০৭. প্রথম সফর

৭. প্রথম সফর

প্রথম বার ইংল্যাণ্ডে এসে ডন যা-কিছু দেখে তাতেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে; এবং ইংল্যাণ্ড উত্তেজিত হয় তার ব্যাটিংয়ে। ইংল্যাণ্ড বোলাররা যত বিপন্ন হয়েছে, ইংরেজরা ততই তাকে পছন্দ করেছে। ১৯৩০ মরশুমে সকলের মুখে মুখে ব্র্যাডম্যানের নাম। দলে দলে ইংরেজ দর্শকরা মাঠে ভিড় করেছে তাদের নিজেদের সেরা বোলারদের দুর্দশা দেখতে এবং সেতা দেখিয়েছেও। তার রানকে ঘিরে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস গড়ে উঠত, তার রানই দলকে সফল করে তোলে।

সফরের প্রথম খেলা উরস্টারে। ডন ২৯০ মিনিটে করল ২৩৬ রান। পরের ম্যাচ লিস্টারে, রইল ১৮৫ নট আউট। সফরের প্রথমদিকেই ডন ইংল্যাণ্ডের মাঠের উইকেটের চরিত্র বুঝে নেয়। ভারী আবহাওয়া বলকে সুইংয়ে সাহায্য করে, উইকেটে ঘাস বেশি তাই বোলাররা পিচ থেকে কিছুটা সাহায্য পায় বটে কিন্তু পিচে পড়ার পর বল আসে মন্থরগতিতে। যেহেতু ডন হ্রস্বাকৃতি এবং পিছিয়ে এসে খেলার অভ্যাসটাই বেশি, তাই মন্থর উইকেট তার পছন্দই হল। কিন্তু অসুবিধায় পড়ল কনকনে ঠাণ্ডায়। সোয়েটার, ব্লেজার, ওভারকোট পরে আগুনের ধারে বসে অপেক্ষার পর মাঠে নেমে ব্যাট চালানোর মতো অস্বস্তিকর ব্যাপার আর কী হতে পারে!

কিন্তু ডন মনে আঘাত পেল খবরের কাগজে একটা লেখা পড়ে। তাতে লেখা হয়েছে, সারের অধিনায়ক পার্সি ফেণ্ডার ডন সম্পর্কে বলেছেন, ‘ও সবসময়ই চমকপ্রদ এবং অনির্ভর পর্যায়ভুক্ত থাকবে।’ ফেণ্ডার বলেন, ডনকে দেখে ওর ওপর আমার ভরসা জাগেনি। সেনিজের ত্রুটি শোধরায় না বা মনে হয় না সেজন্য কোনো চেষ্টা তার আছে। এরপর ডন স্থির করে সারের সঙ্গে খেলায় এসব কথার জবাব দেবে।

বৃষ্টির জন্য মাত্র এক দিনই খেলা হয়। নরম পিচে অস্ট্রেলিয়া ব্যাট করে পাঁচ উইকেটে ৩৭৯ রান তুলেছিল। তার মধ্যে ডনের রান ২৫২ নট আউট। নিখুঁত নির্ভুল চমকপ্রদভাবে সংগৃহীত। দ্বিতীয় শতরানটি মাত্র ৮০ মিনিটে তোলা।

হ্যাম্পশায়ারের সঙ্গে খেলা শুরু হল মে মাসের শেষ দিনে। ডনের তখন ইংল্যাণ্ড সফরে হাজার রান পূর্ণ হতে আর মাত্র ৪৬ রান বাকি। মে মাসের মধ্যে হাজার রান ৪ জন ইংরেজ— গ্রেস, হেওয়ার্ড, হ্যামণ্ড ও হ্যালোজ— করতে পেরেছে। কোনো অস্ট্রেলিয়ান পারেনি। সুতরাং ডন বদ্ধপরিকর, করতেই হবে। কিন্তু টস হতেই মাথায় হাত। হ্যাম্পশায়ার টসে উডফুলকে হারিয়ে ব্যাট করবে ঠিক করেছে। মে মাসের শেষ দিন, সুতরাং ডনের ভাগ্যে এই মাসে ব্যাট করার আর সুযোগ হবে না।

কিন্তু ক্ল্যারি গ্রিমেট তা সম্ভব করল! হ্যাম্পশায়ার ইনিংস সেই দিনই শেষ হল এবং ডনকে তাড়াতাড়ি ইনিংস ওপেন করতে পাঠানো হয়। ডন যখন ৪৭ রান করেছে তখন বৃষ্টি নেমে খেলা বন্ধ হয়। ডনের তখন ১,০০১ রান।

ডনের রান সংগ্রহের বহর নিরন্তর বেড়েই চলল। নটিংহামে প্রথম টেস্ট ম্যাচে সেকরল ৮ ও ১৩১, লর্ডস টেস্টে ২৫৪ ও ১। নিষ্ঠুরভাবে সেবোলারদের পিটিয়ে যেখানে বল পাঠাতে চেয়েছে সেখানে পাঠিয়েছে। ১৬০ মিনিটে ১৫৫ রান তোলে। বলা হয়েছিল ডনের ব্যাটে আগুন ধরে যাবে। পরদিন ২৫৪ রানের মাথায় পার্সি চ্যাপম্যান অলৌকিকভাবে ক্যাচ ধরে তাকে আউট করে। ডনের মতে ব্যাটিং কৌশলের দিক থেকে এটি তার জীবনের সেরা ইনিংস। এই টেস্টে দলীপ সিংহজি ১৭৩ করেছিল।

প্রথম টেস্টে ৯৩ রানে হারের পর অস্ট্রেলিয়া লর্ডসে জেতে ৭ উইকেটে। চার দিনের এই খেলায় অস্ট্রেলিয়া ৬ উইকেটে ৭২৯ রানে ইনিংস ঘোষণা করে। লর্ডসে এত রান উঠবে কতৃপক্ষ আশা করেননি। স্কোর বোর্ডে মোট রানের ঘরে সাত সংখ্যাটি তাদের ছিল না।

লিডসে তৃতীয় টেস্ট ম্যাচে ডন ৩৩৪ রান করে টেস্ট ক্রিকেটে বিশ্বরেকর্ড করে। জ্যাকসন ওপেন করতে নেমে এক রানে আউট হয়ে ফিরে আসতে ডন খেলতে নামে। লাঞ্চের আগে ৯৯ মিনিটে সম্পূর্ণ করল শতরান। বোলার ছিল লারউড ও টেট। প্রথম দিন লাঞ্চের আগে টেস্ট ম্যাচে শতরান তার আগে করেছে দুই অস্ট্রেলিয়ান, ভিক্টর ট্রাম্পার (ম্যানচেস্টার, ১৯০২) ও চার্লি ম্যাকার্টনি (লিডস, ১৯২৬)।

তবে ইনিংসটি নিখুঁত নয়, টেটের প্রথম বলে ডন পরাস্ত হয়। স্টাম্প ঘেঁষে বল চলে যায়। ১৪১ ও ২০২ রানে মিড অনের মাথার উপর ক্যাচ তুলেছিল। লাঞ্চের আগে ডন ১০৫, চা-পানের সময় ২২০ এবং দিনশেষে ৩৪০ মিনিট ব্যাট করে ৩০৯ রানে অপরাজিত থাকে, দলের ৪৫৬ রানের মধ্যে। যখন ক্রিজ থেকে ফিরছে তখন তাকে ঝরঝরে তাজা দেখাচ্ছিল যেন এইমাত্র স্নান সেরে এল। সারাদিন সে৪০ বার বাউণ্ডারিতে বল পাঠিয়েছে একথা তাকে দেখে বিশ্বাস করা যাচ্ছিল না। এই সময় সেএকটি উক্তি করে যা ক্রিকেট ইতিহাসে বরাবর থেকে যাবে। ক্লান্ত এক ইংল্যাণ্ড ফিল্ডারকে ডন খুব খুশিয়াল মেজাজে বলে, ‘কালকের খেলার জন্য খুব ভালোই প্র্যাকটিস হল।’

তবে পরদিন ডন বেশিক্ষণ ক্রিজে থাকেনি আর ছটি ৪ মেরে (মোট ৪৬টি) ৩৩৪ রানে ডন উইকেটকিপার ডাকওয়ার্থের হাতে আউট হয় টেটের বলে। ডন ৩৩৪ রান করে ৩৭৫ মিনিটে (এখন কল্পনা করা যায় না)। ১৯৩৮-এ হাটন ৩৬৪ করে ৮০০ মিনিটে (৩৫টি চার)। ১৯৫৭-৫৮-তে সোবার্সের অপরাজিত ৩৬৫ রান ৬০৮ মিনিটে (৩৮টি চার) সংগৃহীত। ১৯৯৩-৯৪-এ ব্রায়ান লারার ৩৭৫ রান ওঠে ৭৬৬ মিনিটে (৪৫টি চার)। মার্ক টেলরের অপরাজিত ৩৩৪ হয় ৭২০ মিনিটে (৩৫টি চার)। ১৯৯৬-৯৭-এ জয়সূর্যের ৩৪০ রান আসে ৭৯৯ মিনিটে (২ ছয়, ৩৫ চার)।টেস্ট ম্যাচে একদিনে ত্রিশতাধিক রান আজ পর্যন্ত ডন ছাড়া আর কেউ সংগ্রহ করতে পারেনি। এই রানে একটিও ছয় নেই।

ম্যানচেস্টারে চতুর্থ টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসে ডন ১৪ রান করে। বৃষ্টির জন্য খেলার মীমাংসা হয়নি। ওভালে ডনের প্রথম টেস্ট খেলাটি জ্যাক হবসের শেষ খেলা। হবসকে মাঠের মধ্যে সকলের সঙ্গে ডনও সংবর্ধনা জানায় এবং দুঃখবোধ করে হবস যখন মাত্র ৯ রান করে আউট হন। ১৮ বছর পর এই মাঠে একই দৃশ্য দেখা যায়। ডনকে তার শেষ টেস্ট খেলায় মাঠের মধ্যে সংবর্ধিত করে ইংল্যাণ্ড দল। হবসের থেকে ডন ৯টি রান কম করেছিল।

ওভালে ১৯৩০-এর টেস্টে ডন ২৩২ রান করে সিরিজে ৭ ইনিংসে ৯৭৪ রান তুলে ১৩৯.১৪ রানের গড় রাখে। এক সিরিজে এত রান আজও কেউ করতে পারেনি। পাঁচ টেস্টে চারটি শতরান, তার মধ্যে তিনটি দ্বিশতাধিক। সফরে করে ২,৯৬০ রান, গড় ৯৮.৬৬। অস্ট্রেলিয়া দলের এই সফরকে ‘ব্র্যাডম্যানের সফর’ নামে অভিহিত করা হয়েছিল, এটা কোনো আশ্চর্যের কথা নয়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *