নর্থ নেলার (North Nailor)—কেই তিনি অ্যাটর্নি নিযুক্ত করলেন। এ কাজেও যে বারওয়েল সাহেব তাঁকে সাহায্য করেছিলেন তা বলাই বাহুল্য। কর্নেল আমাকেই অনুরোধ করলেন তাঁর মামলা চালাবার জন্য। আমি রাজি হলাম, এবং প্রথমেই কোম্পানি যে জমির দানপত্র কর্নেলকে দিয়েছিলেন তা ভাল করে পরীক্ষা করলাম। দেখলাম দানপত্রের মধ্যে কোনো গলদ নেই, এবং জমির কোনো গণ্ডগোলের জন্য তিনি দায়ী নন, গবর্নমেন্টই দায়ী। অতএব মামলা চালাবার সমস্ত দায়িত্ব গবর্নমেন্টের, কর্নেলের নয়। এই কথা কর্নেলকে জানাবার জন্য আমি তাঁকে অনুরোধ করলাম। অ্যাডভোকেট—জেনারেল জন ডে আমার যুক্তি মেনে নিলেন। কোম্পানির সেক্রেটারি অবশেষে নেলারকে জানালেন যে—ওয়াটসনের মামলার দায়িত্ব তাঁকেই নিতে হবে। তার আগেই ঘোষালের পক্ষে নেলার মামলার ভার দিয়েছিলেন বলে তিনি তাঁর পার্টনার আর—একজন অ্যাটর্নি স্যামুয়েল টলফ্রের উপর মামলার ভার দেন। সেক্রেটারি শেষে আমাকেই অনুরোধ করেন মামলা চালাতে, এবং জানিয়ে দেন যে নতুন ল—কমিশনার সর্বব্যাপারে আমাকে যখনই প্রয়োজন হবে সাহায্য করবেন। সুতরাং কর্নেলের মামলা নিয়ে আমি বেশ জড়িয়ে পড়লাম।

কর্নেলের পক্ষে মামলার দায়িত্ব গবর্নমেন্টই নিচ্ছেন দেখে গোকুল ঘোষাল রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। তখনকার দিনে গবর্নমেন্টের সুনজরে থাকা এ দেশের অবস্থাপন্ন লোকদের বিশেষ কাম্য ছিল। তাই গবর্নমেন্টের অপ্রীতিভাজন হতে পারেন মনে করে ঘোষাল বেশ বিচলিত হয়েছিলেন। তা ছাড়া, সরকারের বিপক্ষে মামলা তিনি জিতবেন কি না সে বিষয়েও তাঁর সন্দেহ ছিল। কিন্তু বারওয়েল তাঁকে মামলা চালাতে ক্রমাগত উস্কানি দিতেন বলে শেষ পর্যন্ত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তিনি আসলে মিটমাট করেননি।

মামলার শুনানি আরম্ভ হল একদিন সকাল ন’টায়, এবং শেষ হল রাত আটটায়। গোকুল ঘোষালই মামলায় জয়ী হলেন। সার এলিজা ইম্পে ঘোষালের পক্ষে দীর্ঘ রায় দিয়ে বললেন যে এই ধরনের ব্যাপার নিয়ে এরকম বিবাদের সৃষ্টি হওয়া উচিত হয়নি। গবর্নমেন্টের উচিত ছিল আপসে এর মীমাংসা করে নেওয়া।

এই ঘটনার পর ওয়াটসন তাঁর ডক—নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল করে দেন। যদি তা তাঁকে না করতে হত, এবং যদি তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি ডক তৈরি করতে পারতেন, তাহলে তা নিঃসন্দেহে এ দেশের একটি স্মরণীয় কীর্তি হয়ে থাকত।

গোকুল ঘোষালের জমি দখলের ব্যাপারে ওয়াটসনের কোনো দোষ ছিল না, অথচ তিনি সেই জমির জন্য রীতিমতো ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। ভবিষ্যতে আরও এরকম জমি দখলের মামলা হতে পারে মনে করে তিনি তাঁর ডকের পরিকল্পনা একরকম বাতিল করাই সিদ্ধান্ত করেন। কিন্তু যে আর্থিক ক্ষতি তাঁকে এর জন্য স্বীকার করতে হল তা পূরণ করার জন্য গবর্নমেন্টকে নোটিশ জারি করলেন। বিলেতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ডেপুটি চেয়ারম্যানকেও আর্থিক ক্ষতিপূরণের জন্য নোটিশ জারি করা হল। ওয়াটসন হয়তো চাকরিও ছেড়ে দিতেন, কিন্তু কোম্পানির চিফ ইঞ্জিনিয়ারের বেতন ও ভাতা ইত্যাদি তখন এত বেশি ছিল যে, হঠাৎ তিনি তা ছাড়তে চাইলেন না। তিনি স্থির করলেন, বাংলা দেশে কিছুদিন থাকবেন, এবং ডক ও জাহাজ নির্মাণের জন্য যে প্রচুর জিনিসপত্র বিদেশ থেকে আমদানি করেছেন, তা অন্তত কিছু বিক্রি করে দেবেন বা কাজে লাগাবেন। ইংলন্ড থেকে তিনি জাহাজ তৈরির জন্য কারিগর ও যন্ত্রপাতিও এনেছিলেন অনেক। তা—ই দিয়ে দু’একটি জাহাজ না তৈরি করে তিনি কাজে ইস্তফা দেবেন না ঠিক করলেন। দু’বছরের মধ্যে তিনখানি জাহাজও তিনি তৈরি করে ফেললেন, সব দিক দিয়েই বিলেতের তৈরি জাহাজের সঙ্গে সেগুলির তুলনা করা চলে। প্রথমটির নাম Surprise, দ্বিতীয়টির নাম Nonsuch, তৃতীয়টির নাম Laurel। প্রায় ৩০০ টনের জাহাজ ‘সারপ্রাইজ’, ইয়োরোপে মালপত্র চালান দেবার জন্য গবর্নমেন্টই কিনে নিলেন। ‘ননসাচ’ ও ‘লরেল’ প্রথমে চীনের বাণিজ্যের জন্য ব্যবহার করা হয়, পরে ইয়োরোপেও পাঠানো হয়। কলকাতায় তৈরি এই জাহাজ তিনখানি দেখে ইয়োরোপের ব্যবসায়ীরা সকলেই বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।

ম হা রা জা ন ন্দ কু মা রে র ফাঁ সি

ফেব্রুয়ারি মাসে (১৭৭৮) ক্যাপ্টেন সাটন ইয়োরোপ যাত্রা করলেন। তাঁর সঙ্গী হলেন ব্যারিস্টার ফ্যারোর। আমাদের এই ব্যারিস্টার বন্ধুটি মাত্র বছর তিনেক প্র্যাকটিস করে প্রায় আশি হাজার পাউন্ড সঞ্চয় করেছিলেন। এই বিপুল অর্থের অধিকাংশই তিনি রোজগার করেছিলেন মহারাজ নন্দকুমারের বিচারের সময় তাঁর কাউন্সেল নিযুক্ত হয়ে। নন্দকুমারের জালিয়াতির অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁর মতন প্রতিপত্তিশালী হিন্দু রাজাকে এই অপরাধের জন্য ফাঁসি দেওয়া, ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের ইতিহাসে একটা কলঙ্কের মতন হয়ে আছে।

গবর্নর—জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে জেনারেল ক্লেভারিঙের ভয়ানক শত্রুতা ছিল। ক্লেভারিং ছিলেন কাউন্সিলের প্রথম সদস্য এবং প্রধান সেনাপতি। একবার হঠাৎ গুজব রটে গেল যে হেস্টিংস গবর্নর—জেনারেলের পদ ত্যাগ করেছেন। সেই সময় ক্লেভারিং বিশেষ তৎপরতার সঙ্গে গবর্নমেন্ট ও ফোর্ট উইলিয়াম দখল করে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। হেস্টিংসের বন্ধুবান্ধবরা সতর্ক থাকার জন্য তাঁর চক্রান্ত ব্যর্থ হয়। হেস্টিংসের সবচেয়ে বড় সমর্থক ছিলেন বারওয়েল, এবং ক্লেভারিঙের পক্ষে ছিলেন কর্নেল মনসন ও ফ্রান্সিস। দুই দলের বিবাদ যখন চরমে পৌঁছয়, ঠিক সেই সময় মনসন হঠাৎ অসুখে মারা যান। তার ফলে হেস্টিংস তাঁর অতিরিক্ত ভোট দিয়ে কাউন্সিলে নিজের দল ভারী করে ফেলেন।

দুই দলে বিবাদ যখন আরম্ভ হত তখন সারা শহরময় রীতিমতো সাড়া পড়ে যেত। প্রত্যেক মুহূর্তে একটা সশস্ত্র সামরিক বিদ্রোহের আতঙ্কে সকলে শঙ্কিত হয়ে থাকত। থাকারই কথা, কারণ বিরোধটা যখন গবর্নর—জেনারেলের সঙ্গে সেনাধ্যক্ষের, তখন বিদ্রোহ প্রত্যাশা করা স্বাভাবিক। অবশেষে নিরপেক্ষরা প্রস্তাব করলেন যে দুই দলের ন্যায়—অন্যায় বিচারের ভার সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের উপর দেওয়া হোক। হেস্টিংস ও ক্লোভারিং উভয়েই এই প্রস্তাবে সম্মত হলেন। দু’জনেই লিখিত বিবৃতি দাখিল করলেন বিচারকদের কাছে। বিচারকরা দুই পক্ষের বক্তব্য সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করে অবশেষে রায় দিলেন এই মর্মে যে হেস্টিংসের গবর্নমেন্টই থাকা উচিত। ক্লেভারিং বিচারকদের রায় মেনে নিলেন। এইভাবে একটা ভয়াবহ বিরোধের মীমাংসা হল, যা না হলে এ দেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অস্তিত্ব বজায় রাখা মুশকিল হত।

দুই দলের যখন বিচার চলতে থাকে তখন উভয়ের অ্যাডভোকেট ও সমর্থকদের মধ্যেও প্রবল ঝগড়াবিবাদ হয়। এই হেস্টিংস—ক্লেভারিং বিবাদ উপলক্ষ করে কলকাতা শহরে তখন কত যে ‘ডুয়েল’ পড়া হয় তার ঠিক নেই। তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ডুয়েল হয় হেস্টিংসের সঙ্গে ফ্রান্সিসের। আর—একটি ডুয়েল হয় আমার বন্ধু রবার্ট পটের সঙ্গে জেমস গ্রান্টের। পট ছিল গোঁড়া হেস্টিংসপন্থী, গ্রান্ট ছিলেন ক্লেভারিংপন্থী। দুই পন্থী শেষে সম্মুখসমরে দ্বন্দ্বের মীমাংসা করলেন। পটের সঙ্গে গ্রান্টের বেশ বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু গবর্নমেন্টের মধ্যে দুই দলের যখন প্রকাশ্য বিবাদ আরম্ভ হল, তখন পট হঠাৎ একদিন গ্রান্টকে বিশ্বাসঘাতক ও ক্লেভারিঙের গুপ্তচর বলে বসল; পটের অভিযোগ হল, গ্রান্ট তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে সমস্ত গোপন খবর বার করে নিয়ে হেস্টিংস—বিরোধীদের জানিয়েছেন। গ্রান্ট এই অভিযোগ অস্বীকার করেন, এবং চ্যালেঞ্জ করে বসেন পটকে। তখন চ্যালেঞ্জ বলতে ডুয়েলই বোঝাত। ডুয়েলের সময় দু’জনের মধ্যে বহু গুলিবিনিময় হল এবং শেষে গ্রান্টকে জখম করে পটই দ্বন্দ্বযুদ্ধে জয়ী হল। ব্যাপারটা ওইখানেই মিটে গেল বটে, কিন্তু গ্রান্টের ‘গুপ্তচর’ বদনাম সহজে দূর হল না।

মহারাজ নন্দকুমার জেনারেল ক্লেভারিঙের একজন বড় সমর্থক ছিলেন। অনেকে মনে করেন সেই কারণেই নন্দকুমারের ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। কথাটা একেবারে মিথ্যা বলে মনে হয় না, কারণ চিফ জাস্টিস এলিজা ইম্পে জুরিদের কাছে মামলাটি পেশ করার সময় পরিষ্কার নন্দকুমারের প্রতি বিদ্বেষভাব প্রকাশ করেছিলেন। জুরিরা কয়েক ঘণ্টা ধরে আলাপ—আলোচনা করার পর অবশেষে নন্দকুমারকে অপরাধী বলে রায় দেন। পরে জুরিদের কয়েকজনের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা হয়। তাঁরা অনেকেই নন্দকুমারকে অপরাধী সাব্যস্ত করতে রাজি ছিলেন না। কেউ কেউ বলেন যে এই অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড হবে জানলে তাঁরা কখনোই এই রায় দিতেন না। ফাঁসির হুকুমে অনেকেই বেশ ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। যেদিন মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি হয়, সেদিন কলকাতা শহরের অধিকাংশ হিন্দু ভোরবেলা উঠে ঘৃণায় ও বিরক্তিতে শহর ছেড়ে চলে যান। বিচারকদের সার রবার্ট চেম্বার্স নন্দকুমার সম্বন্ধে ভিন্নমত পোষণ করতেন। তাঁর মতে নন্দকুমার এমন কোনো গুরুতর অপরাধ করেননি, যার জন্য তাঁকে কঠোর দণ্ড দেওয়া উচিত। কিন্তু চেম্বার্স এত ভালমানুষ ছিলেন যে তাঁর ব্যক্তিত্ব বলে বিশেষ কিছু ছিল না। সার ইম্পে সহজেই তাঁকে কাবু করে ফেললেন, এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর অনুরোধে চেম্বার্স নন্দকুমারের মৃত্যুপরোয়ানাতে সই করতেও বাধ্য হলেন।

অল্পদিনের মধ্যেই ক্লেভারিঙের মৃত্যু হল। তাঁর প্রথম পক্ষের স্ত্রীর তিনটি কন্যার মধ্যে কনিষ্ঠা কেরোলিন দেখতে অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন। এমনিতে বেশ চৌকস মেয়ে হলেও, কেরোলিন বিবাহিত জীবনে সুগৃহিণী হয়েছিলেন শুনেছি। তিনি ইংলন্ডে গিয়ে এক অ্যাডমিরালকে বিবাহ করেন।

বাং লা র কা ল বৈ শা খী

ক্লিভল্যান্ড ও আমি এপ্রিল ১৭৭৮ পর্যন্ত বেশ একত্রে ঘরসংসার পাতিয়ে ছিলাম। কিন্তু কিছুদিন পরে তাঁর সঙ্গে একত্রে থাকতে আমারই সঙ্কোচ হল। কারণ আমাদের যা খরচ হত তা আমরা দু’জনেই সমান ভাগে দিতাম, অথচ ক্লিভল্যান্ড দিনে দু’গ্লাসের বেশি মদ্যপান করতেন না, এবং বন্ধুবান্ধবদেরও বিশেষ খাওয়াদাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করতেন না। এদিকে মদ্যপান ও ভোজসভা দুইই আমি পুরোদমে চালাতাম, এবং তার ফলে স্বভাবতই আমার জন্য খরচ হত অনেক বেশি। তা সত্ত্বেও তিনি অর্ধেক ব্যয়ভার বহন করবেন এবং আমি তা গ্রহণ করব এটা আমার শোভন বা সঙ্গত বলে মনে হল না। আমি তাই আলাদা বাসা করে থাকার সিদ্ধান্ত করলাম। একটি নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছিল, পয়লা মে থেকে সেটি ভাড়া নেব স্থির করলাম। আমরা দু’জনে যে বাড়িটিতে ছিলাম, আগেই বলেছি সেটি কাঁচা গাঁথনির বাড়ি, চুনসুরকির গাঁথনি নয়। দক্ষিণদিকে সূর্যের তাপ লাগত বেশি, এবং তাতে বাড়ি খুব গরম হয়ে যেত। আমি তাই এ দেশি একজন মিস্ত্রি ডেকে একটি বারান্দা করে নেব ঠিক করলাম। আমার মতলব শুনে বাড়িওয়ালি মিসেস পগডেন ছুটে এলেন একদিন, এবং বললেন যে দেওয়ালের গা দিয়ে বারান্দা ঠেলে বার করলে বাড়িটা ধসে পড়ে যাবে। আমি তখন মালপত্তর কিনে ফেলেছি, কাজেই এ বিষয়ে মিঃ লায়নের (আর্কিটেক্ট) সঙ্গে পরামর্শ করে কাজটা সেরে ফেলব ঠিক করলাম। লায়নের নির্দেশ অনুযায়ী বারান্দা তৈরি হয়ে গেল।

মার্চ, এপ্রিল, মে—বাংলা দেশে এই তিন মাস হল চৈতালি ঘূর্ণি ও কালবৈশাখী ঝড়ের সময়। কিন্তু ঝড়জল খুব প্রবল ও ভয়ঙ্কর হলেও ঝড়ের পর বাইরের আবহাওয়া বেশ শান্ত শীতল ও উপভোগ্য হত। সপ্তাহে শনি—রবিবার সার রবার্ট চেম্বার্সের বাড়িতে না গিয়ে, কলকাতার চার মাইল উত্তরে কাশীপুরে গঙ্গাতীরে ক্যাপ্টেন থর্নহিলের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম। ক্যাপ্টেনের এই বিলাস বাগানবাড়িতে অনেকেই তখন স্ফূর্তি করার জন্য যেতেন। ক্যাপ্টেনও ছিলেন দিলদরিয়া লোক, সকলকে আদর—আপ্যায়নের জন্য দু’হাতে অর্থব্যয় করতেন। একবার এপ্রিল মাসের শেষে বোধহয় কাশীপুরে তাঁর বাড়িতে বেড়াতে গেছি, সন্ধ্যার সময় কালবৈশাখীর ঝড় উঠল। এরকম প্রচণ্ড ঝড় অনেকদিন দেখিনি। ঈশানকোণ থেকে ঝড় উত্তর—পূর্ব কোণে সরে গেল এবং আরও প্রচণ্ডতর বেগে বইতে লাগল। আমার নিজের বাড়িটি উত্তর—পূর্বদিকে খোলা বলে আমি রীতিমতো চিন্তিত হলাম। বার বার আমার তৈরি নতুন বারান্দাটির কথা মনে হতে লাগল। ভাবলাম, ঝড়ের দাপটে হয়তো ফিরে গিয়ে দেখব বারান্দাটি ভেঙে পড়েছে, এবং তার সঙ্গে বাড়ির দেয়ালটিও।

ক্যাপ্টেনের বাড়ি থেকে বেরোতে রাত প্রায় বারোটা হয়ে গেল। ফিটনে করে স্বগৃহাভিমুখে ঊর্ধ্বশ্বাসে যাত্রা করলাম। বাড়ির কাছে রাস্তায় এসে মধ্যরাতের আবছায়ায় মনে হল যেন আমার জীর্ণ বাড়ির কঙ্কালটা সোজা হয়েই দাঁড়িয়ে আছে, ভেঙে পড়েনি। আরও একটু এগিয়ে বাড়ির দরজার কাছে এসে দেখলাম, আমার সাধের বারান্দা ধুলোয় গড়াগড়ি যাচ্ছে, উঠোনের উপর তার ভগ্নস্তূপ ছড়িয়ে রয়েছে। যা—ই হোক, তবু আমার অদৃষ্ট ভালই বলতে হবে, কারণ গোটা বাড়িটা অন্তত ঝড়ে ধসে পড়েনি।

ত রু ণী ই হু দি শি ল্পী ই সা ক

আমি ও ক্লিভল্যান্ড যখন একসঙ্গে থাকতাম তখন কলকাতায় একজন তরুণী চিত্রশিল্পী এসে হাজির হলেন। ক্লিভল্যান্ডের সঙ্গে ইংলন্ডেই তাঁর আলাপ হয়েছিল। সেইজন্য তিনি তাঁর চিত্রাঙ্কনের ব্যবসার সাফল্যের জন্য বিশেষ চেষ্টা করতে লাগলেন। আমাকে একদিন অনুরোধ করলেন আমার প্রতিকৃতির জন্য শিল্পীর কাছে ‘সিটিং’ দিতে হবে। আমি রাজি হলাম, কারণ আমার একখানি ছবি আমার বোনকে পাঠাবার জন্য দরকার ছিল। প্রথম দিন যখন শিল্পীর স্টুডিওতে হাজরে দিলাম, তখন ক্লিভল্যান্ডও আমার সঙ্গে ছিলেন। ইহুদিনি শিল্পীর সামনে আমি বসে আছি, এমন সময় হঠাৎ তিনি বললেন যে, কুশ্রী চেহারা যাদের তারা যে কী করে শিল্পীর কাছে নিজের ছবি আঁকাতে আসে তা তিনি কল্পনা করতে পারেন না। তাঁর অপ্রত্যাশিত মন্তব্যে রীতিমতো চমকে গিয়ে আমি বললাম, ‘এখানে অবশ্য আমি নিজে ইচ্ছে করে আসিনি, আপনার অনুরোধেই এসেছি। তা ছাড়া আপনার এই মন্তব্যের অর্থ কী তাও আমি জানি না।’ শিল্পী ইসাক তাঁর স্বভাবসুলভ সরল ভঙ্গিতে বললেন, ‘বন্ধু ক্লিভল্যান্ডের পক্ষে এই ধরনের উক্তি করা খুবই অশোভন হয়েছে। আর আমাকে যদি কলকাতা শহরে কেবল সুন্দর লোকদের ছবি আঁকতে হয়, তাহলে তো আমাকে এখনই পাততাড়ি গুটিয়ে স্বদেশে ফিরে যেতে হবে, ব্যবসা করা আর চলবে না।’ বছর দুই পরে এই ইহুদিনি শিল্পী মহিলা হিগিনসন নামে কোম্পানির একজন উচ্চপদস্থ ধনিক কর্মচারীকে বিবাহ করেন।

ফ্রা ন্সি সে র প্রে মে র কা হি নি

মিঃ ফিলিপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় যে বিশেষ প্রীতিকর হয়নি, তা আগেই বলেছি। আমি যখন বার্কের পরিচয়পত্র তাঁকে দিয়েছিলাম তখন অ্যাটর্নিদের সম্বন্ধে তিনি যে দম্ভোক্তি করেছিলেন, তা কখনও ভোলবার নয়। তিনি নিজেকে এত উচ্চস্তরের জীব মনে করতেন যে, সেখান থেকে অ্যাটর্নিদের তাঁর অতিনগণ্য জীব বলে মনে হত। কিন্তু অদৃষ্টচক্রে এমনই ঘটনা ঘটল যে তাঁকে সাংঘাতিকভাবে শেষ পর্যন্ত সেই অ্যাটর্নিদেরই শরণাপন্ন হতে হল। যেজন্য তাঁকে অ্যাটর্নির দ্বারস্থ হতে হল, সেই ঘটনাটি এই :

জর্জ ফ্রান্সিস গ্রান্ড নামে কোম্পানির একজন পদস্থ কর্মচারী একটি সুন্দরী ফরাসি তরুণীকে বিবাহ করেছিলেন। ফিলিপ ফ্রান্সিস ঘটনাচক্রে প্রায় উন্মাদের মতন তাঁর প্রেমে পড়লেন। এরকম উন্মত্ত কাণ্ডজ্ঞানহীন প্রেম সচরাচর দেখা যায় না। প্রেমের তাড়নায় তিনি একদিন একটি বেআইনি কাজ করে একেবারে ফেঁসে গেলেন। আমি বাংলা দেশে আসার কয়েক মাস পরেই ঘটনাটি ঘটল। পাকেচক্রে এমনই হল যে মিঃ গ্রান্ড আমাকেই তাঁর অ্যাটর্নি মনোনীত করবেন স্থির করলেন। প্রস্তাব নিয়ে যখন তিনি আমার কাছে এলেন তখন আমি তাঁকে বুঝিয়ে বললাম যে আমার পক্ষে তাঁর মামলা পরিচালনা করা সম্ভব নয়। ফ্রান্সিসের প্রতি কোনো বিশেষ অনুরাগবশত যে আমি এ কথা বলেছিলাম, তা নয়। ব্যাপারটা নিতান্ত ব্যক্তিগত ও অত্যন্ত লজ্জাকর বলে এবং ফ্রান্সিস মিঃ বার্কের বন্ধু বলে আমি সঙ্কোচ বোধ করলাম। মিঃ গ্রান্ড আমার যুক্তি আদৌ সঙ্গত নয় বলে আমাকে খুবই অনুরোধ করতে লাগলেন। প্রতিদিন তিনি আমার অফিসে আসতেন, এবং মামলার দায়িত্ব নেবার জন্য আমাকে পীড়াপীড়ি করতেন। তাঁর অনুরোধ এড়ানো সম্ভব নয় দেখে আমি অবশেষে কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলাম।

যেদিন আমি পালালাম, সেইদিন সকালেই গ্রান্ড অফিসে এসে আমার ক্লার্ক টলফ্রেকে বুঝিয়েসুঝিয়ে মামলার ভার চাপিয়ে গিয়েছিলেন। টলফ্রের কাছ থেকে এই খবর পেয়ে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম, কিন্তু তার উপর রাগ করতে পারলাম না। খবর পেয়েই তৎক্ষণাৎ কলকাতায় ফিরে এলাম, এবং আদালতে গিয়ে আমার মামলার দায়িত্ব নাকচ করে দিলাম। গ্রান্ডের সঙ্গে দেখা করে বললাম, আমার অনুপস্থিতিতে আমার ক্লার্ককে মামলা রুজু করতে বলে তিনি অন্যায় করেছেন। গ্রান্ড খুবই লজ্জিত ও দুঃখিত হলেন, অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চাইলেন, কিন্তু তবু আবার আমাকে অনুরোধ করলেন মামলার ভার নেবার জন্য। আমি তা প্রত্যাখ্যান করে চলে এলাম। তিনি বাধ্য হয়ে শেষে একজন অ্যাটর্নি নিযুক্ত করলেন।

এদিকে ফিলিপ ফ্রান্সিস আমার নোটিশ পেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তিনিও আমাকে অনুরোধ করলেন তাঁর মামলার দায়িত্ব নেবার জন্য। তাঁকেও আমি ‘না’ বলে দিলাম, এবং পরিষ্কার জানিয়ে দিলাম যে এ ব্যাপারে কারও পক্ষ সমর্থন করতে আমি রাজি নই।

যথাসময়ে মামলার বিচার আরম্ভ হল আদালতে। সাক্ষীসাবুদ ও অন্যান্য প্রমাণ থেকে ফ্রান্সিসের একটি আচরণই অত্যন্ত গর্হিত বলে মনে হল। তিনি নামি গ্রান্ডের অনুপস্থিতিকালে প্রায়ই লুকিয়ে ছদ্মবেশে শ্রীমতী গ্রান্ডের কাছে যেতেন। যদি সাধারণভাবে যেতেন, তাহলেও হয়তো বলবার কিছু থাকত না। কিন্তু প্রাচীর ঘেরা বাড়ির ফটকও বন্ধ থাকত বলে, তিনি রাত্রিবেলা একখানি মই কাঁধে করে, কালো পোশাক পরে, চুপিসারে যেতেন, এবং প্রাচীর টপকে বাড়িতে ঢুকে শ্রীমতী গ্রান্ডের ঘর পর্যন্ত হাজির হতেন। গ্রান্ডের ভৃত্যরা তাঁকে একাধিক রাত্রে শ্রীমতী গ্রান্ডের শয়নকক্ষ থেকে বেরোতে দেখেছে। ফ্রান্সিসের পক্ষে তাঁর আত্মীয় টিলঘম্যান আদালতের বিচারকদের সামনে যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ তর্ক করলেন, এবং এই ধরনের অন্যান্য মামলার নজির দেখিয়ে ফ্রান্সিসের অপরাধ লঘু প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাতে বিশেষ কিছু ফল হল না।

বিচারের দিন দেখা গেল যে বিচারকদের মধ্যে ফ্রান্সিসের অবৈধ প্রেমের অপরাধের গুরুত্ব সম্বন্ধে মতভেদ আছে। জুনিয়র জর্জ হিসেবে জাস্টিস হাইড প্রথমে রায় দেন। তিনি বলেন, ঘটনাটি বাইরে থেকে যত লঘুই মনে হোক, তিনি মনে করেন ফ্রান্সিস অপরাধ করেছেন, সেজন্য তাঁকে দণ্ড দেওয়া উচিত। হাইডের পরে বলেন সার রবার্ট চেম্বার্স। তিনি আইনের পাণ্ডিত্য দেখিয়ে বলেন যে ফ্রান্সিস—মিসেস গ্রান্ডের অবৈধ প্রেম আইনের চোখে দণ্ডনীয় অপরাধ নয়। অবশেষে চিফ জাস্টিস সার এলিজা ইম্পে রায় দেন। চেম্বার্সের আইনের পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে তিনি বলেন যে তার অধিকাংশ বর্তমান ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক। এই অপরাধ বিচারের জন্য সার রবার্টের মতন আইন—বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্যের বিশেষ প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন না। জাস্টিস হাইডের সঙ্গে তিনিও একমত, এবং ফ্রান্সিসের দণ্ড পাওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন। তাঁর দণ্ড হল, পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা। হাইড সেই সময় ইম্পের কানে কানে বলে দিলেন, ‘বলুন, সিক্কা টাকা।’ ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সিক্কা টাকা,’ ইম্পে বললেন। আদালতকক্ষের শ্রোতারা সকলে হেসে উঠলেন।

বিচারের সাত দিনের মধ্যে টিলঘম্যান ইংলন্ডে আপিল করবার জন্য আদালতে এসে তাঁর বক্তব্য পেশ করলেন। সার রবার্ট যেসব আইনের উত্থাপন করেছিলেন, টিলঘম্যানও তা—ই করলেন। চিফ জাস্টিস মন্তব্য করলেন, ‘এ যুক্তি তো আগেই সার রবার্টের কাছ থেকে শুনেছি।’ এই সময় ফ্রান্সিসের কাছ থেকে তিন লাইন লেখা এক টুকরো কাগজ এল টিলঘম্যানের কাছে। আমি আদালতে তাঁর পাশে বসে থাকলেও, তাতে কী লেখা ছিল, দেখতে পেলাম না। দেখলাম, আপিলের আবেদন আর পেশ করা হল না। পরেও আর কোনোদিন হয়নি। জানা গেল, গ্রান্ড নাকি জরিমানাটা আধাআধিতে রফা করে ব্যাপারটা ফ্রান্সিসের সঙ্গে আপসে মিটিয়ে ফেলেছেন। কারণ এ দেশে যা হবার তা হল, আবার ইংলন্ডে যদি এই নিয়ে হইচই হয়; তাহলে গ্রান্ড আর স্বদেশে ফিরে গিয়ে মুখ দেখাতে পারবেন না। যা ঘটেছে তাতে কলঙ্ক ও লজ্জা তাঁর, প্রেমিক ফ্রান্সিসের নয়। সেইজন্যই তিনি ব্যাপারটা ফ্রান্সিসের সঙ্গে মিটিয়ে ফেললেন। ফ্রান্সিসও দেখলেন সুবর্ণসুযোগ, অতএব গররাজি হলেন না।

ফিলিপ ফ্রান্সিসের সেই রোমান্টিক প্রেমের ব্যাপার নিয়ে কলকাতার সাহেবসমাজে বেশ শোরগোল পড়ে গেল। ব্রেকফাস্টে, ডিনারে, ট্যাভার্নে কফি হাউসে, হোটেলে, বাড়িতে, পালকিতে ফিটনে, পাশাপাশি ঘোড়ার পিঠে বেড়াতে বেড়াতে, সর্বত্র সর্বদা ফ্রান্সিসের দুঃসাহসিক রোমান্স সকলের প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠল। ফুটন্ত ও আধফোটা কবিরা ঘটনাটি থেকে কাব্যিক প্রেরণা সঞ্চয় করে বেশ কিছু কবিতাও লিখে ফেললেন। তার মধ্যে একটি কবিতা এই :

Psha! What a Fuss, twixt SHEE and ‘twixt her!

What abuse of a dear little creature,

A GRAND and a mighty affair to be sure,

Just to give a light PHILIP (fillip) to nature.

How can you, ye prudes, blame a luscious young wench,

Who so fond is of Love and romances.

Whose customs and manners are tout a fait French,

For admiring whatever from FRANCE-IS.

.

ফ্রান্স, ফ্রান্সিস ও গ্রান্ডের তরুণী ফরাসি পত্নীকে নিয়ে কবিরা এরকম অনেক কৌতুক কাব্য রচনা করেছিলেন। কিন্তু ফ্রান্সবাহিনীর রোমান্সের নটেগাছটি কলকাতা শহরে ফ্রান্স—ইসের কেলেঙ্কারিতে শুকিয়ে গেল না। ফরাসি প্রেমের বীজ আবার ফরাসি দেশের মাটিতে অঙ্কুরিত ও পল্লবিত হয়ে উঠল। মনের দুঃখে শ্রীমতী গ্রান্ড কলকাতা শহর ছেড়ে প্যারিসে চলে গেলেন। সেখানে প্রসিদ্ধ তালিবান্দ তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়লেন, এবং বিবাহও করে ফেললেন। ফিলিপ ফ্রান্সিসের রোমান্টিক প্রেমকথার শেষ হল ফ্রান্সে।

৩. হিকির স্মৃতিকথা

গ্রীষ্মকালে মার্চ মাসের পর আদালতের ছুটি মিলল কিছুদিন। এক বন্ধুর সঙ্গে কলকাতার আশপাশে বেড়াতে বেরুলাম। একটি ফিটন করে প্রথমে গেলাম ব্যারাকপুর—কলকাতা থেকে মাত্র মাইল পনেরো দূরে। ব্যারাকপুরে সিপাইরা থাকে এবং প্রত্যেক মাসের পয়লা তারিখে সিপাইদের একটি ব্যাটেলিয়ান সেখান থেকে ফোর্ট উইলিয়ামে যায় ‘ডিউটি’ দেবার জন্য। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা ব্যারাকপুরে থেকে আমরা পলতায় গেলাম জন প্রিন্সেপের কাছে, তাঁর কাপড় ছাপানো কারখানা দেখতে। তিনি আমাদের যথেষ্ট আদর—অভ্যর্থনা করলেন, এবং আমরা দু’দিন বেশ আরামে সেখানে কাটিয়ে দিলাম। পলতা থেকে আমরা চন্দননগর গেলাম ফরাসি গবর্নরের বাড়ি। তাঁর বাড়িতে অবশ্য তিনি থাকতেন না, মঁশিয়ে শেভিলার্ড নামে একজন সম্ভ্রান্ত ফরাসি ভদ্রলোক থাকতেন। তিনিও আমাদের বেশ রাজকীয় স্টাইলে আপ্যায়ন করলেন। চন্দননগর থেকে গেলাম চুঁচুড়ায়, বাংলা দেশের ডাচ উপনিবেশে। তখন গবর্নর ছিলেন মিঃ রোজ। হল্যান্ডে জন্ম হলেও, তাঁর পিতা ছিলেন স্কচম্যান। ডাচ গবর্নরও ঠিক নবাবের মতন বাস করতেন চুঁচুড়ায়। মধ্যে মধ্যে তাঁর কাউন্সিলের সদস্যদের সভা বসত তাঁর বাড়িতে এবং সভার শেষে কেউ তাঁর দিকে পিছন ফিরে যেতে পারত না। অর্থাৎ ফিরে যাবার সময় তাঁদের এক—পা এক—পা করে পিছিয়ে যেতে হত। যাবার সময় তাঁরা মাথা হেঁট করে হাত তুলে সেলাম করতে করতে যেতেন। আমরা যেদিন তাঁর বাড়িতে পৌঁছলাম, সেদিন দেখলাম তাঁর বাড়ির বিশাল একটি হলঘরে প্রকাণ্ড একটি টেবিল পাতা, এবং তার উপর প্রায় পঞ্চাশটি কভার বিছানো। বুঝলাম এটি ভোজের আয়োজন ছাড়া কিছু নয়। ভোজের সময় হল যখন, তখন হলঘরের পিছনের একটি দরজা হঠাৎ খুলে গেল, এবং সকলের সামনে আবির্ভাব হল গবর্নর রোজের। সঙ্গে সঙ্গে সাময়িক কায়দায় ব্যান্ড বেজে উঠল, এবং খাওয়া শেষ না—হওয়া পর্যন্ত বাজনা চলতে থাকল, থামল না। সন্ধ্যার সময় আমরা ফোর্ট ও পাবলিক বিল্ডিং সব ঘুরে ঘুরে দেখলাম। তিন দিন মহানন্দে চুঁচুড়ায় কাটিয়ে আমরা আবার পলতায় গেলাম প্রিন্সেপের কাছে, এবং সেখানে আরও তিন দিন কাটিয়ে কলকাতায় ফিরে এলাম।

‘ক্যা চ ক্লা ব’-এ র ক থা

কলকাতায় ফিরে এসে আমি একটি ক্লাবের সভ্য হলাম, তার নাম ‘ক্যাচ ক্লাব’ (Catch Club)। এরকম একটি চমৎকার ক্লাবের সভ্য আর কখনও আমি হয়েছি বলে মনে পড়ে না। ক্লাবটি মহিলাদের কাছে মোটেই পছন্দসই ছিল না, এবং তাঁদের ঢুকতেও দেওয়া হত না ক্লাবে। অর্থাৎ ক্লাবের সভ্য হবার অধিকার ছিল না মহিলাদের। কয়েকজন সুরশিল্পী ও সঙ্গীতরসিক মিলে এই ক্লাবটি গড়ে তোলেন। ‘হারমনিক’ নামে সুরজ্ঞদের একটি সভায় এই ক্লাব গঠনের সিদ্ধান্ত করা হয়। দেখা যায়, সেই সভায় যখন কোনো সঙ্গীত বা বাজনা হত, তখন কাঁচা বয়সের ছেলেমেয়েরা অনবরত বকবক করে কথা বলে তার রসভঙ্গ করে দিত। সুতরাং বিজ্ঞ ও বিশুদ্ধ রসিকরা মনস্থ করলেন যে তাঁরা একটি আলাদা সুরসভা করবেন, এবং তাতে বেরসিকদের প্রবেশাধিকার থাকবে না। এই সভারই আমি সভ্য হলাম। আমি অবশ্য পুরনো হারমনিকেরও সভ্য ছিলাম, কিন্তু নতুন স্থাপিত হবার পর হারমনিক ক্রমে একটি নাচসভায় পরিণত হল, এবং তার খ্যাতি কমে গেল অনেক। তরুণী মেয়েরা বিদ্রুপ করে নতুন ক্লাবকে বলত ‘He Harmonic’, অর্থাৎ পুরুষ হারমনিক। নতুন ক্লাবের উদ্বোধন হল বিখ্যাত একটি কনসার্টের মহড়া দিয়ে। কলকাতা শহরের খ্যাতনামা শিল্পীরা সকলে প্রায় এই মহড়ায় উপস্থিত ছিলেন। সন্ধ্যা সাতটায় আরম্ভ হয়ে, কনসার্ট শেষ হল রাত ন’টায়। দশটায় আমরা ‘সাপার’ খেতে বসলাম। তারপর আরম্ভ হল ভাল ভাল ‘catch’, ‘glee’ ও একক—সঙ্গীত। লর্ড স্যান্ডউইচের বিখ্যাত ‘ক্যাচ ক্লাব’—এর সভ্য মিঃ পটেল থেকে আরম্ভ করে গোল্ডিং, হেইনস, প্লেডেল প্রমুখ নামজাদা গায়করা একে একে গাইলেন এবং ক্লাবের সভ্যরা পর্যায়ক্রমে সভাপতিত্ব করলেন। অবশেষে আমারও ডাক পড়ল, এবং আমি সভাপতির চেয়ারে বসেই কয়েক কেতলি শ্যাম্পেনের অর্ডার দিলাম। সভাস্থ সকলে আমার প্রস্তাব শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বাহবা দিতে লাগলেন। প্ল্যাডেল নিজে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন যে এই অমূল্য প্রস্তাবের জন্য স্বর্ণাক্ষরে আমার নাম খোদাই করে রাখা উচিত।

গানবাজনার মজলিশে রাতভোর হয়ে গিয়ে সূর্য উঠে গেল। মাত্রাটা একটু বেশি হয়ে গেল বলে সেইদিনই ঠিক করা হল যে দুটো বাজলেই এবার থেকে শ্যাম্পেনের অর্ডার দেওয়া হবে। ক্লাবের সভ্যসংখ্যা পঁচিশজনের বেশি হবে না বলে স্থির করা হয়েছিল, কিন্তু ‘ক্যাচ ক্লাব’ শেষ পর্যন্ত এত জনপ্রিয় হয়েছিল, যে একটি সভ্যপদ খালি হলে তার জন্য অন্তত পঞ্চাশজন আবেদন করতেন।

.

প থে র দু র্ঘ ট না

বাংলা দেশে তখন যাঁরা থাকতেন তাঁরা প্রায় জলের মতন মদ্যপান করতেন, এবং নানা রকমের ভোজসভায় কেবল নেমন্তন্ন খেয়ে বেড়াতেন। সামাজিকতার ব্যাপারে আমি বিশেষ অনুরাগী ছিলাম, এবং সেইজন্য কলকাতা শহরে অল্পদিনের মধ্যে ‘best host’ বলে আমি সকলের কাছে পরিচিত হলাম। বেলা একটায় সাধারণত তখন ডিনার খাওয়া হত, এবং খাওয়াদাওয়ার পর সন্ধ্যার আগে গাড়ি করে হাওয়া খেতে বেরুনো হত ঘোড়দৌড়ের মাঠের দিকে। সেখানে গাড়ি থেকে নেমে বেড়াতে বেড়াতে সকলে কিছুক্ষণ গল্পগুজবও করতেন।

একবার আমি একটি বেশ বড় ডিনার—পার্টি দিয়েছিলাম। ক্যাপ্টেন হেফারম্যান নামে একজন আইরিশ ভদ্রলোক ভোজসভায় নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন এমনিতে খুব চমৎকার লোক, তবে একটু ল্যাদলেদে স্বভাবের। অতিথিদের সকলকে আমি আকণ্ঠ মদ্যপান করালাম। সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে সকলেই চিৎ হয়ে পড়লেন, হেফারম্যান ছাড়া। কিন্তু তিনি আর একফোঁটাও পান করতে চাইলেন না। আমি তাঁকে বললাম, ‘চলুন একটু বাইরে থেকে হাওয়া খেয়ে ঘুরে আসি, তাহলেই শরীর ও মেজাজ দুইই ঠিক হয়ে যাবে।’ আমার প্রস্তাবে তিনি রাজি হলেন, এবং আমরা দু’জনে ফিটনে করে বেরিয়ে পড়লাম।

যত জোরে একজোড়া ঘোড়া দৌড়তে পারে, তত জোরে আমার ফিটনও ছুটতে লাগল। আধ ঘণ্টার মধ্যেই সন্ধ্যার অন্ধকারে চারদিক ঢেকে গেল। কি বা আলো, কোনো কিছুরই চেতনা তখন আমার ছিল না। কণ্ঠ তো বটেই, মাথা পর্যন্ত তখন আমার ক্ল্যারেটে আচ্ছন্ন, রীতিমতো ভোঁ ভোঁ করছে। ঘোড়া কোনদিকে ছুটছে, তার দিকনির্ণয় করাও তখন দুঃসাধ্য। সঙ্গী হেফারম্যান গাড়ির মধ্যে দু’চারবার প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমরা কি ঠিক রাস্তায় চলেছি? আমার তো তা মনে হয় না।’ আমি তাঁর কাছে স্বীকার করলাম যে সঠিক রাস্তার খবর আমি জানি না। এ কথা বলতে—না বলতেই ঘোড়া দু’টি পিফনসহ আমাদের নিয়ে বিরাট একটি গর্তের মধ্যে হুড়মুড় করে পড়ল। গর্তটি প্রায় বারো—চোদ্দো ফুট গভীর এবং বারো মাসের মধ্যে আট মাস জলে ভর্তি থাকে। কিন্তু আমাদের পতনকালে, ভাগ্য ভাল বলেই গর্তটি শুকনো ছিল। স্বর্গ থেকে নরকে পড়লেও বোধহয় মানুষ এরকম হতভম্ব হয়ে যায় না। আমরা অবাক না হতে হতে প্রায় অজ্ঞানই হয়ে গেলাম, এবং সম্বিৎহারা হয়ে যেন একটা অন্ধকার কবরের মধ্যে হাঁটুমুখ গুঁজে পড়ে রইলাম। জ্ঞান যখন ফিরে এল তখন দেখলাম, আমার আইরিশ বন্ধুটি পুঁটলি পাকিয়ে পাশে রয়েছেন, এবং হাত বাড়িয়ে অন্ধকারে কী যেন হাতড়াচ্ছেন। আমার মাথায় হাত ঠেকাতেই বললেন, ‘এই যে পেয়েছি, নিশ্চয় ঘোড়া নয়, হিকি সাহেবের মাথা।’ আমি বললাম, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, ‘এমন গাড্ডাতে ফেলেছেন যে আর উঠতে পারব বলে তো মনে হচ্ছে না। দয়া করে আমাকে গাড্ডা থেকে নির্গমনের পথ দেখিয়ে দিন?’

‘পথ তো নিশ্চয় দেখানো উচিত, কিন্তু উভয়েরই যে অবস্থা তাতে কে কাকে পথ দেখাবে বলুন?’ এই কথা বলে আমি কোনোরকমে মাটি হাঁচড়ে উপরে ঠেলে উঠলাম, এবং হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমার বন্ধুটিকেও উঠতে সাহায্য করলাম। দূরে দেখলাম একটি আলো জ্বলছে। বন্ধুটিকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করতে বলে আমি সেই আলো লক্ষ্য করে হাঁটতে আরম্ভ করলাম। ঘোড়া দু’টি সম্বন্ধে খোঁজ করাই আমার উদ্দেশ্য ছিল। ঊর্ধ্বশ্বাসে হনহন করে চলতে চলতে আবার ফের একটি গর্তের মধ্যে পড়লাম। পা মুচকে বেকায়দায় পড়াতে এবারে রীতিমতো আঘাত পেলাম—মনে হল যেন হাড়গোড় ভেঙে গেল। চোখের সামনে থেকে নিভে গেল, অন্ধকারে চেতনাও ক্রমে ডুবে যেতে লাগল। এরকম ঘোর সঙ্কটে কখনও পড়িনি। এমন সময় কয়েকজন এ দেশি গ্রাম্য লোক ওই স্থান দিয়ে যাচ্ছিল। তারা আমায় দেখতে পেয়ে দাঁড়াল, এবং গর্ত থেকে টেনে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইল। হাসপাতাল কাছেই ছিল, কাজেই অল্পক্ষণের মধ্যে পালকিতে করে সেখানে পৌঁছতে কোনো অসুবিধা হল না। লোকজনেরাই আমার জন্য পালকি ডেকে এনেছিল।

হাসপাতালে হেড—সার্জেনের ঘরে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল। আমি তাঁকে আদ্যোপান্ত ঘটনার বিবরণ দিলাম, এবং আমার সঙ্গীটিকে কী অবস্থায় রেখে এসেছি তা—ও তাঁকে জানালাম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তিনি লোকজন পাঠিয়ে আমার ঘোড়া দু’টি, গাড়ি ও বন্ধুটিকে খুঁজে নিয়ে এলেন। ঘোড়া দু’টি অক্ষত অবস্থায় বেঁচে রয়েছে দেখে আমার খুবই আনন্দ হল। হেফারম্যানও দেখলাম বিশেষ আঘাত পাননি, হাঁটুতে সামান্য চোট লেগেছে মাত্র। আমারই অবস্থা হয়েছে সবচেয়ে কাহিল, বিশেষ করে দ্বিতীয়বার গর্তে পড়ার পর। আমার অবস্থা সব দেখে—শুনে আইরিশ বন্ধুটি গম্ভীরভাবে বললেন যে ভবিষ্যতে আর কোনোদিন তিনি মাতাল গাড়োয়ানের গাড়িতে চড়ে বেড়াতে বেরুবেন না।

লে ডি ই ম্পে র না চ স ভা

কয়েকদিনের মধ্যে চিফ জাস্টিসের বাড়িতে একটি নাচসভায় নেমন্তন্ন হল। লেডি ইম্পেই এই সভার আয়োজন করেছিলেন। নাচসভায় কলকাতা শহরের গণমান্য সাহেবসুবোদের মধ্যে প্রায় সকলেই উপস্থিত ছিলেন। খাবার সময়ে আমি জাস্টিস হাইডের সঙ্গে এক টেবিলে বসেছিলাম। আমাদের পাশে একদল তরুণ ছোকরা খেতে বসেছিল। জাস্টিস হাইড যেমন খেতে ভালবাসতেন, তেমনি খেতেও পারতেন। তাঁর খাওয়া দেখে একজন তরুণ ছোকরা মন্তব্য করল, ‘জজসাহেব যেরকম গোগ্রাসে মুরগি খাচ্ছেন, তাতে মনে হয় তিনি তাঁর স্ত্রীর চেয়ে টার্কি মুরগি ভালবাসেন বেশি।’ কথাটা বেশ স্পষ্টই হাইডের কানে গেল। তিনি মুরগির ঠ্যাং চিবুতে চিবুতে ছোকরার দিকে মুখ তুলে বললেন, ‘তা ঠিক নয় হে ছোকরা, তা ঠিক নয়।’ হাইড শুনতে পেয়েছেন দেখে ছেলেটি লজ্জায় চেয়ার ছেড়ে দূরে চলে গেল।

সপ্তাহে প্রায় একদিন করে আমি জাস্টিস হাইডের বাড়ি যেতাম সঙ্গীতসভায় যোগ দিতে। লেডি হাইড সঙ্গীতের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন, এবং সুগায়িকা বলে তাঁর নিজেরও যথেষ্ট খ্যাতি ছিল।

অ হং কা রী ক মো ডো র

আমি যখন বাংলা দেশে এলাম তখন ফরাসিদের সঙ্গে ইংরেজদের লড়াই চলেছে পন্ডিচেরিতে, এবং একটি ব্রিটিশ নৌবহর ফরাসি উপনিবেশে অভিযান করবে ঠিক হয়েছে। কিন্তু ব্রিটিশ অ্যাডমিরালের অধীনে যে নৌবহর ছিল তা ফরাসিদের প্রতিদ্বন্দ্বী হবার যোগ্য নয়। বাংলা দেশে তাই খবর এল কিছু সাহায্য পাঠাবার জন্য। ওয়ারেন হেস্টিংস দু’খানি বাণিজ্যপোত সামরিক কায়দায় সাজিয়ে মাদ্রাজে পাঠাবেন স্থির করলেন। জাহাজে দু’খানির ভার দেওয়া হল জোসেফ প্রাইস নামে এক ভদ্রলোকের উপর। ভদ্রলোক একসময় নৌবিভাগে ছিলেন বটে, কিন্তু পরে তা ছেড়ে দিয়ে হেস্টিংসের কৃপাশ্রয়ে ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। তাঁর উপর জাহাজের ভার দিয়ে ‘কমোডোর’ উপাধি দেওয়া হল এবং ‘রেজোলিউশন’ নামে একটি জাহাজে একজন ক্যাপ্টেনও দেওয়া হল তাঁর অধীনে।

.

অনেকদিন থেকে হেস্টিংসের ইচ্ছা ছিল বোম্বাইয়ের মতন কলকাতাতেও নৌবিভাগের একটি ঘাঁটি স্থাপন করা। এই সুযোগে তিনি তাঁর কাউন্সিলে প্রস্তাবটি উত্থাপন করলেন। প্রস্তাবটি গৃহীত হল। কোম্পানির নিজের জাহাজ ‘ব্রিটানিয়া’ ও ‘ন্যান্সি’ রণপোতে পরিণত করে কলকাতার শেরিফ রিচার্ডসনের উপর পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হল, এবং তাঁকেও করা হল ‘কমোডোর’। রিচার্ডসন সগৌরবে তাঁর জাহাজে মর্যাদার নিশান উড়িয়ে দিলেন। ওদিকে প্রাইসও তাঁর জাহাজে ‘কমোডোর’ হয়ে একই নিশান উড়িয়েছিলেন। কার এই নিশান ওড়াবার অধিকার আছে তা—ই নিয়ে দুই দৈবাৎ কমোডোরের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূচনা হল। ব্যাপারটা হেস্টিংসের কানে পৌঁছল, এবং তিনি রীতিমতো বিরক্ত হয়ে দু’জনকেই ডেকে পাঠালেন। দু’জনে কাছে আসতে তাঁদের তিনি বেশ ধমক দিয়ে বললেন, ‘ছেলেপিলেরা যেমন খেলনা নিয়ে ঝগড়া করে, আপনারা দু’জনেও তেমনই নিশান নিয়ে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছেন। যদি এখনও এই ঝগড়ার শেষ না হয়, তাহলে আপনাদের খেলনা কেড়ে নিয়ে জাহাজ ছেড়ে চলে যেতে বলতে আমি বাধ্য হব। ভবিষ্যতে আর কোনো দায়িত্বপূর্ণ কাজের ভার আপনাদের দেওয়া হবে না।’

হেস্টিংসের কথায় কাজ হল। দুই কমোডোরের নিশানই সমান মর্যাদায় হাওয়ায় উড়তে লাগল। রিচার্ডসন অবশ্য খুব বেশি মাথা হেঁট করেননি। ‘ন্যান্সি’ জাহাজখানির ভার দেওয়া হল আমার আইরিশ বন্ধু হেফারম্যানের উপর। ১৭৭৮, এপ্রিলের মাঝামাঝি কমোডোর প্রাইস মাদ্রাজ যাত্রা করলেন তাঁর জাহাজ নিয়ে: রিচার্ডসন যাত্রা করার আগে বিরাট এক ভোজের আয়োজন করলেন তাঁর জাহাজে। এরকম ভোজ কলকাতা শহরে উঁচু মহলেও সাধারণত হয় না। শহরের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা সকলেই প্রায় নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন।

ব্রিটানিয়া জাহাজখানিকে অনেক টাকা খরচ করে অত্যন্ত চমৎকারভাবে সাজানো হয়েছিল। কোনোদিক থেকে আয়োজনের ত্রুটি হয়নি কিছু। কেবল একটিমাত্র ত্রুটি ছিল এই যে ডক থেকে জাহাজে উঠবার কোনো নির্দিষ্ট ল্যাডার কিছু তখন ছিল না। নিয়ন্ত্রিত মহিলাদের তাই বাধ্য হয়ে চেয়ারে বসিয়ে তুলে নিয়ে যেতে হত। কলকাতায় মিসেস উড কোম্পানির এক বিশিষ্ট কর্মচারীর বিখ্যাত স্ত্রী ছিলেন। স্ত্রী হিসেবে তিনি বিখ্যাত ছিলেন তাঁর বিরাট বপুর জন্য। তাঁর মতন স্থূলকায় মহিলা তখন কলকাতায় আর কেউ ছিলেন কি না সন্দেহ। ভোজের দিন মুশকিল হল, তাঁকে ডক থেকে জাহাজ পর্যন্ত পার করা নিয়ে। চারজন লোক যখন তাঁকে চেয়ারে বসিয়ে ঠেলে পার করবার চেষ্টা করল, তখন দেখা গেল যে দড়ি আর সরছে না। একটা গণ্ডগোল শুরু হয়েছে দেখে উপরের কেবিন থেকে নাবিকেরা নিচের দিকে লক্ষ করে দেখল মিসেস উডের অবস্থা। তাঁর চেহারা দেখে সকলে একসঙ্গে হই—চই করে উঠে বলল, ‘এ মাল জাহাজে তোলা যাবে না, সকলে মিলে চেষ্টা করলেও না।’ অবশেষে অবশ্য মিসেস উডকে জাহাজে তোলা হল বটে, কিন্তু এমন হল্লা করে তোলা হল যে, ব্যাপারটা অনেকের কাছে খুব শোভন মনে হল না। গোড়াতেই শ্রীমতী উডকে নিয়ে একটা করুণ ও হাস্যকর অবস্থার সৃষ্টি হল। তাঁর স্বামী বেচারি অসম্ভব চেঁচামেচি করলেন, এবং বোঝা গেল বিরক্তও হলেন যথেষ্ট। কিন্তু শ্রীমতী একেবারে নির্বিকার রইলেন, এবং অপরাধীদের ক্ষমা করতেও তিনি কুণ্ঠিত হলেন না।

ভদ্রলোক ও মহিলা মিলিয়ে প্রায় দেড়শোজন সেদিন ভোজসভায় যোগ দিয়েছিলেন। খানাপিনার বেশ এলাহি ব্যবস্থা করেছিলেন কমোডোর সাহেব। খাবার সময় সামরিক বিভাগের বাদকেরা চমৎকার বাজনাও বাজিয়েছিল। সমস্ত জাহাজ ও ডক নানা রঙের রঙিন বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছিল। খাওয়াদাওয়ার পর নর্তকীদের নাচ শুরু হল নৃত্যমঞ্চে। একদিকে নাচ চলতে লাগল, আর—একদিকে চলতে লাগল মদ্যপান। উর্বশীদের সভায় যাঁরা গেলেন না, তাঁরা সুরাদেবতা ব্যাকাসের সাধনায় মশগুল হয়ে রইলেন। অনর্গল ধারায় তাঁদের কণ্ঠনালি দিয়ে শ্যাম্পেন ও ক্ল্যারেট বয়ে যেতে লাগল। বরফে ঠান্ডা করা পানীয়ের আস্বাদই আলাদা বলে সকলে আকণ্ঠ সুরাপান করলেন। রাত্রি একটার সময় যথারীতি ‘সাপার’ খেতে দেওয়া হল এবং সকলেই তা বেশ সাগ্রহেই খেলেন। তারপর গায়ক—গায়িকারা আরম্ভ করলেন সুললিত কণ্ঠে গান। গানের রেশ শেষ হতে—না হতে সুন্দরী নর্তকীরা আবার উঠলেন নাচের জন্য। সকাল ছ’টা পর্যন্ত তাঁদের নাচ চলল। ক্লান্তিতে সকলে তখন একেবারে অবসন্ন হয়ে পড়লেন। এবারে যে যার উঠে গৃহাভিমুখে যাত্রা করলেন।

সাং বা দি ক হি কি

কলকাতায় কয়েকদিন থাকার পর আমি সাংবাদিক হিকির কাছ থেকে একখানি অপ্রত্যাশিত চিঠি পেলাম। তখন তিনি ঋণের দায়ে জেলখানায় বন্দি হয়ে আছেন। চিঠি লিখে আমাকে অনুরোধ করেছেন তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করার জন্য। একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, এবং সাক্ষাৎ পরিচয়ের পর তাঁকে রীতিমতো মাথাপাগলা লোক বলে মনে হল। তাঁর একটা স্বাভাবিক প্রতিভা ছিল বটে, কিন্তু শিক্ষাদীক্ষা বিশেষ কিছু ছিল বলে মনে হল না। আচার—ব্যবহারে তাঁকে বদ্ধপাগল বললে ভুল হয় না। তাঁর পাগলামির জন্য তাঁকে আমি ‘খ্যাপা আইরিশম্যান’ বলে ডাকতাম। যেদিন তাঁর সঙ্গে জেলখানায় সাক্ষাৎ হল সেদিন তিনি অনেকক্ষণ ধরে তাঁর কারাজীবনের চরম দুর্দশার কথা আমাকে বললেন। তাঁর এই দুর্ভোগের জন্য কয়েকজন কুচক্রী বাঙালিই যে দায়ী, সে কথাও তিনি আমাকে জানাতে ভুললেন না। বুঝলাম, বাঙালি মহাজন বা বেনিয়ানদের কাছে ঋণের দায়ে তিনি প্রায় দু’বছরের উপর জেল খাটছেন। হিকি অবশ্য ঋণের কথা অস্বীকার করলেন এবং বললেন যে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করে তাঁকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তাঁর সঙ্গে একাধিকবার আমি জেলখানায় দেখা করতে গিয়েছিলাম, এবং তিনি আমাকে যেসব কাগজ দেখিয়েছিলেন তাতে তাঁর কথা বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হল। বেচারির দুরবস্থা দেখে দুঃখও হল এবং আদালতে তাঁর মামলা তদারক করব বলে আমি তাঁকে কথা দিয়ে ফেললাম।

জেমস হিকি যে মাথাপাগলা লোক, তা আগেই বলেছি। লোকজনের কাছে খোঁজ করতে তাঁরাও ওই কথা বললেন। আদালতে মামলা উঠলে একটুতেই তিনি নাকি খেপে যান এবং নিজের অ্যাটর্নি—উকিলদের যা—তা বলে গালিগালাজ করেন। সেজন্য তাঁর মামলা করতে কেউ রাজি হল না। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই চিন্তার বিষয় হল বটে, কিন্তু তাঁর অবস্থা দেখে সত্যিই করুণা হল, রাজি না হয়ে পারলাম না। তবু তাঁকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলাম যে মামলার ভার যতক্ষণ আমার উপর থাকবে, ততক্ষণ হাজার ভুলচুক ও অন্যায় হলেও, সে সম্বন্ধে একটি কথাও তিনি বলতে পারবেন না। এই ধরনের কোনো বেয়াদবি আমি সহ্য করতে পারব না। আমার কথায় যখন তিনি রাজি হলেন, তখন তাঁর মামলার কাগজপত্র আমি চেয়ে নিলাম।

কাগজপত্র বুঝে নিয়ে টিলঘম্যান ও মসকে অনুরোধ করলাম হিকির পক্ষে দাঁড়াবার জন্য। মামলার শুনানির দিন হেবিয়াস কর্পাসের সাহায্যে তাঁকে জেলখানা থেকে আদালতে নিয়ে আসা হল। টিলঘম্যান যখন একজন সাক্ষীকে জেরা করতে আরম্ভ করলেন, তার কিছুক্ষণের মধ্যেই হিকি সাহেবের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। তিনি আর মুখ বুজে থাকতে পারলেন না, প্রতিশ্রুতির কথাও ভুলে গেলেন। হঠাৎ হাত—পা ছুড়ে উন্মাদের মতন চিৎকার করে বললেন টিলঘম্যানের দিকে আঙুল দেখিয়ে, ‘সার, উনি কিছুই জানেন না সার! এ দেশের আদালতে ওকালতি করছেন বটে, কিন্তু নেটিব বাঙালিদের কীভাবে জেরা করে কথা বার করতে হয় তা তিনি এখনও শেখেননি। হুজুর যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি নিজেই সাক্ষীকে জেরা করতে পারি।’

হিকির এই ব্যবহারে টিলঘম্যান তৎক্ষণাৎ মামলার কাগজপত্রও ফেলে দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন, এবং এই অপমানের জন্য আমার উপরেই দোষারোপ করলেন। করাই স্বাভাবিক, কারণ আমি তাঁকে কথা দিয়েছিলাম যে আদালতে হিকি কোনো অশোভন ব্যবহার করবেন না। এইভাবে আমাকে অপদস্থ করা হল বলে আমি হিকিকে ডেকে এনে মিথ্যাবাদী, ভবঘুরে, কুলাঙ্গার ইত্যাদি বলে খুব গালমন্দ করলাম। সঙ্গে সঙ্গে বেচারি একেবারে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে আমার পা জড়িয়ে ধরলেন, এবং তাঁর অন্যায় ব্যবহারের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। কেবল আমার কাছে নয়, চিফ জাস্টিসের কাছেও। তাঁর কাছে তিনি হাতজোড় করে বললেন যে আর কখনও তিনি আদালতের মধ্যে এরকম ব্যবহার করবেন না। যাতে আমি তাঁর অপরাধ ক্ষমা করে আবার মামলার ভার নিই, সেজন্য আমাকে অনুরোধ করতে তিনি জজসাহেবের কাছে আবেদন করলেন। আমি শেষ পর্যন্ত রাগ করতে পারলাম না, আবার তাঁর মামলার ভার নিলাম। অবশেষে মামলাতে আমাদেরই জিত হল, বিশ হাজার টাকা মিথ্যা ঋণের দায় থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে হিকি কারামুক্ত হলেন।

মুক্তি পাবার দু’দিনের মধ্যেই আবার একজন তাঁর বিরুদ্ধে কোর্টে নালিশ করলেন। এবারেও শুনানির সময় তিনি আদালতগৃহের মধ্যেই সাক্ষীকে অশ্রাব্য ভাষায় চিৎকার করে গালাগালি করলেন—চোর—জোচ্চোর—পাষণ্ড—নরাধম ইত্যাদি। ঘন ঘন বুক চাপড়ে তিনি ভগবান যিশুকে ডেকে বলতে লাগলেন, ‘হায় যিশু! কেন আমায় শঠ ও প্রবঞ্চকদের খপ্পরে ফেলে এইভাবে নাজেহাল করছ।’ যা—ই হোক, এই দ্বিতীয় মামলাতেও আমাদের জিত হল, হিকি সমস্ত ঋণের দায় থেকে একেবারে মুক্ত হলেন।

.

হি কি র প্র থ ম প্রে স ও সং বা দ প ত্র

আমার সঙ্গে যখন হিকির প্রথম সাক্ষাৎ হল তার প্রায় সাত বছর আগে তিনি এ দেশে আসেন। জেলখানায় বন্দি হয়ে থাকার সময় একটি কারণে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তিনি প্রিন্টিং সম্বন্ধে এই সময় একখানি বই হাতে পান, এবং বইখানি পড়ে তাঁর মনে প্রিন্টার হবার বাসনা জাগে। আমি যত দূর জানি, কলকাতা শহরে তখন ছাপাখানা বলে বিশেষ কিছু ছিল না। অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে বইখানি পড়ে হিকি ছাপার ‘অক্ষর’ সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ জ্ঞান সঞ্চয় করেন, এবং অনেকদিন ধৈর্য ধরে অসাধারণ পরিশ্রম করে তিনি এক সেট ছাপার হরফ তৈরি করেন। তাঁর এই ছাপার হরফ দিয়ে বিজ্ঞাপন ও হ্যান্ডবিল ছাপার কাজ মোটামুটি চলে যেত। যথেষ্ট সুলভ হারে তিনি এইসব কাজ করতে পারতেন বলে তাঁর ছাপাখানার ব্যবসা অল্পদিনের মধ্যেই বেশ জমে গেল। ব্যবসা থেকে কিছুদিনের মধ্যে সামান্য কয়েকশো টাকা জমিয়ে তিনি ইংলন্ডে পাঠিয়ে দিলেন, পুরো এক সেট ছাপাখানার যন্ত্রপাতি টাইপ ইত্যাদি আনার জন্য। তার সঙ্গে কিছু ওষুধপত্তরেরও অর্ডার দিলেন ডাক্তারি করার উদ্দেশ্যে। প্রিন্টার ও ডাক্তার দুইই হবার ইচ্ছা হল তাঁর।

ইংলন্ডে ছাপাখানার অর্ডার দিয়ে মনে মনে তিনি আর—একটি পরিকল্পনা করে বসলেন। তাঁর ইচ্ছা হল, কলকাতা থেকে একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করবেন। তখন কোনো সংবাদপত্র শহরে ছিল বলে আমি জানি না। বিলেত থেকে টাইপপত্র এসে পৌঁছতে তিনি একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করবেন বলে বন্ধুবান্ধবদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। সকলেই তাঁর পরিকল্পনার কথা শুনে খুশি হয়ে তাঁকে যথেষ্ট উৎসাহ দিলেন। উৎসাহ পেয়ে হিকি যথাসময়ে তাঁর পত্রিকা প্রকাশ করলেন। পত্রিকার বিশেষত্ব ও নতুনত্বের জন্য অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর পাঠকসংখ্যাও বেশ জুটে গেল। শ্লেষ—বিদ্রুপ ও রঙ্গরসিকতাই ছিল পত্রিকার বিশেষত্ব, যদিও সেগুলি খুব উচ্চস্তরের নয়। তার আরও একটা বিশেষত্ব ছিল এই যে তিনি যে কোনো ব্যক্তির চরিত্র অনুযায়ী চমৎকার নামকরণ করতে পারতেন, এবং তাঁর সম্বন্ধে নানারকম কাহিনি রচনা করতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন।

কলকাতা শহরে তখন টিরেটা নামে এক ভদ্রলোক ছিলেন, তাঁর পেশা ছিল স্থাপত্য। তিনি ইটালিয়ান হলেও জীবনের অধিকাংশ সময় তাঁকে ফ্রান্স ও জার্মানিতে কাটাতে হয়। প্রায় কুড়ি বছর একটি ব্রিটিশ উপনিবেশে বাস করার পরেও তিনি তাই ইংরেজি ভাষা ভাল করে আয়ত্ত করতে পারেননি। কথা বলার সময় এমন একটা জগাখিচুড়ি ভাষায় তিনি কথা বলতেন, যা ইংরেজি ফরাসি পর্তুগিজ ও হিন্দুস্থানি না জানলে কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। দেখতে তিনি খুব সুপুরুষ ছিলেন, এবং সুন্দর মুখশ্রীর মধ্যে সবচেয়ে আগে নজরে পড়ত তাঁর দীর্ঘ তীক্ষ্ন উন্নত নাসিকাটি।

গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি উত্তাপ বাড়ে জুন মাসে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, জুন মাসের চার তারিখে রাজার জন্মদিন উপলক্ষে গবর্নরের নাচসভায় তিনি দামি ভেলভেটের স্যুট পরে সুসজ্জিত হয়ে প্রতি বছরেই যোগ দিতেন। একবার এই নাচসভার বিবরণ দিতে গিয়ে টিরেটা সম্বন্ধে হিকি তাঁর পত্রিকায় লেখেন : ‘Nosey Jargon danced his annual minuets, seasonably dressed in a full suit of crimson velvet.’ টিরেটা সম্বন্ধে এমন সুন্দর নামকরণ আগে কেউ করতে পারেননি। তারপর থেকে টিরেটা ‘Nosey Jargon’ নামে কলকাতার সাহেবসমাজে পরিচিত হয়ে যান। বিশিষ্ট নাকের জন্য ‘Nosey’ এবং পাঁচমিশালি ভাষার জন্য ‘Jargon’।

পত্রিকা চালিয়ে হিকি বেশ মোটা মুনাফা করতেন। যদি একটু মাথা ঠান্ডা করে তিনি পত্রিকাটি চালাতেন, তাহলে ব্যবসার দিক থেকে লাভবান তো হতেনই, নিজেও যথেষ্ট অর্থ রোজগার করতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি পারেননি, কারণ সমাজের সর্বশ্রেণির লোকের ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে পত্রিকায় কটু মন্তব্য করার ফলে তিনি অনেক মানহানির মামলার দায়ে পড়ে বহু টাকা খেসারত দিয়েছেন। তাঁর পত্রিকার ব্যাপারে একটা—না—একটা মামলা আদালতে লেগেই থাকত এবং সবই মানহানির মামলা। মানহানির দায়ে এইভাবে হিকি প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন, তবু তাঁর পত্রিকার এই আত্মঘাতী নীতি পরিহার করেননি।

গ্রীষ্মকালে ও বর্ষাকালে আমি প্রায় বজবজে আমার এক বন্ধুর কাছে বেড়াতে যেতাম। কলকাতা থেকে মাইল কুড়ি দূরে একটি সুন্দর জায়গায় নদীর তীরে তিনি থাকতেন এবং তাঁর সঙ্গে কয়েকদিন কাটিয়ে আমি সত্যিই খুব আনন্দ পেতাম। এইভাবে কলকাতার বিশিষ্ট সমাজে চলে—ফিরে পরমানন্দে আমার দিনগুলি কেটে যেতে লাগল। অ্যাটর্নির ব্যবসাও বেশ জমে উঠল, এবং দিন দিন মক্কেলের সংখ্যাও দ্রুত বাড়তে লাগল। সারা সকাল একটানা কাজ করে আমি তাল সামলাতে পারতাম না।

জু রি র বি চা রে র জ ন্য আ ন্দো ল ন

কলকাতা শহরের আদালতের বিচারকরা তখন ইংরেজই ছিলেন। কিন্তু তাঁদের বিচারে ইংরেজরাও সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। এ দেশের ‘নেটিব’দের মতন আদালতে তাঁদেরও অপরাধের বিচার করা হবে, ইংলিশম্যান ও ইন্ডিয়ানের মধ্যে মর্যাদার কোনো তারতম্য থাকবে না, এ কথা মেনে নিতে তাঁদের জাত্যভিমানে বাধল। যে ঘটনা থেকে ইংরেজদের মধ্যে এই আন্দোলনের সূত্রপাত হল, সেটি কিন্তু খুবই সামান্য একটি ঘটনা।

কর্নেল ওয়াটসনের দু’জন বাঙালি ছুতোর মিস্ত্রি একবার কিছু যন্ত্রপাতি ও জিনিসপত্র চুরি করে ধরা পড়ে। চিফ সুপারিন্টেন্ডেন্ট মিঃ ক্রেসির কাছে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। জাহাজের সঙ্গী হিসেবে ক্রেসির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল। ক্রেসি ওই দু’জন মিস্ত্রিকে হাত—পা বেঁধে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে বেত্রাঘাত করেন। কেবল বেত্রাঘাত করেই তাদের তিনি রেহাই দেননি, দু’দিন একটি গুদামঘরে বন্দিও করে রেখেছিলেন। ক্রেসির এই ব্যবহার নিশ্চয় আইনসঙ্গত হয়নি।

মিস্ত্রি দু’জন ছাড়া পাবার পরেই একজন অ্যাটর্নির কাছে যায়, ক্রেসির বিরুদ্ধে মামলা করা যায় কি না সেই বিষয়ে পরামর্শ করার জন্য। অ্যাটর্নি তাদের মামলা করতে পরামর্শ দেন, এবং তাদের নির্দেশে ক্রেসির কাছে অ্যাটর্নি চিঠি পাঠান। মিস্ত্রিদের অবৈধ ও অন্যায়ভাবে আটক ও বেত্রাঘাত করার জন্য ক্রেসির কাছে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়। তাঁকে এ কথাও চিঠিতে জানানো হয় যে ক্ষতিপূরণ না করলে তাঁকে আদালতে যথারীতি অভিযুক্ত করা হবে। ক্রেসি ছিলেন অত্যন্ত দাম্ভিক লোক। ‘নেটিব’দের সঙ্গে বিবাদের ব্যাপারে আপসের কথা তিনি ভাবতেই পারতেন না। এক্ষেত্রে সেই ‘নেটিব’ আবার মিস্ত্রিশ্রেণির লোক, কাজেই তাঁর আত্মাভিমানে আরও বেশি বাধল। তিনি অ্যাটর্নির চিঠি উপেক্ষা করলেন, এবং তার কোনো জবাব দেওয়ারই প্রয়োজন বোধ করলেন না। অবশেষে তাঁর বিরুদ্ধে দু’জন মিস্ত্রি আদালতে দুটি মামলা দায়ের করল, প্রত্যেকটি পাঁচ হাজার টাকা খেসারত দাবির মামলা।

মামলা শুরু হবার পর ওয়াটসনের বাড়িতে একদিন বৈঠক হল। অ্যাটর্নি অ্যাডভোকেট নিয়োগ করে ক্রেসির পক্ষে কীভাবে সমর্থন করা যায়, বৈঠকে তা—ই নিয়ে আলোচনা হল। ক্রেসি কিন্তু অন্যের ওকালতির ব্যাপারে রাজি হলেন না। তিনি বললেন, তাঁর পক্ষে তিনি নিজেই ওকালতি করবেন, এবং একজন ইংরেজ হিসেবে তিনি তাঁর স্বদেশের রীতি অনুযায়ী দাবি করবেন জুরির বিচার। আমি তাঁকে একজন আইনজ্ঞ হিসেব অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে, আমাদের পার্লামেন্টের আদেশেই এ দেশে আদালত স্থাপিত হয়েছে, এবং বিচারকরা নিযুক্ত হয়েছেন। দেওয়ানি মামলায় বিচারকরাই হলেন জুরি। কিন্তু কোনো কথায় কর্ণপাত করার মতন মানসিক অবস্থা তখন ক্রেসির ছিল না। তিনি বললেন যে তা হতে পারে না, এ প্রথা ব্রিটিশ কনস্টিটিউশন বিরোধী, তিনি প্রাণপণ করে এই অন্যায় রীতির বিরুদ্ধে লড়াই করবেন।

আদালতে মামলা শুরু হল, এবং ক্রেসি ঠিক করলেন তিনি নিজে আদালতে তাঁর পক্ষের বক্তব্য পেশ করবেন। মামলার দিন সকাল আটটার মধ্যে কোর্টে ভিড় জমে গেল। কলকাতার ব্রিটিশ বাসিন্দারা, সিবিল ও মিলিটারি, সকলেই প্রায় কোর্টে উপস্থিত হয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন অসুস্থতার জন্য চিফ জাস্টিস কোর্টে আসতে পারেননি। সেইজন্য মামলার শুনানি সেদিনকার মতন স্থগিত রাখা হল।

.

ম হ র মে র দা ঙ্গা

দিনটা ছিল মুসনমানদের মহরম উৎসবের দিন। মহরমের সময় সর্বশ্রেণির মুসলমানরা রাস্তায় শোভাযাত্রা করে বেরোয়, এবং ভাং (Bang) নামে এক রকমের ড্রাগ খেয়ে উন্মত্তের মতন আচরণ করতে থাকে। এরকম উচ্ছৃঙ্খল উন্মত্ততা আর কোনো সময় তাদের মধ্যে দেখা যায় না। শোনা যায়, সেই বছর নবাব সাদৎ আলি কলকাতায় এসেছিলেন, এবং সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে সেই কারণে মহরম উৎসবের উন্মত্ততা ওই বছরে অত্যধিক বেড়েছিল।

মামলার শুনানির দিনে জাস্টিস রবার্ট চেম্বার্স ও হাইড তাঁদের আসনে এসে বসেছেন, এবং কোর্টের কাজকর্ম শুরু করার তোড়জোড় চলছে, এমন সময় রাস্তায়, একেবারে আদালতগৃহের নিচে, বিরাট একটি জনতার হল্লা শোনা গেল। কাড়ানাকাড়ার প্রচণ্ড শব্দে কোর্টের কেউ কারও কথা শুনতে পাচ্ছিলেন না। জনতার হট্টগোল ও বাজনার শব্দে কোর্টের কাজকর্ম প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম হল। সার রবার্ট নিরুপায় হয়ে আদালতের কনস্টেবলদের হুকুম দিলেন নিচে রাস্তায় গিয়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে। হুকুম জারির কয়েক মিনিটের মধ্যেই রূপ নামে একজন বৃদ্ধ জার্মান কনস্টেবল চিৎকার করে দৌড়তে দৌড়তে নিচে থেকে উপরে ছুটে এল। এত ভয় পেয়েছে সে যে তার হাঁপানি আর থামে না। দেখা গেল যে তার মাথার পরচুলোটাও নেই। হাঁপানি একটু থামতে সে বলল যে, নিচে যখন সে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে গিয়েছিল তখন তারা তাকে ধরে বেদম প্রহার করেছে, এবং তার টুপি ও পরচুলো কেড়ে নিয়েছে। তার হাতে বিচারালয়ের ন্যায়ের প্রতীকস্বরূপ যে, ‘দণ্ডটি’ ছিল, জনতার ভিতর থেকে দু’জন ব্রিটিশ খালাসি এসে সেটি কেড়ে নিয়ে আনন্দে নাচতে নাচতে চলে গেছে।*

জার্মান কনস্টেবলের এই বিবরণ কোর্টের সাহেবরা উদগ্রীব হয়ে শুনলেন, এবং শুনে রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলেন।

জনতার হট্টগোল ক্রমেই খুব বাড়তে লাগল। কোর্টের আন্ডার—শেরিফকে আদেশ করা হল জনতাকে হটিয়ে দেবার জন্য। ততক্ষণে আরও কয়েক হাজার লোক এসে জনতার সঙ্গে যোগ দিয়েছে এবং তার চেহারাও হয়ে উঠেছে মারমুখী। দেখলে মনে হয়, যে কোনো সময় একটা দাঙ্গা বেধে যেতে পারে। আন্ডার—শেরিফ হ্যারি স্টার্ক তাঁর শান্তির দণ্ডটি নিয়ে জনতার সামনে উপস্থিত হওয়ামাত্রই তারা তাঁর দণ্ডটি কেড়ে নিয়ে ভেঙে দিল, এবং তাঁকে চ্যাংদোলা করে ধরে নিয়ে চলে গেল। নবাবের কয়েকজন ভৃত্য তাঁকে চিনত। ভিড়ের ভিতর থেকে দেখতে পেয়ে তারা তাঁকে উদ্ধার না করলে জনতার হাতে আন্ডার—শেরিফ হয়তো সেদিন মারা পড়তেন।

দেখতে দেখতে জনতা যেন একেবারে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। কোর্টের সামনে যেসব বেয়ারা ও হরকরা দাঁড়িয়ে ছিল তাদের উপর হামলা করল জনতা। চারদিকে যত পালকি ছিল, সেগুলিকেও তারা ভাঙতে আরম্ভ করল। একদল আদালতগৃহ লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে লাগল। কাচের জানালাগুলি ভেঙে পড়তে লাগল ঝনঝন করে। ঘরের মধ্যে পর্যন্ত ইটপাথরের টুকরো আসতে লাগল।

এইভাবে আধ ঘণ্টা কাটাবার পর শোনা গেল যে জনতা তলোয়ার নিয়ে আদালতের প্রহরীদের আক্রমণ করেছে, এবং মধ্যের বড় সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠেছে। খবরটা শোনামাত্রেই উপস্থিত ভদ্রলোকের মধ্যে একটা ত্রাসের সৃষ্টি হল, এবং যে যেদিকে সম্ভব ছুটতে আরম্ভ করল আত্মরক্ষার জন্য। আতঙ্কিত পলাতকদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম, প্রাণ বাঁচাবার জন্য একেবারে ছাত্রের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি, সার রবার্ট চেম্বার্সের ভাই উইলিয়াম চেম্বার্স আগে থেকেই পালিয়ে বসে আছে। নেটিবদের স্বভাবচরিত্র সম্বন্ধে তাঁর রীতিমতো জ্ঞান আছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বললেন, ‘আজকে আর আমাদের বাঁচার কোনো সম্ভাবনা নেই। ক্ষিপ্ত জনতা এখানকার প্রত্যেকটি ইংরেজকে ধরে ধরে হত্যা করবে মনে হয়।’

সত্যি কথা বলতে কী, আমি ব্যাপারস্যাপার দেখে রীতিমতো ভয়ে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ইংরেজ বলে গর্বিত মিঃ ক্রেসি উইলিয়ামের কথা শুনে বুক ফুলিয়ে বললেন, ‘ব্যাপার যদি তা—ই হয়, তাহলে আসুন আমরা ঠিক ইংরেজের মতন আমাদের সৎসাহসের পরিচয় দিই, এবং এইভাবে না পালিয়ে এই উচ্ছৃঙ্খল জনতার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। যদি প্রাণই দিতে হয়, তাহলে তা বীরের মতন দেওয়াই ভাল, কাপুরুষের মতন মরে কোনো লাভ নেই।’ এই কথা বলে তিনি সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামতে আরম্ভ করলেন, এবং তাঁর পিছুপিছু অন্যান্য ইংরেজরাও দৌড়তে লাগলেন।

ক্রেসির এই ব্যবহারে আশ্চর্য ফল হল। সকলে মিলে সামনে গিয়ে রুখে দাঁড়াতে জনতা পিছু হটতে আরম্ভ করল। এর মধ্যে পুরনো কেল্লা থেকে একদল সৈন্য এসে হাজির হল ঘটনাস্থলে। প্রবলবেগে একপশলা ইটপাটকেল বর্ষণ করে, গোরা সৈন্য দর্শনে, জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে চারদিকে ছুটতে লাগল। সেনাদলের কমান্ডারের কপালে সজোরে একটি ইটের টুকরো এসে লাগল, এবং ঝরঝর করে রক্ত পড়তে লাগল তাঁর কপাল দিয়ে। কমান্ডার তাতে আদৌ দমলেন না। খটখট করে তিনি আদালতগৃহের মধ্যে ঢুকে সোজা বিচারকদের কক্ষের দিকে চলে গেলেন। সামনে গিয়ে তাঁদের অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, ‘আমার জীবন বিসর্জন দিয়ে হলেও আপনাদের মর্যাদা রক্ষা করব।’

আমার কাছে বীর ইংরেজপুঙ্গবদের এই অভিনয়টি অত্যন্ত হাস্যকর বলে মনে হয়েছিল। কারণ ক্রেসি কীভাবে আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন তা শোনবার জন্য কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে সেদিন বহু ইংরেজ মিলিটারি অফিসার অস্ত্রশস্ত্রসহ আদালতে উপস্থিত ছিলেন। জনতার হট্টগোলের সময় তাঁদের কাউকেই বীরপুরুষের মতন আচরণ করতে দেখা যায়নি। সাধারণ লোকের মতন তাঁরাও ভয় পেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করেছিলেন।

সৈন্যরা আসার ফলে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল বটে, কিন্তু একেবারে ওই অঞ্চল ছেড়ে চলে গেল না, দূরে দূরে ছোট ছোট দল বেঁধে তারা দাঁড়িয়ে রইল। দাঙ্গায় আমার পালকিটি খোয়া গেল আরও অনেকের মতন। তিনশো টাকা দামের পালকিটি একেবারে চুরমার হয়ে গিয়েছিল, জোড়াতালি দেবারও কেনো উপায় ছিল না। বিক্ষুব্ধ মুসলমান জনতা রাইটার্স বিল্ডিংসে (Writers Buildings)—এর বাইরের ফটক, জানলার শার্সি ও বাতিও অনেক ভেঙে ফেলেছিল। রাস্তা দিয়ে চলবার সময় পথে কোনো সাহেব দেখলেই তারা ঢিল ছুড়ছিল, এবং ধরে প্রহারও করছিল।

ভারতের ব্রিটিশ রাজধানীতে এই ধরনের একটি ঘটনা ঘটে যাওয়ায়, সারা দেশব্যাপী একটা সাড়া পড়ে যায়। অনেকে বলাবলি করতে থাকেন যে নবাব নিজে এই দাঙ্গায় প্ররোচনা দিয়েছেন, এবং তাঁর অভিসন্ধি হল ইয়োরোপীয়দের হত্যা করা। গুজব নবাবের কানে পৌঁছতে তিনি তার প্রতিবাদ করে একটি ইস্তেহার জারি করেন, এবং কলকাতা শহরময় তা প্রচুর পরিমাণে বিলি করেন। দাঙ্গার পান্ডাদের ধরে দিতে পারলে পাঁচ হাজার টাকার পুরস্কার দেওয়া হবে বলে তিনি ঘোষণা করেন।

এই ঘটনার পর গবর্নমেন্ট এক আদেশ জারি করে দেন এই মর্মে যে মহরম উৎসবের সময় কলকাতা শহরের ভিতরে কোনোরকম শোভাযাত্রা করা চলবে না।

জু রি র বি চা র

কিছুদিন পরে ক্রেসির মামলা আবার আরম্ভ হল। শুনানির দিন কোর্টে আগের মতনই সাহেবদের ভিড় হল। ক্রেসি আত্মপক্ষ সমর্থনে বেশ ভালই ওকালতি করলেন। ঠিক এতটা তিনি করতে পারবেন এ আমি ভাবিনি। চিফ জাস্টিস অবশ্য তাঁর বিপক্ষেই রায় দিলেন, এবং তাঁর অন্যায় আচরণের জন্য চারশো সিক্কা টাকা জরিমানা করলেন। অন্য মামলাটির আর আলাদা শুনানি হল না, ওই একই জরিমানা সাব্যস্ত হল। কিন্তু আপিল করার ন্যায্য অধিকার থাকবে ক্রেসির, এ কথা তাঁর পক্ষের উকিল দাবি করলেন।

এরপরেই ইংরেজদের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধিকারের আন্দোলন আরম্ভ হল। কেবল বাংলা দেশের মধ্যেই আন্দোলন সীমাবদ্ধ রইল না, বাইরে কোম্পানির অন্যান্য প্রদেশেও ছড়িয়ে পড়ল। বাংলা দেশে তো বটেই, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ইংরেজরা চিঠিপত্র লিখে ও টাকাকড়ি পাঠিয়ে তাঁকে ইংলিশম্যানের মর্যাদা রক্ষার জন্য উৎসাহিত করতে লাগলেন। তাঁকে ‘Wilkers of India’ বলে ইংরেজ—সমাজ অভিনন্দন জানালেন। তাঁর আপিলের সমস্ত খরচ সংগ্রহের জন্য সাহেবরা সোৎসাহে চাঁদা আদায় করতে আরম্ভ করলেন। তার জন্য আলাদা একটি কমিটিও গঠিত হল।

কর্নেল ওয়াটসন বিচারকের রায় নিয়েই আপিল করার পক্ষপাতী ছিলেন। আমার তাতে মত ছিল না, কারণ তাতে কোনো লাভ হবে না বলেই আমার ধারণা ছিল। আমার মতন আরও অনেকে এই মত পোষণ করতেন। কিন্তু ওয়াটসন জিদ ধরলেন যে ব্যাপারটা এমনিতে কিছুতেই ছেড়ে দেওয়া হবে না। অবশেষে তিনি শহরের কয়েকজন গণ্যমান্য ইংরেজকে ডেকে এ বিষয়ে পরামর্শ করলেন এবং আলোচনা করে ঠিক হল যে যত শীঘ্র সম্ভব কলকাতার ইংরেজদের একটি সভা ডেকে এ বিষয়ে কী কর্তব্য তা স্থির করা হবে। বিষয়টি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উত্থাপন না করে ছাড়া হবে না।

১৭৭৯ জানুয়ারি মাসে এই উদ্দেশ্যে কলকাতার থিয়েটারগৃহে ইংরেজদের বিরাট একটি সভা হল। এই সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে একটি আপিলের প্রস্তাবও গৃহীত হল। আপিলে ভারতে বিচারালয় প্রতিষ্ঠার অ্যাক্ট সংশোধনের দাবি জানানো হয়, এবং প্রস্তাব করা হল যেন ভারতে ব্রিটিশ নাগরিকদের মর্যাদা রক্ষার জন্য স্বতন্ত্র বিচারের ব্যবস্থা করা হয়, এবং সেই বিচার যেন জুরির বিচার হয়।

আবেদনপত্র খসড়া করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হল। কমিটিতে ছিলেন কর্নেল পিয়ার্স, কর্নেল ওয়াটসন, জন শোর (লর্ড টিগনমাউথ), জন পেট্টি, আলেকজান্ডার হিগিনসন, হেনরি কটারেল, জন ইভেলিং, চার্লস পার্লিং, ফ্রান্সিস গ্লাডউইন ও ব্রুক। প্রত্যেকেই বিখ্যাত ও বিচক্ষণ ব্যক্তি এবং বিষয়টি নিয়ে সকলেই যথাসাধ্য মাথা ঘামাতে লাগলেন। সপ্তাহে চারদিন করে কমিটির বৈঠক বসতে থাকল। বৈঠকে ঠিক হল যে আপিল খসড়া করতে হলে মামলার নথিপত্রগুলি দরকার। তার জন্য চিফ জাস্টিসের কাছে আবেদন জানানো হল, কিন্তু কোনো ফল হল না। তিনি কোর্টের কর্মচারীদের হুকুম দিলেন যেন মামলা সংক্রান্ত কোনো দলিলপত্র কাউকে না দেখানো হয়। তা—ই হল, দলিলপত্র পাওয়া গেল না।

কমিটির পরবর্তী বৈঠকে কর্নেল ওয়াটসন বিচারকদের দাম্ভিক আচরণের তীব্র সমালোচনা করলেন। প্রসঙ্গত আমার স্বাধীন মনোভাব ও নির্ভীক মতামতের প্রশংসা করে কমিটির কাছে তিনি এই ব্যাপারে আমাকেই অ্যাটর্নি নিয়োগের জন্য প্রস্তাব করলেন। কমিটির সভ্যরা এই প্রস্তাব অবশ্য একবাক্যে সমর্থন করলেন এবং পত্রের দ্বারা তাঁরা আমাকে জানালেন যে আমিই তাঁদের অ্যাটর্নির কাজ করব। তারপর থেকে কমিটির প্রত্যেক সভার নোটিশ আমি পেতাম, এবং আমাকে সভায় উপস্থিতও থাকতে হত।

অনেক চেষ্টা করে আমি কোর্টের দলিলপত্র দেখার অনুমতি পেলাম। তার জন্য কমিটির কাছে আমার খাতির খুব বেড়ে গেল। কারণ কয়েকটি দলিল না দেখতে পেলে আপিল খসড়া করা কঠিন হত। করলেও তা টিকত কি না সন্দেহ। যা—ই হোক, আমার কৃতিত্বে সকলেই মুগ্ধ হলেন। একজন প্রস্তাব করে বসলেন যে, আপিলসহ আমাকে ইংলন্ডে পাঠালে কাজটি আরও ভাল হতে পারে। প্রস্তাবটি সময়মতন বিবেচনা করে দেখবেন বলে সকলে আশ্বাস দিলেন।

এই কথা শোনবার পর থেকে আমার মন ক্রমেই ইংলন্ডমুখী হতে থাকল। স্বদেশের অনেক স্মৃতি বারবার জাগতে থাকল মনে। কিছুদিনের জন্য সব গুটিয়ে ফেলা যায় কি না ভাবতে লাগলাম। লোকজনের কাছে ও বাজারে কত দেনা আছে, এবং মক্কেলদের কাছে পাওনাই বা কত আছে, তার একটা হিসেবপত্তর করতে আরম্ভ করলাম। আমার ইংলন্ড যাবার মনোবাসনা অবশ্য কারও কাছে আভাস—ইঙ্গিতেও প্রকাশ করিনি। সারাক্ষণ পরিশ্রম করে নিজের কাজ করতে থাকলাম এবং আপিলের ব্যাপারটাও যাতে তাড়াতাড়ি সেরে ফেলা যায় তার জন্য তৎপর হলাম। বলা বাহুল্য, আপিলের আন্দোলনের সঙ্গে এইভাবে জড়িয়ে পড়ার জন্য বিচারকরা কেউ আমার প্রতি খুশি হননি। সার এলিজা ইম্পে আমার উপর এত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন যে বাইরের কোনো সভাসমিতিতে সাক্ষাৎ হলে তিনি মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতেন, কথা বলতেন না আমার সঙ্গে। সার চেম্বার্স বা হাইড অবশ্য দেখা হলে কথা বলতেন, কিন্তু তাঁরা যে খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। একদিন চেম্বার্স আমাকে বলেই ফেললেন যে আমি আপিলের ব্যাপারে জড়িত হয়ে বিশ্বাসঘাতকের কাজ করেছি। এতে আমার অ্যাটর্নির পেশারও ক্ষতি হবে বলে তিনি ইঙ্গিত করলেন।

১৭৭৯ ফেব্রুয়ারি মাসে কমিটির আবেদনপত্র খসড়ার কাজ শেষ হল। পত্রে নিবেদন করা হল, যে অ্যাক্ট অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্ট এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা সংশোধন করা প্রয়োজন, ইংরেজদের জাতীয় স্বার্থে। বাংলা—বিহার—উড়িষ্যায় অন্তত যেন ইংরেজদের জুরির দ্বারা বিচারের ব্যবস্থা করা হয়। কলকাতার ইংরেজ বাসিন্দাদের সভা ডেকে আপিলের খসড়া মঞ্জুর করিয়ে নেওয়া হল। আপিলের একটা কপি আমার কাছে ছিল, এবং আমি তা এখানে প্রকাশ করতে পারতাম। কিন্তু একবার প্রচণ্ড ঝড়ে আমার অনেক জিনিসপত্রের সঙ্গে কপিটিও নষ্ট হয়ে যায়।

আবার সকলে পরম উৎসাহে চাঁদা তুলতে আরম্ভ করলেন আপিলের খরচ জোগাবার জন্য। অনেক টাকা উঠল। এইবার আমি কর্নেল ওয়াটসনকে আমার ইংলন্ড যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম, এবং বললাম যে বছর দুয়েকের জন্য আপিলের কাজের দায়িত্ব নিয়ে যদি ইংলন্ড ঘুরে আসি, তাহলে ক্ষতি কী? তিনি বললেন, ক্ষতি অনেক, কয়েক বছরে অ্যাটর্নি হিসেবে আমার যে পসার জমেছে তা জমানো আমার পক্ষে সম্ভব হবে কি না সন্দেহ। উঠতির মুখে এখন আমার বাংলা দেশ ছেড়ে যাওয়া ঠিক হবে না। কর্নেলের কথা যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ জেনেও মনটা আমার ইংলন্ডের জন্যই উন্মুখ হয়ে রইল। অবশেষে ইংলন্ড যাওয়াই সাব্যস্ত করলাম।

ইংলন্ড যাওয়া সম্বন্ধে মন স্থির করে ফেলেছি দেখে ওয়াটসন শেষে কমিটির কাছে আমার ইচ্ছার কথা জানালেন, এবং প্রস্তাব করলেন যে পার্লামেন্টে আপিল পেশ ও তদারক করার ভার আমার উপরেই দেওয়া হোক। তার জন্য আমার যাতায়াতের খরচ এবং দু’বছরের জন্য বার্ষিক দু’শো পাউন্ড অ্যানাউন্স মঞ্জুর করা হোক। কমিটির সভ্যরা খুশি হয়ে প্রস্তাব পাশ করলেন এবং দু’শো পাউন্ডের বদলে বছরে চারশো পাউন্ড করে আমার অ্যালাউয়েন্স ঠিক হল।

যাত্রার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলাম। আমার বেনিয়ান দুর্গাচরণ মুখুজ্যেকে ডেকে বললাম, তাঁর হিসেবপত্র বুঝে নিতে। অন্যান্য পাওনাদারদেরও খবর দিলাম। মাসান্তে বাজারের দেনা যথাসাধ্য শোধ করে দিতাম বলে আমার ধারণা ছিল যে দরজি বোধহয় আমার কাছে হাজার দেড়—দুই টাকা পাবে। কিন্তু হিসেব আসতে দেখলাম, দরজির কাছে দেনা পাঁচ হাজার টাকা। বেনিয়ানকে তাগিদ দিয়েও পুরো হিসেব পাওয়া গেল না। যাবার দিন এগিয়ে এল। সার চেম্বার্স ও জাস্টিস হাইডের কাছ থেকে বিদায় নিলাম, কিন্তু সার এলিজার কাছে যাবার সাহস হল না।

১৫ এপ্রিল, ১৭৭৯ সন্ধ্যায় কলকাতা ছেড়ে স্বদেশ অভিমুখে যাত্রা করলাম।*

.

* এ দেশি লোকের বিক্ষুব্ধ জনতার মধ্যে ব্রিটিশ খালাসিদের যোগদান ও এই আচরণ লক্ষণীয়।

* দু’বছর নয়, চার বছর পরে উইলিয়াম হিকি দ্বিতীয়বার ভারতবর্ষে আসেন। এবং কিছুদিন মাদ্রাজে থেকে ১৭৮৩ জুন মাসে বাংলা দেশে এসে আবার তাঁর কাজ আরম্ভ করেন।

৪. হিকির স্মৃতিকথা

বাংলা দেশে ফিরে এসে ১৭৮৩, পয়লা জুলাই থেকে আমি আবার কাজকর্ম শুরু করলাম। আমার পুরনো বেনিয়ান দুর্গাচরণ মুখুজ্যে ওইদিন আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, এবং আমি কোম্পানির অধীনে একজন উচ্চপদস্থ সিবিলিয়ান হয়ে ফিরে আসিনি দেখে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। আমার মতন একজন লোক এই চাকুরি চাইলেই পেতে পারে, এই তাঁর ধারণা ছিল।

দুর্গাচরণবাবু আমাকে একটি সুন্দর পালকি কিনে দিলেন, তার সঙ্গে একদল বেয়ারা ও অন্যান্য চাকরবাকরও জোগাড় করে দিলেন। তিনি চলে যাবার পর টলফ্রে ও অন্যান্য পুরনো বন্ধুবান্ধবরা দেখা করতে এলেন সকালে। চিফ জাস্টিস সার এলিজা ইম্পে কোনো সূত্রে আগেই খবর পেয়েছিলেন যে আমি সমুদ্রপথে বাংলা দেশ অভিমুখে রওনা হয়েছি। খবর শুনেই বোধহয় তিনি কোর্ট থেকে একটি নোটিশ কলকাতা শহরের সব বিশিষ্ট স্থানে লটকে দিয়েছিলেন। নোটিশের মর্ম এই :

যেসব অ্যাটর্নি কোর্টের তালিকাভুক্ত হয়েও এক বছরের বেশি প্র্যাকটিস করছেন না, অথবা অনুপস্থিত আছেন, তাঁরা এই নোটিশ জারির চোদ্দো দিনের মধ্যে কোর্টে সশরীরে উপস্থিত হয়ে জবাবদিহি করবেন। জবাব যদি তাঁদের যুক্তিসঙ্গত না হয়, অথবা তাঁরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উপস্থিত না হন, তাহলে কোর্টের অ্যাটর্নির তালিকা থেকে তাঁদের নাম কেটে দেওয়া হবে।

বোঝা গেল, আমার উপরেই প্রতিশোধ নেবার জন্য চিফ জাস্টিস এই কৌশল উদ্ভাবন করেছেন। আমি পার্লামেন্টে জুরির বিচার দাবি করে আন্দোলন করার জন্য ইংলন্ড পর্যন্ত যাত্রা করেছিলাম বলে সার এলিজা আমার উপর আদৌ প্রসন্ন ছিলেন না। একটা ব্যক্তিগত আক্রোশের বশেই মনে হয় তিনি অ্যাটর্নিদের সম্বন্ধে এই নোটিশ জারি করেছিলেন। কারণ এক বছরের বেশি প্র্যাকটিস করেননি এরকম অনেক অ্যাটর্নি ছিলেন, কিন্তু আমার মতন কাউকে তার জন্য দুর্ভোগ ভুগতে হয়নি। নোটিশ যখন জারি হয়, আমি তখন ট্রিনকোমালয়ে ফরাসিদের বন্দি হয়েছিলাম। সুতরাং চোদ্দো দিনের মধ্যে কোর্টে উপস্থিত হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সেইজন্য কোর্টের ‘ক্লার্ক’ আমার নাম, বিচারকদের আদেশে, অ্যাটর্নির তালিকা থেকে বাদ দিয়েছিলেন।

সমস্ত ব্যাপারটাই ব্যক্তিগত বিদ্বেষপ্রসূত বলে আমি সত্যিই খুব ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়েছিলাম। আমার মনোভাব চিফ জাস্টিসকে জানাবার জন্য আমি ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। একজন বিচারক হয়েও তিনি যে কত সঙ্কীর্ণচিত্ত ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হতে পারেন, সে কথা চিঠিতে লিখে তাঁকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিলাম। চিঠিখানা লেখা হলে বন্ধু পটকে পড়িয়ে শোনালাম। পট বলল, চিঠির ভাষা খুবই কড়া হয়েছে, এবং চিঠি পড়ে জাস্টিস এলিজা একেবারে খেপে যাবেন বলে মনে হয়। পট নিজেই চিঠিখানা হাতে করে নিয়ে যাবে বলল, এবং আমাকে কথা দিল যে ইম্পে যতই ক্রুদ্ধ হন—না কেন, সে তাঁকে শান্ত করে ঠিকই কার্যোদ্ধার করে নেবে।

এ লি জা ই ম্পে

পরদিন সকালে পট আমার বাড়ি এসে একখানি চিঠি দিল আমাকে। চিঠিখানা চিফ জাস্টিসের। পট বলল, সার এলিজা আমার চিঠি পড়ে এত রেগে গিয়েছিলেন যে তিনি কথাই বলতে পারছিলেন না। অনেক চেষ্টা করে সে তাঁর মুখে হাসি ফুটিয়েছে ও কথা বার করেছে। অবশেষে, মেজাজ খুশি হবার পর, এই চিঠিখানা তিনি আমাকে লিখে পাঠিয়েছেন :

উইলিয়াম হিকি

.

মহাশয়,

কোর্টের কয়েকজন অ্যাটর্নি কিছুদিন আগে আমার কাছে আবেদন করেছিলেন যে তাঁদের কাজকর্ম ক্রমেই কমে যাচ্ছে, এবং তার জন্য অ্যাটর্নির সংখ্যা আরও অনেক কমানো দরকার। এই কারণে, অ্যাটর্নির সংখ্যা কত, এবং তাঁদের মধ্যে সত্যিকার প্র্যাকটিসিং অ্যাটর্নি ক’জন তার একটা সঠিক ধারণা করার জন্য আমি একটি নোটিশ জারি করেছিলাম। এ ছাড়া আর অন্য কোনো কারণে ইচ্ছা করে কোর্টের অ্যাটর্নির তালিকা থেকে আপনার নাম কেটে দেওয়া হয়নি। আপনি এত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এখানে অনুপস্থিত ছিলেন যে আপনি স্বেচ্ছায় আপনার পেশা ছেড়ে দিয়েছেন বলে আমাদের ধারণা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এখন আপনি যখন জানিয়েছেন যে ব্যাপারটা আদৌ তা নয়, অ্যাটর্নির পেশা ছাড়ার কোনো ইচ্ছা আপনার নেই, এবং আপনার অজ্ঞাতে ও অনুপস্থিতিকালে উক্ত নোটিশটি যখন প্রকাশ করা হয়েছিল, তখন আপনার নাম বাতিল করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। এই অবস্থায় আপনার নাম বাতিল করা হলে সত্যিই তা অন্যায় হয়। আমার দিক থেকে আমি তাই আপনাকে জানাচ্ছি যে আপনি আবার স্বচ্ছন্দে এই কোর্টের অধীনে অ্যাটর্নির কাজ শুরু করতে পারেন। তার জন্য আপনাকে কী করতে হবে তা আমার সঙ্গে অনুগ্রহ করে যদি একদিন সাক্ষাৎ করেন তো বলে দিতে পারি।

আপনার একান্ত অনুগত সেবক,

ই. ইম্পে

সার এলিজার কাছ থেকে এই চিঠি পাওয়ার পর পট একদিন আমাকে তার গাড়ি করে কোর্টহাউসে নিয়ে গেল। আমি যখন ইয়োরোপে ছিলাম তখন সুপ্রিমকোর্ট পুরনো বাড়ি থেকে এই বাড়িতে উঠে গিয়েছিল। বাড়িটা হল গঙ্গার ধারে চাঁদপাল ঘাটের কাছে। এই বাড়িতে সার এলিজাও সপরিবারে থাকতেন।

আমাকে তাঁর পড়ার ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই এলিজা হাজির হলেন, এবং আমি উঠে দাঁড়িয়ে মাথা হেঁট করে তাঁকে অভিবাদন জানালাম। তিনিও প্রত্যভিবাদন জানালেন, কিন্তু মাথা নাড়ালেন কি না, এবং আমার দিকে ফিরে তাকালেন কি না, তা ঠিক বোঝা গেল না। তাঁর অবস্থা দেখে পট বেশ জোরেই হেসে ফেলল। এলিজা এই গম্ভীর পরিবেশে তাঁকে হাসতে দেখে অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন এবং রীতিমতো চটে গিয়ে বললেন, ‘হঠাৎ এমন কী কারণ ঘটল যার জন্য আপনি এমন বিসদৃশভাবে হেসে উঠলেন?’ পট চুপ করে রইল, তাঁর কথার কোনো উত্তর দিল না, এবং সত্যিই খুব অশোভনভাবে আরও জোরে অট্টহাসি হেসে উঠল। এলিজা গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘আপনার এই অকারণ পুলকের ধাক্কা যদি না সামলাতে পারেন, তাহলে কোর্টে এসে আমার সঙ্গে দেখা করবেন।’ পট তাঁকে নমস্কার জানিয়ে বলল, ‘তাহলে দেখবেন সার, আমার বন্ধু হিকির উপর যেন সুবিচার করা হয়। আপনি কোর্টে যান, আমি একবার লেডি এলিজার সঙ্গে দেখা করে যাই।’

আমি সার এলিজার পশ্চাদনুসরণ করলাম কোর্ট পর্যন্ত। কোর্টে গিয়ে তাঁর আসনে বসেই তিনি বললেন, ‘মিঃ উইলিয়াম হিকি কী কারণে এতদিন কোর্টে প্র্যাকটিস করতে পারেননি তা পরিষ্কার করে বলেছেন। বিচারকরা মনে করেন তাঁর নাম অ্যাটর্নির তালিকা থেকে বাদ দেবার কোনো সঙ্গত কারণ নেই। সুতরাং তিনি যথারীতি শপথ গ্রহণ করে আবার অ্যাটর্নির কাজ শুরু করতে পারেন।’

কোর্ট থেকে সোজা আমি ফোর্ট উইলিয়ামে চলে গেলাম কর্নেল ওয়াটসনের সঙ্গে দেখা করতে। এর মধ্যে তাঁর অনেক পরিবর্তন হয়েছে, তিনি কিয়ারম্যান নামে এক মহিলাকে ঘটনাচক্রে বিবাহ করে বসেছেন। আগেকার মতন আন্তরিকভাবেই তিনি আমাকে অভিনন্দন জানালেন, এবং অমন সুন্দর প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়ে ইংলন্ড চলে যাবার জন্য খুবই দুঃখ করলেন। আর সেরকম কাজকর্ম আমি পাব কি না সে সম্বন্ধেও তিনি সন্দেহ প্রকাশ করলেন। যা ই হোক, তিনি বললেন, ‘সকলে মিলে চেষ্টা করলে নিশ্চয় আবার আপনার প্র্যাকটিস জমিয়ে ফেলা যাবে। আমি আপনাকে কয়েকজন ধনি এ দেশি মক্কেলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। আমি নিজেও ধীরেসুস্থে আমার বর্তমান অ্যাটর্নির কাছ থেকে কাজকর্ম সরিয়ে নিয়ে আপনাকে দিতে পারব। আমার বর্তমান অ্যাটর্নি একজন উঁচুদরের চোর, কেন যে এতদিন তার ফাঁসি হয়নি জানি না। এরকম ধূর্ত বদমায়েশ লোক আমি দেখিনি বললেই চলে। এই স্কাউন্ড্রলটি আবার অন্যান্য অ্যাটর্নিদেরও এইসব শঠতা শিক্ষা দিচ্ছে।’

এই অ্যাটর্নির নাম সলোমান হ্যামিলটন। আমিও তাঁর সম্বন্ধে যা জানি তাতে ওয়াটসনের কথা আদৌ অতিরঞ্জিত বলে মনে হল না। আমি যখন ইংলন্ডে ছিলাম, তখন তিনি আইরিশ আদালতে প্র্যাকটিস করতেন। পরে এ দেশে এসে তিনি অ্যাটর্নি হন। অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর ব্যবসা বেশ ফেঁপে ওঠে, এবং তিনি অনেকের অনেক পয়সা নির্বিচারে ঠকিয়ে নিতে আরম্ভ করেন। ওয়াটসন তাঁর সম্বন্ধে যেসব কথা বললেন তা বর্ণে বর্ণে সত্য।

কলকাতার অন্যান্য বন্ধুবান্ধবরা সকলেই বেশ ভাল আছেন দেখলাম। কেবল শুনলাম আমার বিলেত যাবার বছর দুই পরে ক্লিভল্যান্ড মারা গেছেন। কোম্পানির অ্যাটর্নি নর্থ নেলরের স্ত্রীর প্রসবকালে শোচনীয় মৃত্যুর কথাও শুনলাম। এই ঘটনাটির সঙ্গে আমাদের চিফ জাস্টিস সার এলিজার বদমেজাজের পরোক্ষ সম্পর্ক আছে বলে এখানে তা বলা দরকার।

একবার গবর্নমেন্টের সঙ্গে বিচার—বিভাগের কোনো একটি নীতিগত বিষয় নিয়ে গুরুতর মতভেদ হয়। কোম্পানির অ্যাটর্নি হিসেবে নেলরের উপর এই অপ্রীতিকর বিরোধ মীমাংসার ভার পড়ে। বিচারকরা কোনো একটি মকদ্দমার যে রায় দেন, গবর্নমেন্ট তা অসঙ্গত মনে করে পুনর্বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করেন। গবর্নমেন্টের পক্ষ থেকে নেলর এ কথা উত্থাপন করামাত্রই চিফ জাস্টিস চটে গিয়ে তাঁকে কোর্টের অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করেন। নেলরকে গ্রেপ্তার করে জেলখানায় বন্দি করা হয়, এবং তিনি সেখানে বেশ পীড়িত হয়ে পড়েন। তাঁর স্ত্রী এই সংবাদ শুনে দুশ্চিন্তায় কাতর হয়ে পড়েন, এবং প্রসবকালে তাঁর মৃত্যু হয়। সার এলিজার আক্রোশের শোচনীয় পরিণতি হয় এইভাবে।

এতেও তিনি শান্ত হননি। শেষ পর্যন্ত তাঁর রাগ গিয়ে পড়ল উইলিয়াম সোয়েনস্টন নামে কোম্পানির এক কর্মচারীর উপর। যে ব্যক্তিকে নিয়ে গবর্নমেন্টের সঙ্গে বিচারকদের বিরোধ, সে যেখানে বাস করত সেখানকার শাসনকর্তা ছিলেন সোয়েনস্টন। সরকারের কর্মচারী হিসেবে তিনি সরকারের আদেশ অনুযায়ী এই ‘নেটিব’ লোকটিকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন, এই তাঁর অপরাধ। চিফ জাস্টিস তাঁর উপরেও অগ্নিশর্মা হয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করেন, এবং নেলরের সঙ্গে তাঁকেও জেলখানায় বন্দি করে রাখেন। তবে তিনি শক্ত লোক, নেলরের মতন দুর্বল নন, অতএব বন্দিজীবনের কয়েকটা দিন তিনি দার্শনিক তত্ত্বকথা চিন্তা করেই কাটিয়ে দিলেন।

কোর্টের লোকজন, অ্যাটর্নি—অ্যাডভোকেট আগে যেমন ছিল তেমনি আছে দেখলাম। কোম্পানির সিনিয়র কাউন্সেল চার্লস নিউম্যান চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন শুনলাম। দীর্ঘদিন কোম্পানির অধীনে কাজ করা সত্ত্বেও যখন তিনি দেখলেন যে তাঁর মাথার উপর দিয়ে একজন নতুন অ্যাডভোকেট—জেনারেল বহাল করা হল তখন তিনি মর্মাহত হয়ে পদত্যাগ করলেন। এর মধ্যে অবশ্য তিনি যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করেছিলেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় ইংলন্ডে ফিরে যাবার সময় জাহাজডুবিতে তিনি মারা যান। কোম্পানির জুনিয়র কাউন্সেল মিঃ লরেন্স—আমি বাংলা দেশে ফেরার কয়েকদিন পরেই—ইহলোক ত্যাগ করেন। এ ছাড়া বাকি সকলেই দেখলাম বেশ বহাল তবিয়তেই আছেন।

ডু য়ে ল ল ড়া র কা হি নি

আমার বন্ধু পট ছিল মুর্শিদাবাদের নবাবের দরবারে ‘রেসিডেন্ট’। এর মধ্যে তার চাকরিটিও গেল। ৮ জুলাই তারিখে সকালে উঠে শুনলাম, এক ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। পাশের একটি ছোট ঘরে তাঁকে নিয়ে গিয়ে বসলাম। তাঁর নাম ক্যাপ্টেন স্যামুয়েল কক্স। তিনি বললেন, ‘আমি মিঃ বেটম্যানের কাছ থেকে আপনাকে একটি কথা জানাতে এসেছি। আপনি যখন ট্রিনকোমালয়ে ছিলেন, তখন তাঁর সম্বন্ধে আপনি অত্যন্ত জঘন্য কুৎসা রটনা করেছিলেন ফরাসি মিলিটারি অফিসারদের কাছে—আপনার বিরুদ্ধে এই তাঁর অভিযোগ। আপনি হয় এই আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে তাঁর কাছে ক্ষমা চাইবেন, আর তা না হলে মিঃ বেটম্যান আপনার সঙ্গে ডুয়েল লড়ে এর মীমাংসা করবেন ঠিক করেছেন।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলাম, ‘ক্ষমা চাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমি তাঁর সম্বন্ধে কোনো মিথ্যা কুৎসা রটনা করিনি, যা বলেছি তা সত্যি কথা, এবং এখনও বলতে দ্বিধা নেই আমার।’ আমার এই সাফ জবাবের পর ডুয়েল লড়ারই সিদ্ধান্ত হল। ঠিক হল, পরদিন সকালে আলিপুরে ‘বেলভেডিয়ার হাউস’—এর পিছনে আমরা ডুয়েলের জন্য পিস্তল নিয়ে উপস্থিত হব, এবং আমাদের সঙ্গে একজন করে বন্ধু থাকবেন। ক্যাপ্টেন কক্স থাকবেন বেটম্যানের সঙ্গে।

কক্স বিদায় নেবার পর আমি পটের কাছে গিয়ে আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত বললাম, এবং তাকে অনুরোধ করলাম আমার সঙ্গে পরদিন ডুয়েলের স্থানে যেতে। পট রাজি হল এবং বলল, ‘ঠিক আছে বিল, কোনো পরোয়া নেই। রাস্কেল বেটম্যানের মাথাটা লক্ষ্য করে একটা গুলি মারলেই কাজ হবে।’

ভৃ ত্য ‘ন বা ব’

এই ৮ জুলাই (১৭৮৩) তারিখটি অনেক কারণে আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। তার মধ্যে একটি কারণ এই ডুয়েলের খবর। অন্য কারণ হল, ওইদিন ব্রেকফাস্ট খেয়ে বারান্দায় বসে সামনে গঙ্গার দিকে চেয়ে আছি, এমন সময় অরিয়োল নামে এক পরিচিত ভদ্রলোকের কাছ থেকে একখানি চিঠি পেলাম। তিনি আমাকে ইংলন্ড যাবার আগে ‘নবাব’ নামে একটি ভৃত্য উপহার দিয়েছিলেন। আমি ফিরে এসেছি জেনে তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন যে এখন যদি ভৃত্যটি কাজে না লাগে, তাহলে তাঁকে ফেরত দিলে তিনি বিশেষ উপকৃত হবেন। চিঠি পেয়ে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমি জানতাম, যে কোনো জিনিস (ভৃত্য হলেও) উপহার দিলে তা আর ফেরত নেওয়া যায় না। অবশ্য অরিয়োল যে অত্যন্ত কৃপণ ও স্বার্থপর লোক তা—ও আমার অজানা ছিল না। তার পক্ষেই উপহার—দেওয়া জিনিস ফেরত নেওয়া সম্ভব। তা হলেও মানুষ হিসেবে মনের এতখানি দীনতা তার কাছ থেকে আশা করিনি। ভৃত্য হিসেবে ‘নবাব’ যে আমার একান্ত অনুগত ও প্রিয় ভৃত্য ছিল তা নয়, আমি তার প্রতি সর্বদাই সদয় ও উদার ব্যবহার করেছি, কিন্তু প্রতিদানে তার কাছ থেকে পেয়েছি অকৃতজ্ঞতা। যা—ই হোক, তবু আমার ধারণা ছিল, সে বুঝি আমার অনুগত। আমি তাই তাকে ছাড়ব না ঠিক করলাম, যদি অবশ্য সে স্বেচ্ছায় তার পুরনো মনিবের কাছে ফিরে যেতে না চায়।

‘নবাব’কে ডেকে পাঠালাম বারান্দায়। ‘নবাব’ এল, তাকে অরিয়োলের চিঠির কথা সব বললাম। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোর মনে আছে অরিয়োলের কথা?’ সে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, খুব ভালই মনে আছে।’ এবার তাকে বললাম, ‘গত চার বছর যে তুই আমাদের সঙ্গে ইংলন্ডে ছিলি, তোর কি মনে হয় না যে আমি, আমার স্ত্রী ও পরিবারের লোকজন সকলে তোর সঙ্গে সব সময় অত্যন্ত সদয় ব্যবহার করেছি?’ সে উত্তর দিল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, তা করেছেন।’ একটু আশ্বস্ত হয়ে আমি বললাম, ‘মিঃ অরিয়োল তোকে ফেরত নিতে চান। তিনি অবশ্য তা নিতে পারেন না, যদি না তুই স্বেচ্ছায় যেতে চাস। আমাদের ছেড়ে তুই কি তোর পুরনো মনিবের কাছে ফিরে যাবি?’ অম্লানবদনে ‘নবাব’ উত্তর দিল এক মুহূর্তও দ্বিধা না করে, ‘হ্যাঁ যাব।’

আমার পাশেই পট বসে এনসাইক্লোপিডিয়ার প্রকাণ্ড একটি ভলিউম নেড়েচেড়ে কী যেন দেখছিল। হঠাৎ মুখ তুলে ‘নবাব’—এর উত্তর শুনে সে তার দিকে চাইল। মনে হল রাগে যেন তার সর্বশরীর কাঁপছে। প্রকাণ্ড এনসাইক্লোপিডিয়াখানা কোলের উপর থেকে তুলে নিয়ে সে তার মাথা লক্ষ্য করে ছুড়ে মারল। আমারও এত রাগ হয়েছিল যে তৎক্ষণাৎ তাকে আমি সামনে থেকে চলে যেতে বললাম। এ কথাও তাকে জানিয়ে দিলাম, যে লোকটি অরিয়োলের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে এসেছে, ইচ্ছা করলে সে এখনই তার সঙ্গে চলে যেতে পারে।

অরিয়োলের অভদ্র আচরণের জবাব দেওয়া প্রয়োজন মনে করে আমি তাকে একখানি চিঠি লিখে জানালাম যে, ভৃত্য ফেরত নেবার তার কোনো অধিকার নেই। তবু আমি তাকে ফেরত দিচ্ছি, কারণ এরকম একজন নিষ্কর্মা চাকর পুষে লাভ নেই। কিন্তু নিষ্কর্মা হলেও, ‘নবাব’ এখন যখন খ্রিস্টান হয়েছে, তখন মিঃ অরিয়োল আর তার সঙ্গে ক্রীতদাসের মতন ব্যবহার করতে পারবেন না।

বে নি য়া ন দু র্গা চ র ণ মু খু জ্যে

‘নবাব’ বিতাড়িত হবার পর আমার প্রাতঃস্মরণীয় বেনিয়ান দুর্গাচরণ মুখুজ্যে সশরীরে এসে হাজির হলেন। আমি বিলেত যাবার আগে টাকার জন্য তাঁকে যে বন্ড দিয়েছিলাম, তিনি বললেন যে সুদে ও আসলে মিলে তা প্রায় আট হাজার টাকা হয়েছে। টাকাটা তাঁকে যত শীঘ্র সম্ভব ফেরত দিলে তিনি খুশি হবেন। মুখুজ্যে মশায় আর কখনও কোনো অ্যাটর্নির কাছে বেনিয়ানের কাজ করবেন না বলে জানিয়ে দিলেন এবং অন্য একজন বেনিয়ান দেখে নিতে আমাকে অনুরোধ করলেন। মুখুজ্যের কথাবর্তার মধ্যে বেশ একটু ঝাঁজ ছিল বলে মনে হল। আমি জীবনে কখনও কারও উদ্ধত কথাবার্তা সহ্য করিনি, এ দেশের ‘নেটিবদের’ তো নয়ই। বেনিয়ানের কথা শুনে আমার মেজাজ গেল বিগড়ে। আমি তাঁকে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগাল দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বললাম, আর তা না হলে তৎক্ষণাৎ চাকর ডেকে তাঁকে পদাঘাত করে বার করে দেব বলে শাসালাম। এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে তিনি আমার সামনে থেকে প্রস্থান করলেন, এবং সোজা অ্যাটর্নির কাছে গিয়ে টাকার জন্য আমাকে নোটিশ দিলেন। কী আর করব। অত টাকা তখন আমার দেবার সাধ্য ছিল না, বাধ্য হয়ে তাই অন্যের কাছ থেকে ধার করে আমার টাকা শোধ করতে হল।

ডু য়ে লে র দি ন

এইভাবে ৮ জুলাইয়ের দিনটি কাটল। ৯ জুলাই ভোর হল, বেটম্যানের সঙ্গে ডুয়েল লড়ার দিন। ঘুম থেকে উঠে দেখলাম শ্রীমতী হিকি অঘোরে ঘুমুচ্ছেন। তাঁকে আর জাগালাম না। পট ইতিমধ্যেই উঠে পোশাক পরে তৈরি হয়ে গেছে। দু’জনে গাড়িতে উঠে যেতে বেশি দেরি হল না। আমরা পৌঁছবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বেটম্যান ও কক্স এসে উপস্থিত হলেন। তাঁরা আসতেই বারো পা করে জমি লড়াইয়ের জন্যে মেপে নেওয়া হল। চাকতি ঘুরিয়ে ঠিক করা হল কে আগে পিস্তল ছুড়বে। বেটম্যানই প্রথম ফায়ারের সুযোগ পেলেন। আমাকে লক্ষ্য করে তিনি পিস্তল ছুড়লেন, কিন্তু গুলি আমার গায়ে লাগল না। তারপর আমিও ছুড়লাম, গুলি বেটম্যানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। উভয়েরই লক্ষ্যভেদ যখন ব্যর্থ হল, তখন বেটম্যান শপথ করে বললেন যে তিনি আমার বা মিসেস হিকির বিরুদ্ধে কারও কাছে কোনো নিন্দা করেননি, এবং কোন বিদ্বেষভাবও আমাদের বিরুদ্ধে তিনি পোষণ করেন না। এ কথা তাঁর মুখ থেকে শোনার পর আমারও ভুল ধারণা ভেঙে গেল। আমি বললাম যে এতদিন একটা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে আমি তাঁকে একজন হীনচরিত্রের লোক বলে মনে করেছি। সেজন্য আমি লজ্জিত ও দুঃখিত। উভয়ের এই স্বীকারোক্তির পর আমাদের ঝগড়া মিটে গেল, এবং ডুয়েলের পর্বও শেষ হল।

১০ তারিখে সুপ্রিম কাউন্সিলের দু’জন সভ্য ম্যাকফার্সন ও স্টেবলসের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। ১২ তারিখে আমার লন্ডনের হেয়ারড্রেসার ফ্রেস্কিনি এসে উপস্থিত হল। খাওয়া—পরা ছাড়া মাসিক ১০০ টাকা বেতনে তাকে কাজে নিযুক্ত করলাম। সম্ভব হলে অন্য মহিলাদেরও কেশপরিচর্যা করে তাকে স্বাধীনভাবে কিছু রোজগারেরও সুযোগ দিলাম।

মাসের বাকি দিনগুলি লোকজনদের অভ্যর্থনা করে ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে কেটে গেল। প্রত্যেকদিন সন্ধ্যায় আমাকে ও মিসেস হিকিকে সঙ্গে নিয়ে পট তার ফিটনে করে রেসকোর্সে বেড়াতে যেত। তখনকার দিনে ফ্যাশন ছিল, স্ট্রান্ডে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আরোহী ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা নানা বিষয় আলাপ—আলোচনা করতেন।

সা র উ ই লি য়া ম জো ন্স

পুরনো বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতদের মধ্যে অনেকে মামলা—মকদ্দমার জন্য আমার খোঁজ করতে লাগলেন। এ দেশি মক্কেলরাই খোঁজ করতেন বেশি। তাঁদের জন্য আমাকে প্রায় রোজই একবার করে শহরে আসতে হত। টলফ্রে তাঁর অফিসের একটি কামরায় আমার হয়ে মক্কেলদের অভ্যর্থনা করতেন। একদিন তিনি আমাকে বেশ খোঁচা দিয়ে বললেন, ‘ব্যবসা করবেন কলকাতায় এবং থাকবেন শহরতলির বাগানবাড়িতে, এইভাবে আর কতদিন চলবে?’ তিনি আমাকে কলকাতায় একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকার জন্য ক্রমাগত তাগিদ দিতে থাকলেন। আমিও একটি ভাল বাড়ির খোঁজ করতে আরম্ভ করলাম। আগস্টের মাঝামাঝি কলকাতা শহরের কেন্দ্রস্থলে আদালতগৃহের কাছাকাছি, চমৎকার একটি বাড়ি পেলাম, মাসিক ভাড়া ৩০০ টাকা। এই মাসের শেষেই বিলেত থেকে সার উইলিয়াম জোন্স ও লেডি জোন্স কলকাতায় এসে উপস্থিত হলেন। সার উইলিয়াম পরলোকগত জাস্টিস লা মেতরের শূন্যস্থানে নিযুক্ত হয়েছেন। কিন্তু মেতর মারা গেছেন ১৭৭৭ সনে, আর জোন্স এসে উপস্থিত হলেন ১৭৮৩ সনের আগস্ট মাসে। রবার্ট চেম্বার্স এই সময় কিছুদিনের জন্য বারাণসী ও উত্তরপ্রদেশের অন্যান্য অঞ্চলে বেড়াতে গিয়েছিলেন। জোন্সের আসার কথা ছিল বলে তিনি নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন যেন তাঁর বাড়িতেই তিনি থাকেন, আলাদা একটি ভাল বাড়ি না—পাওয়া পর্যন্ত। জোন্স তা—ই করলেন, কলকাতায় পৌঁছে চেম্বার্সের বাড়িতে গিয়ে উঠলেন।

পরদিন সকালে সার এলিজা ইম্পে কোর্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকদের কাছে একটি সার্কুলার পাঠালেন। সকলকে ব্রেকফাস্টে নিমন্ত্রণ করে জানানো হল যে তাঁরা পরদিন সকালে চিফ জাস্টিসের বাড়িতে আসবেন এবং ব্রেকফাস্ট খেয়ে একসঙ্গে কোর্টে যাবেন। সেখানে তাঁদের উইলিয়াম জোন্সের সঙ্গে একে একে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে, এবং তারপর নতুন বিচারক তাঁর শপথ গ্রহণ করবেন। অ্যাডভোকেট, অ্যাটর্নি ও কোর্টের অন্যান্য কর্মচারীরা সকলেই নির্দিষ্ট দিনে ও সময়ে উপস্থিত হয়েছিলেন, কেবল আমি ছাড়া। আমি এলিজার বাড়িতে চা—কফি খেতে যাইনি, তার কারণ আগে একদিন তাঁর বাড়িতে গিয়ে যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল তাতে আর আমার যাওয়ার প্রবৃত্তি হয়নি। আমি অবশ্য রাস্তা থেকে শোভাযাত্রায় যোগ দিয়েছিলাম, এবং উইলিয়ামের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচয়েরও সুযোগ পেয়েছিলাম। পরিচয়ের সময় জোন্স আমার নাম শুনে মুখের দিকে চেয়ে বললেন, ‘আপনি বোধহয় হ্যারোতে আমার সহপাঠী ছিলেন?’ আমি বললাম, ‘না আমি নই, আমার দুই দাদা আপনার সঙ্গে হ্যারোতে পড়তেন।’

নতুন বিচারকের সঙ্গে আলাপ—পরিচয়ের পালা শেষ হবার পর আমার বন্ধু মর্স তার দুই বোনের সঙ্গে দেখা করবার জন্য নিয়ে গেল। আগেই তাদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল ইংলন্ডে। দুই বোনই বিবাহিতা। একজনের বিবাহ হয়েছিল মিডলটন নামে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। হেস্টিংসের বিচারের সময় ইনি সাক্ষী দিতে গিয়ে এমন অদ্ভুত স্মৃতিশক্তির পরিচয় দেন যে সাধারণ লোকের কাছে তাঁর নাম হয়ে যায় ‘Memory Middleton’ অর্থাৎ যা তিনি বলেন তা—ই ভুল হয়, এবং বলবার সময় কোনো কথাই তাঁর মনে পড়ে না। মর্স ১৭৮১ সনে একটি সেনাদলে পে—মাস্টারের চাকরি নিয়ে ওকালতি ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে চলে যান। তখনকার দিনে সেনাদলে এই পে—মাস্টারের চাকরি সকলের কাছেই খুব লোভনীয় ছিল, কারণ এতে উপরি আয় ছিল অনেক। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেনাদলের সঙ্গে যাবার সময় পথে কমান্ডারের সঙ্গে তাঁর কোনো কারণে বিবাদ হয়। তার ফলে তিনি তাঁর চাকরির সুযোগ—সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। অবশেষে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফিরে এসে আবার ওকালতি ব্যবসায়ে যোগ দেন। তাঁর অনুপস্থিতিকালে হেনরি ডেভিস নামে এক ভদ্রলোক অ্যাডভোকেট হয়ে আসেন। আইনবিদ্যায় মর্স তাঁর চেয়ে বেশি পণ্ডিত হলেও, ডেভিস প্রত্যুৎপন্নমতি ও সুবক্তা ছিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই সেজন্য প্র্যাকটিস জমে যায়। মর্সের অনেক মক্কেল তিনি হাত করে ফেলেন। তাতে মর্সের আর্থিক ক্ষতি তো হয়ই, আত্মসম্মানেও আঘাত লাগে। শোনা যায়, বিচারকরা তাঁকে কিছুদিনের মধ্যে শরিফ করে দেবেন আশ্বাস দিয়েছিলেন। প্রস্তাব শুনে তিনি আমাকে বলেন, ‘আমি যদি শেরিফের পদ গ্রহণ করতে রাজি হই, আপনি তাহলে কি আন্ডার—শেরিফ হতে রাজি আছেন?

এদিকে ডেভিস অল্পদিনের মধ্যে কোর্টে বেশ নাম করে ফেললেন। একটি মামলা পরিচালনা করে তাঁর খ্যাতি আরও বেড়ে গেল। গবর্নমেন্ট এই সময় এমন একটি আইন পাশ করার চেষ্টা করছিলেন যাতে বাংলা দেশের ব্যবসায়ী—মহলের বিশেষ ক্ষতি হবার সম্ভাবনা ছিল। ব্যবসায়ীরা তাই যাতে আইনটি পাশ না হয় তার জন্য আদালতে লড়েছিলেন। তাঁদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেছিলেন ডেভিস। তাঁর চমৎকার ওকালতির জন্য মামলায় ব্যবসায়ীরাই জয়ী হন, গবর্নমেন্ট হেরে যায়। তারপর থেকে ডেভিসের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে তিনিই গবর্নমেন্টের অ্যাডভোকেট—জেনারেল নিযুক্ত হন। এই পদে এমন যোগ্যতার সঙ্গে তিনি কাজ করেন যে কোম্পানির ডিরেক্টররা খুশি হয়ে তাঁকে বেতন ও অ্যালাউয়েন্স ছাড়া একেবারে তিরিশ হাজার টাকা পুরস্কার দেন।

এই সময় বিলেত থেকে একখানি জাহাজ এসে পৌঁছয় কলকাতায় এবং চারদিকে রটে যায় যে সার এলিজা ইম্পে শীঘ্রই ইংলন্ড যাত্রা করবেন, তাঁর বিরুদ্ধে ডিরেক্টরদের কয়েকটি গুরুতর অভিযোগের উত্তর দেবার জন্য। গুজব সত্য হয়, জানুয়ারি মাসে (১৭৮৪) এলিজা ইংলন্ড যাত্রা করেন।

সা হে ব দে র এ ক টি উৎ স ব

নতুন যে বাড়ি ভাড়া করলাম কলকাতায় তা সাজাতে প্রায় বারো হাজার টাকার আসবাব লাগল। ঘর সাজানোর ভার পড়ল আমার স্ত্রী শার্লতের উপর। ১৭৮৩, সেপ্টেম্বর মাসে আমরা নতুন বাড়িতে উঠে গেলাম। এবারে একদিন ঘর—গোছানি উৎসবের (হিকি ‘Setting up Ceremony’ বলে উল্লেখ করেছেন) ঝামেলা পোয়াতে হবে বলে খুবই চিন্তিত হয়ে উঠলাম। কলকাতার সাহেবসমাজে এই উৎসবটি যে কোথা থেকে আমদানি হয়েছিল তা জানি না। সাহেবদের বিবিরা এসে যখন সংসার পেতে বসতেন তখন এই উৎসব তাঁদের করতে হত শহরের অন্যান্য বিবিদের সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য। উৎসবের সমারোহ ও আয়োজনটি বেশ উপভোগ্য। উৎসবের দিন গৃহকর্ত্রী বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর ও সুসজ্জিত ঘরে একটি চেয়ারের উপর সেজেগুজে বসে থাকেন, তার দু’পাশে থাকেন বান্ধবীরা সখীর মতন। তিনজন ভদ্রলোক সর্বদা মোতায়েন থাকেন দরজার কাছে শহরের মহিলাদের অভ্যর্থনা করার জন্য। তিনজন থাকেন কারণ প্রত্যেক মহিলার সঙ্গে দু’জন করে ভদ্রলোক আসেন। তাঁদের মধ্যে একজন এগিয়ে গিয়ে প্রথমে আগন্তুক মহিলার হাত ধরে আপ্যায়ন করে বাড়ির ভিতরে নিয়ে আসেন, বাকি দু’জন তাঁর সঙ্গী দুই ভদ্রলোককে সামলান। মহিলাকে ভিতরে এনে গৃহকর্ত্রীর সামনে নিয়ে গিয়ে নাম বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। তারপর তিনি কিছুক্ষণ সমবেত মহিলাদের মধ্যে গিয়ে বসেন, এবং মিনিট পাঁচ—দশ পরে উঠে এসে গৃহকর্ত্রীকে নমস্কার জানিয়ে বিদায় নেন। এইভাবে একজনের পর একজন আসেন ও চলে যান। এই আসা—যাওয়ার ব্যাপার সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত প্রায় ১১টা পর্যন্ত চলতে থাকে। আসারপর্ব অবশ্য একরাতেই শেষ হল না, পর পর আরও দু’রাত ধরে চলল। লৌকিকতার ব্যাপার যদি এখানেই শেষ হত, তাহলেও ভাল ছিল। কিন্তু তা হবার উপায় ছিল না। যেসব মহিলা গৃহোৎসবে আসতেন, পালা করে তাঁদের প্রত্যেকের বাড়িতে সস্ত্রীক অন্তত একবার যেতে হত।

কলকাতা শহরে ইংরেজ বাসিন্দার সংখ্যা যত বাড়তে থাকল, তত এই গৃহোৎসবের উৎসাহও কমতে আরম্ভ করল। ১৭৮৬ সনের পর থেকে এই উৎসব কলকাতা শহরে আর কেউ করেছেন বলে আমার মনে পড়ে না। তারপর থেকে শহরে নতুন সংসার পাতলে কেবল নিজেদের বন্ধুবান্ধবদের নিয়েই উৎসব করা হত।

সাং বা দি ক হি কি

এরপর হঠাৎ একদিন চিঠি পেলাম আমার সেই পুরনো মক্কেল জেমস অগাস্টাস হিকির কাছ থেকে। চিঠির উপরে দেখলাম ঠিকানা কলকাতার সেই জেলখানা। আশ্চর্য! ভদ্রলোকের কারাবাসে যেন ক্লান্তি নেই। আমি ফিরে এসেছি জেনে তিনি আবার আমাকে তাঁর সঙ্গে একবার জেলখানায় দেখা করার জন্য অনুরোধ করে চিঠি লিখেছেন। এরকম অনুরোধ, এবং এই ধরনের বিচিত্র লোকের কাছ থেকে রক্ষা না করে পারা যায় না। একদিন আমি জেলখানায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আমকে দেখেই জেমস হিকির মনের মধ্যে যার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ জমা হয়েছিল, অকথ্য ও অভদ্র ভাষার ভিতর দিয়ে সেগুলি অনর্গল বন্যার বেগে বেরুতে লাগল। অভিযোগের তাঁর অন্ত নেই। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা, তাঁর গেজেটের পৃষ্ঠায় তিনি সাহস করে সত্য কথা বলেন বলে সকলে তাঁকে, বিশেষ করে ক্ষমতাবানেরা, অন্যায়ভাবে নির্যাতন করেন।

হিকি তাঁর সুদীর্ঘ অভিযোগ সম্বন্ধে ভাষণ শুরু করলেন এইভাবে: ‘বুঝলেন হিকি সাহেব, আমার কয়েকজন শত্রু কেবল নিজেদের জঘন্য প্রতিহিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য আমাকে অন্যায়ভাবে জেলখানায় আটক করে রেখেছেন। এই শত্রুদের নেতৃস্থানীয় হলেন দুজন, গবর্নর—জেনারেল হেস্টিংস ও সুপ্রিমকোর্টের চিফ জাস্টিস সার এলিজা ইম্পে। যেমন লাটসাহেব একজন অপদার্থ জীব, তেমনি অপদার্থ তাঁর জজ।’ এইটুকু প্রস্তাবনা করে জেমস হিকি বলতে লাগলেন, এই দু’জন স্বেচ্ছাচারী শাসক ও বিচারক ন্যায়সঙ্গত আইনের দিক থেকে প্রকাশ্য আদালতের বিচারে আমাকে কিছুতেই জব্দ করতে পারছে না দেখে, অবশেষে আমার বিরুদ্ধে একটা অত্যন্ত হীন ষড়যন্ত্র ফেঁদে বসলেন। প্রথমে তাঁরা কলকাতার প্রধান শেরিফকে এই উদ্দেশ্যে হাত করলেন। উদ্দেশ্য হল শেরিফকে দিয়ে এমন বারোজন ইংরেজকে জুরি হিসেবে তিনি ঠিক করলেন, যাঁরা ন্যায়বিচারের কথা ভুলে গিয়ে তাঁরই নির্দেশ পালন করবেন। অর্থাৎ আমাকে বেশ কঠোর শাস্তি দিয়ে শায়েস্তা করবেন। তাহলে হেস্টিংস ও ইম্পের আনন্দের আর সীমা থাকবে না।

আসল ঘটনাটি এই। হিকি তাঁর পত্রিকায় হেস্টিংসের চরিত্র ও ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে এমন সব কথা এমন কুৎসিত ভাষায় লিখছিলেন যে শেষ পর্যন্ত হেস্টিংস অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে তিনটি মানহানির মামলা দায়ের করেন। প্রথম মামলা আরম্ভ হলে জুরিদের মধ্যে দু’জন হিকিকে নিরপরাধ বলে রায় দেন। পরে বারোজনই এক ঘরে বসে প্রায় ত্রিশ ঘণ্টা আলোচনার পর হিকিকে ‘not guilty’ বলে রায় দেন। রায় শুনে চিফ জাস্টিস ইম্পে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তিনি প্রকাশ্যে বলেন যে এরকম একটি অন্যায় রায় তিনি কোর্টে দলিলগত করে রাখতে অনিচ্ছুক। সেইজন্য বিষয়টি ভাল করে পুনর্বিবেচনা করার জন্য তিনি আবার জুরিদের অনুরোধ করেন। এই কথা শোনার পর জুরিদের মধ্যে টমাস লায়ন (বিখ্যাত আর্কিটেক্ট) সাহস করে বলেন, জুরির নৈতিক দায়িত্ব সম্বন্ধে খুব সচেতন হয়েই তিনি এই রায় দিয়েছেন, এবং কোনো কারণেই তা তিনি পরিবর্তন করা প্রয়োজন মনে করেন না। ইম্পের আদেশানুযায়ী জুরিরা অবশ্য কয়েক মিনিটের জন্য ঘরে গিয়ে বসলেন, কিন্তু ফিরে এসে একই রায় দিলেন। এবারে ইম্পে তা গ্রহণ না করে পারলেন না। হিকির জয় হল। ইম্পে হুকুম দিলেন, দ্বিতীয় মামলার জন্য নতুন জুরি নির্বাচন করতে। কিন্তু দ্বিতীয়বারও একজন নির্ভীক ব্যক্তির জন্য (জুরিদের মধ্যে) হিকি নিরপরাধ বলে ছাড়া পেলেন। তৃতীয় মামলাতেও তা—ই হল।

হিকি বার বার তিনবার এইভাবে মামলায় জয়ী হলেন দেখে পরবর্তী সেশনস—এ শেরিফকে দিয়ে বারোজন গবর্নমেন্টের জো—হুকুম ব্যক্তিদের জুরির জন্য সাবধানে বাছাই করে নেওয়া হল। তিনটি মামলাতেই তাঁরা হিকিকে অপরাধী বলে রায় দিলেন। চিফ জাস্টিস প্রত্যেক মামলার জন্য হিকিকে ছ’মাস করে মোট আঠারো মাস কারাদণ্ড দিলেন এবং তিন হাজার টাকা করে মোট ন’হাজার টাকা জরিমানা করলেন। কারাবাসের নির্দিষ্টকাল উতরে গেলেও জরিমানা আদায় না—হওয়া পর্যন্ত তাঁকে জেলখানায় বন্দি হয়ে থাকতে হবে বলে সার এলিজা জানিয়ে দিলেন।

হিকি বলতে লাগলেন, ‘আমার স্বাদেশিকতা ও সমাজবোধের জন্য এইভাবে আমি আজ এই জঘন্য জেলখানায় বন্দি হয়ে আছি। দেখে—শুনে মনে হয় না যে এই পৃথিবীতে কর্তব্যবোধ বলে কিছু আছে। কয়েকজন ব্রিটন (মুষ্টিমেয় কয়েকজন), এখনও যাঁরা ন্যায়বিচারবোধ জলাঞ্জলি দেননি, আমার দুঃখভোগে কাতর হয়ে তাঁরা আমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেন। তাঁরা ঠিক করেন, কলকাতা শহরে ইয়োরোপীয় অধিবাসীদের একটি সভা ডেকে আমাকে আর্থিক সাহায্য করার প্রস্তাব বিবেচনা করবেন, সকলে মিলে চাঁদা করে আমার জরিমানা ও ক্রাউন ক্লার্কের ফি দিয়ে দেবেন, এবং যতদিন না আমি মুক্তি পেয়ে আবার স্বাধীনভাবে আমার পত্রিকা প্রকাশ করতে পারি ততদিন আমার ব্যয়ভার বহন করবেন। এই উদ্দেশ্যে সভা ডাকা হল, প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হল, কিন্তু সভাস্থ মাত্র পাঁচজন লোক ভয় পেয়ে গিয়ে প্রস্তাবে আপত্তি করলেন। তাঁরা বললেন যে গবর্নর—জেনারেল ও চিফ জাস্টিসের বিরুদ্ধে তাঁরা এরকম কোনো প্রচেষ্টার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতে রাজি নন, এবং কারও রাজি হওয়া উচিত বলেও মনে করেন না। এই ধরনের আপত্তি ওঠার পর প্রস্তাবটি চাপা পড়ে যায়। তারপর প্রায় দু’বছর হল আমি এই জেলখানায় বন্দি হয়ে আছি। আমার কোনো সহায় বা সম্বল বলে কিছু নেই। জরিমানা আমার পক্ষে কোনোদিনই দেওয়া সম্ভব হবে না। অতএব জীবনের বাকি দিনগুলি এই শোচনীয় অবস্থায় আমাকে জেলখানাতেই কাটাতে হবে মনে হয়। আমি যে আর জীবদ্দশায় মুক্তি পাব, এবং স্বাধীনভাবে কোনোদিন আমার পত্রিকা প্রকাশ করতে বা কোনো স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারব, তা আশা করি না।

আমি আগেই বলেছি, হিকি একজন প্রতিভাবান লোক। কিন্তু শিক্ষাদীক্ষার অভাবে তাঁর প্রতিভা তিনি বিশেষ কাজে লাগাতে পারেননি। তা ছাড়া তাঁর মেজাজও ছিল অত্যন্ত রুক্ষ। তিনি প্রায় কথায় কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন, বিশেষ করে তাঁর কোনো কাজকর্মে পরিকল্পনায় কেউ বাধা দিলে তিনি কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। তাঁর বুদ্ধিও খুব তীক্ষ্ন ছিল। তাঁর বিচারের সময় তিনি নিজেই যেভাবে সাক্ষীদের জেরা করেছিলেন, তা একজন বিচক্ষণ উকিলের দ্বারাই করা সম্ভব। জুরিদেরও সোজা প্রশ্ন করে তিনি এমনভাবে কোর্টের সামনে তাঁদের কয়েকজনের মিথ্যা নিরপেক্ষতার মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন যে তাঁদের আর মুখ দেখানোর উপায় ছিল না। একজনকে তিনি হেস্টিংসের বন্ধু ও উমেদার বলে প্রমাণ করেছিলেন; আর—একজনকে সার এলিজার অনুগত বলে জুরির পদ থেকে তাঁর অপসারণ দাবি করেছিলেন; তৃতীয় একজনকে ঘুসখোর বলে এমনভাবে অপমান করেছিলেন যে সকলের সামনে তাঁর মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল; চতুর্থ একজনকে তিনি সরকারের বড় চাকুরে বলে জুরি হবার অযোগ্য বলে দাবি করেছিলেন। জন রাইডার নামে একজন জুরি সম্বন্ধে তিনি প্রকাশ্য আদালতে নির্ভয়ে বলেছিলেন, ‘ওই ভদ্রলোকও যখন জুরিতে বসেছেন তখন আমার আর বিচারের প্রয়োজন কী? বিচার প্রহসনমাত্র। কারণ আমি জানি ওই ভদ্রলোক আমাদের চিফ জাস্টিসের (সার এলিজার দিকে আঙুল দেখিয়ে) একজন অন্ধভক্ত ও মোসাহেব বিশেষ। এলিজা ওঁকে যা বলবেন, উনি তারই পুনরাবৃত্তি করবেন। সুতরাং বিচারের আগেই আমি নিজেকে অপরাধী বলে স্বীকার করতে রাজি আছি। মিঃ রাইডারের বিবেক বলে কিছু আছে কি না সন্দেহ। এরকম একজন দুর্নীতিপরায়ণ জঘন্য চরিত্রের লোক কদাচিৎ সমাজে দেখা যায়। মিঃ রাইডার কেবল সার এলিজার মোসাহেব নন, লেডি এলিজারও বিশেষ অনুরাগী ভক্ত। সারাদিন তিনি কলকাতা শহরের ভাল ভাল দোকানে ঘুরে বেড়ান লেডি এলিজার জন্য পোশাক—পরিচ্ছদ দেখে।’

এই কথা শুনে কোর্টের সমস্ত লোক হো—হো করে হেসে উঠলেন। আর হিকি এমন বেয়াদবের মতন কথাটা বলে ফেললেন যে সার এলিজাও কোনো জবাব দিতে পারলেন না।

৫. হিকির স্মৃতিকথা

কলকাতায় বাসা করে থিতিয়ে বসার অল্পদিনের মধ্যেই আবার আগেকার মতন আমার প্র্যাকটিস জমে উঠল। আমার মক্কেলরা আমাকে দিয়ে কাজ করিয়ে খুব খুশি হতেন, এমনকি বিপরীত পক্ষের লোকেরাও আমার উদার ও স্পষ্টবাদিতার জন্য আমাকে খুব পছন্দ করতেন। আমি সব সময় আমার অধীন কর্মচারীদের প্রতি ভদ্র ব্যবহার করতাম, কখনও তাদের অসম্মান করতাম না, অথচ মেলামেশার ব্যাপারে একটা পার্থক্য বজায় রেখে চলতাম। এই কারণে কোনো স্তরের লোকের কাছেই আমি কোনোদিন অপ্রিয় হইনি।

কলকাতায় বাসা করার জন মিসেস হিকি ও আমার জন্য দু’খানা গাড়ি কিনতে হল। মিসেস হিকির জন্য কিনলাম লন্ডনে তৈরি চ্যারিয়ট গাড়ি, তিন হাজার সিক্কা টাকা দিয়ে। আমার জন্য কিনলাম একটি ফিটন গাড়ি, আঠারোশো টাকা দিয়ে। তিনটি ঘোড়া কিনলাম ১৭৫০ টাকা দামে। তখনকার দিনে ভাল জাত—ঘোড়ার এরকমই দাম ছিল। এইসব জিনিসপত্র কেনাকাটা করতে আমাকে প্রায় হাজার চল্লিশ টাকা খরচ করতে হল। তার জন্য আমাকে বছরে শতকরা বারো টাকা করে সুদ দিতে হত। প্রায় কুড়ি বছর ধরে আমাকে এই ঋণের বোঝা বহন করতে হয়েছে।

.

ল র্ডে র ছে লে

সেপ্টেম্বর মাসে তেরো বছরের ছেলে অনরেবল ফ্রেডারিক ফিৎসরয় কলকাতায় এসে পৌঁছল। লর্ড সাউদাম্পটনের ছেলে, তাই ‘অনরেবল’ বললাম। বিরাট পরিবার নিয়ে লর্ড শেষদিকে বেশ একটু আর্থিক অসচ্ছলতার মধ্যে পড়েছিলেন। সেইজন্য তাঁর কিশোর পুত্রকে কোম্পানির সামান্য ‘রাইটার’ করে বাংলা দেশে পাঠাতে তিনি কুণ্ঠিত হননি। ছেলেটি খুব চঞ্চল ও হালকা প্রকৃতির ছিল বলে আমার নিজের খুব ভাল লাগত, কারণ কিশোর বয়সে আমিও তা—ই ছিলাম। আমি তাকে আমার বাড়ির ভোজসভায় প্রায়ই নেমন্তন্ন করতাম। কিন্তু কিছুদিন আলাপ—পরিচয়ের পর বুঝলাম যে, বাইরে থেকে তাকে যেরকম মনে হত আসলে তা সে নয়। ছেলেমানুষির মুখোশ পরে যে কোনো কুকর্ম তার পক্ষে করা সম্ভব। ছেলেটির এই পরিচয় পাবার পর থেকে আমি আর তাকে খুব বেশি পাত্তা দিতাম না বাড়িতে। শুনলাম তার মধ্যে কিছু পাগলামিরও লক্ষণ ছিল। উত্তরাধিকারসূত্রে তার মা—র কাছ থেকে সে এই উপসর্গটি পেয়েছিল। এই পাগলামির একটি ছোট ঘটনা এখানে বর্ণনা করছি।

এক ভদ্রলোক কলকাতায় পৌঁছে মেকলে নামে এক ব্যক্তির খোঁজ করতে ফিৎসরয়ের বাড়িতে এসেছিলেন। রাইটার্স বিল্ডিংসের কোয়ার্টারে তখন এঁরা সকলে একটি করে ঘর নিয়ে থাকতেন। মেকলে তখন বাসায় ছিলেন না। ভদ্রলোক ফিৎসরয়কে জিজ্ঞাসা করতে সে বলে, ‘মেকলে তো অনেক আছে, আপনি কোন মেকলেকে চান?’ ভদ্রলোক বলেন, ‘এতজন মেকলে আছেন তা আমি জানতাম না, আমার বন্ধু একজন স্কচম্যান।’ সে বলে, ‘ওই পরিচয় দিলে কি আর মেকলেকে খুঁজে পাওয়া যায়? তবে আসুন, দেখা যাক কোনো একটা উপায় খুঁজে বার করা যায় কি না। আপনি তাঁকে দেখলে চিনতে পারবেন তো?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘তা নিশ্চয় পারব।’ ‘তবে এক কাজ করুন, বাড়ির সামনে রাস্তায় চলে যান, সেখানে দাঁড়িয়ে ম্যাক—ম্যাক করে ডাক দিন। ডাক শুনে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে অনেকেই রাস্তার দিকে দেখবে, তখন আপনি আপনার মেকলেকে দেখে ফেলবেন।’ এই কথা বলে ফিৎসরয় চলে গেল। ভদ্রলোক নিশ্চয় বুঝলেন যে পাগলের পাল্লায় পড়েছেন।

কলকাতায় বাসা করার কিছুদিন পর থেকেই আমার স্ত্রী শার্লতের দ্রুত শরীর খারাপ হতে লাগল। ডাক্তার—বৈদ্য দেখিয়েও তাঁর স্বাস্থ্য ভাল করা সম্ভব হল না। তার কারণ, বাইরের সামাজিক লৌকিকতা রক্ষা করার জন্য তাঁকে এত পরিশ্রম করতে হত যে ডাক্তারের কোনো উপদেশই তাঁর পক্ষে পালন করা সম্ভব হত না। পরিচিত বন্ধুবান্ধবরা অনবরত চিঠিপত্র লিখে আমাদের নিমন্ত্রণ করতেন ও প্রতিদানে নিমন্ত্রিত হতে চাইতেন। উপহার—উপঢৌকনও তাঁদের কাছ থেকে অবিশ্রান্ত ধারায় আসতে আরম্ভ করল। অতএব প্রতি—উপহারেরও ঝক্কি বাড়ল অনেক। সব ঝক্কিটাই প্রায় শার্লতেকে একলাই সামলাতে হত। মধ্যে মধ্যে বন্ধুপত্নীরা বাড়ি চড়াও করে তাঁকে বাজারে কেনাকাটা করার জন্য ধরে নিয়ে যেতেন। অসুস্থ শরীরে এত ঝঞ্ঝাট ও উপদ্রব তাঁর পক্ষে সহ্য করা কঠিন হয়ে উঠল। স্বাস্থ্যও তাঁর ক্রমে ভেঙে পড়তে লাগল।

.

চী না বা জা রে র ক থা

শ্রীমতীর একদিনের বাজার করার অভিজ্ঞতার কথা আমার মনে আছে। জনৈকা বন্ধুপত্নীর সঙ্গে তিনি একদিন কলকাতার চীনাবাজারে বাজার করতে গিয়েছিলেন। চীনাবাজারে তখন বাঙালিদের অনেক দোকান ছিল, বাজারে গিয়ে তাঁর সঙ্গিনী একটির পর একটি দোকান ঘুরে জিনিসপত্র একেবারে তছনছ করে ফেললেন, কিন্তু একটি পয়সারও জিনিস কিছু কিনলেন না। দোকানদাররা অত্যন্ত বিরক্ত হল, শার্লতেও আদৌ খুশি হননি। অবশেষে দোকানদারদের কাছে সম্মান বাঁচাবার জন্য শার্লতে কয়েকটি বিলিতি রিবন কেনেন। ব্যাপারটা আমি কিছুদিন পরে জানতে পারলাম, যখন ব্যবসায়ী গোপী দে—র তরফ থেকে অ্যাটর্নি হ্যামিলটন চিঠি লিখে জানালেন যে, দু’টুকরো রিবনের জন্য তাঁর ক্লায়েন্টের বত্রিশ সিক্কা টাকা অবিলম্বে দিতে হবে, আরও পাঁচ টাকা তাঁর চিঠির খরচসহ। তা না দিলে সুপ্রিমকোর্টে ওই টাকার জন্য আমার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।

চিঠি পেয়ে আমি একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম; সামান্য টাকার জন্য একজন খুদে ব্যবসায়ীর এই উকিলের চিঠি লেখার ঔদ্ধত্য আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারলাম না। পাওনা টাকার সঙ্গে আমি অ্যাটর্নিকে অত্যন্ত কড়া ভাষায় তাঁর চিঠির একটি জবাবও পাঠিয়ে দিলাম। হ্যামিলটনের চিঠিখানি আমি কোর্টের জজ, অ্যাডভোকেট ও অন্যান্য অফিসারদের সকলকে দেখালাম। সকলেই তাঁর চিঠির খুব নিন্দা করলেন, এবং স্বীকার করলেন যে এরকম চিঠি লেখা গোপী দে ও তাঁর অ্যাটর্নির পক্ষে খুবই অন্যায় হয়েছে। হ্যামিলটন অবশ্য পরে খুব লজ্জিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন, কিন্তু আমি তাঁকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারিনি। অ্যাটর্নি হিসেবে হ্যামিলটন কর্নেল ওয়াটসনের খুব প্রিয় ছিলেন। তা হলেও আমি সব সময় এরপর থেকে তাঁকে এড়িয়ে চলতাম।

যা—ই হোক, ইতিমধ্যে শার্লতের ক্রমেই স্বাস্থ্যহানি হতে লাগল, এবং বোঝা গেল অসুখ বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। ১৭৮৩ সনে ইংলন্ডে থেকে ফিরে আসার পর আমি পূর্বের জুরি—কমিটির কাছে আমার কিছু পাওনা টাকার জন্য চিঠি লিখলাম। বিলেতে কমিটির তরফ থেকে আবেদনপত্রটি পার্লামেন্টে পেশ করে তদারক করে আমি নিজে বেশ কিছু টাকা খরচ করেছিলাম। কর্নেল ওয়াটসন আমার দাবি সমর্থন করেন, কিন্তু কর্নেল পিয়ার্স, মিঃ শোর ও অন্যান্য সকলে সমর্থন করেননি। ব্যক্তিগত কারণে নয়; অন্য কারণে।

আমাকে বাধ্য হয়ে তাই সুপ্রিমকোর্টে আবেদন করতে হল। আবেদন করার আগে আমি আমার কাউন্সেলকে সমস্ত ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করলাম। ইংলন্ড যাবার দু’মাস আগে থেকে কীভাবে কমিটিকে সাহায্য করেছি, ইংলন্ডে গিয়ে কীভাবে আমি রেকর্ডকিপার ও কোর্টের অন্যান্য কর্মচারীদের খরচ জুগিয়েছি, নানাবিধ প্রয়োজনীয় দলিলপত্র সংগ্রহ করার জন্য, এবং কীভাবে আবেদনটি পার্লামেন্টে যথাযথভাবে উত্থাপন ও পরিচালনা করার জন্য নিজে মেহনত করেছি, সেসব কথা তাঁকে গুছিয়ে বললাম। যে টাকা আমি কমিটির কাছে চেয়েছি, খুঁটিয়ে দাবি করলে তার চেয়ে অনেক বেশি চাইতে পারি। বিবরণ শুনে কাউন্সেলও তা—ই বললেন। অতএব আমার খরচপত্রের ও ন্যায্য পারিশ্রমিকের একটি বিস্তারিত বিল তৈরি করে আমি সুপ্রিমকোর্টে ফাইল করে দিলাম। এ ছাড়া আমার আর অন্য কোনো উপায় ছিল না। শুভাকাঙ্ক্ষীরাও তা—ই পরামর্শ দিলেন। জুরি—কমিটির বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে আমাকে মামলা করতে হল। কিছুদিন পরে সালিশী নিযুক্ত করে আমার মামলার নিষ্পত্তি করা হল, কমিটির কাছ থেকে তিন হাজার সিক্কা টাকা আমি পেলাম।

স্ত্রী বি য়ো গ

এদিকে আমার স্ত্রী শার্লতের স্বাস্থ্য ক্রমেই খারাপ হতে থাকল। ডাক্তারেরা পরামর্শ দিলেন, কিছুদিন তাঁকে নিয়ে নদীর বুকে বেড়াতে, যদি হাওয়া বদলের ফলে কোন উপকার হয়। বেশ বড় একটি নৌকা তার জন্য ভাড়া করে সাজিয়ে—গুছিয়ে নিলাম। ৭ ডিসেম্বর নৌকা করে বেরিয়ে পড়লাম বজবজের দিকে। সেখানে আমার এক বন্ধু থাকতেন, তিনি আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা করলেন। প্রথম দিনটা বেশ ভালই কাটল, শার্লতের স্বাস্থ্যেরও যেন একটু উন্নতি হল বলে মনে হল। কিন্তু তার পরের দিন থেকে তাঁর স্বাস্থ্যের এত দ্রুত অবনতি হতে থাকল যে আমি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। পাঁচ দিনের দিন সকালে তাঁকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে এলাম।

কলকাতায় ফিরে আসার সপ্তাহখানেকের মধ্যে ডঃ স্টার্ক বললেন যে তাঁর বাঁচবার সম্ভাবনা খুব কম বলে তিনি মনে করেন। বাস্তবিক তারপর থেকে প্রতিদিন তিনি মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যেতে লাগলেন। অবশেষে ক্রিসমাসের দিন এল, ২৫ ডিসেম্বর। সকালে উঠে শার্লতের একবার ম্লানদৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে দেখলেন। কথা বলার আর শক্তি নেই তখন, ক্ষীণসুরে আমাকে কাছে ডাকলেন। হাত তোলার আর ক্ষমতা নেই। তবু কম্পমান হাত দু’টি তুলে আমার গলা জড়িয়ে ধরে, মুখটি মুখের কাছে টেনে নিয়ে চুম্বন করে কানে কানে বললেন, ‘দুঃখ কোরো না, ঈশ্বরের কথা চিন্তা করো, তাঁর প্রতি বিশ্বাস রেখো, শান্তি পাবে।’ তার কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তার বললেন, শার্লতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। এক মুহূর্তের মধ্যে আমার চারিদিকের সমস্ত বিশ্বসংসার থেকে যেন আলো নিভে গেল। মর্মান্তিক বিচ্ছেদ—বেদনার অগাধ অন্ধকারে আমি তলিয়ে গেলাম। কোনো সান্ত্বনাই ভাল লাগছিল না। চেনা ঘরবাড়ি, চেনা মুখ, চেনা পরিবেশ, সবই আরও তীব্রভাবে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল আমার শার্লতেকে। টলফ্রে মস ও অন্যান্য বন্ধুবান্ধবরা সকলে আমাকে কিছুদিনের জন্য কলকাতা ছেড়ে বাইরে যেতে বললেন।

আমার বন্ধু রবার্ট পট তখন বর্ধমানে ছিল। সে আমাকে অবিলম্বে সেখানে যাবার জন্য অনুরোধ করে চিঠি লিখল। তার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে মিলেমিশে থাকলে আমার মনের ভার কিছুটা কমতে পারে ভেবে ৩০ ডিসেম্বর বর্ধমান যাত্রা করলাম। পরদিন সকালে বর্ধমান পৌঁছলাম ব্রেকফাস্টের সময়। পট আমাকে নানাভাবে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল। নানা কাজ ও নানা পরিবেশের ভিতর দিয়ে সে আমার সর্বক্ষণের একমুখী চিন্তাকে ভিন্নমুখী করবার ব্যবস্থা করল। বর্ধমান থেকে দূরে নানা জায়গায় আমরা বেড়াতে যেতাম। নানা রকমের লোকজন ও প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতাম। বর্ধমান টাউন থেকে প্রায় মাইল বারো দূরে পট শিকার করার জন্য চমৎকার একটি বাংলো তৈরি করেছিল। তার সঙ্গে প্রায়ই যেতে হত সেখানে। শিকারেও সঙ্গী হতে হত। মানুষের সান্ত্বনার চেয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের এই সান্ত্বনায় সত্যিই আমার মনের ভার কমেছিল অনেক।

অ প রা ধী র বি চা র

১৪ জানুয়ারি ১৭৮৪ একজন নীচজাতের লোককে খুনের অপরাধে বিচার করা হয়। কোনো ধনিক হিন্দু পরিবারের ছ’বছরের একটি বালককে বাড়ির দরজার কাছ থেকে ভুলিয়ে ছোট একটা গলির ভেতর নিয়ে গিয়ে লোকটি তার গলা কেটে ফেলে এবং তার ধড়টিকে ভার বেঁধে (যাতে ভেসে না ওঠে) পাশের পুকুরে ফেলে দেয়। এই বর্বর শিশুহত্যার প্রধান উদ্দেশ্য হল ছেলেটির পায়ের মল, হাতের বালা ও গলার হার ছিনিয়ে নেওয়া। এ দেশের অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলেমেয়েদের বাল্যকালে নানারকম গহনা পরিয়ে রাখা হত। এত বড় অপরাধ করে স্বভাবতই লোকটি কোর্টে দাঁড়িয়ে স্বীকার করল যে সে দোষী। কিন্তু চেম্বার্স অকারণে আইনের সূক্ষ্ম বিচারের কথা ভেবে ওইভাবে দোষ স্বীকার না করে বিতর্কের সুযোগ নিতে বললেন। বিচারকের এই অনুরোধ শুনে লোকটি কেমন যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘বেশ; তাহলে আমি দোষী নই।’

জুরির একটি প্যানেল ঠিক করা হল। শুনানি চলতে লাগল। লোকটি যে সত্যিই খুন করেছে তা প্রমাণ করতে কোনো অসুবিধা হল না। অবশেষে আসামিকে জিজ্ঞাসা করা হল, তার কিছু বক্তব্য আছে কি না। সে উত্তর দিল, ‘আমার আর কী বলবার থাকতে পারে। আমি ছেলেটিকে খুন করেছিলাম। শয়তান আমাকে দিয়ে এই কাজ করিয়েছিল। আমি মহা অপরাধ করেছি, এবং আমি জানি সেজন্য আমাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে। সবই আমার অদৃষ্ট, এতে কারও কিছু করার নেই। বিচার আপনারা ঠিকই করেছেন।’

যথারীতি কোর্ট—ক্লার্ক যখন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাকে যদি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়, তাহলে কি তোমার কিছু বলার আছে?’ লোকটি বেশ বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল, ‘না মশায়, কিছুই বলবার নেই। কেন অনর্থক ঘ্যানর ঘ্যানর করে বিরক্ত করছেন। আপনাদের মতন এমন অদ্ভুত বিচার আমি দেখিনি। আমি বলছি আমি খুন করেছি, আর আপনারা আমাকে দিয়ে বলাতে চান যে আমি খুন করিনি। তারপর আইনের নানারকম কসরত দেখিয়ে ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত জাহির করতে চান। আপনাদের বিচারের উপদ্রবে আমি প্রায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। অনুগ্রহ করে আপনাদের বিচারের পালা শেষ করুন, এবং আমাকে এই জঘন্য কাঠগড়া থেকে মুক্তি দিন।’

তা সত্ত্বেও মধ্যরাত্রের আগে বিচারের পালা শেষ হল না, কারণ আইনের বাতিকগ্রস্ত রবার্ট চেম্বার্স কেবল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সাক্ষীদের নামের বানান এবং তাঁদের প্রত্যেকটি কথার ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। অবশেষে খুনি আসামির মৃত্যুদণ্ড হল। পরদিন সোমবার সকালে ঠিক হল তাকে ফাঁসি দেওয়া হবে।

মর্স আমাকে অনুরোধ করলেন, পরদিন ফাঁসির জায়গায় যথাসময়ে উপস্থিত হবার জন্য। আমি তা—ই উপস্থিত হলাম। ফাঁসির জায়গায় উপস্থিত হয়ে দেখলাম মঞ্চ তৈরি করা হচ্ছে। মঞ্চে ওঠার আগে শেরিফ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মৃত্যুর আগে তোমার যদি কিছু বাসনা থাকে তো বলো।’ লোকটি তখন নির্বিকারচিত্তে উত্তর দিল, ‘বাসনা আমার বিশেষ কিছু নেই। আমার প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে, দয়া করে এখন কিছু খেতে দিন। জেলখানায় আপনারা আমাকে প্রায় না খাইয়ে রেখেছেন। লোকটির কথা শুনে আমরা সকলে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। শেরিফের মুখ দিয়ে দেখি কথা বেরুচ্ছে না, তিনি বোবা হয়ে গেছেন। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে যে ব্যক্তি ফাঁসিকাঠে ঝুলে প্রাণ দেবে তার খিদে পেলেও তা যে এমনভাবে প্রকাশ করা সম্ভব, কেউ তা কল্পনা করতে পারেনি। কিন্তু ওই স্থানে তখন কোনো খাদ্য সংগ্রহ করা একেবারেই সম্ভব ছিল না। শেরিফ ও তাঁর সঙ্গীরা খাদ্যের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন দেখে লোকটি গম্ভীরভাবে বলল, ‘আপনারা অকারণে আমার জন্য এত ব্যস্ত হবেন না। খাবার না—পাওয়া গেলে আর কী করবেন। খাদ্যের প্রতি আমার কোনো লোভ নেই। তবে আপনারা জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমার কী ইচ্ছা আছে, আমি তাই উত্তর দিয়েছিলাম যে আমার খিদে পেয়েছে, কিছু খেতে দিন। কিন্তু খাবার যখন পাওয়া যাচ্ছে না তখন আর দরকার নেই।’

খাদ্যসমস্যার এইভাবে যখন সমাধান হয়ে গেল তখন মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ফাঁসির মঞ্চের তক্তাটিও সরিয়ে নেওয়া হল তার পায়ের তলা থেকে, এবং লোকটি দড়িতে ঝুলতে লাগল।

চি ত্র ক র ট মা স হি কি

ফেব্রুয়ারি মাসে হেস্টিংস—পত্নী মাদাম ইমহফ কোম্পানির জাহাজে করে কলকাতা ছেড়ে ইয়োরোপ চলে গেলেন। মার্চ মাসে আর—এক তৃতীয় হিকির সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। এঁর নাম টমাস হিকি। ইনি একজন বিখ্যাত চিত্রকর, পোর্ট্রেট—পেন্টার। হিকি বাংলা দেশে এলেন মূর্তিচিত্রের কাজ করবেন বলে। চিত্রকরের পেশা গ্রহণ করে তিনি কলকাতায় বেশ প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন। তাঁকে দেখার পর থেকে আমার আরও বেশি করে শার্লতের কথা মনে হতে লাগল। একদা যখন আমি ও টমাস হিকি লিসবনের এক হোটেলে একসঙ্গে থাকতাম, তখন কতদিন যে শার্লতের কয়েকটি পোর্ট্রেট আঁকা সম্বন্ধে তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে তার ঠিক নেই। টমাস হিকি কলকাতার সবচেয়ে অভিজাত পল্লিতে খুব বড় একটি বাড়ি ভাড়া নিলেন। সেখানে ঠিকঠাক হয়ে বসে তিনি শার্লতের একটি পোর্ট্রেট আঁকবেন বলে স্থির করলেন। পূর্ণাকার পোর্ট্রেট। তাঁর আঁকা শেষ হলে আমাকে অবশ্য ছবিটি পুরো দু’হাজার সিক্কা টাকা দিয়ে কিনে নিতে হল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, শার্লতের চেহারার সঙ্গে অনেক দিক থেকে সাদৃশ্য থাকলেও পোর্ট্রেটটি আমার খুব ভাল লাগেনি।

ম দ্য পা ন

শার্লতের মৃত্যুর পর থেকে স্বভাবতই আমার জীবনের ধারা খানিকটা বদলে গেল। স্রোতের মুখে কিছুটা গা ভাসিয়ে দিলাম। মদ খেয়ে বেশ গরম না হয়ে বিছানায় শুতে পারতাম না। ঘুম আসত না চোখে। মধ্যে মধ্যে অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে নিজের জ্ঞান হারিয়ে ফেলতাম, এবং চেষ্টা করতাম এইভাবে শার্লতের স্মৃতি ভুলে থাকতে। ক্রমে ক্রমে মদ্যপান আমর রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেল। কলকাতায় তরুণ ইংরেজ কর্মচারীরা তখন কতকটা হাত—পা ছেড়ে দিয়ে মদ্যপান করতেন। তাঁরা আমার সান্ত্বনার উৎস সন্ধানে সবচেয়ে উৎসাহী সুরাসঙ্গী হয়ে উঠলেন। সুতরাং সুরাপানের অভ্যাস হতে খুব বেশি দেরি হল না। টাকা জলের মতন রোজগার করতে লাগলাম বটে, কিন্তু দেনাপত্তর শুধে তাতেও আমার কুলোত না। ঋণের সুদ মিটিয়ে আমার খরচটা চলে যেত বলে টাকা নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতাম না। অর্থাৎ টাকার কথা চিন্তা করে জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন কখনও বোধ করিনি। গড়ে প্রতি মাসে আমার রোজগার ছিল প্রায় তিন হাজার সিক্কা টাকা। খরচও ছিল তাই। শহরের মধ্যে তখন আমারই চালচলন ও খানাপিনা ছিল সবচেয়ে শৌখিন। সবচেয়ে দামি ফরাসি মদ ও পুরনো মদিরা আমারই খানা টেবিলে নিয়মিত সাজানো থাকত। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আমার কাজের ডেস্কে বসা পর্যন্ত সময়টুকু আমার কাছে খুবই অসহ্য বলে মনে হত। একা একা বসে যখন ব্রেকফাস্ট খেতে হত তখন শার্লতের কথা মনে হত আরও বেশি। চারদিকে ঘরকন্নার সমস্ত জিনিসপত্রের উপর তাঁর হাতের স্পর্শ অনুভব করতাম। সমস্ত বাড়িটাতেই যেন তাঁর হাত—পায়ের ছাপ লেগে রয়েছে মনে হত। শার্লতের স্মৃতির এই দুঃসহ বোঝা নিয়ে এ বাড়িতে থাকা যে আর সম্ভব নয়, তা বুঝতে পারলাম। অন্তত বারো মাস থাকার কড়ার করে বাড়িওয়ালির কাছ থেকে বাড়িটা ভাড়া নিয়েছিলাম। কিন্তু তার আগেই ছেড়ে যেতে হবে বলে তাঁকে কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হলাম। তিনিও তাতে আপত্তি করলেন না। আমি এসপ্ল্যানেডের কাছে গঙ্গার ধারে সুন্দর একটি খোলামেলা বাড়ি ভাড়া করলাম। আরামে বাস করার মতন এত সুন্দর অঞ্চল কলকাতাতে আর নেই। নতুন বাড়িতে গিয়ে খুব দ্রুত আমার স্বাস্থ্যের উন্নতি হল।

এই সময় ইয়োরোপ থেকে আমদানি খাদ্যের ও পানীয়ের বেশ অভাব হয়েছিল কলকাতায়। অবশ্য তার চাহিদাও বেড়েছিল খুব, এবং সেই অনুপাতে জিনিসের আমদানি হচ্ছিল না। তাই ইয়োরোপীয় জিনিসের দাম বেড়ে গিয়েছিল খুব। হ্যাম ও চিজ পাঁচ সিক্কা টাকা করে পাউন্ড বিক্রি হত। ক্ল্যারেট পাওয়াই যেত না, যা পাওয়া যেত তা ৬৫.০০ টাকা করে ডজন বিক্রি হত। আমাদের অবশ্য তার বিশেষ অভাব ছিল না। ডেনমার্ক থেকে আমাদের এক বন্ধু জাহাজে করে প্রচুর ক্ল্যারেট নিয়ে এসেছিল। তার কাছ থেকে আমি পুরো দুটি চেস্ট কিনে মজুত করে রেখেছিলাম।

এপ্রিল মাসে আমার বন্ধু জেমস গ্র্যান্ট বাংলা দেশে এসে উপস্থিত হলেন। যেদিন তিনি এলেন সেইদিন রাত্রেই তাঁকে একটি ক্লাবের তরফ থেকে বিরাট একটি ভোজ দিয়ে অভ্যর্থনা করা হল। আমিও সেই ক্লাবের একজন সভ্য ছিলাম। লন্ডনে তাঁর সঙ্গে কোনো কারণে আমার এমন একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যে কলকাতায় আসার পর তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসতে আমি তেমন উৎসাহ বোধ করছিলাম না। ক্লাবের ভোজসভায় গিয়ে ভেবেছিলাম কোনোরকমে পাশ কাটিয়ে চলে যাব। কিন্তু তা হল না। ভোজ আরম্ভ হবার ঠিক আগেই গ্র্যান্ট আমার কাছে এগিয়ে এসে একেবারে দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে করমর্দন করে বললেন, ‘কী মশায়, কেমন আছেন? আমাকে কি ভুলে গেলেন নাকি? না, আগেকার রাগ আপনার এখনও কমেনি? আমার উপর রাগ করা কিন্তু আপনার অন্যায়। আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন। আমাদের দু’জনেরই পরিচিত এক ব্যক্তি আমাদের বন্ধুবিচ্ছেদের জন্য পরস্পরের কাছে কুৎসা রটনা করেছে। সুতরাং মিথ্যা ধারণা নিয়ে আমার উপর রাগ করে থাকবেন না। আগেকার কথা ভুলে যান। আসুন, আবার আমরা পুরনো দিনের মতো বন্ধু হয়ে যাই।’

এই কথার পর আমার পক্ষে রাগ করে থাকা সম্ভব হল না। আবার আমাদের পুরনো বন্ধুত্ব আমরা ফিরে পেলাম। এবার আমি একদিন তাঁকে আমার বাড়িতে ডিনার খেতে বললাম। সেইদিন কলকাতার সব সেরা সাহেবদেরও নেমন্তন্ন করলাম। নিমন্ত্রিত অতিথিদের ইংলিশ ক্ল্যারেট খাওয়াবার ইচ্ছা হল। কলকাতার বাজারে তখন তা একেবারে দুর্লভ। ‘বাক্সটার অ্যান্ড জয়’ নামে বড় একজন ইয়োরোপীয় ব্যবসায়ীর কাছে খোঁজ করতে ইংলিশ ক্ল্যারেটের সন্ধান পেলাম। শুনলাম কয়েকজন বাছাই খদ্দেরের জন্য কিছু মাল তিনি মজুত করে রাখেন। সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, তাঁরা আমাকেও একজন বাছাই খদ্দের মনে করেন। আমি তাঁদের কাছ থেকে তিন ডজন ক্ল্যারেট পেলাম। সাধারণত এর অর্ধেকও কোনো বিশিষ্ট খদ্দেরকে তাঁরা দেন না। নেহাত ভাগ্যের জোরে আমি পেয়ে গেলাম।

ভোজের দিন সকালবেলা আমি আমার খানসামাকে বলে রাখলাম রাতে খাবার সময় অতিথিদের ইংলিশ ক্ল্যারেট দিতে। দু’দিন আগে দোকান থেকে যে ক্ল্যারেট নিয়ে এসেছি, তাই দিতে হবে বলে ভাল করে বুঝিয়ে দিলাম। রাতে ভোজের সময় দেখলাম অতিথিরা ক্ল্যারেট পান করে একেবারে হইহল্লা করে প্রশংসা করছে। ‘এ মাল কোথায় পেলেন’ বলে সকলে রীতিমতো চিৎকার শুরু করে দিয়েছেন। আমি তখন চুপচাপ বসে পান করছিলাম। পান করার সময় গন্ধ পেয়ে আমার মনে হল ডাচ ক্ল্যারেট পান করছি। ভাবলাম, খানসামা হয়তো ভুল করে ইংলিশের বদলে ডাচ ক্ল্যারেট দিয়েছে। কিন্তু কথাটা আর তখন ফাঁস করলাম না। খানসামা যখন প্লেট তুলছিল তখন কাছে পেয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি কোন ক্ল্যারেট দিয়েছিলে, ইংলিশ না ডাচ?’ খানসামা উত্তর দিল, ‘না সাহেব। আগে ডাচ ক্ল্যারেট দিয়েছি, এবারে খানার শেষে ইংলিশ ক্ল্যারেট দেব।’ তার উত্তর শুনে আমি একটু বিরক্তই হলাম।

যা—ই হোক, যা হবার তা হয়ে গেছে। এবারে ইংলিশ ক্ল্যারেট দিতে বললাম। কিন্তু দেওয়া মাত্রই অতিথিরা সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘হিকি সাহেব, আপনার খানসামা আগেকার মাল বদলে দিয়েছে।’ আমি বললাম, ‘বদলে যখন দিয়েছে তখন নিশ্চয়ই আরও দামি ও ভাল মাল, আপনারা পান করে আরও আরাম পাবেন।’ বলামাত্রই তাঁরা সকলে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘না না মশায়, মাল ভাল না, দরকার নেই আমাদের দামি মাল খেয়ে, আপনি আমাদের আগেকার মাল দিতে বলুন।’ আমি তাঁদের কথায় বিশেষ বিচলিত হলাম না, কারণ আমি জানতাম যে তাঁদের ইংলিশ ক্ল্যারেটই দেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁরা তা বুঝতে পারবেন বলে তাঁদের ধৈর্য ধরতে বললাম। দ্বিতীয়বার তাঁদের ওই ক্ল্যারেটই দেওয়া হল। এবারেও খেয়ে তাঁরা ওই মত দিলেন। অর্থাৎ তাঁদের মতে ডাচ ক্ল্যারেটই অনেক বেশি সুস্বাদু ও সুগন্ধি। তাঁদের কথার আর প্রতিবাদ না করে আমি বললাম, ‘খুব ভাল কথা, আপনাদের রুচিজ্ঞান সম্বন্ধে আমার কিছু বলবার নেই। তবে এইটুকু শুধু বলতে চাই যে আপনারা যে ক্ল্যারেট খেয়ে মুগ্ধ হয়েছেন তা ১৮ টাকা ডজন হিসেবে কিনেছি। আর যার নিন্দা করলেন তা কিনেছি ৬৫ টাকা করে ডজন।’ কিন্তু সত্যিকারের সমঝদার লোকের সংখ্যা যে কত অল্প তা বুঝলাম যখন দেখলাম, দাম শোনামাত্রই কয়েকজন ইংলিশ ক্ল্যারেটের সপক্ষে মৃদুস্বরে গুণগান করতে আরম্ভ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন যে ইংলিশ ক্ল্যারেটের একটা এমন আলাদা স্বাদ আছে যা ডাচের নেই, তবে তা ধরতে পারা খুব সহজ ব্যাপার নয়। দু’চারজন আগেই তা বুঝতে পেরেছিলেন, কিন্তু সকলের মতের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারেননি। আমি আর তাঁদের কথার কোনো জবাব দিলাম না। কে যে কত বড় বোদ্ধা তা মনে মনেই বুঝলাম।

ক ল কা তা র থি য়ে টা র

১৭৮৩ সনে বাংলা দেশে ফিরে আসার পর ফ্রান্সিস র‍্যান্ডেল নামে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। আমি যখন বিলেতে ছিলাম, র‍্যান্ডেল তখন কোম্পানির অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জেন হয়ে কলকাতায় আসেন। বয়স তাঁর বছর পঁচিশ, কিন্তু দেখলে মনে হয় তাঁর দ্বিগুণ বয়স, লম্বাচওড়া চেহারার জন্য। মুখশ্রী অত্যন্ত সুন্দর, চোখগুলি টানাটানা, কণ্ঠস্বর গম্ভীর। চোখের চাউনিতে মনের ভাব চমৎকারভাবে প্রকাশ করতে পারেন, ইংলন্ডের বিখ্যাত অভিনেতা গ্যারিককেও মধ্যে মধ্যে হার মানিয়ে দেন। কণ্ঠস্বর গম্ভীর হলেও তাতে এমন মিষ্টি সুর আছে যে শুনলে মোহিত হয়ে যেতে হয়। এইসব গুণের সমন্বয় দেখে মনে হত, যেন অভিনয় করার জন্যই তাঁর জন্ম হয়েছে। ধীরে ধীরে তাঁরও সেই কথা মনে হল। সার্জেনের চাকরি থেকে মনটা গিয়ে পড়ল স্টেজের উপর। ভাল অভিনেতা হবার ইচ্ছা হল তাঁর। ইচ্ছাটা যে তাঁর কলকাতাতেই প্রথম জাগল তা নয়, তার আগে স্বদেশে ইংলন্ডেও জেগেছিল। ইংলন্ডে তিনি অনেক থিয়েটার করেছেন, এবং অভিনেতা হিসেবে অ্যামেচার মহলে তাঁর বেশ সুনামও হয়েছিল। কিন্তু অভিনয়টাকে পেশা করার ব্যাপারে তাঁর পরিবারের সকলের বিশেষ আপত্তি ছিল। সেইজন্য তিনি সার্জারি পড়তে আরম্ভ করেন, এবং কোম্পানির সহকারী সার্জেনের চাকরি নিয়ে এ দেশে চলে আসেন।

র‍্যান্ডেল যখন কলকাতায় আসেন তখন শহরে বেশ বড় একটি পাবলিক থিয়েটার সকলে চাঁদা দিয়ে চালাতেন। কিন্তু এই সময় থিয়েটারের ভদ্রলোক অভিনেতাদের মধ্যে, কার কোন চরিত্র অভিনয়ের যোগ্যতা আছে তা—ই নিয়ে ভয়ানক গণ্ডগোল বেধে গেল। প্রত্যেকেই চান নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে, কারণ প্রত্যেকেরই ধারণা যে তিনিই সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। ঝগড়া এমন স্তরে পৌঁছল যে শেষে ডুয়েল পর্যন্ত গড়িয়ে গেল। তার ফল হল এই যে থিয়েটারের জন্য আর অভিনেতাই পাওয়া যেত না। অভিনয়ের পোশাক—পরিচ্ছদের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়েছিল। ব্যয়বাহুল্যের জন্য প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা দেনা হয়ে গিয়েছিল থিয়েটারের।

কলকাতায় আসার কিছুদিন পরেই র‍্যান্ডেল থিয়েটারের মালিকদের কাছে প্রস্তাব করেন যে তিনি তার সমস্ত দায়িত্ব নিতে পারেন, যদি তাতে তাদের কোনো আপত্তি না থাকে। যেখান থেকে যেরকম করে হোক তিনি অভিনেতা সংগ্রহ করবেন, এবং নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, এই চার মাস অন্তত সপ্তাহে একটা করে নতুন নাটক অভিনয়ের ব্যবস্থা করবেন। তা ছাড়া মালিকরা যদি তাঁকে প্রত্যেক বক্সের জন্য এক সোনার মোহর এবং প্রত্যেক সিটের আট সিক্কা টাকা মূল্য দর্শকদের কাছ থেকে আদায় করতে দেন, তাহলে তিনি থিয়েটারের সমস্ত ঋণও শোধ করে দেবার দায়িত্ব নিতে পারেন এবং কখনও কোনো কারণে মালিকদের কাছে আর টাকা চাইবেন না বলে কথাও দিতে পারেন। র‍্যান্ডেলের কাছ থেকে এই প্রস্তাব পেয়ে থিয়েটারের মালিকরা একটি সভা ডেকে বিষয়টি আলোচনা করেন, এবং থিয়েটারের সমস্ত দায়িত্ব র‍্যান্ডেলকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আলাদা একটি চুক্তিপত্র করে র‍্যান্ডেলকে থিয়েটারের ভার অর্পণ করা হয়। থিয়েটার পরিচালনার ভার নিয়ে র‍্যান্ডেল তাঁর কাছেই একটি সুন্দর বাড়িতে বাস করতে থাকেন।

র‍্যান্ডেলের সুদক্ষ পরিচালনায় দিন দিন থিয়েটারের উন্নতি হতে থাকল। থিয়েটার আগেও হত, কিন্তু র‍্যান্ডেলের তত্ত্বাবধানে ক্রমে তার যে রূপান্তর ঘটতে থাকল, কলকাতা শহরের অধিবাসীদের কাছে তা অভিনব ও অপ্রত্যাশিত। র‍্যান্ডেলের মতন পরিচালক ও অভিনেতা আগে কেউ ছিলেন না। যেমন তাঁর চেহারা, তেমনি স্বভাবচরিত্র। একবার কেউ তাঁর কাছে এলে ছাড়তে পারতেন না। তাই আগে যাঁরা থিয়েটার থেকে দূরে থাকতেন, সহজে কাছে যে ঘেঁষতে চাইতেন না, তাঁরা অনেকেই তাঁর অধীনে থিয়েটারে যোগ দিলেন। কার কী কাজ বা অভিনয় করার যোগ্যতা আছে তা নিয়ে আর বিবাদ হত না। র‍্যান্ডেলের বিচারবুদ্ধিকেই সকলে শ্রেষ্ঠ বলে মেনে নিতেন। বাইরের অনেক ভদ্রলোক তাঁর কাছে অভিনয় শিক্ষা ও স্টেজের নানাবিধ পরামর্শের জন্য আসতেন। র‍্যান্ডেলের পরিচালনায় কলকাতার রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ভঙ্গি ও মঞ্চশিল্প দুয়েরই যথেষ্ট উন্নতি হল।

উন্নতির প্রথম লক্ষণরূপে দেখা গেল থিয়েটারের দর্শকসংখ্যা অনেক বেড়েছে। যে কোনো নতুন নাটকের অভিনয় শুরু হলে থিয়েটার হলে দর্শকদের জায়গা দেওয়া সম্ভব হত না। এইভাবে থিয়েটারের আয় বেড়ে যাবার ফলে র‍্যান্ডেল অল্পদিনের মধ্যেই আগেকার ঋণ সব শোধ করে ফেললেন। মুনাফার অনেকটা অংশ তিনি নিজেও ভোগ করতেন। তবে সবটা নিজে গ্রাস করে না ফেলে তিনি তার খানিকটা অংশ অন্যান্য অভিনেতা ও স্টেজকর্মীদের ভাগ করে দিতেন। অভিনয়ের জন্য যাঁর যা পোশাকের দরকার হত, তাঁকে তা তিনি যত পয়সাই লাগুক কিনে দিতেন। শুধু তা—ই নয়, অভিনয় শেষ হবার পর সেই রাত্রে তিনি অভিনেতাদের ভূরিভোজন করাতেন, এবং ক্ল্যারেট, স্যাম্পেন বা বর্গান্ডি দিয়ে আপ্যায়ন করতে কুণ্ঠিত হতেন না। কেউ কেউ দেখতাম এই রাজকীয় অভ্যর্থনায় আত্মবিস্মৃত হয়ে রাতভোর পর্যন্ত বসে বসে সুরাপান করতেন। এই ভোজের জন্য আমি দেখেছি র‍্যান্ডেলকে ৮০ সিক্কা টাকা ডজন মূল্যে শ্যাম্পেন কিনতে। র‍্যান্ডেলের নিজেরও অনেকদিন থেকে সুরার প্রতি গভীর আসক্তি ছিল। সুরাপানের অভ্যাসও তাঁর দীর্ঘকালের। সুতরাং তরুণ অভিনেতাদের সুরাপ্রেমিক করে তুলতে তাঁর বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি বাংলা দেশের তরুণ উড্ডীয়মান ইংরেজদের মধ্যে একজন অদ্বিতীয় জনপ্রিয় ব্যক্তি হয়ে উঠলেন।

কেবল মঞ্চাধ্যক্ষ হিসেবেই র‍্যান্ডেল একজন কৃতী ব্যক্তি ছিলেন না। অভিনয়কলাতেও তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিল। তখন কলকাতা শহরে তাঁর সমস্তরের অভিনেতা আর কেউ ছিলেন না। আমার মনে আছে একবার উইলয়াম বার্ক তাঁর শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’ অভিনয় দেখে আমাকে বলেছিলেন যে সব দিক থেকেই র‍্যান্ডেলকে ইংলন্ডের অন্যতম অভিনেতা গ্যারিকের সমকক্ষ বলতে তাঁর কোনো দ্বিধা নেই। বার্কের মতন একজন বিচক্ষণ ব্যক্তির মতামত নিশ্চয় উপেক্ষণীয় নয়। কেবল ‘হ্যামলেট’ অভিনয় নয়, ‘কিং লিয়ার’; ‘ওথেলো’; ‘রিচার্ড দি থার্ড’ প্রভৃতি অভিনয়েও র‍্যান্ডেল অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তবে আমার ধারণা, ‘ওথেলো’র অভিনয়ে তিনি কখনও গ্যারিকের উপরে উঠতে পারেননি।

কলকাতা শহরে থিয়েটারের সাফল্যে র‍্যান্ডেল রীতিমতো উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। ইংলন্ড থেকে অভিনেতা ও অভিনেত্রী দুইই তিনি এ দেশে নিয়ে আসার জন্য উদযোগী হলেন। তখন কলকাতার রঙ্গমঞ্চে মহিলা অভিনেত্রী কেউ ছিলেন না। পুরুষরাই দাড়ি—গোঁফ কামিয়ে নারীর ভূমিকায় অভিনয় করতেন। যে সময়ের কথা বলছি সেই সময় মিঃ ব্রাইড ও মিঃ নরফার নামে দু’জন সুদর্শন ভদ্রলোক স্ত্রী চরিত্রের অভিনয় করে খুব সুনাম অর্জন করেছিলেন। কিন্তু তাহলেও নারীর ভূমিকায় পুরুষের অভিনয় যত সুদক্ষই হোক, তা কখনও স্বাভাবিক হতে পারে না। দর্শকদের মনে কলকাতার মঞ্চাভিনয় সম্পর্কে এইদিক থেকে একটা মস্ত বড় অভাব ছিল। র‍্যান্ডেল এই অভাব পূরণ করে দিয়ে কলকাতার থিয়েটারের ইতিহাসে এক নতুন যুগ প্রবর্তন করেন। ইংলন্ড থেকে তিনি কয়েকজন মহিলা অভিনেত্রী নিয়ে আসেন। তাঁরা প্রথম শ্রেনির না হলেও, দ্বিতীয় শ্রেনির অভিনেত্রী নিশ্চয়ই। কলকাতার রঙ্গমঞ্চে তাতেই একটা হইচই পড়ে যায়। কয়েকজন পুরুষ অভিনেতাও এই সময় ইংলন্ড থেকে আসেন।

আমার প্রকৃতির সঙ্গে র‍্যান্ডেলের সাদৃশ্য ছিল অনেক। সেইজন্য তাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বও বেশ গভীর হয়েছিল। প্রায় প্রত্যেক দিনই কয়েকটি ঘণ্টা করে আমি তাঁর সঙ্গে কাটাতাম। সুরাপানে মত্ত হয়ে অনেক সময় তিনি একটু অতিরিক্ত হই—হল্লা করতেন। তা—ই করে তিনি নিজের একটি হাত ও পা একেবারে জখম করে ফেলেছিলেন।

হে য়া র ড্রে সা র

আমার আইরিশ বন্ধু ক্যাপ্টেন হেফারম্যান এই সময় বোম্বাই থেকে কলকাতায় এসে বাস্তবিকই এমনভাবে আমার চুল ড্রেস করে দিত যে কলকাতা শহরে আমার মাথার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে।

ফ্রেস্কিনিকে নিয়ে একবার একটি সুন্দর ঘটনা ঘটেছিল, এখনও আমার মনে আছে। ঘটনাটি এই। শার্লতের মৃত্যুর কয়েকদিন পরের কথা। সারারাত না ঘুমিয়ে বিছানায় ছটফট করে বেলা প্রায় সাতটা আন্দাজ উঠে চুপ করে বারান্দায় বসে আছি। গায়ের লম্বা কোটটা মুড়ি দিয়ে নানা রকমের কথা ভাবছি। এমন সময় একটি চাকর এসে খবর দিল, কে একজন অপরিচিত ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। আমার শরীর ও মন কোনোটাই সেদিন ভাল ছিল না। তাই চাকরটিকে বললাম, তুমি গিয়ে তাঁকে বলো যে আজ আমার পক্ষে দেখা করা সম্ভব হবে না, আর—একদিন আসতে। চাকরটি ফিরে এসে বলল যে ভদ্রলোক আমাকে ঠিক দু’টি কি তিনটি কথা বলে চলে যাবেন, একেবারেই বিরক্ত করবেন না। এই কথা শোনার পর বাধ্য হয়ে আমাকে নিচে যেতে হল। ভদ্রলোক দেখা হওয়ামাত্রই খুব অনুনয় করে বললেন, ‘আমি খুব লজ্জিত, আপনাকে বিরক্ত করলাম। একটা কথা শুধু জানতে এসেছি, আপনার কি একদিন সময় হবে আমার বাড়িতে এসে একজন মহিলার একটু কেশচর্যা করে দিতে?’ এতক্ষণে আসল রহস্যটা উদ্ঘাটিত হল। বুঝলাম, ভদ্রলোক আমার হেয়ারড্রেসার ফ্রেস্কিনির খোঁজে এসেছেন, এবং আমাকে তা—ই মনে করে কথাবার্তা বলছেন। আমি কিছু না বলে একটি নমস্কার করে চলে এলাম। যাবার সময় বললাম, আমি আমার চাকরকে বলে দিচ্ছি, সে ফ্রেস্কিনিকে ডেকে দেবে। প্রায় এক ঘণ্টা পরে একখানা চিঠি পেলাম ভদ্রলোকের কাছ থেকে। ভদ্রলোকের নাম জেমস ক্রকেট। লন্ডনের একজন নামকরা বোহেমিয়ান, আমি চিনি। উচ্ছৃঙ্খল জীবন কাটিয়ে লন্ডনে এত ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন যে পাওনাদারদের ভয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি কোম্পানির একটা চাকরি নিয়ে এ দেশে চলে আসতে বাধ্য হন। তারপর অবশ্য অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। আমাকে একজন ইটালিয়ান হেয়ারড্রেসার মনে করে তিনি যে ভুল করেছিলেন তা নিয়ে আমরা প্রায়ই ঠাট্টাবিদ্রুপ করতাম।

বে নি য়া ন বা বু র র স বো ধ

এবারে শিল্পী টমাস হিকিকে নিয়ে সত্যিই আমি খুব বিব্রত হয়ে পড়লাম। তিনি আমার বাড়িতে রোজ ঘোরাফেরা করতে আরম্ভ করলেন, আর—একটি পোর্ট্রেট আঁকতে চান। শার্লতের পূর্ণাকৃতি চিত্রের পাশে যদি আমারও একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র না থাকে তবে নিতান্তই বেমানান হয় বলে তিনি বারংবার আমাকে প্ররোচিত করছিলেন। কিন্তু আমি তো বিলক্ষণ জানতাম যে তাঁর একটি পোর্ট্রেট মানে হল দু’হাজার সিক্কা টাকা। অবশেষে উপরোধে ঢেঁকি গেলার মতন এই টাকা দিয়ে ছবি আমাকে আঁকাতেই হল। আঁকা শেষ হবার পর প্রথমে আমি আমার বাঙালি বেনিয়ানবাবুকে ছবিটা দেখালাম। মতামত জিজ্ঞাসা করতে ছবির আপাদমস্তক কয়েকবার চোখ বুলিয়ে তিনি বললেন, ‘Yes, picture like master, but where watch?’ ‘ছবি তো সার ঠিক মাস্টারের মতই হয়েছে, কিন্তু ঘড়িটা কোথায় গেল?’

বেনিয়ানবাবুর দোষ নেই। ছবি, বিশেষ করে পোর্ট্রেট বলতে তখন বোঝাত, কেবল চেহারার নয়, পোশাক—পরিচ্ছদেরও নিখুঁত প্রতিলিপি। আমি তখন বেশ ঝকঝকে একটি সোনার হার শিলমোহরসহ বুকে ঝুলিয়ে রাখতাম। ছবিতে এই হারটি ছিল না, তাই বেনিয়ানবাবুর মনে হয়েছিল খুঁত আছে। আমি ইয়োরোপে অনেক সমঝদারের মুখেও ছবি সম্বন্ধে এই ধরনের সমালোচনা শুনেছি। সাদৃশ্য দিয়েই তাঁরা ছবির শ্রেষ্ঠতা বিচার করতেন। সেক্ষেত্রে একজন বাঙালি বেনিয়ানের আর দোষ কী!

ফে ন উ ই ক সা হে বে র মে লা

এডওয়ার্ড ফেনউইক নামে তখন কোম্পানির একজন উচ্চপদস্থ সিবিলিয়ান ছিলেন কলকাতায়। মে মাসে প্রায় প্রত্যেক বছরই গার্ডেনরিচে তাঁর বাগানবাড়িতে তিনি একটি চমৎকার মেলার আয়োজন করতেন। কয়েক হাজার লাল নীল রঙিন বাতি দিয়ে বাগান সাজানো হত। লখনউ থেকে বিখ্যাত আতশবাজদের আনা হত বাজির উৎসবের জন্য। নানা রকমের সং সেজে পোশাক পরে লোকজন আসত মেলায়, কেউ কেউ তাদের বিচিত্র পোশাকের সঙ্গে মুখোশও পরত। বাগানের চারদিকে তাঁবু খাটানো হত। তাঁবুর তলায় টেবিল সাজিয়ে দেওয়া হত নানা রকমের খাদ্য ও পানীয় দিয়ে। প্রায় তিনশো লোকের খানা এইভাবে টেবিল সাজিয়ে রাখা হত। এ ছাড়া বিশাল বাগানবাড়ির প্রায় প্রত্যেক ঘরে প্রচুর পরিমাণে মজুত থাকত। বাদকের দল থাকত বাগানের নানা স্থানে, মধ্যে মধ্যে তারা সামরিক কায়দায় বাজনা বাজিয়ে অতিথি ও দর্শকদের উৎসাহিত করত। নর্তকীরা থাকত বাজনার তালে তালে নৃত্যের ভঙ্গিমায় সকলের মনোরঞ্জনের জন্য। কেবল বাগানটি নয়; কলকাতা থেকে গার্ডেনরিচ যাবার শেষের দু’মাইল রাস্তা দু’দিকে দু’বার করে আলো দিয়ে সাজানো হত। তাতে দিবালোকের মতন পরিষ্কার দেখাত সব। কোনোদিক দিয়েই ফেনউইক সাহেব তাঁর এই গ্রাম্য উৎসবের সমারোহের আদৌ কোনো ত্রুটি করতেন না।

সেবার মেলা হল খুব সুন্দর আবহাওয়ার মধ্যে। সাধারণত বছরের এই সময়টাতে দক্ষিণে হাওয়ার জোর থাকে খুব বেশি এবং প্রায়ই প্রবল ঝড় হয়। সে বছর তা হয়নি। শহরের অন্যান্য সব গণ্যমান্য ভদ্রলোকের মতন আমি একটি মেলার নিমন্ত্রণের কার্ড পেয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেইদিনই আবার আমি একজনকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম আমার বাড়িতে খাবার জন্য। খাবার সময় কতকটা বেহিসেবির মতন সুরাপান করে ফেলে আমার অবস্থা রীতিমতো কাহিল হয়ে গিয়েছিল। অবস্থা খুব শোচনীয় দেখে বন্ধুবান্ধবরা সকলেই আমাকে ফিটনের বদলে চ্যারিয়টে চড়ে যেতে বললেন। দু—একজন তাঁদের চ্যারিয়টে আমাকে একটি সিটও দিতে চাইলেন। নিজে ফিটন চালিয়ে গেলে আমি যে নিশ্চিত একটি দুর্ঘটনা ঘটাব, এই তাঁদের ভয় হল। আমি কিন্তু তাঁদের কথায় কর্ণপাত করলাম না। ঠিক করলাম নিজেই ফিটন চালিয়ে যাব। অবশেষে ফিটনে উঠে বসলাম, এবং লাগাম হাতে নিয়ে আমিরি স্টাইলে ঘোড়া ছোটালাম। সহিস বা মশালচি কাউকেই সঙ্গে নিলাম না। ঘোড়া ছুটল জোর—কদমে। মেলার পথে গার্ডেনরিচের দিকে যাত্রীর ও গাড়ির ভিড় ছিল খুব। আমার ফিটন সকলকে ছাড়িয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল। কোনো দুর্ঘটনা ঘটল না। কর্নেল ওয়াটসনের ডকের প্রাচীরের কাছে এসে আমার হঠাৎ মনে হল ঘোড়াগুলো যেন একটু বেশি জোরে ছুটছে। মনে হতেই লাগাম টেনে ধরলাম, ঘোড়াও আস্তে চলতে আরম্ভ করল।

এইভাবে বেশ আস্তে আস্তে ট্রট করে চলছি, এমন সময় দেখলাম আর—একটি গাড়ি আমাকে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, গাড়ির মধ্যে দু’জন ভদ্রমহিলা ও একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। ভদ্রমহিলাদের দেখে স্বভাবতই আমার সৌজন্যবোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। আমার নিজের গাড়িটা রাস্তার পাশ করে তাঁদের বেরিয়ে যাবার পথ করে দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সৌজন্য দেখাতে গিয়ে বিপদ ঘটল আমার। গাড়ি পাশ করতে গিয়ে ঘোড়া দুটো ফিটনটাকে ঠেলে নিয়ে গিয়ে তুলল একটা গাছের গুঁড়ির উপর। একটা পুরনো বাড়ির জীর্ণ দেয়াল ভেদ করে গাছটি ঠেলে উঠেছিল। আমি হঠাৎ ধাক্কায় একেবারে হুমড়ি খেয়ে কামানের গোলার মতন ছিটকে পড়লাম। মাথাটা তিরের মতন গিয়ে মাটিতে পড়ল, এবং মুখের একটা দিকের চামড়া অনেকটা ছড়ে গেল। কিন্তু অতিরিক্ত ক্যারেট পানের জন্য আমার বিশেষ সাড় ছিল না বলে এতটা আঘাত পেয়েও আমি কিছু বুঝতে পারিনি। তাই দুর্ঘটনার কথা আদৌ চিন্তা না করে, গাড়ি ও ঘোড়া ফেলে রেখে, আমি ফেনউইক সাহেবের বাগানবাড়ির দিকে টলতে টলতে এগুতে থাকলাম।

যখন মেলায় পৌঁছলাম, তখন আমার চেহারা যে কীরূপ ধারণ করেছে, সে সম্বন্ধে আমার চেতনাই ছিল না। আমার পরনে ছিল নীল রঙের সিল্কের একটি জামা। গাড়ি থেকে আছাড় খেয়ে পড়ার পর তার উপর ছোপ লেগেছিল ভাঙা ইটের গুঁড়োর। গাল দিয়ে রক্তের যে ধারা গড়িয়ে পড়েছিল, তারও গাঢ় লাল রংটি এর সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। সব মিলে সত্যিই একটি রংচঙে সং হয়ে উঠেছিলাম আমি। ভিতরে রং, বাইরেও রং। রংবেরঙের আলোর মেলায় উপস্থিত হয়ে মনে হল আমিই যেন আদর্শ ‘দর্শক’। ফেনউইকের আসল ঘরটিতে পৌঁছতেই উপস্থিত অতিথিবৃন্দ আমাকে এই অবস্থায় দেখে ভয়ে ও বিস্ময়ে হইহই করে উঠলেন। তাঁরা অনেকেই আমাকে চিনতেন বলে এতখানি অবাক হয়েছিলেন। কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ আমার মতন একজন রুচিবাগীশ লোক এরকম ক্লাউনের মতন উন্মত্ত অবস্থায় এসে এখানে হাজির হবে, এ কথা তাঁরা কল্পনাও করতে পারেননি। সকলে চেয়ার—টেবিল ছেড়ে হইচই করে এসে আমাকে ঘিরে ধরে নানারকম প্রশ্ন করতে লাগলেন। কোথায়, কখন ও কেন আমার এই শোচনীয় অবস্থা হল, সকলের মুখে ঘুরিয়ে—ফিরিয়ে সেই একই প্রশ্ন। এর মধ্যে তাঁরা আমাকে সেবাশুশ্রূষাও করতে আরম্ভ করলেন। মুখের ক্ষতস্থান ভাল করে ধুয়ে তার উপর সাদা কাপড় জড়িয়ে দেওয়া হল দেখলাম। এতক্ষণে মনে হল ভদ্রলোকের সামনে দাঁড়াবার মতন অবস্থা হয়েছে আমার। আগেকার মূর্তি নিয়ে কতকটা চেনাপরিচিত ভদ্রলোক সামনে উপস্থিত হতেই তাঁদের যে অবস্থা দেখলাম তাতে মনে হয় মহিলাদের সামনে উপস্থিত হলে তাঁরা হয়তো আঁতকে উঠে চিৎকার করতেন অথবা অজ্ঞান হয়ে যেতেন। সকলে মিলে অনেক বুঝিয়ে আমাকে বিছানায় শুইয়ে রাখবার চেষ্টা করলেন, এবং আমোদ—প্রমোদে যোগ দিলে ক্ষতি হবে বলে উপদেশ দিলেন। আমি কিন্তু তাঁদের উপদেশ ও অনুরোধ রক্ষা করতে পারলাম না। বললাম, ফেনউইক সাহেবের মেলায় কলকাতা শহরের এতসব অপ্সরা—উর্বশীর সমাগম হয়েছে, তাঁরা নড়েচড়ে নেচে—গেয়ে বেড়াচ্ছেন, আর আমি তাঁদের না দেখে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কড়িকাঠ গুনব, তা কখনোই সম্ভব নয়। অতএব আমোদে ও প্রমোদে আমি যোগদান করবই, কারও বাধা বা আপত্তি শুনব না। তা—ই হল, খানাপিনা বা হল্লা কোনোটাই বাদ দিলাম না। খানা টেবিলে আমাদের মতন মজাদার ও মেজাজি সঙ্গী বাস্তবিকই কলকাতা শহরে তখন দুর্লভ ছিল। আমার সাহচর্যে সকলেই তাই পানভোজনে রীতিমতো মেতে উঠলেন, এবং আমার ঠাট্টা—রসিকতায় হাসির ফোয়ারা ছুটতে লাগল। কিন্তু তাঁরা সেদিন আমাকে আর বেশি পান করতে দেননি। ঘণ্টা তিন—চারের মধ্যে আমার নেশা অনেকটা কেটে গেল, আমি সুস্থ হয়ে উঠলাম।

অনেক রাতে আমার গাড়িটা ও ঘোড়া দুটোর কথা মনে হল। ফেনউইকের ভৃত্যদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, তারা কোনো খোঁজ পেয়েছে কি না। তাদের কাছ থেকে শুনলাম, জেনারেল স্টিবার্ট রাস্তায় পরিত্যক্ত অবস্থায় আমার গাড়িঘোড়া দেখতে পান, এবং তাঁর লোকজনদের দিয়ে ঠিকঠাক করে ফেনউইক সাহেবের বাড়িতে নিয়ে আসেন। তিনি ভেবেছিলেন, গাড়ির মালিক বা যাত্রীকে নিশ্চয়ই মেলাতে পাওয়া যাবে। গাড়ি থেকে নিচে পড়ার সময় ঝাঁকুনি খেয়ে আমার ঘড়ির চেনের সঙ্গে লাগানো কয়েকটি মোহর ছিঁড়ে পড়ে যায়। তার মধ্যে একটি মোহর ছিল আমার অত্যন্ত প্রিয়; ১৭৬৮ সনে আমি যখন প্রথম ক্যাডেট হয়ে ভারতবর্ষে আসি তখন আমার ভাই জোসেফ আমাকে উপহার দিয়েছিল। মোহরটি দেখতে চমৎকার, টুকটুকে লাল পাথরের উপর এনগ্রেভ করা।

ফেনউইকের অতিথিদের পানভোজনের জের কাটিয়ে উঠতে রাতভোর হয়ে বেলা সাতটা বেজে গেল। তা—ই দেখে অনেকে একেবারে ব্রেকফাস্ট খেয়ে ফিরবেন স্থির করলেন। তাঁদের মধ্যে আমিও একজন। বেলা ন’টার সময় আমি আমার ফিটন হাঁকিয়ে শহরের দিকে যাত্রা করলাম। ফেরার পথে যখন দুর্ঘটনার স্থানটিতে পৌঁছলাম, তখন আমার সঙ্গীটিকে বললাম যে গাড়ি থামিয়ে আমি আমার হারানো মোহরটি ভৃত্যদের দিয়ে খুঁজে দেখব। শুনে তিনি উপহাস করলেন। প্রায় পঞ্চাশ ফুট চওড়া একটা রাস্তার মধ্যে ধুলো ঘেঁটে ছোট মোহর কুড়িয়ে পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার কিন্তু ধুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ একটা ভাঙা টাইলের টুকরোর মতন কী দেখা গেল। ধুলো ঝেড়ে দেখলাম, আমার সেই হারিয়ে যাওয়া মোহরটি। আমার একজন খিদমতগার সেটি কুড়িয়ে নিয়ে এসে আমাকে দেখাতে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। যেমন আগে পরতাম, তেমনি আজও আমি সেই মোহরটি পরে থাকি। এটি আমার সব সময়ের সঙ্গী বললেও ভুল হয় না।

৬. হিকির স্মৃতিকথা

সেশনস—এর বিচার আরম্ভ হল গ্রীষ্মকালে, জুন মাসে। তারিখ পড়ল ১০ জুন (১৭৮৪ সন)। সকাল ৮টায় কোর্ট বসবে, জুরিদেরও তা—ই জানানো হয়েছে। অন্যান্য বিচারকরা ও জুরিরা সকলেই সময়মতো কোর্টে এসেছেন, কেবল সার রবার্ট আসেননি। সব ব্যাপারেই তিনি অত্যন্ত ঢিমেতালে চলেন, এবং দু’চার ঘণ্টা পর্যন্ত দেরি হওয়া তাঁর পক্ষে আদৌ অস্বাভাবিক নয়। বেলা একটা নাগাদ তিনি এসে পৌঁছলেন, নির্দিষ্ট সময়ের পাঁচ ঘণ্টা পরে। জুরিদের শপথ করিয়ে তাঁদের মামলা বুঝিয়ে দিতে বেলা তিনটে বেজে গেল। তারপর আর বিচার আরম্ভ করা যায় না বলে সেদিনের মতন শুনানি মুলতুবি রইল।

র বা র্ট চে ম্বা র্স

পরদিন সকল ন’টার সময় হাইড ও জোন্স কোর্টে উপস্থিত হলেন, এবং জুরিদের শপথগ্রহণের কাজ শেষ করে আসামিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখে চেম্বার্সের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। কারণ, রীতি হল, চিফ বা সিনিয়র জজ উপস্থিত না থাকলে বিচারের কাজ আরম্ভ হতে পারে না। জাস্টিস হাইড ও উইলিয়াম জোন্স চুপ করে চেয়ারে বসে হাত কচলাতে লাগলেন। বেলা যখন এগারোটা বেজে গেল তখন হাইড রীতিমতো বিচলিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে রবার্টের কাছে চিঠি লিখতে বসলেন। তিনি লিখলেন, ‘আমি ও জোন্স সাহেব বেলা ন’টা থেকে কোর্টে এসে বসে আছি, বেলা এগারোটা পর্যন্ত আপনার দেখা নেই। অনুগ্রহ করে জানান, কোর্টে আসা আপনার পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে কি না।’ চাপরাশি দিয়ে রবার্টের বাড়ি পাঠাবেন বলে চিঠিখানা যখন তিনি ভাঁজ করছিলেন, ঠিক সেই সময় তিনি এসে উপস্থিত হলেন। হাইডের হাতে ভাঁজ করা চিঠিখানা দেখে রবার্ট একগাল হেসে বললেন, ‘ব্রাদার হাইড, আমি যখন এসেই পড়েছি তখন অত দূরে কষ্ট করে চিঠি পাঠাবার আর দরকার নেই। ওটা এবারে ছিঁড়ে ফেলুন।’ হাইড গম্ভীর সুরে উত্তর দিলেন, ‘ছিঁড়ে লাভ কী বলুন, আবার তো কালকেই দরকার হবে।’

চেয়ারে উপবেশন করে সার রবার্ট প্রথমে তাঁর প্রাইভেট মিনিট—বুকে জুরিদের নাম লিখতে লাগলেন। নামের তালিকা করতে এক ঘণ্টা কেটে গেল। তারপর কাঠগড়ায় আসামির দিকে চেয়ে তিনি বললেন যে আজ তার বিচারের দিন নয়, অন্য একজন সিঁধেল চোরের বিচারের দিন। অবশেষে সেই চোরটিকে এনে হাজির করা হল। এতেও বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। তারপর যা শুরু হল তা আরও চমৎকার। আসামির নাম জিজ্ঞাসা করাতে সে বেশ কায়দা করে উচ্চারণ করে বলল ‘পিটার কার্ল’। আসামি জাতিতে আইরিশম্যান শুনে রবার্ট তার নামের ভাষাতাত্ত্বিক রহস্য সম্বন্ধে কৌতূহলী হয়ে উঠলেন, এবং এ বিষয়ে উইলিয়াম জোন্সকে কাছে পেয়ে নানারকম প্রশ্ন করে উত্ত্যক্ত করে তুললেন।

রবার্ট। ‘আচ্ছা মিঃ জোন্স, নামের বানানটা কি তাহলে K দিয়ে হবে, না C দিয়ে হবে?’

জোন্স। ‘K দিয়ে কেন হবে বুঝতে পারছি না, C দিয়েই তো হওয়া উচিত।’

রবার্ট। ‘উচ্চারণ তাহলে কী হবে?’

জোন্স। ‘CARLL—সার্ল।’

রবার্ট। ‘আপনি তো আইরিশ ভাষা জানেন?’

জোন্স। ‘আজ্ঞে হ্যাঁ জানি।’

রবার্ট। ‘বেশ, বেশ! তাহলে অনুগ্রহ করে বলুন, এ নামের অর্থ কী?’

জোন্স। ‘অর্থ আর কী? নামের অর্থ নাম; অর্থাৎ কার্ল মানে কার্ল। এ ছাড়া আর কী অর্থ হতে পারে, বুঝতে পারছি না।’

দুই বিচারকের এই প্রশ্নোত্তরে আদালতগৃহের লোকজন সকলে হো—হো করে হেসে উঠলেন। সার রবার্ট কিন্তু তাতে আদৌ বিচলিত হলেন না। হাইডের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে তিনি বললেন, ‘আজ ১৬ জুন, ওয়েস্টমিনস্টার ও ইংলন্ডের অন্যান্য পাবলিক স্কুল আজকের তারিখ থেকে গ্রীষ্মের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। সেই পুরনো স্মৃতি আমার মনে পড়ছে।’

হাইড। ‘তা—ই নাকি? আপনার স্মৃতিশক্তির তারিফ না করে পারা যায় না।’ হাইডের কথার সঙ্গে একটু বিরক্তি ও বিদ্রুপের সুর মেশানো ছিল।

সার রবার্টের মতন একজন বিচক্ষণ বিচারক যে আদালতে বসে এরকম অবিবেচকের আচরণ করতে পারেন, সামনের কাঠগড়ায় আসামিকে দাঁড় করিয়ে রেখে; তা কল্পনাই করা যায় না। তাঁর মতন একজন অসাধারণ পণ্ডিতের চরিত্রে এই বালসুলভ চাপল্য মোটেই খাপ খেত না। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত স্কলার ও ডাইনেরিয়ান প্রফেসর ছিলেন। খামখেয়ালি হলেও সমস্ত ছোটখাটো কাজ এত নিখুঁতভাবে তিনি করতেন যার সত্যি কোনো তুলনা হয় না। সামান্য কিছু একটু লিখতে হলে তিনি প্রত্যেকটি কথার অর্থ যাচাই করে ব্যবহার করতেন। একই অর্থবোধক বিভিন্ন শব্দ লিখে নিয়ে, জনসন ও অন্যান্যদের অভিধান দেখে বিচার করে, তিনি তার মধ্যে একটিমাত্র তিনি শব্দ নির্বাচন করতেন। এটা তাঁর এক রকমের বাতিক ছিল, যে কোনো ভাব প্রকাশের জন্য সঠিক শব্দপ্রয়োগের বাতিক। তাঁর একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু এইজন্য রবার্টের কথা উঠলে তাঁকে পাণ্ডিত্যের দিক দিয়ে অভিধানের সঙ্গে তুলনা করে বলতেন অভিধান বটে, কিন্তু পাতাগুলি এলোমেলো করে সাজানো এবং অক্ষরবিন্যাসেও গণ্ডগোল। অর্থাৎ, এমন অভিধান যার অবিন্যস্ত পৃষ্ঠা ও অক্ষরের ভিতর দিয়ে কোনো শব্দের বা তার অর্থের হদিশ পাওয়া কঠিন। সার রবার্ট সম্বন্ধে সত্যিই এ কথা বলা চলে। চরিত্রের দৃঢ়তা ও চিন্তার সংযমের অভাবে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য সমুদ্রের মতন গভীর না মনে হয়ে, গহন অরণ্যের মতন পথশূন্য মনে হত।

জা স্টি স হা ই ড

সার রবার্টের চরিত্রের এত দোষত্রুটি সত্ত্বেও জাস্টিস হাইড তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর প্রতি গভীর অনুরাগও ছিল হাইডের, যা অবশ্য সকলের ছিল না। চেম্বার্সের মতন হাইডের চরিত্রেও অনেক অসঙ্গতি ছিল। হাইড ছিলেন উদারপ্রকৃতির হৃদয়বান ব্যক্তি, কিন্তু এমন কতকগুলি চারিত্রিক দুর্বলতা তাঁরও ছিল যার জন্য তিনি অনেকবার বিপদে পড়েছেন। অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ হওয়া সত্ত্বেও মধ্যে মধ্যে ঝোঁকের মাথায় এমন সব কাজ তিনি করে বসতেন যার মধ্যে কোনো বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যেত না। তাঁর গৃহের দ্বার সর্বদাই সকলের পানভোজনের জন্য উন্মুক্ত থাকত। পানের জন্য নানা রকমের দামি মদ, এবং ভোজনের জন্য উপাদেয় সব খাদ্যদ্রব্যও মজুত থাকত তাঁর ঘরে। স্বভাবতই তার আকর্ষণে অতিথি ও বন্ধুবান্ধবদের ভিড় হত খুব তাঁর বাড়িতে। বিনা পয়সায় সুরাপানের সুযোগ এবং তার সঙ্গে বিবিধ চর্বচোষ্য আহারের সুবিধা, কে না গ্রহণ করতে চাইবে বলুন? সপ্তাহে দু—তিন দিন করে এমন সব লোক আসতেন, যাঁদের ভাগ্যে বছরে একটি ডিনারের নিমন্ত্রণও জোটার কথা নয়। হাইডের উদার আতিথেয়তার অপব্যবহার করতেন এইভাবে সকলে। কত লোককে যে তিনি মাসিক ভাতা দিতেন তার হিসেব নেই। প্রতি মাসে একশো টাকা থেকে দু’তিন টাকা পর্যন্ত মাসোহারা পায়, এরকম অভাবগ্রস্ত লোকের সংখ্যা যে তাঁর তালিকায় কত হয়েছিল তা বলা যায় না। যে যেরকম লোক তার সেরকম মাসোহারার ব্যবস্থা ছিল। এইজন্য বছরে ৮০০০ পাউন্ড স্টার্লিং তাঁর বেতন বা আয় হওয়া সত্ত্বেও তিনি টাকায় কুলোতে পারতেন না। টাকার টানাটানি তাঁর সর্বদাই লেগে থাকত। দশ বছর ভারতবর্ষে বাস ও চাকরি করার পর তিনি দেখলেন যে দেনায় তিনি ডুবে গিয়েছেন। এত দেনা তাঁর হয়েছিল তা শোধ করার জন্য বিলেতের পৈতৃক সম্পত্তি বেচে তাঁকে প্রায় ১২,৫০০ পাউন্ড স্টার্লিং, অর্থাৎ প্রায় এক লক্ষ সিক্কা টাকা নিয়ে আসতে হয়। এইরকম তাঁর দয়াদাক্ষিণ্যের বহর ছিল। বাস্তবিকই জাস্টিস হাইডের মতন হৃদয়বান ব্যক্তি তখনকার কালের কলকাতা শহরে খুবই দুর্লভ ছিল।

এবারে তাঁর উদারতার ও হঠকারিতার কয়েকটি কাহিনি উল্লেখ করব। টমাস মট (Thomas Motte) নামে একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী ছিলেন। শোনা যায় সারা এশিয়ার মধ্যে তাঁর মতন বড় ব্যবসায়ী দু’চারজন ছিলেন কি না সন্দেহ। একবার একটি বড় কারবারে অনেক টাকা নিয়োগ করে তাঁর লোকসান হয়ে যায়। টাকার দায়ে এবং জেল খাটার ভয়ে তিনি ব্রিটিশ এলাকা ছেড়ে ফ্রেডারিকনগরে (শ্রীরামপুর) ভ্যানিশদের অধীনে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। আর্থিক দুরবস্থাও তাঁর এমন চরমে পৌঁছয় যে বন্ধুবান্ধবদের সাহায্য ছাড়া তাঁর পক্ষে বাঁচাই মুশকিল হয়ে ওঠে। একজন ধনিক ব্যবসায়ী হঠাৎ এই ভাগ্যবিপর্যয়ে পরিচিত সকলেই তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন। তাঁরা প্রস্তাব করেন যে কয়েকজন বন্ধু মিলে চাঁদা তুলে মটকে মাসিক অর্থসাহায্য করা হোক। প্রস্তাবকারীদের মধ্যে জাস্টিস হাইডও ছিলেন। তাঁরই ইচ্ছায় মটের শ্যালক পিটার টুচেট প্রস্তাবটি কাজে পরিণত করার ভার নেন। তিনি ঠিক করেন যে মাসিক ৬০০ টাকা হলেই চলবে এবং তার জন্য ছ’জন বন্ধুর কাছ থেকে ১০০ টাকা করে তিনি চাইবেন। প্রথমে নিজের নামের পাশে ১০০ টাকা তিনি লিখে রাখেন। দ্বিতীয় বন্ধু জন হলডেনও তা—ই করেন। তারপর চাঁদার খাতা যখন হাইড সাহেবের কাছে যায়, তিনি তাঁর নামের পাশে ২০০ টাকা লিখে দেন। চতুর্থ ব্যক্তি পিটার স্পিকের কাছে যখন চাঁদার জন্য যাওয়া হয় তখন তিনি হাইডের টাকার অঙ্ক দেখে তার পাশে লিখে মন্তব্য করেন: ‘ছ’জন বন্ধু যখন সমানভাবে সাহায্য করবেন ঠিক হয়েছে, তখন হাইড সাহেবের বেশি টাকা দেওয়া অর্থহীন।’ ব্যাপার হল, পিটার স্পিকের তখন দানধ্যানে খ্যাতি ছিল যথেষ্ট। হাইড তাঁর উপর টেক্কা দিয়ে যাবেন, এ বোধহয় তাঁর সহ্য হল না। যা—ই হোক, মন্তব্যসহ যখন চাঁদার খাতা পুনর্বার হাইড সাহেবের কাছে নিয়ে যাওয়া হল, তখন তিনি তা দেখে রীতিমতো ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। যার উপর তিনি ক্রুদ্ধ হতেন, তাকেই ‘গর্দভ’ বলা তাঁর অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্পিকের মন্তব্য দেখেও তা—ই বললেন তিনি। তারপর যে ব্যক্তি খাতা নিয়ে এসেছিল তাকে বললেন, ‘আপনি ফিরে গিয়ে মিঃ স্পিককে বলবেন যে অনেক টাকার ব্যাপার নিয়ে অকারণে তাঁর মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। আমার টাকা যেভাবে খুশি খরচ করার স্বাধীনতা আমার আছে, তাতে হস্তক্ষেপ করার অধিকার স্পিক পেলেন কোথা থেকে? তাঁর টাকা তিনি গঙ্গায় ফেলে দিন বা যা—ই করুন, আমি যেমন তা নিয়ে মাথা ঘামাইনি, তেমনি তিনিও আমার টাকা সম্বন্ধে দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি যাকে ইচ্ছা যত টাকাই দিই—না কেন, তাতে তাঁর কিছু আসে যায় না।’ এই কথা বলে হাইড সাহেব চাঁদার খাতাটা খুলে তাঁর নামের পাশে ২০০ টাকার অঙ্কটি কেটে ৩০০ টাকা লিখে দিলেন। সেই মাসিক ৩০০ টাকা করেই সারাজীবন তিনি টমাস মটকে সাহায্য করেছেন।

হাইডের অনেক সদগুণ থাকা সত্ত্বেও, এই আত্মাভিমান, জিদ ও একগুঁয়েমির জন্য তিনি মধ্যে মধ্যে খুবই বিসদৃশ অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। এমনিতে লোকজনের প্রতি তিনি যথেষ্ট ভদ্র ব্যবহার করতেন, কিন্তু তাঁর বিচারকের কাজকর্মের ব্যাপারে যদি কেউ কখনও তাঁর কাছে আসতেন, তাহলে আত্মীয়—বন্ধু নির্বিশেষে তিনি তাঁর প্রতি অত্যন্ত ‘ফর্মাল’ ব্যবহার করতেন, এমনকি রীতিমতো রূঢ় হতেও কুণ্ঠিত হতেন না। একবার তাঁর একজন বিশেষ পরিচিত কমান্ডার ‘অ্যাফিডেভিট’ করার জন্য তাঁর কাছে আসেন। হাইড যখন তাঁর আবেদনপত্র পড়ছিলেন তখন কমান্ডার ভদ্রলোক তাঁর সামনের একটি চেয়ারে বেশ আরামে বসে পড়েন। হাইডের সঙ্গে সত্যিই তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। কিন্তু তিনি চেয়ারে বসামাত্রই হাইড তাঁর দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন, ‘উঠে দাঁড়ান! কে আপনাকে বসতে বলেছে?’ কমান্ডার তাঁর দরখাস্ততে নাম লিখেছিলেন ‘জে. প্রাইস’ (J. Price)। হাইড বিরক্ত হয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘J—টা কী? জেকব, জেমস, জেরিমিয়া, জন, না আর কিছু? নামটা যে এইভাবে লিখেছেন, লোকে কি আপনার নাম নিয়ে গবেষণা করবে?’

কমান্ডার ভদ্রলোক হঠাৎ হাইডের এই বিস্ফোরণে ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, ‘আমার নাম সার—জন প্রাইস, তবে বরাবরই আমি এভাবে আমার নাম লিখে থাকি।’

হাইড আরও বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলেন, ‘তা যদি লিখে থাকেন তাহলে নিরেট বোকার মতন কাজ করেছেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বদভ্যাসটি ছাড়ুন।’

কথাবার্তার সময় তিনি নিজেই একটি দলিলের নিচে ‘জে. হাইড’ বলে নামসই করে দেন। তা—ই দেখে কমান্ডার ভদ্রলোক বলেন, ‘আপনিও তো সার জে. হাইড লিখলেন। লোকে কী করে জানবে আপনার পুরো নাম কী?’

এই কথা শোনামাত্রই হাইড ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে কমান্ডারকে তৎক্ষণাৎ তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন। যাবার সময় তাঁকে ডেকে শুনিয়ে দিলেন, ‘মনে রাখবেন, আপনি একজন জাহাজের ক্যাপ্টেন, সমাজের লোকের কাছে সুপ্রিমকোর্টের বিচারকের সঙ্গে আপনার নামের ও তাঁর মর্যাদার পার্থক্য কী, তা আপনার জানা উচিত।’

কোনো লোককে লাল রঙের কোট পরতে দেখলে (সেনাবিভাগের লোক ছাড়া) হাইড তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন। কোনো অ্যাটর্নির এক পর্তুগিজ ক্লার্ক আদালতে তাঁর কাছে একটা সাধারণ কাজের জন্য এসেছিল। হাইডের সামনে দাঁড়িয়ে, তিনি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই, সে ‘যে আজ্ঞে হুজুর’ বলতে লাগল। দাঁতে দাঁত চেপে, তার দিকে চেয়ে হাইড বিড়বিড় করে বলেন, ‘যে আজ্ঞে হুজুর—গর্দভ কোথাকার।’ পর্তুগিজ ক্লার্কটি হাইডের গজরানির উত্তরে আবার বলল, ‘যে আজ্ঞে হুজুর।’

‘এবারে বলুন তো যে আজ্ঞে হুজুর, আপনার কী কাজ?’ হাইড জিজ্ঞাসা করলেন।

‘যে আজ্ঞে হুজুর’—ক্লার্কটি উত্তর দিল।

‘আপনি কি কেবল যে আজ্ঞে হুজুর বলতেই এসেছেন, এটিই কি আপনার কাজ?’ হাইড আবার জিজ্ঞাসা করলেন।

‘যে আজ্ঞে হুজুর’—পর্তুগিজ ক্লার্কটি আবার জবাব দিল।

অ্যাফিডেভিটের কাগজখানা রেগে তার মুখের উপর ছুড়ে মেরে আরদালিকে ডাক দিয়ে হাইড সাহেব বললেন, ‘ওই যে আজ্ঞে হুজুর গর্দভটাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে কোর্টের বাইরে বার করে দিয়ে এসো।’

কলকাতা শহরে যখন পুলিশ ছিল না, তখন একজন বিচারক নিয়মিত চেম্বারে বসতেন, শহরের দৈনন্দিন অভিযোগ, বিবাদ—বিসংবাদ ইত্যাদি নিষ্পত্তির জন্য। চেম্বার ছিল লালবাজারের কাছে। একবার দু’জন হিন্দু ভদ্রলোক সামান্য একখণ্ড জমির মালিকানা নিয়ে হাইডের চেম্বারে নিষ্পত্তির জন্য আসেন। হাইড দু’জনের অভিযোগ শুনে সালিশির দ্বারা ব্যাপারটা মিটমাট করে নিতে বলেন। প্রস্তাবে একজন রাজি হলেন, অন্যজন হলেন না। হাইড বার বার তাঁকে অনুরোধ করলেন, কিন্তু কিছুতেই তিনি তা শুনলেন না। তিনি হাইডকেই বিচার করে দিতে বললেন। কিন্তু হাইডও নাছোড়বান্দা, এবং তাঁর জিদ হল, যেহেতু তিনি নিজে প্রস্তাব করেছেন, সেই হেতু তা মানতেই হবে। হিন্দু ভদ্রলোকটিও কম জেদি ছিলেন না। তিনি সাফ বলে দিলেন, ‘সালিশি আমি মানব না, বিচার আপনাকেই করতে হবে।’ হাইড বললেন, ‘কী করতে হবে—না—হবে তা আমি বুঝব; আপনাকে উপদেশ দিতে হবে না। পাঁচ মিনিট আপনাকে ভাববার সময় দিলাম—ভেবে বলুন সালিশি মানবেন কি না!’ হিন্দু ভদ্রলোকটি একই ভাষায় উত্তর দিলেন, ‘এক মিনিটও ভাববার প্রয়োজন নেই, আপনাকে আমি পরিষ্কার বলে দিয়েছি যে সালিশি আমি মানব না।’

‘বেশ, ভাল কথা, আপনার একগুঁয়েমিকে কী করে শায়েস্তা করতে হয় তা আমি জানি।’ এই কথা বলে হাইড সাহেব একজন ক্লার্ককে ডেকে সেই হিন্দু ভদ্রলোকটিকে জেলখানায় নিয়ে গিয়ে আটকে রাখতে বললেন।

এই হুকুম দিয়ে যখন তিনি সমন লিখতে আরম্ভ করলেন, তখন সেই হিন্দু ভদ্রলোকের কোনো একটি ভৃত্য দৌড়ে গিয়ে তার অ্যাটর্নিকে খবর দিল। অ্যাটর্নি কাছেই থাকতেন, খবর পেয়ে তিনি ছুটে এলেন হাইডের চেম্বারে। অ্যাটর্নিকে দেখে হাইডের মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল। পারতপক্ষে কাজের সময় তিনি কৌতূহলী লোকের উপস্থিতি সহ্য করতে পারতেন না। অ্যাটর্নিদের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা ছিল সবচেয়ে বেশি। সুতরাং তাঁকে দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী চান আপনি? হঠাৎ কী কারণে সন্ধ্যার সময় এখানে আপনার আসার প্রয়োজন হল?’

অ্যাটর্নি বললেন, ‘হুজুর, আমার নিজের ইচ্ছাতেই আমি এখানে এসেছি, সেজন্য মাফ করবেন। আমার একজন বিশিষ্ট মক্কেলের ভৃত্যের মুখে খবর পেলাম যে বিনা অপরাধে আপনি তাকে জেলখানায় বন্দি করে রাখার হুকুম দিয়েছেন। সে সম্বন্ধে আমার কিছু বক্তব্য আছে বলে আমি এসেছি।’ হাইড বেশ ধমকানির সুরে বললেন, ‘আপনার ইচ্ছা হল বলেই আপনি সোজা এখানে ওকালতি করতে চলে এলেন, এতটা স্বেচ্ছাধীন আপনি হলেন কী করে? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনি আমার চেম্বার ছেড়ে চলে যান, তা না হলে মুশকিলে পড়বেন।’

অ্যাটর্নি বললেন, ‘আমার মক্কেল কলকাতা শহরের একজন বিশিষ্ট নাগরিক। অর্থ ও প্রতিপত্তি দু’দিক থেকেই তাঁর সমকক্ষ লোক খুব অল্পই আছেন। জাতিতে তিনি হিন্দু লোকের সঙ্গে থাকলে জাতিচ্যুত হবেন, এবং তাঁর সামাজিক মর্যাদাহানি হবে। যত টাকাই হোক, আমি তাঁর জন্য জামিন হতে রাজি আছি। আমার আবেদন, আপনি তাঁকে জামিনে মুক্তি দিন।’

এই কথার উত্তরে হাইড বললেন, ‘আমি আপনার জামিন বা প্রশংসা কোনোটারই ধার ধারি না। আপনার মক্কেলের কত টাকা আছে, বা জাতিতে তিনি কত উচ্চস্তরের লোক, এসব সার্টিফিকেট দেবার জন্য আপনাকে এখানে ডেকে আনা হয়নি। অতএব আপনি আপনার নিজের কাজে যান, এখানে ঝামেলা করবেন না।’

অ্যাটর্নি সাহেব বেশ একটু মেজাজ দেখিয়ে বললেন, ‘আমার মক্কেলের অ্যাটর্নি হিসেবে আমাকে যা করতে হবে তা আপনাকে জানাচ্ছি। বাধ্য হয়ে আমাকে অন্য বিচারকের কাছে হেবিয়াস কর্পাসের আবেদন করতে হবে।’

অ্যাটর্নির এই উদ্ধত উক্তিতে হাইড ক্ষিপ্ত হয়ে গর্জন করে উঠলেন: ‘এত বড় স্পর্ধা আপনার যে আইনের হুমকি দিয়ে আমাকে কাজ করাতে চান? আপনি এখনই এখান থেকে বেরিয়ে যান, তা না হলে আপনার সম্ভ্রান্ত হিন্দু মক্কেলের মতন আপনারও অবস্থা হবে, এবং কেবল মক্কেলের জন্য নয়, আপনার নিজের জন্যও হেবিয়াস কর্পাসের আবেদন করতে হবে।’

এই কথা শোনার পর অ্যাটর্নি হাইডের চেম্বার থেকে বিদায় নিলেন। হাইডও বুঝতে পারলেন যে কাজটা তাঁর আদৌ আইনসঙ্গত হচ্ছে না। সুতরাং অ্যাটর্নির প্রস্থানের পর তিনি তাড়াতাড়ি একজন হরকরা পাঠিয়ে দিলেন জেলখানায়, হিন্দু ভদ্রলোকটির মুক্তির আদেশ দিয়ে।

আর—একটি ছোট্ট ঘটনার কথা আমি জানি প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে। ঘটনাটি এই। একদিন সন্ধ্যাবেলা বিশেষ কাজের জন্য হাইডের চেম্বারে বসে ছিলাম, এমন সময় হ্যামিলটন নামে একজন অ্যাটর্নি, হাগিন্স নামে তাঁর একজন মক্কেলকে নিয়ে হাইডের কাছে উপস্থিত হলেন। তিনি তাঁর মৃত পিতৃব্যের বিপুল সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক হয়েছেন, এবং তা যথারীতি দখল করে দেখাশুনা করার জন্য কোর্টের অনুমতিপত্র নিতে এসেছেন। হ্যামিলটনের মক্কেল হাগিন্স মোটেই প্রকৃতিস্থ ছিলেন না। অত্যধিক মদ্যপান করার ফলে তাঁর অর্ধেক চেতনা প্রায় লোপ পেয়ে গিয়েছিল। বিষয়টি জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বলে জাস্টিস হাইড চার্টার ও পার্লামেন্ট অ্যাক্ট পাঠ করে দেখছিলেন বিষয়টি তাঁর কোর্টের এক্তিয়ারভুক্ত কি না। হাইড যখন বইপত্র ঘেঁটে দেখছিলেন, তখন হ্যামিলটনের মাতাল মক্কেল টলতে টলতে তাঁর সামনে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনি এইসব বড় বড় অপাঠ্য আইনের বই ঘাঁটবেন, আর আমি কি আপনার সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকব?’

ভদ্রলোক তো মাতাল তা হাইড এতক্ষণ বুঝতে পারেননি। কথাগুলি শুনে তাঁর খেয়াল হল, তিনি তাকিয়ে দেখলেন যে মক্কেলের অবস্থা একেবারে কাহিল। সুতরাং তিনি অ্যাটর্নিকে বললেন, ‘আপনার মক্কেল তো দেখছি একটা আস্ত জানোয়ার, ওকে এখনই কোর্ট থেকে বার করে নিয়ে যান।’ অ্যাটর্নি অনেক কষ্টে তা—ই করলেন, টানতে টানতে মক্কেলকে আদালতের বাইরে নিয়ে গেলেন।

কয়েকদিন পরে আবার একদিন অ্যাটর্নি ও মক্কেল দু’জনেই এলেন। সেদিন অবশ্য মক্কেল প্রকৃতিস্থ ছিলেন। হাইড সাহেব তাঁকে অনুমতিপত্রটি দিয়ে বললেন, ‘আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে, আপনি এই বিপুল সম্পত্তি তদারক করতে পারবেন কি না। তা ছাড়া, আপনার যা মতিগতি দেখছি, এবং যে মাত্রায় আপনি মদ্যপান করেন, তাতে ভরসা হয় না যে আপনি কাকার নাবালক ছেলেমেয়েদের দেখাশুনা করবেন।’

হাইডের চরিত্রের এই মানবিক মাধুর্যই সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল। অনেক সময় আইনের দিক দিয়ে তিনি অপরাধীদের যোগ্য শাস্তি দিতে পারতেন না বলে, এবং বহু অপরাধের সুবিচার করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হত না বলে, তিনি দুঃখ প্রকাশ করতেন। বলতেন, ‘যদি বিচারকের আইন—প্রণয়নের ক্ষমতা থাকত, তাহলে বহু অন্যায়ের ন্যায্য প্রতিকার আমি করতে পারতাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমার সে ক্ষমতা নেই, তাই জেনেশুনেও সব সময় সব অন্যায়ের সুবিচার করা আমার দ্বারা সম্ভব হয় না।’

এই ধরনের একটি বিচারের সমস্যার কথা আমি উল্লেখ করব। শেরিফ নামে কলকাতা ট্রেজারির একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্লার্ক ছিলেন। তিনি একটি অনাথ বালিকার সঙ্গে অবৈধ প্রেম করে শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে স্বামী—স্ত্রীর মতন বসবাস করতেও আরম্ভ করেন। যথাকালে তাঁর কয়েকটি পুত্রকন্যাও হয়। কিন্তু কিছুকাল পরেই দেখা যায়, আর—একজন স্ত্রীলোকের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হয়েছেন, এবং বিবাহ না করলে স্ত্রীলোকটি তাঁর সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ স্থাপন করতে রাজি নয় বলে, তিনি তাঁকে বিবাহ করতেও সম্মত হয়েছেন। কিন্তু তার জন্য তিনি তাঁর পূর্বের স্ত্রী সেই অনাথ মহিলা ও তার ছেলেমেয়েদের ভরণপোষণের ব্যাপারে কিছু করতে একেবারে ইচ্ছুক ছিলেন না। অসহায় অবস্থায় তাদের পরিত্যাগ করে তিনি নতুন স্ত্রী নিয়ে ঘর করবেন মনস্থ করেন। শুধু তা—ই নয়, ভদ্রলোক এত নিষ্ঠুর ও বদমায়েশ ছিলেন যে অনাথ স্ত্রীর সামান্য যা গয়নাগাটি ও জিনিসপত্তর ছিল; তা—ও ভয় দেখিয়ে কেড়ে নিয়ে চলে যান। সেই অনাথ মহিলা অবশেষে একেবারে নিরুপায় হয়ে জাস্টিস হাইডের শরণাপন্ন হন। শেরিফের কাছে মাসিক ভাতা ও ক্ষতিপূরণ দাবি করে তিনি হাইডের কাছে আবেদন করেন।

হাইডের মতন একজন মহানুভব বিচারক এরকম অমানুষিক আচরণের কথা শুনে যে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও বিচলিত হবেন, তা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই সময়কার আইন এমন ছিল যে তার জোরে শেরিফের মতন একজন নিষ্ঠুর পাষণ্ডকে বিশেষ কিছুই দণ্ড দেওয়া যায় না। তবু সেই অনাথ মহিলার আবেদনে তিনি এত দূর বিচলিত হলেন যে আইনের বলে কিছু করা যায় না জেনেও তিনি ঠিক করলেন যে শেরিফকে আদালতে ডেকে, সকলের সামনে নির্মম ভাষায় গালাগাল করবেন। মানুষ হয়েও শেরিফ যে কত জঘন্য পশুর মতন আচরণ করেছেন একজন অসহায় মহিলার প্রতি, এ কথা প্রকাশ্য আদালতে বললে, হাইড ভাবলেন, হয়তো তার সুপ্ত মানবতাবোধ জাগতে পারে। কিন্তু তা হল না। তিনি অবশ্য সমন জারি করে শেরিফকে কোর্টে ডেকে পাঠালেন। তারপর প্রকাশ্য আদালতে হাইড ও শেরিফের মধ্যে যে বাক্যবিনিময় হল তা এই :

হাইড। ‘শেরিফ সাহেব, আপনি আপনার স্ত্রীর প্রতি যে আচরণ করেছেন, তাতে কি আপনি মনে করেন যে মনুষ্যসমাজে আপনি ভদ্রলোক বলে গণ্য হবার যোগ্য!’

শেরিফ। ‘আমার ধারণা আমি এমন কিছু করিনি, যাতে সেই যোগ্যতা আমার ক্ষুণ্ণ হয়েছে।’

হাইড। ‘আপনি মানুষ নন, চোর—ডাকাত ও জানোয়ারদের চেয়েও অধম। একটি অনাথ বালিকার নারীত্বের অপমান করে আপনি কাপুরুষের মতন আজ অন্য নারীর সঙ্গসুখ উপভোগ করার জন্য উদগ্রীব। যত সহজে ও নিশ্চিন্তে, এবং নির্বিবেক জীবের মতন, কেবল টাকার জোরে আপনি এই জঘন্য কাজ করছেন, বনের কোনো জানোয়ারও তা করতে পারত না। আবার ওই মুখ দিয়ে উচ্চারণ করছেন যে সমাজে আপনি ভদ্রলোক বলে গণ্য হবার যোগ্য।’

শেরিফ। ‘মানুষ হিসেবে, এবং নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমার কী করা উচিত বা অনুচিত, আশা করি তার একমাত্র বিচারক আমি। আমার এই ব্যক্তি—স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার অধিকার কারও আছে বলে আমি মনে করি না।’

হাইড। ‘তা অবশ্য নেই, ঠিক কথা। তবে এ কথাও ঠিক যে সভ্য মানবসমাজে বাস করে আপনি যা ইচ্ছে তা—ই করতে পারবেন না। তবে বর্তমান আইনের অবস্থা এমন যে তার জোরে আমারও ক্ষমতা নেই আপনার অন্যায়ের বিচার করার। কিন্তু আমি অবাক হয়ে যাই ভেবে যে কোন গুণের জন্য, বা কীসের জোরে, আপনি নিজেকে ভদ্রলোক বলে জাহির করছেন? আপনি পায়ে জুতো পরে এসেছেন সেজন্য? আশ্চর্য! এই দেশে দেখতে পাই, জুতো পরলেই মানুষ ভদ্রলোক হয়ে যায়। আর কী? নিশ্চয় আপনার বিলক্ষণ টাকার জোরও আছে? তা—ই নয় কি?’

শেরিফ। ‘নিশ্চয়, টাকার জোর তো আছেই।’

হাইড। ‘কত টাকা আছে আপনার?’

শেরিফ। ‘গুনে দেখিনি, তবে দুলক্ষেরও বেশি।’

হাইড। ‘তাহলে, ওহে দু’লক্ষ টাকার ভদ্রলোক। আপনাকে সবিনয়ে একটা প্রশ্ন করতে পারি কি—এক লক্ষ টাকায় ভদ্রলোক হওয়া যায় না? অর্ধেক টাকা আপনি আপনার অসহায় পরিত্যক্তা স্ত্রীকে দিয়ে দেন, তাহলে কি সমাজের ভদ্রলোকের স্তর থেকে আপনার পতন হবে?’

শেরিফ। ‘আপনার এ কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করি না।’

হাইড দুঃখে ও ক্ষোভে প্রায় মাথার চুল ছিঁড়তে লাগলেন, এবং সম্বিৎহারার মতন চিৎকার করে উঠলেন শেরিফের দিকে চেয়ে। বললেন, ‘পাষণ্ড জানোয়ার কোথাকার, বেরিয়ে যাও কোর্ট থেকে, বেরিয়ে যাও বলছি।’

শেরিফের নিষ্ঠুর আচরণে জাস্টিস হাইড সেদিন খুবই ব্যথিত হয়েছিলেন। অসহায় মহিলাটির দিকে চেয়ে তাঁর চোখে জল এসে গিয়েছিল। আর একটি কথাও তিনি বলতে পারেন নি। চুপিচুপি কেবল তাঁর এজেন্টকে বলে দিয়েছিলেন প্রত্যেক মাসে ৫০ টাকা করে মহিলাটিকে সাহায্য করতে, এবং কোথা থেকে কে তাঁকে অর্থসাহায্য করছে তা যেন তিনি কিছুতেই জানতে না পারেন। প্রায় পনেরো মাস হাইড এইভাবে মহিলাটিকে সাহায্য পাঠিয়েছিলেন, এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর গোপনতাও তিনি রক্ষা করতে পারেননি। তারপর হঠাৎ একদিন সকালে মহিলাটি হাইডের বাড়ি এসে, শহরের এক বিখ্যাত ব্যবসায়ীর সঙ্গে তাঁর বিবাহের প্রস্তাবের কথা জানালেন, এবং বললেন যে আর তাঁর অর্থসাহায্যের প্রয়োজন হবে না। হাইডের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতায় তাঁর দুই চোখ দিয়ে অনর্গল ধারায় জল ঝরতে লাগল। হাইড তাঁকে সান্ত্বনা দিলেন, এবং তাঁর পুনর্বিবাহের সংবাদে তিনি যে খুব খুশি হয়েছেন, তা—ও তাঁকে জানাতে ভুললেন না। দয়াদাক্ষিণ্য, দানধ্যান অনেককে করতে দেখেছি, কিন্তু মনে হয়েছে, কোথায় যেন তাঁদের আত্মপ্রচারের একটা বাসনা তার মধ্যে লুকিয়ে আছে। এরকম বিনা আড়ম্বরে, ঢাক না পিটিয়ে, অকৃপণভাবে অসহায় ও বিপন্ন মানুষকে দানধ্যান করতে হাইডের মতন খুব কম লোককেই সংসারে দেখা যায়।

জাস্টিস হাইডের জীবনে আরও দুটি ঘটনার উল্লেখ করব যা শুনলে আপনারা হাসি সংবরণ করতে পারবেন না।

একদিন রাতে চেম্বার থেকে হাইড বাড়ি ফিরছিলেন, এমন সময় একজন তরুণী ইয়োরোপীয় মহিলা দৌড়তে দৌড়তে এসে রাস্তার উপর তাঁর পালকি দাঁড় করাল। তারপর সেই বিচিত্রবেশা মহিলার কী কান্না, কপাল চাপড়ানো ও আবেদন—নিবেদনের বহর। হাইড স্বভাবতই হতভম্ব হয়ে গেলেন। কলকাতা শহরের উপর ঘটনাটি ঘটছে। জাস্টিস হাইডের পালকিও সকলের চেনা, আর তরুণী মহিলাটিও কারও অচেনা নয়, কারণ সে মহানগরের একজন বহুজনপরিচিতা বারাঙ্গনা। তাকে চিনতেন না কেবল হাইড সাহেব। তবুও তার বিচিত্র বেশভূষা এবং ততোধিক বিচিত্র মুখ—হাত—পা নাড়ার ভঙ্গি দেখে তিনি কিছুটা সন্দেহ করেছিলেন। প্রকাশ্য রাস্তার উপর নাটকীয় দৃশ্যটি জমতে দেওয়া ঠিক নয় বলে তিনি মহিলাটিকে বললেন, পরদিন সকালে তাঁর বাড়ি আসতে। বাড়িতে বসে তিনি তার অভিযোগ সব শুনবেন এবং সাধ্যমতো তার বিহিত করারও চেষ্টা করবেন বলে আশ্বাস দিলেন। কিন্তু মহিলা তো সাধারণ মহিলা নয়, কমলির মতো নাছোড়বান্দা। সে তৎক্ষণাৎ বলল যে পরদিন সকাল পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার মতন অবস্থা নয় তার। সমস্যাটা জরুরি, এবং এখনই তার একটা যা হোক সমাধান করা প্রয়োজন।

হাইডের পালকি গৃহাভিমুখে বেয়ারারা কাঁধে করে বয়ে নিয়ে চলল। পাশে পাশে সেই তরুণী বারাঙ্গনাটিও দৌড়তে লাগল। শহরের জনপথে, রাত্রিবেলা, সে এক বিচিত্র দৃশ্য।

বাড়ি ফিরে হাইড জামাকাপড় বদলে খানা টেবিলে নৈশভোজনের জন্য বসেছেন জন তিনেক বন্ধু নিয়ে, এমন সময় বেয়ারা খবর দিল যে একজন মেমসাহেব খোঁজ করছেন। হাইড বুঝতে পেরে তাকে উপরতলায় ডেকে পাঠালেন। খাবার সময়, অতএব বাধ্য হয়ে তরুণীটিকেও খাবার কথা বলতে হল। ধন্যবাদ জানিয়ে সে বলল যে ভোজনে তার রুচি না থাকলেও, কিঞ্চিৎ মদিরাপানে তার আপত্তি নেই। বেশ বড় এক গ্লাস মদিরা পান করে সে তার নাম বলল ‘ডানডাস’। বর্তমানে যে জঘন্য জীবন তাকে যাপন করতে হচ্ছে তা বর্ণনা না করাই ভাল। এই বলে মিস ডানডাস জীবনের কথা বলতে শুরু করল। সদ্বংশের মেয়ে সে, তার দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন, আর—একজন নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট। তার বয়স যখন বছর চোদ্দো তখন একজন তারুণ্যতেজোদ্দীপ্ত অশ্বারোহী বাহিনীর অফিসারকে দেখে সে প্রেমে পড়ে এবং পিতৃগৃহ ত্যাগ করে চতুর্দশী ডানডাস তার সহধর্মিণী হয়। অশ্বারোহী অফিসারদের সঙ্গে সারা ইংলন্ড চষে বেড়িয়ে অবশেষে রাজাজ্ঞায় স্বামীর ইস্ট ইন্ডিজে যাত্রাকালে তার সঙ্গে ভারতবর্ষে মাদ্রাজ প্রদেশে চলে আসে। তখন টিপুর সৈন্যদের সঙ্গে ইংরেজদের লড়াই হচ্ছে এবং সেই লড়াইয়ে তার বীর অশ্বারোহী যোদ্ধা স্বামী প্রাণ হারায়। দুঃখকষ্ট ও দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে শ্রীমতী ডানডাস যে জীবন বরণ করতে বাধ্য হয়েছে, তা তো তাঁরা স্বচক্ষে দেখতেই পাচ্ছেন। এই কথা বলে হাইডের সামনে ডানডাস ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। কোমলতায় হাইড স্ত্রীলোককেও হার মানিয়ে দেন। অতএব তাঁর হৃদয়ও সঙ্গে সঙ্গে গলে গেল। ধরা গলায় তিনি বললেন, তারপর কী হল?

তারপর আর কী? বাংলাদেশে এসে ডানডাস নতুন বারাঙ্গনাবৃত্তি অবলম্বন করে জীবনধারণ করতে লাগল। বছরখানেক হল সে জনৈক মিডলটন সাহেবের বাড়িতে একখানা ঘর নিয়ে থাকে ও খায়, এবং তার জন্য যে টাকা দিতে হয় তা প্রাপ্যের চেয়ে অনেক বেশি বলেই তার ধারণা। তথাপি মিডলটন ও তাঁর স্ত্রী উভয়েই তার উপর অকথ্য অত্যাচার করেন, এমনকি কারণে—অকারণে মধ্যে মধ্যে তাকে বেদম ঠ্যাঙানিও দেন। অদ্য রজনীতে সেই ঠ্যাঙানির দাপটেই সে ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে, এবং সেই সময় তাকে পালকি চড়ে যেতে দেখে ছুটে এসে পালকি আটকেছে, বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে না এলে আজ বোধহয় তার বাড়িওয়ালা ও বাড়িওয়ালি দু’জনে মিলে তাকেই খুনই করে ফেলত।

ঘটনাটি করুণ, বলবার ভঙ্গিটিও মর্মস্পর্শী, বলতে বলতে অঝোরে অশ্রুবর্ষণ, এবং সবার উপরে অভিনেত্রী বক্তা সুন্দরী তরুণী—এতগুলি ব্যাপারের অভাবনীয় সমাবেশে হাইড সাহেব রীতিমতো বিচলিত ও অভিভূত হলেন। তাঁর স্বাভাবিক মানবতাবোধ অত্যন্ত উগ্রভাবে সজাগ হয়ে উঠল। ছলাকলায় সুদক্ষা শ্রীমতী ডানডাস সহজেই তাঁর অন্তরের দুর্গটি জয় করে ফেলল।

হাইড বললেন, ‘আজ রাত্রে আপনি ঘরে ফিরে যান, আমার ভৃত্য গিয়ে আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। তার সঙ্গে আমি একটি পরোয়ানাও পাঠিয়ে দিচ্ছি, কাল সকালে যাতে মিস্টার ও মিসেস মিডলটন আমার বাড়িতে উপস্থিত হয়ে, আমার সামনে তাঁদের অভদ্র ও অন্যায় আচরণের কৈফিয়ত দেন সেজন্য!’

বলা বাহুল্য, শ্রীমতী ডানডাসের এ প্রস্তাব পছন্দ হল না। তৎক্ষণাৎ আপত্তি জানিয়ে সে বলল, প্রাণ থাকতে আর সে ওই বাড়িতে পদার্পণ করবে না, রাত্রিযাপন করা তো দূরের কথা। যদি অন্য কোথাও আশ্রয় না মেলে, তাহলে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে রাত্রি কাটিয়ে দেবে।

একজন অসহায় হতভাগ্য নারী, তার উপর সুন্দরী তরুণী, শহরের পথে পথে ঘুরে রাত কাটাবে, এ প্রস্তাব হাইড সাহেবেরও মনঃপূত হবার কথা নয়। তিনি তাঁর সর্দার বেয়ারাকে ডেকে বললেন, ‘বাড়িতে কোনো খালি ঘরে মিস ডানডাসের রাত্রিতে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে?’

সর্দার—বেয়ারা সবিনয়ে বললে, ‘সম্ভব হবে না হুজুর। কারণ কোনো ঘরই খালি নেই, এবং দু’তিনটে বেশি খাটপালঙ যা ছিল তা আপনার এক বন্ধু সেদিন বারাসাত নিয়ে গিয়েছেন।’

হাইড বেশ দুশ্চিন্তায় পড়লেন। বৃদ্ধ বিলি পসন সেরাতে নিমন্ত্রিতদের মধ্যে একজন ছিলেন। বৃদ্ধ বেশ রসিক ব্যক্তি। হাইডকে চিন্তিত দেখে তিনি বললেন, ‘সার, বৃথা চিন্তা করে লাভ কী? ঘর এবং বিছানা দুইই যখন পাওয়া যাচ্ছে না তখন এক কাজ করতে পারেন। আপনার ঘরও বড়, বিছানাও যথেষ্ট প্রশস্ত। তার একপাশে নবাগতা অতিথির শয়নের ব্যবস্থা করে দিলে ক্ষতি কী?’

কাঁচা রসিকতা হাইড কোনোদিনই বিশেষ বরদাস্ত করতে পারতেন না। বৃদ্ধ বিলির কথায় তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, ‘কথাবার্তার মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন, ভাল লক্ষণ নয়। মনে হয় আপনার মস্তিষ্কটি একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।’

হাইডের সমস্যার সমাধান অবশ্য ডানডাস নিজেই করে দিল। সে বলল, শহরে দু’—তিনটে ভাল ট্যাভার্ন আছে, তার যেকোনো একটিতে সে স্বচ্ছন্দে রাত কাটাতে পারে। ট্যাভার্নের কথা শুনে হাইড তেমন খুশি হলেন না। কারণ কলকাতার ট্যাভার্ন সম্বন্ধে তাঁর আদৌ ভাল ধারণা ছিল না। উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে মট সাহেব ছিলেন। তিনি বললেন যে তাঁর জানা দু’টি ভাল ট্যাভার্ন আছে, যেখানে ভদ্রভাবে রাত্রিবাস করা যে—কোনো মহিলার পক্ষে সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।

মটের কথা শুনে হাইড আশ্বস্ত হলেন এবং তখনই তাঁর বেয়ারাদের ডেকে হুকুম দিলেন, পালকি সাজিয়ে মেমসাহেবকে ভাল একটি ট্যাভার্নে পৌঁছে দিয়ে আসতে। অবশেষে তা—ই করা হল। জাস্টিস হাইডের পালকি চড়ে নগরের নটী ডানডাস চলল ট্যাভার্ন সন্ধানে। নগরের লোক অবাক হয়ে দেখতে লাগল এবং যার মুখে যা এল তা—ই বলতে লাগল। দু’চারটে কথা ও মন্তব্য যে হাইডের কানে পৌঁছয়নি তা নয়। কিন্তু তিনি তা গ্রাহ্য করেননি। সেটুকু সৎসাহস তাঁর বরাবরই ছিল দেখেছি। যা তিনি ভাল বুঝতেন বা করা কর্তব্য মনে করতেন তা লোকজনের মতামত উপেক্ষা করেই করতেন। বিরূপ মন্তব্যে কখনও ভয় পেতেন না।

বেয়ারাদের ফিরে আসা পর্যন্ত তিনি তাঁর ঘরে চুপ করে বসে ছিলেন, শুতে যাননি। তারা যখন ফিরে এসে বলল যে মেমসাহেব একটি ভাল ট্যাভার্নে উঠেছেন, এবং তার মালিক হুজুরের কথা শুনে তাঁকে সাদরে অভ্যর্থনা করেছে, তখন তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে বিশ্রাম নিতে গেলেন।

দ্বিতীয় ঘটনাটি খাদ্য নিয়ে ঘটেছিল। সেটা উল্লেখ করছি এইজন্য যে হাইডের চরিত্র বুঝতে তা সাহায্য করবে। হাইডের এক বন্ধু একবার রংপুর থেকে তাঁর জন্য কিছু ভাল বাদাম পাঠিয়েছিলেন। বাংলা দেশের কোথাও সে বাদাম পাওয়া যেত না, একমাত্র রংপুর ছাড়া। তা—ও আবার একটিমাত্র গাছে সেই বাদাম ফলত। হাইড কিছুটা ভোজনবিলাসী ছিলেন। বাদাম পেয়ে তিনি খুব খুশি হলেন এবং খানসামাকে ডেকে বলে দিলেন প্রতিদিন দুধের সঙ্গে বাদাম দিতে, আর তার সঙ্গে আমের পুডিং। খানসামার কানে তিনটি কথা মাত্র পৌঁছল—আমের পুডিঙেয়র ‘পুডিং’ কথাটি, ‘দুধ’ আর ‘বাদাম’। সুতরাং সে ভাবল, সাহেব তাকে রাতের খানার জন্য ভাল করে ‘বাদামের পুডিং’ বানাতে বলেছেন। যত বাদাম ছিল, সমস্ত ঝেড়েমুছে দিয়ে সে পুডিং বানাল। খাবার সময় উৎসাহের সঙ্গে সেই পুডিং নিয়ে হাইডের সামনে টেবিলের ওপর রাখামাত্রই, তার চেহারা দেখে তিনি চমকে উঠলেন। চক্ষু বিস্ফারিত করে খানসামার দিকে চেয়ে বললেন, ‘এ যে বিশাল পুডিং দেখছি। কার জন্য বানিয়েছ, আমাদের জন্য, না ফোর্ট উইলিয়ামের গোরা সৈন্যদের জন্য? তারাও খেয়ে শেষ করতে পারবে কি না, আমার সন্দেহ আছে!’

খানসামা মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখন বলো তো খানসামা সাহেব, পুডিং নামে এই বিশাল পিণ্ডাকার পদার্থটির নাম কী? কীসের পুডিং? খানসামা হাত রগড়ে বলল, ‘আজ্ঞে হুজুর, এ হল আজ্ঞে পুডিং। আপনি বলেছিলেন হুজুর, তাই আজ্ঞে—বাদামের পুডিং।’

কথা শুনে লাফ দিয়ে উঠে হাইড বললেন, ‘হ্যাঁ, কী বললে, বাদামের পুডিং? আরে জানোয়ার, গর্দভ, রাস্কেল, স্কাউন্ড্রেল, অপদার্থ কোথাকার। বাদামের পুডিং, না অশ্বডিম্ব বানিয়েছ! কে খাবে তোমার পুডিং? খাবেন আপনারা?’

নিমন্ত্রিত অতিথিরা খাবার টেবিলে পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। হাইড আরও ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘বাদামের পুডিং বানিয়েছ, সব বাদামগুলো শেষ করে দিয়েছ। বেরোও রাস্কেল, বেরিয়ে যাও বলছি—’

ইত্যবসরে একজন অতিথি একটুখানি পুডিং কেটে খেয়ে, ‘বাঃ, বাঃ, চমৎকার পুডিং দেখছি, বাদামের যে এত সুস্বাদু পুডিং হয় তা তো জানতাম না—’ ইত্যাদি বলে বোধহয় হাইড সাহেবকে সান্ত্বনা দেবার ও ঠান্ডা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু হাইড তাতে শান্ত হলেন না, একবার রেগে গেলে সহজে তাঁকে শান্ত করাও যেত না। খানসামার উপর তাঁর অনর্গল কটুবাক্যবর্ষণ চলতে থাকল।

তারপর থেকে দীর্ঘকাল পর্যন্ত কেউ আর হাইড সাহেবের মুখে বাদামের কথা শোনেননি। বাদামের কথা উচ্চারণ করলেই তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন। সামান্য পুডিং নিয়ে যে এই বিভ্রাটের সৃষ্টি হতে পারে তা কেউ কল্পনাও করতে পারবেন না।

মু র্শি দা বা দে র রে সি ডে ন্ট প ট

জুলাই মাসের দিকে (১৭৮৪ সাল) এসপ্ল্যানেড অঞ্চলে বেশ বড় একটি বাড়ি খালি পাওয়া গেল। খোলামেলা ও আলো—বাতাসের দিক থেকে এরকম বাড়ি হঠাৎ পাওয়া কঠিন। অতএব আর দেরি না করে বাড়িটা ভাড়া করে ফেললাম। বাড়িটা পুরনো হলেও বাদশাহি ধরনের এবং কোর্টহাউসের কাছে, কলকাতার কেন্দ্রস্থলে এত সুন্দর বাড়ি তখন খুব কমই ছিল।

জুলাই মাসেই আমার বন্ধু রবার্ট পট খুব ভাল একটি চাকরি পেল। তখনকার দিনে কোম্পানির আমলের সবচেয়ে লোভনীয় চাকরি। বাংলার নবাবের দরবারে মুর্শিদাবাদে রেসিডেন্ট (Resident) নিযুক্ত হল পট। বিরাট চাকরি, যেমন টাকা তেমনি মর্যাদা ও ক্ষমতা। নবাবের সমস্ত দেনাপাওনার টাকা, মাসোহারা ইত্যাদি যা কিছু সব কোম্পানি তাঁদের মুর্শিদাবাদে রেসিডেন্টের হাত দিয়ে পাঠান এবং—‘a considerable portion of it always struck to his fingers’—হাত নিয়ে নবাবের হাতে যাবার সময় তার বেশ খানিকটা অংশ রেসিডেন্ট হাতের দশ আঙুলে আটকে থাকে (অর্থাৎ হিকি সাহেব বলতে চান যে নবাবের টাকাপয়সা লেনদেনের ব্যাপারে রেসিডেন্ট বেশ দু’পয়সা কমিশন পান।)

শুধু তা—ই নয়, রেসিডেন্টের অর্থাগমের আরও একটি পথ প্রশস্ত ছিল, যা অনেকেই জানেন না। নবাব তাঁর ব্যক্তিগত ভোগবিলাসের জন্য ইয়োরোপীয় পণ্যদ্রব্যাদি যথেষ্ট কেনাকাটা করতেন, এবং তার সম্পূর্ণ ভার থাকত সাহেব রেসিডেন্টের উপর। তিনি যা বলতেন, যা পছন্দ করে দিতেন, তা—ই তিনি বিলিতি বাছাই মাল মনে করে পরম নিশ্চিন্তে কিনে ফেলতেন। কোন বিদেশি দ্রব্যের কী মূল্য, তা—ও এ দেশি নবাবের জানবার কথা নয়, বিদেশি রেসিডেন্ট জানতেন। অতএব সেদিক থেকেও যথেষ্ট অর্থ পকেটস্থ করার তাঁর সুযোগ ছিল। কেউ সে সুযোগ অবহেলা করছেন বলে মনে হয় না।

পট যখন ইংলন্ডে ছিল তখন লর্ড হাই—চ্যান্সেলর থার্লো (Lord Thurlow) চেষ্টায় সে এই চাকরিটি কোম্পানির ডিরেক্টরদের কাছ থেকে জোগাড় করে। তখন কথা ছিল যে সেই বছরেই (১৭৮৩ বা ১৭৮৪) রেসিডেন্ট সার জন ডয়েলি (Sir John Doyly) কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করবেন, এবং রবার্ট পট মুর্শিদাবাদের রেসিডেন্ট নিযুক্ত হবে। কিন্তু ডয়েলি সুযোগ বুঝে শেষ কোপ মারতে ছাড়লেন না। পটের চাকরি পাওয়ার কথা শুনে তিনি জানালেন যে ইচ্ছা করলে এখনই অবসর না নিয়ে তিনি আরও দু’তিন বছর চাকরি করতে পারেন। জানাবার উদ্দেশ্য হল, পটের উপর চাপ দিয়ে, ঘাড় মটকে, বেশ কিছু টাকা আদায় করা। গরজ পটের, চাকরি পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে যোগ দিতে না পারলে হয়তো ফসকে যেতেও পারে, এবং চাকরিটাও যা—তা চাকরি নয়। পট তাই চট করে ডয়েলির টোপটি চোখ বুজে গিলে ফেলল।

বন্ধুবান্ধব আমরা সকলে তাকে নিষেধ করলাম, অনর্থক অর্থদণ্ড দিতে। কিন্তু চাকরির জন্য পট এত বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠল যে কারও কথা সে শুনল না। দু’দশ হাজার টাকা নয়, গুনে তিন লক্ষ সিক্কা টাকা ডয়েলির হাতে পট সমর্পণ করেছিল। তাতেও নাকি ডয়েলি মন্তব্য করেছিলেন যে দু’বছর আগে মুর্শিদাবাদের রেসিডেন্টের চাকরি থেকে অবসরগ্রহণের বিনিময়ে যা ন্যায্য খেসারত তাঁর পাওয়া উচিত ছিল তা তিনি পাননি। তাই তিনি প্রস্তাব করলেন যে তাঁর গৃহের পুরনো আসবাবপত্তরগুলিও পটের কিনে নেওয়া উচিত। দাম ডয়েলির এজেন্টই ঠিক করে দেবেন। এজেন্ট দাম ঠিক করলেন মূল্যে ৯০ হাজার টাকা। পট নগদ ডয়েলির মালপত্তরও কিনে নিল, যদিও তার অধিকাংশই তার কোনো কাজে লাগেনি। সর্বসাকুল্যে পটের কাছ থেকে প্রায় চার লক্ষ টাকা বিদায়—সেলামি নিয়ে ডয়েলি দয়া করে মুর্শিদাবাদের রেসিডেন্টের পদ থেকে যথাসময়ের বছর দুই আগে অবসর গ্রহণ করলেন।

মুর্শিদাবাদের রেসিডেন্টের গদিতে বসবার সুযোগ পেয়ে পট ভারী খুশি হল; চার লক্ষ টাকা নগদ দক্ষিণার জন্য একটুও দুঃখ হল না। মহানন্দে মুর্শিদাবাদ যাত্রা করে সে তাড়াতাড়ি আফজলবাগে তার বাড়িটি দখল করে বসল। মুর্শিদাবাদ শহর থেকে প্রায় মাইল চার দূরে আফজলবাগ। রেসিডেন্টের বাড়িটিও প্রাসাদতুল্য, গড়ন—পরিকল্পনাও অতি সুন্দর। কিন্তু তার চেয়ে আরও অনেক বেশি সুন্দর আমার বন্ধু পটের কল্পনা। সেই কল্পনাকে রূপ দেবার জন্য সে রেসিডেন্টের পুরনো বাড়ি ভেঙেচুরে নতুন করে গড়তে আরম্ভ করল। কোথাও দু’খানা ছোট ঘর ভেঙে একখানা বড় ঘর করল, কোথাও নতুন বারান্দা করল, কোথাও নতুন সিঁড়ি। তাতে বাড়ির চেহারাই একেবারে বদলে গেল, দেখলে মনে হয় যেন লাট—বেলাটের বাড়ি। বসবাসের ব্যাপারে দেখেছি, পটের বরাবরই একটা ব্যক্তিগত রুচি ছিল। তার সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। বর্ধমানেও একবার সে মাত্র কয়েক মাসের জন্য ছিল, কিন্তু তার মধ্যেই বাড়ি ও আসবাবের ব্যাপারে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা খরচ করে ফেলেছিল।

এ ক টি বি চি ত্র দু র্ঘ ট না

জীবনে দুর্ঘটনা ঘটেছে অনেক, বিশেষ করে কলকাতা শহরে, এবং অধিকাংশই আমার ফিটনগাড়ি চালাতে গিয়ে। একদিন এক ডিনারের নেমন্তন্নে একটু বেশি মাত্রায় মদ্যপান করে ফেলেছিলাম। পা টলছিল, বেসামাল বোধ করছিলাম। ভোজ শেষ হবার পর, ক্যাপ্টেন বন্ধু মর্ডান্যাট বললেন, তাঁকে নিয়ে ফিটনে করে একটু বায়ুসেবন করাতে। সুরাপানের পর বায়ুসেবন বেশ ভালই লাগে। আমিও তাই রাজি হলাম, এবং দুর্বুদ্ধির বশে নিজেই ফিটন হাঁকিয়ে বেড়াতে বেরুলাম। বলগা হাতেই ধরা রইল, কিন্তু তাতে ঘোড়া দু’টির ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়নোর কোনো বাধা হল না। পিঠে চাবুক পড়তে বেগ প্রায় বাতাসের গতি ধরল। চোখে তখন ক্ল্যারেটের রং ধরেছে, ফুরফুরে হাওয়া লাগছে গায়ে, আর মনে হচ্ছে যেন দেবদূতের মতন পুষ্পরথে করে স্বর্গের দিকে উড়ে চলেছি। জানিও না কখন ঘোড়া দু’টি কোর্টের দিকে বাঁক নিয়েছে। ক্যাপ্টেনের ইচ্ছা ছিল ফোর্টের ভিতর দিয়ে যাবার। আমি নিজেই তা—ই শুনে ঘোড়ার মুখ কখন কেল্লার দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছি খেয়াল নেই। স্বর্গের বদলে যে আমরা ফোর্টের দিকে চলেছি, এবং দুরন্তবেগে তা—ও হুঁশ নেই। ফোর্টের ভিতরে ঢোকার রাস্তাগুলি সরু সরু, জোরে গাড়ি চালিয়ে যাওয়া কখনও উচিত নয়। সে চেতনা তখন আমাদের লুপ্তপ্রায়। সরু পথে ঘোড়া সবেগে ছুটেছে, ডান—বাঁ জ্ঞানও নেই। ফোর্টের ভিতর থেকে আর—একখানি গাড়ি আসছিল বাইরে। কীভাবে যে আমার ফিটন তার গা ঘেঁষে তিরবেগে বেরিয়ে গেল, এবং কেমন করে সামনাসামনি প্রচণ্ড সংঘর্ষে ধুলোয় গুঁড়িয়ে না গিয়ে তার পক্ষে এই ভেলকি দেখানো সম্ভব হল, তা আমি জানি না, আমার ঘোড়ারা জানে। ধাক্কা যদি লাগত তাহলে ধরাধাম থেকে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হত, শেলের মতন গাড়ির জোয়াল বিঁধত বুকে এবং তার ফলে হাড়পাঁজর টুকরো টুকরো হয়ে হাওয়ায় উড়ন্ত নিশ্চয়। ভাবতেও গা শিউরে ওঠে।

একটা ফাঁড়া কেটে গেল। ফোর্টের ভিতরে ঢুকলাম, গাড়ির বেগ না কমিয়ে। তখন বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে, ভাল করে পথও দেখছি না চোখে। এমন সময় একটা তীব্র গোঙানি শুনে চেয়ে দেখলাম, জনৈক গোরা সৈন্য আমার ফিটনের ধাক্কায় রাস্তায় চিৎ হয়ে পড়েছে, এবং কী করব ভাবতে—না—ভাবতে নিমেষের মধ্যে ঘোড়া দুটো ও গাড়ির চাকাগুলো তার দেহের উপর দিয়ে চলে গেল মনে হল। ফিটন থামাব কি—না ভাবছি, এমন সময় ক্যাপ্টেন বললেন, ‘কী করছেন হিকি সাহেব? তাড়াতাড়ি গাড়ি হাঁকিয়ে কেটে পড়ুন, অন্ধকারে কেউ দেখতে পায়নি। সৈনিকের দফা শেষ হয়ে গেছে, তার জন্য কোনো চিন্তা নেই।’

বুকের ভেতরটা ঢিপ ঢিপ করে উঠল। ভয়ে অবশ হলে বলগা ছেড়ে দিলাম। ঘোড়া দৌড়ে ফোর্ট পার হয়ে গেল। বাইরে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। মনটা কিন্তু একেবারে দমে গেল। একটা নিরীহ লোককে এইভাবে বধ করলাম ভেবে কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। দ্বিতীয় দিন সকালে আমার বন্ধু ফোর্টের ডাক্তার উইলসনের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। ফোর্টের ভিতরে ঢোকার সময় পলাতক খুনি আসামির মতন অপরাধী বোধ করছিলাম। ডাক্তার উইলসনের কাছে গিয়ে, এ কথা—সে কথার পর, জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা, দু’একদিনের মধ্যে কোর্টের ভিতরে কোনো গাড়িচাপা—টাপার দুর্ঘটনা ঘটেছে কি?’ ডাক্তার বললেন, ‘দিন দুই আগে সন্ধ্যাবেলা একটি অদ্ভুত দুর্ঘটনা ঘটেছে। তৃতীয় রেজিমেন্টের একটি সৈনিক কর্নেল হ্যাম্পটনের কোচগাড়িতে চাপা পড়েছে। মনে হয় গাড়ির জোয়ালে জোরে বুকে ধাক্কা লেগেছিল, কর্নেল বুঝতে পারেননি বলে চলে গেছেন। সৈন্যটাকে আহত অবস্থায় ধরাধরি করে আমার কাছে নিয়ে আসতে, আমি তার অবস্থা দেখে ভাবলাম হয়তো টেঁসেই যাবে। কিন্তু খানিকটা রক্ত কেটে বার করে দেবার পর সে বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠল। এখন হাসপাতালে ভালই আছে, বোধহয় কাল সকালেই ছাড়া পেয়ে যাবে।’

এই কথা বলে ডাক্তার উইলসন বললেন, ‘সৈন্যটি নিজের দোষেই চাপা পড়েছিল। মদ খেয়ে বেশ উন্মত্ত অবস্থায় সে রাস্তা দিয়ে চলছিল, আর কর্নেলের ঘোড়াও গিয়েছিল খেপে, তিনি সামলাতে পারেননি। পলাশির গেট দিয়ে নাকি তীব্রবেগে তাঁর গাড়ি বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল। সৈন্যটির ধারণা, কর্নেলের গাড়ি, আমার ধারণা কিন্তু অন্যরকম। অন্য কারও গাড়ি, এবং আরোহী চারজন নয়, দু’জন। তবে এই সময় সন্ধ্যাবেলা প্রায় কর্নেল হ্যামিলটন গাড়ি করে ফোর্টের মধ্যে ঘুরে বেড়ান বলে সৈন্যটি তাঁর কথা বলেছে।’

আহত সৈন্যটি ভাল আছে ও সুস্থ হয়ে উঠেছে শুনে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। নিজের অপরাধ স্বীকার করার সাহসও পেলাম অনেক। ডাক্তারকে বললাম পূর্বাপর সব ঘটনার কাহিনি। শুনে তিনি আমার পলায়ন—কৌশলের জন্য ধন্যবাদ জানালেন। আমি বললাম, ‘লোকটি সুস্থ হয়ে উঠলে, অনুগ্রহ করে একদিন যদি তাকে আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন, আমি ক্ষতিপূরণ বাবদ তাকে কিছু টাকা দেব তাহলে।’ উইলসন রাজি হলেন।

কয়েকদিন পরে সৈন্যটি এল আমার বাড়িতে, তার রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে একখানি চিঠি নিয়ে। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘আপনার ক্ষতিপূরণের উদার প্রস্তাবে আমরা সকলেই খুব খুশি হয়েছি। তবে টাকাটা যদি সৈন্যটির হাতে না দিয়ে আপনি তার স্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেন তাহলে খুবই ভাল হয়। সৈন্যটি এমনিতে খুব ভাল, সাহসী ও কর্তব্যপরায়ণ, কিন্তু একটি মারাত্মক দোষ তার মদ্যপান। টাকা হাতে পেলে সে মদ খেয়ে উড়িয়ে দেবে। তার স্ত্রী অত্যন্ত পরিশ্রম করে চারটি ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন, সংসার দেখছেন, এবং মুখ বুজে মাতাল স্বামীর সব অত্যাচার সহ্য করছেন। সেইজন্য আমার অনুরোধ, টাকাটা আপনি দয়া করে তার স্ত্রীর কাছেই পাঠিয়ে দেবেন।’

চিঠি পেয়ে আমি তা—ই করলাম, বেশ মোটা একটা টাকা তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নামে পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু তাকেও একেবারে খালি হাতে বিদায় করতে কষ্ট হল, দু’টি সোনার মোহর দিলাম তাকে। পরে খবর পেয়ে খুশি হলাম যে সৈন্যটি সেই মোহর দু’টি নিজে খরচ না করে তার স্ত্রীকেই পাঠিয়ে দিয়েছিল। তার স্ত্রী তা—ই দিয়ে সংসারের প্রয়োজনীয় অনেক জিনিসপত্র কিনেছিলেন।

৭. হিকির স্মৃতিকথা

১৭৮৫ সনের এপ্রিল মাসে বেঞ্জামিন মি (Benjamin Mee) নামে আমার এক বন্ধু বিলেত থেকে বাংলা দেশে এসে উপস্থিত হলেন। তাঁর পিতা লন্ডন শহরের একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী এবং ‘ব্যাঙ্ক অফ ইংলন্ডে’—এর অন্যতম ডিরেক্টর ছিলেন। লন্ডনে তিনি রীতিমতো বিলাসিতার মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন এবং অর্থের অপব্যয়ও করেছেন যথেষ্ট। তা ছাড়া নানা রকমের ফাটকাবাজিতেও অনেক টাকা লোকসান দিয়েছেন। অবশেষে দেনার দায়ে পৈতৃক সম্পত্তির প্রায় অধিকাংশই তিনি পাওনাদারদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন। বন্ধুবান্ধবরা তখন তাঁকে পরামর্শ দেন, ভাগ্যান্বেষণের উদ্দেশে ভারতযাত্রা করতে। বাংলার সেনাবাহিনীতে একজন ক্যাডেটের চাকরি নিয়ে তিনি এ দেশে আসেন। উদ্দেশ্য যে চাকরি করা নয় তা বোঝাই যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষপুটে কোনোরকমে একবার এ দেশে পৌঁছে স্বাধীনভাবে কিছু করাই তাঁর লক্ষ্য ছিল। আমার সঙ্গে তাঁর ইংলন্ডেই আলাপ হয়, এবং বন্ধুত্বও গভীর হয় দু’জনের মধ্যে।

বে ঙ্গ ল ব্যা ঙ্ক

কলকাতা শহরে পৌঁছবার অল্পদিনের মধ্যেই বেঞ্জামিন ক্যাডেটের চাকরি ছেড়ে দেন এবং বেঙ্গল ব্যাঙ্কে অংশীদাররূপে যোগদান করেন। তখন ব্যাঙ্কের আরও দু’জন অংশীদার ছিলেন জেকব রাইডার ও মেজর মেটকাফ, দু’জনেই আমার বন্ধু। ব্যাঙ্কের ব্যবসা খুবই জমে উঠেছিল এবং লাভও হচ্ছিল যথেষ্ট। সারা এশিয়া মহাদেশের ব্রিটিশ অধিকারভুক্ত এলাকায় বেঙ্গল ব্যাঙ্কের নোট চালু হয়েছিল বেশ, নগদ টাকার মতনই তার লেনদেন হত সর্বত্র। এত বেশি পরিমাণ টাকার নোট চলত ব্যাঙ্কের, যা তখনকার দিনে সত্যিই কল্পনা করা যায় না। কিন্তু মানুষ সব সময় স্থিরবুদ্ধি ও দূরদৃষ্টি নিয়ে কাজ করে না, এমনকি নিজের মঙ্গল ও স্বার্থ কোথায় তা—ও বোঝে না। বেঙ্গল ব্যাঙ্কের অংশীদারদেরও তা—ই হল। তাঁরা দুর্বুদ্ধির বশবর্তী হয়ে, ব্যাঙ্কের উন্নতির দিকে মনোযোগ না দিয়ে, নানা রকমের বাণিজ্যের ও অর্থ উপার্জনের পরিকল্পনা করতে লাগলেন। কতকগুলি পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যেতে বাজারে তাঁদের সুনাম ক্ষুণ্ণ হল, লোকের আস্থা ভেঙে গেল তাঁদের উপর। লোকের বিশ্বাস হারালে ব্যাঙ্কের ব্যবসা চালানো যায় না। কিছুদিনের মধ্যেই তাই তাঁদের ব্যাঙ্কের দ্রুত অবনতি শুরু হল, এবং অবশেষে প্রতিষ্ঠানটি উঠেও গেল।

এই প্রসঙ্গে টমাস হেনচম্যানের কথা মনে পড়ছে। বিলেত থেকে একই জাহাজে তিনি বেঞ্জামিনের সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছিলেন। কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে তাঁর মতন বুদ্ধিমান চালাক লোক তখন আর কেউ ছিলেন কি না সন্দেহ। বেশ কয়েক বছর তিনি বাংলা দেশে ছিলেন কোম্পানির কনট্রাক্টর হিসেবে, এবং ইয়োরোপের বাজারের জন্য পোশাক—কাপড় সরবরাহ করাই তাঁর কাজ ছিল। এই কনট্রাক্টরি করে তিনি এত ক্লান্ত হয়ে পড়লেন যে স্বদেশে ইংলন্ডে তাঁকে ফিরে যেতে হল স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য। তিন বছর পরে তিনি আবার ফিরে এলেন কলকাতায়, কোম্পানির কনট্রাক্টররূপে নয়, মিলিটারি পে—মাস্টার—জেনারেলের বিরাট চাকরি নিয়ে। হেনচম্যানের কৃতিত্ব কোনোমতেই অস্বীকার করার উপায় নেই।

মু র্শি দা বা দ

মুর্শিদাবাদের নবাব দরবারে আমার বন্ধুবর যে ‘রেসিডেন্ট’ নিযুক্ত হয়েছিল, সে কথা আগে বলেছি। বড় চাকরি পেয়েও পট যে তার অ্যাটর্নি বন্ধুর সুখ—দুঃখের কথা ভোলেনি তা বুঝলাম যখন দেখলাম যে সে মুর্শিদাবাদ থেকে খোঁজখবর করে একটি সুন্দর এ দেশি মেয়ে আমাকে কলকাতায় উপঢৌকন পাঠিয়েছে, আমার নিজের ভোগের (হিকির ভাষায়, ‘for my private use’)। মেয়ের নাম কিরণ (অর্থাৎ কিরণমালা)। কিরণমালার সঙ্গে প্রায় বছরখানেক মনের সুখে একত্রে বাস করার ফল হল একটি পুত্রসন্তান। মনে মনে আমি মেনে নিতে বাধ্য হলাম যে সে আমারই সন্তান, যদিও তার ঘন কালো চুল ও কালো রং দেখে মনটা আমার আদৌ প্রসন্ন হয়নি। পুত্রের গায়ের ও চুলের রঙের কথা চিন্তা করে মধ্যে মধ্যে মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে যেত।

একদিন বাইরে থেকে বেড়িয়ে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত সময়ে বাড়ি ফিরে দেখলাম, মাদাম কিরণমালা ঘরের মধ্যে বিছানার উপর আমার একজন খিদমতপাত্রকে জড়িয়ে ধরে দিব্যি শুয়ে অকাতরে ঘুমুচ্ছে। পাশে নবজাত সন্তানটিও গভীর ঘুমে মগ্ন। আমি সন্তর্পণে পিছনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকেছি, তাদের ঘুম ভাঙার কথা নয়। নিদ্রাভিভূত কিরণমালা ও খিদমতগারকে ডাক দিতেই তারা উঠে বসে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। বোধহয় ভাবছিল, আমি স্বপ্নের ছায়ামূর্তি, না বাস্তব কায়ামূর্তি। আমি অবশ্য একটুও বিচলিত হইনি। তাদের ঘুম ও বিস্ময়ের ঘোর কাটার পর প্রশ্ন করে জানলাম যে কেবল আমি নই, আমার নোকর খিদমতগারও কিরণমালার সঙ্গে সমানে এতদিন ধরে সহবাস করে এসেছে। নবজাত আবলুস কাঠের মতন পুত্রের জন্মরহস্যও অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেল। ভৃত্য ও কিরণমালা দু’জনকেই সন্তানসহ বিদায় করে দিলাম বাড়ি থেকে। কিন্তু পরে যখন শুনলাম, কিরণ খুব দুঃখে দিন কাটাচ্ছে, তখন তার জন্য একটা মাসোহারার বন্দোবস্ত না করে পারলাম না।

মেজর রাসেল কয়েক মাস ধরে পেটের অসুখে ভুগছিলেন। কিছুতেই তাঁর অসুখ সারছে না দেখে ডাক্তাররা তাঁকে হাওয়া বদল করতে বললেন। রাসেল ঠিক করলেন মুর্শিদাবাদে পটের কাছে কিছুদিনের জন্য বিশ্রাম নিতে যাবেন। আমাকে তাঁর সঙ্গী হিসেবে যাবার জন্য অনুরোধ করতে আমিও রাজি হলাম। অনেকদিন শহর ছেড়ে বাইরে যাইনি, মনটাও হাঁপিয়ে উঠেছিল। মুর্শিদাবাদ যাওয়া স্থির হয়ে গেল। একটি ভাল পানসি নানাবিধ খাদ্যদ্রব্যে ও পানীয়ে ভর্তি করা হল আমাদের মুর্শিদাবাদ সফরের জন্য। যাবার পথে নদীতীরের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে করতে চললাম। পলাশিগৃহ—এবং পলাশির সেই ঐতিহাসিক রণাঙ্গন দেখলাম, যেখানে ক্লাইব সিরাজের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে এ দেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত স্থাপন করেছিলেন। কলকাতা থেকে নৌকোয় করে মুর্শিদাবাদ পৌঁছতে আট দিন সময় লাগল। পট থাকত আফলবাগে কাশিম বাজারের নদীর তীরে, বহরমপুর সেনাবাস থেকে তিন মাইল এবং মুর্শিদাবাদ শহর থেকে দু’মাইল দূরে। এই মুর্শিদাবাদ শহরেই বাংলার নবাব তখনও বাস করতেন।

পট যে বাড়িতে বাস করত তা রাজপ্রাসাদ বললেও ভুল হয় না। বাড়িতে তার আসবাবপত্তর যথেষ্ট ছিল, সবই রাজকীয় স্টাইলের। পট থাকতও রাজার মতন। মেজর রাসেল ও আমাকে সাদরে অভ্যর্থনা করে পট তার প্রাসাদে নিয়ে গেল। আমার জন্য প্রাসাদের একটা দিক আগে থেকে সাজিয়ে—গুছিয়ে সে ঠিক করে রেখেছিল। পরম আরাম—বিলাসে বসবাস করার জন্য একজন মানুষের যা কিছু প্রয়োজন হতে পারে তার সবই সে ব্যবস্থা করেছিল। স্নানের জন্য ঠান্ডা—গরম জল থেকে আরম্ভ করে, এ দেশে ভোগবিলাসের জন্য প্রয়োজনীয় কোনো সামগ্রীরই অভাব ছিল না।

পরদিন সকালে পটের সঙ্গে আমার বহরমপুর বেড়াতে যাওয়া স্থির হল। সকালে উঠে দেখলাম পটের প্রাসাদের বিশাল সোপানশ্রেণির দু’পাশে সারিবদ্ধ হয়ে সাজগোজ করে ভৃত্যরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমরা যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম তখন আমাদের তারা এ দেশি কায়দায় সেলাম করতে লাগল। সিঁড়ি দিয়ে নেমে প্রাঙ্গণে পৌঁছতে দেখলাম, একদল সুসজ্জিত অশ্বারোহী চমৎকার সব আরবি ঘোড়ার পিঠের উপর সুন্দর ভঙ্গিতে বসে রয়েছে। তাদের কোমরের পাশে তলোয়ার ঝুলছে। সামনে আমাদের জন্য একটি বড় ফিটন প্রস্তুত ছিল। আমরা ফিটনে ওঠার সময় অশ্বারোহীরা তলোয়ার খুলে অভিনন্দন জানাল। এত সব চোখ—ধাঁধানো ব্যাপার দেখতে অভ্যস্ত নই বলে পটকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এসব আবার কী?’ পট হাসতে হাসতে বলল, ‘এরা আমার দেহরক্ষী, সংখ্যায় ষাটজন। আমি যখন কোথাও বেরুই তখন এরা এইভাবে হাজরে দেয়।’ ফিটনে উঠে পট যখন ঘোড়ার লাগাম ধরল, তখন দু’জন অশ্বারোহী আগে দৌড়তে লাগল সামনে, এবং দশজন চলল পিছনে। এইভাবে রক্ষী—পরিবৃত হয়ে আমরা বহরমপুর পৌঁছলাম। সেনাবাসের অফিসাররা আমাদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ইয়োরোপীয় দেশি সৈন্যদের ব্যারাক দেখালেন। বহরমপুরের অন্যান্য সরকারি অফিস—ঘরবাড়িও দেখলাম। আমার দু’চারজন পুরনো বন্ধু তখন এখানে থাকতেন। তাঁদের মধ্যে কাশিমবাজার কুঠির প্রধান মিস্টার কেলি ও মুর্শিদাবাদের কমার্শিয়াল রেসিডেন্ট মিস্টার এডওয়ার্ড ফেনউইকের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। অতঃপর কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে অন্যান্য পরিচিত বন্ধুবান্ধব যাঁরা ছিলেন তাঁদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে আমাদের নামের একটি করে কার্ড রেখে এলাম। হঠাৎ খবর না দিয়ে আসার জন্য তাঁদের অনেকের সঙ্গেই সাক্ষাৎ হল না। এইসব কাজ সারতেই বেলা বেড়ে গেল অনেক। মধ্যাহ্নভোজনের জন্য তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হল।

বেলা দুটোর সময় খাবার টেবিলে আমরা প্রায় তিরিশজন খেতে বসলাম। নবাগত অতিথি মেজর রাসেল ও আমি ছাড়া, পটের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব আরও কয়েকজন সেখানে থাকতেন। সকাল—সন্ধ্যায় প্রত্যেকের বেড়াবার জন্য গাড়িঘোড়া মজুত থাকত, পটের জন্য থাকত আলাদা একটি ফিটন। আমি যাবার পর পট বাড়ির প্রত্যেক লোকজনকে আমার প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে বলে দিয়েছিল, কারণ আমার যা পেশা তাতে বাইরে বেড়াবার অবকাশ খুব কম এবং কোনো জায়গায় একবারের বেশি দু’বার আসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব দু’বেলা যাতে গাড়ি করে আমাকে এ অঞ্চলের সমস্ত দ্রষ্টব্য স্থান দেখিয়ে নিয়ে বেড়ানো হয়, তার ব্যবস্থা করারও নির্দেশ দিয়েছিল পট। প্রতিদিনের ভ্রমণ—তালিকাও সেইভাবে সে তৈরি করে দিয়েছিল। নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়ে দিনগুলো যে কেমন করে কেটে যেত তা আমি টেরও পেতাম না।

অনেক জায়গার মধ্যে নবাবের প্রাসাদে বেড়াতে যাবার কথা স্বভাবতই বিশেষভাবে মনে আছে। যাবার আগের দিন পট নবাব—বাহাদুরকে খবর পাঠিয়েছিল যে সে তার বিশেষ অন্তরঙ্গ বন্ধুকে নিয়ে পরদিন সকালে তাঁর প্রাসাদে দেখা করতে যাবে এবং তাঁর সঙ্গে ব্রেকফাস্ট খাবে। নির্দিষ্ট দিনে সকালে যখন আমরা নবাব—প্রাসাদে পৌঁছলাম তখন নবাব আমাদের সাদর অভিনন্দন জানালেন এবং আপ্যায়ন করে প্রাসাদের ভিতরে নিয়ে গেলেন। সাহেবি রুচি অনুযায়ী আমাদের জন্য ব্রেকফাস্টের চমৎকার আয়োজন করা হয়েছিল। খাওয়া শেষ হলে নবাব—বাহাদুর নিজে আমাদের তাঁর বিশাল প্রাসাদের সমস্ত ঘুরে ঘুরে দেখালেন। প্রাসাদের সংলগ্ন তাঁর উদ্যান দেখলাম, গাড়িঘোড়ার আস্তাবলও দেখলাম। নবাবের জীবনযাত্রার এইসব বিচিত্র উপকরণ দেখে যে রীতিমতো চমৎকৃত হয়েছিলাম তা বলাই বাহুল্য।

নবাবের প্রাসাদ থেকে আফজলবাগে ফিরে আসার সময় পথে একজন এ দেশি সাধু দেখলাম। দেখে মনে হল সাধুটি খোঁড়া এবং পথের ধারে দাঁড়িয়ে পথিকদের কাছে ভিক্ষা চাইছে, কিন্তু তার ভিক্ষা চাওয়ার ভঙ্গি অদ্ভুত। পথের ধারে দাঁড়িয়ে বিকট সুরে চিৎকার তো করছেই, উপরন্তু যেসব অঙ্গভঙ্গি করছে তা—ও ভয়ংকর। পাশ দিয়ে যাবার সময় পট সাধুটিকে লক্ষ্য করে একটি করে টাকা ছুড়ে দিল। আশ্চর্য ব্যাপার দেখলাম, সাধুটি টাকার দিকে চেয়েও দেখল না, ততোধিক তাচ্ছিল্যের সঙ্গে অন্যদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে অনর্গল দুর্বোধ্য মাতৃভাষায় কী যেন বকবক করতে লাগল। কণ্ঠস্বর ও প্রকাশভঙ্গি থেকে মনে হল, সাধু রীতিমতো ক্রুদ্ধ হয়ে কী বলছে। পটকে জিজ্ঞাসা করাতে সে বলল, সাধুটি নাকি অকথ্য ভাষায় আমাদেরই গালাগাল দিচ্ছে। পটের মতে তার কটূক্তির তাৎপর্য হচ্ছে এই—

‘আরে হারামজাদা বিলেতি বাঁদর। দয়ার অবতার মনে করছ নিজেকে? তাচ্ছিল্য করে সাধুকে একটা টাকা ছুড়ে দিয়ে টাকার গরম দেখাচ্ছ হা—রা—ম—জা—দা। আরে বিলেতি বাঁদর, টাকার গরম কী দেখাচ্ছিস আমাকে! তা—ও বুঝতাম যদি অন্তত একশো টাকা ছুড়ে দিতিস। বিলেতি বাঁদর হয়ে তোরা রাজপ্রাসাদে থাকিস, আর সাধু হয়ে আমার মাথা গোঁজার স্থান নেই। শত শত ভৃত্য তোদের সেবা করে, আর কীটপতঙ্গ—মাছির উপদ্রবে আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠি। ব্যাটা বাঁদর, বড় অহংকার হয়েছে তোদের! সামনে—পেছনে ঘোড়সওয়ার ছুটিয়ে, পথের ধুলো উড়িয়ে লোকজন তাড়িয়ে রথ হাঁকিয়ে চলেছিস! নবাব রে! আবার এত বড় স্পর্ধা হয়েছে যে যাবার সময় ব্রাহ্মণ—সাধুকে লক্ষ্য করে একটা ময়লা টাকা ছুড়ে দিচ্ছিস? হারামজাদা বিলেতি বাঁদর, ভেবেছিস এইভাবে দান করে স্বর্গে যাবি? তা হবে না, সে পথ বন্ধ। জঘন্য নরকে যাবি তোরা এবং সেখানে যমরাজ তোদের অন্যায় অত্যাচার ও পাপের জন্যে আষ্টেপৃষ্ঠে চাবুক মেরে শায়েস্তা করবে।’

পটের এই ব্যাখ্যা শুনে আমি অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘পথে গাড়ি হাঁকিয়ে যেতে যেতে এত কথা তুমি শুনলে কী করে, এবং যদি না শুনেও থাকো তাহলে এ দেশি ভাষার অর্থ বুঝলে কী করে? সবটাই তোমার কল্পনা নয় তো?’ উত্তরে পট বলল যে, সে বহুবার পথ চলতে এই সাধুকে দেখেছে, তার কথা শুনেছে, এবং গাড়ি থেকে নেমে সাধুর সামনে দাঁড়িয়ে দোভাষীকে দিয়ে তার কটূক্তির অর্থ বুঝে নিয়েছে।

তিন দিন পরে নবাব—বাহাদুর সাড়ম্বরে পারিষদ—অনুচর পরিবৃত হয়ে আফজলবাগে পটের বাড়িতে এলেন সামাজিক শিষ্টতা রক্ষার জন্য। আমাদের তিনি নৈশভোজের নিমন্ত্রণ করে গেলেন। সেদিন রাতে সদলবলে আমরা নবাব—প্রাসাদে গিয়ে পর্যাপ্ত ভূরিভোজে আপ্যায়িত হলাম, এবং তার সঙ্গে চমৎকার আতশবাজির উৎসবও দেখলাম।

অবশেষে একদিন অসংখ্য এ দেশি বাঁদর দর্শনের পর আমার মুর্শিদাবাদ সফর শেষ হল। দশ—বিশটা বাঁদর নয়, কয়েক হাজার বাঁদর দেখলাম একসঙ্গে। তাদের ডেরা ছিল মুর্শিদাবাদ থেকে মাইল পাঁচেক দূরে একটি নিভৃতে আম্রকুঞ্জে। এ অঞ্চলের অনেক পর্যটক এই বাঁদর—উপনিবেশ দেখতে আসতেন বলে তারা নরসান্নিধ্যে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। নরমূর্তি দেখে বাঁদরের দল আদৌ বিচলিত হত না, বরং বেশ নিকট আত্মীয়—বন্ধুর মতন সোৎসাহে লেজ তুলে দর্শকদের কাছে এসে ঘিরে বসত, এবং হাত—পা জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করত। কিচিরমিচির শব্দ ও কুৎসিত মুখভঙ্গিমা করে একপাল বাঁদর কাছে আসতেই আমি ভয় পেয়ে গেলাম। সঙ্গীরা আমাকে শান্ত করে বললেন, ভয় পাবার কিছু নেই, ওরা খাবার চাইছে। পট মধ্যে মধ্যে যখন বাঁদর দেখতে আসত তখন সঙ্গে করে প্রচুর পরিমাণে কেক—মিস্টি—কলা নিয়ে আসত। বাঁদরগুলির হাবভাব দেখে মনে হল, সেদিনও যে আমরা এসব খাবার নিয়ে গেছি তা তারা জানে। কেক—মিষ্টি—কলা বিতরণ করার পর বাঁদরগুলি মহানন্দে তারস্বরে চিৎকার করতে করতে লাফ দিয়ে আবার গাছের ডালে উঠে গেল।

.

পরদিন এইভাবে আফজলবাগে কেটে গেল। আর থাকা চলে না, কলকাতায় ফিরতে হবে। মেজর রাসেল আরও কিছুদিন থাকবেন মনস্থ করলেন। পটের একখানি বগিগাড়িতে করে নির্দিষ্ট দিনে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করলাম। গাড়ি করে পলাশিগৃহ পর্যন্ত পৌঁছে দেখলাম, সেখানে বেয়ারারা পালকি নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। গাড়ি থেকে নেমে পালকিতে চড়লাম। অনেকে দেখেছি, বেশ স্বচ্ছন্দে পালকির মধ্যে শুয়ে ঘুমিয়ে যেতে পারেন, আমি তা পারি না। পারতপক্ষে পথ চলাচলের জন্য যত দূর সম্ভব আমি পালকি এড়িয়ে চলি। এক্ষেত্রে গত্যন্তর নেই বলে বাধ্য হয়ে পালকিতে চলতে হল। পালকি—বেয়ারারা সাধারণত ঘণ্টায় চার মাইল করে পথ চলে, সূর্যাস্তের পর ছায়া নামলে তার চেয়ে বেশিও যেতে পারে। দিনের বেলা রোদের তাপে পালকি বইতে তাদের খুবই কষ্ট হয়। পালকির পিছনে আরোহীর মালপত্তর নিয়ে কুলিরা দৌড়তে থাকে। পথ দীর্ঘ হলে স্বভাবতই একদল বেয়ারা আগাগোড়া পালকি বইতে পারে না। সমস্ত পথটা বিভিন্ন ‘স্টেজ’—এ বা পর্বে ভাগ করা থাকে, সাধারণত আট মাইল অন্তর এক—একটি পর্বের শেষ হয়। দুই পর্ব পর্যন্ত পথ চলার পর বেয়ারা বদল হয়, অর্থাৎ একদল বেয়ারা ষোলো মাইল পথ পালকি টানে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তখন গ্রীষ্মকাল এবং গরমও এত বেশি যে হেঁটে পথ চলাই দুঃসাধ্য। তার উপর অধিকাংশ পথই হল খোলা মাঠের উপর দিয়ে। যেদিকে চেয়ে দেখো সেদিকেই কেবল মাঠ আর মাঠ। ধু—ধু করছে দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, রোদের হলকা ছুটছে মাটি দিয়ে, গাছপালা, ঝোপঝাড় কিছুরই চিহ্ন নেই কোথাও। মাথার উপরে ঝকমকে নীল আকাশ, তার মধ্যে জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডের মতন সূর্য চারিদিকে যেন ঝলসে দিচ্ছে। বেয়ারা প্রায় আট ক্রোশ পথ চলার পর রোদের ঝলসানিতে মুষড়ে পড়ল, কাতরসুরে বলল, ‘সাহেব, আর আমরা পালকি বইতে পারব না।’ তাদের মুখের দিকে চেয়ে বুঝলাম, আর এক পা—ও পালকি টানার ক্ষমতা নেই তাদের। অন্য একদল বেয়ারা তারা খোঁজ করল, কিন্তু গ্রাম কোথায় আর লোকই বা কোথায়? ন্যাড়া মাঠের মধ্যে অসহায় অবস্থায় পালকিতে বসে রইলাম। প্রায় ঘণ্টাখানেক বসে থাকার পর অসহ্য গরমে অনিশ্চয়তার মধ্যে ছটফট করছি, এমন সময় মাথায় এক মতলব খেলে গেল। এর মধ্যে বেয়ারাদেরও প্রায় ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নেওয়া হয়ে গেছে। তাই ভাবলাম কিছু বেশি পয়সা বকশিস বা ঘুস দেবার লোভ দেখালে হয়তো তারা উৎসাহিত হতে পারে। টাকাপয়সা, বিশেষ করে বকশিস ও ঘুস এমন জিনিস যে তাতে সব জাতের মানুষের উপর সমান ক্রিয়া হয়। এ দেশে এসে এ অভিজ্ঞতা আরও বেশি করে লাভ করেছি। নির্জীব মানুষকে ঘুস সজীব করে তোলে, অথর্ব ও পঙ্গুকে নতুন জীবনীশক্তি দান করে। ঘুসের জাদুস্পর্শে খোঁড়াও সোজা হয়ে দৌড়তে আরম্ভ করে। অতএব বেয়ারাদের কাছে বেশ লোভনীয় ঘুসের প্রস্তাব করলাম। সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম তারা চাঙ্গা হয়ে উঠল, বুক টান করে সোজা হয়ে দাঁড়াল এবং দ্বিগুণ উৎসাহে পালকির বাঁট কাঁধে তুলে হনহন করে পথ চলতে লাগল। কিন্তু মানুষ তো, শক্তির সীমা আছে। ঘুসের মাদকতায় তারা মাত্র ছ মাইল পথ পালকি বয়ে নিয়ে গেল। তারপর বিশাল এক জনশূন্য প্রান্তরের মধ্যে আমাকে নামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আর পারব না।’ তখন প্রায় দ্বিপ্রহর, সূর্যের তাপে গোটা মাঠটা জ্বলন্ত চুল্লির মতন গনগন করছে। বহু কাকুতিমিনতি করে ও টাকার লোভ দেখিয়েও আর কোনো ফল হল না। তাদের ভাবগতিক দেখে মনে হল, আর এক পা—ও চলতে তারা রাজি নয়। নিজেদের মধ্যে চাপা সুরে কিছুক্ষণ কী যেন তারা আলাপ করল, তারপর আমাকে মাঠের মধ্যে ফেলে হঠাৎ এমন ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে আরম্ভ করল যে আমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। কী ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারলাম না। অনেকদিন হয়ে গেল এ দেশে আছি, এরকম বিচিত্র অভিজ্ঞতা এর আগে কখনও হয়নি। সেদিন মনে হল, এই মাঠের মধ্যেই বোধহয় আমাকে দগ্ধে দগ্ধে মরতে হবে।

তাকিয়ে দেখলাম, শূন্য মাঠের উপর দিয়ে বেয়ারারা প্রাণপণে দৌড়চ্ছে, প্রায় মাইল তিনেক দূরে একটা গাছের ঝোপের মতন কী দেখা যাচ্ছে সেইদিকে। সেটা কোন দিক, পূর্ব পশ্চিম, না উত্তর দক্ষিণ, এবং ওই ঝোপটাই বা কীসের, কিছুই উপলব্ধি করতে পারলাম না। মাথার ঘিলু রোদের তাপে গলে তরল হয়ে গেছে মনে হল। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে লাগল, মনে পড়ল ১৭৫৭ সনে কলকাতার অন্ধকূপ হত্যার কাহিনি। সূর্যাস্তের পর ছায়া নামলে যে নিশ্চিন্ত হব তা—ও তখন ভাবতে পারছি না। কারণ আগেই শুনেছি, এ অঞ্চলে বাঘের উপদ্রব ভয়ঙ্কর, এবং সন্ধ্যার অন্ধকারে শিকারের সন্ধানে তারা বাইরে বেরোয়। দিনে রোদ এবং রাতে বাঘ, এই ভয়াবহ উভয়সংকটের চিন্তায় কাতর হয়ে পড়লাম। একবার মনে হল রোদে পুড়ে মরার চেয়ে বাঘের পেটে যাওয়া ভাল, আবার পরক্ষণেই বাঘের পেটে যাওয়ার আতঙ্কে শিউরে উঠে ভাবলাম রোদে দগ্ধে মরা অনেক ভাল। নানা রকমের উগ্রচিন্তা ও কল্পনা কিলবিল করতে লাগল মাথার মধ্যে। শেষে ক্লান্ত হয়ে পালকির ভিতরে ঢুকে শুয়ে রইলাম।

ঘণ্টা দুই পালকির ভিতরে শুয়ে থাকার পর দূরে মনে হল কারা যেন এইদিকে আসছে। আরও কাছে এগিয়ে আসতে মনে হল, আমারই পালকিবেয়ারা। তারা আবার দল বেঁধে ফিরে আসছে। মনে একটু আশার সঞ্চার হল। ফিরে আসার পর তারা বলল, মাইল আড়াই—তিন দূরে একটা আমবাগান ও পুকুর আছে তারা জানত। দৌড়ে গিয়েছিল তারা সেই পুকুরে স্নান করার জন্য। তা না হলে এই গরমে আজ তাদের আধমরা হয়ে শুয়ে পড়ে থাকতে হত। পুকুরে স্নান করে, আম গাছ থেকে আম পেড়ে খেয়ে, বাগানের ছায়ায় তারা ঘণ্টা দুই ঘুমিয়ে এসেছে। এখন তাদের ক্লান্তি দূর হয়েছে, পূর্ণ উদ্যমে পালকি বইতেও তাদের আপত্তি নেই। এতক্ষণ পরে আমার দুঃস্বপ্নের ঘোর কাটল। পালকি চলল প্রান্তরের উপর দিয়ে। একটা গ্রামের কাছে পালকি আসতে থামতে বললাম বেয়ারাদের। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে গেছে। একটা তরমুজ কিনলাম গ্রাম থেকে এবং তা—ই খেয়ে কোনোরকমে তৃষ্ণা নিবারণ করলাম।

বিকেল চারটে নাগাদ হুগলি পৌঁছলাম, কলকাতা থেকে মাইল তিরিশ দূরে। হুগলিতে আমার এক বন্ধু কিনলক সাহেব থাকতেন। তাঁর বাড়িতে উঠে, একটু জলযোগ ও বিশ্রাম করে, কলকাতামুখো রওয়ানা হব ঠিক করলাম। বাড়িতে গিয়ে শুনলাম, প্রায় তিন দিন হল আমার বন্ধুটি শিকার করতে বেরিয়েছেন, সপ্তাহান্তে ফিরবেন। তাঁর ভৃত্যরা সংবাদ দিল। আমার রোদে—পোড়া ক্লান্ত চেহারা দেখে খানসামা বুঝল যে আমি বিশ্রাম নিতে এসেছি। সে আমাকে বাড়ির ভিতরে আহ্বান করে নিয়ে গিয়ে বিশ্রাম করতে অনুরোধ করল। তারপর খানসামাটি আমাকে আশ্বাস দিল যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে আমার জন্য কিছু খানা তৈরি করে নিয়ে আসছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই সে চমৎকার খানার সঙ্গে এক বোতল ক্ল্যারেট আনতেও ভুলল না। খানাপিনা শেষ করে মনে হল, বন্ধুর খানসামার কৃপায় পুনর্জীবন লাভ করেছি। খানসামাটি আমাকে সুন্দর একটি সাজানো শয়নকক্ষে নিয়ে গিয়ে ঘুমুতে বলল, কিন্তু আমি আর দেরি করতে পারলাম না। তাকে বললাম, আমাকে কলকাতায় ফিরতেই হবে, তা না হলে কাজের ক্ষতি হবে, এবং বিশ্রাম নিয়েও স্বস্তি পাব না। সন্ধ্যা সাতটার সময় হুগলি থেকে পালকিতে রওনা হয়ে রাত প্রায় দুটোর সময় কলকাতায় পৌঁছলাম আমার বাড়িতে। বাড়ি পৌঁছেই সোজা ঘরে গিয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়ে ঘুম দিলাম। আমার মুর্শিদাবাদ সফরের কাহিনি এইখানে শেষ হল।

ক র্ন ও য়া লি সে র আ গ ম ন

১৭৮৫ সনের আগস্ট মাসে দু’জন ভদ্রলোক কলকাতা এসে পৌঁছলেন ইংলন্ড থেকে। একজন স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত ডাক্তার জেমস হেয়ার, আর—একজন ব্যারিস্টার রবার্ট লেডলি। কলকাতায় দু’জনেই প্র্যাকটিস করতে এসেছেন, একজন ডাক্তারি; একজন ব্যারিস্টারি। দু’জনেই বিশিষ্ট গুণী ভদ্রলোক, কলকাতার সাহেবসমাজে তাঁদের উপস্থিতিতে বেশ সাড়া জাগল।

আমি এই সময় কলকাতার ‘Bachelor’s Club’—এর একজন সভ্য নির্বাচিত হয়েছি। নাম দেখেই বোঝা যায়, ক্লাবটি কেবল অবিবাহিত পুরুষদের জন্য। কেউ বিবাহ করলে তাঁকে সভ্যপদ ত্যাগ করতে হত। আমি যখন সভ্য নির্বাচিত হই, তখন ক্লাবের সভ্যসংখ্যা কুড়িজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এই ধরনের ক্লাবের সভ্যপদ যে খুব বেশি দিন কেউ বজায় রাখতে পারতেন না তা বলাই বাহুল্য। ঘন ঘন ক্লাবের সভ্য বদল হত। অবিবাহিত সভ্যরা বিবাহ করে পদত্যাগ করতেন, আবার নতুন সভ্য নির্বাচিত হত। ক্লাবটি ছোট হলেও, কলকাতার সাহেবসমাজে তার নামডাক ছিল খুব। প্রায় বিশ বছরের উপর ক্লাবটি টিকে ছিল।

সেপ্টেম্বর মাসের (১৭৮৫ সন) গোড়ার দিকে লর্ড কর্নওয়ালিস কলকাতা এসে পৌঁছলেন, গবর্নর—জেনারেল ও কমান্ডার—ইন—চিফ, উভয় পদের দায়িত্ব নিয়ে। কর্নওয়ালিসের আগে আর কাউকে এই যুক্ত—পদের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। তাঁর সঙ্গে প্রাইভেট সেক্রেটারি হয়ে এলেন কর্নেল রস, এবং ‘এডি’ হয়ে এলেন দু’জন—ক্যাপ্টেন হলডেন ও ক্যাপ্টেন ম্যাডাম। রস, হলডেন ও ম্যাডাম তিনজনেই আমাদের অবিবাহিতদের ক্লাবের সভ্য নির্বাচিত হলেন।

লর্ড কর্নওয়ালিসের উপস্থিতির কয়েকদিনের মধ্যেই উইলিয়াম বার্ক তাঁর বাগানে বিরাট এক ভোজের আয়োজন করলেন। নবাগত গবর্নর—জেনারেলকে আপ্যায়ন করাই তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। কর্নওয়ালিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় হবার সুযোগ হয় আমার এই ভোজসভায়। তাঁর ভদ্র ও শিষ্ট আচরণে আমি মুগ্ধ হই। সুরাযোগে চর্বচোষ্য ভোজ খাওয়া রাত্রি প্রায় আটটা পর্যন্ত চলবার পর, কর্নওয়ালিস শহরে ফিরে আসার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বার্ক তাঁকে অনুরোধ করলেন আরও কিছুক্ষণ থাকার জন্য, তিনি অনুনয়—বিনয় করে বললেন যে, খাদ্য ও পানীয় দুইই তিনি খুব উপভোগ করে পর্যাপ্ত পরিমাণে খেয়েছেন, আর কিছু খাবার ক্ষমতা তাঁর নেই। গৃহে ফিরে তাঁকে অনেক দরকারি কাজ সারতে হবে, এর বেশি পানভোজন করলে তিনি কিছু করতে পারবেন না।

মিস্টার বার্ক তাঁকে কোচে তুলে দিয়ে এলেন। তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি কর্নেল রসও ভোজ টেবিল থেকে উঠে পড়েছিলেন, কিন্তু বার্ক তাঁকে ছাড়লেন না। কর্নওয়ালিস তাঁর দিকে চেয়ে বললেন, ‘যতক্ষণ খুশি বার্ক সাহেব আপনি মিস্টার রস ও অন্যান্যদের আটকে রাখুন। মিস্টার রসকে বসিয়ে যতক্ষণ ইচ্ছা খাওয়ান, আমার আপত্তি নেই।’ এই কথা বলে তিনি কোচ হাঁকিয়ে চলে গেলেন। একাই গেলেন, সঙ্গে একজনও ভৃত্য, চাপরাশি বা সিপাই কেউ গেল না দেখলাম। শুনেছি, যতদিন কর্নওয়ালিস বাংলা দেশে ছিলেন, ততদিন তিনি কেবল সরকারি ব্যাপারে ছাড়া কোনো ব্যক্তিগত বা সামাজিক ব্যাপারে কখনও সিপাই—ভৃত্য পরিবেষ্টিত হয়ে চলাফেরা করতেন না। যে কোনো সাধারণ সুরুচিসম্পন্ন ভদ্রলোকের মতন বিনা আড়ম্বরে একাই তিনি চলাফেরা করতে ভালবাসতেন।

বার্কের বাগানবাড়িতে খানাপিনার অভিজ্ঞতার পর কর্নওয়ালিস মনস্থ করেন, বাইরে কারও বাড়িতে আর কোনোদিন নিমন্ত্রণ খাবেন না। প্রত্যেকদিন তাঁর গৃহেই তিনি প্রায় কুড়ি—পঁচিশজন নিমন্ত্রিত অতিথিদের নিয়ে ডিনার খেতেন। কেবল প্রথানুযায়ী বছরে একদিন চিফ জাস্টিসের বাড়ি, অথবা কোনো সরকারি উৎসবে তিনি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতেন। এ ছাড়া বাড়ির বাইরে কখনও কোনো খানাপিনার সভায় তিনি যেতেন না। তাঁর পরিবারের সকলের সঙ্গেই আমার অন্তরঙ্গ পরিচয় হয়েছিল বলে সপ্তাহে অন্তত একদিন আমিও তাঁর বাড়ি নিমন্ত্রণ খেতে যেতাম। নির্দিষ্ট সময়ে খানা টেবিলে বসা হত, গ্রীষ্মকালে বেলা চারটেয়, শীতকালে বেলা তিনটের সময়। গবর্নর—জেনারেল প্রায় দু’ঘণ্টা সময় খানা টেবিলে কাটাতেন এবং নিজে পানভোজন তদারক করতেন। টেবিলের উপর মদের বোতল হাতে হাতে ঘুরবে, এই ছিল তাঁর নির্দেশ। কেউ যদি বোতল ‘pass’ করতে দেরি করতেন, অথবা তাতে ছিপি আঁটতে ভুলে যেতেন, তাহলে কর্নওয়ালিস খানা টেবিলে বসেই ঠাট্টা করে বেশ দু’কথা তাঁকে শুনিয়ে দিতেন। এইভাবে দু’ঘণ্টা ধরে প্রত্যহ নিমন্ত্রিত অতিথিদের নিয়ে তাঁর গৃহে নিয়মিত ডিনার খাওয়া চলত।

তখনকার রীতি অনুযায়ী প্রত্যেক বছর ক্রিসমাসের দিন গবর্নর—জেনারেল, তাঁর কৌন্সিলের সদস্যরা এবং কলকাতা শহরের গণ্যমান্য সাহেবসুবোরা সকলে কোর্টহাউসে একত্রে মিলে ডিনার খেতেন। রাতে মহিলারা ‘সাপার’ খেতেন এবং শেষে ‘বল নাচ’ হত। সে বছরেও ভোজের দিন ঠিক হল ২৫ ডিসেম্বর। লর্ড কর্নওয়ালিস এই পদ্ধতিতে ক্রিসমাস উৎসবপালনের বিরোধী ছিলেন। কারণ তাঁর মতে এইভাবে নাচ—গান—হল্লার মধ্যে ধর্মোৎসব পালন করলে তার কোনো গাম্ভীর্য বা মর্যাদা রক্ষা করা হয় না। কলকাতা শহরে ইংরেজরা যে ক্রিসমাস উৎসবকেও এই ভোগবিলাসের স্তরে নামিয়ে এনেছেন, এ দৃশ্য দেখে তিনি মর্মাহত হয়েছিলেন। তারপর থেকে, প্রধানত কর্নওয়ালিসের জন্যই, ক্রিসমাস উৎসবের ধারা বদলে যায় কলকাতায়।

.

বা ণি জ্য—বো র্ডে র বি রু দ্ধে অ ভি যো গ

১৭৮৬ সনের জানুয়ারি মাস থেকে কর্নওয়ালিস একটি অত্যন্ত কঠোর ও অপ্রিয় কর্তব্যপালনে অগ্রণী হন। কোম্পানির সিনিয়র কর্মচারীদের বিরুদ্ধে নানাবিধ প্রতারণার গুরুতর অভিযোগ সম্পর্কে ডিরেক্টররা তাঁকে তদন্ত করার আদেশ দিয়েছেন। অভিযোগ হল, তাঁরা পণ্যদ্রব্যের কনট্রাক্টের ব্যাপারে নিজেরা জড়িত থেকে, অথবা অনেক সময় বেনামিতে নিজেরাই কনট্রাক্ট নিয়ে কোম্পানিকে ন্যায্য মুনাফা থেকে বঞ্চিত করেছেন।

কোম্পানির ব্যবসাবাণিজ্য সংক্রান্ত যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনা করতেন ‘বোর্ড অফ ট্রেড’ (Board of Trade)। একজন প্রেসিডেন্ট ও এগারোজন সদস্য নিয়ে এই বাণিজ্য—বোর্ড গঠিত হত। কোম্পানির সিনিয়র কর্মচারীরা ক্রমিক পদোন্নতির ফলে বোর্ডের সদস্যপদ লাভ করতেন। তাতে যে তাঁরা খুব প্রসন্ন বা কৃতার্থ হতেন তা নয়, কারণ পদোন্নতির ফলে তাঁদের কেবল সম্ভ্রম—মর্যাদাই বাড়ত, অধিক অর্থপ্রাপ্তি ঘটত না। বোর্ডের সদস্যদের বেতন ছিল তখন এগারশো সিক্কা টাকা। প্রত্যেকে প্রায় তার অনেক বেশি টাকা বাইরের ব্যবসাবাণিজ্যাদি থেকে রোজগার করতেন। অতএব বোর্ডের সদস্য হবার পর তাঁরা সকলেই এই আর্থিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে নেন। ব্যবস্থাটা এইরকম—তাঁরা যাঁদের পণ্যদ্রব্যের কনট্রাক্ট পাইয়ে দেবেন, তাঁদের কাছ থেকে কমিশন নেবেন, অথবা নিজেরাই গোপনে বেনামিতে কনট্রাক্ট নিয়ে মুনাফাটা আত্মসাৎ করবেন। এ কাজ তাঁরা নিঃসঙ্কোচেই করতেন, এবং এ দেশের সমস্ত লোক তো বটেই, বিলেতের কোম্পানির ডিরেক্টররাও খুব ভালভাবেই তাঁদের এই অপকৌশলে অর্থোপার্জনের কথা জানতেন। তবু হঠাৎ ডিরেক্টররা কেন ক্রুদ্ধ হয়ে লর্ড কর্নওয়ালিসকে এই অপ্রীতিকর কর্তব্য পালন করতে বললেন, তা বোঝা যায় না। তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন যে কোম্পানির কোনো সিনিয়র কর্মচারী মাসিক এগারোশো টাকা বেতন পেয়ে বাংলাদেশে সমর্যাদায় দিনযাপন করতে পারেন না। অতএব যে কোনো উপায়ে হোক; বাড়তি টাকাটা তাঁদের রোজগার করতেই হয়। কেউ ঘুস নেন; কেউ কমিশন নেন, কেউ বা গোপনে ব্যবসা করে মুনাফা করেন। তা না করলে, কেবল কোম্পানির মুনাফার তহবিল ভর্তি করলে, তাঁদের চলবে কেন? এতৎসত্ত্বেও কোম্পানির ডিরেক্টররা হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে বাণিজ্য—বোর্ডের সদস্যদের প্রতারণার অপরাধে অভিযুক্ত করে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন বলে মনে হল না। দুঃখের বিষয়, এই অপ্রিয় কাজটা সম্পাদন করার ভার পড়েছিল কর্নওয়ালিসের উপর। তিনি গুপ্তচর—গোয়েন্দা লাগিয়ে বোর্ডের সদস্যদের কাজকর্ম—গতিবিধির খোঁজখবর করতে লাগলেন। এ কথা নিশ্চয় বলব যে, এ কাজ গবর্নর—জেনারেলের যোগ্য কাজ নয়। তাঁর সময়ে বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন উইলিয়াম বার্টন। বার্টনের বিরুদ্ধেও গুরুতর অভিযোগ উপস্থিত করা হল। তাঁর পূর্বের দু’জন প্রেসিডেন্ট (দু’জনেই তখন ইংলন্ডে ছিলেন) ডেভিস ও অলড্রাসিকেও (Aldrassey) একই অপরাধে অভিযুক্ত করা হল। এই তিনজন প্রেসিডেন্ট ছাড়া মিস্টার রাইডার, মিস্টার রুক, মিস্টার বেটম্যান, মিস্টার কেইলি নামে চারজন বোর্ডের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করা হল। মিস্টার টমাস ফ্লুকম্যান নামে একজন কনট্রাক্টরও বোর্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকার জন্য অভিযুক্ত হলেন। কোম্পানির অ্যাটর্নি প্রত্যেক অপরাধীর বিরুদ্ধে অভিযোগের খসড়া ও প্রতারিত অর্থের বিল তৈরি করলেন। বিল তৈরি হতে—না হতেই বিলেতের ডিরেক্টরদের কাছ থেকে কর্নওয়ালিস নতুন নির্দেশ পেলেন এই মর্মে যে, যাঁদের অভিযুক্ত করা হয়েছে তাঁদের যেন অবিলম্বে, আদালতের বিচার শেষ না—হওয়া পর্যন্ত বোর্ডের সদস্যপদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। অর্থাৎ আদালতের বিচারের আগেই ডিরেক্টররা নিজেরাই রায় দিয়ে দিলেন। কোম্পানির কয়েকজন গণ্যমান্য বিশিষ্ট পুরাতন কর্মচারী এইভাবে রাতারাতি একেবারে অসহায় অবস্থায় পথে এসে দাঁড়ালেন।

এদিকে আমার বন্ধুবান্ধবরা এই সময় প্রতিদিন আমাকে অজস্র অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে লাগলেন। কলকাতার অন্যতম অ্যাটর্নি হিসেবে বোর্ডের অধিকাংশ সদস্যের মামলা আমিই পরিচালনা করব এবং তার জন্য প্রচুর অর্থও পাব, এই তাঁদের উল্লাস ও অভিনন্দনের কারণ। অভিযুক্তদের মধ্যে আমার উপর মামলা পরিচালনার ভার দিলেন প্রেসিডেন্ট বার্টন, রাইডার, বেটম্যান, ফ্লুকম্যান ও কেইলি। সুতরাং কথাটা যে একেবারে মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত হয়ে রটেছিল তা নয়।

বোর্ডের প্রেসিডেন্ট বার্টন প্রথমে খুব বুক ফুলিয়ে বললেন যে আদালতে তিনি এমন সব সত্য কথা প্রকাশ করবেন যাতে ডিরেক্টরদের অভিসন্ধি ফেঁসে যাবে এবং বিচারকরাও তাঁকে নির্দোষ বলে রায় দিতে বাধ্য হবেন। কিন্তু মামলা ওঠার কয়েকদিন আগে তিনি গোপনে খবর পেলেন যে সরকারপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে দলিল—প্রমাণসহ প্রতারণার এত তথ্য সংগ্রহ করেছেন যে কোর্টে তাঁর পরাজয় অনিবার্য। পরাজয় হলে তাঁর নামে প্রায় এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড (প্রায় ১৯—২০ লক্ষ টাকা) ডিক্রি হবে, এই সংবাদ পেয়ে তিনি অত্যন্ত ঘাবড়ে গিয়ে ডাচদের আশ্রয়ে শ্রীরামপুরে পালিয়ে গেলেন এবং সেখানে কয়েক মাস আত্মগোপন করে থাকার পর ডাচ—জাহাজে করে ইয়োরোপ যাত্রা করলেন। বাকি জীবন আর তিনি ইংলন্ডে ফিরে যাননি। কোপেনহ্যাগেন শহরে ভূসম্পত্তি কিনে ওমরাহ হয়ে কিছুকাল বসবাস করার পর বার্টন দেহত্যাগ করেন। আমার একজন প্রধান মক্কেলের মামলা এইভাবে চুকে যায়।

মেসার্স বেটম্যান ও রাইডার কোর্টে উপস্থিত হয়ে প্রথমেই অ্যাটর্নির টাকার বিল খানিকটা পরিমাণ কমিয়ে মেনে নেন। কিন্তু তাঁরা যে তাঁদের মনিব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে প্রতারণা করেছেন, এ কথা স্বীকার করেন না। উৎকোচ বা কমিশন যা তাঁরা কনট্রাক্টরদের কাছ থেকে পেয়েছেন, তা তাঁদের ন্যায্য প্রাপ্য বলেই তাঁরা মনে করেন। তার মধ্যে কোনো অসাধু উদ্দেশ্য, অথবা কোম্পানিকে ঠকানোর ইচ্ছা থাকে না। প্রকৃতপক্ষে বাণিজ্য—বোর্ডের সদস্য নিযুক্ত হয়ে তাঁরা নিজেরাই যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করে নিয়েছেন। কোম্পানির আর্থিক ক্ষতির কোনো প্রশ্নই ওঠে না, বরং খেসারতের কথা উঠলে তাঁরাই সেটা দাবি করতে পারেন। তাঁদের এই যুক্তি যে অনেকটা ন্যায়সঙ্গত, কোম্পানির ডিরেক্টররা তা স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। তারপর বেটম্যান ও রাইডার দু’জনেই আবার তাঁদের আদেশে বোর্ডের সদস্যপদে পুনর্বহাল হন।

কোর্টে মিস্টার কেইলি কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা লড়তে থাকেন। প্রায় পনেরো মাস কলকাতার সুপ্রিমকোর্টে মামলা চালিয়ে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। ডাক্তাররা তাঁকে স্বদেশে ফিরে যাবার পরামর্শ দেন। কেইলি ইংলন্ডের কোর্টে মামলা চালাবার অনুমতি চাইলে সরকার তা মঞ্জুর করেন। তিনি ইংলন্ড চলে যান। যাবার সময় আমি তাঁকে আমার বাবা ও ভাইয়ের কাছে চিঠি দিয়ে দিই। বিলেতে কেইলির মামলা পরিচালনার ভার তাঁদের উপর পড়ে। আমার বাবাই ছিলেন বিলেতে কেইলির সলিসিটার। কিছুদিন পরে বাবার সঙ্গে কেইলির মামলা—সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মতান্তর হয়। অন্য অ্যাটর্নি তাঁর মামলার দায়িত্ব নেন। কয়েক বছর ধরে প্রচুর খরচ করে মামলা চালাবার পর কেইলি জয়লাভ করেন বটে, কিন্তু দেনায় তিনি ডুবে যান। অবশেষে দেনার দায়ে তাঁকে কিছুদিন জেল খাটতেও হয়।

মিস্টার ফ্লুকম্যানই কেবল বাংলা দেশ থেকে দফায় দফায় তাঁর মামলা লড়েছিলেন। প্রত্যেক দফায় তিনি জয়ীও হয়েছিলেন। শেষে কেবল নিজের খরচা দিয়েই তাঁর মামলার নিষ্পত্তি হয়ে যায়। ডিরেক্টররা তাঁকে কনট্রাক্টরির কাজে পুনর্বহাল করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি রাজি হননি। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, যে কোম্পানির ডিরেক্টররা তাঁদের কর্মচারীদের প্রতি এরকম সংকীর্ণ মনোবৃত্তির পরিচয় দেন, তাঁদের অধীনে কাজ তিনি করবেন না। কিছুদিন পরে ফ্লুকম্যান ইংলন্ডে ফিরে গিয়ে ‘কোর্ট অফ প্রোপ্রাইটার্স’—এ কোম্পানির ডিরেক্টরদের কাজকর্মের ও নীতির তীব্র সমালোচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন।

প্রায় ষোলো মাস ধরে সুপ্রিমকোর্টে এই মামলাগুলি চলে (১৭৮৬—৮৭) এবং তার ফলে আমার যে অর্থপ্রাপ্তি ঘটে তাতে নিজের দেনা প্রায় অর্ধেক শোধ করে ফেলি। কলকাতা শহরে নবাবি চালে জীবন কাটানোর ফলে দেনায় আমার মাথার চুল পর্যন্ত বিকিয়ে ছিল। বাণিজ্য—বোর্ডের সদস্যদের মামলা পরিচালনা করে যে দু’পয়সা পেলাম তাতে দেনা অর্ধেক শোধ হল। বাকি অর্ধেকের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেলাম না। কেবল দেনা নয়, তার সুদের কথা ভাবলেও ভয় হয়। শতকরা ১২ টাকা হারের কম সুদে টাকা ধার পাওয়া যেত না। ঘর ভাড়া, চাকরবাকর, খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি নিয়ে আমার মাসিক সংসার খরচ লাগত প্রায় চার হাজার টাকা, এবং কষ্টে চালালেও তিন হাজার টাকার কমে কুলোতে পারতাম না।

১৭৮৬ সনের বাকি দিনগুলি কোনোরকমে কেটে গেল। আমি একটু অসুস্থ হয়ে পড়লাম, মধ্যে মধ্যে হিক্কার মতন হতে লাগল, বোধহয় অত্যধিক স্বেচ্ছাচারিতার জন্য। বন্ধুরা পরামর্শ দিলেন নিয়মিত ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে। তার জন্য দু’টি ভাল ঘোড়া কিনলাম, তার মধ্যে একটি ভাল রেসের ঘোড়া, বহুবার বাজি জিতেছে। ঘোড়াটির নাম মোমাস, রিচার্ডসন নামে একজন খেলোয়াড়ের ঘোড়া। প্রায় ছ’মাস ধরে সপ্তাহে দু’দিন আমি নিয়মিত ঘোড়ায় চড়ে বেড়ালাম, তারপর আর দিন ও ঘণ্টা ধরে অত নিয়ম পালন করা সম্ভব হল না বলে ছেড়ে দিলাম। আমার আইরিশ অতিথি কার্টার ঘোড়ায় বেড়াতে খুব ভালবাসতেন এবং প্রত্যহ সকালে মোমাসকে নিয়ে বেড়াতে বেরুতেন। এরকম ভাল ঘোড়া তিনি নাকি আর কখনও চড়েননি।

বছরের শেষদিকে আমর এক বন্ধু হামফ্রে স্বদেশে ফিরে যাবেন ঠিক করলেন। আফিমের ঠিকাদারি করে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ভাগ্য ফিরিয়ে নেন এবং প্রায় হাজার চল্লিশ পাউন্ড উপার্জন করে ইংলন্ডে ফিরে গিয়ে তার সদ্ব্যবহার করবেন মনস্থ করেন। এই সময় আমার এক বিশেষ বন্ধু হঠাৎ অসুখে মারা যান। তাঁর নাম হেনরি ভ্যান্সিটার্ট। সেদিন উইলিয়াম ডানকিনের বাড়িতে আমার মধ্যাহ্নভোজের নিমন্ত্রণ ছিল, যাবার পথে হেনরির বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে খোঁজ করে জানলাম তিনি খুবই অসুস্থ। সেইদিনই বিকেল পাঁচটা ছ’টার সময় ফেরার পথে তাঁর দরজায় এসে শুনলাম তিনি মারা গেছেন, এবং শুধু তা—ই নয়, আধ ঘণ্টা আগে তাঁর মৃতদেহ গোরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এত তাড়াতাড়ি সব ব্যাপারটা চুকে যেতে পারে, ভাবতে পারিনি। ভ্যান্সিটার্টের মৃত্যুর কয়েকদিন পরেই ডানকিন অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং ডাক্তার অ্যালেন ও ফ্রেমিঙের ঐকান্তিক চেষ্টায় কোনোরকমে বেঁচে উঠলেন। ডাক্তাররা তাঁকে অন্তত মাসখানেক মাস দেড়েকের জন্য নদীপথে বেড়াতে উপদেশ দিলেন। সুযোগ পেয়ে আমিও তাঁদের সঙ্গী হলাম। পয়লা ফেব্রুয়ারি কলকাতা থেকে আমরা যাত্রা করলাম।

.

নৌ কা ভ্র ম ণ

ডাক্তার অ্যালেনও আমাদের সঙ্গী হলেন। খাওয়াদাওয়ার যাবতীয় বন্দোবস্তের ভার দেওয়া হল স্টিফেনসন ক্যাসনের উপর। এ দেশের লোকেদের হালচাল আমার বিলক্ষণ জানা আছে বলে আমি পরামর্শ দিলাম যে বাবুর্চিদের নৌকা ও খানসামা—ভৃত্যদের নৌকা না—ছাড়া পর্যন্ত আমাদের নৌকা যেন না ছাড়া হয়। কারণ ওই নৌকা দু’টি চোখের সামনে না রাখলে খাওয়াদাওয়ায় বিপর্যয় ঘটতে পারে এবং জলপেথ ভ্রমণের সমস্ত আনন্দ মাটি হয়ে যেতে পারে। আমি ভুক্তভোগী বলে সাবধান করে দিলাম। কিন্তু মনে হল ক্যাসন সাহেব, যাঁর উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তিনি যেন আমার কথায় একটু ক্ষুব্ধ হলেন। আমাকে তিনি বললেন যে ওই নৌকা দু’টিতে তিনি একটি করে হরকরা রেখেছেন, তাঁর আদেশ অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কি না দেখার জন্য। কাজেই চিন্তার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি পুনরায় তাঁদের সাবধান করে দিলাম, ক্যাসন তা ভ্রূক্ষেপ করলেন না। সকলা দশটায় চাঁদপাল ঘাট থেকে নৌকা ছাড়ল এবং দক্ষিণে হাওয়ায় নৌকা বেশ জোরেই চলতে লাগল। বেলা সাড়ে—এগারোটার মধ্যে আমরা শ্রীরামপুর পার হয়ে গেলাম। ডানকিন জানালেন যে তাঁর বেশ খিদে পেয়েছে। আমাদেরই পেয়েছে, তাঁর তো পাওয়া স্বাভাবিক, কারণ তিনি অসুখ থেকে উঠেছেন। এদিকে বেলাও দুপুর হয়েছে। কিন্তু খাবার কোথায়? কোথায় বা সেই বাবুর্চি—খানসামাদের নৌকা? নদীর উপর যত দূর চোখ যায়, কোথাও তাদের দেখা যায় না। আমি বেগতিক দেখে শ্রীরামপুরে নৌকা বাঁধতে বললাম এবং প্রস্তাব করলাম হয় কিছু খাবার কেনা যাক, না—হয় বাবুর্চিদের নৌকা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাক। কিন্তু আমার উপদেশ আবার উপেক্ষা করা হল। ক্যাসন বিরক্ত হয়ে বললেন, একটু ধৈর্য ধরুন মশাই, সব ঠিক হয়ে যাবে। অত ব্যস্ত হলে কি চলে? নৌকা বাঁধা হল না, যেমন চলছিল তেমনি দ্রুত চলতে লাগল, একে—একে চন্দনগর, চুঁচুড়া, হুগলি, ব্যান্ডেল সব পার হয়ে গেল। তারপর অনেক দূর পর্যন্ত নদীতীরে আর কোন শহর নেই। সেই নৌকা দু’টিরও কোনো খোঁজ নেই।

খাবার জন্য পুরো এক ঘণ্টা সময় নির্দিষ্ট ছিল, এবং বেলা দুটোর মধ্যে তা শেষ হয়ে যাবার কথা। বেলা তিনটে বেজে গেল খাবারের নৌকার দেখা নেই। পেট সকলেরই জ্বলছে, ডানকিন সাহেবের প্রায় দাউদাউ করে। এবার ধৈর্যচ্যুত হয়ে তিনি ক্যাসনকে বেশ একটু ধমকই দিলেন। বললেন, আপনি নিজেই গোঁ ধরে চলেছেন, কারও কথায় কর্ণপাত করছেন না, অথচ দেখা যাচ্ছে আপনার ধারণা কোনোটাই ঠিক নয়। কিন্তু অভিযোগ বা ক্রোধ প্রকাশ করলে তো আর পেট ভরবে না। বেলা যখন পাঁচটা বেজে গেল, ডাক্তার অ্যালেন তখন বললেন যে কিঞ্চিৎ ঝোলজাতীয় খাদ্য পেলে যদি চলে তাহলে আমাদের সহগামীর একটি ছোট বজরা থেকে তিনি কিছুটা অন্তত ডানকিনের জন্য সংগ্রহ করে দিতে পারেন। বলা বহুল্য, পাশে আলাদা বজরায় করে যাচ্ছিলেন ডাক্তারের স্ত্রী ও দুটি ছেলেমেয়ে। প্রস্তাব শুনে ডানকিন প্রায় লাফিয়ে উঠে বললেন, যে কোনো খাদ্য পেলেই তিনি খুশি হবেন, ‘কারি’ বা যা—ই হোক। তা—ই শুনে ডাক্তার তাঁর বজরা থেকে খাদ্য নিয়ে এলেন, প্রচুর ‘কারি’ ভাত ও রুটি। আমরা সকলে হুমড়ি দিয়ে পড়ে তা গোগ্রাসে গিলে ফেললাম। ছ’টা বেজে গেল, সন্ধ্যা হল। রাত কাটাবার জন্য শুকসাগরে আমরা নৌকা বাঁধলাম।

রাত প্রায় ন’টার সময় ভৃত্যদের নৌকা এসে পৌঁছল। তাদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া চলেছে তখন। কেউ হুঁকো, কেউ তামাক আনতে ভুলে গেছে। ডানকিন সাহেবের পরামানিক নাকি তাদের আটকে রেখে ক্ষুরে শান দিয়ে নিয়েছে। তা ছাড়া ঘাটে ভৃত্যরা এসে ক্রমে জমা হলেও শেষে দেখা গেল নৌকার মাঝি আসে নি। এরকম ছোটখাট অনেক কারণের জন্য ঘাট থেকে নৌকো ছাড়তে তাদের প্রায় ঘণ্টা তিনেক দেরি হয়েছে। তা যে হবে, আমি জানতাম। কারণ এই বাংলা দেশের লোকদের আমি দেখেছি, যখনই ঘর ছেড়ে বাইরে কোথাও যেতে হয় তখনই যেন তাদের মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। এইজন্যই আমি ওই নৌকা দু’টি আগে ছাড়বার কথা বলেছিলাম। এই বিপর্যয়ের পর ডানকিন আমাকে ক্যাসনের বদলে ম্যানেজারি করতে অনুরোধ করলেন। তাঁর শুধু একটি শর্ত হল যে প্রত্যহ সকালে ঘণ্টা দুই তাঁর খেলার সঙ্গী হতে হবে। কথা হল সেই সময় ডাক্তার অ্যালেন আমার কাজটুকু চালিয়ে নেবেন। তা—ই হল, আগেকার ব্যবস্থা বদলে গেল, এবং তারপর থেকে যথাসময়ে যথেষ্ট খাবার পাওয়ার আর অসুবিধা হয়নি।

নদীপথে আরও আমরা এগিয়ে গেলাম, চড়ায় আটকে মধ্যে মধ্যে বেশ বাধাও পেতে হল। কাশিমবাজারের নদীর মুখে আমাদের নৌকো এমন আটকাল এবং খাওয়াও বন্ধ হয়ে গেল যে দাঁড়ি—মাঝিরা প্রাণপণে টানাটানি করে হয়রান নৌকা এক ইঞ্চি নড়াতে পারলাম না। শেষে অন্যান্য নৌকার দাঁড়িরা মিলে প্রায় ঘণ্টা তিনেক ঠেলাঠেলি করে নৌকাটিকে একটি খালে নিয়ে গিয়ে ফেলল। একটি গোটা দিনই আমাদের এইভাবে নষ্ট হয়ে গেল। ন’দিনের দিন আমরা আফজলবাগে পৌঁছলাম। পৌঁছে আমার বন্ধু রবার্ট পটকে একটি চিঠি পাঠিয়ে খবর দেব ভাবছি, এমন সময় দেখি পট নিজেই পঞ্চাশ—দাঁড়ি পানসি নিয়ে আমাদের নৌকার কাছে এগিয়ে আসছে। আমাদের আসার খবর কাশিমবাজার থেকে নবাবের আমলারা গতকাল রাতেই তাদের কানে পৌঁছে দিয়েছিল। পটের অনুরোধে আমরা নামলাম এবং তারই বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। দশ দিন আমরা তার অতিথি হয়ে ছিলাম, তার নবাবি চালের খানাপিনায় অভ্যর্থনায় পরম নিশ্চিন্তে গা ভাসিয়ে দিয়ে। তার মধ্যে দু’দিন কাশিমবাজার কুঠির কমার্শিয়াল চিফ জেমস কেলি (James English Keighley) আমাদের ভূরিভোজনে আপ্যায়ন করেছিলেন। কুঠির প্রধান কর্মকর্তা হয়েও তিনি আলাদা রেশমের ব্যবসায় প্রচুর টাকা করেছিলেন। পট ছিল নবাব—দরবারের ‘রেসিডেন্ট’, কাজেই ইংরেজ—রাজপ্রতিনিধি হিসেবে নবাবি বিলাসিতা তার শোভা পায়। কিন্তু কুঠির কমার্শিয়াল চিফ হয়েও পটের সঙ্গে কেলি প্রায় পাল্লা দিয়ে চলবার চেষ্টা করতেন। এ ছাড়া একটা দিন ফেনউইক সাহেবের সঙ্গে (যাঁর গার্ডেনরিচের বাড়িতে মেলার বিবরণ আগে দিয়েছি) বেশ আনন্দেই কাটল, একদিন নবাবের আতিথ্যও গ্রহণ করতে হল, এবং আর—একদিন কমান্ডিং অফিসার ডেভিড সাহেব আফজলবাগ থেকে মাইল দুই দূরে তাঁর গৃহে আমাদের নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গেলেন। এদিকে আমাদের কলকাতায় ফেরার সময় হয়ে এল। পয়লা মার্চ থেকে কোর্ট খুলবে, তার আগে সকলকে পৌঁছতে হবে। আমাদের নৌকাযাত্রার উদ্দেশ্যও সফল হয়েছে, ডানকিন বেশ সুস্থ ও সবল হয়ে উঠেছেন। এখন আমরা স্বচ্ছন্দে ফিরে যেতে পারি। ১৯ ফেব্রুয়ারি আফজলবাগ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা কাশিমবাজার অভিমুখে যাত্রা করলাম। দু’দিন কেলি সাহেবের অতিথি হয়ে কাশিমবাজারেও থাকতে হল, তাঁর মন রাখার জন্য। দু’দিনেই তিনি আতিথেয়তার চূড়ান্ত করলেন। ২১ তারিখে কলকাতার দিকে আমরা রওনা হলাম, পৌঁছলাম ২৭ তারিখে। একটি মাস বেশ চমৎকার কাটল।

ক ল কা তা র ঝ ড়

এক বছর নভেম্বর মাসের গোড়ায় (২ নভেম্বর ১৭৮৭) প্রচণ্ড ঝড় হয় কলকাতায়। সাধারণত এমন সময় তা হবার কথা নয়, কারণ বর্ষা শেষ হয়ে তখন শীতের হাওয়া বইতে থাকে। এ বছর অবশ্য তা হয়নি, বর্ষা অতিরিক্ত দিন স্থায়ী হয়েছিল। সেদিন আমার কোর্টের কাজ ছিল অনেক, তাই একটু ভোরে উঠে অফিসঘরে কাজ করতে বসেছিলাম। সকাল সাতটা আন্দাজ বৃষ্টি নামল। বৃষ্টি তো বৃষ্টি, একেবারে মুষলধারে বৃষ্টি! তার সঙ্গে প্রচণ্ড হাওয়া, সাংঘাতিক ঝড়। যে বাড়িটায় আমি তখন বাস করতাম তা এত পুরনো ও জীর্ণ যে ঝড়ের দাপটে কাঁপতে থাকল, প্রতিমুহূর্তে মনে হতে লাগল, এই বুঝি আমায় ধসে পড়ে। আমার অতিথি কার্টার সাহেব ভয়ে ‘চাপা পড়লাম’ বলে আর্তনাদ করতে লাগলেন। ঝড়ের মধ্যে আমাকে কোর্টে যেতে হল, না গিয়ে উপায় ছিল না বলে। বেয়ারারা অনেক কষ্টে পালকি বয়ে নিয়ে গেল, কয়েক গজ যেতে প্রায় আধ ঘণ্টা সময় লাগল। কোর্ট থেকে নদীর উপর ঝড়ের তাণ্ডবলীলা দেখলাম, বোট—নৌকাগুলি নিয়ে যেন খেলনার মতন ছিনিমিনি খেলছে। বড় বড় তিন—চারশো টনের পোতগুলিও ঢেউয়ের আঘাতে ডুবুডুবু হয়েছে। হুগলি নদীর মতন এত ছোট নদীতে ঝড়ের তাণ্ডবে যে এরকম ভয়াবহ তরঙ্গ—বিক্ষোভ হতে পারে, নিজের চোখে না দেখলে তো কখনোই বিশ্বাস করতাম না।

প্রায় দুপুর পর্যন্ত ঝড়বৃষ্টি হল। তারপর হঠাৎ সব থেমে গেল, কিন্তু মাথার উপর নীল আকাশ ভেসে উঠল না। তর্জনগর্জন স্তব্ধ হল বটে, মেঘের আক্রোশ কাটল না। তামাটে রঙের মেঘ চারদিকে ছেয়ে রইল। আমরা কোর্টগৃহের ছাদের উপর গিয়ে চারদিকের ধ্বংসস্তূপের দিকে চেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। নদীর উপর নৌকা—বজরা—পানসি খণ্ড খণ্ড হয়ে ভেসে চলেছে, বড় বড় প্রায় আটখানা জাহাজ নোঙর উপড়ে পশ্চিম তীরে গিয়ে আছড়ে পড়েছে। এই দৃশ্য দেখতে দেখতে ঝড়ের তাণ্ডব আরম্ভ হল। প্রায় চার ঘণ্টা ধরে আবার ঝড়বৃষ্টি বজ্রপাত হল। কোর্টে বিশেষ কোনো কাজ হল না। বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরলাম। দুপুরে কয়েকজন ভদ্রলোককে খাবার নিমন্ত্রণ করেছিলাম, কিন্তু তিনজন ছাড়া আর কেউ বাড়ি থেকে বাইরে বেরুতে সাহস করেননি। ফিরে দেখি আমার আইরিশ অতিথিটি ভয়ে প্রায় আধমরা হয়ে আছেন।

পরদিন সকালে নির্মেঘ আকাশে সূর্য উঠল এমন দীপ্ত ভঙ্গিতে যে তার দিকে চেয়ে আগের দিন ঝড়বৃষ্টির কথা কেউ কল্পনা করতে পারবে না। এরকম ঝড়ের অভিজ্ঞতা এ দেশেও আমার কোনোদিন হয়নি। ঝড়ে বহু লোকের ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। আর কত লোক যে মারা গিয়েছিল তার ঠিক নেই। গাছপালা উপড়ে পড়ে রাস্তাঘাট সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কলকাতার চোদ্দো মাইল দক্ষিণে বারুইপুর পর্যন্ত টানা রাস্তার দু’দিকে যে বড় বড় সাহেব সারি ছিল তার গোটা ছয়েক ছাড়া একটিও খাড়া ছিল না।

জ মা দা র নি

কিছুদিনের মধ্যে আমার আইরিশ অতিথি কার্টার লিভারের অসুখে অত্যন্ত কাতর হয়ে ইংলন্ডে ফিরে যাবেন মনস্থ করলেন। আমি তাঁর যাবার সব ব্যবস্থা করে দিলাম। আমার বাসায় যখন তিনি থাকতেন তখন একটি সুন্দর হিন্দুস্থানি মেয়ে তাঁর কাছে নিয়মিত যাতায়াত করত। মেয়েটি দেখতে—শুনতে ভাল এবং চালাক—চতুর। কাজেই কার্টার চলে যাবার পর মেয়েটিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার সঙ্গে থাকবে কি না। বেশ খুশি হয়েই সে তার সম্মতি জানাল এবং তারপর থেকে আমার সঙ্গেই সে বাস করতে লাগল। তার নাম ছিল ‘জমাদারনি’, আমার বন্ধুবান্ধবরাও ওই নামে তাকে ডাকত। জমাদারনি হিন্দুস্থানি মেয়ে হলেও এ দেশের মেয়েদের মতন আদৌ লাজুক ছিল না এবং বিদেশিদের দেখলে ঘোমটা দিয়ে সামনে থেকে পালিয়ে যেত না। তার এই সপ্রতিভ ভাবভঙ্গির জন্য আমার বন্ধুরা সকলেই তাকে খুব পছন্দ করতেন। খানাপিনার টেবিলে, এমনকি ভোজসভায় পর্যন্ত, স্বচ্ছন্দে সে মেলামেশা করতে পারত। অবশ্য খাদ্য ও পানীয়ের ব্যাপারে তার নিজের সংযত অভ্যাস ও রুচি কোনোদিন সে ত্যাগ করেনি।

শি ল্পী ড্যা নি য়ে ল

এই সময় বাংলা দেশে দু’জন প্রতিভাবান শিল্পী আসেন। তাঁরা খুড়ো—ভাইপো ড্যানিয়েল। শিল্পকর্মে তাঁরা যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। প্রতিভার সমাদর করতে আমি কখনও কুণ্ঠিত হইনি, ড্যানিয়েলের ক্ষেত্রেও হলাম না। যথাসাধ্য শিল্পকর্মে তাঁদের সাহায্য করার চেষ্টা করলাম। তাঁদের ইচ্ছা হল, কলকাতা শহরের কয়েকটি চিত্র আঁকবেন। আমি নিজে তাঁদের অগ্রিম গ্রাহক তো হলামই, কলকাতায় পরিচিত বন্ধুমহলেও তাঁদের বহু পৃষ্ঠপোষক ও গ্রাহক করে দিলাম। শহরের বারোখানি দৃশ্যচিত্র তাঁরা আঁকলেন, বারোটি মাস লাগল আঁকতে। এই তাঁদের এ দেশের প্রথম শিল্পপ্রয়াস। অতএব পরবর্তীকালের ছবির মতন কলকাতা শহরের এই ছবিগুলির মধ্যে তাঁরা সেরকম শিল্পনৈপুণ্য দেখাতে পারেননি।

ম ন্ব ন্ত র

১৭৮৮ সনের ডিসেম্বর মাসে ডানকিন ইয়োরোপ চলে যান। ১৭৮৯ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে জেরিমিয়া চার্চ নামে আমার এক অ্যাডভোকেট বন্ধুর হঠাৎ মৃত্যু হয়। বন্ধু পট রেসিডেন্টের চাকরি ছাড়ার পর বিবাহ করেন। পাত্রী কুমারী ক্রাটেনডেন, সম্পর্কে তাঁর বোন হলেও, দেখতে—শুনতে ও স্বভাবচরিত্রে চমৎকার মহিলা ছিলেন। ফিলিপ নামে একজন ব্যারিস্টার অসুস্থ হয়ে বিলেতে চলে যান। তাঁর কাছে ড্যানিয়েলেদের আঁকা কলকাতা শহরের বারোখানি দৃশ্যচিত্রের একটি সেট আমি আমার ভাইয়ের জন্য পাঠিয়ে দিই।

আমি যে বাড়িটায় বাস করতাম সেটা বহুদিনের পুরনো বাড়ি। সেদিনের প্রচণ্ড ঝড়ে তার ভিতরের পাঁজরাগুলো ঝরঝরে হয়ে গেছে মনে হল। বাড়িটায় বাস করা আর নিরাপদ নয় মনে করে আমি বাড়িওয়ালাকে জানিয়ে দিলাম যে মাসের শেষে বাড়ি ছেড়ে দেব। এ কথা শুনে তিনি একদিন আমার কাছে এসে বললেন যে আমার মতন একজন ভাল ভাড়াটে ছেড়ে দিতে তিনি অনিচ্ছুক। দরকার হলে তিনি বাড়ি ভেঙে আমার ফরমায়েশ মতন তৈরি করে দেবেন। এই প্রস্তাবে আমি রাজি হলাম এবং কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটে তাঁর একখানি বাড়িতে উঠে গেলাম। যেদিন গেলাম সেইদিনই দেখলাম তাঁর লোকজন পুরনো বাড়িটা ভাঙতে আরম্ভ করেছে।

আগেকার ঝড়ের মতন এ বছরেও চোখের সামনে একটা ভয়ংকর বিপর্যয় ঘটতে দেখলাম। বাংলা—বিহার জুড়ে এক মর্মান্তিক মন্বন্তর হল। দরিদ্র লোকের দুঃখের আর সীমা রইল না। কলকাতার ইংরেজ অধিবাসীরা চাঁদা তুলে যত দূর সম্ভব দুঃস্থদের সেবার ব্যবস্থা করলেন। অনেক টাকা চাঁদা তোলা হয়েছিল, কারণ সেই টাকা দিয়ে প্রতিদিন প্রায় বিশ হাজার দুর্ভিক্ষপীড়িতদের অন্নদান করা হত। ছ’টি বিভিন্ন স্টেশন থেকে খাদ্যদ্রব্য বিলি করার ব্যবস্থা হয়েছিল, চাল—ডাল—আটা ইত্যাদি। প্রত্যেক স্টেশনের বিলিব্যবস্থা তদারক করার জন্য দু’জন করে ইংরেজ উপস্থিত থাকতেন। প্রায় চার মাস ধরে এই সেবাকর্ম করার পর দেখা গেল যে দুঃস্থের সংখ্যা না কমে ক্রমেই বেড়ে চলেছে এবং শহরে দলে দলে এসে তারা জমা হচ্ছে। অবস্থা দেখে গবর্নমেন্ট বেশ ভয় পেয়ে গেলেন, দানধ্যান ও খাদ্য বিতরণ একেবারে বন্ধ করে দেবার হুকুম দিলেন, চতুর্দিকে সেই মর্মে ‘নোটিশ’ টাঙিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু তাতেও ভিড় কমল না। কলকাতা শহরের মধ্যে ও আশপাশে বুভুক্ষু জনতার আর্তনাদ বাড়তে লাগল, পথঘাট সব ভর্তি হয়ে গেল। ঘরের দরজা খুলে বাইরে পা বাড়ালেই তাদের ক্ষুধার্ত আর্তনাদ ও মৃত্যুযন্ত্রণার কাতরানি শুনতে হত। কত মানুষ, শিশু ও নারী যে পথের উপর মরে পড়ে থাকত তার ঠিক নেই। মোটামুটি একটা হিসাব থেকে জানা যায় যে কয়েক সপ্তাহ ধরে গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে পঞ্চাশজন করে বুভুক্ষু মারা গেছে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হল এই যে কলকাতার মতন শহরে পথের উপর ক্ষুধার যন্ত্রণায় তিলে তিলে এরা মৃত্যুবরণ করেছে নিঃশব্দে মুখ বুজে, কোনো অভিযোগ করেনি, প্রতিবাদ করেনি, দোকানপাট লুট করেনি, বাড়িঘরে হানা দেয়নি, এমনকি দরজায় দরজায় ঘুরে চেঁচিয়ে ভিক্ষে করেনি পর্যন্ত। এ বোধহয় এই ভারতবর্ষের মতন দেশেই সম্ভব। এ দেশের শান্তশিষ্ট নিরীহ অহিংস লোক কেবল অজানা এক অদৃষ্টের উপর নির্ভর করে ও নিশ্চিন্তে নীরবে কীভাবে যে তিলে তিলে মৃত্যুও বরণ করতে পারে, তা এই মন্বন্তরের মর্মান্তিক দৃশ্য স্বচক্ষে দেখলে বোঝা যায়।

জ মা দা র নি র স ঙ্গে হি কি র সং সা র

১৭৭১ সনের কথা। গরম পড়তে আমার ব্যারিস্টার বন্ধু শ সাহেব বললেন যে মার্চ, এপ্রিল, মে এই তিন মাসের জন্য গার্ডেনরিচে একটি বাগানবাড়ি দু’জনে মিলে ভাড়া নেওয়া যাক। এই তিন মাস কলকাতা শহরের মধ্যে বাস করতে সত্যিই প্রাণ বেরিয়ে যায়। কাজেই বন্ধুর প্রস্তাবে আপত্তি করলাম না। বেশ বড় একটি বাগানবাড়ি ভাড়া নেওয়া হল, একেবারে গার্ডেনরিচের একপ্রান্তে, কলকাতা থেকে সাড়ে সাত মাইল দূরে নদীর খুব কাছাকাছি। বাড়িটা দোতলা, নিচের তলায় ন’খানা বড় বড় ঘর এবং চারখানা ছোট ঘর, দোতলায় দু’খানা বিশাল বড় বড় ঘর। উপরের ঘর আমার জন্য ব্যবস্থা করে নিলাম, যাতে আমার জমাদারনি দাসী—পরিবৃতা হয়ে নিরিবিলিতে বাস করতে পারে। বাকি ঘর শ’—কে দেওয়া হল, তার সিঁড়িও ছিল আলাদা। নিচে থাকল প্রশস্ত ভোজনকক্ষ, চা—ঘর, বিশাল ড্রয়িং রুম এবং বিলিয়ার্ড রুম। সিডন্সের তৈরি চমৎকার একটি বিলিয়ার্ড টেবিল এক হাজার সিক্কা টাকা দিয়ে কেনা হল। অন্যান্য ঘরগুলি বন্ধুবান্ধব ও অতিথিদের ব্যবহারের জন্য খালি রাখা হল। এক শনিবার আমরা গৃহপ্রবেশের দিন ঠিক করলাম এবং বন্ধুবান্ধবকে নিমন্ত্রণ করে প্রচুর ক্ল্যারেট মদ্যপানের ব্যবস্থা করা হল। অতিথিরা পানের নেশায় মশগুল হয়ে বললেন, বাড়িটার একটা নামকরণ করা উচিত। ‘Sportsman’s Hall’, ‘Bachelors Hall’, ‘Savoir Vivre’ এবং এরকম আরও বহু নাম প্রস্তাব করা হল। নাম নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বিতর্ক হয়ে গেল। অবশেষে অধিকাংশ অতিথি ‘The White Lion’ নামটি পছন্দ করলেন এবং বাড়ির সেই নামই রাখা হল। শনি—রবিবারের প্রমোদান্তে সোমবার সকালে আমরা কলকাতায় ফিরে এলাম।

বাড়ি দেখে আমার জমাদারনি খুশিতে আটখানা হয়ে গেল এবং আহ্লাদ করে বললে যে ওবাড়ি ছেড়ে সে আর কোথাও যাবে না। সুতরাং তার বসবাসের জন্য সেখানে একটা পাকাপাকি বন্দোবস্ত করতে হল। আমার বন্ধু শ রাতে প্রায় সেখানে ফিরে যেতেন, তা না হলে তার নাকি ঘুম হত না। আমি অবশ্য কলকাতাতেই থাকতাম কাজকর্মের জন্য, সপ্তাহ অন্তে শনিবার রাতে যেতাম এবং রবিবার থাকতাম। দিন পনেরো আন্দাজ থাকার পর জমাদারনির অসুখ হল। খবর পেয়ে দেখতে গেলাম এবং তাকে টাউনে নিয়ে এলাম। ডাক্তার হেয়ার রুগি দেখে বললেন যে ওই অঞ্চলের জোলো হাওয়ার জন্য এরকম অসুখ প্রায়ই হয়ে থাকে। ডাক্তারের মুখ থেকে এই কথা শোনার পর জমাদারনি জিদ ধরে বসল যে ওই বাড়িতে সে আর রাত কাটাবে না। আমারও কেমন ভয় হয়ে গেল, তারপর থেকে ওই বাড়িতে রাত কাটাতে পারতাম না। দিনের বেলা বন্ধুবান্ধব নিয়ে যেতাম, রাত হলে টাউনে ফিরে আসতাম। তিন মাস কেটে যাবার পর বন্ধু শ হিসেব করে বুঝিয়ে দিলেন বাড়ির জন্য আমার ভাগে পাওনা হয়েছে ৭৩০১ সিক্কা টাকা।

জুন মাসের গোড়ার দিকে আমার জমাদারনি হঠাৎ বায়না ধরে বসল যে তাকে নৌকায় করে নদীতে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে। বাধ্য হয়ে আমাকে কয়েকটা নৌকা ভাড়া করে তাকে নিয়ে নদীপথে ভ্রমণে বেরুতে হল। চুঁচুড়া পর্যন্ত যাবার পর আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হল না, কারণ গঙ্গার তীর থেকে চুঁচুড়া শহরের চেহারা দেখে জমাদারনি চক্ষু বড় বড় করে বললে, ‘কী সুন্দর! আমি এখানেই থাকব, আর কোথাও যাব না।’ ডাচদের উপনিবেশ চুঁচুড়া। ঘাটে নেমে শহরের মধ্যে একটি বাড়ি ঠিক করলাম, বেশ ভাল শুকনো খটখটে বাড়ি, ড্যাম্প নেই। এর আগেও ১৭৭৮ সনে আমি একবার চুঁচুড়ায় এসেছি। কলকাতা থেকে বেশি দূর নয়, মাইল পঁচিশ—তিরিশ হবে। চুঁচুড়ায় বাড়ি দেখে জমাদারনী খুশি হল। আমি বললাম, একটু রঙ্গ করে, গার্ডেনরিচের বাড়ি দেখেও তো খুশি হয়েছিলে। তার উত্তরে সে তার হিন্দুস্থানি মাতৃভাষায় বেশ কড়া সুরে জবাব দিলে, ‘হ্যাঁ, ঠিক কথা, গার্ডেনরিচের ”হোয়াইট লায়ন” আমার বেশ ভাল লেগেছিল, ড্যাম্প লেগে অসুখবিসুখ না হলে নিশ্চয় সেখানে থাকতাম। এখানে তা হবে না, কারণ বাড়িঘরের দিকে চেয়ে দেখো কত শুকনো এবং গঙ্গার হাওয়াও কত ভাল। এই জায়গা ছেড়ে আমাকে আর কোথাও যেতে হবে না।’ তার কথাই ঠিক হল, বাস্তবিকই জায়গাটা স্বাস্থ্যের দিক থেকে বেশ সয়ে গেল দেখলাম। গার্ডেনরিচের বাড়ির জন্য যেসব ফার্নিচার কেনা হয়েছিল, সেগুলি নিজে কিনে নিয়ে চুঁচুড়ার বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম। চুঁচুড়ার বাড়িতেও শ আমার ভাগীদার হতে চাইলেন, কিন্তু আমি আর ঝঞ্ঝাটে যেতে রাজি হলাম না। আমি বললাম, মধ্যে মধ্যে আমার বাড়িতে অতিথি হবেন, আমি খুব খুশি হব।

গার্ডেনরিচের হোয়াইট লায়নের চেয়ে চুঁচুড়ার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বাড়ি দুইই বেশ স্বাস্থ্যকর মনে হল। অল্পদিনের মধ্যেই জমাদারনির স্বাস্থ্যের অপ্রত্যাশিত উন্নতি হল এবং আমারও হাঁপের অসুখ অনেকটা কমে গেল। কলকাতার চেয়ে চুঁচুড়াতে আমার স্বাস্থ্য বেশ ভাল থাকত। প্রতিদিন সকালে সেখানে অনেকক্ষণ ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতাম। সাধারণত প্রত্যেক শুক্রবার রাতে, বিশেষ করে চাঁদনি রাতে চুঁচুড়ায় যেতাম, অথবা শনিবার ভোরে রওনা হয়ে ব্রেকফাস্ট খাওয়ার সময় পৌঁছতাম, আবার সোমবার সকালে কলকাতায় ফিরে আসতাম। বন্ধুবান্ধব অন্তত একজন কেউ সঙ্গে থাকতেন, ছুটির সময় শ গিয়েও তিন—চার দিন করে থাকতেন। মধ্যে মধ্যে ডাচ সাহেবদেরও ভোজে নিমন্ত্রণ করতাম এবং তার জন্য অর্থাৎ প্রচুর শ্যাম্পেন—বর্গান্ডিসহ সেই ভোজের জন্য, বিলক্ষণ অর্থব্যয় হত।

কলকাতা থেকে পলতার মাঝামাঝি রুক্সের বাংলো পর্যন্ত আমি আমার নিজের চ্যারিয়ট গাড়িতে করে যেতাম এবং সেখান থেকে হয় কোনো সঙ্গীর গাড়িতে অথবা বগিগাড়ি ভাড়া করে পলতা যেতাম। পলতার ফেরিঘাটে নৌকায় পার হতাম। ওপারে আমার ফিটনগাড়ি বা বগিতে করে চুঁচুড়া পৌঁছতে প্রায় চার ঘণ্টা সময় লাগত। বন্ধুদের, বিশেষ করে জাহাজের বন্ধুদের দেখা পেলে, চুঁচুড়ায় নিয়ে গিয়ে প্রাণ খুলে অভ্যর্থনা করতাম।

ক্রমে চুঁচুড়া স্থানটির প্রতি বেশ অনুরাগী হয়ে উঠলাম এবং স্থির করে ফেললাম সেখানেই বসবাস করব। জিনিসপত্তর বা কেনাকাটার বাকি ছিল সব কিনে ঘরদোর গুছিয়ে ফেললাম। নিজস্ব একটি বোট তৈরি করারও বাসনা হল, গঙ্গায় বেড়াবার জন্য। কাস্টম হাউসের একটি সুন্দর পানসি ছিল, আমার পছন্দমতন। কলকাতার বিখ্যাত বোট—ব্যবসায়ী গিলেট সাহেবকে এইজন্য একদিন ডেকে পাঠালাম এবং বললাম আমাকে একটি পানসি বানিয়ে দিতে। তিনি রাজি হলেন, তবে বললেন যে বাঙালি কারিগরদের দিয়ে নৌকার হাল ও অন্যান্য কয়েকটি জিনিস তৈরি করিয়ে নিতে। তাঁর কথা অনুযায়ী কাস্টম হাউসের কারিগর দিয়ে নৌকা তৈরি করানো হবে ঠিক হল। দ্রুতগামিতার জন্য নৌকা কাস্টম হাউস বোটের চেয়ে চার—ছয় ইঞ্চি সরু করা হবে স্থির হল। যথাসময়ে বোট যখন তৈরি হয়ে গেল তখন দেখলাম গিলেট সাহেব তাঁর কথা ঠিক রেখেছেন। বোটের গড়নটি এমন সুন্দর হয়েছিল যে নদীর উপর পাল্লা দিয়ে কেউ তার সঙ্গে চলতে পারত না। একমাত্র ডাকাতদের নৌকার কাছে হার মানতে হত। এ দেশের ডাকাতদের নৌকা সাধারণত ৭০—৮০ ফুট লম্বা হত এবং অন্তত জন চল্লিশ দাঁড়ি থাকত তাতে। আমার বোটটি ছিল ৪৮ ফুট লম্বা, সাড়ে—চার ফুট চওড়া। নদীতে খুব ঢেউ থাকলে নৌকা বাইতে বেশ ভয় করত। বারোজন দাঁড়ি ও দু’জন মাঝি নিয়ে চোদ্দো জন লোক লাগত আমার নৌকা বাইতে।

প্রথম যেদিন কলকাতায় নদীতে আমার বোট ভাসানো হয় সেদিন চাঁদপাল ঘাটে লোকের বেশ ভিড় হয়েছিল। সাহেবের নতুন বোট দেখার জন্য নয় শুধু, পোশাক—পরিচ্ছদ সজ্জিত দাঁড়ি—মাঝিদের দেখার জন্যও। প্রত্যেকের পরনে সাদা ট্রাউজার ও জ্যাকেট, মাথায় লাল ও সবুজ রঙের পাগড়ি এবং মাজায় বাহারে কোমরবন্ধ। আমি যতটুকু জানি, আমার আগে আর কোনো ইংরেজ এরকম সুসজ্জিত দাঁড়ি—মাঝি নিয়ে গঙ্গায় নৌকাবিলাস করেননি। লর্ড ওয়েলেসলি এইসব ব্যাপারে বিলাসিতার কিঞ্চিৎ বহর দেখিয়েছিলেন, কিন্তু সে আরও কিছুদিন পরের কথা।

আমার বোট গঙ্গায় ভাসানোর পর গিলেট সাহেব লর্ড কর্নওয়ালিসের জন্য, হিন্দুস্থানি ও ইয়োরোপীয় কায়দায় মিশ্রণে একটি বড় ছাব্বিশ—দাঁড়ি বোট তৈরি করেন। কলকাতা থেকে ব্যারাকপুরের বাগানবাড়িতে যাতায়াত করার জন্য এই বোট তৈরি করা হয়। গিলেট বললেন, আমার বোটের চেয়ে লাটসাহেবের বোট বেশি দ্রুতগামী হবে, কিন্তু পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে চলে দেখেছি লাটের বোটের চেয়ে আমার বোট অনেক বেশি দ্রুতগামী। বোট তৈরি হল বটে, কিন্তু তার রক্ষণাবেক্ষণে আমার অজস্র অর্থব্যয় হতে থাকল। বোটের দাম পড়ল দু’হাজার সিক্কা টাকা, দাঁড়ি—মাঝির জন্য প্রতিমাসে টাকা পঁয়ষট্টির কিছু বেশি, এবং আজ এটা, কাল সেটা, পরশু মেরামত ইত্যাদির খাতে নিত্য বেশ কিছু। বোট—বিলাসিতার বোঝা বেশ দুঃসহ হয়ে উঠল।

৮. হিকির স্মৃতিকথা

একজন বাঙালি কেরানি গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে আমার অফিসে কাজ করছেন। হঠাৎ তিনি নাটোরে কোম্পানির একজন সিবিল কর্মচারীর কাছ থেকে দ্বিগুণ বেতনে চাকরির প্রস্তাব পান। তাঁর এই পদোন্নতিতে আমার বাধা দেবার ইচ্ছা না থাকলেও এরকম একজন ভদ্র ও বিশ্বস্ত কেরানিকে ছেড়ে দিতে আমার কষ্ট হচ্ছিল।

বা ঙা লি কে রা নি র ক বি তা

নাটোরে যাবার বছরখানেক পরে তাঁর কাছ থেকে আমি একখানি চিঠি পাই। চিঠিখানা সাধারণ চিঠি নয়, গদ্যভাষায় লেখাও নয়, আগাগোড়া একটি দীর্ঘ কবিতা। এতদিন তিনি আমার এখানে কাজ করেছেন, কিন্তু তাঁর এই সুপ্ত কাব্যপ্রতিভার আমি কোনো হদিশই পাইনি। আশ্চর্য। কবিতার মধ্যে তিনি তাঁর নতুন কর্মস্থল সম্বন্ধে যা লিখেছেন তা আশাপ্রদ নয়। কবিতাটি এই :

I have sad down with great regret to begin Nattore treatise,

The reader must be arrested in concern and surprise!

Natural quality of Spring is in a far distance,

Nover freshes our temper southern breeze and flowers’

fragrance

Or repetition on parrots, nightingales, and warbling magpies,

Here we meet agony by sereeching of owls and parlah

dogs’ cries!

Summer treats us very hard in its turn,

Searcely can find air to exhale until sun dives in west

cavern

When tempests not only arises to destroy every straw cottage,

Also occasions great conflagration to consume them with

rage;

The daylight makes everyone’s face distorted,

And the eyes being ready to start from the head!

All habitations are sunk down in water by Autumn.

Terrible noise of thunders, clouds with rain frops that

fall down

Neither sun nor moon with all her starry train be perceived.

The day or night being consequently undistinguished,

Winter generally occupies a greater part of the year,

This whole Spring is considered a part of it here!

No full moon can make her brightness half so visible

As an Assembly Room illuminated with wax candle!

We are indeed at the borders of habitable sphere,

Among wild people and savages, under polar star.

RAMRUTTON CHUCKERBUTTY

.

এর ভাবার্থ করলে এই দাঁড়ায় :

মনের দুঃখে নাটোর—কাহিনি লিখতে বসেছি,

পাঠকরা তা শুনে হতবাক হবেন বিস্ময়ে।

বসন্তের পদধ্বনি কান পেতেও শোনা যায় না এখানে,

দক্ষিণে হাওয়ায় ফুলের গন্ধ ভেসে আসে না,

শোনা যায় না পাখির কাকলি,

কেবল পেচকের আর খেঁকি কুকুরের কর্কশ চিৎকার চারিদিকে।

এদিকে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড অভিনন্দনে প্রাণ ওষ্ঠাগত,

সূর্যাস্তের পরে মলয়ের মন্দগতি মুক্তি,

অতঃপর ঝড় ওঠে যখন, পর্ণকুটির ছিন্ন করে,

আর লকলকে অগ্নিশিখায় গ্রামকে গ্রাম ছাই হয়ে যায়,

দিবালোকে ঝলসানো বিকৃত সব মুখ দেখি আশেপাশে,

চক্ষু কপালে বিস্ফারিত!

বর্ষান্তের শরতে ঘরবাড়ি জলমগ্ন।

যেমন বজ্রধ্বনি, তেমনি বৃষ্টি অবিশ্রান্ত ধারায়,

চন্দ্র—সূর্য—তারা মেঘের আড়ালে লুকায়,

কীবা দিন কীবা রাত বোঝা যায় নাহি যায়।

শীতেরই প্রভুত্ব বেশি গোটা সাল জুড়ে,

বসন্ত পশ্চাতে তার ভয়ে লেজ নাড়ে।

পূর্ণিমার রাতের চাঁদ অর্ধ—জ্যোতির্ময়

মিটমিটে বাতি—জ্বালা ঘর মনে হয়।

এলাম কোথায়? মনে মনে ভাবি

এ কি মনুষ্যলোকের প্রান্ত? বর্বরের বাসভূমি?*

রা ম র ত ন চ ক্র ব র্তী

আমার এই বাঙালি কেরানির কবিতাটি সযত্নে রক্ষা করে এসেছি এতদিন, তাই পাঠকদের উপহার দেবার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।

ক ল কা তা র থি য়ে টা র

এই সময় কলকাতায় আমার এক বিশিষ্ট বন্ধু ফ্রান্সিস র‍্যান্ডেল(Francis Randell)—এর  মৃত্যু হয়। তখন তাঁর বয়স বত্রিশ বছর। র‍্যান্ডেলের অকালমৃত্যুতে তাঁর পরিচিত বন্ধুবান্ধব ও গুণগ্রাহীরা সকলেই খুব মর্মাহত হন। আমার ব্যক্তিগত ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি, কারণ এরকম বন্ধু কদাচিৎ ভাগ্যের জোরে পাওয়া যায়। তাঁর মৃত্যুতে কলকাতার থিয়েটার—রসিকদের যে ক্ষতি হয় তা প্রায় অপূরণীয়। একটা কথা আছে, দুর্ভাগ্য যখন আসে তখন একা আসে না, সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে আসে। র‍্যান্ডেলের মৃত্যুর অল্পদিন পরে পোলার্ড নামে একজন প্রতিভাবান অভিনেতা হঠাৎ এ দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। পোলার্ড কেবল অভিনয়েই দক্ষ ছিলেন যে তা নয়, তিনি খুব চমৎকার দৃশ্যপট আঁকতে পারতেন এবং সংগীত ও সুর রচনাতেও পারদর্শী ছিলেন। কিন্তু এই পেশাতে তাঁর অভাব মিটত না বলে তিনি কলকাতার ‘জেনারেল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া’ নামে এক ব্যাঙ্কে বেশ ভাল মাইনের একটি চাকরি করতেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এ দেশের ব্যয়বাহুল্যের নেশা তাকেও পেয়ে বসল, যেমন অধিকাংশ বিদেশিকেই পেয়ে বসে। রোজগারের কথা ভুলে গিয়ে দু’হাতে তিনি টাকা ওড়াতে আরম্ভ করলেন। তার ফল যা হবার তা—ই হল। ব্যাঙ্ক থেকে বেশ বৃহৎ পরিমাণ টাকা তছরুপের দায়ে তিনি ব্যাঙ্কের কর্তৃপক্ষের কাছে ধরা পড়লেন। অপরাধের দণ্ডের ভয়ে শেষ পর্যন্ত হঠাৎ একদিন চুপিসারে একটি আমেরিকান জাহাজে করে ফিলাডেলফিয়াতে পলায়ন করলেন। সেখানে পৌঁছবার কয়েকদিনের মধ্যে অসুখে তাঁর মৃত্যু হল।

ঠি কা দা রে র ক থা

ঘটনাচক্রে এমন একটি বাস্তব অবস্থার সৃষ্টি হয় এই সময় যে আমার বৈষয়িক পতন প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। আর্থার মেয়ার নাম (Arthur Mair) আমার এক বন্ধু ছিলেন, Bucks Society—র সেক্রেটারি। ব্যবসাবাণিজ্যে তাঁর অদম্য উদ্যম ছিল, ‘স্পেকুলেট’ করতে তিনি ভালবাসতেন। আরও একজন ভদ্রলোক ছিলেন ওই একই গোত্রের, যত বড় বড় ‘স্পেকুলেটিভ’ ব্যবসার ফন্দিফিকির তাঁর মাথায় অনবরত পাক খেত। নামটি যদিও তাঁর টমাস কটন তাহলেও ইংলন্ডে corn—এ র ব্যবসায়ে তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন এবং শেষে সর্বস্বান্ত হয়ে মার্কামারা ‘ইনসলভেন্ট’ হয়ে যান। অবশেষে ভাগ্যের পাশাখেলায় শেষ চাল চালার জন্য তিনি প্রাচ্য দেশ ভারতবর্ষে আসেন। সাফোক(Suffolk)—এর লোক হওয়াতে লর্ড কর্নওয়ালিস তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে খুবই প্রীতির চোখে দেখতেন। কাজেই ভাগ্য ফেরাবার সুযোগের অভাব তাঁর হয়নি। কর্নওয়ালিস নিজে ছিলেন তাঁর সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক। বিলেত থেকে আসার সময় তিনি এখানকার উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ আলাপের জন্য বহু পরিচয়পত্রও সংগ্রহ করে এনেছিলেন। তাতেও তাঁর কাজের যথেষ্ট সুবিধা হয়েছিল। বুককিপিং ও অঙ্কে তিনি বিলক্ষণ দক্ষ ছিলেন বলে এ দেশে আসামাত্রই বেশ মোটা বেতনে ‘জেনারেল ব্যাঙ্ক’—এর ক্যাশিয়ার ও চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট নিযুক্ত হন। মেয়ার সাহেবেরও এখানকার বড় বড় লোকের সঙ্গে খুব খাতির ছিল, সুতরাং তাঁর সঙ্গে কটন সাহেবের ব্যবসাক্ষেত্রে ভালই যোগসাজশ হল। উভয়ে চেষ্টা করলে যত খুশি টাকাও জোগাড় করতে পারতেন। ব্যবসায়ে দুজনে পার্টনার হয়ে কাজ করতে লাগলেন। সরকারি মহলে স্বয়ং কর্নওয়ালিসের সঙ্গে যথেষ্ট হৃদ্যতা থাকায় প্রথমেই তাঁরা এমন তিন—চারটি জিনিসের কনট্যাক্ট পেলেন যাতে রাতারাতি প্রচুর মুনাফা করে ভাগ্য ফিরে যাবার সম্ভাবনা।

তখনকার কালে কোম্পানির সঙ্গে যাঁরা ঠিকাদারি ব্যবসা করতেন তাঁদের দু’টি জামিন দিয়ে একটি বন্ডে সই করতে হত। চুক্তির শর্ত পালন না করতে পারলে কনট্রাক্টের টাকা অনুপাতে ঠিকাদাররা দণ্ডিত হতেন। কিন্তু জামিনের ব্যাপারটা কাগজে—কলমেই থাকত, কার্যক্ষেত্রে কোনো ঠিকাদারের চুক্তিভঙ্গের জন্য কোনো গ্যারান্টারকে অভিযুক্ত করা হয়েছে বলে শুনিনি। অথচ কোম্পানির ঠিকাদারদের পক্ষে চুক্তি ভঙ্গ করা একটা স্বাভাবিক অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন। যা—ই হোক, মেসার্স মেয়ার ও কটন একবার একটা বাণিজ্যচুক্তির ব্যাপারে আমাকে জামিন হতে অনুরোধ করেন। অনুরোধ উপেক্ষা করা আমার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ তাঁদের অ্যাটর্নি হিসেবে আমি বহু টাকাও তখন রোজগার করতাম। বাধ্য হয়ে তাই তাঁদের পাঁচ লক্ষ টাকারও বেশি একটি বন্ডের জামিন হতে হল আমাকে। এঁরা তিনটি বড় জাহাজ কিনে ভাড়া খাটাতে আরম্ভ করলেন। মালয় উপকূলে ও চীনে এই জাহাজে মাল বহন করা হত। স্থানীয় একজন ইয়োরোপীয় ব্যবসায়ীর সঙ্গে এঁরা গোপনে অন্যান্য ব্যবসায়ীদের ‘ইনভেস্টমেন্ট’ চালান দেওয়ারও ব্যবস্থা করে নেন। টাকা দাদন দিয়ে এ দেশের তুলা ও রেশমের বস্ত্রাদি যা কেনা হত কোম্পানির আমলে, তাকেই বলা হত ‘ইনভেস্টমেন্ট’। বছর তিনেক এইভাবে তাঁদের ব্যবসাবাণিজ্য চলার পর অর্থের ব্যাপারে তাঁরা বেশ জড়িয়ে পড়লেন। তাঁদের আর্থিক দুর্গতি আরও বেড়ে গেল একটা বিপর্যয়ের জন্য। চীনগামী তাঁদের একটি জাহাজ হঠাৎ ঝড়ে ডুবে যায় এবং তার ফলে প্রায় এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড মূল্যের জিনিসও নষ্ট হয়ে যায়। এরপরেই এ দেশের লোকের মুখে শুনতে পেলাম, বাজারে নাকি মেয়ার—কটনদের বিল শতকরা কুড়ি ভাগ কম দামে বিক্রি হচ্ছে। কথাটা রটতেই কয়েকদিনের মধ্যে আমার এক অন্তরঙ্গ বন্ধু গোপনে আমাকে খবর দিলেন যে মেয়াররা একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন এবং যে কোনো মুহূর্তে তাঁরা ব্রিটিশ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আত্মরক্ষার জন্য পলায়ন করতে পারেন।

এই কথা শোনার পর আমার পক্ষে চুপ করে বসে থাকা সম্ভব হল না। আমার সহকর্মী বন্ধু জন শ—এর সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করলাম। তিনি বললেন, আর দেরি না করে কোর্টে একটি বিল দাখিল করে আসামিদের আটকে ফেলতে। একদিনের মধ্যেই কাজটা সেরে ফেলতে হবে, তা না হলে সব পণ্ড হয়ে যেতে পারে বলে তিনি সাবধান করে দিলেন। পরদিন সকাল দশটায় কোর্ট খোলামাত্রই একটি বিল ফাইল করে অ্যাফিডেভিট করলাম এবং সার উইলিয়াম ডানকিনের কাছ থেকে আসামিদের আটকাবার জন্য একটি হুকুমও বার করে নিলাম। বেলা এগারোটার মধ্যে কটন ও মেয়ার দু’জনেরই হাজতে বন্দি হলেন। জামিনে মুক্তির জন্য দু’জন ভদ্রলোকের নাম করেন তাঁরা, কিন্তু শেরিফ তা অগ্রাহ্য করেন। পরে ক্যাপটেন ফেনউইক ওই দু’জনের সঙ্গে জামিন হতে রাজি হলে আসামিদের আবেদন মঞ্জুর করা হয়। ছাড়া পেয়ে দু’জন জামিনদারের সঙ্গে তাঁরা ব্রিটিশ এলাকা ছেড়ে বাইরে উধাও হয়ে যান। শেষে ফেনউইক সাহেবকেই ধরে হাজতে আটকে রাখা হয়। ক্যাপটেন ফেনউইক এক বিচিত্র চরিত্রের লোক। তিনি আর্কটের নবাবের একটি জাহাজের কর্ণধার ছিলেন। জাহাজটি প্রত্যেক বছর এখান থেকে মক্কাযাত্রীদের তীর্থ করতে নিয়ে যেত, ক্যাপ্টেন ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা সেই অবকাশে মালপত্তর বোঝাই করে নিয়ে যেত, বাণিজ্যও করে নিতেন। যাত্রীদের মক্কা দোখাও হত, ফেনউইকও কিছু পয়সা পেতেন, নবাব তো পেতেনই।

ফেনউইক স্বভাবতই আমার উপর খুব বিরক্ত হলেন এবং নানাভাবে কটূক্তি করে, ভয় দেখিয়ে আমাকে মেয়ার—কটনের পশ্চাদ্ধাবনে নিরস্ত করার চেষ্টা করলেন। কিছুতেই যখন কোনো ফল হল না তখন তিনি নিজেই আমার পরিবর্তে পাঁচ লক্ষ টাকার জামিন হবার প্রস্তাব করলেন। গবর্নর—জেনারেলের সম্মতিক্রমে আমার বন্ড বাতিল করে দেওয়া হল। একটা বিরাট দায় থেকে আমি রেহাই পেলাম।

মেসার্স কটন—মেয়ারের বাণিজ্যিক বিপর্যয়ের জন্য বহু লোক আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হন। এর কিছুদিন পরেই টমাস গ্রাহাম নামে বিখ্যাত বাণিজ্যকুঠি আর্থিক পতন হয় এবং হঠাৎ তাঁরা টাকা লেনদেন বন্ধ করে দেন। এই হাউসের অংশীদার টমাস গ্রাহাম (Thomas Graham) কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত সিবিলিয়ান ছিলেন, এঁর ভাই রবার্ট গ্রাহাম (Robert Graham) ছিলেন আর—একজন অংশীদার, লন্ডনের একটি বড় ব্যাঙ্কিং হাউসে কাজকর্ম শিখে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, জন মুরে (John Moubray) ও উইলিয়াম স্কিরো (William Skirrow) নামে আরও দু’জন অংশীদার ইংলন্ড ও হল্যান্ডে বাণিজ্যিক শিক্ষা পেয়েছিলেন। এই হাউস দেউলিয়া হবার পর কোম্পানির ডিরেক্টররা বেশ ঘাবড়ে যান এবং এই মর্মে এক নির্দেশ পাঠান যে কোম্পানির সিবিল বা মিলিটারি কোনো কর্মচারী কোনো মার্কেন্টাইল হাউসের সঙ্গে অংশীদাররূপে অথবা কোনো বাণিজ্য সংক্রান্ত কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কদাচ সংশ্লিষ্ট থাকতে পারবে না।

ব্যবসাক্ষেত্রে এই হাউসের সুনাম ছিল যথেষ্ট। এর খ্যাতি ও প্রতিপত্তিও ছিল অসাধারণ। কতজনের কত সঞ্চিত মূলধন যে হাউসে খাটত তা বলা যায় না। টমাস গ্রাহাম দেউলিয়া হবার পর তাই এদেশে পাবলিক ক্রেডিটের ভিত পর্যন্ত নড়ে যায় এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে দীর্ঘ সময় লাগে। অংশীদারদের মধ্যে স্কিরো সাহেব অল্পদিনের মধ্যে উন্মাদ হয়ে যান। মুরে ও রবার্ট গ্রাহাম হতাশায় মুষড়ে পড়ে ডাচ উপনিবেশ চুঁচুড়ায় পালিয়ে যান এবং সেখানে অত্যধিক মদ্যপান করে মাস পনেরোর মধ্যে মারা যান। একেই বলে বিপর্যয়।

বে ঙ্গ ল ব্যা ঙ্ক

এদিকে আমার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকল। আগেকার হাঁপের যন্ত্রণা থেকে ডাক্তার—বদ্যি করেও মুক্তি পেলাম না। মনে হতে লাগল বোধহয় বেশি দিন আর বাঁচব না। অতএব বিষয়সম্পত্তি উইল করে একটা ব্যবস্থা করে যাওয়া দরকার অনুভব করলাম। আমর নিজের সম্পত্তি রক্ষার জন্য যতটা নয়, মক্কেলদের দলিলপত্রের নিরাপত্তার জন্য তার চেয়ে অনেক বেশি। ১৭৯২ সনের জানুয়ারি মাসে একটি উইল করলাম আমার তিনজন বন্ধু বেঞ্জামিন মি, জন রাইডার ও ডেভিড রসের সামনে। বন্ধুরা সকলেই তখন বেশ সুস্থ সবল লোক ছিলেন, এবং আমি ছিলাম রুগণ ও জীর্ণদেহ। অথচ আজ তাঁরা সকলেই পরলোকে, কিন্তু আমি বেঁচে আছি, আমার শরীরও আগের চেয়ে অনেক ভাল হয়েছে।

এই সময় কলকাতার আর্থিক জগতে আর—একটি দুর্ঘটনা ঘটল, বেঙ্গল ব্যাঙ্ক (Bengal Bank) দেউলিয়া হয়ে গেল। ব্যাঙ্কের কর্তৃপক্ষের উপর আমার অগাধ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস ছিল, হঠাৎ তা ধূলিসাৎ হয়ে গেল বলে ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব মুষড়ে পড়লাম। ফ্রান্সিস মিউর (Francis Mure) কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তিনি ইয়োরোপে চলে গেলেন। ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হবার সময় দু’জনমাত্র অংশীদার ছিলেন, জেকব রাইডার (Jacob Rider) ও বেঞ্জামিন মি (Benjamin Mee)। এঁরা দু’জন কেবল যদি ব্যাঙ্কের ব্যবসায়ে মনোনিবেশ করতেন তাহলে নিজেরাও যেমন বিত্তশালী হতে পারতেন, প্রতিষ্ঠানেরও তেমনি সমৃদ্ধি হত। কিন্তু দুর্মতি তাঁদের, তা তাঁরা করেননি। তার বদলে নানারকম স্পেকুলেটিভ ব্যবসায়ের দিকে তাঁরা ঝুঁকে পড়লেন, টাকাপয়সা নির্বিচারে নিয়োগ করতে লাগলেন, এবং তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি যা হবার তা—ই হল। তাঁরা নিজেরা ডুবে গেলেন, ব্যাঙ্কটিও দেউলিয়া হল।

ক ল কা তা র ল টা রি

১৭৯৩ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায় বড় একটি লটারির পরিকল্পনা করা হয় এবং লটারির কর্তারা আমার অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাকে একজন কমিশনার নিযুক্ত করেন। যেদিন লটারির ড্রয়িং হবে তার আগের দিন পর্যন্ত অনেক টিকিট অবিক্রীত থেকে যায়। প্রস্তাব করা হয়, কমিশনাররা মিলে সেই টিকিটগুলি কিনে নেওয়া হোক। আমি আপত্তি করি, কিন্তু জন রিচার্ডসন নামে মাত্র একজন কমিশনার ছাড়া বাকি সকলে উৎসাহিত হয়ে প্রস্তাবের পক্ষে মত দেন। কাজেই মতামতের ভোটে আমরা হেরে যাই এবং বাধ্য হয়ে আমাদের টিকিট কেনার জন্য টাকা দিতে হয়। উৎসাহীরা আশা দেন যে এতগুলি টিকিট যখন কেনা হচ্ছে তখন ভাগ্যে আমাদের লটারির শিকে ছিঁড়বেই ছিঁড়বে। আমি অবশ্য কোনোদিনই এরকম ভাগ্য ফেরাতে বিশ্বাসী নই। অবশেষে আমি যা ভয় করেছিলাম তা—ই হল। লটারির ড্রয়িং হল, কিন্তু মার্জারদের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল না, অথচ প্রত্যেকের ভাগ্যে টিকিটের জন্য দু’টি হাজার করে টাকা দিতে হল। জীবনে অনেক টাকা অপব্যয় করেছি, কোনোদিন তার জন্য আপশোস করিনি। কিন্তু এই টাকাটা দিতে বেশ গায়ে লাগল। স্কচ ভাষায় রিচার্ডসন বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, ‘The De’il damn all your cursed Looteries.’ একটি বগিগাড়ি কিনবেন বলে ভদ্রলোক দু’হাজার টাকা সংগ্রহ করে রেখেছিলেন, এখন তাঁর বগিও গেল, টাকাও গেল। তাঁর অবস্থা দেখে সত্যই দুঃখ হল। কলকাতার লটারির এই তিক্ত অভিজ্ঞতা সারাজীবন মনে রাখার মতন।

ক র্ন ও য়া লি শ ও শো র

ফেব্রুয়ারি মাসের ছয় তারিখে (১৭৯৩) কলকাতার সিবিলিয়ানরা কর্নওয়ালিসকে মহাসমারোহে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন, সেরিঙ্গাপত্তমের রণকীর্তির বার্ষিক উৎসবে। সামরিক কায়দায় সম্মান প্রদর্শনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল লেফটেন্যান্ট—কর্নেল হেনরি কক্স কলক্র্যাফটের উপর। ইনি একটু অধিক মাত্রায় কেতাদুরস্ত এবং সর্বদাই আতিশয্যের পক্ষপাতী। অভিনন্দন—উৎসবে খরচ হয়েছিল সাত হাজার পাউন্ডেরও বেশি, অর্থাৎ প্রায় এক লক্ষ টাকা। একরাত্রির আমোদের জন্য এটা খুব বাড়াবাড়ি নয় কি?

এই মাসেই সার জন শোর (John Shore) কলকাতায় এসে পৌঁছলেন কর্নওয়ালিস বিদায় নিলে তাঁর স্থান অধিকার করার জন্য। কিন্তু কলকাতায় এসে তিনি শুনলেন, কর্নওয়ালিসের ভারত ত্যাগ করতে এখনও কিছুদিন দেরি আছে।

.

জ মা দা র নি স হ চুঁ চু ড়া বা স

এর মধ্যে আমার নিয়মিত চুঁচুড়া যাতায়াত বন্ধ হয়নি, কারণ আমার জমাদারনি চুঁচুড়া ছেড়ে অন্য কোথাও যায়নি। মধ্যে তার শরীরটা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল, বাড়ি বদলে, চিকিৎসা করে, অনেক কষ্টে আবার তাকে সুস্থ করে তুলেছি। এখন আবার সে দিব্যি গাঁট্টাগোট্টা হয়েছে এবং হাসিখুশি ভাবও ফিরে এসেছে।

১৭৯৪ সনের কথা। ডেপুটি—শেরিফের কাজকর্মে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হত বলে কিছুদিন চুঁচুড়ায় নিয়মিত যাতায়াত করতে পারতাম না। সপ্তাহ অন্তে অবশ্য একবার যেতেই হত জমাদারনিকে খুশি করার জন্য। শনিবার বিকেলে গিয়ে রবিবারটা সারাদিন থেকে কলকাতায় ফিরে আসতাম। আমার যাতায়াত কমে যাওয়াতে জমাদারনি বলল, এত বড় বাড়ি অনর্থক ভাড়া করে রাখার প্রয়োজন নেই, একটা ছোট বাড়ি হলেই তার চলে যাবে। কথাটা মন্দ নয় ভেবে শহরে প্রবেশের মুখে নদীর পাড়ের উপর একটা ছোট বাড়ি ভাড়া করলাম। বাড়ির ছাদের উপর নিজের খরচে একটি ছোট বাংলো তৈরি করে নিলাম, হাজারখানেক টাকার মধ্যে। সারা বাংলা দেশের মধ্যে এত সুন্দর বাংলো তখন ছিল কি না সন্দেহ থাকলেও এত ঠান্ডা ঘর বোধহয় কোথাও ছিল না। বাংলো দেখে জমাদারনির আনন্দ আর ধরে না।

কলকাতায় আমি যে ভাড়া বাড়িতে থাকতাম তার বাড়িওয়ালা ছিলেন একজন পর্তুগিজ, নাম রবার্টসন। বাড়ি অনুপাতে তিনি আমার কাছ থেকে অনেক বেশি ভাড়া নিচ্ছেন এ কথা বন্ধুরা আমাকে বহুবার বলেছেন। একদিন মাসে সাড়ে চারশো টাকা করে ভাড়া দিতাম, এখন পুরো চারশো করতে বললাম। গত এগারো বছর ধরে এই বাড়িতে ভাড়া আছি, টাকা নিয়ে কোনো গণ্ডগোল হয়নি কোনোদিন। রবার্টসন স্বীকার করলেন, আমার মতন নির্ঝঞ্ঝাট ভদ্রলোক ভাড়াটে পাওয়া খুবই কঠিন, কিন্তু তবু ভাড়া কমাতে রাজি ছিলেন না। বিশেষ করে, হালে বহু টাকা খরচ করে তিনি কেবল আমার সুবিধের জন্য বাড়ি মেরামত করেছেন, কাজেই এখন ভাড়া কমানোর কোনো প্রশ্নই ওঠে না। যখন তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না তখন আমি চিফ জাস্টিস রবার্ট চেম্বার্সের শরণাপন্ন হলাম। প্রসিদ্ধ আর্কিটেক্ট টমাস লায়ন (Thomas Lyon)—এর তৈরি চেম্বার্সের একটি অনুপম ম্যানসন ছিল কোর্টহাউসের ঠিক পিছনে। যেহেতু কোর্টেই আমার কাজকর্ম বেশি, তাই কোর্টের পাশে থাকলে আমার খুব সুবিধা হবে এই কথা চেম্বার্সকে জানালাম। মাসিক সাড়েচারশো টাকায় তিনি আমাকে বাড়িটি দিতে রাজি হলেন। পাঁচ বছরের জন্য আমি বাড়িটা লিজ নিলাম, নিজের খরচে মেরামত করার শর্তে। ১৯৭৪ সনের পয়লা এপ্রিল আমি নতুন বাড়িতে উঠে এলাম দেখে পুরনো বাড়িওয়ালা রবার্টসন হতাশ হলেন এবং শেষে তাঁর বাড়িটি মাসিক চারশো টাকা ভাড়াতেই দিতে রাজি হলেন। কিন্তু তখন আর মত বদলাবার সময় ছিল না।

সপ্তাহখানেক নতুন বাড়িতে থাকার পর আমার মনে হল দক্ষিণদিকে টানা বারান্দা করে নিলে বাড়িটা চমৎকার হবে। দু’একজন বন্ধুর সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করে একদিন একজন বাঙালি আর্কিটেক্টকে ডেকে বললাম, খরচের হিসেবসহ একটি প্ল্যান করে দিতে। হিসেবটি সার রবার্টের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে লিখলাম যে যদি তিনি এই নতুন বারান্দা নির্মাণের অর্ধেক খরচ বহন করেন, বাকি অর্ধেক আমি করব। বিষয়টি ভাবতে তাঁর বেশ কয়েকদিন সময় কেটে গেল। অতঃপর তিনি তাঁর নিজস্ব গুরুগম্ভীর ভাষায় ও ভঙ্গিতে তার একটা দীর্ঘ উত্তর দিলেন। তাতে কতরকম যুক্তির যে অবতারণা করলেন তার ঠিক নেই। আশ্চর্য হল, খরচের অর্ধেক দিতে তিনি রাজি হলেন বটে, কিন্তু আইনজ্ঞের মতন যুক্তির প্যাঁচ করে জানিয়ে দিলেন যে হিসেবের অতিরিক্ত খরচ হলে সেটা আমাকেই সম্পূর্ণ বহন করতে হবে। কেবল এইটুকু বলেই যদি তিনি থামতেন তাহলেও ভাল হত। কিন্তু সহজে থামবার পাত্র তিনি নন। সুদীর্ঘ চিঠির মধ্যে তিনি এই ধরনের বাড়ির ‘বারান্দা’ থাকলে কী সুবিধা ও অসুবিধা হতে পারে সে সম্বন্ধে গবেষণা করে একটি নিবন্ধ রচনা করেছেন। তা পাঠ করে অর্থোদ্ধার করতে রীতিমতো গলদঘর্ম হয়ে যেতে হয়। মোট কথা, বারান্দার সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি এই তাঁর প্রতিপাদ্য বোঝা গেল। তৎসত্ত্বেও প্রায় চোদ্দোপৃষ্ঠা ধরে নিবেদন করার পর শেষকালে তিনি লিখেছেন : ‘কিন্তু তবু হিকি সাহেব, আমার সমস্ত বক্তব্য নিবেদন করার পরেও এ কথা আমি স্বীকার করব, এবং অনেকেই স্বীকার করবেন, আপনার পরিকল্পিত বারান্দা তৈরি করা হলে বাড়িটা সত্যই সব দিক থেকে অনেক ভাল হবে।’

সুপ্রিমকোর্টের চিফ জাস্টিস সামান্য একটা বারান্দা নিয়ে যে এত দূর বেসামাল ও বিচলিত হতে পারেন, ভাবা যায় না। তথাপি আসল ব্যাপারে তিনি যে প্রধান বিচারক হিসেবে আমার মতন অ্যাটর্নির চেয়ে অনেক বেশি বিচক্ষণ, এ সত্য আমি হৃদয়ঙ্গম করলাম তাঁর টাকার হিসেব থেকে। প্ল্যানে যে ‘এস্টিমেট’ দেওয়া হয়েছে তার বেশি খরচ হলে তা বহনের দায়িত্ব তাঁর নয়, আমার। বিচক্ষণ বিচারক বিলক্ষণ জানতেন যে কোনো বিল্ডারের হিসেবই শেষ পর্যন্ত ঠিক থাকে না, টানতে টানতে রবারের মতন বেড়ে যায়। ঝানু অ্যাটর্নি হয়েও এ কথা আমার চিঠিতে আমি উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিলেন যে আমি অ্যাটর্নি, আর তিনি চিফ জাস্টিস। তাঁর অনুমানই সত্য হল। হিসেব ছিল ন’হাজার টাকার, কাজ শেষ হবার পর হল সাড়ে দশ হাজারের কিছু বেশি। চেম্বার্স চুক্তি অনুযায়ী দিলেন সাড়ে চার হাজার টাকা, আর বাড়তি খরচ ধরে আমাকে দিতে হল ছ’হাজারের কিছু বেশি। আগে বারান্দার রেলিং ও রঙের খরচের কথা মনে পড়েনি, হিসেবেও ধরা হয়নি। তার জন্যই বাড়তি খরচটা লাগল এবং আমাকে তা একাই দিতে হল। বারান্দা তৈরি হবার পর বাড়ির চেহারা একেবারে পালটে গেল, সকলেই দেখে চমৎকৃত হলেন। একটা মনের মতন সুন্দর বাড়িতে বাস করতে পারব ভেবে আমারও খুব আনন্দ হল। বাড়ির প্রত্যেকটি ঘর ভাল ভাল আসবাবপত্তর দিয়ে সাজালাম।

এদিকে শরীরের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে আরম্ভ হল। ভাবলাম, হঠাৎ কিছু হবার আগে জমাদারনির জন্য একটা কিছু ব্যবস্থা করে যাওয়া উচিত। তার ইচ্ছা অনুযায়ী চুঁচুড়াতেই জায়গা কেনা স্থির হল। নদীর তীর থেকে শ’খানেক গজ দূরে জমি কিনলাম, ডাচ—গবর্নরের বাড়ির যে সুন্দর পার্ক তার পাশে। যে বাঙালি আর্কিটেক্ট ভদ্রলোক আমার কলকাতার বাড়ির বারান্দা তৈরি করেছিলেন তাঁকেই ডেকে এখানকার বাড়ির প্ল্যান করতে দিলাম। তিনি আমাকে তিন রকমের তিনটি নকশা দিলেন, তার মধ্যে আমার কলকাতার বসতবাড়ির মতন, যেটি সেইটি আমি গ্রহণ করলাম। আকারে বাড়িটি ছোট, কিন্তু তিনতলা। ১৭৯৬ সনের পয়লা জানুয়ারি বাড়ির ভিত প্রতিষ্ঠা হল এবং ১৫ জুন থেকে বাড়িতে বাস করতে আরম্ভ করলাম। এত শীঘ্র বাড়ির কাজ শেষ হয়ে যাবার কারণ, টাকা নিয়মিত সরবরাহ করার ফলে অনেক বেশি লোকজন লাগিয়ে আমিনদের পক্ষে শক্ত কাজ করানো সম্ভব হয়েছিল। বাড়িটিও এত সুন্দর হয়েছিল যে চুঁচুড়ার লোকেরা তো বটেই, আমি নিজে দেখেও অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, আর জমাদারনি যে কী খুশি হয়েছিল তা বলা যায় না। চুঁচুড়ার এই বাড়িটি তৈরি করতে এবং আসবাবপত্তর দিয়ে সাজাতে আমার চল্লিশ হাজার টাকা খরচ হয়।

গৃহপ্রবেশের মাস দুই আগে এপ্রিল মাসে জমাদারনি আমাকে জানায় যে সে অন্তঃসত্ত্বা। আমাকে সে আশা দিয়ে বলে যে একটি ‘ছোট উইলিয়াম সাহেব’ পয়দা হলে সে খুব খুশি হবে।

জ ন সা হে বে র বা ণি জ্য

এদিকে আমার বন্ধু জন বেশ ভালভাবেই কাজকর্ম করতে করতে হঠাৎ দুর্বিপাকে পড়েন। নিজের পেশা থেকেই তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন, কিন্তু লোভ সংবরণ করতে না পেরে তিনি আরও বেশি অর্থের জন্য ব্যবসায়ের দিকে ঝোঁকেন, এবং সেটি ছোটখাটো ব্যবসা নয়, বিরাট একটি ব্যবসা। পূর্বউপকূলে মশলাপাতির একচেটে ব্যবসাটিকে তিনি সম্পূর্ণ নিজে আয়ত্ত করার চেষ্টা করেন। এই ব্যবসাতে একমাত্র কোম্পানিরই অধিকার ছিল এবং আমাদের পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল। সেইজন্য জন সাহেবকে গোপনে এই ব্যবসা করতে হত এবং জাহাজের অধ্যক্ষরা তারই সুযোগ নিয়ে যদৃচ্ছা প্রতারণা করতে কুণ্ঠিত হতেন না। ফ্রাশার্ড নামে এক ব্যক্তি তাঁকে এই ব্যবসায়ের বুদ্ধি দিয়েছিলেন এবং তিনিই ছিলেন প্রধান কর্মকর্তা। আর তাঁর ব্যবসায়ের সমস্ত মূলধন জোগান দিতেন নিমাইচরণ মল্লিক নামে এক অতিশয় বিত্তশালী বাঙালি ভদ্রলোক। মল্লিকের মতন বুদ্ধিমান চতুর ব্যক্তির তখন কেউ ছিলেন কি না সন্দেহ।

ব্যবসা আরম্ভ করতে—না করতেই জন তার সাফল্যের সম্ভাবনাময় এত উৎসাহী হয়ে উঠলেন যে বন্ধুবান্ধবদের ডেকে তিনি সে কথা বলতে শুরু করলেন। যাঁরা এই ব্যবসায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই অদূর ভবিষ্যতে লক্ষপতি হবেন, এ বিশ্বাস তাঁর বদ্ধমূল হয়ে গেল। তাঁর আশা সফল হত কি না তা বলা যায় না, যদি ডাচদের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ না বেধে যেত। ডাচদের সঙ্গে এই বিরোধের ফলে পূর্বাঞ্চলের ডাচ—দ্বীপগুলি ব্রিটিশ রণতরী দখল করে নেয়। এই সময় জনের মশলাপাতির কয়েকখানি মালবোঝাই জাহাজ আটক করা হয়। দু’বছর ধরে সেগুলি তিনি খালাস করার আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হন এবং তাঁর লক্ষপতি হবার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। জন একেবারে নিঃসম্বল হয়ে যান।

জা স্টি স হা ই ডে র মৃ ত্যু

সুপ্রিমকোর্ট ও কলকাতার সমাজে এই সময় একটা বিরাট ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দিল। জাস্টিস হাইড এমন অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে চিকিৎসকরা তাঁর বাঁচার আশা নেই বলে রায় দিলেন। তাঁর মৃত্যুর কয়েকদিন আগে ইংলন্ড থেকে সার জেমস ওয়াটসন কলকাতায় এসে পৌঁছলেন, উইলিয়াম জোন্সের মৃত্যুর পরে তাঁর বিচারকের শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য। জোন্সের সঙ্গে ওয়াটসনের কোনোদিক থেকেই তুলনা হয় না। তাঁকে নিয়ে অনেক ব্যঙ্গকবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে এই কবিতাটি আমার বেশ ভাল লেগেছিল :

At Folly’s freaks ofttimes surprized we stare,

A Banks succeeding to great Newton’s chair!

Reynolds whom genius with the graces blest,

Succeeded by that sweet Hist’ry painter West,

Now comes the wildest freak that folly owns,

Viz., Sergeant Watson, post Sir William Jones!!!

তিন সপ্তাহ কলকাতায় আসার পর তিনি যে বাড়িতে ছিলেন সেটা বদল করে চৌরঙ্গিতে নতুন একটি বাড়ি কিনে উঠে গেলেন। দুঃখের বিষয়, গৃহান্তরিত হবার দু’একদিনের মধ্যেই তাঁকেও দেহান্তরিত হতে হল। বিপদটা ঘটল এইভাবে। প্রথম প্রথম এ দেশে এসে অনেকেই দেখেছি বাহাদুরি দেখিয়ে সূর্যের তাপটাকে অগ্রাহ্য করতে চান। ওয়াটসনও তা—ই করেন। নতুন বাড়িতে আসবাবপত্তর সরাবার সময় তিনি নিজে রোদে দাঁড়িয়ে তদারক করেন। তার জন্য বেশ কয়েক ঘণ্টা তাঁকে রৌদ্রদগ্ধ হতে হয়। পরের দিন মধ্যাহ্নভোজনের সময় হঠাৎ তাঁর শরীর ঝিমঝিম করতে থাকে এবং তিনি খুব অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন। খাবার টেবিলে না বসে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়েন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। ডাক্তার ডাকার সময় হয়নি। সুপ্রিমকোর্টের কর্মচারীরা এবং শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা অনেকেই পরদিন তাঁর শবযাত্রায় যোগদান করেন। কেবল গোঁয়ার্তুমির জন্য বিচারক ওয়াটসনের, বিচারের আসনে ভাল করে বসার আগেই হঠাৎ মৃত্যু হয়।

পরের মাসে জাস্টিস হাইড মারা যান। তাঁর মৃত্যুতে সকলেই মর্মাহত হন। এরকম উদারহৃদয় বিচক্ষণ বিচারক এ দেশে খুব কমই এসেছেন। কত অসহায় দীনদরিদ্র লোককে তিনি যে টাকাপয়সা, খাদ্যদ্রব্য ও পোশাক—পরিচ্ছদ দিয়ে নিয়মিত সাহায্য করতেন তার ঠিক নেই। এহেন একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকেও মরণাপন্ন অবস্থাতে তাঁরই এক সহযোগী বিচারকের অবিবেচনার জন্য যে কী অমানুষিক দুর্ভোগ ভুগতে হয়েছিল তা বোধহয় অনেকেই জানেন না। ঘটনাটি এখানে তাই উল্লেখ করেছি। যিনি তাঁর দুর্ভোগের কারণ হয়েছিলেন তাঁর নাম সার রবার্ট চেম্বার্স।

জা স্টি স চে ম্বা র্সে র সং কী র্ণ তা

কলকাতা শহরের ইয়োরোপীয় অঞ্চলে, অর্থাৎ চৌরঙ্গিপাড়ায়, প্রায় একশো বিঘা একটি জমির মালিকানা নিয়ে কয়েক মাস ধরে সুপ্রিমকোর্টে মামলা চলছিল। এই জমিটাতে একটি বড় বাজার বসানো হয়েছিল, তাতে মাংসের দোকান থেকে নানা রকমের পণ্যদ্রব্যের দোকান ছিল অনেক। বাজারটি বেশ ভাল চলত এবং যাঁদের বাজার, তাঁরা বেশ মুনাফা করতেন। বাজারের কাছাকাছি ইয়োরোপীয়দের ভাল ভাল বসতবাড়ি থাকার জন্য বাসিন্দারা অনেকে বাজার তুলে দেবার চেষ্টা করেন। জমির প্রকৃত মালিক যিনি, তাঁকে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ না দিয়ে জোর করে উচ্ছেদ করে বাজার বসানো হয়েছিল বলে তিনিও বাসিন্দাদের পক্ষে যোগ দেন। কিন্তু সার রবার্ট নিজে বাজারের অন্যতম অংশীদার বলে জোর করে বাজার বসানো হয় ও চালানো হতে থাকে। চেম্বার্সের এই স্বার্থের কথা সকলেই জানতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি এ মামলার প্রধান বিচারক হয়ে রীতিমতো পক্ষপাতিত্ব করতে আরম্ভ করেন। মামলা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে, বিচার আর শেষ হয় না। চেম্বার্সই এই জের টেনে চলতে থাকেন, কারণ তিনি জানতেন যে মামলার রায় দিলেই তাঁর সহযোগী বিচারক উইলিয়াম ডানকিন বিরোধিতা করবেন। অবশেষে অধৈর্য হয়ে অভিযোগকারীরা বলেন যে দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি না করলে তাঁরা প্রিভি কাউন্সিলে আবেদন করবেন। চেম্বার্স তখন চিফ জাস্টিস। এ অবস্থায় রায় দিতে হবেই জেনে তিনি শুধু তাঁর সহযোগী ডানকিনের উপর ভরসা না করে জাস্টিস হাইডকে কোর্টে হাজির করার সিদ্ধান্ত করেন। হাইড তখন মৃত্যুশয্যায়, তাঁর নড়াচড়া নিষেধ; তা সত্ত্বেও প্রাণ হাতে নিয়ে তাঁকে কোর্টে উপস্থিত হতে হল, শুধু চেম্বার্সের খেয়ালের জন্য নয়, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য। চেম্বার্স ভাবলেন, হাইড তাঁকে সমর্থন করবেন, এবং তিনজন বিচারক থাকলে শুধু ডানকিনের মতভেদের জন্য চিফ জাস্টিস হিসেবে তাঁকে আর অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে না।

বিচারের দিন সুপ্রিমকোর্ট লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। প্রধান বিচারপতির এই চারিত্রিক অধঃপতন ও স্বার্থের খেলা দেখে সকলের মন অশ্রদ্ধায় ভরে উঠল। মরণোন্মুখ হাইডকে তিনজন বন্ধু মিলে ধরাধরি করে কোর্টে নিয়ে এলেন এবং অনেক কষ্টে কোনোরকমে তাঁকে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। যে কোনো মুহূর্তে তাঁর মৃত্যু হতে পারে জেনেও তাঁকে কোর্টে আনা হয়েছে বলে আদালতসুদ্ধু লোক যেমন ক্ষুব্ধ তেমনি ক্রুদ্ধ হল চেম্বার্সের উপর। চেম্বার্স এসে প্রধান বিচারপতির আসনে বসলেন এবং তাঁর স্বাভাবিক লঘু ভঙ্গিতে পাশে হাইডের দিকে চেয়ে মন্তব্য করলেন, ‘জাস্টিস হাইড দেখছি অসুস্থ। সেইজন্য আমি প্রথমে তাঁকেই মামলার রায় দিতে অনুরোধ করছি।’ কোর্টের ভিতর থেকে এই কথা বলামাত্রই তুমুল প্রতিবাদের ধ্বনি শোনা গেল। এবারে চেম্বার্স নিজে হাইডকে অনুরোধ করলেন রায় দিতে। জাস্টিস ডানকিন আপত্তি জানিয়ে বললেন যে এত অসুস্থ শরীর নিয়ে ব্রাদার হাইড কোর্টে এসেছেন, তাঁকে বিশ্রাম করতে দেওয়া উচিত, এখনই কথা বলতে দেওয়া অন্যায় হবে। কোনো কথায় চেম্বার্স কর্ণপাত করলেন না। বাধ্য হয়ে হাইড কথা বলার চেষ্টা করলেন, এবং অতিকষ্টে দু’তিনটে অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ কথা বলে ক্লান্তিতে চেয়ারে গা ছেড়ে দিলেন। প্রত্যেকে ভাবল তিনি বোধহয় মারা গেলেন। তৎক্ষণাৎ তাঁকে ধরাধরি করে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল।

এত বড় একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল, কিন্তু যাঁর জন্য ঘটল তিনি কিছুমাত্র বিচলিত হয়েছেন বলে মনে হল না। হাইডকে বাড়ি পাঠানোর পর চেম্বার্স তাড়াতাড়ি মামলার রায় দিয়ে দিলেন এবং ডানকিন কিছু বলার আগেই তা রেকর্ড করবার চেষ্টা করলেন। বলা বাহুল্য, বাজারের পক্ষেই তিনি রায় দিলেন, তবে ডানকিনকে নিরস্ত করার চেষ্টা তাঁর সফল হল না। ডানকিন উঠে তাঁর বিপরীত রায় ঘোষণা করে বললেন, চেম্বার্সের সঙ্গে এই মামলার কোনো বিষয়ে তিনি একমত নন। জাস্টিস হাইডের উপর এরকম জুলুম করার জন্যেও তিনি চেম্বার্সের আচরণের কঠোর সমালোচনা করলেন।

জ মা দা র নি র মৃ ত্যু

এই বছর (১৭৯৬) আগস্ট মাসে আমার ব্যক্তিগত জীবনেও একটি দুর্ঘটনা ঘটল। আমার স্ত্রী শার্লতের মৃত্যুর পর এরকম ঘটনা আর ঘটেনি। অন্তঃসত্ত্বা হবার পর জমাদারনির শরীর বেশ ভালই ছিল, ক্রমে তার স্বাস্থ্যের উন্নতি হচ্ছিল এবং আমিও তার সম্বন্ধে নিশ্চিত ছিলাম। ৩০ জুলাই তারিখে আমি তাকে চুঁচুড়া থেকে কলকাতায় নিয়ে গেলাম প্রসবের সুবিধার জন্য। ডাক্তার হেয়ার তাকে পরীক্ষা করে বললেন, যে কোনো সময় তার সন্তান প্রসবের সম্ভাবনা আছে। ৪ আগস্ট তারিখে সকালে একসঙ্গে বসে ব্রেকফাস্ট খেলাম, জমাদারনি বেশ কথাবার্তা বলল, তার কোনো উপসর্গ কিছু বুঝতে পারলাম না। সেদিন খুব জরুরি কাজ বলে কোর্টে আসতে হল। কোর্টে আসার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ভৃত্যরা এসে খবর দিল, বিবিসাহেব মৃত্যুর মুখে। তৎক্ষণাৎ বাড়ি ফিরে গিয়ে দেখলাম জমাদারনি অচৈতন্য অবস্থায় দাঁতকপাটি লেগে সটান শুয়ে রয়েছে, এবং একটি সুন্দর পুত্রসন্তান হয়েছে তার। পাঁচমিনিটের মধ্যে ডাক্তার হেয়ার এলেন, প্রসূতির অবস্থা দেখে অবাক হয়ে গেলেন, এবং বেশ কড়া ওষুধ দিলেন খেতে। ওষুধ খেয়ে জমাদারনির জ্ঞান ফিরে এল এবং আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল যে কোনো ভয় নেই, সে ঠিক ভাল হয়ে উঠবে। ডাক্তারও তাই বললেন। কাজেই আমি কোর্টে ফিরে গেলাম। ফিরে যাওয়ামাত্রই আবার ভৃত্যরা এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল। গিয়ে দেখি জমাদারনি আবার অজ্ঞান হয়ে পড়েছে, ডাকাডাকিতে কোনো সাড়া দিচ্ছে না। এবারে তার জ্ঞান ফিরল না, সেইদিনই রাত ন’টার সময় তার মৃত্যু হল। মৃত্যুর পর খোঁজ করে জানলাম, এ দেশি যে ধাত্রীকে প্রসব করানোর ভার দেওয়া হয়েছিল সে যমজ সন্তান হবে ভেবে প্রসবের পর জমাদারনিকে জোর করে ধরে চিৎ করে শুইয়ে রেখেছিল। তার ফলে অসহ্য যন্ত্রণায় সে অজ্ঞান হয়ে যায় এবং পরে তার মৃত্যু হয়। হিন্দুস্থানের সাধারণ মেয়েদের মধ্যে এরকম বুদ্ধিমতী, শান্তশিষ্ট অথচ সপ্রতিভ মেয়ে খুব কমই দেখা যায়। তাই আমার বন্ধুবান্ধবরা সকলে তার মৃত্যুতে খুবই দুঃখিত হয়েছিলেন।

ছোট শিশুটিকে নিয়ে আমার মহাসমস্যা হল। সমাধান করে দিলেন বন্ধুপত্নী শ্রীমতী টার্নার। তাঁর নিজের ছেলেমেয়ে অনেক, তাদের মধ্যে আর—একটি বাড়লে কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না বলে তিনি আমাকে আশ্বাস দিলেন। শিশুটিকে তিনি নিয়ে গেলেন এবং একটি নার্স রেখে তাকে মানুষ করতে লাগলেন। ছেলেটি বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়ে বড় হচ্ছিল, কিন্তু ১৭৯৭ সনের মে মাসের গোড়ায় হঠাৎ কয়েকদিনের অসুখে মারা গেল। জমাদারনির শেষ স্মৃতিটুকুও নিশ্চিহ্ন হল।

.

* ভাবার্থ আমার নিজের। বি ঘো

৯. হিকির স্মৃতিকথা

লর্ড ওয়েলেসলি মারকুই ও ক্যাপ্টেন জেনারেল উভয়ের ক্ষমতা ও মর্যাদা নিয়ে এ দেশে গবর্নর—জেনারেল হলেন। মহীশূরে টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে কৃতিত্ব দেখিয়ে তিনি এই সম্মান অর্জন করেন।

ও য়ে লে স লি র ন বা বি

ওয়েলেসলির মতন অকৃপণভাবে কোম্পানির অর্থব্যয় করতে আর কাউকে দেখা যায়নি। তাঁর আমলে লাটপ্রাসাদের ভৃত্যবাহিনী যেমন বিশাল আকার ধারণ করল, তেমনি তাদের সাজপোশাকের বাহার ও বৈচিত্র্য সকলের চোখ ধাঁধিয়ে দিল। লাটবেলাটি করতে হলে যে এ দেশের নবাবদেরও টেক্কা দিতে হবে, এসত্য তিনি যেন মর্মে মর্মে—উপলব্ধি করলেন। লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেন, অর্থাৎ লিডেনহল স্ট্রিটের সিন্দুকরক্ষীরা। কেবল বিলাসিতার বহর দেখিয়ে তিনি ক্ষান্ত হলেন না, কলকাতা শহর ও তার চারদিকের উন্নতির জন্যও তিনি বদ্ধপরিকর হলেন। পরিপার্শ্বের উন্নতিকল্পে তাঁর প্রথম কীর্তি হল কলকাতা শহর বেষ্টন করে একটি ষাট ফুট চওড়া পাকা রাস্তা গঠন করা (সার্কুলার রোড)। কেবল হুগলী নদির তীরবর্তী প্রায় আট মাইল পথ এই পরিকল্পনা থেকে বাদ রইল। এই রাস্তা তৈরি হবার ফলে শহরবাসীদের সুবিধা হল খুব, বিশেষ করে ইয়োরোপীয়দের ঘোড়ায় চড়ে চক্কর দেওয়ার আর কোনো অসুবিধে রইল না, তারপরেই লাটবাহাদুরের মনে হল, যে প্রাসাদে তিনি বাস করেন তা ঠিক লাটোপযুক্ত নয়, অতএব তার আশপাশের জায়গাজমি দখল করে এবং লোকজনদের ঘরবাড়ি ভেঙেচুরে বিশাল চৌহদ্দির মধ্যে মধ্যমণির মতন অট্টালিকা নির্মাণের পরিকল্পনা করা হল। লর্ডের ইচ্ছা কার্যে পরিণত হতে দেরি হল না বেশি। চারদিকের ঘরবাড়ি থেকে বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করা হল এবং সেগুলি নিশ্চিহ্ন করে খালি মাঠ করে ফেলা হল। বিশাল জায়গা ঘিরে চমৎকার উদ্যান রচনা করে তার মধ্যে তৈরি করা হল নতুন লাটপ্রাসাদ।

লিডেনহল স্ট্রিটের ম্যানেজারদের অর্থের এই অপব্যয়েও তাঁর মনটা তেমন খুশি হল না। পরিকল্পনার বহর ক্রমেই তাঁর বাড়তে লাগল। তিনি ঠিক করলেন ফোর্ট উইলিয়ামের কোল থেকে একেবারে কলকাতার উত্তর সীমানা পর্যন্ত আগাগোড়া নদীর পাড়টি সলিড কংক্রিটে বাঁধিয়ে ফেলবেন। এই কংক্রিটের পাড়ের ধারে ধারে থাকবে বড় বড় মালগুদাম, কাস্টম হাউস এবং আরও অন্যান্য অফিস যা নদীতীরের কাছাকাছি থাকা উচিত। প্রায় পাঁচ মাইল দীর্ঘ এই শান—বাঁধানো পাড়টির এই পরিকল্পনাও খসড়া করা হয়ে গেল।

কিন্তু এতেও লর্ডের তৃপ্তি হল না। তিনি ব্যারাকপুরে দ্বিতীয় একটি লাটপ্রাসাদ বানাবেন স্থির করলেন। তারও একটি বিরাট পরিকল্পনা খসড়া করা হল এবং সেটি সম্পূর্ণ বাস্তবে রূপ দেওয়া তাঁর লাটত্বকালে সম্ভব হবে না জেনেও তিনি অগ্রসর হলেন। ভবিষ্যতের বড়লাটরা যাতে অন্তত শহর থেকে দূরে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশে একটি মনোরম বাগানবাড়িতে বাস করার আরাম উপভোগ করতে পারেন, সেদিকে তাঁর দৃষ্টি দেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করলেন। নামে বাগানবাড়ি বটে, কিন্তু কলকাতার লাটপ্রাসাদের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী করা হবে বাড়িটিকে স্থির হল। তা ছাড়া অতিরিক্ত যা করা হল তা—ও কম নয়। বাগানের মধ্যে একটি রঙ্গমঞ্চ এবং একটি বৃহৎ আস্তাবল তৈরি করা হল। দেশ—বিদেশ থেকে বাছাই—করা উৎকৃষ্ট সব ঘোড়া নিয়ে এসে আস্তাবলে রাখা হল। হরেক রকমের পশুপক্ষী ও জীবজন্তু নিয়ে এসে বিচিত্র একটি পশুশালাও তৈরি করা হল। চিন্তাক্লিষ্ট বড়লাট বাহাদুরের আরাম, বিরাম ও বিলাসিতার উপকরণের কোনো অভাব যাতে না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেই ওয়েলেসলি ব্যারাকপুরের বাগানবাড়ি তৈরি করেছিলেন।

ফো র্ট উ ই লি য়া ম ক লে জ

ওয়েলেসলি আর—একটি পরিকল্পনা করেন যা তাঁর অন্যতম কীর্তিরূপে গণ্য হবার যোগ্য। তিনি কলকাতায় একটি কলেজ স্থাপন করবেন স্থির করেন। কোম্পানির জুনিয়র কর্মচারীরা এই কলেজে এ দেশি ভাষা ও বিদ্যা শিক্ষা করবে, এই তাঁর ইচ্ছা। অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন এই কলেজেও প্রোভোস্ট, ভাইস—প্রোভোস্ট ও প্রফেসর নিযুক্ত করা হবে ঠিক হল। কলেজের জন্য তিনি গার্ডেনরিচের প্রথম থেকে পর পর পাঁচখানি বাড়ি দখল করে নিলেন, অর্থাৎ কিনে ফেললেন। তার মধ্যে একটি বাড়ি ছিল পরলোকগত উইলিয়াম বার্কের। বাড়িটি বন্ধক ছিল বলে তখনও পর্যন্ত বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। কোম্পানির অনুরোধে আমাকেই বাড়িটি বিক্রির সব ব্যবস্থা করতে হল, এবং তার মূল্য পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা থেকে বন্ধক ও সুদ বাবদ বত্রিশ হাজার একশো টাকা পাওনাদারদের শোধ করে দিলাম। গার্ডেনরিচের বাড়ি ছেড়ে ওয়েলেসলি কলকাতার মধ্যস্থলে কলেজের জন্য বড় একটি বাড়ি লিজ নিলেন। বাড়িটি ম্যাকডোনাল্ড নামে একজন ব্যবসায়ী নাচের মাস্টার ‘পাবলিক এক্সচেঞ্জ’—এর জন্য তৈরি করেছিলেন, কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্যসিদ্ধির কোনো আশা নেই দেখে তিনি সেটি কোম্পানির মতন একজন ভাল ভাড়াটেকে লিজ দিতে সম্মত হন। বাড়িতে কলেজের কাজ আরম্ভ হবার পর প্রত্যহ ছাত্রদের খাবার টেবিলে প্রোভোস্ট অথবা ভাই—প্রোভোস্ট উপস্থিত থাকতেন। কিন্তু কলেজের কাজকর্ম বেশি দিন চলল না, কারণ কোম্পানির কর্মকর্তারা হঠাৎ জানিয়ে দিলেন যে কলেজ চালানোর কোনো প্রয়োজন নেই এবং তার জন্য টাকা খরচ করাও অর্থহীন। ওয়েলেসলি এই আদেশ বিনা প্রতিবাদে মেনে নিলেন এইজন্য যে কোম্পানির অর্থের অপব্যয় তাঁর হাত দিয়ে এত হয়েছে যে কোনো কথা বলার মুখ আর তাঁর ছিল না।

ক কা রে ল কো ম্পা নি

১৮০১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে আমি রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়লাম। বেশ বুঝতে পারলাম, স্বাস্থ্য ক্রমেই ভেঙে পড়ছে, আয়ু আর বেশি দিন নেই। অবশ্য ডাক্তার হেয়ারের অক্লান্ত চেষ্টায় এবারও কোনোরকমে গা—ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। ওঠার পরেই বড় একটি মামলায় জড়িয়ে পড়লাম। ‘ককারেল, ট্রেল অ্যান্ড কোম্পানি’ নামে একটি বিখ্যাত বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মচারী তহবিল তছরুপের দায়ে ধরা পড়েন। কর্মচারীর নাম রাউল্যান্ড স্কট, জাতিতে পর্তুগিজ, দীর্ঘকাল কোম্পানির প্রধান বুককিপার ও সহকারী ক্যাশিয়ারের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। টাকার পরিমাণ এত বেশি যে কোম্পানির কর্তৃ,পক্ষ ব্যাপারটি জানতে পেরে স্কটকে ডেকে বুঝিয়েসুঝিয়ে টাকাটি আদায় করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও মোট টাকার চার ভাগের এক ভাগের বেশি আদায় করা সম্ভব হয় না। কোনো উপায় না দেখে শেষে স্কটকে জেলখানায় বন্দি করা হয়। ককারেল কোম্পানির বেনিয়ান ছিলেন নিমাইচরণ মল্লিক। কোম্পানির কর্তারা তাঁকে তলব করে বললেন যে, স্কট যে টাকা চুরি করেছে তা তাঁকেই ক্ষতিপূরণ করতে হবে, কারণ বেনিয়ান হিসেবে কর্মচারীদের জামিন হলেন তিনি। নিমু মল্লিক এই দায়িত্ব অস্বীকার করে বলেন যে বেনিয়ান হিসেবে তিনি কেবল নেটিব বা এ দেশি কর্মচারীদের জন্য দায়ী, অন্যদের জন্য দায়ী নন। বিশেষ করে স্কট সাহেব তাঁর বেনিয়ান নিযুক্ত হবার আগে থেকেই এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, কাজেই স্কটের কোনো জাল—জুয়াচুরির জন্য তাঁর কোনো দায়িত্ব নেই।

মল্লিক মহাশয়ের জবাবে ককারেলের কর্তারা মোটেই প্রীত হলেন না। তাঁরা নিমাইচরণ, তাঁর দুই ছেলে ও একটি ভাইপোর (যিনি খুড়োর কেরানির কাজ করতেন) বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে মামলা করেন। এই মামলায় আমি আসামি মল্লিকদের পক্ষে দাঁড়াই এবং আসামিদেরই জয় হয়। তাঁরা খরচাসহ ডিক্রি পান। কিন্তু ককারেল কোম্পানির কৌঁসুলি দাম্ভিক বারোজ প্রিভি কাউন্সিলে আবেদন করলেন সুপ্রিমকোর্টের রায় নাকচ করার জন্য। তাঁর উদ্দেশ্য সফল হল না, কেবল ককারেলকেও কিছু অর্থদণ্ড দিতে হল। ককারেলের বিরুদ্ধে মামলায় নিমু মল্লিকের জয় হবার পর থেকে আমার পসার হু হু করে বাড়ত লাগল। মক্কেলের জায়গা হয় না। ঘরে এমন অবস্থা হল। ১৮০১ সাল নিজের পেশাগত কাজকর্মের চাপে কোথা দিয়ে কেটে গেল টের পেলাম না।

১৮০২ সালের কথা। চুঁচুড়ার বাড়িতে মধ্যে মধ্যে যাই বটে, কিন্তু এত ঝামেলা পোহাতে আর ভাল লাগে না। বাড়ির জন্য কতকগুলি চাকরবাকর অনর্থক পুষতে হয়, তা ছাড়া সেই শখের বোটটির জন্য চোদ্দোজন দাঁড়ি—মাঝি তো আছেই। এই কারণে বাড়িটা বেচে দেব ঠিক করলাম। জনৈক সার্জেন প্লেস্কেট মাত্র দশ হাজার টাকা মূল্য দিতে চাইলেন, কিন্তু মূল্যটা এত কম এবং ক্রেতার লাভটা এত বেশি বলে মনে হল যে আমি তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলাম। মাসখানেক পরে তিনি আবার ওই মূল্যের কথা জানিয়ে লিখলেন যে তিনি কেবল বাড়িটি চান, আসবাবপত্র, সিডনের বিলিয়ার্ড টেবিল, ডিশ, প্লেট, মেহগনি বুককেস বা অন্যান্য কোনো জিনিস চান না। এইসব আসবাবের মূল্য প্রায় পাঁচ হাজার টাকা হবে। কাজেই কিছু অন্তত বাঁচল মনে করে আমি দশ হাজার টাকাতেই বাড়িটা তাঁকে বেচে দিলাম। এতে আমার হাজার চল্লিশ টাকার মতন ডাহা লোকসান হল।

পা র্ট না র শি প বি চ্ছে দ

পরবর্তী দুটো বছর কোনোরকমে কেটে গেল। ১৮০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমার ব্যবসায়ের পার্টনার বেঞ্জামিন টার্নার হঠাৎ ইয়োরোপ ফিরে যাবেন বলে হিসেব চুকিয়ে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলবেন ঠিক করেন। একটা হিসেবও চটপট করে ফেলে দিয়ে তিনি আমার কাছে দাখিল করলেন। সেই হিসেবের দিকে চেয়ে, এবং আমার কাছে তাঁরা যে খাতে যে পাওনার অঙ্ক বসানো হয়েছে তা দেখে আমার চক্ষু কপালে উঠল। আমি নাকি আমার লভ্যাংশের অতিরিক্ত টাকা প্রায় আমাদের কোম্পানির তহবিল থেকে নিয়েছি, এবং তার সুদ বাবদ আমার পার্টনারের একটা মোটা টাকা পাওনা হয়েছে। এ সত্য আবিষ্কার করে এবং পার্টনারের হিসেবের বাহাদুরি দেখে আমি স্তম্ভিত হলাম। ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে জানালাম যে কোনোদিন তাঁর ব্যক্তিগত একটি টাকাও আমি নিইনি, অতএব তাঁর কোনো সুদ আমার কাছে পাওনা হয়নি। যে টাকা তিনি দাবি করেছেন তা ন্যায্য নয় এবং আমি তা কিছুতেই দেব না, তার জন্য তিনি যা খুশি করতে পারেন। কিছুদিন এইভাবে কড়া চিঠিপত্র লেখালেখি চলতে লাগল। টার্নার অবশ্য মেজাজ অনেকটা ঠান্ডা রেখেছিলেন, আমার পক্ষে তা রাখা একেবারেই সম্ভব হয়নি। অবশেষে বন্ধুবান্ধবরা ব্যাপারটায় হস্তক্ষেপ করায় ঠিক হল যে আমরা আদালতে না গিয়ে সালিশি মেনে নেব। সালিশিতে আমার খুব বেশি লাভ হল না, কেবল সুদের হার থেকে রেহাই পেলাম। তবে পার্টনারশিপ ব্যবসা শেষ পর্যন্ত চুকিয়ে ফেলা হল।

বিপদের সময় বিপদ বাড়ে। এই সময় সার হেনরি রাসেল একটি ঘোড়ার গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। কয়েক মাস তাঁর পক্ষে কোনো কাগজপত্র দেখা বা সই করা সম্ভব হয়নি বলে আমিও তাঁর ক্লার্ক হিসেবে কোনো বেতন পাইনি, তাতে আমার বেশ আর্থিক অসুবিধা হয়েছে।

হি দা রা ম ও র ঘু না থ ব্যা না র্জি

আমার পার্টনার টার্নারের সঙ্গে বিচ্ছেদ হবার পর একদিন নিমাইচরণ মল্লিক আমার কাছে নানা বিষয়ে সৎ পরামর্শ দেবার জন্য নিজেই উদযোগী হয়ে এলেন। আমি জানতাম, টার্নারকে আমার পার্টনার হয়ে ব্যবসা না—করার সৎ পরামর্শও তিনিই দিয়েছিলেন। তবু তিনি এসে সদিচ্ছা জানিয়ে বললেন যে ব্যবসার খাতিরে আমিও তাঁর কাছে যা, টার্নারও তা—ই, এবং উভয়েরই মঙ্গলচিন্তা সর্বদাই তিনি করে থাকেন। মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী নিমাইবাবু আমাকে বললেন যে হিদারাম ব্যানার্জি ও তাঁর ভাই রঘুনাথ ব্যানার্জির কাছে বিভিন্ন সময়ে বন্ড দিয়ে আমি যে টাকা লেনদেন করেছি, সে সম্বন্ধে তিনি আমাকে কিছু পরামর্শ দিতে চান। বিশেষ করে রঘুনাথের কাছে আমার নাকি অনেকটা টাকা ঋণ আছে এবং সে বিষয়ে আমার এখনই সচেতন হওয়া উচিত। এ কথার উত্তরে আমি বললাম, হিদারাম ও রঘুনাথ এই দুই ভাইকে আমি এক নম্বরের শঠ ও প্রবঞ্চক (হিকির ভাষা হল ‘errent knaves and scoundrels’ বলে মনে করি। দুই ভাই মিলে মতলব করে কতরকম কৌশলে যে টাকাপয়সার ব্যাপারে আমাকে ঠকিয়েছে, তার ঠিক নেই। যদি দু’জনকে অথবা একজনকেও আর কিছুদিন আমার কাজে বহাল রাখতাম তাহলে ভিটেমাটি উচ্ছন্নে দিয়ে পথের ভিখিরি হয়ে আমাকে ঘুরে বেড়াতে হত। রঘুনাথ কিছুকাল আমার বেনিয়ানের কাজ করেছিল। আমি নিমাইবাবুকে বললাম, যেহেতু হিদারাম ও রঘুনাথের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব আছে, সেই কারণে আমি যে তাদের কোনোরকম মর্যাদা দেব তা নয়। এ কথা ঠিক যে অনেক সময় বাধ্য হয়ে আমি রঘুনাথকে বন্ড লিখে দিয়েছি, একটি টাকাও পাওনা নেই জেনেও। পরে যখন দেখলাম এই ভ্রাতৃদ্বয়ের বিবেক বলে কোনো পদার্থ নেই, এবং টাকার জন্য যে কোনো অপকৌশল অবলম্বন করতে তারা প্রস্তুত, তখন তাদের ডেকে আমি পরিষ্কার বলে দিই যে একটি টাকাও আমি তাদের দেব না, সুদ বা আসল কোনো বাবদেই নয়। তার জন্য তারা যা খুশি করতে পারে, আইন—আদালত পর্যন্ত।

হিদারাম ও রঘুনাথের জুলুমের কথা শুনে আমার প্রাক্তন পার্টনার টার্নার আমাকে একজন বাঙালি বন্ধুকে দিয়ে খবর পাঠান যে আমি যদি হিসেবের যাবতীয় খাতা ও কাগজপত্র তাঁর কাছে লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিই তাহলে তিনি সেগুলি ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন এবং তার গরমিল ও জুয়াচুরিও ধরে দিতে পারেন। ব্যবসার পার্টনারশিপ নিয়ে গণ্ডগোল হবার পরেও যে টার্নার আমার প্রতি এতটা সহানুভূতিশীল থাকতে পারেন, আমি তা ভাবতে পারিনি। তাঁর সহৃদয়তায় সত্যিই আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। হিসেবের সমস্ত খাতাপত্র পাঠিয়ে দিলাম তাঁর কাছে। এ দেশি হিসেবপত্রের কায়দাকানুন কিছুই আমার জানা ছিল না। টার্নার জানতেন এবং যে কোনো ঘুগু বাঙালি হিসেবনবিশকে তিনি ইচ্ছা করলে এ ব্যাপারে ঘোল খাওয়াতে পারতেন। আমরা যখন একসঙ্গে ব্যবসা করছি তখন এ বিষয়ে তাঁর দক্ষতা আমি দিনের পর দিন দেখেছি। হিসেবের খাতা খুঁটিয়ে দেখে তিনি ‘ডবল এন্ট্রি’ প্রভৃতি নানা রকমের জুয়াচুরি হাতেনাতে ধরে ফেলতেন। কাজেই টার্নার চেষ্টা করলে যে হিদারাম—রঘুনাথের প্রতারণার ফন্দি অনেকটা ফাঁস করে দিতে পারেন, সেবিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। আমি তাই টার্নারকে আমার পূর্বের রূঢ় ব্যবহারের জন্য, বিশেষ করে চিঠিপত্রের কড়া ভাষার জন্য, ক্ষমা চেয়ে একটি চিঠি লিখলাম। চিঠির সুন্দর জবাবও দিলেন তিনি। উভয়ের মধ্যে যে মনকষাকষি চলছিল, এই উপলক্ষে তা কেটে গিয়ে আবার আমরা পরস্পর বন্ধু হিসেবে মিলিত হলাম।

টার্নারের সঙ্গে আমার পার্টনারশিপ ব্যবসা চুকে যাবার পর আর কারও সঙ্গে আমি এ ব্যাপারে হাত মেলাইনি। অথচ আমার অ্যাটর্নির কারবার তখন এত দূর ফেঁপে উঠেছিল যে অফিস এস্টাবলিশমেন্ট দ্বিগুণ বাড়াতে পারতাম। কিন্তু আমি তা—ও করিনি। আমার হেড কেরানি রামধন ঘোষ পর্যন্ত আমার ভাবগতিক দেখে বেশ বিচলিত হয়ে উঠলেন। ১৭৮৩ জুন থেকে এই ১৮০৬ সাল পর্যন্ত প্রায় তেইশ বছর তিনি আমার অ্যাটর্নির অফিসে কাজ করতেন, কিন্তু কোনোদিন আমার টাকাপয়সার উদারতা সম্বন্ধে তাঁর মনে কোনো সন্দেহ জাগেনি। তিনিও একদিন ধৈর্য হারিয়ে বললেন, আমিও নাকি ক্রমে নিমু মল্লিকের মতন ইহুদি—মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠছি। আমাদের যখন হিকি—টার্নার নামে যুক্ত প্রতিষ্ঠান ছিল তখন গৌর দে, একজন ধনকুবের বাঙালি, আমাদের উভয়েরই বেনিয়ান ছিলেন। পরে টার্নার আলাদা হয়ে গেলে গৌরবাবু তাঁর সঙ্গে চলে যান। তারপর আমিও আর কোনো নতুন বেনিয়ান নিয়োগ করিনি। তার ফলে অবশ্য আমার লাভের অঙ্ক ক্রমেই ফেঁপে উঠছিল।

এই সময় রামমোহন মজুমদার নামে শেরিফের অফিসের হেড কেরানির আকস্মিক মৃত্যুতে ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব ক্ষতিগ্রস্ত হই। ১৭৮৪ সালে রবার্ট মর্সের অধীনে আমি যখন আন্ডার শেরিফ ছিলাম তখন মজুমদারকে একজন সাধারণ কেরানি হিসেবে আমি শেরিফের অফিসে ঢুকিয়ে দিই। তারপর থেকে এই ১৮০৬ সাল পর্যন্ত এই অফিসে কাজ করে তিনি হেড কেরানি হয়েছেন এবং কাজকর্ম অনেক শিখেছেন। ডেপুটি—শেরিফের অধিকাংশ কাজ তিনিই করে দিতেন, তার জন্য তাঁকে যেতে হত না। তার মৃত্যুও হল আশ্চর্যভাবে। আমার চোখের সামনে ডেস্কের কাছে বসে একমনে তিনি লিখছিলেন। লিখতে লিখতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন, আমি আমার পালকি করে তাড়াতাড়ি তাঁকে বাড়ি পাঠিয়ে দিই। বাড়ি পৌঁছে ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে তিনি মারা যান।

নি মা ই চ র ণ ম ল্লি ক

১৮০৭ সালের কথা। অর্থের সমাগম অনর্গল ধারায় হচ্ছে, স্বাস্থ্যের ক্ষয় হচ্ছে দ্রুতগতিতে। মক্কেল অনেক, কাজও অনেক, একটানা দীর্ঘ সময় ডেস্কে বসে তা শেষ করতে হয়, তবেই টাকা পাওয়া যায়। এই সময় কয়েকটি জটিল মামলা পরিচালনায় আমি অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তার মধ্যে একটি হল নিমাইচরণ মল্লিকের পারিবারিক বিষয়সম্পত্তির মামলা। নিমাইচরণ বা নিমু মল্লিকের কথা একাধিকবার বিবিধ প্রসঙ্গে আগে উল্লেখ করেছি। বাঙালিদের মধ্যে তাঁর মতন অগাধ ধনসম্পত্তির মালিক তৎকালে হাতে গোনা যেত। বেনিয়ানি ও অন্যান্য কাজকর্ম করে তিনি বহু অর্থ উপার্জন করেছেন। কিন্তু তাঁর অর্থ রোজগারের আরও একটি উপায় ছিল যা অনেকেরই জানা নেই। অ্যাটর্নি, অ্যাডভোকেট ও আদালতের সংস্রবে দীর্ঘদিন থাকার ফলে, এবং নিজেরও তীক্ষ্ন বুদ্ধির জোরে, তিনি আইনের মারপ্যাঁচ অনেক ঝানু উকিল—ব্যারিস্টারের চেয়ে ভাল বুঝতেন। মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ নেবার জন্য লোকজন অ্যাটর্নি—উকিলের কাছে যাবার আগে তাঁর কাছে যেত। বিবাদের বিষয় শুনে এবং কাগজপত্র দেখে তিনি পরিষ্কার বলে দিতে পারতেন, মামলায় হার মানতে হবে না জিত হবে, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁর কথা ফলে যেত। বাস্তবিকই এসব বিষয়ে তাঁর অসাধারণ বুদ্ধি ছিল। দেখতে দেখতে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ল, চারদিকে, এবং বাড়িতে লোকজনের ভিড়ও হতে লাগল খুব। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি তাঁর বাড়ির একটি ঘরে নির্দিষ্ট কয়েক ঘণ্টার জন্য বসতেন, মক্কেলদের মামলার বিষয় মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং কী করতে হবে—না হবে সে বিষয়ে যুক্তি—পরামর্শ দিতেন। এর জন্য অ্যাটর্নি—ব্যারিস্টারদের মতন তাঁরও এক রকমের ‘ফি’ ধার্য ছিল, সেটা হল মামলার মোট টাকার উপর কমিশন। এই কমিশন থেকে তিনি প্রচুর টাকা উপার্জন করেছেন।

এরকম একজন ধুরন্ধর লোক যে নিজের বিষয়সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারার ব্যাপারে প্রকাণ্ড ভুল করে ফেলবেন, এবং সে ভুলের জালে নিজেরই জীবনসায়াহ্নে জড়িয়ে পড়বেন তা কেউ ভাবতে পারেন কি? অনেক আগে থেকে নিমু মল্লিক তাঁর বিশাল বিষয়সম্পত্তি ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে উইল করে রেখেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর সম্পত্তির ভোগদখল নিয়ে ঝগড়া করে ছেলেরা যাতে পারিবারিক অশান্তি না ঘটায়, এবং মামলা করে অনর্থক অর্থের অপব্যয় না করে, তার জন্য অনেক ভেবেচিন্তে তিনি উইল করে রেখেছিলেন। শেষবার পীড়িত হবার পর দীর্ঘদিন ভুগে তিনি মারা যান। রোগশয্যায় তাঁর আটটি ছেলেকে কাছে ডেকে তিনি উইলের কথা বলেন। ছোট ছেলেটির বয়স তখন বছর আঠারো হবে। উইলের কথা বলে তিনি সকলকে অনুরোধ করেন যেন তাঁর মৃত্যুর পর সম্পত্তি বিভাগ নিয়ে ভাইদের মধ্যে যেন কোনো বিবাদ না হয়, এবং যে ছ’জন নাবালক রয়েছে তারা যেন সম্পত্তির তত্ত্বাবধানে কোনো ওজর—আপত্তি না করে। এই কথা বলার পরেই সেই ছ’জন নাবালক ছেলে তাদের মুমূর্ষু পিতার মুখের উপরে জবাব দেয় যে কোনো অনুরোধ বা উপদেশ শুনতে তারা রাজি নয়, কারণ তাদের উপর তিনি বিষয়—বণ্টনের ব্যাপারে অবিচার করছেন এবং বড় দুই ভাইকে অন্যায়ভাবে বেশি অংশ দিয়েছেন। বৃদ্ধ নিমাইচরণ মৃত্যুশয্যায় নাবালক পুত্রদের মুখ থেকে এই কথা শুনে পরলোকের চিন্তা করতে লাগলেন। বড় দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে নাবালক ছয় ভাই বিষয়ের সমান অংশ দাবি করে আদালতে মামলা করলেন। মামলার সঙ্গে আমিও জড়িয়ে পড়লাম, পরিচালনার দায়িত্ব পড়ল আমার উপর। কলকাতায় বাকি যতদিন ছিলাম ততদিন এই মামলাও চলেছিল। যদি আরও কিছুকাল কলকাতায় থাকতাম, মামলার নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত, তাহলে টাকার দিক থেকে হয়তো আমারও ভাগ্য ফিরে যেত। তবু যে পরিমাণ টাকা এ মামলা থেকে আমি পেয়েছি তা যথেষ্ট, বাকি যা পাইনি তার জন্য কোনো দুঃখ নেই আমার।

১৮০৭ সালের গোড়ায় ডাক্তার হেয়ার আমাকে বললেন যে যদি কিছুদিন বাঁচার ইচ্ছা থাকে তাহলে যত শীঘ্র সম্ভব ভারতবর্ষ ছেড়ে ইংলন্ডে ফিরে যেতে। তারপর থেকে আমার মন গৃহাভিমুখী হয়ে উঠল। সম্পত্তি বলতে তখন আমার হাজার সত্তর টাকা ছিল এবং তা—ই দিয়ে শতকরা আট টাকা সুদের কোম্পানির কাগজ কিনে রেখেছিলাম। শেষদিকে এই টাকাটা বাড়াবার জন্য খুবই চেষ্টা করছিলাম, বাজে খরচ যথাসম্ভব কমিয়ে ও সঞ্চয় করে।

নী ল ক র সা হে ব

এই সময় আমার এক বন্ধু ফ্রেডারিক মেটল্যান্ড আর্নট শোচনীয়ভাবে মারা যান। ১৭৭৭ সালে তিনি ক্যাডেট হয়ে একই জাহাজে আমার সঙ্গে ভারতবর্ষে আসেন এবং পরে সেনাবিভাগে ক্যাপ্টেনের পদে উন্নীত হন। কিন্তু ক্যাপ্টেনের কাজ ছেড়ে দিয়ে টাকা রোজগারের আশায় তিনি নীলের (indigo) ব্যবসা করবেন ঠিক করেন। তার জন্য কৃষ্ণনগরে গিয়ে বাস করতে আরম্ভ করেন। দেশীয় প্রথা অনুযায়ী তিনি চাষিদের টাকা দাদন দিয়ে নীলচাষ করাতেন। চাষিরা এবারে নাকি তাঁর কাছ থেকে দাদন খেয়ে চুক্তি অনুযায়ী তাঁকে গাছ সরবরাহ করেনি, অন্য কোনো নীলকরের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। চাষিদের ব্যবহারে ক্রুদ্ধ হয়ে আর্নট গ্রামে গিয়ে তাদের উপর চড়াও হন এবং দু—একজনকে টেনেহেঁচড়ে ধরে আনার চেষ্টা করেন। আইনের প্রয়োগ আনর্ট নিজেই করার জন্য উদ্যত হন, কিন্তু তা করতে গিয়ে ভীষণ বিপদে পড়ে যান। কয়েকশত চাষি দলবদ্ধ হয়ে বাঁশ—লাঠি ইত্যাদি নিয়ে তাঁকে ঘেরাও করে এবং জবরদস্তির জবাব চায়। জবাব না পেয়ে তারাও অপরাধের বিচারক হয় নিজেরা, এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ না দিয়ে আর্নট সাহেবকে বাঁশপেটা করে ধরাশায়ী করে। এমনভাবে তাঁকে পেটানো হয় যে জড়পিণ্ডের মতন তিনি দলা পাকিয়ে যান। কাকুতিমিনতি, অনুনয়—বিনয় সবই তাঁর ব্যর্থ হয়। ফাটা মাথা, হাড়গোড় ও পাঁজরসুদ্ধ তাঁকে বাড়িতে বয়ে আনা হয় এবং সেখানে কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আশ্চর্য হল এরকম একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কোনো তদন্ত করা প্রয়োজন বোধ করলেন না গবর্নমেন্ট। বরং ইংরেজ মহলে বলাবলি হতে শুনেছি যে দোষ আর্নটের এবং দোষের উপযুক্ত দণ্ড তিনি পেয়েছেন। দু’জন চাষিকে তিনি নাকি আগে অত্যাচার করে মেরে ফেলেছিলেন। কাজেই চাষিদের হাতেই তাঁর মৃত্যু হওয়াতেই তিনি বেঁচে গেছেন, তা না হলে বিচারে তাঁর দুষ্কৃতির জন্য আরও বেশি দুর্ভোগ তাঁকে ভুগতে হত।

হি কি র স ম্প ত্তি র হি সে ব

ডাক্তার হেয়ার আমার ভগ্নস্বাস্থ্য সম্বন্ধে আর—একবার সাবধান করে দিলেন। সুতরাং নতুন কাজকর্ম নেওয়া বন্ধ করে দিয়ে ইংলন্ডে ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলাম। ১৮০৮ সালে পয়লা জানুয়ারি লোহার সিন্দুক খুলে দেখলাম তাতে এক লক্ষ বাইশ হাজার টাকার কোম্পানির কাগজ রয়েছে। সকলকেই ইংলন্ড যাবার কথা জানিয়ে অনুরোধ করেছিলাম দেনাপাওনা চুকিয়ে ফেলতে, কিন্তু অনেকেই তার কোনো উত্তর দেননি। আমি জানতাম বাজারে আমার কিছু ধারদেনা আছে, কিন্তু সেটা এত ছড়ানো যে পাওনাদাররা না জানালে আমার পক্ষে খোঁজ করে তা পরিশোধ করা সম্ভব নয়। আমার অনুপস্থিতিতে এইসব দেনাপাওনার দায়িত্ব তাই কারও উপর না দিয়ে গেলে অন্যায় হবে মনে হল। কিন্তু কার উপর এই গুরুদায়িত্ব দেওয়া যায়? সুপ্রিমকোর্টের অ্যাটর্নি ডোনাল্ড ম্যাকনারের কথা মনে হল। ম্যাকনার একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক, সচ্চরিত্র ও পরিশ্রমী। রবার্ট চেম্বার্সের উইল ও টেস্টামেন্টের একজিকিউটার তিনি এবং লেডি চেম্বার্সেরও এজেন্ট রূপে কাজ করেন গত চার বছর ধরে। চেম্বার্সের মৃত্যুর পর এই দায়িত্ব লালন করে তিনি বেশ সুনাম অর্জন করেছেন। সেইজন্য তাঁকেই আমার এজেন্টের কাজ করার জন্য অনুরোধ করলাম এবং তিনি আমার প্রস্তাবে সম্মত হলেন।

চারটি বড় বড় সেগুনকাঠের সিন্দুক, একটি লেখার ডেস্কসহ ব্যুরো, শোবার জন্য একটি ছোট খাট, একটি টেবিল এবং আরও কয়েকটি ছোটখাটো কাঠের জিনিস একজন ইয়োরোপীয় ছুতোরমিস্ত্রিকে দিয়ে তৈরি করালাম আমার কেবিনের জন্য। এক বাক্স ক্ল্যারেট এবং এক বাক্স মদিরা কিনলাম। ঠিক করলাম এইসব জিনিসপত্র নিয়ে নৌকা করে জাহাজ পর্যন্ত গিয়ে আমার কেবিনটা আগে থেকে সাজিয়ে—গুছিয়ে রেখে আসব। দু’একজন বন্ধু এই কাজে আমাকে সাহায্য করবেন কথা দিলেন। যেদিন যাওয়া হবে স্থির হল তার আগের দিন রাতে আমার এমন পেটের যন্ত্রণা হতে লাগল যে বিছানা ছেড়ে আমি উঠতেই পারলাম না। শেষে নিরুপায় হয়ে ভাবলাম, আমার যে বাঙালি ভৃত্যটি আছে তাকেই কেবিন সাজাতে পাঠাব।

ভৃ ত্য চাঁ দে র কী র্তি

এই বঙ্গদেশীয় ভৃত্যটির নাম চাঁদ। বন্ধুমহলে সকলেই জানে চাঁদ আমার পিয়ারের ভৃত্য। যখন সে ছোট্ট শিশু ছিল তখন থেকে তাকে আমি পালন করেছি। এখন সে আঠারো বছরের সুন্দর বলিষ্ঠ যুবক, কাজকর্মে ও কথাবার্তায় রীতিমতো স্মার্ট। কিন্তু ছেলেবেলা থেকে আমার কাছে আদর ও আশকারা পেয়ে তার ইহকাল—পরকাল ঝরঝরে হয়ে গেছে। আমিও তাকে শখের পোষা জীবের মতন নিজের খেয়ালখুশি চরিতার্থের জন্য এত আবদার দিয়ে মানুষ করেছি যে কিছু বলবার নেই। নিজের খুশিমতন তাকে নানা রকমের পোশাক দিয়ে সাজিয়েছি, তার সব রকমের অন্যায় ও অত্যাচার সহ্য করেছি এবং তারই ফলে আমার বহু পুরাতন ভৃত্য চাঁদ আজ একটি বাঁদর ও বুলবুলি বাবুটি তৈরি হয়েছে। আমার বন্ধুবান্ধবরাও সব সময় তার সঙ্গে হাসি—ঠাট্টা—মশকরা করে তার মাথাটি চিবিয়ে খেয়েছে।

চাঁদ যখন বারো—তেরো বছরের হল তখন সে বেশ সিঁধেল চোর হয়ে উঠল দেখলাম। এই আশকারাই তার একমাত্র কারণ। আমি যখন ঘুমিয়ে থাকতাম তখন সে সোজা আমার ঘরে ঢুকে, পকেট থেকে ড্রয়ারের চাবি বার করে দু’চারটে সোনার মোহর নিয়ে আবার আমার পকেটে রেখে চলে যেত। কয়েক মাস ধরে তার এই মোহর চুরি অবাধে চলতে থাকে। তার কারণ, চাঁদ জানত, টাকাপয়সার কোনো হিসেব আমার থাকে না, এবং দু’চারটে মোহর তা থেকে সরিয়ে ফেললে আমি কোনোদিনই ধরতে পারব না। বাস্তবিক ধরতে আমি পারতাম না, যদি না চাঁদের লোভ ক্রমে বেড়ে যেত এবং চুরিটা তার নিত্যকর্ম হয়ে দাঁড়াত। দু’একদিন মনে একটু খটকা লাগাতে আমি টাকার হিসেব রাখতে আরম্ভ করলাম। হিসেব যে ক’দিন রেখেছি, সকালে উঠে দেখেছি, কিছু টাকা উধাও হয়েছে। চাঁদের ওপর তখনও কোনো সন্দেহ হয়নি। ব্যাপারটা যখন প্রতিদিন ঘটতে লাগল তখন আমার পুরনো কেরানি রামধন ঘোষকে সব খুলে বললাম। আদ্যোপান্ত শুনে তিনি বললেন, আমার খানসামা নাকি তাঁকে বলেছে যে চাঁদ আজকাল দামি দামি বাহারে পোষাক পরছে এবং ঘড়ি ও অন্যান্য বাবুগিরির জিনিসও কিনছে খুব। এত পয়সা সে পাচ্ছে কোথা থেকে? সে যা বেতন পায় তা থেকে এসব করা সম্ভব নয়। কেরানিবাবু পরিষ্কার ইঙ্গিত করলেন যে চাঁদই সব চুরি করছে।

এই ইঙ্গিত পেয়ে চাঁদকে ডেকে আমি বললাম যে, কিছুদিন হল আমার ড্রয়ার থেকে টাকা চুরি যাচ্ছে, এবং সে এই টাকা চুরি করছে। শুনে সে গাছ থেকে পড়ার মতন ভাব দেখাল। তখন আমি চালপড়ার ওঝা ডাকব বলে ভয় দেখালাম। ওঝা এসে সমস্ত ভৃত্যকে ডেকে শুকনো চাল চিবোতে দেবে, এবং নানারকম কুৎসিত মুখভঙ্গিমা করে কী সব মন্ত্রপাঠ করতে থাকবে। তারপর সে সকলকে যখন চিবোনো চাল উগরে ফেলতে বলবে তখন দেখা যাবে, যে অপরাধী বা চোর, তার মুখের চাল লালাতে ভেজেনি, শুকনোই রয়েছে। অর্থাৎ এই জাদুর আসল রহস্য হল এই যে, অপরাধী হলেই ভয়ে তার গলা ও মুখ শুকিয়ে যাবে, চাল আর লালাতে ভিজবে না। অতঃপর ওঝা অপরাধীর দিকে চেয়ে আরও বীভৎস মূর্তিতে মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকবে এবং তাকে এই বলে ভয় দেখাবে যে, অপরাধ মুখে স্বীকার না করলে এখনই ভূতে কিলোতে থাকবে। এই অবস্থায়, বলা বাহুল্য, অপরাধী দোষ স্বীকার করতে বাধ্য হয়। এই চালপড়ার জাদুতে চোর যে ধরা পড়ে না তা নয়, তবে নির্দোষ লোককেও বেশ নাজেহাল হতে হয়। তার কারণ অপরাধের ভয়ে যেমন চোরের গলা শুকিয়ে যায় তেমনি ওঝার ভয়েও অনেক নির্দোষ লোকের গলা কাঠ হয়ে আসে। মুখের চাল তাদেরও ভেজে না। যা—ই হোক, এ দেশের লোকদের, বিশেষ করে চোরছ্যাচড়দের চালপড়া সম্বন্ধে বিলক্ষণ ভয় আছে। ওঝার কথা বলাতেই আমার কাজ হল, তাকে আর আসতে হল না। চাঁদ তার অপরাধ স্বীকার করল।

অপরাধ স্বীকার করার পর চাঁদ ভাবল, এবারে নিশ্চয় তার চাকরি যাবে। আমি অবশ্য সেরকম কিছু ভাবিনি, কারণ নিজের হাতে মানুষ করে তার ওপর এমন একটা মমতা হয়েছিল, যে তাকে ছাড়াবার কথা ভাবতে পারতাম না। আমি কিছু বলার আগেই চাঁদ আমাকে না বলে কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। বোম্বাইগামী এক জাহাজের ক্যাপ্টেনের ভৃত্য হয়ে সে পালাল। বোম্বাই থেকে চীন কয়েকবার জাহাজে যাতায়াত করে এবং ক্যাপ্টেনের কাছে প্রায় পনেরো মাস কাজ করে, চাঁদ আবার কলকাতায় ফিরে এল। ফিরে এসেই আমাকে জানাল যে, তার আগের স্বভাব এখন শুধরে গেছে এবং তার অপরাধের জন্য সে অনুতপ্ত। আমি যদি তার অপরাধ ক্ষমা করে আবার তাকে ভৃত্যের কাজে নিয়োগ করি তাহলে সে কৃতার্থ হবে। আমি তাকে আগেও ছাড়াতে চাইনি, বরং সে ছেড়ে যাওয়াতে দুঃখ পেয়েছি। কাজেই সে যখন ফিরে এসে নিজেই আবার কাজ করতে চাইল তখন খুশি হয়েই আমি রাজি হলাম। তারপর থেকে গত তিন বছর সে আমার সাজঘরের ভৃত্য হিসেবে কাজ করছে। এ ছাড়া আমি যখন বাইরে কোথাও গাড়ি করে বেড়াতে বেরোই তখন সে ঘোড়ায় চড়ে গাড়ির পিছনে পিছনে যায়। ঘোড়ায় চড়াও তাকে আমি নিজে শিখিয়েছিলাম, এবং সে চমৎকার ঘোড়ায় চড়তে পারত। সংক্ষেপে এই হল আমার পিয়ারের ভৃত্য চাঁদের জীবনবৃত্তান্ত।

আমি ইংলন্ডে ফিরে যাব শুনে চাঁদও আবদার করে বসল যে, সে—ও আমার সঙ্গে যাবে। এতদিন করতে পারিনি, আজও তার আবদার উপেক্ষা করতে পারলাম না। চাঁদও আমার সঙ্গে ইংলন্ডে যাবে ঠিক হল।

আমার জাহাজের নাম হল ‘ক্যাসল ইডেন’। সাগরদ্বীপের ওপারে নোঙর করা আছে, সেখানে গিয়ে কেবিন সাজাতে হবে। আমি অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য সঙ্গে যাদের যাবার কথা ছিল তাদেরও যাওয়া হল না। কিন্তু আমার স্লুপ ভাড়া করা হয়ে গিয়েছে, এক—আধ টাকা নয়, পাঁচশোটি টাকা ভাড়া। সুতরাং চাঁদকে মালপত্র দিয়ে পাঠাব ঠিক করলাম। আমার অসুস্থতার খবর পেয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেন কলনেট সাহেব খবর পাঠিয়েছেন যে—স্টিফেন গ্রেগ নামে একটি লোককে কেবিন সাজাবার কাজে সাহায্য করার জন্য তিনি দিতে পারবেন। এ কাজে গ্রেগের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাও আছে। গ্রেগ যথাসময়ে এলেন, তাঁর সঙ্গে চাঁদ ও দিনু নামে আর—একটি ছোট ছেলেকে পাঠিয়ে দিলাম। আসবাবপত্রের সঙ্গে যাবতীয় খাদ্যদ্রব্য ও পানীয়, ক্ল্যারেট মদিরা পেরি বিয়ার ব্র্যান্ডি যা ছিল সবই তাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হল। চাঁদকে ডেকে বলে দিলাম, খাওয়াদাওয়ার কোনো অসুবিধা হবে না, ভোজন ও পান যত খুশি তারা করলেও ক্ষতি নেই, কারণ প্রত্যেক জিনিস প্রচুর পরিমাণে মজুত করা হয়েছে।

বারো দিন পরে স্লুপটি কলকাতায় ফিরে এল। গ্রেগ আমার কাছে এসে খবর দিলেন যে, তিনি আমার কেবিন খাট, টেবিল, ড্রেসিং—স্ট্যান্ড, চেয়ার, ব্যুরো ইত্যাদি দিয়ে যথাসম্ভব সুন্দর করে সাজিয়েছেন এবং লকারের মধ্যে মদিরাদি পানীয় ভর্তি করে রেখেছেন। জাহাজে পৌঁছলে আমার কোনো অসুবিধা হবে না। গ্রেগ সাহেব এলেন বটে, কিন্তু চাঁদের দেখা নেই, অথচ সকলের আগে চাঁদেরই আসা উচিত। অন্যান্য ভৃত্যদের জিজ্ঞাসা করলাম চাঁদের খবর কী? তারা বললে যে, চাঁদ তার মা—কে দেখতে বাড়ি গেছে। এই কথা বলে ভৃত্যরা চলে যাবার পরেই খানসামা এসে আমাকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে গেল। জাহাজে ব্যবহারের জন্য আমার যে বিছানাটি পাঠিয়েছিলাম, দেখলাম সেটি নোংরা অবস্থায় ঘরের মধ্যে জড়ানো রয়েছে। বিছানা, বালিশ, লিনেন চাদর, পর্দা অধিকাংশই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, কতকগুলি বমিতে ভিজে রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি দূর করে ফেলে দিতে বললাম। জিজ্ঞাসা করলাম, এগুলি আমাকে এভাবে প্রদর্শনীর মতন দেখাবার কারণ কী? বুঝলাম, এসব চাঁদের কীর্তি বলে আমাকে ভাল করে দেখানো হল।

কীর্তির বিবরণ যা শুনলাম তা এই। কলকাতা থেকে নৌকা ছেড়ে ফলতা পর্যন্ত যাবার পর চাঁদ নাকি সারেংকে নৌকা বাঁধতে বলে। তখনও প্রায় ঘণ্টা তিনেক বেলা ছিল এবং চমৎকার হাওয়াও ছিল, নৌকা বাঁধার কোনো কারণই ছিল না। সারেং সে কথা চাঁদকে বুঝিয়ে বলতেও চাঁদ রাজি হল না, নৌকা বাঁধার জন্য জোর করতে লাগল। গ্রেগ সারেংকে বলল, আমি নাকি তাকে বলে দিয়েছি ফলতায় নৌকা বেঁধে সেখান থেকে কিছু জিনিসপত্র কেনার জন্য। গ্রেগ নাকি বলেছিল যে অনর্থক কোনো জিনিস কেনার দরকার নেই, প্রচুর জিনিস আছে, ফলতায় এইভাবে সময় কাটালে তারা নির্দিষ্ট সময়ে জাহাজে পৌঁছতে পারবে না। এতসব কথা ও যুক্তি চাঁদের একান দিয়ে ঢুকে সেকান দিয়ে বেরিয়ে গেল। হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে সে বলল যে, ফলতার মেসার্স গ্যামেজ অ্যান্ড সন্ডার্সের দোকান থেকে কয়েকটি খাদ্যদ্রব্য কেনার জন্য আমি তাকে হুকুম দিয়েছি। অবশেষে চাঁদের জোরজবরদস্তিতে ফলতার ঘাটে নৌকো ভেড়াতেই হল। ঘাটে নেমে চাঁদ গ্রেগকে বলল, ‘চলো একটু ঘুরে—ফিরে আসি, দেখি একটা মেয়েটেয়ে পাকড়াও করা যায় কি না। রাতটা তাহলে ভালই কাটবে।’ প্রস্তাব শুনে গ্রেগ ঘাবড়ে গিয়ে আপত্তি করল। কিন্তু পরোয়া নেই, চাঁদ একলাই চলে গেল এবং ঘণ্টা দুয়ের মধ্যে একটি নয়, তিনটি বারাঙ্গনা বালিকাকে নিয়ে ফিরে এল নৌকায়। গ্রেগ তাকে বুঝিয়ে বলল, ‘এসব কাণ্ডমান্ড কোরো না, তোমার মাস্টার হিকি সাহেব যদি জানতে পারেন তাহলে সর্বনাশ হবে। তোমার চাকরিও যাবে, আর তার সঙ্গে ইংলন্ডে যাওয়াও পণ্ড হবে।’ চাঁদ হেসে জবাব দিল, ‘আরে রেখে দাও তোমার ওসব কথা, ভীতু সাহেব কোথাকার। আমার মাস্টার তোমার মতন নপুংসক নন, জানতে পারলেও তিনি আমাকে কিছু বলবেন না। আর তা ছাড়া জানবেনই বা কী করে?’ গ্রেগের মনে এইভাবে সাহসের সঞ্চার করার চেষ্টা করে চাঁদ মেয়ে জুটিয়ে এনেছে। মেয়ে তিনটির সঙ্গে কী রফা হয়েছে তা—ও সে বুক ফুলিয়ে জানিয়ে দিল। ফলতা থেকে তারা সাগরদ্বীপ পর্যন্ত যাবে এবং সেখান থেকে কলকাতায় ফেরার পথে ফলতায় তাদের নামিয়ে দেওয়া হবে। এত কথাবার্তায় গ্রেগ সাহেব প্রায় অর্ধেক গলে গেল, বাকি অর্ধেক গলতে বেশি দেরি হল না। দু’একবার গাঁইগুঁই করে গ্রেগ শেষে চাঁদের ধমকানি ও প্রলোভনে ভুলে গেল। সেই রাতটি ফলতায় মহা উল্লাসে কাটল। প্রাণ খুলে ভোজন ও মদ্যপান করে সারারাত ধরে হুল্লোড় করা হল। অবশেষে মদে চুর হয়ে গুণধর চাঁদ আমার অত্যন্ত শখের শয্যাটি পেতে দু’পাশে দু’টি মেয়েকে নিয়ে বিশ্রাম করতে গেল। অতঃপর সেই শয্যা এই অবস্থায় কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

এ কেবল এক রাতের ঘটনা নয়। পরে প্রতিটি দিন ও রাত এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। গ্রেগ অবশ্য পরে ভয় পেয়ে বেশি মদ্যপান করেনি, কেবল মাত্রা রেখে কিঞ্চিৎ বিয়ার পান করেছে। চাঁদের সে চেতনাও হয়নি। খাদ্য ও মদ্য কিছুই অভাব ছিল না। অতএব সে তার দুটি মেয়েকে নিয়ে যত ইচ্ছা তা খেয়েছে এবং বেলেল্লাপনা করেছে। কলকাতায় পৌঁছে মনে হয়, তার কিঞ্চিৎ চৈতন্যোদয় হয়, তাই আমার সামনে এসে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারেনি। এরপর আমার সঙ্গে তার ইংলন্ডে পাওয়া তো দূরের কথা, এখানে চাকরি করার প্রশ্নই ওঠে না। এ কথা বুঝতে পেরেই চাঁদ গা—ঢাকা দেয়। তার ফলে আমাকে আর কোনো দুর্ব্যবহার করতে হয়নি। তারপর আমাকে আর চাঁদের মুখদর্শন করতেও হয়নি।

চাঁদের কুকীর্তির কথা কেবল যে গ্রেগের মুখ থেকে শুনলাম তা নয়, দিনু ছেলেটিও বলল, এবং সারেং ও লশকররা একবাক্যে তা সমর্থন করল। নিজেই আশকারা দিয়ে একটা অপদার্থ কুলাঙ্গার তৈরি করেছি চাঁদকে, ভেবে লজ্জিত হলাম। ঘটনাচক্রে যে তার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছি, এবং তাকে ইংলন্ডে নিয়ে গিয়ে বিপদে পড়িনি, নেহাত ভাগ্যের জোরে। মন্নু নামে আমার আর—একটি তেরো বছরের বালক—ভৃত্য ছিল, চার বছর ধরে আমার কাছে কাজ করছে, চাঁদের বদলে তাকেই ইংলন্ডে নিয়ে যাব ঠিক করলাম। মন্নু কোনো কাজকর্ম বিশেষ করত না, নানা রকমের ভঙ্গিমা করে খেলা দেখিয়ে লোকজনকে হাসানোই ছিল তার কাজ। আর খাবার টেবিলে আমার চেয়ারের পিছনে সে দাঁড়িয়ে থাকত। অল্প বয়স বলে তার মা কিছুতেই তাকে আমার সঙ্গে যেতে দিতে রাজি হয়নি। শেষে নগদ পাঁচশো টাকা দিয়ে তাকে রাজি করাতে হয়।

ম হী শূ রে র রা জ কু মা র

ইংলন্ড যাত্রার দিন যত এগিয়ে আসতে লাগল, আমার ইয়োরোপীয় ও ভারতীয় বন্ধুরা তত যেন পরস্পর পাল্লা দিয়ে আমার প্রতি বন্ধুত্ব দেখাতে উৎসুক হলেন। সকলের কাছ থেকে বিচিত্র সব উপহার আসতে আরম্ভ হল। পাটনা থেকে উইন্টন পাঠালেন একটি আরামকেদারা, মিসেস ল্যাপ্রিমোদে পাঠালেন সুন্দর একটি কার্পেট। তরুণ বন্ধু টমাস দিলেন একটি সুন্দর সোনার পেনসিল—কেস। যখন ডেপুটি—শেরিফ ছিলাম এবং শেরিফের সব কাজকর্ম করতাম তখন কারাবন্দি টিপু সুলতানের পুত্র ময়জুদ্দিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়েছিল। তিনি প্রায়ই আমাকে ডেকে পাঠিয়ে তাঁর অভাব—অভিযোগ নিবেদন করতেন। তাঁর শোচনীয় অবস্থা দেখে আমার খুবই কষ্ট হত, কিন্তু কিছুই করবার ছিল না, মধ্যে মধ্যে কেবল কথার সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া। আমার ইংলন্ড প্রত্যাবর্তনের সংবাদ পেয়ে তিনি অত্যন্ত বিচলিত হলেন। আমি যখন তাঁর সঙ্গে কারাগারে দেখা করতে গেলাম তখন তিনি পাগলের মতন হাত—পা ছুড়ে বলতে লাগলেন, ‘আপনি চলে গেলে এ দেশে বন্ধু বলে আমার আর কেউ থাকবে না। কে—ই বা তখন আমার কাছে আসবে, আমার দুটো দুঃখের কথা শুনবে এবং মানুষের মতন ব্যবহার করবে। আমি আর তাহলে বাঁচব না।’ দ্বিতীয় দিন যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম তখন তিনি উদভ্রান্তের মতন আমার পা দু’টি জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন, এবং মিনতি করে বললেন, ‘হিকি সাহেব, আপনার সঙ্গে আমাকেও দয়া করে ইংলন্ডে নিয়ে চলুন। এ দেশে আমার আর কেউ নেই, কিছু নেই, এখানে আমি কিছুতেই বেঁচে থাকতে পারব না।’ টিপু সুলতানের পুত্রের মুখ থেকে এই কথা শুনলে নিতান্ত নিষ্ঠুর লোকের মনেও করুণার উদ্রেক হবে। আমি তাঁকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। বললাম, ‘আপনাকে সঙ্গে করে ইংলন্ড নিয়ে যেতে পারলে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব। কিন্তু আমার ইচ্ছায় তো আপনি যেতে পারবেন না। কোম্পানির কর্তারা অথবা এখানকার গবর্নমেন্ট আপনাকে বাইরে কোথাও যাবার অনুমতি দেবেন না।’

কথাটা শুনে রাজকুমার ময়জুদ্দিন লোহার গরাদের ভিতর দাঁড়িয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘কেন? কেন অনুমতি দেবেন না? আমাদের উপর এত অত্যাচার করেও কি ইংরেজদের প্রতিহিংসাবৃত্তি চরিতার্থ হয়নি? আমার পিতাকে তাঁরা হত্যা করেছেন, আমাদের সমস্ত রাজ্য কেড়ে নিয়েছেন, পরিবারের সকলকে নানা জায়গায় জেলখানায় বন্দি করে রেখেছেন, তাতেও কি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাগ যায়নি? আমাকেও কি তাঁরা জেলখানায় বন্দি করে দগ্ধে দগ্ধে মেরে ফেলতে চান? সকলে বলাবলি করছিল যে নতুন গবর্নর—জেনারেল লর্ড মিন্টো নাকি মানুষ হিসেবে উদারচরিত্র, তাই ভেবেছিলাম, তিনি আমার একটা কিছু ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু গতিক দেখে মনে হচ্ছে তা দুরাশামাত্র। আপনি আমার কথা তাঁর কাছে গিয়ে বলুন, আমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করুন। আমার কোনো দাবি নেই, দৈনিক এক মুঠো ভাত আর একটু জল পেলেই চলবে। বিলেতে গিয়ে আমি আপনার গোলাম হয়ে থাকব, যা হুকুম করবেন তা—ই করব, আমাকে এ দেশের এই কারাগার থেকে মুক্ত করে দিন, দোহাই আপনার।’

কথাগুলো এমন উন্মত্তের মতন প্রাণপণে চেঁচিয়ে তিনি বলতে লাগলেন, যে আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। জেলার গর্ডন সাহেবকে ডেকে বললাম তাঁকে সামলাবার জন্য। পরে তাঁকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে এই বলে বিদায় নিলাম যে, তাঁর জন্য যথাসাধ্য কিছু করার আমি চেষ্টা করব। তারপর আর কোনোদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাইনি, গিয়ে কোনো লাভ নেই বলে।

কলকাতার কারাগারেই টিপু সুলতানের এই পুত্রের মৃত্যু হয় পরে। সংবাদপত্রে তার বিবরণ পড়েছি।

শি ল্পী চি না রি

প্রসঙ্গত একজন শিল্পী বন্ধুর কথা এখানে বলতে হচ্ছে। তাঁর নাম জর্জ চিনারি (George Chinnery)। আমার বিলাতযাত্রার কয়েক মাস আগে চিনারি মাদ্রাজ থেকে বাংলা দেশে আসেন। তাঁকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা হয়। সুপ্রিমকোর্টের চিফ জাস্টিস সার হেনরি রাসেলের একটি প্রতিকৃতি আঁকার জন্য কলকাতার স্বনামধন্য ব্যক্তিরা তাঁকে নিয়ে আসেন। ফারসি ভাষায় রাসেলকে একটি আবেদনপত্র মারফত অনুরোধ করা হয় প্রতিকৃতির জন্য শিল্পীর কাছে ‘সিটিং’ দিতে। রাসেল তাতে সম্মত হন। কথা হয় যে, তাঁর এই পোর্ট্রেটটি টাউন হলে টাঙিয়ে রাখা হবে। কলকাতার টাউন হল নির্মাণের কাজ তখন পুরোদমে চলছে। চিনারি এই প্রতিকৃতি অঙ্কনে যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেন। যতদিন তাঁর ক্যানভাসের একটি টুকরোও থাকবে ততদিন তাঁর প্রতিভার ছাপও থাকবে তার উপর।

চিনারি একজন অসাধারণ প্রতিভাবান শিল্পী ছিলেন। কিন্তু তার পাগলামি ও খামখেয়ালির অন্ত ছিল না। মনে হয়, মানসিক দৌর্বল্য তাঁর একটা ব্যাধির মতন ছিল, স্বাস্থ্যও মোটেই ভাল ছিল না। অথচ অহমিকাবোধও তাঁর অত্যন্ত প্রবল ছিল। রাসেলের ছবি আঁকার জন্য তাঁকে ডেকে আনা হয়েছে বলে চিফ জাস্টিস নিজের মাননীয় অতিথি হিসেবেই তাঁকে স্বগৃহে আশ্রয় দিয়েছিলেন। দু’টি বড় বড় ঘরের একটি অ্যাপার্টমেন্ট তাঁর জন্য আলাদা বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। রাসেল তাঁকে নিজ পরিবারের লোকের মতনই আপনার মনে করতেন এবং ডিনার—টেবিলে একসঙ্গে বসে খেতেন।

কী কারণে জানি না, আমার প্রতি চিনারি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। বোধহয় আমার শিল্পরুচিবোধ সম্বন্ধে তাঁর আস্থা ছিল। রাসেলের পোর্ট্রেট আঁকার সময় তিনি পর্বে পর্বে আমার মতামত জানতে চেয়েছেন, ছবির ‘কম্পোজিশন’ দেখিয়ে সমালোচনা করতে বলেছেন, এবং প্রয়োজন হলে একাধিকবার পেনসিল স্কেচ করে আবার তা সংশোধন করেছেন। শেষ পর্যন্ত যে স্কেচটি আমার পছন্দ হয়েছে সেইটিকে তিনি তুলে দিয়ে রূপায়িত করেছেন ক্যানভাসের উপর। সাধারণত কোর্টরুমে বসেই তিনি প্রত্যহ ছবিটি আঁকতেন, আমিও তাঁর সঙ্গে দু’তিন ঘণ্টা করে থেকে ছবি আঁকা দেখতাম। কিছুটা উৎকেন্দ্রিক হলেও, তাঁর মতন একজন প্রতিভাবান শিল্পীর সাহচর্য পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করতাম। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি ছবি আঁকার কাজ করতেন। মধ্যে মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য আঁকতে একটু বেশি সময় লেগেছে। প্রায় তিন মাসে ছবি আঁকা শেষ হয়েছে। ক্যানভাসের উপর শেষ আঁচড় দেবার পর রাসেলের মূর্তিচিত্রের দিকে চেয়ে সত্যিই আমার খুব আনন্দ হল। আশ্চর্য তাঁর ক্ষমতা। আমি খুশি হয়েছি জেনে চিনারিও খুব আনন্দিত হলেন।

দু’জনের বন্ধুত্ব বেশ গভীর হল। ছবি আঁকা শেষ হবার পর একদিন তিনি বললেন যে, তাঁর জন্য আমাকে একটি কাজ করতে হবে। কী কাজ না জেনেই আমি বললাম, নিশ্চয় করব, খুশি হয়ে করব। পরে শুনলাম, কাজ আর কিছুই না, তাঁর ইচ্ছা হয়েছে আমার একটি ছবি আঁকবেন, তার জন্য তাঁর কাছে বসতে হবে। নিজের ছবি আঁকানোর জন্য এই ধরনের বসাবসিতে আমি কখনোই রাজি হতাম না, যদি অনুরোধটা চিনারির মতন কেউ না করতেন। আমি রাজি হলাম, আমার ছবিও আঁকা হল। কলকাতার কোর্ট—হাউসে সার হেনরি রাসেলের ডাইনিং রুমের একটি কোণে এই ছবিটি টাঙানো আছে।

ইং ল ন্ড যা ত্রা

কলকাতা থেকে বিদায় নেবার দিন এগিয়ে এল। যে স্লুপটি পাঁচশো টাকা দিয়ে ভাড়া করেছিলাম জাহাজে মালপত্র পৌঁছে দেবার জন্য, কলকাতা থেকে যাবার জন্য সেইটাই আবার ঠিক করলাম। ৯ ফেব্রুয়ারি (১৮০৮) কলকাতা থেকে যাত্রা করার দিন স্থির হল। হাতে মাত্র কয়েকটা দিন, টুকিটাকি কাজকর্ম অনেক বাকি। সবচেয়ে ঝঞ্ঝাটের কাজ হল এখানকার আসবাবপত্তর নিলেমে বিক্রির ব্যবস্থা করা। মেসার্স টুলো, ড্রিং অ্যান্ড কোম্পানি নামে বিখ্যাত অকশনিয়ারকে নিলামের ভাগ দেওয়া হল। নিলামের এক মাস পরে টাকা দেওয়ার প্রচলিত নিয়ম থেকে তাঁরা আমাকে অব্যাহতি দিলেন। বিক্রির পর আমি মোট ১৮,৩৫০ সিক্কা টাকা পেলাম, যা আশা করেছিলাম তা থেকে প্রায় দশ হাজার টাকা কম। তার কারণ জিনিসগুলি জলের দরে বিক্রি হয়ে গেল নিলামে। একজোড়া বিরাট আকারের আয়না, পাঁচ—ছ’হাজার টাকায় কেনা, বিক্রি হল মাত্র আটশো টাকায়। প্রায় দশ হাজার টাকা দামের কতকগুলি ভাল ভাল ছবি মাত্র বারশো টাকায় বিক্রি হল। অন্যান্য জিনিসের তো কথাই নেই। কেবল প্লেট বিক্রি হয়েছিল মোটামুটি ন্যায্য দামে, বাকি সব জলের দরে বিক্রি হয়ে গেল।

৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি, দু’দিন আমার পুরাতন বিশ্বাসী ভৃত্যদের টাকাপয়সা মিটিয়ে দিলাম। তাদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করে চলে যেতে হবে এ কথা ভেবে মনটা বিষণ্ণ হয়ে ছিল। এতদিন তারা যে অকাতরে আমাকে সেবা করেছে, শুধু টাকা দিয়ে তার প্রতিদান দেওয়া যায় না। তবু টাকা ছাড়া কী—ই বা আমি দিতে পারি। সাধ্যমতন যা পারলাম তাদের টাকাপয়সা দিয়ে বিদায় নিলাম। সর্বসাকুল্যে আমার তহবিলে টাকা ছিল তখন এক লক্ষ উনপঞ্চাশ হাজার একশো সাতাশি টাকা, তা থেকে এখানে সব দিতে—থুতে প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ খরচ হয়ে যাবে। পুরনো একটি অ্যানুইটি নতুন করে চালু করতে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা দিতে হল। মোট পুঁজি থেকে বাকি যা খরচ হল তার হিসেব করলে এই দাঁড়ায়—

মোট পুঁজি – ১৪৯,১৮৭ টাকা

তা থেকে খরচ হল :

অ্যানুইটির জন্য – ৫০০০ টাকা
কেবিন ও জাহাজের ভাড়া – ৮০০০ টাকা
মদিরাদি সুরা বাবদ – ১২৩৫ টাকা
ফার্নিচার, কাপড়চোপড় ইত্যাদি – ২০,৮০০ টাকা
কেরানি রামধন ঘোষকে উপহার ও গৌরচরণ দে-র কাছে তাঁর ঋণ বাবদ – ১৮০০ টাকা
ভৃত্যদের (৬৩) তিন মাসের বেতন – ২০০০ টাকা

ভৃত্যদের বিবরণ:

১ খানসামা ১ দর্জি ১ বাটলার ২ দারোয়ান ৮ খিদমতগার

২ ধোপা ২ হেয়ারড্রেসার ১ টিনার ২ আবদর ২ মেথর

১ কম্প্রাডোর ১ ডুবিয়া ২ বেইকার ৪ সহিস ২ রাঁধুনি

৩ ঘাসকাটা ৯ বেয়ারা ১ কোচম্যান ৫ হরকরা ২ ভিস্তি

৩ মশালচি ৪ মালি ৫ চাকর (গোলাপ ও টি পি দাসীর জন্য)

= মোট ৬৩ জন

জর্জ টাইলার বাবদ – ৬২৩০ টাকা
গোলাপ দাসীর জমি ও বাড়ি বাবদ – ৩৫৪২ টাকা
টি পি দাসীর জমি ও বাড়ি বাবদ – ১৫০০ টাকা
মন্নুর মা-কে মন্নুর জন্য – ৫০০ টাকা
স্লুপ ভাড়া – ৫০০ টাকা
ইংলন্ডের উপর বিলের জন্য – ৪৮০০ টাকা
সেন্ট হেলেনার খরচের জন্য – ২০০০

বাকি রইল মোট ৯২,০০০ টাকা

এই বিরানব্বই হাজার টাকা সম্বল নিয়ে ইংলন্ড যেতে হবে, অর্থাৎ এই টাকার আয় থেকে সেখানে চালাতে হবে। শতকরা আট টাকা হারে সুদে কলকাতায় কোম্পানির ট্রেজারিতে টাকাটা জমা দিয়ে ছ’মাস অন্তর লন্ডনে আমার নামে সুদটা পাঠিয়ে দেবার নির্দেশ দিলাম। এই হারে বাৎসরিক সুদ হয় প্রায় ৯২০ পাউন্ড, বারো তেরো হাজার টাকার মতন। তাতেই আমার জীবনের বাকি দিনগুলো কোনোরকমে চলে যাবে ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। তা ছাড়া ইংলন্ডে পৌঁছে আগে ‘বিল’ কিনে জমানো প্রায় ১৭০০ পাউন্ড পাবার কথা। তাতেও অনেক খরচ কুলিয়ে যাবে।

৯ ফেব্রুয়ারি (১৮০৮) সার হেনরি রাসেলের সঙ্গে শেষ ডিনার খেলাম। আজকেই যাত্রা করার কথা ছিল, কিন্তু কোনো বিশেষ জরুরি কারণে ১২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সকালের আগে জাহাজ ছাড়বে না বলে খবর পেলাম। ভালই হল, আরও দিন দুই সময় পাওয়া গেল, দেখাসাক্ষাতের কাজ কিছু সেরে নেওয়া যাবে। ১০ ফেব্রুয়ারি মাস্টার—অ্যাটেন্ডেন্ট ক্যাপ্টেন থর্নহিলের বাড়ি আমার ‘ক্যাসল ইডেন’ জাহাজের ক্যাপ্টেন কলনেটের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল এবং আমরা একসঙ্গে অনেকে মিলে ডিনার খেলাম। কলনেট বললেন যে, গবর্নমেন্টের অর্ডার অনুযায়ী এবার থেকে সমস্ত জাহাজের কমান্ডারদের চব্বিশ ঘণ্টা আগে কলকাতার ব্যাঙ্কশাল ছেড়ে চলে যেতে হবে। সেজন্য তিনি একটি ছোট বোট ভাড়া করেছেন, তাতে করে কাল সকালেই কলকাতা ছেড়ে চলে যাবেন এবং ফলতায় গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। ফলতায় আমি পৌঁছলে একসঙ্গে সাগরদ্বীপ যাওয়া হবে। ১০ তারিখ দুপুরবেলা স্লুপে করে আমি খানসামা, রাঁধুনি ও ভৃত্যদের জিনিসপত্র দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। তাদের বলে দিলাম ফলতায় পৌঁছে আমি না—যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে।

১১ ফেব্রুয়ারি দুপুরবেলা বন্ধু লেডলি ভাল করে টিফিন খাওয়ালেন। কিন্তু আসন্ন বিদায়ের কথা ভেবে সমস্ত মনটা এমন একটা অব্যক্ত বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে ছিল যে, একটি খাবারও গলা দিয়ে নামল না। কেবল দু’তিন গ্লাস ক্ল্যারেট পান করলাম। লেডলির গাড়ি দরজাতেই মোতায়েন ছিল, বিদায়কালীন কোনো ভণিতা না করে সোজা গিয়ে গাড়িতে উঠে ঘোড়ার লাগাম ধরে, আট মাইল দূরে লেডলির বাগানবাড়ির দিকে রওনা হলাম। সেখানে আমার সেই নখের পুরনো পানসিটি ঘাটে বাঁধা ছিল। যদিও পানসিটি বিক্রি করে দিয়েছিলাম, তাহলেও আমার বিদায়যাত্রার জন্য মালিক সেটি পাঠাতে কুণ্ঠিত হননি। পানসিতে আমার ইংলন্ডের সঙ্গী বালক—ভৃত্য—মন্নু, সর্দারবেয়ারা ও আরও তিনজন ভৃত্য অপেক্ষা করছিল। তাদের নিয়ে গার্ডেনরিচের ঘাট থেকে পানসি ছেড়ে দিলাম।

দীর্ঘকাল বাংলা দেশে থাকার পর আজ তার কোল ছেড়ে যেতে বাস্তবিকই কষ্ট হচ্ছিল।

লেডলির বাগানবাড়ি থেকে ফলতা মাইল পঁচিশ দূর, ভেবেছিলাম সন্ধ্যার আগে পৌঁছে যাব। কিন্তু হঠাৎ এমন একটা হাওয়া বইতে আরম্ভ হল, যে ফলতা পৌঁছতে রাত প্রায় আটটা বেজে গেল। ফলতায় পৌঁছে ঘাটের কাছাকাছি কোথাও আমরা ক্যাপ্টেনের বোট দেখতে পেলাম না। আমার ভৃত্যদের নৌকাও দেখা গেল না। হরকরা পাঠিয়ে গ্যামেজ অ্যান্ড সন্ডার্সের ট্যাভার্ন থেকে খোঁজ নিয়ে জানলাম যে, ক্যাপ্টেন বিকেলে ঘাটে বোট বেঁধে তাদের ওখান থেকে কিছু খাবারদাবার নিয়ে চলে গেছেন। শুনে তো আমার চক্ষু কপালে উঠল। কী হল, কেন চলে গেলেন, কিছুই ঠাহর করতে পারলাম না। পানসিতে করে সাগরদ্বীপ যাওয়া বিপজ্জনক ভেবে হতাশ হলাম, ভাবলাম কলকাতায় ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। দাঁড়ি—মাঝিদের সেই কথা জানিয়ে প্রস্তুত হতে বললাম। খবরটা শুনে ভৃত্যরা খুব খুশি হল, তারা ভাবল, সাহেবের আর বিলেত যাওয়া হবে না।

মাঝিরা পাল—টাল ঠিক করছে, এমন সময় একজন দাঁড়ি দূরে আঙুল দেখিয়ে বললে, ‘ওই বোধহয় ক্যাপ্টেনের বোটের ডবল—মাস্তুল দেখা যাচ্ছে।’ তাড়াতাড়ি সেইদিকে নৌকা চালাতে বললাম। কাছে গিয়ে দেখলাম দাঁড়ির কথাই ঠিক। ক্যাপ্টেন কলনেট গম্ভীর হয়ে বোটের ডেকের উপর আমার প্রতীক্ষায় বসে আছেন। পানসি ও তার মাঝিমাল্লাদের বিদায় দিয়ে আমরা স্লুপে গিয়ে উঠলাম। কিছুক্ষণ পরে খানসামা এসে খবর দিল খানা তৈরি। খেতে বসলাম, কিন্তু একটি দানাও পেটে গেল না। মনের অবস্থা খুব খারাপ, ক্রমেই যেন বেশি ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। আমার প্রিয় লাল শরাব পান করে একটু চাঙ্গা হবার চেষ্টা করলাম। রাত এগারোটার সময় ক্যাপ্টেন বললেন, এবারে ঘুমিয়ে পড়া যাক। বিছানায় পাঁচ মিনিট না শুতে শুতেই বিকট শব্দ শুনে চমকে উঠলাম। কেবিনের ভিতর থেকে একটা গোঁ—গোঁ আওয়াজ হচ্ছে। কান পেতে শুনে বুঝলাম, ক্যাপ্টেন গম্ভীর নিদ্রায় মগ্ন, তাঁর নাক ডাকছে। আমার নাক ডাকা তো দূরের কথা, চোখের পাতা পর্যন্ত বুজল না। বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে লাগলাম। ভোর হতেই ডেকের উপর গিয়ে দেখি, মাঝিরা বোট ছাড়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। পূর্বাকাশে সুন্দর সূর্য উঠেছে, চারদিকে জলের উপর, দূরে সবুজ মাঠের উপর আলো ঝলমল করছে। মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। ইচ্ছা হল মাঝিদের বলি, চলো আবার কলকাতায় ফিরে যাই। কথাটা যেন বলতে গিয়েও বলা হল না। মনের যে অবস্থা হয়েছিল, তাতে ক্যাপ্টেন সঙ্গে না থাকলে সত্যিই হয়তো কলকাতায় ফিরে যেতাম।

যথাসময়ে সাগরদ্বীপে জাহাজের কাছে এসে পৌঁছলাম। মন্নুকে সঙ্গে নিয়ে আমার কেবিনে ঢুকলাম। দাঁড়ি—মাঝি ও ভৃত্যদের নিয়ে স্লুপটি কলকাতায় ফিরে যাবে। ভৃত্যরা বিদায় নিতে এল। প্রত্যেকের চোখে জল, কয়েকজন ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আমি নিজেও যে তাদের সামনে এরকম অসহায় দুর্বলের মতন কেঁদে ফেলব, ভাবতে পারিনি। তাদের স্লুপ ছেড়ে দিল। আমার কেবিনে বসে রইল, কালাপানি পাড়ি দেবার অপেক্ষায়।

বালক মন্নুর গাল বেয়ে টসটস করে চোখের জল পড়তে লাগল। কেবিনের জানালা খুলে একদৃষ্টে সে চেয়ে রইল ভৃত্যদের সেই নৌকার দিকে, যত দূর দেখা যায়। নৌকা মিলিয়ে গেল দূরে, মনে হল যেন গার্ডেনরিচে—আরও একটু দূরে বাংলা দেশের কলকাতায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *