৩. শিল্পীশহর কলকাতা

শিল্পীশহর কলকাতা

বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরীদের জমিদারির অন্তর্গত একটি নগণ্য গ্রাম ছিল ‘ডিহি কলিকাতা’। উত্তর—দক্ষিণ—পুবে আরও কয়েকটি গ্রাম নিয়ে ছিল ‘পরগনা কলিকাতা’। উত্তরাংশের কয়েকটি গ্রাম ছিল নদিয়ায় (কৃষ্ণনগর) রাজাদের অধীনে। দক্ষিণে বেহালা—বড়িশা পর্যন্ত ছিল সাবর্ণ চৌধুরীদের জমিদারির মধ্যে। সাধারণ বাংলার গ্রামের মতন ছিল ‘ডিহি কলিকাতা’। রাজস্বাদি আদায়ের কেন্দ্রীয় গ্রাম বলে ‘ডিহি’ বলা হত। তার সীমানাও ছিল তখন খুব সংকীর্ণ। উত্তরে বর্তমান মহাত্মা গান্ধী রোড, দক্ষিণে ধর্মতলা স্ট্রিট, গঙ্গার তীর পর্যন্ত—এই ছিল তার আনুমানিক সীমানা। এই সীমানা ক্রমে উত্তর—দক্ষিণ—পুবে বিস্তৃত হয়ে বিশাল মহানগরের রূপ ধারণ করেছে, মাত্র দু’শো বছরে। ‘ডিহি কলিকাতা’ হয়েছে মহানগরী।

কলকাতা শহরের বয়স দু’শো বছরের বেশি বলা সমীচীন নয়। এ কথা ঠিক যে ১৬৯০ সালে জোব চার্নক যদি সুতানুটিতে তৃতীয়বার ‘হল্ট’ করে বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের সিদ্ধান্ত না করতেন, যদি নবাবের অনুমতি নিয়ে তার সঙ্গে দুর্গ প্রতিষ্ঠা না করা হত, তাহলে গ্রাম থেকে ধীরে ধীরে কলকাতা ইংরেজদের রাজধানী ও প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হত না, এবং তা না হলে বর্তমান মহানগরের আকার ও মর্যাদা লাভ করাও তার পক্ষে সম্ভব হত না। সেইজন্যই ঐতিহাসিকরা ১৬৯০ সালটিকে শহরের প্রতিষ্ঠা—বৎসর বলেন। কিন্তু জোব চার্নক কলকাতার প্রথম বিদেশি বণিক নন, তাঁর স্বজাতি ইংরেজরাও নন। বাণিজ্যস্থান হিসেবে সুতানুটি—কলকাতা নির্বাচনের কৃতিত্বও সবটুকু তাঁদের প্রাপ্য নয়। তার অনেক আগে, সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই মনে হয়, ভাগীরথীর পশ্চিম তীরের হুগলি, সপ্তগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বাঙালি শেঠ—বসাক তন্তুবণিক ও অন্যান্য বণিকরা, পূর্ব তীরস্থ সুতানুটি অঞ্চলে এসে বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে তোলেন। বিদেশি বণিকদের মধ্যেও, ইংরেজদের অনেক আগে আর্মেনিয়ানরা আসেন। এতদিন আমরা জানতাম, সেন্ট জন গির্জার সীমানার মধ্যে চার্নকের সমাধিমন্দিরটিই কলকাতার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন সমাধি। কয়েক বছর আগে, কলকাতার আর্মেনিয়ান নাজারেথ গির্জার প্রাঙ্গণে, রেজাবিবে নামে জনৈকা আর্মেনিয়ান মহিলার একটি সমাধি আবিষ্কৃত হয়েছে। সমাধির গায়ে যে লিপিটি আছে, তার আর্মেনিয়ান সন ১৫, ইংরেজি সন হবে ১৬৩০ (১৬১৫ + ১৫)। রেজাবিবে ছিলেন দানবীর সুকিয়ার পত্নী। আর্মেনিয়ান সুকিয়াদের নামেই কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিট। চার্নকের আগমনের অর্ধশতাব্দীরও আগে আর্মেনিয়ান বণিকরা যে কলকাতা অঞ্চলে বাণিজ্যের জন্য বসতি স্থাপন করেছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ দেশি ও বিদেশি বণিকদের বাণিজ্যকেন্দ্র হাট—বাজার—বন্দর থেকে সুতানুটি—কলকাতা ইংরেজ বণিকদের প্রধান বাণিজ্যস্থান ও রাজধানী হয়ে মহানগরে পরিণত হয়েছে। এই হিসেবে, কলকাতার নাগরিক রূপায়ণের কাল আরও একশো—দেড়শো বছর বিস্তৃত করে, তিনশো থেকে সাড়ে—তিনশো বছর হয়।

কিন্তু ১৭৫৬ সালেও নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করেছিলেন এবং কলকাতার নাম দিয়েছিলেন ‘আলিনগর’। তার এক বছর পরে, ১৭৫৭ সালে, পলাশির রণাঙ্গনে জয়ী হয়ে ইংরেজরা এ দেশের রাজসিংহাসন দখল করেন। পলাশির যুদ্ধের পর বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডরূপে দেখা দেয়। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত ঠিক দু’শো তিরিশ বছরই হল কলকাতার প্রকৃত ইতিহাস।

অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই ইংরেজ ও ইয়োরোপীয় বণিকরা অনেকে বাংলাদেশের কলকাতা শহরে আসতে আরম্ভ করেন। সামান্য বেতনের রাইটার ও কর্মচারী হয়ে এসে, ইন্টারলোপিং ও অন্যান্য উপায়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে, ‘নবাবের’ মতন তাঁরা স্বদেশে ফিরে যেতেন। ইংলন্ডেও তাঁরা ‘নবাব’ বলে পরিচিত ছিলেন। প্রথম যুগের এই ইংরেজ নবাবরা এ দেশি বাঙালি নবাব ও রাজা—মহারাজাদের বিলাসী জীবনযাত্রা অনুকরণ করে চলতেন। বাড়িতে তাঁদের চার—পাঁচ ডজন করে চাকরবাকর থাকত। হুঁকো—গড়গড়ায় তাঁরা তামাক খেতেন, ঘোড়ায় চড়ে বা ফিটন—বগি—পালকি গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াতেন, এ দেশি তুকতাকে বিশ্বাস করতেন, দেবালয়ে পূজা দিতেন, উৎসব—পার্বণে ভোজসভায় বাইজিনাচ দেখতে যেতেন, কৃষ্ণাঙ্গিনীদের নিয়ে সুসজ্জিত বজরায় করে নৌকাবিহার করতেও আদৌ কুণ্ঠিত হতেন না। উৎসবের সময় বাজি পোড়ানো হত, নানা রকমের তামাশা দেখানো হত, যেমন ঘোড়ার খেলা, বেলুন ওড়ানো ইত্যাদি। মধ্যে মধ্যে বড় বড় সাহেবরা সামান্য কারণে ডুয়েল লড়তেন এবং তাতে প্রাণও দিতেন। সামান্য চুরির অপরাধে তখন কলকাতার প্রকাশ্য রাস্তায় ঢেঁড়া পিটিয়ে লোক জড়ো করে অপরাধীকে ফাঁসি দেওয়া হত। এই ছিল ন্যায়বিচার। এ দেশে তান্ত্রিক দেবদেবীর স্থানে নরবলি দেবার প্রথা তখনও লুপ্ত হয়নি। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীদের, অনেক সময়, ইংরেজরা দেবস্থানে নিয়ে গিয়ে নরবলিও দিতেন। একসঙ্গে দুই কাজই হত, পূজা দেওয়া হত, দণ্ডও দেওয়া হত।

ইংরেজরা যখন এ দেশে এইরকম অর্ধবর্বর জীবনযাপন করতেন, তখন জ্ঞানবিদ্যা বা শিল্পকলাচর্চার দিকে তাঁদের কোনো নজর ছিল না। এইসব ইংরেজ রাইটার—ফ্যাক্টর, বণিক—সৈনিকদের মধ্যে জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি কেউ এ দেশে আসতেনও না। বাজিকর ও সার্কাসওয়ালা ইংরেজরা আসতেন, পয়সা রোজগার করবার জন্য। শৌখিন কারিগরদের মধ্যে ‘হেয়ারড্রেসারদের’ মতন কেউ কেউ আসতেন এবং তাঁরা কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে এ দেশি লোকদেরও ‘হেয়ারড্রেসিং’ শিক্ষা দিতেন। কাপড় ধোলাই করার জন্য ইংরেজ রজকরাও আসতেন। আর আসতেন কফি হাউস ও ট্যাভার্ন—কিপাররা।

অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরেজ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের ও স্তরের প্রতিনিধিরা সকলেই কলকাতায় আসেন একে—একে। প্রথমে সমাজের তলার দিকের প্রতিনিধিরাই আসেন, উপরের মনীষী, জ্ঞানীগুণী, বিদ্যোৎসাহী ও কলানুরাগীরা আসেন অনেক পরে। পলাশির যুদ্ধের পর, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে তাঁরা আসতে আরম্ভ করেন। ইংলন্ডের ও ইয়োরোপের অন্যান্য স্থানের বিদ্যোৎসাহী শিল্পীরাও দুই—একজন করে আসেন কলকাতা শহরে। তাঁদের আগমনের পর, কলকাতা শহর ধীরে ধীরে আধুনিক সংস্কৃতিকেন্দ্রে পরিণত হয়। পাশ্চাত্য ভাবধারার আমদানিও এই সময় থেকে হতে থাকে। ইয়োরোপীয় পণ্ডিতরা আসেন, শিক্ষাবিদরা আসেন এবং তাঁদের সঙ্গে দু’চারজন করে চিত্রশিল্পী ও খোদাই—শিল্পীরাও আসেন। জ্ঞানবিদ্যার তীর্থ কলকাতা এইসব শিল্পীদের আনাগোনায় শিল্পীতীর্থে পরিণত হয়।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত যেসব চিত্রশিল্পী কলকাতা শহরে আসেন, তাঁদের কোনো ধারাবাহিক ইতিবৃত্ত কেউ রচনা করেননি। জরাজীর্ণ—প্রাচীন পত্রিকার পৃষ্ঠার মধ্যেই তাঁদের সেই ইতিবৃত্ত সমাধিস্থ হয়ে আছে। তাকে পুনরুদ্ধার করে কাহিনির ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রেখে, কলকাতার শিল্পীকথা রচনা করা খুবই কঠিন। তবু আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করব সেই প্রায়লুপ্ত ইতিবৃত্ত পুনরুদ্ধার করতে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে, ইয়োরোপের যেসব চিত্রশিল্পী ও অন্যান্য শিল্পী কলকাতা শহরে এসেছিলেন, তাঁরা কী করেছিলেন, কী এঁকেছিলেন, কীভাবে এ দেশে তাঁদের চিত্রকলাপদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছিলেন, তার ভাব ও ভঙ্গিমা প্রচার করেছিলেন, প্রধানত তা—ই হল আমাদের আলোচ্য বিষয়। আলোচনা স্বভাবতই ইতিবৃত্তপ্রধান হবে। কিন্তু তা হলেও, এ দেশের শিল্পী ও শিল্পবণিকরা এই ইতিবৃত্তের ভিতর থেকে এ দেশি চিত্রকলার নতুন পরিবর্তনের ধারা সম্বন্ধে অনেক চিন্তনীয় উপাদানের সন্ধান পাবেন। পাশ্চাত্য চিত্রশিল্পীদের সংস্পর্শে এসে, পাশ্চাত্য চিত্রকলার ভাবধারা ও ভঙ্গিমার প্রভাবে, কীভাবে এ দেশে শিল্পীরা শিল্পকলার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন করে যাত্রা শুরু করেন, তারও সুস্পষ্ট আভাস এই কাহিনির ভিতর থেকে পাওয়া যাবে। সংস্কৃতিক্ষেত্রের আরও অন্যান্য বিষয়ের মতন, শিল্পকলারও আদানপ্রদানের প্রধান তীর্থ ছিল কলকাতা শহর। কাহিনিও তাই কলকাতাকেন্দ্রিক।

পঞ্চদশ—ষোড়শ শতাব্দীতে ইয়োরোপীয় ‘রিনেস্যান্সের’ প্রভাবে চিত্রকলারও নবজাগরণ হয়েছিল। সেই সময় বোত্তিচেল্লি (১৪৪৪—১৫১০), লেওনার্দো (১৪৫২—১৫১৯), মিকেলঞ্জেলো (১৪৭৫—১৫৬৪), গ্রনওয়াল্ড (১৪৭৫—১৫২৮), টিশিয়ান (১৪৭৭—১৫৭৬), র‍্যাফেল (১৪৮৩—১৫২০) প্রভৃতি প্রসিদ্ধ চিত্রশিল্পীদের আবির্ভাব হয়েছিল ইয়োরোপে। সপ্তদশ শতাব্দীতে রূবেনস (১৫৭৭—১৬৪০), রেমব্রান্ডট (১৬০৬—১৬৬৯), ভ্যান ডাইক (১৫৯৯—১৬৪১) প্রভৃতি নতুন কলাকীর্তির পরিচয় দেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে হগার্থ (১৬৯৭—১৭৬৪), রেনল্ডস (১৭২৩—১৭৯২), গেইনসব্যুরো (১৭২৭—১৭৮৮), গয়া (১৭৪৪—১৮২৬), ডেভিড (১৭৪৮—১৮২৫), ব্লেক (১৭৫৭—১৮২৭), টার্নার (১৭৭৫—১৮৫১), কনস্টেবল (১৭৭৭—১৮৩৭) প্রভৃতি শিল্পীরা চিত্রকলার উৎকর্ষসাধনে ব্রতী হন। কেবল চিত্রকরদের নামের তালিকা হলেও, এই নামের ভিতর থেকেই পাশ্চাত্য চিত্রকলার তদানীন্তন পরিবেশ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে কলকাতা শহরে যেসব শিল্পী আসতে আরম্ভ করেন, তাঁদের কাহিনি পড়বার আগে এই পরিবেশটির কথা মনে রাখা দরকার। চিত্রকলার দিক থেকে কেবল এইটুকু বলা যেতে পারে যে ‘পোর্ট্রেট’ বা প্রতিকৃতি ও ‘ল্যান্ডস্কেপ’ বা প্রাকৃতিক দৃশ্য চিত্রণে পাশ্চাত্য শিল্পীরা তখন বিশেষ উৎকৃষ্টতা অর্জন করেছেন। কলকাতা শহরে কেবল ইয়োরোপের চিত্রশিল্পীরা যে এসেছিলেন তা নয়, বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা চিত্রেরও আমদানি হয়েছিল। চিত্রশিল্পী ও চিত্র, দুয়ের আগমনে কলকাতা শহরের চিত্রকলার ইতিহাসে ধীরে ধীরে নবযুগের সূচনা হয়েছিল।

কলকাতা শহরে বিদেশি চিত্রশিল্পীদের আনাগোনার এই কাহিনির উপকরণের উৎস হল প্রাচীন পত্রিকার ‘নোটিশ’ বা বিজ্ঞপ্তি। শিল্পীরা আসতেন, এবং তখনকার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি ছেপে তাদের আগমনবার্তা শহরের ‘ভদ্রলোক’ ও ‘ভদ্রমহিলাদের’ কাছে ঘোষণা করতেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকের এরকম দু’একটি বিজ্ঞপ্তির নমুনা উদ্ধৃত করছি। ১৭৮৪ সালের ৪ মার্চের ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকায়, ‘To the Lovers of Arts in India’ শিরোনামে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞপ্তিটি এই—

Captain Francis Swain Ward, of the Madras Establishment, whose paintings and drawings of Gentoo Architecture etc. are well known, and esteemed in Europe and India, having been solicited by many of his well-wishers to publish his works, which are of too expensive a nature for him to effect without support, makes known by the channel of this paper, his intention of publishing by subscription twelve views of curious buildings, etc. all taken on the sport by himself. They are proposed to be on a large scale, and will be engraved by the first masters in England.

The price will be twentyfive pagodas, or one hundred rupees, for each set. Subscriptions will be received by Mr. J. M. Clary, or at the shop of Messrs. Williams and Rankin, in Calcutta.

ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিস সোয়েন ওয়ার্ড ‘জেন্টু’ বা হিন্দু স্থাপত্যের চিত্রাঙ্কনে দক্ষ শিল্পী এবং তাঁর দক্ষতার কথা ইয়োরোপ ও ভারতের গুণীমহলে সুবিদিত। তাঁর গুণগ্রাহীদের একান্ত ইচ্ছা যে তিনি একটি চিত্রসংকলন প্রকাশ করেন। কিন্তু এই ধরনের চিত্রসংকলন প্রকাশ করা অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার বলে, তিনি অগ্রিম সাবস্ক্রিপশন তুলে সংকলনটি প্রকাশ করতে চান। ইংলন্ডের মাস্টার—এনগ্রেভাররা তাঁর চিত্রগুলি করবেন বলে তিনি জানিয়েছেন এবং প্রতি সেটের একশো টাকা মূল্যও ঘোষণা করেছেন। মেসার্স উইলিয়ামস অ্যান্ড র‍্যানকিনের দোকানে অগ্রিম দক্ষিণা গ্রহণ করা হবে বলে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। ক্যাপ্টেন ওয়ার্ডের আঁকা অষ্টাদশ শতাব্দীর ‘ওল্ড হাউস’—এর একটি চিত্র উল্লেখযোগ্য। ১৭৯২ সালে এই পুরাতন আদালতগৃহটি ভেঙে ফেলা হয়।

১৭৮৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ‘ক্যালকাটা গেজেট’—এ জনৈক মিস্টার কুয়েইরস এই মর্মে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন—

Mr. Queiros having purchased a large and valuable collection of pictures, amongst which are undoubted originals, by the most able masters, proposes to dispose of them by Raffle, and begs leave to submit the following scheme to his friends and the public—

সাহেব কতকগুলি ছবি কিনেছেন, তার মধ্যে ইয়োরোপীয় মাস্টার শিল্পীদের ‘অরিজিন্যাল’ ছবিও অনেক আছে। ছবিগুলি বিক্রি করার কৌশলটিও তাঁর অভিনব। লটারি করে তিনি বিক্রি করতে চান। যে স্কিমটি তিনি উক্ত গেজেটে প্রকাশ করেন, তাতে দেখা যায় শেয়ারপ্রতি ২০০ সিক্কা টাকা করে, ৭৫টি শেয়ার বিক্রি করে তিনি ১৫,০০০ টাকা সংগ্রহ করতে চান। ইয়োরোপীয় চিত্রশিল্পীদের ছবি কীভাবে কলকাতা শহরে আসত ও বিক্রি হত, এটি তার একটি দৃষ্টান্ত মাত্র।

এ ছাড়া পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বড় বড় সাহেবদের জিনিসপত্তর নিলামে বিক্রি হত। তার মধ্যে ছবিও থাকত যথেষ্ট। ওয়ারেন হেস্টিংসের নিজের জিনিসপত্তর বিক্রির একটি বিজ্ঞপ্তি, ১৭৮৫ সালের ৩ মার্চ তারিখের ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাতে দেখা যায় ‘Paintings and Prints’—ও আছে। বিজ্ঞপ্তিটি এই—

To be sold by Public Auction

by Mr. Bondfield

On Monday, the 7th of March, and the following days, until the whole is disposed of, at the Old Court House. The valuable effects of Warren Hastings, Esquire, consisting of Plate, Paintings and Prints; a large organ rich Sadlery, embroidered Howdah for an elephant: several rich fly Palanquins.

নগদ সিক্কা টাকা দিয়ে জিনিস কিনতে হবে বলে নিলামকার বন্ডফিল্ড বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন। হাতির জমকালো হাওদা, রূপসজ্জা, বড় অর্গ্যান, দামি প্লেট ফার্নিচার, বহু রকমের কারুকার্যশোভিত পালকি, ছবি ও প্রিন্ট ইত্যাদি নগদ মূল্য দিয়ে কলকাতা শহরে কারা কিনতেন? শীল লাহা মল্লিকরা কিনতেন, শোভাবাজারের নবকৃষ্ণ, পাথুরিয়াঘাটার সুখময় রায় প্রভৃতি বাঙালি রাজা—মহারাজারা কিনতেন, ঠাকুর পরিবারের কর্তারা কিনতেন এবং অক্রুর দত্ত, হিদারাম ব্যানার্জি, বারাণসী ঘোষ প্রভৃতি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকের প্রতিপত্তিশালী ধনিক বাঙালি বেনিয়ানরা কিনতেন। তাঁদেরই গৃহ থেকে বাইরের সমাজে এইসব জিনিসের শিল্পরূপের প্রভাব বিকীর্ণ হত।

ছবি বা ছবির বই বিক্রির বিজ্ঞপ্তি ছাড়াও, শিল্পীরা নিজেরা চিত্রাঙ্কন শিক্ষা দিতেন। আজকালকার মতন সংবাদপত্রের মারফত নাম জাহির করার বিচিত্র সব কলাকৌশল তখন জানা ছিল না। সুতরাং ছোটবড় সর্বস্তরের শিল্পী, যাঁরা কলকাতা শহরে আসতেন, তাঁদের পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বক্তব্য জানাতে হত। আগেই বলেছি, প্রাকৃতিক দৃশ্য ও প্রতিকৃতি চিত্রণ, এনগ্রেভিং ইত্যাদির বিশেষ বিকাশ হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে। ইয়োরোপীয় শিল্পী যাঁরা কলকাতায় আসতেন তাঁরা পোর্ট্রেট আঁকতেন খুব বেশি এবং সাধারণত তা—ই করেই জীবিকা অর্জন করতেন। কলকাতার ইংরেজ রাজপুরুষরা, ধনিক বাঙালি রাজা—মহারাজা বেনিয়ান বণিকরা তাঁদের ডেকে পোর্ট্রেট আঁকাতেন, অথবা তাঁদের স্টুডিওতে গিয়েও এইজন্য হাজরে দিতেন। এ ছাড়া, শিল্পীরা দক্ষিণা নিয়ে ছবি আঁকা শিক্ষাও দিতেন। সেইজন্য তাঁদের বাধ্য হয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে হত। যেমন, ১৭৮৫ সালের ২১ এপ্রিল জনৈক মিস্টার হোন ‘ক্যালকাটা গেজেট’—এ এই মর্মে একটি বিজ্ঞপ্তি দেন—

Mr. Hone presents his compliments to the Ladies and Gentlemen of this Settlement, and proposes to lay apart three days in the week for the purpose of teaching Drawing or Painting. Those Ladies or Gentlemen who wish to be taught that polite Art by Mr. Hone, may know his terms by sending a chit, or waiting on him at his house in the Rada Bazar.

রাধাবাজারের মিস্টার হোনের মতন আরও অনেক শিল্পী কলকাতা শহরে এসে, স্থানীয় ‘ভদ্রলোক ও মহিলাদের’ কলাবিদ্যা শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁদের অনেকের নাম সেকালের কলকাতার রাজকীয় জীবনযাত্রার হল্লার মধ্যে হারিয়ে গেছে। তখনকার কলকাতার সমাজের ইংরেজ ও বাঙালি প্রধানদের প্রত্যক্ষ পোষকতায় তাঁরা জীবনধারণ করেছেন। আজকের উন্নত দৃষ্টিতে দেখলে, তাঁদের কলাচর্চার মধ্যে কৃতিত্বের পরিচয় হয়তো বিশেষ পাওয়া যাবে না। তখনকার মানদণ্ড দিয়ে তাঁদের বিচার করতে হবে। তা করলে, রাধাবাজার বা জানবাজারবাসী এইসব ইয়োরোপীয় শিল্পীদের কাজকর্ম খুব নগণ্য বলে মনে হবে না। ড্যানিয়েল, জোফানি, ডয়েলি, বেইলি, হজেস, ইমহফ, বেলনস, সলভিনস প্রমুখ শিল্পীরা তাঁদের কলাকীর্তির নিদর্শন রেখে গিয়েছেন। তাঁদের আঁকা তদানীন্তন কলকাতা শহরের নানা বিষয়ের চিত্র বাংলাদেশের আচার—ব্যবহার, পোশাক—পরিচ্ছদ, উৎসব—পার্বণের ছবি, কেবল চিত্রকলার নমুনা হিসেবে নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান হিসেবেও মূল্যবান। এ দেশের শিল্পকলার নতুন অগ্রগতির ইতিহাসে তার কিছুটা প্রভাব আছে বলে আমরা মনে করি। প্রাচীন কলকাতার ও বাংলার সমাজ—সংস্কৃতির নানা দিকের চিত্রও এই শিল্পকাহিনির মধ্যে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

সুন্দরম্

শ্রাবণ ১৩৫৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *